গণআন্দোলনের স্বার্থে ছাত্রসমাজ বাংলাদেশের পাশে দাঁড়ান
ছাত্র ফেডারেশনের ৫ম রাজ্য সম্মেলনের আহ্বান
আগরতলা, ১৯ মে গত ১৭ থেকে ১৯ মে রাজ্য ছাত্র ফেডারেশনের ৫ম সম্মেলনে আগরতলার কমিউনিটি হলে অনুষ্ঠিত হয়। আজ চিলড্রেন্স পার্কে অনুষ্ঠিত সম্মেলনের প্রকাশ্য অধিবেশনে প্রধান বক্তার ভাষণে মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির রাজ্য কমিটির সম্পাদক কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী বলেন, ছাত্ররা সব সময়ই থাকেন গণআন্দোলনের পুরােভাগে। আজ পূর্ব বাংলায় জনসাধারণ তাদের গণতান্ত্রিক অধিকার রক্ষার জন্য যে আন্দোলন করছেন এবং ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট সামরিক চক্র যেভাবে জনগণের ভােটের বাক্সে দেওয়া রায়কে পদদলিত করে সশস্ত্র আক্রমণ হেনে লক্ষ লক্ষ ছাত্র-যুব, শ্রমিক-কৃষক ও মধ্যবিত্তকে হত্যা করে গণতন্ত্রের টুটি টিপে ধরেছে ঠিক তেমনিভাবে ভারতবর্ষের পুঁজিপতি জমিদারদের রক্ষক ইন্দিরা সরকার ভারতের গণতান্ত্রিক শক্তির উপর আঘাত হানছে। তাই আজ ছাত্র সমাজের সবচেয়ে বড় দায়িত্ব ত্রিপুরার তথা ভারতবর্ষের গণআন্দোলনের স্বার্থে পূর্ব বাংলার গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রামকে সর্বপ্রকার সাহায্য করে জয়যুক্ত করতে হবে। নচেৎ ভারতবর্ষের গণতান্ত্রিক শক্তির উপর অনুরূপ আঘাত আসবে।
তেমনি পশ্চিম বাংলায় ও সমস্ত সম্পদ দিল্লীর ভাণ্ডারে জমা হয় আর তার এক দশমাংশ পায় পশ্চিম বাংলার জনগণ। কিন্তু বীর বাংলার শ্রমিক-কৃষক তাদের ন্যায্য পাওনা আদায়ের জন্য গত এক বছর থেকে কেন্দ্রের বিরুদ্ধে আন্দোলন গড়ে তুলেছেন, সেই আন্দোলনের ঢেউ পশ্চিম বাংলার পাশাপাশি রাজ্যগুলাের জনগণের মধ্যে প্রতিফলিত হবে তাই ইন্দিরা সরকার এত অত্যাচার চালাচ্ছেন পশ্চিম বাংলার জনগণের উপর।
তিনি বলেন, আজকে শুধু সশস্ত্র আক্রমণ হেনে জনগণকে দমানাে যাচ্ছে না। তাই গণআন্দোলনে ফাটল ধরাবার জন্য শাসকগােষ্ঠী বেছে নিয়েছে বামপন্থী নামাবলী গায়ে দেওয়া কিছু দলকে যার পুরােভাগে রয়েছে দক্ষিণপন্থী সংশােধনবাদীরা। আবার অপরদিকে বিপ্লবের নাম করে নকশালপন্থী সমাজ বিরােধীদের ব্যবহার করা হচ্ছে গণআন্দোলনের কর্মীদের হত্যার কাজে এবং গত একবছরে প্রায় এক হাজার কর্মীকে প্রাণ দিতে হয়েছে। এই তিন প্রকার আক্রমণের বিরুদ্ধে পশ্চিম বাংলার গণতান্ত্রিক শক্তিকে লড়াই করে এগিয়ে যেতে হচ্ছে।
সর্বশেষে তিনি বলেন, যে পূর্ব ভারতে একদিন স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল আসুন সেই পূর্ব ভারত থেকেই আবার আমরা গণতান্ত্রিক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করে কেন্দ্রের ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াই।
নৃপেন চক্রবর্তী
কমরেড নৃপেন চক্রবর্তী বলেন, বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের আজ এক অসহায় অবস্থার মধ্যে কালাতিপাত করতে হচ্ছে। জিনিসপত্রের দাম দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। ইতিমধ্যেই দারুণ খাদ্য সঙ্কট দেখা দিয়েছে অথচ ইন্দিরা সরকার কালােবাজারীদের শাস্তি দেবার কথা বলেও কিছু করছে না।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার ফ্যাসিস্ট সামরিক অত্যাচারের ফলে শরণার্থীরা এখানে এসেছেন আর ইন্দিরা তাদের আবার রক্তাক্ত ইয়াহিয়ার হাতে তুলে দিতে চাইছেন।
তিনি ছাত্রদের সংগঠিত শক্তি নিয়ে কেন্দ্রের কংগ্রেস সরকারের এই অপকৌশলের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াতে আহ্বান জানান।
প্রতিনিধি সম্মেলনে গৃহীত রিপাের্ট ও প্রস্তাবাবলী ব্যাখ্যা করে ভাষণ দেন সাধারণ সম্পাদক কমরেড মানিক সরকার। সভায় গণসঙ্গীত পরিবেশন করেন ত্রিপুরা সাংস্কৃতিক পরিষদ, সভাপতিত্ব করেন নবনির্বাচিত সভাপতি কমরেড বিজন ধর।
প্রতিনিধি সম্মেলন
১৭ মে বিকেলে পতাকা উত্তোলন করে সভার উদ্বোধন করেন বিদায়ী সভাপতি কমরেড বাদল চৌধুরী। শােক প্রস্তাব পাঠ করেন মানিক সরকার।
সম্মেলন পরিচালনা করার জন্য বাদল চৌধুরী, বিজন ধর ও রসরঞ্জন বণিককে নিয়ে একটি সভাপতিমণ্ডলী ও মানিক সরকার, মাধব সাহা, সমীরণ রায় ও দীপঙ্করদেকে নিয়ে একটি স্ট্যান্ডিং কমিটি গঠিত হয়। প্রতিনিধি সম্মেলনের উদ্বোধন করেন কমরেড বীরেন দত্ত। এমপি বলেন, ত্রিপুরায় ছাত্রসমাজ প্রতিক্রিয়ার বিরুদ্ধে তীব্র লড়াই চালিয়ে ছাত্রসমাজকে প্রগতির পথে টেনে এনেছেন। আজকে এই সম্মেলন থেকেও ছাত্রনেতৃত্ব আগামী দিনে সংগঠনকে দৃঢ় করে কঠিন সংগ্রামের মাধ্যমে ত্রিপুরার বিপ্লবী জনগণের পাশে দৃঢ়ভাবে দাঁড়াবেন।
কার্য নির্বাচক কমিটির রিপোের্ট রাখেন কমরেড মানিক সরকার এবং এরপর বিভাগীয় কমিটিগুলাের রিপাের্ট পেশ করা হয়। ২৪ জন প্রতিনিধি রিপাের্টের উপর আলােচনা করেন এবং সর্বসম্মতিক্রমে এই রিপাের্ট গৃহীত হয়।
প্রস্তাব গ্রহণ
সম্মেলন থেকে দেশে দেশে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের সমর্থনে ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে, পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামের সমর্থনে, পশ্চিম বাংলার গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে ও ফ্যাসিস্ট অত্যাচারের বিরুদ্ধে। পি. ডি. এ্যাক্ট, ওয়েস্টবেঙ্গল সিকিউরিটি এ্যাক্টের বিরুদ্ধে উৎপাদনমুখী শিক্ষা ব্যবস্থা চালুর করার দাবিতে, দ্রব্যমূল্য প্রতিরােধে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সমর্থনে এবং অধ্যয়ন ও শ্রমের জন্য লাল ব্যাজ দান ইত্যাদি প্রস্তাব গ্রহণ করা হয় এবং ২৪ দফা দাবিসম্বলিত একটি দাবি সনদ গৃহীত হয়।
নাম
এখন থেকে এই সংগঠনের নাম হবে ভারতের ছাত্র ফেডারেশনের ত্রিপুরা রাজ্য কমিটি।
কর্মকর্তা নির্বাচন
সম্মেলন থেকে নিম্নলিখিতদের নিয়ে সম্পাদকমণ্ডলী গঠন করা হয়- সভাপতি বিজন ধর, সহ-সভাপতি গজেন্দ্র দেবনাথ, বিমল সিংহ, সাধারণ সম্পাদক মানিক সরকার, সহ-সম্পাদক সমীর চক্রবর্তী, মাধব সাহা, অফিস-সম্পাদক মনােরঞ্জন পাল, সম্পাদকমণ্ডলীর অন্যান্য সদস্য বাদল চৌধুরী, ধীরাজ গুহ ও জগদীশ দেববর্মাসহ পঁচিশ জনের একটি কার্যকরী কমিটি নির্বাচিত হয়।
সম্মেলনে অভিনন্দন জানিয়ে ভাষণ দেন অজয় বিশ্বাস, ইলা ভট্টাচার্য্য, কল্যাণ পাল, শংকর দাস, নৃপেন চক্রবর্তী, অমলেন্দু সেনগুপ্ত ও অভ্যর্থনা সমিতির পক্ষে অশােক চক্রবর্তী। সম্মেলনে বিভিন্ন মহকুমা থেকে ১৩৭ জন প্রতিনিধি, ৪২ জন দর্শক ও ১৪ জন প্রাক্তন কর্মকর্তা উপস্থিত ছিলেন।
সূত্র: দেশের ডাক
২১ মে, ১৯৭১
০৬ জ্যৈষ্ঠ, ১৩৭৮