বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে নতুন বাধা
(নিজস্ব প্রতিনিধি)
নয়াদিল্লী, ২৫ জুলাই- পূর্ব বাংলার স্বাধীনতা অর্জনের সংগ্রামকে আরাে ব্যাপক গণভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করবার লক্ষ্য নিয়ে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জুনটার (চক্র) শাসনের বিরুদ্ধে সংগ্রামরত বিভিন্ন দল ও সংগঠনকে নিয়ে বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে। বিভিন্ন সংবাদপত্রে তাদের ঘােষণাপত্রও প্রকাশিত হয়েছে। এই মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি- কুমিল্লা, শ্রীহট্ট, ময়মনসিংহ, চট্টগ্রাম, ঢাকা, কুষ্টিয়া, রংপুর, রাজশাহী, যশােহর, খুলনা প্রভৃতি জেলায় ইতিমধ্যে সংগ্রামরত জনগণের ব্যাপক ঐক্য গঠনের প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে সংগ্রাম চালাচ্ছেন।’
সমন্বয় কমিটি গঠনের পর পাকিস্তানের সামরিক চক্র এবং কায়েমী স্বার্থান্বেষী মহল বিশেষ করে আতঙ্কিত হয়েছে। তাই পাক সামরিক শাসকেরা নতুন গড়ে ওঠা গণভিত্তি ভেঙে দেবার জন্য যেমন তৎপর হয়েছে, তেমনি সমম্বয় কমিটির নেতা ও কর্মীদের খুঁজে বের করার জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গেছে, বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটির কয়েকজন নেতা ও কর্মীকে পাক জঙ্গি শাসকের নির্দেশে ‘পঞ্চমবাহিনী’ বা ‘দেশদ্রোহী’ আখ্যা দিয়ে হত্যা করেছে বা গ্রেফতার করে আটক করেছে।
‘বাংলাদেশ জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম সমন্বয় কমিটি গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি (মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে পরিচালিত) কমিউনিস্ট বিপ্লবীদের পূর্ব বাংলা সমন্বয় কমটি, পূর্ব বাংলার কমিউনিস্ট পার্টি (দেবেন শিকদারের নেতৃত্বে শ্রমিক-কৃষক, কর্মী সংঘ, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (হাতিয়ার), পূর্ব বাংলা কৃষক সমিতি, পূর্ব বাংলা শ্রমিক ফেডারেশন, (পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশন) এবং পূর্ব বাংলা বিপ্লবী ছাত্র ইউনিয়ন প্রভৃতি রাজনৈতিক দল ও সংগঠনকে নিয়ে। এই সমন্বয় কমিটির পক্ষ থেকে এক ঘােষণায় ‘আশু করণীয়’ পনেরাে দফার এক কর্মসূচি ঘােষণা করা হয়েছে। প্রধানত গ্রামের কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের ভিত্তিতে গেরিলাবাহিনী গঠনের উপর এতে জোর দেয়া হয়েছে। আওয়ামী লীগসহ সমস্ত শক্তিকে একটি সংগ্রামী ফ্রন্টে ঐক্যবদ্ধ করার আহ্বানও এতে দেয়া হয়েছে।
সমন্বয় কমিটির আহ্বান বাংলাদেশের জেলায় জেলায় ছড়িয়ে পড়ছে। এদের ঘােষণাপত্র সংগ্রামী জনগণের মধ্যে নতুন আশা ও উৎসাহ সৃষ্টি করছে, সংবাদ পাওয়া যাচ্ছে যে, বিভিন্ন জেলায় গ্রামে গ্রামে বিভিন্ন মতাবলম্বী কর্মীরা ঐক্যবদ্ধ হচ্ছেন, তাদের প্রচেষ্টায় কৃষকদের মধ্য হতে নতুন সংগ্রামী বাহিনী গড়ে উঠছে। ফলে স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যাপকতা ও গভীরতা লাভ করছে। এদের কর্ম তৎপরতার ফলে বেশ কিছু গ্রামে পাক বাহিনী আগের মতাে আর সহজে ঢুকতে পারছে না। এমনি এলাকা দিন দিন বাড়ছে। ফলে পাক শাসকেরা বিচলিত হয়ে উঠছে এবং সমন্বয় কমিটির নেতা ও কর্মীদের গ্রেপ্তার ও হত্যা করার প্রচেষ্টাকে তীব্রতর করছে।
আশ্চর্যের কথা এই যে, সমন্বয় কমিটির এ মহৎ প্রচেষ্টাকে স্বাগত করার বদলে বাংলাদেশ সরকারের আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একাংশ এতে বিচলিত বােধ করছেন। মুক্তি সংগ্রামে আগ্রহী সমস্ত শক্তিকে ঐক্যবদ্ধ করা এবং শ্রমিক-কৃষক সংগঠিত জনগণের উপর সংগ্রামের ভিত গড়ে তােলার উপরই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের ভবিষ্যত বহুলাংশে নির্ভর করছে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্বের একাংশ এতে বামপন্থীদের শক্তি বৃদ্ধির সম্ভাবনা দেখে এই প্রচেষ্টার বিরােধিতা করছেন। এই সরকারের মন্ত্রী জনাব কামরুজ্জামান সমন্বয় কমিটির প্রচেষ্টাকে বিভেদ পন্থী বলে আখ্যা দিয়ে বিবৃতি দিয়েছেন। আরাে আশ্চর্যের কথা এই যে, সােভিয়েট কমিউনিস্ট পার্টির অনুগামী পূর্ব পাকিস্তান কমিউনিস্ট পার্টির নেতারা সমন্বয় কমিটির প্রচেষ্টার সঙ্গে সহযােগিতা করার বদলে বিভিন্ন বিবৃতিতে সমন্বয় কমিটিকে একই সুরে বিভেদপন্থী বলে প্রচার করছেন এবং সমস্ত শক্তির ঐক্যের পরিবর্তে শুধু আওয়ামী লীগের সঙ্গে তাদের ঐক্যকেই একমাত্র উপায় বলে মনে করছেন। বিশ্বস্ত সূত্রে জানা গেছে যে, ভারত সরকার এই সমন্বয় কমিটির আর্বিভাবকে ভয়ের চোখে দেখছেন এবং এদের নেতা ও কর্মীরা কেউ ভারতে এলে তাদের ‘পঞ্চমবাহিনী’ বা ‘পাক গুপ্তচর’ আখ্যা দিয়ে গ্রেপ্তার করার কথা ভাবছেন। ইতিমধ্যে বিভিন্ন সূত্রের খবরে প্রকাশ, পাক গুপ্তচর আখ্যা দিয়ে এই সমন্বয় কমিটির কয়েকজনকে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গ্রেপ্তারও করা হয়েছে। বাংলাদেশের অভ্যন্তরে পাকবাহিনীর গুলি ও বাইরে গ্রেপ্তার হবার আশঙ্কা মাথায় নিয়েই সমন্বয় কমিটির নেতা ও কর্মীরা কাজ করে যাচ্ছেন।
সূত্র: দেশের ডাক
২৫ জুলাই, ১৯৭১