You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিদেশীর চোখে আজকের ঢাকা অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন বুকে নিয়ে এক নিষ্প্রাণ নগরী আমার চোখের সামনে এক নিষ্প্রাণ নগরী, তার সারা দেহে গভীর ক্ষতচিহ্ন, রক্তের দাগ। নিতান্তই খুড়িয়ে। খুড়িয়ে সে স্বাভাবিক জীবনের দিকে ফিরে যাবার চেষ্টা করছে।

ঢাকা থেকে শুক্রবার কথাই লিখে পাঠিয়েছেন অ্যাসােসিয়েটেড প্রেসএর সংবাদদাতা শ্রীরােজেন ক্রম। ২৬ মার্চ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আরম্ভ হবার পর এই প্রথম একদল বিদেশী সাংবাদিককে ঢাকা শহর দেখার সুযােগ দেওয়া হল।

সরকারী আতিথ্যে সরকারী উদ্যোগে বিদেশী সাংবাদিকরা ঢাকা শহর দেখানাে হয়। সামরিক প্রশাসক টিক্কা খান তাঁদের এক ভােজসভায় আপ্যায়িত করেন।

এদের মধ্যে ছিলেন সংবাদসংস্থা রয়টার পি প্রতিনিধি, লন্ডনফিনানসিয়াল টাইমস‘, ‘নিউইয়র্ক টাইমস ম্যাগাজিনএবংনিউ চায়না নিউজ এজেন্সীর প্রতিনিধিরা, সংখ্যায় মােট ছয়জন ।।

পাকিস্তানবিরােধী প্রচার কার্যে বিভ্রান্ত না হয়ে ঘটনাস্থলে এসে সরেজমিনে তদন্ত করতে সাংবাদিকদের অনুরােধ জানানাে হয়েছিল।

প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়েছিল, আপনাদের পাঠানাে কোন সংবাদের ওপরই সেনসরের ধরা পড়বে না, যা দেখবেন, তাই রিপাের্ট করবেন।

ঢাকা থেকে রয়টারের প্রতিনিধি রিপাের্ট করেছেন। বাংলাদেশের বিদ্রোহ বা বিপ্লব উচ্ছেদ করার জন্য পাক সেনাবাহিনী ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঠিক ছয় সপ্তাহ আগে। কিন্তু, আজও ঢাকার বিমানবন্দরে সৈন্যরা বিমান

 বিধ্বংসী কামান আকাশের দিকে তাক করে পরিখায় অবস্থান করছে। করাচি থেকে জেট বিমানে করে ঢাকা বিমানবন্দরে নামবার কালে সৈন্যদের সদ্যসতর্ক প্রহরা চোখে পড়ল। নিকটেই একটি রেডারঘটিও দেখলাম।

 বিমানবন্দরের আশেপাশে জনশূন্য কতকগুলি ভাঙা বাড়ি। বিমানে বসেই আমাদের পথপ্রদর্শক পাকিস্তানী সরকারি কর্মচারীকে জিজ্ঞাসা করলাম, লােকগুলি গেল কোথায়?

জবাব : সেনাবাহিনী আইনশৃঙ্খলা পুন: প্রতিষ্ঠাকল্পে রাস্তার নেমে আসার আগে সাম্প্রদায়িক

দাঙ্গাহাঙ্গামায় ওরা নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছে।

রােজেন রুম তার বার্তায় বলেছেন : যে দিকেই তাকাচ্ছি, দেখতে পাচ্ছি, অর্থনৈতিক বিপর্যয় সারা শহরটিকে দীর্ঘকালের জন্য পঙ্গু করে দিয়েছে। | সামরিক প্রশাসক লেঃ জেনারেল টিক্কা খানকে সে কথা বলতেই তিনি স্বীকার করলেন, সব দিকে অবস্থা অনুকূল থাকলেও অর্থনৈতিক পুনর্গঠনে অন্তত এক বছর লেগে যাবে।

রােজেন রুম আরও জানাচ্ছেন : ঢাকায় সেনাবাহিনীর পূর্ণ কর্তৃত্ব রয়েছে কিন্তু কয়েকটি ছাড়া অধিকাংশ | দোকানপাট ঘরবাড়ি আজও বন্ধ রয়েছে। কিন্তু সেগুলির ওপরে পাকিস্তানী পতাকা উড়ছে, একটি দুটি নয়, হাজার হাজার পাকিস্তানী পতাকা। কিন্তু পরিষ্কার বােঝা যাচ্ছে, কোনাে উৎসুক মন আগ্রহবশে সেগুলি তুলি দেয়নি, সংকোচের সঙ্গে অনিচ্ছা সত্ত্বেও সেগুলি ওড়ানাে হয়েছে। | ঢাকার গণহত্যা সম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে টিক্কা খান বললেন : কথা আপনাদের জানাতে আমার বুক ফেটে যাচ্ছে। কিন্তু, সত্যই এক ব্যাপক হত্যালীলা ঘটে গিয়েছেএই হত্যায় বলি হয়েছেন যারা পাকিস্তানের সমর্থক, যাঁরা সরকারের সমর্থকসােজা কথায়, বাঙালীরা অবাঙালীদের হত্যা করে নৃশংস উল্লাসে মেতে

উঠেছিল।

টিক্কা খান বলেন : বহু ছাত্র নিহত হয়েছেন। কিন্তু, ব্যাপারটি বুঝে নিন ছাত্রদের হাতের অস্ত্র ফেলে দেবার জন্য অনুরােধউপরােধ জানানাে হলে ছাত্ররা তাতে কর্ণপাত করল না। পালটা গুলি চালালাে সৈন্যদের ওপর। নিতান্ত বিপন্ন হয়েই সৈন্যরা ছাত্রদের ওপর আঘাত হানতে বাধ্য হলাে। প্রথম রাত্রেই একমাত্র ঢাকা শহরে প্রায় দেড় শত বিদ্রোহী বাঙালী নিহত হলাে। | নির্দোষ নরনারীকে হত্যা করা হচ্ছে শুনেই সৈন্যরা রাস্তায় বেরিয়ে পড়েছিল, কিন্তু বিশ্বাস করুন, তার আগে পূর্ব পাকিস্তানের কারও গায়ে একটুও আঁচড় লাগতে দেওয়া হয়নি।

একটি ঘটনার কথা শুনুন। পাঁচ শত অবাঙালিকে একটি ঘরের মধ্যে পুরে তাতে আগুন লাগিয়ে দেওয়া হয়। একজনও রক্ষা পাননি। | রােজেন রুম বলছেন : ঢাকার দশ লক্ষ অধিবাসীরযাদের সর্বদাই রাস্তায় ভিড় করে থাকতে আমি আগে দেখেছিএকটি অতিনগণ্য অংশই আজ শহরে রয়েছে। ঢাকা রেস কোরসের সবুজ ঘাসের আস্তরণের মধ্যে রমনা কালীবাড়ি ঘিরে যে হিন্দু পাড়াটি ছিল, আজ সেখানে কতগুলি দগ্ধ বিধ্বস্ত ঘরবাড়ি ছাড়া কিছুই অবশিষ্ট নেই। সেই শ্মশানভূমির আকাশে কতগুলি কাক, নিচে পােড়াবাড়ির গাঘেঁষে কয়েকটি শিশু দাঁড়িয়ে আছে, মনে হলাে, তারা নতুন ভিখারী।

ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের রানওয়ের পাশেই সৈন্যদের বিবরঘাটি দেখতে পেলাম। আজ বাহিরের পৃথিবীর সঙ্গে যােগাযােগের প্রধান কেন্দ্র এই বিমানবন্দর। বিদ্রোহীরা চট্টগ্রাম বন্দরের সঙ্গে ঢাকার রেল সড়ক যােগাযােগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে।

রােজেন রুম বলছেন : আমরা দুজন সাংবাদিক সরকারী ব্যবস্থার সুযােগ না নিয়ে নিজেরাই একখানা ট্যাকসি ডেকে বেরিয়ে পড়লাম শহরের পুরােনাে মহল্লা, বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্য যে সকল স্থানে লড়াই চলেছিল, সে দিকেই। নবাবপুর রােড ধরে ট্যাকসি ছুটে চলছে, পথের দুপাশে দগ্ধ, অর্ধদগ্ধ বিধ্বস্ত গৃহের দীর্ঘ সারি।

একজন বাঙালিকে নিয়ে প্রশ্ন করতেই তিনি বললেন : গভরমেন্ট যে কী করেছে, তাই দেখে যান। কিন্তু এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে আপনার দেশের গভরমেন্ট এমন নীরব কেন? এখনও বুড়িগঙ্গায় মৃতদেহ ভাসছে।

বুড়িগঙ্গার সে জায়গাটিতে আমাদের দুজনকে নিয়ে যাবার অনুরােধ তিনি মানলেন না।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ভবনটি বহুলাংশেই অক্ষত রয়েছে। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয়ের দুটি ছাত্রাবাসের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণের স্বাক্ষর আজও রয়েছে।

জগন্নাথ হলের প্রাচীরে এখনও কামানের গােলায় চিহ্ন রয়েছে। ভস্মীভূত কক্ষগুলি উন্মুক্ত আকাশের

দিকে হা করে আছে।

ইকবাল হল’-এর সব কয়টি ক্ষতচিহ্ন মুছে ফেলার চেষ্টা হয়েছে, কিন্তু মােছা যায়নি। তার সারা দেহ জুড়ে কেবলই বুলেট কামানের গােলার দাগ।

যেদিকেই তাকাই, পাকিস্তানী পতাকা উড়ছে। ব্যাপারটি প্রথমে বুঝতে পারিনি। একজন বাঙালিকে জিজ্ঞাসা করতেই তিনি বললেন : পাকিস্তানী হানাদারদের হাত থেকে জানমানধনসম্পদ বাঁচাবার ওই একটি মাত্র পথই রয়েছে এবং সেটি হল, পাকিস্তানী পতাকা উড়িয়ে দেওয়া।

জেনারেল টিক্কা খান বললেন : সারা পূর্ব পাকিস্তান আজ সেনাবাহিনীর নিয়ন্ত্রণে রয়েছে, যদিও ভারতীয়দের অনুপ্রবেশের আশঙ্কা সর্বদাই থেকে যাচ্ছে।

দীর্ঘস্থায়ী গেরিলা লড়াইয়ের সম্ভাবনাও রয়েছে, যদিও সেটা ঠিক মুহূর্তেই আরম্ভ হবে বলে মনে হয়

না।

টিক্কা খান আরও বলেন : যােগাযােগ পরিবহণব্যবস্থা নিদারুণভাবে বিপর্যস্ত হয়েছে। কোন কোন সেতু এমনভাবে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়া হয়েছে যে, সেগুলি মেরামত করতে এক মাস পর্যন্ত সময় লেগে যাবে।

টিক্কা খান আরও বলেন : লড়াইয়ের প্রথম পর্যায়ে লক্ষ ৬০ হাজার থেকে লক্ষ ৭০ হাজার পর্যন্ত বাঙালী পাক সরকারের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করেছিল কিন্তু আজ পর্যন্ত প্রায় এক লক্ষ বাঙালী তাদের অস্ত্রশস্ত্রসহ সেনাবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে।

টিক্কা খান আরও বলেন : ঢাকার শত বাঙালীকে একটি বাড়িতে পুরে আগুনে পুড়িয়ে মারছিল, কিন্তু বদলা নেওয়া হতে পারে আশঙ্কায় সে সংবাদ পশ্চিম পাকিস্তানীদের কানে পৌঁছানাে হয়নি কামান দাগিয়েছিলাম বলেই না বিদ্রোহীদের আস্তানা থেকে বের করে আনা সম্ভবপর হল | ঢাকার প্রত্যহ রাত্রি সাড়ে দশটা থেকে ভাের ৩০ মি: পর্যন্ত কারফিউ রয়েছে। টিক্কা খান এইসুসংবাদ ঘােষণা করেন যে, পয়গম্বরের জন্মদিন উপলক্ষে দুদিনের জন্য কারফিউ বেমালুম তুলে নেওয়া হচ্ছে। উপলক্ষে জনসভা শােভাযাত্রার অনুমতিও দেওয়া হচ্ছে।

রয়টার, পি। ১০ মে৭১

সূত্রঃ আনন্দবাজার পত্রিকা

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!