You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.29 | শরণার্থীরা লড়াই করেই দেশে ফিরে যাবেন | কালান্তর - সংগ্রামের নোটবুক

শরণার্থীরা লড়াই করেই দেশে ফিরে যাবেন (২)
(সফর প্রত্যাগত স্টাফ রিপাের্টার)

বাঙলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের সমস্যা গােটা পশ্চিমবঙ্গের সব চাইতে বড় সমস্যা এবং অনস্বীকার্য, এই সমস্যা তীব্রতর পশ্চিম দিনাজপুরে। এই জেলার স্থানীয় জনসংখ্যা যেখানে প্রায় ১৬ লক্ষ, সেখানে আগত শরণার্থীর সংখ্যা সরকারি হিসাবে ১৪ লক্ষ, বে-সরকারী হিসাব অনুযায়ী প্রায় ১৮ লক্ষ। অর্থাৎ স্থানীয় জনসংখ্যার চাইতেও বেশি।
সুতরাং জেলার সর্বত্র-গঞ্জে, বন্দরে, মাঠে, গাছতলায়, স্থানীয় অধিবাসীদের বাড়ি বাড়ি শরণার্থীই শুধু চোখে পড়বে। এটা প্রশাসনের পক্ষে মস্ত বড় সমস্যা। শুধু রিলিফের নয়, আইন শৃঙ্খলারও কিন্তু দৃঢ় প্রত্যয় নিয়ে এই সমস্যার মােকাবিলা করার জন্য যে প্রশাসনিক উদ্যোগ দরকার সর্বত্র তা নজরে পড়েনি। সেই উদ্যোগ যদি থাকতাে তাহলে রঘুনাথপুর, গঙ্গরামপুর, রামগঞ্জ কিংবা দাসপাড়া ক্যাম্পগুলিতে হাজার হাজার সবস্বান্ত পরিবারকে গত দেড় মাসেরও বেশি শুধু চাল ছুটিয়ে ক্ষুন্নিবৃত্তি করে কোনওক্রমে প্রাণ বাঁচাতে হত না। এইসব শরণার্থীদের ডাল তরকারী বা তেল তাে দূরের কথা, নুনটুকুও সরবরাহ করা হয় দিনের পর দিন।
এছাড়াও বহু শরণার্থী ওপার বাঙলা থেকে এসে এপারে আত্মীয় স্বজন বন্ধু বান্ধবদের বাড়িতে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। এক দিক থেকে এই শরণার্থীর সরকারের প্রশাসনিক সমস্যাকে আরেকটা লঘু করেছেন, হ্রাস করেছেন, ক্যাম্পগুলিতে আশ্রয় প্রার্থীদের চাপ। কিন্তু এঁদের কোনও র্যাশন দেওয়া হচ্ছে না। ফলে, এদের যারা আশ্রয় দিয়েছেন, সেইসব সাধারণ গৃহস্থের উপর যেমন প্রচণ্ড চাপ পড়ছে, তেমনি আশ্রয় প্রার্থীরাও এক অস্বস্তিক অবস্থায় রয়েছেন। এই সব শরণার্থী যদি এখন হাজারে হাজারে তাদের আত্মীয়স্বজনের ঘর ছেড়ে এসে ক্যাম্পগুলিতে ভীড় করেন, তা হলে জেলা প্রশাসনের কাজের ভার বাড়ে বই কমবেনা। শরণার্থী হিসাবে এদের নাম দ্রুত তালিকাভুক্ত করে কেন এদের দৈনিক র্যাশান দিয়ে স্থানীয় গৃহকর্তাদের ভার লাঘব করা হবে না?

কমিউনিস্টকর্মীরা শরণার্থীদের পাশে আছেন
শরণার্থীদের যথাসম্ভব রিলিফ ও প্রশাসনিক অচলায়তনকে নড়াবার জন্য মালদহ দিনাজপুর জেলায় কমিউনিস্ট কর্মীরা তাদের সীমিত শক্তি নিয়েই ঝাপিয়ে বর্বর ইয়াহিয়া ফৌজের আক্রমণে সাময়িকভাবে পশ্চাদপসরণ করে এপর বাঙলায় এসেছেন এবং নিজেদের দেশকে মুক্ত করেই স্বদেশে ফিরে যাবেন, স্থানীয় অধিবাসী এবং শরণার্থীদের মধ্যে এই রাজনৈতিক প্রচারকার্যের দায়িত্বও নিয়েছেন কমিউনিস্টরাই।
কারণ, এপার বাঙলায় যেমন শরণার্থীদের বিশেষত হিন্দু শরণার্থীদের এই রাজ্যেই স্থায়ীভাবে বসবাস করার জন্য প্ররােচনা দিয়ে সাম্প্রদায়িকতা সৃষ্টি করার সুযােগ সন্ধানারা রয়েছে, তেমনি আগত সমস্ত শরণার্থীও তাদের দেশের ঘটনাবলি সম্পর্কে রাজনৈতিকভাবে সচেতন নন।
কিন্তু প্ররােচিত হলে, তাদের কেউই এপার বাঙলায় থাকবার কথা ভাবছেন না। তারা থাকবেন কেন? দেশ ত্যাগ হবার ২৪ বছর পরেও যারা পূর্ববঙ্গ ছাড়েন নি, যাদের সেখানে জমি-জমা ব্যবসাবাণিজ্য— এক কথায় জীবন ও জীবিকার উপায় উপকরণ রয়েছে তারা কোন্ সুখে এ রাজ্যে উদ্বম্ভ হয়ে থাকবার স্বপ্ন দেখবেন বিশেষত যখন বাঙলাদেশের মানুষ সাম্প্রদায়িক ভেদযুদ্ধের সংকীর্ণতাকে আক্রমণ করে গণতন্ত্র ও ধর্ম নিরপেক্ষতার এক নতুন আদর্শ নিয়ে লড়াই শুরু করেছেন।
তাই ওপার বাঙলার দিনাজপুরের কিংবদন্তীর নায়ক কমরেড গুরুদাস তালুকদার এপার বাঙলার পশ্চিম দিনাজপুরে মাটকুণ্ড বা দাসপাড়া ক্যাম্পে যখন প্রত্যয়ভরে ঘােষণা করেন, আমরা লড়াই করতে করতে পিছু হটে এসেছি আবার লড়াই করতেই ইয়াহিয়ার কুত্তাদের খতম করে বাপের ব্যাটার মতাে নিজেদের ভিটায় স্বাধীন বাঙলাদেশে ফিরে যাবাে, তখন ক্যাম্পের হাজার হাজার আদিবাসী, হিন্দু, মুসলমান শরণার্থী প্রবল সমর্থনে জয়ধ্বনি করে উঠেন। বাঙলাদেশ থেকে আসা মানুষগুলির এটাই মনের কথা।
বগুড়া, রাজশাহী, রংপুর আর দিনাজপুরের মানুষের কাছে লালঝাণ্ডা সুপরিচিত। রাজশাহীর নাচোলের। আধিবাসী এখন মালদহের কালিন্দা, ক্যাম্পের বাসিন্দা বৃদ্ধ রাইহা মাঝির কাছে বিদ্রোহী নায়িকা ইলা মিত্রর স্মৃতি আজো অম্লান। সাতবিঘা জমির মালিক রাইহা মাঝি অনে লড়বে। লড়াই করার জন্য ট্রেনিং দেওয়া হােক, অস্ত্র দেওয়া হােক, দলে দলে জোয়ানরা নাম খেলাবে মুক্তিফৌজে।
এই হল বাঙলাদেশের মানুষের বাঙলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের মেজাজ।
এই মেজাজকে-ই সংগঠিত করার দায়িত্ব কমিউনিস্টদের, বাঙলাদেশের শুভাকাক্ষি সমস্ত রাজনৈতিক দলের। কমরেড রাজেশ্বর রাও দক্ষিণ ও উত্তরবঙ্গের জেলাগুলি সফর করে কমিউনিস্ট কর্মীদের কাছে এই একটি কাজকেই সবচাইতে অগ্রাধিকার দিয়ে করবার জন্য আহবান জানিয়েছেন এবং শরণার্থীদের কাছে আহ্বান জানিয়েছেন সমস্ত রকম বিভেদ ও প্ররােচনার বিরুদ্ধে, মুক্তিফৌজের সমর্থনে দাঁড়াবার জন্য।
কারণ, বাঙলাদেশে যে নবজাত গণতন্ত্র ও ধর্মনিরপেক্ষতার শক্তি আজ লড়ছে, তার সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গেই নয়, ভারতের রাজনৈতিক ভাগ্যও জড়িত। বাঙলাদেশে সাম্প্রদায়িক ভেদবুদ্ধির পরাজয়ের অর্থ ভারতেও হিন্দু সাম্প্রদায়িকার সমাধি। প্রতিক্রিয়ার ভেদ কৌশলের একটি বড় অস্ত্র হাতছাড়া হয়ে যাওয়া এ দেশে গণতন্ত্রের আরাে বিকাশ।

উৎসাহ এবং সমস্যা
বাঙলাদেশ থেকে আশা নওজোয়ানদের মধ্যে লড়াই করার জন্য উৎসাহের অভাব নেই। কিন্তু সে উৎসাহ হিন্দু শরণার্থীদের মধ্যে অপেক্ষাকৃত কর্ম, এটাও অপ্রিয় সত্য। একটা ঘটনা লক্ষ করা যায় : মুসলিম তরুণরা অধিকাংশ এদেশে এসেছেন লড়াই করতে করতে পিছু হটে। ইয়াহিয়া ফৌজের প্রধান আক্রমণের লক্ষ্য বস্তু যেহেতু যুব ছাত্র, সেই হেতু বহু ক্ষেত্রে এমনও দেখা গিয়েছে যে, বাঙলাদেশের বৃদ্ধ বাবা মা নিজেরা বাড়ি থেকে জোয়ান ছেলেটিকে বাইরে পাঠিয়ে দিয়েছেন অস্ত্র শিক্ষা নিয়ে অস্ত্র হাতে নিয়ে দেশকে মুক্ত করে ফিরে আসবার জন্য। এই সব তরুণদের কাছে পারিবারিক বাধনের প্রশ্ন গৌণ, মুখ্য প্রশ্ন হলাে দেশকে স্বাধীন ও মুক্ত করা।
কিন্তু হিন্দুরা এসেছেন সপরিবারে, পরিবারের একজনের অপরজনের উপরে এই অসহায় লড়াইয়ের প্রতি এপার বাংলার মানুষের সমর্থন অকুণ্ঠ। এই রাজ্যের সমস্যাসঙ্কুল অর্থনীতির উপরে আধ কোটি বাড়তি শরণার্থীর চাপও তাই পশ্চিমবঙ্গের মানুষকে বিচলিত করে নি, তারা সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন বাঙলাদেশ থেকে আসা বাঙলাদের প্রতি।
কিন্তু কিছু কিছু আমলা অফিসার শরণার্থীদের দুভাগ্যের সুযােগ নিতে কসুর করছেন না। পশ্চিম দিনাজপুরের ইসলামপুর মহকুমার ঠোকরাবাড়ি বর্ডার সিকিওরিটি ফোর্সের ক্যাপ্টেন সুভাষচন্দ্র এমনি একজন অফিসার।
ওপার বাঙলার দিনাজপুরের ঠাকুর গাঁ নির্বাচন কেন্দ্র থেকে প্রদেশিক আইন সভায় নির্বাচিত আওয়ামী লীগ সদস্য (এমপিএ) মহম্মদ ফজলুল করিম আরাে অনেকের সঙ্গে এপার বাঙলার ইসলামপুরে এসে আশ্রয় নিয়েছেন। আসবার সময় তিনি একটি গাড়ি সঙ্গে আনেন। ওপার বাঙলা থেকে যে সব এমএলএ এবং এম পি এ গাড়ি নিয়ে এপার এসেছেন, তাদের সেই গাড়ি ব্যবহার করতে দেবার নীতি রাজ্য সরকারেরও। কিন্তু বি এস এফ-এর এই ক্যাপ্টেন সুভাষ তার ব্যক্তিগত প্রয়ােজনে ঐ এমপিএ-র গাড়িটি চেয়ে নিয়ে আজ প্রায় একমাস হয়ে গেল ফেরত দিচ্ছেন না। বস্তুত, ঐ গাড়ি তিনি ফেরত দিতে অস্বীকার করেছেন এবং ব্যক্তিগত প্রয়ােজনেই গাড়িটি ব্যবহার করছেন।
এই ক্যাপ্টেনটির সম্পর্কে অন্যান্য গুরু অসযােগও ইসলামপুরের মানুষের কাছে শােনা যায়। এসব ঘটনা সরকারের একেবার অজানা নয়, কিন্তু এখন পর্যন্ত এই ক্যাপ্টেনের অপকর্মগুলি বন্ধ করার কোনও ব্যবস্থাই হয়নি।
অবিলম্বে যদি এর প্রতিবারের ব্যবস্থা না হয় তাহলে অদূর ভবিষ্যতে এখানে অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটতে পারে যা ইসলামপুরের মতে একটা ‘সেনাসাইভ’ জায়গার পক্ষের ক্ষতিকর নয় ভারত সরকারের সুনামের পক্ষেও ক্ষতিকর হবে।

সূত্র: কালান্তর, ২৯.৭.১৯৭১