You dont have javascript enabled! Please enable it!
পৃথিবীর ইতিহাসে উল্লিখিত কলঙ্কময় দিনগুলাের অন্যতম দিন ১৫ আগস্ট, ১৯৭৫। আজ থেকে তেত্রিশ বছর পূর্বে এই দিনে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে তাঁর প্রিয় ধানমণ্ডির ৩২ নম্বরের বাড়িতে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। মানবসভ্যতার ইতিহাসে সংযােজিত হয় আরেকটি জঘন্য হত্যাকাণ্ড। সেই  মর্মান্তিক ঘটনার খরবটি আমার কাছে কীভাবে পৌঁছাল তা আজও স্মৃতিপটে  উজ্বল হয়ে আছে। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট। তখন আমি উচ্চ শিক্ষার্থে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের রয়াল হলওয়ে কলেজে ছিলাম সপরিবারে। আমাদের বড়মেয়ে সিমকির বয়স তখন চার বছর তিন মাস। সবেমাত্র নার্সারি স্কুলে ভর্তিহ য়েছে। রুটিনমাফিক প্রতিদিন সকালে ওকে স্কুলে রেখে আমার স্ত্রীকে তার অফিসে নামিয়ে দিয়ে বাসায় গিয়ে নাস্তা সেরে ল্যাবরেটরিতে যাই।
 
উল্লেখ্য যে, আমার বিশ্ববিদ্যালয় জীবনে ঘনিষ্ঠ বঙ্গ মইন উদ্দিন আফজা (সােভিয়েত ইউনিয়নের বাকুতে পিএইচডি করছিল) গ্রীষ্মের ছুটির কাটাতে পাঁচ সপ্তাহের জন্য আমাদের বাসায় এসেছিল। সে ছাত্রজীবনে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রলীগের নেতৃস্থানীয় একজন ছিল। এখনও মুজিব-আদর্শ থেকে এতটুকু বিচ্যুত হয়নি। বর্তমানে আমেরিকায় পেনসিলভেনিয়ার রুমসবার্গ বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক।  ওইদিন সকাল নয়টায় দু’বন্ধু নাস্তার টেবিলে দেশের অবস্থা ও রাজনীতি নিয়ে অনেক আলােচনা করলাম, তর্ক-বিতর্ক কম হয়নি। এটা ঠিক যে, মহান হৃদয় বঙ্গবন্ধুর উদারতার সুযােগে আওয়ামী লীগের একশ্রেণীর সুবিধাবাদী নেতার কারণে উগ্র বামপন্থীদের হটকারিতা এবং সর্বোপরি স্বাধীনতাবিরােধী পাকিস্তান পন্থিদের নেতার ষড়যন্ত্রের কারণে দেশের সার্বিক অবস্থা আশানুরূপ ছিল না। এতো সত্ত্বেও কেন জানি বঙ্গবন্ধুর যে-কোনাে সমালােচনা আমি সহ্য করতে পারি না, যদি না তা গঠনমূলক হয়।  ফিরে আসা যাক ঘটনার শুরুতে।যেহেতু তখন গ্ৰীষ্মকাল, কাজেই কাজকর্মে সবার মধ্যেই একটা ঢিলেঢালা ভাব। নাস্তা সেরে (তখন সকাল দশটা) দু’বন্ধু কলেজে যাই। বাসা থেকে তিন মিনিটের হাঁটাপথ। ল্যাবরেটরিতে ঢুকতেই এক মিশরীয় মহিলা, নাম কারিমা রুগব (আমার সুপারভাইজারের অধীনেই তিনি গবেষণারত) ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে বললেন : তুমি কি শুনেছ তােমাদের দেশের  প্রেসিডেন্ট শেখ মুজিবুর রহমানকে হত্যা করা হয়েছে? শুনে তাে মাথায় যেন আকাশ ভেঙ্গে পড়ল। বলাে  তুমি ঠিক শুনেছ তাে? তিনি বললেন : বিবিসির রেডিওতে শুনেছেন।
 
হত্যার বিবরণ তিনি শুনলেও তা প্রকাশ করতে পারলেন না। দু’বন্ধু সঙ্গে সঙ্গে বাসায় ফিরে আসি। ঘন্টায় ঘন্টায় রেডিও সংবাদ । হা কারিমা ঠিকই শুনেছেন। আফজা চিৎকার করে উঠল । সাইদুর, সর্বনাশ হয়ে গেছে। অপেক্ষায় থাকলাম ১২ টার বিবিসি টিভি সংবাদের জন্য, আর মনে মনে আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করছি, যা শুনলাম তা যেন সঠিক না হয়।  ইতিমধ্যে লন্ডন ও তার আশপাশ থেকে বন্ধুবান্ধবের বেশ কয়েকটি ফোন পেলাম। মনটা আরও খারাপ হয়ে গেল টিভি খবর শােনার পর। নিরপেক্ষ, বস্তুনিষ্ঠ খবর পরিবেশনার জন্য বিবিসির সুনাম পৃথিবী ব্যাপী। লন্ডনে যাবার পর বিবিসির প্রতি আমার অনুরাগ আরও বৃদ্ধি পায়। কিন্তু ওই দিন বিবিসির খবর শােনার পর আমার ভেতরে যে কী প্রক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না। খবরের লিড নিউজ ছিল : শেখ মুজিব হত্যাকাণ্ড। খবরে বলা হল : মেজর ডালু (আসলে হবে ডালিম) রেডিওতে ঘােষণা দিয়েছে, ‘শেখ মুজিবকে হত্যা করা হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের ওপর বিবিসি তার নিজস্ব বিশ্লেষণ দেয়, যা খুব একটা খারাপ ছিল না। স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধুর অবদানের মূল্যায়ন মােটামুটি সঠিক ছিল।  কিন্তু যে-বিষয়টি আমাদের স্তম্ভিত করে তা হল স্বাধীনতাবিরােধী রাজাকার গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার। ভাবটা এই যে, এই মুহূর্তে বাংলাদেশ সম্পর্কে মতামত দেবার মতাে বাংলাদেশী কমিউনিটিতে নিরপেক্ষ কোনাে ব্যক্তি নেই। অনেক গণ্যমান্য ব্যক্তি থাকা সত্ত্বেও কেন গোলাম আযমের সাক্ষাৎকার নেয়া হল তা আজও আমার কাছে বােধগম্য নয়। বঙ্গবন্ধুর হত্যায় গোলাম আযম এতই আনন্দিত ও উল্লসিত যে, প্রথম ত্রিশ সেকেন্ড তিনি কোনাে কথাই বলতে পারেননি।
মুখে ছিল অট্টহাসি। তার প্রথম মন্তব্য : ‘The traitor of the country has been killed and the people are now very happy ক্ষোভে দুঃখে গা জ্বালা করছিল। বেশি রাগ হচ্ছিল বিবিসির ওপর। শেষপর্যন্ত ওরা গােলাম আযমের সাক্ষাৎকার নিল? এটাই কি ওদের নিরপেক্ষতার নমুনা? যে ব্যক্তির জন্ম না হলে বাংলাদেশ স্বাধীন হত না তাকে ‘Traitor” বলার মতাে ধৃষ্টতা প্রদর্শনের সুযােগ দেয়া হল। একই সঙ্গে লন্ডনে (অস্পষ্ট) হাইকমিশনার সৈয়দ অবদুস সুলতানের সাক্ষাৎকার নেয়া হল পার্শ্ববর্তী থাই অ্যামবেসির বারান্দা থেকে। তিনি সুকৌশলে একুল ওকুল বজায় রাখলেন তার বক্তব্য। তবে বঙ্গবন্ধুর প্রতি গভীর শ্রদ্ধা রেখেই তিনি কথা বলেছেন।
 
বঙ্গবন্ধু হত্যার ঠিক একবছর পর ১৯৭৬ সালে ১৫ আগস্ট লন্ডনের আইটিভিতে এ্যান্থনি ম্যাসকারেনহাস (যিনি বঙ্গবন্ধুর বিশেষ বন্ধু ছিলেন) বাংলাদেশের ওপর আধঘন্টার একটি অনুষ্ঠান প্রচার করেন। সেখানে বঙ্গবন্ধুর আত্মীকৃত খুনী কর্নেল ফারুক ও তার ভায়রা কর্নেল রশিদের সাক্ষাৎকার নেয়া হয়। তাতে ওরা দুজনেই  বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরিকল্পনার বর্ণনা দেন, যাতে স্পষ্টভাবে  – (অস্পষ্ট)  মােশতাক ও জিয়াউর রহমানের জড়িত থাকার কথা প্রকাশ পায়। খন্দকার মােশতাক সরাসরি জড়িত ছিলেন, আর জিয়াউর রহমান (তদানীন্তন ডেপুটি চিফ অব আর্মি স্টাফ) অত্যন্ত চতুরতার সঙ্গে ভূমিকা পালন করেন। তবে মূলত তার ইঙ্গিতেই ছিল ওই অপকর্মে খুনীদের মূল শক্তি ও সাহসের উৎস।
 
১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বর মাসের শেষদিকে কমনওয়েলথ স্কলারশিপে লন্ডন যাই। অক্টোবর মাসের প্রথম সপ্তাহে বয়লি হলওয়ে কলেজ ছাত্রসংসদ বিদেশী ছাত্রদের এক সংবর্ধনার আয়ােজন করে। ছাত্রসংসদের সভাপতি আগেই বলে রেখেছিল আমাকে দু-কথা বলতে হবে। অবাক হলাম অনুষ্ঠানের শুরতেই আমার নাম ডাকা দেখে। শুধু তাই নয়, সভাপতি মহোদয় আমাকে বিশেষভাবে পরিচয় FOR ‘Mr. Khan from Sheikh Mujibur Rahman’s Bangladesh”। মনে হয়েছিল আমিই যেন অনুষ্ঠানের প্রধান আকর্ষণ। আসলে আমাকে তো তাদের চেনার কথা নয়। আমি যে ওই অনুষ্ঠানে বিশেষ  —(অস্পষ্ট) — কারণ আমি মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বহু ত্যাগের বিনিময়ে অর্জিত স্বাধীন দেশ বাংলাদেশ থেকে আগন্ত—যার নেতা শেখ মুজিবুর রহমান। সারা বিশ্বের মানুষ বাংলাদেশকে জানে শুধুমাত্র শেখ মুজিবের –(অস্পষ্ট)– চার বছর থাকাকালীন লক্ষ করেছি, রাস্তাঘাটে, পার্কে, শপিং মলে অনেকেই যখন জিজ্ঞাসা করত আমরা কোন্ দেশ থেকে এসেছি। বাংলাদেশ বলার সঙ্গে সঙ্গেই বলে উঠত শেখ মুজিবুর রহমানের দেশ। অনেকে আবার বাংলাদেশ না চিনলেও শেখ মুজিবুর রহমানের নামে সঙ্গে পরিচিত। তাই একথা বলার অপেক্ষা রাখে না যে শেখ মুজিব ও বাংলাদেশ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত, একে অপরের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
 
উল্লেখ্য যে, ১৯৭১ সালে লন্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন কলেজের ছাত্ররা শেখ মুজিবের মুক্তি ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সক্রিয়ভাবে –(অস্পষ্ট)– চালায় এবং বাংলাদেশের মানচিত্রখচিত টাই বিক্রি করে মুক্তিযুদ্ধের ফাণ্ডে অর্থ জমা দেয়। বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর বাংলাদেশ কমনওয়েলথের সদস্য হওয়াতে –(অস্পষ্ট)–  হয়ে পাকিস্তান কমনওলেথ ত্যাগ করে।  আমরাই প্রথম ব্যাচ কমনওয়েলথ স্কলারশিপ ব্রিটেন যাই । ও আমি নই, ওই সময় যারা ব্রিটেন গিয়েছে তারা দারুণভাবে সমাদৃত হয়েছে ব্রিটিশের কাছে। খুব ভালাে লাগত ওমের উষ্ণ আতিথেয়তা। গর্ববােধ লাগতো যে আমরা বাংলাদেশ থেকে গিয়েছি। অনেকেই খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে সেইসব –(অস্পষ্ট)– অভিজ্ঞতা জানতে চাইত কৌতহল । ওরা আমাদেরকে বীবের জাতি হিসেবে মর্যাদা দিত। কারণ মাত্র  নয় মাসের যুদ্ধে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মতাে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে পরাস্ত করে মাটিকে মুক্ত করা কম কৃতিত্বের কথা না। আর এ কৃতিত্বের মূলে হিলেন অদম্য সাহসী শেখ মুজিব। তিনি তার এই অসীম সাহস অত্যন্ত সফলতার সঙ্গে –(অস্পষ্ট)– মধ্যে সঞ্চারিত করতে পেরেছিলেন। ত্রিশ লাখ প্রাণের বিনিময়ে যে স্বাধীনতা অর্জিত হয়েছে তা পৃথিবীর ইতিহাসে নজিরবিহীন। স্বাধীনতার  জন্য এতো ত্যাগ পৃথিবীর কোনাে জাতি করেনি, আর তাই তাে বিশ্ববাসীর কাছে আমাদের ছিল এত মর্যাদা ও কদর।
 
আগেই উল্লেখ করেছি বঙ্গবন্ধু বাঙালি জাতিকে বিশ্বদরবারে একটি মর্যাদাশীল জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছিলেন। অথচ মাত্র সাড়ে তিন বছরের মধ্যে দেশী ও বিদেশী –(অস্পষ্ট)–মাধ্যমে বিশ্বের কাছে সেই গৌরবমাখা মর্যাদাকে ভূলুণ্ঠিত করে একটি অসভ্য বর্বর জাতিতে পরিণত করা হল। সংঘটিত হল পৃথিবীর ইতিহাসে সবচেয়ে জঘন্য হত্যাকাণ্ড। জাতির জনকের সন্তান সম্ভবা পুত্রবধূ ও দশ বছরের নিস্পাপ শিশু সন্ধান রাসেলও সে নৃশংস হত্যাকাণ্ড থেকে রেহাই পায়নি। ভাগ্যক্রমে শেখ হাসিনা ও রেহানা দেশের বাইরে ছিলেন, নইলে তাদেরকে একই ভাগ্য বরণ করতে হত।
 
১৫ আগস্ট সেই বেদনাময় ঘটনার পর প্রায় মাসখানেক আমি কলেজে যাইনি। কীভাবে সহপাঠী বিদেশী বন্ধুবান্ধব ও শিক্ষকদের সামনে মুখ দেখাব? ব্রিটিশ পত্রপত্রিকায় প্রায় প্রতিদিন ওই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের নিন্দা জানিয়ে লেখা ছাপা হত। বাঙালি বলে পরিচয় দিতে যেখানে গর্ববােধ করেছি সেখানে আমাদের এখন পরিচয় বর্বর অসত। জাতি হিসেবে অনেকেই প্রশ্ন করতেন  যে ব্যক্তির জন্ম না হলে তােমরা কোনােদিন স্বাধীন হতে পারত না, তাকে কী করে হত্যা করতে পারলে? শুধু আমি নই, প্রবাসী সকল বাংলাদেশীকেই তখন এ-ধরনের প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়েছে। সে-প্রশ্নের কোনাে জবাব জানা নেই।  প্রবাসজীবনে অনেক ঘটনার মধ্যে আরেকটি ঘটনার কথা উল্লেখ করে আমি এ সংক্ষিপ্ত লেখার ইতি টানব। ১৯৮০ থেকে ১৯৮২ এই দুবছর আমি লুসাকাতে জাম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। ওই সময় সমগ্র জাম্বিয়াতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে প্রায় ৮০টি বাঙালি পরিবার বাস করত। পেশায় অধিকাংশই শিক্ষক, প্রকৌশলী, চিকিৎসক ও এ্যাকাউন্টেন্ট। সেখানে বাংলাদেশীর একটি সমিতি ছিল—’জাম্বিয়া বাংলাদেশ ফ্রেন্ডশিপ এ্যাসােসিয়েশন’। আমি ছিলাম সমিতির সাধারণ সম্পাদক। সভাপতি ছিলেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এক প্রবীণ শিক্ষক সমিতির মাধ্যমে আমরা জাতীয় দিবসগুলো পালন করতাম। ১৯৮১ সালে বেশ জমক করে স্বাধীনতা দিবস পালন করেছিলাম হােটেল ইন্টারনে। প্রধান অতিথি হিসেবে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলাম জাম্বিয়া সরকারের স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. মাপুজাকে।
 
অনুষ্ঠান উপলক্ষে যে –(অস্পষ্ট)– প্রকাশ হবে তাতে সভাপতির ভাষণ থাকবে। কিন্তু সমস্যা দেখা দিল এই ভাষণ নিয়েই। ভাষণে তিনি যা লিখেছেন তাতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রমানের কোনাে নামগন্ধ নেই। বিএনপির মতাে জিয়াউর রহমানকে স্বাধীনতার ঘােষক হিসেবে উল্লেখ করে এমনভাবে উপস্থাপন করেছেন তাতে যে-কেউ মনে করবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে জিয়াউর রহমানই সর্বেসর্বা শেখ মুজিব নামে ওই সময় কেউ ছিল না। সমিতির কার্যনির্বাহী বাের্ডের আরও ২/১ জনসহ আমি বেঁকে বসলাম। এমনভাবে ইতিহাসবিকৃতি করে বিদেশের মাটিতে সমিতির নামে স্বাধীনতা দিবস উদযাপিত হতে পারে না। সভাপতিকে তার ভাষণ সংশােধন করে প্রকৃত ঐতিহাসিক সত্য অন্তর্ভুক্ত করতে হবে। সভাপতিও অনড় থাকলেন, এটা কার ভাষণ। তিনি যেভাবে ইচ্ছা লিখতে পারেন। আমরা বললাম এটা তার ব্যক্তিগত লেখা নয়। সমিতির পক্ষ হতে সভাপতি হিসেবে তার লেখা। অনেক চাপ সৃষ্টির পর তিনি নতি স্বীকার করতে বাধ্য হলেন এবং জিয়াউর রহমান যে বঙ্গবন্ধুর পক্ষে স্বাধীনতার বাণী পাঠ কৱেন তা উল্লেখ করলেন সমস্যার সমাধান হল।
 
সবচেয়ে মজার ব্যাপার হল প্রধান অতিথির ভাষণে ৬ মিনিটের মাথায় যখন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে Founding fathead of Bangladesh বলে উল্লেখ করলেন তখন হলে উপস্থিত সবার হাততালিতে এক অনাবিল আনন্দের পরিবেশ সৃষ্টি হল।  দুঃখজনক বিষয় হল বিদেশীরা যখন ঐতিহাসিক সত্যকে স্বীকার করে, তখন আমরা অনেক শিক্ষিত মানুষ ব্যক্তিস্বার্থে বা গােষ্ঠীস্বার্থে ইতিহাসবিকৃতি নিয়ে ব্যস্ত থাকি। কথায় বলে । ‘Truth shall prevail=সত্যকে চাপা দিয়ে রাখা যায় না। ইতিহাস খণ্ডিত বা বিকৃতি করে নিরবচ্ছিন্নভাবে অপপ্রয়াস চালানাে হয়েছে বঙ্গবন্ধুর অবদানকে খাটো করে তাঁর অবিস্মরণীয় কীর্তিসমূহের অবমূল্যায়ন করে মানুষের স্মৃতি থেকে তার নাম-নিশানা মুছে ফেলার জন্য তারই একটা ছােট্ট উদাহরণ লুসাকার ওই ঘটনা।
 
কিন্তু আমরা জানি ইতিহাস চিরন্তন সত্য প্রকাশ করে থাকে। শত চেষ্টা করেও বঙ্গবন্ধুর স্মৃতি বাঙালির হৃদয় থেকে মুছে ফেলা সম্ভব হয়নি। তাই তাে ২০০৪ সালে বিবিসির শ্ৰোতামণ্ডলীর রায়ে তিনি নতুনভাবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙ্গালী হিসেবে। বঙ্গবন্ধুর অস্তিত্ব বাংলার আকাশে, বাতাসে, মাটিতে ও পানিতে মিশে আছে, যা মুছে ফেলা সম্বব নয়। বিশ্বব্যাপী তিনি ছিলেন দারুণভাবে জনপ্রিয়। তাই বিদেশে যখনই বাংলাদেশী বলে পরিচয় দিয়েছি সঙ্গে সঙ্গে জবাব পেয়েছি—তুমি শেখ মুজিবের দেশের লোক। বাঙালি হিসেবে এটা কি আমাদের কম সৌভাগ্য? বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের পর পরই খ্যাতনামা নিউজউইক ম্যাগাজিন বঙ্গবন্ধুকে ‘পােয়েট অব পলিটিকস’ অভিধায় আখ্যায়িত করে।  আজকের এই দিনে গভীর শ্রদ্ধা জানাই সেই মহান মানব, সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ বাঙালি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে–(অস্পষ্ট)– আজীবন নিরলস নিঃস্বার্থ আন্দোলন সংগ্রামের সফল স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ। আমাদের অনেক ভুল হয়েছে, অনেক ক্ষতি হয়েছে, অনেক পিছিয়ে গেছি। তাই আজকের দিনে প্রতিজ্ঞা হােক— স্বাধীনতাবিরােধী ও উগ্র মৌলবাদীদের রুখতে স্বাধীনতার পক্ষে সবাই আমরা ঐক্যবদ্ধ হই ।
 
জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৮
Reference – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!