১০ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ দিল্লীতে শেখ মুজিবের ৩ ঘণ্টা
শেখ মুজিবকে বহনকারী বিমান দিল্লী পালাম (পরে ইন্দিরা গান্ধী) বিমান বন্দরে পৌঁছালে ২১ বার তোপধ্বনি দিয়ে তাকে স্বাগত জানানো হয়। বিমান বন্দরে ভারতীয় প্রেসিডেন্ট ভিভি গিরি, ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্দুস সামাদ আজাদ তাকে স্বাগত জানান। তারপর শেখ মুজিবকে সশশ্র বাহিনীর গার্ড অব অনার প্রদান করা হয়। ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী তার মন্ত্রীসভা, নেতৃবৃন্দ, উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। বিমানবন্দরে কম্যুনিস্ট দেশ গুলির বাহিরে যে সকল দেশের রাষ্ট্রদূতেরা উপস্থিত ছিলেন তারা হলেন যুক্তরাজ্য, ডেনমার্ক, ভ্যাটিকান, আয়ারল্যান্ড, পশ্চিম জার্মানি, ইতালি, ফ্রান্স, কলম্বিয়া, নরওয়ে। উচ্চপদস্থ সরকারী কর্মকর্তাদের সাথে পরিচয় করিয়ে দেয়ার সময় শেখ মুজিব কয়েকজন কর্মকর্তার সাথে ক্ষনিক আলাপ করেন। তারপর বিমানবন্দরের টেকনিক্যাল এরিয়ায় তিনি আগত সুধীদের উদ্দেশে এক শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন। শুভেচ্ছা বক্তব্য এ তিনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে ভারতের ভুমিকার প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রদর্শন করেন। অনুষ্ঠানটি পরিচালনা করেন ভারতে নিযুক্ত সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত। তিনিও সেখানে সংক্ষিপ্ত বক্তব্য রাখেন। এর পর শেখ মুজিব ক্যান্টনমেন্ট প্যারেড গ্রাউন্ড এ যান। পথে হাজারো ভারতীয় রাজপথে তাকে দেখে উচ্ছ্বাস প্রকাশ করে। তারা মিছিলের পর মিছিল করতে করতে প্যারেড গ্রাউন্ড এ যাচ্ছিল। প্যারেড গ্রাউন্ড এ উপস্থিত জনগনের উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করেন। তিনি সেখানে ইংরেজিতে ভাষণ দিতে উদ্যত হলে উপস্থিত জনতা না না করে বাংলায় ভাষণের দাবী জানান পরে তিনি বাংলায় ভাষণ দেন। ভাষণে তিনি বলেন ভারত বাংলাদেশের বন্ধুত্ব চিরদিন অক্ষুন্ন থাকবে। রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরি শেখ মুজিবের উদ্দেশে মানপত্র পাঠ করেন। তারপর তিনি রাষ্ট্রপতি ভবনে যান সেখানে তিনি রাষ্ট্রপতি ভিভি গিরির সাথে কিছুক্ষন আলাপ করেন। প্রেসিডেন্ট ভবনে ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং ৪০ মিনিট ব্যাপী ঘরোয়া আলোচনা করেন। আলোচনা শেষে শেখ মুজিব তিনি সাংবাদিক সাক্ষাৎকার দেন। তাদের তিনি জানান তিনি আশা করছেন বিশ্ব এর দেশ সমুহ বাংলাদেশের বাস্তবতা মেনে নিবেন এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিবেন। ঢাকা রওয়ানা হওয়ার আগে সেখানে কিছুক্ষন ফটো সেশন করেন।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ আমি প্রতিশ্রুতি পূরণ করেছি- ইন্দিরা গান্ধী
ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নয়াদিল্লীতে ক্যান্টনমেন্ট (বর্তমানে কারিয়াপ্পা) প্যারেড গ্রাউন্ডে দিল্লী বাসীর উদ্দেশে শেখ মুজিবের বক্তব্য প্রদান অনুষ্ঠানে ভাষণে বলেছেন শেখ মুজিবুর রহমান ভারতের জনগনের মাঝে এসেছেন ইহা ভারতের জন্য আনন্দ ও গৌরবের দিন। তিনি বলেন শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার মানুষকে মুক্ত ও নয়া জীবন গঠন করার প্রেরনা দিয়েছেন। শেখ মুজিবুর রহমানের দেহ পাকিস্তানের কারাগারে আটক ছিল তার আদর্শ নয়। ইন্দিরা গান্ধী বলেন তিনি তিনটি বিষয়ে জনগণকে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন এবং সকল প্রতিশ্রুতি পুরন করেছেন। প্রতিশ্রুতি গুলি হল শরণার্থীদের ফেরত পাঠানো, মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য এবং শেখ মুজিবকে মুক্ত করা। শেখ মুজিবুর রহমান তার জনগন ও পরিবারের কাছে ফিরে যাচ্ছেন। শেখ মুজিবকে এখন বিরাট চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে হবে। এই চ্যালেঞ্জ হল সমৃদ্ধি, প্রগতিশীল ও শক্তিশালী দেশ গঠন এবং দেশের জনগণকে নবজীবন প্রবাহে উদ্ভুত করা।
নোটঃ লিঙ্কের ভিডিওতে সাড়ে চার মিনিট থেকে ইন্দিরার ভাষণ।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ ঢাকা বিমান বন্দরে শেখ মুজিব
দুপুরে ঢাকা বিমানবন্দরে ব্রিটিশ রাজকীয় কমেট বিমান অবতরন করলে বিমানের সিড়ি সংযুক্ত হওয়ার সাথে সাথেই সাবেক ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ এমএনএ, ছাত্রনেতা ও নায়ক খসরু ও কয়েকজন বিমানের দরজায় ছুটে যান এবং শেখ মুজিবের নামার প্রাক্কালে তাকে জড়িয়ে ধরেন এবং ফুলের মালা পরিয়ে দেন। বিমান থেকে নেমে এলে তাকে গার্ড অব অনার মঞ্চে নিয়ে যান সশস্র বাহিনী প্রধান কর্নেল ওসমানী এবং সেনাবাহিনীর ঢাকা এলাকা প্রধান লেঃ কঃ শফিউল্লাহ। গার্ড অব অনার পরিচালনা করেন মেজর মইনুল। পরে শেখ মুজিবকে সশস্র বাহিনীর অপর অফিসারদের সাথে পরিচয় করে দেয়া হয়। চীফ অফ স্টাফ কর্নেল রব, উপ সশস্র বাহিনী প্রধান এয়ার ভাইস মার্শাল একে খন্দকার, সেক্টর কমান্ডারদের মধ্যে এমকে বাশার, সিআর দত্ত, লেঃকঃ নুরুজ্জামান, মীর শওকত আলী, খালেদ মোশাররফ, এমএ মঞ্জুর, উইং কমান্ডার হামিদুল্লাহ,মেজর রফিক সহকারী স্টাফ প্রধান মেজর এআর চৌধুরী,সহকারী স্টাফ প্রধান আবু ওসমান চৌধুরী, মেজর আবু সালেক চৌধুরী, মেজর জিয়াউদ্দিন, মেজর জামান, মেজর হায়দার, ক্যাপ্টেন গাফফার সহ আরও অনেকে। বিদেশী অতিথিদের মধ্যে ছিলেন ব্রিটিশ এমপি জন স্টোন হাউজ, ভারতীয় এমপি সমর গুহ, সোশালিস্ট ইন্টারন্যাশনালের হেন্স জেনিসেক, ব্রিটিশ এমপি এবং ওয়ার অন ওয়ানটস প্রধান ডোনালড চেসওয়ারথ, সোভিয়েত কন্সাল জেনারেল ভ্যালেন্টিন পোপভ, ব্রিটিশ হাই কমিশন কর্মকর্তা আর জি ব্রিটেন, মিডরফট, ফ্রান্সের কন্সাল জেনারেল পিয়েরে বারখেলে। এছাড়াও নেপাল, যুক্তরাষ্ট্র, জাপান, অস্ট্রেলিয়া, পোল্যান্ড, যুগস্লভিয়া, ইন্দোনেশিয়া, পশ্চিম জার্মানি, বুলগেরিয়ার মিশন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন। আরও উপস্থিত ছিলেন ভারতের পররাষ্ট্র দপ্তরের যুগ্ন সচিব একে রায়, ভারতীয় সেনাবাহিনীর এসকে গঙ্গোপাধ্যায়, বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টির মনি সিংহ, আব্দুস সালাম, ন্যাপের ক্যাপ্টেন হালিম, মতিয়া চৌধুরী, বাংলাদেশ কংগ্রেসের মনোরঞ্জন ধর,আওয়ামী লীগ নেতা আব্দুল মান্নান (টাং),খালেদ মোহাম্মদ আলী এমএনএ, আব্দুর রাজ্জাক,আমির হোসেন আমু এমপিএ, ছাত্রলীগ সভাপতি নুরে আলম সিদ্দিকি, সাধারন সম্পাদক শাজাহান সিরাজ, ডাকসু ভিপি আসম আব্দুর রব, জিএস আব্দুল কুদ্দুস মাখন, শেখ মুজিবের পিতা ও ভাগ্নে শেখ মনি, শেখ মুজিবের তিন পুত্র, আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভার সকল সদস্য উপস্থিত ছিলেন।
নোটঃ মেজর জলিল গ্রেফতার থাকায় এবং ওসমানীর সাথে বিরোধ থাকায় মৌলভীবাজারে দায়িত্ব পালনরত লেঃকঃ জিয়াউর রহমান এই দুই সেক্টর কমান্ডার/ ব্রিগেড কমান্ডার এদিনে উপস্থিত ছিলেন না।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ রেসকোর্সে শেখ মুজিব
শহর আওয়ামী লীগ বিমানবন্দর এবং প্রধান সড়কে ভিড় না করার আগের দিন প্রচার সত্ত্বেও লাখো জনতা বিমান বন্দর এবং রাস্তা পরিপূর্ণ করে ফেলে। পুলিশ বিভাগের অনুরোধ সত্ত্বেও উন্মুক্ত রাস্তা বেদখল হয়ে যায়। ফলে রেসকোর্সে পৌছতে শেখ মুজিবের অনেক বিলম্ব হয়ে যায়। তিনি ক্লান্তির কারনে দিল্লীতে লম্বা বক্তব্য না দিয়ে তড়িঘড়ি শেষ করে দিয়েছিলেন এখানে জনজট তার ক্লান্তি আর বাড়িয়ে দিয়েছিল। রেসকোর্সের বক্তৃতায় তিনি বলেন বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করেছে বাংলার একজন মানুষ বেচে থাকতে এ স্বাধীনতা নস্যাৎ হতে দেবনা। বাংলাকে দাবিয়ে রাখতে পারে পৃথিবীতে এমন কোন শক্তি নেই। তিনি কান্না জড়িত কণ্ঠে শহীদদের প্রতি সন্মান জানান। তিনি বলেন আজ আমার সাধ পুরন হয়েছে। তিনি রবীন্দ্রনাথের কবিতার একটি লাইন সাত কোটি সন্তানেরে হে মুগ্ধ জননী রেখেছ বাঙালি করে মানুষ করনি চয়ন করে বলেন কবি গুরুর এই আক্ষেপ আমরা মোচন করেছি। বাংলার মানুষ আজ প্রমান করেছে তারা প্রান দিতে যানে আর তারা যে কাজ করেছে তার নজির পৃথিবীতে নেই। মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন তোমরা যে রক্ত দিয়েছ তা বৃথা যেতে পারে না। তিনি বলেন বাংলাদেশ ২য় বৃহত্তম মুসলিম রাষ্ট্র কিন্তু ব্বাংলাদেশ কোন ধর্মীয় রাষ্ট্র হবে না। এদেশের মূলনীতি হবে গনতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরপেক্ষতা। তিনি জনগনের উদ্দেশে বলেন এখনি দেশ পুনর্গঠন কাজে নেমে পড়ুন। নিজেরাই রাস্তাঘাট মেরামত করুন। তিনি বাংলাদেশকে সাহায্য করার জন্য সকল দেশের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বাংলাদেশকে স্বীকৃতি ও জাতিসংঘ সদস্য পদ দেয়ার জন্য সকল মুক্ত দেশের প্রতি আহবান জানান। বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে ইন্দিরা গান্ধীর ভুমিকার প্রশংশা করে তিনি বলেন আমি ভারতবাসী এবং ইন্দিরাগান্ধির প্রতি চির কৃতজ্ঞ। তিনি বলেন অনেক ভারতীয় সৈন্য ধিরে ধীরে প্রত্যাহার করা হচ্ছে আমি যখন বলব সবাই সেদিন চলে যাবে। তিনি বলেন ২৫ মার্চ রাত্রে আমাকে ছেড়ে যাবার সময় সৈয়দ নজরুল তাজউদ্দীন কাঁদতে কাঁদতে আমার বাসভবন ত্যাগ করেছিলেন আমি বলেছিলাম আমি এখানেই মরতে চাই।
তিনি বলেন বাংলাদেশে গণহত্যার তদন্ত ও বিচার হবে। তবে আন্তজার্তিক দল তদন্ত করতে চাইলে তিনি স্বাগত জানাবেন। তিনি বলেন আমার বিরুদ্ধে মামলায় যারা সাক্ষী দিয়েছে তাদেরও বিচার করা হবে। কামালকে ৩ মাস ধরে চেষ্টা করার পরও কামাল আমার বিরুদ্ধে সাক্ষী দেয়নি।
ভুটটো সম্পর্কে তিনি বলেন আমাকে বলা হয়েছিল দু অংশের মধ্যে শিথিল একটা সম্পর্ক রাখা যায় কিনা। ভুটটো এর উদ্দেশে তিনি বলেন আপনারা সুখে থাকুন বাঙ্গালিরা আপনার সাথে স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবেই বন্ধু হতে চায়।
১০ জানুয়ারী ১৯৭২ঃ পরিবারের সাথে মুজিব
বিমানবন্দরে উপস্থিত ছিলেন শেখ মুজিব এর তিন পুত্র এবং বয়োবৃদ্ধ পিতা। চোখাচোখি হলেও তাদের মধ্যে কুশলাদি বিনিময়ের সুযোগ হয়নি। শেখ কামাল মুজিবকে বহনকারী ট্ট্রাকে অনেক কাছেই ছিলেন তবুও তাদের মধ্যে আলাপের সুযোগ হয়নি। রাসেল পিছনে একটি জীপে ছিলেন তবে তার সাথে একবার চোখাচোখি হয়েছিল সে সময় রাসেল হাত নাড়িয়ে পিতাকে শুভেচ্ছা জানান। রেসকোর্স থেকে ধানমণ্ডির বাড়ীতে বিকেল ৫ টা ৩৫ মিনিটে পৌঁছেন শেখ মুজিব। বাড়ীর বাহিরে তখন হাজারো জনতা মুহুর্মুহু জয়বাংলা জয় বঙ্গবন্ধু স্লোগানে এলাকা প্রকম্পিত করে তুলছিল। তারা বাড়ীর প্রবেশ পথে তাকে স্বাগত জানান। জনতার ভিড়ে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন বাড়ীতে প্রবেশে ব্যর্থ হন। তিনি পরে অন্য বাড়ীর দিক দিয়ে বিশেষ ব্যবস্থায় বাড়ীতে প্রবেশ করেন। বাড়ীতে পৌছলেই তার জ্যেষ্ঠ কন্যা শেখ হাসিনা তাকে জড়িয়ে ধরে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। তিনি কন্যাকে সান্তনা দিতে দিতে এগিয়ে যান। একদল নারী এ সময় শেখ মুজিবের উদ্দেশে পুষ্পবর্ষণ করেন। ঘরের ভিতরে প্রবেশের পর ছোট মেয়ে শেখ রেহানা শেখ মুজিবকে জড়িয়ে কান্নায় ভেঙ্গে পরেন। পরে রেহানা মুজিবকে তার ৯০ বছরের বৃদ্ধ পিতার শয়ন কক্ষে নিয়ে যান। তিনি তার বৃদ্ধ পিতার পা ছুয়ে কদমবুছি গ্রহন করেন। পরে তিনি তার বৃদ্ধা মাতার কাছে যেয়ে তাকে জড়িয়ে ধরে শিশুদের মত কাদতে থাকেন।
৬ টা ১৫ মিনিটে তার বাসভবনে বিশেষভাবে প্রস্তুত ড্রইংরুমে ফিরে নেতৃবৃন্দ এবং দেশী বিদেশী সাংবাদিকদের মুখোমুখি হন। ড্রইং রুমটি ছিল ডেকোরেটর থেকে আনা কয়েকটি সাধারন পোর্টেবল ফোল্ডিং চেয়ার।