৬ দফার উত্থাপন : পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসনের মহাসনদ, সরকার ও রাজনৈতিক দলের প্রতিক্রিয়া এবং জনগণের সমর্থন
৫ ও ৬ই ফেব্রুয়ারি লাহােরে বিরােধী দলের সম্মেলন শেষে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান এবং তার প্রতিনিধি দল ১০ তারিখ পর্যন্ত লাহােরে অবস্থান করেছিলেন। সেখানে তিনি পশ্চিম পাকিস্তান আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে বিভিন্ন বিষয়ে আলাপ আলােচনা করেন। ১০ই ফেব্রুয়ারি পশ্চিম পাকিস্তানের সাংবাদিকদের সঙ্গে তিনি লাহাের সম্মেলনে আলােচিত ও গৃহীত বিভিন্ন সিদ্ধান্ত সম্পর্কে কথা বলার পাশাপাশি পূর্ব পাকিস্তানে স্বায়ত্তশাসন এবং নিরাপত্তার বিভিন্ন বিষয় নিয়ে তাঁর চিন্তাধারার বেশকিছু ধারণা উপস্থাপন করেন। বােঝাই যাচ্ছিল তিনি পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন ও নিরাপত্তা নিয়ে অনেক বেশি উদ্বিগ্ন ছিলেন। সে কারণে লাহাের থেকে ১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেই তিনি তেজগাঁও বিমানবন্দরে তাঁর চিন্তাধারার প্রথম প্রকাশ ঘটান। এটিই শেখ মুজিবের ৬ দফা নামে পরদিন থেকেই পরিচিত হয়ে ওঠে। পরদিন জাতীয় পত্রপত্রিকায় এটি প্রকাশিত হয়। অচিরেই তিনি আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটিতে এটি উপস্থাপন করেন এবং মার্চ মাসে ১৮, ১৯, ২০ তারিখ অনুষ্ঠিত পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে উপস্থাপনের মাধ্যমে রাজনৈতিক কর্মসূচি হিসেবে ৬ দফাকে দল থেকে অনুমােদন করা হয়। পরবর্তী সময়ে দেশের জনগণের কাছে ৬ দফা প্রচারের জন্য তিনি গণসংযােগে বের হন। ফলে ৬ দফা অতি
৭৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
দ্রুতই স্বায়ত্তশাসনের একটি মহাসনদ হিসেবে জনগণের কাছে তুলে ধরার উদ্যোগ গৃহীত হয়। এর বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার এবং কয়েকটি রাজনৈতিক দল অবস্থান নেয়। এর ফলে পূর্ব বাংলার স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে আওয়ামী লীগ বনাম সরকার ও প্রতিক্রিয়াশীল রাজনৈতিক দলগুলাের মধ্যে আদর্শগত বিরােধ মাঠে গড়ায়।
১১ই ফেব্রুয়ারি ঢাকা তেজগাঁও বিমানবন্দরে অবতরণের পর সাংবাদিকদের সম্মুখে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান, লাহােরে নিয়ে যাওয়া তার যে দাবিনামা উত্থাপন করতে পারেননি তা এখানে সবিস্তারে তুলে ধরেন। তিনি সাংবাদিকদের বলেন, লাহােরে অনুষ্ঠিত বিরােধী শিবিরের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাবাদিই নয়, গােটা সম্মেলনের সঙ্গেই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়াছে।… পূর্ব পাকিস্তানের বঞ্চিত সাড়ে পাঁচ কোটি মানুষের সহিত বিশ্বাসঘাতকতা করা সম্ভব নয় বলিয়াই এই সম্মেলনের সঙ্গে তাঁহাকে ও তাঁহার সহকর্মীদের সম্পর্ক ছিন্ন করিতে হইয়াছে এবং সেইজন্যই সম্মেলনে গৃহীত কোনাে প্রস্তাব বা সিদ্ধান্তের সঙ্গে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের কোনােরূপ সম্পর্ক বা সংস্রব নাই।১১৯ সাংবাদিকদের সঙ্গে দীর্ঘ এক ঘণ্টার আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমান তাদের বিভিন্ন ধরনের প্রশ্নের উত্তর দেন। ১৯৬৫ সালের পাক-ভারত যুদ্ধোত্তর পরিস্থিতি পর্যালােচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান লাহােরে যে বিষয়টি উত্থাপিত করতে চেয়েছিলেন তা বাধাগ্রস্ত হয়ে ৬ দফা আকারে ঢাকা বিমানবন্দরে সাংবাদিকদের সম্মুখে তুলে ধরেন-যা ১২ই ফেব্রুয়ারি পত্রপত্রিকায় (দৈনিক ইত্তেফাক, দৈনিক আজাদ) বিস্তারিত বর্ণনা দেওয়া আছে। শেখ মুজিবুর রহমান তার উত্থাপিত ৬ দফায় যেসব দিকনির্দেশনা রয়েছে তার ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে বলেছেন, ‘পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার বিগত ১৭ দিনের যুদ্ধে যে অভিজ্ঞতা হইয়াছে তাহাতে প্রশাসনিক দিক দিয়া জনসাধারণের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনের কথা বিবেচনা করিয়া দেশের প্রশাসনিক কাঠামাে সম্পর্কে নতুনভাবে চিন্তা করার প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। তিনি বলেন, বিগত অস্বাভাবিক ধরনের জরুরি
————————————————
১১৯ ইত্তেফাক, ১২ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬, দেখুন, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও অন্যান্য (সম্পাদিত), বাংলাদেশ: প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০১৭, ঢাকা, পৃ. ২৯২ (৬৬)।
————————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৭৯
দিনগুলােতে কেবল পূর্ব পাকিস্তানিদের ঐক্যবােধই দেশের দুই প্রদেশকে ঐক্যবদ্ধ রাখিতে সমর্থ হইয়াছে, ঘটনাক্রমে নহে।১২০
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি ৬ দফায় ফেডারেল পদ্ধতির যে সরকার ব্যবস্থা পাকিস্তানে প্রতিষ্ঠা করার দাবি উত্থাপন করেছেন তার ব্যাখ্যায় তিনি বলেছেন, “ফেডারেল সরকার দেশরক্ষা এবং পররাষ্ট্র বিষয়ের দায়িত্ব পালন করিবেন। এই দুইটি বিষয় ছাড়া আর বাকি যেসব বিষয় থাকিবে তার সম্পূর্ণ কর্তৃত্ব থাকিবে ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত স্টেটসমূহের হাতে।… দেশের মুদ্রাব্যবস্থায় বিনিময়যােগ্য দুইটি পৃথক ধরনের মুদ্রার অথবা শর্তসাপেক্ষে একটি মুদ্রাব্যবস্থা কায়েম রাখার সুপারিশ করিয়াছেন।… ফেডারেশনের জন্য যদি একটি মুদ্রাব্যবস্থা কায়েম রাখিতে হয়, তবে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য পৃথক ব্যাংকিং ব্যবস্থা প্রবর্তন করিতে হইবে এবং সেইক্ষেত্রে পূর্ব পাকিস্তান হইতে পশ্চিম পাকিস্তানে মূলধন পাচার বন্ধ করার জন্য কার্যকরী শাসনতান্ত্রিক বিধান করিতে হইবে। এ ছাড়াও পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সম্পূর্ণ পৃথক আর্থিক ও অর্থনৈতিক নীতি প্রবর্তন করিতে হইবে।১২১
কর ধার্য করা সম্পর্কে সাংবাদিক সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান। বলেছেন, “সর্বপ্রকারের কর ও শুল্ক ধার্যের একচেটিয়া অধিকার ফেডারেশনের স্টেটসমূহের হাতেই থাকিবে। ফেডারেল সরকারের কোনােরূপ কর ধার্যের অধিকার থাকিবে না। তবে সংশ্লিষ্ট ব্যয় নির্বাহের জন্য স্টেটসমূহের করের একটি অংশ ফেডারেল সরকার পাইবেন। স্টেটসমূহের সকল প্রকার করের একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ অংশ দ্বারাই ফেডারেল সরকারের তহবিল গঠিত হইবে।১২২
সাংবাদিক সম্মেলনে বৈদেশিক বাণিজ্য সম্বন্ধে ৬ দফায় ৫টি বিশেষ দফা শেখ মুজিব সুপারিশ করেছেন। প্রথমত, ফেডারেশনের প্রতিটি স্টেটের পৃথকভাবে বিদেশি বাণিজ্যের হিসাব রাখিতে হইবে। দ্বিতীয়ত, বিদেশি বাণিজ্যের দ্বারা আগত বিদেশি মুদ্রা স্টেটগুলাের অধিকারে থাকিবে। তৃতীয়ত, ফেডারেল সরকারের বিদেশি মুদ্রার চাহিদা সমান হারে
————————————————–
১২০ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ) পৃ. ২৯৩ (৬৬)
১২১ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ) পৃ. ২৯৩ (৬৭)
১২২ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ) পৃ. ২৯৩ (৬৭)
————————————————–
৮০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
বা সম্মত কোনাে একটা হারে স্টেটসমূহ মিটাইবে। চতুর্থত, প্রয়ােজনীয় স্বদেশে প্রস্তুত সকল দ্রব্যই বিনা শুল্কে বা টেরিফের বিধি-বিধানমুক্ত অবস্থায় স্টেটসমূহের মধ্যে যাতায়াত করিবে। শেষত, শাসনতান্ত্রিক বিধান করিয়া স্টেটসমূহকে বিদেশে বাণিজ্যিক প্রতিনিধি প্রেরণের এবং সংশ্লিষ্ট স্টেটের স্বার্থে বিদেশে বাণিজ্য চুক্তি সম্পাদন করার অধিকার দিতে হইবে।”১২৩
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি দেশ রক্ষার জন্য শাসনতন্ত্র মতে স্টেটসমূহকে আঞ্চলিক সংহতি ও শাসনতন্ত্রের নিরাপত্তা রক্ষার জন্য ‘প্যারা-মিলিটারি বা আঞ্চলিক বাহিনী সংরক্ষণের অধিকার-দানেরও সুপারিশ করেন।১২৪
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন, “লাহাের সম্মেলনের উদ্যোক্তাদের প্রভাবশালী একটি মহল পূর্ব পাকিস্তানের দাবি-দাওয়া আলােচনা তাে দূরের কথা, শুনিতে পর্যন্ত প্রস্তুত না থাকায়। তিনি তাঁর প্রতিনিধিদলসহ সম্মেলনের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করিতে বাধ্য হইয়াছেন।… পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষ পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য দাবি-দাওয়ার প্রতি সহানুভূতিশীল রহিয়াছে বলিয়াই তাহার বিশ্বাস।১২৫
তাসখন্দ ঘােষণা সম্পর্কে সাংবাদিকদের প্রশ্নের উত্তরে শেখ মুজিব বলেন, পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটি কর্তৃক তাসখন্দ প্রশ্ন বিবেচনার পূর্বে এই প্রশ্নে কোনাে মতামত দেওয়ার কোনাে এখতিয়ার তাহার নাই এবং সেজন্যই লাহাের সম্মেলনে এই প্রশ্নে তাহার কোনাে মতামত দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। সম্মেলনে যােগদানের উদ্দেশ্য ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, আশা করা গিয়াছিল যে, এই সম্মেলনে জাতীয় সমস্যাদি পুঙ্খানুপুঙ্খভাবে বিচার-বিশ্লেষণ করা হইবে এবং ভবিষ্যতের জন্য জাতির সামনে সঠিক একটা কর্মসূচি তুলিয়া ধরা হইবে। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে দেখা গেল যে, সম্মেলনের প্রভাবশালী উদ্যোক্তারা সবকিছুই পূর্বাহে সাজাইয়া রাখিয়াছেন এবং দেশের প্রধান প্রধান সমস্যাদির কিছুই তাঁহারা বিচার-বিবেচনা করিতে প্রস্তুত নন।১২৬
————————————
১২৩ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃঃ ২৯৩-২৯৪ (৬৭)।
১২৪ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃঃ ২৯৪ (৬৮)
১২৫ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃঃ ২৯৪ (৬৮)
১২৬ পুর্বোক্ত, (ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃঃ ২৯৪ (৬৮)
————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৮১
বিমানবন্দরে জনৈক সাংবাদিকের এক প্রশ্নের জবাবে শেখ মুজিব বলেন। যে, লাহাের সম্মেলনের সাবজেক্ট কমিটির কাছে তিনি যে ছয় দফা সুপারিশ করিয়াছেন, সেই ছয় দফা অন্তর্ভুক্ত করিয়া গণতান্ত্রিক কোনাে সংগ্রামের জন্য কোনাে প্ল্যাটফরম গঠন করা হইলে তিনি সেই প্ল্যাটফরমের সঙ্গে থাকিবেন। তিনি অবশ্য স্পষ্টভাবেই ঘােষণা করেন যে, রাজনৈতিক দল ভাঙ্গিয়া দিয়া বিভিন্নমুখী মতবাদসম্পন্ন দলসমূহের সঙ্গে মিলিয়া একদল করা সম্ভব নয় এবং সেই প্রশ্নে তিনি সম্মতও নন।১২৭
শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে লাহাের সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে অন্য আরও যারা ছিলেন তারা হলেন-জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরী, জনাব হাফেজ হাবিবুর রহমান, অধ্যাপক ইউসুফ আলী-এমএনএ, জনাব নূরুল ইসলাম-এমএনএ এবং জনাব আবদুল মালেক, এমপিএ।১২৮ ৬ দফা সম্পর্কে শেখ মুজিবুর রহমানের চিন্তাধারা সাংবাদিকদের মাধ্যমে জনগণ এবং সরকারের দৃষ্টিতে গােচরীভূত করার এটিই ছিল প্রথম সার্বিক উদ্যোগ। এর আগে স্বায়ত্তশাসনের দাবি নিয়ে। শেখ মুজিবুর রহমান রাজনৈতিক প্রস্তুতি ধীরে ধীরে গ্রহণ করেন। ১১ই ফেব্রুয়ারি তিনি তা জনসম্মুখে নিয়ে আসেন। সাংবাদিক সম্মেলনের মাধ্যমে ৬ দফার মূল বিষয়বস্তু এবং শেখ মুজিবুর রহমানের ব্যাখ্যা ১২ই ফেব্রুয়ারি। পত্রপত্রিকাসমূহে প্রকাশিত হয়। শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা ঘােষণা করে তার ভিত্তিতে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসন দাবি করেছেন। বলে ইংল্যান্ডের কয়েকটি দৈনিক পত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়।১২৯ ৬ দফার প্রতি সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে একটি দীর্ঘ অভিনন্দনসূচক বিবৃতি প্রদান করা হয়। ১৩ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সম্পাদক জনাব এমএ আজিজ, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব আবদুল্লাহ আল হারুণ, দফতর সম্পাদক জনাব এমএ হান্নান ও কোষাধ্যক্ষ জনাব জানে আলম দোভাষ অদ্য (রবিবার) এক যুক্ত বিবৃতিতে বলেন, সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলন-এ যােগদানকারী আওয়ামী লীগ দলীয়
——————————————
১২৭ পুর্বোক্ত, ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃ. ২৯৪ (৬৮)
১২৮ পুর্বোক্ত, ইত্তেফাক এবং বাংলাদেশ, পৃ. ২৯৪ (৬৯)
১২৯ এম. এ. ওয়াজেদ মিয়া, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে ঘিরে কিছু ঘটনা ও বাংলাদেশ, ইউপিএল, ১৯৯৩, পৃ. ২৪(৬৯)
——————————————
৮২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ও আওয়ামী লীগ দলীয় প্রতিনিধিরা যে সুচিন্তিত ও বলিষ্ঠ ভূমিকা গ্রহণ করিয়াছেন-তাহাতে ইহাই প্রমাণ করে যে, শুধুমাত্র বিরােধিতার খাতিরেই বিরােধিতা করা বা ক্ষমতার লােভে রাজনীতি করা আওয়ামী লীগের উদ্দেশ্য নয় অথবা ঘােলাজলে মাছ। শিকার করার প্রবণতা আওয়ামী লীগের নাই। আমরা আশা করিয়াছিলাম যে, প্রস্তাবিত লাহাের সম্মেলন যুদ্ধ পূর্ব, যুদ্ধকালীন ও যুদ্ধোত্তরকালের দেশের রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক সমস্যাদি সত্যের কষ্টিপাথরে বিচার বিশ্লেষণ করিয়া-দেশকে বাস্তবানুগ নেতৃত্ব দানের কর্মপন্থা নির্ধারিত করিবে। কিন্তু দুর্ভাগ্যের বিষয় লাহাের সম্মেলন যে সাম্প্রতিক তাসখন্দ চুক্তির বিরােধিতা করার উদ্দেশ্যেই আহূত হইয়াছিল ইহাই প্রমাণ হইল। আমরা মনে করি, তাসখন্দ চুক্তি সাম্প্রতিক পাক-ভারত ভয়াবহ যুদ্ধেরই ফলশ্রুতি। পাক-ভারত শান্তিপূর্ণ ও বুন্ধত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠা আওয়ামী লীগ দলের বহু-আকাঙ্ক্ষিত বিলম্বে হইলেও তাসখন্দ চুক্তি পাক-ভারত বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক প্রতিষ্ঠায় সহায়ক হইবে। সুখের বিষয়, ভারতের সহিত বন্ধুত্বপূর্ণ। সম্পর্কের কথা উঠিলে যাহারা তাহা বাঁকা চোখে দেখিতেন ও উহার প্রস্তাবকদের নিন্দা করিতেন, আজ তাহারাও তাসখন্দ চুক্তির অন্যতম প্রবক্তা। বিলম্বে হইলেও বাস্তবতার চাপে তাহাদের যে চক্ষু খুলিয়াছে ইহাই আশার কথা। আজ দেশের আপামর জন সাধারণ ইহাই বুঝিতে পারিয়াছে যে, কোনাে গুরুতর সমস্যারই (কাশ্মীরসহ) সমাধানের পথ বল প্রয়ােগ নয়। আর পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের বিলাসিতাও করিতে পারে না। লাহাের সম্মেলন এর সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করিয়া তাই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ইহাই প্রমাণিত করিল যে, পূর্ব বাংলার সিদ্ধান্ত ও নেতৃত্ব সঠিক পথেই পরিচালিত হইতেছে। তাই আমরা জনাব মুজিবুর রহমান সাহেবকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করিতেছি। পরিশেষে আমরা জনসাধারণের কাছে। আবেদন করিব, লাহাের সম্মেলনে শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক দাবিকৃত ৬ দফা, যথাপূর্ণ গণতন্ত্র কায়েম, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন, আঞ্চলিক রক্ষা ব্যবস্থা ও আঞ্চলিক অর্থনৈতিক বিধিব্যবস্থা, পার্লামেন্টারি শাসন ব্যবস্থা ইত্যাদি কায়েম করার জন্য দুর্বার গণআন্দোলন গড়িয়া তুলুন।১৩০
—————————————-
১৩০ ইত্তেফাক, ১৪ই ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৭০)
—————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৮৩
অন্যদিকে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার ও পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু কিছু রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ ৬ দফাকে পাকিস্তানের অখণ্ডতার প্রতি হুমকি হিসেবে দেখা শুরু করে। ১৪ই ফেব্রুয়ারি করাচিতে ‘পূর্ব পাকিস্তানের আইন ও পার্লামেন্টারি দফতরের মন্ত্রী জনাব আবদুল হাই চৌধুরী গতকল্য এখানে এক বিবৃতিতে আওয়ামী লীগের জেনারেল সেক্রেটারি শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানকে লইয়া কনফেডারেশন গঠনের প্রস্তাবের নিন্দা করেন। জনাব হাই চৌধুরী বলেন যে, অনুরূপ প্রস্তাব দেশদ্রোহিতার নামান্তর। তিনি বলেন, দেশকে খণ্ডবিখণ্ড করার ইহা প্রথম পদক্ষেপ হইবে। মনে হয়, একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে পাকিস্তানের সৃষ্টি যাহারা মানিয়া লইতে পারে নাই তাহাদের সমর্থ নেই শেখ মুজিবের বিবৃতি দেওয়া হইয়াছে এবং পাকিস্তান নস্যাৎ করাই ইহার উদ্দেশ্য।১৩১
আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান তাঁর উত্থাপিত ৬ দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার এবং কিছু কতিপয় রাজনৈতিক নেতার বিরােধিতার জবাবে ১৭ই ফেব্রুয়ারি ঢাকায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তব্য প্রদান করেন। তাতে তিনি ওইসব বিরােধিতার জবাবে বলেন, জাতীয় সংহতি ও সমৃদ্ধি অক্ষুন্ন রাখার জন্য ফেডারেল সরকারের বিভিন্ন ইউনিটে ব্যাপক ক্ষমতা প্রদান করা একটি শাসনতান্ত্রিক কাঠামাে ছাড়া আর কিছুই নহে।১৩২ জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের নেতা আতাউর রহমান খান উদ্ভূত পরিস্থিতিতে যেসব বক্তব্য প্রদান করেন তাহা আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের উত্থাপিত ৬ দফা এবং অন্যান্য বক্তব্যের খুব কাছাকাছিই ছিল। ১৯শে ফেব্রুয়ারি চৌমুহনীতে পাবলিক হলে অনুষ্ঠিত জনসভায় আতাউর রহমান খান যে বক্তব্য দেন তাতে তিনি, পূর্ব পাকিস্তানকে কলােনীরূপে ব্যবহার করার নিন্দা করেন।… ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব লংঘন করার ফলেই পূর্ব পাকিস্তানের ভাগ্যে দুর্দশা নামিয়া আসিয়াছে। সাম্প্রতিক পাক-ভারত যুদ্ধের কারণ ও উহার ফলাফল বর্ণনা প্রসঙ্গে জনাব আতাউর রহমান খান দেশের বর্তমান নেতৃত্বের সমালােচনা করেন। তিনি বলেন, জনসাধারণ এখন বুঝিতে শুরু করিয়াছে যে, বর্তমান। নেতত্বের হাতে দেশের স্বার্থ নিরাপদ নয়। ২১শে ফেব্রুয়ারী দিবস সম্পর্কে
———————————–
১৩১ ইত্তেফাক, ১৫ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৭০)
১৩২ দৈনিক আজাদ, ১৭ ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৭১)
———————————–
৮৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মন্তব্য প্রসঙ্গে জনাব আতাউর রহমান খান বলেন যে, একুশে ফেব্রুয়ারীর আন্দোলন প্রকৃতপক্ষে জনসাধারণের গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামেরই অংশবিশেষ। চলতি একুশে ফেব্রুয়ারী হইতে তিনি গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের সংগ্রাম শুরু করার জন্য জনসাধারণের প্রতি আহ্বান জানান। দেশের শাসনতান্ত্রিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যাসমূহ সমাধানের অদ্য জনাব আতাউর রহমান খান সভায় নিম্নলিখিত পাঁচটি প্রস্তাব পেশ করেন। (ক) কেবিনেট প্রথাসহ দেশে পার্লামেন্টারি সরকার কায়েম, (খ) দেশকে পররাষ্ট্র ও অর্থ দফতর কেন্দ্রের হাতে রাখিয়া প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন প্রদান, (গ) পূর্ব পাকিস্তানের রক্ষাব্যবস্থার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের ওপর নির্ভর না করিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ওপরই নির্ভর করা, (ঘ) পাকিস্থানে দুইটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা স্বীকার করিয়া লওয়া, (ঙ) কোনাে শক্তিজোটে যােগদান না করা।১৩৩ আতাউর রহমান খানের উত্থাপিত ৫ দফায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের। উত্থাপিত ৬ দফার অনেকগুলাে উপাদান উপস্থিত ছিল। তখনও পর্যন্ত আতাউর রহমান খান ছাড়া পূর্ব পাকিস্তানের অন্যকোন রাজনৈতিক দলের বক্তৃতা বিবৃতিতে ৬ দফার সমর্থন কিংবা অনরূপ দাবিনামা সম্বলিত কোনাে বক্তব্য দেখা যায়নি।
অন্যদিকে শেখ মুজিবুর রহমান ২০শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ আওয়ামী লীগের ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা তাঁর ধানমন্ডিস্থ (বাড়ি নং-৬৭৭, রােড নং-৩২) বাসভবনে আহ্বান করেন। দিনব্যাপী অনুষ্ঠিত ওয়ার্কিং কমিটির এই সভায় শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ৬ দফা, লাহাের সম্মেলন, তাসখন্দ ঘােষণা, ভারত-পাকিস্তান দ্বন্দ্ব এবং রাজনৈতিক করণীয় সম্পর্কে দলীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য আলােচনা করেন। এই সভায় ওয়ার্কিং কমিটির সদস্য ছাড়া জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ সদস্য এবং জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকরা বিশেষ দায়িত্ব ও আগ্রহ সহকারে বিশেষ আমন্ত্রণক্রমে এই বৈঠকে যােগদান করেন। প্রায় ১৫ ঘণ্টাব্যাপী ওয়ার্কিং কমিটির সভা চলে। এতে উল্লেখিত বিষয়সমূহের ওপর আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দ চুলচেরা বিশ্লেষণ ও মতামত
——————————————
১৩৩ দৈনিক আজাদ, ১৯শে ফেব্রুয়ারি, ১৯৬৬ (৭১)
——————————————
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৮৫
প্রদান করেন। ৬ দফার প্রতি তাদের সমর্থন প্রদানসহ অনুমােদন প্রদান করা হয়। এতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি-সংবলিত আওয়ামী লীগের এই ৬ দফার দলীয় ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ সহকারে পুস্তিকা প্রকাশ করে দেশবাসীর মধ্যে বিতরণ করার সিদ্ধান্তও গ্রহণ করা হয়।১৩৪ পুস্তিকার খসড়া ও প্রকাশের জন্য ৬ সদস্যবিশিষ্ট একটি শক্তিশালী কমিটি গঠন করা হয়। এরা হলেন-বিশিষ্ট আওয়ামী লীগ নেতা ও হাইকোর্ট বার সমিতির সভাপতি জনাব আবদুস সালাম খান, শেখ মুজিবুর রহমান, জনাব জহিরুদ্দীন, জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, হাফেজ হাবিবুর রহমান এবং রাজশাহী জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব মুজিবুর রহমান।১৩৫ দলের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান দেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতির সঙ্গে বিরােধীদলীয় নেতৃবৃন্দের সাক্ষাৎকার এবং সাম্প্রতিক লাহাের সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রতিনিধিদলের যােগদান ও সম্মেলনের সঙ্গে সর্বপ্রকার সম্পর্কচ্ছেদ প্রভৃতি বিষয়ে ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে যােগদানকারীদের অবহিত করান।১৩৬
ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে তাসখন্দ চুক্তি সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সুস্পষ্ট অভিমত প্রকাশ করিয়াছেন। তাসখন্দ ঘােষণাপত্র সম্পর্কে মতামত দান প্রসঙ্গে গৃহীত প্রস্তাবে দেশে ব্যক্তিকেন্দ্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েম রাখা এবং এই ধরনের ব্যবস্থা কায়েম রাখার ফলে উদ্ভূত বিভিন্ন পরিস্থিতির তীব্র সমালােচনা করা হয়। ব্যক্তিকেন্দ্রিকশাসনব্যবস্থার দোষ-ত্রুটি ও বিপদ-আপদ হইতে দেশ ও দেশবাসীকে অব্যাহতি দানের জন্য পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ বর্তমান শাসনতান্ত্রিক ও অপ্রতিনিধিত্বশীল শাসনব্যবস্থার অবসানকরতঃ জনসাধারণের ইচ্ছাকে। সার্বিক প্রাধান্য দিয়া দেশে পূর্ণ গণতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা কায়েমের জোর দাবি জাইয়াছেন।’
ওয়ার্কিং কমিটির গৃহিত প্রস্তাবে বলা হয়, ‘তাসখন্দ ঘােষণাপত্র পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে সৎ-প্রতিবেশীসুলভ সম্পর্কে প্রতিষ্ঠার ব্যাপারে
——————————–
১৩৪ ইত্তেফাক, ২২শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ দেখুন, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক ও অন্যান্য (সম্পাদিত), বাংলাদেশ : প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাৎকার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিকলা একাডেমি, ২০১৭ ঢাকা, পৃ. ২৯৫ (৭২)
১৩৫ পূর্বোক্ত (৭২)।
১৩৬ পূর্বোক্ত (৭২)
——————————–
৮৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
কার্যকর নাও হইতে পারে বলিয়া পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি মনে করে। পাকিস্তান-ভারতের মধ্যকার কাশ্মীরসহ সকল সমস্যা সমাধানকল্পে দুই দেশই তাসখন্দ ঘােষণাপত্রকে উহার অন্তর্নিহিত তাৎপর্যমতে কার্যকরী করার প্রয়াস পাইবে বলিয়া ওয়ার্কিং কমিটি আশাবাদ প্রকাশ করিয়াছে।১৩৭ ওয়ার্কিং কমিটিতে ৬ দফার প্রতি সমর্থন ছাড়াও এটিকে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয় এবং আওয়ামী লীগের জাতীয় কংগ্রেসকে সফল করার জন্য দলীয় নেতৃবৃন্দ তৃণমূল থেকে আওয়ামী লীগকে সুসংগঠিত করার উদ্যোগ গ্রহণ করেন। বলা চলে আওয়ামী লীগ ৬ দফা প্রদানের মাধ্যমে পাকিস্তানের রাজনীতিতে যে আলােড়ন সৃষ্টি করেছিল সেটি ওয়ার্কিং কমিটির সিদ্ধান্ত হিসেবে গৃহীত হওয়ার পর নতুন মাত্রা লাভ করে, দলের অভ্যন্তরে ৬ দফা সম্পর্কে দ্বিধা-দ্বন্দ্ব দ্রুত নিরসন হতে থাকে। ৬ দফাকে জনগণের কাছে দ্রুত নিয়ে যাওয়ার জন্য আওয়ামী লীগ সম্মেলন অনুষ্ঠানের উদ্যোগ গ্রহণ করে। সম্মেলন আওয়ামী লীগকে নতুন নেতৃত্ব প্রদান এবং কর্মসূচি গ্রহণের যে সুযােগ দেবে সেটি আন্দোলন সংগ্রামের নিয়মতান্ত্রিক ধারা তৈরিতে শক্তি জোগাবে-এমন উপলব্ধি থেকেই শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুত দলকে এবং জনগণকে ৬ দফা কেন্দ্রিক একাত্ম করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নামেন। ওয়ার্কিং কমিটির সভার পর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে সর্বপ্রথম চট্টগ্রাম জেলা কমিটির সম্মেলনে নেতৃবৃন্দ যােগদান করেন। সেখানে ২৬শে ফেব্রুয়ারি অনুষ্ঠিত উক্ত সম্মেলনে বলা হয়, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে-শক্তিশালী পাকিস্তানই ছিল দেশবাসীর বরাবরের কাম্য। কিন্তু স্বার্থান্বেষী মহলের স্বার্থ ও চক্রান্তের মারপ্যাচে জনগণের সে কামনা বরাবরই স্তিমিত হইয়া পড়িয়াছে। এবার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের সহিত মাত্র ১৭ দিনের যুদ্ধে দেশবাসী যে অভিজ্ঞতা লাভ করিয়াছে, সেই সাক্ষাৎ অভিজ্ঞতার পরিপ্রেক্ষিতেই দেশবাসী আজ নতন করিয়া অনুধাবন করিয়াছে যে, শক্তিশালী কেন্দ্রীয় সরকার নহে-কেবলমাত্র শক্তিশালী পাকিস্তানই পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের নিবিড় ঐক্য ও সংহতির একমাত্র রক্ষাকবচ। আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি প্রকৃত প্রস্তাবে
——————————————–
১৩৭ পূর্বোক্ত, পৃ: ২৯৫-২৯৬ (৭৩)
——————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৮৭
দেশবাসী জনসাধারণের ঈপ্সিত সেই শক্তিশালী পাকিস্তানেরই সুস্পষ্ট রূপরেখা। রাষ্ট্র ও সমাজ-জীবনে এই রূপরেখার বাস্তবায়নের জন্য আওয়ামী লীগের ৬ দফার বাণী লইয়া গ্রামে গ্রামে আপনারা ছড়াইয়া পড়ন।… স্থানীয় জেএম সেন হলে চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের বার্ষিক সম্মেলন ও কাউন্সিল সভায় সমাগত সহস্রাধিক আওয়ামী লীগ কর্মীর উদ্দেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান এই উদাত্ত আহ্বান জানান। পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, অতীতের মতাে ভবিষ্যতেও গণতন্ত্রকে যাতে কায়েমী স্বার্থের শিকারে পর্যবসিত হইতে না হয়, দেশবাসীকে যাতে গণতন্ত্র কায়েম থাকা অবস্থায়ও মহল বিশেষের অনুগ্রহ বা অনুকম্পার ওপর নির্ভর করিতে না হয়, গণতন্ত্র মতে প্রতিষ্ঠিত সরকারকে যাতে ব্যক্তি বা গােষ্ঠী বিশেষ নিজের বা নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য খতম করিতে না পারে, সর্বোপরি গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা সম্ভব হইলে দেশবাসী যাতে অনন্তকাল ধরিয়া স্বাধীনতার সত্যিকারের স্বাদ জীবনের সর্বস্তরে ভােগ করিতে পারে, তার জন্যই আওয়ামী লীগ গত ১৮ বৎসরের শাসন ও শােষণের, নির্যাতন ও বঞ্চনার আলােকে পূর্ব পাকিস্তানের মুক্তিসনদ ৬ দফা প্রণয়ন করিয়াছে।”১৩৮
চট্টগ্রাম জেলা সম্মেলনে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফা এবং অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে একটি নীতিনির্ধারণী বক্তব্য প্রদান করেন। তাতে তিনি বেশকিছু প্রশ্নের উত্তর প্রদান করেন। বিষয়গুলাে সেই সময়ের রাজনীতি, শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার আন্দোলন, দষ্টিভঙ্গি, অন্যান্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পর্ক প্রসঙ্গে স্পষ্ট ধারণা লাভের জন্য খুবই জরুরি। সেই বিবেচনা থেকে আমরা জনাব শেখ মুজিবুর রহমানের প্রদত্ত ভাষণের পরবর্তী অংশ তুলে ধরছি। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন কী?-এই প্রসঙ্গে শেখ মুজিব বলেন, এ যাবৎ আমরা পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের কথা বলিয়াছি, কিন্তু পরিতাপের বিষয় এই যে, আমাদের এই আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবির তাৎপর্য বা অন্তর্নিহিত লক্ষ্য সম্পর্কে পশ্চিম পাকিস্তানের এবং পূর্ব পাকিস্তানের কোনাে কোনাে নেতা কোনােদিন আগ্রহ প্রকাশ করেন নাই। তাই, আজ আমরা সংশ্লিষ্ট সকলের
————————————
১৩৮ ইত্তেফাক, ২৭শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৭৪)
————————————
৮৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
অবগতির জন্য ৬ দফার মধ্য দিয়া স্পষ্ট করিয়া বলিয়া দিয়াছি যে, আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে আমরা কি বুঝি। দেশবাসীকে কেবল ধোকা দিবার নিমিত্ত আজও যারা আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের ফাঁকা স্লোগান তােলেন, তাদের বুঝা উচিত যে, ফাঁকা বুলির যুগ শেষ হইয়াছে। আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন অর্থে তারা কি বােঝেন বা বুঝাইতে চাহেন, আওয়ামী লীগের ৬ দফার পাশাপাশি দফা-ওয়ারীভাবে আজ তাহাদিগকে তাহা স্পষ্ট করিয়া বলিতে হইবে। যদি তাহারা তাহা না করেন, তাহা হইলে তাহাদের কথাকে দেশবাসী রাজনৈতিক কারচুপি এবং পূর্ব পাকিস্তানকে ভাওতা দেওয়ার আরেক দফা নতুন প্রয়াস বলিয়া গণ্য করিবে। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযােগ্য যে, জেলার দূরবর্তী এলাকা হইতে আগত এক সহস্রাধিক সঙ্কল্পদৃঢ় আওয়ামী লীগ কর্মীর সমাবেশে শেখ সাহেব বক্তৃতা করিতেছিলেন। বৈষম্যের প্রশ্নে জাতিসংঘ বিশেষজ্ঞদের লইয়া কমিশন গঠনের দাবি-শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বর্তমান শাসনতন্ত্রে দুই প্রদেশের মধ্যকার অর্থনৈতিক বৈষম্য স্বীকার এবং উহা দূরীকরণের অঙ্গীকার করা হইলেও বাস্তবক্ষেত্রে বৈষম্য হ্রাস পাইতেছে না। তিনি বলেন যে, বর্তমানে বরং অধিকতর নৈপুণ্যের সঙ্গে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতেই দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্য বৃদ্ধি পাইতেছে। শেখ মুজিব বলেন যে, স্বাভাবিকতার কদর থাকিলে তিনি এ ব্যাপারে তদন্ত কমিশনই দাবি করিতেন। কিন্তু বর্তমান সরকারের আমলে বিভিন্ন কমিশনের রিপাের্ট যেভাবে দিবালােকের মুখ দেখিবার মওকা পায় না, এবং এই সেদিনও ঈদের চাঁদ সংক্রান্ত ব্যাপারে গঠিত কমিটির ৭ দিনের মধ্যে রিপাের্ট পেশের ব্যাপারটিও যেভাবে ধামাচাপা পড়িয়াছে। তাহাতে তিনি আর তদন্ত কমিশন দাবি করেন না। তৎপরিবর্তে তিনি জাতিসংঘের বিশেষজ্ঞদের লইয়া একটি নিরপেক্ষ তদন্ত কমিশন গঠন। করিয়া দুই প্রদেশের অর্থনৈতিক বৈষম্যের হিসাব করার ব্যবস্থা করার জন্য সরকারের নিকট দাবি জানানই বাঞ্ছনীয় মনে করেন। অন্যান্য দল সম্পর্কে আওয়ামী লীগের নীতি-অন্যান্য রাজনৈতিক দলের প্রতি আওয়ামী লীগের নীতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবর রহমান বলেন যে, যেসব দল ৬ দফায় বর্ণিত দাবি-দাওয়ার স্বীকৃতি দিবেন, সেই সব দলের সঙ্গে সহযােগিতা করিতে আওয়ামী লীগ সর্বদাই প্রস্তুত। এমনকি পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক মুক্তি এবং অন্যান্য দাবি পূরণের ব্যাপারে অপর কোনাে রাজনৈতিক দল
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৮৯
আমাদের এই ৬ দফা অপেক্ষাও উন্নত কোনাে প্রস্তাব পেশ করিতে পারিলে আওয়ামী লীগ সানন্দে তাহা বিবেচনা করিতে প্রস্তুত বলিয়া শেখ মুজিব ঘােষণা করেন। তিনি ঘরে ঘরে ৬ দফার বাণী পৌছাইয়া দেওয়ার জন্য আওয়ামী কর্মীদের প্রতি আহ্বান জানান।… সম্মেলনে জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিশদ বিবরণ দেন। সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি অধ্যাপক নুরুল ইসলাম। সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে চট্টগ্রাম শিল্প ও বণিক সংঘের প্রাক্তন সভাপতি জনাব মােহাম্মদ ইদ্রিস বলেন যে, মরহুম সােহরাওয়ার্দীর মাত্র ১৩ মাসব্যাপী প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে শিল্পকে প্রাদেশিক বিষয় করার ফলেই আজকাল শিল্পবাণিজ্য ক্ষেত্রে দুই-চারজন বাঙালি দৃষ্ট হয়। সম্মেলনে ডা. সৈয়দুর রহমান ও জনাব আবদুল্লাহ আল হারুণও বক্তৃতা করেন। চট্টগ্রামের চারণ কবি জনাব মােহাম্মদ শফি ৬ দফার ওপর রচিত কবিতা সম্মেলনে পাঠ করিয়া শুনান। উক্ত চারণ কবি লালদীঘির গত শুক্রবারের জনসভায়ও ৬ দফা ভিত্তিক গান পরিবেশন করেন। জনাব শফির গানে সন্তুষ্ট হইয়া শেখ মুজিবর রহমান তাহাকে ৫০ টাকা পুরস্কার দেন। মাইজদী যাত্রা-চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কাউন্সিল সম্মেলন শেষে শেখ মুজিবর রহমান অন্যান্য আওয়ামী লীগ নেতা সমভিব্যাহারে আগামীকল্য (২৭শে ফেব্রুয়ারি) ভােরে মাইজদী রওয়ানা হইতেছেন। অদ্য (রবিবার) সকালে তিনি মাইজদী কোর্টে নােয়াখালী জেলা আওয়ামী লীগ সম্মেলনে যােগদান করিবেন এবং বিকালে বেগমগঞ্জে এক জনসভায় বক্তৃতা করিবেন।১৩৯
২৭শে ফেব্রুয়ারি মাইজদী কোর্ট টাউন হলে আওয়ামী লীগের নােয়াখালী জেলা সম্মেলনে প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক শেখ মুজিবুর রহমান। সম্মেলনে বক্তৃতা প্রদানকালে তিনি বলেন, আমরা আর নেতাদের ঐক্যে বিশ্বাস করি না। আমরা জনগণের ঐক্যে বিশ্বাসী এবং জনগণের ঐক্য কায়েমের প্রত্যাশী। আমরা চাই তথাকথিত প্রাসাদ-ষড়যন্ত্রের রাজনীতির অবসান ঘটক এবং রাজনীতি সাধারণ মানুষের অধিকারে আসক। বিবেকের
————————————-
১৩৯ পূর্বোক্ত (৭৬)।
————————————-
৯০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
দংশন যিনি অনুভব করেন, আসুন-আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচিকে সমুন্নত করিয়া তুলুন।… হলে উপস্থিত হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে জনতা বিপুল হর্ষধ্বনি ও করতালি সহকারে শেখ মুজিবকে সম্বর্ধনা জ্ঞাপন করেন। নােয়াখালী জেলার ১৬টি থানা হইতে প্রায় ৩ শত প্রতিনিধি এই সম্মেলনে যােগদান করিয়াছেন। সম্মেলন দৃষ্টে প্রতীয়মান হয় যে, আওয়ামী লীগের ৬ দফা কর্মসূচি প্রদেশের ঘরে ঘরে আলােড়ন সৃষ্টি করিতে সক্ষম হইয়াছে এবং কর্মিগণ যেকোনাে ত্যাগের বিনিময়ে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসন অর্জনে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বক্তৃতা প্রসঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান কর্মীদের প্রতি ঘরে ঘরে ৬ দফার বাণী পৌছাইয়া দেওয়ার আহ্বান জানান। প্রয়ােজন হইলে কর্মীদের স্বেচ্ছায় কারাবরণ করার জন্য তিনি কর্মীদের প্রস্তুত থাকিতে পরামর্শ দেন। তিনি বলেন যে, যেদিন এই ছয় দফার জন্য একজন কর্মীও গ্রেফতার হইবেন, সেইদিন যেন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি কারাগার কর্মীদের দ্বারা ভরিয়া যায়।১৪০
প্রদেশব্যাপী ৬ দফার প্রচার আরও ব্যাপকতর করার লক্ষ্যে মার্চ মাসের ১৮, ১৯ ও ২০ তারিখ ঢাকায় সম্মেলন অনুষ্ঠানে প্রস্তুতি জোরদার করা হয়। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিপুল সংখ্যক নেতাকর্মী ঢাকা আসার প্রয়ােজনীয় সাংগঠনিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়। ৬ দফাকে এই সম্মেলনে দলের নতুন কর্মসূচি হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার জন্য আওয়ামী লীগ সকল শক্তি নিয়ােগ করে। এরই প্রতিফল দেখা যায় সম্মেলনে।
১৯৬৬ সালের ১৮ই মার্চ বিকাল ৩টায় ঢাকার মতিঝিলস্থ ইডেন হােটেল প্রাঙ্গণে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী জাতীয় সম্মেলন শুরু হয়। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে আওয়ামী লীগের সভাপতি মওলানা আবদুর রশীদ তর্কবাগীশের অসুস্থতার কারণে সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম এডভােকেট সভাপতিত্ব করেন। এটি উদ্বোধন করেন তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান হাইকোর্ট বার সমিতির সভাপতি এডভােকেট আবদুস সালাম খান। করাচি আওয়ামী লীগ সভাপতি মিয়া মনজুরুল হক ও সাধারণ সম্পাদক খলিল আহমদ তিরমিজি কাউন্সিলে অংশগ্রহণ করেন। এতে দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ১৪৪৩ জন কাউন্সিলার ও ডেলিগেট অংশগ্রহণ করেন। সম্মেলনটি আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক ইতিহাসের
————————————————-
১৪০ ইত্তেফাক, ২৮শে ফেব্রুয়ারি ১৯৬৬ (৭৭)
————————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৯১
জন্যই শুধু নয়, পূর্ব পাকিস্তানের স্বায়ত্তশাসনসহ রাজনৈতিক অর্জনকে সুদূর প্রসারির লক্ষ্যে বাঁক পরিবর্তনের একটি তাৎপর্যপূর্ণ ঘটনা হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
১৮ই মার্চ উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে শেখ মুজিবুর রহমান ‘আমাদের বাঁচার দাবি’ (দেখুন পরিশিষ্ট-৪) শিরােনামে ৬ দফার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ উপস্থাপন করেন। দলিলটি ওয়ার্কিং কমিটিতে গঠিত বিশেষ কমিটি কর্তৃক প্রণীত ও অনুমােদিত ছিল। এতে শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফার পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্যা ও বিশ্লেষণ ছাড়াও অপব্যাখ্যাকারীদের ব্যাখ্যার জবাব তিনি সম্মেলনে উপস্থাপন করেন। এতে তিনি প্রতিটি দফার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক বাস্তবতা একজন রাজনীতিবিদ হিসেবে তুলে ধরেন। দীর্ঘ এই দফাওয়ারি বক্তব্য উপস্থিত নেতৃবৃন্দ গভীর মনােযােগের সঙ্গে শােনেন।
দীর্ঘ এই আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমান ৬ দফার বিরুদ্ধচারীদের নানা সমালােচনার জবাব দিয়েছেন। এবং একই সঙ্গে রাজনীতিতে প্রতিক্রিয়াশীল ও অতি প্রগতিশীলদের চরিত্র উন্মােচন করেছেন। তিনি স্পষ্ট উল্লেখ করেছেন, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্যদাবির কথা বলিতে গেলে। দেশদ্রোহিতার বদনাম ও জেল-জুলুমের ঝুঁকি লইয়াই সে কাজ করিতে হইবে। অতীতে এমন অনেক জেল-জুলুম ভুগিবার তকদির আমার হইয়াছে। মুরব্বিদের দোয়ায়, সহকর্মীদের সহৃদয়তায় এবং দেশবাসীর সমর্থনে সেসব সহ্য করিবার মতাে মনের বল আল্লাহ আমাকে দান করিয়াছেন। সাড়ে পাঁচ কোটি পূর্ব পাকিস্তানির ভালােবাসাকে সম্বল করিয়া আমি এ কাজে যেকোনােও ত্যাগের জন্য প্রস্তুত আছি।১৪১ ১৯শে মার্চ ১৯৬৬ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ কাউন্সিল ৬ দফা দাবিকে আনুষ্ঠানিক অনুমােদন দান করে। এটিকে সম্মেলন দলীয় ম্যানিফেস্টোতে অন্তর্ভুক্ত করে। ১৯শে মার্চ সম্মেলনের দ্বিতীয় অধিবেশন রাত দশটায় শেষ হয়। অধিবেশন শেষে নেতাকর্মীদের মধ্যে বিপুল উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। কর্মীরা ৬ দফার কর্মসূচি নিয়ে সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ার নতুন উদ্যম এই সম্মেলনে লাভ করে। সম্মেলনে আগত নেতাকর্মীরা পারস্পরিক দেখা-সাক্ষাৎ ভাবের আদান-প্রদানের মধ্য দিয়ে আওয়ামী লীগ কর্মীরা
——————————————
১৪১ শেখ মুজিবুর রহমান, আমাদের বাঁচার দাবি, কাউন্সিলে উত্থাপিত ৬ দফা পুস্তিকা, ১৯৬৬, ঢাকা, বাংলাদেশের স্বাদীনতা যুদ্ধ দলিলপত্র : দ্বিতীয় খণ্ড
——————————————
৯২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
তাদের আত্মীয়তাকে আরও নিবিড় করার সুযােগ লাভ করে। সম্মেলনে ৬ দফা এবং গৃহীত কর্মসূচিতে তারা আরও আত্মপ্রত্যয়ের সঙ্গে সংগ্রাম করার অনুপ্রেরণায় অনুপ্রেরিত হন।১৪২
সম্মেলনে নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব জহিরুদ্দীন ৬ দফা সম্পর্কে বক্তব্য দানকালে বলেন, ক্ষমতাসীনদের প্রতি টেলিভিশন বা জনসভার ৬ দফা প্রশ্নের আওয়ামী লীগের সঙ্গে প্রত্যক্ষ বিতর্কে অবতীর্ণ হইতে আহ্বান জানান। তিনি যেকোনাে কেন্দ্রীয় মন্ত্রীকে ৬ দফার দফাওয়ারি জবাব দানের চ্যালেঞ্জ দান করেন। জনাব জহিরুদ্দীন ৬ দফা দাবি সম্পর্কে ব্যক্তিগত পর্যায়ে বা প্রকাশে যেকোনাে আলােচনায় অংশগ্রহণের জন্য সকলের প্রতি আহ্বান জানান। ৬ দফা না পড়িয়া বা উহার মর্ম উপলব্ধি না করিয়া যাহারা উহার সমালােচনা করিতেছেন, তিনি তাহাদের এহেন কাজের নিন্দা করেন। তিনি বলেন যে, ইহাতে কোনাে ফলােদয়-তাে হইবেই না, বরং হিংসা-দ্বেষের সষ্টি হইবে।১৪৩
১৯শে মার্চ কাউন্সিল সর্বসম্মতভাবে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি পদে শেখ মুজিবুর রহমান, সহ-সভাপতি পদে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, হাফেজ হাবিবুর রহমান এবং মুজিবুর রহমান (রাজশাহী), সাধারণ সম্পাদক পদে তাজউদ্দীন আহমদ, সাংগঠনিক সম্পাদক পদে মিজানুর রহমান এমএলএ, শ্রম সম্পাদক পদে জহুর আহমদ চৌধুরী, প্রচার সম্পাদক পদে আবদুল মােমেন এডভােকেট, মহিলা সম্পাদিকা পদে মিসেস আমেনা বেগম, অফিস সম্পাদক জনাব মােহাম্মদ উল্লাহ, সমাজকল্যাণ সম্পাদক পদে কে এম ওবায়দুর রহমান এবং কোষাধ্যক্ষ পদে জনাব নূরুল ইসলাম চৌধুরীকে নির্বাচিত করে। সিদ্ধান্ত হয় যে পরে সভাপতি কার্যকরী সংসদের ২৬ জন সদস্য মনােনয়ন প্রদান করবেন।১৪৪ সভাপতি পদে নির্বাচিত হওয়ার পর ওই দিন শেখ মুজিবুর রহমান কাউন্সিল অধিবেশনে যে নীতিনির্ধারণী বক্তব্য প্রদান করেছিলেন তাতে তিনি উল্লেখ করেন, ‘সমগ্র পাকিস্তানের সার্বিক কল্যাণ সাধন, বিশেষ করিয়া সমগ্র দেশে একটি শােষণহীন সমাজব্যবস্থা কায়েমই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের
———————————–
১৪২ পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৭ (৭৯) ১৪৩ পূর্বোক্ত, পৃ. ৩০৮ (৭৯) ১৪৪ ইত্তেফাক, ২০ মার্চ ১৯৬৬ (৭৯)
———————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৯৩
মুখ্য উদ্দেশ্য। এই উদ্দেশ্য হাসিলের জন্যই পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ৬ দফা প্রণয়ন করিয়াছে এবং সমাজতন্ত্রবাদী কর্মসূচি গ্রহণ করিয়াছে।১৪৫
তিনি আরও বলেছেন, আওয়ামী লীগ কর্মীদের স্মরণ রাখিতে হইবে যে, ৬ দফার মাধ্যমে আওয়ামী লীগ আজ যে সংগ্রামের পথে পা বাড়াইয়াছে, সে পথ কণ্টকাকীর্ণ এবং এই পথে সাফল্য অর্জন সময় সাপেক্ষ। তবে, ছয় দফার বিরুদ্ধে আজ যেসব মহল দায়িত্বহীন প্রচারণায় লিপ্ত আছেন, একদিন-না-একদিন তারা তাদের ভুল বুঝিতে পারিবেন।… পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ একদিন-না-একদিন ছয় দফা দাবিকে তাদেরও নিজেদের দাবি বলিয়াই মানিয়া লইবেন।১৪৬
বস্তুত ইডেন হােটেল চত্বরে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগের তিন দিনব্যাপী সম্মেলন রাজনৈতিক কর্মসূচি এবং নেতৃত্ব নির্বাচন দেশের রাজনৈতিক একটি বাক পরিবর্তনের সূচনা করে। শেখ মুজিবসহ নির্বাচিত নেতৃবৃন্দ ৬ দফাকে প্রদেশের স্বায়ত্তশাসনের সনদ হিসেবে প্রতিষ্ঠার কর্মসূচি গ্রহণ করে আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েন। সম্মেলনটি এক অর্থে ৬ দফার রাজনৈতিক কর্মসূচি গ্রহণ এবং আন্দোলনের দিকনির্দেশনার সম্মেলনে পরিণত হয়।
সম্মেলনের শেষ দিন ২০শে মার্চ বিকেলবেলা পূর্ব নির্ধারিত জনসভা অনুষ্ঠিত হয় পল্টন ময়দানে। দৈনিক ইত্তেফাক পত্রিকায় এই জনসভার বিবরণ প্রকাশ করে এভাবে, ‘প্রকৃতির উদ্দাম তাণ্ডবকে স্তব্ধ করিয়া সভায় সমাগত বিপুল জনতার উদ্দেশে তুমুল করতালি ও হর্ষধ্বনির মধ্যে দৃপ্তকণ্ঠে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের নবনির্বাচিত সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান ঘােষণা করেন, নিজেদের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে পূর্ব পাকিস্তানের সাড়ে ৫ কোটি মানুষের চোখে-মুখে আজ যে বিরাট জিজ্ঞাসা, কুসুমাস্তীর্ণ পথে সে জিজ্ঞাসার জবাব মিলিবে না-এ জিজ্ঞাসার জবাব পাইতে হইলে জেল- জুলুম-অত্যাচার-নির্যাতনকে আশীর্বাদ বলিয়া বরণ করিতে হইবে। প্রয়ােজন হইলে মৃত্যুকে আলিঙ্গনের জন্যও প্রস্তুত থাকিতে হইবে। সাড়ে ৫ কোটি মানুষের ভাগ্য ও দেশের দুই অংশের বৃহত্তর ঐক্য ও সংহতির জন্য চরম ত্যাগ স্বীকারের প্রস্তুতির এই বাণী লইয়া আপনারা দিকে দিকে ছড়াইয়া পড়ন, পূর্ব পাকিস্তানের প্রত্যন্ত প্রদেশের প্রতিটি মানুষকে জানাইয়া
————————————————-
১৪৫ ঐ (৭৯)
১৪৬ ঐ (৮০)।
————————————————-
৯৪ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
দিন, দেশের জন্য, দশের জন্য, অনাগতকালের ভাবী বংশধরদের জন্য সবকিছু জানিয়া শুনিয়াই আওয়ামী লীগের নেতা ও কর্মীরা এবার সর্বস্বপণ করিয়া নিয়মতান্ত্রিক পথে ছয় দফার ভিত্তিতে দেশব্যাপী আন্দোলনের জন্য আগাইয়া আসিয়াছে।১৪৭
৬ দফাকে কেন্দ্র করে পাকিস্তানের রাজনীতি কয়েকদিনের মধ্যেই আলােচনা-সমালােচনায় মুখরিত হয়ে ওঠে। আওয়ামী লীগের সম্মেলনের প্রাক্কালেই পশ্চিম পাকিস্তানের বেশিরভাগ রাজনৈতিক দলের নেতৃবৃন্দ আওয়ামী লীগ নেতা শেখ মুজিবুর রহমান এবং আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে তীব্র সমালােচনা করে বক্তব্য প্রদান শুরু করেন। এর থেকে বাদ যাননি স্বয়ং প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান, পররাষ্ট্র মন্ত্রী হিসেবে জুলফিকার আলী ভুট্টোও। পূর্ব পাকিস্তানেও ডানপন্থার মুসলিম লীগ, জামায়াত ইসলাম, নেজামে ইসলাম ৬ দফার বিরুদ্ধে সােচ্চার হয়ে ওঠে। এতে বাদ যায়নি। বাম রাজনীতির অন্যতম নেতা মাওলানা ভাসানীসহ উগ্র হঠকারী বাম দল ও নেতৃবৃন্দ। এদের সকলের অভিযােগের জবাব দিয়েছিলেন শেখ মুজিবুর রহমান সম্মেলনে তাঁর পঠিত (আমাদের বাঁচার দাবি) বক্ততায়। এরপর। দেশব্যাপী দলীয় প্রধান হিসেবে শেখ মুজিব যে ঝটিকা সফর শুরু করেন সেখানেও তিনি তাদের সকল অভিযােগের জবাব প্রদান করেন। এমনকি জুলফিকার আলী ভুট্টোকে তিনি বাহাস করার জন্য যেকোনাে স্থানে হাজির হওয়ার জন্য আমন্ত্রণও জানিয়েছিলেন। সেজন্য তিনি নবনির্বাচিত সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদকে দায়িত্ব প্রদান করেছিলেন যেন জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের সঙ্গে ৬ দফার ওপর আলােচনায় সম্মত হয়ে। ঢাকায় আসা মাত্রই তাকে খবর দেওয়া হয়। শেখ মুজিব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন জনসভার যেকোনাে কর্মসূচি স্থগিত রেখে তিনি ভুট্টোর সঙ্গে বাহাসে অংশ নিতে তাৎক্ষণিকভাবে ঢাকায় ছুটে আসবেন। বিষয়টি পাকিস্তানের গণমাধ্যমে ব্যাপকভাবে প্রচারিত হয়েছিল। কিন্তু জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবুর রহমানের চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করেননি। ঢাকা অনুষ্ঠিত সম্মেলন শেষে শেখ মুজিবুর রহমান আওয়ামী লীগের সম্মেলনে গৃহীত
————————————————-
১৪৭ ইত্তেফাক, ২১ মার্চ ১৯৬৬, দেখুন, বাংলাদেশ, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক, পৃ. ৩১২ (৮০)
————————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৯৫
কর্মসূচি ও ৬ দফাকে জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য দেশব্যাপী সফর শুরু করেন। ২৫শে মার্চ তিনি চট্টগ্রাম জেলা আওয়ামী লীগ কর্মী সমাবেশে যােগদান করেন। সেখানে তিনি বলেন, ছয় দফা দাবি কায়েমি স্বার্থের মূলে আঘাত হানিয়াছে বলিয়াই কোনাে কোনাে মহল উহার বিরুদ্ধে বিভিন্ন কথা বলিতেছে। প্রেসিডেন্ট গৃহযুদ্ধ ও অস্ত্রের ভাষা সম্পর্কে যে মন্তব্য করিয়াছেন,… প্রেসিডেন্টের ন্যায় দায়িত্বসম্পন্ন ব্যক্তি এই সকল কথা বলায় এই কথাগুলাে বিশ্বাস করা ছাড়া উপায় নাই।১৪৮
চট্টগ্রাম থেকে ২৫শে মার্চ শেখ মুজিবুর রহমান সন্দ্বীপে রওনা করেন। ২৬শে মার্চ সেখানে অনুষ্ঠিত জনসভায় শেখ মুজিব ৬ দফা সম্পর্কে বলেন, ‘বঙ্গোপসাগরের বিধ্বংসী গ্রাস আর ভয়াল প্রকৃতির উদ্দামতার হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য দ্বীপাঞ্চলীয় জনসাধারণের যেমন উপকূলীয় বাঁধ অতীব প্রয়ােজন, ঠিক তেমনই কায়েমি স্বার্থবাদীদের শােষণের হাত হইতে রক্ষা পাওয়ার জন্য সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানের একটি নিরাপত্তা বাঁধের প্রয়ােজন দেখা দিয়াছে। অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক দিক দিয়া পূর্ব পাকিস্তানের ওপর যে সর্বনাশ নামিয়া আসিয়াছে, সেই সর্বনাশের হাত হইতে রেহাই পাওয়ার জন্য এই নিরাপত্তা বাঁধ নির্মাণে আর কালবিলম্ব করা যায় না। এই নিরাপত্তা বাঁধই ছয় দফা।১৪৯
সন্দ্বীপ থেকে শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রাম হয়ে সাতকানিয়ায় ২৭শে মার্চ অনুষ্ঠিত জনসভায় যােগদান করেন। সেখানে অনুষ্ঠিত জনসভা শেষে ঢাকায় প্রত্যাবর্তন করেন।
৬ দফার বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার এবং রাজনৈতিক কয়েকটি দল অবস্থান নিতে গিয়ে শেখ মুজিবের দাবিকৃত ১৯৪০ সালের লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসনের দাবিটি তারা ভিন্নভাবে উপস্থাপন করেছিল। এ প্রসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মােনায়েম খানের বক্তব্যের প্রতি দৃষ্টি দেওয়া যেতে পারে। দৈনিক আজাদ ৩রা এপ্রিল দেওয়া এক ভাষণে ৬ দফার বিরুদ্ধে তার দেওয়া বক্তব্য প্রকাশ করে। পত্রিকায়
—————————————–
১৪৮ ইত্তেফাক, ২৬ মার্চ ১৯৬৬ ২১ মার্চ ১৯৬৬, দেখুন, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক…পৃঃ ৩১৫ (৮১)
১৪৯ ইত্তেফাক, ২৮ মার্চ ১৯৬৬, দেখুন, আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক… পৃ. ৩১৬ (৮১)
—————————————–
৯৬ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
মােনায়েম খানের বক্তব্যের শিরােনাম করা হয়েছিল ‘লাহাের প্রস্তাবের ভুল ব্যাখ্যা করিতেছেন।
এতে তিনি বলেন, প্রদেশসমূহের জন্য পূর্ণ স্বায়ত্তশাসন প্রবর্তনের দাবিদারগণ ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাবের বিকৃত রূপ প্রদান করিতেছেন। গভর্নর বিভিন্ন মতাবলম্বী ব্যক্তিদের এক সমাবেশে বলেন যে, কতিপয় সরকারবিরােধী নেতা লাহাের প্রস্তাব সম্পর্কে ভুল তথ্য প্রদান করিতেছেন। তিনি বলেন যে, মরহুম হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দী এই প্রস্তাবের সংশােধনী প্রস্তাব আনয়ন করেন এবং চৌধুরী খলিকুজ্জামান, মরহুম চণ্ডীগড় জনাব ফিরােজ খান নুন, জনাব হেদায়েত উল্লাহ প্রমুখ ইহা সমর্থন। করেন।১৫০
মােনায়েম খান ৬ই এপ্রিল লাহােরে অনুষ্ঠিত লাহাের জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের কার্যকরী কমিটির সভায় যােগদানের জন্য আসেন। সেখানে তিনি সাংবাদিকদের ৬ দফার বিরুদ্ধে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করতে গিয়ে বলেন, ‘৬ দফা কর্মসূচি প্রণয়নকারীগণ ২১ দফা কর্মসূচি নিয়া ১৯৫৪ সালেও জনগণকে ধোঁকা দিয়াছিল। তাহাদের উক্ত কর্মসূচির মধ্যে নিরাপত্তা আইন বাতেল করার কথাও ছিল। কিন্তু মরহুম শহীদ সােহরাওয়ার্দীর উজিরে আজম থাকাকালে তাহারাই আইনে আরও নবতর প্রাণ সঞ্চার করিয়াছিল। জনাব মুজিবুর রহমান, জনাব আবুল মনসুর, জনাব আতাউর রহমান, জনাব জহিরুদ্দিন প্রমুখ আইন পরিষদে নিরাপত্তা আইনের স্বপক্ষেই ভােট প্রদান করেন। তিনি বলেন যে, লাহাের প্রস্তাবের ভিত্তিতে প্রাদেশিক স্বায়ত্তশাসনের দাবি ২১ দফা কর্মসচিতেও ছিল।১৫১ অন্যদিকে ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি প্রধান মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ৭ই এপ্রিল ফরিদপুর থেকে ঢাকা এসে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ৬ দফার বিরুদ্ধে তার প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা দাবি বাতেল করিয়া দেন। সাম্রাজ্যবাদী দুর অনুচরবর্গ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনীতি ক্ষেত্রে যে শােষণ চালাইয়া যাইতেছে, তাহার সমাধানের কোনাে পন্থাই উক্ত সর্মসূচিতে নাই বলিয়াই তিনি তাহা বাতেল করিয়া দিয়াছেন। তিনি বলেন
——————————————-
১৫০ দৈনিক আজাদ, ৪ঠা এপ্রিল ১৯৬৬ (৮২)
১৫১ দৈনিক আজাদ, ৮ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৩)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৯৭
যে, ১৯৪০ সালের ঐতিহাসিক লাহাের প্রস্তাব অনুসারে প্রদেশসমূহের জন্য স্বায়ত্তশাসনের দাবির প্রতি তাহার পূর্ণ সম্মতি রহিয়াছে। কিন্তু তাহাতে দেশে সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তনের জন্য পাকিস্তানের লক্ষ লক্ষ মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষাও প্রতিফলিত করিতে হইবে।১৫২ অন্যদিকে বিভিন্ন জেলায় ঝটিকা সফরে ৬ দফার পক্ষে জনমত গঠনে আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান একের পর এক জনসভা অনুষ্ঠিত করে যাচ্ছিলেন। ৭ এপ্রিল তিনি ভাষণ দেন পাবনা শহরে অনুষ্ঠিত জনসভায়। তাতে স্থানীয় টাউন হল ময়দানে এক বিরাট জনসভায় বক্তৃতা দানকালে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগের সভাপতি জনাব শেখ মুজিবুর রহমান ন্যায়সংগত স্বার্থের খাতিরে ৬ দফা কর্মসূচি আদায়ের জন্য নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম পরিচালনার আহ্বান জানান। মুহুর্মুহু করতালির মধ্যে তিনি ঘােষণা করেন যে, ৬ দফা প্রস্তাবকে তিনি শক্তিশালী পাকিস্তান গঠনের সুনিশ্চিত পথ বলিয়া উল্লেখ করেন। সভায় উপস্থিত বিপুল জনসাধারণকে উদ্দেশ্য করিয়া শেখ মুজিবুর রহমান বলেন যে, বাচিতে হইলে মানুষের মতই বাঁচিতে হইবে নতুবা সম্মানজনকভাবে মৃত্যুকে বরণ করাই শ্রেয়। তিনি ৬ দফা প্রস্তাবের বিস্তৃত ব্যাখ্যা প্রদান করেন। পূর্ব পাকিস্তানীদের ওপর শােষণ ও বঞ্চনার কথা উল্লেখ করিয়া আওয়ামী লীগ সভাপতি বলেন, আর ১০ বৎসর পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানের ওপর শােষণ চালাইলে এই প্রদেশবাসীর আর পরণের একখণ্ড কাপড়ও অবশিষ্ট থাকিবে না। তিনি সশস্ত্র বাহিনীকে পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায্য অংশ দাবি করেন। পূর্ব পাকিস্থানীরা হিন্দুদের সম্মুখে জুতা পরিধান করিত না বলিয়া প্রেসিডেন্ট আইয়ুব সম্প্রতি যে মন্তব্য করিয়াছেন ইহাকে শেখ সাহেব দুঃখজনক বলিয়া অভিহিত করেন।১৫৩
৬ দফাকে তিনি এই জনসভায় সর্বপ্রথম ৬ দফা উভয় প্রদেশের জন্য ম্যাগনা কার্টা’ বলে অভিহিত করেন। ৬ দফার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তান
————————————————-
১৫২ দৈনিক আজাদ, ৮ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৩)
১৫৩ দৈনিক আজাদ, ৮ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৪)
* ম্যাগনা কার্টা Magna Carta অর্থ মহাসনদ। (1: a harter of liberties to which the English barons forced King John to give his assent in June 1215 at Runnymede. (১২১৫ সালের জুন মাসে ইংরেজ রায়রননা রাজা জনকে রানিমিড নামক স্থানে স্বাধীনতার সনদ গ্রহণ করতে বাধ্য করেন) 2: a document constituting a fundamental guarantee of rights and privieges.)
————————————————-
৯৮ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
আওয়ামী লীগের নেতাদের বিরূপ প্রতিক্রিয়া ছিল। করাচি আওয়ামী লীগের নেতা বাকী বালুচ ৮ই এপ্রিল সংবাদপত্রে দেওয়া এক বিবৃতিতে ৬ দফা পাকিস্তানকে ‘দুর্বল করিবে’ বলে অভিহিত করেন। বিবৃতিতে তিনি বলেন, ‘শেখ মুজিবুর রহমানের ৬ দফা প্রস্তাব কার্যকরী করা হইলে দেশ দুর্বল হইয়া পড়িবে এবং এই জন্য পাকিস্তানের উভয় অংশের পক্ষে ইহা সমান। উদ্বেগের কারণ।… জনাব বালুচ, শেখ মুজিবের ৬ দফা সম্পর্কে গভর্নর জনাব আবদুল মােনায়েম খানের মন্তব্যে বিস্ময় প্রকাশ করেন। তিনি বলেন যে, গভর্নর মােনায়েম খান কখনও ৬ দফার নিন্দা করেন নাই বরং তিনি ৬ দফাকে ২১ দফার সহিত যুক্ত করিয়া কতিপয় রাজনৈতিক নেতার নিন্দা করিয়া চলিয়াছেন।”১৫৪
৯ এপ্রিল আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান বগুড়ার এডওয়ার্ড পার্কে অনুষ্ঠিত বিশাল জনসভায় ‘৬ দফা দাবি আদায়ের উদ্দেশ্যে বিরামহীন সংগ্রাম পরিচালনা ও ঐক্যবদ্ধ হওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।১৫৫
৬ দফা সম্পর্কে জুলফিকার আলী ভুট্টো মােকাবেলা সভায় মিলিত হওয়ার যে প্রস্তাব অবশেষে দিয়েছিলেন সেটি সাংবাদিকগণ ১৩ এপ্রিল শেখ মুজিবুর রহমানের দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তিনি বলেন, ‘নিজ কর্মব্যস্ততার দরুন আমার প্রস্তাব মতে, ২৪ এপ্রিল পল্টন ময়দানের জনসভায় ছয় দফার প্রশ্নে আমার মােকাবিলা করিতে অসামর্থ্য জ্ঞাপন করিয়া পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো আগামী ১৭ এপ্রিল এই মােকাবিলার যে প্রস্তাব দিয়াছেন, আমি সানন্দচিত্তে তাহা গ্রহণ করিতেছি। কিন্তু যেহেতু জনাব ভুট্টোর প্রস্তাবটি খুব স্পষ্ট নহে, সেইহেতু আমি তাঁহাকে দ্ব্যর্থহীনভাবে জানাইয়া দিতে চাই যে, জনগণের দাবি ছয় দফা সম্পর্কে উভয়পক্ষের মােকাবিলা হইবে প্রকাশ্য জনসভায়-কাহারও খাসকামরায় নহে। এবং এই মােকাবিলা সভার প্রিজাইডিং অফিসার হইতে হইবে হাইকোর্টের কোনাে বিচারপতিকে-কোনাে রাজনৈতিক দলের কেউ-টেউকে নহে।১৫৬
———————————————-
১৫৪ দৈনিক আজাদ, ৯ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৪)
১৫৫ দৈনিক আজাদ, ১১ এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৪)
১৫৬ ইত্তেফাক, ১৪ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৫)
———————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ৯৯
কিন্তু জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টো শেখ মুজিবের উক্ত প্রস্তাবে সাড়া দেননি। শেখ মুজিবুর রহমান ১৫ই এপ্রিল যশােরের জনসভায় শ্রোতাদের জানান যে, একটানা ভুট্টো আমাকে মােকাবিলা করার প্রশ্নের শেষ পর্যন্ত কাটিয়া পড়ায় ছয় দফার ব্যাপারে আমাদের প্রথম পর্যায়ের বিজয় সূচিত হইয়াছে। তাহার এই পশ্চাদপসারণ শুধ তাহার একারই পরাজয় নহে ইহা সামগ্রিকভাবে বর্তমান সরকারেরই পরাজয়। কারণ, স্বয়ং প্রেসিডেন্টসহ যখন কেন্দ্রীয় সরকারের হর্তাকর্তাদের প্রায় সকলেই এখানে উপস্থিত, তখনও তাঁহারা ছয় দফা প্রশ্নে সামনাসামনি দাঁড়াইতে সক্ষম হন নাই।১৫৭
১৭ই এপ্রিল তিনি খুলনায় স্থানীয় মিউনিসিপ্যাল পার্কে বিরাট এক জনসমাবেশে ভাষণ দেন। সেখানে তিনি বলেন, জেল আমরা বহুবার দেখিয়াছি, বুলেটের আঘাতও পরীক্ষা করিয়া দেখিতে প্রস্তুত। আঘাত যতই প্রচণ্ড হইবে, আমাদের সংগ্রাম ততই জোরদার হইবে, আপােষহীনভাবে চলিতেই থাকিবে। শেখ সাহেব বলেন যে, সরকার ছয় দফার উদ্যোক্তাদের ব্যাপকভাবে গ্রেপ্তারের জন্য প্রস্তুতি নিতেছেন। তাই, এক্ষণে জনসাধারণকেই সমস্যা অনুধাবন করিতে এবং ঐক্যবদ্ধ হইতে হইবে।১৫৮ খুলনা থেকে ঢাকায় ফেরার পথে শেখ মুজিবের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদোহিতামূলক’ বক্তৃতা দেয়ার অভিযােগে মামলায় গ্রেফতার করা হয়। অবশ্য, কোর্ট থেকে জামিনে তিনি বের হয়ে আসেন। তবে ২১শে এপ্রিল তাকে ঢাকায় গ্রেফতার করে সিলেট জেলে প্রেরণ করা হয়। ২৩শে এপ্রিল সিলেটে তাকে জামিন দেওয়া হয়।
কিন্তু ময়মনসিংহে তাহার বিরুদ্ধে অন্য একটি মামলায় অভিযােগ আনয়ন করায় জনাব শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রাখা হইয়াছে বলিয়া আওয়ামী লীগ সূত্রে জানা গিয়াছে।… পূর্ব পাকিস্তান দণ্ডবিধি আইন, জননিরাপত্তা ও দেশরক্ষা আইন বলে শেখ মুজিবুর রহমানকে গত একুশে এপ্রিল ঢাকায় গ্রেফতার করিয়া সিলেট প্রেরণ করা হইয়াছিল। প্রথমে মহকুমা হাকিম কর্তৃক শেখ মুজিবের জামিন নামঞ্জুর হইয়াছিল কিন্তু পরে সিলেট সেসন জজের আদালতে তাঁহার জামিন মঞ্জুর করা হয়। ইতিমধ্যে পুনরায় ময়মনসিংহে তাহার বিরুদ্ধে অনুরূপ অভিযােগ আনয়ন করা হয় ও
————————————–
১৫৭ ইত্তেফাক, ১৬ই এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৫)
১৫৮ ইত্তেফাক, ১৯শে এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৫)
————————————–
১০০ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
তাঁহাকে যুক্তি প্রদান না করিয়া পুলিশ প্রহরাধীনে আটক রাখা হইয়াছে। শেখ মুজিবুর রহমানের বন্ধুবর্গ পুনরায় জামিনের আবেদন করিলে মহকুমা হাকিম তাহা প্রত্যাখ্যান করেন। অতঃপর জামিনের আবেদন সেসন কোর্টে পেশ করা হইলে তাহা সিলেট আদালতের আওতাভুক্ত না হওয়াতে হাকিম জামিনের আবেদন মঞ্জুর করিতে অপারগ হন। শেখ মুজিবকে পুলিশ প্রহরাধীনে ময়মনসিংহে প্রেরণ করা হইয়াছে বলিয়া প্রকাশ।১৫৯ শেখ মুজিবুর রহমানের গ্রেফতার ও মামলায় হয়রানির প্রতিবাদে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ ২৪শে এপ্রিল পল্টন ময়দানে একটি প্রতিবাদ সভার আয়ােজন করে। সভায় ‘৬ দফা প্রস্তাবকে পাকিস্তানের গণশক্তির ‘মুক্তির সনদ হিসাবে অভিহিত করিয়া প্রস্তাব গৃহীত হয়।
জনসভায় নেতৃবৃন্দ শেখ মুজিবুর রহমানের ওপর অযথা হয়রানি ও। অত্যাচারের প্রতিবাদ জানাইয়া সভায় আর একটি প্রস্তাব গৃহীত হয়।১৬০
পর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেপ্তার ও জেলে আটক রাখার প্রতিবাদ জানিয়ে পত্র-পত্রিকায় দীর্ঘ বিবতি প্রদান করেন জাতীয় গণতান্ত্রিক ফ্রন্টের অন্যতম নেতা আতাউর রহমান খান। বিবৃতিতে তিনি বলেন, “বিচারের নামে শেখ মুজিবুর রহমানকে যেভাবে হয়রানি করা হইতেছে তাহাতে জনগণ স্তম্ভিত হইয়া পড়িয়াছে। শেখ মুজিবুর যেখানেই জনসভায় বক্তব্য করিয়াছেন সেখানেই সরকার পাকিস্তান দেশকে আইন এবং নিরাপত্তা আইন বলে তাহার বিরুদ্ধে। মামলা দায়ের করিয়াছেন। এই মামলার দোহাই দিয়া তাহাকে যেরূপভাবে এক স্থান হইতে অন্য স্থানে নিয়া যাওয়া হইতেছে তাহা অত্যন্ত নিষ্ঠুর। রাজনৈতিক হয়রানির ইতিহাসে এইরূপ নিষ্ঠুরতার তুলনা নাই। তিনি বলেন যে, অন্য জেলার একটি মামলায় তাহাকে কোনাে এক স্থানে গ্রেফতার মুক্ত আদেশ দিবার পূর্বেই আবার ভিন্ন এক জেলার আর এক মামলার দরুন পুনরায় গ্রেফতার হয়ে পুলিশের সুবিধা মাফিক নির্দিষ্ট সময়ের পরােয়ানা করিয়া ট্রেনযােগে তাহাকে স্থানান্তরিত (অস্পষ্ট)। এই সব ঘটনাদৃষ্টে কমপক্ষে ইহাই প্রতীয়মান হয় যে, ইহা সবই ষড়ন্ত্রমূলক। জনাব আতাউর রহমান খান বলেন যে, এই সম্পর্কে আমি সরকারকে ইহা স্মরণ করাইয়া
——————————————-
১৫৯ দৈনক আজাদ, ২৪শে এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৬)
১৬০ দৈনিক আজাদ, ২৫শে এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৬)
——————————————-
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১০১
দেওয়া কর্তব্য মনে করি যে, লাহাের প্রস্তাব ভিত্তিতে আঞ্চলিক স্বায়ত্তশাসন ও দুই অর্থনীতির দাবি এবং পূর্ব পাকিস্তানের নিরাপত্তা ব্যবস্থা পূর্ব পাকিস্তানের রহিয়াছে, এই কঠিন বাস্তবের অনুমােদন স্থানের দাবি কোনাে স্বতন্ত্র ব্যক্তি বা দলের দাবি নয়, এই সকল দাবিই পূর্ব পাকিস্তানের সমগ্র জনগণের প্রাণের দাবি। তিনি বলেন যে, জনগণের ন্যায্য দাবি-দাওয়া গ্রহণ বা কোনাে অনুমােদনের পরিবর্তে প্রেসিডেন্ট এবং গভর্নরসহ সরকারের বিভিন্ন মুখপাত্রগণ আমাদিগকে বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টিকারী বলিয়া আখ্যায়িত করিয়া চলিয়াছেন, কিন্তু বড়ােই কৌতূহলের বিষয় এই যে, তাহারা কেহই তাহাদের সুদীর্ঘ ও শ্রম সাপেক্ষ বিবৃতি ও বেতার ভাষণে কখনও আমাদের দাবিসমূহের কোনাে প্রকৃত ভুল-অন্যায়, অযৌক্তিক ও বিচ্ছন্নতাপ্রবণ বলিয়া আখ্যায়িত করিতে পারেন নাই। রাজনৈতিক নেতাদের হয়রানি করা জনগণের দাবি গ্রহণের বিকল্প পথ নয়। ইতিহাসে এইরূপ অসংখ্য নজীর রহিয়াছে যে, জনগণের গণতান্ত্রিক আশা আকাঙ্ক্ষার দাবি নস্যাৎ করিয়া দিতে সরকার বার বারই ব্যর্থ হইয়াছেন।’১৬১
এরপর শেখ মুজিবুর রহমান জেল থেকে মুক্ত হয়ে আবার বিভিন্ন জেলা সফর শুরু করেন। এই সময় তিনি জনগণের কাছে আগের চাইতে বেশি জনপ্রিয় হয়ে ওঠেন। তাকে দেখার জন্য মানুষ বিভিন্ন রেলস্টেশনে অবস্থান। গ্রহণ করতে থাকে। তিনি সেইসব স্টেশনে অপেক্ষমাণ জনতার উদ্দেশে ভাষণ প্রদান করে তার গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা করলেও পরবর্তী স্টেশনে। একই অবস্থা তৈরি হতাে। এ বিষয়ে ৭ই মে দৈনিক আজাদ পত্রিকায় প্রকাশিত সংবাদ থেকে স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যায়। উল্লেখ্য, ৬ মে তারিখ পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমান, সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, প্রচার সম্পাদক আবদুল মােমিন চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী এমএনএ কোষাধ্যক্ষ জনাব নুরুল ইসলাম চৌধুরীসহ সিলেটে ট্রেনযােগে গমন করেন। পথিমধ্যে বিপুল সংখ্যক মানুষ শেখ মুজিবুর রহমানের বক্তৃতা শােনার জন্য অপেক্ষা করায় প্রতি স্টেশনে তিনি তাদের উদ্দেশে ভাষণ দেন। সিলেট পৌছার পর বিপুল সংখ্যক মানুষ তাঁকে সংবর্ধনা জ্ঞাপন করে। তারা ‘৬ দফা প্রস্তাব
—————————————-
১৬১ দৈনিক আজাদ, ২৬শে এপ্রিল ১৯৬৬ (৮৭)
—————————————-
১০২ ৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ
জিন্দাবাদ’, ‘শেখ মুজিবুর রহমান জিন্দাবাদ’, ‘শেখ মুজিবকে হয়রানি করা চলবে না’ ইত্যাদি স্লোগানে সিলেট স্টেশন মুখরিত করেন।১৬২
পরদিন ৮ই মে পূর্ব পাকিস্তান আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ মুজিবুর রহমান নারায়ণগঞ্জ টাউন হল ময়দানে স্মরণকালের বৃহত্তম জনসভায় ভাষণ দেন। উক্ত জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান বলেন, “শক্তিশালী, সুখী, সমৃদ্ধিশালী ও গণতান্ত্রিক পাকিস্তান সৃষ্টির উদ্দেশ্যেই আমাদের বাঁচার দাবি ছয় দফা পেশ করি। কিন্তু আমাদের বিদেশী চর এবং পাকিস্তানের ধ্বংসকামী বলিয়া আখ্যায়িত করা হইতেছে। কিন্তু এ সব আখ্যা আমাদের কাছে নতুন নয়। পাকিস্তানের ভিত্তি লাহাের প্রস্তাবের প্রণেতা শেরে বাংলা এবং পাকিস্তানের অন্যতম স্রষ্টা শহীদ সােহরাওয়ার্দীকেও উক্ত আখ্যায়িত হইয়া পৃথিবী হইতে বিদায় নিতে হইয়াছে। সংগ্রামী চেতনায় উদ্বুদ্ধ বিপুল জনতাকে লক্ষ করিয়া শেখ মুজিব এক এক করিয়া ৬ দফা কর্মসূচির বিস্তারিত ব্যাখ্যা দান করিয়া তুমুল করতালির মধ্যে ঘােষণা করেন, ছয় দফা। দাবি উত্থাপনের পর হইতে নতুনভাবে আমার বিরুদ্ধে একটার পর একটা মামলা দায়ের করা হইতেছে। কিন্তু ক্ষমতাসীনদের জানিয়া রাখা দরকার যে, কোনাে কিছুতেই আমাদের ছয় দফা আদায়ের প্রতিজ্ঞা হইতে বিচ্যুত করা যাইবে না।’… জনতার উদ্দেশে তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের ১৪ শত কর্মী ছয় দফা আদায়ের জন্য কারাভােগসহ যে-কোনাে ত্যাগ স্বীকারের প্রতিজ্ঞা গ্রহণ করিয়াছেন। এসময় জনতার উদ্দেশ্যে তিনি বলেন, প্রয়ােজনবােধে আপনারাও কারাভােগে প্রস্তুত আছেন কি? সঙ্গে সঙ্গে একযােগে লক্ষ হস্ত উত্তোলন করিয়া জনতা কারাভােগের প্রস্তুতির শপথ গ্রহণ করেন।১৬৩ নারায়ণগঞ্জের উক্ত জনসভায় ৬ দফা প্রণেতা শেখ মুজিবকে সাড়ে পাঁচ কোটি নহে-দশ কোটি জনগণের নেতা বলে ঘােষণা করা হয় এবং তাঁকে নারায়ণগঞ্জ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে ছয় দফা। খােদিত একটি স্বর্ণতারকায় ভূষিত করা হয়, আদমজীর শ্রমিকদের পক্ষ থেকে পাটের তৈরি মালায় ভূষিত করা হয়। বস্ত্রশ্রমিকরা মালা পরিয়ে দেন।
————————————————————–
১৬২ দৈনিক আজাদ, ৭ই মে, ১৯৬৬ (৮৭)।
১৬৩ বাংলাদেশ: প্রবন্ধ, বক্তৃতা, বিবৃতি, বাণী, নির্দেশ ও সাক্ষাঙ্কার, শেখ মুজিবুর রহমান, বঙ্গবন্ধু ললিতকলা একাডেমি, ২০১৭, ঢাকা, পৃ. ৩২২-৩২৩ (৮৮)
————————————————————–
৬ দফা : স্বাধীনতার মহাসনদ ১০৩
পাট ব্যবসায়ী এবং নারায়ণগঞ্জ সিটি আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে মাল্য ভূষিত করা হয়। এইসব ঘটনা পাকিস্তানের সরকারি কর্তৃপক্ষ অবলােকন করতে থাকে এবং ছয় দফার প্রতি পূর্ব বাংলার জনগণের সমর্থন দ্রুত বৃদ্ধি পাওয়া ও একই সঙ্গে ছয় দফার প্রণেতা শেখ মুজিবুর রহমানের জনপ্রিয়তা দ্রুত শীর্ষে উঠতে দেখা যায়। সম্ভবত এমন পরিস্থিতিতে পাকিস্তানের সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে আরও নির্যাতন ও নিবর্তনের পথ বেছে নেয়।
Reference: ৬ দফা স্বাধীনতার মহাসনদ – মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী