সংবিধানে জিয়া কী কী পরিবর্তন করেন? কেন করেন?
বাংলাদেশের শাসনতন্ত্র ছিলাে মুক্তিযুদ্ধের নির্যাস ও লক্ষ লক্ষ শহীদদের আত্মত্যাগের কাঙ্খিত দলিল। জিয়াউর রহমান স্বীয় স্বার্থে মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধ ও চেতনার উপর ভিত্তি করে রচিত শাসনতন্ত্র পরিবর্তন করে প্রকৃত প্রস্তাবে মুক্তিযুদ্ধর হৃৎপিন্ডে ছুরি চালিয়ে দেন। জিয়াউর রহমান সামরিক ফরমান বলে রাজনৈতিক দলগুলােকে ঘরে বন্দী করে, ৬২ হাজার নেতা-কর্মীকে কারাগারে আটক করে জনমতকে বুটের তলায় চেপে ধরে ‘জনগণের অভিপ্রায়কে সঙ্গীণে বিদ্ধ করে সংবিধানের মৌলিক পরিবর্তন করে বাংলাদেশকে পুনরায় পাকিস্তানী আদর্শে ফিরিয়ে নেন।
(ক) সংবিধানের প্রস্তাবনার শীর্ষে (পরম দয়াময়, পরম দয়ালু আল্লাহর নামে)‘ এই কথাগুলাে যুক্ত করেন।
(খ) প্রস্তাবনার অংশে যেখানে উল্লেখিত ছিল “জাতীয় মুক্তির জন্য ঐতিহাসিক সংগ্রামের মাধ্যমে”- সেই স্থানে “জাতীয় স্বাধীনতার জন্য ঐতিহাসিক যুদ্ধের মাধ্যমে প্রতিস্থাপন করা হয়। বাঙালী জাতি শুধুমাত্র নয় মাসে যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেনি। হাজার বছরের মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত পর্যায় ছিলাে সশস্ত্র স্বাধীনতা যুদ্ধ। বাঙালী জাতির সেই হাজার বছরের সংগ্রাম, অগণিত মানুষের আত্মদান ও রক্তের সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করে জিয়াউর রহমান শুধু মাত্র বাঙালীর জাতির সংগ্রামকে নয় মাসের স্বাধীনতা যুদ্ধে রূপান্তরিত করে বাঙালীর হাজার বছরের ইতিহাসকে যেমন নাকচ করেছেন, তেমনি লাখাে শহীদদের প্রতি করেছেন অবমাননা। গ.সংবিধানের ৬ অনুচ্ছেদ যেখানে লেখা ছিল বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাঙালী বলিয়া পরিচিত হইবেন‘ স্থলে “বাংলাদেশের নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিতি হইবেন” যােগ করা হলাে। বাঙালি জাতির হাজার বছরের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি কৃষ্টি ও ঐতিহ্যের বন্ধনকে ছিন্ন করা হলাে।
(ঘ) সামরিক ফরমানে বাঙালি জাতির আত্মপরিচয় মুছে ফেলা হলাে। ৯ম অনুচ্ছেদ যেখানে বলা হয়েছিল “ভাষাগত ও সংস্কৃতিগত একক সত্ত্বাবিশিষ্ট যে বাঙালি জাতি ঐক্যবদ্ধ ও সংকল্পবদ্ধ সংগ্রাম করিয়া জাতীয় মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব অর্জন করিয়াছেন সেই বাঙালি জাতির ঐক্য ও সংহতি হইবে বাঙালি জাতীয়তাবাদের ভিত্তি।” এই নবম অনুচ্ছেদ তুলে দিয়ে সেখানে প্রতিস্থাপন করা হলাে “স্থানীয় শাসন সংক্রান্ত প্রতিষ্ঠান সমুহের উন্নয়ন”। কোথায় জাতি স্বত্ত্বা আর আত্মপরিচয়ের বিশাল গৌরবমন্ডিত ঐতিহাসিক ভিত্তি আর কোথায় স্থানীয় শাসনের কথা,-ভাবতে অবাক ও বিস্মিত হতে হয়!
ঙ.সংবিধানের ১২ অনুচ্ছেদ বিলুপ্ত করা হলাে। যে ১২ অনুচ্ছেদ ছিলাে স্বাধীনতার চেতনা ও মুক্তিযুদ্ধের মূল্যবােধের অন্যতম মূলভিত্তি। পাকিস্তান আমলে সামরিক স্বৈরাচারী শাসক ও শােষক গােষ্ঠী পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ব্যবহার করে জাতীয় ঐক্য ও সংহতি বিপন্ন করেছে। সমাজ প্রগতির ধারাকে রুদ্ধ করতে চেয়েছে। সম্প্রদায়গত হানাহানি লাগিয়ে, দাঙ্গা বাধিয়ে, মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করে, খুন ধর্ষণ হত্যা লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযােগ করে মানবিকতাকে করেছে ভূলুণ্ঠিত। স্বাধীন বাংলাদেশে কেউ যেন রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করতে না পারে সেই লক্ষ্যে সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদে বলা হয়েছিল ধর্মনিরপেক্ষতার নীতি বাস্তবায়নের জন্য
ক) সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতা,
খ) রাষ্ট্র কর্তৃক কোন ধর্মকে রাজনৈতিক মর্যাদা দান,
গ) রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে অপব্যবহার,
ঘ) কোন বিশেষ ধর্ম পালনকারী ব্যক্তির প্রতি বৈষম্য বা তাহার উপর নিপীড়ণ বিলােপ করা হইবে”-এই অনুচ্ছেদ রহিত করা হয়েছে।
সাম্প্রদায়িক রাজনীতিকে উৎসাহিত করার লক্ষ্যে ধর্মকে রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহারের হীন স্বার্থে জিয়াউর রহমান সংবিধানের ১২নং অনুচ্ছেদ তুলে দিয়েছেন। সংবিধানের ৩৮ নং অনুচ্ছেদের “তবে শর্ত থাকে যে, রাজনৈতিক উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী কোন সাম্প্রদায়িক সমিতি বা সংঘ কিংবা অনুরূপ উদ্দেশ্যসম্পন্ন বা লক্ষ্যানুসারী ধর্মীয় নামযুক্ত বা ধর্ম ভিত্তিক অন্য কোন সমিতি বা সংঘ গঠন করিবার বা তাহার সদস্য হইবার বা অন্য কোন প্রকারে তাহার তৎপরতায় অংশ গ্রহণ করিবার কোন অধিকার কোন ব্যক্তির থাকিবেনা।” অর্থাৎ ধর্মকে নিয়ে রাজনীতি করার অপপ্রয়াসে পবিত্র ধর্মকে হীনস্বার্থে ব্যবহারের জন্য কোন রাজনৈতিক দল গঠন করা যাবে না। জিয়াউর রহমান এই অনুচ্ছেদ শর্তটুকু বিলুপ্ত করেছেন। একই সাথে স্বাধীনতা বিরােধী সাম্প্রদায়িক দল জামাত ইসলাম, শিবির, মুসলিম লীগ, নেজামে ইসলামী ইত্যাদি দলকে রাজনীতি করার সুযােগ করে দেন, মওলানা রহিম, শাহ আজিজ, সবুর খান, আলিম, মতিন, শামসুল হুদা, মওলানা মান্নান স্বাধীনতা বিরােধী। ব্যক্তিদের রাজনীতিতে পুনর্বাসিত করার লক্ষ্যে। সংবিধানে শুধুমাত্র ১২নং অনুচ্ছেদে সংযােজন করেই বঙ্গবন্ধু নিশ্চিত ছিলেন না। যদিও সাধারণ ক্ষমার আওতায় অনেকেই জেল হতে বেরিয়ে এসেছিলাে, তবুও তাদের রাজনীতি করার অধিকার ছিলাে না। সংবিধানের ৬৬নং লিপিবদ্ধ হয়েছিলাে-সংসদে নির্বাচিত হবার যােগ্যতা ও অযােগ্যতা সম্পর্কে। উক্ত অনুচ্ছেদে পরিস্কারভাবে বলা হয়েছিলাে “কোন ব্যক্তি সংসদের সদস্য নির্বাচিত হইবার এবং সংসদ সদস্য থাকিবার যােগ্য হইবেন না, যদি (গ) তিনি কোন বিদেশী রাষ্ট্রের নাগরিকত্ব অর্জন করেন কিংবা কোন বিদেশী রাষ্ট্রের প্রতি আনুগত্য ঘােষণা বা স্বীকার করেন;
(ঙ) তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশে যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে যে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত হইয়া থাকেন; একই সাথে সংবিধানের ১২২ অনুচ্ছেদে ভােটার তালিকায় নামভুক্তির যােগ্যতার ক্ষেত্রে স্পষ্ট করে বলা হয়েছিল
৫. তিনি ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ যােগসাজশকারী (বিশেষ ট্রাইব্যুনাল) আদেশের অধীনে কোন অপরাধের জন্য দন্ডিত না হইয়া থাকে। ১৯৭২ সালের বাংলাদেশ ভােটার তালিকা আদেশ (পি. ও নং ১০৪) এবং বাংলাদেশ যোগসাজশকারী আদেশকে (পি ও নং ৮) চতুর্থ তফসিলে সাংবিধানিকভাবে প্রটেকশন দেয়া হয়েছিলাে।
৬. মূলতঃ জাতির জনক বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দেশে স্বাধীনতা বিরােধী ব্যক্তি ও দালালদের সর্বস্তরে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গৃহীত হয়। এক সামরিক ফরমান বলে ১৯৭৫ সনের ৭ই নভেম্বর বিচারপতি আবু সাদাত মােহম্মদ সায়েম একাধারে গণপ্রজতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট এবং প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক পদে অধিষ্ঠিত হন। জিয়াউর রহমান প্রধান সেনাপতি এবং উপ-প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক। কিন্তু কার্যক্ষেত্রে প্রতিটি বিষয়ে রাষ্ট্রীয় নীতিমালা এবং বাস্তবায়ন ক্ষেত্রে জেনারেল জিয়াউর রহমান নানাবিধ কৌশলে ক্ষমতার কেন্দ্র বিন্দু হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে সমর্থ হন।
৭. জেনারেল জিয়াউর রহমান পরিস্কার বুঝতে পেরেছিলেন তার বহু কাঙিক্ষত। প্রেসিডেন্ট পদটি করায়ত্ত করতে তিনি আওয়ামী লীগ বা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির ও দলগুলাের নিকট হতে তেমন সহায়তা পাবেন না। সেজন্য তাকে বিকল্প শক্তির দিকে ঝুঁকতে হবে। এবং তাদের নিয়েই রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনে এগিয়ে যেতে হবে।
Reference: জেনারেল জিয়ার রাজত্ব -অধ্যাপক আবু সাইয়িদ
ভিডিও- ১৯৮১ সালে জিয়া হত্যার পর লন্ডনে বিক্ষোভ। দুই গ্রুপ মুখোমুখি।