বঙ্গবন্ধুর পারিবারিক জীবন | বেবী মওদুদ
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জীবন ছিল বড় আনন্দের। যদিও জীবনের অনেকটা সময় তাঁর কেটেছে কারাগারে এবং রাজনৈতিক কর্মব্যস্ততায়। পরিবারের সবার সঙ্গে থেকেও যেন থাকা হত না। তার বাবা-মায়ের আদর-যত্ন, ভাইবােনের ভালােবাসা, স্ত্রীর প্রেম ও মমত্ব, সন্তানদের শ্রদ্ধা এবং আত্মীয়স্বজন ও বন্ধুদের নিবিড় সম্পর্ক একদিকে তাঁর ব্যক্তিজীবনকে পরিপুষ্ট করেছে, ভরপুর করেছে উদারতায়; আবার ইস্পাতসম কাঠিন্যে শক্তি যুগিয়েছে, লক্ষ্যে পৌঁছাতে আদর্শবাদী ও আত্মত্যাগী করে তুলেছে। একসঙ্গে তাঁর দেশপ্রেম ও দেশের মানুষের জন্য ভালােবাসা যেন তাঁর প্রাণশক্তি ছিল। পারিবারিক জীবনের সুখ ও আনন্দ ফেলে এসে জনগণের জীবনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তােলেন। শুধু সমাজ, দেশ ও জাতির ভাগ্য পরিবর্তন করেছেন দুঃখী মানুষের মুখে হাসি ফোটানাের জন্য। নিজের জীবনের জন্য কখনও ভাবেননি। নিজের মা-বাবার দিকে ফিরে। তাকাননি। বৃদ্ধ মা-বাবারও কোনাে খোঁজখবর রাখার সময় পাননি। অথচ তার জন্য তাঁর বাবা-মা, স্ত্রী-সন্তানদের ওপরেও আঘাত এসেছে; তাঁদেরও নানারকম যাতনা ও লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়েছে।
১৯২০ সালের ১৭ মার্চ টুঙ্গিপাড়া নামে এক প্রত্যন্ত গ্রামে শেখ মুজিবের জন্ম হয়। তাঁর জন্মগ্রগ্রণ পুরাে ‘শেখ বংশে আনন্দ বয়ে এনেছিল। দু-মেয়ের পর ছেলে জন্ম নেয়ায় মা সায়রা খাতুন খুব খুশি হয়েছিলেন। তার পিতা নাতির নামকরণ করে গর্বিত মাকে সেদিন বলেছিলেন, ‘মা সায়রা, তােমার ছেলের জগৎজোড়া নাম। হবে।’ বৃদ্ধা মা বাংলাদেশের স্রষ্টা হিসাবে তাঁর ছেলেকে দেখে একথা স্মরণ করতেন এবং সেই গর্ব নিয়েই জীবন-অতিবাহিত করেন।
বঙ্গবন্ধুর শৈশব-কৈশাের মা-বাবার আদর-শাসনে এবং যত্নে কেটেছিল। মায়ের চিন্তা ছিল তার রোগাপাতলা ছেলে ‘খােকা’ কবে বড় হবে? টুঙ্গিপাড়ায় গ্রামের বাড়িতে তাঁর শৈশব কেটেছিল। গ্রামীণজীবনের রূপ-রস-গন্ধ তাঁকে যেমন সরল-সাধারণ ও কোমল করে গড়ে তােলে, তেমনি গ্রামের মানুষের সংগ্রাম তাকে অভিজ্ঞ করে তােলে।
মুজিবের এগারাে বছর বয়সে বিয়ে হয় চাচাত বােন ফজিলাতুননেছা রেণুর সঙ্গে। তার বয়স ছিল তখন মাত্র তিন বছর। কালাকালে খেলার সাথী বেণু পরবর্তীকালে সুযােগ্য জীবনসঙ্গী হিসেবে ভালােবাসা দিয়ে পরবর্তী জীবনে আরও বেশি করে সাহস ও শক্তি যুগিয়েছিলেন তার রাজনৈতিক জীবনকে প্রতিষ্ঠিততে। বেগম মুজিবই তার শ্বশুর-শাশুড়ি, আত্মীয় স্বজনদের দেখাশােনা, সন্তু নিদের লালনপালন করে সংসার সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করেছেন। আবার অন্যদিকে স্বামীর রাজনীতি, সংগ্রাম, কারাবরণ, মামলা পরিচালনা ও পার্টির ভালাে-মন্দ দেখেছেন। নিজের বাড়িতে সভা বা বৈঠক করা, তাদের জন্য নিজে রান্না করে পরিবেশন করা, কারাবরণকারী নেতা ও কর্মীদের পরিবারকে সাহায্য করেছেন নিঃস্বার্থভাবে। রাজবন্দি স্বামীর সঙ্গে দেখা করতে গিয়ে বাইরের আন্দোলনের খবর পৌছানাে, পরামর্শ করা এবং নির্দেশ শুনে এসে নেতাকর্মীদের কাছে পৌছে দিতেন। স্বামী রাজনীতি করতেন বলে সামাজিকভাবে অনেক সময় নিগৃহীত হয়েছেন। ঢাকা শহরে বাড়ি ভাড়া করে থাকতে কষ্ট-দুর্ভোগ পােহাতে হয়েছে অনেক। ছেলেমেয়েদের স্কুলে ভর্তি করাতে, সংসার চালাতে এবং নিজের গহনা বিক্রি করে স্বামীর মামলা চালাতেও দ্বিধাবােধ করেননি কখনও। তারপরও স্বামীর কাছে কখনও কোনাে অভিযােগ করেননি। বরং স্বামীর সুবিধার জন্য ত্যাগ স্বীকার করেছেন, হাসিমুখে পাশে দাড়িয়ে সহযােগিতা করেছেন। গ্রামে তাঁর নিজের সম্পত্তি বিক্রি করে ঢাকায় বাড়ি তুলেছেন একটু একটু করে, সংসারের খরচ মিটিয়েছেন। একটা সাধারণ মধ্যবিত্ত পরিবারের একজন দায়িত্বশীল নিষ্ঠাবান গৃহকত্রী ছিলেন তিনি। কিন্তু তাঁর ব্যক্তিত্ব ও ঢারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের প্রধানতম দিকটা হল, একজন নির্ভীক ও আত্মত্যাগী রাজনৈতিক নেতার স্ত্রী হিসেবে সবার আপনজন ছিলেন। এই আত্মোপলব্ধি তাকে এতবেশি সচেতন করেছিল বলেই স্বামীর বাজনৈতিক চিন্তাভাবনার একান্ত সঙ্গী ছিলেন। শেখ মুজিবের অনেক গুৰুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণের সময় অনেক ক্ষেত্রে পরামর্শ দিতেন। একজন রাজনীতিবিদ স্বামীর উপযুক্ত স্ত্রী ছিলেন বলেই বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বালি জাতির অবিস্মরণীয় নেতা হতে পেরেছিলেন, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নেতৃত্ব দিয়েছেন এবং বাস্কালি জাতির পিতা হতে পেরেছেন।
চল্লিশ-পঞ্চাশ-ষাটের দশকে শেখ মুজিব যথন নেতা হিসেবে গড়ে উঠছেন, কারাগারে যাচ্ছেন, আন্দোলন-সংগ্রামে সারাদেশ ঘুরছেন এবং জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করছেন—স্ত্রী ফজিলাতুননেছার সতর্ক দৃষ্টি ছিল তার প্রতি এবং মা-বাবার সথে, ও সন্তানদের প্রতি গভীর ভালােবাসাও ছিল। এ সময়টা শেখ মুজিবের দূরদৃষ্টিসম্পন্ন নেতা হয়ে ওঠার সময়। পাকিস্তানের স্বৈর সামরিক শাসকগােষ্ঠীর প্রধান টার্গেট ছিলেন শেখ মুজিব-যাকে অর্থবিত্ত মন্ত্রিত্ব দিয়ে তারা ক্রয় করতে পারেনি তাদের স্বার্থে ব্যবহারের জন্য। কেননা মুজিব ছিলেন সৰ স্বার্থে। * দেশ ও মানুষের স্বার্থকে প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে। তিনি পাকিস্তানের বৈষম্য ও শােষণের শাসনের নিজে ছিলেন দুর্বার, দুর্দান্ত এক অনলবর্ষী বক্তা। তিনি ছিলেন সব প্রতিক্রিয়াশীল চক্রের কাছে আতঙ্ক।
একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের প্রারম্ভে ২৫ মার্চ রাতে পাকিস্তানি সৈন্যরা এঁকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়। জেনারেল ইয়াহিয়া খান তাকে দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়েছিল। সামরিক আদালত গােপন বিচার করে মৃত্যুদস্ত প্রদান করে। আর তার ফেলে যাওয়া ঘর-সংসার নিয়ে বেগম মুজিবকে কম লাঞ্ছনা ভােগ করতে হয়নি। ঢাকা শহরে থাকার জায়গা খুঁজতে হয়েছে। পাকসেনাদের ভয়ে আত্মীয়স্বজন আশ্রয় দিতে রাজি হয়নি। ৩২ নং বাড়ি পাকিস্তানি সৈন্যরা লুটপাট করে সিল মেরে রেখে দিয়ে বেগম মুজিব ও সন্তানদের খুঁজে বের করে ধানমথি ১৮ নং রােডের একটি বাড়িতে বন্দি করে রাখে, যেখানে খাদ্য ও ঘুমানাের নূ্যনতম সুবিধাটুকু দেয়নি। বৃদ্ধ বাবা-মাকে রাস্তায় বসিয়ে রেখে গ্রামের বাড়িঘর পুড়িয়ে ছাই করে দোয়। তারপরও মুক্তিযুদ্ধ হয়েছে। লাখ লাখ মানুষ প্রাণ বিসর্জন দিয়েছে, হাজার হাজাৰ নাৰীৰ সম্বমহানি ঘটেছে। সে এক নিদারুণ অমানিশার কাল ছিল। তারপরও দেশ স্বাধীন হয়েছে, বঙ্গবন্ধু পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্ত হয়ে স্বাধীন বাংলাদেশে সংগীৱৰে প্রত্যাবর্তন করেছেন। আপন পরিবারে স্ত্রী-সন্তানের ভালােবাসা, মা-বাবার মমত্বের ছায়ায় আশ্রয় নিয়েছেন। এই পারিবারিক আনন্দ ও শান্তি ছিল তার সব সংগ্রামের উৎস। বাঙালি জাতির সফল ও সার্থক নেতা হিসেবে, বাংলাদেশের স্থপতি হিসেবে তাঁর কীর্তিময় জীবন দেখে গর্ব করেছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। বঙ্গবন্ধু পরিবার ছিল একটি আদর্শ বাঙালি পরিবার। জীবনযাপন ছিল খুব। সাধারণ। সুনেতৃত্ব, নীতিবান, মিতব্যয়ী এবং সদ্ব্যবহারের জন্য তাদের একটা বংশগত মর্যাদা ছিল। এতক নেতা ও প্রধানমন্ত্রী হয়েও বত্রিশ নম্বর বাড়িতে কোনাে এসি, কার্পেট ও দামি আসবাবপত্রের বাল্য ছিল না। সামাজিক ও পারিবারিক মূল্যবােধ ছিল উন্নত, জীবনাচরণ ছিল রুচিসম্মত।
১৫ আগস্ট ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব নিহত হলেন নিষ্ঠুর ও নৃশংসভাবে। থাম্বকের দল তাঁকে হত্যা করেছিল রাজনৈতিক কারণে। কিন্তু তার স্ত্রী ফজিলাতুননেছা বেণু, তিন পুত্র শেখ কামাল, শেখ জামাল, শেখ রাসেল; সলাধু হয়ে আসা সুলতানা কামাল ও পারভীন জামালকেও ঘাতকের দল হত্যা করে। বঙ্গবন্ধুর ছােট ভাই আবু নাসের এ-বাড়িতে থাকায় সেদিন তাঁকেও হত্যা করে ঘাতকরা। কী ছিল তাদের অপরাধ? বঙ্গবন্ধুর নিরাপত্তা অফিসার কর্নেল আমিলকেও হত্যা করে বাড়ির সামনের রাস্তায়। তাঁর ভাগ্নে শেখ ফজলুল হক মনি ও তার স্ত্রী আরজু মণি, অগ্নীপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাত ও দুর দুই কন্যা ও পুত্র এবং শিশু নাতিকেও হত্যা করেছিল। এসব হত্যাকাণ্ড কেন করা হয়েছিল? মানুষের মাঝে আতঙ্ক ও নৃশংসতা সৃষ্টি করতে।
বঙ্গবন্ধুরই বা কী অপরাধ ছিল? বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের নেতৃত্ব দিয়ে বাঙালি জাতির পিতা হওয়াটাই কি তালের চক্ষুশূল ছিল। তাই তারা মেনে নিতে পারেনি বলেই এমন রক্তাকাণ্ড ঘটিয়েছে? ঘাতকের দল তাঁকে যদি রাজনৈতিক কারণে হত্যা করে থাকে, তাহলে তার স্ত্রী, শিশুসন্তান রাসেল, নববধূসহ পুত্র ও অন্য আত্মীয়স্বজনদেরও এমন নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করল কেন? বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের পরিবার ও বংশকে ধ্বংস করে দেয়াটাই ছিল তাদের উদ্দেশ্য। মানবিকতার আদর্শচ্যুত, বিবেকহীন এই ঘাতকদের বিচার শেষ হবে কবে? শাস্তি কেন হবে না?
বাঙালি জাতি ও বাংলাদেশের জন্য বঙ্গবন্ধুর পরিবার ভীবন দিয়ে যে বিরাট আত্মদান করে গেছেন তা সংগ্রাম, সাহস, শক্তি, মানবিকতা ও কল্যাণের আদর্শে মহীয়ান করে রাখতে পারি, আজ এটাই আমাদের একমাত্র প্রার্থনা।
যুগান্তর ২৬ আগস্ট ২০০৮
Reference – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী