You dont have javascript enabled! Please enable it!
পনেরােই আগস্ট তারিখটিকে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল- আবদুল গাফফার চৌধুরী
পনেরােই আগস্ট তারিখটিকে কেন বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে বেছে নেয়া হয়েছিল?
শেখ পরিবারকে উদ্ধারের জন্য কি ভারত থেকে হেলিকপ্টার এসেছিলো?
বঙ্গবন্ধু হত্যায় কি সৌদি যোগসূত্র আছে?
ভারতের রাষ্ট্রপতি কেন জিয়াকে ‘স্বাধীনতার ঘােষক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি’ বলেছে?
জিয়া কেন বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘােষণা করতে চেয়েছিলো?
বঙ্গবন্ধুর খুনি কর্নেল ফারুক কেমন করে রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেছিলো?
প্রশ্নগুলোর উত্তর নিয়ে লিখেছেন আবদুল গাফফার চৌধুরী।
পড়তে পারেন।
১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট খুব ভােরে লন্ডনের বাসায় আমি তখনাে বিছানা ছেড়ে উঠিনি। ঠিক এই সময় খবরটি প্রচারিত হল, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আর নেই। তাকে ওইদিনই বাংলাদেশ সময় শেষরাতের দিকে হত্যা করা হয়েছে। প্রথম বেতারে প্রচারিত হয়েছিল শুধু বঙ্গবন্ধুকে হত্যার খবর। বেলা দুপুর না-গড়াতেই খবর পেলাম, স্বাধীন বাংলাদেশের স্থপতিকে সপরিবারে হত্যা করা হয়েছে। তার পত্নী, ভাই, তিন ছেলে (ছােট ছেলে রাসেলের বয়স তখন ১০ বছর ।), দুই ছেলের নববিবাহিত বউ, ভাগ্নে ও ভগ্নীপতিদের পরিবারের অনেক সদস্য কেউ নেই। বেঁচে গেছেন মাত্র তার দুই মেয়ে। তারা তখন বিদেশে। এমন নৃশংস ও বর্বর হত্যাকাণ্ড বাংলাদেশে ঘটতে পারে, তা আগে কেউ কল্পনা করতে পারেনি।
 
১৫ আগস্ট ভারতের স্বাধীনতা দিবস। ভারত তখন বাংলাদেশের সবচাইতে বড় মিত্র দেশ। ওইদিন সন্ধ্যায় লন্ডনের ভারতীয় দূতাবাস স্বাধীনতা দিবস উপলক্ষে একটা রিসেপশনের আয়ােজন করেছিল। লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশের অনেক বিশিষ্ট নাগরিকের সঙ্গে আমিও এই রিসেপশনে আমন্ত্রিত হয়েছিলাম। আমরা কেউ যাইনি। ঢাকায় এতবড় রক্তাক্ত পরিবর্তন ঘটার খবর শােনার পর কোনাে আনন্দ-উৎসবে যােগ দেয়ার মতাে মনের অবস্থা আমাদের কারােরই ছিল না।  পরদিন লন্ডনের ইন্ডিয়া উইকলি’র তৎকালীন সম্পাদক লন্ডনে বসবাসকারী ভারতীয়দের মধ্যে অত্যন্ত প্রভাবশালী ব্যক্তি ড, তারাপদ বসু আমাকে টেলিফোন করলেন। বললেন : গত সন্ধ্যায় আমাদের ইন্ডিপেন্ডেন্টস ডে-র অনুষ্ঠানে তােমাদের কাউকে দেখলাম না। আমিও আশা করিনি, তােমরা আসবে অথবা আসতে পারবে। সেজন্য তােমাকে টেলিফোন করিনি। মুজিব-হত্যার খবর পাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই আমার মনে একটা প্রশ্ন জেগেছে, তােমাদের রাষ্ট্রপতিকে সপরিবারে হত্যার জন্য হত্যাকারীরা কেন বেছে বেছে ভারতের স্বাধীনতা দিবসটিকেই বেছে নিল?
 
প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছিল। কিন্তু মহাশােকের আধিক্যে প্রশ্নটা মনে তখনো তেমন বড় হয়ে ওঠেনি। ভাই ও বসুকে বললাম, প্রশ্নটা আমার মনেও জেগেছে। তবে এ নিয়ে চিন্তাভাবনা করার অবকাশ এখনাে পাইনি।
 
ব্যাপারটা নিয়ে ভাবছি। যদি কোনাে জবাব খুঁজে পাই তােমাকে জানাব। তুমিও এ সম্পর্কে কোনাে সিদ্ধান্তে এলে আমাকে জানিও।
 
তথাস্তু বলে টেলিফোনের রিসিভার রেখে দিয়েছিলাম। কিন্তু একটা কথা স্মরণ হতেই চমকে উঠলাম। স্মরণ হল লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় গতকাল ১৫ আগস্টের সংখ্যায় একটা ডাবল কলাম বিজ্ঞাপন ছাপা হয়েছিল। বিজ্ঞাপনটির শিরােনাম ইংরেজি থেকে বাংলায় অনুবাদ করলে দাঁড়ায়—“মিনি ডিক্টেটর মুজিবকে উৎখাতের ডাক।” বিজ্ঞাপনের ভেতরে শেখ মুজিবকে স্বৈরাচারী, গণনির্যাতনকারী, রক্ষীবাহিনীর সাহায্যে ফ্যাসিসট কায়দায় দেশ শাসনকারী ইত্যাদি আখ্যা দিয়ে। তাকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ডাক দেয়া হয়েছে। কারা এই ডাকটি দিয়েছেন তাদের নাম নেই। কেবল লন্ডনের একটি ঠিকানা দেয়া হয়েছে এবং বিজ্ঞাপনদাতাদের পরিচয় হিসেবে বলা হয়েছে-“বাংলাদেশের জনগণের কল্যাণকামী।”
 
‘টাইমস’ পত্রিকায় ছাপা হওয়া এই বিজ্ঞাপনটি ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) দুপুরেই আমার চোখে পড়েছিল। কিন্তু মন তখন শােকে এক অভিভূত এবং ঢাকার পরবর্তী ঘটনাবলি জানার জন্য এতই উদগ্রীব যে, তাকে কোনাে গুরুত্ব দেইনি। লন্ডনেও বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক লােক তখন মুজিববিরােধী তৎপরতায় লিপ্ত হয়েছিল। তারা গােপন প্রচারপত্রও বিলি করত। সুতরাং এই বিজ্ঞাপনও তাদের কাজ মনে করে কোনাে গুরুত্ব দেয়ার প্রয়ােজন মনে করিনি। কিন্তু মনে শােকের প্রাবল্য কমতেই এবং একটা দিন চলে যেতেই বিজ্ঞাপনটির কথা আচমকা মনে পড়ল এবং আগের দিনের ‘টাইমস’ পত্রিকাটি বের করে। বিজ্ঞাপনটি আবার পড়লাম। বসুর মতো আমার মনেও প্রশ্ন দেখা দিল। বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যা করার জন্য ঘাতকের ১৫ আগস্ট দিনটিকে বেছে নিল কেন? সবচাইতে বড় কথা, তারা কি নিশ্চিত হয়েছিল যে, ১৫ আগস্ট তারিখেই এই হত্যাকাণ্ড ঘটানাে সম্ভব হবে? নইলে লন্ডনের কাগজে এই তারিখেই বিজ্ঞাপনটি প্রকাশের জন্য তারা আগে স্পেস বুকিং দিয়েছিল কীভাবে?
আমি নিজেই এ ব্যাপারে একটু খোঁজখবর নেয়ার চেষ্টা করেছিলাম। ‘টাইমস পত্রিকার অফিস তখন সেন্ট্রাল লন্ডনের গ্রেজ ইন রােডে। সেই অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপনটি কারা দিয়েছেন, কবে দিয়েছেন তার খোঁজ নিয়েছিলাম। টাইমসের বিজ্ঞাপন বিভাগ এই ব্যাপারে মুখ খুলতে নারাজ। আমি ওই বিজ্ঞাপনদাতাদের কেউ নই জেনে বললেন, এই ব্যাপারে আমাকে কিছু জানাতে তারা অপারগ। এর একবছর পর লন্ডন থেকে প্রকাশিত অধুনালুপ্ত সাপ্তাহিক ‘বাংলার ডাক কাগজে বঙ্গবন্ধুর প্রথম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে লেখা আমার এক কলামে এই বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করি। আরও কিছুকাল পর লন্ডনে বসবাসকারী বাংলাদেশের প্রবীণ সাংবাদিক এবং সাহিত্যিক আবদুল মতিন যখন বঙ্গবন্ধুর ওপর একটি বই লিখতে শুরু করেন, তখন আমার পুরােনাে লেখা থেকে এই বিজ্ঞাপনটির কথা উল্লেখ করেন এবং তিনি নিজেও বিজ্ঞাপনটি সম্পর্কে খোঁজখবর নিতে শুরু করেন। এবার “টাইমস’ পত্রিকায় অফিসে গিয়ে বিজ্ঞাপনটির সম্পর্কে তথা সংগ্রহে আমার অসুবিধা হয়নি। ঘটনাটি বহু পুরােনাে বিধায় টাইমস-এর বিজ্ঞাপন বিভাগ এ সম্পর্কে আমাকে প্রয়োজনীয় তথ্য জানাতে সাহায্য করে।
 
বঙ্গবন্ধু হত্যার কয়েক বছর পর এই বিজ্ঞাপন সংক্রান্ত ব্যাপারে যে তথ্যটি জেনে আমি বিস্মিত হই, তা হল টাইমস-এ বঙ্গবন্ধুকে ক্ষমতা থেকে উৎখাতের ডাক দেয়ার বিজ্ঞাপনটি দেয়া হয়েছিল ৬ আগস্ট তারিখে জাপা হওয়ার জনা। পরে তড়িঘড়ি তারিখ সরিয়ে ১৫ আগস্টে নেয়া হয়। যারা বিজ্ঞাপনটি দেয়ার জন্য ‘টাইমস’ পত্রিকার কন্ট্রাক্ট সই করেছিলেন তাদের একজন ছিলেন লন্ডন থেকে প্রকাশিত একটি বাংলা সাপ্তাহিকের মালিক-সম্পাদক। তিনি খন্দকার মােশতাকের খুবই ঘনিষ্ঠ ব্যক্তি ছিলেন। পরে মােশতাকের দল ছেড়ে এরশাদের জাতীয় পার্টিতে যােগ দিয়ে বাংলাদেশের সংসদ সদস্য হয়েছিলেন। তাঁর মন্ত্রী হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু তার আগেই দুরারােগ্য ক্যান্সার রােগে মারা যান।
 
আমার মনে সাংবাদিকসুলভ অনুসন্ধিৎসা তখনই প্রবল হয়ে ওঠে যে, লন্ডনের কাগজে যে বিজ্ঞাপনটি ছাপা হওয়ার কথা ছিল ৬ আগসট (১৯৭৫) তারিখে, সেটিকে ১৫ আগষ্ট তারিখ পর্যন্ত পিছিয়ে নেয়া হয়েছিল কেন? পরে এই প্রশ্নটির জবাব পেয়েছি বঙ্গবন্ধুর হত্যাকারীদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ কোনাে কোনাে সূত্র থেকে। তারপর বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলা যখন শুরু হয় তখন কোনাে কোনাে অভিযুক্তের জবানবন্দি থেকেও বিষয়টি আমার কাছে স্পষ্ট হয়েছে।
 
১৯৭৫ সালের ৮ আগস্ট তারিখে চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় একটি উপগ্রহ যােগাযােগ কেন্দ্র উদ্বোধনের জন্য বঙ্গবন্ধুর সেখানে যাওয়ার কথা ছিল। ঘাতকেরা প্ল্যান করেছিল তাকে চট্টগ্রামের বেতবুনিয়ায় অ্যাম্বুশ করে হত্যা করা হবে। পরিকল্পনাটি পরে পাল্টানাে হয় এবং ১৫ আগস্ট তারিখে ঢাকায় বাসভবনেই তাঁকে সপরিবারে হত্যার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। লন্ডনে হত্যাকারীদের সমর্থকদের তারিখ পাল্টানাের কথা জানিয়ে দেয়া হলে তারা বিজ্ঞাপনটি প্রকাশে দিনটিও পাল্টে দেন।  এরপরও একটি প্রশ্ন আমার মনে থেকে যায়, যে প্রশ্নটি ১৫ আগস্টের ঘটনার পরদিন “ইন্ডিয়া উইকলির’ সম্পাদক ড. তারাপদ বসু আমাকে জিজ্ঞাসা করেছিলেন । ১৫ আগস্ট তারিখটি ভারতের স্বাধীনতা দিবস জেনেও হত্যাকারীরা কেন ওই তারিখটিকেই বেছে নিয়েছিল? এই প্রশ্নটির সঠিক জবাব এই দীর্ঘকালেও আমি জানতে পেয়েছি তা বলতে পারব না। কিন্তু পরবর্তী কয়েক বছরে হত্যাকারীদের নেতৃস্থানীয় কারাে কারো কথাবার্তা, সাংবাদিকদের দেয়া সাক্ষাৎকার এবং তাদের দ্বারা গঠিত ফ্রিডম পার্টির নেতা ও মুখপত্রটির প্রচার-প্রােপাগান্ডার ধরণ থেকে বুঝতে অসুবিধা হয়নি যে, বঙ্গবন্ধুর হত্যাকাণ্ডটি পূর্বপরিকল্পিত এবং হত্যাকাণ্ডের দিনটি অনেক ভেবেচিন্তে নির্ধারণ করা হয়েছিল।
মুজিবহুত্যার বহুপূর্বেই লন্ডনে বাংলাদেশের কিছু স্বাধীনতাবিরােধী ব্যক্তিকে জড়ো করে একটি চক্র গড়ে তোলা হয়েছিল। তার প্রধান নেতা ছিলেন ব্যারিস্টার আক্কাস আলি নামে বাংলাদেশের এক আইনজীবী। তিনি পাকিস্থানী এবং প্রচণ্ড ভারত-বিরোধী বলে পরিচিত ছিলেন। তার নেতৃত্বে লন্ডনভিত্তিক একটি স্বাধীন পূর্ব পাকিস্তান সরকার গঠন করা হয়। এরা নিয়মিত লিফলেট, বুকলেট প্রকাশ করতেন এবং ‘আলহেলাল’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। পত্রিকাটি এখনাে আছে।
 
এই পাকিস্তানপন্থী বাংলাদেশী চক্রটিকে মৃত্যুর আগ পর্যন্ত সর্বপ্রকার সমর্থন ও সাহায্য যুগিয়েছেন বাংলাদেশের এক রাজনৈতিক নেতা মাহমুদ আলী। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের সময় তিনি পাকিস্তানে (তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে) পালিয়ে যান এবং পাকিস্তানে ইয়াহিয়ার মন্ত্রিসভায় যােগ দেন। এরপর পাকিস্তানে বহুবার সরকার পরিবর্তন ঘটেছে, কিন্তু মাহমুদ আলী প্রতিটি সকাৱে মন্ত্রী থেকে গেছেন। তার প্রধান কাজ ছিল লন্ডনে বাংলাদেশ-বিরােধী ষড়যন্ত্রের একটি শক্ত ঘাঁটি গড়ে তোলার ব্যাপারে ইসলামাবাদে বসে সর্বপ্রকার আর্থিক ও অন্যান্য সাহায্য যােগানাে। এ কাজে জন্য তিনি মাঝে মাঝেই লন্ডনে আসতেন। এখানে এসে তার সমর্থকদের নিয়ে সভা করে বাংলাদেশের স্বাধীনতালাভকে ভারতে ঔপনিবেশ হওয়া এবং শেখ মুজিবকে ভারতের তাবেদার বলে অভিযােগ তুলে বক্তৃতা করছেন। তার প্রধান শ্লোগান ছিল-“ভারতের দাসত্বের জিঞ্জিরা ভাঙতে হবে, তাবেদার মুজিবকে ক্ষমতা থেকে উৎখাত করতে হবে।”
 
মাহমুদ আলীর পাশাপাশি লন্ডনস্থ পাকিস্তানের দূতাবাসের গােয়েন্দা-চক্রও বাংলাদেশবিরােধী চক্রান্তের প্রত্যক্ষভাবে সাহায্য যোগাতে থাকে। এই ব্যাপারে সউদি-কানেকশনের আভাস পাওয়া যায়। সউদি অর্থসাহায্যে ব্রিটেনে পলাতক জামায়াত সদস্য এবং একাত্তরের যুদ্ধাপরাধী এবং ঘাতকদের বেশ কয়েকজন শক্তিশালী ও সংঘবদ্ধ হয়ে উঠতে থাকে। তাদের প্রচারণার প্রধান টার্গেট ছিল মুজিব সরকার এবং ভারত। ঢাকা ও দিল্লির মধ্যে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধকালীন যে সহযােগিতা ও শৈলী গড়ে ওঠে তা ভাঙতে পারলেই বাংলাদেশে মুজিব-সরকারকে উৎখাত করা সম্ভব বলে তারা ধরে নিয়েছিল। ১৯৭৪ সালে তারা বাংলাদেশে বন্যা ও দুর্ভিক্ষ হওয়ার জন্য ভারতকে দায়ী করে এবং তাদের প্রচারপত্রে বঙ্গবন্ধু হত্যার কিছু আগেই ভবিষ্যৎবাণী করা হয়, শীঘ্রই বাংলাদেশ মুজিব-সরকারকে উৎখাত করে ভারতের তাঁবেদারির অবসান ঘটানাে যাবে। 
 
নানা তথ্যসূত্র থেকেই আমি জানতে পেরেছিলাম যে, পাকিস্থানের সামরিক জান্তার গােয়েন্দাচক্রের অনুমােদনক্রমেই বঙ্গবন্ধু হত্যার দিন হিসেবে ১৫ আগষ্ট তারিখটিকে বেছে নেওয়া হয়েছিল। উদ্দেশ্য, বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনে ভারত যে সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছিল, সেই হাতটিকে একটু মুচড়ে দিয়ে প্রতিশােধ গ্রহণ। দ্বিতীয়ত, ভারতের স্বাধীনতা দিবসের আনন্দ-উৎসবে বাংলাদেশের মানুষ যাতে আর কোনােদিন প্রসন্নমনে যােগ দিতে না পারে তার ব্যবস্থা করা। একই দিনে ভারতে স্বাধীনতা দিবসে আনন্দ-উৎসব এবং পাশাপাশি প্রতিবেশী বাংলাদেশে জাতি গভীর শােক দিবসের বেদনাবিধুর পরিবেশ। বাংলাদেশের মানুষ প্রতিবেশীর আনন্দে সাগ্রহে শরিক হবে, না নিজেদের গভীর শােকে নীরবে অথবা প্রকাশ্যে অশ্রুপাত করবে? বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য কেবল ১৫ আগস্ট তারিখটিকেই বেছে নিয়ে খুনীচক খুশি থাকেনি, বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর তারা রটিয়ে দিয়েছিল ভারত শেখ পরিবারকে উদ্ধার করার জন্য শেষমুহূর্তে একটি সামরিক হেলিকপ্টার ঢাকায় পাঠিয়ে দিয়েছিল। সেটি ঢাকায় অবতরণ করতে না পেরে পালিয়ে যায়। ঢাকার বহু কাগজে বড় করে এই খবরটি প্রকাশের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। কিন্তু পরে জানা গেছে, খবরটি ছিল সর্বৈৰ মিথ্যা। শেখ মুজিবকে ভারতের তাবেদার এবং ভারত বাংলাদেশে হস্তক্ষেপ করতে আগ্রহী এটা প্রমাণ করার জন্য এই মিথ্যা প্রচারণাটি চালানাে হয়েছিল।
 
এই প্রোভোকেশনের মূলেও দিল্লির তৎকালীন আচরণ দুদেশেরই অনেক মানুষকে বিস্মিত করেছে। খন্দকার মােশতাক মুজিব হত্যা করে পালের গােদা এবং তার সরকার কয়েকজন খুনী মেজরের সমর্থননির্ভর জেনেও বঙ্গভবনে ছুটে গিয়ে খন্দকার মােশতাকের সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হন এবং তার সরকারকে মেনে নেন। জেনারেল জিয়াউর রহমান যখন বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদটি দখল করেন, তখন স্বয়ং ভারতের রাষ্ট্রপতি তাকে ‘স্বাধীনতার ঘােষক ও স্বাধীনতা যুদ্ধের সেনাপতি’ বলে সার্টিফিকেট দেন এবং জিয়াউর রহমান সম্পর্কে বলা হয়, তিনি হচ্ছেন ‘অন্ধকার মেঘে চিকন আলাের রেখা।” ভারতে রাজীব গান্ধীর প্রধানমন্ত্রিত্বের আমলে দুদেশেরই অনেকে মনে করতেন, বাংলাদেশে এরশাদ সরকারের প্রকৃত পেইন হচ্ছে দিল্লির কংগ্রেস সরকার। অনেক পরে এরশাদ সম্পর্কে রাজীব গান্ধীর মোহভঙ্গ হয়।
 
ঢাকায় জিয়াউর রহমান থেকে এরশাদ, এরশাদ থেকে খালেদা জিয়া, এদের প্রত্যেকটি সরকার নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ভারত-বিদ্বেষের কার্ডটি ব্যবহার করেছেন। তাতে বাংলাদেশের জাৰ্তীয় স্বার্থের কল্যাণ হয়নি। বরং অকল্যাণই হয়েছে। জাতির জনক হিসাবে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মর্যাদা নিয়েও প্রত্যেকটি সামরিক ও স্বৈরতান্ত্রিক সরকার দাবার চাল চেলেছেন এবং বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তাঁর দেশের মানুষের মনে যে ক্রমবর্ধিত আবেগ ও ভালােবাসা তাকে ম্যানিপুলেট করে নিজেদের ক্ষমতার স্বার্থে ব্যবহার করতে চেয়েছেন।
 
জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় বসার পর আওয়ামী লীগারদের সমর্থন সংগ্রহের আশায় প্রলােভন দেখিয়েছিলেন, তিনি বঙ্গবন্ধুকে জাতির পিতা ঘােষণা করতে যাচ্ছেন। এ সম্পর্কে তার ঘােষণার খসড়াও নাকি তৈরি হয়ে গিয়েছিল। তারপর কী এক রহস্যময় কারণে সেই ঘােষণা প্রচার স্থগিত হয়ে যায়। তারপরই শুরু হয় বঙ্গবন্ধুর নাম-নিশানা ইতিহাস থেকে মুছে ফেলার এবং মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস, বিকৃতির অপচেষ্টা। জেনারেল এরশাদও ক্ষমতা দখলের পর এমন ভাবসাব দেখাতে শুরু করেছিলেন যে, বঙ্গবন্ধুকে সরকারিভাবে জাতির পিতা ঘােষণা মাত্র দিনক্ষণের ব্যাপার। কিন্তু তার প্রায় দীর্ঘ ১০ বছরের শাসনামলে দেখা গেল তিনি নিজেকে নিজেই ‘পল্লীবন্ধু’ খেতাব দিয়ে জাতির একমাত্র ত্রাণকর্তা সাজার চেষ্টা করছেন। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের বিচার করা দূরের কথা, অন্যতম প্রধান খুনী কর্নেল (অব.) ফারুককে তিনি রাষ্ট্রপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করারও সুযোগ দিয়েছিলেন। তার আমলেও ভারত বিরােধী প্রচারণা জোরেশােরে চলতে দেয়া হয় এবং যে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানাে হয় তার পেছনে ছিল তার সরকারের প্রত্যক্ষ মদদ।
খালেদা-নিজামী সরকারের আমলে বঙ্গবন্ধুর মর্যাদা রক্ষা দূরের কথা, তাঁর ছবির অমর্যাদা, তার নামাঙ্কিত বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের নাম বদল, জেনারেল জিয়াউর রহমানকে তাঁর সমমর্যাদার জাতীয় বীর হিসেবে প্রতিষ্ঠাদানের নির্লজ্জ প্রচেষ্টা চালানাে হয়। পাশাপাশি চলতে থাকে তার বিদ্বেষ প্রচার এবং আওয়ামী লীগকে ভারতের ‘সেবাদাস’ আখ্যা দিয়ে বিএনপির সর্বোচ্চ পর্যায় থেকে অনবরত প্রচারণা।
 
বর্তমান বছরে ১১ জানুয়ারির পটপরিবর্তনের পর অবশ্য এই অবস্থার কিছুটা বদল হয়েছে। বর্তমান তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বঙ্গবন্ধুর জন্মদিনে তাঁর টুঙ্গিপাড়ার সমাধিতে গিয়ে শ্রদ্ধা নিবেদন করেন এবং আজ (১৫ আগস্ট) মৃত্যুদিবসেও রাষ্ট্রপতি ও প্রধান উপদেষ্টা দুজনেই টুঙ্গিপাড়ায় শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য যাবেন।
 
অন্যদিকে সেনাপ্রধান বেশ কিছুকাল আগেই স্বীকার করেছেন, জাতির জনক এবং জাতীয় নেতাদের এতদিন যথাযােগ্য মর্যাদা দেওয়া হয়নি। এখন তারা তা দেবেন। ইতিহাসে বঙ্গবন্ধুর নাম মর্যাদার সঙ্গে সংযােজনের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। একই সঙ্গে ভারতবিদ্বেন্ধী প্রচারের মাত্রাও এখন খুব কম। কিন্তু অতীতের নজির টেনে অনেকেই বলছেন, এই অবস্থাটা কতদিন বজায় থাকবে, তা দেখার বিষয়। নাকি পেছনে আবার অদৃশ্য কলকাঠি নড়ে উঠবে এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক দৃশ্যপট আর অঞ্জীতের মতাে বদলে যাবে। এ-সম্পর্কে চূড়ান্ত কথা বলার সময় এখনাে আসেনি। 
 
বঙ্গবন্ধুর স্বঘােষিত খুনীদের আপিল মামলার শুনানি বহু টালবাহানার পর আবার শুরু হয়েছে। অনেকের ধারণা, এই মামলায় কী রায় হয় এবং খুনীদের দণ্ড বহাল থাকলে তা কীভাবে কার্যকর করা হয় তা দেখার জন্য এখন অপেক্ষা করাই ভালাে। বঙ্গবন্ধুর খুনীদের মামলার শুনানির পরিণতি কী পাড়ায়, সেটাই হবে বর্তমান সরকারের চরিত্র-বিচারের সেরা মাপকাঠি।
 
আজ থেকে বত্রিশ বছর আগে যারা বঙ্গবন্ধুকে হত্যার জন্য ১৫ আগস্ট তারিখটিকে বেছে নিয়েছিলেন এবং লন্ডনের ‘টাইমস’ পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছিলেন, তারা অনেকেই এখনাে বেঁচে আছেন এবং বাংলাদেশের রাজনীতিতে তাদের সমর্থকদের যথেষ্ট শক্তিশালী অবস্থান রয়েছে। এবারের পনেরােই আগস্টেও দেখা যাচ্ছে, তাদের অবস্থান মােটেও দুর্বল হয়নি।
 
জনকণ্ঠ ১৫ আগস্ট ২০০৭
 
 
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!