You dont have javascript enabled! Please enable it!
বাইগার নদীর তীরে ঘেঁষে ছবির মতাে সাজানাে সুন্দর একটি গ্রাম। সে গ্রামটির নাম টুঙ্গিপাড়া। বাইগার নদী এঁকেবেঁকে গিয়ে মিশেছে মধুমতী নদীতে। এই মধুমতী নদীরই অসংখ্য শাখানদীর একটি নদী বাইগার নদী। নদীর দুপাশে তাল, তমাল-হিজল গাছের সবুজ সমারােহ। ভাটিয়ালী গানের সুর ভেসে আসে হালধৱা মাঝির কণ্ঠ থেকে, পাখির গান আর নন্দীর কলকল ধ্বনি এক অপূর্ব মনােরম পরিবেশ গড়ে তােলে। প্রায় দুশাে বছর পূর্বে মধুমতী নদী এই গ্রাম ঘেঁষে বয়ে যেত। এই নদীর তীর ঘেঁষেই গড়ে উঠেছিল জনবসতি। প্রকৃতির অমােঘ নিয়মে ধীরে ধীরে নদীটি শুকিয়ে যায়। চর জেগে গড়ে ওঠে আরও অনেক গ্রাম।
 
সেই দুশাে বছর আগে ইসলাম প্রচারের দায়িত্ব নিয়েই আমাদের পূর্বপুরুষরা এসে এই নদীবিধৌত প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও সুষমমণ্ডিত ছােট গ্রামটিতে তাদের বসত গড়ে তােলেন। এবং তাদের ব্যবসা-বাণিজ্য ছিল কলকাতা বন্দরকে কেন্দ্র করে। অনাবাদি জমিজমা চাষবাস শুরু করেন এবং গ্রামের বসবাসকারী কৃষকদের নিয়ে একটি আত্মনির্ভরশীল গ্রাম হিসেবেই এই গ্রামটিকে বেশ বর্ধিষ্ণু গ্ৰামরূপে গড়ে তােলেন। যাতায়াতের ব্যবস্থা প্রথমে শুধু নৌকাই ছিল একমাত্র ভরসা। পরে গােপালগঞ্জ থানা স্টিমারঘাট হিসেবে গড়ে ওঠে। আমাদের পূর্বপুরুষরা টুঙ্গিপাড়া গ্রামে জমিজমা ক্রয় করে বসতির জন্য কলকাতা থেকে কারিগর ও মিস্ত্রি এনে দালানবাড়ি তৈরি করেন, যা সমাপ্ত হয় ১৮৫৪ সালে। এখনও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে সেই যে দুটো দালানে বসতি ছিল, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আগুন দিয়ে সে দুটোই জ্বালিয়ে দেয়।
 
এই দালানকোঠায় বসবাস শুরু হবার পরে ধীরে ধীরে বংশবৃদ্ধি হতে থাকে আর আশপাশে বসতির সংখ্যাও বৃদ্ধি পায়। এই দালানেরই উত্তর-পূর্ব কোণে টিনের চালাঘর তােলেন আমার দাদার বাবা শেখ আবদুল হামিদ। আমার দাদা শেখ লুৎফর রহমান এই বাড়িতেই সংসার গড়ে তােলেন। আর এখানেই জন্ম নেন আমার বাবা।
 
 ১৯২০ সালের ১৭ মার্চ। আমার আব্বার নানা শেখ আব্দুল মজিদ আমার আব্বার আকিকায় নাম রাখেন শেখ মুজিবুর রহমান। আমার দাদীর প্রথম দুই কন্যা সন্তানের পর প্রথম পুত্রসন্তান আমার আব্বা। আর তাই আমার দাদীর বাবা তার সব সম্পত্তি দাদীকে দান করেন এবং নাম রাখার সময় বলে যান, ‘মা সায়রা তাের ছেলের এমন নাম রাখলাম যে নাম জগৎজোড়া খ্যাত হবে।’
 
আমার আব্বার শৈশব কেটেছিল টুঙ্গিপাড়ার নদীর পানিতে ঝাঁপ দিয়ে, মেঠো পথের ধুলােবালি মেখে। বর্ষার কাদাপানিতে ভিজে। বাবুই পাখি বাসা কেমন করে গড়ে তোলে, মাছরাঙ্গা কীভাবে ডুব দিয়ে মাছ ধরে। কোথায় দোয়েল পাখির বাসা, দোয়েল পাখির সুমধুর সুর আমার আব্বাকে দারুণভাবে আকৃষ্ট করত। আর তাই গ্রামের ছোট ছেলেদের সঙ্গে করে মাঠে ঘাটে ঘুরে প্রকৃতির সঙ্গে মিশে বেড়াতে তাঁর ভালাে লাগত। ছোট্ট শালিক পাখির ছানা, ময়না পাখির ছানা ধরে তাদের কথা বলা ও শিস দেওয়া শেখাতেন। বানর ও কুকুর পুষতেন, তাঁর কথামতো যা বলতেন তাই তারা করত।  আবার এগুলি দেখাশােনার ভার দিতেন ছোটবােন হেলেনের উপর।  এই পােষা পাখি জীব-জন্তুর  প্রতি এতটুকু অবহেলা তিনি সইতে পারতেন না। মাঝে মাঝে এজন্য ছোটবােনকে বকাও খেতে হত।
 
আমাদের বাড়ির দক্ষিণ-পশ্চিমদিকে ঘেঁষে একটি সরু খাল চলে গেছে, যে খাল আলী ও বাইগার নদীর সংযােগ রক্ষা করে। এই খালের পাড়েই ছিল বড় কাছারি ঘর।  আর এই কাছারির পাশে মাস্টার, পন্ডিত ও মৌলবি সাহেবদের থাকার ঘর ছিল। এরা গৃহশিক্ষক হিসেবে নিয়ােগপ্রাপ্ত ছিলেন এবং তাদের কাছে আমার বাবা আরবি, বাংলা, ইংরেজি ও অঙ্ক শিখতেন।
 
আমাদের পূর্বপুরুষদেরই গড়ে তােলা গিমাডাঙ্গা টুঙ্গিপাড়া স্কুল। তখন ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। বাড়ি থেকে প্রায় সােয়া কিলােমিটার দূর।  আমার আব্বা এই স্কুলে প্রথম লেখাপড়া করেন। একবার বর্ষাকালে নৌকা করে স্কুল থেকে ফেরার সময় নৌকা ডুবে যায়।  । আমার আব্বা খালের পানিতে পড়ে যান। এরপর আমার দাদী তাকেঁ আর ঐ স্কুলে যেতে দেননি। আর একরত্তি ছেলে, চোখের মণি, গোটা বংশের আদরের দুলাল,তাঁর এতটুকু কষ্ট যেন সকলেরই কষ্ট! সেই স্কুল থেকে নিয়ে গিয়ে গােপালগঞ্জ মিশনারি স্কুলে ভর্তি করে দেন। গােপালগঞ্জ আমার দাদার কর্মস্থল ছিল। সেই থেকে গােপালগঞ্জেই তিনি পড়ালেখা করতে শুরু করেন। মাঝখানে একবার দাদা মাদারীপুর বদলি হন। তখন কিছুদিনের জন্য মাদারীপুরেও আব্বা পড়ালেখা করেন। পরে গােপালগঞ্জেই তাঁর কৈশাের বেলা কাটে।
আমার আব্বার শরীর ছিল বেশ রােগা। তাই আমার দাদি সব সময়ই ব্যস্ত থাকতেন কিভাবে তাঁর খােকার শরীর ভালাে করা যায় । আদর করে দাদা-দাদিও খােকা বলেই ডাকতেন। আর ভাইবােন গ্রামবাসীদের কাছে ছিলেন ‘মিয়া ভাই’ বলে পরিচিত। গ্রামের সহজ সরল মানুষদের সঙ্গে অত্যন্ত সহজভাবে তিনি মিশতেন। আমার দাদি সব সময় ব্যস্ত থাকতেন খােকার শরীর সুস্থ করে তুলতে। তাই দুধ, ছানা, মাখন ঘরেই তৈরি হত। বাগানের ফল, নদীর তাজা মাছ সব সময় খােকার জন্য বিশেষভাবে প্রস্তুত থাকত। কিন্তু আমার আব্বা ছােট্ট বেলা থেকেই ছিপছিপে পাতলা ছিলেন, তাই দাদির আফসােসেরও সীমা ছিল না কেন তার খােকা একটু হৃষ্টপুষ্ট নাদুশ-নুদুশ হয় না। খাবার বেলায় খুব সাধারণ ভাত, মাছের ঝােল, সবজিই তিনি পছন্দ করতেন। খাবার শেষে দুধ ভাত-কলা ও গুড় খুব পছন্দ করতেন। আমার চার ফুপু ও এক চাচা ছিলেন। এই চার বােনের মধ্যে দুই বােন বড় ছিলেন। ছােট্ট ভাইটির যাতে কোনাে কষ্ট না হয় এজন্য সদা সর্বদা ব্যস্ত থাকতেন বড় দুই বােন। বাকিরা ছােট্ট কিন্তু দাদা-দাদির কাছে খােকার আদর ছিল সীমাহীন। আমাদের বাড়িতে আশ্রিতের সংখ্যাও ছিল প্রচুর। আমার দাদার ও দাদির বােনদের ছেলে-মেয়ে বিশেষ করে যারা পিতৃহারা-মাতৃহারা তাদেরকে দাদা-দাদি নিজেদের কাছে এনেই মানুষ করতেন। আর তাই প্রায় সতেরাে আঠারাে জন ছেলে-মেয়ে একই সঙ্গে বড় হয়ে ওঠে। আব্বার যখন দশ বছর তাঁর বিয়ে হয়। আমার মায়ের বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। আমার মা পিতৃহারা হবার পর তার দাদা এই বিয়ে দিয়ে সমস্ত সম্পত্তি মা ও খালার নামে লিখে দেন। আমার খালা মায়ের থেকে তিন চার বছরের বড়। আত্মীয়ের মধ্যেই দুই বােনকে বিয়ে দেন এবং আমার দাদাকে (গার্জিয়ান) মুরুব্বি করে দেন। আমার মার যখন ছয়-সাত বছর বয়স তখন তার মা মারা যান এবং তখন আমার দাদি কোলে তুলে নেন আমার মাকে। আর সেই থেকে একই সঙ্গে সব ছেলে মেয়েদের সঙ্গে মানুষ হন।
আমার আব্বার লেখাপড়ার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি দারুণ ঝোঁক ছিল। বিশেষ করে ফুটবল খেলতে খুব পছন্দ করতেন। মধুমতী নদী পার হয়ে চিতলমারী ও মােল্লারহাট যেতেন খেলতে। গােপালগঞ্জে স্কুলের টিম ছিল। এদিকে আমার দাদাও খেলতে পছন্দ করতেন। আব্বা যখন খেলতেন তখন দাদাও মাঝে মাঝে খেলা দেখতে যেতেন। দাদা আমাদের কাছে গল্প করতেন যে, তােমার আব্বা এত রােগা ছিল যে, বলে জোরে। লাথি মেরে মাঠে গড়িয়ে পড়তাে। আব্বা যদি ধারে কাছে থাকতেন তবে সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করতেন। আমরা তখন সত্যিই খুব মজা পেতাম। এর। পেছনে মজার ঘটনা হল মাঝে মাঝে আব্বার টিম ও দাদার টিমের মধ্যেও খেলা হত। আমি যখন ঐ সমস্ত এলাকায় যাই, অনেক বয়স্ক লােকের সঙ্গে পরিচয় হয় যারা আব্বার ছােটবেলার কথা বলেন। আমাদের বাড়িতে এই খেলার অনেক ফটো ও কাগজ ছিল। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী আমাদের বাড়ি পুড়িয়ে দেয়। ফলে সব শেষ হয়ে যায়।
তিনি ছােটবেলা থেকে অত্যন্ত হৃদয়বান ছিলেন। তখনকার দিনে। ছেলেদের পড়াশােনার তেমন সুযােগ ছিল না। অনেকে বিভিন্ন বাড়িতে। জায়গির থেকে পড়াশুনা করতাে। চার পাঁচ মাইল পথ হেঁটে স্কুলে আসতে হত। সকালে ভাত খেয়ে স্কুলে আসত। আর সারাদিন অভুক্ত অবস্থায়। অনেকদূর হেঁটে তাদের ফিরতে হত। যেহেতু আমাদের বাড়িটা ছিল ব্যাংক পাড়ায় আব্বা তাদেরকে বাড়িতে নিয়ে আসতেন। স্কুল থেকে ফিরে দুধভাত খাবার অভ্যাস ছিল এবং সকলকে নিয়েই তিনি খাবার খেতেন। দাদির কাছে শুনেছি আব্বার জন্য মাসে কয়েকটা ছাতা কিনতে হত কারণ আর কিছুই নয়। কোন ছেলে গরিব, ছাতা কিনতে পারে না, দূরের পথ রােদ বৃষ্টিতে কষ্ট হবে দেখে, তাদের ছাতা দিয়ে দিতেন। এমনকি পড়ার বইও মাঝে মাঝে দিয়ে আসতেন।
দাদির কাছে গল্প শুনেছি, যখন ছুটির সময় হত তখন দাদি আমগাছের নিচে এসে দাঁড়াতেন। খােকা আসবে দূর থেকে রাস্তার উপর নজর রাখতেন। একদিন দেখেন তার খােকা গায়ের চাদর জড়িয়ে হেঁটে আসছে, পরনের পায়জামা-পাঞ্জাবি নেই। কি ব্যাপার? এক গরিব ছেলেকে তার শত ছিন্ন কাপড়ে দেখে সব দিয়ে এসেছেন।
আমার দাদা দাদি অত্যন্ত উদার প্রকৃতির ছিলেন। আমার আব্বা যখন কাউকে কিছু দান করতেন তখন কোনােদিনই বকাঝকা করতেন না বরং উৎসাহ দিতেন। আমার দাদা ও দাদীর এই উদারতার আরও অনেক নজির রয়েছে।
 
স্কুলে পড়তে পড়তে আব্বার বেরিবেরি রােগ হয় এবং চোখ নষ্ট হয়ে যায়। ফলে চার বছর লেখাপড়া বন্ধ থাকে। তিনি সুস্থ হবার পর পুনরায় স্কুলে ভর্তি হন। এই সময় আব্বার একজন গৃহশিক্ষক ছিলেন, তাঁর নাম ছিল হামিদ মাস্টার। তিনি ছিলেন ব্রিটিশ বিরােধী আন্দোলনে সক্রিয় এবং বহু বছর জেল খাটেন। পরবর্তী পর্যায়ে আব্বা বিভিন্ন সময় যখন জেলে থাকতেন অথবা পুলিশ গ্রেফতার করতে আসত, আমার দাদী মাঝে মাঝেই সেই মাস্টার সাহেবের নাম নিতেন আর কাঁদতেন। এমনিতে আমার দাদা-দাদী অত্যন্ত উদার মনের মানুষ ছিলেন, ছেলের কোনাে কাজে কখনাে তারা বাধা দিতেন না বরং উৎসাহ দিতেন। অত্যন্ত মুক্ত পরিবেশে আমার বাবার মনের বিকাশ ঘটেছে। প্রতিটি কাজ যখনই যেটা ন্যায়সঙ্গত মনে হয়েছে আমার দাদা তা করতে নিষেধ না করে বরং উৎসাহ দিয়েছেন।
 
আব্বার একজন স্কুল মাস্টার একটা সংগঠন গড়ে তুলে এবং বাড়িবাড়ি ঘুরে ধান, টাকা, চাল, জোগাড় করে গরিব মেধাবী ছেলেদের সাহায্য করতেন। অন্যতম সক্রিয় কর্মী হিসেবে তিনি তার সঙ্গে কাজ করতেন এবং অন্যদের উৎসাহ দিতেন। যেখানেই কোনাে অন্যায় দেখতেন সেখানেই তিনি প্রতিবাদ করতেন। একবার একটি অন্যায়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে তিনি প্রথম সরকার সমর্থকদের দ্বারা ষড়যন্ত্রের শিকার হন ও গ্রেফতার হয়ে কয়েকদিন জেলে থাকেন।
কৈশােরেই তিনি খুব বেশি অধিকার সচেতন ছিলেন। একবার যুক্ত বাংলার মুখ্যমন্ত্রী শেরেবাংলা গােপালগঞ্জে সফরে যান এবং স্কুল পরিদর্শন করেন। সেই সময় সাহসী কিশাের মুজিব তাঁর কাছে স্কুলঘরে বর্ষার পানি পড়ার অভিযোেগ তুলে ধরেন এবং মেরামত করার অঙ্গীকার আদায় করে সবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন।  গােপালগঞ্জ স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাশ করে তিনি কলকাতায় ইসলামিয়া কলেজে পড়তে যান। তখন বেকার হােস্টেলে থাকতেন। এই সময় তিনি হােসেন শহীদ সােহরাওয়ার্দীর সংস্পর্শে আসেন। হলওয়ে মনুমেন্ট আন্দোলনে জড়িয়ে পড়েন সক্রিয়ভাবে। এই সময় থেকে তাঁর রাজনীতিতে সক্রিয় অংশগ্রহণ শুরু হয়।
 
১৯৪৬ সালে তিনি বি.এ. পাশ করেন। পাকিস্তান-ভারত ভাগ হবার সময় যখন দাঙ্গা হয়, তখন দাঙ্গা দমনে সক্রিয় ভূমিকা রাখেন। কাজ করে যেতেন নিজের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। আমার মেজ ফুপু তখন কলকাতায় থাকতেন। ফুপুর কাছে শুনেছি মাঝে মাঝে অভুক্ত অবস্থায় হয়তাে দুদিন বা তিন দিন কিছু না খেয়ে কাজ করে গেছেন। মাঝে মাঝে যখন ফুপুর খোজ খবর নিতে যেতেন তখন ফুপু জোর করে কিছু খাবার খাইয়ে দিতেন। অন্যায়কে তিনি কোনােদিনই প্রশয় দিতেন না। ন্যায় ও সত্য প্রতিষ্ঠার জন্য জীবনের ঝুঁকি নিতে তিনি কখনাে পিছপা হননি।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন বিভাগে ভর্তি হন। তখন তৃতীয় ও চতুর্থ শ্রেণির কর্মচারীদের আন্দোলনে সমর্থন দেন ও সক্রিয় অংশগ্রহণ করেন। সচিবালয়ের সামনে অবস্থান ধর্মঘট করতে গিয়ে গ্রেফতার হন। অল্প কয়েকদিন পর মুক্তি পান। এই সময় পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করার কথা ঘােষণা দেন মুহম্মদ আলী জিন্না এবং উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা হিসেবে ঘােষণা দিলে তদানীন্তন পূর্ব পাকিস্তানের প্রতিটি বাঙালি প্রতিবাদী হয়ে ওঠে। ছাত্র সমাজ এই আন্দোলনে সক্রিয় অংশগ্রহণ কর এই আন্দোলনে ১৯৪৯ সালে আমার আব্বা গ্রেফতার হন। আমি তখন খুবই ছােট্ট আর আমার ছােট ভাই কামাল কেবল জন্মগ্রহণ করেছে। আব্বা ওকে দেখারও সুযােগ পাননি।
একটানা ১৯৫২ সাল পর্যন্ত তিনি বন্দি ছিলেন। সেই সময় আমাদের দুই ভাইবােনকে নিয়ে আমার মা দাদা-দাদির কাছেই থাকতেন। একবার একটা মামলা উপলক্ষে আব্বাকে গােপালগঞ্জ নিয়ে যাওয়া হয়। কামাল তখন অল্প অল্প কথা বলা শিখেছে। কিন্তু আব্বাকে ও কখনও দেখেনি, চেনেও না। আমি যখন বার বার আব্বার কাছে ছুটে যাচ্ছি ‘আব্বা আব্বা বলে ডাকছি ও শুধু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছে। গােপালগঞ্জ থানায় একটা বড় পুকুর আছে, যার পাশে বড় খােলা মাঠ। ঐ মাঠে আমরা দুই ভাইবােন খেলা করতাম ও ফড়িং ধরার জন্য ছুটে বেড়াতাম। আর মাঝে মাঝেই আব্বার কাছে ছুটে আসতাম। অনেক ফুল পাতা কুড়িয়ে এনে থানার বারান্দায় কামালকে নিয়ে খেলতে বসেছি ও হঠাৎ আমাকে জিজ্ঞাসা করল, “হাসু আপা তােমার আব্বাকে আমি একটু আব্বা বলি। কামালের সেই কথা আজ যখন মনে পড়ে আমি তখন চোখের পানি রাখতে পারি না! আজ ও নেই, আমাদের আব্বা বলে ডাকারও কেউ নেই।
ঘাতকের বুলেট শুধু আব্বাকেই ছিনিয়ে নেয়নি; আমার মা, কামাল, জামাল, ছােট্ট রাসেলও রেহাই পায়নি। রেহাই পায়নি কামাল-জামালের নব পরিণীতা বধূ সুলতানা ও রােজী, যাদের হাতের মেহেদির রং বুকের রক্তে মিশে একাকার হয়ে গেছে। খুনিরা এখানেই শেষ করেনি, আমার একমাত্র চাচা শেখ নাসের, তরুণ নেতা আমার ফুপাতাে ভাই শেখ মনি, আমার ছােট্ট বেলার খেলার সাথী শেখ মনির অন্তঃসত্ত্বা স্ত্রী আরজুকে খুন করেছে। এই খুনিরা একই সাথে আক্রমণ করেছে আবদুল রব সেরনিয়াবাত (আমার ফুপা), তাঁর তেরাে বছরের কন্যা বেবী, দশ বছরের ছেলে আরিফকে, তার জ্যেষ্ঠপুত্র আবুল হাসানাত আবদুল্লাহর চার বছরের শিশু পুত্র বাবুও খুনিদের হাত থেকে রেহাই পায়নি। কর্নেল জামিল, যিনি আমার পিতার জীবন রক্ষার জন্য ঘুম থেকে উঠে ছুটে এসেছিলেন তাঁকেও তারা হত্যা করে। এ কেমন বর্বর নিষ্ঠুরতা? আজও গুলির আঘাতে পঙ্গু হয়ে আছেন আমার মেজ ফুপু।  যেদিন কামাল আব্বাকে ‘আব্বা’ ডাকার অনুমতি চেয়েছিল, আমি সঙ্গে সঙ্গে ওকে আব্বার কাছে নিয়ে যাই আব্বাকে ওর কথা বলি। আব্বা ওকে কোলে তুলে নিয়ে অনেক আদর করেন। আজ আর তারা কেউই বেঁচে নেই- আজ যে বার বার আমার মন আব্বাকে ডাকার জন্য ব্যাকুল হয়ে ওঠে। মায়ের স্নেহ, ভাইদের সান্নিধ্য পাবার জন্য উন্মুখ হয়ে থাকি, কিন্তু শত চিৎকার করলেও তাে কাউকে আমি পাব না। কেউ তাে আর সাড়া দিতে পারবে না। তাদের জীবন নৃশংসভাবে বুলেট দিয়ে চিরদিনের মতাে যে ঘাতকেরা স্তব্ধ করে দিল, তাদের কি বিচার হবে না?
১৩ আগস্ট, ১৯৯১
সাপ্তাহিক প্রতিচিত্র আগস্ট ২০০৮ 
Reference – বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বহুমাত্রিক মূল্যায়ন – ড. মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী
error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!