You dont have javascript enabled! Please enable it!

বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ওপর প্রেরিত প্রতিবেদন, বিবিসি, লন্ডন, ৩০শে মার্চ-১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
১।
প্রতিবেদন
৩০শে মার্চ, ১৯৭১
– ইভান চার্লটন

লন্ডনের একজন আইনের ছাত্র যিনি সদ্যই ঢাকা থেকে এসে পৌঁছেছেন তিনি সেখানে সেনাবাহিনীর কর্তৃত্ব গ্রহণ করার বিবরণ দিয়েছেন।

একটি সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় মিঃ এ. কে. এম. সামসুল আলম চৌধুরী বলেন যে তিনি পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব নেয়ার আগেই লন্ডনে যাবার একটি বিমান টিকেট কেনেন। তিনি গতকাল সকালে ঢাকা থেকে আরো অনেক পশ্চিম পাকিস্তানীদের সাথে একটি বিমানে উঠতে সক্ষম হন। তিনি যখন ঢাকা ছাড়েন তখন ঢাকার পরিস্থিতি কেমন ছিল জানতে চাইলে তিনি বলেনঃ “ভয়াবহ”। যেখানে পাকিস্তানের সাংবিধানিক ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনা চলছে সেখানে এধরণের অতর্কিত সামরিক আক্রমণ চালানোর পেছনে কি কারণ থাকতে পারে এ ব্যপারে তাঁর মতামত জানতে চাইলে, তিনি বলেন যে তিনি মনে করেন পশ্চিম পাকিস্তানের নেতৃবৃন্দ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছেন, যাদের মধ্যে মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো অন্যতম, যে তিনি যেন শেখ মুজিবুর রহমান-এর পূর্ব পাকিস্তানের ভবিষ্যতের জন্য প্রস্তাবিত শর্তাবলী মেনে না নেন এবং অস্ত্রপ্রয়োগের সাহায্য নেন। এরপর সন্ধ্যার দিকে ঢাকার জনগণ জানতে পারে যে প্রেসিডেন্ট এবং পশ্চিমের অন্যান্য নেতারা ঢাকা ছেড়ে চলে গেছেন। শহরজুড়ে গুজব ছড়িয়ে পড়ে যে সেনাবাহিনী আক্রমণ করতে যাচ্ছে এবং জনগণ স্বতঃস্ফুর্তভাবে রাস্তায় রাস্তায় অবরোধ তৈরী করতে শুরু করে। তিনি বলেন প্রতিরক্ষা বাহিনীতে পূর্ব পাকিস্তানের যে অংশটি ছিল সেখানে পরিকল্পিত কোন বিদ্রোহ দেখা দেয়নি। রাস্তার অবরোধগুলো সেনাবাহিনী ভেঙে গুঁড়িয়ে দেয়; এরপর চলতে থাকে ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে ধ্বংসযজ্ঞ এবং হত্যালীলা।

মিঃ আলম নিশ্চিত যে শেখ মুজিব জীবিত এবং মুক্ত আছেন। তাঁর এই বিশ্বাসের ভিত্তি হচ্ছে শেখ মুজিবের কাছের লোকদের সূত্র ধরে। তিনি আওয়ামী লীগের একজন কর্মকর্তা কিনা জানতে চাইলে, মিঃ আলম বলেন যে তিনি লন্ডনে শেখ মুজিবের ব্যক্তিগত প্রতিনিধি। সেনাবাহিনী কর্তৃত্ব গ্রহণ করার আগে শেখ মুজিব তাকে বলেছিলেন যে যদি পরিস্থিতি খারাপ হয় তাহলে তিনি যেন পূর্ব পাকিস্তান থেকে বের হয়ে যাবার চেষ্টা করেন এবং বিশ্বের কাছে আবেদন জানান – বিশেষ করে যুক্তরাজ্যের জনগণের কাছে যাতে তারা বাঙালীদের রক্ষা করতে সাহায্য করে।

পূর্ব পাকিস্তানে এরপর কি ঘটবে সে ব্যপারে মিঃ আলম স্মরণ করেন ৭ই মার্চে এক বিশাল গনসমাবেশে দেয়া শেখ মুজিবের ভাষণের কথা যেখানে তিনি প্রত্যেক ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে তোলার জন্য জনগণকে পরামর্শ দেন। মিঃ আলম নিশ্চিত যে শহরগুলোতে সেনাবাহিনী সাময়িকভাবে প্রতিরোধ চূর্ণ করতে পারলেও, পরিণামে জনগণ পশ্চিমা সেনাবাহিনীর উপর বিজয়ী হবেই।

২।
লন্ডন থেকে প্রতিবেদন
জিম বিডালফ কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১

আমাদের কমনওয়েলথ প্রতিনিধি জিম বিডালফ, আজ দেশে ফিরে এসেছেন, পাকিস্তানে একমাস অতিবাহিত করার পর।

গত দশদিন ধরে আমি পশ্চিম পাকিস্তানে ছিলাম – সেনাবাহিনী কর্তৃক পূর্ব পাকিস্তান থেকে বিতাড়িত হয়ে এবং বাকি জনগোষ্ঠীর সাথে সরকারী বিবৃতি ও অস্বীকৃতির ধুম্রজাল ভেদ করে আসলেই ঠিক কি ঘটছে তা বোঝার চেষ্টায়।

পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ, যারা শুধুমাত্র তাদের সরকারের কথাই শোনে, তাদের কোন ধারণাই নেই পূর্ব পাকিস্তানে আদৌ কিছু ঘটেছে কিনা, কারো নিহত হবার কথা জানা তো দুরের কথা। কিন্তু এখন রাষ্ট্রীয় গোলযোগের ব্যাপ্তি সরকারী অস্বীকৃতি ভেদ করে ধীরে ধীরে পরিস্কার হচ্ছে। গত সপ্তাহে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, ঢাকা, এবং দেশটির দক্ষিনে অবস্থিত বন্দরনগরী চট্টগ্রামে, পরিচালিত হত্যা ও ধ্বংসের অসংখ্য প্রত্যক্ষদর্শী পাওয়া গেছে। গতকাল পাকিস্তান বেতার থেকে প্রচার করা হয়েছে যে সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীদেরকে উত্তরপূর্ব এবং উত্তরপশ্চিমের শহরগুলো থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে। এবং এই প্রথম বারের মতো, পাকিস্তান বিমানবাহিনী এই অভিযানগুলোতে অংশ নিয়েছে বলে জানানো হয়েছে। প্রতিবেদনে বলা হয় বেসামরিক জানমালের কোন ক্ষয়ক্ষতি হয়নি।

সীমান্তের ওপারে ভারতে, সংবাদ সংস্থাগুলি দাবী করে যে পূর্ব পাকিস্তানের চারটি শহরে বোমা হামলা করা হয়েছে, এবং তাদের বক্তব্য অনুযায়ী বেশ কয়েকটি বিজয় এসেছে তারা যাদেরকে বলছে “মুক্তি বাহিনী”-এর দ্বারা।

এই দাবীগুলো, ভারত থেকে আসা, পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারী কার্যালয়গুলোতে ক্রোধ এবং উপহাসের সাথে গৃহীত হবে যেখানে মানুষ রাগান্বিতভাবে বলে থাকে যে ভারতীয় প্রতিবেদনগুলো ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে চলমান কথার যুদ্ধের একটি অংশ হিসেবে তৈরী মনগড়া প্রতিবেদন মাত্র।

নিরীক্ষণ থাকুক বা না থাকুক, পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণ অবশ্যই জানতে পেড়েছে, গুজব বা বিদেশী প্রচার থেকে, কি ঘটছে তার একটি ভালো অংশ এবং ব্যক্তিগত কথোপকথনে আমি গভীর দুঃখ দেখতে পেয়েছি আবার একই সময়ে, দৃঢ়প্রতিজ্ঞা যে পূর্ব পাকিস্তানকে আলাদা হয়ে যাবার সুযোগ দেয়া হবে না।

স্বল্প মেয়াদে, সেনাবাহিনী অবশ্যই অনেক শহরে ঘাঁটি গড়ে তুলতে পারে, কিন্তু সারাদেশ জুড়ে শহরের পর শহর থেকে গণ্ডগোলের খবর যখন আসতে থাকে, পাকিস্তানের দাবী এ ঘটনাগুলো কিছু দুষ্কৃতিকারী এবং সশস্ত্র অনুপ্রবেশকারীরা ঘটাচ্ছে তা যে ক্রমশ ক্ষীণ হতে থাকে, এবং একটি দীর্ঘ মেয়াদী, তিক্ত সংগ্রামের, সম্ভাবনা তখন খুবই বাস্তব মনে হয়।
বুশ হাউস সংবাদ নকলনবিসি শাখা কর্তৃক তৈরী পাণ্ডুলিপি থেকে গৃহীত

৩।
ওয়াশিংটন থেকে প্রতিবেদন
চার্লস হুইলার কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
যুক্তরাষ্ট্র এবং পাকিস্তান

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আজ বলেছে যে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে পাকিস্তানকে অনুরোধ জানিয়েছে পূর্ব পাকিস্তানে সংঘর্ষ বন্ধ করার জন্য সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নিতে, এবং বাঙালী বিদ্রোহীদের সাথে একটি শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানে উপনীত হতে।

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র জানান এটি এবং পূর্ব পাকিস্তানে চলমান সংগ্রামের ব্যপারে অন্যান্য মার্কিন অভিমতগুলো ওয়াশিংটনে উপস্থিত দেশটির রাষ্ট্রদূত, আগা হিলালি কে, সোমবারে অবহিত করা হয়। পাকিস্তানে যুক্তরাষ্ট্রের রাষ্ট্রদূতকেও ইসলামাবাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের কাছে এব্যপারে একই ভাবে মার্কিন উদ্বেগ প্রকাশ করার নির্দেশ দেয়া হয়। এই মুখপাত্র এটা পরিস্কার করে বলেন যে যুক্তরাষ্ট্র, চলমান সহিংসতার ব্যপারে দুঃখ প্রকাশের পাশাপাশি, দুর্দশা লাঘবে আন্তর্জাতিক সাহায্যের প্রস্তাবগুলো কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে পাকিস্তানের সরকারী কর্মকর্তাদের ব্যর্থতায় হতাশা প্রকাশ করে। তিনি পুনরাবৃত্তি করেন যে পাকিস্তানে পরিচালিত যে কোন আন্তর্জাতিক মানবহিতৈষী কার্যক্রমে সাহায্য করতে যুক্তরাষ্ট্র প্রস্তুত আছে।

৪।
করাচী থেকে প্রতিবেদন
রবার্ট রবসন কর্তৃক
১০ই এপ্রিল, ১৯৭১.
নিয়ন্ত্রণ

পাকিস্তানে এক কঠোর নতুন সামরিক আইনের নিয়ন্ত্রণ সীমিত করতে পারে যেকোনো সন্দেহভাজন ব্যক্তির চলাচল, তাদের কর্মসংস্থান; যে সাজসরঞ্জাম তাদের কাছে থাকতে পারে বা তারা ব্যবহার করতে পারে, অন্যদের সাথে তাদের যোগাযোগ এবং সংবাদ প্রচারের সাথে জড়িত তাদের কার্যক্রম বা অভিমতের প্রচার। এই নতুন আইনের বিভিন্ন ধারা ভঙ্গ করলে গুরুতর দণ্ডের বিধান রাখা হয়েছে, যার মধ্যে জরিমানা এবং ৭ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদণ্ডও রয়েছে। করাচী থেকে জানাচ্ছেন রবার্ট রবসন।

এই নতুন আইনটি রাষ্ট্রদ্রোহিতামূলক বা পাকিস্তানের নিরাপত্তা, জননিরাপত্তা, বা স্বার্থ বা প্রতিরক্ষার প্রতি হুমকিস্বরূপ যেকোনো কর্মকাণ্ড প্রতিহত করার সাথে সম্পর্কিত বলে জানানো হয়েছে। এই আইনটির সেইসব কর্মকাণ্ডও প্রতিহত করার কথা যেগুলি নাগরিক শৃঙ্খলা বজায় রাখা, অন্যান্য পরাশক্তির সাথে পাকিস্তানের সম্পর্ক বজায় রাখা, পাকিস্তানের যে কোন অঞ্চলে শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখা এবং প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের সরবরাহ এবং সেবাসমুহ চালু রাখার প্রতি হুমকিস্বরূপ। সন্দেহভাজন বিদেশী নাগরিকদেরকে দেশত্যাগ করতে বলা এবং তাদের ফিরে আসার উপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হতে পারে, অথবা তাদেরকে আটক করা বা তাদের চলাচল সীমিত করে দেয়া বা তাদের চলাচলের প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে সশরীরে দেখা করতে বলা হতে পারে। এর প্রভাব অবশ্য পাকিস্তানী নাগরিকদের উপরও সমভাবে পড়ছে শুধুমাত্র তাদেরকে দেশত্যাগ করতে বলা ছাড়া।

এই নতুন আইনটি এই মুহূর্তে জারি করার নির্দিষ্ট কারণটি তাৎক্ষনিকভাবে জানা যায়নি। এটা অবশ্য সুস্পষ্ট যে সংবাদপত্র, বেতার অথবা টেলিভিশনের সাংবাদিক বা ক্যামেরাম্যান, অথবা অন্যান্য সাংবাদিক বিদেশী বা স্থানীয় যাই হোক না কেন তাদের উপর এটি প্রয়োগের বিশেষ সুযোগ রয়েছে যদিও প্রদত্ত ক্ষমতার ব্যাপ্তি এতই ব্যাপক যে সমভাবাপন্ন বা অন্যান্য ক্ষেত্রের অনেক ব্যক্তির উপরই এর প্রভাব পড়তে পারে।

৫।
কোলকাতা থেকে প্রতিবেদন
ডেভিড সেলস কর্তৃক
১৬ই এপ্রিল, ১৯৭১

পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কর্তৃক বিচ্ছিন্নতাবাদী পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করার ব্যপারে ভারতের আচরণ অত্যন্ত সাবধানী ছিল সবসময়ই। কিন্তু ভারত সরকারের মধ্যে উদ্বেগের লক্ষন দেখা যাচ্ছে ভারত এবং পূর্ব পাকিস্তানের মধ্যকার দীর্ঘ সীমান্ত জুড়ে সশস্ত্র সংঘর্ষ শুরু হওয়ার আশংকা থেকে। ডেভিড সেলস-এর প্রতিবেদনঃ

পূর্ব পাকিস্তানের অভ্যন্তরে বাঙালী জনগোষ্ঠীর ওপর যে দমনপীড়ন চলছে তার সাথে সম্পৃক্ততা এড়াতে মিসেস গান্ধী অত্যন্ত সতর্ক আছেন। আমার অন্তত তাই ধারণা হয়েছে সীমান্তের দুই পাশের এলাকা দেখে। সামরিক পরিপ্রেক্ষিতে, পূর্ব অংশের অবরুদ্ধ অনিয়মিত যোদ্ধাদের জন্য আনুষ্ঠানিকভাবে কিছুই করা হয়নি, যদিও তাদের অস্ত্র, গোলাবারুদ, জ্বালানী এবং খাদ্যের সঙ্কট ছিল। অনানুষ্ঠানিকভাবেও, যতটুকু বোঝা যাচ্ছে খুব সামান্যই সাহায্য করা হয়েছে, অন্তত সংগঠিতভাবে তো নয়ই। সত্যিকারের সহানুভূতি ছিল অনেকই, কিন্তু কার্যকর সহায়তা করা হয়েছে খুব সামান্যই, পশ্চিম সীমান্ত ধরে অবশ্যই। এটা সত্যি যে সব শরণার্থীকেই গ্রহণ করে নেয়া হচ্ছে যাদের মধ্যে আহত অনিয়মিত যোদ্ধা ও ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস এর মুলত বাঙালী প্রাক্তন সদস্যরা রয়েছে এবং তাদেরকে প্রাথমিকভাবে খাদ্য এবং আশ্রয় দেয়া হচ্ছে। আহতরা ভারতীয় হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছে।

চলতি সপ্তাহ পর্যন্ত সীমান্ত পুরোপুরি খোলা ছিল, পূর্ব পাকিস্তান পার্শ্বে কিছুই ছিল না, ভারতীয় পার্শ্বে যথারীতি বর্ডার সিকিউরিটি ফোর্স ছাড়া অন্য আর কোনো বাহিনীর চিহ্নও ছিল না। যখন পাকিস্তান বেতার থেকে প্রচার করা হয় যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছয়টি ডিভিশন পূর্ব পাকিস্তানের সাথে ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকায় জড়ো হচ্ছে তখন সেখানে আসলে কোনোধরণের সামরিক কর্মকাণ্ড পরিলক্ষিত হয়নি তাছাড়া ২,০০,০০০ সৈন্যের উপস্থিতি কারো চোখ এড়িয়ে যাওয়ার কথা নয়। সামরিক সূত্র জানিয়েছে এই খবরটি একেবারেই সত্যি নয়। তবে এটা সত্যি যে ভারতীয় নির্বাচন চলাকালে অশান্ত কোলকাতা এলাকায় যে এক ডিভিশন সৈন্য মোতায়েন করা হয়েছিল তাদেরকে ওখানেই রেখে দেয়া হয়েছে।
গত কয়েকদিনে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ছোট ছোট দল পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তবর্তী এলাকাগুলোতে এসে পৌঁছাতে শুরু করেছে, যদিও নিয়মিত সেনাবাহিনী সীমান্তের অন্তত তিন মাইল ভিতরে থাকবে পাকিস্তানের সাথে বেশ কয়েকবছর ধরে বলবত থাকা এরূপ অনুক্ত চুক্তি অনুযায়ী তারা ঠিক সীমান্তের পাশে থাকছে না। পাকিস্তান সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে এই চুক্তির ব্যাত্যায় ঘটলে ভারত মনে করছে তাদের সেজন্য প্রস্তুত থাকা প্রয়োজন। কিন্তু দলগুলোর ছোট আকার দেখে, মনে হচ্ছে এগুলি নিত্যনৈমিত্তিক সতর্কতামূলক ব্যবস্থা ছাড়া আর কিছু নয়।

তাদের মনের গভীরে এই ভয়ও আছে যে পাকিস্তান সরকারের সাথে সাথে চীনারাও তিব্বতের দিকে মনোযোগ ভিন্নমুখী করার জন্য কিছু সামরিক কার্যক্রম শুরু করতে পারে, যা কিনা ভুটান এবং সিকিমের মাঝখানে অবস্থিত যেখানে ভারত নিজেকে বিশেষভাবে অরক্ষিত মনে করে। এখন পর্যন্ত, এবং এটি একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়, ভারতের কোনো ভয়ই বাস্তবে রূপ নেয়নি এবং তাদের দিক থেকে সামরিক পরিপ্রেক্ষিতে, তার সাথে রাজনৈতিকভাবেও, তারা অত্যন্ত সতর্কতার সাথে কাজ করছে বলেই মনে হচ্ছে।

৬।
জেনেভা থেকে প্রতিবেদন
অ্যালান ম্যাকগ্রেগর কর্তৃক
৭ই এপ্রিল, ১৯৭১
পূর্ব পাকিস্তান

মিঃ স্ট্যানলি মিটন, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেস এর ইমারজেন্সি রিলিফ অফিসার, জেনেভায় ফিরে এসেছেন তার পূর্ব পাকিস্তানের সীমান্তবর্তী এলাকা, কোলকাতার উত্তর পূর্ব এলাকা, এবং সেখান থেকে করাচী এবং লাহোর হয়ে সপ্তাহব্যাপী পরিদর্শন শেষ করে। তিনি কাউন্সিলের কাছে প্রতিবেদন পেশ করেছেন যে বর্তমান পরিস্থিতিতে যেসব এলাকায় যুদ্ধ চলছে সেখানে চিকিৎসা বা খাদ্য সরবরাহ করার জন্য কিছুই করার উপায় নেই। জেনেভা থেকে, আলান ম্যাকগ্রেগর এই প্রতিবেদন পাঠিয়েছেন।

আন্তর্জাতিক রেড ক্রসের মতোই, ওয়ার্ল্ড কাউন্সিল অব চার্চেসও তৈরী আছে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরী ত্রাণ পাঠানোর জন্য, কিন্তু তারা সেটা করতে পারছেনা কেননা পাকিস্তানী সরকার বলছে যে বাইরে থেকে কোনো ধরণের হস্তক্ষেপ তারা চায় না, এমনকি চিকিৎসা সেবাদানকারী দলের আকারেও নয়। এটি বস্তুত মিঃ মিটন কাউন্সিলের সদরদপ্তরে যে প্রতিবেদন পেশ করেছেন তারই কথা। বনগাঁয়ে, কোলকাতা থেকে উত্তর-পূর্ব দিকে পঁয়তাল্লিশ মাইল দূরে সীমান্তের ভারতীয় পার্শ্বে, তিনি মুসলিম এবং হিন্দু উভয় ধর্মের শরণার্থীদের সাথেই কথা বলেছেন এক হিন্দু ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের তৈরী আশ্রয় শিবিরে, যেটিকে তিনি বর্ণনা করেন খাদ্যসঙ্কটবিহীন একটি সুসংগঠিত শিবির হিসেবে। শরণার্থীরা তাঁকে বলে তাদের গ্রামে বোমা হামলার কথা। তাদের কেউ কেউ পেড়িয়ে যায় সীমান্ত, কদাচিৎ পাকিস্তানী সেনাবাহিনীর টহলদল ছাড়া যা আপাত অরক্ষিত, তাদের ফসলের ক্ষেতের যত্ন নিতে এবং এরপর আবার ভারতীয় পার্শ্বের শিবিরে ফিরে আসে।

মিঃ মিটন বলেন যে ব্যক্তিগতভাবে কিছু ভারতীয় নাগরিক কিছু পরিমাণ ত্রাণ, ওষুধপত্রসহ পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে গেছে। তিনি দুটি ইউরোপীয় মিশনারি পরিবারের সাথে কথা বলেছেন যারা পায়ে হেঁটে ভারতে এসে পৌঁছেছেন ঠেলাগাড়িতে করে তাদের যাবতীয় অস্থাবর সম্পত্তি নিয়ে। তারা বলেছেন স্থানীয়ভাবে খাদ্যসঙ্কট রয়েছে, তবে যেহেতু বেশীরভাগ চাষী সেপ্টেম্বর মাসে ফসল তোলার জন্য তাদের বীজ বোনার কাজ শেষ করতে পেরেছে, একটি দুর্ভিক্ষের পরিস্থিতি হয়তো এড়ানো যাবে।

৭।
কলম্বো থেকে প্রতিবেদন
২২শে এপ্রিল, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক
পাকিস্তানের অর্থনীতি

পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতির কারণে পাকিস্তানের অর্থনীতি কিভাবে প্রভাবিত হচ্ছে তা নিয়ে লিখেছেন রনাল্ড রবসন।

গৃহযুদ্ধ শুরু হবার আগে পাকিস্তানের অর্থনীতি রুগ্ন ছিল। এই রোগশয্যা অতি দ্রুতই মৃত্যুশয্যায় পরিণত হতে পারে। পূর্ব অংশটি সবসময়ই পশ্চিম অংশের চেয়ে বেশী বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে আসছে পাকিস্তানের জন্য। প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানকে উৎখাত করার জন্য যে আন্দোলন হয় তাতে পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অগ্রগতি বাধাগ্রস্থ হয়েছিল। ঐ সময়ে শুরু হওয়া গোলযোগ আসলে আর কখনই থামেনি। তবে চলমান সঙ্কট পূর্ব অংশের অর্থনীতিকে কার্যত অচল করে দিয়েছে। ইতোমধ্যে শুধুমাত্র পাট এবং পাটজাত পণ্য উৎপাদনে যা ক্ষতি হয়েছে তা একাই অনেক গুরুতর। পহেলা মার্চের পর থেকে চা রপ্তানিও বন্ধ রয়েছে। দেশটির পশ্চিম অংশ যা কিনা পূর্ব অংশের চায়ের ওপর নির্ভরশীল তাদেরকে দেশের বাইরে থেকে চা আমদানি করতে হয়েছে। নিউজপ্রিন্ট কাগজ আসতো দেশটির পূর্ব অংশ থেকে। সেটিও এখন বিদেশী উৎস থেকে আমদানি করতে হচ্ছে এবং তিনগুন দাম দিয়ে। এরকম পরিস্থিতি হয়তো ধনী কোনো দেশ সাময়িক বিব্রতকর পরিস্থিতি হিসেবে কাটিয়ে দিতে পারতো, কিন্তু পাকিস্তান বিশ্বের অন্যতম দরিদ্র একটি দেশ, যা বৈদেশিক সাহায্যের উপর গভীরভাবে নির্ভরশীল।

এ মাসের শুরুতে পাকিস্তান একটি মার্কিন ঋণ পরিশোধের সময়সীমা বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করেছে, এবং পশ্চিম অংশে খোলাখুলিভাবে প্রচারিত তথ্য অনুযায়ী, পাকিস্তান অন্যান্য দেশ এবং বিশ্বব্যাংকের কাছেও তাদের ঋণের মেয়াদ বৃদ্ধি করার জন্য আবেদন করবে বলে বোঝা যাচ্ছে।

গত ফেব্রুয়ারী মাসের পর থেকে রাষ্ট্রীয় ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের পরিমাণ প্রকাশ করা হচ্ছে না যেখানে এটি ইতিমধ্যেই পরিস্কার বোঝা যাচ্ছে যে এই সঞ্চয়ের পরিমাণ আশঙ্কাজনক হারে কমে যাচ্ছে। রাষ্ট্রীয় ব্যাংক বিধিবদ্ধ আইনগত বাধ্যবাধকতা অনুযায়ী তার প্রচলিত নোটের নির্দিষ্ট পরিমাণ অংশকে সোনা এবং বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয়ের বিপরীতে নিশ্চিত করতে ব্যর্থ হয়েছে। ফেব্রুয়ারী মাসের শেষ নাগাদ মাত্র তেরো শতাংশের কিছু বেশী পরিমাণ প্রচলিত মুদ্রার নোট এভাবে নিশ্চিত করা ছিল। এবং আমাকে বলা হয় যে পাকিস্তান কতিপয় আরব রাষ্ট্রের কাছ থেকে অর্থনৈতিক সাহায্য পাবার আশা করছে।

পূর্ব পাকিস্তানের চলমান সঙ্কটের কারণে দেশটির দুই অংশের মধ্যে অর্থের প্রবাহ বন্ধ আছে অনেকদিন ধরে। দেশটির পশ্চিম অংশটি, উদাহরণস্বরূপ, তুলাজাত পণ্য বিক্রি করে পূর্ব অংশে এবং তা থেকে অর্জিত অর্থ ফিরে আসার উপর পশ্চিম অংশে পণ্যের পুনঃউৎপাদন নির্ভর করে। অর্থ ফিরে আসা বন্ধ হয়ে গেছে। এতে পশ্চিম অংশে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে। পূর্ব পাকিস্তানে যে পাটের চারা রোপণ করার কথা ছিল তা করা হয়নি। চাষিরা এর পরিবর্তে ধান বুনেছে খাদ্য উৎপাদনের জন্য। পাটের বাজার পড়তির দিকে থাকলেও এটি এখনো বৈদেশিক মুদ্রার অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ উৎস। মনে হচ্ছে ভবিষ্যৎ উৎপাদন ব্যাহত হতে বাধ্য। এই চলমান বিবাদের কারণে চা উত্তোলনকারী শ্রমিকেরা, যারা মুলত হিন্দু ধর্মাবলম্বী, চা বাগান ছেড়ে পালিয়ে গেছে। চা গাছের পর্যাপ্ত যত্ন না নেয়ার কারণে উৎপাদন ব্যাহত হচ্ছে এবং এর দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি হওয়ার সম্ভাবনাও রয়েছে। অবশ্যই যুক্তরাজ্যের কিছু স্বার্থ এখানে সংশ্লিষ্ট আছে। পাকিস্তানে যুক্তরাজ্যের বিনিয়োগের পরিমাণ প্রায় দশ কোটি পাউন্ড, যার বেশীরভাগই পূর্ব অংশে। পাকিস্তান যুক্তরাজ্যের বৈদেশিক সাহায্যের বড় গ্রাহক এবং যুক্তরাজ্যের সাথে পাকিস্তানের একটি সন্তোষজনক বাণিজ্য সমতা বজায় রয়েছে।

পূর্ব অংশে এই মুহূর্তে দুর্ভিক্ষের কোনো আশঙ্কা থাকার কথা নয়। যুক্তরাষ্ট্র থেকে খাদ্যশস্য পাঠানো হচ্ছিল, কিন্তু সঙ্কট শুরু হবার পর অন্তত প্রথম ছয় সপ্তাহ, শস্যগুলো চট্টগ্রাম বন্দরে খোলা অবস্থায় পড়ে থেকে পচে যাচ্ছিল, প্রত্যক্ষদর্শীদের বর্ণনা অনুযায়ী। দেশের ভেতরে যে কোন সরবরাহ নিয়ে যাওয়া খুবই কঠিন হয়ে পড়ছিল, শ্রমিক অসন্তোষ চলার সময় তারা শহর ছেড়ে পালিয়ে যেত গ্রামে, যার মানে হচ্ছে কাজের প্রচুর ক্ষতি। অনেক শ্রমিক ভারতে পালিয়ে গেছে এবং তারা হয়তো আর কখনই ফিরে আসবে না।

যে সামরিক কার্যক্রম চলছে সেটি নিজেই অনেক খরচান্ত ব্যপার। সৈন্যদেরকে উপ-মহাদেশের পাশ দিয়ে উড়িয়ে ঢাকায় নিয়ে যেতে হচ্ছে যেহেতু পাকিস্তানী বিমান ভারতের উপর দিয়ে উড়ে যেতে পারবে না। জ্বালানী তেলের জন্য অনেক টাকা খরচ হচ্ছে এবং অতিরিক্ত বিমান ভাড়া করতে হচ্ছে। মানুষের জীবনের দামের হিসেবে কত খরচ হয়েছে তা এখনো বোঝা যাচ্ছে না। সেনাবাহিনীর কার্যক্রম শুরু করার পর কতজন নিহত-আহত হয়েছে তার সঠিক সংখ্যা অনুমান করা যাচ্ছে না। এভাবে বাধাগ্রস্ত হবার পর এটা আশা করা ঠিক নয় যে কেউ ডিক্রী জারি করলেই পূর্ব পাকিস্তানের স্বাভাবিক অর্থনীতি আবার চালু হয়ে যাবে।

পাকিস্তানকে সাহায্য প্রদানের জন্য সংঘ, যেটি যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্স, পশ্চিম জার্মানি, ইটালি, জাপান, কানাডা এবং অস্ট্রেলিয়া কে নিয়ে গঠিত সেটি জুন মাসে বৈঠকে বসবে। বৈঠকের পর বৈঠক মুলতুবী করা হয়েছে। লক্ষন দেখে মনে হচ্ছে দাতা দেশগুলো ঠিক কি ঘটছে সে ব্যপারে আরো পরিস্কার ধারণা পাবার জন্য অপেক্ষা করছে এবং তাদের মনোভাব একটি গুরুত্বপূর্ণ নিয়ামক হিসেবে কাজ করবে। পাকিস্তানের মোট বাজেটের পঞ্চাশ শতাংশেরও বেশী বরাদ্দ করা হয় প্রতিরক্ষা খাতে। যদি দেশটির পূর্ব অংশ যেটি বেশীরভাগ অর্থ উপার্জন করতো, শেষ পর্যন্ত আলাদা হয়ে যায় বা কার্যত অনুৎপাদনশীল থেকে যায় তাহলে পশ্চিম অংশের জন্য এককভাবে তার বর্তমান সেনাবাহিনীর ভরণপোষণ করা প্রায় অসম্ভব হয়ে উঠবে।

আমি মাত্র কয়েকটি সমস্যার কথা এখানে বলেছি কিন্তু প্রমাণাদির ভিত্তিতে, যেকোনো দৃষ্টিকোণ থেকেই দেখা হোক না কেন পাকিস্তানের অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনিত হয়েছে।

৮।
করাচী থেকে তারবার্তা
২৬শে জুন ১৯৭১
মার্ক টালি কর্তৃক

মিঃ এম. এম. আহমেদ, প্রেসিডেন্টের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ১৯৭১/৭২ অর্থবছরের জন্য পাকিস্তানের বাজেট ঘোষণা করেন। করাচী থেকে মার্ক টালি কর্তৃক প্রেরিত প্রতিবেদনঃ

মিঃ আহমেদ বলেন তিনি বাজেট উপস্থাপন করছিলেন অস্বাভাবিক প্রতিকূল অবস্থায়। দেশের বৈদেশিক মুদ্রার সঞ্চয় থেকে চল্লিশ কোটি রুপির এক বিশাল পতন ঘটেছে। রাজস্ব আয় বাজেটে নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ১১৬ কোটি ৪০ লক্ষ রুপি কম হয়েছে; এবং উন্নয়নখাতে ব্যয় নির্ধারিত লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে অনেক কম হয়েছে। ১৯৭০-৭১ অর্থবছরে পাকিস্তানের অর্থনীতির কার্য-সম্পাদন খারাপ হওয়ার মূল কারণ পূর্ব পাকিস্তানের অর্থনৈতিক জীবনে বন্যা, ঘূর্ণিঝড় এবং নাগরিক বিশৃঙ্খলার কারণে ব্যঘাত সৃষ্টি হওয়া। মিঃ আহমেদ হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন দেশটিকে আরো স্ব-নির্ভর হওয়া শিখতে হবে কেননা আগামী বছরে বৈদেশিক সাহায্য পাওয়ার সম্ভাবনাগুলো খুবই অনিশ্চিত। তিনি বলেন দেশটি ইতিমধ্যেই বৈদেশিক সাহায্যের উপর নির্ভরতা কমিয়ে এনেছে এবং তিনি রপ্তানিকে উৎসাহিত করার জন্য নতুন পন্থা উপস্থাপন করেন। আভ্যন্তরীণভাবে তিনি নতুন কোন অধিক গুরুত্বপূর্ণ কর আরোপ করেননি কিন্তু কোম্পানি কর খাত থেকে প্রত্যক্ষ কর আদায় বৃদ্ধি করার প্রতি গুরুত্ব দেন, এবং উন্নতমানের সিগারেটের উপর উচ্চ-ফলনশীল কর বৃদ্ধি করেন। মিঃ আহমেদ তবুও উন্নয়ন খাতে ব্যয় কমাতে এবং বাজেট ঘাটতির ৩৬ কোটি টাকা জোগাড় করার জন্য নতুন আরোপিত কর থেকে অর্জিত রাজস্ব আয়ের উপর নির্ভর করতে বাধ্য হন যা কিনা এরূপ রাজস্ব আয়ের অর্ধেকেরও বেশী হবে। প্রতিরক্ষা খাতে বাজেট বরাদ্দ বিশেষ বাড়ানো হয়নি। পাকিস্তান যেসব অর্থনৈতিক সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে এই বাজেটটি সেসব সমস্যা মোকাবিলা করার জন্য যথেষ্ট জোরালো হয়েছে কিনা তা অনেকাংশে নির্ভর করছে তিনটি অতিসূক্ষ্ম জিনিশের উপর – পূর্ব পাকিস্তানের বর্তমান পরিস্থিতি, বৈদেশিক সাহায্যের প্রবাহ, নতুন আরোপিত কর আদায়ে সংশ্লিষ্ট রাজস্ব কর্তৃপক্ষের কর্মদক্ষতা।

৯।
২৩শে অগাস্ট, ১৯৭১
পাকিস্তানের প্রতি যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব

দেশটির পূর্ব অংশে সাম্প্রতিককালে সঙ্ঘটিত গোলযোগের পর পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নীতি কি হওয়া উচিত তা নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রে বিভক্ত মতামত রয়েছে। ওয়াশিংটন থেকে জানাচ্ছেন জন ওসমান।

পূর্ব পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার বর্ণনা দেয়ার জন্য যুক্তরাষ্ট্রে গণহত্যা শব্দটিকেই ব্যবহার করা হচ্ছে, অভিযোগ হচ্ছে বিছিন্নতাবাদের শাস্তি হিসেবে সরকার তার নিজের নাগরিকদের উপরই লাগামহীন জাতিগত হত্যাকাণ্ড শুরু করেছে। ম্যাসাচুসেস্ট থেকে নির্বাচিত সিনেটর, এডওয়ার্ড কেনেডি পাকিস্তানীদেরকে গণহত্যার জন্য দায়ী করার কাজে দায়িত্বপ্রাপ্তদের মধ্যে সবচেয়ে প্রভাবশালীদের অন্যতম। আরেকজন হচ্ছেন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত, চেস্টার বৌলস। বেশীরভাগ মানুষের চেয়ে পরিস্থিতি সম্বন্ধে কেনেডি সম্ভবত বেশী ওয়াকিবহাল আছেন যদিও এটা সত্যি যে তিনি সমস্যাটি সম্বন্ধে গবেষণা করার সুযোগ পেয়েছেন শুধুমাত্র সীমান্তের ভারতীয় পার্শ্ব থেকেই। তাঁর পাকিস্তান সফর করার কথা ছিল কিন্তু তাঁর সেখানে যাওয়ার অনুমতি বাতিল করা হয় কেননা ততক্ষণে, পাকিস্তানীদের বক্তব্য অনুযায়ী, তিনি নিজেকে পাকিস্তানীদের বিপক্ষে পক্ষপাতদুষ্ট হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করে ফেলেছেন। কেনেডির প্রকাশিত বিবৃতিগুলো পড়ার পর এব্যপারে পাকিস্তানীদেরকে দোষারোপ করা বেশ কঠিন কেননা এটা বেশ পরিস্কার বোঝা গেছে যে পুরোপুরি খোলা মন নিয়ে সিনেটর সেখানে যেতেন না। যদিও এটা সত্যি, যেমনটা কেনেডি বলেছেন, যে শেখ মুজিবুর রহমানের বিরুদ্ধে পরিচালিত মামলাটি যেকোনো আন্তর্জাতিক আইনের ধারনায়ই চরম নিষ্ঠুরতা ছাড়া আর কিছুই নয় একইভাবে এটা অবশ্যই অভিমতের ব্যপার, যেটি সিনেটরের রয়েছেই, মুজিব একমাত্র অপরাধে অপরাধী যে তিনি একটি নির্বাচনে জয়ী হয়েছেন। পাকিস্তানের সরকারের মতে তিনি জাতির অর্ধেকেরও বেশী মানুষকে নিয়ে আলাদা হয়ে যাচ্ছিলেন, এ এমন একটি কাজ যা সম্ভবত আত্মসঙ্কল্পের অধিকন্তু রাষ্ট্রদ্রোহিতারও।

এখানকার সরকারী কর্মকর্তারা পরিস্থিতির ব্যপারে কেনেডির মূল্যায়নের উপর সন্দেহের উদ্রেক করার জন্য এইসব বিষয়গুলো নিয়ে আসছেন যদিও তারা নিজেরাই পরিস্কারভাবে বিভক্ত হয়ে আছেন ঠিক কিভাবে এই সমস্যার মোকাবেলা করলে ভালো হবে সেই ব্যপারে। অতিরিক্ত ভারত-ঘেঁষা হবার কারণে চেস্টার বউই-র ধারণাগুলিকে বাতিল করে দেয়া হয়।

তাহলে এত জনপ্রিয় এবং গুরুত্বপূর্ণ উভয় ধরনের সমালোচনা করার পর সরকারের কাছে আর কি ধরণের নীতি অবশিষ্ট থাকলো? মূলত এটি ওয়াশিংটন পোস্ট পত্রিকা যাকে বর্ণনা করছে ত্রাণ, সংযম এবং সামঞ্জস্যবিধানের নীতি। প্রথমত হোয়াইট হাউজ এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় চেষ্টা করছে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে একটা যুদ্ধ বেঁধে যাওয়া প্রতিরোধ করতে, দ্বিতীয়ত দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধে সাহায্য করতে এবং শরণার্থীদের দুর্দশা লাঘব করতে যুক্তরাষ্ট্র ব্যবস্থা করেছে ৩,০০,০০০ টন খাদ্যশস্যের এবং এগুলোকে বহন করে নিয়ে যাবার জন্য জাহাজ ভাড়া করা হয়েছে ৩০ লক্ষ ডলার ব্যয় করে। তৃতীয়ত, আমেরিকা চায় পুরো ভারতীয় উপ-মহাদেশে রাশিয়া এবং চীনের সাথে ক্ষমতার কোন এক ধরণের ভারসাম্য বজায় রাখতে।

যে বড় প্রশ্নটি এখন এখানে তোলা হয়েছে তা হচ্ছে ভারত-সোভিয়েত মিত্রতা চুক্তি কিভাবে এই নীতিকে প্রভাবিত করবে। এখানে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত, আগা হিলালির কাছে এটি ভারতের জোট-নিরপেক্ষতা নীতির অবসান চিহ্নিত করছে। ভারতীয়দের কাছে এটি বিশেষ কারো প্রতি সরাসরি আক্রমণাত্মক হিসেবে উদ্দিষ্ট নয় যদিও লক্ষ্য করা গেছে যে ভারতের বাম পন্থী প্রচার মাধ্যম আগামী শরৎকালে মিসেস গান্ধীর এখানে আসার প্রস্তাবিত সফরের বিরুদ্ধে এক প্রচারাভিযান চালু করেছে। ভারতীয়রা মার্কিনীদেরকে পাকিস্তানের অস্ত্র সরবরাহকারি হিসেবে দেখে, মার্কিনীরা বিশ্বাস করে ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তানের সঙ্কট বাড়িয়ে তোলার দোষে অপরাধী। সবমিলিয়ে ওয়াশিংটন এবং নয়া দিল্লীর মধ্যে সম্পর্ক এখন খুবই নিম্ন পর্যায়ে রয়েছে যেখানে ইসলামাবাদ এবং এখানের মধ্যে রয়েছে সহানুভূতিশীল সম্পর্ক, সরকার দুঃখভারাক্রান্ত হচ্ছে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় যেগুলোকে বলছে পূর্ব পাকিস্তানে ঘটে যাওয়া মর্মান্তিক ঘটনাবলী, কিন্তু একই সময়ে পাকিস্তানকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে শেখ মুজিবের উপরে যেকোনো ধরণের প্রতিশোধপরায়ণ পদক্ষেপ নেয়া হলে তা মার্কিন সমর্থন শেষ হয়ে যাবার পথ করে দেবে। এটা সবাই জানে যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের ব্যপারে মিঃ নিক্সন অতি উচ্চ ধারণা পোষণ করেন এবং মার্কিন নীতির উদ্দেশ্য মূলত পাকিস্তানের একতা বজায় রাখা তবে তা যেকোনো মুল্যে নয়।

১০।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন (আংশিক)
৩০শে নভেম্বর, ১৯৭১
নিজামুদ্দিন আহমেদ কর্তৃক
পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি

তীব্র যুদ্ধের খবর এসে পৌঁছাচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানী, ঢাকা,-তে সিলেট, দিনাজপুর এবং যশোর থেকে। ভারতীয় সৈন্যরা বারবার চেষ্টা করেছে পাকিস্তানীদের কাছ থেকে কামালপুর ফাঁড়ি দখল করতে এবং যশোর জেলা সদরের দিকে অগ্রসর হতে। কিন্তু পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদেরকে চৌগাছার ওপারে ভারতীয় প্রদেশ পশ্চিম বঙ্গের সাথে সীমান্তের কাছে থামিয়ে দিয়েছে। ভারতীয়রা রাশিয়ার তৈরী একশ ত্রিশ মিলিমিটার কামান ব্যবহার করছে, যশোর রণাঙ্গনে। ভারতীয়রা, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সূত্র অনুযায়ী, দিনাজপুর জেলার পঞ্চগড়ে রাশিয়ার তৈরী সর্বাধুনিক ট্যাঙ্কও ব্যবহার করেছে, পূর্ব পাকিস্তানের একেবারে উত্তর সীমান্তে দুদিন আগে। সেখানে এখনো যুদ্ধ চলছে। পাকিস্তানী সেনাবাহিনী আরো সাত জন ভারতীয় সৈন্যকে আটক করেছে যাদের নিয়ে গত তিন সপ্তাহে আটককৃত নিয়মিত বাহিনীর সৈন্য সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ালো তেরোতে, অধিকন্তু কয়েকজন ভারতীয় আধা-সামরিক বাহিনী – “বর্ডার স্পেশাল ফোর্স”-র সদস্য।

বিদ্রোহী যাদেরকে সরকারীভাবে বর্ণনা করা হচ্ছে “ভারতীয় দালাল” এবং “দুষ্কৃতিকারী” হিসেবে, তারা একটি যাত্রীবাহী ষ্টীমার আক্রমণ করেছে যেটি পাকিস্তান রিভার ষ্টীমার কোম্পানির মালিকানাধীন, সেটি ব্রিটিশ “সাহায্যপুষ্ট” একটি সহযোগী প্রতিষ্ঠান ইন্ডিয়ান জেনারেল নেভিগেশন অ্যান্ড রিভার ষ্টীমার নেভিগেশন কোম্পানি লিমিটেডের, যাত্রী বহনরত অবস্থায়। একজন যাত্রী নিহত হন এবং আরো দুইজন আহত হন। ঢাকা এবং দুর্গম বরিশাল জেলার মধ্যে এটিই একমাত্র যোগাযোগ মাধ্যম ছিল যেহেতু অন্যান্য ব্যক্তিগত যান্ত্রিক নৌযান চলাচল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। একদিন চলাচল বন্ধ থাকার পর, এই ষ্টীমারটি এখন ঢাকা থেকে একদিন পর পর চলাচল করবে।

১১।
বুশ হাউজের কূটনৈতিক শাখা থেকে প্রতিবেদন
৪ঠা ডিসেম্বর, ১৯৭১
টনি পেইন্টিং কর্তৃক

পাকিস্তানের পরিস্থিতি আরো খারাপ হওয়াতে, যুক্তরাষ্ট্র নিরাপত্তা পরিষদের এক অধিবেশন ডেকেছে।

এটি আসলেই একটি তীব্র আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক কর্মকাণ্ডময় দিন ছিল যার চূড়ান্ত পরিণতিতে নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশন ডাকা হয়। আরো গুরুত্বপূর্ণ একটি খবর আসে যে জাপানের সরকার উভয় পক্ষকেই সংযম প্রদর্শনের জন্য আহ্বান জানিয়েছে। এই আহ্বানটি যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রীর তরফ থেকে পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এবং ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর কাছে ইতিপূর্বে পাঠানো বার্তাগুলোর সাথে প্রতিধ্বনিত হয়েছে – এবং যেটি আসলে, গোলযোগ শুরু হবার পর থেকেই যুক্তরাজ্যের তরফ থেকে ঘন ঘন করা প্রচেষ্টাগুলোকে বিশেষায়িত করেছে।

যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো এক্ষেত্রে তাঁর গুরুত্বপূর্ণ প্রভাব খাটান যখন তিনি এই যুদ্ধের ব্যপারে তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং যুদ্ধরত পক্ষগুলোকে একটি শান্তিপূর্ণ সমাধান খুঁজে বের করার প্রয়োজনিতার ব্যপারে আহ্বান জানান। সোভিয়েত প্রধানমন্ত্রী, মিঃ কসিগিন, অধিকন্তু তাঁর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। কিন্তু তিনি সোভিয়েত মধ্যস্ততার সম্ভাবনা নাকচ করে দেন যেধরনের মধ্যস্ততার কল্যাণে ১৯৬৬ সালে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে তাসখন্দ চুক্তি স্বাক্ষর হয়। তিনি এরকম মন্তব্য করেছেন বলে শোনা গেছে যে এবার সোভিয়েত ইউনিয়ন একা অগ্রসর হতে পারবে না। তাঁর এই মন্তব্য অবধারিতভাবে পর্যবেক্ষকদের দৃষ্টি জাতিসংঘের দিকে ফিরিয়ে দিয়েছে এবং বিশেষ করে নিরাপত্তা পরিষদের জরুরী অধিবেশনের প্রতি। না ভারত না পাকিস্তান কেউই কোন পদক্ষেপ নিতে রাজি আছে বলে মনে হয়নি। কিন্তু সব পরাশক্তির মধ্যে, যুক্তরাষ্ট্রকেই শুধু তাৎক্ষনিকভাবে উদ্বিগ্ন বলে মনে হয়েছে। পররাষ্ট্র সচিব, মিঃ রজার্স তাঁর আইসল্যান্ড সফর বাতিল করেন। পরবর্তীতে জানা যায় যে তিনি এবং সরকারের অন্যান্য বিভাগগুলো যতটুকু গভীরভাবে সম্ভব সংশ্লিষ্ট ছিল এবং, পরিশেষে দেখা গেল যে মার্কিনীরা, জাপান এবং অন্য আরো কয়েকটি দেশের সাথে একত্রে এই উদ্যোগ নিয়েছে। অবশ্যই তাদের প্রতি যুক্তরাজ্যের সমর্থন আছে, যার কূটনীতিকেরা সূক্ষ্মভাবে তাদেরকে ঠেলে দিচ্ছিলেন নিরাপত্তা পরিষদের অধিবেশনের দিকে। মিঃ কসিগিনের মন্তব্যও এই ইশারা দেয় যে সোভিয়েত ইউনিয়নও একটি অধিবেশন চায়। প্রশ্নবোধক চিহ্ন হচ্ছে, অবশ্য, নিরাপত্তা পরিষদে রাশিয়া এবং চীনের মধ্যে বিরোধের আশঙ্কা। ভারতের সাথে রাশিয়ার মিত্রতা চুক্তি রয়েছে এবং চীন, কিছুদিন আগে জাতিসংঘের কাছে স্বীকার করেছে এবং নিরাপত্তা পরিষদে তাদের স্থায়ী আসনের কাছে যে, তারা পাকিস্তানকে সমর্থন জানাতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

১২।
ঢাকা থেকে তারবার্তা
৮ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক

পাকিস্তানের জন্য যে একটি জাতীয় সরকার গঠন করা হয়েছে তা এখনো পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তানে বহুল প্রচারিত নয় যে তার প্রতিক্রিয়া জানা যাবেঃ

প্রথম যে বিষয়টি স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়েছে বলে মনে হচ্ছে যে মিঃ জুলফিকার আলী ভুট্টো, সহকারী প্রধান মন্ত্রী এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রীর দ্বৈত দ্বায়িত্বে থাকা সেই ব্যক্তি যাকে হিসাবে ধরে চলতে হবে। যদিও তিনি প্রধান মন্ত্রী, মিঃ নুরুল আমিন এর বয়স আটাত্তর বছর, এবং যদিও তিনি দুর্বল নন, তবুও মিঃ ভুট্টোর মতো প্রাণশক্তিও তাঁর নেই।

মিঃ ভুট্টো সবসময়ই ভারতের প্রতি অনমনীয় মনোভাব পোষণ করে এসেছেন। পশ্চিম পাকিস্তানের দৃষ্টিকোণ থেকে পরিস্থিতি পর্যালোচনা করলে, তিনি সন্দেহাতীতভাবে এই খবর পেয়ে অনুপ্রানিত হয়েছেন যে পাকিস্তানের সেনাবাহিনী কাশ্মীরের অনেকখানি ভেতরে অগ্রসর হতে সক্ষম হয়েছে। এটাও সন্দেহাতীত যে মিঃ ভুট্টো পূর্ব পাকিস্তানের প্রকৃত সামরিক পরিস্থিতি সম্বন্ধেও পূর্ণ ওয়াকিবহাল আছেন। নিরপেক্ষ পর্যবেক্ষকদের কাছে এখন মনে হচ্ছে এরকম একটি ধারণা তৈরী করার পেছনে এখন কিছু যুক্তি আছে যা তিন মাস আগেই পশ্চিম পাকিস্তানের কিছু মহলে সাম্প্রতিক বিষয় হিসেবে আলোচিত হয়েছে, এই মর্মে যে পাকিস্তানের রণকৌশল এরকম হওয়া উচিত যে এক হাজার মাইল দুরের পূর্ব অংশটিকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে উদ্বুদ্ধ করা যাবে না এটা বুঝতে পারা, এবং পাকিস্তানের লক্ষ্য থাকতে হবে এরকম যে পশ্চিমে সমপরিমাণ ভূখণ্ড দখল করে নেয়া যেটি ভারতের সাথে দর কষতে কাজে লাগবে।

এই যুক্তিটি কাজে লাগবে, যেমনটা উনিশশ পঁয়ষট্টি সালে হয়েছিল, যদি বহির্বিশ্বের চাপে সংঘর্ষের সমাপ্তি নিশ্চিত হয়। এখন পর্যন্ত জাতিসংঘের মাধ্যমে যুদ্ধ বিরতি নিশ্চিত করার সব চেষ্টা ব্যর্থ হয়েছে।

ইতোমধ্যে পূর্ব পাকিস্তানের দুর্দশা চলছে। সবেমাত্র পরিস্কারভাবে জানা গেছে যে শনিবার ভোরে অতি উচ্চতা থেকে পরিচালিত ভারতীয় বোমারু বিমানের হামলার সময়, চারটি বোমার একটি গুচ্ছ ঢাকার আদমজী-নগর এলাকার একটি পাটকলের শ্রমিকদের বস্তির উপর পড়ে। একটি বোমা বিস্ফোরিত হতে ব্যর্থ হয়। বাকি তিনটি বোমা ছয়শ বর্গগজ জুড়ে পলকা বসতবাড়ির মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে। অনুমান করা হচ্ছে যে পাঁচশ মানুষ নিহত হয়েছে, এবং আরো আড়াইশত মানুষ এখনো ধ্বংসস্তূপের নিচে চাপা পড়ে আছে যেগুলো শ্রমিকেরা খালি হাতেই সরানোর চেষ্টা করছে।

১৩।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জন ওসমান কর্তৃক (১)

কোলকাতা থেকে ভারতীয় সংবাদ সংস্থা পি. টি. আই. এবং অল-ইন্ডিয়া রেডিও প্রচার করেছে যে কানাডার রাজকীয় বিমান বাহিনীর একটি এবং যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিমান বাহিনীর আরেকটি হারকিউলিস বিমানকে ঢাকা বিমানবন্দরে অবতরণের অনুমতি দেয়নি সেখানকার পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ এবং বিমানদুটি কোলকাতায় ফিরে আসে। এই বিমানদুটি চারটি বিমানের অংশ, একটি কানাডীয় এবং তিনটি যুক্তরাজ্যের, যেগুলিকে ভারতীয় বিমান বাহিনী নিরাপদে কাজ করার নিশ্চয়তা দিয়েছে ২৪ ঘণ্টাব্যাপী অপসারণ কার্যক্রম পরিচালনা করার জন্য ভারতীয় স্থানীয় সময় সন্ধ্যা ৬ টা, দুপুর ১২ টা ৩০ মিনিট লন্ডন স্থানীয় সময় পর্যন্ত। পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষকে গতকালই এই কার্যক্রম চালানোর অনুমতি দেবার কথা বলা হয়েছিল কিন্তু এখন পরিস্থিতি পাল্টে গেছে বলে মনে হচ্ছে। নয়া দিল্লী থেকে জানাচ্ছেন জন ওসমান।

প্রায় ৫০০ জন বিদেশী নাগরিককে ঢাকা থেকে অপসারণের পরিকল্পিত কার্যক্রম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়েছে, কানাডীয় বিমানটি, যেটির শরীরে জাতি সঙ্ঘের চিহ্ন আঁকা ছিল, প্রথমে কোলকাতার উদ্দেশ্যে ফিরিয়ে দেয়া হয় বলে জানা যায়, তারপর যুক্তরাজ্যের বিমান বাহিনীর বিমানগুলোও একই পথে ফিরে আসে। ঢাকার কর্তৃপক্ষ, আমি এখানকার বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছি, বিমানগুলোকে সেখানে অবতরণ করার অনুমতি দিতে অস্বীকৃতি জানায়, এবং কারণ হিসেবে বলা হয় যে পাকিস্তানীরা একারণে আপত্তি জানায় যে বিমানগুলি এসেছে ভারত – শত্রু এলাকা থেকে। এদিকে ভারতীয়রা এখন পর্যন্ত দৃঢ়তার সাথে বলে আসছে যে ঢাকাগামী বিমানগুলো যেন কোলকাতা হয়ে যায় যাতে করে তাদের যাত্রাপথের বিশদ বিবরণ জানা থাকায় সম্ভাব্য বিপর্যয় এড়ানো যায়, এবং এর সাথে সাথে এটাও নিশ্চিত করা যায় যে এই বিমানগুলো মানবিক প্রয়োজন ছাড়া আর অন্য কোন কাজে ব্যবহার করা না হয়।

ভারতীয়দের আরোপিত শর্তাবলী এখন পরিবর্তিত হবে কি হবে না তা অনুমান করা দুস্কর, এবং পাকিস্তানীরা ঠিক কি চাইছে সেটাও বুঝতে পারা কঠিন, যদিনা তারা সরাসরি ব্ল্যাকমেইল করার চিন্তা করে থাকে এবং বিদেশী নাগরিকদেরকে জিম্মি হিসেবে ধরে রেখে অন্যান্য দেশগুলোর উপর চাপ সৃষ্টি করার চেষ্টা করতে চায় যাতে করে ঐ দেশগুলি জাতিসঙ্ঘ এবং অন্যান্য জায়গায় পাকিস্তানকে সমর্থন করে। এধরণের প্রস্তাবনা অবশ্য নিন্দাত্মক এবং এমন কোন প্রমাণ নেই যা থেকে বিশ্বাস করা যায় যে পাকিস্তানের মনে এধরণের ভাবনা রয়েছে।

ভারতীয় শর্তাবলীর শিথিলকরণেও এই সমস্যা সমাধানে সাহায্য হবার সম্ভাবনা রয়েছে। কানাডীয় বিমানটি খুব সহজেই ব্যাংকক থেকে এবং যুক্তরাজ্যের রাজকীয় বিমান বাহিনীর বিমানগুলো সরাসরি সিঙ্গাপুর থেকে আসতে পারে যদি অন্য কোন উপায়ে ভারতীয় শর্তাবলী পুরন করার ব্যবস্থা করা যায়। এই পর্যায়ে আমরা শুধুমাত্র ঘটনা কোন দিকে গড়ায় তার জন্য প্রতীক্ষা করতে পারি যেখানে কূটনৈতিক প্রচেষ্টা চলতে থাকবে এই অচলাবস্থা দূর করতে। ইতোমধ্যে আমি যখন এই বার্তা প্রেরণ করছি ততক্ষনে ভারতীয় নিরাপত্তা নিশ্চয়তার সময়সীমা পেরিয়ে যাচ্ছে।

১৪।
কোলকাতা থেকে প্রতিবেদন
৯ই ডিসেম্বর ১৯৭১
ডেভিড সেলস কর্তৃক

সাক্ষাৎকার গ্রাহকঃ
আপনি যশোরে গিয়েছিলেন ডেভিড এবং আপনি নিশ্চয়তা দিয়ে বলছেন যে এই শহরটি এখন পুরোপুরিভাবে ভারতীয়দের দখলে রয়েছে তাই কি?

সেলসঃ ওরা গতকাল এই শহর পেরিয়ে গেছে। ওরা বড় সামরিক ঘাঁটিটিতেও গিয়েছিল যেটি শহর থেকে দুই বা তিন মাইল উত্তর দিকে অবস্থিত এবং বিমান ঘাঁটিটিও এই সবকিছু এখন ভারতীয় দখলে রয়েছে এবং আমরা তা স্বচক্ষে দেখেছি।

পাকিস্তানীরা যাবার পথে বেশ কয়েকটি সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে তারা অত্যন্ত দক্ষতার সাথেই তা করেছে।

খোদ যশোর শহরটি বরং অনেকটা জনমানবশূন্য ছিল। মানুষজন সবেমাত্র শহরে ফিরে আসতে শুরু করেছে এবং তারা ভারতীয় সৈন্যদেরকে দেখে উল্লসিত ছিল।

১৫।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
৯ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
জন ওসমান কর্তৃক

এই মুহূর্তে ভারত এবং পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ চলছে, লন্ডন সময় সকাল ৫ টায়। নয়া দিল্লীতে সদ্য স্বীকৃতি প্রাপ্ত বাংলাদেশ দূতাবাসে আনুষ্ঠানিক পতাকা উত্তোলন অনুষ্ঠান অনুষ্ঠিত হয়।

এই সপ্তাহান্তের মধ্যে ঢাকা দখলের যুদ্ধ শুরু হবে বলে প্রকাশিত হয়েছে এখানে। পূর্ব রণাঙ্গনে পাকিস্তানীদের প্রতিরোধ ভেঙে পড়ছে বলে মনে হচ্ছে কিন্তু পাকিস্তানীদের উদ্দেশ্য আসলে কি সে ব্যপারে প্রশ্ন রয়ে গেছে। সেখানে আটকে পড়া সৈন্যরা কি একটি মরণপণ শেষ চেষ্টা করবে এবং সমুদ্রপথে অপসারণ করতে চাইবে নাকি তারা আত্মসমর্পণ করবে। ভারতের সেনাবাহিনীর প্রধান দ্বিতীয় বারের মত পাকিস্তানীদেরকে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলেছেন হয় আত্মসমর্পণ কর নয় মৃত্যুর জন্য প্রস্তুত থাকো। ইতোমধ্যে ভারতীয় সৈন্যদেরকে আদেশ দেয়া হয়েছে যে তাদেরকে মনে রাখতে হবে যে তারা মুক্তিদাতা হিসেবে পূর্ব বঙ্গে প্রবেশ করছে বিজেতা হিসেবে নয় এবং তাদের আচরণ যেন সেরূপ হয়। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী ভারতীয় বিমান বাহিনীকে অভিনন্দন জানিয়েছেন তারা পূর্ব বঙ্গে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীকে সম্পূর্ণরুপে ধ্বংস করে দিতে সক্ষম হয়েছে বলে। কোলকাতা থেকে প্রাপ্ত অসমর্থিত প্রতিবেদন অনুযায়ী জানা গেছে যে পূর্ব বঙ্গের পাকিস্তানী সামরিক সর্বাধিনায়ক পশ্চিম পাকিস্তানে চলে গেছেন সাথে করে অন্যান্য উচ্চপদস্থ কর্মকর্তা, কর্মচারী এবং তাদের পরিবারবর্গকে নিয়ে। প্রতিবেদনে আরো বলা হয় যে সহকারী সামরিক আইন প্রশাসককে রেখে যাওয়া হয় তার পক্ষে যতটুকু সম্ভব চেষ্টা করে যাওয়ার জন্যে।

১৬।
দিল্লী থেকে প্রতিবেদন
১০ই ডিসেম্বর, ১৯৭১ জন ওসমান কর্তৃক

অল ইন্ডিয়া রেডিও আজ জানিয়েছে যে ঢাকা এখন কার্যত ঘেরাও হয়ে আছে এবং বহির্বিশ্বের সাথে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। নয়া দিল্লী থেকে জানাচ্ছেন, জন ওসমান।

সরকারীভাবে মেঘনা নদীর পূর্ব পাড়ের তিনটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নেয়ার খবর প্রকাশিত হবার পর এখান থেকে দেখে মনে হচ্ছে ভারতীয়দের জন্য ঢাকায় প্রবেশ করার দুয়ার এখন প্রায় খুলে গেছে। এই শহর তিনটি হচ্ছে রেলসংযোগসহ নদীবন্দর চাঁদপুর, দাউদকান্দি এবং আশুগঞ্জ। এই তিনটির মধ্যে ঢাকায় যাওয়ার সবচে সহজ পথ হচ্ছে আশুগঞ্জ, কিন্তু পশ্চিম পাড়ের সাথে সংযোগ রক্ষাকারী সেতুটি পশ্চাদপসরণকারী পাকিস্তানীরা উড়িয়ে দিয়েছে। অন্য দুটি শহর থেকে অগ্রসর হতে হলে আরো কয়েকটি নদী পার হতে হবে এবং এই জল প্রতিবন্ধকতাগুলিকে ভারতীয় সেনানায়করা গুরুত্বপূর্ণ প্রতিরক্ষা রেখা হিসেবে প্রথম থেকেই বিবেচনা করে আসছিলেন। তাই এখনো সব শেষ হয়ে যায়নি। কিন্তু অল ইন্ডিয়া রেডিও বলছে ঢাকা পুরোপুরিভাবে অবরুদ্ধ এবং পাকিস্তানীরা হয়তো একটি শেষ চেষ্টা করার পরিকল্পনা করছে শহরটির পার্শ্ববর্তী এলাকায়। ইতোমধ্যে, ভারতীয় কর্মকর্তারা দাবী করছেন সামরিক বাহিনীর তিনটি শাখা থেকেই বন্যার মতো সাফল্যের সংবাদ আসছে এবং সেনানায়কদের নাম এমনভাবে সরাসরি বলা হচ্ছে যে যদি এই সংবাদগুলো পরবর্তীতে অতিরঞ্জিত বলে প্রতীয়মান হয় তাহলে তা ওদের জন্য অত্যন্ত অপেশাদারসুলভ বলে মনে হবে। উদাহরণস্বরূপ, ভারতীয় বিমান বাহিনীর পশ্চিম বিভাগের প্রধান, এয়ার-মার্শাল ইঞ্জিনিয়ার, বলেন পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর পশ্চিম বিভাগের একচতুর্থাংশ ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে যেখানে পূর্ব বিভাগে গত দুই দিন ধরে অভিযান চালানোর পর ভারতীয়রা এখন দাবী করছে যে সেখানে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীকে পুরোপুরি ধ্বংস করে দেয়া হয়েছে। এবং শিলং, আসামের রাজধানী থেকে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী ভারতীয় জঙ্গিবিমান ঢাকার কাছে নারায়ণগঞ্জে পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পূর্ব বিভাগের অবশিষ্টাংশদের বহনকারী জলযান ডুবিয়ে দিয়েছে। এই খবরে বলা হয় ষ্টীমার এবং বজরা থেকে শুরু করে যন্ত্রচালিত নৌযান এবং টহলদানকারী নৌযান মিলিয়ে প্রায় একশো জলযান ধ্বংসপ্রাপ্ত বা ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এখানে মনে করা হচ্ছে যে পাকিস্তানীরা হয়তো বরিশাল বা নারায়ণগঞ্জের মতো এলাকা দিয়ে পালিয়ে যাবার চেষ্টা করছে, কিন্তু ভারতের প্রচারিত খবরে এবং প্রচারপত্রে তাদেরকে বারবার বলা হচ্ছে যে তাদের আর কোন আশা নেই। ইতোমধ্যে, ভারতীয় নৌবাহিনী দাবী করছে যে তারা গভীর সমুদ্রে তাদের কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করেছে এবং তারা তাদের ইচ্ছা মোতাবেক করাচী ও পাকিস্তানের অন্যান্য বন্দর আক্রমণ করতে সক্ষম। এখান থেকে দেখে যা মনে হচ্ছে, এবং এর উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে যে এখান থেকে দেখে পাকিস্তানের জন্য পরিস্থিতি খুবই হতাশাব্যঞ্জক বলে মনে হচ্ছে।

১৭।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন
১১ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রনাল্ড রবসন কর্তৃক

বেশী মানুষকে দেখা যাচ্ছে ঢাকার রাস্তায় তাদের স্বল্প অস্থাবর সম্পত্তি ঠেলাগাড়িতে করে নিয়ে যাচ্ছে যেহেতু পরিবারগুলো সেইসব এলাকা থেকে সরে যাচ্ছে যেগুলো ভারতীয় বিমানের আক্রমণের শিকার হচ্ছে বা নারায়ণগঞ্জের মতো নদীতীরবর্তী এলাকা থেকে যেখানে তারা মনে করছে যুদ্ধ হবে ঢাকা অভিমুখে অগ্রসর হবার সময়।

বিমান আক্রমণের সময় ঢাকা শহরবাসীরা অদ্ভুতরকম শান্ত থাকে।

পূর্ব বাংলায় পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সর্বাধিনায়ক, জেনারেল নিয়াজি, কে ঢাকায় দেখা গেছে, যা সেইসব গুজবগুলোকে বাতিল করে দেবে যেগুলো প্রচারিত হয়েছিল যে সে পূর্ব পাকিস্তান থেকে পালিয়ে গেছে।

১৮।
রাওয়ালপিন্ডি থেকে প্রতিবেদন
১৫ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
হ্যারল্ড ব্রাইলি কর্তৃক

পাকিস্তানের জনগণ যখন জাতিসংঘে শান্তি প্রচেষ্টার অগ্রগতির লক্ষন দেখার জন্য অধীর আগ্রহে অপেক্ষা করছে, সেখানে সামরিক বাহিনী নিজেদেরকে প্রস্তুত করছে যেটিকে দেখে মনে হচ্ছে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য ভাগ্য নির্ধারণী যুদ্ধ এর রাজধানী ঢাকার প্রতিরক্ষার যুদ্ধ। রাওয়ালপিন্ডি থেকে জানাচ্ছেন হ্যারল্ড ব্রাইলিঃ

পূর্ব বাংলায় অবস্থানরত পাকিস্তানী বাহিনী ব্যাপক পুনর্বিন্যাস কাজে নিয়োজিত রয়েছে তাদের মুখপাত্রের ভাষ্য অনুযায়ী তাদের পূর্ব অঙ্গরাজ্যটির সর্বোত্তম উপায়ে প্রতিরক্ষা নিশ্চিত করার জন্য। তারা বিস্তারিত জানাতে অস্বীকৃতি জানায়। “আমাদের শত্রুরা ঠিক এটাই জানতে চায়” একজন উচ্চপদস্থ সামরিক কর্মকর্তা আমাকে বলেন, “তাদেরকে অনেক সময় ব্যয় করতে হবে এটা জানার জন্য এবং আমি আশা করি তারা ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির সম্মুখীন হবে”। তাদের কথা মেনে নিলে সামরিক বাহিনীর সদস্যরা যারা পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ নাগরিক তারা ঢাকার পরিপূর্ণ রাস্তাকে স্টালিনগ্রাদে পরিণত করে রাখতে পারবে দিনের পর দিন ধরে এবং তাদের বার্তা সর্বদাই একই রকমঃ আমরা শেষ মানুষটি বেঁচে থাকা পর্যন্ত যুদ্ধ করে যাবো। পাকিস্তানী স্থল বাহিনী নিজেদের মধ্যে পুনর্বিন্যাস করছে ভারতীয় ছত্রীসেনা এবং হেলিকপ্টার থেকে অবতরণকারী সৈন্যদের দ্বারা তাদের অবস্থানের ভিতরে বারংবার অনুপ্রবেশের ঘটনা বিবেচনা করে। পূর্ব বাংলার আকাশে ভারতীয় আধিপত্য নিশ্চিত হবার কারণে তারা কার্যত কোনো বাধা ছাড়াই এটা করতে পারছে যতক্ষণ পর্যন্ত তারা মাটিতে নেমে আসছে আরকি এবং তারপর পাকিস্তানীরা বলছে যে এই ছত্রী অনুপ্রবেশকারীদেরকে তারা মেরে থেঁৎলে দিচ্ছে এবং এই ছত্রী সেনারা তেমন কোনো অগ্রগতি করতে সমর্থ হয়নি। পূর্ব বঙ্গে অবস্থানকারী পাকিস্তান বিমান বাহিনীর দুর্বল শক্তি অনেকদিন আগে থেকেই কার্যত অচল হয়ে পড়েছে। একটি অবসন্ন বাহিনী যাদের কোনো ঘাঁটি নেই কার্যক্রম পরিচালনা করার। ঢাকা বিমান বন্দরে অবস্থিত এর একমাত্র ঘাঁটিটি অবিরত বিমান আক্রমণে অচল হয়ে আছে। পরিস্থিতির কঠিন বাস্তবতা যাই হোক না কেন, পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মনোবল দুর্বল হয়ে যাবার কোন লক্ষণই দেখা যাচ্ছে না।

স্রোতের মতো পাকিস্তানীদের বীরত্বের খবর আসছে যে তারা অসংখ্য ভারতীয় সৈন্যকে পিছু হটতে বাধ্য করছে এবং তাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ঘটাচ্ছে। এটাই তাহলে পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের মনোভাব, তারা সবাই ঢাকার পতন হবার সম্ভাবনাকে মনে স্থান দিচ্ছে না এবং তাই তাদের চমকিত প্রতিক্রিয়া কেমন হবে তা আন্দাজ করা কঠিন।

১৯।
ঢাকা থেকে প্রতিবেদন
১৭ই ডিসেম্বর, ১৯৭১
রয়টার্সের গ্র্যানভিল ওয়াল্টস কর্তৃক

আমি আজ একজন ভারতীয় জেনারেলের জিপগাড়ির সামনে সামনে একটি ট্যাঙ্কে চড়ে পূর্ব পাকিস্তানের রাজধানীতে প্রবেশ করি যখন বিজয়ী ভারতীয় সেনাবাহিনী পতিত শহরটিতে ঢুকছে। রাজধানী জুড়ে বিশাল জনসমুদ্র একত্রিত হয় ভারতীয় সেনাদেরকে শুভেচ্ছা জানাতে, ফুল ছড়িয়ে, হাত নেড়ে এবং চিৎকার করতে করতেঃ “ভারত-বাংলাদেশের বন্ধুত্ব দীর্ঘজীবী হোক”।

এখানে ব্রিগেডিয়ার মিশ্রা, চৌকস ৩৭তম ডিভিশনের অধিনায়ক, অন্যান্যদের সাথে একত্রে ভারতীয় গণ্যমান্যদের আগমনে অভ্যর্থনা জানাচ্ছেন, যাদের মধ্যে লেফটেন্যান্ট জেনারেল অরোরাও আছেন, যিনি পূর্ব রণাঙ্গনে ভারতীয় বাহিনীর সর্বাধিনায়ক, যারা দশটি ভারতীয় হেলিকপ্টারের বহর নিয়ে এসেছেন। ক্রমবর্ধমান আনন্দ এবং হৈ চৈ-এর মাঝে জেনারেল অরোরা এবং ভারতীয় সেনাবাহিনী, নৌবাহিনী এবং বিমান বাহিনীর প্রধানগন, ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে রেসকোর্স ময়দানের দিকে অগ্রসর হন, যেখানে আত্মসমর্পণের দলিলটি আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাক্ষরিত হয়, একটি খুবই সাধারণ অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে ঠিক সেই স্থানে অনুষ্ঠিত হয় যেখান থেকে শেখ মুজিবুর রহমান, আওয়ামী লীগের নেতা, তাঁর বিখ্যাত বাংলাদেশের স্বাধীনতার ভাষণ দেন গত মার্চ মাসে সেনাবাহিনীর কঠোর অবস্থান নেয়ার আগে।

বেশীরভাগ বাঙালির জন্য শেখ মুজিবের অনুপস্থিতি একমাত্র খারাপ বিষয় ছিল যেটি সে রাতের উৎসবমুখর পরিবেশকে ম্লান করে দেয়।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!