You dont have javascript enabled! Please enable it! 1974.07.03 | বাংলার বাণী সম্পাদকীয় | খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য | জননায়কের জীবনাবসান | শেখ মণি - সংগ্রামের নোটবুক

বাংলার বাণী
ঢাকাঃ ৩রা জুলাই, বুধবার, ১৮ই আষাঢ়, ১৩৮১

খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের লক্ষ্য

পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার শুরুতে এবং জাতীয় সংসদ অধিবেশনে মাননীয় খাদ্যমন্ত্রীর বক্তব্য ছিল–আমরা চলতি পাঁচশালা পরিকল্পনার মধ্যে খাদ্য স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে পারব। তবে শর্ত আছে। যদি আপদ-বিপদ কিছু না ঘটে। প্রাকৃতিক দুর্যোগ জনিত ক্ষয়ক্ষতি বিপুল না হয়, অতিবৃষ্টি, বন্যার প্রকোপ দেখা না দেয়, কঠোর পরিশ্রম করা যায়, সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়িত হয় এবং আরো অনেক কাল্পনিক সম্ভাবনার ১০০ ভাগ গ্যারান্টি থাকলে তবেই আমরা লক্ষ্যে পৌঁছাতে পারবো। অতএব আমাদের দৃষ্টি তারপর সবুজ বিপ্লবের দিকেই স্বাভাবিকভাবে ধাবিত হয়েছে। কারণ প্রাকৃতিক দুর্যোগের খামখেয়াল এবং আনুষঙ্গিক সম্ভাবনার প্রতি আমরা অতটা আস্থাশীল নই।
আমরা দেখি সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নের পদক্ষেপ নিতে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় বিভিন্ন পদক্ষেপ নিয়েছেন। পাওয়ার পাম্প বিতরণ, সুলভে সার সরবরাহ, বীজ সরবরাহ এবং আনুষঙ্গিক আনুকূল্য সবাই দিতে আগ্রহী হয়েছেন। এ ব্যাপারে বিভিন্ন সংগঠনের মাধ্যমে কর্মসূচি এগিয়ে চলছে। এই মর্মে পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনও প্রকাশিত হয়েছে। অর্থাৎ সবুজ বিপ্লবের বিপ্লবাত্মক কাজ দ্রুতগতিতে হচ্ছে এমন একটা আশা আমাদের মনে হচ্ছে। এরই প্রেক্ষিতে কোথাও কোথাও ইরি ধান ফলনের আশাব্যঞ্জক চমকপ্রদক সংবাদও প্রতিবেদন মারফত আমরা পাচ্ছি।
কিন্তু তার পাশাপাশি যখন দেখি পাওয়ার পাম্পগুলো অকেজো হয়ে পড়ে থাকে, সারে ভেজাল মেশানো হয়, কীটনাশক ওষুধে ভেজাল দেয়া হয়, বীজে ভেজাল থাকে, বাঁধ ভেঙে পানি জমিতে ঢুকে হাজার হাজার একর জমির ফসল নষ্ট করে ফেলছে–তখন খাদ্য সংরক্ষণের ব্যাপারে আমরা স্বাভাবিকভাবেই সন্ধিগ্ধ হয়ে উঠি।
সম্প্রতি পত্রিকান্তরের প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে যে, ‘সরকারী গুদাম থেকে সরবরাহকৃত সবই ভেজাল থাকায় পাবনা জেলা ২০ হাজার একর’ জমিতে ধান নষ্ট হয়ে গেছে। এসব ইরি ধানের বীজ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের বিভিন্ন গুদাম থেকে কৃষকরা সংগ্রহ করেছিলেন।…. একজন সরকারি কর্মকর্তা জানান যে, ইরি ধানের বীজ কৃষি উন্নয়ন কর্পোরেশনের দত্তনগর ফার্ম থেকে আমদানি করা হয়েছিল। আর অত্যন্ত স্বাভাবিক ভাবেই তাই ভেজাল বীজের গাছ গজায়নি, ফলে ওই অঞ্চলের কৃষকরা মাথায় হাত দিয়ে বসে আছে। তাদের উচ্চ ফলন প্রতারিত হয়েছে নিদারুণভাবে।
কিছুদিন আগেও পত্রিকান্তরে প্রতিবেদনের প্রকাশিত হয়েছিল–ভেজাল সার আর ভেজাল কীটনাশক ওষুধ প্রয়োগ করে বরিশালে ৫০ একর জমির ধান সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে গেছে। সাদা রং (ইউরিয়া), সাদা লবণ এবং লাল রং (ফসফেট) সৈন্ধব লবণ মেশালে আপাত দৃষ্টিতে নিরীহ কৃষকরা তা বুঝতে পারেনি। ঐ সার নিয়ে গিয়ে জমিতে ধান গাছ গুলোর বারোটা বেজে যায়।
কীটনাশক ওষুধে মেশানো হয় কেরোসিন। ফলে পাকা ফসলকে পোকার আক্রমণ থেকে অনেক ক্ষেত্রেও রক্ষা করা যায় না। ওষুধ ছিটিয়েও কোন লাভ হয় না। এবং হাজার হাজার মণ আকাঙ্ক্ষিত উৎপাদিত শস্য আর কৃষকের ঘরে ওঠে আসে না। এক খবরে জানা গেছে যে, ভেজাল মিশ্রিত সার ও ওষুধ প্রয়োগের ফলে দিনাজপুর মহাকুমার শতকরা ৫০ ভাগ ফসল নষ্ট হয়ে গেছে। নিঃসন্দেহে ভয়ানক তথ্য এসব।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ বন্যা আমাদের দেশের নিত্যসঙ্গী। প্রতিবছর দুর্যোগ রাক্ষসী এদেশের কোটি কোটি মণ খাদ্যশস্য গ্রাস করে। খরা এবং অতিবৃষ্টি ও তারই অঙ্গীভূত। তাহলে একমাত্র মানুষই কর্মতৎপরতা এখন বাঁচার পথ সৃষ্টি করবে। সেক্ষেত্রে যদি এহেন নৈরাজ্য, উদাসীনতা, স্বার্থপরতা দেখা যায় তবে আমরা দাঁড়াবো কোথায়? ভিক্ষা করে আমরা আর কতকাল পেট চালাবো? নাকি সেটিও খাদ্য স্বয়ম্ভরতা পূরণের পূর্ব শর্তরূপে বিশ্বাস করতেই থাকবে?
আমাদের অনেক বাধা-বিপত্তি এবং অসুবিধা। সে কথা স্বীকার করতে লজ্জা নেই। কিন্তু মুষ্টিমেয় অসাধু ব্যক্তিদের অসততা, অকর্মণ্যতা, বেইমানি এবং অদূরদর্শিতার কথা আজ আর ঢেকে রাখবার পথ বোধহয় খোলা নেই। যাহোক আমরা চাই খাদ্য স্বয়ম্ভরতা অর্জন করতে। তার জন্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের শর্তাবলী আংশিকভাবে মেনে নিলেও মানসিক অকর্মণ্যতা ও অসততার শর্ত আমরা মানতে রাজি নয়। অতএব আর কোন কথা নয়–আজ কাজ চাই। বাঁচার প্রশ্নে নির্মম ও কঠোর ভাবে নিজেদের দাবিকে তুলে ধরতে চাই। সকল শ্রেণীর দুর্নীতিবাজদের সমূলে উৎখাত চাই। এই সবুজের দেশে সবুজ বিপ্লব সার্থক হচ্ছে তা দেখতে চাই।

জননায়কের জীবনাবসান

পরশু পেরন প্রাণ ত্যাগ করেছেন। বহুদিন হয় তিনি রোগে ভুগছিলেন। রোগাক্রান্ত শরীরেই তাকে গ্রহণ করতে হয়েছিল রাষ্ট্রপরিচালনার দায়িত্ব। সুদীর্ঘ ১৮ বছরের নির্বাসন কাটিয়ে তিনি দেশে ফিরেছিলেন প্রায় এগারোমাস আগে। এটা খুব সহজ ব্যাপার ছিল না। এককালের জনপ্রিয় একনায়ক জুয়ান ডোমিঙ্গো পেরনকে স্বদেশে ফিরে আনতে তার অনুসারীদের অনেক কাঠ খড় পোড়াতে হয়েছে। সুদীর্ঘ ১৮ বছর তারা লড়েছে সামরিক শাসনের বিরুদ্ধে।
দীর্ঘদিনের এই সংগ্রাম ছিল আর্জেন্টিনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা প্রবর্তনের সংগ্রাম। পেরনের ভাবমূর্তি, তার সংস্কারমূলক এবং সাম্রাজ্যবাদবিরোধী নানা পদক্ষেপ জনসাধারণের মনে প্রেরণা জুগিয়ে এসেছে।
জুয়ান ডোমিঙ্গো পেরন ও ক্ষমতায় এসেছিলেন এক সামরিক অভ্যুত্থানের সিঁড়ি বেয়ে। তরুণ জাতীয়তাবাদী সামরিক অফিসারদের একটি গ্রুপের সদস্য ছিলেন তিনি। এই গ্রুপ ১৯৪৩–এর ৪ঠা জুন আর্জেন্টিনায় সামরিক অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ক্ষমতা দখল করে। পেরন তখন নিম্নপদস্থ একজন অফিসার। কিন্তু এই অবস্থানের ওপর তার প্রভাব ছিল অত্যন্ত বেশি। এক বছর পর তিনি জেনারেল এডেলমিরো ক্যারেল-এর মন্ত্রিসভায় প্রথম যুদ্ধ মন্ত্রী এবং পরে ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে মনোনীত হন। ১৯৪৬ সালে দেশের শাসনভার অর্পিত হয় তার উপর। আর্জেন্টিনার প্রেসিডেন্ট হিসেবে তিনি পূর্ণ নির্বাচিত হন ১৯৫১ সালে।
এই দ্বিতীয়বার দায়িত্ব গ্রহণের পরে শুরু হয় তাকে উৎখাতের ষড়যন্ত্র। রোমান ক্যাথলিক গির্জার সঙ্গে তার সম্পর্কের অবনতি ঘটতে থাকে। ইতিমধ্যে অর্থনৈতিক অবস্থার জটিল হয়ে ওঠে। শ্রমজীবী মানুষের সঙ্গে পেরনের ছিল গভীর একাত্মতা। তাদের স্বার্থের স্বপক্ষে তিনি নানা পদক্ষেপ গ্রহণ করেন। আর্জেন্টিনার দেশীয় পুঁজিপতিরা আন্তর্জাতিক পুঁজির সহায়তায় পেরনের বিরুদ্ধে জনগণকে ক্ষেপিয়ে তোলার অপচেষ্টা চালায়। সর্বশেষ আঘাত হানে সামরিক বাহিনী। প্রাথমিকভাবে নৌবাহিনীর একটা বিদ্রোহ সফলতার সাথে দমন করা সত্ত্বেও তিনি শেষ রক্ষা করতে পারলেন না। তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো। এরপর নির্বাসন; প্রথমেই প্যারাগুয়ে এবং তারপর বহু বছর স্পেনের দুঃসহ একাকিত্বের মধ্যে তিনি জীবন যাপন করেন।
আঠারো বৎসর নির্বাসনে থেকে তিনি দেশে ফিরে এসেছিলেন তেয়াত্তুরের শেষের দিকে। জনমতের চাপে সামরিক একনায়ক সাহসী গণতান্ত্রিক ব্যবস্তা প্রবর্তনে অঙ্গীকার করতে বাধ্য হন। সেই নির্বাচনে পেরনপন্থী জাস্টিসিয়ালিস্ট পার্টির স্লোগান ছিল প্রেসিডেন্ট পদে ক্যাম্পোরা, ক্ষমতায় পেরনকে আর্জেন্টিনার জনসাধারণ ক্ষমতায় পুনরায় ফিরিয়ে আনার জন্যই ক্যাম্পোরাকে বিপুল ভোটে জয়যুক্ত করেন। হেক্টর ক্যাম্পোরা প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়ার ক’দিন পরেই পদত্যাগ করেন। দেশে ফিরে এসেছে সে পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন পেরন।
১৮ বছর পরে তৃতীয়বারের মতো প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হই জোয়ান ডোমিঙ্গো পেরন আর্জেন্টিনাকে গণতান্ত্রিক লক্ষ্য অর্জনে এগিয়ে নিয়ে যাবার জন্য অক্লান্ত পরিশ্রম শুরু করেন । এ পথে এগুতে থাকে অনেক প্রতিকূলতা অতিক্রম করতে হয়েছে। এক এক করে তিনি শেষে সকল বাধা অপসারণ করতে থাকেন। ল্যাটিন আমেরিকার কোন দেশকে সুস্থ গণতান্ত্রিক বিকাশের পথে এগিয়ে নেওয়া চাট্টিখানি কথা নয়।
পেলেন সেই দুর্গম পথে চলার নীতিই অনুসরণ করে চলেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পেরনকে কোনদিনই ভালো চোখে দেখেননি। তার সাম্রাজ্যবাদবিরোধী ভূমিকা সব সময় বিরক্তিকর ছিল তাদের কাছে। এবার আলেন্দের চিলি ঘেঁষে অবস্থিত দেশ আর্জেন্টিনায় ভপেরন ক্ষমতা গ্রহণের ফলে স্বাভাবিকভাবেই এই অশুভ শক্তি দারুণভাবে উদ্বিগ্ন হয়ে ওঠে। দক্ষিণপন্থী প্রতিক্রিয়াশীল চক্র শুধু বাইরে থেকে নয় এমনকি পেরনের পার্টির অভ্যন্তরে ও বিভেদ সৃষ্টির অপপ্রয়াস অব্যাহত রাখে। পাশাপাশি অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ বাড়িয়ে দেয় উগ্রপন্থীরা। পেরনকে বাধ্য হয়ে ক্ষমতাগ্রহণের ক’মাস পরে উগ্রপন্থা রাজনৈতিক সংগঠনগুলোকে নিষিদ্ধ করে দিতে হয়। কঠোরভাবে তিনি এদের মোকাবেলার পদক্ষেপ গ্রহণের সিদ্ধান্ত নেন।
রোগ- দুর্বল শরীরেও তিনি গত এগার মাস আর্জেন্টিনায় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার ব্যাপারে যে তৎপরতা চালিয়ে যান তা সত্যিই প্রশংসার যোগ্য। আমেরিকার দুয়ারে দাঁড়িয়ে তিনিই প্রথম বলেছিলেন চিলির গণতান্ত্রিক সরকার উৎখাতের মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র দায়ী। সেই আলেন্দে পাশবশক্তি কর্তৃক নিহত, পেরনও বিদায় নিলেন। ল্যাটিন আমেরিকার গণতান্ত্রিক এবং প্রগতিশীল শক্তির দুই নেতার ওপর আস্থা রাখতে পেরেছিলেন আস্থা কি আর কারো উপর রাখতে পারবেন। আমরা ব্যক্তির ভূমিকাকে বড় করে দেখছি না কিন্তু এমন কিছু অবস্থা রয়েছে যেখানে ব্যক্তির প্রভাবকে কোনমতে খাটো করে দেখা যেতে পারে না। পেরন নেই, কিন্তু তার আদর্শকে সামনে রেখে পেরনের উত্তরসূরীরা ল্যাটিন আমেরিকার রাষ্ট্রসমূহ গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা কায়েম এবং সাম্রাজ্যবাদ বিরোধী সংগ্রাম অব্যাহত রাখবেন বলে আমরা আশা করি।

কালেক্টেড অ্যান্ড ইউনিকোডেড বাই- সংগ্রামের নোটবুক

পত্রিকার মূল কপি পড়তে এখানে ক্লিক করুন