শিরোনামঃ “স্বাধীন বাংলা ” অবাঙ্গালী ও ব্রিটিশ কর্তৃক বংগভংগের উদ্যোগের বিরুদ্ধে লেখা সম্পাদকীয়
সুত্রঃ সাপ্তাহিক মিল্লাত
তারিখঃ ৯ মে ১৯৪৭
সম্পাদকীয়
স্বাধীন বাংলা
দুইশত বৎসর পরাধীনতার পর বাঙালী জাতি আজ স্বাধীন হইতে চলিয়াছে। আর তের মাসের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীন হইবে। বহু ত্যাগ ও সাধনার পর বাঙালীর জীবনে আসিয়াছে এই পরম বাঞ্চিত শুভক্ষণ।
কিন্তু কি হতভাগ্য এই বাংলাদেশ – বহু প্রতীক্ষিত এবং দীর্ঘদিনের সাধনালব্ধ এমন একটি শুভক্ষণকে ব্যর্থ করিতে অবাঙালী কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্ররোচনায় এই বাংলাদেশেরই একদল স্বার্থান্ধ লোক অতি জঘন্য ষড়যন্ত্রে মাতিয়াছে। বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ইহার একটি খণ্ডিত অংশকে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের তাঁবেদাররূপে বাঁধিয়া রাখিতে এই ষড়যন্ত্রকারীর দল তাহাদের সকল শক্তি ও সামর্থ্য নিয়োজিত করিয়াছে।
সমগ্র ভারতবর্ষকে পরাধীনতার শৃঙ্খলে মজবুত করিয়া বাঁধিতে বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদী কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্ট সৃষ্টি করিয়াছিল। আর, শুধু বৃটিশ সাম্রাজ্যবাদীই বা বলি কেন? বৃটিশের এদেশে আগমনের পূর্ব ভারতবর্ষ যখনই কোন সাম্রাজ্যবাদীর শাসনাধীনে আসিয়াছে তখনই কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের লৌহ নিগড় ভারতের সকল দেশকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিয়াছে। কিন্তু ভারতের অন্যান্য সকল দেশকে শৃঙ্খলাবদ্ধ করিলেও অতীতে একাধিক সাম্রাজ্যবাদী শত চেষ্টা সত্ত্বেও বাংলাদেশের স্বাধীনতা হরণ করিতে পারে নাই। আর্য্যদের সাম্রাজ্য মিথিলা পর্যন্ত বিস্তার লাভ করিয়াছিল বটে, কিন্তু বাংলাদেশ কখনও আর্য্যদের পদানত হয় নাই। এমন কি অত বড় বড় সব নামকরা সম্রাট মহারাজা অশোক, কনিষ্ক, সমুদ্রগুপ্ত, চন্দ্রগুপ্ত, বিক্রমাদিত্য তাহারাও কেহ বাংলাদেশকে তাহাদের সাম্রাজ্যের অন্তর্ভুক্ত করিতে পারেন নাই। গুপ্ত আমল পর্যন্ত বাংলাদেশের স্বাধীনতার পতাকা কোন বিদেশীর স্পর্শে কলুষিত হয় নাই।
পাল বংশ ও সেনবংশের স্বাধীন রাজাদের শাসনাধীন স্বাধীন বাংলা সমগ্র ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন থাকিয়া তাহার স্বীয় বৈশিষ্ট্যে রূপায়িত হইয়াছিল। মোহাম্মদ বখতিয়ারের বংগ বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত বাঙলার ইতিহাস বলিতে স্বাধীন বাঙলার ইতিহাসই বুঝায়।
তারপর বিদেশী মুসলমান বাংলাদেশ দখল করিয়া কালক্রমে ইহাকে যখন নিজের দেশ বলিয়া মানিয়া লইল তখন আবার শুরু হইল দিল্লীর কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের বন্ধন হইতে মুক্তির সংগ্রাম। দিল্লীর সুলতান কুতুবুদ্দিনের মৃত্যুর পরই গোড়েশ্বররা দিল্লীর সহিত সকল সম্পর্ক ছিন্ন করিয়া স্বাধীনভাবে বাংলাদেশ শাসন করিতে শুরু করেন। সুলতান আলতামস দিল্লীর সিংহাসনে আরোহণ করার পর ‘বিদ্রোহী’ বাংলাকে পুনরায় শৃঙ্খলিত করিলেন বটে কিন্তু গিয়াসউদ্দীন বলবনের আমলে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের নিগড় ভাংগিয়া তুগরল খাঁ আবার বাংলার স্বাধীনতার পতাকা উড়াইয়া দিলেন। এই যে শুরু হইল দিল্লীর কেন্দ্রীয় সরকারের সহিত বাংলাদেশের সংগ্রাম, গোটা পাঠান আমল ও মোগল আমলের শেষ পর্যন্ত এই সংগ্রাম নিরবিচ্ছিন্নভাবে চলিল। ঐতিহাসিক জিয়াউদ্দীন বারানী বলিয়াছেন , “ বাঙলার অধিবাসীদের বিদ্রোহী হওয়ার একটা মজ্জাগত স্পৃহা আছে। ” কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের শাসনের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী হওয়ার এই স্পৃহা বাস্তবিকই বাঙালী চরিত্রের সবচাইতে উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য। বাংলার স্বাতন্ত্র্য স্বাধীনতা অব্যাহত রাখিতে বাংলাদেশ বরাবর যে লড়াই করিয়াছে সেই লড়াইয়ের ইতিহাসই বাংলার ইতিহাস। দিল্লীর সাম্রাজ্যকে বাংলাদেশ কোনদিনই বরদাস্ত করিতে পারে নাই, আর দিল্লীর
সম্রাটরাও বাঙলার স্বাধীনতাকে কোনদিনই সহজ চিত্তে মানিয়া লইতে পারে নাই। তাই কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্ট ও বাংলার মধ্যে চিরদিন বিরামহীন ও আপোষহীন লড়াই চলিয়াছে। এই লড়াইয়ে কখনও বা পরাজিত হইয়া কেন্দ্রের রাষ্ট্রীয় বন্ধনে বাংলাদেশ বাঁধা পড়িয়াছে আর কখনও বা কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টকে পরাজিত করিয়া বাঙলাদেশের স্বাধীন সত্তাকে সমগ্র দুনিয়ার সম্মুখে সে উঁচু করিয়া ধরিয়াছে। দিল্লীশ্বর বারবার পাশবিক শক্তিবলে বাংলার স্বাধীনতা হরণ করিয়াছে বটে, কিন্তু বাংলাদেশ যখনই সময় ও সুযোগ পাইয়াছে তখনই মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া দিল্লীর রাষ্ট্রীয় বন্ধন ছিঁড়িয়া বাঙলার আজাদীর পতাকা উড়াইয়াছে।
সমগ্র ভারত হইতে বিচ্ছিন্ন তাহার একক স্বতন্ত্র একটি সত্তা আছে এই অনুভূতি বাঙলার সহজাত অনুভূতি। এই অনুভূতির প্রেরণাতেই বাংলাদেশ দুনিয়ার ইতিহাসে এক গৌরবময় ট্র্যাডিশন সৃষ্টি করিয়াছে। ভারতে সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠার লোভ তাহার মনে কখনও স্থান পায় নাই। অপরপক্ষে, লড়াইয়ে পরাজিত না করা পর্যন্ত ভারত সাম্রাজ্য পরাধীনতার শৃঙ্খলে তাহাকে কখনও বাঁধিতেও পারে নাই।
বাঙালী যে সুমহান ট্র্যাডিশনের ধারক ও বাহক সেই ট্র্যাডিশনের প্রেরণাতেই বাংলার স্বতন্ত্র স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের বাসনা আজ তাহার মনে জাগিয়াছে। অতীতে পরাধীন বাংলা যখনই লক্ষ্য করিয়াছে, ভারত সরকারের কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্ট দুর্বল হইয়া পড়িতেছে তখনই সে কেন্দ্রের তাঁবেদারী অস্বীকার করিয়া বাংলার সার্বভৌম স্বাধীনতা ঘোষণা করিয়াছে। আজ ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি হইতে চলিয়াছে। তাই ভারত হইতে বৃটিশ সাম্রাজ্যের বিলুপ্তির সংগে সংগে কেন্দ্রীয় গভর্ণমেন্টের সকল বন্ধন ছিন্ন করিয়া বাংলাদেশ তাহার ট্র্যাডিশনকে সমগ্র জগতের সম্মুখে উঁচু করিয়া তুলিয়া ধরিতে উন্মুখ হইয়া উঠিয়াছে।
কিন্তু অত্যন্ত লজ্জার কথা , এক শ্রেণীর কায়েমী স্বার্থবাদী দেশদ্রোহীর ভূমিকায় অবতীর্ণ হইয়া বাংলাকে দ্বিখণ্ডিত করিয়া ইহার একটি অংশকে বিদেশীর হাতে তুলিয়া দিতে গভীর ষড়যন্ত্র করিতেছে। অবাঙালীদের প্রতি বিদ্বেষের কথা বাড়ীর পাশে বিহার ও আসামে কংগ্রেস ও ভারতীয় আমলে প্রবাসী বাঙালীর উপর অত্যাচার ও অবিচারের কথা , অবাঙালী কর্তৃক নিষ্ঠুরভাবে বাংলার ধন-দৌলত শোষণের কথা, নিখিল ভারতীয় কংগ্রেস রাজনীতিতে উপেক্ষিত ও অবহেলিত বাঙালী হিন্দু নেতাদের অপমানের কথা – সব কথাই ষড়যন্ত্রকারীদের জানা আছে; তবু তাহারা বিদেশী ধনিক – বণিকদের প্রেরণায় বাংলাদেশের একটি অংশকে বিদেশীর উপনিবেশে রূপান্তরিত করিত উন্মত্ত হইয়া উঠিয়াছে।
বাঙালী হইয়াও যাহারা বাংলা দ্বিখণ্ডিত করার পক্ষে ও বাংলার স্বাধীনতার বিরুদ্ধে আওয়াজ তুলিয়াছে তাহাদিগকে একটি প্রশ্ন করিতে চাই। বাঙালীর রক্ত শোষণ করিয়া যাহারা বিত্ত সঞ্চয় করিয়াছে তাহারা আজ অকস্মাৎ এমন পরোপকারী হইয়া উঠিল কেন ? বংগভংগ আন্দোলনকে সাফল্যমণ্ডিত করিতে তাহারা দুই হাতে পানির মত অর্থ ব্যয় করিতেছে কেন? এই কেন’র কি কোন জওয়াব নাই? জওয়াব আছে। আর সেই জওয়াবের ভিতরেই বংগভং আন্দোলনের সকল গূঢ় রহস্য নিহিত।
ভারতের অন্যান্য প্রদেশের প্রবাসী বাঙালীদের উপর যে নির্যাতন চলিতেছে সেই নির্যাতনের বিরুদ্ধে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত প্রবাসী বংগীয় সাহিত্য সম্মেলনে যে সব তীব্র মন্তব্য ও প্রস্তাবাদি পাশ করা হইয়াছে তাহা সবারই জানা আছে। কিন্তু সবকিছু জানিয়া-শুনিয়াও বাংলার ট্র্যাডিশনকে পদদলিত করিয়া অখণ্ড ভারতের তাঁবেদাররূপে বাংলার একটি অংশকে বাঁধিয়া রাখার জন্য গুটিকয়েক কায়েমী স্বার্থবাদী বাঙালী আজ ক্ষেপিয়া উঠিয়াছে। ইহাদের এই ক্ষেপামীর ফলে বাঙালীর জীবনে যে কি ভয়াবহ পরিমাণ অভিশাপ দেখা দিতে পারে, সে সম্পর্কে আমরা বারান্তরে আলোচনা করিব।