পূর্ববঙ্গ সংগ্রাম বিষয়ে
কমল কুমার মজুমদার
আজ প্রায় তিন হপ্তা হইতে যায়, পূর্ববঙ্গতে নিরীহদের ক্রন্দন রােল উথিত রহিয়াছে কত বেচারী নিষ্কলঙ্ক শিশু কণ্ঠে বাজান বাজান! ধ্বনি, মাতার, বাজানরে! বুকফাটা আর্তনাদ হাওয়াতে মিলিয়েছে; অনেক জনক দুখী তবু বিশ্বাসী আল্লারে! বলিয়া শেষ নিশ্বাস ত্যাগ করিয়াছে; অসংখ্য মানুষ ইতমধ্যে আর নাই; আজান আর শ্রুত হইবে না, সৌন্দর্য পাংশুবর্ণ ধারণ করিল; যে তবু ইহা অবধারিত শান্ত যাহারা, ক্ষোভে অবমাননায় মারাত্মক হইবেই, কাজেই এবং উহাদের রাজনৈতিক অভিলাষ, জনমত অধিকার, ভগবান পূর্ণ। করিবেন। জয় ইহাদের আমাদের অবশ্যম্ভাবী!
শুধু গায়, খালি পায়, একদম বেতালিম লড়াই কেহ কখনও লিখে নাই; স্থলে জলে আকাশে বীভৎস অস্ত্রধারী স্বৈরাচারীরা; আমরা যাহারা যুগ যুগ ধরিয়া মনুষ্যকৃত রকমফের শয়তানির মধ্যে জীবন ধারণ করিতে আছি, তাহারা এই বিকট যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, আমাদের চিত্ত বিভ্রান্ত হইল পাশ্চাত্য ঐতিহাসিকরা যে কোনাে ছুতায়, ‘সেমেটিক এ্যাটর্যসিটি’ পদটি, বিশেষত ফিরিঙ্গীরা, উল্লেখে সাপাটে তৎপর দেখা যাইবে (এই শালারা ভুলক্রমে প্যালওপনেজিয়ান যুদ্ধে বিবিধদের মধ্যে থেরাসিয়ানদের স্বভাব সুসা নগরীর কথা, একাধিক ইনকুইজিশন, বন্দুকহীনরেড ইন্ডিয়ান বধ, টাসমানিয়াতে প্রাতরাশের পর জংলি শিকার রূপ অবসর বিনােদন, ইদানিং ভিয়েতনাম সেদিন বেজেন ক্যাম্প, হিরােসিমা- আহা নরডিক (১) মহিমা, মনে রাখে না, নিশ্চয়ই মনে রাখে না বলিয়াই পুনরায় হত্যাকাণ্ড সংগঠন করে। একমাত্র ভেলেতেয়রর লিখেন যে, প্রতীচ্যের রাজারা অপছন্দ যে কোনাে লােকের মুণ্ডু কাটিয়া থাকে, একই কর্মই পাশ্চাত্যে রাজারা ভগবদ অধিকারে করিয়া থাকে)-ঐ ‘সেমেটিক অ্যাটরােসিটি ইয়াহিয়া খা আমাদের দেখাইল।
ইয়াহিয়া খা ও তৎগগাষ্ঠী কর্তৃক অনুষ্ঠিত ইত্যাকার কুৎসিত পৈশাচিকতার তুলনা কোথাও নাই, কেন না অস্ত্র এতাে ভয়ঙ্কর কখনও হয় নাই, এমনও যে যুদ্ধখাের মার্কিন, চীন ও ফিরিঙ্গি দেশবাসী সাধারণ মানুষ (!) তাহারাও এই ঘটনাতে শিহরিবে, চমৎকার অমায়িক নৃশংসতা! বাবার (সম্ভবত) মাজুন ভক্ষণরত থাকিয়া জগর আহ্লাদে মনুষ্য কোতল পর্ব দর্শনে চক্ষু সার্থক করেন, খণ্ডিত ধড় নির্গত রক্তে জমি পিচ্ছিল ও তদীয় সামিয়ানা স্থান নােংরা হইল, এই কারণ তাহার সামিয়ানা তিনবার হটাইতে হয়, অবশ্য এই ক্ষেত্রে ভাগ্যহতরা সকলেই সক্ষম পুরুষ মানুষ! ইয়াহিয়ার চাঁদমারী শিশু রমণী বৃদ্ধ আর্ত! এবং হায়! আমাদের একমাত্র বিশ্বাস একটি সুখ, রক্ত দাগ শত ধৌতিতে উঠে না, দুশমনে দরজার করাঘাত শুনিবে!
দৈনিক কাগজ, ঐ বিকারকে নির্ভুল আখ্যা দিতে হাতড়াইতে আছে, বলিয়াছে মধ্যযুগীয় বর্বরতা, আমরা যদি খতাইয়া দেখি তবে বুঝিব ঐ আখ্যা কী পর্যন্ত যুক্তিজোরাল; তদানীন্তন অত্যাচাররত দুশমনের গায় আহতের রক্ত ফিনকি কোনাে মমতার সঞ্চার করিত না; তবু ইহার মধ্যেও ছাড় ছিল, হেরট ব্লেড বা তরবারিও সমান হেঁতেলে, পার্থক্য ছিল অল্প, মারাত্মককে শুধু হাতে ঘায়েল করার বহু উল্লেখ দেখা যায়, যেহেতু সৎসাহস ও শারীরিক বল তখন নস্যাৎ হয় নাই আর রাত্রে যুদ্ধ প্রায়ই হইত না। কিন্তু ইদানিংকার অস্ত্র যদি কোনাে সহজ মানুষ দেখে তাহা হইলে ঝটিতি তাহার স্নায়ুঘাত হইবে, এখানে কোনাে নিস্তার নাই; শব্দ শ্রুত হওনের পূর্বেই দেহ ঝাঁঝরা হইবে, (হায় একদা দমদম বুলেট লইয়া কত মূঢ় আপত্তি ওঠে!) ইয়াহিয়া খান এই রূপ অস্ত্র সর্বত্র ছড়াইয়া দিয়াছে! পূর্ববঙ্গ বিকৃত হইতেছে, আমরা যাহারা কয়েক বছর যাবত কলিকাতার তথা পশ্চিমবঙ্গের খুনলীলাতে আঁকাইতে ছিলাম (ইদানিং কোন দৈনিক পূর্ববঙ্গের আন্দোলনের সহিত তুলনামূলকভাবে এই জঘন্যতাকে ‘গুপ্ত বিপ্লব’ বলিয়া মানিয়াছেন) তাহারা ঐ সংবাদে ধাত-ছাড়া হইয়াছে। আমাকে বহুদিন পূর্বে ভৈরবগঞ্জে এক নিকারী বলিয়াছিল, করতা বাবু মাছের চেয়ে মানুষের চেয়ে এমন হালাল জীব আর নাই’।
ইয়াহিয়া সহাস্যবদনে ইতিহাস পেষ্টোই যােগাইতেছে, যেহেতু ফিরিঙ্গী মার্কিন চীন ও রুশ ভারতসরকার তাহার বন্ধু; ন্যায়-অন্যায় আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বালখিল্য শব্দ- লুডাে খেলার ভাষা; এখানে এক মহতী নীতি বা কূটনৈতিক পাটোয়ারি ক্রিয়া করে, তাহা এই যে, ‘টিপেছ কি টিপেছি’। উপরিযুক্ত শয়তানেরা যে কিরূপ তাহা নিশ্চয়ই ইতিহাস জানিতে চাহিবে না, কিন্তু যে, ছাপােষা মানুষের রগ বিদীর্ণ হইবে ঐ শালাদের রকমসকম দেখিলে, এমনও যে, খচ্চড়-প্রধান লরেন্স, সেও ফিরিঙ্গী-ফরাসি খলতায় ধাঁধিয়া গিয়াছিল! এখন এখানে যে দেশ গরদনা দিতেছে তখন একমাত্র সেই বেচারি দেশই আততায়ীর প্রতি কম্পিত কণ্ঠে বলিতে পারে আমায় মারছ কেন?
ভারত বিরাট শক্তি কখনও ছিল না; এখনও, কখনই হইতে পারিবে না; সে তাহার পরীক্ষিত সৈন্যদের (যাহারা ভি সি হইতে বহু পদক প্রাপ্ত হইয়াছে, এইসব পদক পাওয়া যে কী দুঃসাহসের পরিচয় তাহা কংগ্রেস বদমাইসরা কখনও ভাবিতে পারিবে না) ভজন শিখাইয়াছে, সে তাহার প্রজাবকে ধনী নির্ধনী, মন্ত্রী হইতে চৌকিদারকে, এমনকি বালক-বালিকাকে হঁাচড়া জুয়াচোরে পরিণত করিয়াছে, ফলে সৎ এবং অসৎ রূপ জবরদস্ত কোনাে কার্যই তাহার ভারতের নিকট আশা করা বাতুলতা, যে এবং তাই মানবতা নামে খুকু চাষাড়ে শব্দ লইয়া আঁখিঠারা ব্যতীত তাহার, ইয়াহিয়ার নিদারুণ অমানুষিকতার ভারতের, উপায় নাই। আজিকার এই বিরুদ্ধে তাহার কিছু বলিবার নাই। বিবিধ কার্যক্রমে চরিত্র তথা মনুষ্যত্ব আসিবার নহে।
পূর্ববঙ্গতি নির্বাচনে মুজিবর রহমান অবিশ্বাস্য সংখ্যায় জয়ী হইলেন, ইহাতে দলের মান বাড়িল, কাজেই যে তিনি পূর্ববঙ্গ নিয়ন্তা হইবেন এমন কথা উঠে না; সংখ্যাগরিষ্ঠ শব্দটি যে কত জোরালাে তাহা যে নেহাত এলেবেলে ইহা পশ্চিমবঙ্গে প্রতি হাত আমরা বুঝিতেছি; কতিপয় ডাক্তার, নার্স, মেথর হাজার হাজার মুমূর্ষ বুর্জয়া-অবুর্জয়া আর্তদের ফেলিয়া ধর্মঘট পাকাইল, লক্ষাধিক শিশুকে, বুর্জয়া নির্বিশেষে, ভুলিয়া দুর্গ দপ্তরের মেহনতী (১) কুলিকামারী কেরানী পােস্টার সাঁটিতে লাগিল, অগণন ছাত্রকে প্রায় দ মজাইয়া, সেকেন্ডারি বোের্ড কেরানী পিওনরা জনগণ চিত্তজয়ী ইউনিয়ন করিতে থাকিল; অতএব সংখ্যাগরিষ্ঠ- তর্কের ঘর থাকিলেও অর্থাৎ আপেক্ষিক হইলেও—শব্দটি কিছু নহে।
মুজিবর সাহেব অসহযােগ আন্দোলন বিবেচনা করিলেন, ইহা খদ্দরই আন্দোলন নহে, যাহা সর্বাংশে ফিরিঙ্গী পছন্দ, ইহা তড়িত ব্যাপার। আমরা দেখিলাম, লাটের বাবুর্চি নাই, জজসাহেব শপথ বাক্য পাঠ করাইতে অস্বীকার করিলেন, যেহেতু ইয়াহিয়া পূর্ববঙ্গকে উপনিবেশ রূপে গড়িতে চাহিয়াছিল, আশ্চর্য যে, তাহাদের পবিত্র পাকিস্তানের এক বিরাট অংশ যে পূর্ববঙ্গ তাহা সে অমান্য করিল, তথাপি মুজিবর রহমান অবিচলিত চিত্তে পাকিস্তানকে ধরিয়াছিলেন। ইয়াহিয়া গােষ্ঠীর শঠতা তিনি বুঝিলেও দেশবাসীকে সম্যক উপলব্ধি যাহাতে তাহা করিতে পারে, অল্পবয়সী ছাত্রী পর্যন্ত যাহাতে এক স্বাধীকার বােধে, অধীরতায় পৌছায় রমণীগণ যাহাতে তাহাদের সন্তান-সন্ততির ভবিষ্যত চিন্তা করত ঐ মুজিবর প্রদর্শিত ধর্ম জেহেদে বাধা প্রদান না করেন তাই বেশ কয়েকদিন মীমাংসার জন্য ঐ মহান নেতাকে পশ্চিমাদের দ্বারস্থ হইতে হইয়াছিলেন। তাজ্জব যে, শাসক ইয়াহিয়া পূর্ববঙ্গীয় ব্যাপার যে ‘জিরাে আউয়ারে পৌঁছিয়াছে তাহা বুঝিয়াছিলেন, যে এবং দাগগা কামান আজ্ঞা দিয়া গেলেন, তাহার গুনতি ছিল, আটচল্লিশ ঘণ্টাতে এই ছেদো ঘেঁটের নিষ্পত্তি হইবে। ঢাকাকে কেন্দ্র করত রেল স্টিমার, যদি মদদ প্রয়ােজন হয়, ধরিয়া এক প্রান্ত হইতে অন্যতে যাওয়া-আসা ঐ আটচল্লিশ ঘণ্টায় কুলাইবে। বিমান এর প্রয়ােজন ঘটিবে না!।
পূর্ববঙ্গীয় মানুষে ঐ মহড়া লইল; এই দিব্য চরিত্র তাহাদের খদ্দর বা ছ্যাচড়া মার্কসিজম গঠিত নহে, ইহা নিরেট জন্মস্থানের প্রতি মাতৃভূমির প্রতি গভীর মায়া। এই চরিত্র তাহার একদিনে নির্মিত একশােবার যে হয় নাই, ইহা মর্মভেদী অপমান হইতে উদ্ভূত; ইতঃপূর্বে গুলির সম্মুখে সে নির্বিকার চিত্তে দাঁড়াইয়াছে। অর্থাৎ যে ভাষা আন্দোলন তীব্রভাবে মুখাইয়া উঠল, অবশেষে ঐ জেহাদ সফলকাম যে হয় তাহা আমরা জানি এবং তখনকার উচ্চশ্রেণী আপামর জনসাধারণের মধ্যে অধিকার বােধ বপন করিতে লাগিলেন; সকলের বক্ষে দেশাত্মবােধ উদ্বুদ্ধ হইল; ইতিমধ্যে যাহারা গোড়া নেমাজী, হাজী তাহাদের সংখ্যা হ্রাস পাইয়াছে, ফলে আধুনিক মত ও জীবন এক হইতে ব্যগ্র হইল! এবং ঘৃণাই তাহাদের ক্ষমতার পরিচয় হইল। প্রত্যেকেই বুঝিয়া লইল যে, স্বাধীনতা ব্যতীত কোনাে পথ নাই এবং যে ঐ জায়গাস্থ বালক-বালিকা মাত্রই ঐ সত্যের কারণে এক ভীমকর্মা প্রতিজ্ঞাবদ্ধ; হায় তাহার হেঁতেল হীন হইয়াও প্রতিজ্ঞা করে।
এখন অজস্র মানুষে প্রাণ দিতেছে! আমাদের সকলের উদ্বেগ প্রকাশ করিলাম, আমরা কেবলমাত্র খবর পাইতে হন্যে হইলাম, বিজন খুনে আমাদের গা-সওয়া হইয়াছে, ভাগ্যিস ঠিক তখনই ঐ প্রচার-সংখ্যা স্ফীতকারী কি দুঃসংবাদ আসিল। কাগজে পদ্য, রেডিওতে বকরেন, জাল ফোটগ্রাফ, ফিল্ম এখনও বঞ্চিত! অবশ্য একদিক দিয়া বিবেচিত হয় যে, আমাদের পশ্চিমবঙ্গীয়বাসীর বােধশক্তি ঐ তরিখা ব্যতীত কোনাে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের তাৎপর্য সঠিক কজা করিতে অক্ষম; মনস্তাত্ত্বিক প্রতিক্রিয়া উহাতে ঐ আবেগে হয় নিশ্চয়ই (১); কিন্তু যে, নামজাদা দৈনিক সকলের অপরিণত ড্রইং-এর যুদ্ধবিষয়ক কার্টুন দেখিলে, একের বােধগম্য হইবে যে, পূর্ববঙ্গে যে কী ঘটিতেছে তাহা সংবাদপত্র আজও ঠাওর করিতে পারিতেছে না! তবুও পুনরায় বলিতে হইবে যে, পশ্চিমবঙ্গীয়রা ইহা অনুন্নত দেশ, অনগ্রসর দেশ ইহাতে যদি কর্তব্যপরায়ণ হয় তাহা হইলে, উহাই দামি।
প্রসঙ্গক্রমে ইহা উল্লেখ করিলে বােধহয় গর্হিত হইবে না যে, স্কুল ও সূক্ষ্ম নজরে পূর্ববঙ্গে ঐ মমদ হাল আমাদের তিন চারি বা ততােধিকভাবে কাজে লাগিয়াছে : আমাদের কাব্যোদ্যম বর্ধিত করিবার, কাপুরুষতা ভুলিবার, পূর্ববঙ্গ নিমিত্ত প্রাণ কত পড়িয়াছিল তাহার পরিচয় দিবার এবং যে সর্বোপরি রুধির কামাইবার সুযােগ বহন করিয়া আনিল!
সেদিন পর্যন্ত জানিতাম, মধুসূদন, নবীন সেন ইহারা বঙ্গের কবি, এখন জানিলাম তাহারা কেহ চট্টগ্রাম, কেহ যশােহর-এর, সম্ভবত ইহা এই যুদ্ধ-কারণে প্রমাণ করিতে চাওয়া হইয়াছে যে, ঐ স্থান সকল শুধু যে, ভূগােল উজ্জ্বল করিয়া আছে এমত নহে, অধিকন্তু উহাদের সংস্কৃতিমূলক ঐতিহ্য অমর এবং আমাদের সহিত ঐ সাংস্কৃতিক যােগ অবিচ্ছেদ্য এই কাব্যোদম্যে আশ্চর্য যে, ঢাকার গােবিন্দ দাস বাদ পড়িয়াছেন এবং আরও আশ্চর্যের ইহা, অগণন পূর্ববঙ্গীয় কবি, যাহারা এই সংগ্রামে যােগ রাখিয়া আসিতেছে, তাহারা বাদ পড়িল, হয়তাে কাগজের মানের দিক দিয়া তাহারা বাজে লেখে! অথবা রেডিও ইহাদের এত পচাইয়াছে। যে, ব্যবহার যােগ্য নহে! তবু স্বীকার করিতে হইবে, মধুসূদন, নবীন সেনকে কবিরূপে গণ্য করা হইল— ইহা সুস্থতার লক্ষণ! এবং এই যুদ্ধতে বহু ন্যাকা কবিত্ব পুনরায় জাগরুক হইল। সাংস্কৃতিক যােগের পর যাহা সবিশেষ লক্ষণযুক্ত তাহা প্রাণ-পড়িয়া থাক! পত্র-পত্রিকায় কতিপয়ের নস্টালজি ছাড়াও ঐ সকল পড়িলে ইন্দ্রনারায়ণবাবুর উল্লেখ মনে পড়েছে যে, আফগানে যুদ্ধ সংঘটিত কোনাে ফিরিঙ্গীর এপিক লেখার উদ্দেশে হয়আমরা যদি স্বাধ্যায় করি তাহা হইলে, মানিতে বাধ্য হইব যে, সামাজিকভাবে বাঙালির পূর্ববঙ্গের সম্বন্ধে অজর রহিয়াছে, চতুর্বর্ণে জগত বটেই এবং ঘর, পরিচয়, রীতিনীতি আচার পূর্ববঙ্গের বিভিন্ন স্থানের নাম বহন করে, এখন বিবাহদির ও শােক সংবাদ বিজ্ঞাপনে তাহার সাক্ষ্য পাইয়া থাকি। এই প্রাণ পড়িয়া থাকার জন্যই বাঙালির চিত্ত অস্থির হইয়াছে, আমরা সকলেই অব্যাভিচারিণী মানসে গাঢ় খেদ রাবনিক দ্বেষ বিস্মৃত হইলাম। নিজেরে বাঙালি বলিতে পারিয়া আমাদের দেহ-মন শুদ্ধ নিশ্চয়ই হইল! যে | এবং নিজেকে বাঙালি স্মরিয়া আমরা পূর্ববঙ্গের মাতৃভূমির জন্য ঈদৃশ লড়াইয়ের বীরত্বের অংশীদার হইলাম! ও তাহাতে করিয়া আমাদের এ যাবত কাপুরুষতা ভুলিবার বিষয় পাইলাম!
বাঙালির চরিত্র সম্পর্কে বহু ঐতিহাসিকের পর্যবেক্ষণ নিপ্রয়ােজন, কালী সিংহী যাহা বলিয়াছেন তাহা সাদাভাবে ইহা যে, যে কোনাে তত্ত্ব পাইলেই বাঙালি বা বজ্জাতরা খামচাইয়া পােষাইয়া লইবে (যথা পূর্ববঙ্গের পরিপ্রেক্ষিতে ইহা পড়ন, ইহা দেখুন ‘জয়-বাংলা’ ইতমধ্যেই দলগত তহবিল খােলা হইয়াছে, ছেদা বাক্স রাস্তাতে অনবরত আঁকি মারিতেছে, অনেক সংস্থা সম্প্রতি হৃদয়বান হইয়াছে, এখানে উল্লেখযােগ্য যে, তিলক ফান্ড, বন্যা ফান্ডগুলাে, চীন প্রতিরােধ ফান্ড উবিয়া গিয়াছে; চীন যুদ্ধে রক্তসংগ্রহ নর্দমায় গিয়াছে! অতএব পূর্ববঙ্গ কতখানি উপকৃত হইবে, তাহা কল্পনা করা যায়। ইহা সত্যই দুঃখের।
আরও দুঃখের, অনেক সংবাদপত্র ইতিমধ্যেই এই মরণপণ লড়াইয়ের কখনও সমালােচনা করিয়া, কখনও বা উপদেশ ছলে ঢিট্টিকরে দিতে ব্যস্ত আছেন; কোনাে সাংবাদিক চৌকষ দোরােখা প্রশ্ন তুলিয়াছেন, ইয়াহিয়া যদি করিল, তাহা হইলে কেনই বা করিল অথবা না যদি’ ইত্যাদি মুজিবর রহমান যদি করিলেন তবে সাংগঠনিক যদি, তবে, কেন, প্রস্তুত ইত্যাদি এইরূপ স্ত্রী-মন ঘােলান প্রশ্ন তুলিয়া! আপন কর্তব্য সারিয়াছেন।
সূত্র: দর্পণ
০৭.০৫.১৯৭১