You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.11.30 | ১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ৩০শে নভেম্বর ১৯৭১ | একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী - সংগ্রামের নোটবুক

১৩ অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ মঙ্গলবার, ৩০শে নভেম্বর ১৯৭১

ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী রাজ্য সভায় পূর্ব পাকিস্তান থেকে সকল পাকবাহিনী প্রত্যাহার পূর্ব বাঙালীদের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেয়ার আহ্বান জানান। শ্ৰীমতী ইন্দিরা গান্ধী বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, আগামী মাস ভারত ও বাংলাদেশের জনগণের চরম সমস্যার মাস। তবে ভারত ও বাংলাদেশের জনগণ যে বর্তমান অন্ধকার কাটিয়ে সুখ ও স্বাচ্ছন্দ-জীবন গড়ে তুলতে পারবে সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ। Mrs. Gandhi demanded the withdrawal of all Pakistani troops from East Pakistan in a speech in the Rajya Sabha on Nov. 30. In the existing situation. She did not believe that the people of Bangladesh would accept anything less than independence, but India could not speak for them. Only the people of Bangladesh had the authority to say what form of Government they wanted. The only solution was for the Pakistan Army to withdraw from Bangladesh as “a gesture of peace”.

পাকিস্তান সরকার আজ সারাদেশে জরুরী অবস্থা ঘোষণার সাথে সাথে ১৯৭১ সালের পাকিস্তান প্রতিরক্ষা অর্ডিন্যান্স এবং পাকিস্তান প্রতিরক্ষা আইন একযোগে বলবৎ করেছে।

স্বস্তি পরিষদের বৈঠকে ভারতীয় হামলার প্রশ্নে পাকিস্তান এখনো ঠিক করেনি। তবে, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বৃহৎ শক্তিবর্গের রাষ্ট্র প্রধানদের কাছে চিঠি লিখেছেন এবং বিভিন্ন দেশে পাকিস্তানের প্রতিনিধিগণ প্রতিদিনের ঘটনাবলী রাখছেন। একজন পাক সরকারী মুখপাত্র সাংবাদিকদের একথা বলেন (দৈঃ পাঃ ৭খঃ পূঃ ১৪৫)

ভারতীয় মিত্রবাহিনী ও মুক্তিবাহিনীর উইংকমান্ডার এম. কে. বাশারের নেতৃত্বাধীন মুক্তিবাহিনী লালমনিরহাট বরাবর তিস্তা নদী অতিক্রম করে হারাগাছা দিয়ে তিস্তার তিস্তা নদী অতিক্রম করে কাউনিয়া এবং মাহিগঞ্জ দিয়ে রংপুরে দস্যু পাকিস্তানী বাহিনীকে অবরোধ করে ফেলে। অন্যদিকে, জলঢাকা ডোমার ডিমলা হয়ে নীলফামারী ও সৈয়দপুর এবং পঞ্চগড় ঠাকুরগাঁ, দিনাজপুর, নীলফামারী সৈয়দপুর উদ্ধার শেষে রংপুর অবরোধ করে। একটি দল হিলি থেকে পীরগঞ্জ দিয়ে রংপুর অবরোধ এবং অপর দল হিলি থেকে পলাশবাড়ির ভেতর দিয়ে গাইবান্ধা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে গাইবান্ধা ও ফুলছড়ি ঘাট উদ্ধার করে। এভাবে অবরোধ সৃষ্টি করে রংপুর থেকে নরপশু পাকিস্তানী দস্যুদের পলায়নের সকল পথ বন্ধ করে দেয়। এ ছাড়া, আসাম এলাকা থেকে ব্ৰহ্মপুত্ৰ নদী অতিক্রম করে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনী বাহাদুরাবাদ দিয়ে জামালপুর ও ময়মনসিংহ অভিমুখে অগসর হয়। আগামী ক’দিনের মধ্যে ইতিহাসে রক্তস্নান করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ মূর্ত হয়ে ওঠবে-এ উদ্দীপনা অকুতভয় বীর মুক্তি বাহিনী অবরুদ্ধ। বাংলাদেশে বিভিন্ন অঞ্চলে আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি করে।

পূর্বঞ্চলীয় কম্যান্ডের লেঃ জেঃ এ. কে. নিয়াজী গত শুক্রবার ঢাকায় একজন বিদেশী সাংবাদিককে বলেছেন ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে গত ২৪ নভেম্বর যে আক্রমণ শুরু করেছে তার কথা উল্লেখ করে বলেন, তাদের যা কিছু আছে সব নিয়েই তারা আমাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কিন্তু তারা ব্যর্থ হয়ে গেছে। মুক্তিবাহিনীও শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উল্লেখ্য, মুক্তিবাহিনী শব্দটি পাকিস্তানের সংবাদ মাধ্যমে প্রথম ব্যবহার হল। (দৈঃ পাঃ৭ খঃ পৃঃ ৬৩৫)

মুক্তিবাহিনী আজ পঞ্চগড় মুক্ত করে পাকিস্তানী এক মুখপাত্র রাওয়ালপিণ্ডিতে বলেন, আজ পূর্বাঞ্চলে সীমান্তবর্তী ২৮টি স্থানে ভারতীয়রা (মুক্তিবাহিনী) আক্রমণ পরিচালনা করে। রংপুর ও দিনাজপুরের পঞ্চগড়ে প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করা হয়। পাকিস্তান বাহিনী পঞ্চগড় ত্যাগ করতে বাধ্য হয়। ভারতীয়রা পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তে তাদের চাপ অব্যাহত রেখে কিছু লাভ করেছেন মুখপাত্র স্বীকার করেন। পঞ্চগড় ছাড়াও যশোরের চৌগাছা, জীবন নগর ও সিলেটের আটগ্রাম পাকবাহিনীর হাতছাড়া হয়ে গেছে। এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম-কুমিল্লা সীমান্তে নিয়োজিত এলাকা দখলের জন্য এক চাপ সৃষ্টি করে রেখেছে।

রাওয়ালপিণ্ডিতে ইয়াহিয়া-ভুট্টো-নূরুল আমিন যৌথ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয় এ দিন।

২২ জন বাঙালী পুলিশ অফিসারকে আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ।

রাওয়ালপিণ্ডিতে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে পূর্ব পাকিস্তানের জামাতে ইসলামীর আমীর অধ্যাপক গোলাম আযম বলেন, জামাতে ইসলামীর সদস্য এবং রাজাকাররা পাকিস্তানকে রক্ষা করার জন্য প্রাণ দিচ্ছে। আমরা এটা আমাদের কর্তব্য মনে করেই বিচ্ছিন্নবাদী মুক্তিযোদ্ধা ও রাষ্ট্রবিরোধী আওয়ামী লীগের লোকদের বিরুদ্ধে পাকিস্তান সরকার ও সেনাবাহিনীকে সহযোগিতা দান করেছি যে, সব দেশপ্রেমিক পূর্ব পাকিস্তানী দেশের অখণ্ডতা রক্ষার জন্য কাজ করেছে। তাদের উৎসাহ দেওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের পূর্বাঞ্চল সফর করা উচিত।

নারায়ণগঞ্জের গোদানাইলে ইউনাইটেড ব্যাংক লুট। মতিঝিলে ইউনাইটেড ব্যাংকে গেরিলা দলের অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সহ হামলা। ঢাকায় প্রাদেশিক জামাতে ইসলামীর সভায় প্রণীত এক প্রস্তাবে বলা হয়, ভারত পূর্ব পাকিস্তান সীমান্তের কিছু এলাকা দখল করে সেখানে তথাকথিত বাংলাদেশ সরকারকে বসানোর ব্যর্থ চেষ্টা করছে। দেশপ্রেমিক প্রদেশবাসীকে যে কোন মূল্যে ভারতের এই অপচেষ্টা প্রতিহত করতে হবে, নইলে মুসলমানদের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে যাবে।

বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি কর্তৃক বাংলাদেশের জনগণের সামনে উত্থাপিত স্বাধীন সার্বভৌম জনগণতান্ত্রিক রাষ্ট্র ও সমাজ ব্যবস্থার রূপরেখা ও কর্মসূচী ঘোষণা করেন। (৪ খঃ পৃঃ ৬০৫)

‘নিউইয়র্ক টাইমস্’-এর সংবাদদাতা সিড্‌নী এইচ শানবার্গ কলকাতা থেকে প্রেরিত এক সংবাদ বিশ্লেষণে বলেন, পূর্ব বংগে বন্ধুত্বপূর্ণ, লোকায়ত ও স্বাধীন একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করাই ভারতের মূললক্ষ্য। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্য তারা যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার সম্ভাবনা মেনে নিয়েছে। এ ব্যাপারে তারা অবিচলিত এবং কোনরকম আপস করতে রাজি নয়। জনৈক ভারতীয় অফিসার পত্রিকাটির সংবাদদাতাকে বলেন, ভারত যুদ্ধ শুরু করবে না। পাকিস্তান যদি যুদ্ধ শুরু করে তাহলে ভারত তার লক্ষ্য অর্জন না হওয়া পর্যন্ত ক্ষান্ত হবে না। (ইন্টরন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন কর্তৃক নিউইয়র্ক টাইম থেকে উদ্ভূত, ২৯ নভেম্বর।)

জনৈক ভারতীয় মুখপাত্র নয়া দিল্লীতে বলেন, ভারতীয় সৈন্যবাহিনী ২৮ নভেম্বর বালুরঘাটের নিকট পূর্ব বংগের সীমান্ত পার হয়ে দ্বিতীয় বার পাকিস্তান বাহিনীকে আক্রমণ করে ৩টি ট্যাংক ধ্বংস করে। ২৭ নভেম্বর প্রথম আক্ৰমণ অনুষ্ঠিত হয়। (ফাইনান্সিয়াল টাইমস, ২৯ নভেম্বর)

২৮ নভেম্বর কলকাতায় অনুষ্ঠিত এক জনসভায় বক্তৃতাদানকালে ভারতীয় প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেন, সম্ভবত আগামী কয়েকদিনের মধ্যেই বাংলাদেশ স্বাধীনতা অর্জন করবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতার ফলে বাংলাদেশ শীঘ্রই স্বাধীন দেশের মর্যাদা লাভ করবে বলে তিনি উল্লেখ করেন। তিনি আরও বলেন, পূর্ণ স্বাধীনতা পূর্ব বংগ সমস্যার একমাত্র সমাধান এবং পূর্ব বংগের বাঙালীরা স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান গ্রহণ করতে রাজি নয়। (মনিংস্টার ২৯ নভেম্বর)। ২৯ নভেম্বর নয়াদিল্লী থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে বলা হয়, যুদ্ধ বন্ধ করা সম্পর্কে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের একটি জরুরী বাণী ভারতে নিয়োজিত মার্কিন রাষ্ট্রদূতের মারফত মিসেস গান্ধীর নিকট প্রেরণ করা হয়। মিসেস গান্ধীর প্রতিক্রিয়া সম্পর্কে ভারতের সরকারী মুখপাত্র কোন মন্তব্য করেননি। মূল সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে কোন প্রস্তাব করা হয়নি বিধায় নিক্সনের বাণী উপেক্ষা করা হবে বলে অনুমান করা হয়। করাচী থেকে প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়। পূর্ব বংগের সীমান্ত এলাকায় ভারতীয় সৈন্যবাহিনীর চাপ ক্রমেই বৃদ্ধি পাচ্ছে সিলেট, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, ও যশোর এলাকায় ভারতীয় আক্ৰমণ অব্যাহত রয়েছে। (ফাইন্যান্সিয়াল টাইমস, ৩০ নভেম্বর)

পিকিং থেকে বয়টার কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদে বলা হয়, ভারত পাকিস্তান সীমান্তে যুদ্ধের জন্য চীনের উপপ্রধানমন্ত্রী লি সিয়েন নিয়ে এক সান্ধ্য অনুষ্ঠানে ভারতের বিরুদ্ধে বিরূপ মন্তব্য করেন।

এদিন ৪নং সেক্টরের ডাউকি সাব-সেক্টর ট্রুপস এবং ৩য় বেঙ্গল রেজিমেন্ট যৌথভাবে মেজর সাফায়েত জামিলের কম্যান্ডে রাধানগর (তামাবিল) শত্রুমুক্ত করেন। পরে গোয়াইনঘাটের অবস্থান শত্রুমুক্ত হয়। মুক্তিবাহিনী টেংরাটিলায় পাকবাহিনীর ওপর আক্রমণ করে। উল্লেখ্য, ৫ই নভেম্বর রাধানগরে প্রচণ্ড যুদ্ধ হয়।

আলবেনিয়ার মুক্তিদিবস উপলক্ষে আয়োজিত এই অনুষ্ঠানে মিঃ লি বলেন, সামাজিক সাম্রাজ্যবাদীদের অর্থাৎ সোভিয়েত ইউনিয়নের সমর্থন ও সাহায্য গ্রহণ করে ভারত কর্তৃক কয়েকদিন যাবৎ পূর্ব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপ পরিচালনার ফলে উপমহাদেশের উত্তেজনাপূর্ণ পরিস্থিতির অবনতি ঘটেছে। এই অনুষ্ঠানে চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই উপস্থিত ছিলেন। ( দি ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ৩০ নভেম্বর)

২৯ নভেম্বর জেনেভা থেকে প্রাপ্ত এক সংবাদে প্রকাশ শেখ মুজিবের গোপন বিচার ও তার ফলাফল সম্পর্কে তথ্য সরবরাহের জন্য ইন্টারন্যাশনাল কমিশন অব জুরিস্ট পাকিস্তান সরকারের নিকট দাবী জানিয়েছে। যদি তাকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়ে থাকে তাহলে দয়া প্রদর্শনের জন্য কমিশন অনুরোধ জানিয়েছে। (ইন্টারন্যাশনাল হেরাল্ড ট্রিবিউন ৩০ নভেম্বর )

নভেম্বর মাসে মুক্তিবাহিনী ব্যাপক তৎপরতা, আন্তর্জাতিক মঞ্চে পাকিস্তানের কোণঠাসা হয়ে পরা এবং চীনের কাছ থেকে উৎসাহজনক সাড়া না পাওয়ায় পাক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া বেশ বেসামাল হয়ে পড়েছিল তা তার কতিপয় উক্তিতে সাক্ষ্য মেলে (ডিসেম্বর ৬ টাইম ম্যাগাজিন) উল্লেখ করেছ যে-

“last week during an impromptu speech at a late night dinner in Islamabad. Lashing out at Indira Gandhi, he (Yahya) said at one point, “If that woman thinks she will cow me, I refuse to take it. If she wants a war. I’ll fight it.” The remark was not only ungallant, it was imprudent. For when it comes to tough mindedness, Mrs Gandhi is at least a match for Yahya Khan. As the only daughter of Jawaharlal Nehru,She was carefully groomed for leadership and grew up and adored and beloved “child of the nations,” From her she inherited a sense of grace under pressure, but where he was the Idealist, she is much more the pragmatist,” (Time Magazine)

Reference:

একাত্তরের দশ মাস – রবীন্দ্রনাথ ত্রিবেদী