হিন্দুস্তান স্টান্ডার্ড, এপ্রিল ১২, ১৯৭১, রাজশাহী যুদ্ধের প্রত্যক্ষ বর্ণনা – রবার্ট কেইলর
রাজশাহী, ১১ই এপ্রিল। বাইরের জগতে পৌঁছানো ইঙ্গিতগুলি থেকে বুঝা যায়, এখানে বেঁচে থাকার সংগ্রামটি পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে অন্যত্র পরিচালিত যুদ্ধগুলির একটি ভাল উদাহরণ।
শহরে, ঢাকা শহরের ১৯০ মাইল উত্তর-পশ্চিমের ১০০,০০০ জনের একটি কর্মব্যস্ত ব্যবসায়িক কেন্দ্র এখন বাংলাদেশের “মুক্তি বাহিনী”। তারা তাদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংকল্পে দৃঢ়, কিন্তু সংগঠন, অস্ত্র, যোগাযোগসহ যুদ্ধে লড়াইয়ের জন্য যেগুলো লাগে তার সবকিছুতেই দুর্বল।
পশ্চিম পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীর বাকি অংশটি শহরের উত্তরের প্রান্তে অবস্থিত একটি সামরিক ঘাঁটিতে অবস্থিত। তারা আধুনিক অস্ত্র এবং আকাশপথ সাহায্যসহ একটি সংগঠিত যুদ্ধের অংশ। তবে, এখন তারা প্রতিকূল জনসংখ্যা বেষ্টিত এবং সরবরাহ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পড়ে আছে।
শেখ মুজিবুর রহমানের আওয়ামী লীগের সমর্থকদের কাছ থেকে নিয়ন্ত্রণ হস্তান্তর করার জন্য সেনাবাহিনী যখন ২৫ ও ২৬শে মার্চ পূর্ব পাকিস্তানে প্রায় সব জায়গায় যুদ্ধ করেছিল তখন এটি এখানেও ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সময় থেকে কত লোক মারা গেছে কেউ জানে না। রাজশাহীতে মুক্তিবাহিনীর নেতারা ধারণা করেন ৩,০০০ থেকে ৪,০০০ পূর্ব পাকিস্তানিদের হত্যা করা হয়েছে। বেশীর ভাগ মৃত্যু ঘটেছে আশেপাশের গ্রামে যেখানে সৈন্যরা হামলা চালিয়েছে এবং বিমান আক্রমন করছে।
অন্য দিকে, মুক্তিকামী নেতারা বলছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রায় ২০০ সৈন্য নিহত হয়েছে, যাদের বেশিরভাগকে কয়েকজন গ্রামবাসী ঘিরে ধরেছিল, যাদের ক্লাব, ইট ও পাথর ছাড়া কোন অস্ত্র ছিল না।
স্থানীয় আওয়ামীলীগ নেতা তাসাদ্দেক হোসেন বলেন, “তারা অসহায় ও নির্যাতিত ছিল এবং তারা তাদের জীবনের চিন্তা না করেই সৈন্যদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছিল এবং তাদের হত্যা করেছিল”।
গত বুধবার যখন শহরে থাকা সেনাদল তাদের অবস্থান সুসংহত করার জন্য শহরের এক মাইল উত্তরে অবস্থিত ক্যান্টনমেন্টে থাকা সৈন্যদের কাছে যায়, তখন মুক্তিবাহিনী রাজশাহী দখল নেয়।
এটা একটা ভুতের শহর, দোকানপাট বন্ধ ও তালাবদ্ধ। বস্তুত জনসংখ্যার সব চলে গেছে, যাদের বেশীরভাগ গ্রামে এবং প্রায় ১০,০০০ আশেপাশে ভারতীয় সীমান্তের পাড়ি দিতে গেছে।
রাস্তায় সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা বহনকারী জীপগাড়ি গুলোই একমাত্র মোটর চালিত যানবহন। কিছু দুই চাকার রিক্সা আছে কিন্তু যাত্রীর অভাবে চালকগুলো বিচ্ছিন্নভাবে রাস্তার কোণে জড়ো হয়।
অন্যত্রের মত, অনেক দোকান এবং ব্যবসা পশ্চিম পাকিস্তানিদের মালিকানাধীন ছিল, যাদের সবাই দৃষ্টিসীমা থেকে অদৃশ্য হয়ে গেছে। এক মুক্তিকামী নেতা আমাকে বলেছিলেন, পশ্চিম পাকিস্তানিদের আটকে রাখা হচ্ছে, কিন্তু রাস্তার “স্বাধীনতা যোদ্ধাদের” একজন ভিন্নকথা বললো।
সে বলেছিল, “আমরা “সালামারদের” ধ্বংস করে দিয়েছি যারা সেনাবাহিনীকে সমর্থন দিয়েছিল এবং জিনিসপত্র সরবরাহ করেছিল”। যুদ্ধের শুরুতে রাজশাহীতে কতজন পশ্চিম পাকিস্তানি ছিল সেটা জানা ছিলনা।
মুক্তি নেতারা বিশ্বাস করেন যে, দুই মাইল বর্গক্ষেত্রের ক্যান্টনমেন্টের মধ্যে, কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা ভবনগুলোর একটি এলাকা, প্রায় ৩০০ সৈন্যদল মোতায়েন রয়েছে। ক্যাম্পের চারপাশে মুক্তিযোদ্ধারা অবস্থান নেয়।
প্রতিরোধ
শহরে প্রতিরোধী যোদ্ধাদের দল গড়ে ওঠার দুদিন আগেই তারা ভিতরে ঢুকে পড়ার চিন্তা করে এবং ক্যান্টনমেন্ট থেকে বেরিয়ে আসা সাদা পতাকাবাহী সৈন্যদের একটি দলের সাথে সামনে এগিয়ে যায়। তাদের মধ্যে কয়েকজন অস্ত্র বহন করছিলো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা দৃশ্যত প্রত্যাশাই করেনি যে পাকিস্তানিরা তাদের ব্যবহার করবে।
তাদের পরিচয় প্রকাশ পাওয়া মাত্রই মেশিন গান চালানো হয়। মুক্তি নেতারা বলেছিল, এই ঘটনায় হতাহতদের সঠিক পরিমান পাওয়া যায়নি, কিন্তু ক্ষতির পরিমাণ অত্যধিক বলে বর্ণনা করেছেন।
মুক্তি নেতারা বলছে, সেনানিবাসে তিন ইঞ্চি মর্টার এবং অন্যান্য ভারী অস্ত্র রয়েছে। তবে তাদের উপর গুলি চালায়নি বরং মনে হচ্ছে তারা তাদের গোলাবারুদ সংরক্ষণ করছে। সৈন্যরা আশ্রয় খাদ খনন করার খবর পেয়েছে। মুক্তিবাহিনী সেনাক্যাম্পে যাওয়া জিনিসপত্র এবং পানির লাইন কেটে দিয়েছে।
যখন আমি এলাকা পরিদর্শন করেছিলাম, রাজশাহীর আকাশে কোন পাকিস্তান বিমান বাহিনীর কোনও বিমান ছিল না, তবে চারপাশের এলাকায় তাদের বিমান হামলার প্রমাণ দেখা যাচ্ছিল।
শহরের দিকে যাওয়া প্রধান সড়ক জুড়ে একটি ট্রাক পড়ে আছে, এবং ৫০ ক্যালিবার কামানের গুলিতে গাড়ির টায়ার ঝাঁঝরা হয়ে ছিটকে বেরিয়ে পড়েছে। কামনটি বহন করছিলো ঢাকায় অবস্থিত সেনাঘাঁটির সামরিক বিমান এফ৮৬ যা যুক্তরাষ্ট্রের তৈরি। গ্রামবাসীরা জানান, চালক পালিয়ে যায় কিন্তু রাস্তায় থাকা একজন বৃদ্ধ মহিলা হামলায় নিহত হয়।
পাশের আরেকটি গ্রামে, একটি মাটির দেয়ালের মসজিদে পেট্রোল বোমা দিয়ে হামলা করা হয়। দেয়ালগুলি দাড়িয়ে থাকলেও কালো হয়ে গেছিলো এবং কাঠের দরজা ও কুরান সহ ভিতরের সবকিছু আগুনে পুড়ে দগ্ধ হয়ে গেছিলো। মসজিদে এক ব্যক্তি নিহত এবং তিনজন আহত হয়েছিল।
বিমান হামলা
মুক্তি নেতারা বলেছিল, বিমানগুলি এক গ্রামের একটা বাজার এবং গঙ্গার তীর জুড়ে আক্রমন চালায় যেখানে বেসামরিক লোক ভারতে প্রবেশের জন্য জড়ো হয়। নদীরটার তীর কয়েক মাইল বিস্তৃত।
প্রতিরোধকারী সদস্যরা বলেছিল, দু চারটি সৈন্যদল নিয়ে বিমানগুলি প্রায়ই দিনে দুইবার আসে। তারা বলেছিল, বিমানগুলির সামনে প্রায়ই একটা হেলিকপ্টার থাকে যেটা লক্ষ্য খুজে বের করে।
সেনা বিমানগুলো শহরের ভিতরে আঘাত করেনি, কিন্তু আঘাত হানে শহরের বাইরের লক্ষ্যবস্তুতে যার বেশিরভাগ গ্রামে অবস্থিত যেগুলোর কোন সামরিক তাত্পর্য আছে বলে মনে হয়নি।
শনিবারে কোনও বিমানের চিহ্ন না থাকলেও, রাইফেল বহনকারী প্রতিরোধী সদস্য, যে আমাকে কালো পতাকাবাহী একটি সবুজ সেডানে করে শহরে নিয়ে আসে, কোন ঝুঁকি নেয়নি।
এক সপ্তাহ ধরে জন্মানো দাড়িতে তার চোয়াল আবৃত ছিল এবং তার চোখ ছিল রক্তাক্ত। আমি যখন তাকে জিজ্ঞেস করি যে কখন বিমান হামলা ঘটেছিল সে বললো, “আজ কি বার সেটাও আমি মনে করতে পারছিনা”। “দিন ও রাত উভয় সময় সে এতটাই কাজ করেছে” – ইউপিআই