অমৃতবাজার পত্রিকা, ১০ এপ্রিল ১৯৭১, বুদ্ধিজীবী নিধন – নারায়ণ চৌধুরী
ইয়াহিয়া খানেরবাহিনী বাংলাদেশের ঢাকায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে গুড়িয়ে দিয়েছে। বলা হয় যে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়েও পশ্চিম পাকিস্তানি সেনারা একই কাজ করেছে।
ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ধ্বংসের তীব্র কাহিনী শুধু মাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্যাম্পাসের ভেতরে অবস্থিত দালান ধ্বংস করেই নয় বরং ক্লাস কক্ষ, ল্যাবরেটরিজ, লাইব্রেরি, ছাত্রছাত্রী হল, স্টাফ কোয়ার্টার প্রভৃতি যা কিছু ক্যাম্পাসের ভেতরে আছে সব তারা ধ্বংস করে। পাশাপাশি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রায় পঞ্চাশ জন অধ্যাপককে জবাই করা হয় যারা এখানে পড়াতেন। এই অধ্যাপকদের মধ্যে পূর্ববাংলার কিছু শীর্ষ বুদ্ধিজীবী আছে, যারা শত্রুদের মর্টারের বর্বর আগুনে পড়ে গেছে বলে বিশ্বাস করা হয়।
যাঁরা ডাকা বিশ্ববিদ্যালয়কে তার আকাঙ্খিত কাঠামো এবং বিস্তৃত সবুজ লন দেখেছেন, যা বিশাল রমনা এলাকা ও তার নিকটবর্তী এলাকাগুলির মধ্যে ছড়িয়ে পড়েছে, তারা পশ্চিম পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের ধ্বংসাবশেষের দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। এই ক্ষতি অপূরণীয়। বিশ্ববিদ্যালয়ের বেশিরভাগ বিশিষ্ট শিক্ষাকর্মীর গণহত্যা এবং প্রকৃত ধ্বংসাবশেষসহ গণহত্যা সম্পর্কে আমরা যখন শুনেছি তখন আমরা মর্মাহত হয়েছি। পাকিস্তানি আর্মি দ্বারা অযৌক্তিকভাবে এই বর্বরতার জন্য আমরা শোকাহত হয়েছি।
সমান্তরাল
অদ্ভুত ট্র্যাজেডি অবশ্যই এমন কিছু যার কোন তুলনা হয়না। হত্যাকাণ্ড এবং যেসব পরিস্থিতি সংঘটিত হচ্ছে সেগুলির প্যাটার্ন হিটলারের সৈন্যদের প্রায় চল্লিশ বছর আগের হত্যাকাণ্ডের সংস্কৃতিকে মনে করিয়ে দেয়। এটা তাদের ফ্যাসিস্ট পদ্ধতি।
ইসলামাবাদ
কিন্তু চক্রের গণনা সম্পূর্ণভাবে ভুল। সকল উপায়ে জনগণকে শোষণ করার পর – তারা নিশ্চিতভাবেই ইতিহাসের শিক্ষায় পরিণত হয়েছে। ফ্যাসিস্টরা সব সময় প্রতিপক্ষকে শেষ করে দিয়ে তার লক্ষ্য অর্জন করেছে। তাদের সেট করা অত্যাচার ও নির্যাতনের ইঞ্জিনগুলি তাদের অহংকারিক অভিলাষের জোরে চলে। পশ্চিম পাকিস্তানি ফ্যাসিস্টদের দ্বারা একই ব্যাপার ঘটছে পুর্ব বাংলায়। ইতিহাসের নির্দয় বাহিনী অবশ্যই নিজের সেট করা আইন অনুযায়ী কাজ করবে। ইয়াহিয়া’র সৈন্যরা বাংলাদেশের সমভূমিতে তাদের সমাধি রচনা করবে তাদের নিজেদের কুচক্রের জন্যেই।
পশ্চিম পাকিস্তানে সংখ্যালঘু শাসকরা এখনো বাঙালির বিশ্বাস ও জীবনধারার ও বাংলাদেশের জনগণের দৃষ্টান্তমূলক সংহতির অনুভূতি এবং গভীরতা পরিমাপ করতে সক্ষম হয় নি। বুদ্ধিবৃত্তিক, বা অ-বুদ্ধিজীবী, বাংলাদেশের সমগ্র জনগোষ্ঠী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অধীনে একতাবদ্ধ এবং এটি তাদের সব পরিস্থিতিতেই থাকাকালীন স্থির সিদ্ধান্ত। চূড়ান্ত বিজয় অর্জন করা পর্যন্ত তারা তাদের দৃঢ়সংকল্পে অবিচল। রাওয়ালপিন্ডির সামরিক জান্তার নেতৃত্বে একটি স্বৈরশাসকের নিয়জিত কিছু সৈন্যবাহিনীর বিভিন্ন বিভাগের সহযোগিতায় তারা তাদের নখ দেখাচ্ছে। তারা হয়ত অত্যাধুনিক মারণাস্ত্র বহন করছে একেবারে নিরস্ত্র প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তবুও এইসব জনগণের মনোবল শেষ করা খুবই কঠিন। তারা একটি নতুন মুক্ত জাতি গঠনে একতাবদ্ধ এবং যে কোন মূল্যে এক থাকবে। এখানে সেখানে কিছু বুদ্ধিজীবীকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে এবং কিছু কিছু আছে, যদিও এসব করে বাংলাদেশের পুনরুত্থানকে দমানো সম্ভব হবে না। এখন পর্যন্ত আমরা যথেষ্ট দৃঢ় বিশ্বাস দেখেছি এবং মুজিবের মুক্তিবাহিনীর মধ্যে সেই সাহস বলবত আছে যা আমাদের অভীষ্ট লক্ষ্যে পৌঁছে নিয়ে যাবে।