অমৃত বাজার পত্রিকা, কলকাতা, মার্চ ২৮, ১৯৭১, জেনারেল টিক্কা খান গুলিতে নিহত, ঢাকা খুলনায় বোমা হামলা, এক লাখ লোক নিহত হওয়ার আশংকা, মুক্তি যোদ্ধাদের তীব্র আক্রমণ
আগরতলা। মার্চ ২৭ – হত্যা ও ধ্বংসযজ্ঞের ঘটনার দুই দিন পর, পূর্ব পাকিস্তানের গৃহযুদ্ধের পরিস্থিতি শুধুমাত্র ঢাকা, কুমিল্লা ও যশোরের তিনটি প্রধান ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সর্বত্রই শেখের বাংলাদেশ বাহিনীর নেতৃত্বে দানা বাঁধছে, যেখানে প্রায় ১০০,০০০ মানুষ নিহত হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
বাংলাদেশ মুক্তি সেনার প্রধান মেজর জিয়া খান আজ স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে ঘোষণা করেন যে, দুই বা তিন দিনের মধ্যেই বাংলাদেশ পাকিস্তানী সামরিক প্রশাসনের হাত থেকে মুক্তি পাবে।
জনাব রহমানকে গ্রেফতার করার বিষয়ে রেডিও পাকিস্তানের ঘোষণা (যা পরে স্বাধীন বাংলা বেতার প্রত্যাখ্যান করেছে) ঢাকাবাসীকে ক্ষিপ্ত করে তোলে, যারা লে. জে. টিক্কা খানের দাপ্তরিক বাসভবন ভাংচুর করে। সামরিক শাসন প্রশাসক এবং তাকে গুলি করে মারা হয়।
নির্ভরযোগ্য সূত্র থেকে প্রাপ্ত তথ্য থেকে বলা হয়েছে যে, প্রায় দশ লক্ষ অধিবাসীর ঢাকা সহ কুমিল্লা ও খুলনা শহর আগুন আর ধোঁয়ায় আচ্ছন্ন যেখানে আধিপত্য ধরে রাখতে হানাদার পশ্চিম পাকিস্তান বেপরোয়াভাবে ট্যাংক, বিমান আর হেলিকপ্টার নিযুক্ত করেছে।
সূত্র মতে, পূর্ব পাকিস্তানের সামরিক শাসন প্রশাসক লে. জে. টিক্কা খানের ঢাকার বাসভবনে মুক্তি যোদ্ধারা আক্রমণ চালালে গুরুতর আহত তিনি হয়ে একটি নার্সিং হোমে S.১৫ p.-এ মারা যান।
শেখের বাহিনী অধিকাংশ সড়ক ও রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণরূপে বিচ্ছিন্ন করে দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী থমকে গেছে।
আতংকের শহর ঢাকার নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার জন্য ভয়ানক যুদ্ধ চলছে বলে জানা গেছে, যেখানে চলমান যুদ্ধে দুই হাজারের বেশি মানুষ মারা গেছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিধ্বস্ত বাড়িঘরের ধ্বংসস্তুপের নিচে শত শত আহত মানুষ পরে আছে ।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত এবং পুরো সীমান্তের অন্যান্য উৎস কর্তৃক সরবরাহকৃত অতিরিক্ত প্রমাণ থেকে বিপদজনক এলাকার অভ্যন্তরের বিষয়ে জানা যায় যে, ঢাকা ও খুলনায় বোমা হামলা করা হয়েছে। ঢাকায় বোমা হামলার কারণে একটি বড় হাসপাতাল ধ্বংস হয়ে গেছে এবং অধিকাংশ রোগী মারা গেছে।
হতাহতের হিসেব অনুমান করার কোনো উপায় ছিল না, তবে হাজারখানেকের মতো হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে এবং এই সংখ্যা খুব দ্রুত বাড়ছে।
ট্যাংক ও বিমানের ব্যবহারের ফলে আরোপিত যুদ্ধের শুরু বলে ইঙ্গিত করছে; তবে প্রায় সকল শহরের রাস্তাঘাটে কাঠ ও ইটের সাহায্যে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, নদী ও খালবিলের উপর থাকা ব্রিজ উড়িয়ে দিয়ে এবং রেললাইন উপড়ে দিয়ে ও রেল স্টেশন ধ্বংস করার মাধ্যমে মুক্তি যোদ্ধারা সেনাবাহিনীর চলাচলে সফলভাবে অচলাবস্থা সৃষ্টি করেছে।
সেনাবাহিনী পুরো পূর্ব পাকিস্তানে কার্যকরভাবে নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করেছে এবং খুব দ্রুতই পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলে পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তবে তাঁরা নতুন সামরিক আইনের আদেশ জারি করে সকল বিল্ডিং-এর ধ্বংসযজ্ঞের ১(X) গজের মধ্যে সকল প্রতিবন্ধকতা সরিয়ে নিতে বলার মাধ্যমে তাঁরা অজ্ঞাতসারে বাধার সম্মুখীন হওয়ার বিষয়টি স্বীকার করে নিয়েছে।
সেনা কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে যে, সদ্য জন্ম নেওয়া প্রজাতন্ত্রের পিতা শেখ মুজিবুর রহমানকে, যাকে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান গতকাল বিশ্বাসঘাতকতার অভিযোগে অভিযুক্ত করেছেন, গ্রেফতার করা হয়েছে, তবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রগুলোর মধ্যে কমপক্ষে তিনটি ঐ দিন ঘোষণা করেছে যে, তিনি নিরাপদ ও মুক্ত আছেন, তাঁদের মধ্যে একজন সরাসরি সম্প্রচার করে লোকজনকে নিশ্চিত করেছেন যে, তিনি ঘটনা প্রবাহের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ করছেন এবং তাঁদেরকে যুদ্ধ চালিয়ে যেতে বলেছেন।
আজ রাতে কৃষ্ণনগরে আসা একটি প্রতিবেদনে জানানো হয় যে, গঙ্গা নদীর তীরে অবস্থিত একটি উপ-বিভাগীয় শহর নবাবগঞ্জে প্রায় ১,০০০ বাংলাদেশী মুক্তি যোদ্ধা অস্ত্র ও গোলাবারুদ বহনকারী একটি স্টিমার আটক করেছে।
প্রতিবেদনে আরও বলা হয়, আটক করার সময় স্টিমারটি অস্ত্র দিয়ে নিয়ন্ত্রিত রাজশাহী শহরের উদ্দেশ্যে যাত্রা শুরু করছিল।
স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত এক ঘোষণায় জনাব মুজিবুর রহমান প্রতিশ্রুতি ব্যক্ত করেন যে, যদি পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে তাহলে তাঁদেরকে নিরাপদে দেশে ফেরত যেতে দেওয়া হবে। তিনি সতর্ক করে দিয়ে বলেন, যদি তাঁরা তা না করে, তাহলে মুক্তিযোদ্ধারা বাঙালীর রক্তের বদলা রক্তের মাধ্যমেই নেবে।
আরেকটি ঘোষণায় তিনি বলেন যে, বাংলাদেশের মধ্যে যদি কেউ ‘বিদেশী’ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনীকে সাহায্য করে, তাহলে তাঁদের বিচার জনতার আদালতে হবে।
স্বাধীন বাংলার এক ঘোষণায় বলা হয়, গতকাল বাঙালি রেজিমেন্ট ও মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে আটক এক পশ্চিম পাঞ্জাবি রেজিমেন্টের সদস্যরা আত্মসমর্পণ করতে শুরু করেছে। বাংলাদেশে মোতায়েন করা এক বেলুচি রেজিমেন্ট তাঁদের পশ্চিম পাঞ্জাবি কমান্ডারদের আদেশের বিরোধিতা করেছে বলে জানা গেছে।
বাংলাদেশের ভেতর থেকে বিভিন্ন প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, মুক্তিবাহিনী বিভিন্ন ইউনিট মুক্তিযোদ্ধাদের কাছ থেকে চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, দিনাজপুর ও সিলেট শহরের নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পাকিস্তানী বাহিনীর প্রচেষ্টাকে রুখে দিয়েছে।
সেনাবাহিনী কর্তৃক চট্টগ্রামের কাছে অবস্থিত পতেঙ্গা বিমানবন্দর দখলে নেওয়ার প্রচেষ্টাকেও নস্যাৎ করে দেওয়া হয়েছে। সেখানকার মুক্তিবাহিনীর ইউনিটের নেতৃত্ব ছিলেন ব্রিগেডিয়ার করিম।
মোংলা বন্দর দখল করাকে মুক্তিযোদ্ধারা একটি বড় সফলতা হিসেবে ঘোষণা করেছেন। এই ঘটনায় খুলনায় পুরো ব্যাটালিয়ন সহ পূর্ব পাকিস্তান রাইফেলসের প্রধান হানাদার বাহিনীকে রুখে দিয়েছেন।
তাঁরা আরও বলেন, চট্টগ্রাম ও খুলনায় নেভাল ইউনিটগুলোও মুক্তিবাহিনীর সাথে যোগ দিয়েছে।
খুবই নির্ভরযোগ্য সূত্রের বরাতে জানানো হয়েছে যে, সামরিক বাহিনীর সাথে দিনব্যাপী যুদ্ধের পর মুক্তিযোদ্ধারা আজ কুমিল্লা পুলিশ অস্ত্রাগার দখল করে নেয়।
যোদ্ধারা অস্ত্র সরিয়ে নেয় ও নিজেদের মধ্যে বণ্টন করে নেয়।
আখাউড়ার কাছে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজটি মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দেওয়ার ফলে সিলেট জেলায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর প্রধান সরবরাহ লাইনটি বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
বৃহস্পতিবার রাতে সেনাবাহিনী তাঁদের নৃশংস হামলা চালানো শুরু করার সময় দখলকৃত ঢাকা বেতারের নিয়ন্ত্রণ নিতে ধারাবাহিকভাবে দ্বিতীয় দিনের মতো ঢাকায় ভয়ানক যুদ্ধ হয়েছে। উভয় পক্ষে হতাহতের সংখ্যা ২,৫০০।
ভয়েস অফ অ্যামেরিকা জানিয়েছে, বাংলাদেশের সর্ববৃহৎ শহর ঢাকার নিরস্ত্র জনগণের উপর ট্যাংক নিয়ে হামলা করা হয়েছে। আরও জানিয়েছে যে, যুদ্ধে আওয়ামী লিগের প্রধান কার্যালয়গুলো ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে।
মুক্তিযোদ্ধাদের বড় ধরনের ক্ষয়ক্ষতির একটি প্রমাণ হলো, আহত মুক্তিবাহিনীর সদস্যদের জীবন বাঁচাতে স্বাধীন বাংলা বেতারে রক্ত দানের আহ্বান জানানো। যুবক লোকদেরকে মুক্তিবাহিনীর দখলে থাকা ঢাকা মেডিক্যাল কলেজের ব্লাড ব্যাংকে যেতে অনুরোধ করা হয়েছে।
আজ বামপন্থী ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মাওলানা আব্দুল হামিদ ভাসানি চাষিদের নিয়ে প্রতিষ্ঠিত তার সংগঠনের সদস্যদেরকে (যার সংখ্যা আনুমানিক *৫০,০০০) বাংলাদেশে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দিতে নির্দেশ দিয়েছেন।
কলকাতায় পাওয়া বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনের জানা গেছে, খুলনা জেলায় ইপিআর কেন্দ্রে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর আক্রমণকে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সদস্যরা সফলতার সাথে নস্যাৎ করে দিয়েছে।
এই প্রতিবেদনগুলোতে বলা হয়েছে, ইপিআর সদস্যদেরকে (যারা এখন বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধা) নিরস্ত্র করার লক্ষ্যে এই দিন বিকেলে হানাদার বাহিনী ঘিরে ফেলে, তবে তাঁরা তাঁদের অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে এই আক্রমণটি রুখে দেন। ব্যাপক সংঘর্ষের ফলে দুই পক্ষেই ক্ষয়ক্ষতি হয়। পরে, ঐ এলাকা থেকে হানাদার বাহিনীকে প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়।
তবে, পদাতিক বাহিনীকে সমর্থন দেওয়ার উদ্দেশ্যে পাকিস্তানী বিমান বাহিনীর বিমানগুলোকে ঐ কেন্দ্রের উপরে দীর্ঘ সময় ধরে চক্কর দিতে দেখা গেছে।
খুলনা শহর থেকে কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত দৌলতপুরে পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী মেশিন গান দিয়ে একটি বড় সমাবেশে আক্রমণ করে নিরস্ত্র ৯০ জন সাধারণ মানুষকে ঘটনাস্থলেই হত্যা করে। সভা না কি প্রার্থনার উদ্দেশ্যে লোকজন সমবেত হয়েছিল, তা জানা যায়নি।
পূর্ব পাকিস্তানের অনেক অঞ্চলে পিছু হটা পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনী আজ ব্যাপক স্থল আক্রমণের শিকার হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রধান প্রধান শহরগুলোর রাস্তায় রাস্তায় ভয়াবহ যুদ্ধ হয় এবং ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে আশংকা করা হচ্ছে।
আতঙ্কগ্রস্ত মানুষ গ্রাম ছেড়ে পালাচ্ছে বলা জানা যায়।
যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে অতীতের যেকোনো সময় থেকে আজ শেখের গোপন বেতার কেন্দ্রের প্রমাণ জোরালো হয়েছে।
রাস্তাঘাটে পরে থাকা পোড়া গাড়ি, পরিত্যাক্ত বুলেট, লাঠি, পাথর ও ভাঙ্গা কাঁচের টুকরো শেখের বাহিনী ও পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর মধ্যে নৃশংস যুদ্ধের ভয়ানক গল্পের সাক্ষী বহন করছে।
সর্বশেষ প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয় যে, পূর্ব পাকিস্তানে শক্তি বৃদ্ধির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানীরা বিমানযোগে সীমিত আকারে সৈন্য সমাবেশ করছে।
পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব শহরের রাস্তায় ভয়ানক যুদ্ধ চলছে বলে প্রতিবেদনে বলা হয়। আওয়ামী লিগের “মুক্তিযোদ্ধারা” আখাউড়ার কাছে অবস্থিত ভৈরব ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে এবং অনেক জায়গায় সড়ক ও রেল যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে। অনেক মানুষ নিহত হওয়া সত্ত্বেও তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে।
তবে, এখানে নজরদারি করা রেডিও পাকিস্তান আজ সকালে দাবি করেছে যে, পূর্ব পাকিস্তানের পরিস্থিতি বেশ ভালোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা হয়েছে এবং ঢাকার কারফিউ “প্রত্যাহার করা হয়েছে”। রেডিওতে অব্যাহতভাবে গতকাল জারি করা সামরিক শাসনের ধারাগুলো প্রচার করা হচ্ছে এবং সেগুলো ভঙ্গ করার পরিণতি সম্পর্কে মানুষকে সাবধান করে দেওয়া হচ্ছে।
আজ স্বাধীন বাংলা বেতারে বলা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর গোলাগুলিতে ঢাকা ও বাংলাদেশের অন্যান্য স্থানে অনেক বিদেশী নাগরিক আহত হয়েছেন।
কুমিল্লায় পাকিস্তানী বাহিনী ও বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধাদের মধ্যে আজ দিনের শুরুতে সংঘর্ষে কমপক্ষে ১৮০ জন্য মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, সিমান্তের কাছাকাছি থেকে খুবই নির্ভরযোগ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
মুক্তি যোদ্ধারা জেলা শহরে অবস্থিত সামরিক অস্ত্রাগারে আক্রমণ চালালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। সামরিক বাহিনী মেশিন গানের মাধ্যমে মুক্তি যোদ্ধাদের উপর গুলি চালায়, যাদের মধ্যে রয়েছে ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলের সদস্য, পুলিশ, ছাত্র ও সাধারণ নাগরিক।
আমাদের শিলং সংবাদদাতা জানান, কুমিল্লা, সিলেট, ময়মনসিংহ ও ফেনী শহর আওয়ামী লিগের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
এই দিন সকালে বন্ধুকযুদ্ধের পরে গণবাহিনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার প্রায় প্রায় ১২,০০০ জন সেনাবাহিনীকে তাড়িয়ে দিয়েছে। আলাদা হয়ে যাওয়া সেনাবাহিনী গোমতী নদী পার হয়ে গেছে। বিকেল পর্যন্ত পুরো নদী জুড়েই গুলি বিনিময় চলছিল।
মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা জেলায় অনেক রেলওয়ে ব্রিজ উড়িয়ে দিয়েছে বা রেললাইন তুলে নিয়েছে এবং অনেক সড়কপথ কেটে দেওয়ায় যানবাহন চলাচল বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চলের বগুড়া থেকেও নিযুক্ত সেনাবাহিনীকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য করা হয়েছে এবং ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন জায়গায় নিযুক্ত সেনাবাহিনী গোলাবারুদ ও রসদের সরবরাহ সংকটে পড়েছে।
চট্টগ্রাম বন্দর থেকে বাংলাদেশের অন্যান্য শহরে হানাদার বাহিনীর চলাচল বিঘ্নিত করার জন্য চট্টগ্রাম ও ঢাকা মহাসড়কের অনেক সড়ক সেতু মুক্তিযোদ্ধারা ক্ষতিগ্রস্ত করে দিয়েছেন।
চট্টগ্রামে হতাহতের ঘটনা সবচেয়ে বেশি বলে জানানো হয়েছে। সারারাত ধরে চট্টগ্রাম বেতার কেন্দ্রের নিয়ন্ত্রণ রাখা আওয়ামী লিগ সমর্থকেরা আজ সকাল পর্যন্ত তা ধরে রেখেছে।
শুধুমাত্র যশোর বিমানবন্দর এলাকায় ১৫০০-এর বেশি শহুরে ও গ্রাম্য সাধারণ মানুষকে মেশিনগানের গুলিতে হত্যা করা হয়, যাদের অনেকেই “লুঙ্গি ও ধুতি” পরিহিত ছিল; তখন শেখের সমর্থকরা বল্লম, লাঠি, রাম দা ও ডেগার নিয়ে সজ্জিত হয়ে বিমানবন্দর দখল করার চেষ্টা করেছে।
হরতাল ডাকা হয়েছে
আগরতলা থেকে সম্প্রচারিত সংবাদে জানা গেছে, চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট, যশোর, বরিশাল ও খুলনায় বাংলাদেশী বাহিনী পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীকে ঘিরে ফেলেছে।
গত দুই দিন সেনাবাহিনীর আক্রমণে শতাধিক সাধারণ মানুষের মৃত্যুর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ হিসেবে পুরো পূর্বাঞ্চলে ‘হরতাল’-এর বিষয়ে আওয়ামী লিগের সিদ্ধান্তকে তাঁরা পুনর্ব্যক্ত করেছে।
তাঁরা ঘোষণা করেন যে, “বঙ্গবন্ধু” শেখ মুজিবুর রহমান হলেন বাংলাদেশের একমাত্র নেতা “দেশকে পশ্চিম পাকিস্তানীদের নির্মম একনায়কতন্ত্র থেকে রক্ষার জন্য যার আদেশ মানুষকে পরিপালন করা উচিত”।
আজ শেষ রাতের দিকে প্রাপ্ত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে যে, রংপুর শহরে কারফিউর মধ্যেই ব্যাপক যুদ্ধ চলছে, এটি হলো সেই তিনটি স্থানের মধ্যে একটি যেখানে দুই দিন আগে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনারা বহু নিরস্ত্র সাধারণ মানুষকে গুলি করে হত্যা করেছে।
ইতোমধ্যে, আজ সকাল ৭টা থেকে বিকেল ৪টা পর্যন্ত ঢাকায় কারফিউ প্রত্যাহার করা হয়েছে। প্রধান সামরিক শাসন প্রশাসক দু’টি নতুন বিধান ইস্যু করেছে, যার অধিকে সভা, সমাবেশ ও মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং প্রকাশনা ও সংবাদপত্রের উপর কঠোর সেন্সরশিপ আরোপ করা হয়েছে, রেডিও পাকিস্তানের প্রতিবেদন।
এই বিধিবিধানের যেকোনো লঙ্ঘন সাত বছরের সশ্রম কারাদণ্ডের বিধান সহ শাস্তিযোগ্য অপরাধ।
সীমান্তের বিভিন্ন স্থান থেকে জানা গেছে, বন্দর নগরী চট্টগ্রাম মুক্ত বাংলাদেশ কর্তৃপক্ষের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আসা জাহাজ থেকে সেনাবাহিনী ও যন্ত্রপাতি নামাতে আওয়ামী লিগের স্বেচ্ছাসেবী ও অন্যরা প্রতিরোধ করলে ২৫ মার্চ চট্টগ্রামে রক্তের বন্যা বয়ে গেছে।
হাজারো সাধারণ মানুষের সহায়তায় মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট ঘিরে রেখেছে।
জ্বালানি সংকট
বর্তমানে পূর্ব পাকিস্তানে থাকা পাকিস্তান বিমান বাহিনী ভয়ানক জ্বালানি সংকটে পড়েছে, আজ কলকাতায় গৃহীত বিশ্বাসযোগ্য প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।
এই প্রতিবেদনগুলো অনুযায়ী, বিমান বাহিনীর বিমানের জন্য এই অত্যাবশ্যকীয় জ্বালানি নিশ্চিত করতে পাকিস্তান সরকার অস্বাভাবিক দামে বার্মার সরকারের সাথে একটি চুক্তি করেছে এবং তাঁরা সরবরাহ করার বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা নদীবহুল বাংলার অনেক ব্রিজ ক্ষতিগ্রস্ত বা ধ্বংস করে দিয়েছেন এবং সেনাবাহিনীর চলাচল শুধুমাত্র শহরের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে।
আজ সকালে এই পরিস্থিতিকে ভয়ানক হিসেবে অভিহিত করা হয়েছে, কারণ সমগ্র জাতিই পশ্চিম পাকিস্তানী দখলদারদের বিরুদ্ধে প্রতিবাদমুখর।