দি নিউইয়র্ক টাইম্স, ১০ই মে, ১৯৭১
ঘৃণ্য হত্যাকাণ্ড
ম্যালকম ডাব্লিউ. ব্রাউন কর্তৃক
রাজশাহী, পাকিস্তান, ১০ই মে
পদস্থ সরকারী কর্মচারীদের সাহচর্যে যে ছয়জন সংবাদকর্মীকে পাকিস্তানের সরকার পূর্ব পাকিস্তানে প্রবেশের অনুমতি দিয়েছে তাদের একজন কর্তৃক
বাঙালী বিচ্ছিন্নতাবাদীদের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর পরিচালিত নিষ্পেষণ শক্তি আপাতদৃষ্টিতে পূর্ব পাকিস্তানের সকল গুরুতর সশস্ত্র বিদ্রোহ চূর্ণ করতে সক্ষম হয়েছে।
এই শহরটি, যার জনসংখ্যা ১,০০,০০০ ছিল, যেটি ঘোলা পানির, ধীরে বয়ে চলা গঙ্গা নদীর পূর্ব পাড়ে অবস্থিত, যার অপর পাড়ের ৩,০০০ গজের মধ্যে ভারত । এই শহরটির মতো সীমান্তবর্তী শহরগুলো আপাত-নিষিদ্ধ বিচ্ছিন্নতাবাদী আওয়ামী লীগের রাজনৈতিক শক্ত ঘাঁটি ছিল, যারা গত ৭ই ডিসেম্বরের জাতীয় সংসদীয় নির্বাচনে ব্যাপক ব্যবধানে জয়লাভ করে।
জাতীয় সেনাবাহিনী, যা মূলত পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবীদের নিয়ে গঠিত; ২৫শে মার্চ পুরো পূর্ব পাকিস্তান জুড়ে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের উপর আঘাত হানে, এবং মাঝ-এপ্রিলের মধ্যে, আপাতদৃষ্টিতে, সেনাবাহিনীর সামরিক অভিযান কার্যত সম্পন্ন হয়ে গেছে।
সীমান্তবর্তী এলাকার সর্বশেষ বিদ্রোহগুলো অত্যন্ত দ্রুততার সাথে দমন করা হয়, এবং যদিও সেনাবাহিনীর টহল দলগুলো এখনো মাঝেমাঝে আক্রান্ত হয়, তবুও এই দ্বিধাবিভক্ত দেশটির পূর্ব অংশটি এখন শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রিত বলে প্রতীয়মান হয়।
সংশ্লিষ্ট সকলের জন্যই এটি বেদনাদায়ক। সাংবাদিকেরা মাটির সাথে মিশে যাওয়া বা লুঠ হওয়া হাজার হাজার দালান দেখেছেন। শহরগুলোতে, শত শত বুলেটে ঝাঁঝরা হওয়া দেয়াল দেখলে বোঝা যায় ফায়ারিং স্কোয়াড কোথায় তাদের কাজ সেরেছে। লাশগুলো পাড়ার কুয়ায় ফেলা হয়েছে, এবং সার্বজনীন জনমানবশূন্যতা ঘটনাবলীর হিংস্রতার সাক্ষ্য দেয়।
ঠিক কিভাবে এসব ঘটেছে তা আপাতদৃষ্টিতে বোঝা যাচ্ছেনা, কেননা প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তাদের দৃষ্টিভঙ্গির উপর নির্ভর করে একবারেই পরস্পরবিরোধী।
সামরিক বাহিনী এবং সারা দেশ জুড়ে তাদের প্রতিষ্ঠিত বেসামরিক “শান্তি কমিটি”-এর সদস্যরা বলছে বেশিরভাগ ধ্বংসযজ্ঞ এবং গণহত্যা ঘটিয়েছে বিদ্রোহীরা, এবং সীমান্তে অনুপ্রবেশকারী ভারতীয় সৈন্যরা।
কিন্তু রাস্তাঘাটে বাঙালীরা প্রায়শই সাংবাদিকদের কাছে এসে ফিসফিসয়ে কিছু কথা বলেই দ্রুত চোখের আড়ালে চলে যায় সদা-উপস্থিত শান্তি কমিটির সদস্যরা দেখার আগেই।
শান্তি কমিটির বেশিরভাগ সদস্য, সেনাবাহিনী যাদেরকে বেসামরিক প্রশাসনের কিছু দায়িত্ব দিয়েছে, হচ্ছে বিহারি মুসলিম, যারা ১৯৪৭ সালে ভারত থেকে পাকিস্তানে চলে আসে যখন ব্রিটিশ ভারতকে ভেঙে এইদুটি রাষ্ট্র তৈরি করা হয়।
পূর্ব পাকিস্তানের বেশিরভাগ ব্যবসা এবং বাণিজ্য এই বিহারীদের হাতে, যারা স্থানীয় বাঙালীদের মাঝে সংখ্যালঘু। স্থানীয় বাঙালীরা বেশিরভাগই মুসলিম, তবে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক হিন্দু সংখ্যালঘু সম্প্রদায় রয়েছে।
অপেক্ষাকৃত সমৃদ্ধিশালী বিহারীদের প্রতি অনেকটা দারিদ্র্যপীড়িত বাঙালীদের, অসন্তোষ, সাম্প্রতিক যুদ্ধে বাঙালীদের বিচ্ছিন্নতাবাদী আন্দোলনের পিছনে একটি কারণ হিসেবে কাজ করেছিল। ধারণা করা হচ্ছে, শত শত সাক্ষাৎকার নেয়ার পর, কিছু কিছু এলাকায় বাঙালীরা বিহারীদের গণহারে হত্যা করেছে এবং তাদের বাড়িঘর লুঠ করেছে এবং পুড়িয়ে দিয়েছে। বাঙালীরা যারা জাতীয় সেনাবাহিনীতে ছিল তারা বিদ্রোহ করেছে বিচ্ছিন্নতাবাদীদের সাথে যোগ দেয়ার জন্য। মূলত পাঞ্জাবী অধ্যুষিত পশ্চিম পাকিস্তানের সেনাবাহিনী যখন জোরপূর্বক পূর্বের অঙ্গরাজ্যে প্রবেশ করে, বিহারীদের মধ্যে তাদের মিত্ররা তৈরি ছিলই, যাদের বেশিরভাগই প্রতিশোধ নেয়ার সুযোগ খুঁজছিল।
এর পরবর্তীতে চালানো গণহত্যার ভয়াবহতা বেশিরভাগ প্রত্যক্ষদর্শীকেই অসুস্থ করে তুলেছে। এই সংঘাতের ফলশ্রুতিতে, এই শহরের মতো শহরগুলো থেকে বেশিরভাগ বাঙালী এবং সংখ্যালঘু হিন্দু সম্প্রদায়ের প্রায় সবাই, পালিয়ে গেছে। এখানে যে দালানগুলো নিয়ে শহরের প্রধান বাজার এলাকা গঠিত সেগুলো ধ্বংস হয়ে গেছে, আপাতদৃষ্টিতে মনে হয় ১৪ই এপ্রিল যখন সেনাবাহিনী এই শহর দখল করে নেয় তখন মর্টারের গোলার আঘাতে এগুলো ধ্বংস হয়েছে।
সুন্দর কারুকার্য করা কাঠের ব্যালকনিসহ কিছু পাঁচ-তলা দালান এখনো দাঁড়িয়ে আছে এই এলাকায়,
তবে ওগুলোর মধ্যে কিছু দালানের উপরদিকের তলাগুলো গোলাবর্ষণে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
শহরের বেশিরভাগ এলাকায়, অবশ্য, গোলাবর্ষণ হয়নি, এবং সাইকেল রিক্সা এবং হকাররা আবারো রাস্তায় চলাচল শুরু করেছে। শহরে আবারো পানি, বিদ্যুৎ সরবরাহ এবং যোগাযোগ ব্যবস্থা চালু হয়েছে, এমনকি একটি অভিযোগ দপ্তরও আছে।