You dont have javascript enabled! Please enable it!

ভুয়া প্রচারের জোয়ার

ইয়াহিয়ার উপর নাকি চাপ দিচ্ছে বৃহৎ শক্তিগুলাে। প্রকাশ্যে আসছে না এই চাপ, আসছে নাকি গােপনে। ওরা নাকি পাক-প্রেসিডেন্টের কানে কানে বলছে, বাংলাদেশের সমস্যার একটি রাজনৈতিক ফয়সালা করে ফেল। ভারতে আগত শরণার্থীদের ফিরিয়ে নেবার ব্যবস্থা কর। নইলে পাবে না আর্থিক সাহায্য। কানে কানে বলা কথাগুলাের মর্মার্থ জানাবেন না জনসাধারণ। বাস্তব অবস্থা দেখে তারা বুঝবেন ফলাফল। ইয়াহিয়ার চাল চলনে এবং কথাবার্তায় ধরা পড়ছে না চাপের কোন অস্তিত্ব। ইয়াহিয়া আগের মতই উদ্বত। তার দুষ্ট বুদ্ধি এখনও যথেষ্ট পরিমাণে সক্রিয়। শরণার্থীদের মধ্যে নাকি আছেন সহায় সম্বলহীন ভারতীয়। ওদের তিনি যেতে দেবেন না বাংলাদেশে। ভারতের ঘাড়ে রাখবেন তিনি আর এক প্রস্থ শরণার্থীর বােঝা। বাংলাদেশকে ঘায়েল করতে হলে দরকার লােকসংখ্যা কমান। পাইকারী হারে হত্যা করেছেন তিনি বাঙ্গালীদের। লক্ষ লক্ষ মানুষকে ঠেলে দিয়েছেন ভারতে। আওয়ামী লীগের সঙ্গে কোন বােঝাপড়ায় রাজী নন ইয়াহিয়া। তিনি চান তাদের নিঃশর্ত আত্মসমর্পন। তাদের ভবিষ্যৎ নির্ভর করবে তার মর্জির উপর। সীমান্তের ওপারে লেলিয়ে দেওয়া হয়েছে মােল্লাতন্ত্রী দলগুলােকে। পাক সৈন্যদের সাহায্যে ওরা চালাচ্ছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। ফিরে যাওয়া তাে দূরের কথা, ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা প্রতিদিন বাড়ছে। এই যদি হয় চাপের ফলশ্রুতি তবে সে চাপের মূল্য কতখানি?
বাংলাদেশ নিয়ে চলছে বৃহৎ শক্তিগুলাের মধ্যে রাজনৈতিক দাবা খেলা। বৃটেনের রক্ষণশীল সরকার আগাগােড়া পাক-সমর্থক। ওরা ইসলামাবাদকে জইয়ে রাখবেন। তাতে বাংলাদেশ জাহান্নামে গেলেও ক্ষতি নেই। গণতন্ত্র এবং মানুষ বড় কথা নয় বড় কথা রাজনৈতিক স্বার্থ। আন্তর্জাতিক সামরিক স্ট্যাটেজীর দিক থেকে পাকিস্তান তাদের দরকার। আমেরিকা মােটেই দিল-খােলাসা নয়। শরণার্থীদের জন্য তার এক চোখে জল ঝরছে এবং অপর চোখে ইয়াহিয়ার মসনদ আগলাচ্ছে। বাংলাদেশের দুর্গতদের জন্য সাহায্য পাঠাতে মার্কিন কর্তৃপক্ষ উদ্‌গ্রীব। তাদের আবেদন প্রথমে নাকচ করেছিলেন ইয়াহিয়া। এখন তিনি সদয়। দয়া করে নেবেন তিনি সাহায্য। রাষ্ট্রসংঘের শর্ত ছিল, বাংলাদেশে সাহায্য বণ্টন করবেন বিশ্বসভার কর্মীরা। অবস্থা এখন পাল্টে গেছে। সাহায্য বণ্টনে ইসলামাবাদের সঙ্গে যৌথ দায়িত্ব বহনে আমেরিকা প্রস্তুত। রাষ্ট্রসংঘও শেষ পর্যন্ত রাজী হয়ে যাবেন। নৌকা, ষ্টীমার, লরী—সব রকমের যানবাহন পাড়ি জমাবে বাংলাদেশে। এগুলাে পড়বে ইয়াহিয়ার চমু এবং মােল্লাতন্ত্রীদের হাতে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য ব্যবহৃত হবে রাষ্ট্রসংঘের দান। দল ভারী করবেন ইয়াহিয়া খান। একথা কারও অজানা নেই যে, সাইক্লোন বিধ্বস্ত বাংলাদেশে একসময় পাঠান হয়েছিল অনেকগুলাে হেলিকপ্টার। ইয়াহিয়া খান সেগুলাে লাগিয়েছেন। সৈন্য চলাচলে এবং গণহত্যার কাজে। বিদেশী সাহায্যের এই অপবাদের প্রতিবাদ ওঠে নি কোন মহলে থেকে। আবার এই পাক-দানবের হাতেই যাচ্ছে রাষ্ট্রসংঘের সাহায্য। তার উদ্যোক্তা বৃটেন, আমেরিকা প্রভৃতি বৃহৎ রাষ্ট্র। ক’দিনের জন্য চমক লাগিয়েছিলেন সােভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগােৰ্নী। ইয়াহিয়ার কাছে তাঁর কড়া চিঠিতে জেগে উঠেছিল বাংলাদেশের অত্যাচারিত মানুষগুলাের আশা-আকাঙ্ক্ষা। পরের চিঠি দিলেন সােভিয়েট প্রধানমন্ত্রী কোসিগিন। তার সুর নরম। নরম থেকে গরমে ওঠাই স্বাভাবিক নিয়ম। সােভিয়েট রাশিয়া নিয়েছে ওল্টো পথ। গরম থেকে নরমে নেমেছে তার সুর। এই যদি হয় চাপের নমুনা। তবে সে চাপে বিশ্বাস নেই কারও। ওটা লােক ঠকানাে ভাওতা।
কিসের আশায় নয়াদিল্লী দিন গুনছেন বুঝতে পারছেন না সাধারণ মানুষ। ভারতের সীমান্তের উপর চলছে। দিনের পর দিন পাক হামলা। বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে পাকিস্তান খরচ করছে দৈনিক প্রায় দেড় কোটি টাকা। আর শরণার্থীদের ভরণপােষণে ভারতের দৈনিক খরচের পরিমাণও তার চেয়ে কম নয়। ইয়াহিয়া দোষী এবং নরঘাতক। গণহত্যা এবং বাঙ্গালী বিতাড়নের জন্য একটা খরচ তাঁকে করতেই হবে। বিনা টাকায় এত বড় কাজ করা যায় না। প্রকৃতপক্ষে ইয়াহিয়ার কৃতকর্মের ফলভােগ করছেন নয়াদিল্লী। অধীর হয়ে উঠেছেন প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী। লােকসভায় তিনি বলেছেন, গােটা দুনিয়া সমস্যার গুরুত্ব উপলব্ধি করতে অক্ষম হলে, নিজস্ব পথে পা বাড়াবে ভারত। আঁৎকে উঠেছে আমেরিকা। এই হুমকীর মধ্যে সে দেখছে যুদ্ধের ইঙ্গিত। সমভাবে ভারত এবং পাকিস্তান কি একই পর্যায়ে পড়ে? মানবসেবী এবং গণহত্যার মধ্যে কি কোন পার্থক্য নেই। ইয়াহিয়ার উপর যদি চাপ সৃষ্টির ইচ্ছা থাকে বৃহৎ শক্তিগুলাের তবে কানে কানে কথা বলার কি দরকার? দোষীকে প্রকাশ্যে ধিক্কার দিতে তাদের এত আপত্তি কেন? পাকসৈন্যরা খেদাবে লক্ষ লক্ষ মানুষ। আশ্রয় দেবে তাদের ভারত। সীমান্তের এপারে চলবে পাক-হানাদারী। মরবে ভারতীয় নাগরিক। প্রতিবাদের জোরাল ভাষা উচ্চারিত হলেই আসবে নির্লজ্জ উপদেশ। এ ধরণের নােংরামী অসহনীয়। বিবেক বলে যদি কোন পদার্থ বৃহৎ রাষ্ট্রগুলাের থেকে থাকে তবে তারা তার টুটি চেপে ধরুক। তাঁকে স্পষ্ট ভাষায় জানিয়ে দিক বাংলাদেশের সত্যিকারের প্রতিনিধি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার। তাদের শাসন পুরাপুরিভাবে কায়েম না হওয় পর্যন্ত স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আসতে পারে না পূর্ব বাংলায়। আর তার প্রতিষ্ঠা ছাড়া স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের ভরসা পাবেন না শরণার্থীরা। এটা বাস্তব সত্য। এলােপাথারী প্রচারে লুকানাে যাবে না রক্তাক্ত ভবিষ্যৎ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৯ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!