“আজই প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙলি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে” – গণপরিষদে বঙ্গবন্ধুর ভাষণ
৪ নভেম্বর ১৯৭২
ঢাকা
(প্রথমে অডিও, এরপর পূর্ণ ভাষণের টেক্সট এবং সব শেষে ১৯৭২ সালের ৪ ও ৫ নভেম্বর তারিখের ইত্তেফাক পত্রিকার সকল পাতা ফুল পেইজ সংযুক্ত করে দেয়া হল।)
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (প্রধানমন্ত্রী; গণপরিষদ নেতা)ঃ জনাব স্পীকার সাহেব, আজই প্রথম সাড়ে সাত কোটি বাঙলি তাদের শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে। বাংলার ইতিহাসে বোধহয় এই প্রথম যে, বাংলাদেশের জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের ভোটের মারফতে এসে তাঁদের দেশের জন্য শাসনতন্ত্র দিচ্ছেন।
আজ আমাকে স্মরণ করতে হয়, আমাকে অনেকদিনের ইতিহাস আলোচনা করতে হয়। কিন্তু আমি তা করতে চাই না। তদানীন্তন ভারতবর্ষ-বাংলাদেশ যাকে আমরা Sub-continent বলতাম, সেখানে সে যুগে যে স্বাধীনতা-সংগ্রাম হয়েছে, তার হিসাব করলে দেখা যাবে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা-সংগ্রামীরাই রক্তদান বেশি করেছে। তার স্বাক্ষর আছে চট্টগ্রামের জালালাবাদে, স্বাক্ষর আছে বাংলাদেশের ঘরে ঘরে মা-বোনদের কাছে।
বাংলার এমন কোন জেলা, মহকুমা ছিল না, যেখানে ইংরেজ-আমল থেকে বিদ্রোহের দাবানল জ্বলে নাই। সেই আলোচনা করতে গেলে দেখা যাবে, সিপাহী বিদ্রোহ এই বাংলার মাটি থেকেই শুরু হয়েছিল।
তারপর, বাংলাদেশের অফিসাররা বহু যুদ্ধ করে, ফাঁসিকাষ্ঠে ঝুলে বারবার সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছে। তারা জেল ভোগ করেছে অনেক। তাতে আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু দুঃখ, বাঙালি জীবনে সুখ কোনদিন আসেনি। বাংলার সম্বন্ধে ঠাট্টা করে আমাকে একজন বলেছিল, তোমার বাংলার উর্বর জমিই তোমার দুঃখের কারণ। তাই বারবার দেখা গেছে, শকুনিরা এর উপর ঝাঁপিয়ে পড়েছে। কারণ, তারা এ দেশের অর্থ-সম্পদের উপর লোলুপ দৃষ্টি দিয়েছিল।
জনাব স্পীকার সাহেব, সমস্ত দুনিয়া এবং তদানীন্তন ভারতবর্ষে যারা শোষক ছিল, তারা বাংলার অর্থ, বাংলার সম্পদ লুট করে নিয়ে গেছে বাংলার মাটি থেকে। গৃহহারা, সর্বহারা কৃষক, মজুরী দুঃখী বাঙালি, যারা সারা জীবন পরিশ্রম করেছে, খাবার পায় নাই। তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে কলকাতার বন্দর, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে বোম্বের বন্দর, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে মাদ্রাজ, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে করাচী, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে ইসলামাবাদ, তাদের সম্পদ দিয়ে গড়ে উঠেছে লাহোর, তাদের সম্পদ দিয়ে পড়ে উঠেছে ডান্ডি গ্রেট-বৃটেন। এই বাংলার সম্পদ বাঙালির দুঃখের কারণ ছিল।
সংগ্রামী বাঙালিরা বার বার এর বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছে, এর বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছে। যুদ্ধ ঘোষণা করেছে তিতুমীর, যুদ্ধ করেছে হাজী শরীয়তউল্লাহ্। তাদের কথা আজ শ্রদ্ধাভরে স্মরণ করতে হয়। কারণ, বাঙালি আজ শাসনতন্ত্র পেতে যাচ্ছে।
স্মরণ করতে হয় শেরে বাংলা ফজলুল হকের কথা। স্মরণ করতে হয় সোহরাওয়ার্দী মরহুমের কথা। আজও স্মরণ করতে হয় মানিক মিয়ার কথা, যিনি তাঁর কলম দিয়ে বাংলার স্বাধীনতা-সংগ্রামে সাহায্য করেছেন। স্মরণ করতে হয় সেই সব সহকর্মীদের আত্মত্যাগের কথা, যাঁরা জীবন দিয়েছেন এই স্বাধীনতা সংগ্রামে।
স্বাধীনতা-সংগ্রাম কেবল নয় মাসই হয় নাই – স্বাধীনতা-সংগ্রাম শুরু হয়েছে ১৯৪৭ সালের পর থেকে। তারপর, ধাপে ধাপে সে সংগ্রাম এগিয়ে গেছে। সে সংগ্রামের একটা ইতিহাস আছে। তাকে আস্তে আস্তে এগিয়ে নিতে হয়। একদিনে সে সংগ্রাম চরম পর্যায়ে পৌছে নাই।
নয় মাস আমরা যে চরম সংগ্রাম করেছি, সে সংগ্রাম শুরু করেছি বহুদিন থেকে। ১৯৪৭ সালে ভাগ করে সংখ্যায় ‘মেজরিটি’ থাকা সত্ত্বেও বাঙালিরা সব কিছু হারিয়ে ফেলল। জনাব জিন্নাহ্ সাহেব, যাঁকে অনেকে তখন নেতা বলে মানতাম, বাঙালিকে এক শকুনির হাতে থেকে আর এক শকুনির হাতে ফেলে দিয়ে করাচীতে রাজধানী কায়েম করলেন। এমন কি, জিন্নাহ্ সাহেব মরার সময় যে Deed দিয়েছিলেন, সেই Deed-এর ভাগ পেয়েছিল পেশোয়ার বিশ্ববিদ্যালয়, পেয়েছিল বোম্বের হাসপাতাল এবং করাচীর স্কুলকেও দান করেছিলেন; কিন্তু বাংলার কোন মানুষের জন্য এক পয়সাও দান করে যান নাই।
বাংলার মানুষ আমরা বুঝতে পারি না, হুজুকে মেতে পরের ছেলেকে বড় করে দেখি – এই ছিল আমাদের দুর্ভাগ্য। দুনিয়ার কোন দেশে ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোন অর্থ পাই না বাংলাদেশ ছাড়া। বাঙালি জাতি আমরা পরশ্রীকাতর এত বেশি। ইংরেজি ভাষায়, রুশ ভাষায়, ফরাসী ভাসায়, চীনা ভাষায় ‘পরশ্রীকাতরতা’ বলে কোন শব্দ নাই – একমাত্র বাংলা ভাষা ছাড়া। এই কারণে বাঙালিদের যেমন ত্যাগ, সাধনা করার শক্তি ছিল, বাঙালিদের মধ্যে তেমনি পরশ্রীকাতরতার মনোভাব দেখা দেয়। যে সকল বাংলাদেশের নেতা সংগ্রাম করেছেন, আমরা তাঁদেরকে বুঝতে পারি নাই। আমরা বুঝেছি, আমাদের নেতা বুঝি চলে এসেছেন সেই বোম্বে থেকে মিস্টার জিন্নাহ্।
যা হোক, সে ইতিহাস এবং ১৯৪৭ সালের পরবর্তী করুণ ইতিহাস অনেকেই জানেন। জনাব স্পীকার সাহেব, ১৯৫২ সালে আপনি যখন আমার কাছে অফিসে এসে বসেন, তখন একখানা ভাঙ্গা চেয়ার, একটা ভাঙ্গা টাইপরাইটার মেশিন আর একজন কর্মী নিয়ে আমরা বসেছিলাম। সে কথা বোধহয় আপনার মনে আছে, স্পীকার সাহেব। তখন আমি আড়াই বৎসর পর জেল থেকে বেরিয়ে এসেছিলাম।
১৯৪৭ সাল থেকে বিরাট ষড়যন্ত্র চলেছিল বাংলাদেশের মানুষকে একটা কলোনী করে রাখার জন্য। বহু আগেই পশ্চিমের শক্তিকে এ দেশ ত্যাগ করে চলে যেতে হত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, বাংলাদেশে একদন লোক চিল, যারা স্বার্থের লোভে, পদের লোভে, অর্থের লোভে তাদের সঙ্গে বারবার হাত মিলিয়েছে, আর বারবার চরম আঘাত করেছে আমাদের উপর। আঘাত করেছে ১৯৪৮ সালে, আঘাত করেছে ১৯৫২ সালে, আঘাত করেছে ১৯৫৪ সালে। এমন কি, যখন ১৯৫৬ সালে শাসনতন্ত্র হয়, তখন বাঙালিরা পরিষদ থেকে ‘ওয়াক-আউট’ করে। তখনও বাঙালির মধ্যে কিছু লোক বেঈমানী করে পশ্চিমাদের সঙ্গে হাত মিলায় মন্ত্রীত্বের লোভে। ১৯৫৮ সালে মার্শাল ল’ বাংলার উপর আসে বাঙালিকে শোষণ করার জন্য। তারা যখন দেখেছে, বাংলার মানুষ জাগ্রতে হয়ে উঠেছে, বাংলার মানুষ প্রতিবাদ করতে শিখেছে, তখন তারা বাংলার মানুষের উপর শক্তি প্রয়োগ করেছে। তাদের শক্তি ছিল একটা। সেই শক্তি ছিল তাদের সামরিক বাহিনী।
ইংরেজ তাদের সাম্রাজ্যবাদকে রক্ষা করার জন্য সামরিক বাহিনী গঠন করতে পাঞ্জাবের কয়েকটি এলাকাকে বেছে নিয়েছিল, যেখান থেকে সামরিক বাহিনীতে লোক ‘রিক্রুট’ করা হত। বাঙালিকে বিশ্বাস করা হত না। বাঙালিকে সামরিক বাহিনীতে নেয়া হত না। কারণ, বাঙালিরা বিদ্রোহ করে – এই হচ্ছে তাদের দোষ। ১৯৪৭ সালের তথাকথিত স্বাধীনতা লাভের পর তদানীন্তন পাকিস্তানে বাঙালিরা সংখ্যায় বেশি ছিল, বুদ্ধিতে বাঙালিরা ভাল ছিল, লেখাপড়া বাঙালিরা ভাল জানত, আক্কেল তাদের বেশি ছিল। কিন্তু একটা জিনিসের অভাব বাঙালিদের ছিল, যার জন্য বারবার বাঙালি মার খেয়ে গেল। যদিও আমাদের অনেক সহকর্মী চেষ্টা করেছিলেন। সেটা ছিল সামরিক বাহিনীর শক্তি। সংখ্যায় বেশি হওয়া সত্ত্বেও বাঙালি তার অধিকার আদায় করতে পারে নাই। যখনই অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে গিয়েছে, তখনই এসেছে চরম আঘাত। ১৯৫৪ সালে ৯২-ক ধারার বলে শেরে বাংলা ফজলুল হক ঘরের মধ্যে অন্তরীণ। আমি সহ ৫০ জন সহকর্মী, যাঁরা তদানীন্তন এম.এল.এ ছিলেন, এবং প্রায় ৫ হাজার কর্মী গ্রেফতার হয়ে জেলে চলে যায়।
সে যুগের ইতিহাস কঠোর সংগ্রামের ইতিহাস। সে কথা কল্পনা করতেও শিউরে উঠি। তখন মানুষ একটু স্থান দিত না, কারও বাড়িতে জায়গা পেতাম না, আত্মীয়-স্বজন পর্যন্ত ভয় করত, একটা পয়সা দিয়ে কেউ সাহায্য করত না। সে যুগে, ১৯৪৭ সাল থেকে মুসলিম লীগ আমলে জিন্নাহ্ সাহেবের জীবিত অবস্থায় যারা এ দেশে বিরোধী-দল গঠন এবং সংগ্রামের পতাকা উত্তোলন করেছিল তাদের কথা যদি স্মরণ না করি, তাহলে অন্যায় করা হবে। তাদের কথা আজ আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
আরও স্মরণ করি তাদের কথা, এই ২৫ বৎসর বাংলাদেশের পথ-ঘাট, রাস্তা-রাজপথ বাংলার যে সমস্ত ছেলের রক্তে রঞ্জিত হয়েছে, যে হাজার হাজার, লক্ষ লক্ষ মায়ের কোল খালি হয়েছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ, মা-বোন জীবন দিয়েছে, লক্ষ লক্ষ মা-বোন ইজ্জত দিয়েছে। লক্ষ লক্ষ ছেলে আজ শেষ হয়ে গেছে। কত মা আজ পুত্র-হারা। হত বোন আজ স্বামী হারা। কত পিতা আজ সন্তান হারা। কত সংসার আজ ছারখার হয়ে গেছে, আর সীমা নেই। শেষ পর্যন্ত কত খেলা খেলে গেল। উড়ে এসে এক-একজন জুড়ে বসত।
জনাব স্পীকার সাহেব, আমি গত নির্বাচনের পূর্বে এবং পরে বলেছিলাম, যে জাতি রক্ত দিতে শিখেছে, সেই জাতিকে কেউ দাবিয়ে রাখতে পারে না, সেই জাতিকে কখনও কেউ পদানত করতে পারে না – সে কথা অক্ষরে অক্ষরে আজ প্রমাণ হয়ে গেছে। অনেকে দালালী করেছেন প্রগতির নামে। ইয়াহিয়া খানের দালালী করেছেন, আইয়ুব খানের দালালী করেছেন। অনেকের তখন জন্ম হয় নাই রাজনৈতিক জীবনে – তাঁরাও অনেক সময় সমালোচনা করেন। গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি বলে সমালোচনা করার অধিকার দিয়েছি। সমালোচনা করুন – কোন সত্য কথা বলতে ভয় না পাওয়া বুদ্ধিমানের কাজ।
গত সংগ্রামের সময়, ২৫শে মার্চ তারিখে আক্রমণ চলে এবং যখন আমার বাড়িতে মেশিনগান মেরে আমাকে গ্রেফতার করে, তখন আমার সহকর্মীদের আমি হুকুম দিয়েছিলাম, যাও, চলে যাও যার যার এলাকাতে – গিয়ে প্রতিরোধ-আন্দোলন গড়ে তোল এবং সংগ্রাম চালিয়ে যাও। ২৫শে মার্চ তারিখে যে আক্রমণ চলে, সে আক্রমণ চালায় পাকিস্তান সেনাবাহিনী বাঙালি সেনাবাহিনীর উপর, বাঙালি ই.পি.আর.-এর উপর, বাঙালি পুলিশের উপর, বাঙালি রক্ষীবাহিনীর উপর, আর বিশেষ করে আওয়ামী লীগের কর্মী ও নেতৃবৃন্দের উপর। আর যারা এদেশের দুঃখী মানুষ, তাদের বস্তি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। রাস্তায় রাস্তায়, ঢাকা শহর থেকে আরম্ভ করে সেদিন সেই অত্যাচার শুরু হয় এবং মেশিন-গান চলে ২৫ তারিখ রাত্রে।
যখন আমি বুঝতে পারলাম, আর সময় নেই এবং আমার সোনার দেশকে চিরদিনের মতো ছেড়ে যেতে হচ্ছে, তখন আমার মনে হল, এই বুঝি আমার শেষ। তখন আমি চেষ্টা করেছিলাম, কেমন করে বাংলার মানুষকে এ খবর পৌছিয়ে দেই এবং তা আমি পৌছিয়ে দিয়েছিলাম তাদের কাছে। সেদিন আমি লাশ দেখেছি, রক্ত আমি দেখেছি। সেই রক্তের উপর দিয়ে আমাকে নিয়ে যাওয়া হয়, সেই রক্তাক্ত মানুষের লাশের পাশ দিয়ে আমাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হয়।
[এই পর্যায়ে তিনি কেঁদে ফেলেন]
সে আগুন আমি দেখেছি। শুধু বলেছিলাম, তোমরা আমাকে হত্যা কর, আমার মানুষকে মের না। তারা আমার কথা শোনে নাই। তারা আমার মানুষকে হত্যা করেছে। ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়েছে। তাদের ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দিয়েছে। আমার সহকর্মীদের হত্যা করেছে। এই গণপরিষদের আমার বহু কর্মীকে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ লোককে হত্যা করেছে। মানুষ যে এত পশু হতে পারে, জনাব স্পীকার সাহেব, দুনিয়ার ইতিহাসে দেখা যায় না। হালাকু খাঁর গল্প পড়েছি, চেঙ্গিস খাঁর গল্প পড়েছি, হিটলারের গল্প পড়েছি, মুসোলিনীর গল্প পড়েছি, কিন্তু মানুষ যে এত পশু হতে পারে তা দেখিনি। দুই বৎসরের দুধের বাচ্চাকে হত্যা করে, তার বুকে লিখে দিয়ে “বল জয় বাংলা” গাছের সঙ্গে টাঙ্গিয়ে রেখেছে। মানুষ কেমন করে এত পশু হতে পারে। ৭০ বৎসরের বৃদ্ধার উপর পাশবিক অত্যাচার করতে পারে কেমন করে। লক্ষ লক্ষ দুধের বাচ্চাকে তারা হত্যা করেছে। গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে তারা আমার লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে। সে রক্ত আমরা ভুলতে পারি না। তাদের কথা আমাদের স্মরণ করতে হয়।
আওয়ামী লীগ, আমি বা সহকর্মীরা ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করি নাই। ক্ষমতার জন্য রাজনীতি করতে চাই না। ক্ষমতা চাইলে বহু ক্ষমতা ভোগ করতে পারতাম। সারা দেশের প্রধানমন্ত্রী হতে পারতাম। আমার সহকর্মীরা বাংলার মন্ত্রীত্ব করতে পারত। কিন্তু বাংলার মানুষের কাছে ওয়াদা করেছিলাম, বাংলার মানুষকে মুক্ত করতে হবে, বাংলার মানুষ সুখী হবে, বাংলার সম্পদ বাঙালিরা ভোগ করবে। সেইজন্য এই সংগ্রাম করেছিলাম।
জনাব স্পীকার সাহেব, বক্তৃতা করা ছেড়ে দিয়েছি। আমি অনেক সময় ভাবপ্রবণ হয়ে যাই। আমার সহকর্মীরা ঘর-বাড়ি ছেড়ে গিয়েছিল সবাই। এই এ্যাসেম্বলীর এমন কোন মেম্বার নাই, যার ঘর-বাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হয় নাই, আত্মীয় স্বজন হত্যা করা হয় নাই। অনেকে অনেক কথা বলে, বলাটা স্বাভাবিক। কার বিরুদ্ধে মানুষ বলে? যে কাজ করে, তারই বিরুদ্ধে মানুষ বলে। যে কাজ করে না, তার বিরুদ্ধে মানুষ বলে না।
আওয়ামী লীগের অনেক সদস্য, আমার কর্মী ভাই-বোন আছে, যাদের ঘর-বাড়ি এমনকি সর্বস্ব চলে গেছে, তবু তারা ক্ষমতা চায়নি। সর্বস্বান্ত হয়ে জঙ্গলে আশ্রয় নিয়েছে। আমার সহকর্মীরা বুঝতে পারছে না, কি করবে। সেদিন আমি তাদের কাছে নেই। আমি ঘোষণা করে বলে দিয়েছি, সমস্ত জেলায়, মহকুমায় এক সঙ্গে প্রতিরোধ-আন্দোলন শুরু হোক এবং হয়েছিলও তাই। আমার সহকর্মীরা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে, স্বাধীন সরকার গঠন করে, দুনিয়ার দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছিল।
সেদিন অনেকেই এগিয়ে আসেননি, শুধু আরাম করে খেয়েছেন। এই সংগ্রামের কথা চিন্তাও করেননি। সেই ভাঙ্গাচোরা দল নিয়ে, অন্যান্য যারা অত্যাচারিত হয়েছে, তাদেরকে নিয়ে মুক্তিবাহিনী গঠন করে, দুনিয়ার কাছে সমস্ত কিছু পরিষ্কার করে তুলে ধরে তারপর তারা পুরোদমে সংগ্রাম করেছিল। নির্ভীক বাংলার সৈনিক, নির্ভীক মুজাহিদ, আনসার, পুলিশ, নির্ভীক সাবেক ই.পি.আর, নির্ভীক বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক, শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, সরকারী কর্মচার্রীদের এক অংশ ঝাঁপিয়ে পড়েছিল সেই নমরুদের বিরুদ্ধে। সেই সংগ্রাম হয়েছিল চরম সংগ্রাম। অস্ত্র কেড়ে নিয়েছিল তাদের হাত থেকে। তখন তারা অস্ত্র পায়নি অন্যান্য জায়গা থেকে। দেশের মধ্যে থেকে অস্ত্র যোগাড় করে নিয়ে তারা সে সংগ্রাম করেছিল। সেইভাবেই এক মাস, দুই মাস পর্যন্ত বিভিন্ন জেলায় মুক্তিবাহিনীর হাতে ছিল। তারপর সাম্রাজ্যবাদী শক্তির সাহায্য পেয়ে পাকিস্তানি বর্বর বাহিনী ভাল ভাল অস্ত্র পেয়ে, গ্রামের পর গ্রাম, শহরের পর শহর জ্বালিয়ে দিয়েছিল। কিন্তু পদানত হয়নি বাঙালি।
সেজন্য আমি স্মরণ করি সেই ৩০ লক্ষ লোককে, যারা রক্ত দিয়েছে, শহীদ হয়েছে। আমি আরও স্মরণ করি আমার সেই পঙ্গু ভাইদের কথা, যাঁরা বসে আছেন পঙ্গু হয়ে। তাঁদের জন্য কর্তব্য করতে চেষ্টা করছি। পঙ্গু ভাইদের জন্য ‘ট্রাস্ট’ করে দিয়েছি চার কোটি টাকা ব্যয় করে। সেখানে তাঁরা পেনশন পাবেন সারা জীবন।
স্মরণ করি আমার নির্যাতিতা মা-বোনের কথা। দুই লক্ষ নির্যাতিতা মা-বোন আজও ক্যাম্পে ক্যাম্পে আছে, যাদের ইজ্জত নষ্ট করে দিয়েছে পাকিস্তানি দস্যুরা – যারা ইসলামের নাম নিয়ে চীৎকার করে, ‘মুসলিম বাংলা’ বলে চীৎকার করে। লজ্জা করে না। দুই লক্ষ মা-বোনের কথা স্মরণ না করলে অন্যায় করা হবে।
যাক, আজ আমরা স্বাধীনতা পেয়েছি রক্তের বিনিময়ে। আমি প্রথমেই বলেছিলাম, এই শাসনতন্ত্র শহীদের রক্ত দিয়ে লেখা। কোন দেশে কোন যুগে আজ পর্যন্ত এত বড় রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পরে এত তাড়াতাড়ি শাসনতন্ত্র দিতে পারে নাই। দেশের কি অবস্থা ছিল, জনসাধারণ জানে। কয় পাউন্ড বৈদেশিক মুদ্রা ছিল, সকলই জানা আছে। রাস্তা-ঘাটের কি অবস্থা ছিল, সবই আপনারা জানেন। চাউলের গুদামে কত চাউল ছিল, এ সবই আপনাদের জানা আছে।
মানুষের ভুললে চলবে না যে, বাংলাদেশ একটি কলোনী-মাত্র ছিল। শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানি মাল বিক্রি করে তার অর্থ পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যেত। সব কিছু তারা ধ্বংস করে দিয়ে যায় এবং যাবার বেলায় গর্ব করে বলে যায় যে, স্বাধীনতা পেল বাঙালি, কিন্তু এমন করে দিয়ে গেলাম যে লক্ষ লক্ষ লোক না খেয়ে মরবে এবং আর মাজা সোজা করে দাঁড়াতে পারবে না। কিন্তু আজ বাংলার মানুষ মাজা টান করে দাঁড়িয়েছে।
যা হোক স্পীকার সাহেব, নয় মাসের মধ্যে শাসনতন্ত্র দেওয়া সহজ কথা নয়। মানুষের মৌলিক অধিকার দেওয়ার কারণ হল, আমরা জনগণের উপর বিশ্বাসী। জনগণের উপর আস্থা রেখেই আমরা পাকিস্তানি সামরিক বাহিনীর বিরুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলাম। আগেই বলেছি, জনগণকে আমরা ভয় পাইনা, জনগণকে আমরা ভালবাসি। সেইজন্য আপনার মাধ্যমে আমি আমার সহকর্মীদের আন্তরিক ধন্যবাদ না দিয়ে পারি না। তাঁরা রাতদিন ধরে অবিশ্রান্ত পরিশ্রম করে তাড়াতাড়ি বিদায় নিয়ে যাচ্ছেন। পাঁচ বৎসর আমরা চালাতে পারতাম। কেউ চ্যালেঞ্জ করলে বাংলার মানুষের কাছে গণভোটে গিয়ে প্রমাণ করে দিতাম যে, বাংলার মানুষ কাঁদের ভালোবাসে। কিন্তু তা আমরা চাইনি, জনাব স্পীকার সাহেব – চেয়েছি মানুষের অধিকার। এই অধিকারের জন্যই সংগ্রাম করেছিলাম এবং এই জন্যই আজ শাসনতন্ত্র দিয়েছি। আমার সহকর্মীদের একজনও আপত্তি করে বলেন নাই যে, আমরা এ্যাসেম্বলী Dissolve করব না। এজন্য আমি গর্বিত। আমার দলের সহকর্মীদের জন্য, মেম্বারদের জন্য আমি গর্বিত।
যাঁরা এই এ্যাসেম্বলীর মেম্বার হয়ে সর্বস্বান্ত হয়েছেন, যাঁরা এই গণপরিষদ-সদস্য, তাঁরা শাসনতন্ত্র পাস করে বলতে পারতেন যে, ভবিষ্যতে আমরা জাতীয় পরিষদরূপে কাজ করব। কারও কিছু বলার অধিকার ছিল না। কেননা, কনভেনশনে তাই রয়েছে, রীতি রয়েছে। কিন্তু তা করি নাই। আওয়ামী লীগ যে ক্ষমতার লোভী নয়, তার আর একটা প্রমাণ, আজ তারা শাসনতন্ত্র দিয়েছে এবং তারা নির্বাচনে যাবে।
শাসনতন্ত্র সম্পর্কে পুঙ্খানুপুঙ্খরূপে আলোচনা হয়েছে। আমার সহকর্মী সকলেই প্রায় বক্তৃতা করেছেন। যিনি একজন ‘অপোজিশনে’ ছিলেন, বা দুইজন স্বতন্ত্র ছিলেন, তাঁরা নিজেরাই স্বীকার করেছেন যে, তাঁদেরকে বেশি সুযোগ দেওয়া হয়েছে। ভবিষ্যতে আসতে পারলে আরও সুযোগ পাবেন। তাতে আমার আপত্তি নাই। আর যদি না আসতে পারেন, তাতেও আমার আপত্তি নাই। জনগণই ঠিক করে দেবে। আমাদের ভালবাসা রয়েছে – জনগণের।
নয় মাসের মধ্যে যে শাসনতন্ত্র দেওয়া হয়েছে, এটা হল আর একটি নতুন সৃষ্টি। আমি আগেই বলেছি, শাসনতন্ত্র ছাড়া, মৌলিক অধিকার ছাড়া দেশের অবস্থা হয় মাঝিবিহীন নৌকর মতো। তাই মানুষের মৌলিক অধিকার যাতে তাড়াতাড়ি ফিরে আসে তারই জন্য আমারেদ পার্টি এই শাসনতন্ত্র প্রদান করল। আশা করি, জনগণ এই শাসনতন্ত্র গ্রহণ করবেন এবং করেছেন। কারণ, আমরা জনগণের প্রতিনিধি। নির্বাচনের মাধ্যমে আমরা এসেছি। কেউ আমাদের পকেট থেকে বের করে দেন নাই। আর, আমরা আসমান থেকে পড়ি নাই বা কেউ এসে আমাদের ‘মার্শাল ল’ জারী করে বসিয়ে দেন নাই।
‘মার্শাল ল’ জারী আমরাও করতে পারতাম। যেদিন আমার বন্ধুরা, সহকর্মীরা এখানে এসে সরকার বসান, সেদিন তাঁরা বলতে পারতেন, emergency। No democracy। No talk for three years। এবং সেটা মানুষ গ্রহণ করতেন। কোন সমালোচনা চলবে না। কোন কথা বলা চলবে না। কোন মিছিল হবে না। কোন পার্টির কাম চলবে না। কারণ, দেশের যা অবস্থা ছিল, তাতে এটা করা যেত। সব দেশে, সব যুগে, বিপ্লবের পরে তাই হয়েছে। কিন্তু আমরা সেটা চাই নাই। শক্তি আমাদের ছিল। আমাদের শক্তি আমাদের জনগণ। কেউ যদি মনে করেন যে, শক্তির উৎস বন্দুকের নল, তাহলে আমি তা স্বীকার করি না। আমি স্বীকার করি, আমার দল স্বীকার করে, শক্তির উৎস হল জনগণ।
জনাব স্পীকার সাহবে, চারটা স্তম্ভের উপর এই শাসনতন্ত্র রচিত হয়েছে। এই সম্বন্ধে বিশদ আলোচনা এই হাউসে হয়েছে। আমার সহকর্মীরা অনেকেই এর উপর বক্তৃতা করেছেন। আমার সহকর্মী ডঃ কামাল হোসেনও অনেক কথার উত্তর দিয়েছেন। অন্য সদস্যরাও এর উপর বক্তৃতা করেছেন। এই যে চারটা স্তম্ভের উপর শাসনতন্ত্র রচনা করা হল, এর মধ্যে জনগণের মৌলিক অধিকার হচ্ছে একটা মূল বিধি। মূল চারটা স্তম্ভ – জনগণ ভোটের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে। শুধু ভোটের মাধ্যমে নয় – ৩০ লক্ষ লোক জীবন দিয়ে, রক্তের মাধ্যমে তা প্রমাণ করে দিয়েছে।
হ্যাঁ, অধিকার আছে অনেক কথা বলার। জাতীয়তাবাদের ভিত্তিতে বাঙালি জাতি ঝাঁপিয়ে পড়েছিল চরম মরণ-সংগ্রামে। জাতীয়তাবাদ না থাকলে কোন জাতি এগিয়ে যেতে পারে না। এই মূলনীতির উপর ভিত্তি করে আমরা এগিয়ে গিয়েছি। আমরা জাতীয়তাবাদে বিশ্বাস করি। জাতীয়তাবাদের অনেক সংজ্ঞা আছে। অনেক ঋষি অনেক মনীষী অনেক বুদ্ধিজীবি অনেক শিক্ষাবিদ এ সম্পর্কে অনেক রকম সংজ্ঞা দিয়েছেন। সুতরাং, এ সম্বন্ধে আমি আর নতুন সংজ্ঞা না-ই দিলাম। আমি শুধু বলতে পারি আমি বাংলাদেশের মানুষ, আমি একটা জাতি।
এই যে জাতীয়তাবাদ, সে সম্পর্কে আমি একটা কথা বলতে চাই। ভাষাই বলুন, শিক্ষাই বলুন, সভ্যতাই বলুন, আর কৃষ্টিই বলুন – সকল কিছুর সঙ্গে একটা জিনিস রয়েছে। সেটা হল অনুভূতি। এই অনুভূতি যদি না থাকে তাহলে কোন জাতি বড় হতে পারে না। এবং জাতীয়তাবাদ আসতে পারে না। অনেক জাতি দুনিয়ায় আছে, যারা বিভিন্ন ভাষাবলম্বী হয়েও এক-জাতি হয়েছে। অনেক দেশ আছে, একই ভাষা, একই ধর্ম, একই সবকিছু নিয়ে বিভিন্ন জাতি গড়ে উঠেছে – তারা এক জাতিতে পরিণত হতে পারে নাই। জাতীয়তবাদ নির্ভর করে অনুভূতির উপর। সেজন্য আজ বাঙালি জাতি যে রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের মাধ্যমে স্বাধীন হয়েছে, যার উপর ভিত্তি করে আমরা স্বাধীনতা নিয়েছি, যার উপর ভিত্তি করে আমরা সংগ্রাম করেছি, সেই অনুভূতি আছে বলেই আজকে আমি বাঙালি, আমার বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এর মধ্যে যদি কেউ আজকে দ্বিতীয় কোন প্রশ্ন তুলতে চান, তাহলে তাঁকে আমি অনুরোধ করব, মেহেরবানি করে আগুন নিয়ে খেলবেন না।
দ্বিতীয় কথা, আমরা গণতন্ত্রে বিশ্বাস করি। গণতন্ত্র সেই গণতন্ত্র, যা সাধারণ মানুষের কল্যাণ সাধন করে থাকে। মানুষের একটা ধারনা এবং আগেও আমরা দেখেছি যে, গণতন্ত্র যেসব দেশে চলেছে দেখা যায় সেসব দেশে গণতন্ত্র পুঁজিপতিদের Protection দেওয়ার জন্য কাজ করে এবং সেখানে শোষকদের রক্ষা করার জন্যই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হয়। সে গণতন্ত্রে আমরা বিশ্বাস করি না। আমরা চাই শোষিতের গণতন্ত্র এবং সেই শোষিতের গণতন্ত্রের অর্থ হল, আমার দেশে যে গণতন্ত্রের বিধিলিপি আছে, তাতে যেসব Provision করা হয়েছে, যাতে এ দেশের দুঃখী মানুষ Protection পায়, তার জন্য বন্দোবস্ত আছে – ঐ শোষকরা যাতে Protection পায়, তার ব্যবস্থা নাই। সেজন্য আমাদের গণতন্ত্রের সঙ্গে অন্যের পার্থক্য আছে। সেটা আইনের অনেক Schedule-এ রাখা হয়েছে, অনেক বিলে রাখা হয়েছে, সে সম্বন্ধে আপনিও জানেন।
অনেক আলোচনা হয়েছে যে, কারও সম্পত্তি কেউ নিতে পারবে না। সুতরাং, নিশ্চয়ই আমরা কারও ব্যক্তিগত সম্পত্তিতে হাত দিচ্ছি না। কিন্তু যে চক্র দিয়ে মানুষকে শোষণ করা হয়, সেই চক্রকে আমরা জনগণের জন্য ব্যবহার করতে চাই। তার জন্য আমরা প্রথমেই ব্যাঙ্ক, ইন্সিওরেন্স-কোম্পানী, কাপড়ের কল, জুট-মিল, সুগার-ইন্ডাস্ট্রি – সব কিছু জাতীয়করণ করে ফেলেছি, তার মানে হল, শোষক-গোষ্ঠি যাতে এই গণতন্ত্র ব্যবহার করতে না পারে। শোষিতকে রক্ষা করার জন্য এই গণতন্ত্র ব্যবহার করা হবে। সেজন্য এখানের গণতন্ত্রের, আমাদের সংজ্ঞার সঙ্গে অন্য অনেকের সংজ্ঞার পার্থক্য হতে পারে।
তৃতীয়ত, Socialism বা সমাজতন্ত্র। আমরা সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করি। এবং বিশ্বাস করি বলেই আমরা এগুলি জাতীয়করণ করেছি। যাঁরা বলে থাকেন, সমাজতন্ত্র হল না, সমাজতন্ত্র হল না, তাঁদের আগে বুঝা উচিত, সমাজতন্ত্র কি। সমাজতন্ত্রের জন্মভূমি সোভিয়েট রাশিয়ায় ৫০ বছর পার হয়ে গেল, অথচ এখনও তারা সমাজতন্ত্র বুঝতে পারে নাই। সমাজতন্ত্র গাছের ফল না – অমনি চেখে খাওয়া যায় না। সমাজতন্ত্র বুঝতে অনেক দিনের প্রয়োজন, অনেক পথ অতিক্রম করতে হয়। সেই পথ বন্ধুরও হয়। সেই পথ অতিক্রম করে সমাজতন্ত্রে পৌছানো যায়। সেজন্য পহেলা Step, যাকে প্রথম Step বলা হয়, সেটা আমার গ্রহণ করেছি – শোষণহীন সমাজ। আমাদের সমাজতন্ত্রের মানে শোষণহীন সমাজ। সমাজতন্ত্র আমরা দুনিয়া থেকে হাওলাত করে আনতে চাই না। এক এক দেশ, এক এক পন্থায় সমাজতন্ত্রের দিকে এগিয়ে চলেছে। সমাজতন্ত্রের মূল কথা হল শোষণহীন সমাজ। সেই দেশের কি Climate, কি ধরনের অবস্থা, কি ধরনের মনোভাব, কি ধরনের আর্থিক অবস্থা, সব কিছু বিবেচনা করে Step by Step এগিয়ে যেতে হয় সমাজতন্ত্রের দিকে এবং তা আজকে স্বীকৃত হয়েছে।
রাশিয়া যে পন্থা অবলম্বন করেছে, চীন তা করে নাই – সে অন্য দিকে চলেছে। রাশিয়ার পার্শ্বে বাস করেও যুগোশ্লাভিয়া, রুমানিয়া, বুলগেরিয়া তাদের দেশের Environment নিয়ে, তাদের জাতির background নিয়ে, সমাজতন্ত্রের অন্য পথে এসেছে। মধ্যপ্রাচ্যে যান – ইরাক একদিকে এগিয়ে চলেছে, আবার মিসর অন্য দিকে চলেছে। বিদেশ থেকে হাওলাত করে এনে কোনদিন সমাজতন্ত্র হয় না, তা যাঁরা করছেন, তাঁরা কোনদিন সমাজতন্ত্র করতে পারেন নাই। কারণ, লাইন, কমা, সেমিকোলন পড়ে সমাজতন্ত্র হয় না – যেমন আন্দোলন হয় না। সেজন্য দেশের Environment, দেশের মানুষের অবস্থা, তাদের মনোবৃত্তি, তাদের ‘কাস্টম’, তাদের আর্থিক অবস্থা, তাদের মনোভাব, সব কিছু দেখে Step by Step এগিয়ে যেতে হয়। একদিনে সমাজতন্ত্র হয় না। কিন্তু আমরা নয় মাসে যে পদক্ষেপগুলি নিয়েছি, তা আমার মনে হয়, দুনিয়ার কোন দেশ, যারা বিপ্লবের মাধ্যমে Socialism করেছে, তারাও আজ পর্যন্ত তা করতে পারে নাই – আমি চ্যালেঞ্জ করছি। কোন কিছু করলে কিছু অসুবিধার সৃষ্টি হয়ই। সেটা Process – এর মাধ্যমে আস্তে আস্তে ঠিক হয়ে যায়।
তার পরে আসছে ধর্মনিরপেক্ষতা। জনাব স্পীকার সাহেব, ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মকর্ম করার অধিকার থাকবে। আমরা আইন করে ধর্মকে বন্ধ করতে চাই না এবং করবও না। ধর্মনিরপেক্ষতা মানে ধর্মহীনতা নয়। মুসলমানরা তাদের ধর্ম পালন করবে – তাদের বাধা দেওয়ার ক্ষমতা এই রাষ্ট্রে কারও নাই। হিন্দু তাদের ধর্ম পালন করবে – কারও বাধা দেওয়ার ক্ষমতা নাই। বৌদ্ধরা তাদের ধর্ম পালন করবে – তাদের কেউ বাধাদান করতে পারবে না। খ্রীষ্টানরা তাদের ধর্ম পালন করবে – কেউ বাধা দিতে পারবে না। আমাদের শুধু আপত্তি হল এই যে, ধর্মকে কেউ রাজনৈতিক অস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করতে পারবে না।
২৫ বৎসর আমরা দেখেছি, ধর্মের নামে জুয়াচুরী, ধর্মের নামে শোষণ, ধর্মের নামে বেঈমানী, ধর্মের নামে অত্যাচার, ধর্মের নামে খুন, ধর্মের নামে ব্যাভিচার – এই বাংলাদেশের মাটিতে এ সব চলেছে। ধর্ম অতি পবিত্র জিনিস। পবিত্র ধর্মকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবে ব্যবহার করা চলবে না। যদি কেউ বলে যে, ধর্মীয় অধিকর খর্ব করা হয়েছে, আমি বলব, ধর্মীয় অধিকার খর্ব করা হয়নি। সাড়ে সাত কোটি মানুষের ধর্মীয় অধিকার রক্ষা করার ব্যবস্থা করেছি।
কেউ যদি বলে, গণতান্ত্রিক মৌলিক অধিকার নাই, আমি বলব সাড়ে সাত কোটি মানুষের অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে যদি গুটি কয়েক লোকের অধিকার হরণ করতে হয়, তাহলে তা করতে হবে। কোন কোন বন্ধু বলেছেন, Schedule – এ এ জিনিস নাই, ও জিনিস নাই। জনাব স্পীকার সাহেব, কেবল শাসনতন্ত্র পাস করলেই দেশের মুক্তি হয় না, আইন পাস করলেই দেশে সমাজতন্ত্র কায়েম হয় না – ভবিষ্যৎ বংশধর, ভবিষ্যৎ জনসাধারণ কেমন করে, কিভাবে শাসনতন্ত্র সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করবে, তারই উপর নির্ভর করে শাসনতন্ত্রের Success, কার্যকারিতা। আমরা চারটি মূলনীতির উপর ভিত্তি করে শাসনতন্ত্র দিয়েছি। কেউ কেউ বলেছেন যে, সরকারী কর্মচারীদের অধিকার খর্ব করা হয়েছে। তাঁরা অন্যান্য দেশের শাসনতন্ত্রও পড়ুন। সরকারী কর্মচারীরা একটা আলাদা জাতি নয়। তারা আমাদের বাপ, আমাদের ভাই। তারা কোন Different Class নয়।
ইংরেজ-আমলে I.C.S., I.P.S. – দের Protection দেওয়া হত। সেই Protection পাকিস্তান-আমলেও দেওয়া হত। আমলাতন্ত্রের সেই Protection-এর উপর আঘাত করেছি – অন্য জায়গায় আঘাত করিনি। এই Class রাখতে চাই না। কারণ, শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে চাই, Classless Society প্রতিষ্ঠা করতে চাই। আইনের চক্ষে সাড়ে সাত কোটি মানুষের যে অধিকার, সরকারী কর্মচারীদেরও সেই অধিকার। মজদুর, কৃষকদের টাকা দিয়ে সরকারী কর্মচারীদের মাইনে, খাওয়াপরার ব্যবস্থা করা হয়। সুতরাং, মজদুর, কৃষকদের যে অধিকার, সরকারী কর্মচারীদের সেই অধিকার থাকবে। এর বেশি অধিকার তাঁরা পেতে পারে না।
সরকারী কর্মচারীদের মনোভাব পরিবর্তন করতে হবে যে, তাঁরা শাসক নন – তাঁরা সেবক। Some people came to me and wanted protection from me. I told them, “My people want protection from you, gentlemen.” আমি তাঁদেরকে তাঁদের মনোভাবের আমূল পরিবর্তন করতে বলেছি। কেউ কেউ শাসনতন্ত্রের নবম ভাগের সমালোচনা করেছেন। গত নয় মাসে কয়জন সরকারী কর্মচারীর বিরুদ্ধে Action নেওয়া হয়েছে? মাত্র কয়েকজনের বিরুদ্ধে Action নেওয়া হয়েছে। তবে ভবিষ্যতে আরও বেশি কর্মচারীর বিরুদ্ধে Action নিতে হতে পারে।
আজ যে কাজ করবে, লোকে তাকে কত ভালবাসে, তার উপর নির্ভর করবে তার Promotion। Promotion – এর ব্যাপারে গরীব, অল্প বেতনভোগী কর্মচারীদের অধিকার থাকবে। গরীব কর্মচারীদের গায়ে কেউ হাত দিতে পারবে না। আজীবন সংগ্রাম করেছি তাদের পাশে দাঁড়িয়ে তাদের অধিকার আদায়ের জন্য। আজও বলছি, ভবিষ্যতেও তাদের পাশে থাকব। তারা গরীব, আমি জানি। তাদের অধিকার রক্ষার ব্যবস্থা করা হয়েছে সংবিধানে।
আমরা Services Reorganisation committee করেছি। সেই কমিটির মেম্বারদের বলেছি, ডঃ কামাল হোসেনও বলেছেন, Central Government – এর 125 Step বা Provincial Government -এর 33 step আমরা রাখবো না। এই 125 এবং 33 step -এর মধ্যে যে কত ফাঁক ছিল, যার সুবিধা নিয়ে অনেক Promotion হত। সাত আসমান। এর বেশি Step সরকারী চাকুরীতে থাকবে না। মাত্র 7 step থাকবে।
এতে বাধা সৃষ্টি করার জন্য কিছু কিছু লোক গোপনে গোপনে ফুসফাস করছে এবং M.C.A. দের কাছে যাওয়া-আসা শুরু করেছে। বহু ক্ষমা করা হয়েছে। আমরা রক্তের আন্দোলনের মাধ্যমে পয়দা হয়েছি। আমরা ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খানের ‘তকমা’ নিয়ে বেড়াইনি। আমরা চোঙ্গা ফুঁকে, রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে জনসমর্থন নিয়ে এখানে এসেছি। কিন্তু আজ যদি কেউ মনে করে থাকেন যে, ইয়াহিয়া খান, আইয়ুব খানের সেই Protection পাবেন তাহলে ভুল করছেন। সরকারী কর্মচারীদের জনগণের সঙ্গে মিশে যেতে হবে। তাঁরা জনগণের খাদেম, সেবক, ভাই। তাঁরা জনগণের বাপ, জনগণের ছেলে, জনগণের সন্তান। তাঁদের এই মনোভাব নিয়ে কাজ করতে হবে।
যাঁরা ময়দানে দাঁড়িয়ে বক্তৃতা করেন যে, দূর্নীতিপরায়ণ সরকারী কর্মচারীদের খতম কর, Action নিলে তাঁরাই আবার মিটিং করে উল্টো প্রস্তাব পাস করেন। নীতি এক হওয়া উচিত। কেউ কেউ বলেন, সরকারকে ধ্বংস করার জন্য অফিস Collaborator -এ ভরে গিয়েছে। Collaborator আছে। যাদের সম্বন্ধে Definite খবর পাই, তাদের বিরুদ্ধে Action নেওয়া হয়। তারপর, কাজ না করে চেয়ার-টেবিলে বসে থাকা, এটা একটা স্টাইল হয়েছে। Mentality must be changed। ঐ C.S.P, P.S.P. বাংলাদেশে থাকবে না। সরকারী চাকুরীতে 7 Step থাকবে। Services Reorganisation Committe করা হয়েছে। কমিটির রিপোর্টের উপর ভিত্তি করে সব কিছু করা হবে। যাঁরা নির্বাচিত হয়ে পরিষদে আসবেন, তাঁরা আইন পাস করবেন, তখন সব হবে। এখন অর্ডিন্যান্স পাস করে কাজ করা হচ্ছে। Scrutiny Committee করা হয়েছে, সেটা থাকবে। অল্প সময়ের মধ্যে অনেক কাজ হয়েছে।
Pay Commission করা হয়েছে। সেটাকে বন্ধ করার জন্য চেষ্টা হয়েছে। বাধা সৃষ্টি করা হয়েছে। কেউ ৭৫ টাকা পাবে, কেউ ২ হাজার পাবে – তা হতে পারে না। সকলের বাঁচবার মতো অধিকার থাকতে হবে। একজন সব কিছু পাবে, আর একজন পাবে না – তা হতে পারে না। Pay Commission সরকারী কর্মচারীদের Highest and Lowest pay ঠিক করে দেবেন। সম্পদ ভাগ করে খেতে হবে। এর বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র হয়েছে। বিরোধী-দলের নাম শুনতে পাই। এ রকম কোন পার্টি আছে কিনা, জানি না। নির্বাচনের আগে এ রকম কোন পার্টি ছিল না। অনেকেই ভোট না পেয়ে পশ্চাদপসরণ করেছিল। ভবিষ্যৎ নির্বাচনে যদি তারা ভোট না পায়, তাহলে সে দোষ আমাদের হবে না। ভোট পেয়ে পরিষদে এসে বলুক, আমরা বিরোধী-দল। যারা নির্বাচনে দাঁড়িয়ে ভোট পায়নি, তারা বলে, আমরা বিরোধী-দল। ভবিষ্যতে ভোট নিয়ে এসে তারপর বলুক, আমরা বিরোধী-দল। তা না হলে বলুক, এই আমাদের দাবী।
গণতন্ত্রে মৌলিক অধিকার ব্যবহার করতে হবে। তার জন্য Ethics মানতে হয়। খবরের কাগজে Journalism করতে হলে Ethics মানতে হবে। তা না হলে Ethics impose করা হয়। গণতন্ত্রের যে অধিকার, তা কেবল চেঁচিয়ে বেড়ালে পালন করা হয় না, বক্তৃতা করলে হয় না। আজ লক্ষ লক্ষ মানুষ না খেয়ে কষ্ট পাচ্ছে। ২৪ লক্ষ টন খাবার বিদেশ থেকে এনে ৬৫ হাজার গ্রামে পৌছে দেওয়া হয়েছে। এজন্য ধন্যবাদ দেওয়া উচিত। রেল-সেতু নাই, কাঠ নাই, বাঁশ নাই। ৬৫ হাজার গ্রামে খবর পৌছে দিয়েছি। যাঁরা অপজিশন করছেন, যান না রিলিফ কমিটি করে, চাঁদা তুলে একটা গ্রামের কিছু লোককে যদি খাওয়াতে পারেন, পাঁচটা লোককে যদি খাওয়াতে পারেন, তাহলেও বুঝি। শুধু খবরের কাগজে নাম উঠাবার জন্য বক্তৃতা করে ‘গণতন্ত্র চাই’ বললে কি হবে।
গণতন্ত্রে যেমন অধিকার আছে, তেমনি সঙ্গে সঙ্গে কর্তব্যও রয়েছে। সেইজন্য শাসনতন্ত্র করার সময় আমরা চারটি স্তম্ভ ঠিক রেখেছি। আমি শাসনতন্ত্রের উপর Clause by clause বলতে চাই না। আমার সহকর্মীরা Clause by clause আলোচনা করেছেন। সেইজন্য জনাব স্পীকার সাহেব, গণতন্ত্রের কথা আমরা যেমন শাসনতন্ত্রে বলেছি, তেমনি সেখানে কর্তব্যের কথাও রয়েছে। জনগণের দাবীর মধ্যে আছে ভোটের দাবী। গত বৎসর পর্যন্ত ভোটারের সর্বনিম্ন বয়ঃসীমা ২১ বৎসর – আমরা শাসনতন্ত্রে সেটা ১৮ বৎসর করেছি। এটাও জনগণের দাবির মধ্যে একটা। আমরা শাসনতন্ত্র এনেছি। তার উপর আইন পাস হবে, যার দ্বারা দেশ পরিচালিত হবে। আমার ভাইয়েরা ভুল করছেন – শাসনতন্ত্রের অর্থ আইন নয়। শাসনতন্ত্রের মাধ্যমে আইন হয়। আইন যে কোন সময় পরিবর্তন করা যায়। শাসনতন্ত্র এমন একটা জিনিস, যার মধ্যে একটা আদর্শ, নীতি থাকে। সেই শাসনতন্ত্রের উপর ভিত্তি করে আইন করতে হয়।
অনেকে ভুল করছেন, ভুল করে যাচ্ছেন। বলছেন, শাসনতন্ত্র বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে। কেউ বুঝবার চেষ্টা করেন নাই বা বুঝতে পারেন না বা বুঝবার মতো আক্কেল নাই, তুই বুঝতে পারেন না বা বুঝতে চান না। কারও আবার মগজ নাই। শাসনতন্ত্রের একটা মৌলিক নীতির উপর নির্ভর করে আইন হয়। সেই Fundamental – এর উপর ভবিষ্যৎ এ্যাসেম্বলীতে আইন পাস হবে। এই মৌলিক আইনের বিরোধী কোন আইন হতে পারবে না। শাসনতন্ত্রে মানুষের মৌলিক অধিকার দেওয়া হয়েছে। সমাজতন্ত্রের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। ধর্মনিরপেক্ষতা, জাতীয়তাবাদের গ্যারান্টি দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে কৃষক, শ্রমিক, দুঃখী মানুষকে, মেহনতী মানুষকে যেন কেউ exploit করতে না পারে। তাদের শোষণ করার জন্য যারা দায়ী, সেইসব শোষককে curtail করা হবে।
শোষকদের ভোটের অধিকার দেওয়া হয় নাই বলে সমালোচনা করা হয়েছে। যারা দোষীসাব্যস্ত হবে, তাদের দেশ থেকে তাড়িয়ে দেয়ার দাবীও আছে। আমার দেশে ফিরে আসার আগে দেশের লোক তাদের যে মেরে ফেলে নাই, সেজন্য তাদের শোকর করা উচিত। আমরা এমন শাসনব্যবস্থা কায়েম করব, যেখানে প্রকাশ্য আদালতে বিচারের ব্যবস্থা থাকবে। সাধারণভাবে যারা দোষী, যারা Collaboration করছে, যারা আমাদের হাজার হাজার ছেলেকে ধরে নিয়ে গিয়ে মিলিটারীর কাছে দিয়ে গুলি করে হত্যা করিয়েছে, তাদের আমরা ভাত খাওয়াচ্ছি, অনেককে জেলে ডিভিশন পর্যন্ত দিয়েছি। আইনের শাসন আমরা মানি। যারা নিরপরাধ তারা নিশ্চয় মুক্তি পাবে। যারা দোষী, যারা জনসাধারণের সঙ্গে শত্রুতা করেছে, তাদের তারা নাগরিক-অধিকার দিতে চায় না। তাদের নাগরিক-অধিকার পাওয়া উচিতও নয়। কারণ, প্রকাশ্যে গাড়ি দিয়ে, ঘোড়া দিয়ে তারা পাক মিলিটারীকে সাহায্য করেছে। মানুষকে ধরে, আমাদের ছেলেদের ধরে মিলিটারীর কাছে দিয়েছে। নানাভাবে তারা Collaboration করেছে।
স্পীকার সাহেব, এই এ্যাসেম্বলীর যে চেয়ারে আপনি বসে আছেন, তার আশেপাশে এবং এই এ্যাসেম্বলীর এমন কোন দেয়াল নাই, যেখানে আমাদের ছেলেদের রক্তের দাগ ছিল না। এই আইনসভার সেইসব দাগ আমাদের পরিষ্কার করতে হয়েছে। আইন পরিষদ দেশের শ্রেষ্ঠ স্থান। সেখানে ঘরের মধ্যে নিয়ে এসে কত লোককে ধরে ধরে হত্যা করা হয়েছে। আপনি দেয়ালের সেইসব দাগ দেখেছেন কিনা, জানি না। এই পরিষদের যাঁরা কর্মচারী আছেন, তাঁরা নিশ্চয় বলবেন, এখানকার ঘরে ঘরে কামরায় কামরায়, দেওয়ালে দেওয়ালে রক্তের দাগ ছিল। অনেকে নিজের রক্ত দিয়ে দেওয়ালের গায়ে জয় বাংলা লিখে গিয়েছে। এই এ্যাসেম্বলীর হলের মধ্যে Collaborator – দের সাহায্যে বহু মানুষকে ধরে এনে জুলুম করেছে।
নিরপরাধ যাঁরা থাকবেন, তাঁদের খালাস দেওয়া হবে। কিন্তু যারা তাদের সঙ্গে সহযোগিতা করে গণপরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের – যাঁরা দেশের জন্য যুদ্ধ করেছিলেন, তাঁদের Seat খালি করিয়ে, আচকান গায়ে দিয়ে নির্বাচনে অংশ নিয়েছেন, ইয়াহিয়া খানকে সাহায্য করেছেন, তাঁদের বাংলাদেশের নাগরিক-অধিকার দেওয়াতেও জনগণ আপত্তি করেছিল। জনগণ বাইরে পেলে তাদের কেটে ফেলত, তাদের আমরা জেলের মধ্যে রেখে ভাত খাইয়ে রক্ষা করেছি।
যা হোক, আমরা সংবিধানের Schedule – এ যা রেখেছি, তাতে কেউ কেউ বলেছেন যে, পূর্বের শাসনকালের কিছু কিছু আইনকে আমরা Protection দিয়েছি। সব দেশেই এটা করা হয়ে থাকে। তা না হলে Litigation করে সব শেষ করে ফেলবে। দেশের প্রয়োজনেই এগুলিকে Protection দেবার ব্যবস্থা রাখা হয়েছে। কতকগুলি আইন পাস করতে হলে আইনসভায় দুই-তৃতীয়াংশ Majority -র প্রয়োজন হবে। কতকগুলি শুধু Majority -তেই পরিবর্তন করা যাবে। এই প্রকার Difference না রাখলে অসুবিধা হবে।
জনাব স্পীকার সাহেব, আজ এই পরিষদে শাসনতন্ত্র পাস হয়ে যাবে। কবে হতে এই শাসনতন্ত্র বলবৎ হবে, তা আমাদের ঠিক করতে হবে। আমি মনে করি, সেইদিন, যেদিন জল্লাদ-বাহিনী রেসকোর্স-ময়দানে মুক্তিবাহিনী ও আমাদের বন্ধু-রাষ্ট্রের মিত্রবাহিনীর যৌথ কমান্ডের কাছে আত্মসমর্পণ করেছিল, সেই তারিখ। সেই ঐতিহাসিক ১৬ই ডিসেম্বর তারিখ থেকে আমাদের শাসনতন্ত্র কার্যকর করা হবে। সেই দিনের কথা রক্তের অক্ষরে লেখা আছে। স্পীকার সাহেব, সেই ইতিহাস আমরা রাখতে চাই।
আজ আমাদের কাজ শেষ হয়ে যাবে। আপনি ১৪ই ডিসেম্বর পর্যন্ত পরিষদ মূলতবী করতে পারেন। ১৪ই ডিসেম্বর তারিখে সদস্যরা এসে আপনার সামনে Original সংবিধানে দস্তখৎ করবেন। শাসনতন্ত্র বাংলায় হাতে লেখা হচ্ছে। তাতে সদস্যরা আপনার সামনে দস্তখৎ করবেন।
১৪ এবং ১৫ তারিখের পর ১৬ই ডিসেম্বর, ১৯৭২ তারিখে শাসনতন্ত্র চালু হবে। চালু হবে বাংলার মানুষের নতুন ইতিহাস।
স্পীকার সাহেব, আপনার কাছে আজ আর একটা জিনিস ঘোষণা করতে চাই। আমি ইলেকশন কমিশনারের সঙ্গে কথা বলেছি। সরকারের সমস্ত সাহায্য তাঁকে দেব। আমি আশা করি, তিনি তা গ্রহণ করবেন। আমি উল্লেখ করছি যে, নির্বাচনের তারিখ নির্দিষ্ট করা হোক ঐ ঐতিহাসিক ৭ই মার্চে। কারণ, সেই দিন, সেই ৭ই মার্চে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আমি ঘোষণা করেছিলামঃ “এবারের সংগ্রাম মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম”। সেই দিন, সেই ৭ই মার্চ তারিখে বাংলাদেশের সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
আমাদের পক্ষ থেকে আমরা সর্বতোভাবে সাহায্য করতে চাই এবং জনসাধারণ সম্পূর্ণ সাহায্য করবেন বলে আমি চীফ ইলেকশন কমিশনারকে আবেদন করব।
জনাব স্পীকার সাহেব, আপনার ধৈর্য্য নষ্ট করতে চাই না – আপনি গত রাত্রে আড়াইটা পর্যন্ত কাজ করেছেন। আমিও কিছু সময় ছিলাম। আপনাকে সহ কর্মচারীদের ধন্যবাদ দিয়ে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে ধন্যবাদ দিয়ে, এ্যাসেম্বলীর কর্মচারীদের – যাঁরা এই কষ্টের ভিতর বাইরে ডিউটি করেছেন, তাঁদের সকলকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই – তাঁরা কর্তব্যপরায়ণতার সঙ্গে তাঁদের দায়িত্ব পালন করেছেন।
আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে যদি খবরের কাগজকে কিছু না বলি, তাহলে আবার মহাবিপদের সম্মুখীন হতে পবে। তাই বলি, আপনারা এত কষ্ট করেছেন, এত কষ্টের মধ্যে বসেছেন, জায়গা আপনাদের ভালভাবে দিতে পারি নাই বসবার জন্য, এই কষ্টের মধ্যেও যে – এত ভালভাবে এ্যাসেম্বলী থেকে শাসনতন্ত্রের প্রসিডিঙের রিপোর্ট করছেন, তার জন্য এই গণপরিষদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই, জানাই মোবারকবাদ আপনাদের। আশা করি, ভবিষ্যতে আরও কয়েক বছর কষ্ট করবেন। কারণ, নতুন এ্যাসেম্বলীতে না যাওয়া পর্যন্ত আপনাদের কষ্টের সীমা নাই, আমাদেরও নাই। আর, দেশবাসী যখন কষ্ট করছে, তখন তার কিছু ভাগ নেওয়া উচিত।
জনাব স্পীকার সাহেব, এই হাউসের পক্ষ থেকে আপনাকে আবার ধন্যবাদ জানাই। জনাব ডেপুটি স্পীকার পেছনে বসে আছেন – তাঁকে ধন্যবাদ না জানালে অন্যায় হবে। তারপর, যাঁরা প্রেসে কাজ করছেন এবং রাত জেগে এই সংবিধানের জন্য দু-তিন বার করে কাজ করতে হয়েছে, তাঁদের সকলকে আমি ধন্যবাদ দিই।
ধন্যবাদ দিই ৩৪ জন মেম্বারকে, যাঁরা অক্লান্ত পরিশ্রম করেছেন ১১ই এপ্রিল তারিখ থেকে। সেদিন এই সংবিধান-কমিটি আমরা করি। তখন দেশবাসীর কাছে আবেদন করেছিলাম যে, দলমত-নির্বিশেষে আপনাদের কোন পরামর্শ, যে কোন মতামত থাকলে মেহেরবানি করে কমিটির কাছে পাঠিয়ে দেবেন। যদিও দু’একটি কেউ কেউ দিয়েছেন, কিন্তু যাঁরা খবরের কাগজে বক্তৃতা করেন, তাঁদের একখানাও দেন নাই। তাঁদের কাছ থেকে যা পেয়েছি, অন্য কর্মীদের কাছ থেকে, অন্য মানুষের কাছ থেকে, প্রফেসারের কাছ থেকে আরও অনেক পেয়েছি। তাতে অনেক সাহায্য হয়েছে। কিন্তু শাসনতন্ত্র যাঁরা মানেন না, যাঁরা গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল, তাঁরা মেহেরবানি করে এক কলম লিখে পাঠাননি। এটা আমাদের অভ্যাস, এটা স্বাভাবিক। জাত যায় না ম’লে, খাসলত যায় না ধুলে।
জনাব স্পীকার, আমার বক্তব্য শেষ করতে চাই। আজ আবার স্মরণ করি আমার জীবনের সেই বিপদের কথা, যেসব থেকে আমি উদ্ধার পেয়েছি। তার চেয়ে বড় কথা আমার জীবনের আজকে সবচেয়ে আনন্দের দিন – সে আনন্দ আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারব না। এই শাসনতন্ত্রের জন্য কত সংগ্রাম হয়েছে এই দেশে। আজকে, আমার দল যে ওয়াদা করেছিল, তার এক অংশ পালিত হল। এটা জনতার শাসনতন্ত্র। যে কোন ভাল জিসিন না দেখলে, না গ্রহণ করলে, না ব্যবহার করলে হয় না, তার ফল বোঝা যায় না।
ভবিষ্যৎ বংশধররা যদি সমাজতন্ত্র, গণতন্ত্র, জাতীয়তাবাদ এবং ধর্মনিরপেক্ষতার ভিত্তিতে শোষণহীন সমাজ প্রতিষ্ঠা করতে পারেন, তাহলে আমার জীবন সার্থক হবে, শহীদের রক্তদান সার্থক হবে।
আবার আপনাকে ধন্যবাদ জানাই, জনাব স্পীকার। আজকে বিদায় নেওয়া হচ্ছে। তবে সদস্যরা আবার সংবিধানে স্বাক্ষর করতে আসবেন। তারপর, যাঁরা পাঁচ বছরের জন্য এসেছিলেন, তাঁরা সেই পাঁচ বছর মেয়াদ পূর্ণ না হতেই চলে যাবেন। এইভাবে তাঁরা যে ত্যাগের প্রমাণ দিলেন, উদারতা দেখালেন, সেটা পার্লামেন্টের ইতিহাসে বিরল। এই জন্য সকলকে ধন্যবাদ দিয়ে আমি বিদায় নিচ্ছি।
খোদা হাফেজ।
জয় বাংলা।
Reference:
বাংলাদেশ জাতীয় সংসদে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান (১৯৭২-১৯৭৫)- শেখ হাসিনা ও বেবী মওদুদ, প্রথম প্রকাশ ১৯৯৮, আগামী প্রকাশনী
বঙ্গবন্ধুর ভাষণ সমগ্র ১৯৪৮-১৯৭৫, সংগ্রামের নোটবুক