পাক গুপ্তচরদের জবানবন্দী
(সংবাদদাতা)
জঙ্গীশাহী ইয়াহিয়ার লােকেরা যা যা বলেছিল ওরা চোখ কান ঝুঁজে সায় দিয়েছিল। কবুল করেছিল ওরা ছ জন পাকিস্তানি চর’সব বরবাদ করে দেব। ফিরে যাব ১ নভেম্বর। কিন্তু ওরা মনে মনে তখনই জানতাে, আল্লার কাছে কসম খেয়েছি, জঙ্গীশাহীকে মদত দেব না। কিন্তু জানের দায়ে, মা-বােনর ইজ্জতের জন্যে মুখে কিছু বলা যাবে না।
এখন জঙ্গীশাহীর সামরিক বাহিনীর লােক, রাজাকার, শান্তি কমিটির লােকগুলাে নিশ্চয়ই দাঁতে দাঁত চেপে বলছে, শালা বেইমান, বাঙালি জাত—কি হিন্দু কি মুসলমান—তামাম বাঙালি লােক শালা বেইমান।
জঙ্গীশাহী খােয়াব দেখেছিল হিন্দুস্থানের সড়ক, রেললাইন আরও অনেক কিছু বরবাদ করে দেবে। শালা খােয়াবই বরবাদ হয়ে গেল।
ছজন ‘পাকিস্তানি চর’ শুধু জঙ্গীশাহীর খােয়াব বরবাদ করে দেয়নি, বেকসুর ফাঁস করে দিয়েছে। সামরিক শাসকদের আর শান্তি কমিটির ‘চর যােগানাের গােপন কারবার।
ওরা ছজন রাজশাহী সীমান্ত দিয়ে ভারতে প্রবেশ করেছিল নাশকতামূলক কাজের দায়িত্ব আর কিছু মাইন নিয়ে। পাকিস্তানের অর্ডিন্যান্স ফ্যাকটরির তৈরি টাটকা মাল।
ওরা দুজন, তার সঙ্গে তামাম মালমশলা এখন ভারতীয় সামরিক বাহিনীর হেপাজতে। ওদের কাউকে জেরা করতে হয়নি, নিজেরাই সত্যি ঘটনা জানিয়েছে ইসলামের নামে।
জবানবন্দীতে ছ জনের ওস্তাদ বলছিল সেদিন, দেখুন আমরা ছ জন কেউ কোনদিন পাট্টি করিনি, বড় বড় লােকদের সঙ্গে ঘােরাঘুরিও করিনি। তবে, মিথ্যা কথা বলব না, আল্লার কাছে কসম, আওয়ামী লীগকেই ভােট দিয়েছি। কেউ জানতে পারেনি। আর আমি কেন, সবাই তাে আওয়ামী লীগকে ভােট দিয়েছে।
এর আগে কখনও পাকিস্তানি চর দেখিনি। ধরে নিয়েছিলাম, লােকগুলাে খুব বলিয়ে-কইয়ে হবে। চেহারায় বুদ্ধির ছাপ থাকবে। এঁদের মধ্যে সেসব কিছুই দেখলাম না। নেহাতই নিরীহ চেহারা। ওস্তাদ বলেছিল, ওর বয়স ৩২। আমার মনে হলাে, কমিয়ে বললেও ৩৫ বছরের বেশি কিছুতেই নয়। সবচেয়ে ছােট যে তার বয়স ১৮ থেকে ২০।
ওস্তাদ তার জবানবন্দী শুরু করল। বাবু, আপনারা বিশ্বাস করুন, আমরা কেউ রিকশা চালাতাম, ট্রাকে মাল বােঝাইয়ের কাজ করতুম, কেউ গুদামে কাজ করতুম। হাঙ্গামার পর থেকে কাজকর্ম বন্ধ হয়েছিল।
ক্যাপ্টেন ইলিয়াসের হুকুমে সব থানা থেকে ওয়ারেন্ট যেতে শুরু করল। সে আপনারা বিশ্বাস করবেন, ওয়ারেন্ট শুনলে থানায় বড় বাবুর কাছে ছুটে যাবেন কেউ এমন নেই। না গেলে প্রাণে বাঁচা দায়, মেয়েবৌয়ের ইজ্জত বাঁচানাে দায়। আমরাও থানায় হাজিরা না দিয়ে পারিনি।
থানার বড়বাবু কয়েদগাড়ি করে আমাদের এক জায়গায় পাঠিয়ে দিলেন। রাজশাহীর সায়েন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে। হ্যা, বাবু, সেই বাড়িটাতে এখন শুধু ট্রেনিং হয়। আমরা ১৩৮ জন ট্রেনিং নিয়েছি সেখানে। দু মাস ট্রেনিং।
এই ১৩৮ জনের মধ্যে ৫৮ জন হলাে মুসলিম লীগ আর জামাতে ইসলামের লোেক। বাকি সব আমাদেরই মতাে। জোর করে, ভয় দেখিয়ে, বােনের ইজ্জত, বৌ-এর ইজ্জত নেওয়া হবে বলে ভয় দেখিয়েছে।
হ্যা, বাবু, শুধু থানার বড়বাবু, পাঞ্জাবী মুসলমান নয়, শান্তিকমিটির চেয়ারম্যান নিজে সিপাই নিয়ে গিয়ে কত লােককে ধরে নিয়ে এসেছে। মিলিটারির লােকেরা কথা বলে উর্দুতে। আমরা মাঝে মাঝে যখন ট্রাকে করে টাউনে যেতাম তখন একটু-আধটু উর্দুতে কথা বুঝতুম। কিন্তু মিলিটারিদের কথা বুঝতে পারতুম।
দু-মাস ট্রেনিংয়ের সময় যারা ওদের কথা বুঝতে পারেনি তারা মার খেয়েছে, রাইফেলের বাঁট দিয়ে ঘা দিয়ে, চুল ধরে টান দিয়েছে।
দু-মাস ট্রেনিং, যেন দু-মাসের কয়েদ। যে রাইফেল দেখলে আমরা ভয়ে পালাতুম সেই রাইফেল থেকে গুলি ছুঁড়তে হয়, তাও শিখিয়েছে। আর শিখিয়েছে দু-তিন জাতের মাইন কি রকম করে ব্যবহার করতে হয়। আর শিখিয়েছে এল এম জি, স্টেনগান, হ্যান্ড মাইন, অ্যান্টি পারসােন্যাল মাইনের ব্যবহার।
দু-মাস ট্রেনিং-এর সময় মাসে মাইনে পেতুম ৪৫ টাকা করে। দুবেলা খাওয়া দিত শান্তি কমিটি।
একদিন হঠাৎ বলল, আমাদের ছ-জনকে হিন্দুস্থানে যেতে হবে। কাজ হলাে, রেল লাইনে, বড় বড় রাস্তায়, সেতুতে মাইন বসিয়ে রেখে সব বরবাদ করে দিতে হবে হিন্দুস্থানের। হিন্দুস্থান আমাদের শত্রু।
ওই কয়েদখানা থেকে ছাড়া পাবার আনন্দে আমরা রাজি হয়ে গেলুম। অবশ্য রাজি না হলে আমাদের মেরে ফেলত।
হিন্দুস্থানে আসার দিনও দেখেছি, বাবু, শরীরে আপনার রক্তমাংস থাকতে সইতে পারবেন না। রাজশাহীর দুর্গাপুরে মিলিটারি কুকুর-বেড়ালের মতাে মানুষকে মেরেছে যেমন করে আড়তে বস্তার ওপর বস্তা পড়ে থাকে তেমনি লাসের ওপর লাশ পড়ে আছে, কুকুর-শকুনদের খেয়ে খেয়ে অরুচি ধরে গেছে। মিলিটারিরা মা বােনেদের ধরে নিয়ে গিয়ে ইজ্জত নিয়েছে, তারপর খুন করে রাস্তায় ফেলে দিয়ে গেছে।
মিলিটারিগুলাের ভয় শুধু মুক্তিবাহিনীর নামে। রাত্রে মিলিটারিরা রাস্তায় বের হয় না। তবে কী জানেন, আমরাও কেউ কোনদিন চিনতে পারিনি মুক্তিবাহিনীর লােককে, কিন্তু মিলিটারির ওপরওয়ালাদের কথাকার্তা শুনে বুঝতে পারতুম, মুখে যাই বলুক না কেন, খানেদের দিন শেষ হয়ে আসছে, ওদের সব সময় চোখ মুখে ভয় জড়িয়ে থাকতাে। তাই কাউকে বিশ্বাস করতাে না। কিন্তু আমাদের অবিশ্বাস করেনি ততটা।
বিশটি টাকা, এই হিন্দুস্থানের টাকা দিয়ে একদিন ওরা আমাদের একটা নৌকোয় উঠিয়ে দিল। তখন আল্লার নামে মনে মনে বললুম, আল্লা, আমাদের তুমি বাঁচাও।
দু রাত্তির কাটিয়ে পয়লা তারিখে আমাদের সেই সায়েন্স রিসার্চ ল্যাবরেটরিতে পৌছােবার কথা। জানি না বাবু, জঙ্গীখানেরা এখানকার খবর পেয়েছে কি-না।
সূত্র: সপ্তাহ, ১৯ নভেম্বর ১৯৭১