পাগলের পাল্লায় ভারত বিমান
বােম্বেটেদের গ্রেপ্তর করেছে পাক-পুলিশ। খবরটি রটিয়েছে ইয়াহিয়ার বেতারযন্ত্র। গত তিরিশে জানুয়ারী শ্রীনগর থেকে জম্মুতে উড়ে যাচ্ছিল একটি যাত্রীবাহী ভারতীয় বিমান। আকাশপথে ওটা দখল করে দুজন কাশ্মীরী বােম্বেটে। বিমানটি নামে লাহােরে। সাড়া পড়ে যায় গােটা পাকিস্তানে। উল্লাসে নৃত্য করতে থাকেন ভুট্টো। তারপর বােম্বেটেরা পুড়িয়ে দেয় বিমানটিকে। তারা পায় পাকিস্তানে রাজনৈতিক আশ্রয়। সরকারি পৃষ্ঠপােষকতায় বােম্বেটেদের প্রদাৰ্পণ এবং ধ্বংসপ্রাপ্ত বিমানের ক্ষতিপূরণ। ইসলামাবাদের চোখের সামনে নয়াদিল্লী তুলে ধরেন আন্তর্জাতিক বিধি। ইয়াহিয়া আনন্দে গদগদ। তিনি গ্রাহ্য করেন নি ভারতের প্রতিবাদ। গর্জে উঠেন শেখ মুজিবর রহমান। ইসলামাবাদের বেহায়পনা ভাল লাগে নি তার। তিনি চাইলেন ঘটনা সম্পর্কে নিরপেক্ষ তদন্ত। নয়াদিল্লী প্রতিশােধ নিলেন। তারা ভারতের আকাশপথে সব রকমের পাক-বিমান চলাচল বন্ধ করে দিলেন। ফ্যাসাদে পড়ল পাকিস্তান। সিংহল ঘুরে যেতে হয় তাদের পূর্ব বাংলায়। তাতে খরচ বড় বেশী।
আন্তর্জাতিক বিমান চলাচল সংস্থার নালিশ জানাল পাকিস্তান। সুবিধা হল না কিছু। এ সংস্থার টোকিও কনভেশন ভেঙ্গেছেন ইসলামাবাদ। বিমান বােঘেটেদের আশ্রয়দান টোকিও কনভেনশন-বিরােধী। এদিকে রাজনৈতিক ঝড়ের সম্ভাবনা দেখা দিল পূর্ববাংলায়। মুজিবরকে কিছুতেই ক্ষমতায় আসতে দেবেন না ভুট্টোইয়াহিয়া এবং তাদের সামরিক চক্র। প্রকাশ্যে চলছিল আপােষ আলােচনা। গােপনে চলছিল বাঙালী নিধনের ব্যাপক আয়ােজন। ভারতের আকাশপথ নিষিদ্ধ। বাধ্য সুরতিক্রম্য। সুতরাং দাগী-চোরের দরকার পড়ল সাধু সাজার। আগেভাগেই বসেছিল একটি তদন্ত কমিশন। একজন হাইকোর্ট জজ হলেন তার প্রধান। বাংলাদেশের হাইকোর্ট জজদের দৃশ্য দেখে এই জজ সাহেবও হয়ত রাত্রে নিজের নাড়ী টিপতেন। পরখ করতেন, তিনি বেঁচে আছেন কিনা। কমিশন রায় দিলেন ভারতীয় বােম্বেটেগিরির জন্য ভারতই দায়ী, পাকিস্তান নয়। গভীর ষড়যন্ত্র এটেছিলেন নয়াদিল্লী। তাঁরই আকাশপথে বােম্বেটেগিরি করিয়েছিলেন এবং বিমানটিকে লাহােরে নামিয়েছিলেন। তাঁদের উদ্দেশ্য—পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ববাংলার মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি। আর আর্থিক দিক থেকে ইসলামাবাদের ক্ষতিসাধন। ভারতের আকাশপথে পাক-বিমান চলাচল নিষিদ্ধকরণ এই ষড়যন্ত্রেরই পরিণতি।
চমৎকার সিদ্ধান্ত। বােম্বেটেরা রাতারাতি হয়েছিল মুক্তিযােদ্ধ। আবার রাতারাতি তারা বনে গেল আসামী। সবই ধাপ্পা। হাইকোর্টের জজ তাে নিজের মাথা বাঁচালেন। কিন্তু ভুট্টো-ইয়াহিয়া বাচবেন কি করে? ঘটনার সূত্রপাতেই ওরা যে বগল বাজিয়ে নাচলেন তার কৈফিয়ৎ কি? নয়াদিল্লীর ষড়যন্ত্রের দোসর কি ছিলেন ভুট্টো নিজে? তার গােপন কথাবার্তার পর বােম্বেটেরা পুড়িয়ে দিয়েছিল ভারতীয় বিমান। পাকিস্তানের যােগসাজস যদি নাই থাকবেন তবে বিমানটি ফিরিয়ে দিতে বাধা ছিল কোথায়? আন্তর্জাতিক রীতি কি ইয়াহিয়া জানতেন না? বােম্বেটেদের রাউলপিন্ডিতে গােপন শিক্ষনবীশী করেছিল। পাক সরকারই তাদের পাঠিয়েছিলেন কাশ্মীরে। এ ধরনের শিক্ষা কেন্দ্রের অস্তিত্বের আঁচ পেয়েছিলেন নয়াদিল্লী। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসে ভারত তার উদ্বেগের কথা জানিয়েছিল পাকিস্তানকে। বােম্বেটেরা লাহােরে নেমে খোজ করেছিল তাদের পরিচিত উচ্চপদস্থ পাক অফিসারদের। ক’মিনিটের মধ্যেই সাড়া পেয়েছিল ওরা। পাক-বেতারের মতে, তিরিশে জানুয়ারী থেকে ফেব্রুয়ারী দু তারিখ পর্যন্ত মুক্তিযােদ্ধারা ছিল লাহােরে নামা ভারতীয় বিমান। প্রত্যক্ষদর্শী এবং বিমানযাত্রীরা তাদের দেখেছেন লাউঞ্জে পুলিশের সাথে কথাবার্তা বলতে। আসলে ওরা থাকত হােস্টেলে। সময়মত এসে বসত বিমানের এই লােকচুরি খেলার মদৎ দিতেন পাক কর্তৃপক্ষ।
বাংলাদেশ এখন স্বাধীন। তুমুল লড়াই চলছে সেখানে গণহত্যা, নারী ধর্ষণ, লুঠতরাজ এবং ধ্বংসলীলা—কিছুই বাদ দিচ্ছে না ইয়াহিয়ার ঘাতকবাহিনী। বাঙালী যে এমন একটা কান্ড করে বসবেন তা স্বপ্নেও ভাবেন নি ইসলামাবাদের ফ্যাসিস্তরা। অর্থভান্ডর নিঃশেষ হয়ে আসছে, দুনিয়ার চারদিকে উঠছে। অজস্র ধিক্কার। স্বাধীন বাংলাদেশ আজ বাস্তব ঘটনা। দু’দিন আগে হােক, আর পরেই হােক বিভিন্ন রাষ্ট্রের কূটনৈতিক স্বীকৃতি সে পাবেই। লক্ষাধিক নরনারী এবং শিশুকে ইতিমধ্যেই খুব করেছেন ইয়াহিয়া খান। তার তিনগুণ হয়েছেন নিরাশ্রয়। পাকিস্তানের রাজনৈতিক আকাশে দেখা দিচ্ছে মেঘ পাক ঘাতকরা বাংলাদেশে এসেছিল মারতে, মরতে নয়। মরার পালা শুরু হতেই পশ্চিমে দানা বাধছে অসন্তোষ তার উপর আবার আন্তর্জাতিক চাপ। হালে পানি পাচ্ছেন না ইয়াহিয়া। বিকার রােগীর প্রলাপযন্ত্র পাক-বেতার আবােল-তাবােল বকছে। রােজই বলছে, বাংলাদেশ শান্ত। তারপরই সৈন্যবাহিনীর অগ্রগতির সংবাদ। কাজকর্ম স্বাভাবিক। কিন্তু কর্মীদের হাজির হবার জন্য প্রতিদিন তাগিদ। কঠোর শাস্তির হুমকী। এই উম্মাদদের নিয়ে মাথা থামান অর্থহীন। আজ ওরা বলছে বিমানে বােম্বেটেগিরির জন্য দায়ী ভারত। কাল হয়ত ওদের মত পাল্টাবে। তখন হয়ত ইসলামাবাদ প্রচার চালাবেন—আগের কথাগুলাে ঠিক নয়। সব ঝুটা। আসল আসামী—শেখ মুজিবর রহমান। এই নরঘাতী শয়তান এবং জানােয়ার দলকে নীতি কথায় শুধরান যাবে না। ওদের ঢিট করতে হলে দরকার চাবুক। ওটা পিঠে পড়লেই ঘেউ ঘেউ আওয়াজের বদলে শােনা যাবে কেউ কেউ আর্তনাদ। তখনই শুরু হবে মানুষের পর্যায়ে ইসলামাবাদের রূপান্তরের প্রথম পর্যায়।
সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৩ এপ্রিল ১৯৭১