You dont have javascript enabled! Please enable it!

সাতই মে গুরুত্বপূর্ণ দিন

প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী লােকসভার বিরােধী দলগুলাের নেতাদের বৈঠক ডেকেছেন। আগামী সাতই মে সকালে তিনি তাদের সঙ্গে আলােচনায় বসবেন। বাংলাদেশের অবস্থা নিঃসন্দেহে প্রাধান্য পাবে। গত এপ্রিল মাসের পয়লা তারিখ সংসদ নিয়েছিলেন সর্বসম্মত প্রস্তাব। তাতে তারা মুক্তিযােদ্ধাদের দিয়েছেন অকুণ্ঠ সমর্থন। ও’দের চূড়ান্ত জয় সম্পর্কে নেই তাদের কোন সংসয়। তারপর এক মাস চলে গেছে। ইয়াহিয়ার গণহত্যা বন্ধ হয় নি। লড়াইয়ের বিরাম ঘটেনি। দশ লক্ষ শরণার্থী ভীড় করেছেন ভারতের সীমান্ত অঞ্চলে। তাদের আসার বিরাম নেই। পাকিস্তানিরা হানাদারী চালাচ্ছে ভারতীয় এলাকায়। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠিত হয়েছে পূর্ব বাংলায়। গ্রামাঞ্চলের অধিকাংশ ভূমি তাদের দখলে। কলকাতায় পাক ডেপুটি হাইকমিশন রূপান্তরিত হয়েছে বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনে। পাক-ভারত উত্তেজনা বাড়ছে। উভয় দেশের কূটনৈতিক সম্পর্ক প্রায় অচল অবস্থায় পৌঁছেছে। বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে স্বীকৃতি দানের প্রশ্ন ঝুলছে। জনসাধারণ অধীর হয়ে উঠেছেন। এসময়ে বিরােধী দলগুলাের নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের আহ্বান খুবই সময়পােযােগী।
বাংলাদেশের সমস্যার সঙ্গে ভারত ওতপ্রােতভাবে জড়িত। তার ঘাড়ে লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর বােঝা চাপিয়ে দিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার সৈন্যদলের সীমান্ত পাঁয়তারা উদ্বেগজনক। সমস্যাটি কেন্দ্রীয় সরকারের একার নয়। ওটা জাতীয় সমস্যা গত পয়লা এপ্রিল সংসদে সর্বসম্মত প্রস্তাব গ্রহণের আগে প্রধানমন্ত্রী শ্ৰীমতী গান্ধী বিরােধী দলগুলাের নেতাদের সঙ্গে খােলাখুলি পরামর্শ করেছিলেন। সংসদীয় গণতন্ত্রে এটা শুভ লক্ষণ। স্বৰ্গত নেহরু এবং লালবাহাদুর শাস্ত্রী এধরনের ঐতিহ্য রেখে গেছেন। বৃটেনেও এই রীতি প্রচলিত। ১৯০৬ সালে ঘটেছিল তার ব্যতিক্রম। সুয়েজ অভিযানের আগে সেদিনের প্রধানমন্ত্রী ইডেন নেন নি বিরােধী দলনেতাদের মতামত। তা নিয়ে সমালােচনাও বড় কম হয় নি। বাংলাদেশের সরকারকে স্বীকৃতি দানের দাবী উঠেছে ভারতের সর্বত্র। লােকসভার বিরােধী দলনেতারাও এ দাবীতে সােচ্চার। কেন্দ্রীয় সরকার এতদিন করেছেন অবস্থার মূল্যায়ন। বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের সঙ্গে রেখেছেন ঘনিষ্ঠ যােগাযােগ। আর বেশীদিন চুপ করে থাকা চলে না। তাদের একটা সিদ্ধান্ত নিতেই হবে। বিলম্বিত পদ্ধতির পরিণাম মারাত্মক হতে পারে। নয়াদিল্লী যাই করুন না কেন তার অংশীদার হবেন সব বিরােধী দল। বাংলাদেশ সম্পকে কেন্দ্রীয় সরকারের পদক্ষেপ সর্বসম্মত হওয়াই বাঞ্ছনীয়। কারণ তার সঙ্গে জড়িত জাতির ভবিষ্যৎ এবং বাংলাদেশের গণতন্ত্রের জয়যাত্রা।
বাংলাদেশ ঘিরে যেসব জটিল সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তার যথাযথ উপলব্ধি অবশ্যই করেছেন বিরােধী দলগুলাের নেতারা। ইয়াহিয়ার জংলী শাসন যত সম্প্রসারিত হবে ভারতে শরণার্থীর সংখ্যা তত বাড়বে। স্বদেশে তাদের প্রত্যাবর্তনের পথ সুগম করতে হলে দরকার মুক্তিফৌজের ত্বরিত সাফল্য। বাংলাদেশের সরকার অবিলম্বে স্বীকৃতি না পেলে এবং তাঁদের সৈন্যদলের হাতে আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র না পৌছলে যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হতে বাধ্য। এ অবস্থায় লক্ষ লক্ষ শরণার্থী নিয়ে কি করবেন কেন্দ্রীয় সরকার? সীমান্তের ঠিক ওপারে ঘাঁটি গেড়ে বসবে ভারত বিদ্বেষী স্বৈরতন্ত্র। পদে পদে ঘা খাবে ভারতের নিরাপত্তা ব্যবস্থা। শেষ পর্যন্ত লেজে গােবরে একাকার হবেন নয়াদিল্লী। বিদেশী রাষ্ট্রগুলাের প্রতিক্রিয়া অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। তারা যদি বাংলদেশে সম্পর্কে ভারতের প্রগতিবাদী চিন্তাধারার সঙ্গে একমত হন, ভার কথা। না হলে নিজের পথ বেছে নিতে হবে শ্রীমতী গান্ধীকে। তাতে ঝুঁকি অনেক। এই জন্যই দরকার বিরােধী দলনেতাদের সঙ্গে আলাপ আলােচনা এবং পাকিস্তানের মােকাবিলায় জাতীয় সংহতি রক্ষার আন্তরিক আগ্রহ। ভাবাবেগের পর্যায় শেষ হয়ে গেছে। কঠিন বাস্তব এসে পড়েছে জাতির সামনে। সংসদের প্রস্তাবে “পূর্ব পাকিস্তান” হয়েছে “পূর্ব বাংলা”। পূর্ব বাংলা সরকারিভাবে বাংলাদেশে পরিণত হয় কিনা তা দেখার জন্য ভারতীয় মাত্রই উৎসুক। আগামী সাতই মে একটা গুরুত্বপূর্ণ দিন। সবাই চেয়ে আছেন এই দিনটির দিকে। এদিনের সিদ্ধান্ত হয়ত প্রতিফলিত হবে লােকসভার পরবর্তী অধিবেশনে। আগামী চব্বিশ মে এই অধিবেশন শুরু হবার কথা। জনতার ধৈর্যের বাধ ক্রমেই ভেঙ্গে পড়ছে। আর অপেক্ষা নয়। আগামী সাতই মে এবং তার পরবর্তী ক’দিনের মধ্যে সব দ্বিধা সঙ্কোচের অবসান ঘটুক। জনসাধারণ জনুন—বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তারা দাঁড়িয়ে আছেন কোথায়?

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ৪ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!