ধীরেন্দ্রনাথ দত্ত
একদা অবিভক্ত ভারতের ও পরে পাকিস্তানের একনিষ্ঠ সেবক, অশীতিপর বৃদ্ধ প্রবীণ রাজনীতিক-নেতা শ্রীধীরেন্দ্রনাথ দত্তকেও পাকিস্তানের সামরিক প্রশাসক ইয়াহিয়া খা লেলানাে ক্ষিপ্ত কুকুরদের বর্বরতার শিকার হইতে হইয়াছে। তাহার কুমিল্লাস্থ বাসভবন হইতে টানিয়া আনিয়া তাহাকে যে-ভাবে হত্যা করা হইয়াছে এবং হত্যার পরেও তাহার মৃতদেহের প্রতি যে আদিযুগীয় ঘৃণ্য আচরণের পরিচয় হত্যাকারীরা দিয়াছে তাহাতে সভ্য জগতের বিবেক বলিয়া কিছু থাকিলে তাহা শিহরিত হইয়া উঠা উচিত। উচিত মুহূর্তমাত্র বিলম্ব না করিয়া এই বর্বরতার অবসানের জন্য অগ্রসর হওয়া। ধীরেন্দ্রনাথ কে ছিলেন, কী ছিলেন তাহা বর্বরতায় উন্মত্ত, রক্তপিপাসু পাক-প্রশাসক বা তাহার প্রেরিত বন্য কুকুরের দল কেহই বােধ হয় জানার প্রয়ােজন অনুভব করেন নাই। রাষ্ট্রগুরু সুরেন্দ্রনাথের যিনি রাজনীতিক শিষ্য ছিলেন, প্রথম যৌবন হইতেই যিনি ছিলেন কংগ্রেসের সেবক, মহাত্মা গান্ধীর নেতৃত্বে পরিচালিত কংগ্রেসের আহ্বানে যিনি আইন ব্যবসায় ত্যাগ করিয়া দেশসেবায় আত্মনিয়ােগ করিয়াছিলেন, আর দেশসেবার পুরস্কার-স্বরূপ যাহাকে সশ্রম কারাদণ্ড ভােগ করিতে হইয়াছিল, যিনি পরাধীন ভারতেও বাংলার আইনসভায় কংগ্রেস-সদস্যরূপে নির্বাচিত হইয়াছিলেন এবং ভারতের গণপরিষদের সদস্য ছিলেন।
গায়ের জোরে পাকিস্তানের সার্বোচ্চ গদিতে অধিষ্ঠিত হঠাৎ-রাজাদের পক্ষে তাহা জানা যে খুবই অস্বস্তিকর। কিন্তু ধীরেন্দ্রনাথের পরিচয়ের এখানেই শেষ নয়। দেশবিভাগের পরেও তিনি তাঁহার জন্মভূমি ত্যাগ করিয়া ভারতে আসেন নাই। জন্মভূমি পূর্বপাকিস্তানের সেবার জন্য সেখানেই থাকিয়া গিয়াছিলেন। সেখানে পাকিস্তান গণ-পরিষদের সদস্য হিসাবে, কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক মন্ত্রী হিসাবে স্মরণীয় কৃতিত্বের সঙ্গে তিনি পাকিস্তানের সেবা করিয়াছেন। তাহা ছাড়া সামাজিক মানুষ হিসাবেও তিনি সম্প্রদায়-নির্বিশেষে পূর্ব-পাকিস্তানের সকল মানুষের সুখদুঃখের সাথী ও বন্ধু ছিলেন। এ-হেন শ্রদ্ধেয় দেশপ্রেমিক মানুষের এই শােচনীয় পরিণতিতে বােধ হয় পাষাণ হইতেও বেদনার ধারা গলিয়া পড়িবে । কিন্তু মরণপণ মুক্তি-সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের মানুষকে দমন করিবার নৃশংস পাক-ক্ষিপ্ততা তাহাকে হত্যার আগে একটাও থমকিয়া দাঁড়ায় নাই। তাহার এই নির্মম পরিণতিতে পাকিস্তান নাহউক, সমগ্র ভারত ও বাংলাদেশ কিন্তু স্তম্ভিত হইয়া যাইবে তাহাদের হৃৎস্পন্দন বন্ধ হইবার উপক্রম হইবে। তাহার শােকার্ত চিত্তে তাহার পবিত্র স্মৃতির উদ্দেশ্যে বিনম্র শ্রদ্ধা নিবেদন করিবেন। তাহাদের সঙ্গে একাত্ম হইয়া আমরাও তাঁহার উদ্দেশ্যে পরম শ্রদ্ধা নিবেদন করি।
আনন্দবাজার : ৮.৪.১৯৭১
Reference:
গণমাধ্যমে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ – মুনতাসীর মামুন