১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ঃ মুজিব পরিবার মুক্ত
ধানমণ্ডির ১৮ নম্বর সড়কের যে বাড়িতে শেখ মুজিবের পরিবারকে অন্তরীন রাখা হয়েছিল, তার পাহারায় ছিল প্রায় এক ডজনের মত পাকিস্তানী বাহিনীর সদস্য, এই দলের প্রধান ছিলেন একজন সুবেদার মেজর। সামরিক আইন প্রশাসক দপ্তরের ব্রিগেডিয়ার কাদিরের অধীনে মেজর হোসেনের দল এই দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন। এদের সাথে ছিল রাইফেল ও হালকা মেশিনগান। ছাদে একটি নীচতলায় একটি এবং গেটে দুটি পোস্টে তারা দায়িত্ব পালন করছিলেন। পালা করে দায়িত্ব পালন করলেও ১৬ ডিসেম্বরের দল আর পরে বদল সম্ভব হয়নি তাই এই দল ১৭ তারিখে দায়িত্ব পালন করে আসছিলেন।
১৬ ডিসেম্বর রাতে এখানে তারা গুলি চালিয়ে একজন মহিলাসহ পাঁচজন মারে। তাদের মেশিনগানের গুলিতে একজন চালক/সাংবাদিক নিহত হয় বাড়ীর গেটের সামনেই গাড়ীতে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ৭৩ ব্রিগেডের ১৪ গার্ড ব্যাটেলিয়ন এর একটি কোম্পানির কম্যান্ডার ছিলেন মেজর তারা। তার ইউনিট ১৬ তারিখ দুপুরেই ঢাকা বিমান বন্দর অবরোধে দায়িত্ব পালন করছিল। মেজর তারা ৪ তারিখে গঙ্গাসাগর যুদ্ধে বীরত্বের জন্য পরে বীরচক্র খেতাব পেয়েছেন । তার ইউনিটের সদস্য নায়েক আলবার্ট এক্কা পেয়েছেন এই অংশের একমাত্র পরম বীর চক্র খেতাব।
বিমানবন্দরে স্থানীয় এক আওয়ামী লীগ নেতা মেজর তারার ব্যাটেলিয়ন কমান্ডার লেঃ কর্নেল বিজয় কুমার চানানার সঙ্গে দেখা করে জানায় পাকিস্তানী সেনারা বঙ্গবন্ধুর পরিবারকে ধানমণ্ডির এক বাড়িতে আটক করে রেখেছে। সেখানে এখনও সশস্র পাকিস্তানী সৈন্য পাহারায় আছে। সময়মত উদ্ধার না করা গেলে সেখানে গুরুতর কিছু ঘটে যেতে পারে। চানানার নির্দেশে মেজর তারা তিনজন সৈনিকসহ ধানমন্ডি রওনা হন। তারা এখানে এসে দেখলেন তিনজন সৈন্য নিয়ে তাদের সাথে লড়ার কোনো সুযোগ নেই, তিনি তার জেসিওকে ডেকে তার হাতের স্টেনগানটা ধরিয়ে দিলেন। তাকে বললেন তাকে কাভার দিয়ে ওয়াল ঘেষে দাঁড়াতে। একটু এগোতেই ছাদের উপর থেকে তাদের উদ্দেশে বলা হলো আর এক পা এগুলেই গুলি করা হবে। তারা পাল্টা জবাব দিলেন যে তিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অফিসার এবং নিরস্ত্র। কথা বলতে চান। এরপর বললেন, ‘আমি আপনার সামনে নিরস্ত্র অবস্থায় পৌছেছি মানেই আপনাদের সেনাবাহিনী আত্মসমর্পন করেছে। বিশ্বাস না হলে আপনার অফিসারকে জিজ্ঞাস করে দেখতে পারেন।’ সেন্ট্রি তাকে হল্ট বলে অপেক্ষা করতে বললো। একটু পর জানালো, আমি তার সঙ্গে কোনো যোগাযোগ করতে পারছি না। তারা পরে জেনেছেন ক্যাপ্টেন পদবীর ওই অফিসার আগেই পালিয়ে যান এবং আত্মসমর্পনের খবর তার অধস্তনরা পায়নি যোগাযোগহীনতার কারণেই।
এসময় মাথার উপর ভারতীয় কিছু হেলিকপ্টার উড়ছিলো। তারা বললেন, দেখো ওপরে আমাদের হেলিকপ্টার, পেছনে দেখো আমার সৈন্যরা দাড়িয়ে। আমার মতো তোমাদেরও নিশ্চয়ই পরিবার ছেলেমেয়ে আছে। তোমরা আত্মসমর্পন করো, আমি নিশ্চয়তা দিচ্ছি তোমরা নিরাপদে তোমাদের ক্যাম্পে বা যেখানে যেতে চাও সেখানে যেতে পারবে। কথাগুলো বলতে বলতে এগোচ্ছিলেন তারা। এমন সময় গেটের ফাক দিয়ে ওই রাইফেলের নলটা তার বুক স্পর্শ করলো। ওই কাপতে থাকা তরুণের চোখে চোখ রেখে ছাদের উপর থাকা হাবিলদারের সঙ্গে কথা বলছিলেন তারা। এমন সময় ভেতর থেকে এক নারীকণ্ঠ ভেসে এলো “If you do not save us, they will kill all of us, we know,” যদি আমাদের না বাচান তাহলে এরা আমাদের মেরে ফেলবে। কথা বলতে বলতে তারা বুকের ওপর চেপে বসা নলটা সরিয়ে দিলেন তারা। তার বুকে কোনো ভয় নেই।
তারা পাকিস্তানীদের অবশেষে বোঝাতে সক্ষম হন। তাদের বেসামরিক পোষাক পড়তে দেওয়া হয় নইলে রাজপথে বাঙালী তরুণদের গুলির মুখে অক্কা পাওয়ার সমূহ সম্ভাবনা। বাড়িতে ঢোকার পর বেগম মুজিব তারাকে জড়িয়ে ধরেন, এবং বলেন, ‘তুমি আমার ছেলে যাকে খোদা নিজে পাঠিয়েছেন।‘’ বাড়ির ভেতরকার দূরাবস্থা জানিয়েছেন তারা। তিনি দেখলেন ঘরে কোনো আসবাব নেই। মুজিব পরিবারের সদস্যরা মাটিতে শুতেন। আর তাদের শেষ ২-৩ দিনের খাবার দাবার বলতে ছিল কিছু বিস্কুট।
মুক্ত হওয়ার পর এই বাসায় দলে দলে বিভিন্ন স্তরের মানুষ দেখা করতে আসেন। ত্রিপুরার একদল সাংবাদিক খবর পেয়ে ছুটে আসেন তাদের দেখতে। এদের মধ্যে অনিল ভট্টাচার্য এবং রবিন সেন গুপ্ত ও ছিলেন। তাদের একজন বেগম মুজিবের একটি সাক্ষাৎকার গ্রহন করেছিলেন। মেজর তারা পরে আর কিছুদিন এই পরিবারের নিরাপত্তা দেখাশুনা করেছেন। পরে বেগম মুজিব তারাকে কিছু উপহার কিনে দিয়েছিলেন। শেখ মুজিব ফিরে এলে তারাকে বাসায় ডেকে পাঠিয়েছিলেন শেখ মুজিব। তাকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছিলেন। শেখ রেহানা অনেকদিন মেজর তারার সাথে পত্র যোগাযোগ রাখতেন। ২০১২ সালে মেজর তারাকে ফ্রেন্ডস অব বাংলাদেশ পদকে ভূষিত করা হয়।