You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.12.16 | আকাশ পথে ২য় দফা পাক সৈন্য পলায়ন - সংগ্রামের নোটবুক

১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ঃ আকাশ পথে ২য় দফা পাক সৈন্য পলায়ন

১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৬ তারিখ ভারতীয় জঙ্গি বিমান তেজগা এবং কুর্মিটোলা বিমানবন্দরে বোমাবর্ষণ করলে বিমানবন্দর ২টি অচল হয়ে যায়। এই রানওয়ে ব্যাবহার করে পাকিস্তানী এফ ৮৬ বিমান উড্ডয়ন সম্ভব ছিল না। কমোডোর এনাম তার বিমান বাহিনী (১৪ স্কোয়াড্রন)পরিতেক্ত ঘোষণা করেন। সকল পাইলট, ক্রু্‌, ইঞ্জিনিয়ারদের বিশেষ ফ্লাইটে বন্ধু (বার্মা)দেশের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠিয়ে দেন। পূর্ব পাকিস্তানে একমাত্র সিভিল বিমান অটার মজুদ ছিল। সেটা নিয়েই ৮ তারিখ(৯) ভোর ৩টায় বিমান রওয়ানা দেয় বিমানের ক্যাপ্টেন ছিলেন দারা এবং ফার্স্ট অফিসার জিয়া। রানওয়েতে ক্ষত থাকা সত্ত্বেও বিমানটি উড়ার জন্য প্রায় ১ কিমি দৌড়াতে হয়। বিমানে আতা শামস সহ অন্য পাইলট ইঞ্জিনিয়ার ছিল। পরদিন কৃষি বিভাগের বিভারে করে আর ৪ জন আকিয়াব পৌঁছেন। বিমানে কৃষি বিভাগের পাইলট জাফর ও স্কোয়াড্রন লিডার দেলওয়ার কো পাইলট হিসাবে ছিলেন। অন্ধকারে বিমান সেনারা ম্যানুয়াল টর্চ দিয়ে আলো জালিয়ে বিমান উড্ডয়নের ব্যাবস্থা করেন। জাফরের রাত্রিকালিন উড্ডয়নের প্রশিক্ষন ছিল না। বিমানটি উড্ডয়ন কালে সামান্যর জন্য বন্দরের এটিসি ভবনে আঘাত থেকে বেচে যায়। এ অবস্থায় বাকি পথে স্কোয়াড্রন লিডার দেলওয়ার বিমানের নিয়ন্ত্রন নিয়ে চালিয়ে নেন। আকিয়াব কতৃপক্ষ বিমানটি অবতরনের অনুমতি না দেয়া সত্ত্বেও বিমান অবতরন করানো হয় এবং আগের দিন আসা অটার বিমানের সামনে পারকিং করা হয়। কিছুক্ষন পর বার্মিজ সেনারা আসে এবং তাদের নিয়ে যায় জিজ্ঞাসা বাদ করে। ১৪ তারিখে ২টি অটার বিমান নিয়ে মেজর পেটট্রিক আকিয়াব পাড়ি দেন । লে কর্নেল লিয়াকত বুখারি ১৯৭১ সনের জানুয়ারী থেকে ৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত চার আর্মি এভিয়েশন ঢাকার প্রধান কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ঐ সময়ে তার অধীনে ৩টি সি ১৩০ কার্গো বিমান, মাত্র ৩টি পুরাতন এম আই ৮ হেলিকপ্টার, ১টি বেভার এবং ৩ টী এলুয়েট-৩ হেলিকপ্টার ছিল। এলুয়েট-৩ এর ভ্রমন ক্ষমতা একটু কম ।

আকিয়াব পৌছতে হলে পথে তার আরেকবার জ্বালানী নিতে হবে। ১৬ ডিসেম্বর চট্টগ্রাম কক্সবাজারের পতন হয়ে গেলে জ্বালানী নেয়া কষ্টকর হবে। ২টি এলুয়েট-৩ ১৬ ডিসেম্বর সকালের ট্রিপ এর জন্য রেখে বাকি ৪টা নিয়ে পলায়ন পরিকল্পনা নেয়া হয়। সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টায় মেজর বুখারি তার নির্ধারিত মিশন হটাত করে বন্ধ করে ফেরত আসেন। মেজর বুখারি হেলিকপ্টারটি ১৯ সিগন্যাল ব্যাটেলিয়নে অবতরণ করান। মেজর বুখারি নিয়াজির কাছে পলায়নের অনুমতি চাইলে নিয়াজি গূল হাসানের পরামর্শ নিতে বলেন। জেনারেল গূল হাসান পলায়নের অনুমতি দেন। অ্যাডমিরাল শরীফ পলায়নের সিদ্ধান্ত সমর্থন করেন। গুল হাসান রাজির পর জেনারেল নিয়াজি রাজি হলেন এবং বুখারিকে আদেশ দিলেন, আহত মেজর জেনারেল রহিমকে সঙ্গে নিয়ে যেতে। রহিম চাদপুরের মুজাফফরগঞ্জে আক্রমনের শিকার হয়েছিলেন পরে চাদপুর থেকে পলায়নের সময় মেঘনা নদীতে ভারতীয় মিগ ২১ এর আক্রমনের শিকার হন। তিনি ইপিআর হাসপাতালে চিকিৎসা শেষে সিএমএইচএ ভর্তি হন সেখান থেকে ফিরে তিনি রাও ফরমানের বঙ্গভবনের বাসায় অবস্থান করছিলেন। মেজর জেনারেল রহিমের সঙ্গে ইসলামাবাদ নিয়ে যাওয়ার জন্য কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র পাঠানোর সিদ্দান্ত হয়। একই সময়ে সিএমএইচএর ৮ জন নার্স ও ২৮ টি পরিবার কে নিয়ে যাওয়ার সিদ্ধান্ত হয়। এমআই ৮ এর ধারণ ক্ষমতা ছিল ৩ জন ক্রু ও ৮ জন যাত্রী (অতিরিক্ত তেল সহ) । ৩টি এমআই ৮ ও ১ টি এলুয়েট-৩ আর্মি গলফ মাঠে সন্ধ্যায় পার্ক করা হল। বুখারি,মেজর তৌহীদ, মেজর জরীফ, মেজর ঈজাজ্, মেজর জহুর আহমেদ(রাও ফরমানের ভাগিনা), মেজর মাসু্‌দ , মেজর সগী্‌র , মেজর বাজওয়া্‌,মেজর নোমান মেজর ইজাজ মিনহাস, স্কোয়াড্রন লিডার সুলতান ও রশিদ কে সাথে নিলেন। গলফ মাঠে যথারীতি হেলিকপ্টারে যাত্রী উঠানো হল।

ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখার জন্য যাত্রীদের মালামাল খাবার নিতে দেয়া হয়নি। তবে যাত্রীদের প্রায় সকলেই চোরাই টাকা সঙ্গে নিয়াছিলেন। মহিলাদের আগে উঠানো হল। নার্সরা প্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও গাইডের অভাবে তাদের সাথে যুক্ত হতে পারেনি বা সময়মত আসতে পারেন নি। ১৬ ডিসেম্বর ভোর ৩টা থেকে প্রতি ৫মিনিট অন্তর হেলিকপ্টার গুলি ঊড়াল দিল । কক্সবাজার পর্যন্ত ৫০০ ফূট নীচ দিয়ে তার পরে ৮০০ ফূট উচ্চতায় উড়েন। নারায়ণগঞ্জকে বাদ দিয়ে কুমিল্লা ফেণী চট্টগ্রাম হয়ে আড়াই ঘণ্টায় তারা আকিয়াব পৌছে । কৃষি বিভাগের ২টি বেভার বিমান একই সময়ে উড়ান দেয়।একটা বেভার স্থল গুলীর শিকার হয় গুলীটা লেজে লাগে তবে হেলিকপ্টার নিরাপদে আকিয়াব পৌছে। ভোর পাঁচটা পনেরো মিনিটে তারা নাফ সীমান্ত অতিক্রম করেন। এর পনেরো মিনিট পরে তারা আকীয়াব পৌঁছেন। ৬ টি হেলিকপ্টারে ১২৩ জন যাত্রী ছিল। যাত্রীদের মধ্যে যারা ছিলেন তারা হলেন লে জেনারেল আলী কূলী, কর্নেল সুলাইমান ,মেজর আকরাম, বার্মিজ মেজর মোস্তফা কামাল (ঘটনাক্রমে মুসলমান মেজর ছিল) তাদের স্বাগত জানান এবং নিকটতম রেস্ট হাঊজে নিয়ে যান । ১৬ ডিসেম্বর ১৯৭১ বেলা ১টা ৫ মিনিটে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর শেষ ২টি এলুয়েট-৩ হেলিকপ্টার ঢাকা তেজগা এয়ারপোর্টের কাছ থেকে উড়ে । এলুয়েট-৩ এর উড্ডয়ন ক্ষমতা কম। পথে হেলিকপ্টারে জ্বালানী সমস্যা দেখা দেয়। হেলিকপ্টার বার্মিজ সীমান্তে গভীর জঙ্গলে অবতরণ করে। সেখানে মেরামত শেষে আকিয়াব রওয়ানা হয় পথে একটি জলাশয় দেখে তার কাছে হেলিকপ্টার অবতরন করে। এই সময়ে অস্র গোলাবারুদ কাগজপত্রও ইত্যাদি সেখানে ফেলে দেয়া হয়। তার পর তারা আকিয়াব রওয়ানা হয়। তারা পৌঁছার পর তাদের আগে আসা সহকর্মীদের বাস ভবনে নেয়া হয়।।

এই হেলিকপ্টারের পাইলট ছিলেন মেজর মোহাম্মদ জারিফ বাঙ্গাশ, মেজর তোহিদ উল হক, এভিয়েশন ইঞ্জিনিয়ার মেজর ইজাজ মিনহাজ ও পাকিস্তান এয়ার ফোর্সের একজন স্কোয়াড্রন লিডার। আকীয়াব পৌঁছার ১ ঘণ্টার মধ্যে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত তাদের দেখাশুনার জন্য রেঙ্গুন থেকে আসেন ।যাত্রীদের পৃথক করার পর সামরিক লোক দের নেভাল বেজ এ নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করা শেষে তাদের বাংলোতে ফেরত পাঠানো হয়। বার্মিজ আর্মি তাদের ভালো আদর আপ্যায়ন করেন। সেখানে তারা বার্মিজ খাবারে অভ্যস্ত না থাকায় খাওয়ার সমস্যা হচ্ছিল এ সময়ে কিছু মুসলিম তাদের বেশ কয়েকদিন খাওয়ার ব্যাবস্থা করে। ২৬ ডিসেম্বর তাদের একটা অংশকে রেঙ্গুন হয়ে কলম্বো হয়ে করাচী পাঠানো হয়। সকল বিমান ও হেলিকপ্টার মান্দালয় পাঠাণো হয় । মান্দালয় থেকে পাইলটদের বার্মিজ বিমান বাহিনীর বিমানে করে রেঙ্গুন নিয়ে দূতাবাসে তাদের হস্তান্তর করা হয়। তাদের একটি বাংলোয় রাখা হয় যেটি একটি বাঙালী প্রথম সচিবের যিনি পক্ষ ত্যাগ করে বাংলাদেশের পক্ষে অবস্থান নিয়েছিলেন। বার্মায় ২-৫ সপ্তাহও অবস্থান কালে তারা আনন্দ ও ফুর্তিতে ছিলেন।

এ সময়ে দুতাবাস থেকে তাদের হাত খরচও দেয়া হয়। ১৩ জানুয়ারি বার্মা বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেয়ার পর পাকিদের প্রতি বার্মিজ অবস্থানের পরিবর্তন হয়। বার্মিজরা পাকিস্তানী বিমান হেলিকপ্টার শিপিং এর মাধ্যমে নিতে বাধা দেয়। তারা জানায় এগুলি চীনের কুনমিং নিতে। পরে আবার সিদ্ধান্ত পরিবর্তন করে বলে ব্যাংকক দিয়ে নিতে। বিমান গুলি চীনের উপর দিয়ে, এমআই হেলিকপ্টার ব্যাংকক দিয়ে জাহাজে করে এলুয়েট-৩ রেঙ্গুনে জাহাজে করে নেয়া হয়। কর্নেল সুলাইমান ২য় কমান্ডো ব্যাটালিয়ন এর কমান্ডিং অফিসার ছিলেন। ১৬ ডিসেম্বর নিয়াজির আত্মসমর্পণ সুলেমান মেনে নেননি তিনি পলায়নের সিদ্দান্ত নেন। নিয়াজি তাকে পালাতে নিষেধ করেছিলেন। তার টু আইসি ছিলেন মেজর পিডি খান। তিনি হাঁটুতে এবং ঘাড়ে গুরুতর আঘাত নিয়ে সিএমএইচএ ভর্তি ছিলেন। সুলাইমান সেখানে যান এবং পিডি খানকে তার সাথে যেতে বলেন। পিডি যেতে সম্মত হন নাই এই ভেবে যে তাকে নিয়ে তাদের যাত্রা বিঘ্নিত হতে পারে। সুলাইমান জোর করে তাকে কাধে করে রওয়ানা হন। পিডি পরে মেজর জেনারেল হয়েছিলেন। তিনি অন্যান্যদের সাথে বার্মা হয়ে পাকিস্তান পৌঁছেন। ১৯৭১ এ বার্মার ভুমিকা পাকিস্তান কৃতজ্ঞ ভরে স্মরণ করে। এরই ফলস্রতিতে সাম্প্রতিক সময়ে উভয়দেশ একাধিক প্রতিরক্ষা চুক্তি করেছে ।