পাকি-গুপ্তচররা এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয় হয়ে উঠেছে
(স্টাফ রিপাের্টার)
পাকিস্তান গুপ্তচর চক্র পশ্চিমবঙ্গে এখন সবচেয়ে বেশি সক্রিয়। অন্তর্ঘাতমূলক কাজ, ভারতবিরােধী গুপ্তচর ও ভারতের প্রতিরক্ষা-ব্যবস্থা সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহ করে চলেছে গুপ্তচররা। পাকিস্তানি গুপ্তচর চক্রের সঙ্গে আরও বেশ কিছু ঈঙ্গ মার্কিন গুপ্তচর চক্রও নানা ছদ্মবেশে পশ্চিমবঙ্গে কাজকর্ম চালিয়ে যাচ্ছে। পাকিস্তানি গুপ্তচর চক্রের বর্তমান মুহূর্তে প্রধান কাজ হয়েছে শরণার্থী শিবিরগুলােতে নানা অসন্তোষের বীজ বপন করা।
এই অশান্তির বীজ বপনের ফলে গত পক্ষকালের মধ্যে লবণ হ্রদ, কল্যাণী, নদীয়া শরণার্থী শিবিরে বেশ কয়েকটি হাঙ্গামা হয়ে গেছে। কোথাও পুলিশকে কঠোর ব্যবস্থা নিতে হয়েছে, কোথাও ত্রাণ দপ্তরকে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হয়েছে। এই গুপ্তচর চক্রের লােকেরা শরণার্থীদের মধ্যে রটনা করছে যে, বাঙলাদেশ স্বাধীন হবার সম্ভাবনা নেই, কাজেই শরণার্থীদের এই দেশেই নাগরিক হওয়ার অধিকার দেওয়া হােক, এইখানেই পুনর্বাসন দেওয়া হােক। কখনও হিন্দু মুসলমান প্রশ্ন, কখনও বাঙলাদেশ সরকার সম্পর্কে প্রশ্ন তুলে ধরা হচ্ছে শরণার্থীদের মধ্যে। ত্রাণ-ব্যবস্থা সম্পর্কেও নানা প্রশ্ন তােলা হচ্ছে। তার মধ্যে প্রধান হলাে বহু বিদেশি রাষ্ট্র আমাদের জন্য এই দিয়েছে, তাই দিয়েছে—অথচ আমরা পাচ্ছি না।
লবণ হ্রদ ও কল্যাণীতে শরণার্থী শিবিরে যে হাঙ্গামা হয়ে গেল তার মূলে ছিল ত্রাণ-দ্রব্য বণ্টন নিয়ে অভিযােগ। আসলে, কতকগুলাে মনগড়া অভিযােগ নিয়ে শরণার্থীদের ক্ষেপিয়ে তােলা হয়, যার ফলে পুলিশকে গ্রেপ্তার, লাঠিচালনা করতে হয়। নদীয়াতে শরণার্থীদের মধ্যে প্রচার চালিয়ে বলা হয় তারা যেন কেউ তাঁবু ছেড়ে অন্য আশ্রয় শিবিরে না যায়। সরকার সীমান্ত-সংলগ্ন শিবিরগুলাে থেকে শরণার্থীদের অন্যত্র সরিয়ে নেবার পরিকল্পনায় যখন বিশেষ ট্রেন নিয়ে এল তখন শরণার্থীরা ট্রেনে উঠতে অস্বীকার করে বলল, তারা কোথাও যাবে না।
শুধু শরণার্থীদের মধ্যে নয়, সীমান্তবর্তী গ্রাম, শহর এমনকি কলকাতায় নানা রাজনৈতিক মহলের মধ্যেও গুপ্তচর চক্রের তৎপরতা বেড়ে চলেছে। গ্রামে গ্রামে ভারতীয় জোয়ানরা প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা করতে চেয়ে বহুক্ষেত্রে চাপা অসন্তোষের সম্মুখীন হচ্ছেন। সাধারন মানুষের মধ্যে প্রচার করা হচ্ছে, বাঙলাদেশ মুক্তিযুদ্ধে আমাদের কী লাভ হবে? বাঙলাদেশের মানুষ স্বাধীন বা পরাধীন যাই থাকুক না কেন, তাতে আমাদের কি? আমরা কেন বেশি ট্যাক্স দেব? কষ্ট করবাে? শহরের বেশ কিছু রাজনৈতিক দলের মধ্যেও এইজাতীয় কিছু কিছু প্রচার শুরু করা হয়েছে। এই প্রচারে বলা হচ্ছে মুজিবনগর কোথায়? মুক্তিযুদ্ধ করছে কারা? মুক্ত এলাকা কোথায় ইত্যাদি।
শহরে শিক্ষিত মহলে এই অন্তর্ঘাতমূলক প্রচারের নেতৃত্ব গ্রহণ করেছে মূলত কিছু দেশি বিদেশি সাংবাদিক। কলকাতায় বসে শতাধিক সাংবাদিক খবর সংগ্রহের নামে পশ্চিমবঙ্গের সর্বত্র আঁতিপাঁতি করে বাঙলাদেশ-বিরােধী সংবাদের সূত্র খুঁজে বেড়াচ্ছে। কলকাতার বেশির ভাগ হােটেলই এখন বিদেশি সাংবাদিক, ক্যামেরাম্যান, টেলিভিশন কর্মীতে ভরা। এই বিদেশি সাংবাদিকরা আবার অনেকে বেশ কিছু দেশি সাংবাদিককে কেউ হিসাবে পেয়েছে।
সূত্র: সপ্তাহ, ১০ ডিসেম্বর ১৯৭১