You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিলোনিয়ার যুদ্ধ এবং শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের লাশ ও কবরের সন্ধানে

গোলাম মুস্তাফা

শহীদ হাবিলদার এয়ার আহাম্মদ, বীর বিক্রম। উচ্চতা ছ’ফুট। গায়ের রং ফর্সা। পেটানো শরীর। বন্ধু-বান্ধব সহ গল্প-গুজব, হাসি-ঠাট্টা আর ধুম আড্ডা তার জীবনের বৈশিষ্ট্য। প্রতিযোগিতামূলক প্রতিটি খেলা-ধূলাতেই সে প্রথম। এয়ার আহাম্মদ আর আমি একই স্কুলের ছাত্র ছিলাম। আমরা পড়তাম ফেনী জেলার ফুলগাজী থানার মুনশির হাটে অবস্থিত আলী আজম হাই স্কুলে। কী কারণে জানিনা, অভিমান করে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলো এয়ার আহাম্মদ। পড়াশুনা আর হলোনা। “ভর্তি” হয়ে গেলো আর্মিতে। চলে গেলো পশ্চিম পাকিস্তানে। সে ১৯৬৬ সালের কথা। তারপর থেকে প্ৰায় পাঁচ বছর তার সাথে আর কোন যোগাযোগ নেই।

১৯৭১ সালের জুলাই মাস। ভারতের পালাটালা ট্রেনিং ক্যাম্প এ আমাদের মিলিটারি ট্রেনিং শেষ হলো। নির্দেশ অনুযায়ী এক কোম্পানি সমান মুক্তিযোদ্ধা নিয়ে আমি হাজির হলাম রাজনগরে। স্থানটি ভারতের অভ্যন্তরে, বাংলাদেশ সীমানার কাছে, বিনোনিয়া শহরের উত্তর পশ্চিমে। বিলোনিয়া সাব-সেক্টর এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর হেডকোয়ার্টার স্থাপিত হয়েছে এই রাজনগরে। ভারতীয় সেনাবাহিনীর ‘Shaktiman’ নামক ট্রাক থেকে নেমে মুক্তিযোদ্ধাদেরকে তিন সারিতে বিন্যস্ত করে এবং মার্চ করে আমি এগিয়ে যাচ্ছি ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর প্রতিষ্ঠাতা কমান্ডিং অফিসার মেজর জাফর ইমামের তাবুর দিকে রিপোর্ট করতে। তাবুর কাছাকাছি হতেই দেখি দীর্ঘদেহী এক সৈনিক। ধাম করে এটেনশনের ভঙ্গীতে সেল্যুট করলো অধিনায়ককে। মাটিতে ডান পা ঠুঁকে এতো জোরে সেল্যুট করলো যেন মেদিনী কেঁপে উঠলো, আশপাশের গাছ থেকে কয়েকটি পাখি ভীতিকর শব্দ করে উড়ে পালালো এবং স্যলুটের শব্দ আশে-পাশের পাহাড়ে ধ্বনি ও প্রতিধ্বনি তুললো। আমি আমার যোদ্ধাদেরকে নিয়ে দাড়িয়ে পড়লাম। কিছুক্ষণ অধিনায়কের সাথে কথা বলে সৈনিকটি এবাউট টার্ন করতেই দেখি, আরে! এতো আমার সেই হারিয়ে যাওয়া প্রিয় বন্ধু এয়ার আহাম্ম! আবেগে ও আনন্দে দু’জন দু’জনকে জড়িয়ে ধরলাম। দু’জনের চোখেই অশ্রুসজল।

এয়ার আহাম্মদ ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর ব্রাভো কোম্পানির হাবিলদার।

পাকিস্তানিদের ১৫ বালুচ রেজিমেন্ট এর সাথে মুখামুখি অবস্থানে থেকে যুদ্ধ করছিলো। বিলোনীয়ার উত্তর-পশ্চিমে বাংকার ও ট্রেঞ্চ খুঁড়ে শক্ত অবস্থান নিয়ে ডিফেন্স গড়ে তুলেছে বঙ্গ শার্দুলিরা। উল্টোদিকে ১৫ বালুচের শক্ত ডিফেন্স। মাঝখান দিয়ে কল কল করে বয়ে চলেছে খরস্রোতা মুহুরী নদী।

হাবিলদার এয়ার আহাম্মদ ছিলো বেপরোয়া রকমের সাহসী । তার কোম্পানি নিয়ে প্রায় রাতেই সে গোপনে শত্রু-নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে পড়তো, শত্রুর অবস্থান রেইড করতো, শত্রুর চলাচলের সময় অথবা পেট্রোলের সময় এমবুশ করতো এবং তাদের জান-মালের প্রচুর ক্ষতিসাধন করতো। শত্রুর এলাকায় ঢুকে অস্ত্ৰ-শস্ত্র নিয়ে চুপিসারে ঘোরা-ফেরা করা এবং এ ধরণের অপারেশন পরিচালনা করে নিরাপদে ঘাঁটিতে তথা ডিফেন্সে ফিরে আসা খুবই ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিলো। এসব বিষয়ে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করলে তা সে তুড়ি মেরে উড়িয়ে দিতো। শত্রুবাহিনীর দিকে ইঙ্গিত করে মাঝেমধ্যেই ফেনীর আঞ্চলিক ভাষায় বলতো “ফাডাই ফালামু, ছেঁছি ফালামু, যুদ্ধ কারে কয় শালার পুতেরগোরে ভালা করি বুঝাই দিমু” ইত্যাদি। এয়ার আহাম্মদ ছিলো অবিবাহিত। কথায় কথায় একদিন সে বলছিলো “বিয়া করিনো’, শাদী করিনো’, ‘বাল-বাচ্চা নাই, ফিছু টান নাই, আঁর কিয়ের ছিন্তা! মইল্লে মচ্ছি, বাইন চোতেরগোরে বাঙালির গুল ফিডা আর কেঁচকা মাইর কারে কয় হিয়েন ভালা করি বুঝাই দিমু।”

আমরা, পাইওনিয়র প্ল্যাটুনের যোদ্ধারা ছিলাম ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর হেডকোয়ার্টার কোম্পানির অন্তর্ভুক্ত। অধিনায়কের সরাসরি তত্ত্বাবধানে পরিচালিত হতো আমাদের কার্যক্রম এবং অপারেশন। আমাদের প্লাটুনের প্রায় সবাই ছিলো ছাত্র। অধিনায়কসহ ব্যাটেলিয়নের পেশাদার সৈনিকগণ আমাদেরকে খুবই স্নেহ করতেন। প্রতিরক্ষা লাইনের সর্বত্রই আমাদের যাতায়াত ছিলো তাই অবাধ।

ডিফেন্স লাইনের সন্নিকটে কালিকাপুর গ্রাম। এ গ্রামের বটতলী বাজারের পশ্চিম পাশে মাটির দেয়াল দিয়ে তৈরি একটি বাড়িতে আমরা থাকি। যুদ্ধের ধাক্কায় বাড়ির লোকজন ভারতে চলে গিয়েছিল। একদিন বিকেলে হঠাৎ সেখানে এয়ার আহাম্মদ এসে হাজির। গাল-গল্প ও ধুম আড্ডার এক পর্যায়ে আকাশ কালো করে মুসলধারে বৃষ্টি নামলো। সাথে আর্টিলারি শেলের মতো প্ৰচণ্ড শব্দের বজ্রপাত আর বিজলীর চমক। সূর্যাস্তের সময় বৃষ্টি থামলো। আমরা এয়ার আহাম্মদকে একটু এগিয়ে দেবো বলে তার সাথে তার বাংকারের দিকে এগিয়ে চললাম। পুরনো দিনের একটি পুকুরের পাশ দিয়ে আমরা হেঁটে চলেছি। আধো আলো আধো অন্ধকারের মধ্যে হঠাৎ বিদ্যুৎ চমকালো। ততোধীক চমকে উঠলাম আমরা। দেখি, পুকুর থেকে শত শত কই, মাগুর এবং টাকি মাছ সদলবলে বের হয়ে আসছে। সে এক অভূতপূর্ব দৃশ্য। কোথায় তাদের গন্তব্য, কেনইবা নিজ আবাসভূমি ছেড়ে তাদের এ অভিসার তা এক অজানা রহস্য। যাক, সবাই মিলে মাছ ধরা শুরু করলাম। এতো তাজা এবং ইয়া বড় সাইজের কই-মাগুর জীবনে আমরা বেশি দেখিনি। ধরতে ধরতে আমাদের হাত যেমন রক্তাক্ত হলো, সকলের লুঙ্গির কোঁচাও তেমনি হলো পূর্ণ। কিন্তু এ মাছ দিয়ে আমরা করবোটা কী? এখানেতো রান্না করার কোনো ব্যবস্থাই নেই। পেছনে, অনেক দূরে একটু মিট মিট আলো নজরে এলো। সকলকে নিয়ে উল্টো পথে সেদিকেই রওনা দিলাম। গিয়ে দেখি ছোট্ট একটি কুড়ে ঘরে এক বৃদ্ধা বসে মাছ ধরার জাল বুনছে। বৃদ্ধাকে আমরা আমাদের পরিচয় দিলাম এবং তার ঘরে পাওয়া একটি ‘লাইয়ে’ সব মাছ রেখে মাছগুলো গ্ৰহণ করতে তাকে বিনীত অনুরোধ করলাম। বৃদ্ধা দাঁতবিহীন মুখে ফোকলা হাসি হেসে খুশি মনে তাতে রাজী হলো। তবে এক শর্তে। শর্তটি হলো কিছু মাছ উনি এখন রান্না করবেন এবং আমাদেরকে তা খেয়ে যেতে হবে। আমরা মহানন্দে রাজী। কিন্তু কাপড় চোপড় আমাদের নোংরা হয়ে আছে। বুড়ি তার পুরনো শাড়ি ও বিছানার চাদর আমাদেরকে দিলেন। আমরা কাপড় বদল করলাম এবং চৌবাচ্চার পানিতে আমাদের ময়লা কাপড় পরিষ্কার করলাম। বড় বড় মাছগুলো নিয়ে উনি পাক শুরু করলেন। বৃদ্ধা খুবই দরীদ্র। ঘরে চাল খুবই কম। তবুও উনি একটু খানি ভাতও পাক করলেন। গোল হয়ে আমরা খেতে বসলাম। সে যে কী অপূর্ব স্বাদ এবং কী তৃপ্তির সাথে তা আমরা খেলাম তা আজ কিছুতেই ভাষায় প্রকাশ করা যাবে না। খাওয়া-দাওয়ার পর বৃদ্ধা তার কাছে থাকা সামান্য পান কাঁচা শুপারী দিয়ে ছোট ছোট খিলি বানিয়ে আমাদেরকে দিলেন। হৃদয়ের ছোঁয়া লাগানো সে পান খেতে খেতে জানা গেলো, বৃদ্ধার ছেলে এবং স্বামীকে হানাদার বাহিনী ধরে নিয়ে গেছে। তাদের আর কোনো খোঁজ নেই। বৃদ্ধা একা, অসহায়। স্বামী সন্তান ফিরে আসবে-এ আকুল আশা নিয়ে কাটে তার রাত দিন। পরিবেশটা বিষাদময় হয়ে গেলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। কেরোসিনের কুপির মৃদু আলোর শিখা থিরথির করে কাঁপছে। এয়ার আহাম্মদ হঠাৎ দাঁড়িয়ে গেলো। চাপা গলায় বৃদ্ধার দিকে তাকিয়ে বললো-মা, এ হারামীর বাচ্চাদেরকে আচ্ছা তরফ্‌সে বাংলার মাটিতে আমরা জনমের শিক্ষা দিয়ে দেবো ইনশাল্লাহ। তুমি আমাদের জন্য একটু দোয়া করো।” আমাদের দিকে ফিরে বললো-“যুদ্ধে যদি মরেই যাই, তাহলে আমাকে তোরা ওদের দখলে থাকা পাকিস্তানের জমিতে বা ভারতের জমিতে কবর দিবি না। আমি স্বাধীন বাংলার মাটিতে কবর চাই। কথা দে আমার ইচ্ছা পূরণ করবি?” কারো মুখে কোন কথা নেই। কিছুক্ষণ পর আমি বললাম-“কথা দিলাম”। “গেলাম” বলে বৃদ্ধাকে পায়ে ধরে সালাম করে লম্বা লম্বা পা ফেলে নিকশ কালো অন্ধকারের মধ্যে ঢুকে গেলো আমার প্রিয় বন্ধু হাবিলদার এয়ার আহাম্মদ।

এরপর বেশ কিছু দিন চলে গেছে। ইতিমধ্যে প্রায় প্রতিদিনই পাকিস্তানিদের সাথে আমাদের ছোট খাটো সংঘর্ষ লেগেই ছিলো। কিন্তু নদীর দুই পাশে উভয় পক্ষেরই বাংকার সহ শক্ত অবস্থান থাকায় এসব সংঘর্ষে কোনো পক্ষেরই বড় রকমের ক্ষতি হয়নি। উভয় পক্ষের ডিফেন্স লাইনের মাঝখান দিয়ে খরস্রোতা মুহুরী নদী প্ৰবাহমান ছিলো বলে কেউ কাউকে সরাসরি আক্রমণ করতে পারছিল না। এ পরিস্থিতির অবসান প্রয়োজন। পাকিস্তানের ১৫ বালুচ ও ২৪ ফ্রন্টিয়ার ফোর্স রেজিমেন্টের সাথে আমাদের একটা বুঝাপড়া হয়ে যাওয়া দরকার। কিন্তু কীভাবে? ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট সহ সহযোগী মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে এক ধরণের অস্থীরতা লক্ষ্য করলাম। সেপ্টেম্বর চলে গেলো। এসে গেলো অক্টোবর। মুহুরির পানির গভীরতা এবং স্রোতের তেজ কমে গেছে। কিন্তু মুক্তি ও মিত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের আনাগোনা বেড়ে গেছে। ২ নম্বর সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফ, মেজর হায়দার এবং মিত্র বাহিনীর ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের জি.ও.সি. মেজর জেনারেল আর. ডি. হীরা যখন তখন আসছেন এবং যাচ্ছেন। মে. জে. আর. ডি. হীরা ‘রকী হীরা’ নামেই অধীক পরিচিত। বুঝতে পারলাম, নতুন কোনো পরিকল্পনা সহ কিছু একটা হতে যাচ্ছে। আমি ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের সি.ও. মেজর জাফর ইমামের ষ্টাফ অফিসার, খুবই আস্থাভাজন এবং স্নেহের পাত্র। অথচ বুঝতে পারলাম, অতি স্পর্শকাতর কোনো একটা পরিকল্পনা অতীব গোপনীয়তার সাথেই প্ৰণীত হচ্ছে যা আমারও জানা উচিত নয়।

ইতিমধ্যে লে. কর্নেল খালেদ মোশাররফের নির্দেশে রাঙ্গামুড়া সাব-সেক্টর কমান্ডার লে. ইমাম উজ-জামান এবং সালদা নদী সাব সেক্টর থেকে সে.ল. দিদার আতোয়ার হোসেন তাদের নেতৃত্বাধীন সৈনিকদেরকে নিয়ে রাজনগরে আসেন এবং মেজর জাফর ইমামের নিকট রিপোর্ট করেন। তাছাড়া প্রবাসী বাংলাদেশ সরকার আয়োজিত ট্রেনিং শেষ করে মুক্তিবাহিনীর কমিশনপ্রাপ্ত প্রথম ব্যাচের মধ্য হতে সে.লে. মিজানুর রহমানও সাব-সেক্টর কমান্ডার মেজর জাফর ইমামের নিকট রিপোর্ট করেন। উল্লেখ্য যে, এর আগে মেজর জাফর ইমামের সাথে একমাত্র ক্যাপ্টেন মোখলেছুর রহমান, ক্যাপ্টেন শহীদুল ইসলাম এবং ফেনী কলেজের ইউ.ও.,টি.সি.র ক্যাপ্টেন মজিবর রহমান খান ছাড়া কোনো অফিসার ছিল না। আরো উল্লেখ্য যে, সে. লে. দিদার ও লে. ইমামের অধীনস্থ বেশির ভাগ সৈনিকই ছিল বিভিন্ন বেঙ্গল রেজিমেন্ট এর অবসরপ্রাপ্ত, ছুটিতে থাকা অথবা পালিয়ে আসা সৈনিক এবং সাবেক ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলস তথা ই.পি.আর. এর বিভিন্ন ইউনিটের সৈনিক। এদের সকলকে নিয়ে বিভিন্ন প্লাটুন কোম্পানি এবং কমান্ড স্ট্রাকচার পুনর্বিন্যাস করে মেজর জাফর ইমাম ১০ম বেঙ্গল রেজিমেন্টকে পূর্ণাঙ্গ রূপ দিলেন। আলফা কোম্পানির দায়িত্ব পেলেন লে. ইমাম, ব্রাভো কোম্পানির দায়িত্ব দেয়া হলো সে.লে। মিজানকে, চার্লি কোম্পানির দায়িত্ব পেলেন সে, লে. দিদার এবং ডেলটা কোম্পানির নেতৃত্ব পেলেন ক্যাপ্টেন মোখলেছ। পাইওনিয়ার প্লাটুন সহ হেড কোয়ার্টার কোম্পানির কমান্ড মেজর জাফর ইমাম নিজের হাতে রাখলেন। আমাদের ডিফেন্স হলো আরো মজবুত। আরেকটা তথ্য মনে পড়ছে। এসময় প্রবাসী বাংলাদেশ সরকারের নির্দেশে জেড ফোর্স, এস ফোর্স এবং কে ফোর্স গঠন করা হয়। ‘কে’ ফোর্স গঠিত হয় ৪র্থ, ৯ম এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সমন্বয়ে এবং লে. ক, খালেদ মোশাররফকে এই ফোর্সের কমান্ডার নিযুক্ত করা হয়।

অক্টোবরের শেষের দিকে মেজর জাফর ইমাম সকল সেকসান, প্লাটুন ও কোম্পানি কমান্ডারদেরকে নিয়ে এক গোপন বৈঠক করলেন। বৈঠকে উনি শত্রু নিয়ন্ত্ৰিত ফেনী-বিলোনিয়ার একটি বড় ম্যাপ মেলে ধরলেন। আমাদের চোখের সামনে ফেনী-বিলোনীয়া অঞ্চলটি পরিস্কারভাবে ফুটে উঠলো। ফেনী থেকে বিলোনীয়া পর্যন্ত দৈর্ঘ্যে এটি ১৬ মাইল লম্বা এবং প্রস্থে ৬ মাইল। এ ভূখণ্ডটির উত্তর, পূর্ব এবং পশ্চিম দিকে ভারতীয় ভূখণ্ড। মুহুরী ও ছিলনীয়া নদী ভারত সীমান্ত থেকে বের হয়ে দক্ষিণ দিকে চলে গেছে। বিলোনীয়া-ফেনী রেল লাইন ছাড়াও বিলোনীয়া-ফেনী ট্রাংক রোড এবং পরশুরাম-ছাগলনাইয়া লিংক রোডটিও ম্যাপের মধ্যে স্পষ্ট ফুটে উঠলো। মেজর জাফর ইমাম বিভিন্ন ফর্মেশনে পাকিস্তানিদের ডিফেন্স লাইন এবং বাংকারগুলোর অবস্থান সম্পর্কে আমাদেরকে মোটামুটি একটা ধারণা দিয়ে বললেন যে, ভবিষ্যৎ আক্রমণের রূপরেখা তৈরীর জন্য আমাদেরকে ভিতরে গিয়ে শত্রুর অবস্থান সরেজমিনে রেকী করতে হবে। রেকী করার ব্যাপারে উনি আমাদেরকে বিস্তারিত ভাবে ব্রিফিং এবং নির্দেশনা দিলেন।

২৭ অক্টোবর ফজরের নামাজের পর থেকে একজন একজন করে মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডারগন সংগোপনে শত্রুর বাংকারগুলোর মাঝখানের ফাঁকা স্থানগুলোর মাঝামাঝি স্থান দিয়ে ভিতরে প্রবেশ করতে লাগলো। ভীষণ বুকিপূর্ণ। কিন্তু ধীরে ধীরে আমরা সবাই ভিতরে ঢুকে গেলাম। আমরা সবাই স্থানীয় জনসাধারণ এবং কৃষকদের মতো লুঙ্গি ও গেঞ্জি পরে খালি পায়ে ভিতরে ঢুকছিলাম এবং সাধারণ লোকদের সাথে মিশে গিয়েছিলাম। ফলে পাকিস্তানি সেনারা সন্দেহও করেনি এবং আমাদেরকে চিনতেও পারেনি। স্থানীয় জনসাধারণ এবং কৃষকরা অবশ্য আমাদেরকে চিনে ফেললো। কিন্তু অবাক ব্যাপার, তারা সকলেই আমাদেরকে সঠিক পথে যেতে সাহায্য করলো এবং শত্রুর অবস্থান এবং তাদের সংখ্যা-শক্তি ও অস্ত্ৰ-শক্তির ব্যাপারে ধারণা দিলো। আমাদের কমান্ডিং অফিসার লুঙ্গী ও গেঞ্জি পরে, মাথায় টুপি লাগিয়ে এবং কোমরে গামছা বেঁধে এই রেকী দলের নেতৃত্ব দিলেন। এছাড়াও তিনি ভবিষ্যৎ সম্ভাব্য যুদ্ধের সময় কার ইউনিটের অবস্থান কোথায় হবে, কোথায় বাংকার খুড়ে নিজের অবস্থান মজবুত করতে হবে এসব বিষয়ে সবাইকে পরিষ্কার ধারণা দিলেন। আল্লাহর অশেষ মেহেরবানীতে এতগুলো কমান্ডার সাথে নিয়ে দিনের আলোতে সব দেখিয়ে শুনিয়ে মেজর জাফর ইমাম নীরবে একজন একজন করে আমাদেরকে নিয়ে পূনরায় ডিফেন্সে ফিরে এলেন। পাকিস্তানিরা বিষয়টি সে মুহুর্তে টেরই পেলোনা।

শত্রু এলাকায় ঢুকে শত্রুকে আক্রমণ করা এমনিতেই ঝুঁকিপূর্ণ। তার উপর আমাদেরকে একটি মাত্র ব্যাটেলিয়ন নিয়ে শত্রুর দুটি ব্যাটেলিয়নের মুখোমুখি হতে হবে। যোদ্ধা ও অফিসারদের সংখ্যা উদ্বেগজনকভাবে পাকিস্তানিদের অনুকুলে। এ অবস্থার কিছুটা পরিবর্তনের লক্ষ্যে এবং ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের শক্তি বৃদ্ধি কল্পে একটি সুসজ্জিত কোম্পানি ‘ধার’ চাইলেন ২নং সেক্টর কমান্ডার লে.ক. খালেদ মোশাররফ ৩নং সেক্টর কমান্ডার লে. ক. শফিউল্লার নিকট। তৎকালীন সময়ে এ অনুরোধ রক্ষা করা কঠিন ছিলো। তবুও জুনিয়র টাইগার অর্থাৎ ২ ইষ্ট বেঙ্গলের সবচেয়ে সুগঠিত একটি চৌকস কোম্পানি ক্যাপ্টেন গোলাম হেলাল মোরশেদ খানের নেতৃত্বে ৩ নং সেক্টর হতে এসে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের শক্তি ও সংখ্যা বৃদ্ধি করলো। কিন্তু ইতোমধ্যেই আমাদের রেকী হয়ে গিয়েছিলো বিধায় ২য় ইস্ট বেঙ্গলের এই কোম্পানিটির জন্যও রেকীর ব্যবস্থা হলো। ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ এবং তার সেকশান, প্লাটুন ও কোম্পানি কমান্ডারদের সাথে ১০ম ইস্ট বেঙ্গলের অভিজ্ঞ কয়েকজন সুবাদার ও হাবিলদারকেও গাইড হিসেবে দেয়া হলো। কিন্তু রেকীর শেষ পর্যায়ে ২য় ইস্ট বেঙ্গলের সুবাদার জাব্বার শত্রুর পোতা মাইন বিস্ফোরণে মারাত্মক আহত হয়। কিছুই বুঝতে না পেরে মাইন বিস্ফোরণের স্থান লক্ষ্য করে শত্রু সেনারা গুলি শুরু করে। আমাদের পক্ষ থেকে আমাদের ডিফেন্স লাইন থেকেও হালকা গোলাগুলি করা হয়। আমরা সবাই ভীষণ টেনশনে পড়ে গেলাম। আমাদের অতিথি কমান্ডারগণ একজন ক্যাপ্টেন সহ শত্রু এলাকায়। কাছের এক বাড়ির দরজা ভেঙ্গে, সেটাকে স্ট্রেচার বানিয়ে, সে স্ট্রেচারে আহত ও রক্তাক্ত সুবাদারকে বহন করে, সঙ্গী কমান্ডারদেরকে সাথে নিয়ে, ক্ষীপ্ৰ গতীতে ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদ ফিরে এলেন আমাদের মাঝে। হাঁফ ছেড়ে বাঁচলাম আমরা।

আক্রমণের দিন হিসেবে ১৯৭১ সালের ৫ নভেম্বরকে বেছে নেয়া হয়। ৫ নভেম্বর সকাল বেলা নির্দেশ মোতাবেক আমরা আমাদের ডিফেন্স এর বাংকার ছেড়ে ভারতের খানিকটা অভ্যন্তরে আমাদের ব্যাটেলিয়ন হেডকোয়ার্টারে এসে সমবেত হলাম। সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে ভারতীয় বাহিনীর ডোগরা রেজিমেন্ট আমাদের ছেড়ে দেয়া ডিফেন্স এ পজিশন নেয়। রাজনগরে মেজর জাফর ইমাম আমাদেরকে আসন্ন অপারেশন সম্পর্কে পূর্ণাঙ্গ ব্রিফিং দিলেন। পরিকল্পনা অনুযায়ী রাতের অন্ধকারে পুরো ব্যাটেলিয়নের সৈনিকগণ যার যার কমান্ডারের নেতৃত্বে পশ্চিম দিকের সীমান্ত দিয়ে শত্রুর বাংকারগুলোর মধ্যখানের ফাঁকা স্থান দিয়ে শত্রুর নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে পড়বে এবং চিথলিয়া রেল ষ্টেশনের উত্তর দিক দিয়ে পশ্চিম থেকে পূর্ব দিকে অগ্রসর হয়ে চন্দনা ও সলিয়া হয়ে শুথুমা পর্যন্ত অগ্রসর হবে। পূর্ব সিমান্তে অপেক্ষমান সৈনিকগণ পাকিস্তানিদের নিয়ন্ত্রিত এলাকায় ঢুকে একইভাবে পূর্ব থেকে পশ্চিম দিকে অগ্রসর হয়ে শুথুমা পর্যন্ত অগ্রসর হয়ে পশ্চিম দিক থেকে অগ্রসরমান সৈনিকদের সাথে নিশ্চিদ্র সংযোগ স্থাপন করবে এবং পূর্ব পশ্চিম অক্ষ রেখা বরাবর উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে বাংকার তৈরি করে রাতের মধ্যেই দু’মুখো ডিফেন্স তৈরি করবে। তাছাড়া অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ, খাদ্য ও অন্যান্য সরবরাহ নিশ্চিত করার জন্য দুই দিকের ডিফেন্স এর মাঝখান দিয়ে যোগাযোগ পরিখা খনন করবে। এতে পরশুরাম ও বিলোনীয়াতে অবস্থানরত শত্রু বাহিনী উত্তর দিকের পকেটে আঁটকা পড়বে, চিথলিয়া-ফুলগাজী-মুনশীর হাট ও ফেনী থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে এবং যুদ্ধ করে হয় তাদেরকে আমরা ঘায়েল করবো, অথবা যুদ্ধ করতে করতে গোলা-বারুদ ও রসদ শেষ হয়ে গেলে বা শারিরীক ও মানসিক ভাবে দূর্বল বা হতোদ্যম হয়ে পড়লে আমরা তাদেরকে জীবন্ত পাকড়াও করবো। ভীষণ ঝুঁকিপূর্ণ এবং অনিশ্চয়তায় ভরা এক পরিকল্পনা-ভাবলাম আমি। দেশমাতৃকার তরে জীবন দান করতে যাচ্ছি বলেই আমার বদ্ধমূল ধারণা হলো। তবে Infiltration এর মাধ্যমে প্রত্যাশিত বিজয় সম্ভবও হতে পারে। এবং সার্থক হলে সামরিক ইতিহাসে তা হবে এক অসাধারণ ঘটনা। পরিকল্পনার অংশ হিসেবে আমরা আমাদের যার যার হাতিয়ার পরিষ্কার করলাম, গুলির ম্যাগাজিন থেকে ব্যারেল এর প্রান্ত পর্যন্ত পরিষ্কার করলাম Pull-through দিয়ে। সেকসান, প্লাটুন ও কোম্পানি কমান্ডারদেরকে এই প্রথম ওয়্যারলেস সেট দেয়া হলো। প্রতিটি সৈনিককেই প্রচুর পরিমানে গুলি, HE 36 Hand Granade, extra magzine, মাটিখোড়ার হাতিয়ার সহ প্রয়োজনীয় মাল-সামানা দেয়া হলো। সেক্টর কমান্ডার লে. কর্নেল, খালেদ মোশাররফ এবং মিত্র বাহিনীর সিনিয়র অফিসারদের সাথে তাঁবুতে বসে আমাদের সি.ও. মেজর জাফর ইমাম সাহেব গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা করছেন এবং মাঝেমধ্যেই বেরিয়ে এসে আমাদের যুদ্ধ-যাত্ৰা তথা রণ-প্ৰস্তুতি দেখছেন। জানা গেলো, আক্রমণ এবং যুদ্ধ আমাদেরকেই করতে হবে। তবে মিত্র বাহিনী দূর পাল্লার আর্টিলারী এবং স্বল্প পাল্লার মর্টার সাপোর্ট ছাড়াও সর্ব প্রকারের লজিষ্টিক এবং প্রয়োজনীয় অস্ত্ৰ, গোলাবারুদ ও খাদ্য সরবরাহের দায়িত্ব নিয়েছে।

নভেম্বর মাস। শীতের সন্ধ্যা। অথচ গতকাল থেকে মুষলধারায় বৃষ্টি নেমেছে। আজ সকাল থেকে বৃষ্টি নেই, তবে আকাশ মেঘলা। প্রকৃতি যেন থমথম করছে এবং অজানা এক আশংকায় শংকিত হয়ে আছে। সন্ধ্যার সাথে সাথে ভারতীয় সেনাবাহিনী আমাদেরকে আজ উন্নতমানের খাবার পরিবেশন করলো। নিঃশব্দে সবাই খাওয়া-দাওয়া শেষ করলো। কারো মুখে কোন কথা নেই। রাত আটটায় প্রতিটি সেকসান এবং প্লাটুন সমেত প্রতিটি কোম্পানিকেই অনুপ্রবেশ তথা Infiltration এর জন্য সুশৃংখলভাবে মুহুরী নদীর পাড়ে নিয়ে যাওয়া হয়। সন্ধ্যা থেকেই আবার গুড়ি গুড়ি বৃষ্টি শুরু হলো এবং রাত নয়টা নাগাদ মূষল ধারায় ভারী বৃষ্টি নামলো। সাথে বিজলীর চমক এবং আর্টিলারীর শব্দের মতো বজপাত। ভিজে আমরা নাস্তানাবুদ। তবে প্রকৃতির এ রুদ্ররূপ আমাদের অনুপ্রবেশের জন্য অত্যন্ত সহায়ক হলো। এ যেন ওদের জন্য গজব আর আমাদের জন্য আল্লাহর একটা নেয়ামত ও রহমত।

রাত সাড়ে দশটা। শুরু হলো অনুপ্ৰবেশ। প্রথমেই সে. লে. মিজানের নেতৃত্বে ব্রাভো কোম্পানির সৈনিকরা ধীরে ধীরে অনুপ্রবেশ শুরু করলো। এর পরপরই সে, লে. দীদারের নেতৃত্বে চার্লি কোম্পানি। চার্লি কোম্পানির পেছন পেছন অনুপ্রবেশ শুরু করে ক্যাপ্টেন হেলাল মোরশেদের নেতৃত্বাধীন ২য় ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্টের সৈনিকগণ। এর পরপরই টাস্কফোর্স কমান্ডার মেজর জাফর ইমামের নেতৃত্বে পাইওনিয়র প্লাটুন সহ হেড কোয়ার্টার কোম্পানির একটা অংশের অনুপ্রবেশ শুরু হলো। মুহুরী নদীতে বুক সমান পানি। নদী পার হতেই শত্রু নিয়ন্ত্রিত এলাকা। ১৫ বালুচের দুটি বাংকারের মধ্যখান দিয়ে বিড়ালের মতো নিঃশব্দে, কিন্তু নেকড়ের হিংস্রতা নিয়ে ঢুকে পড়লাম আমরা শত্রুর এলাকায়। ব্রাভো কোম্পানির প্রথম অংশ শলিয়া গ্রাম হয়ে শুথুমা গ্রামের প্রান্তে গিয়ে থেমে যায়। ক্যাপ্টেন মাহফুজের নেতৃত্বাধীন ১ নং সেক্টরের সৈনিকগণ পূর্ব সীমান্ত দিয়ে ঢুকে গুথুমা গ্রামে এসে আমাদের ব্রাভো কোম্পানির অগ্রগামী সৈনিকদের সাথে সংযোগ স্থাপন করে। চলার পথের রাস্তা ছিলো কর্দমাক্ত ও পিচ্ছিল। ঝম ঝম করে বিরামহীনভাবে আকাশ ভেঙ্গে বৃষ্টি নামছেতো নামছেই। যখন তখন প্ৰচণ্ড শব্দে বাজপাত। ঘুটফুটে অন্ধকার। পথ চিনে এগিয়ে যাওয়া মুশকিল হচ্ছে। কিন্তু মাঝে মধ্যেই টর্চের মতো বিজলির চমক পথ চিনতে এবং সঠিক রুটে এগিয়ে গিয়ে ডিফেন্স লাইন গড়ে তুলতে আমাদেরকে মূল্যবান সাহায্য করছিলো। সাথে সাথেই শুরু হলো বাংকার খোঁড়ার কাজ। কাজটি কঠিন। কারণ যতটুকু খোড়া হয় ততটুকুই বৃষ্টির পানিতে ভর্তি হয়ে যায়। সুতরাং দুজনে বাংকার খুঁড়লে বাকি দুজনকে পানি সরানোর কাজে ব্যস্ত থাকতে হচ্ছে। অমানুসিক পরিশ্রম। শেষ রাতের দিকে মোটামুটি বাংকার ও দুই ডিফেন্সের মাঝখান দিয়ে যোগাযোগ পরিখা খনন শেষ করে উত্তর ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে দুই সারির পূর্ব পশ্চিমের সাধারণ রেখা বরাবর ডিফেন্স লাইন তৈরি করা শেষ হলো। ৬ নভেম্বর ভোরের আগেই আটকা পড়ে গেলো পরশুরাম ও বিলোনিয়ায় অবস্থানরত শত্রু সেনারা। প্রচণ্ড বৃষ্টি, বজ্রপাত ও দুৰ্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে হানাদার বাহিনী তাদের সুরক্ষিত বাংকার থেকে বের তো হলোই না, বরং আরামে রাত্রি যাপন করলো। বুঝতেই পারলো না, তারা ঘেরাও হয়ে গেছে এবং মহা বিপদের মধ্যে পড়ে গেছে।

আমাদের সৈনিকরা যখন পরিখা খনন করে ডিফেন্স লাইন তৈরিতে ব্যস্ত, আমরা পাইওনিয়র প্লাটুনের যোদ্ধারা তখন আমাদের প্রতিরক্ষা লাইনের দুই দিকের সম্মুখ ভাগে এন্টি পার্সোনাল ও এন্টি ট্যাংক মাইন বসাতে মহা ব্যস্ত। এছাড়া শত্রুসেনাদের সম্ভাব্য আগমন পথে আমরা বেশ কিছু Booby Trapও পেতেছিলাম। বুবি ট্র্যাপ কী? বুবি ট্র্যাপ প্রকৃতপক্ষে একটি বিশেষ ধরনের শক্তিশালী এন্টি পার্সোনাল মাইন। একে বলে M-16 Mine. এ মাইনটির আকার এবং Shape অনেকটা আধা কেজি ওজনের মিলক পাউডারের টিনের মতো অথবা আগের দিনের শিশুদের Glaxo দুধের টিনের মতো। ভেতরটা শক্তিশালী বিস্ফোরকে ঠাঁসা । উপরের অংশে ডেটোনেটর ফিট করতে হতো। উপরে আংটার মতো একটা জিনিস ছিলো যাকে বলে Fuze Hook. এ ছাড়া ছিলো ৪০ গজ লম্বা অত্যন্ত চিকন তার। তারগুলো ছিলো বিভিন্ন রং এর। যেখানে এই মাইন বসানো হবে সেখানকার প্রকৃতি এবং রং এর সাথে খাপ খাইয়ে তার বাছাই করতে হয়। আমরা ধান খেতের জন্য সবুজ এবং রাস্তার জন্য ধূসর রং এর তার আগেই বেছে নিয়েছিলাম। M-16 মাইন মাটিতে পুঁতে তার উপরে থাকা হুক এর সাথে দু’টি সবুজ তার বেঁধে দু’দিকে দু’টো তার নিয়ে গিয়ে ৪০ গজ দূরে শক্ত একটি কাঠি মাটিতে পুতে তার মাথায় টান টান করে তারটি বেঁধে দিতে হতো। এর অর্থ হলো, শত্রু সেনারা আক্রমণের জন্য আমাদের ডিফেন্স এর দিকে আসতে চাইলেই পাতানো তারে হোচট খাবে এবং সাথে সাথেই M-16 মাইনটি বিস্ফোরিত হয়ে তারা তছনছ হয়ে যাবে। M-16 মাইন তথা Booby Trap এর ধ্বংস-ক্ষমতা মারাত্মক। এছাড়াও আমরা ছোট ছোট প্রচুর P-2 প্লাস্টিক মাইন বসিয়েছিলাম। এগুলোকে বলে Non Detectable Anti Personal Mine. প্লাষ্টিকের তৈরি বলে শত্রু পক্ষের Mine Detector এগুলোকে মোটেই চিহ্নিত করতে পারবে না। এ মাইন গুলোর দুটো অংশ, দুটো অংশের মাঝখানে একটি Metalic Plate বা পাত থাকে। দুটো অংশ প্যাচানো। বাম দিকে ঘুরালে খুলে যায়। খুলে ভেতরে থাকা পাতটা সরিয়ে দিয়ে উপরের অংশটি নিচের অংশের উপর বসিয়ে ডান দিকে ঘুরালেই বিস্ফোরণের জন্য এ মাইন রেড়ী। খুবই সতর্কতার সাথেই এগুলোকে রেডি করে মাটিতে পূতে Camouflage and Concealment করতে হয়। সামান্য এদিক সেদিক হলে বা অসতর্কতার ফলে একটু চাপ পড়লেই বিস্ফোরিত হয়ে আমরাই আহত বা নিহত হতে পারতাম। তাছাড়া বিস্ফোরণের শব্দ শুনে শ্ত্রু যদি এগিয়ে আসে তাহলে আমরা সহ অপ্ৰস্তুত অবস্থায় আমাদের পুরো ব্যাটালিয়ন নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে পারে। শত্রু নিয়ন্ত্রিত এলাকায় শত্রুর কাছাকাছি অবস্থানে থেকে রাতের ঘুটফুটে অন্ধকারে এবং দুৰ্যোগপূর্ণ আবহাওয়া, কিনবিলে অসংখ্য জোঁকের মধ্যে কীভাবে সারা রাত স্বার্থকভাবে শত শত Booby Trap, এন্টি পার্সোনাল ও এন্টি ট্যাংক মাইন আমরা সেদিন পুঁতেছিলাম তা আজ এ বয়সে এসে ভাবতেই অবাক লাগে। নিজেকে শ্রদ্ধা করতে, সমীহ করতে, আদর করতে ইচ্ছে হয়।

আমাদের টাস্ক ফোর্স কমান্ডার মেজর জাফর ইমাম স্বয়ং এসে ডিফেন্স লাইন দেখলেন, সন্তুষ্ট হলেন এবং সবাইকে শেষ মুহুর্তের দিক নির্দেশনা দিয়ে সাহস ও উৎসাহ প্ৰদান করলেন। কথাবার্তা সবই হচ্ছে ফিসফিস করে। সি.ও. চলে গেলেন অনন্তপূরে, তার কমান্ড পোস্টে তথা অস্থায়ী ব্যাটালিয়ন সদর দপ্তরে। কমান্ড পোষ্টটি স্থাপিত হয়েছে ব্রাভো ও চার্লি কোম্পানির মাঝখানে।

চার্লি কোম্পানির ডান দিকে, মুহুরী নদী পার হয়ে নদীর পূর্ব পাড়ে ধনিকুণ্ডা এলাকায় অনুপ্রবেশ করে লে. ইমাম-উজ-জামানের কমান্ডে আলফা কোম্পানি পূর্ব ও দক্ষিণ দিকে মুখ করে এবং পরিখা খুঁড়ে ইতোমধ্যেই শক্ত অবস্থান নিয়েছে। শেষ রাতের দিকে ডিফেন্স তৈরি করে আমাদের প্রস্তুতি সম্পন্ন হওয়ার পর ধীরে ধীরে বৃষ্টি থেমে গেলো। চারদিকে কবরের মতো নিস্তব্ধতা। আমরা সবাই মহা সতর্ক। ওঁত পেতে বসে আছি। সোবোহ সাদেক। পূবের আকাশ ধীরে ধীরে আলোকিত হচ্ছে। মোয়াজ্জিনের আজান এবং পাখির কিচির মিচির শব্দ শোনা যাচ্ছে। প্রস্তুত আমরা।

হঠাৎ দূর থেকে ঢুক ঢুক গুড় গুড় ধরণের শব্দ ভেসে এলো। কিসের শব্দ বোঝা গেলো না। ক্রমেই শব্দটি নিকটবর্তী হলো। এক পর্যায়ে দেখা গেলো যে ফেনীর দিক থেকে চিথলিয়া রেল ষ্টেশন হয়ে ইঞ্জিন চালিত একটি রেলওয়ে ট্রলি পরশুরামের পথে আমাদের ডিফেন্স লাইনের দিকে এগিয়ে আসছে। টাস্ক ফোর্স কমান্ডার সবাইকে শান্ত থাকতে এবং নির্দিষ্ট সময়ে ট্রলিটির দিকে আক্রমণ পরিচালনা করতে ব্রাভো কোম্পানির হাবিলদার এয়ার আহাম্মদকে নির্দেশ দিলেন। হাবিলদার এয়ার আহাম্মদের ইউনিটটি রেল লাইন ও ফেনী-বিলোনীয়া রোডের মাঝখানে সবচাইতে গুরুত্বপূর্ণ ও ঝুঁকিপূর্ণ এলাকায় ডিফেন্স তৈরি করে পূর্বেই অবস্থান নিয়েছিলো। টিক টিক টিক টিক। আমাদের হার্ট বিট এবং ঘড়ির কাটা এগিয়ে চলছে ক্লান্তিকর ভাবে। এগিয়ে আসছে ট্রলিটি। নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে আসছে ট্রলির আরোহীরাও। ৫০ গজ দূরত্বে আসার পর পরিষ্কার দেখা গেলো যে, ট্রলিটিতে পাঁচজন পাকিস্তানি সৈনিক বসে আছে। ফায়ারা! মেজর জাফর ইমামের নির্দেশ। মুহুর্তের মধ্যেই হাবিলদার এয়ার আহাম্মদ এবং তার সৈনিকরা বৃষ্টির মতো গুলিবর্ষণ শুরু করলো। ট্রলিটি বিধ্বস্ত হলো এবং পলকের মধ্যেই অপ্ৰস্তুত অবস্থায় সকল শত্রু সেনা নিহত হলো। আশে পাশের বাংকারে অবস্থানরত পাকিস্তানি সেনারা কিছুই বুঝতে পারলোনা, হয়তো ভেবাচেকা খেয়ে বিষয়টা কী তা বোঝার চেষ্টা করছে।

এদিকে বিজয়ের প্রাথমিক আনন্দে এবং প্রতিক্রিয়ায় হাবিলদার এয়ার আহাম্মদ অতি মাত্রায় উত্তেজিত হয়ে পড়ে। বাংকার থেকে সে লাফিয়ে বের হয় এবং দৌড়ে গিয়ে নিহত ক্যাপ্টেনের ব্যাজ এবং পিস্তলটি নিয়ে আবার ফিরে আসতে থাকে নিজ বাংকারের দিকে। এয়ার আহাম্মদ যখন বাংকারের একেবারে সন্নিকটে, তখনি শত্রুর এক ঝাক গুলি এয়ার আহাম্মদের বাঁ কানের পাশ দিয়ে ঢুকে মাথাটা তার ঝাঁঝরা করে দিলো। এয়ার আহাম্মদ তৎক্ষণাৎ শহীদ হয়ে গেলো। বিলোনিয়ার দ্বিতীয় যুদ্ধের প্রথম শহীদ। পরবর্তীতে ট্রলির চারদিকে বিক্ষিপ্তভাবে পড়ে থাকা শত্ৰু-সেনাদের একটি রকেট লঞ্চার, একটি স্টেনগান, তিনটি রাইফেল এবং এয়ার আহাম্মদের মুষ্টিবদ্ধ হাত থেকে পাকিস্তানি ক্যাপ্টেনের রিভলভারটি উদ্ধার করা হয়।

হাবিলদার এয়ার আহাম্মদের মৃত্যুতে মেজর জাফর ইমাম খুবই উদ্বিগ্ন এবং শোকাহত হলেন। কেননা অদম্য এবং বেপরোয়া রকমের সাহসী এ হাবিলদারকে তিনি খুবই পছন্দ ও স্নেহ করতেন। এয়ার আহাম্মদের বাংকার সহ আশেপাশের অন্তত পাঁচটি বাংকারে উনি রিজার্ভ থেকে আরো পাঁচজন সৈনিক পাঠালেন। আশে পাশের শত্রু সেনারা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে এতোক্ষণে নিশ্চয়ই জেনে গেছে। সুতরাং যে কোনো সময় আমরা প্রতি আক্রমণের সম্মুখীন হতে পারি। সতর্ক থাকার জন্য, সম্ভাব্য আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য এবং মনোবল অক্ষুন্ন রাখার জন্য ফিল্ড ওয়্যারলেসের মাধ্যমে তিনি প্রতিটি সেকসন, প্লাটুন ও কোম্পানি কমান্ডারদের সাথে কথা বললেন এবং প্রয়োজনীয় নির্দেশনা দিলেন। চারিদিক শান্ত ও চুপচাপ। কিছুই ঘটলোনা। কিন্তু প্রায় মিনিট পঁচিশেক পরে হঠাৎ এয়ার আহমদের প্লাটুনের উপর পাকিস্তানি সেনারা উত্তর ও দক্ষিণ উভয় দিক থেকেই সাঁড়াশী আক্রমণ পরিচালনা করলো। তারা ভেবেছিলো, মুক্তি বাহিনীর একটি ছোট্ট এম্বুস দল তাদের ট্রলিটিকে আক্রমণ করেছে। তারা কল্পনাও করতে পারেনি যে একটি ব্যাটেলিয়ান প্লাস শক্তি নিয়ে আমরা তাদেরকে ঘেরাও করে রেখেছি। এ ভুলের খেসারত তাদের বেশ ভালোভাবেই দিতে হলো। ব্রাভো কোম্পানির সমস্ত ইউনিট একই সময় পাল্টা হামলা চালালে শত্রু সেনারা প্রচুর সংখ্যায় হতাহত হয় এবং বাকি সৈনিকগণ পিছু হটে যায়। আমাদের পাল্টা আক্রমণের সময় ‘বি’ কোম্পানি ছাড়াও আমাদের পূরা ডিফেন্স লাইন থেকেই মরাল সাপোর্ট হিসেবে হাল্কা গুলি বর্ষণ করা হয়। ফলে পাকিস্তানিরা আমাদের অবস্থান সম্বন্ধে মোটামুটি একটা ধারণা পেয়ে যায়। তাদের পক্ষ থেকে অবশ্য আর কোনো আক্রমণ এলোনা। তারা সম্ভবত পরিস্থিতি মূল্যায়ণ করে বড়ভাবে আক্রমণের পরিকল্পনা রচনা করছে। কোথাও কোনো সাড়া শব্দ নেই। যেন একটু আগে কিছুটি হয়নি!

মনটা আমার খুবই বিষন্ন। প্রকৃত যুদ্ধ শুরুর আগেই চলে গেলো এয়ার আহাম্মদ। কিছুটা শান্তনও অবশ্য পেলাম। শক্ৰ সেনাদের মধ্যে একজন ক্যাপ্টেন, একজন সুবাদার, একজন ল্যান্স নায়েক এবং দুইজন সিপাহীকে খতম করে তবেই বিদায় নিলো সে। হতাহতের হার ১:৫। যুদ্ধের প্রথম ফলাফল আমাদের পক্ষে। ভাবনায় ছেদ পড়লো। খই ফোটার মতো হঠাৎ গোলাগুলি শুরু হলো। সমগ্ৰ ডিফেন্স জুড়ে দুদিক থেকেই তারা প্ৰচণ্ডভাবে আমাদেরকে আক্রমণ করে বসলো। আমরাও আক্রমণ প্রতিহত করে চলেছি। সে এক ভয়াবহ দৃশ্য। পাকিস্তানিরা বেপরোয়া। উত্তর দিকের, তথা বিলোনিয়া ও পরশুরামে অবস্থানরত হানাদারেরা যুদ্ধ করছে আমাদেরকে হটিয়ে অবরোধ থেকে বের হয়ে দক্ষিণে গিয়ে তাদের মূল বাহিনীর সাথে মিলিত হতে। আর দক্ষিণ দিক থেকে শক্ৰ সেনারা আমাদেরকে আক্রমণ করছে আমাদেরকে শেষ করে দিয়ে উত্তর দিকে আঁটকে পড়া তাদের সৈনিকদেরকে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে। দু’দিক হতে বেপরোয়া এ আক্রমণে আমাদের স্যান্ডউইচ’ হওয়ার দশা। কিন্তু অদম্য মনোবল নিয়ে আমাদের যোদ্ধারা শক্রর ভয়াবহ আক্রমণ প্রতিহত করতে লাগলো। গুলির বিরামহীন আওয়াজ। বিপজ্জনক পরিস্থিতি। ইতোমধ্যে ভারতীয় ২৩ মাউন্টেন ডিভিশনের দূর পাল্লার আর্টিলারী গর্জে উঠলো। আর্টিলারী ও মর্টারের গোলার প্রচণ্ড আঘাতের সাথে সাথে আমাদের আক্রমণও তীব্রতর হলো । পাকিস্তানিদের ত্রাহী মধুসুধন অবস্থা। যুদ্ধ কিছুটা আমাদের অনুকূলে এসে গেলো। তবে আক্রমণের গতি ও তীব্ৰতা অক্ষুন্ন রইলো।

হঠাৎ দুটো কথা মনে পড়ে গেলো। এয়ার আহাম্মদের লাশ কই? তাকে না আমি বাংলার মুক্ত মাটিতে সমাহিত করার ওয়াদা করেছি? আমি টাস্ক ফোর্স কমান্ডার মেজর জাফর ইমামের পাশের বাংকারে। এ মুহুর্তে বাংকার থেকে বের হওয়া খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। তবুও আমি আমার বাংকার ছেড়ে বের হয়ে এলাম। দ্রুত গতিতে ক্রলিং করে কমান্ডারের বাংকারে গিয়ে ঢুকলাম। কমান্ডার মেজর জাফর ইমাম ভীষণ ব্যস্ত।

বাংকারে বসেই উনি পুরো ডিফেন্সের খোঁজ খবর নিচ্ছেন, দিচ্ছেন প্রয়োজনীয় নির্দেশ। বিচক্ষণতার সাথে পরিস্থিতি মূল্যায়ন করে ভারতীয় তথা মিত্র বাহিনীকে অনুরোধ করছেন নির্দিষ্ট স্থানে আর্টিলারী ফায়ারের জন্য। মুহুর্তের মধ্যেই মিত্র বাহিনীর মূহুর্মুহু গোলা-বৃষ্টি পাকিস্তানীদের সেই নির্দিষ্ট অবস্থান তামা-তামা করে দিচ্ছে। এক ফাঁকে তাকালেন উনি আমার দিকে। কী ব্যাপার, তুমি এখানে কেন? প্রশ্ন তার। এয়ার আহাম্মদের শেষ ইচ্ছার কথাটা তাকে আমি জানালাম এবং তার লাশ উদ্ধার করে স্বাধীন বাংলার মাটিতে তাকে সমাহিত করার জন্য স্যারের অনুমতি চাইলাম। ‘ইমপসিবল! War Field এর সবচেয়ে ভয়ানক আর স্পর্শকাতর স্থানে এয়ার আহাম্মদের লাশ পড়ে আছে। এ মুহুর্তে এ লাশ উদ্ধার করতে যাওয়া আত্মহত্যা করার শামিল হবে। “Wait!” ব্যস্ত হয়ে পড়লেন উনি আবার। গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজ এবং অবর্ননীয় টেনশনের মধ্যেও সময় সুযোগ বুঝে সি.ও.কে আমি বুঝাতে সক্ষম হলাম যে, এ মুহুর্তে আমরা স্থানীয়ভাবে আগে মোতায়েনকৃত শক্ৰ সেনাদের সাথে লড়ছি। কিন্তু ফেনী এবং কুমিল্লা হতে পাকিস্তানি সেনাদের Reinforcement আসা শুধুই সময়ের ব্যাপার। ওদের আক্রমণ তখন আরো ভয়াবহ এবং তীব্রতর হবে। সে পরিস্থতিতে এ লাশ উদ্ধারই করা যাবে না। জীবন দিয়ে হলেও এ লাশ এখনি আমি সরিয়ে আনতে চাই, সমাহিত করতে চাই মুক্তাঙ্গনে। প্রিয় বন্ধু ও সহযোদ্ধা এয়ার আহাম্মদকে দেয়া ওয়াদা আমি ভঙ্গ করতে পারবো না। বলতে বলতে আমার গলা ধরে এলো, টপ টপ করে গড়িয়ে পড়লো বেদনাশ্রু। মেজর জাফর ইমাম অপলক তাকিয়ে রইলেন আমার দিকে। দীর্ঘ নিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ওকে।’

‘থ্যাংক্যু স্যার’ বলে ফিরে এলাম আমি নিজের বাংকারে। সহযোদ্ধাদেরকে নিয়ে বসলাম। লাশ উদ্ধারের টেকনিক, লাশ পরিবহন এবং লাশ নিয়ে ফিরে আসার রুট সহ খুটিনাটি যাবতীয় প্ল্যান করে ফেললাম দ্রুত। পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা খুবই রিস্কি হবে-বললাম আমি। আরো বললাম ‘এ মিশনে আমার চারজন সহযোদ্ধা চাই।’ এয়ার আহাম্মদের লাশ উদ্ধার করতে গিয়ে পুরো টিমেরই লাশ হয়ে যাওয়া প্ৰায় শত ভাগ নিশ্চিত জেনেও গম্ভীরভাবে রাজী হয়ে গেলো শহীদ, মোশাররফ, সফিক ও মানু। কাল বিলম্ব না করে ‘বিসমিল্লাহ’ বলে রওয়ানা দিলাম আমরা। দু’পাশে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের বাংকার। সবাই যুদ্ধরত, সতর্ক ও ব্যস্ত। ক্রলিং করে দু’দিকের আমাদের বাংকারের সারির মাঝখান দিয়ে পূর্ব দিকে এগুচ্ছি আমরা। গন্তব্য শালিয়া গ্রাম। দু’দিক থেকেই অবিরত গুলি আসছে, ‘ক্রস ফায়ার’ হয়ে আমাদের সামান্য উপর দিয়ে চলে যাচ্ছে তা দু’দিকে। মজা পাচ্ছিলাম এই ভেবে যে, উত্তর দিকে অবস্থানরত পাকিস্তানির দক্ষিণ দিকে ফায়ার করছে আর দক্ষিণ দিকে অবস্থানরত পাকিস্তানির উত্তর দিকে। আমাদের টিম এবং আমাদের ডিফেন্সের উপর দিয়ে চলে গিয়ে সেসব অজস্র গুলি ওদেরই সহযোদ্ধাদেরকে কিছুটা হলেও ঘায়েল করছেই। আমাদের যোদ্ধারা অপেক্ষাকৃত নিরাপদ বাংকারে। আমাদের ডিফেন্সের সামনে বাংকার খুঁড়ে ডিফেন্স তৈরি করার সুযোগই তারা পায়নি। তারা যুদ্ধ করছে জমিনের আইল বা পুকুর পাড়ের আড়ালে থেকে। সুতরাং তাদের ফ্রেন্ডলি ফায়ারে তাদেরই আহত নিহত হওয়ার সম্ভাবনা আমাদের চাইতে বেশি। কী দারুণ!

দীর্ঘ সময় ক্রলিং করে প্যাঁক-কাদায় একাকার হয়ে ‘বি’ কোম্পানীর কমান্ডার সে. লে. মিজান এবং নায়েব সুবেদার সেকান্দার আলীর সাথে দেখা করে তাদের দিক নির্দেশনায় আমরা এয়ার আহাম্মদের লাশের পাশে এসে পৌঁছলাম। বাংকার থেকে এনে তার সহযোদ্ধারা তার মৃত দেহটি পাশের মাটির দেয়াল ঘেরা একটি গুদাম ঘরের মেঝেতে এনে রেখেছে। এয়ার আহাম্মদ শুয়ে আছে উপরের দিকে মুখ করে। ডান চোখ খোলা। বাঁ চোখ ভেদ করে শত্রু নিক্ষেপিত গুলি মাথার পেছনের সামান্য ডান পাশ দিয়ে বের হয়ে গেছে। ঠোঁটটি শক্তভাবে বন্ধ। দুহাতই আছে মুষ্টিবদ্ধ অবস্থায়। গায়ের সার্টসহ শরীর রক্তাক্ত। ‘বি’ কোম্পানির এক যোদ্ধা এসে এয়ার আহাম্মদের লাশ জড়িয়ে ধরে হাউমাউ করে শিশুর মতো কাঁদছে। তার নাম নুরুল ইসলাম। মুনশীর হাটের দরবারপুর গ্রামের মজুমদার বাড়ির ছেলে। পরে হাবিলদার হিসেবে ১০ বেঙ্গল থেকে সে রিটায়ার্ড করে। সে যাক, নুরুল ইসলাম সহ সকলে মিলে এয়ার আহাম্মদের লাশ আমরা নীচের উঠানে নামিয়ে আনলাম। মোশাররফ, শহীদউল্লাহ এবং সফিক আড়াআড়িভাবে পশ্চিম দিকে মাথা দিয়ে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লেন। প্ল্যান অনুযায়ী এয়ার আহাম্মদের লাশ তাদের পিঠের উপর উত্তর দিকে মাথা রেখে পিঠ এবং কোমরের মাঝামাঝি স্থানে আড়াআড়িভাবে শুইয়ে দেয়া হলো। আমি সামনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লাম। একইভাবে মানু পেছনে উপুড় হয়ে শুয়ে পড়লো। প্ৰচণ্ড গোলাগুলির মধ্যে ডান-বাম-ডান বলে বলে আমি ফিরতি পথে ক্রলিং শুরু করলাম । লাশবাহী তিন মুক্তিযোদ্ধা একই গতিতে আমাকে অনুসরণ করলো। চলতে গিয়ে দেহের ভাইব্রেশন এবং নড়াচড়ার কারণে লাশ বাঁকা হয়ে গেলে বা স্থানচ্যুত হতে থাকলে পুর্বের নির্দেশ মোতাবেক মানু তা সঠিক স্থানে ঠেলে বা টেনে দিতো। এগিয়ে চলেছি। আমরা। বাম-ডান-বাম। বাম-ডান-বাম। লেফট-ব্রাইট-লেফট। লেফটরাইট-লেফট। ব্যতিক্রম হলো এই যে, স্বাভাবিকভাবে এ ধরনের মার্চ পাষ্টে পা চলে, আর এখন আমাদের চলছে দুহাতের দুই কনুই। রাস্তা কর্দমাক্ত। কোথাও কোথাও পিচ্ছিল। গোলাগুলি চলছে অবিরাম। রাস্তা শেষ হতে চায় না। অবশ্য স্বভাবতই আমাদের চলার গতি ছিলো অত্যন্ত মন্থর।

কতদূর এসেছি, কতক্ষণ চলেছি জানিনা। হঠাৎ ক্ষীণ কণ্ঠের আর্তনাদ এবং এক ধরনের কষ্টকর কণ্ঠস্বর শুনা গেলো। সহযাত্রী তথা সহযোদ্ধাদেরকে কাদায় থুঁতনি রেখে কিছুক্ষণ বিশ্রাম নিতে বলে ধীরে ধীরে আমি সেই গোংগানী ধরনের আওয়াজের দিকে এগিয়ে গেলাম। গিয়ে দেখি হাবিলদার বায়েজিদ এক অশ্বথ গাছে হেলান দিয়ে বসে আছে। আটিলারী বা মর্টারের গোলার আঘাতে তার ডান পা’টা কোমরের অংশ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে হাত তিনেক দূরে পড়ে আছে। আমাকে দেখে বিষাদ ক্লিষ্ট একটা হাসি দিয়ে বললেন ‘পানি।’ পানি কোথায় পাবো? কোথাও খাবার পানি দেখলাম না। আশে-পাশে কোন পুকুর বা টিউবওয়েলও নেই। পাশেই ছোট্ট একটি গর্তে ঘন ও ময়লা সামান্য একটি পানি চোখে পড়লো। দু’হাত দিয়ে এক আঁজলা ঘোলা পানি এনে তার মুখে ঢেলে দিলাম। অমৃত বা শরাবন তহুরার মতো তিনি তা পান করলেন এবং তৃপ্তির হাসি হাসলেন। উঠতে গিয়ে ডান দিকে কাত হয়ে পড়ে গেলেন তিনি এবং যন্ত্রণায় কঁকিয়ে উঠলেন। আমি তাড়াতাড়ি গিয়ে তার পাশে বসে পড়লাম। মাথাটা টেনে নিলাম কোলে। বললেন, ‘মুস্তফা ভাই, বাঁচবো না। আমি মরে যাচ্ছি। স্বাধীন বাংলাদেশটা দেখে যাওয়ার সৌভাগ্য আমার হলোনা।’ হাঁপাচ্ছেন উনি। চোখ বন্ধ করে রাখলেন কিছুক্ষণ। খুললেন আবার। কণ্ঠ ক্ষীণ হয়ে এসেছে। মৃদু এবং ক্ষীণ কণ্ঠে বললেনঃ ‘শীপু নামে আমার একটি ছেলে আছে। পারলে একটু দেইখেন।’ আবার চোখ বুজে ফেললেন। আমি তার কপাল এবং মাথায় হাত বুলিয়ে দিচ্ছি। হঠাৎ জোরে বলে উঠলেন ‘লা ইলাহা…তখনি একটা আর্টিলারী বিকট শব্দে নিকটে কোথাও বিস্ফোরিত হলো। শরীরটা একটু ঝাঁকানী দিয়ে নিথর হয়ে গেলো হাবিলদার বায়োজিদের শরীর। আমি বললাম-‘ইন্নালিল্লাহে ওয়া ইন্না ইলাইহে রাজেউন।’…এ লাশ নিয়ে এখন আমি কী করি? মনে পড়ে গেলো এয়ার আহাম্মদের লাশের কথা। অনিচ্ছা সত্ত্বেও এবং বাধ্য হয়েই তাই হাবিলদার বায়েজিদের মাথা অত্যন্ত তমিজের সাথে মাটিতে নামিয়ে রেখে ক্রলিং করে ফিরে এলাম পূর্বের অবস্থানে, এয়ার আহাম্মদের কাছে। আমার সহযোদ্ধারা ইত্যবসরে খানিকটা বিশ্রাম পেলো। ভালোই হলো। এ পদ্ধতিতে, ঐ ভয়ানক পরিবেশে, বিপদসংকুল কর্দমাক্ত পথে, ঐ ভারি লাশ নিয়ে প্রায় দুই কিলোমিটার পথ চলা যে কতো সাহসের, কতো কষ্টের এবং কতো বড় মিশনের ব্যাপার, প্রিয় পাঠক, আপনার কথা বাদ দিন, আমি নিজেই আজ তা কল্পনাও করতে পারি না।

আবার শুরু হলো আমাদের ক্লান্তিকর পথ চলা। আশে-পাশে শত্রুর গোলা এসে পড়ছে। মাথার উপর দিয়ে যাচ্ছে হাজার হাজার, লাখ লাখ বুলেট। এক সময় শত্রুর ব্রাশ ফায়ারের এক ঝাঁক গুলি আমার চুল আঁচড়িয়ে দিয়ে চলে গেলো। বেঁচে গেলাম। আমাদের শরীর নিস্তেজ । শরীর আর চলে না। শ্বাস-প্ৰশ্বাস ভারি হয়ে গেছে। নিশ্বাস বের হওয়ার সময় মনে হচ্ছে যেন নাকের চারপাশের দেয়াল ছুরির কাটার মতো ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে থেমে একটুখানি বিশ্রাম নিয়ে আগাচ্ছি। কিন্তু সত্যিই আর পারি না। এক পর্যায়ে বিরামহীন গোলাগুলির প্রচণ্ড আওয়াজের মধ্যে বিপজ্জনক পথে এবং প্যাঁক-কাদার মধ্যেই আমরা ঘুমিয়ে পড়লাম, হয়তোবা জ্ঞান হারালাম। জানিনা কতোক্ষণ ছিলাম। এভাবে। এক সময় চেতনা ফিরো এলো। কতোক্ষণ অচেতন অবস্থায় পড়েছিলাম তা আর কোনোদিন জানা যাবে না। শুরু হলো আবার আমাদের সেই অস্বাভাবিক কাফেলার পথ চলা। এক সময় আমরা আমাদের গর্বের ধন, আমাদের প্রান প্রিয় সি.ও. মেজর জাফর ইমামের বাংকারের সামনে পৌঁছে গেলাম। জাফর ইমাম প্রথমে অবাক বিস্ময়ে এবং পরে প্রশংসার দৃষ্টিতে আমাদের দিকে তাকালেন। তিনি আমার পিঠ চাপড়ে দিলেন। বললেন-‘এ্যা গ্রেট জব ডান!’ হাবিলদার এয়ার আহাম্মদের পাশে কিছুক্ষণ অশ্রুসজল নয়নে নীরবে তাকিয়ে রইলেন। এরপর স্থানীয় কিছু ভলান্টিয়ার ডেকে এনে লাশ ভারতীয় সীমান্তের অভ্যন্তরে বিলোনিয়া-চোত্ত্বাখোলা রাস্তা পর্যন্ত নেয়ার ব্যবস্থা করে দিলেন। পাহাড়ি ঐ রাস্তাটি ভয়ানক রকমের পিচ্ছল, আঁকা-বাঁকা এবং উঁচু-নীচু। কোন যান-বাহনই নেই। একেবারেই ফাঁকা। লাশ নিয়ে দাঁড়িয়ে আছি আমরা। যেতে হবে চোত্তাখোলা। এখান থেকে সেই গন্তব্য হবে অন্তত ১০ মাইল। কী করি?

হঠাৎ দেখি বিলোনিয়ার দিক থেকে একটা সামরিক জিপ এগিয়ে আসছে। সবাই মিলে হাত নেড়ে এবং চেঁচামেচি করে জিপটাকে থামানোর চেষ্টা করলাম, কিন্তু ব্যর্থ হলাম। একই গতিতে জিপটি চলে যাচ্ছে আমাদের গন্তব্য চোত্তাখোলার দিকে। মনটা খারাপ হয়ে গেলো। কিন্তু বেশ কিছু দূর যাওয়ার পর জিপটি কেন জানি হঠাৎ থেমে গেলো এবং কী মনে করে জানিনা, ব্যাক গিয়ার মেরে পিছনে ফেরত আসা শুরু করলো, থামলো আমাদের সামনে এসে। জিপ থেকে লাফিয়ে নামলো বি.এস.এফ এর এক ক্যাপ্টেন। উপরে নীচে তাকিয়ে দেখলেন আমাকে এবং আমার সহযোদ্ধাদেরকে। আমাদের চোখে তখন টকটকে লাল এবং পুরো শরীর কাদায় প্যাঁকে একাকার। কিম্ভূত কিমাকার অবস্থা। বললেন, ‘আপলোক কৌন হ্যায়? কেয়া মাংতা? হুয়া কেয়া?’ আমি উর্দু-হিন্দি ভাষা বুঝি, কিন্তু বলতে পারিনা। হাবিলদার এয়ার আহাম্মদের লাশ দেখিয়ে ইংরেজীতে বললাম ‘আমার সহযোদ্ধা। বিলোনিয়া যুদ্ধের প্রথম শহীদ। তবে এক ক্যাপ্টেন সহ ৫ শত্রু সেনাকে খতম করে তবেই মৃত্যুবরণ করেছে। তার শেষ ইচ্ছা ছিলো বাংলার মুক্ত মাটিতে কবর পাওয়ার। যুদ্ধের ময়দান থেকে তার লাশ আমরা তুলে নিয়ে এসেছি। এ লাশ নিয়ে আমরা চাত্তাখোলা যেতে চাই। জিপটি কী দেয়া সম্ভব?’ কথাটা বলেই নিজেকে নিতান্তই বোকা এবং অবিবেচক মনে হলো। যুদ্ধের সময় ইচ্ছা থাকলেও উনি এভাবে একটা সামরিক যান ধার দিতে পারেন না। তার সেই স্বাধীনতাও হয়তো নেই। ক্যাপ্টেন ধর (তার নাম ধর বলেই মনে পড়ে) কিছুই বললেন না। তিনি তার সৈনিকদেরকে সাথে নিয়ে এয়ার আহাম্মদের লাশের পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন এবং আমাকে অবাক করে দিয়ে সামরিক কায়দায় এয়ার আহাম্মদকে সেলুটি করলেন। আমাকে বললেন- ‘But do you have a free land to burry him?’ আমি বললাম-‘Probably we don’t. But please don’t worry. If need be, we will fight to free a piece of land to burry him.’ আমার আবেগ, অনুভূতি, মনোবল এবং শহীদ সহযোদ্ধার শেষ ইচ্ছা পূরণে আমাদের সকলের দৃঢ় সংকল্পে ক্যাপ্টেন হতবাক হয়ে গেলেন। হঠাৎ দেখি, চোখ থেকে তার অশ্রু গড়িয়ে পড়ছে টপ টপ করে। ভাঙ্গা গলায় বললেন-‘You wanted to have the jeep?’ আমি তারাতারি বললাম-Yes sir!” দরদ ভরা কষ্ঠে বললেন উনি-‘You get it!’

ভিনদেশী এক সৈনিকের অভাবনীয় সহযোগিতা ও সহমর্মীতায় একেবারেই লাজওয়াব এবং আপ্লুত হলাম আবেগে। ড্রাইভারকে ক্যাপ্টেন হিন্দিতে কিছু নির্দেশ দিলেন এবং চোত্তাখোলার নির্দিষ্ট একটি স্থানে গাড়ি নিয়ে তাদের জন্য অপেক্ষা করতে বললেন। এরপর তিনি তার অধীনস্থ সৈনিকদেরকে নিয়ে সেই কৰ্দমাক্ত পিচ্ছিল পথ ধরে চোত্তাখোলার দিকে মার্চ করা শুরু করলেন। আর আমরা এয়ার আহাম্মদের লাশ সহ সেই জিপ নিয়ে তাদেরকে অতিক্রম করে এগিয়ে চললাম। কৃতজ্ঞতা আর শ্রদ্ধায় আজো স্মরণ করি মিত্র বাহিনীর উদারতা, সহৃদয়তা, সহমর্মিতা আর সেদিনের সেই কথা।

চোত্তাখোলা একটা ছোট্ট সীমান্ত শহর। চিরকুমার জননেতা এবং ফেনীর এমপি জনাব খাজা আহাম্মদ এখানে একটি ‘মুক্তিযোদ্ধা রিক্রুটমেন্ট এন্ড ট্রানজিট ক্যাম্প’ স্থাপন করেছিলেন। বাংলাদেশ থেকে আসা শরণার্থীদের বেশ কয়েকটা শরনার্থী শিবিরও এখানে রয়েছে। চোত্তাখোলা থেকে মাইল খানেক পূর্বেই বাংলাদেশের সীমানা এবং আন্তর্জাতিক সীমানা হতে বালুয়া গ্রামের দূরত্ব এক মাইলের চাইতে সামান্য একটু বেশি। এই বালুয়া গ্রামেই এয়ার আহাম্মদের জন্ম এবং এ গ্রামেই আমরা তাকে সমাহিত করতে চাই।

লাশবাহী আমাদের জিপটি শেষ পর্যন্ত চোত্তাখোলায় এসে পৌঁছালো। এখানে অবস্থানরত হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে বাংলাদেশের শত শত লোক জড়ো হলো। বালুয়া গ্রামের আওয়ামী লীগের নিবেদিত কর্মী মোহাম্মদ আলী এয়ার আহাম্মদের লাশ জড়িয়ে ধরে আকুল কান্নায় ভেঙে পড়লেন। তাকেই বালুয়া গ্রামে পাঠালাম এয়ার আহাম্মদের বাবা-মা-চাচা-মামাদের খবর দেয়ার জন্য। স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা ইউনুস চৌধুরীর নেতৃত্বে লাশ নিয়ে আমরা সীমান্তের ধারে গিয়ে পৌঁছলাম। বালুয়া গ্রাম তখনো পুরোপুরি শত্রুমুক্ত হয়নি বলে সেখানে কবর দেয়া কঠিন ও অত্যন্ত কুঁকিপূর্ণ হবে বিধায় সীমান্তের ৫০০ গজ দূরের দক্ষিণ পৈথারা গ্রামে একটি উঁচু স্থানে তাকে সমাহিত করার সিদ্ধান্ত হলো। কিন্তু ধানের মাঠের শেষ প্রান্তে পাকিস্তানিদের বাংকার চোখে পড়লো। কবর দেয়ার সময় পাকিস্তানিদের দ্বারা যদি আমরা আক্রান্ত হই তা প্ৰতিহত করার লক্ষ্যে ব্যবস্থা গ্ৰহণ করলাম। শাকী ও ছালেহ আহমদের প্লাটুনের কয়েকজন মুক্তিযোদ্ধা, স্থানীয় কিছু গেরিলা যোদ্ধা এবং আমার চারজন সহযোদ্ধাদেরকে নিয়ে ছোট্ট একটি প্রতিরোধ বাহিনী গড়ে তুললাম। অস্ত্ৰ-শস্ত্ৰ সহ তাদেরকে এমনভাবে ডিফেন্সিভ পজিশনে Place করলাম যাতে শত্ৰু-সেনারা আক্রমণ করলেও যুদ্ধ করতে করতে এয়ার আহাম্মদকে আমরা সমাহিত করে ফেলতে পারি। এর মধ্যেই এয়ার আহাম্মদের মা-বাবা-মামা সহ আত্মীয় স্বজন এসে গেলো। সৃষ্টি হলো এক বেদনা-বিধুর পরিবেশ। সে দৃশ্য বর্ণনা করা অসম্ভব। শুরু হলো কবর খোড়া। ইতিমধ্যে কোত্থেকে জানি সবুজের মধ্যে লাল গোলকের মধ্যখানে মানচিত্র খচিত বাংলাদেশের আদি পতাকাটি নিয়ে আসলেন ইউনুস চৌধুরী। সেই পতাকা দিয়ে আমরা এয়ার আহাম্মদের লাশ মুড়ে দিলাম। স্থানীয় মসজিদের ইমাম জানাজা পড়ালেন। ইতিমধ্যে কবর খোঁড়া হয়ে গেছে। এয়ার আহাম্মদের ছোট মামা রুহুল আমিন সহ মোট তিনজন কবরে নেমে এয়ার আহাম্মদের লাশ গ্ৰহণ করলেন এবং ধীরে ধীরে সে লাশ কবরের মাটিতে শুইয়ে দিলেন। তিনজনের মধ্যে দু’জন কবর ছেড়ে উঠে এলেও রুহুল আমিন মামা কবর ছেড়ে আসতে অস্বীকার করলেন। এয়ার আহাম্মদের লাশ জড়িয়ে ধরে কাত হয়ে উনি কবরে শুয়ে পড়লেন এবং তাকে সহ কবর দেয়ার কাজ শুরু করার জন্য আমাদেরকে বিনীত অনুরোধ করলেন। কবর থেকে উঠে আসার জন্য আমাদের সমস্ত যুক্তি এবং অনুরোধ ব্যর্থ হলো। তাকে সহ দ্রুত কবর দিয়ে দেয়ার জন্য করুন কান্না সহ উনি অনুনয় বিনয় করতে থাকলেন। জানা গেলো যে, এয়ার আহাম্মদ এবং তার ছোট মামা রুহুল আমিন প্ৰায় সমবয়সী, ছোটবেলাকার খেলার সাথী ও ঘনিষ্ঠ বন্ধু। দুজনই অবিবাহিত। ভীষণ সমস্যায় পড়ে গেলাম। এ ধরনের দৃশ্য অপ্রত্যাশীত ও অস্বাভাবিক। সময় বয়ে যাচ্ছে। যে কোনো সময় আমরা পাকিস্তানিদের দ্বারা আক্রান্ত হতে পারি। ইতোমধ্যেই ভিড়-ভাট্টা দেখে পাকিস্তানিরা দুটো Single Shot fire করলো। আমার সহযোদ্ধাদেরকে বাধ্য না হলে fire open করতে আগেই নিষেধ করেছিলাম। দাফন-কাফন সম্পন্ন হওয়ার পূর্বে যুদ্ধবিগ্ৰহ বা কোনো ঝামেলাতে জড়াতে চাইনা আমি। ছোট মামার ব্যাপারে শেষ পর্যন্ত আমাকে কঠোর হতেই হলো। মোহাম্মদ আলী সহ তাগড়া ৪ জন যুবককে একটু দূরে ডেকে নিয়ে ব্রিফিং দিলাম। পরিকল্পনা মোতাবেক তারা আচম্বিত কবরে নেমে মামা কিছু বুঝে উঠার আগেই বিজলীর গতীতে তাকে চেং দোলা করে উঠিয়ে কবরের বাইরে ঠেলে দিলেন। সাথে সাথে ৭/৮ জন জোয়ান ছেলে তাকে মাটিতে ঠেষে ধরলো। আর এ ফাঁকে আমরা এয়ার আহাম্মদকে শেষ দেখা দেখে, চির বিদায় জানিয়ে কবর দেয়ার কাজ সমাধা করলাম। দোয়া-দরুদ পড়ে, মুনাজাত করে এবং সকল মুক্তিযোদ্ধারা মিলে সামরিক কায়দায় এয়ার আহাম্মদকে সেল্যুট ফিরে এলাম আমরা বিলোনিয়ার যুদ্ধ ক্ষেত্রে। টাস্ক ফোর্স কমান্ডার মেজর জাফর ইমামের কাছে রিপোর্ট করে ছুটলাম আমি শহীদ হাবিলদার বায়েজিদ যেখানে শহীদ হয়েছেন সেই অশ্বথ গাছের দিকে। গিয়ে দেখি জমাট বাধা থোক থোক রক্ত। কিন্তু হাবিলদার বায়েজিদ নেই। কোথায় গেল আমার নিজের হাতে রেখে যাওয়া এ লাশ??

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!