You dont have javascript enabled! Please enable it!

উদ্বাস্তুরা মানিয়ে নেবার চেষ্টা করছেন
কমলকুমার দাস

জিজ্ঞেস করলে উত্তর পাবেন, “জী আমরা জয় বাংলার লােক।” অধিকাংশেরই পরণে লুঙ্গী, গায়ে হাফ হাতা গাঢ় নীল জামা, মা, এক মুখ দাড়ি, পায়ে রঙিন রবারের জুতাে, হাতে দু-একটা কাপড়ের পুঁটলি, সঙ্গে মেয়েছেলে আর কাচ্চাবাচ্ছা।
এই মাসখানেক আগেও যারা বনগাঁয় এসেছিলেন, আজকের বনগাঁ তাঁদের কাছে নতুন লাগবে। শহরে ঢােকার মুখে, রেল লাইন পার হলেই চোখে পড়বে অসংখ্য মানুষ। শহর ছাড়িয়ে, রায় ব্রীজ পার হয়ে গেঁড়াপােতা, হেলেঞ্চা, বাগদা, মামাভাগনা অতিক্রম করে একেবারে পাকিস্তান সীমান্ত বয়রা পর্যন্ত এই জনস্রোত চোখে পড়বে। খালি মানুষ আর মানুষ। পথের পাশে মানুষ, রাস্তা ভর্তি মানুষ। বাসের মাথায় মানুষ।
বনগাঁ শহরের কাছে হরিদাসপুরে শরণার্থীদের জন্য ক্যাম্প খােলা হয়েছে। এই ক্যাম্পে প্রায় দশ হাজার লােক আশ্রয় পেয়েছেন। সরকারি সহযােগিতায় ভারত সবাশ্রম সংঘ এই ক্যাম্প পরিচালনা করছেন।
বনগাঁ হাসপাতালেও দেখলাম ওপার বাঙলার রােগীর সংখ্যা বেশি। বুলেট বিদ্ধ লােকও অনেক আছেন। বুলেট বিদ্ধ ৫৫ বছরের পাঁচু দাস আর তারাপদ দাসকে অ্যাম্বুলেন্স থেকে নামাতে দেখলাম। খবর পেয়ে জানলাম ওদের গ্রাম নিশ্চিন্দপুর, পাে: কালীগঞ্জ। ওঁরা যশাের জেলার লােক। বাড়ি থেকে টেনে নিয়ে এসে ওদের পরিবারের বাকি সকলকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে।
সায়রার কথা বাগদার কাছে এক ক্যাম্পে দেখলাম সায়রা মাটিতে উপুড় হয়ে পড়ে চীৎকার করে কাঁদছে, হাত পা ছুড়ছে, মাথা ঠুকছে আর বলছে, আমি থাকব না, আমায় নিয়ে চলাে, গাড়ি আনাে।”
ওর পুরাে নাম সায়রা খাতুন, বয়স ১৬, বাবার নাম সানু সর্দার। শুনলাম যশােরেই এক ছেলের সঙ্গে তার বিয়ের ঠিকঠাক হয়েছিল। হঠাৎ বিয়ের আগের দিন রাতে ওদের গ্রামে শুরু হয় পাকিবাহিনীর পৈশাচিক আক্রমণ। ওরা কোনমতে এপার বাঙলায় পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়। তারপর থেকেই সায়রার এই দশা। ছেলেটার এখন পর্যন্ত কোন খবর পাওয়া যায়নি। মাঝে মাঝে সায়রা প্রকৃতিস্থ হয়। তখন বিয়ের কথা বললেই ও চুপ করে যায় আর চোখ দিয়ে দূরে কাকে যেন খুঁজতে চেষ্টা করে।
দৈনিক সংবাদপত্রে আর এক সায়রার কথা নিশ্চয়ই পড়েছেন। নাম “সায়রা বিবি” ও “লাল রং” দেখলেই আঁতকে ওঠে। তার স্বামীকে ও স্বচক্ষে বুলেট বিদ্ধ হয়ে নিহতদের মধ্যে পড়ে থাকতে দেখেছে।

হেলেঞ্চা, বাগদা ও মামা ভাগনা ক্যাম্প
হেলেঞ্চা ক্যাম্পে শরণার্থী সংখ্যা ৯৪৬৮। এখানে প্রতিদিন শরণার্থীদের জন্য প্রায় ৪০ কুইন্টাল চালের ভাত, ২০ কুইন্টাল ডাল আর ২০ কুইন্টালের মতাে আলু লাগে। আতপ চালের ভাত হলে চালের পরিমাণ কিছু বেশি লাগে। রাজ্য সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ এই লেখার সময় পর্যন্ত ৪৮০০ জন লােককে টিকা দিয়েছেন। “লায়নস ক্লাব” ও গুজরাটী সংঘ” এই ক্যাম্প পরিচালনা করছেন।
মামা ভাগনায় দুটো ক্যাম্প খােলা হয়েছে। ১নং ক্যাম্পে ৫২১৫ জন শরণার্থী স্থান পেয়েছেন। ২নং ক্যাম্পে আশ্রয় প্রার্থীদের সংখ্যা ৪৮১২। দুটি ক্যাম্পেই প্রতিদিন শরণার্থীদের সংখ্যা কিছু কিছু বৃদ্ধি পাচ্ছে। ১নং ক্যাম্প পরিচালনা করছেন ভারত সেবাশ্রম সংঘ। ২নং ক্যাম্প পরিচালনা করছেন “শ্রীগুরু সংঘ”।
“বাগদা” ক্যাম্পে শরণার্থীদের সংখ্যা প্রায় ৬০০০ হাজারের মতাে। সরকারি সহযােগিতায় “কাশী বিশ্বনাথের” নব যুবক সংঘ এই ক্যাম্প তদারকীর দায়িত্ব নিয়েছেন। এখানে ৫২০০ জনকে প্রতিষেধক দেওয়া হয়েছে।
ক্যাম্পে দুপুরের খাবার হিসাবে ভাত, ডাল, আর তরকারি দেওয়া হচ্ছে। রাতের খাবার ‘খিচুড়ি’। কিছু কিছু বেসরকারি স্বেচ্ছামূলক প্রতিষ্ঠান দুধ, রুটি ও শিশুখাদ্য দিচ্ছেন।
সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগ প্রতিটি ক্যাম্পে যথাসাধ্য চিকিৎসার ব্যবস্থা করছেন। এছাড়া কলকাতার কিছু কিছু ডাক্তারী ছাত্র স্বেচ্ছায় উদ্বাস্তুদের সেবার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। কিন্তু তা সত্ত্বেও দেখলাম প্রতিটি ক্যাম্পেই ‘রােগীর সংখ্যা প্রচুর। অধিকাংশ লােকেরই দেখলাম পেটের অসুখ করেছে। এছাড়া বেশ কিছু লােক চুলকানি ও জ্বরে আক্রান্ত হয়েছে। দু একজনের ‘চিকেন পক্স’ও হয়েছে। আসন্নপ্রসবা বহু মহিলাও ক্যাম্পে আছেন।
আজকের এই শােচনীয় পরিস্থিতির মধ্যেও দেখলাম শরণার্থীরা নিজেদেরকে বেশ মানিয়ে নিয়েছেন। ক্ষেতের কাছে যা পাওয়া যাচ্ছে তাই দিয়েই যথাসম্ভব সুষ্ঠুভাবে থাকার চেষ্টা করছেন। অনেকে আবার কাঠের উনুন তৈরি করে খাবার গরম করছেন। ছােট ছেলেমেয়েরা খেলাধূলা করছে। পুরুষদের মধ্যে কেউ কেউ “একত্র” খাটছেন, দুই-চারজন নিজেদের রিক্সা চালাচ্ছেন। দু-এক জায়গায় তাসের আসর বসছে। বাগদা হাইস্কুলের শিবিরের প্রশস্ত উঠানে, পায়ে ঘুঙুর বেঁধে হাতে তানপুরা নিয়ে তুরফ মিয়াকে দেখলাম উদাত্তকণ্ঠে গান গাইছেন। পরিচিত কেউ আবার এলেন কিনা তাই দেখতে অনেকে আবার দল বেঁধে এক শিবির থেকে অন্য শিবিরে যাচ্ছেন। দিনের আলাের শেষে দু-একটা ক্যাম্পে দেখলাম সন্ধ্যাপ্রদীপ ও ধূপ জ্বালানাে হয়েছে।
বাগদা হাসপাতালে ঢুকতেই চোখে পড়ল বিছানায় বসে ৭/৮ বছরের একটা মেয়ে বছরখানেক বয়সের একটা বাচ্চাকে কোলে নিয়ে অঝােরে কাঁদছে আর ওদের ঘিরে বেশ কয়েকজোড়া অশ্রুসজল চোখ। ওদের বাড়ি ছিল পদ্মাপারের ততালিয়ান গ্রাম। আচম্বিতে পাকিস্তানি আক্রমণে ওদের মা আর চার বছরের ভাইটা নিহত হয়। ওদের বাবা অনেক কষ্টে ওদের নিয়ে এপার বাঙলায় হাজির হন। তার পরই ওদের বাবা শ্ৰীঅজিত বসুর শুরু হয় পাইখানা আর বমি। ওদের বাপকে হাসপাতাল বেডে স্যালাইন দেওয়া হয়েছে। আমি বাড়ি ফিরছি। ওদের কান্নার আওয়াজ তখনও শােনা যাচ্ছিল।

সূত্র: সপ্তাহ, ২৮ মে ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!