You dont have javascript enabled! Please enable it!

বিশ্ব শরণার্থীদের কথা ভুলে গেছে | ওয়েস্টার্ন মেইল (কার্ডিফ) | ২৪ শে সেপ্টেম্বর ১৯৭১
লেখকঃ সুনন্দ দানা রায় ।

পূর্ববাংলা শরণার্থীদের প্রত্যাবর্তন জন্য প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী নির্ধারিত ছয় মাসের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছে । ভারত এর বিপর্যস্ত ত্রাণ কর্মকর্তারা ভারী বর্ষনের ফলে সৃষ্ট বন্যার বিরুদ্ধে নিদারুণভাবে যুদ্ধ করে যাচ্ছেন। সরকারীভাবে ঘোষিত ৯ মিলিয়ন শরণার্থীর মধ্যে সাড়ে পাঁচ মিলিয়ন শরণার্থী খাদ্য ওষুধ এবং বস্ত্র সব সরবরাহ থেকে বঞ্চিত আছে। বন্যা আক্রান্ত হয়ে জলাবদ্ধ থাকার কারনে বিভিন্ন স্থানে দ্রুত মজুদ শেষ হয়ে যাওয়া জিনিসগুলো সরবরাহ করার কাজও জটিল হয়ে পড়েছে। শিবিরের হতাশাগ্রস্ত ৮ জন তরুন ডাক্তার ও ২০০০ নার্স অভিযোগ করেছেন যে সবচেয়ে বেশী হওয়া গ্যাস্ট্রোন্টারিটিটিস এবং স্ক্যাবিস রোগের ঔষধ ডিসপেনসারিগুলোতে পাওয়া যাচ্ছেনা এবং চালের সরবরাহ ৫০০ গ্রাম থেকে জোর করে কমিয়ে ৩৫০ গ্রামে আনা হয়েছে । হাজার হাজার বাঁশের তৈরি অস্থায়ী আবাসের কঙ্কাল ত্রিপল বা পলিথিনের আচ্ছাদন ছাড়াই পড়ে আছে।

দুর্ভিক্ষ একটি তাত্ক্ষণিক বিপদ নয়, তবে কর্মকর্তারা আরেকটি ভয়ঙ্কর রোগের প্রাদুর্ভাবকে ভয় করছেন যা হলো কলেরা। মে মাসে এই রোগে ৬০,০০০ জন আক্রান্ত হয়েছিলো যার মধ্যে ৯,০০০ জন প্রান হারান। নতুন নতুন বিপদ যতটা না শরণার্থী শিবির থেকে আসে তার চেয়ে বেশী আসে বিভিন্ন সংবাদ থেকে। পূর্ব বাংলাকে স্বাধীন করার জন্য গেরিলা মুক্তিবাহিনীর আক্রমনের ফলে পাকিস্তানী বাহিনীর চালানো প্রতিহিংসামূলক কর্মকাণ্ডে সিলেট থেকে ভারতের মেঘালয় রাজ্যে ১৬০০০ এর বেশি শরণার্থী আশ্রয় নিয়েছে। তাদের বেশিরভাগই কলেরায় আক্রান্ত হয়ে এসেছে, যাদের এক সপ্তাহের মধ্যে চিকিৎসা শুরু করা প্রয়োজন কিন্তু কলকাতায় অবস্থিত রিলিফ হেডকোরারটার মেডিসিনের বাহী একটি কার্গোর চালান পাঠাতে পারছেনা আসামে যা কিনা দক্ষিন-পূর্বে ত্রান সরবরাহের একটি প্রধান কেন্দ্র। কলকাতা থেকে গৌহাটি পর্যন্ত ঐতিহ্যবাহী নদীপথ ১৯৬৫ সালের যুদ্ধের সময় বন্ধ করে দেয়া হয়।

বিশ্ববিবেক শরণার্থীদের জন্য তাদের দেয়া আশ্বাস রাখেনি। বিশ্বজুড়ে জাতিগুলির প্রতিশ্রুত অর্থের দশ ভাগেরও কম পরিমাণ অর্থ পাওয়া গেছে। যদিও উদ্বাস্তুদের দৈনিক প্রবাহ আগস্ট এ আসা ৩৪০০০ থেকে সেপ্টেম্বরে ২৬০০০ এ নেমে এসেছে। পরিকল্পনাকারী যারা পূর্বে প্রত্যাশা করেছিলো – তার কিছুটা আশাবাদী যে সমস্যা এমাসের শেষের দিকে কমে আসবে এবং তারা সামনের ৬ মাসের পরিকল্পনা ও বাজেট প্রনয়নে ব্যস্ত সময় পার করছেন। অনেক প্রতিকূলতার মধ্যেও ত্রাণের কার্যক্রম যেভাবে অব্যাহতভাবে চলেছে সেটি একটি অলৌকিক ঘটনা। কিন্তু শরণার্থী শিবিরগুলোতে চরম হতাশার মাঝেও অনেক আশার আলো ঘুরে বেড়ায়। ক্যাম্পগুলোতে শুধু রয়েছে অক্ষম বৃদ্ধ , মহিলা ও শিশুরা। তরুনেরা মুক্তি বাহীনিতে যোগদানের জন্য শিবির ত্যাগ করেছে। ৫০০০ জন লোকের শরনারথী শিবিরে আমি দেখেছি সামান্য ছোটমাছ আর শাক রাখা আছে ছোট্ট ছোট্ট দোকানে যা স্থানীয়রা খেয়ে থাকে। বালকেরা মাছ ধরার জাল বোনায় ব্যস্ত ছিলো এবং একজন কুজো হয়ে যাওয়া বৃদ্ধ মহিলা আবহমানকাল ধরে চলে আসা গ্রামীন আতিথিয়তায় বরন করে নিয়েছিলেন। তিনি আমাদের ব্রিটিশ দাতব্য সংস্থা অক্সফামের দেয়া মল্ট ফ্লেভারের ত্রাণের বিস্কুট দিয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন। এটিই হচ্ছে উদ্বাস্তু জীবনের বাস্তবতা। এখানে স্কুল আছে, বিনোদনের জন্য সপ্তাহিক গানের আসর হয়। এবং উদ্বাস্তুদের থেকে নির্বাচিত স্বেচ্ছাসেবীদের দিয়ে পরিষ্কার পরিচ্ছতা অভিযান করা হয়। কিন্তু যেসব জেলায় ক্যাম্প বন্ধ করা হয়েছে, সেখানের অবস্থা বিপজ্জনক। অতি বর্ষণে নদী ও খাল উপচে পড়া পানিতে পশ্চিমবঙ্গ ঘোলাপানির এক ক্রুদ্ধ সাগরে পরিণত হয়েছে। প্রদেশের শহরগুলো বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে, ব্রিজগুলো ভেঙ্গে পড়েছে, রাস্তা ও রেললাইন ভেসে গেছে। পশ্চিমবঙ্গের বন্যাতে মৃতের সংখ্যা হাজারেরও বেশি ছাড়িয়েছে। ত্রান সরবরাহের অন্যতম প্রধান সমস্যা হয়ে দাড়িয়েছে যোগাযোগ ব্যবস্থা। পশ্চিমবঙ্গের উত্তর দিকের পাঁচটি জেলা- পশ্চিম দিনাজপুর, জলপাইগুড়ি, কোচ বিহার, দার্জিলিং ও মালদা। কলকাতার ২০০ মাইল দক্ষিনে অবস্থিত ফারাক্কায় গঙ্গার তীব্র স্রোতের কারনে প্রায় ৩৫০০০০ শরণার্থীর যোগাযোগ বিছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। এটি আসাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরা প্রদেশের তিনটি উত্তর-পূর্বাঞ্চলীয় রাজ্যগুলির প্রধান রাস্তা ছিল, যা দিয়ে প্রায় দুই মিলিয়ন শরণার্থী পাঠানো হয়েছিলো । কলকাতা হলো সকল কিছু সাপ্লাইয়ের মূল ঘাটি। আগামী কয়েদিনের মধ্যে যোগাযোগ পুনরায় চালু না হলে সেখানে অবস্থিত ৪০০ ক্যাম্পের (ঐ ৫ রাজ্যের মোট ৯৪০ টির মধ্যে) ঔষধ , কাপড় , খাবার ও নির্মাণ সামগ্রীর মজুদ শেষ হয়ে যাবে ।

এই হতাশাজনক পরিস্থিতিতে অক্সফামের পাঁচটি রিলিফ বোঝাই ট্রাক পানিতে ভেসে গেছে, এখন তারা বাধ্য হচ্ছে বিমান পরিবহনের মধ্যমে ঔষধ পাঠাতে। কিন্তু এই পথে পন্য পাঠানোর ক্ষেত্রে একমাত্র ভরসা দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ আমলের পুরোনো ডাকোটা বিমান যারা এই ক্রাসিসের সুযোগে ভাড়া বাড়িয়েছে ত্রিপুরার রাজধানী আগরতলায় মালামাল পাঠানর ক্ষেত্রে। ভারতীয় বিমান বাহিনীর প্লেন ইতিমধ্যেই সেখানে এক ডজনের বেশী ফ্লাইট পরিচালনা করেছে কিন্তু এটি যথেষ্ট নয়। অক্সফাম আঞ্চলিক পরিচালক জুলিয়ান ফ্রান্সিস বলছেন যে তিনি এই বছরের শেষ নাগাদ পূর্ববঙ্গ উদ্বাস্তুদের জন্য প্রায় £৬,৩৪,০০০ ব্যয় করার আশা করছেন। কিন্তু অক্সফাম বিহারের হুড্সের জন্য ৪২ হাজার পাউন্ড এর ত্রাণ প্রকল্পের কাজ শুরু করে এবং খরচ কমাতে গত সপ্তাহে ফ্রান্সিস বন্যা দুর্গত রাস্তা এড়িয়ে বিকল্প রাস্তা ব্যবহার করে তিনটি গাড়ি পাঠিয়েছে যার প্রতিটিতে নয় টন করে হাই প্রোটিনযুক্ত খাবার, ঔষধ ও কাপড় পাঠানো হবে।

সময় শেষ হয়ে যাচ্ছে। বর্ষা মৌসুমের সবচেয়ে খারাপ সময় এখন শেষ হতে পারে, কিন্তু স্টোরেজ সুবিধা উত্তর ও উত্তর-পূর্বের মধ্যে অপর্যাপ্ত। এবং কম চলাচলের জন্য সাপ্লাই এর চালান পাঠানো অনিশ্চিত। রাস্তাগুলির এ অবস্থার কারণে গত ২০ দিন ধরে কলকাতা রাস্তায় জাতিসংঘ প্রদত্ত প্রায় ২৩০টি জাপানী ট্রাক অচল বসে আছে। এই দুর্দশার বর্ণনা করা প্রায় অসম্ভব। যেখানে শরনার্থী ও চাষী দুই পক্ষই এখন গৃহহীন। হুড এলাকায় যেখানে পানিতে তলিয়ে থাকা রাস্তা মাথা উচু করে দাড়িয়েছে সেখানে বন্যার ফলে অমানবিক পরিস্তিতি ও গন ক্ষুধা সৃষ্টি হয়েছে – যা ছড়িয়ে আছে বনগাঁ শহর থেকে চল্লিশ মাইল দূরে পাকিস্তান সীমানা পর্যন্ত।

একজন ভারতীয় রোমান ক্যাথলিক চার্চ এর প্রাইস্ট বলেছেন, তিনি তার দায়িত্বে থাকা ১৭ টির মধ্যে এখন মাত্র ৩ টি ক্যাম্পে ভ্রমন করতে পারছেন। বাকিগুলো হয় বন্যায় নিমজ্জিত, নাহয় যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন। ক্যাথলিক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন ক্যারিতাস প্রাইস্টকে কিছু অর্থ সাহায্যের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে এবং প্রাইস্ট চেষ্টা করছেন কিছু স্থানীয় নৌকা কেনার জন্য যার মাধ্যমে তিনি পুনরায় ঐসকল ক্যাম্প এর সাথে সংযোগ স্থাপন করতে পারেন। এতকিছু সত্বেও ত্রানের কাজ অব্যাহত রয়েছে এবং এই কার্যক্রমের প্রধান ভারতীয় কর্মকর্তা কর্নেল পি এন লুথরা বলেছেন ত্রাণ কার্যক্রমের সুচী আগের অবস্থান থেকে সরে নতুন ভাবে করা হয়েছে। এখন পাঁচ ধাপে এই কার্যক্রম পরিচালনা করার কারনে কিছু সুবিধা পাওয়া যাচ্ছে। সীমান্ত থেকে শরণার্থীদের গ্রহন করা হচ্ছে, এরপর প্রতিষেধক দেয়া হচ্ছে, তারপর তারা পাকিস্তানী এজেন্ট কিনা তা ক্রসচেক করে দেখা হচ্ছে, এরপর তাদের থাকার জায়গা দেয়া হচ্ছে, অন্যান্য সুবিধাযুক্ত কার্ড প্রদান করা হচ্ছে এবং এসবকিছুই হচ্ছে এরা ভারতে প্রবেশের মাত্র তিন দিনের মধ্যেই। এরপর দ্বিতীয় পর্যায়ে ছোট ও বিচ্ছিন্ন ক্যাম্পে থাকা শরনার্থীদের একত্র করা হচ্ছে এবং বড় শহরের বড় ক্যাম্পে পাঠানো হচ্ছে। প্রতিটি ক্যাম্পের ধারন ক্ষমতা এক লক্ষ। জলপাইগুড়ির ৫৪ টি ক্যাম্প এর সংখ্যা ইতোমধ্যে ২২ এ নেমে এসেছে এবং প্রত্যাশা করা যাচ্ছে শীঘ্রই তা ১২ তে নামিয়ে আনা যাবে । তাদের প্রধান সড়কের পাশে উঁচু স্থানে তৈরি ক্যাম্পে পাঠানোর ব্যাপারে কর্নেল লুথরার যুক্তি হচ্ছে এতে তাদের সংখ্যা নিয়ন্ত্রন সহজ হবে, তাদের মেডিকেল সুবিধা ও ত্রান সরবরাহও সহজে করা যাবে। কিন্তু কথা হচ্ছে তাদের আসলে কিছুই দেয়া যাবেনা যদিনা বৈদেশিক সাহায্য বা নতুন ত্রানের ব্যবস্থা না হয়। তৃতীয় পর্যায়ের সম্ভাব্য পরিকল্পনায় রয়েছে শরণার্থীদের নিজ দেশে নির্বিঘ্নে ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়াটি, কিন্ত হতাশ তরুন অফিসার কর্নেল লুথরা এই করুন পরিস্থিতি দেখে শরণার্থীদের ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়ার আগেই হয়ত পদত্যাগ করতে পারেন ।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!