জয় বাংলা ১৯ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ, ২৮শ সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার ২রা অগ্রহায়ণ, ১৩৭৮ ১৯শে নভেম্বর, ১৯৭১
“এই ঈদে আমাদের প্রার্থনা হোক….”
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জন্য তাজউদ্দিন আহমেদ জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ঈদ বাণীতে বলেনঃ ‘আমাদের দেশে এবারের ঈদ এসেছে অত্যন্ত মর্মান্তিক পরিবেশে। দখলীকৃত এলাকায় শত্রুসৈন্য তাণ্ডব চলছে, লক্ষ লক্ষ মানুষ স্বাভাবিক জীবনযাত্রা থেকে বিচ্যুত হয়ে শরণার্থী হয়েছেন, সর্বাত্মক প্রস্তুতি চলছে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য, রক্তের বিনিময়ে মানুষ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার জন্য করছে। এবার ঈদে আনন্দ মুছে গেছে আমাদের জীবন থেকে, আছে শুধু স্বজন হারানোর শোক, দুর্জয় সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা ও আত্মত্যাগের প্রবল সংকল্প।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আমার নিজের পক্ষ থেকে বাংলাদেশের জনসাধারণকে ঈদ উপলক্ষে আমি আন্তরিক শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। ঈদের আনন্দ আজ আমরা হারিয়েছি, তা আমাদের জীবনে পুনঃপ্রতিষ্ঠা হবে সেদিনই, যেদিন আমরা দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করব। আমি আপনাদেরকে আশ্বাস দিচ্ছি যে, যথাসর্বস্ব পণ করে যে স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত, তার চূড়ান্ত সাফল্যের দিনটি নিকটতর হয়ে এসেছে। সেই মুহূর্ত থেকে এগিয়ে আনার সংগ্রামে আমরা সকলের জন্য নিঃস্বার্থভাবে নিজেদের নিয়োগ করতে পারি, এই ঈদে তাই হোক আমাদের প্রার্থনা।’
খুনি ইয়াহিয়ার সাথে আলাপ আলোচনার কোনো প্রশ্নই উঠে না
স্বার্থবাদী মহলের বিভ্রান্তিকর প্রচারণা জবাবে বাংলাদেশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ এক বিশেষ সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে,’ইয়াহিয়া খান বা তার কোন প্রতিনিধির সাথে কোনরকম আলোচনা শুরুর প্রশ্নই উঠতে পারে না।’
খন্দকার মোশতাক আহমেদ দ্ব্যর্থহীনভাবে ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশের যুদ্ধের একমাত্র লক্ষ্য হচ্ছে পূর্ণ স্বাধীনতা।
বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী জানান যে, বাংলাদেশ নেতৃত্ব সরকারি বা বেসরকারি কোন পর্যায়ে কলকাতায় মার্কিন কূটনীতিকগণ বা অন্য কোন লোকের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদের কাছ থেকে কোনো রাজনৈতিক টোপ বা বাণী পাননি। তিনি এ ধরনের প্রকাশিত সংবাদের সত্যতা সরাসরি অস্বীকার করেন।
খন্দকার মোশতাক আহমেদ বলেন, কলকাতায় মার্কিন কূটনীতিকদের মাধ্যমে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ইয়াহিয়ার পক্ষ থেকে দূতালী করার সংবাদ প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হল বিশ্বব্যাপী বাংলাদেশের বন্ধুদের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করা এবং বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের কৃতিত্বপূর্ণ ও বিরাটতর সাফল্যের মুখে তাদের মধ্যে বিভ্রান্তি আনয়ন ও যুদ্ধের ব্যাপারে তাদেরকে উদাসীন করে তোলা।
পররাষ্ট্রমন্ত্রী সংশ্লিষ্ট স্বার্থবাদী মহল এর প্রতি আবেদন জানিয়ে বলেন, আপনারা যদি আমাদের বাঁচার জন্য কিছু করতে না পারেন, তাহলে অন্ততঃ আমাদের স্বাধীনতার জন্য মরতে দিন। বাংলাদেশের মানুষের রক্তের স্রোতকে শক্তি শিবিরের স্বার্থে বা অন্যদের উপর প্রভাব রাখার কাজে ব্যবহার করবেন না।’
যারা বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে আলোচনার সংবাদ প্রচার করেন তারা পাকিস্তানেরই বন্ধু এবং দুরভিসন্ধি নিয়েই তারা তা করে থাকেন বলে খন্দকার মোশতাক মন্তব্য করেন।
উপসংহারে বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া সাড়ে সাত কোটি বাঙালির প্রতিটি অস্ত্রের ভাষায় কথা বলেছে বাংলার বীর মুক্তি বাহিনীর সেই অস্ত্রের ভাষায় তার সমুচিত জবাব দিচ্ছে এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত এই অস্ত্রের ভাষাতেই জবাব দিতে থাকবে।
মহিলাদের পত্রিকা
“মায়ের ডাক”
সম্প্রতি মুজিবনগর থেকে মহিলাদের উদ্যোগে “মায়ের ডাক” নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়েছে। পত্রিকাটি সম্পাদনা করছেন বেগম নিলুফার মাহবুব। বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর জনতা যেদিন আহমেদ পত্রিকাটির প্রতি শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেছেন এবং মহিলাদের এই উদ্যোগকে অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ইয়াহিয়ার রাজত্বে
বাঙ্গালীদের বেতন নাই
মুজিবনগরে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার রেলওয়ে বাঙালি কর্মচারীদের এপ্রিল মাস থেকে এ পর্যন্ত বেতন দেওয়া হয়নি। কিন্তু রেলওয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী ও উর্দুভাষী কর্মচারীরা রীতিমতো বেতন পাচ্ছে।
বাঙালি কর্মচারীদের সরাসরি বেতন না দেওয়ার জঙ্গী সিদ্ধান্ত জানিয়ে দেওয়া হয়েছে। তাদের আরো বলে দেওয়া হয়েছে যে, রেলওয়ে রায় না হওয়া পর্যন্ত কোন বাঙালি রেল কর্মচারী বেতন পাবে না।
এছাড়াও শত শত রেল কর্মচারীকে ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী গ্রেফতার করে তাদের উপরে অবর্ণনীয় নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
বাঙালি রেল কর্মচারীদের অপরাধ হচ্ছে, তারা পহেলা মার্চ থেকে বাঙালি জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষিত অসহযোগ আন্দোলনের প্রতি সক্রিয় সমর্থন জানিয়েছিলেন।
দিশেহারা শত্রুসৈন্য এখন আত্মরক্ষায় ব্যস্ত
ঢাকায় মুক্তি বাহিনীর সাঁড়াশি আক্রমণ
(নিজস্ব প্রতিনিধি প্রেরিত)
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা দখলীকৃত ঢাকা শহরে ক্রমাগত প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যদের কে এক অস্বস্তিকর পরিবেশে ফেলে দিশেহারা করে তুলেছেন।
গত ২রা নভেম্বর রাত্রে ঢাকার পুলিশ দপ্তরের উপরে গেরিলা যোদ্ধারা এক আকস্মিক আক্রমণ চালায়। টহলদানরত পুলিশকে পরাস্ত করে বোমা দ্বারা আক্রমণ চালিয়ে দখলদারদের বহু দলিলপত্র ভষ্মিভূত করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা কয়েকদিন পূর্বে মতিঝিলস্থ পিআইএ অফিসে একটি শক্তিশালী বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে অফিসের কাগজপত্র ধ্বংস এবং একজন দালাল কর্মচারীকে গুরুতররূপে আহত করেন। এছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের কুখ্যাত আব্দুল কাইয়ুম কে গুলি করে হত্যা করেন।
একজন বিদেশী কূটনীতিক জানাচ্ছেন যে, ঢাকা শহরে এখন সূর্যাস্তের পর সম্পূর্ণ মুক্তিবাহিনীর অধীনে চলে যায়। সন্ধ্যার পর পাকিস্তান সামরিক গাড়িগুলো আর রাস্তায় টহল দিতে সাহস পায়না। সেখানকার সাধারণ মানুষ মুক্তিবাহিনীকে সর্বাত্মক সাহায্য করছেন। দিনের বেলায় রাস্তায় ব্যারিকেড তৈরি করে রাখছে। সামরিক বাহিনীর পোশাক পরে একদল লোক যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করছে। একজনকে পাহারা দিচ্ছেন ৩ জন সামরিক পুলিশ। কলকাতা স্থ বিদেশি কূটনৈতিক মিশনের উক্ত কনসাল জেনারেল বলেন ঢাকায় অবস্থানকালে তিনি ঢাকা নারায়ণগঞ্জ সড়ক দিয়ে নারায়ণগঞ্জের গিয়েছিলেন। তিনি ওই সড়কের আশেপাশে কোন পাকা গৃহ দেখতে পাননি। চাউলের দাম বর্তমানে প্রতিসের ৭৫ পয়সা।
তিনি বলেন সাধারণ লোক খুব ভয়ে ভয়ে দিনের বেলায় রাস্তায় চলাফেরা করেন। কিন্তু হানাদার সৈন্যদের সন্ধ্যার পর মনে হয় ধাকা একটি মৃত নগরী। খানসেনাদের মনোবল এখন সম্পূর্ণ ভেঙে যাচ্ছে। তিনি আরো বলেন তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমান বিধ্বংসী কামান ছাড়াও বাঙ্কার এবং সামরিক ফেলা হয়েছে। ডাক্তার মালিকের সরকারের কোনো অস্তিত্ব সেখানে নেই। তথাকথিত মন্ত্রীরা আত্মরক্ষার জন্য এখন ক্যান্টনমেন্টের আশ্রয় নিয়েছে।
বিলম্বে পাওয়া খবরে জানা গেছে যে, গত ১৫ই অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার নিকট সি এন্ড বি সড়কে দুইজন পাকিস্তানি খানসেনা ও দুইজন রাজাকারকে হত্যা করে। উক্ত দিন অত্র জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা একজন রাজাকার কে হত্যা করে এবং একটি রাইফেল ও ৫০ রাউন্ড গুলি মুক্তিবাহিনী হস্তগত করে।
উক্ত জেলায় ২৩শে অক্টোবর স্বাধীনতাকামীরা সোনাগাজীতে হানাদারদের একটি দলকে অতর্কিত আক্রমন করে দুইজন পাকসেনাকে নিহত ও চার জনকে আহত করে।
একই তারিখের মুক্তিযোদ্ধারা সোনাগাজী রাস্তায় একজন অফিসার সহ ৯জন হানাদার সৈন্য খতম করেন এবং তাদের জিপটিও সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। গত ২৪শে অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর তরুণ গেরিলারা এক সংঘর্ষে লিপ্ত হয়। রাতে দখলদার সেনারা ৩শত সেনা নিয়ে অতর্কিতে সোনাগাজী আক্রমণ করলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা তার দাঁত ভাঙ্গা জবাবে তাদেরকে প্রতিহত করেন। উভয় পক্ষে প্রায় দুই ঘণ্টা যুদ্ধের পর শত্রুদের ৩ জন খানসেনা ও সাত জন রাজাকার নিহত হয়।
কুকুর পাগল!
পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জাঁদরেল ব্রিগেডিয়ার শামীম এখন লাহোরের বনেদি মানসিক হাসপাতালে বাসিন্দা হয়েছেন এবং দুই পুত্র শোকে বুক চাপড়াচ্ছেন। ব্রিগেডিয়ার শামীম ১০৫ ইন্ডিপেন্ডেন্ট ব্রিগেডের কমান্ডার ছিলেন।
তার সাম্প্রতিক কর্মস্থল ছিল লাহোর ফাজিলকা সীমান্তে। সেখানে রক্ত খেকো দানব ইয়াহিয়ার ১০৫ ব্রিগেডের কর্মাধ্যক্ষ হিসেবে ব্রিগেডিয়ার শামীম আমাদের প্রতিবেশী বন্ধু রাষ্ট্র ভারতের সীমান্ত গোলযোগ সৃষ্টির কাজে লিপ্ত ছিল। নভেম্বরের প্রথম সপ্তাহের শেষের দিকে তারা তার তাবুতে বসে যখন সে হুইস্কি পান করছিল তখন মুক্তিবাহিনীর হাতে তার দুই পুত্রের নিহত হওয়ার খবর পেয়েই ব্রিগেডিয়ার শামীমের মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। তারপর তাকে লাহোরের পাগলা গারদে ভর্তি করে দেওয়া হয়। বর্তমানে এই ব্রিগেডের দায়িত্ব নিয়েছে ব্রিগেডিয়ার আমির হামজা।
ব্রিগেডিয়ার শামীমের এক ছেলে মেজর এবং অপর ছেলে বেসামরিক প্রশাসন কাজে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় নিযুক্ত ছিল। মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসী গেরিলারা তাদের দু’জনকেই হত্যা করে।
একজন বিদেশি সাংবাদিক লিখেছেন, পশ্চিম পাকিস্তানের উচ্চপদস্থ সামরিক অফিসার প্রতিদিনেই বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মীয়-পরিজনের নিহত হওয়ার সংবাদ পাচ্ছে। সমগ্র পশ্চিম পাকিস্তানে এর ফলে মাতম শুরু হয়ে গেছে।
পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে যেসব সাধারণ সৈনিক প্রতিদিন নিহত হয়েছে তাদের মৃত্যুর খবর তাদের পরিবার-পরিজনের কাছে গোপন রাখছে। মৃত্যুর খবর না জানিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের বসবাসরত তাদের পরিবারের কাছে পূর্বের মতোই মানি অর্ডারের বেতন পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা অব্যাহত রেখেছে। শুধুমাত্র অফিসারদের মৃত্যু গোপন রাখা সম্ভব নয় বলে তাদের পরিবারকে জানানো হচ্ছে।
খান সেনারা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির অপচেষ্টা করছে
মুক্তিবাহিনী ও বসে নেইঃ অতর্কিত আক্রমণে হাজার হাজার মণ ধান চাল উদ্ধার
(জয় বাংলার নিজস্ব প্রতিনিধি)
খুলনা ১৬ই নভেম্বরঃ দেবহাটা থানার আশেপাশের অধিকৃত অঞ্চলে হানাদার পাকসেনারা কৃত্রিম দুর্ভিক্ষ সৃষ্টির এক ঘৃন্য ষড়যন্ত্রে মেতেছে। তারা বিভিন্ন গ্রাম থেকে ধান, চাল, হাঁস-মুরগি, গরু-ছাগল ইত্যাদি কেড়ে নিয়ে গিয়ে নিজেদের ইচ্ছে অনুযায়ী জমা করে রাখছে এবং স্থানীয় জনসাধারণের ওপর অকথ্য অত্যাচার চালাচ্ছে। খান সেনারা স্থানীয় অঞ্চলের জনসাধারণকে ক্ষেতের পাকা ফসল ঘরে তুলতে নিষেধ করে এক আদেশ জারি করেছে। মাঝে মাঝে তারা দেশি দালাল রাজাকার দিয়ে হাট বাজারও লুট করছে। লুঠকরা খাদ্যদ্রব্য তারা অন্যত্র পাচার করছে এবং কিছু কিছু আবার স্থানীয়ভাবেও স্তূপীকৃত করে রাখছে। পাকিস্তানি হানাদারের ঘনিষ্ঠ মহল থেকে জানা গেছে যে, তারা কিছু ফসল ক্ষেতেই নষ্ট করে দিতে চায় এবং বাকিটা লুট করে নিজেদের আয়ত্তে নিয়ে এসে কৃত্রিম অভাব সৃষ্টি করে জনতার পেটের ক্ষুধা কে নিজেদের কাজে লাগাতে চায়। নরপিশাচের বাংলাদেশের মানুষকে ধুঁকে ধুঁকে মারার যে হীন চক্রান্ত করেছে তা উপলব্ধি করে স্থানীয় জনসাধারণ উদ্বেগাকুল হয়ে পড়েছে। রেশন দেবার নাম করে খানসেনারা একদিকে বিশ্বজনমতকে ধোঁকা দিচ্ছে অপরদিকে বাংলাদেশের বীর জনতাকে অভুক্ত রেখে বশ করার অপচেষ্টার মেতেছে।
কিন্তু বাংলাদেশের দুর্বার শক্তিধর মুক্তি সৈনিকেরাও বসে নেই। বাংলাদেশি হানাদার কবলিত মানুষের দুঃখ মোচনের জন্য তাদের সৃষ্টি, তারা জনসাধারণের উপরে আঘাত আসলেই তার পাল্টা আঘাত করার জন্য তাদের পাশে গিয়ে দাঁড়িয়েছে। গ্রামের পর গ্রাম শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করে ঘৃণ্য পশুর সকল ষড়যন্ত্র বানচাল করে দেবার জন্য বাংলাদেশের শক্তিধর সৈনিকেরা দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। তাই পাকিস্তানের দস্যুদের লুঠ করা মাল গুদামজাত করে রাখার ঘাঁটিতে অতর্কিত হামলা চালিয়ে জনগণের জনগণের হাতে ফিরিয়ে দেবার ব্যবস্থা করেছে। সম্প্রতি এখানকার দেবী শহরে পাক বাহিনীর এক লুঠ করা মালের গুদামে হামলা করে মুক্তিবাহিনীরা এক হাজার মণ চাল উদ্ধার করে এবং স্থানীয় বুভুক্ষ বাংলার জনসাধারণের মধ্যে বিলি করে দেয়। মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের খানসেনারা পালিয়ে প্রাণ রক্ষা করে এবং সমগ্র এলাকা মুক্তিবাহিনীর দখলে আসে। এই অঞ্চলটি এখন একটি সুরক্ষিত মুক্ত এলাকা। কানাড়া স্থানীয় এলাকা থেকে হাজার হাজার মণ চাল ও ধান সরিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনীর সুতীক্ষ্ণ দৃষ্টি এদিকেও সজাগ। সম্প্রতি ইছামতি নদীর তীরে কয়েকটি গ্রাম থেকে লুঠ করা চালবোঝাই লঞ্চের উপরে হামলা করে বীর মুক্তিসেনা কয়েক হাজার মণ চাল উদ্ধার করে।
আজ সকালে সূত্রপাত হতে উদ্ধারকৃত বারো শত মণ চাল বোঝাই একটি মুক্তএলাকায় এসে পৌঁছেছে। ২৫শে মার্চের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে সমগ্র বাঙালি জাতিকে পিষে মারার ষড়যন্ত্র বাংলাদেশের বীর জনসাধারণ যেমন করে বানচাল করে দিয়েছে, আজকের কৃত্রিম দুর্ভিক্ষের লোক মারার ষড়যন্ত্রের জাল ও বাংলাদেশের বীর জনতা তেমনি ছিড়ে ফেলবে এতে সন্দেহ নেই। সকল ষড়যন্ত্রের বেড়াজাল ভেঙে বাংলাদেশ এখন নতুন সূর্য উঠেছে-সূর্যকে কেউ রুখতে পারবে না।
লবণ হ্রদ শরণার্থী শিবিরে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বলেন-
ধর্মনিরপেক্ষ গণতান্ত্রিক সমাজবাদই আমাদের লক্ষ্য
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
গত বৃহস্পতিবার পশ্চিমবাংলার সল্টলেকে শরণার্থী শিবিরে আয়োজিত এক জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ দৃঢ়তার সাথে ঘোষণা করেন যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের অগ্নি মন্ত্রে দীক্ষিত বাংলাদেশ মুক্তিযোদ্ধাদের এবং শরণার্থীরা অদূর ভবিষ্যতে স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরতে পারবেন।
নেতৃবৃন্দ বলেন যে, যতদিন বাঙালি জাতি থাকবে, সভ্যতা থাকবে, ইতিহাস থাকবে ততদিন বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী অটুট থাকবে। কেননা, ভারতবাসী বাংলাদেশের জন্য যা করেছেন তা তারা কোনদিন ভুলতে পারবে না। বাঙালি অকৃতজ্ঞ জাতি নয়।
আওয়ামীলীগ নেতৃবৃন্দ বিশেষভাবে আমন্ত্রিত হয় মুজিবনগর থেকে বাংলাদেশ ভলান্টিয়ার কোর আয়োজিত এই সভায় ভাষণ দিতে এসেছিলেন।
সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী বলেন, পশ্চিমারা ভেবেছিল নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সমস্ত আসন পাবে না। তারপর ও যখন পেয়ে গেল তখন ওরা চেয়েছিল বঙ্গবন্ধুকে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ দিয়ে বাঙ্গালীদের ফাঁকি দিয়ে যাবে, বাংলাদেশের উপর শোষণ অব্যাহত রাখবে। কিন্তু আওয়ামী লীগ ক্ষমতার রাজনীতি করে না। আওয়ামী লীগ চেয়েছে বাংলাদেশ বাঙালির শাসন কায়েম করতে, বাংলাদেশ ধর্মনিরপেক্ষ শাসন ব্যবস্থা কায়েম করতে এবং নিজেদের সম্পদ সমভাবে বন্টন করে খেতে। তাই আওয়ামী লীগ ওদের ফাঁদে পা দেয়নি, দিতে পারেনা।
তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানে জঙ্গি চক্র বাঙালিকে ২৫শে মার্চের পর স্বাধীনতা ঘোষণা করতে বাধ্য করেছে। আমাদের অস্ত্র হাতে তুলে নিতে বাধ্য করেছে। আমরা যুদ্ধে নেমেছি। চূড়ান্ত বিজয় না হওয়া পর্যন্ত আমরা অস্ত্র সংবরণ করবো না। যতদিন বাংলাদেশে একটি ও পশ্চিমা সৈন্য থাকবে ততদিন যুদ্ধ চলবে।
জনাব মিজানুর রহমান চৌধুরী কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, যদি বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধুর কেশাগ্র স্পর্শ করা হয়, পশ্চিম পাকিস্তানের আমাদের যে সমস্ত সেনা অফিসার আটক আছেন তাদের কোনো ক্ষতি করা হয়, ইপিআর, বেঙ্গল রেজিমেন্টের যে সমস্ত সৈনিক আমাদের সাথে যুদ্ধ করছেন তাদের পরিবার-পরিজনের কোন ক্ষতি করা হয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বসবাসকারী বাঙ্গালীদের কোন ক্ষতি হয় তাহলে বাংলাদেশের যুদ্ধ শেষ হলে ও পশ্চিমাদের বিরুদ্ধে আমাদের যুদ্ধ শেষ হবে না। আমরা তাদের মাতৃভূমিতে যুদ্ধ সম্প্রসারিত করব এবং সে যুদ্ধে তাদের মা-বোনদের বিধবা করে ছাড়বো।
শয়তানের নতুন খেলা
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
পশ্চিম পাকিস্তান শুকনো মরুভূমি অঞ্চল। পশ্চিম পাকিস্তানের দক্ষিণ অঞ্চলে বছরে গড়পড়তা ১০ ইঞ্চির বেশি বৃষ্টিপাত হয় না। উত্তরাঞ্চলে হয় গড়-পড়তা ২০ ইঞ্চির মত বৃষ্টিপাত। সেচের পানি ছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের অধিকাংশ জমিতে চাষ করা চলে না। বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানের ২৭০ লক্ষ্ একর জমিতে কৃত্রিম সেচ ব্যবস্থার সাহায্যে চাষ করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের মোট আবাদী জমির শতকরা ৬৯ ভাগ জমিতে সিন্ধু নদ থেকে পানি নিয়ে গম চাষ করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানের পাঞ্জাবকে শস্য ভান্ডার বলা হয়। পাঞ্জাবের গমের উৎপাদন এর মূলে আছে সেচের পানি। সিন্ধুতে পাঞ্জাবের মতেই সেচের পানি ছাড়া চাষ করা চলে না। আর এ পানিও অাসে সিন্ধু নদ থেকে। সিন্ধু নদের পানি বখরা নিয়ে পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশের মধ্যে বিরোধ এখন বিরাট এক চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে। কারণ পাঞ্জাব সিন্ধু নদ থেকে সেচের জন্য যে পরিমান পানি গ্রহণ করছে তাতে সিন্ধু নদীর পানির মাত্রা কমে গিয়ে সিন্ধু নদের নানা জায়গায় বিস্তীর্ণ অঞ্চলজুড়ে চর পড়তে আরম্ভ করেছে। সিন্ধু নদী শুকিয়ে যাবার অবস্থা। সিন্ধীরা তাই বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। সিন্ধু নদের কোটরি অঞ্চল থেকে সিন্ধু নদের মোহনা পর্যন্ত পানির ভয়ঙ্কর অভাব পরিলক্ষিত হচ্ছে এর ফলে সিন্ধু প্রদেশের সমস্ত সেচ প্রকল্পই বাতিল হতে চলেছে। অন্যদিকে পাঞ্জাবীরা বলছে তাদের দেশে ফসল ফলানোর জন্য যে পরিমাণ পানির প্রয়োজন তার অধিকার তারা ছাড়বেনা। সেচের পানির সাহায্যে পাঞ্জাব চাচ্ছে তার গমের উৎপাদন বর্তমান ফসলের পরিমান থেকে শতকরা ২০ ভাগ বাড়াতে। কিন্তু সিন্ধু প্রদেশ কেউ যদি তার সেচের জন্য প্রয়োজনীয় পানি দিতে হয় তবে পাঞ্জাবের গমের ফলন শতকরা ২০ ভাগ বাড়াবে না, বরং শতকরা ১৫ ভাগ কমে যাবে বলে হিসাব করা হচ্ছে। পাঞ্জাবিরা যুক্তি দেখাচ্ছে, যদি সিন্ধু প্রদেশ কে পানি দেওয়া হয়, তবে পাঞ্জাবের এই গমের উৎপাদন কমে যাওয়ার ফলে সারা পশ্চিম পাকিস্তানের বিদেশ থেকে প্রচুর গম আমদানি করতে হবে। কিন্তু পাঞ্জাবের জমিতে সেচের পানির যথাযথভাবে সরবরাহ করলে, পশ্চিম পাকিস্তানের গমের চাহিদার মাত্র শতকরা ১.৫ ভাগ বাইরে থেকে আনবার প্রয়োজন করবে।
কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে, পশ্চিম পাকিস্তান আর এখন একটা প্রদেশ নয়। পাঞ্জাবে গমের ফলন বৃদ্ধি পাওয়া মানেই সিন্দুর কৃষকের খেতে পাওয়া নয়, সিন্ধুর খাদ্য সমস্যার সমাধান হওয়া নয়। পাঞ্জাবের সমস্যা আর সিন্ধুর সমস্যা আলাদা, আর সে এভাবেই তাদের বিচার করতে হবে। পাঞ্জাবে গমের ফলন বৃদ্ধি মানে পাঞ্জাবি কৃষকের স্বচ্ছলতা। অন্যদিকে সিন্ধু দেশের ফসল না ফলার অর্থ সিন্ধু দেশের কৃষকের অনাহারে মরা। তাই সারা পশ্চিমবঙ্গ ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধির যুক্তি দেখিয়ে, সিন্ধু নদের পানির ন্যায্য অধিকার থেকে সিন্ধিদের বঞ্চিত করা চলে না।
শোনা যাচ্ছে পাকিস্তানের রাজনীতির মেকিয়াভেলি জুলফিকার আলী ভুট্টো এখন সিন্ধু প্রদেশের পক্ষে। পাঞ্জাবীরা ও ইসলাম পছন্দ দলগুলো এখন ভুট্টোর বিপক্ষে উঠাচ্ছেন প্রাদেশিকতা দাবি। ভুট্টোকে বলা হচ্ছে পাকিস্তানের অখন্ডতা বিরোধী। ভুট্টোর পক্ষে আমাদের কিছু বলবার নেই। কিন্তু বর্তমান গোলযোগ থেকে প্রমাণ হচ্ছে যে পাঞ্জাবিটা মনে করে পাকিস্তানে যা কিছু তাদের স্বার্থের পরিপন্থী, তাই পাকিস্তানের স্বার্থের বিরোধী, অর্থাৎ পাকিস্তান ও পাঞ্জাব অভেদার্থক।
‘হামলোক মুক্তি কা সাথ লড়াই কারণে নেহি আয়া, উও সিপাই কা কাম হায়….’
দখলীকৃত বাংলাদেশে পাঞ্জাবি পুলিশের বিদ্রোহ
জয়বাংলা প্রতিনিধি
পূর্বাঞ্চলের ১৩০০ মাইল সীমান্ত বেবি পাক সামরিক জান্তা ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করার বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা অভ্যন্তরে হানাদারদের ব্যবস্থা দুর্বল হয়ে পড়েছে। অথচ তারা নিজেই সীমান্তে উত্তেজনা সৃষ্টির উদ্দেশ্যে যে পরিস্থিতির উদ্ভব ঘটিয়েছে, তাতে দখলীকৃত এলাকার অভ্যন্তরের শক্তি বৃদ্ধির উদ্দেশ্যে সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ করা ও তাদের পক্ষে সম্ভব নয়। তাই তাড়াহুড়া করে ট্রেনিং দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা অনভিজ্ঞ কিশোর সৈনিক, পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও স্থানীয় রাজাকার দালালদের উপর এই দায়িত্ব ন্যস্ত করেছে। কিন্তু দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ মুক্তিযোদ্ধাদের মোকাবিলা করা তাদের পক্ষে মোটেই সম্ভব হচ্ছে না।
শুধু তাই নয়, পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা পুলিশদের অনির্দিষ্টকালের জন্য বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রেখে দেওয়াও সম্ভব হচ্ছে না। দখলীকৃত এলাকা অভ্যন্তরে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশরাই প্রধানত মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের শিকার হচ্ছে। গত জুন মাসের প্রথম পক্ষে একমাত্র ঢাকা শহরের রমনা থানা তে চল্লিশটি চীনা রাইফেল জমা পড়েছিল। এই চীনা রাইফেল গুলি পাঞ্জাবি পুলিশদের ইস্যু করা হয়েছিল। তাদের মধ্যে ৪০ জন পাঞ্জাবি পুলিশ নিহত হওয়ায় সেই রাইফেল গুলো পুনরায় রমনা থানায় জমা পড়েছিল।
শুধু ঢাকাতেই নয়, টাঙ্গাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নরসিংদী এবং অন্যান্য এলাকাতেও মুক্তিযোদ্ধা ও গ্রামবাসীদের আক্রমণে বহু পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশ নিহত হওয়ায় তাদের মধ্যে ত্রাস ও ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা পুলিশের মৃত্যুতেও পশ্চিম পাকিস্তানে তাদের আত্মীয়-স্বজনের মধ্যেও ভিশন ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। তারা অবিলম্বে দখলীকৃত বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের স্বদেশে দেশে ফিরিয়ে আনার দাবি জানাচ্ছে। তার ফলে সেখানকার পুলিশ ও সামরিক তারা খুব বেকায়দায় পড়েছে। উপায়ান্তর না দেখে গত জুন মাসেই পাঞ্জাবের পুলিশ কর্তা তাদের পুলিশ বাহিনীকে ফিরিয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছিল।
গত জুন মাসে ঢাকার জয়দেবপুর আরেকটি কৌতুক জনক ঘটনা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ বাহিনীর ভীতিও বিক্ষোভের পরিচয় পাওয়া যায়। টাঙ্গাইল ও ময়মনসিংহ জেলার অভ্যন্তরে নিযুক্ত পাঞ্জাবি পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণের ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে স্ব স্ব কর্মস্থল থেকে পালিয়ে জয়দেবপুরের ক্যাম্পে চলে আসে। তাদেরকে বুঝিয়ে সুঝিয়ে যার যার কর্মস্থলে ফেরৎ পাঠাবার জন্য সামরিক বাহিনীর ক্যাপ্টেন পাঠানো হলে পাঞ্জাবি পুলিশরা তাকে ঘেরাও করে বলেঃ “হামলোক মুক্তি (মুক্তি বাহিনী) কা সাথ লড়াই কারনে নেহি আয়া। উও সেপাই কা কাম হায়। হামলোগকো পুলিশ কা ডিউটি ডিউটি কারেগা।’
সর্বত্র এই একই অবস্থা। বরং ভীতি ও অসন্তোষ আরো বৃদ্ধি পেয়েছে। কিন্তু প্রয়োজন ওরে পথে স্থানীয় পুলিশ সংগ্রহ করতে না পারায় এদের স্বদেশে ফেরত পাঠানো সম্ভব হচ্ছে না। বরং ইচ্ছার বিরুদ্ধে সামরিক আইনের খড়গ উঁচিয়ে জোর করে নতুন নতুন পুলিশ আমদানি করা হচ্ছে। অথচ শুরুতে মাত্র তিন মাসের করারে স্থায়ীভাবে এদের পাঞ্জাব থেকে ধার করে আনা হয়েছিল। এখন এদের মৃত্যুর কোন কৈফিয়ত দেওয়া তাদের পক্ষে সম্ভব হচ্ছে না।
সম্প্রতি ঢাকা থেকে লন্ডনের ডেইলি টেলিগ্রাফের প্রতিনিধি এক খবরে জানিয়েছেন যে, ৬০০০ পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশের মনোবল ভেঙ্গে পড়ার লক্ষণ দেখা যাচ্ছে। বাঙালি পুলিশদের শূন্য স্থান দখল করার জন্য এদের আনা হয়েছিল। গোড়ায় তাদের সেপ্টেম্বরেই স্বদেশে ফেরত পাঠানো হবে বলে প্রতিশ্রুতি দিয়ে দখলীকৃত বাংলাদেশে আনা হয়েছিল। এখন তারা অসহিষ্ণু হয়ে উঠেছে এবং অবিলম্বে ফিরে যাবার একটা পাকা তারিখের দাবি জানাচ্ছে।
এই ভাবেই একে একে পাকহানাদারদের সকল অবলম্বনেই হারিয়ে যেতে বসেছে। ঘরে-বাইরে নাজেহাল হয়ে তাদের এখন অবস্থা দাঁড়িয়েছে মাথার গায়ে কুকুর পাগলের মত।
খান সেনা নিহত
গত ৪ঠা নভেম্বর দিনাজপুর জেলায় মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা পাকিস্তান সৈন্য বাহিনীর উপর প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে মোহনপুর সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছেন। উক্তস্থানে এগার জন হানাদার সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়ে যায় এবং একজনকে মুক্তিবাহিনী বন্দী করেন। এর পরের দিন চণ্ডীগড়ে দুজন রাজাকারকে খতম করে ও নয় জনকে বন্দী করা হয়।
বঙ্গবন্ধুর বাণী
“আমি নিজেকে বাঙালি ভাবতে গর্ববোধ করি। বহতা নদীর মতো আমাদের সংস্কৃতির ধারা ও বেগবতী ও প্রাণ আবেগপূর্ণা। আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হলে বাঙালি আবার বিশ্ব সভায় মাথা তুলে দাঁড়াবে। বাঙালি হওয়ার সঙ্গে ধর্মে মুসলমান থাকার কোনো বিরোধ নেই। একটি আমার ধর্ম। অন্যটি জাতি পরিচয়। ধর্ম আমার ব্যাক্তিগত বিশ্বাস এবং আচার। জাতি পরিচয় আমার সমষ্টিগত ঐতিহ্য। একজন হিন্দু বাঙালি ও মুসলমান বাঙালি অথবা বৌদ্ধ, খ্রিস্টান বাঙালির মধ্যে পার্থক্য এইটুকু যে তাদের ধর্ম মত আলাদা। কিন্তু খাদ্য, রুচি, ভৌগোলিক পরিবেশ, স্বাস্থ্য ও সংস্কৃতি বর্ণ ও রাজনৈতিক লক্ষ্যের দিক থেকে তারা অভিন্ন।”
উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগের ঈদ
রমজানের পূর্ণ কৃচ্ছ্র সাধনার মাস শেষ হলো। এই সংখ্যা “জয়বাংলা” যখন পাঠকদের হাতে পৌঁছাবে, তখন বাংলাদেশের মুসলমান ঈদুল ফিতরের উৎসবের জন্য অপেক্ষমান। আকাশের শওয়ালের এক ফালি চাঁদ ও হয়তো উঠি উঠি করছে। শারোদৎসব বাঙালির যেমন একটি সার্বজনীন উৎসব, তানি তাদের অপর একটি সর্বজনীন উৎসব রমজান শেষের ঈদ। এবার শারদ উৎসবে বুড়িগঙ্গার পাড়ে যেমন বাজনা বাজে নি, তেমনি এবার ঈদের খুশির চাঁদ বাঙালির আকাশে উঠেনি। খুশি হওয়ার, উৎসব করার অবকাশ কই এখন বাঙালির জীবনে? গোটা জাতি যখন তার অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে ব্যস্ত, নরপশু ইয়াহিয়ার দস্যুচক্রের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি যখন জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত, তখন উৎসব করার, আনন্দ করার অবকাশ মানুষের জীবনে থাকতে পারে না।
গতবারের বাংলাদেশের মুসলমান রোজার ঈদে উৎসব করতে পারেনি। ১২ই নভেম্বর এর প্রলয়ংকারী ঝড়ের সেবার ২০ লাখ বাঙালি মৃত্যুবরণ করেছে। দেড় হাজার মাইল দূরে তথাকথিত ইসলামাবাদের শাদ্দাদী বেহেশতে বসে ইয়াহিয়া চক্র বিশ লাখ বাঙালির মর্মান্তিক মৃত্যু দেখে উপেক্ষার শয়তানি হাসি হেসে এবং আরো ১০ লাখ বাঙালিকে হত্যার জন্য ছুরি শানিয়েছে। গতবার বাংলার মুসলমান বিশ লাখ মানুষের মৃত্যুর শোকে রোজার ঈদে শোকাশ্রু চোখে কাতারবন্দী হয়েছে নামাজের ময়দানে,-এবার আরো ১০ লাখ ভাই বোনের মাসের স্তুপের উপর বসে তারা আকাশের দেখছে বাঁকা খঞ্জরের মতো ঈদের চাঁদ। এবারও তারা উৎসব পালন করতে পারে না। আর রোজার ঈদ তো উৎসবের ঈদ নয়, ত্যাগ ও কৃচ্ছ্র সাধনার ঈদ। সারা বাংলার মানুষ আজ এই মহান ত্যাগব্রতে উদ্বুদ্ধ যে, দেশকে হানাদার দস্যুদের কবলমুক্ত করার জন্য তারা হাসিমুখে প্রাণ কোরবান করবে।
আজ নয়, বাংলার আকাশে খুশির ঈদের চাঁদ একদিন উদিত হবে। এবং সেদিন সুদূর নয় -যেদিন ইয়াহিয়ার দস্যুবাহিনী বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত হবে এবং স্বাধীন ও মুক্ত বাংলার নীল আকাশে শাওয়ালের চাঁদ সব অশ্রুর কুয়াশা মুক্ত হয়ে আবার খুশির রোশনাই ছড়াবে।
১২ই নভেম্বরের সেই দিনটি
১৯৭০ সালের ১২ ই নভেম্বর। একাত্তুরের ১২ই নভেম্বর তারিখে দুঃখভারাক্রান্ত ও শোকসন্তপ্ত চিত্তে আমরা স্মরণ করেছি এক বছর আগের এই দিনটিকে-এবং এই দিনটিতে নিহত বাংলাদেশের উপকূলবর্তী জেলার বিশ লাখ নারী-পুরুষ ও শিশুকে। বাংলার মানুষকে সেদিন এই মৃত্যুর তাগুব থেকে রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসেনি ইয়াহিয়া চক্র। ইয়াহিয়ার বিমানবাহিনী আজ বাংলার আকাশে উড়ে হাজার হাজার টন বোমা ফেলছে, সেদিন দুর্গত এলাকায় খাদ্য নিক্ষেপের জন্য এর একটি বিমানও পাওয়া যায়নি। নির্বাচনী প্রচার অভিযান বন্ধ রেখে বঙ্গবন্ধু সেবার ছুটে গিয়েছিলেন দুর্গত এলাকায় বিপন্ন মানবতার ত্রানে। আকুল আবেদন জানিয়েছিলেন ইয়াহিয়া চক্রের কাছে, তোমাদের কাছে আমাদের যে সাড়ে তিন হাজার কোটি টাকা পাওনা আছে তা থেকে অন্ততঃ কিছু টাকা দাও বিপন্ন বাংলার মানুষকে বাঁচানোর জন্য।’ মনুষ্যত্ববোধ বর্জিত ইয়াহিয়া চক্র বঙ্গবন্ধুর আবেদনে সাড়া দেয়নি। বরং মরার উপর খাড়ার ঘা হানার জন্য গোপনে ছুরি শানিয়েছে। বাংলার মানুষ নভেম্বরের আঘাত কাটিয়ে উঠতে না উঠতেই তাদের ওপর নেমে এসেছে ইয়াহিয়ার পশুশক্তির আঘাত। ২৪শে মার্চের এক রাতে ইয়াহিয়া হত্যা করেছে এক লাখের উপর বাঙালিকে। এক্ষণেই নিহতের সংখ্যা দশ লাখের উপর।
আসলে ২৫শে মার্চ তারিখে যে পাকিস্তান নামক তথাকথিত দেশটি ১০ লাখ মানুষের লাশের স্তুপের নিচে চিরকালের জন্য হারিয়ে গেছে, তার ধ্বংস শুরু ১২ ই নভেম্বর তারিখে। ১৯৭০ সালের ১২ই নভেম্বর তারিখটিই প্রমাণ করে দিয়েছে, পাকিস্তান নামে একটি অবাস্তব দেশের কোন বাস্তব ভিত্তি নেই, এদেশে এক জাতির বাস নয়, একই মনুষ্যত্ববোধ, সমবেদনা ও সহানুভূতির রাখিতে তারা বাধা নয়। এই পাকিস্তানের শাসক, তারা পশু শক্তিতে বিশ্বাসী, মানবতায় বিশ্বাসী নয়। এদের মুখে ইসলামের নাম এদের ভন্ডামি ঢাকা দেওয়ার স্লোগান মাত্র। ১২ই নভেম্বর তাই বাঙালিকে যে পথ দেখিয়েছে-সেই পথ স্বাধীনতার, সেই পথ আত্মমর্যাদাবোধের পথ।
মুক্তিবাহিনী এগিয়ে চলেছে
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর এখন ঢাকা শহরের দিকে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। ঢাকার অদূরবর্তী মুন্সিগঞ্জ থানার বিস্তীর্ণ এলাকায় উড়েছে স্বাধীন বাংলার পতাকা। ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনীর সকল রণাঙ্গনের মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে এখন এর পশ্চাদপসরণ এর সময় পোড়ামাটি নীতি গ্রহণ করেছে। তাদের হাতে ধ্বংস হচ্ছে গ্রাম, জনপদ, শস্যভান্ডার, নিহত হচ্ছেন নারী, শিশু, নির্বিশেষে বাঙালি গ্রামবাসী।
এত রক্ত, এত মৃত্যুর মধ্যেও আমরা বলবো আমাদের দুঃখ মোচনের দিন সমাসন্ন। ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের পরাজয় অত্যাসন্ন। স্বাধীন ও সুখী বাংলাদেশ গঠনের যে স্বপ্ন সাড়ে সাত কোটি মানুষের চোখে এঁকেছেন বঙ্গবন্ধু, সেই স্বপ্ন বাঙালির জীবনে সফল ও সার্থক হবেই।
সংগ্রামী অভিনন্দন
বেহায়া খাঁ এখন কি করবে?
আপনাদের ‘জয় বাংলা’ সাপ্তাহিক আমি নিয়মিত পাঠ করি এবং আনন্দ পাই। ৭২ ঘন্টা বাঙ্গালীদের দমন করতে গিয়ে পশ্চিমা বেহায়া খাঁ যে বিপাকে পড়েছে, এমন বিপাকে হিটলার-মুসোলিনিও পড়েনি। ভদ্রলোক সেই যে ২৫শে মার্চ রাতে ঢাকা ছেড়ে পালিয়েছে, তারপর বহু তারিখ দিয়ে ও আর ঢাকা যায়নি। বেহায়া খাঁর সিপাহসালার দস্যু টিক্কাও এখন ঢাকা থেকে অপসারিত। অন্যদিকে সংগঠিত মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রত্যেক বেহায়া খাঁর সৈন্যেরা কচুকাটা হচ্ছে। লন্ডন-নিউইয়র্কের কাগজে খবর প্রকাশিত হয়েছে, বেহায়া খাঁর বিরুদ্ধে তাঁর সহকর্মীদের মধ্যেও নাকি চক্রান্তের জাল বিস্তৃত হয়েছে। যেকোনো দিন বেহায়া খাঁর গদি যেতে পারে। বেহায়া খাঁ অবশ্য দু’ কানকাটা জানোয়ার। তার কোনো কিছুতেই লাজ-লজ্জা নেই। ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ করবো বলে হুমকি ছেড়ে এখন ভারতের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার জন্যই সে অস্থির। কিন্তু শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী এই জানোয়ারটিকে পাত্তা দেয়নি। ফলে বেহায়া খাঁ বড় বিপাকে পড়েছে। এখন এই জানোয়ারটি কি করবে তা জানার জন্য আমরা বড়ই কৌতুহলী। আপনাদের জনপ্রিয় কাগজে সম্পর্কে একটি আলোচনা ছাপালে খুশি হব।
-টমাস রঞ্জন দত্ত
(প্রবাসী খ্রিস্টান বাঙালি)
কলম্বো, সিংহল।
বিশ্বের দৃষ্টি বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ থেকে ভিন্ন দিকে সরিয়ে নেবার অপচেষ্টা মাত্র
ইয়াহিয়া চক্রের যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির অভিমত
জেনারেল ইয়াহিয়া খানের যুদ্ধ প্রস্তুতি এবং ভারতের বিরুদ্ধে তার যুদ্ধের প্রকাশ্য হুমকিকে বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন থেকে বিশ্বের দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেওয়ার অভিসন্ধি বলে বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির মন্তব্য করেছেন।
৬ই নভেম্বর মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা কমিটির সভায় গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের এই অভিসন্ধির আরেকটি অর্থ হল হানাদার দের বিরুদ্ধে গণপ্রতিরোধ বাহিনী ক্রমবর্ধমান হামলা চালিয়ে যে সাফল্য অর্জন করেছেন, তা থেকে সকলের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে নেওয়া।
কমিটির সভায় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সর্বশেষ অবস্থা পর্যালোচনা করা হয়। পশ্চিম পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের ওই দুরভিসন্ধি ব্যর্থ করার জন্য বাংলাদেশের সমস্ত শ্রেনী, সম্প্রদায় এবং স্বাধীনতা যোদ্ধাদের প্রতি আহ্বান জানানো হয়। শত্রুর দুর্বলতার পূর্ণ সুযোগ নিয়ে তাকে খতম করার আবেদনও জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মূল লক্ষ্য হলো বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা এবং এই লক্ষ্যের প্রতি তাদের অদম্য সংকল্পের কথাও কমিটির প্রস্তাবে পুনরায় উল্লেখ করা হয়।
বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী, জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ উক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ, অর্থমন্ত্রীর জনক মনসুর আলী, স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী এএইচএম কামরুজ্জামান এবং জনাব আব্দুস সামাদ, ফনি ভূষণ মজুমদার (আওয়ামী লীগ, অধ্যাপক মোজাফ্ফর আহমেদ),(ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টি), শ্রী মনোরঞ্জন ধর (বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস), ও শ্রী মনি সিং (বাংলাদেশ কমিউনিস্ট পার্টি), উপস্থিত ছিলেন।
অসুস্থতার দরুন ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আব্দুল হামিদ খান ভাসানীর সভায় উপস্থিত হতে পারেননি।
কমিটি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দানের দাবি জানিয়েছেন। এবং অবৈধ নির্বাচনের মাধ্যমে পাকিস্তানের সামরিক শাসন প্রবর্তনে ইয়াহিয়া খানের অপচেষ্টার নিন্দা করেছেন।
কমিটির গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের বিভিন্ন সরকারের কাছে আবেদন জানিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নের সর্বপ্রকার সাহায্য ও সহযোগিতার জন্য কমিটি ভারত সরকারকে কৃতজ্ঞতা জানিয়েছেন।
কুষ্টিয়ার অধিকাংশ গ্রাম মুক্তি বাহিনীর দখলে
কুষ্টিয়া, ৭ই নভেম্বর-অত্র জেলার মেহেরপুর শহরের উত্তর, দক্ষিণ-পশ্চিমের ৩০ টি গ্রাম মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা শত্রু খবর মুক্ত করেছেন।
ভৈরব নদীর পশ্চিম তীরে ধর্মদা ও যাদবপুরে মুক্তিবাহিনীর তাদের ঘাঁটি স্থাপন করেছেন। এছাড়া মেহেরপুরের দখিনে মানিকপুরে ও দরিয়াপুরেও মুক্তি বাহিনী ঘাঁটি স্থাপন করেছেন।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আরও চারজন দূতাবাস কর্মচারীর আনুগত্য ঘোষণা
কাঠমুন্ডু স্থল পাকিস্তানি দূতাবাসের আরো তিনজন বাঙালি কর্মচারী পাকিস্তানের সামরিক চক্রের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
ইতিপূর্বে কাঠমুন্ডু স্থাপাক দূতাবাসের বাঙালি কূটনৈতিক সাবেক ফার্স্ট সেক্রেটারি ও চ্যা্ন্সারী প্রধান জনাব মোস্তাফিজুর রহমান বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
বর্ধমান পর্যায়ে যে তিনজন বাঙালি কর্মচারী বাংলাদেশ সরকার প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন তারা হচ্ছেন দূতাবাসের ড্রাইভার জনাব আব্দুস সাত্তার খান, অফিস অর্ডারলি জনাব মোহাম্মদ আলী আজম, এবং দূতাবাস পিয়ন জনাব মোঃ ইদ্রিস।
সিঙ্গাপুর দূতাবাসের একজনের আনুগত্য বদল
সিঙ্গাপুরের এক খবরে প্রকাশ হয় সেখানকার পাকিস্তানি দূতাবাসের একজন সাইফার এসিস্ট্যান্ট ৩৯ বছর বয়স্ক জনাব আলী আহমেদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন।
এ প্রসঙ্গে জনাব আহমেদ ঘোষণা করেছেন যে একজন দেশ প্রেমিক বাঙালী হিসেবে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক সরকারের অধীনে কাজ করতে পারেন না।
জনাব আহমেদ গত ৮ই নভেম্বর রাত্রে তার স্ত্রী ও তিন কন্যাকে নিয়ে সিঙ্গাপুর থেকে বিমানযোগে অন্যত্র চলে যান। যাবার আগে তিনি বিভিন্ন সংবাদ সংস্থা, সংবাদপত্র, সংবাদপত্র প্রতিনিধি ও দূতাবাস কর্তৃপক্ষের নামে ডাকে চিঠি পাঠিয়েছেন এবং তাদের সকলকে তার আনুগত্য বদল এর কথা জানিয়েছেন।
জনাব আহমেদ পশ্চিম পাকিস্তানে জঙ্গি চক্রের নায়ক জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খানের নামেও একখানা চিঠি পাঠিয়েছেন। তাতে তিনি ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের গণহত্যা চালানোর অভিযোগ করেছেন।
সিঙ্গাপুরস্থ পাক দূতাবাসের আর মাত্র দুজন বাঙালি কর্মচারী রয়েছেন। তাদের দুজনেই কেরানিগিরিতে নিয়োজিত রয়েছেন।
“পাকিস্তানের প্রতি বাঙ্গালীদের আর আনুগত্য নেই”
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
‘পাকিস্তানি সামরিক সরকারের প্রতি সাড়ে সাত কোটি বাঙালির আনুগত্যহীনতাই স্বাধীন বাংলাদেশকে সম্ভব করে তুলেছে।’ মিস্টার অ্যান্থনি মাসকারেনহাস সম্প্রতি কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।
মিঃ মাস্কারেনহাস লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় বাংলাদেশে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর অত্যাচারের চাক্ষুষ বিবরণ লিখেছিলেন। তিনি বলেন ভুট্টো পাক সেনাবাহিনীর ক্রীড়নকের ভূমিকা পালন করেছিলেন মাত্র। তিনি নিজেই এ সুযোগ তাদের দিয়েছিলেন।
মিস্টার মাসকারেনহাস তার গ্রন্থের প্রকাশ উপলক্ষে ভারত সফর করছেন। তার গ্রন্থের নাম ‘ দি রেপ অব বাংলাদেশ’। তিনি ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে বলেন যে, ইয়াহিয়া খান পূর্ণ ক্ষমতা সম্পন্ন ছিলেন না, একথা সত্য নয়। অবশ্যই তিনি পারিপার্শ্বিকতার হাতে বন্দি ছিলেন এবং পাকিস্তানে যা ঘটেছে তার জন্য ইয়াহিয়া খানেই দায়ী।
লন্ডন ত্যাগের পর পরিবর্তিত পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনোরূপ মন্তব্য করেননি। ব্যক্তিগতভাবে তিনি জানেন যে, শেখ মুজিবুর রহমান সুস্থ আছেন।
‘রেপ অফ বাংলাদেশ’গ্রন্থে ১৯৬৯- এর মার্চ থেকে ১৯৭১ এর মার্চ পর্যন্ত ঘটনার বিবরণ রয়েছে। বাঙ্গালীদের আলাদা চলার নীতি থেকে কেউই এখন বিচ্যুত করতে পারবে না। তিনি বলেন, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে পূর্ব বাংলার প্রথম আলাদা হয়ে যাওয়াটা শুধু সময়ের প্রশ্ন মাত্র। মানসিকভাবে এবং আবেগের দিক থেকে এই ভাঙ্গন ইতিমধ্যেই সমাপ্ত হয়ে গেছে।’
গ্রন্থের প্রথম দিকের পরিচ্ছেদ গুলিতে ইয়াহিয়া খানের নেতৃত্বে পাকিস্তানি শাসকরা কিভাবে পূর্ব বাংলাকে উপনিবেশ বানিয়ে রেখেছিল এবং বাঙালিকে দ্বিতীয় শ্রেণীর নাগরিক মর্যাদা দেয়া হয়েছিল তার বর্ণনা আছে।
গ্রন্থ পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া খানের বর্তমান ত্রিশঙ্কু অবস্থাও বর্ণিত হয়েছে। বর্তমান সামরিক সরকারের প্রতি পশ্চিম পাকিস্তানের ধূমায়িত অসন্তোষ মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে এবং প্রতিনিধিত্বমূলক সরকার গঠনের ইচ্ছা ও নানা ভাবে প্রকাশ পাচ্ছে।
সীমান্ত অঞ্চলেও অসন্তোষ বিরাজ করছে, বিশেষ করে বেলুচিস্তান ও উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের অসন্তোষের কথা তিনি উক্ত গ্রন্থে উল্লেখ করেন।
পাক সেনাবাহিনীর বিপ্লবের সম্ভাবনার ইঙ্গিত দিয়ে তিনি বলেন, যদি অনুরোধ ঘটনা ঘটেই, অত্যাধিক রক্তপাতের মধ্য দিয়েই তা অনুষ্ঠিত হবে। পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীতে ইতিপূর্বে শান্তিপূর্ণভাবেই ক্ষমতা হস্তান্তরিত হয়েছে। মিস্টার মাস্কারেনহাস আশঙ্কা করেন যে, পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ঐতিহ্য ইকারেকর মত রক্তাক্ত অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বিলুপ্ত হবে।
পশুর কাছে ভদ্রলোকের চিঠি
পশ্চিম জার্মানির চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট গত বৃহস্পতিবার বন- এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, ভারত বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে তার মতামত জানিয়ে তিনি শীঘ্রই প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কে চিঠি লিখবেন।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার পর চ্যান্সেলর উইলি ব্রান্ট বলেন, ভারত উপমহাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে শ্রীমতি গান্ধীর বর্ণনা শুনে তিনি বিশেষ অভিভূত হয়েছেন।
চ্যান্সেলর ব্রান্ট বলেন, শ্রীমতি গান্ধীর নয়াদিল্লির উদ্দেশ্যে যাত্রা করার পরেই তিনি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান কে চিঠি লিখবেন।
চিঠির বক্তব্য বিষয় তিনি প্রকাশ করতে চান না। কারণ তাদের ইসলামাবাদের উপর তার প্রভাব আছে তাও হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা করেন। সৃষ্টির উদ্দেশ্যে তিনি সর্বপ্রথম শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দেয়ার প্রস্তাব করবেন বলে মনে হয়।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সম্মানে আয়োজিত জনসভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মিঃ উইলি ব্রান্ট বলেন, পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানের জন্য কোন না কোন উপায়ে পাকিস্তানকে খুঁজে বের করতেই হবে এবং যেসব লক্ষ লক্ষ শরণার্থী ভারতে পালিয়ে এসেছেন তাদের নিরাপত্তা প্রত্যাবর্তনের ব্যবস্থা ও পাকিস্তানকে করতে হবে।
তিনি আরো, বলেন পূর্ববঙ্গ থেকে যেসব শরণার্থী পালিয়ে এসেছেন তারা যে নিজেরা চরম দুঃখ কষ্টের মধ্যে পড়েছেন তাই নয়, তাদের আগমনের ফলে এক সংঘাতিক উত্তেজনাকর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীমতি গান্ধী জার্মান চ্যান্সেলরের স্বাগত ভাষণ এর প্রতুত্তরে বাংলাদেশ সমস্যার কোনো উল্লেখ না করে ‘সাহস ও দূরদৃষ্টির জন্য’ মিঃ ব্রান্ট যে এ বছর নোবেল শান্তি পুরস্কার পেয়েছেন তার উল্লেখ করে মিঃ ব্রান্টের প্রশংসা করেন।
পশ্চিম জার্মানির ঘোষণা
পশ্চিম জার্মানি সরকারের পক্ষ থেকে এক ঘোষণায় বলা হয়, ভারত উপমহাদেশের বর্তমান পরিস্থিতিতে ফেডারেল সরকার খুবই উদ্বিগ্ন। ফেডারেল সরকার আশা প্রকাশ করেন যে, পরিস্থিতি অত্যন্ত উত্তেজনাপূর্ণ হওয়া সত্ত্বেও যুদ্ধ পরিহার করা সম্ভব হবে।
পরিস্থিতির রাজনৈতিক সমাধানের পশ্চিম জার্মানির কোন সহযোগিতার প্রয়োজন হলে ফেডারেল সরকার সানন্দে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করবেন।
ফেডারেল সরকার এ বিষয়ে নিঃসন্দেহ যে, ভারত উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতি বজায় রাখার জন্য পূর্ববাংলা সমস্যার অবশ্যই রাজনৈতিক সমাধান খুঁজে বের করতে হবে। একমাত্র রাজনৈতিক সমাধান হলেই যুদ্ধ পরিহার করা সম্ভব হবে এবং শরণার্থীরা নির্ভয়ে স্বদেশে ফিরে যেতে পারবেন।
মুক্তিবাহিনীর হাতে আরো একটি জাহাজ বিনষ্ট
বাংলার স্বাধীনতাকামী বীর যোদ্ধারা অস্ত্রবাহী আরো একটি জাহাজ ডুবিয়ে পাকিস্তানি জঙ্গিশাহীকে দিশেহারা করে তুলেছেন।
গত ৩০শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুমিল্লার লন্ঠনঘাটে একটি মালবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই জাহাজটি অস্ত্র খালাস করার উদ্দেশ্য যাচ্ছিল। জাহাজের নাবিক ও পাঁচজন খালাসী সকলেই ডুবে মারা গেছে।
ভারতের প্রেসিডেন্ট বলেন –
ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভিভি গীরি গত ১১ই নভেম্বর বহরমপুরের এক সমাবেশে পাকিস্তানের রণ উন্মত্ততার এবং যুদ্ধের পাঁয়তারা সম্পর্কে বলেন, আমাদের সামনে যে চ্যালেঞ্জ দেখা দিয়েছে, একদা এবং দৃঢ় সংকল্পের শক্তিতে ভারতের জনগণ তা জয় করতে সক্ষম হবে।
তিনি বলেন যে, পূর্ব সীমান্তে আমরা যখন মানুষের তৈরি করা গভীর সংকটের সম্মুখীন, তখন এই উড়িষ্যায় বিরাট প্রাকৃতিক বিপর্যয় মোকাবেলা ও আমাদের করতে হচ্ছে। এটা জাতির সামনে সত্যি সংকটজনক মুহূর্ত।
শ্রী গিরি দৃঢ় প্রত্যয়ের সঙ্গে বলেন, আমাদের জনগনের উপর আমার গভীর আস্থা আছে। কাজেই চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা তাদের সাফল্য সম্পর্কে আমার কোন সন্দেহ নেই।
বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীন মুক্তি সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ুন
দেশের ছাত্র ও তরুণ সমাজের প্রতি ছাত্র নেতৃবৃন্দের আবেদন
বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে-আলম সিদ্দিকী, সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কেন্দ্রীয় ছাত্র সংসদের সহ-সভাপতি এ,এস,এম আব্দুর রব, সাধারণ সম্পাদক আব্দুল কুদ্দুস মাখন এবং বাংলাদেশ ছাত্র ইউনিয়নের সভাপতি নুরুল ইসলাম ও সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম (সেলিম) এক যুক্ত বিবৃতিতে মাতৃভূমির মুক্তি ও বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি ত্বরান্বিত করার জন্য জনগণের রায় মোতাবেক প্রতিষ্ঠিত বাংলাদেশ সরকারের পশ্চাতে কাতারবন্দী হওয়ার উদ্দেশ্যে দেশের ছাত্র সমাজের প্রতি আকুল আবেদন জানিয়েছেন।
বিবৃতিতে তারা বলেন, বাঙালি জাতির মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শে অনুপ্রাণিত ও নির্দেশে পরিচালিত গৌরবোজ্জ্বল মুক্তি সংগ্রামের এখন সপ্তম মাস।
আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর বিরুদ্ধে মরণপণ যুদ্ধে লিপ্ত। মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য তারা অকাতরে ঢেলে দিচ্ছেন তাদের তাজা রক্ত। পাকিস্তানের চরম প্রতিক্রিয়াশীল দের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ সংগ্রামের ব্যাপারে বাংলাদেশের ছাত্র সমাজের একটি মহান ঐতিহ্য রয়েছে। সেই ঐতিহ্যকে সমুন্নত রেখে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার সংগ্রামে ইস্পাত কঠিন ঐক্য ছাত্রসমাজকে আজ গড়ে তুলতেই হবে।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন দেশের ছাত্র তরুণ সমাজকে আজ এগিয়ে এসে সশস্ত্র সংগ্রামে অংশ নিতে হবে।
আমাদের স্মরণ রাখতে হবে যে বর্বর ইয়াহিয়া চক্রকে চীন সরকার ও মার্কিন সাম্রাজ্যবাদীরা মদদ দিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং আমাদের প্রবল প্রতিকূলতার বিরুদ্ধেই সংগ্রাম করতে হবে।
আমাদের সংগ্রাম এক জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম। আমাদের উদ্দেশ্য বাঙালি জাতির বাঞ্ছিত লক্ষ্যে উপনীত হওয়া। এই সংগ্রাম সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম। এটা জনগণের যুদ্ধ।
সুতরাং বাংলাদেশের প্রতিটি সংগ্রামী শক্তিকে আজ বাংলাদেশ সরকারের নেতৃত্বাধীনে ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
তাই বাংলাদেশের তরুণ ও ছাত্রসমাজ বিশেষ করে ছাত্রলীগ ও ছাত্র ইউনিয়নের কর্মীদের প্রতি আমাদের আবেদন, আপনারা মুক্তি সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়ুন, সংঘবদ্ধভাবে মুক্তিসংগ্রামী দের সাহায্য করুন, শহর ও গ্রামের স্কুল ও কলেজ বর্জন করুন, দখলীকৃত এলাকায় প্রশাসন ব্যবস্থা বাতিল করুন এবং হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করুন।
ছাত্র নেতৃবৃন্দ তাদের বিবৃতিতে বলেন, মুক্তিবাহিনীর নতুন নতুন সাফল্য অর্জনের স্বাধীনতা বিশ্ব বিবেক ও অধিক মাত্রায় আমাদের পক্ষ অবলম্বন করেছে। ভারত ও সোভিয়েত ইউনিয়নের মত যেসব দেশ আমাদের নানাভাবে সাহায্য ও সমর্থন দিচ্ছেন তার জন্য জানাই আমাদের কৃতজ্ঞতা। বিশ্বের সমস্ত মুক্তি ও গণতন্ত্রকামী জাতীয় দেশ বিশেষ করে বিশ্বের তরুণ ও ছাত্র সমাজের প্রতি আমাদের ন্যায্য সংগ্রামে সমর্থন ও সাহায্যের জন্য আমরা আবেদন জানাচ্ছি। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকার করার জন্য, বিশ্বের রাষ্ট্র বর্গের প্রতি আমরা আবেদন জানাই।
উপসংহারে ছাত্র নেতৃবৃন্দ বলেন, মাতৃভূমির মুক্তি অর্জনের প্রাণ দেওয়ার মতো গৌরবজনক কাজ আর দুনিয়াতে কিছুই নেই। আসুন, আমরা নিজেদের মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার শপথ নেই। আমাদের বিজয় অবধারিত।
– জয় বাংলা।
চাঁদপুরে ১২ জন রাজাকার বন্দি ও দুইজন খতম
গত ২৬শে অক্টোবর মুক্তিবাহিনীর নৌ-কমান্ডোরা চাঁদপুরের নিকট মেঘনার বুকে পাকিস্তান সৈন্যবাহিনী তিনটি দেশি নৌকায় আক্রমণ করেন। এ নৌকাগুলোতে সৈন্যদের রসদ ও ছিল। এই আক্রমণে খানসেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি ছাড়াও ১২ জন রাজাকারকে চারটি রাইফেলসহ বন্দি করা হয়। নৌ-কমান্ডো আটককৃত খাদ্যদ্রব্য গ্রামবাসীদের মধ্যে বিতরণ করেন।
গত ২৯শে অক্টোবর চাঁদপুরের রেলওয়ে গুদামের কাছে এক দালালের বিই কোং পেট্রোল ডিপোতে অগ্নিসংযোগ করেন ফলে প্রহরারত দুইজন দালাল খতম হয় এবং চার জন গুরুতররূপে আহত হয়।
আন্তর্জাতিক সাহায্যের ক্ষেত্রে পাকিস্তান কোণঠাসা
যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক অস্ত্র চালানোর সমস্ত লাইসেন্স বাতিল
পশ্চিম পাকিস্তানে জঙ্গি চক্রের নায়ক ইয়াহিয়া খানের সরকার সবদিক থেকেই কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। বিশ্বের অন্য কোথাও ঠাই না পেয়ে ভুট্টোর নেতৃত্বে যে সামরিক প্রতিনিধিদল পাঠানো হয়েছিল তারাও ব্যর্থ মনোরথ হয়ে ফিরে এসেছে। এদিকে দেশের জনগণ ও কংগ্রেস কে উপেক্ষা করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার “পূর্বে স্বাক্ষরিত চুক্তির অজুহাত তুলে ইয়াহিয়া চক্রকে যে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দিয়ে যাচ্ছিল তাও বন্ধ হয়ে গেছে। নিক্সন সরকারকে অবশেষে দেশের জনগণ ও কংগ্রেসের মতামতের কাছে নতি স্বীকার করতে হয়।
খবরে প্রকাশ গত ৮ নভেম্বর ওয়াশিংটনের সরকারিভাবে ঘোষণা করা হয় যে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তানের ৩৬ লাখ ডলার মূল্যের রপ্তানির জন্য যে সমস্ত লাইসেন্স ইস্যু করেছিলেন তার সব কয়টিই বাতিল করে দিয়েছেন।
মার্কিন সরকার কেবলমাত্র এক লাখ ৫০ হাজার ডলার মূল্যের অস্ত্রশস্ত্র রপ্তানির লাইসেন্স বহাল রেখেছেন। মার্কিন কাস্টমস বিভাগে ইতিমধ্যেই এই সমস্ত সমর সম্ভারের রপ্তানি ক্লিয়ারেন্স দিয়েছে এবং সেগুলো ইস্ট কোষ্ট ডক ধর্মঘটের অবসানের পর করাচির জাহাজে উঠানো হবে।
মার্কিন পররাষ্ট্র দপ্তরের মুখপাত্র মিঃ মিস্টার বার্নস ব্রে জানান যে পাকিস্তানের অস্ত্র চালানের আর কোনো লাইসেন্স বহাল নাই। ভালো পাকিস্তানের আর কোনভাবে মার্কিন অস্ত্র লাভের উপায় নেই বলে তিনি জানান।
প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে সম্প্রতি মার্কিন সিনেট নিক্সন সরকারের বৈদেশিক অর্থনৈতিক সাহায্য বিল সম্পূর্ণরূপে নাকচ করে দেয়। পরে অবশ্য বেছে বেছে কয়েকটি দেশের অর্থনৈতিক সাহায্য পুনরুজ্জীবিত করা হয়। কিন্তু এই পুনরুজ্জীবিত বিলে পাকিস্তানকে কোন সাহায্য দানের ব্যবস্থা রাখা হয় নাই। বলা ভালো, নিক্সন সরকারের মূল পাকিস্তানের জন্য দুই শতাধিক কোটি টাকা বরাদ্দ করা হয়েছিল।
সিলেটের জানেকা মুখপাত্র জানিয়েছেন যে তারা কোনো অবস্থাতেই পাকিস্তানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে দিবেন না।
স্বাধীন বাংলাদেশ এখন বাস্তব সত্য
-ফরাসি অভিমত
ফরাসি নেতৃবৃন্দ ও জনগণ এখন ভাবতে আরম্ভ করেছেন যে স্বাধীন বাংলাদেশে একটি বাস্তব সত্য। পাকিস্তান থেকে বাংলাদেশের বিচ্ছেদের ব্যাপারটি এখন চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছে। ফরাসি প্রেসিডেন্ট পম্পিডু বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ফরাসি মহলের ধারণা, বাংলাদেশ সমস্যার কোনো সামরিক সমাধান ইসলামাবাদের পক্ষে সম্ভব নয়। কারন, বাংলাদেশে সমস্যা একটি সামরিক সমস্যা নয়, রাজনৈতিক সমস্যা ফ্রান্স মনে করে, জনগণের ইচ্ছাই এক্ষেত্রে হওয়া উচিত চূড়ান্ত। ফ্রান্স পশ্চিম পাকিস্তান ও বাংলাদেশে দু’টি স্বতন্ত্র রাজনৈতিক সত্তা হিসেবে দেখতে আরম্ভ করেছে।
ফ্রান্স পাকিস্তানের অন্যতম অর্থ জোগানদার। ফ্রান্সের কাছ থেকে পাকিস্তান সরকার ৬০টির মতো মিগ জঙ্গিবিমান ক্রয় করেছে। মিগ বিমান খুব নিচু দিয়ে উড়ে যেতে পারে ও শেল ছুড়তে পারে। মিগ বিমান রাডারে ধরা পড়ে না। বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে ফ্রান্সের দৃষ্টিভঙ্গির পরিবর্তন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সহায়ক হবে। ফ্রান্স পাকিস্তানকে আর অস্ত্র সরবরাহ করবে না বলে খবরে প্রকাশ। ফ্রান্স থেকে যদি পাক সরকার যন্ত্র না পায় ও নতুন যন্ত্র কিনতে না পারে, তবে পাক সামরিক বাহিনীকে গুরুতর অসুবিধার সম্মুখীন হতে হবে।
মুক্তিযুদ্ধের নতুন পর্যায় ও আন্তর্জাতিক দুনিয়া
আব্দুর রাজ্জাক চৌধুরী
জাতীয় এবং আন্তর্জাতিক ঘটনাবলী দেখে মনে হচ্ছে বাংলাদেশে প্রশ্নটি দ্রুত চরম মুহূর্তের দিকে এগিয়ে চলেছে। মুক্তিবাহিনীর বিগত কয়েক মাসের অনুসৃত গেরিলা ও কমান্ডো পদ্ধতির “আঘাত হানো এবং পালিয়ে যাও” রণকৌশলের লক্ষণীয় পরিবর্তন ঘটেছে। গেরিলা পদ্ধতির যুদ্ধের সঙ্গে অনেক ক্ষেত্রে দেখা যাচ্ছে যে সরাসরি সামনাসামনি মোকাবেলা করা হচ্ছে। অর্থাৎ গেরিলা যুদ্ধের রণকৌশল এর সঙ্গে নিয়মিত সংগ্রামের রণকৌশলের সমন্বয় ঘটেছে। ময়মনসিংহ-কিশোরগঞ্জ মহাকুমা এবং সিলেটের বানিয়াচং এলাকার যুদ্ধ এ কথাই প্রমাণ করে যে সরাসরি আঘাত হেনে দখলীকৃত এলাকা হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত করার ক্ষমতা মুক্তিবাহিনীর অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে।
বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে নিয়ন্ত্রিত ও চরম পরিনতির দিকে নিয়ে যাবার ব্যাপারে মুক্তিবাহিনীর সমর শক্তির এই নতুন লক্ষণ এর ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের মুক্তি যে পথ বেয়েই আসুক না কেন, তা পুরোপুরি ভাবে নির্ভর করবে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর আঘাত হানার ক্ষমতার উপরে। বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধান দু’পক্ষ টেবিলে বসে শান্তিপূর্ণ আলোচনার মাধ্যমে আনতে হলেও মুক্তিবাহিনীর রণশক্তির বলেই আনা সম্ভব। আক্রমণকারী হানাদাররা শান্তিবাদী নয়। শান্তি আর আলোচনার ভাষা তারা বোঝে না। বুঝলে ২৫শে মার্চের বর্বর অধ্যায়ের সুচনা হত না। কাজেই বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির বাংলাদেশ প্রশ্নে রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে আসছেন, সমাধানের সেই পথে হানাদার ইয়াহিয়া চক্রান্তে হলেও মুক্তিবাহিনীর ক্ষমতার জোরেই তাদেরকে সেই পথে আসতে বাধ্য করতে হবে। এমনিতে তারা বাপ ডাকবেনা গুতোর চোটেই তাদের পিতৃ নাম উচ্চারণ করাতে হবে। তাহলে তারা বাপ বাপ বলে সমাধানের পথে পা বাড়াবে।
* * *
বাংলাদেশ সমস্যার উদ্ভব হবার সঙ্গে সঙ্গে সে সমস্যার জন্য ভারত ও মারাত্মক ভাবে জড়িয়ে পড়েছে। ভারত সরকারের হিসাব মতে প্রায় ৯৫ লক্ষ শরণার্থী ভারতে এসে পড়েছে। আর্থ-সামাজিক, ও রাজনৈতিক যে কোন দিক থেকে শরণার্থীর এই চাপ অনির্দিষ্টকালের জন্য ভারতের পক্ষে বহন করা সম্ভব নয়। তার ওপর পাকিস্তান ভারতের পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্ত বরাবর আক্রমনাত্মক সৈন্য সমাবেশ করেছে। যে হানাদাররা ভারতের উপর শরণার্থীর বোঝা চাপিয়ে দিয়েছে তারাই আবার সীমান্তে আক্রমণাত্মক সৈন্য সমাবেশ করেছে।
ভারতের পর পাকিস্তানে দুতরফা আক্রমণ ভারতের পক্ষে নীরবে মেনে নেওয়া সম্ভব নয়। এটা ভারতের সার্বভৌমত্বের প্রতি পাকিস্তানি হামলার শামিল। কাজেই ভারতকে পাল্টা ব্যবস্থা অবশ্যই গ্রহণ করতে হবে। পাকিস্তান ভারতের জন্য যে সংকটের সৃষ্টি করেছে এবং যে উদ্ধত আক্রমণাত্মক ভঙ্গিতে ভারতের সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেছে তাদের পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের একক ব্যবস্থা গ্রহণের নৈতিক অধিকার রয়েছে। কিন্তু সেই ব্যবস্থা গ্রহণ না করে ভারত শেষবারের মতো বিশ্বের বিভিন্ন শক্তিকে ভারতের অবস্থাটি জানিয়ে দিতে চায়। এতে সমস্যা সমাধানে বাংলাদেশের সরকার ও প্রতিনিধিবৃন্দের অংশগ্রহণের পথ উন্মুক্ত রাখার সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে।
ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর ইউরোপের কয়েকটি দেশে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সফরকে আমরা সেই দৃষ্টিতে বিচার করলে খুব ভুল করা হবে না। সেদিক থেকে শ্রীমতি গান্ধী তার বক্তব্যকে স্পষ্ট করতে পেরেছেন।
তাছাড়া শ্রীমতি গান্ধীর এই সফর আর একটা দিক থেকেও গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশ প্রশ্নে শ্রীমতি গান্ধী দুটো ব্যাপার বোঝাতে পেরেছেন। তার একটি হলঃ বাংলাদেশ সমস্যাটি ইসলামাবাদের সামরিকজান্তা এবং বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে বিরোধ জনিত সমস্যা।
ব্রিটেনের সফরকালে ভারতের প্রধানমন্ত্রী যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথকে উপরোক্ত সত্যটি বোঝাতে পেরেছেন। তাছাড়া ব্রিটেনে উপলব্ধ করেছে যে, এই সমস্যার অবসান ঘটাতে হলে বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে একটা গ্রহণযোগ্য ‘রাজনৈতিক সমাধান’বের করতে হবে।
এ ব্যাপারে ভারতের অভিমত হলো, ২৫শে মার্চের পূর্বে বাংলাদেশের জনগণ পূর্ণ স্বাধীনতার দাবি করেনি। কিন্তু ইসলামাবাদের সামরিকজান্তা ২৫শে মার্চ ও তারপরে যে নারকীয় ঘটনা ঘটিয়েছে তার ফলে বাংলাদেশের পক্ষে এখন আর পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোনো সমাধান গ্রহণযোগ্য নয়।
অপরদিকে ব্রিটেন মনে করে যে, পাকিস্তান ভেঙ্গে দেবার ভিত্তিতে কোনো আলোচনার উদ্যোগ গ্রহণ করা সম্ভব নয়। তারা আরো মনে করে যে, একটা শিথিল পাকিস্তানি কনফেডারেশনের অংশ হিসেবে অবস্থানের ভিত্তিতে সমাধান বের করার জন্য বাংলাদেশে নেতৃবৃন্দকে রাজি করানো উচিত।
এ দায়িত্ব তারা প্রকারান্তরে ভারতের উপর চাপাতে চায়। অপরদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাব অতটা খোলা নয়। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের ব্যাপারে প্রত্যক্ষ উদ্যোগ গ্রহণের কোন অঙ্গীকার তারা করেনি। বরং দক্ষিণ এশিয়ার সংকট সমাধানের ব্যাপারে তার দেশের পক্ষে যা করা সম্ভব মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তা করবে প্রেসিডেন্ট নিক্সন এই ধরনের একটা অস্পষ্ট কথার আড়ালে আত্মগোপন করেছেন। তবে যুক্তরাষ্ট্র ভবিষ্যতে পাকিস্তানকে আর সামরিক সাহায্য দেবে না বলে নাকি মনস্ত করেছে। তবে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এ ধরনের প্রতিশ্রুতির মূল্য কতটুকু তা ইতিপূর্বের কোনো কোনো ঘটনায় আমরা প্রত্যক্ষ করেছি। সিনেটর কেনেডি পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের মৌখিক আর কাজের পার্থক্য ফাঁস করে দিয়েছিলেন। সৌদি আরব আমেরিকার কাছ থেকে পাওয়া যে বিমান ও সমর উপকরণ পাকিস্তানের কাছে বিক্রি করেছে তা আমেরিকার গোপন স্বীকৃতি ছাড়া সম্ভব নয়।
* * *
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেন প্রভৃতি দেশ বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান চায়। এই সমাধানের জন্য আলোচনার পথ উন্মুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণের দায়িত্ব তারা ভারতের উপর চাপাতে চায় (বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে উদ্যোগী হওয়ার জন্য), এবং পাকিস্তান ভেঙে যাক তা চায় না। অর্থাৎ তারা পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের পক্ষপাতি।
প্রথমে আলোচনার টেবিলে বসে শান্তিপূর্ণ উপায়ে সমাধানের প্রশ্নটি বিবেচনা করা যাক। ব্রিটেন-আমেরিকা প্রভৃতি দেশ চাই যে ভারত যেন এ ব্যাপারে উদ্যোগী হয়। কিন্তু বাংলাদেশে সমস্যাটি যাদের সৃষ্টি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা যদি নিজে থেকে সমাধানের জন্য আগ্রহ প্রকাশ না করে তাহলে আলোচনার দরজাই উন্মুক্ত হতে পারেনা। তাছাড়া একমাত্র বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের নেতৃত্বে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধিবৃন্দের সঙ্গেই বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের আলোচনা হতে পারে। এই বাস্তব সত্যটা ব্রিটেন, আমেরিকা প্রভৃতি দেশের সরকারকে উপলব্ধি করতে হবে এবং ইয়াহিয়া সরকারকে তা উপলব্ধি করতে বাধ্য করতে হবে।
উপরোক্ত শর্তগুলো পূরণ হলে আসে আলোচনার টেবিলে বসার যৌক্তিকতা ও নৈতিকতার প্রশ্ন। ঘাতক ইয়াহিয়া চক্রের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসার ব্যাপারে অনেরেই নৈতিক আপত্তি আছে। কেউ কেউ মনে করেন যে, আলোচনায় বসার অর্থ হচ্ছে মুক্তিসংগ্রামকে বর্জন করা। কিন্তু সে কথা মোটেই সত্য নয়। যদি আলোচনায় বসতেই হয় তাহলে মুক্তিযুদ্ধ জোরদার করে এবং অব্যাহত রেখেই বসতে হবে। বরং বলা যায় যে মুক্তিযুদ্ধের সাফল্যের জরিমানা তাদের আলোচনায় আসতে বাধ্য করা যাবে। আলজেরিয়ার মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত রেখে ফরাসি সরকারের সঙ্গে আলজেরিয়ার মুক্তিকামী জনগণের প্রতিনিধিদের আলোচনা এবং আলজেরিয়ার স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছিল। তবে আলোচনার সফল পরিসমাপ্তি সম্ভব হয়েছিল আলজেরিয়ার মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তির ফলে, ফরাসি সরকারের ভালো মানুষীর জন্য নয়।
তাই আমি নিজের ব্যক্তিগত ভাবে আলোচনার টেবিলে বসার ব্যাপারে কোনো আপত্তি দেখিনা। তবে সেই আলোচনা হতে হবে বাংলাদেশের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রতিনিধিবৃন্দ এবং পাকিস্তান সামরিক জান্তার মধ্যে এবং তা অবশ্যই কোনো নিরপেক্ষ তৃতীয় অনুষ্ঠিত হতে হবে। যাতে আলোচনা ব্যর্থ হলে বন্দিত্বের আশঙ্কা বঙ্গবন্ধুর অন্যান্য নেতৃবৃন্দের উপর হুমকি হিসেবে বিরাজ না করে।
এ কথা সকলেরই জানা আছে যে, ভিয়েতনামের দীর্ঘস্থায়ী রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম অব্যাহত থাকা সত্ত্বেও আলোচনার টেবিলে বসতে ভিয়েৎকং সরকারের তরফ থেকে কোনো আপত্তি হয়নি। বরং দক্ষিণ ভিয়েতনামের তাবেদার সরকার ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ভিয়েতনামের মুক্তিযোদ্ধাদের সরকারের সঙ্গে আলোচনায় বসতে তীব্র আপত্তি জানিয়েছিল। যে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দকে পাকিস্তানি সামরিক জান্তা দেশদ্রোহী, ক্রিমিনাল ইত্যাদি আখ্যা দিয়েছে যে আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করেছে এবং যে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের আসন বাতিল করেছে তাদের সঙ্গে আলোচনায় বসলে বাংলাদেশ প্রশ্নে তাদের (অর্থাৎ বাংলাদেশের নেতৃবৃন্দের) রাজনৈতিক বাস্তবতা প্রতিনিধিত্ব এবং কথা বলার অধিকার কে স্বীকার করে নেওয়া হয়। এই কারণেও পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যা হিসেবে চিহ্নিত করতে চায়। যে সমস্ত দেশ বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলছেন তারাও পাকিস্তানের জন্য এই অস্বস্তিকর দির্টি উপলব্ধি করছেন বলেই পাক-ভারত ডায়ালগ এর কথা বলছেন, বাংলাদেশ সরকারের অংশগ্রহণের প্রশ্নটি এড়িয়ে যাচ্ছেন।
তাই ভারতের শরণার্থী সমস্যাকেই বাংলাদেশে সমস্যার মূল সংকট হিসেবে তারা দেখছেন বা দেখাতে চাইছেন। কিন্তু ভারতের শরণার্থী সংকট বাংলাদেশ সংকটেরই একটা উপসর্গ মাত্র এবং বাংলাদেশের প্রকৃত সমাধান হলেই যে শরণার্থী সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে এটা তারা বুঝতে পারছেন না অথবা বুঝবার চেষ্টা করছেন না।
* * *
অনেকে মনে করেন যে, বাংলাদেশ সমস্যাটি পাক ভারত বিরোধী হিসেবে চিহ্নিত হবার একটা বড় কারণ হচ্ছে বাংলাদেশে সমস্যাকে এতদিন প্রধানতঃ মানবিক দিক থেকে বিশ্বের কাছে তুলে ধরা হয়েছে এবং রাজনৈতিক কারণে অপেক্ষাকৃত গৌণ থেকে গেছে। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নৃশংস অত্যাচার, গণহত্যা ও ভারতে শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণের মর্মান্তিক দিকটির উপরেই বেশি জোর দেয়া হয়েছে। বিশ্ব বিবেক জাগ্রত করার এবং ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার প্রতি তীব্র ঘৃণা সৃষ্টি করার জন্য এর প্রয়োজন অবশ্যই ছিল। কিন্তু সেই অজুহাতে একটি রাষ্ট্র থেকে অন্য রাজ্যের বেরিয়ে আসা কিংবা রাষ্ট্রীয় কাঠামো ভেঙে দেয়া চলে বলে বিশ্বের অনেক রাষ্ট্রের পক্ষেই মেনে নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। তাদের খটকা এখানেই। তারা প্রচলিত ধারণা থেকে মানবতা বিরোধী কার্যকলাপের প্রতিবিধানের উপায় হিসেবে শাসন কাঠামোর এবং প্রয়োজনবোধে কিঞ্চিৎ শাসনতান্ত্রিক রং বদলের কথাই ভাবেন। শুধু মানবের কারণকে তারা একটা রাষ্ট্রকে ভেঙ্গে দেবার পক্ষে যথেষ্ট বলে মেনে নিতে পারেন না। কারণ তাদেরকে নিজ নিজ দেশের রাষ্ট্রীয় সংহতি ও ঐক্যের কথা ভাবতে হয়।
কাজে বাংলাদেশ সমস্যার শুধু মানবিক দিক করে দেখালেই চলবে না, রাজনৈতিক দিকটিই বড় করে তুলে ধরতে হবে। বাংলাদেশ রাষ্ট্রবিজ্ঞানের যেকোনো সংজ্ঞা অনুযায়ী একটা স্বতন্ত্র দেশ এবং স্বতন্ত্র জাতীয় সত্যটি রাজনৈতিক দিক থেকে জোরের সঙ্গে তুলে ধরতে পারলে অনেক দেশের পক্ষেই নৈতিক দিক থেকে এবং জাতিসংঘের সনদ অনুযায়ী বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তিসংগ্রামের বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। চরিত্রগত দিক থেকে বাংলাদেশের এই সংগ্রাম যে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম সঠিকভাবে তা বুঝিয়ে দিতে পারলে একটি রাষ্ট্র ভেঙ্গে দেবার অহেতুক ভীতি থেকে দুনিয়ার অনেক রাষ্ট্রই মুক্তি পাবে। তখন তাদের পক্ষে আরও প্রত্যক্ষভাবে এগিয়ে আসা সম্ভব হবে।
এদিকটা যে একেবারেই তুলে ধরা হয়নি তা নয়- তবে পত্রপত্রিকা থেকে সর্বত্র মানবিক প্রশ্নটিই বেশি প্রাধান্য পেয়ে এসেছে। তাতে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত হয়েছে কিন্তু মা বাংলাদেশের স্বতন্ত্র জাতীয় অস্তিত্বের বাস্তবতা ততটা স্বীকৃত হতে পারেনি।
সাম্প্রতিক ভারত যুগোস্লাভিয়া কমিউনিকেট উপনিবেশ সমূহের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের প্রতি সমর্থন জানানো হয়েছে। এ প্রসঙ্গে আমাদের মনে রাখা দরকার যে এই কমিউনিটি প্রচারিত হয়েছিল বাংলাদেশ প্রশ্নে শ্রীমতি গান্ধী ও প্রেসিডেন্ট টিটোর মধ্যে আলোচনা বৈঠক শেষে। কাজেই উপরোক্ত মন্তব্যের পেছনে বাংলাদেশের সংগ্রামের চরিত্রের প্রতি একটা প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিত রয়েছে বলে ধরে নেওয়া যায়।
বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চরিত্রগত দিক দিয়ে রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে যদি আরো বলিষ্ঠভাবে তুলে ধরা যায় তাহলে কোনো গণতান্ত্রিক দেশের পক্ষে সরাসরি বিরোধিতা করা সম্ভব হবে না। সেক্ষেত্রে চীনের ভূমিকা ও সরাসরি বাংলাদেশের পক্ষে না এলেও অনেকখানি নিষ্ক্রিয় হতে বাধ্য। কাজে বাংলাদেশের স্বতন্ত্র রাজনৈতিক অস্তিত্বের কারন গুলোর উপর যাতে অন্য ঘটনাগুলি প্রাধান্য লাভ করে বিষয়টি আলোচনা করতে না পারে সেদিকে লক্ষ্য রাখার প্রয়োজন রয়েছে।
পিকিং থেকে খালি হাতে ভুট্টোর প্রত্যাবর্তন
বিবিসির এক খবরে প্রকাশ গত রবিবার পিকিং-এ একদল চীনা তরুণ চীন সফরকারী পাকিস্তানের সামরিক প্রতিনিধিদলের অসামরিক নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টোর বিরুদ্ধে বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা পূর্ব বাংলার জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার দানের ব্যাপারে পাকিস্তানের বিরূপ মনোভাব এর বিরুদ্ধে এই বিক্ষোভ প্রদর্শন করেন। তারা জনাব ভুট্টোর কাছে জানতে চান পশ্চিম পাকিস্তান সরকার বাংলাদেশের জনগণকে গণতান্ত্রিক অধিকার দিতে চান না কেন?
এদিকে ভুট্টোর নেতৃত্বাধীন প্রতিনিধিদলের পিকিং সফর সম্পর্কিত সকল জল্পনা-কল্পনার প্রায় অপমান হয়েছে। বিশ্বের প্রায় সমস্ত পত্র-পত্রিকা, সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এবং বেতার ও টেলিভিশনে ব্যাপারে একমত যে ভুট্টোর প্রতিনিধি দল খালি হাতেই পিকিং থেকে ফিরে এসেছে। অর্থাৎ যে উদ্দেশ্যে ইয়াহিয়া খানের প্রতিনিধিদলকে পিকিং প্রেরণ করেছিলেন তা ব্যর্থ হয়েছে।
ওয়াকিবহাল মহলের মতে ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্য ছিল ভারত সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে চীনের সাথে কোন চুক্তি করা। আর তা সম্ভব না হলে পাক-ভারত যুদ্ধে চীনের সক্রিয় হস্তক্ষেপ সম্পর্কে চিনা নেতাদের কাছ থেকে স্পষ্ট ঘোষণা আদায় করা। কিন্তু চীন এর কোনটিই করতে রাজী হয়নি। তারা শুধুমাত্র কতিপয় মামুলি ধরনের কথাবার্তা বলে ভুট্টোর দলকে বিদায় দিয়েছেন।
এ প্রসঙ্গে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহল ভুট্টোর প্রতিনিধি দলের সম্মানে প্রদত্ত ভোজসভায় চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিঃ চেং পেং ফি’র মন্তব্যের উপর গুরুত্ব আরোপ করছেন। তিনি তাঁর বক্তৃতায় পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বাংলাদেশ সমস্যার ‘একটা যুক্তিসঙ্গত সমাধান’ করার আহ্বান জানিয়েছেন। তারা জনাব ভুট্টো প্রদত্ত ভোজসভায় প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাই-এর বক্তৃতার
উপরও গুরুত্ব দিতেছেন না। চীনা প্রধানমন্ত্রী তাঁর বক্তৃতায় জনাব ভুট্টো যে উদ্দেশ্যে গিয়েছেন তার ধারে কাছেও না গিয়ে পাকিস্তান ও চীনের মধ্যকার “বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক ও সহযোগিতা”র বিষয়ে উল্লেখ করে বক্তৃতা শেষ করেছেন। তার বক্তৃতায় পাক-ভারত সম্পর্কে উপমহাদেশের উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সম্পর্কে কোনো উল্লেখই ছিল না।
এছাড়া চীনের অস্থায়ী পররাষ্ট্রসচিব “বৈদেশিক শত্রু কর্তৃক আক্রান্ত হলে পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসার” ব্যাপারে যে মন্তব্য করেছেন পর্যবেক্ষক মহলের মতে এটা একটা কথার কথা মাত্র। কেননা, চীন জানে যে ভারত কোন অবস্থাতেই পাকিস্তানকে আক্রমণ করতে যাচ্ছে না। কেবলমাত্র পাকিস্তান কর্তৃক আক্রান্ত হলে ভারত আত্মরক্ষার জন্য পাল্টা আক্রমণ করবে। সে অবস্থায় চীনের পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসার কোনো প্রয়োজন হবে না।
চীনের এ মতি গতির কারণ কি?
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের কতিপয় কারণে চীন-পাকিস্তানের ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করেছেন।
প্রথমতঃ সম্প্রতি জাতিসংঘের চীনের অন্তর্ভুক্তি ও ফরমোজার বহিষ্কার প্রশ্নে আফ্রো-এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকা সহ সারা বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গ চীনকে যে আশা নিয়ে ভোট দিয়েছে চীন এই মুহূর্তে তার অমর্যাদা করতে চায়না। চীন জাতিসংঘে গিয়ে বিশ্বে উত্তেজনা হ্রাসের ব্যাপারে গঠনমূলক ভূমিকা পালন করবে বলেই সকলের আশা।
দ্বিতীয়তঃ বিশ্বের অত্র অঞ্চলে রুশ ভারত মৈত্রী পাল্টা ব্যবস্থা হিসেবে পাকিস্তানকে তাদের যত প্রয়োজনে থাকুক না কেন চীনের সীমান্তে বিপুল সংখ্যক সৈন্য মোতায়েন থাকার প্রেক্ষিতে চীন বাহ্যতঃ রাশিয়ার বিরুদ্ধে শত্রুতামূলক কিছু করতে নারাজ।
তৃতীয়তঃ চীন-ভারত বিরোধের প্রেক্ষিতে আমেরিকার সামরিক জোটে আবদ্ধ থাকা সত্বেও পাকিস্তান চীনের পক্ষপুটে যাবার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বর্তমানে চীন-ভারত সম্পর্কের উন্নতি হওয়ায় চীনের কাছে পাকিস্তানের প্রয়োজন আগের মত আর নাই।
চতুর্থত পাকিস্তানের সামরিক চক্র দেশে প্রগতিশীলদের নির্মূল করে প্রতিক্রিয়াশীল ধর্মান্ধদের যেভাবে মদদ দিয়ে চলছে তাতে দেশে-বিদেশে চীন সরকার বিশেষ অসুবিধায় পড়েছে। ইয়াহিয়া চক্রভ্যুঃ তোকে দলের নেতা করে পাঠিয়ে তা কাটাবার চেষ্টা করেছে। কিন্তু পারেনি। সর্বোপরি বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনের নীতি পাকিস্তানে ও বাংলাদেশে চিনা পন্থীদের বেকায়দায় ফেলেছে।
সর্বশেষে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর সাফল্য থেকে চীন নেতারা হয়তো বুঝতে পেরেছেন যে বাহির থেকে পশ্চিম পাকিস্তানিদের যত সহজে দেওয়া হোক না কেন মুক্তিবাহিনীর বিজয় অবধারিত। কোন শক্তিই তাদের গতিরোধ করতে পারবে
না। ফলে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর চীনকে সেজন্য খেসারত দিতে হবে।
রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের মতে এসব কারণে চীনের পক্ষে এই মুহূর্তে পাকিস্তানকে ডাস্টবিনে নিক্ষেপ করা সম্ভব না হলেও বাংলাদেশের বিরুদ্ধেও কোন প্রকাশ্য ভূমিকা গ্রহণ সম্ভব নয়।
বাংলাদেশের যুদ্ধ আসলে একটি ‘জাতীয় মুক্তি আন্দোলন’
‘বাংলাদেশের যে সংগ্রাম চলছে তা জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং তার মধ্যে গৃহযুদ্ধের উপাদান রয়েছে।’
ভারতের সফররত সোভিয়েত সংসদীয় প্রতিনিধি দলের নেতা মিস্টার কুদরিয়াভেৎসেভ সম্প্রতি দিল্লিতে প্রেসক্লাব অব ইন্ডিয়ার ‘মিট দ্য প্রেস’ অনুষ্ঠানে উপরোক্ত মন্তব্য করেন।মিঃ কুদরিয়াভেৎসেভ সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম সোভিয়েতের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিষয়ক সংসদীয় কমিটির সাধারণ সম্পাদক। তিনি প্রথম সোভিয়েত নেতা যিনি বাংলাদেশ আন্দোলনকে জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম বলে প্রকাশ্য স্বীকৃতি দিলেন। মিঃ কুদরিয়াভেৎসেভের এই মন্তব্য এই কারণে আরো বেশি তাৎপর্যপূর্ণ যে, তিনি শুধু একজন সফররত সংসদীয় সদস্য হিসেবে এ কথা বলেননি -বলেছেন সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র ও তার সরকারের প্রতিনিধি হিসেবে।
তিনি আরো বলেছেন, বাংলাদেশের এখন যা ঘটছে তা “পাকিস্তানের সন্ত্রাসের নীতির দ্বারা ত্বরান্বিত জাতীয় মুক্তি আন্দোলন।”
তিনি জোর দিয়ে বলেন, ‘ যে সমাধানেই নির্ণয় করা হোক না কেন, জনগণের ইচ্ছা তাদের আইন সঙ্গত অধিকার ও জাতীয় আশা-আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতেই তা করতে হবে।’
মিঃ কুদরিয়াভেৎসেভ আশা করেন যে ভারত-পাকিস্তান সীমান্তের উত্তেজনাপূর্ণ ঘটনাবলী দু’দেশের মধ্যে কোনো সংঘর্ষ ডেকে আনবে না। তবে সংঘর্ষ হবে কিনা তা তিনি বলতে পারেন না। তার মতে ভিয়েতনাম এবং মধ্যপ্রাচ্যের অবস্থা এখনো বিস্ফোরণের মুখে থাকায় পৃথিবীর তৃতীয় একটা সংঘর্ষের ক্ষেত্রের বিলাসিতায় মাততে পারেনা। তারচেয়েও বড় কথা, একবার সংঘর্ষ শুরু হলে অধিক থেকে অধিকতর দেশ তাদের জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হয়।
তিনি আশা করেন যে, পাকিস্তান বাস্তব অবস্থা উপলব্ধি করবে, একটা সমাধানে উপনীত হবে এবং স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনবে যাতে শরণার্থীরা আস্থার সাথে স্বদেশে ফিরে যেতে পারে। তবে কি করে সেটা করা যেতে পারে তা তিনি বলতে পারেন না। সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র অথবা অন্য কোনো দেশের পক্ষে তা বলা সম্ভব নয়। পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক গোষ্ঠী আর বাংলাদেশের নেতাদেরেই সে সমাধান বের করতে হবে।
সোভিয়েত যুক্তরাষ্ট্র-‘বাংলাদেশ’ কথাটা ব্যবহার করে না কেন, এই প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন। কথায় কিছু যায় আসে না। আসল কথা হচ্ছে কাজ।
ভারত সোভিয়েত সাংস্কৃতিক সমিতির উদ্যোগে আয়োজিত এক সভায় মিঃ কুদরিয়িভেৎসেভ বলেন যে, ভারত যদি আক্রান্ত হয় তাহলে তার দেশ তাকে সাহায্য করবে।
ভারত সোভিয়েত চুক্তি সম্পর্কে তিনি বলেন, পাকিস্তানি শাসকদের যুদ্ধংদেহী মনোভাবের দরুন ভারতের অখন্ডতা যখন বিপন্ন হয়ে পড়ে তখন এই চুক্তি স্বাক্ষরিত হয়।
পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠীর প্রতি প্রাভদা
সম্প্রতি প্রাভদা এক নিবন্ধে পাকিস্তানের সামরিক শাসক গোষ্ঠীর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে যে, ভারতস্থিত ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে পূর্ণ নিরাপত্তা ও স্বাধীনতার মধ্যে পূর্ববঙ্গে ফিরে যাওয়ার মত অবস্থা সৃষ্টি করা হোক।
সোভিয়েত কমিউনিস্ট পার্টির সংবাদপত্র প্রাভদায় মিস্টার ওলেন ওরেষ্টভ বাংলাদেশের রাজনৈতিক সংকটের ব্যাখ্যা করেছেন ও শরণার্থীদের দেশত্যাগ উপমহাদেশে পরিস্থিতি আরও খারাপ হওয়ার প্রধান কারণ বলে উল্লেখ করেছেন।
শরণার্থীদের ভাগ্যকে দুঃখজনক বলে বর্ণনা করে পত্রিকাটি লিখেছে, পাকিস্তান সরকার শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার অধিকার স্বীকার করেছেন, সুতরাং তাদের এমন অবস্থা সৃষ্টি করা উচিত যা শরণার্থীদের পূর্ণ নিরাপত্তা এবং স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেবে। পত্রিকাটি দুঃখ প্রকাশ করে লিখেছেন, ইয়াহিয়া খানের প্রশাসন তা করেনি, ফলে শরণার্থী পরিস্থিতি জটিল আন্তর্জাতিক সমস্যায় পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানি কিছু উগ্র স্বভাবের ও চরমপন্থী লোক আছে যারা কোনো যুক্তির ধার ধারে না, বর্তমান পরিস্থিতির জন্য ভারতকে দায়ী করছে এবং দুই দেশের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধাতে উস্কানি দিচ্ছে।
অক্টোবর দিবস উপলক্ষে ক্রেমলিনে আয়োজিত এক সভায় সোভিয়েত পলিটব্যুরোর সদস্য মিঃ ভিক্টর গ্ৰিসিনের বক্তৃতায় উল্লেখ করে প্রাভদা লিখেছেন, পূর্ববঙ্গের ঘটনায় সোভিয়েত ইউনিয়ন বিশেষ উদ্বিগ্ন। সোভিয়েত ইউনিয়ন আশা করে যে, পূর্ববঙ্গের সমস্যা সমাধানের মধ্য দিয়ে বর্তমান জটিলতার শান্তিপূর্ণ মীমাংসা হবে। পাকিস্তান সরকারের জনগণের উপর প্রতিশোধ গ্রহণ করা বন্ধ করা উচিত এবং শরণার্থীদের দেশে ফিরে যাওয়ার অবস্থা সৃষ্টি করা উচিত। একমাত্র তখনই ভারত-পাকিস্তান সীমান্ত প্রকৃত শান্তির সীমান্ত এবং সৎ প্রতিবেশীসুলভ সীমান্ত হয়ে উঠবে।
খুনি ইয়াহিয়াদের বাঙালি বিদ্বেষে কূটনীতির অঙ্গনও কলঙ্কিত
ইয়াহিয়ার বাঙালি বিদেশের বিষবাষ্প নয়াদিল্লিস্থ পাকদূতাবাসেও সংক্রমিত হয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানী দূতাবাস কর্মীদের পৈশাচিক বর্বরতা কূটনীতির সৌজন্য ও লৌকিকতার ইতিহাসকে মসীলিপ্ত করেছে।
গত ২রা নভেম্বর মনা দিল্লির দূতাবাসের অবশিষ্ট ১১ জন বাঙালি কর্মী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করলে, দূতাবাসের পশ্চিম পাকিস্তানী দস্যুরা লাঠি, লোহার রড এবং অন্যান্য মারাত্মক অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে এবং বেদম প্রহার করে। বাঙালি কর্মীদের পরিবার-পরিজন এমনকি নারী ও শিশু পর্যন্ত এই পাইকারি নির্যাতন থেকে রেহাই পায়নি।
শিশু ও মেয়েদের নিয়ে দেয়াল টপকে তারা যখন কসাইখানা থেকে বেরিয়ে আসেন তখন অনেকের ক্ষতস্থান থেকেই রক্ত ঝরছিল।
ঘটনার খবর পেয়ে নয়াদিল্লিস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব আহমেদ রশীদ চৌধুরী তার দুই সহকর্মীসহ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে স্থানীয় পুলিশ ও কয়েকজন ভারতীয় এবং বিদেশি সাংবাদিক এর সহায়তায় তাদের নিরাপদ আশ্রয় প্রেরণ করেন। গুরুতররূপে আহতদের হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়।
নির্যাতিত বাঙালি কর্মীরা বলেন, পাকিস্তান সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা বিভাগের ‘নায়েক’ মর্যাদার জনৈক মোস্তাক বাট-এর নেতৃত্বে এই দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয়। উক্ত বাট ভারতে নাশকতা মূলক কাজ কর্মের তত্ত্বাবধায়ক। বাটের নেতৃত্বে সামরিক বাহিনীর আব্দুল হামিদ, এ, রহমানী, তোরাবাজ খান, সফিউদ্দিন, তাবিজগুল খান, নুর মহাম্মদ, আসিক হোসেন, পুলিশ বাহিনীর মহাম্মদ ইয়াসিন ছাড়াও পশ্চিম পাকিস্তানের ড্রাইভার এবং নিরাপদ সক্রিয়ভাবে অংশ নেয়।
ভারতের পাক গোয়েন্দা চক্রের প্রধান আব্দুল গনির ব্যক্তিগত সহকারি জনাব হোসেন আলী প্রচন্ড প্রহারের ফলে যখন অজ্ঞান হয়ে পড়ে তখন তাকে ধরাধরি করে দূতাবাসের একটি কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়। সে সময় জনাব হোসেন আলী ১৫ বছরের কন্যা মায়া সাহায্যের জন্য চিৎকার করে ওঠে এবং আতঙ্কে হতবুদ্ধি হয়ে পালানোর চেষ্টা করে। তখন উক্ত বাট মায়ার চুলের মুঠি ধরে তাকে নির্মমভাবে প্রহার করতে থাকে। তাকে যখন তার পিতার মতোই টেনেহিঁচড়ে একটি রুমের মধ্যে ঢোকানো ছিল তখনও মায়া প্রাণপণে চিৎকার করে সাহায্য কামনা করেছিল।
জানা গেছে, জনাব হোসেন আলী, তার স্ত্রী এবং তিন কন্যাকে একাই রুমের ভিতরে আটক রাখা হয়েছে। জনাব আলীর চিকিৎসার কোন ব্যবস্থা তো হয়েই নাই। আটককৃতদের মধ্যে জনাব আলীর দুই বছরের একটি শিশু কন্যা ও রয়েছে।
পরিবার পরিজনসহ অবশিষ্ট বাঙালি কর্মচারীগণ দূতাবাসের বাইরে এসেই প্রথম কথা বলেন ‘জয় বাংলা’।
যে দশজন দূতাবাসকর্মী বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন তারা হলেন মেসার্স মোজাম্মেল হক, নুরুল হক, শফিকুর রহমান, আবদুল আউয়াল, চৌধুরী মোহাম্মদ ইউনুস, সফিউদ্দীন আহমেদ খান, আবুল হোসেন, আলিম উদ্দিন এবং খলিল উদ্দিন।
পাক হাইকমিশনার আটক জনাব হোসেন আলী ও তার পরিবারবর্গের মুক্তির জন্য বাংলাদেশ সরকার জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট, ভারতের কূটনৈতিক মহলের ডীন এবং আন্তর্জাতিক রেডক্রসের চেয়ারম্যানের কাছে হস্তক্ষেপের’ অনুরোধ জানিয়েছেন।
গত ৪ঠা নভেম্বর দিল্লিতে এক সাংবাদিক সম্মেলনে জনাব হুমায়ুন রশীদ চৌধুরী বলেন যে প্রতিরোধমূলক ব্যবস্থা নেবার আগে, আমাদের শান্তিপূর্ণ প্রচেষ্টার কি ফল দেয় সেজন্য আমরা অপেক্ষা করবো।
তিনি আরো বলেন, জনাব আলী শিশুদের আবেদন এবং আমাদের এবং বিশ্ব সংস্থা গুলোর সম্মিলিত প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হয়, তাহলে অবশ্যই আমরা আমাদের পরিকল্পনা অনুযায়ী এগিয়ে যাব। এর সম্পূর্ণ দায়িত্ব তখন সাজ্জাদ হায়দারকেই নিতে হবে।
এদিকে জনাব আলী এবং তাঁর পরিবারবর্গের কোন খবর পাওয়া যাচ্ছে না। তার ভাগ্য সম্পর্কে পাক হাইকমিশন বিশেষ গোপনীয়তা রক্ষা করে চলেছে। বিদেশি সাংবাদিকেরা পাক হাইকমিশন থেকে আলী পরিবারের খবর জানার বহু চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়েছেন।
জনাব চৌধুরী বলেন, ‘আমরা জানি না জনাব আলী জীবিত না মৃত।’
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম আলীর মুক্তির উদ্দেশ্যে অবিলম্বে হস্তক্ষেপ করার জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্ট-এর কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম এক তারবার্তায় জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলকে জানিয়েছেন, জনাব আলী পাক হাইকমিশনের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগের ভারপ্রাপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানী অফিসারের ব্যক্তিগত সহকারি পাক গুপ্তচর কাজকর্মের বিষয়ে ওয়াকিবহাল, সুতরাং তার প্রাণহানির সমূহ আশঙ্কা আছে।
দিল্লির পাক হাইকমিশনের কয়েকজন বাঙালি কর্মচারীকে মারধর এবং প্রাণহানির চেষ্টা করার জন্য তিনি জাতিসংঘকে পাকিস্তানি বর্বরতার নিন্দা করার দাবি জানিয়েছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যা এখন বিদেশে পাক কূটনীতিক মিশন গুলির ভিতরেও চালান আরম্ভ হয়েছে। বিশ্বের সমাজের উচিত এই আচরণের তীব্র নিন্দা করা।
ভারতস্থ বাংলাদেশ হাই কমিশনার জনাব এম হোসেন আলী দিল্লিস্থ হাইকমিশনে আটক বাঙালি দূতাবাসকর্মী জনাব হোসেন আলী খানের জন্য গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে এক বিবৃতি দেন। তিনি বলেন, যেহেতু জনাব হোসেন আলী খান সিনিয়র পাকিস্তানি গোয়েন্দা অফিসার এর ব্যক্তিগত সহকারী ছিলেন, সুতরাং তার জীবন নাশের ও প্রবল আশঙ্কা রয়েছে।
বিবৃতিতে তিনি বিশ্বের সকল শান্তিপ্রিয় নাগরিককে হোসেন আলী খানের মুক্তির জন্য পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর সর্বাত্মক চাপ প্রয়োগের আহবান করেন। তিনি বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের জান্তার বোঝা উচিত যে বাংলাদেশের জনগণের বিশ্বাস এবং আস্থা তারা চিরকালের জন্য হারিয়েছে। তিনি দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি শত্রুমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত বাংলাদেশের জনগণ থামবেন না। এই শয়তানের রাজত্ব একটি চরম আঘাত প্রত্যাশা করছে। আশা করা যায় অচিরেই বিশ্বসমাজ এগিয়ে আসবেন, অন্যথায় মুক্তিবাহিনী চরম আঘাত হানার জন্য প্রস্তুত হয়েই আছেন।’
মুজিবকে জেলে রেখে কোনো সমাধানই সম্ভব নয়
-ইরানি পত্রিকা
ইরানের রাজধানী তেহরান থেকে প্রকাশিত ‘সাদে মারদম’ পত্রিকায় দাবি করা হয়েছে, শেখ মুজিবকে অবিলম্বে মুক্তি দেওয়া হোক। শেখ মুজিবকে মুক্তিদান বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের প্রথম সোপান। তাকে কারাগারে আবদ্ধ রেখে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান এর কথা উঠতেই পারে না। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে যে, শেখ মুজিবকে ছেড়ে দিলে কেবল পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক অবস্থার উন্নতি ঘটবে না, এর ফলে যুদ্ধ উত্তেজনা হ্রাস প্রাপ্ত হবে।
পত্রিকাটির মতে, শেখ মুজিবের মুক্তি পশ্চিম পাকিস্তানের জনসাধারণ ও সমর্থন করবে।
সামরিক অভিযান বাংলাদেশ সমস্যা সমাধান করতে পারেনি। সামরিক অভিযানের ফলে কোনো অভিষ্ট সিদ্ধ হয়নি। এখন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের জন্য উদযোগী হওয়া বাঞ্ছনীয়।
দেশ বন্ধুর চোখে বাংলাদেশ ও হিন্দু- মুসলমান
আজকের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা যদি ধরা হয় তাহলে দেখা যাবে পূর্ববাংলার রংবেরঙের মুসলিম লীগ, জামাতে ইসলামী, নিজামে ইসলামী,পি, ডি,পি ও বাঙ্গালী রাজাকার গুন্ডাদের সঙ্গে আপেক্ষিকভাবে বেশি লড়াই করতে হচ্ছে বাঙ্গালীদের। কারণ অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের পশ্চিমাংশের সেনারা হলো বিদেশি পর্যায়ভুক্ত।
যাইহোক মান্দালয় থেকেই সুভাষচন্দ্র দেশবন্ধুর জীবনচরিত লেখক শ্রী হেমেন্দ্রনাথ দাশগুপ্তকেও একটি বিরাট পত্র দেন। সেখানেও তার মনের কথার সঙ্গে দেশবন্ধু প্রসঙ্গে লেখেন, বাংলার সভ্যতা ও শিক্ষার সারসংকলন করিয়া তাহাকে রূপ দিলে যেরূপ মানুষের উদ্ভব হয় দেশবন্ধু অনেকটা সেইরূপ ছিলেন।
তাহার গুন বাঙালির গুণ, তাহার দোষ বাঙালির দোষ। তাহার জীবনের সবচেয়ে বড় গৌরব ছিল যে, তিনি বাঙালি। তাই বাঙালি জাতিও তাহাকে এত ভালোবাসিতো। তিনি প্রায়ই বলিতেন যে, বাঙালির দোষগুণ বাঙালি, বাঙালি! কেহ বাঙালিকে ভাবপ্রবণ বলিয়া ঠাট্টা বা বিদ্রুপ করিলে তিনি ব্যথিত হইতেন, তিনি বলিতেন- আমরা ভাবপ্রবণ ইহাই আমাদের গৌরবের বিষয়। তার জন্য লজ্জিত হইবার কোন কারন নাই।
বাংলার যে একটা বৈশিষ্ট্য আছে, বাংলার প্রকৃতিরূপে, বাংলা সাহিত্যে, বাংলার গীতিকবিতায়, বাঙালির চরিত্রের বৈশিষ্ট্য মূর্ত হয়ে উঠিয়াছে- একথা দেশবন্ধু যেরূপ জোরের সহিত প্রকাশ করিয়াছেন, তাহার পূর্বে সেইরূপ আর কেহ করিয়াছিলেন বলে আমার মনে হয় না। অবশ্য প্রভাব তাহার সম্পূর্ণ নিজস্ব নয়।
এরপর তিনি দেশবন্ধুর স্বদেশ-বিদেশ প্রীতির উপরে লেখেন,”প্রত্যেক নিয়েছে জাতীয় শিক্ষার বিকাশ সাধন করে তার ফলে বিশ্বমানবের শিক্ষা পরিপুষ্ট হয়। জাতীয় শিক্ষা কে বর্জন করিয়া অথবা অবহেলা করিয়া বিশ্ব মানবের সেবা সম্ভবপর হয় না। দেশবন্ধু স্বদেশ প্রেমের পরিণতি বিশ্ব প্রেমে; কিন্তু তিনি স্বদেশপ্রেমকে বাদ দিয়া বিশ্ব প্রেমিক হবার প্রয়াস পান নাই। অপরদিকে দোহার স্বদেশপ্রেম তাহাকে আত্যন্তিক স্বার্থপরতার দিকে লইয়া যাইতে পারে নাই।
দেশবন্ধু তাহারে স্বদেশপ্রেমের মধ্যে বাঙালিকে ভুলিয়া যাইতেন না। অথবা বাঙালাকে ভালবাসিতে গিয়া স্বদেশকে ভুলিতেন না। তিনি বাংলা কে ভালোবাসি ট্রেন প্রাণ দিয়া, কিন্তু তাহার ভালোবাসা বাংলার চতুঃসীমার মধ্যে আবদ্ধ ছিল না। বাংলার বাহিরে দোহার যে সকল সহকর্মী ছিলেন তাহাদের নিকট শুনিয়াছি যে, দেশবন্ধু সংস্পর্শে আসার অল্পদিনের মধ্যেই তাহারা তাহাদের হৃদয়ের দ্বারা আকৃষ্ট হয়েছিলেন।
সুভাষ চন্দ্রের এই লেখা থেকে প্রমাণিত হয় যে নিজের প্রদেশকে ভালোবাসলেই বা দেশের কাজ করলেই অপরকে ছোট করে দেখা বা অবজ্ঞা করা বোঝায় না। স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে ছোট করে দেখলে বা অপরের গুণগুলি কে অস্বীকার করলেই সংকীর্ণ মনের পরিচয় দেওয়া হয়। অর্থাৎ প্রকৃত জাতীয়তাবাদের সঙ্গে প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদের কোন পার্থক্য নেই, কারণ যে জাতীয়তাবাদ অপরকে ঘৃণা করতে শেখায় তা যেমন জাতীয়তাবাদ আন্তর্জাতিকতাবাদ অপরের গুণগুলি কে অস্বীকার করতে শেখায় তাও প্রকৃত আন্তর্জাতিকতাবাদ নয়।
যাইহোক এছাড়াও সুভাষচন্দ্র ওই চিঠিতে হিন্দু-মুসলমান সম্পর্কে দেশবন্ধুর মনোভাবের কথা জানিয়ে লেখেন,”ভারতের নায়ক দের মধ্যে দেশবন্ধুর মতো ইসলামের এত বড় বন্ধু আর কেউ ছিলেন বলে আমার মনে হয় না-অথচ সেই দেশবন্ধু তারকেশ্বর সত্যাগ্রহ আন্দোলনে অগ্রণী হইয়াছিলেন। তিনি হিন্দু ধর্মকে এত ভালোবাসি তো তার জন্য প্রাণ দিতে প্রস্তুত ছিলেন অথচ তার মনের মধ্যে গোঁড়ামি আদৌ ছিল না। এই জন্য তিনি ইসলামকে ভালোবাসিতে পারিতেন। আমি জিজ্ঞাসা করি, কয়জন হিন্দু জননায়ক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন তাহারা মুসলমানকে আদৌ ঘৃণা করেন না? কয়জন মুসলমান জননায়ক বুকে হাত দিয়ে বলতে পারেন তাহারা হিন্দুকে ঘৃণা করেন না? দেশবন্ধু ধর্মমত হিসেবে বৈষ্ণব ছিলেন। কিন্তু তাহার বুকের মধ্যে সকল ধর্মের লোকের স্থান ছিল। চুক্তিপত্রের দ্বারা বিবাদ ভঞ্জন হলেও তিনি বিশ্বাস করতেন না যে শুধু তাহারা হিন্দু-মুসলমানের মধ্যে প্রীতি ও ভালোবাসা জাগরিত হইবে। তাই তিনি শিক্ষার দিক দিয়া হিন্দুধর্ম ও ইসলামের মধ্যে মৈত্রী স্থাপনের চেষ্টা করিতেন। হিন্দু শিক্ষা ও ইসলামী শিক্ষার মধ্যে কোথায় মিল পাওয়া যায় এই বিষয়ে কারাগারে মাওলানা আকরাম খাঁ’র সহিত তাহার প্রায় ই আলোচনা হতো। আমার যতদূর স্মরণ আছে হিন্দু-মুসলমানের শিক্ষার মিলন এর বিষয়ে মৌলানা সাহেব পুস্তক বা প্রবন্ধ লিখিতে রাজি হইয়াছিলেন।”
এরপর স্বরাজ সম্পর্কে লেখেন স্বরাজের প্রতিষ্ঠা হইবে উচ্চশ্রেণীর স্বার্থসিদ্ধির জন্য নয়, জনসাধারণের উপকার ও মঙ্গলের জন্য এরূপ দেশবন্ধু জোর গলায় প্রচার করেছিলেন প্রথম শ্রেণীর আর কোনো নেতা সেরূপ করিয়াছিলেন বলে আমার মনে হয় না। আর স্বরাজ কি? তার উত্তরে দেশবন্ধু বলেন,” স্বরাজ মানে তোমার আমার অন্তরে যে প্রকৃতি আছে সে প্রকৃতিকে উপলব্ধি করা।”যারা মনে করেন স্বরাজ একটা শাসন প্রণালী, তারা জানে না যে স্বরাজ হলে তবে শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠিত হয়। স্বরাজ আগে, শাসন প্রণালী প্রতিষ্ঠা পরে। স্বরাজ অর্থ কি? অর্থ হিন্দু মুসলমান মিলিয়া মে নবীন জাতি গড়ে উঠেছে, তাদের শুদ্ধ মনের সম্মিলিত ইচ্ছায় প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে জীবনের প্রণালী।”আর তাছাড়া তিনি নিজে বাঙালি ছিলেন বলেই হয়তো বিশেষ করে বাঙালি জাতির কথা উল্লেখ করে বলেছেন,”হিন্দু এবং মুসলমান নিয়েই বাঙালি জাতি। আমরা সঙ্গবদ্ধ হয়ে বিশ্বের দরবারে দাঁড়াবো।”একথা দেশবন্ধু তথাকথিত নেতাদের মতো দায়সারা কথা বলেই ক্ষান্ত হয়েছেন তা নয় তার কথা তিনি তার জীবনের শত শত কাজের দ্বারাই যে প্রমাণ করেছেন তা বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলামের ‘ইন্দ্রপতন’ কবিতার কয়েকটি লাইন দেখলেই বোঝা যাবে। তার উদ্দেশ্যে কবি লিখেছেন,
“তোমারে দেখিয়া কাহারও
হৃদয়ে জাগে নিঃসন্দেহ
হিন্দু কিংবা মুসলিম তুমি অথবা
অন্য কেহ।
তুমি আর্তের, তুমি বেদনার,
ছিলে সকলের তুমি,
সবারে যেমন আলো দেয় রবি,
ফুল দেয় সবে ভূমি।
হিন্দুর ছিলে আকবর তুমি
মুসলিমের আরংজিব;
যেখানে রেখেছে জীবের বেদনা, সেখানে দেখেছো শিব।
নিন্দাগ্লানির পঙ্ক মাখিয়া;
পাগল মিলন হেতু
হিন্দু-মুসলমানের পরানে তুমিই
বাধিলে সেতু।
জানিনা আজকে কি অর্ঘ দেবে
হিন্দু- মুসলমান
ঈর্ষা পঙ্কে জন্মজ হয়ে ফুটুক
এদের প্রাণ।”
অতএব হিন্দু হলেই যে মুসলমানকে ম্লেচ্ছ বলতে হবে আর মুসলমান হলে যে হিন্দুদের কাফের বলতে হবে তা নয়। এক ধর্মাবলম্বী হয়েও যে অন্যের জন্য করা যায় তা রবীন্দ্রনাথ, সুভাষচন্দ্র, নজরুলের মতো দেশবন্ধু ও তার জীবনে দেখিয়ে গেছেন।তাইতো তার মৃত্যুতে কবি গোলাম মোস্তফা লিখেছেন-
“মিলিত জাতির মহররম আজি
শহীদ নবীন হোসেন বীর
হাহাকার করে এ কারবালায়
ফেল ফেল আজি অশ্রুনীর।”
এখন দেশবন্ধু জন্মশতবার্ষিকী পূর্তি উপলক্ষে দুই বাংলার প্রগতিশীল মানুষের মনে অন্ততঃ এটুকু জাগা উচিত যে আজো দু’ দেশে দারিদ্র, অজ্ঞতা, সংকীর্ণতা, অন্ধ অনুকরণ এর মোহ ইত্যাদি রয়েছে তাই আমরা যদি নিজেদের সাধ্যমত চেষ্টার সব ব্যাপারেই ভালোর দিকে হাওয়া ঘোরাতে পারি তাহলে শুধু যে দেশবন্ধুর আদর্শের প্রতি শ্রদ্ধা জানানো হবে তা নয়, নিজেরাও কি এতে উপকৃত হব না?
দেশবন্ধু যখন বাংলার সেবা করেছিলেন তখন ছিল একটাই বাংলাদেশ। তারপর বাংলার রাজনৈতিক রঙ্গমঞ্চে অনেক দৃশ্য ঘটে যাবার পর হয়েছে দেশভাগ। ‘পূর্ব পাকিস্তান’ পূর্ব বাংলা থেকে হয়েছে বাংলাদেশ। পূর্ব পাকিস্তান আমলে সে দেশের শাসকচক্র এমন অবস্থার সৃষ্টি করেছিলেন যে দেশবন্ধুর মতো এত বড় বাংলার সন্তানের নাম মুছে দেওয়া হচ্ছিল বাংলার ইতিহাস থেকে। পরে গভীর দেশপ্রেমের আদর্শ নিয়ে জন্ম নিয়েছে নতুন বাংলাদেশ। আর সেদিন সুদূর নয়, যেদিন দেশবন্ধুর দেশে উড়বে বাংলাদেশের পতাকা। তখন যদি দুই বাংলার জনগণ দেশবন্ধু স্মৃতি রক্ষার্থে তেলিরবাগ ও ঢাকাতে সমাজ সেবা কেন্দ্র, গ্রন্থাগার ও স্মৃতি স্তম্ভ স্থাপনের জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের কাছে আবেদন জানায় তাহলে কি ভুল হবে?
শেষ করছি দেশবন্ধুর মৃত্যুতে তার জীবনের মর্মকথা ব্যক্ত করে রবীন্দ্রনাথের লেখা দুটি লাইন দিয়ে-
“এনেছিলে সাথে করে
মৃত্যুহীন প্রাণ,
মরণে তাহাই তুমি
করে গেলে দান।”
সদ্য মুক্ত বাংলাদেশ থেকে এলাম
সারোয়ার জাহান
(জয়বাংলা নিজস্ব প্রতিনিধি)
সমগ্র দেবহাটা থানা গত দুমাস ধরে মুক্তি বাহিনীর দখলে রয়েছে। সমগ্র এলাকায় বাংলাদেশ সরকারের প্রশাসন ব্যবস্থা পুরোদমে চলেছে। মুক্ত এলাকার সীমানায় বাংলাদেশের দামাল ছেলেরা হানাদার শত্রুদের সকল আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য সদা প্রস্তুত রয়েছে। ঘৃণ্য পাকসেনা প্রতিদিনের বাংলাদেশের মুক্তি মাটি পূর্ণ দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু মুক্তিবাহিনীর বীর জওয়ানদের পাল্টা আক্রমণের মুখে তারা কিছুতেই টিকতে পারছে না। মুক্ত এলাকার প্রতিটি মানুষ আজ মুক্তিবাহিনীর পাশে দাঁড়িয়ে শত্রুকে নির্মূল করার দৃপ্ত শপথ নিয়েছে।
অপরদিকে মুক্ত এলাকায় জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে ফিরে এসেছে স্বাভাবিক জীবন। হানাদার বাহিনীর হামলায় স্বাভাবিক জীবনের যে তার ছিঁড়ে গিয়েছিল, তা আবার একে একে জোড়া লাগছে। সেখানে হাট-বাজার চলছে পুরোদমে, জেলেরা মাছ ধরছে নদীতে, পল্লী বধুর পুকুর ঘাটে গোসল করছেন নিশ্চিন্তে, চাষিরা মাঠে করছেন কাজ, কেউ ফসল কাটছেন, আবার কেউ সদ্য ফসল তোলা মাঠে বইছেন হাল। ডাক্তারেরা রোগীর চিকিৎসা করছেন। মুক্ত হওয়ার সাথে সাথে সেখানে এসে জনতার সাথে মিশে গিয়েছে মুক্তিবাহিনীর চিকিৎসকেরা। মুক্তিবাহিনীর দৃষ্টির সামনে সকল প্রকার চুরি ডাকাতি রাহাজানি বন্ধ হয়ে গেছে। রাজাকার আর বেশি দুশমনেরা পালিয়ে গেছে পাক বাহিনীর ছত্রছায়ায় অধিকৃত এলাকায় সাতক্ষীরা শহরে। হানাদার বাহিনীর দালালদের মাধ্যমে মুক্ত এলাকার খাদ্যসামগ্রী অধিকৃত এলাকায় পাচার করে যাতে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করতে না পারে সেদিকে সদা সজাগ মুক্তিবাহিনী প্রখর দৃষ্টি রেখেছে। মুক্ত এলাকার বাইরে সকল প্রকার জিনিস পাচার তারা বন্ধ করে দিয়েছে। শত্রুপক্ষের হামলার আশঙ্কা থাকায় তারা সকল সময় জনতার পাশে পাশেই রয়েছে যাতে জনসাধারণ পাক পশুর আক্রমণে অসহায় হয়ে না পড়ে। জরুরী পরিস্থিতিতে মুক্ত এলাকার ছোটখাটো প্রশাসনিক কাজ মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিক রা নিজেরাই দেখছেন। মুক্ত এলাকায় জীবনের নিশ্চয়তা পেয়ে বাংলাদেশের ছিন্নমূল মানুষ যারা এখানে ফিরে আসছেন মুক্তিবাহিনী তাদের ঘরবাড়ি তৈরি করে দিয়ে নতুন বাংলাদেশের গোড়াপত্তন করছে। গড়ে তুলছে সুখী-সমৃদ্ধ জীবনের চলার সিঁড়ি। বাস্তবায়িত হতে চলেছে শেখ মুজিবের লালিত স্বপ্ন। একশত আশি বর্গমাইলের এই এলাকায় ঘরে ঘরে এখন উঠছে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রক্ত পতাকা।
রাজশাহীতে দস্যু সৈন্যদের হাতে সহস্রাধিক নিরীহ গ্রামবাসী নির্মমভাবে নিহত
(জয়বাংলা প্রতিনিধি প্রেরিত)
গত ৮ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা রাজশাহীর তিন মাইল পশ্চিমে বেড়পাড়ায় দুইটি পাকিস্তানি সেনা বেসামরিক গাড়ির উপর আক্রমণ চালিয়ে দশ জন সৈন্য বাহী একটি গাড়ী উড়িয়ে দেন। এই আক্রমণে আরো পাঁচজন খানসেনা গুরুতর আহত হয়।
পরেরদিন বিপুল সংখ্যক সৈন্য আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত হয়ে উক্ত স্থানে আগমন করে আগের দিনের ঘটনার প্রতিশোধ নেওয়ার জন্য ক্ষিপ্ত কুকুরের মত বেড়পাড়ায় ২ এলাকার ঘরবাড়িতে যথেচ্ছভাবে অগ্নি সংযোগ ছাড়াও সাড়ে তিনশত নিরীহ-নিরস্ত্র নারী-পুরুষ-শিশু দিয়ে নির্বিচারে নির্মমভাবে হত্যা করে।
এখানে উল্লেখযোগ্য অনুরূপভাবে গত ২৪শে অক্টোবর খানসেনারা নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
সম্প্রতি মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা প্রেমতলির ফরহাদ পুরো ধ্বংস করলে বেইমান পাকিস্তানি পশুরা প্রতিশোধমূলক প্রেমতলী থেকে রাজবাড়ী পর্যন্ত এলাকার সাড়ে সাতশত নিরীহ-নিরস্ত্র নারী-পুরুষ শিশুকে নির্মমভাবে বেয়োনেটের দাঁড়া হত্যা করে।
দুইটি সামরিক ট্রেন ধ্বংস
গত ৫ই থেকে ৭ই নভেম্বর পর্যন্ত বাংলাদেশের রংপুর-দিনাজপুর মুক্তিবাহিনী একজন মেজর সহ বেশ কিছু সংখ্যক পাকিস্তানী সৈন্য করেছেন এবং একটি বিশেষ সামরিক ট্রেন ডিনামাইটের সাহায্যে ধ্বংস করে দিয়েছেন।
৭ই নভেম্বর রাতে অমরখানায় যখন পাকফৌজ একটি পরিখা খনন করছিল মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী বীর যোদ্ধারা তাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে পাঁচজন সেনাকে নিশ্চিহ্ন করে দেয়। মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ প্রতিহত করতে না পেরে অবশেষে পাকিস্তানি সৈন্যরা নিহত সঙ্গীদের ফেলে রেখে পালিয়ে যায়।
গত ৬ই নভেম্বরের বলর পাড়ার কাছে মুক্তিবাহিনীর পোতা মাইন বিস্ফোরণে একটি বিশেষ সামরিক উড়ে যায়। এর ফলে গাড়ির ইঞ্জিন ও পাঁচটি বগি লাইনচ্যুত হয়। এরপর মুক্তি বাহিনীর গুলিতে প্রায় ৫০ জন খান সেনা নিহত হয়।
ওই দিনেই মুক্তিযোদ্ধারা দুটি ফাঁড়ি আক্রমণ করে দখল করে। উক্ত স্থানে একজন খানসেনা ও ৪ জন রাজাকার খতম হয়। মুক্তিবাহিনী সেখান থেকে তিনটি রাইফেল একটি মেশিনগান ও কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।
বেইমানীর পুরস্কার
(জয় বাংলা প্রতিনিধি প্রেরিত)
ঢাকা, ১৫ই নভেম্বর। -তথাকথিত উপনির্বাচনের রাজশাহী থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত তথাকথিত একজন জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বাঙ্গালীদের সাথে বেইমানি পুরস্কার স্বরূপ মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কুকুরের মত হত্যা করেছে।
এই বিশ্বাসঘাতকের নাম মোঃ ইয়াসিন। সে বাঙালির দুশমন খুনি নুরুল আমিনের পিডিপি পার্টির একজন তথাকথিত নেতা। সম্প্রতি এই মীরজাফর তথাকথিত উপনির্বাচনে রাজশাহী থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দিতায় জয়যুক্ত হয়।
এখানে উল্লেখযোগ্য যে সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা তথাকথিত উপ নির্বাচনে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সুলতান উদ্দিন খান এবং চট্টগ্রাম থেকে উপনির্বাচন পদপ্রার্থী জনৈক কুখ্যাত দালাল কেও হত্যা করেন।
যশোরে খানসেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি
মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে যশোর জেলার প্রায় থানাতেই খানসেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
সাতক্ষীরার দক্ষিনে হরিনাথ অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধারা গভীরে ঢুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর ওপর আক্রমণ চালান। এই দুর্বার আক্রমণের মুখে খানসেনারা টিকতে না পেরে অবশেষে বিমানের সাহায্য নেয়।
টাঙ্গাইলের বিস্তীর্ণ এলাকা শত্রুমুক্ত
বীর মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড মারের চোটে খান সেনাদের ইতস্ততঃ পলায়ন
মুক্তিবাহিনীর দুঃসাহসিক’ গেরিলা যোদ্ধারা প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদেরকে সমগ্র টাঙ্গাইল জেলা থেকে বিতাড়িত করতে সক্ষম হয়েছেন। দুর্বার দুর্ধর্ষ গেরিলা যোদ্ধাদের বেপরোয়া মারের চোটে তুলাধোনা হয়ে হানাদারেরা প্রাণ বাঁচানোর জন্য টাংগাইল ছেরে এলোপাতাড়ি ছুড়তে থাকে। সঙ্গে সঙ্গে মুক্তিবাহিনী ক্ষিপ্রগতিতে মুক্ত এলাকায় প্রতিরক্ষামূলক অবস্থান নেয়।
মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের সংবাদ পরিবেশন করে আরো জানাচ্ছেন যে, বর্তমানে টাঙ্গাইলের মুক্ত অঞ্চল উত্তরে পাবনা জেলার রায়গঞ্জ থানা ও দক্ষিণে ঢাকা জেলার মানিকগঞ্জ পর্যন্ত বিস্তৃত।
ঢাকায় তিনটি বিদ্যুৎ জেনারেটর ধ্বংস
ঢাকায় গেরিলা যোদ্ধারা শহরের প্রধান বিদ্যুৎ স্টেশনের চারটির মধ্যে তিনটি জেনারেটর ধ্বংস করে দিয়েছেন। ফলে ঢাকা শহরের অধিকাংশ এলাকা গভীর অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে গিয়ে শত্রু চলাচলকে সম্পূর্ণভাবে স্তব্ধ করে দিয়েছে। এছাড়া শহরে পানি সরবরাহ বন্ধ এবং সমগ্র শিল্প-কারখানা অচল হয়ে গেছে। এখন একমাত্র শত্রু দখলীকৃত ক্যান্টনমেন্ট ছাড়া সমগ্র ঢাকা শহর ধরতে গেলে মুক্তি বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে।
দক্ষিণাঞ্চলে ব্যাপক তৎপরতা
বাংলাদেশের দক্ষিণ অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা খুবই তৎপর রয়েছেন। বীর গেরিলা যোদ্ধারা বিভিন্ন অঞ্চলের রেললাইন তুলে ফেলেছেন এবং টেলিযোগাযোগ ব্যবস্থা আক্রমণ চালিয়ে বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছেন। ফলে বাংলার দক্ষিণ ও উত্তর অঞ্চলের জেলাগুলোর মধ্যে ট্রেন চলাচল সম্পূর্ণ অচল হয়ে পড়েছে।
মুক্তিবাহিনীর যোদ্ধারা এখন দর্শনা ও আলিগঞ্জ এবং আলিগঞ্জ ও যশোর স্টেশনের মধ্যবর্তী রেললাইনের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছে।
ময়মনসিংহ আক্রমন অব্যাহত
গত ৬ই নভেম্বর ময়মনসিংহ জেলার ও তানতার অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী ও খান সেনাদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচণ্ড চাপ সহ্য করতে না পেরে হানাদাররা পিছু হাটতে থাকে এবং পরে উক্ত ২টি থানা এলাকা ছেড়ে যেতে বাধ্য হয়।
মুক্তিবাহিনীর সফল অভিযান
কুমিল্লায় গত মাসে আরও তিনশত খান সেনা নিহত
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত মাসের ১৬ই অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা কুমিল্লার হাজিগঞ্জ থানাধীন চিতোশিতে টহলদানরত খানসেনাদের ওপরে এক অতর্কিত আক্রমন চালিয়ে সাতজনকে বন্দী করেন। এছাড়া মুক্তিবাহিনী তিনটি রাইফেল ও ৫০ রাউন্ড গুলি দখল করেন।
গত ১৭ই অক্টোবর গেরিলা যোদ্ধারা ফরিদগঞ্জ থানাধীন চাঁদরাতে এক চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ১৩ জন হানাদারকে নিহত ও ১৭ জনকে মারাত্মকভাবে আহত করেন।গত ১৯শে অক্টোবর হাজিগঞ্জ থানার বলাখালের চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ৪ জন খান সেনা ও ১৬ জন রাজাকারকে খতম করেন। এই অভিযানে ১৩ জন হানাদার মারাত্মকভাবে আহত হয়। উক্ত দিন মুক্তিবাহিনীর অসমসাহসী যোদ্ধারা ফরিদগঞ্জে আরেকটি সফল আক্রমণ চালিয়ে পাঁচজন দস্যু সৈন্য এবং তাদের তাবেদার ২৮ জন রাজাকারকে নিশ্চিহ্ন করে দেন। এছাড়া ২৩ জন রাজাকার মারাত্মকভাবে আহত হয়।
গত ২৬শে অক্টোবর অত্রথানার সাহাপাড়ায় এক দুঃসাহসী আক্রমণ চালালে ১০ জন খানসেনা ও ৫ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রাণ হারায়। এই আক্রমণে আরো ২৫ জন রাজাকার আঘাতপ্রাপ্ত হয়।
গত ৩০শে অক্টোবর মুক্তিযোদ্ধারা বারাসাতে এক চোরাগুপ্তা আক্রমণ চালিয়ে চারজন রাজাকারকে খতম করেন। গত ২০শে অক্টোবর মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা সাহাপুরে এক দুঃসাহসিক অভিযান চালিয়ে আরো দুইজন হানাদারকে নিহত করেন।
গত ২রা নভেম্বর মুক্তিযোদ্ধারা সাহাপুরে শত্রু ঘাটির উপর আক্রমণ চালিয়ে তিনজন হানাদারকে খতম করেন।
৬রা নভেম্বর রামাহানপুর একজন কুখ্যাত পাকিস্তানি দালালকে মুক্তিযোদ্ধারা হত্যা করেন। চৌঠা নভেম্বর উক্তজেলায় মুক্তিযোদ্ধা আরো একজন দালালকে হত্যা করেন।