জয় বাংলা ১২ নভেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
প্রথম বর্ষ, ২৭শ সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার, ২৫ শে কার্তিক ১৩৭৮ ১২ই নভেম্বর ১৯৭১
বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে ইয়াহিয়া চক্র বিপাকে পড়েছে
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়ন মনি, বাঙালি জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্য নিয়ে জল্লাদ নায়ক ইয়াহিয়া খান নানা রূপ খেল খেলার প্রচেষ্টা চালিয়েছে। কিন্তু তার সকল প্রচেষ্টাই ব্যর্থ হয়েছে।
জল্লাদ ইয়াহিয়া প্রথমে শেখ মুজিবুর রহমান বেঁচে আছেন কি নেই অথবা বেঁচে থাকলেও নিরাপদ কিনা তার কোনো নিশ্চয়তা দিতে অস্বীকার করে। সে সাড়ে সাত কোটি মানুষের জননায়ক ক্রিমিনাল বলে অভিহিত করার ধৃষ্টতা দেখিয়েছে। তাকে ফাঁসি দেওয়ার হুমকি দিয়েছে। জল্লাদ নায়ক ইয়াহিয়ার এসবেরই উদ্দেশ্য ব্ল্যাকমেইল করা। অর্থাৎ বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করার ভয় দেখিয়ে বাঙালি জাতিকে স্বাধীনতার দাবি পরিত্যাগ করতে বাধ্য করা। কিন্তু আজকের বাঙালি জাতি যে ভিন্ন ধাতে গড়া তা ইয়াহিয়া দের জানা ছিল না। থাকলে বর্তমান বিশ্বের একজন অতি জনপ্রিয় নায়কের ভাগ্য নিয়ে তারা এমন ছিনিমিনি খেলতে পারত না।
তবে ধর্মের কল বাতাসে নড়ে। ইয়াহিয়া বাঙ্গালীদের দমন করতে গিয়ে যতগুলো ব্যবস্থা আজ পর্যন্ত নিয়েছে তার প্রতিটিই বাঙ্গালীদের পক্ষে গিয়েছে, বাঙালির জাতীয় ঐক্যকে অধিকতর সুদৃঢ় করে তুলেছে, তাদের মনোবল কে ইস্পাত কঠিন করে তুলেছে।
সর্বশেষে জল্লাদ নায়ক জানিয়েছে যে ‘দেশবাসী’ চাইলে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে তার কোন আপত্তি নাই। কিন্তু এই দেশবাসী কারা এবং তাদের অভিমতটাই বা তার জানার পদ্ধতি কি? দেশবাসী বলতে যদি ইয়াহিয়া তথাকথিত পাকিস্তানে সাড়ে ১২ কোটি অধিবাসীকে বুঝিয়ে থাকেন তাহলে সে ভুল করেছে। কেননা, ২৫শে মার্চের পর সে পাকিস্তান জাতি আর নাই। সে পাকিস্তান মৃত, ইতিহাসের বিষয়। কেননা, বাঙালি জাতি আজ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ আজ স্বাধীন ও সার্বভৌম। সুতরাং জেনারেল ইয়াহিয়া খান যদি দেশবাসী বলতে বাঙালি জাতিকে বুঝিয়ে থাকে তাহলে তার জানা উচিত যে বাঙালি জাতির শতকরা ৯২টি ভোট দিয়ে তাকে তাদের পক্ষে কথা বলার একমাত্র মুখপাত্র বানিয়ে দিয়েছে গত ডিসেম্বরে। তারা তাকে পর দেশের বন্দীখানায় থাকার জন্য ভোট দেয়নি, দিয়েছিলেন মুক্ত মানুষ হিসেবে তাদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণ করতে, তাদের জীবনের সুখ আনতে, তাদের মুখে হাসি ফোটাতে।
আর পশ্চিম পাকিস্তানের অধিবাসীদের অভিমত বলতে তা ৮ জেনারেলের অভিমতকেই বোঝায়। ইয়াহিয়া খান যদি তা অস্বীকার করতে চায় তাহলে তাকে সে দেশে এ প্রশ্নে গণভোট নিতে হয়। কিন্তু ইয়াহিয়া নিশ্চয়ই তা চায় না। তাহলে তাকে সে দেশের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন লোকদের অভিমতের উপর নির্ভর করতে হবে।
এদিক দিয়ে বিচার করলে তারা ইতিমধ্যেই বঙ্গবন্ধুর আশু মুক্তির দাবি জানিয়েছেন। সীমান্ত গান্ধী খান আবদুল গাফফার খান, তাঁর পুত্র সীমান্ত বেলুচিস্তানের জনপ্রিয় নেতা খান আব্দুল আলী খান বঙ্গবন্ধুর গ্রেফতারের তীব্র নিন্দা করে বহু আগেই তার মুক্তি দাবি করেছেন।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, তাহরিখে, ইস্তেকলাল পার্টির নেতা ও সাবেক বিমান বাহিনীর প্রধান এয়ার মার্শাল আজগর খান, লেনিন শান্তি পুরস্কার প্রাপ্ত কবি ফয়েজ আহমেদ ফয়েজ সহ ৪৫ জন পশ্চিম পাকিস্তানের শুভবুদ্ধি সম্পন্ন লোক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তি দাবি করেছেন। এই ৪৫ জনের মধ্যে রয়েছেন পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট রাজনৈতিক ট্রেড ইউনিয়ন ও ছাত্রনেতা, আইনজীবী, সাংবাদিক, লেখক।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল ইয়াহিয়া খানের কাছে এক আবেদনের তারা দাবি করেছেন যে, হয় শেখ মুজিবকে ছেড়ে দেওয়া হোক, না হয় সাধারন আদালতে তার বিচারের ব্যবস্থা করা হোক।
তারা নিজেদের আবেদনে ইয়াহিয়াকে বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে তার মন্তব্যের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। তাদের ইয়াহিয়া বলেছে যে জাতি ‘চাইলে সে মুজিবকে মুক্তি দিবে।’ দেখা যাক ইয়াহিয়া খান এবার কি করে বা বলে।
দালাল খতম
ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে খোদ ঢাকা শহরে মুজিব বাহিনীর তৎপরতা আশাতীতভাবে বেড়ে গেছে। ফলে পাক দালালরা তো বটেই সৈন্যরাও ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে উঠেছে। মুজিব বাহিনীর গেরিলারা নভেম্বর মাসের ১লা থেকে ৭ তারিখের মধ্যে মোট ২৩ জন দালালকে হত্যা করেছেন। তার মধ্যে বিনা প্রতিদ্বন্ধিতায় নির্বাচিত একজন তথাকথিত পরিষদ সদস্য রয়েছে। তার নাম সুলতান উদ্দিন খান। এই দালাল একজন মুসলিম লীগ পন্থী, তাকে নারায়ণগঞ্জ থেকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত করা হয়েছে। তাকে প্রকাশ্য দিবালোকে ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রাস্তায় চাষাঢ়ায় গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তার সাথে খুলনার কুখ্যাত সবুর খানের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত আমির হোসেনকেও হত্যা করা হয়েছে। তাদের সাথে অপর এক দালাল আহত হয়েছে। রেডিও পাকিস্তানের খবর মতে পাঞ্জাবি সামরিক শাসক চক্র ও তাদের দালাল পুলিশ রাজাকাররা এখনো পর্যন্ত হত্যাকারীদের কোন সন্ধান করতে পারেনি।
এর আগে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা আইয়ুবের গর্ধব কুখ্যাত মোমেনকে স্টেনগানের গুলিতে হত্যা করে এবং পড়ে গোরস্থান থেকে তুলে নিয়ে নদীতে নিক্ষেপ করে। দালালদের মনে যে ত্রাসের সঞ্চার করেছে তারা এখনও তা কাটিয়ে উঠতে পারেনি।
এছাড়া গেরিলারা কাইয়ুম খান পন্থী কনভেনশন লীগের সাধারণ সম্পাদক আবদুস সবুর খানের ঢাকাস্থ বাসভবনের গত ৪ঠা নভেম্বর বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। দালাল সবুর অল্পের জন্য প্রাণে বেঁচে গিয়েছে। তবে ওয়াকেফহাল মহলের ধারণা সবুর খানের দিন শেষ হয়ে এসেছে।
এছাড়া গেরিলারা চৌঠা নভেম্বর নৌবাহিনী একজন পদস্থ অফিসার পুত্রকে মেশিনগানের গুলিতে নিহত করেছে। তার পত্নী এবং একটি শিশু সন্তান আহত হয়েছে। গেরিলারা আলোচ্য অফিসারের বাসগৃহে মেশিনগানের গুলি চালায়।
উক্ত অফিসার ও তার এক পুত্র বাঙালি হয়েও নগ্নভাবে পশ্চিমাদের দালালি করছিল।
একই দিনে গেরিলারা ঢাকার একটি বিশেষ এলাকায় তিনজন দোকানদারকে গুলি করে হত্যা করেছে। এরা জোর করে বাঙ্গালীদের এই দোকানগুলো ভোগ দখল করেছিল।
এতো গেল দালাল হালাল করার দিক। অন্যদিকে গেরিলারা ঢাকা নারায়ণগঞ্জ রেল যোগাযোগ বানচাল করে দিয়েছে। তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়েও একটা বোমা বিস্ফোরণ ঘটায়। ফলে দালালদের যে ২-৪ জন সন্তান বিশ্ববিদ্যালয়ে আসত তারাও এখন আসা বন্ধ করে দিয়েছে। তার আগে গেরিলারা ঢাকা শহরের কাছে একখানা নৌকা ডুবিয়ে দিয়ে পাঁচ জনকে হত্যা ও দু’চারজনকে আহত করেছে। সেনোরা তেজগাঁও থেকে বেরইল হয়ে নৌকা যোগে ঢাকায় আসছিল।
ঢাকা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করে দেওয়া তো নিত্য নৈমিত্তিক ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। গেরিলারা প্রায়ই ডেমড়া ও কাঞ্চনের বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র অচল করে দেন।
অন্যদিকে সামরিক বাহিনী ও পুলিশ বাহিনীর বিক্ষোভ ও এতদিনে দাগ বেধে উঠেছে। প্রকাশ, বাংলাদেশের ‘কাফের নিধনের’ জন্য পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আনা পুলিশবাহিনী বাড়ি ফেরার জন্য অস্থির হয়ে উঠেছে। তারা নাকি একটা নির্দিষ্ট সময়ের মধ্যে দেশে ফেরত না পাঠালে বিদ্রোহের হুমকি দিয়েছে।
একটি বিদেশী সংবাদ সরবরাহ সংস্থার প্রতিনিধি এ প্রশ্ন পুলিশের ইন্সপেক্টর জেনারেলকে জিজ্ঞেস করলে তিনি বিদ্রোহের কথা অস্বীকার করলেও নির্দিষ্ট ছয় মাসের সময়সীমা উত্তীর্ণ হওয়ার পর পুলিশরা ঘরে ফিরতে উদগ্রীব বলে জানিয়েছেন।
আবার ঝড়ঃ প্রধানমন্ত্রীর বাণী
১৯৭০ সালের ১১ই নভেম্বরের প্রলয়ংকারী ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের ক্ষতচিহ্নের দাগ না শুকাতেই একই অঞ্চল দিয়ে পুনরায় প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটে গেল। বাংলাদেশের উপকূলবর্তী এলাকায় চট্টগ্রাম-কক্সবাজার, নোয়াখালী এবং দ্বীপাঞ্চলের কুতুবদিয়া-মহেশখালী উপর দিয়ে বিভীষিকার কাল রাত নেমে এসেছিল।
গত ৬ই নভেম্বর বাংলাদেশের সমুদ্র উপকূলবর্তী এলাকায় প্রবল ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের দরুন বহু লোকের মৃত্যু ও বিপুল সম্পত্তি বিনাশ হয়েছে।
কক্সবাজারের দক্ষিণ অঞ্চল এবং চট্টগ্রামের উত্তরাঞ্চলো যথেষ্ট ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
নোয়াখালী জেলার রামগতি ও হাতিয়া দ্বীপের সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
মহেশখালী-কুতুবদিয়া ও কলম্পুরচর ও ঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।
ঘন্টায় ১০০ মাইলের বেশি বেগে ঘূর্ণিঝড় বয়ে যাওয়ার ফলে বহু ঘরবাড়ি ধ্বংস হয়ে গেছে। বিদ্যুৎ ও টেলিফোন এর তার ছিড়ে পড়ে গেছে।
গত বছর এই সব অঞ্চলেই ঘূর্ণিঝড় ও জলোচ্ছ্বাসের দরুন ৬ লক্ষ লোকের মৃত্যু ঘটে।
প্রধানমন্ত্রীর সমবেদনা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রী, জনা তাজউদ্দিন আহমেদ দেশবাসীর উদ্দেশে এক বিবৃতিতে বলেন, কুতুবদিয়া, মহেশখালী, কক্সবাজার এবং বাংলাদেশের উপকূল অঞ্চলে ঘূর্ণিঝড়ে আমি অত্যন্ত মর্মাহত। ১৯৭০ সালের ঘূর্ণিঝড়ের তাণ্ডবের পর পাক বাহিনীর অত্যাচারে জনগণ জর্জরিত হয়েছেন। এখন এসব অঞ্চলেই আমার ভাইয়েরা নতুন এক বিপর্যয়ের মুখে পড়লেন। শোকসন্তপ্ত পরিবারবর্গের এবং প্রাকৃতিক বিপর্যয় ক্ষতিগ্রস্ত মানুষদের প্রতি আন্তরিক সহানুভূতি জানাচ্ছি। আমাদের জনগণ ধৈর্য এবং সহিষ্ণুতা দিয়ে এই বিপর্যয়ের মোকাবিলা করার শক্তি অর্জনে সক্ষম হবেন। এইসব অঞ্চলের জনগণকে অবিলম্বে সাহায্য দেবার জন্য বাংলাদেশের সমাজসেবী এবং স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা গুলির কাছে আমি আবেদন জানাচ্ছি।
জাতিকে যতক্ষণ ভারতবিরোধী রাখা যায় ততক্ষণই কেবল ইয়াহিয়া নিরাপদ
তাই সারাদেশে তার এই রণোন্মদনা
উইলিয়াম স্পেনসার একজন ফ্রিল্যান্সার সাংবাদিক। তিনি পেন্টহাউস ম্যাগাজিনের অন্যতম সম্পাদক এবং লন্ডনের অবজারভার পত্রিকায় একজন নিয়মিত লেখক।
মিস্টার উইলিয়াম স্পন্সর সম্প্রতি পাক-ভারত সফর করেছেন। আলোচনায় তিনি পাকিস্তানে যে উন্মাদনা দেখেছেন তার একটা চিত্র তুলে ধরেছেন।
মিস্টার স্পন্সর লিখেছেনঃ “ট্রেনে পশ্চিম পাকিস্তান সফরকারী যে কোন বিদেশী সাংবাদিকের মনে এই ধারণা জন্মাবে যে ভারতের সাথে পাকিস্তানের যেকোনো মুহূর্তে একটা যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। পাকিস্তানে যে পুরোপুরি যুদ্ধ প্রস্তুতি চলছে তাতে কোন সন্দেহ আছে বলে প্রতীয়মান হয় না। কেননা পাকিস্তানের যুদ্ধ প্রস্তুতি আলামত সর্বত্র বিরাজিত।”
তিনি লিখেছেন,”কোয়েটা থেকে লাহোর পর্যন্ত প্রতিটি স্টেশনে আমি অস্ত্রসজ্জিত সৈন্য, কামান, ট্যাংক, ট্রাক, জীপ ও গোলাবারুদ ভর্তি সীমান্তের দিকে যেতে দেখেছি।
লাহোরে ভাগ্যত: স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হওয়ার চিহ্ন কম দেখা গেলেও শহরের সমস্ত প্রাচীর গাত্রে ‘ভারতকে খতম কর” প্রভৃতি ধরনের লেখার ছড়াছড়ি দেখা যায়। এগুলো যে মানুষের স্বতঃস্ফূর্ত অভিব্যক্তির প্রকাশ নয় এবং সরকার নিয়ন্ত্রিত লোকদের কাজ তা বুঝতে কোন কষ্ট হয়না।
সাংবাদিক স্পেন্সার লিখেছেন,”আফগানিস্তান থেকে ভারত ভ্রমনের পথে আমি বেশ কিছুসংখ্যক পাকিস্তানের সাথে কথাবার্তা বলেছে তাদের মনোভাব জানার জন্য। যাদের সাথে আমি কথা বলেছি তাদের মধ্যে পদস্থ সরকারি কর্মচারী, আর্মি অফিসারগণ, কমিশন অফিসার ও অসামরিক সাধারণ লোক রয়েছেন। পাকিস্তানের মত একটা দেশে যেখানে করা সামরিক শাসন জারি রয়েছে, সংবাদপত্রের কোন ও স্বাধীনতা নাই, সে দেশে একজন বিদেশীর সাথে প্রাণখুলে ট্রেনে কথা বলা দুঃসাহসের কাজ। তাই তাদের, সত্যিকারের মনোভাব জানা কার পক্ষেই সম্ভব নয়।
‘পাকিস্তান সীমান্তের সামনে পা দিয়ে আমি বুঝতে পারি যে পাকিস্তানে কিছু একটা ঘটছে। সেখানে একজন কাস্টম অফিসার আমাকে জানান যে আমার পক্ষে ভারত পর্যন্ত পৌঁছানো হয়তো সম্ভব হবে না। কেননা, ভারতের সাথে পাকিস্তানের যুদ্ধ চলছে।
তার কথাটা আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না। কারন, এমন কিছু তার আগে আমি কোথাও শুনতে পাইনি। কিন্তু লোকটি আমাকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে তিনি যা বলছেন তা সত্য, এবং তারপর তিনি ভারতের বিরুদ্ধে এক দফা বিষেদাগার করে নিলেন। সর্বশেষে কাস্টম অফিসার আমাকে তারে দৃপ্ত বিশ্বাসের কথা জানিয়ে দিলেন যে এ যুদ্ধে পাকিস্তান গৌরব উজ্জ্বল বিজয়ের অধিকারী হবেই।
পরবর্তী অভিজ্ঞতার আলোকে আমি একথা বিশ্বাস করতে বাধ্য হয়েছি যে কাস্টম অফিসার আমাকে যা বলেছেন তা একেবারে মিথ্যা নয়। ধামন থেকে কোয়েটা আগমন করি আমি ট্রেনে। পথিমধ্যে প্রায় সব জায়গাতেই রেলপথের ওপর প্রতিবন্ধকতা দেখতে পাই। আর তার পাশে দাঁড়িয়ে থাকে দেখি সংগীন উঁচু করে সৈন্য ও পুলিশদের। তারা বেওনেট উঁচু করে এসে আমাদের গাড়ি তল্লাশি করে। এটা সামরিক শাসনের আরেকটা দিক।
সাধারণভাবে বলতে গেলে পাকিস্তান এমন একটা দেশ যেখানে জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে সামরিক বাহিনীর উপস্থিতি লক্ষণীয়। ভারতের অবস্থা তেমনটি নয়। ট্রেনে বাসে সৈন্যদের উপস্থিতি, প্ল্যাটফর্ম সমূহে সুসজ্জিত সৈন্যদের অবস্থান ছাড়াও সর্বত্র দেখা যাবে কাঁটাতারের বেড়ায় এবং অস্ত্র গুদাম সমুহ।
আমি যে সব পুলিশ অফিসার ও সৈনিকদের সাথে কথা বলেছি তাদের অনেকেই কি ঘটছে না ঘটছে তার কিছুই জানেন না বলে মনে হল। তবে তাদের সবাইকে বিদেশিদের কাছ থেকে সহানুভূতি আদায়ের কোশেশ করতে দেখা গেছে।
ভারতীয় সীমান্তের কাছাকাছি এলাকায় বহু অগণিত পাকিস্তানীর সাথে আমার কথা হয়েছে। তাদের সবাই আমাকে একথাই বুঝাতে চেয়েছে পাকিস্তানের মত একটা বেহেশত থাকতে আমি কেন ভারতের মতো একটা নরকের যাচ্ছি। এদের কেউ কেউ কথাটা রহস্য করে বললেও অনেকেই তাদেরকে ভারত সম্পর্কে যা বোঝানো হয়েছে তাতে আন্তরিকভাবে বিশ্বাস করেই একথা বলেছেন। তাদেরকে সরকারের তরফ থেকে এ কথাই বোঝানো হয়েছে যে ‘ভারত একটা নগ্ন আক্রমনকারী’ এবং তারা তাতে মনেপ্রাণে বিশ্বাস স্থাপন করেছেন।
প্রথম সুযোগেই আমি পাকিস্তানের হাল-হকিকত সম্পর্কে অবহিত হওয়ার জন্য লাহোরের দৈনিক ‘পাকিস্তান টাইমস’ পত্রিকার একটা কপি করি। কিন্তু তাতে আমি যা চেয়েছিলাম তার কিছুই পেলাম না। কাগজে পড়ে কথায় মনে হল যে ভারতের বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ উন্মাদনা সৃষ্টির কাগজ বেশ এগিয়ে চলেছে। কাগজ খানার প্রথম পৃষ্ঠা ব্যাপী যে সমস্ত কল্পিত কাহিনী ছাপা হয়েছে বাস্তবের সাথে গুলোর কোনও সম্পর্ক নেই।
এগুলোর মধ্যে একটা সংবাদে দাবি করা হয়েছে যে পাকিস্তানের অভ্যন্তরে অনুপ্রবেশকারী ৭১৪ জন ভারতীয় এজেন্টকে খতম করা হয়েছে।
পাকিস্তানের রণোন্মত্ততা দেখে একথা বলা চলে যে দু’দেশের মধ্যে যে কোন সময় একটা যুদ্ধ বেঁধে যেতে পারে। বিশেষ করে কাশ্মীর সমস্যার উপর পাকিস্তান যেভাবে জোর দিয়েছে তাদের কথা চিন্তা করা আরও সহজ হয়ে ওঠে।”
উপসংহারে সাংবাদিক স্পন্সার বলেন, সবকিছু বিশ্লেষণের পর আমি বিশ্বাস করতে পারি না যে পাকিস্তান ভারতের সাথে কেন যুদ্ধ করতে প্রস্তুত। কেননা পাকিস্তান আজ যেভাবে সমস্যায় জড়িয়ে পড়েছে-যা অনেক পাকিস্তানিই আমার কাছে স্বীকার করেছেন-যে যুদ্ধ বাধলে পাকিস্তান সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে পড়বে। বরং অবস্থাদৃষ্টে আমার এই প্রতিতী জন্মেছে যে, ইয়াহিয়া খান যে জটিল সমস্যার সৃষ্টি করেছেন তার থেকে জনগণের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করার জন্যই তিনি যুদ্ধোন্মত্ততার পথ বেছে নিয়েছেন।
মোটকথা পাকিস্তানিদের যতক্ষণ পর্যন্ত ভারতের বিরুদ্ধে উত্তেজিত করে রাখা যায় ততক্ষণই ইয়াহিয়া নিরাপদ। তাই তার এ ব্যবস্থা।”
পাবনায় ৪৫ জন দালাল খতম
পাবনা, ৯ই নভেম্বর-সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী, সুজানগর, সাগরকান্দি, খলিলপুর, বেড়া, কাশিনাথপুর, সাথিয়া, গোয়ালবাড়ি, শিবরামপুর, দুলাই, সাতবাড়িয়া, নাজিরগঞ্জ প্রভৃতি এলাকায় প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ৪৫ জন কুখ্যাত রাজাকার ও দালালকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। এসব এলাকায় সম্প্রতি এই সব বেইমানরা এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মুক্তিবাহিনীর সফল অভিযানের পর গ্রামবাসী স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছেন।
শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান নিহত
গত ৭ই নভেম্বর মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের সোনাকান্দার তথাকথিত শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান হাজী সাহেব আলীকে গুলি করে হত্যা করেছেন। একদিন একজন এমপিএ সহ ১১ জনকে প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা গুলি করে হত্যা করেছেন।
মোহাম্মদ আলীর ডাণ্ডাগুলীর রাজনীতি!
ছোট একটি খবর। খবরটা প্রচার করেছে তথাকথিত পাকিস্তানের একটি সংবাদ সরবরাহ সংস্থা। তাদের বলা হয়েছে যে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে পাকিস্তান প্রতিনিধি দলের নেতা সিলেটের রাজনৈতিক এতিম মাহমুদ আলী পিন্ডিতে তার মনিব জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খানের সাথে সাক্ষাত করেছেন এবং তাকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগদান কারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধি দলের সাথে মাহমুদ আলীদের যে আলোচনা হয়েছে তা জানিয়েছেন। সংবাদে একথাও বলা হয়েছে যে ইয়াহিয়া খানের সাথে বংশবদ মাহমুদ আলীর বৈঠক ১০ মিনিটকাল স্থায়ী হয়েছে।
জাতিসংঘের কোন বাঙালিকে পাকিস্তানি প্রতিনিধি দলের নেতা নিযুক্তি এই প্রথম। বাংলাদেশে অনেক উপযুক্ত লোক থাকতেও কোনদিন পিন্ডির পাকিস্তান ওয়ালারা জাতিসংঘে প্রতিনিধি দলের নেতা হিসেবে বাঙালিকে পাঠানোর কথা চিন্তাও করতে পারেনি। কারণ তাতে পাকিস্তানে যে বাংলাদেশ বলেও একটি অংশ আছে তা ধরা পড়ে যাবার সম্ভাবনা ছিল। তাছাড়া ইসলাম ও দ্বিজাতিতত্ত্বের নামে অর্জিত পাকিস্তান তো ছিল পাঞ্জাবি কায়েমী স্বার্থবাদীদের বাপ-দাদার খাস তালুক পাকিস্তানের মৃত্যুর পর হলেও পিন্ডি ওয়ালারা কুলাঙ্গার হলেও একজন বাঙালিকে জাতিসংঘে নেতা করে পাঠিয়েছে। বাঙালি ও বাংলাদেশের সাথে মাহমুদ আলী দের বাড়িওয়ালাদের পাকিস্তানের আজ আর কোন সম্পর্ক না থাকলেও মীরজাফর আলী তো অন্তত: মৃত্যুর আগে একবার ওজারতির তেজারতি করে নিতে পারল।
আমাদের কথা সেখানে নয়। নিজেদের মনোরঞ্জনের জন্য ইয়াহিয়া খানরা মাহমুদ আলী দের মত লোকদের দিয়ে যা খুশি তা করে নিতে পারে। তারা এদের দিয়ে জাতিসংঘের নাচের অনুষ্ঠানও করে নিতে পারে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মধ্যে মাহমুদ আলী দের মত দু’চারজন নাচনে ওয়ালা থাকবে তাতে আশ্চর্য কি! কিন্তু প্রশ্নটা হল জাতিসংঘ অধিবেশনে এবার ১৩০টি দেশের প্রতিনিধি দল যোগ দিয়েছেন। ইয়াহিয়া খানের বাপ-দাদার খাসতালুক -তথাকথিত পাকিস্তান আজ এক মহা সংকটে নিপতিত। বাংলাদেশের মানুষের মুক্তি পদদলিত করতে গিয়ে তারা আজ গেরাকলে আটকে পড়েছে। ফাটা বাঁশে আটকে দিয়ে তারা আজ মরণ চিৎকারে কন্ঠ ফাটিয়ে ফেলছে। তাই তাদের এই প্রাণান্তকর অবস্থা থেকে রক্ষা করার উপায় বের করার জন্য মাহমুদ আলী নিশ্চয়ই ১৩০টি না হোক, অন্তত: ১০০ টি প্রতিনিধি দলের সাথে কথা বলেছে। তাদের কথা শুনেছে। এদের মধ্যে কেউ হয়তো ইয়াহিয়া দের পক্ষে বলেছেন আবার অনেকে বিপক্ষে বলেছেন। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে মাহবুব আলী কি করে মাত্র ১০ মিনিট সময়ের মধ্যে তার মনিবকে সমস্ত আলাপ আলোচনার বিষয়, সমস্ত প্রতিনিধি দলের পক্ষ বিপক্ষের বক্তব্য বলে ফেলতে পারল? তবে কি শুধুমাত্র মোহাম্মদ আলীর ‘চেহারা মোবারক’ দর্শনের জন্য বাদশা ইয়াহিয়া তাকে রাজদরবারে ডেকে এনেছে? আসল রিপোর্টটা ইয়াহিয়া কি প্রতিনিধিদলে তার গোয়েন্দা আগাশাহীর কাছ থেকেই নিয়েছে?
হয়তোবা অবস্থাটা এমন ও হতে পারে যে , মাহমুদ আলীর বলার মত তেমন কিছুই ছিল না। কেননা, জাতিসংঘের তারা যাদের সাথে দেখা করেছেন তাদের সবাই মাহমুদ আলীদের একই জবাব দিয়ে দিয়েছেন। এককথায় তাদের বক্তব্য নাকচ করে দিয়েছেন। তাই মাহমুদ আলীকেও মাত্র এক কথাতেই মনিবের কাছে রিপোর্ট শেষ করতে হয়েছে-‘কেউ আমাদের কথা শোনে না।’
প্রবাসী বাঙ্গালীদের প্রতি আওয়ামী লীগের অভিনন্দন
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এবং আন্তর্জাতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে দীর্ঘ আলোচনার পর গত বৃহস্পতিবার আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠক সমাপ্ত হয়-এই সভায় ৪২ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। আওয়ামী লীগের অস্থায়ী সভাপতি এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভায় সভাপতিত্ব করেন।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গৃহীত প্রস্তাবে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বসবাসকারী যেসব বাঙালি বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জানিয়েছেন এবং মুক্তিসংগ্রামকে সক্রিয়ভাবে সাহায্য ও সহযোগিতা করছেন তাদেরকে অভিনন্দন জানানো হয় এবং তাদের কাছ থেকে আরও ব্যাপক সক্রিয় সাহায্য কামনা করা হয়। অভের প্রস্তাবে বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চল এবং দখলীকৃত এলাকার জনগণ চরম নির্যাতনের মুখে ও জাতি ধর্ম ও দলমত নির্বিশেষে সকল ভেদাভেদ ভুলে ঐক্যবদ্ধ রেখে পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য যে বিরামহীন সংগ্রাম করছেন তার জন্য তাদের সংগ্রামী অভিনন্দন জানানো হয়। ভবিষ্যতে শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হেনে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে আরও ব্যাপক প্রস্তুতি গ্রহণের জন্য তাদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।
মিথ্যা
আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা নিউইয়র্ক টাইমস-এর সংবাদদাতা ম্যালকম ডব্লিউ ব্রাউন তার পত্রিকায় লিখেছেন, পূর্ববঙ্গের শহর ও গ্রাম গুলির উপর ভারতীয় সেনাদের গোলাবর্ষণ সম্পর্কে পাক কর্তৃপক্ষ প্রায়ই প্রতিবাদ জানিয়ে থাকেন। সম্প্রতি তিনি ‘পূর্ব বাংলার’কোন একটি গ্রামের খবর সংগ্রহ করতে যান। তিনি সেখানে একটি বিধ্বস্ত বাড়ি লক্ষ্য করেন। এই বাড়িটিতে ২ ইঞ্চি মর্টারের গোলার আঘাতের চিহ্ন দেখতে পান। ব্রাউন বলেছেন, দু ইঞ্চি মর্টারের গোলার পাল্লা খুব বেশি নয়। সীমান্তের ওপার থেকে এসব গোলা ছোড়া হয়ে থাকলে, তা কখনো বাড়িটির ক্ষতিসাধন করতে পারত না। এমনকি তার ধারে কাছেও আসতে পারত না।
উথান্ট কি নিজে জাতিসংঘের মর্যাদা রক্ষা করতে পারবেন?
গত রোববার জাতিসংঘ সনদের ২৬তম বার্ষিকী উদযাপিত হয়েছে। এ উপলক্ষে এক বাণীতে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল মন্তব্য করেছেন যে, জাতিসংঘ প্রত্যাশা পূরণ করতে পারেনি। গত বছর এই দিনে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বিশ্ব পরিস্থিতি আলোচনা করে জাতিসংঘের ভূমিকা ও বিশ্বের বিভিন্ন শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের পরিপ্রেক্ষিতে বিশ্বের পরিস্থিতি সম্পর্কে নিরাশার চিত্র তুলে ধরেছিলেন।
কিন্তু যে উদ্দেশ্য নিয়ে জাতিসংঘের পতন হয়েছিল, জাতিসংঘ সনদ রচিত হয়েছিল সেই বাঞ্ছিত অপ্রত্যাশিত লক্ষ্য অর্জনে জাতিসংঘ ব্যর্থ হল কেন? দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের ফলে প্রায় দুই কোটি মানুষের লাশের উপরে জন্ম নিয়েছিলো জাতিসংঘ। যুদ্ধের পরাধীনতার, ক্ষুধার, দারিদ্রের এবং মত প্রকাশের অধিকার হারাবার ভীতি থেকে দুনিয়ার মানুষকে মুক্তি দানের জন্য জাতিসংঘ সনদের মানুষের মৌলিক অধিকারের নীতি ঘোষিত হয়েছিল। কিন্তু এই মানবাধিকারের সনদ ঘোষণার দীর্ঘ ২৬ বছর পরেও বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার পদদলিত ও লাঞ্চিত হচ্ছে।
দক্ষিণ আফ্রিকার শার্প ভিলের কালো মানুষদের হত্যাকান্ডের হলে আর কিছু না হোক ওই কলঙ্কিত দিনটি জাতিসংঘের সকল সদস্য রাষ্ট্রে প্রতি বছর মানবাধিকার দিবস হিসেবে উদযাপিত হয়ে আসছে। কিন্তু বাংলাদেশের ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা একটি-দুটি নয় শত শত ‘শার্পভিলের হত্যাকাণ্ড’ ঘটিয়েছে। কিন্তু জাতিসংঘের কর্মকর্তাদের তাতে তেমন বিচলিত হতে দেখা যায়নি। কখনো কখনো দু-একটি অর্ধমৃত বিবেকের নির্জীব সরকারি কন্ঠ ক্ষীণ সুরে ধ্বনিত হয়েছে মাত্র। জাতিসংঘের মানবাধিকার সম্পর্কিত সনদ বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার জঙ্গিশাহীর গণহত্যার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, তাদের হৃদয়ে কোন দাগ কাটতে পারেনি।
আজ যখন বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা সেঊ জল্লাদকে হত্যা করে মানুষের শ্বাশত অধিকারকে প্রতিষ্ঠা করতে চলেছে তখন তারা ভারত পাকিস্তানের মধ্যে সশস্ত্র সংঘাতের সম্ভাবনার নামে হঠাৎ করে উদ্বিগ্ন হয়ে পড়েছেন। স্পষ্টতঃ তাদের এই উদ্যোগ হত্যাকারীকে প্রশ্রয় দানের নামান্তর। আসলে জাতিসংঘের বিতর্ক মঞ্চ বৃহৎ শক্তিবর্গের ক্ষমতা দ্বন্দের এবং তার নিজস্ব প্রভাব বলয়ের পরিসর বৃদ্ধির ক্ষেত্রে পরিণত হয়েছে এবং মানবাধিকার লঙ্ঘন প্রতিষ্ঠার দায়িত্ব নিক্ষিপ্ত হয়েছে আস্তাকুঁড়ের আবর্জনায়। কাজেই বাংলাদেশ সমস্যা কে কেন্দ্র করে উদ্ভূত পরিস্থিতি সম্পর্কে কোন কথা বলার অধিকার কি সত্যিই তাদের আছে?
এত সাহস পায় কোথায়?
পাগলা কুকুর কোণঠাসা হয়ে পড়লে সামনে যত লোক পাওয়ার সবাইকে কামড়াতে উদ্যত হয়। কিন্তু প্রতিটা লোক একটা করে বাড়ি দিলে বা ঢিল ছুড়লে তার নিজের কী অবস্থা দাঁড়াবে তা ভাবার মতো মানসিক অবস্থা পাগলা কুকুরের থাকেনা। পাকিস্তানের সামরিক জান্তার অবস্থাও তাই হয়েছে। যে লোক বা দেশ বাংলাদেশের সংঘটিত গণহত্যার ব্যাপারে সত্য কথা বলেন (অবশ্য এ ব্যাপারে সত্য কথা বললেই তা পাকিস্তানে জঙ্গি চক্রের বিরুদ্ধে যায়) তারা তার বিরুদ্ধেই ঝাঁপিয়ে পড়ে। তারা এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে অপদস্থ করেছে যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী ও জনপ্রিয় সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডিকে, তারা গালিগালাজ করেছে জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উ থান্টকে(অবশ্য পরে নিজেদের দিকে মত ঘুরিয়ে দেয়ায় তারা ও উ থান্টকে বর্তমানে প্রশংসা করছে)। তাদের পাগলা কুকুর সুলভ আচরণ এর সর্বশেষ নজির ছবি বিমান বাহিনী প্রধান এয়ার মার্শাল পিএস কোতাকোভকে পাকিস্তান ভূখণ্ডের উপর দিয়ে বিমান চালনা করে ভারতে আসতে না দেয়া।
প্রকাশ, এয়ার মার্শাল কোতাকোভ নয়াদিল্লি গমনের জন্য পাকিস্তানের উপর দিয়ে বিমান চালিয়ে যাবার অনুমতি চান। কিন্তু পাকিস্তান সরকার তা নামঞ্জুর করেন। ফলে সোভিয়েত বিমান বাহিনীর প্রধান কে ইরান হয়ে ঘুরে ভারতে আসতে হয়। এতে তার সময় লেগেছিল ১৬ ঘন্টা। আর পাকিস্তানের উপর দিয়ে আসলে তার সময় লাগতো ৮ ঘন্টা।
সোভিয়েত ইউনিয়নের প্রতি পাকিস্তানের জঙ্গির শাসকদের এই মনোভাবের কারণ কি? কারণ অবশ্য সবারই জানা। সোভিয়েত ইউনিয়ন বাংলাদেশ প্রশ্নে যে মনোভাব নিয়েছেন তা পাকিস্তানের শাসকদের স্বার্থের অনুকূল নয়। সোভিয়েত ইউনিয়নেই সর্বপ্রথম বাংলাদেশের সংঘটিত গণহত্যার বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলেন। বাংলাদেশে গণহত্যা শুরু হয় ২৫ শে মার্চ রাতে। আর সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাস পদগর্নি চৌঠা এপ্রিল এক পত্র পাঠিয়ে হিটলারের প্রেতাত্মা ইয়াহিয়া খানকে তা বন্ধ করতে বলেন। তারপর গঙ্গা-যমুনা, পদ্মা-মেঘনায় অনেক পানি গড়িয়েছে। মুক্তিবাহিনী জল্লাদ বাহিনীকে রুখে দাঁড়িয়েছেন, তাদের সমুচিত শিক্ষা দেবার জন্য প্রস্তুতি নিয়েছেন। দুনিয়ার অনেক দেশ নানা ছলে বাংলাদেশ সমস্যার ব্যাপারে নাক ঢুকিয়েছেন। কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়ন তার নীতিতে অটল রয়েছেন। সোভিয়েত ইউনিয়ন ভারতের সাথে মৈত্রী চুক্তি করেছেন যার ফলে ইয়াহিয়া খানেরা ব্ল্যাকমেইল করার সুযোগ পেল না। এমনকি নিজেরা প্রথমে সীমান্তে সৈন্য সমাবেশ করেও রুশ ভারত চুক্তির তাৎপর্য অনুভব করে নিজেরাই আবার পারস্পারিক ভিত্তিতে সৈন্য সরিয়ে নেবার প্রস্তুতি দিয়েছে।
এই চুক্তির পর ও পাকিস্তানের সামরিক শাসকদের আশা ছিল তারা দেনদরবার করে, নানা প্রলোভন দেখিয়ে অন্যান্য অনেক রাষ্ট্রের মত সোভিয়েত ইউনিয়নেরও মত পরিবর্তন করতে পারবে।তাই তারা পররাষ্ট্র সেক্রেটারি সুলতান মোহাম্মদ খান কে মস্কো পাঠায়। কিন্তু তাতে কোন সুবিধা হয় না। তারপরও তাদের আশা ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নকে তারা নিজেদের পক্ষে নিতে পারবে। সেজন্য বোধহয় মাত্র পক্ষকাল আগেও জঙ্গী চক্রের নায়ক জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খান তার জাতীয় উদ্দেশ্যে প্রদত্ত ভাষণে “সত্যিকারের পরিস্থিতি অনুধাবন” করতে পারার জন্য সোভিয়েত নেতৃত্বের প্রশংসা করেছিল। ইয়াহিয়া তখন ও বোধহয় বুঝতে পারেনি যে তোষামোদের দাওয়াই দিয়ে ছবি আঁকা নেতাদের মন গলানো যাবে না, তাদেরকে অন্যায়ের পথে নেয়া যাবে না।
তারপর পার্সিপোলিসে প্রেসিডেন্ট পদগর্নির সাথে জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খান দেখা করেছে, হয়তো অনেক কান্নাকাটিও করেছে কিন্তু কিছুতেই সোভিয়েত প্রেসিডেন্টের মন গলাতে পারেনি। তাই বোধহয় আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খানের সরকার শেষ পর্যন্ত সোভিয়েত ইউনিয়নকে প্রকাশ্য শত্রু হিসেবে গণ্য করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
ভুট্টোর ভরাডুবি
মিঃ ভুট্টো চীন গিয়েছিলেন। একা নয় সদলে। তাঁর সঙ্গে ছিল ইসলামী দেশের সামরিক বাহিনীর তিন প্রধান এবং বৈদেশিক দপ্তরের কোন কোন কর্তা। চীনা প্রধানমন্ত্রী মিঃ চু-এন-লাই এবং অন্যান্য নেতাদের সঙ্গে ভুট্টো গং-এর আলাপ আলোচনা হয়েছে। আলোচনা শেষে কোন যুক্ত ইশতেহার প্রকাশিত হয়নি। পিকিং এর ভোজ সভায় মিঃ চু এন লাই যে বক্তৃতা দিয়েছেন, তাতেও ভারত পাকিস্তানের সম্পর্ক এবং বাংলাদেশের কোন উল্লেখ ছিল না। একমাত্র অবস্থায় চিনা পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার চেং পেং ফি নাকি বলেছেন, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন সাহায্য করবে। এই সাহায্য কি ধরনের তারও কোনো স্পষ্ট উল্লেখ নেই, তার বক্তৃতার কোথাও। উপরন্তু পিকিং বাংলাদেশ প্রশ্নের রাজনৈতিক সমাধানের জন্য ইসলামাবাদের জঙ্গী চক্রকে উপদেশ দিয়েছে, এই মর্মে খবর প্রকাশিত হয়েছে।
তবু মিস্টার ভুট্টো তার দেশে ফিরে ইয়াহিয়ার কাছে তার মিশনের ফলাফল সম্পর্কে রিপোর্ট দিয়েছেন। এই রিপোর্টে তিনি কি বলেছেন তা প্রকাশ পায়নি। তবে প্রকাশ্যে বলেছেন, চিনা নেতাদের সঙ্গে তার আলোচনা সন্তোষজনক হয়েছে। সাংবাদিকদের কাছে হুংকার ছেড়ে তিনি বলেছেন,’ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ হলে গঙ্গা সিন্ধু নদের পানি লালে লাল হয়ে যাবে।’ ভুট্টোর হুংকারও তর্জন-গর্জন কে আমরা আদৌ দাম দেই না। এই মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের অতীত ও বর্তমানের রাজনৈতিক চরিত্র এবং ভূমিকা আমাদের জানা। ১৯৬৫ সালে তিনি হুংকার ছেড়েছিলেন, ভারতের সঙ্গে হাজার বছর ধরে তিনি যুদ্ধ করবেন। তারপর যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর মন্ত্রী পদ হারিয়ে কাঁদতে কাঁদতে রাওয়ালপিন্ডি ছেড়ে করাচির বাড়িতে ফিরে ছিলেন। এত বড় জাদরেল নেতা-গত মার্চ মাসে তিনি জেনারেল জিয়ার আহ্বানে ঢাকা আসতেও সাহস করেননি। তাকে একজন মেজর জেনারেল দেহরক্ষী হিসেবে দেওয়ায় পুরো এক কোম্পানির সৈন্যের পাহারায় তিনি ঢাকায় এসেছিলেন এবং আসার আগে পীরের দোয়া এবং বহু তাবিজ-কবজ গলায় ও বাহুতে বেঁধে নিয়েছিলেন। লজ্জা থাকলে এই ভূট্টো আবার গঙ্গা সিন্ধু নদী রক্ত লাল হবে বলে বহ্বাড়ম্বর করতেন না। ১৯৬৭ সালে তৎকালীন আইয়ুব মন্ত্রিসভার তথ্যসচিব খাজা শাহাবুদ্দিন প্রকাশ করেছিলেন, ভুট্টো আসলে পাকিস্তানি নাগরিক নন। পাকিস্তানি নাগরিকত্ব ছাড়াই ষড়যন্ত্রের রাজনীতি কৃপায় তিনি পাকিস্তানের মন্ত্রী হয়েছিলেন। সুতরাং আজ যে ভুট্টো যুদ্ধের নামে এত গরম গরম কথা বলছেন, যুদ্ধ বাধলে তিনি যে পাকিস্তান ছেড়ে পালাবেন, অথবা সকলের আগে সাদা পতাকা উড়িয়ে আত্মসমর্পণ করবেন, তাতে আমাদের সন্দেহ নেই। ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে গরম গরম কথা বলে যে ব্যক্তি তার ব্যক্তিগত দূত সাজতে পারে এবং দূতগিরির স্থায়ী চাকরি পাওয়ার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করতে পারে, তার আত্মসম্মান বোধ অথবা জ্ঞান কতটুকু আছে, সে প্রশ্ন এখানেও না তোলাই ভালো।
ভুট্টোর পিকিং সফরের আসল কথা অবশ্য পাস করে দিয়েছিলেন, লন্ডন টাইমস পত্রিকার ইসলামাবাদস্থ সংবাদদাতা। তিনি জানিয়েছেন, পিকিং এডমিশন এর ফলাফল সম্পর্কে ইসলামাবাদে গভীর নৈরাশ্য দেখা দিয়েছে। এই নৈরাশ্য দেখা দেওয়াই স্বাভাবিক। ইয়াহিয়া খান যত জোরেই বলুন, পাকিস্তান আক্রান্ত হলে চীন সাহায্য করবে, কিন্তু তিনি জানেন, বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ছাড়া পাকিস্তানি হানাদারের আর কেউ আক্রমণ করবে না। মুক্তিবাহিনী এখনো পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধরত। এ যুদ্ধ যে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের যুদ্ধ নয়, নয়া চীন তা জানে এবং বোঝে।সুতরাং ভারত কর্তৃক পাকিস্তান আক্রান্ত হওয়ার কোন আশঙ্কা নেই। এটা ইয়াহিয়া যেমন জানে তেমনি পিকিংও জানেন। ইয়াহিয়া চেয়ে ছিলেন, তিনি একটা ছলছুতায় ভারতের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ নামবেন, আর অমনি ভারত-পাকিস্তানকে আক্রমণ করেছে এই অজুহাতে চীন এগিয়ে আসবে অথবা ভারতকে শাসাবে। ভুট্টো সাহেব এই দুরাশা নিয়েই পিক নিয়ে গিয়েছিলেন। মামুর জোরে যারা চোখ রাঙানোর রাজনীতি করে, তার মধ্যে ইয়াহিয়া ভুট্টো চক্রের নাম সর্বাগ্রে উল্লেখ্য। চীন যেখানে একবারও মুখ খুলছেন না, সেখানে বারবার চীন আমাদের পাশে আছে, ভারত পাকিস্তানকে আক্রমণ করলে চীন আমাদের পাশে দাঁড়াবে-এ ধরনের আত্মপ্রতারণা মূলক উক্তি একমাত্র নিমজ্জমান ব্যক্তিদের ভরাডুবির আগে কাতরোক্তিকেই স্মরণ করায়।
চীন যেখানে ভিয়েতনামে গিয়ে লড়ছে না, নিজের কুময়, মাৎস নিয়ে যুদ্ধে জড়াচ্ছে না, চোখ বুঝে হংকংয়ে ব্রিটিশ আধিপত্য এবং ফরমোজা মার্কিন আধিপত্য সহ্য করছে, তারা ইয়াহিয়া ভুট্টোর মতো বিশ্বধিকৃত দুটি ফ্যাসিস্ট নরপশুকে সাহায্য করার জন্য এগোবে, এরূপ চিন্তাভাবনা পাগলামির নামান্তর মাত্র। ঘরের কুকুরকে কোলে তোলা আর রাস্তার কুকুর কে প্রশ্রয় দেয়ার মধ্যে পার্থক্য যে অনেক খানি, ইয়াহিয়া ভুট্টো তা বোধগম্য না হওয়ারই কথা। তাই ভুট্টো পিকিং থেকে ফিরেই ঘেউ ঘেউ শুরু করেছে এবং তার সুরে তাল মিলিয়ে ইয়াহিয়া ঘন ঘন নাড়তে শুরু করেছে। কিন্তু অচিরেই চীনের নেতাদের আসল মনোভাব প্রকাশ পেলে এই হর্ষ যে বিষাদে পরিণত হবে তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই।
চীনের চু-এন-লাই এর নেতৃত্বে এখন মডারেট নেতৃত্বের হাতে রাজনৈতিক ক্ষমতা রয়েছে। উগ্রপন্থীরা হটে হয়ে গেছে। জাতিসংঘে চীনের আসল লাভ ঘটেছে। এই অবস্থায় ইয়াহিয়ার দুমড়ানো গোঁফ চাড়া দেয়ার জন্য চীন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে কোনো কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করে গোটা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার ইমেজ নষ্ট করবে, এটা আমরা বিশ্বাস করি না। বরং এশিয়ার রাজনীতিতে পাকিস্তানের ফ্যাসিবাদের চাইতে ভারতের গণতন্ত্র সরকারের মিত্রতাকে চিন অধিক কাম্য মনে করতে পারে।
দেশবন্ধুর চোখে বাংলাদেশ ও হিন্দু-মুসলমান
– বাসবজিৎ বন্দ্যোপাধ্যায়
‘বিদ্যা, বুদ্ধি, টাকা- এরই নাম ঢাকা।’ ঢাকার লোকেরা যেখানেই থাকুক না কেন গর্বভরে বলে থাকেন এই কথা। যদিও এ তিনটি জিনিস যে শুধু ঢাকাতেই আছে তাও যেমন ঠিক নয় আবার আজকের ঢাকাতে সকলেই যে তিনটি জিনিসের অধিকারী তাও নয়। তবু এই কথার সত্যতা যে যেভাবেই প্রমাণ করুক না কেন তেলিরবাগের দেশবন্ধু চিত্তরঞ্জন দাস তার নিজের ক্ষুদ্র জীবনের মধ্যে এই কথার সত্যতা যেভাবে প্রমাণ তা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করতে দ্বিধা করবেন না।
এই তিনটি জিনিস হিন্দু-মুসলমান নির্বিশেষে সকলের কাছে বিতরণ করে তিনি যে ঢাকাবাসীদের কাছে অমর হয়েছেন তা নয় তিনি সমগ্র বাংলা এবং অবিভক্ত ভারতের ইতিহাসেও চিরস্মরণীয় হয়ে গেছেন।
এইটা কি মহাপুরুষের বাংলাদেশের জনপ্রিয়তার কারণ খুঁজে দেখতে গেলে সহজেই চোখে পড়বে যে তার বঙ্গ প্রেম শুধুমাত্র মঞ্চে উঠে বক্তৃতা লেখার মধ্যেই আবদ্ধ ছিল না, ছিল তার কাজের মধ্যে, বিশাল হৃদয়, দানশীলতা, ত্যাগ ও ধর্মীয় উদারতার মধ্যে। তাইতো সেই সময় কবি জীবনানন্দ দাশ তার ‘রূপসী বাংলা”তে লিখেছিলেন, মধুকূপী ঘাস-ছাওয়া, ধলেশ্বরীটির পারে, গৌরী বাংলায় এবার বল্লাল সেন আসিবে না জানি আমি -রায়গুণাকর আসবেনা -দেশবন্ধু আসিয়াছে খরধার পদ্মায় এবার, কালীদহে ক্লান্ত গাঙশালিখের ভিড়ে আসিয়াছে ঝড়…”
সেদিনের সেই ঝড় ইতিহাস মিশে আছে বাংলার প্রত্যেক গ্রামে, গঞ্জে, শহরে, আকাশে, বাতাসে। কলকাতা, ঢাকা-চট্টগ্রাম, শ্রী হট্ট, নোয়াখালী, রাজশাহি, সিরাজগঞ্জ -যেখানে গেছেন সেখানেই করেছেন মানুষের সেবার বিনিময়ে পেয়েছেন অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা, ভালোবাসা। মানুষ হিসেবে তিনি যেমন ভালোবেসেছিলেন উচ্চ নিচু জাতি ধর্ম হিসেবে বাংলার মানুষকে, সেইরকম ভালবেসেছিলাম তার প্রিয় সোনার বাংলাকেও। এ দেশ প্রেমিক ত্যাগী মহাপুরুষ শিল্পীর মনোভাব নিয়েই বাংলা ও বাঙালির মনের ভাব ফুটিয়ে তুলেছেন তার “বাংলার গীতিকবিতা” প্রবন্ধের শুরুতে। সেখানে তিনি লিখেছেন,’বাংলার জল, মাটির মধ্যে একটা চিরন্তন সত্য নিহিত আছে। সেই সত্য, যুগে যুগে আপনাকে নব নব রূপে, নব নব ভাবে প্রকাশিত করিতেছে। শত সহস্র পরিবর্তন, আবর্তন ও বিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে সেই চিরন্তন সত্যই ফুটিয়া উঠিয়াছে। সাহিত্যে, দর্শনে, কাব্যে, যুদ্ধে, বিপ্লবে, ধর্মে-কর্মে, অজ্ঞানের, অধর্মের, স্বাধীনতায়, পরাধীনতায়, সেই সত্যই আপনাকে ঘোষণা করিয়াছে, এখনো করিতেছে। সে যে বাংলার প্রাণ, বাংলার মাটি, বাংলার জল, সেই প্রাণের বহিরাবরণ।”
এই ‘বাংলার গীতিকবিতা’প্রবন্ধের লাইনগুলি একদিন মনের মধ্যে এত সুন্দর ছাপ লেগেছিল যে বেরসিক ও বিপ্লবীরাও এটা পড়ে নিজেদের দেখা বাংলার ছবি আঁকতেন আরো সুন্দর করে। দিতেন তাতে রঙিন তুলির রঙিন পোঁচ। এর এক অপূর্ব উদাহরণ হল সুদূর জেল থেকে সুভাষ চন্দ্রের লেখা একটি চিঠির উত্তরের অংশঃ
দেশবন্ধু তার বাংলার গীতিকবিতায় বলেছেন,’ বাংলার জল বাংলার মাটির মধ্যে একটা চিরন্তন সত্য নিহিত আছে।’একটির সত্যতা কি এমন ভাবে বুঝতে পারতুম, যদি এখানে এক বছর না থাকতুম? বাংলার ঢেউখেলানো শ্যামল শস্য ক্ষেত্র মধু গন্ধবহ মুকুলিত আম্রকানন মন্দিরে মন্দিরে ধূপধুনা জ্বালা সন্ধ্যা আরতি, গ্রামের ছবির মত কুটির প্রাঙ্গণ -এসব দৃশ্য কল্পনা মধ্য দিয়েও কত সুন্দর। প্রাতে অথবা অপরাহ্নের খন্ড খন্ড শুভ্রমেঘ যখন চোখের সামনে ভাসতে ভাসতে চলে যায়, তখন ক্ষণিকের জন্য মনে হয় মেঘদূত বিরহী যক্ষের মতো তাদের মারফত কয়েকটি অন্তরের কথা বঙ্গজননীর চরণ প্রান্তে লুটিয়ে দেই।’
বর্মার মান্দালয় জেল থেকেই সুভাষচন্দ্র আরো কয়েকটি সুন্দর সুন্দর চিঠি লিখেন যাতে তিনি দেশবন্ধুর বিশাল হৃদয়, সাংবাদিক নিপুণতা, অসাধারণ বাগ্মীতা, সংঘ গঠনের ক্ষমতা, তরুণের প্রতি সমবেদনা, সাহিত্য প্রতিভা ইত্যাদির কথা উল্লেখ করেন। তিনি মাসিক বসুমতি তে কথা সাহিত্যিক শরৎচন্দ্র লেখা ‘স্মৃতিকথা’ পড়ে লেখকের মনুষ্য চরিত্রে গভীর অন্তর্দৃষ্টি ও ছোট ছোট ঘটনার সুন্দর বিশ্লেষণ করে রস ও সত্য উদ্ধার করার ক্ষমতা দেখে মুগ্ধ হয়ে তার উল্লেখ করে শরৎচন্দ্র কে লেখেনঃ
“পরাধীন দেশের সবচেয়ে বড় অভিশাপ এই যে, মুক্তিসংগ্রামে বিদেশিদের অপেক্ষা দেশের লোকদের সঙ্গে মানুষকে লড়াই করতে হয় বেশি।” এই উক্তির নিষ্ঠুরতা তাঁর অনুগ্রহে, কর্মীরা হারে হারে বুঝেছে এবং এখনো বুঝছে…. ভালো-মন্দ স্বীকার করে নিয়েই যে তাকে ভালোবাসা উচিত-এই কথায় তিনি বিশ্বাস করতেন এবং এই বিশ্বাসের উপর তার জীবনের ভিত্তি।
মুক্তিসংগ্রামে পরাধীন দেশের অভিশাপ সম্পর্কে দেশবন্ধুর উক্তিটির কথা উল্লেখ করেছেন সুভাষচন্দ্র, সেটি সেদিনও যেমন সত্য ছিলো আজও তেমন সত্য আছে।
মোমেনের ভাগ্য সব দালালকেই বরণ করতে হবে
বসন্তের লোভে পড়ে যে মীর জাফর আলী খান পলাশীর আম্রকাননে বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার স্বাধীনতা বিকিয়ে দিয়েছিল ইতিহাসের কুখ্যাত হয়ে থাকলেও মৃত্যুর পরে সে বাংলার মাটিতে শায়িত থাকার সুযোগ পেয়েছিল। এর ফলে মৃত্যুর পরেও সে বাংলাদেশের পবিত্র মাটি কে অপবিত্র করার সুযোগ পেয়েছিল। কিন্তু বাংলার লাটগিরি লাভের আশায় যে কুখ্যাত মোমেন খান বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের সাথে বেঈমানী করেছে এমনকি গদি হারাবার পর জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে পরাধীনতার জিঞ্জিরে আবদ্ধ রাখার প্রয়াস পেয়েছে আজিকার বাঙালি সমাজ তাকে কোনদিনও ক্ষমা করতে পারে না। বাঙ্গালী বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাকে স্টেনগানের গুলিতে কুকুরের মত হত্যা করেছে। মোমেনের আত্মীয়রা ভেবেছিল ওখানেই সবকিছুর শেষ। মৃত্যুর পরে অন্ততঃ মোমেন খান বাংলার মাটিতে শান্তিতে থাকতে পারবে। তাই তারা জায়গা কিনে আজিমপুরার গোরস্থানে তার লাশ সমাহিত করেছিল। কিন্তু তারা ভুলে গিয়েছিল যে বাঙালি তরুণরা মৃত্যুর পরও মোমেন খান কে ক্ষমা করতে পারে না, কাকে বাংলার মাটি অপবিত্র করতে দিতে পারেনা। মোমেনের আত্মীয়রা আরো ভুলে গিয়েছিল যে, এই আজিমপুরা গোরস্থানে সাহিত্য রয়েছেন ভাষা আন্দোলনের অমর শহীদান বরকত, সালাম ও রফিক। আরও রয়েছেন বঙ্গবন্ধুর দক্ষিণ হস্ত দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তোফাজ্জল হোসেন (মানিক মিয়া) এবং আজীবন সংগ্রামী জনাব আবু হোসেন সরকার প্রমুখ। তাই আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা হাজার হাজার পশ্চিমা সৈন্য ও তাদের দালালদের চোখকে ফাঁকি দিয়ে রাতের বেলায় মোমেন খানের লাশটি গোরস্থান থেকে তুলে নিয়ে নদীতে ফেলে দিয়েছেন।
প্রকাশ, মোমেন খানের অপবিত্র লাশ তুলে নেওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধারা সেখানে একখানা কাগজে কতিপয় কথা লিখে রেখে গেছেন। তাতে লেখা হয়েছে, অন্যান্য দালালদেরও মোমেনের এই দশা হবে। তাদেরকে কুকুরের মত হত্যা করা হবে। তারপর তাদের লাশ নদীতে ফেলে দেওয়া হবে বা শিয়াল-কুকুরের উদরপূর্তির কাজে লাগানো হবে যাতে মৃত্যুর পর তারা বাংলার মাটিকে অপবিত্র করতে না পারে।
ইয়াহিয়ার সনদের চা পান নিষিদ্ধ
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত সংবাদে জানা গিয়েছে যে, তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে মোতায়েন তাদের ভাড়াটিয়া সৈন্যদের সরবরাহের ব্যাপারে সম্পূর্ণরূপে অসুবিধায় পড়েছে। শুধু স্থানীয়ভাবে প্রাপ্ত না হলে তাদের পক্ষে সৈন্যদের আর বাইরে থেকে এনে জিনিসপত্র দেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। মুক্তিবাহিনীর গেরিলা তৎপরতায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হওয়া ছাড়াও বিদেশ থেকে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র আসতে বৈদেশিক মুদ্রার প্রয়োজন হয়। কিন্তু সেই বৈদেশিক মুদ্রা আজ আর কোথায়? এমনকি পিন্ডির জঙ্গী চক্র তাদের বাংলাদেশ মোতায়েন সৈন্যদের সামান্য চা পর্যন্ত সরবরাহ করতে পারছে না। তাই তারা সৈন্যদের নির্দেশ দিয়েছে চা পান না করার জন্য।
সংবাদে প্রকাশ, আগে বাংলাদেশের চা বাগানগুলোতে উৎপন্ন চা-ই সৈন্যদের মধ্যে সরবরাহ করা হতো। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের চা বিক্রি করে পিন্ডি ওয়ালারা প্রতি বছর কোটি কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করত। কিন্তু বর্তমানে বাংলাদেশের চা বাগানগুলো মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে থাকায় তারা আর চা পাচ্ছে না। প্রথমদিকে লুটতরাজ করে বিভিন্ন চা কারখানা ও দোকানপাট থেকে দস্যুরা যে সমস্ত চা নিয়ে ক্যান্টনমেন্টে জমা করেছিল তাও শেষ হয়ে গেছে। এখন উপায়? কোন উপায় নাই। তাই সৈন্যদের জন্য চা পান নিষিদ্ধ।
*মার্কিন সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ঢাকা নগরী*
মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানি সৈন্যদের সমস্ত আরাম হারাম করে দিয়েছেন
‘শিকাগো ডেইলি নিউজ’পত্রিকায় বিশিষ্ট সাংবাদিক আর্নেস্ট উইথরোল ‘ঢাকার পাকজান্তা শান্তিতে নেই’ শিরোনামায় এক নিবন্ধে বলেন, ‘ মুক্তিবাহিনী নামে পরিচিত বাংলাদেশ সেনাবাহিনী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীকে আঘাতের পর আঘাত করে চলেছে।’
ভিয়েতনাম যুদ্ধের সমর সংবাদদাতা আর্নেস্ট উইথরোল তার সাম্প্রতিক বাংলাদেশ সফরের অভিজ্ঞতা বর্ণনা করে উক্ত প্রবন্ধ লেখেন।
বাংলাদেশের পঙ্গু ও যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পর্কে তিনি বলেন, প্রদেশের পূর্বাঞ্চলের দুটি বৃহৎ নগরী ঢাকা ও চট্টগ্রামের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী রেলপথে যাতায়াত করা তার সফরের সময় পর্যন্ত অসম্ভব ছিল। ব্রিজগুলো ধ্বংস হবার ফলে হাইওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা ও পঙ্গু হয়ে গেছে। বদ্বীপ অঞ্চলের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ যোগাযোগ মাধ্যম নদীপথেও অনবরত গেরিলা আক্রমণ পরিচালিত হচ্ছে। সামরিক মহড়া একটিমাত্র সামরিক বিমান এর সাহায্যে পাকিস্তানি আর্মি পোস্টে খাদ্য ও লোক সরবরাহ করা হচ্ছে।’
মিস্টার উইথরোল মুক্তিবাহিনীর এক অফিসারের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন এবং তার বুদ্ধিমত্তার প্রশংসা করেন। তাকে মুক্তি বাহিনীর উক্ত অফিসার জানান যে, সূর্যাস্তের পর গ্রাম অঞ্চল গুলো মুক্তি বাহিনীর দখলে থাকে।
উক্ত অফিসার তাকে বলে, যদি বিশ্বাস না হয় তবে চলুন, দু’রাতের মধ্যে আমি আপনাকে ঢাকায় পৌছে দিব। শহরের বড় হোটেলে আপনার থাকার ব্যবস্থা করা না গেলেও ভালো হোটেলে আপনাকে থাকার ব্যবস্থা করে দেব।’
বিদ্রোহীরা অত্যন্ত সাহসিকতার সঙ্গে কাজ করছেন। ঢাকাস্থ হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টাল প্রবল প্রহরায় রাখা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর এক যোদ্ধা জনৈক বিদেশি সাংবাদিকের সঙ্গে সেই হোটেলে দেখা করেন এবং উক্ত সাংবাদিককে ঢাকার বাইরে গ্রামাঞ্চলে পাক সেনাবাহিনীর যে কোন কর্তৃত্ব নেই তা প্রত্যক্ষ করার জন্য তাকে নিমন্ত্রণ করেন। পরে পাক সরকারের গোয়েন্দা পুলিশের চোখে ধুলো দিয়ে উক্ত সাংবাদিককে মুক্তাঞ্চল ঘুরিয়ে-ফিরিয়েও দেখান।
মিস্টার উইথরোল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের প্রশংসা করে বলেন, জনৈক বিদায়ী পাকিস্তানি অফিসারের সম্মানে আয়োজিত সান্ধ্য ভোজ সভার খাদ্যতালিকা সেই রাতেই গোপন বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত হয়। ঢাকা শহরের একটি বিশেষ বড় ঘড়ি যে পাঁচ মিনিট স্লো চলছে তাও পাক সামরিক বাহিনীর উদ্দেশে উক্ত বেতার কেন্দ্র থেকে ঘোষণা করা হয়।
মিস্টার উইথড্রল তার প্রবন্ধের উপসংহার টানেন মুক্তিবাহিনীর উক্ত অফিসারেরই উক্তি দিয়ে। এসব ঘটনা খুব সাধারন বুদ্ধিমত্তার পরিচায়ক কিন্তু এতেই শত্রুসেনাদের চোখের ঘুম হারাম হয়ে যায়। কারণ তারা হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে যে সমাজের প্রতিটি স্তরেই মুক্তিফৌজের নিজেদের লোক নিয়োজিত রয়েছেন।
শেষের সেদিন বড়ই ভয়ঙ্কর
এদেশের প্রাজ্ঞ ব্যক্তিরা হঠকারীদের উদ্দেশ্যে মন্তব্য করেছিলেন, শেষের সেইদিন বড়ই ভয়ংকর। পশ্চিম পাকিস্তানের ধনকুবের ও সামরিক নেতাদের চোখে-মুখে মৃত্যুর আতঙ্ক ফুটে উঠতে শুরু করেছে। বিলম্বে হলেও শেষের সেদিন যে তাদের জন্য ভয়ঙ্কর পরিণতি অপেক্ষা করছে তা তারা সত্রাসে উপলব্ধি করতে শুরু করেছে। আর সেই জন্য তাদের মধ্যে পাকিস্তানে ডুবন্ত নৌকা ছেড়ে পালাবার তাড়াহুড়ো পরে গেছে।
ইসলামাবাদের বিদেশি কূটনীতিক নয়াদিল্লিতে নিযুক্ত তার সহযোগীদের কাছে এক পত্রে জানিয়েছেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানের ধনিক ও শীর্ষ নেতৃত্বের মধ্যে মারাত্মক আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। সম্পদশালী পশ্চিম পাকিস্তানিরা দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে এবং ইতিমধ্যে অনেকে তাদের পরিবারবর্গের ইরান এবং ইংল্যান্ডের পাঠিয়ে দিয়েছে। ব্যাংক থেকে টাকা কড়িও উঠিয়ে নিতে শুরু করেছে।
ইসলামাবাদে নিযুক্ত বিদেশি কূটনীতিক তারপত্রে আরো জানিয়েছেন যে, সীমান্তে পাকিস্তান ও ভারতের সৈন্য সমাবেশের পর থেকেই তাদের মনে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। তার মতে এসব পাকিস্তানের নেতাদের মনোবল নষ্ট হবার একটা বড় কারণ হল, সোভিয়েত ইউনিয়ন যেখানে ভারতের প্রতি পূর্ণ সমর্থন জানিয়েছেন, সেখানে চীন নীরবতা অবলম্বন করে বসে রয়েছে এবং বহু চেষ্টা সত্ত্বেও পাকিস্তানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ঘোষণা আদায় করতে পারছে না।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখ করা যেতে পারে যে, কয়েকদিন পূর্বে লন্ডনের ‘ডেইলি মেইল’ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান-এর মন্তব্য খুবই প্রনিধান যোগ্য। তিনি সে সাক্ষাৎকারে মন্তব্য করেছিলেন যে, চীন সরাসরি পাকিস্তানের পাশে না দাঁড়ালে ও প্রয়োজনীয় অস্ত্রশস্ত্র দিয়ে সাহায্য করবে। ইয়াহিয়া খানের উক্ত মন্তব্যের মধ্যে প্রকৃতপক্ষে পাকিস্তানি সমর নেতাদের নৈরাশ্যই প্রকাশ পেয়েছে।
পাকিস্তানের ভারিয়াস অন্যদিকে পশ্চিম পাকিস্তানের যে ধনকুবেররা দেশ ছেড়ে পালাবার জন্য প্রস্তুত হচ্ছে, পাকিস্তানের বর্তমান ভাগ্যবিপর্যয়ে তাদের দায়িত্ব কম নয়। সারা পাকিস্তানের মোট ব্যবসার শতকরা ৬০ ভাগ এবং ব্যাংক ও বীমা ব্যবসার শতকরা ৮০ ভাগ পশ্চিম পাকিস্তানের মাত্র ২০ টি পরিবারের কুক্ষিগত। তাদের এই শোষণ অব্যাহত রাখার জন্য বাংলাদেশের মানুষের রাজনৈতিক অধিকার হরণ করা হয়েছে এবং বাংলাদেশকে একটি উপনিবেশে পরিণত করা হয়েছে। তারা যাতে নির্বিবাদে বাংলাদেশের উপর শোষণ চালাতে পারে সেই উদ্দেশ্যে সামরিক জান্তার সাথে হাত মিলিয়ে বাংলাদেশের মানুষের স্বাধিকারের দাবিকে রক্তগঙ্গায় ডুবিয়ে দিতে চেয়েছিল। কিন্তু তারা তখন শেষের এই দিনের ভয়ঙ্কর পরিণতি অনুমান করতে পারেনি। এখন সেই পরিণতি শিয়রে উপস্থিত হতে দেখে এই সকল ধনকুবের সবার আগে সরে পরবার আয়োজন করছে।
ঢাকা ক্যান্টনমেন্টে দিনরাত কাফন তৈরি হচ্ছে
মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা ঢাকায় বর্তমানে খুবই সক্রিয়। গেরিলাদের তৎপরতার ফলে পাকসেনারা কোণঠাসা হয়ে পড়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১৮৯ জন পাকিস্তানি সেনা নিহত হচ্ছে। ছুতারেরা মৃত অফিসারদের কফিন তৈরি করার জন্য ক্যান্টনমেন্টে দিনরাত কাজ করছে। কবরস্থ করার জন্য পাক সৈন্যদের লাশ এইসব কফিনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠানো হয়।
সম্প্রতি লন্ডনের সানডে টাইমস পত্রিকায় প্রকাশিত রিপোর্টে এ কথা বলা হয়েছে।
বাংলাদেশ থেকে সানডে টাইমসের সংবাদদাতা তার রিপোর্টে সম্প্রতি ঢাকায় একাধিক সরকারি ভবনের ওপর আটশরও বেশী গেরিলার ধারাবাহিক আক্রমণের কথা জানিয়েছেন। এর মধ্যে কয়েকটি সরকারি বাড়ি শহরের প্রধান ব্যবসা কেন্দ্র অবস্থিত।
উক্ত রিপোর্টে আরও বলা হয় যে, গেরিলা আক্রমণের ফলে পাকবাহিনী বিমানবন্দর সুরক্ষিত রাখার জন্য বিমান বন্দর পর্যন্ত প্রধান সড়কের দু’পাশে ‘পিল বক্স’ স্থাপন করতে বাধ্য হয়েছে।
পিআইএ-এর বিমানগুলো মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় ভীত হয়ে পড়েছে। পি আই -এর বোয়িং বিমান গুলি পূর্বে আন্তঃমহাদেশীয় গতিপথে চলাচল করত। আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা নির্দিষ্ট প্রতিবছরের বর্তমানে যতটা সম্ভব জলপথের উপর দিয়ে যাতায়াত করি এবং বিমানের আলোক সংকেত ও জ্বালানো হয় না।
*কানাডীয় প্রতিনিধি দলের সফর অভিজ্ঞতা*
ইয়াহিয়ার পাকিস্তানে একজন শরণার্থীও ফিরে যাবে না
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
কানাডিয়ান ইন্টারন্যাসনাল ডেভলপমেন্ট এজেন্সির প্রেসিডেন্ট এবং সাত সদস্যবিশিষ্ট কানাডীয় তথ্যানুসন্ধান কমিটির নেতা মিস্টার পল গেরিন লাজোলে গত ২৯শে অক্টোবর কলকাতায় এক সাংবাদিক সম্মেলনে বলেন যে, বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন এর পর তিনি এ সিদ্ধান্তে এসেছেন যে একজন শরণার্থী ও বর্তমান অবস্থায় বাংলাদেশে ফিরে যাবে না। মিঃ পল গেরিনের নেতৃত্বে আলোচ্য প্রতিনিধিদল শরণার্থীদের প্রয়োজন সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের উদ্দেশ্যে ভারতে অবস্থিত বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করেন।
সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, বিভিন্ন শিবির পরিদর্শনকালে তিনি বহু শরণার্থীর সাথে ব্যক্তিগতভাবে আলোচনা করেছেন। কিন্তু তিনি এমন একজন শরণার্থী ও দেখেন নি যে বাংলাদেশের বর্তমান অবস্থা দেশে ফিরে যেতে রাজি আছেন।
মিঃ পল গিরিন বলেন ভারত সরকার শরণার্থীদের স্বদেশে ফিরে যেতে দিবেন না বলে পাকিস্তান যে প্রচারণা চালাচ্ছে তার পেছনে কোনো সত্যতা নেই। পক্ষান্তরে শরণার্থীরা তাকে জানিয়েছে যে তারা কেবলমাত্র স্বাধীন বাংলাদেশেই ফিরে যাবে।
ভারতে নিযুক্ত কানাডীয় হাইকমিশনারও সাংবাদিক সম্মেলনে উপস্থিত ছিলেন। তিনি জানান যে, ভারতে অবস্থানরত বাংলাদেশ শরণার্থীদের জন্য কানাডার সাহায্যের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে সাড়ে চার কোটি টাকায়। তিনি আশ্বাস দেন যে আগামী সপ্তাহ নাগাদ সমস্ত কানাডীয় সাহায্য ভারতে এসে পৌঁছাবে।
ভারত সফর শেষে সাত সদস্যবিশিষ্ট কানাডীয় দলটি পাকিস্তানের যাবে। দলের নেতা জানান যে, তারা মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি থেকে সমগ্র শরণার্থী সমস্যাটি পরীক্ষা করে দেখবেন।
সিলেট রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর বিজয় অভিযান অব্যাহত
দুইটি থানা দখলঃ ৬টি নৌযান ধ্বংস
সিলেট ও ময়মনসিংহ রণাঙ্গনের বিভিন্ন এলাকায় মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তাদের অবস্থা দাঁড়িয়েছে খাঁচায় আটকা পড়া জানোয়ারের মত।
মুক্তিবাহিনীর দেশপ্রেমিক’ বীর যোদ্ধারা রাধানগর, সারিঘাট এবং কানাইরঘাটে পাক হানাদার বাহিনীকে এমন ব্যতিব্যস্ত করে রেখেছে যে তাদের পক্ষে অন্যান্য চৌকির সাহায্যে যাওয়া কিংবা চলাফেরা সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গিয়েছে। অপরদিকে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সালুটি গড় বিমানবন্দরের কাছাকাছি কোম্পানীগঞ্জের নিকটে মুক্তিসেনারা পাকহানাদারদের ওপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালাচ্ছে।
দিশেহারা পাকসেনারা মুক্তিবাহিনীর অগ্রগতি রোধ করতে না পেরে পাকিস্তানি বিমান বাহিনীর সাহায্য গ্রহণ করেছে এবং পাকিস্তানের বিমান থেকে উক্ত এলাকার অধিবাসীদের উপর নির্বিচারে গুলিবর্ষণ করা হয়েছে।
গত মঙ্গলবার সিলেটের উত্তর পূর্বে অবস্থিত রাধানগরের মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পাকসেনারা ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়েছে। এই যুদ্ধে ১৭ জন পাকসেনা নিহত এবং ৩০ জন আহত হয়েছে। রাধানগরের বিপর্যস্ত পাকসেনাদের সাহায্যের জন্য সারিঘাট থেকে একদল সৈন্য পাঠানো হয়েছিল কিন্তু মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণের মুখে তারা নিজেদের প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যেতে বাধ্য হয়। এ রিপোর্ট লেখা পর্যন্ত রাধানগরে যুদ্ধ চলছে বলে খবর পাওয়া গিয়েছে।
কয়েকদিন পূর্বে মুক্তিবাহিনী সিলেটের বানিয়াচং এবং ধর্মপাশা থানা দুটি মুক্ত করেছিল। এখনো দুটি এলাকায় আমাদের বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের শক্তি আরো দৃঢ় করেছে।
মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড শেল ও মেশিনগানের গুলিবর্ষণের মুখে পাকিস্তানি সেনারা তাদের পূর্বতন অবস্থা থেকে ক্রমাগত পেছনে হটে যেতে বাধ্য হচ্ছে।
মুক্তিবাহিনীর প্রবল গোলাবর্ষণের ঢাকা আজমিরীগঞ্জ, শেরপুর সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে গিয়েছে। সিলেটের সরবরাহ প্রধানতঃ এই নৌপথের উপরেই নির্ভর করতো। কিন্তু সিলেটের ধমনী বলে পরিচিত এই নৌপথ বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবার ফলে সিলেট সেক্টরের পাকবাহিনীর জরুরী সরবরাহ অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে। গত একক হলে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণের ফলে এই নদী পথে ছ’টি জলযান ডুবে যায়। এ জলযানগুলো ঢাকা থেকে সিলেটে জরুরী সরবরাহ নিয়ে যাচ্ছিল।
পাক সেনা নিহত
জয়ন্তিয়াপুর ও সারিঘাট এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং গত সোমবার মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে ৮ জন পাকসেনা নিহত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা খুমারঘাট বিধ্বস্ত করেছে এবং সিলেট শহরের দুটি বিদ্যুৎ পাইলন ধ্বংস করেছে।
আত্ম বিলুপ্তি অবধারিত জেনেও ইয়াহিয়া কেন যুদ্ধ বাধাতে চায়-
ইয়াহিয়া খান ভারত সংলগ্ন পাকিস্তানি সীমানায় সৈন্য সমাবেশ করেছে। পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলে কাশ্মীর থেকে কচ্ছ পর্যন্ত এবং ভারত-বাংলাদেশ সীমান্তের দিকে সৈন্য সমাবেশ করা হয়েছে।
ভারতের সহিত দ্বিপাক্ষিক আলোচনার প্রস্তাবে ভারতের অনিচ্ছা প্রকাশের পর থেকে ইয়াহিয়া খানের হুমকির পরিমাণ বেড়ে যায়। তার কথায় ও কাজে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ দেহি মনোভাবের প্রতিফলন ও দেখা যায়। পাল্টা ব্যবস্থা অনুযায়ী ভারত ও তার সীমান্ত এলাকায় সৈন্য মোতায়েন করেছে। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর আক্রমনাত্মক কার্যকলাপ ও অনেক বেড়ে গেছে।
এই পরিস্থিতিকে ঠেকা দিতে গিয়ে ইয়াহিয়া খান অবশেষে যে পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে তাতে সর্বস্ব খোয়া যাওয়ার আশঙ্কায় হতাশ জুয়াড়ির সর্বস্ব বাজি ধরার মনোভাবটি পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে। ইয়াহিয়া ধারণা যে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ বেধে গেল বৃহৎ শক্তি অবশ্যই হস্তক্ষেপ করতে এগিয়ে আসবে।
ইয়াহিয়া খান মনে করে যুদ্ধ শুরু হলে অন্ততঃ দু’একদিন ও যুদ্ধ চালাতে পারলে স্বস্তিপরিষদ যুদ্ধবিরতির জন্য কার্যকরী ভূমিকা গ্রহণ করবে এবং সীমান্ত থেকে রাষ্ট্রকেই সৈন্য প্রত্যাহার করতে বাধ্য করবে। ‘নোম্যান্সল্যান্ডে’ জাতিসংঘের রক্ষী বাহিনী মোতায়েন করা হবে।
তথাকথিত এই শান্তি রক্ষা করে গঠিত হলে ইয়াহিয়া খান তখন নিরুদ্বেগে মুক্তিবাহিনীকে দমন করতে পারবে এবং কিছু রাজনৈতিক সুযোগ-সুবিধা দিয়ে বাংলাদেশের জনগণকে পাঞ্জাব প্রভাবিত এক পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই থাকতে বাধ্য করতে পারবে।
ইয়াহিয়ার এই মনোভাব আঁচ করেই ভারতের প্রতিরক্ষামন্ত্রী মিস্টার জগজীবন রাম ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্যে সতর্কবাণী উচ্চারণ করেন। মিস্টার জগজীবন রাম বলেছেন যে, ভারতের পাল্টা আক্রমণে পাকিস্তানের প্রত্যন্ত অঞ্চলেও ফল ভোগ করবে। লাহোর ও শিয়ালকোটের বিশেষ উল্লেখ করে তিনি বলেন, ভারতের সফলতা দখল করবে, তা আর ফিরিয়ে দেওয়া হবে না।’
ইয়াহিয়া খান নিজের ফাঁদে নিজেই আটকা পড়ে গেছে। পাকিস্তান ভৌগোলিকভাবে ২ অঞ্চলে বিভক্ত হওয়ার ফলে সামরিক কারণে প্রয়োজনীয় সৈন্য অপসারণ করাও সম্ভব নয়। কারণ যে অঞ্চল থেকে সৈন্য অপসারণ করা হবে সেই অংশই হবে যুদ্ধের দিক থেকে ‘দুর্বল এলাকা’। ইয়াহিয়ার আশঙ্কা, দুর্বল এলাকায় দিয়েই ভারত এগিয়ে আসবে।
অপরদিকে ভারীও উন্নত ধরনের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত মুক্তিবাহিনীকে এলাকায় লড়াই করে পাকবাহিনীকে নাজেহাল করে তুলছে। ভিয়েং কং গেরিলাদের ‘আঘাত করে সরে পড়’ কায়দায় তারা লড়াই করছেন।
মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের অন্তর্ঘাতমূলক কার্যকলাপ ও বৃদ্ধি পেয়েছে। যাতায়াত ব্যবস্থা ও রসদ সরবরাহ ব্যবস্থা পঙ্গু করে দিতে তারা বদ্ধপরিকর। এসব কারনেও সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য প্রত্যাহারের ব্যাপারে ইয়াহিয়া দ্বিধাগ্রস্থ।
নিজের ভ্রান্তির ফলে ইয়াহিয়া খান পূর্ববাংলায় শোচনীয় পরাজয়ের সম্মুখীন হয়েছে।
পাকিস্তানের ব্যাপারে বৃহৎ শক্তিবর্গের মনোভাব ও উপেক্ষণীয় নয়।
দুই অঞ্চলকে এক রেখে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি রক্ষা করতে বৃহৎ শক্তিবর্গ আগ্ৰহী। শেখ মুজিবুর রহমানের প্রধান দাবি ছিল স্বায়ত্তশাসন এর অধিক, কিন্তু পূর্ণ স্বাধীনতা নয়, হয় তো এই শর্তেই ইয়াহিয়া খানকে শেখ মুজিবের সঙ্গে আপোষ করার জন্য বৃহৎ শক্তির চাপ প্রয়োগ করতে পারে।
ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়া খান বলতে শুরু করেছে যে, জনগণ চাইলেই শেখ মুজিবকে মুক্তি দেওয়া হবে।
ইয়াহিয়া খানের অন্যতম প্রধান মিত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্টেট ডিপার্টমেন্টের সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ করার পরিকল্পনা কে সমর্থন করছে। উক্ত পরিকল্পনা অনুযায়ী ভারত জাতীয় সীমান্ত থেকে সৈন্য অপসারণ করে তার জন্য ও স্টেট ডিপার্টমেন্ট অচিরেই উদ্যোগ নিচ্ছে।
ভারতের সম্মতি না পেলে, পাকিস্তান একতরফাভাবে সীমান্ত থেকে সৈন্য প্রত্যাহার করতে পারেনা। বৃহৎ শক্তির মর্জি জেনেও ভারত এই প্রস্তাব সরাসরি নাকচ করে দিয়েছে। একতরফাভাবে সৈন্য অপসারণ পাকিস্তানের জন্য রাজনৈতিকভাবেও ক্ষতিকর হবে। কেননা ভয়ে পিছিয়ে গেছে বলে জনগণের কাছে পাকসেনারা হাস্যস্পদ হয়ে পড়বে। অগত্যা, ইয়াহিয়া খানকে একমাত্র যুদ্ধের পথেই বেছে নিতে হচ্ছে।
৬৫-এর যুদ্ধকালীন পরিস্থিতি আর বর্তমান পরিস্থিতি এক তো নয়ই বরং বহুলাংশে ভিন্নতর। ৬৫-তে পাকিস্তান নাঙ্গা তলোয়ার দিয়ে সশস্ত্র সৈন্য নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল। তদুপরি পশ্চিম পাকিস্তান এবং কাশ্মীরের অপেক্ষাকৃত সুবিধাজনক এলাকাতেই এই যুদ্ধ সীমাবদ্ধ ছিল। পূর্বের চেয়ে ও পাকিস্তানের যুদ্ধ উপকরণ এখন অনেক বেশি রয়েছে। উন্নত ধরনের ট্যাংক, বিমানবহর ও গোলন্দাজ বাহিনীর সুবিধা থাকা সত্ত্বেও পাকিস্তানের বর্তমান অবস্থা সম্পূর্ণ অন্যরকম, পাক সেনাবাহিনীর মনোবলই ভেঙে পড়েছে।
ভারতের সেনাবাহিনীকে ও নবীকরণ করা হয়েছে। রাশিয়ার তৈরি টি-৫৪, টি-৫৫ এবং পিটি-৬৭ ট্যাংক ছাড়াও ভারতের নিজেদের বৈজয়ন্ত ট্যাংক রয়েছে। ভারতের বিমান বাহিনীতে বোমারু বিমান মিগ-২১, এস, ইউ-৭ ছড়াও ভারতে তৈরি মারুত (এইচ এবং -২৪) তো রয়েছেই। নৌবাহিনী দিক থেকেও ভারত এখন স্বয়ংসম্পূর্ণ। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের জলপথের যোগাযোগব্যবস্থা বানচালের জন্য সাবমেরিন ছাড়াও ভারতের দ্রুতগামী ফিগেট রয়েছে।
যুদ্ধের সময় ধর্মের জিকির তুলেছে যে বিশেষ কায়দা হয়না ৬৫-এর খেমকারান ট্যাংক যুদ্ধে পাকিস্তান অন্ততঃ এই অভিজ্ঞতাটুকু লাভ করেছে। অতিসম্প্রতি পাঞ্জাবি মুসলমান সৈন্য কর্তৃক পাইকারিভাবে বাঙালি মুসলমান হত্যার হলো ধর্মীয় ঐক্যের অস্ত্রটিও সম্পূর্ণ ভোঁতা হয়ে গেছে।
অনিবার্যভাবে পাকিস্তানের দুই প্রবল শক্তির সম্মুখীন বাইরের দিক থেকে পাঁচগুণ বিশাল ভারত এবং ঘরের মধ্যে সামরিক জান্তার ঔপনিবেশিক শাসনের যাঁতাকলে পিষ্ট বাংলাদেশের বিক্ষুব্ধ জনগণ।
বাংলাদেশের বধ্যভূমিতে কি দেখেছি
নরমুণ্ডের গেণ্ডুয়া খেলা বা নর রক্তের হোলিখেলার নজির বিশ্বের ইতিহাসে বিরল নয়। এ খেলা খেলেছিলো চেঙ্গিস, হালাকু খান রা। আর সমসাময়িক ইতিহাসে খেলেছে হিটলার। লাখো লাখো দেশবাসীকে গ্যাস চেম্বারে পুড়িয়ে হত্যা করতে তার বিবেকে বাঁধেনি।
মুসলমানদের ইতিহাসেও এক নজির আছে। কারবালা-প্রান্তরে মুসলমান নামধারী জল্লাদ ইয়াজিদের সেনাবাহিনীর তার নজির রেখে গেছে। নজর রেখে গেছে সীমার। কারবালার প্রান্তরে মুসলমান নামধারী নরপিশাচরা তাদের প্রতিপক্ষের প্রতি যে নির্দয় আচরণ করেছিল তারা চিরকাল মানব ইতিহাসের কলঙ্ক হয়ে থাকবে। প্রতিপক্ষের লোকজন এমনকি নিরীহ-নিরস্ত্র নারী ও শিশুদেরও তারা রেহাই দেয়নি সেদিন। পানির বদলে শিশুদের দিয়েছিল তীরের তীক্ষ্ণ আঘাত। শুধু তাই নয়, হোসেনের মুণ্ড বর্শার মাথায় গেঁথে পাষণ্ড সীমার পৈশাচিক আনন্দ করতে করতে দামেস্কে তার প্রভুর কাছে নিয়েছিল।
তেমনি পৈশাচিক আচরণ করেছে পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলমান নামধারী ব্যক্তিরা ইয়াহিয়ার, টিক্কার সেনাবাহিনী। গত ২৫ শে মার্চের পর তারা পাখি শিকারের মত খোশমেজাজে বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে। তারা হত্যা করেছেন নারী-শিশু নির্বিশেষে সকলকে।
শুধু বাঙ্গালীদের হত্যা করেই তারা ক্ষান্ত হয়নি। মৃত লাশের উপর বসে আনন্দ করেছে। সন্ধ্যার পর সামরিক ছাউনিতে বসে বসে সারাদিনে কতটা বাঙালি মেরেছে, কতজন বাঙ্গালী মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে তা নিয়ে পৈশাচিক আনন্দ প্রকাশ করেছে। কথাগুলো বলেছেন, বিলাতের ‘সানডে টাইমস’ পত্রিকায় নিয়মিত লেখক ও পাকিস্তান রাষ্ট্রের কাগজ মর্নিং নিউজ এর ভূতপূর্ব সাংবাদিক ম্যাসকারেনহাস। কিছুদিন আগে তিনি বাংলাদেশে পরিদর্শন করতে আসেন সাংবাদিক হিসেবে। বাংলাদেশের পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষের অত্যাচারের যে চেহারা তিনি দেখেন তাতে তিনি নিদারুণভাবে মর্মাহত হন। তিনি তার স্ত্রী পুত্র নিয়ে করাচি থেকে পালিয়ে বেড়াতে যান সে দেশের পত্রিকা মারফত এই বর্বরতার কথা সারা বিশ্বকে জানাতে। মাস্কারেনহাস ভারতের গোয়াতে জন্মান। ধর্মে তিনি খ্রিস্টান। করাচিতে তিনি স্থায়ী বসতি স্থাপন করেন। নিরপেক্ষ সাংবাদিক হিসেবে তিনি প্রভূত খ্যাতি অর্জন করেন। বিলাতের প্রভাবশালী পত্রিকা সানডে টাইমস এ তার প্রকাশিত লেখাগুলি সারা বিশ্বে আলোড়ন সৃষ্টি করে।
সাংবাদিক মাসকারেনহাস বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার সেনা বাহিনীর বর্বরতার একটি বই লিখেছেন। বইটি সম্প্রতি লন্ডনে প্রকাশিত হয়েছে। বইটির নাম দিয়েছেন তিনি ‘দি রেপ অফ বাংলাদেশ’।
তাতে তিনি লিখেছেন, অভিধানে জেনোসাইডের (গণহত্যা) যে সংজ্ঞা দেওয়া হয়েছে ইয়াহিয়ার লেলিয়ে দেয়া সেনাবাহিনী বাংলাদেশে ঠিক করেছে।
তিনি লিখেছেনঃ কি নিখুঁত ও সুচারুরূপে বাংলাদেশে এই গণহত্যার পরিকল্পনা তৈরি ও বাস্তবায়ন করা হচ্ছিল কুমিল্লায় ১৪শ ডিভিশনের সদরদপ্তর সফরকালে তা আমি জানতে পারি।
মিস্টার মাসকারেনহাস মন্তব্য করেছেন হিটলারের পর এমন পৈশাচিক কাণ্ড কারবার আর কোথাও হয়নি।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশে অবস্থানকালে আমাকে স্বচক্ষে হত্যা ও জ্বালানো পোড়ানো অভিযান দেখতে হয়েছে। সেই সময় গ্রামে গ্রামে ও বাড়িতে বাড়িতে তল্লাশি করে হিন্দু ও অন্যান্য শ্রেণীর দুশমনদের হত্যা করা হচ্ছিল।’
তিনি আরো লিখেছেন, আমি গ্রামের পর গ্রাম নির্মূল করতে দেখেছি এবং সামরিক শাসকদের হাসতে হাসতে মানুষকে মৃত্যুদণ্ড দিতে দেখেছি। বাইরে থেকে দেখলে যাদের ভালো ছেলে বলে মনে হবে এমন আর্মি অফিসারদের আমি এক জায়গায় বসে প্রত্যেকের শিকারের সংখ্যা সম্পর্কে গালগল্প করতে দেখেছি এবং সর্বাধিক সংখ্যক বাঙালি হত্যাকারীকে গর্ববোধ করতে দেখেছি।’
কিশোরগঞ্জের আটটি থানার দুশো বর্গমাইল এলাকা মুক্তঃ শহর অবরুদ্ধ
কিশোরগঞ্জ মহাকুমার প্রায় ২০০ বর্গমাইল এলাকা সম্পূর্ণ মুক্ত হয়েছে এবং উক্ত এলাকার উপর মুক্তিবাহিনীর পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। মুক্তিযোদ্ধারা খাস কিশোরগঞ্জ শহর অবরোধ করে রেখেছে। যে কোন মুহূর্তে কিশোরগঞ্জ শহর পাকহানাদারদের কবলমুক্ত হবে বলে আশা করা যাচ্ছে। মুক্তিবাহিনী কিশোরগঞ্জ, পাকুন্দিয়া, হোসেনপুর, ইটনা, অষ্টগ্রাম, করিমগঞ্জ এবং নিকলী প্রভৃতি আটটি থানা এলাকা মুক্ত করেছে।
গত মঙ্গলবার মুক্তিবাহিনীর যমুনা নদীর ওপরে জামালপুর ফেরি ধ্বংস করে দিয়েছে। উক এলাকায় অস্ত্রশস্ত্রসহ রাজাকার ও পাকসেনা মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বন্দি হয়েছে।
চট্টগ্রামে দু’খানা অয়েল ট্যাংকার বিনষ্ট
বাংলাদেশের দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা শত্রুর উপর আরেকটি প্রচন্ড আঘাত হেনেছেন। গত বুধবার (৩রা নভেম্বর) তারা চট্টগ্রাম বন্দরে আরেকখানা অয়েল ট্যাংকার ডুবিয়ে দিয়েছেন।
মুক্তিবাহিনীর ডুবুরিদের হাতে চট্টগ্রাম ও মংলা বন্দরে পরপর কয়েক খানা পাকিস্তানি ও বিদেশি জাহাজ নিমজ্জিত ও বিনষ্ট হওয়ার পর সামরিক চক্র ওই দুটো বন্দরে করা সামরিক পাহারার ব্যবস্থা করেছিল। কিন্তু বাংলার স্বাধীনতার সূর্য সৈনিক রা তাদের চোখে ধুলো দিয়ে সর্বশেষ অয়েল ট্যাংকারটি নিমজ্জিত করে দিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর ডুবুরিরা অয়েল ট্যাংকারে মোট তিনটি বিস্ফোরণ ঘটিয়েছেন। ঢাকায় নিয়োজিত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের লাট-বেলাটরা মুক্তিবাহিনীর এই অসমসাহসিক কাছে নেহায়েত ঘাবরিয়ে গিয়েছে। তারা সরকারিভাবে এই অয়েল ট্যাংকার ডুবির কথা স্বীকারও করেছে। তবে চিরাচরিত পদ্ধতিতে কাজটা ভারতীয় এজেন্ট দের বলে চালিয়েছে। এই তথাকথিত সরকারি কর্তার জানিয়েছেন যে অল জানকারি সাত জন নাবিক নিখোঁজ হয়েছে এবং অপর দশ জন আহত হয়েছে।
ঘটনার বিবরণে জানা যায় প্রায় দশ হাজার টনের এই অয়েল ট্যাংকারটিতে গত বুধবার সকালে আধঘন্টা পর পর দুটো বিস্ফোরণ ঘটে। ফলে সমগ্র ট্যাংকারে আগুন ধরে যায়। তখন অগ্নিনির্বাপক দল ও নাবিকরা আগুন নেভানোর কাজে আত্মনিয়োগ করে। ঠিক এই সময় প্রচণ্ড শব্দ করে আরেকটি বিস্ফোরণ ঘটে এবং অগ্নিনির্বাপকে নিযুক্ত সমস্ত লোকজন জাহাজ থেকে সমুদ্রে নিক্ষিপ্ত হয়। তারপর ট্যাংকারটি জ্বলতে জ্বলতে পানিতে ডুবে যায়।
ঢাকা তথাকথিত সরকারি মহল ট্যাংকারটির নাম “মাহতাব জাবেদ” বলে জানিয়েছে। কিন্তু লয়েডস শিপিং কোম্পানির তালিকা অনুযায়ী অনুরূপ কোন জাহাজ নাই। তবে পাকিস্তানের অনুরূপ দু’খানা ট্যাংকার রয়েছে। তার একটি নাম হল “মাহাতাব জাবেদ” -এর মালিক হচ্ছে ইস্টার্ন পাকিস্তান কমার্শিয়াল কর্পোরেশন। অপরটির নাম হচ্ছে “মাহাতাব জাবেদ-২” । এটির মালিক হচ্ছে পাকিস্তান ট্যাংকার্স কোম্পানি। দু’খানাতেই দশ হাজারের মত তেল ধরে।
প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে, গত সপ্তাহে বাংলার বীর মুক্তিযোদ্ধারা চট্টগ্রাম বন্দরে আর একখানা অয়েল ট্যাংকার ক্ষতিগ্রস্ত করেছে। সে ট্যাংকারটি ছিল গ্ৰীক মালিকানাধীন।
বিদেশি সাংবাদিকের দৃষ্টিতে ইয়াহিয়াদের কথা ও কাজ!
জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্র বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত করার উদ্দেশ্যে ‘ক্ষমা ঘোষণা’, স্বাভাবিক অবস্থা, পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও সামরিক সরকারের বড় বড় বুলি আওড়ালেও আসলে এগুলো যে সবই ফাঁকা। এর কোনটিই বাস্তবায়নের ইচ্ছা তার বা তার সামরিক চক্রের নাই।
এসব প্রশ্নে ইয়াহিয়া চক্রের মুখোশ উন্মোচন করে দিয়েছেন। লন্ডনের বিখ্যাত গার্ডিয়ান পত্রিকার ঢাকাস্থ প্রতিনিধি মার্টিন উলাকট। তিনি অতি সম্প্রতি ঢাকা ত্যাগ করেছেন।
তিনি লিখেছেন বাংলাদেশের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে ইসলামাবাদ পাকিস্তান সরকার অনেক কথা বলছেন। তাদের আন্তরিক ও তাতে সন্দেহ প্রকাশ না করেও বলা চলে যে, বাংলাদেশের এখনো হিংসাত্মক কার্যকলাপের জোর-জবরদস্তির রাজত্ব পুরোদমে চলছে। তবে এর সবকিছুই যে সেনাবাহিনীর করছে তা নয়, কেননা পুরা সেনাবাহিনী এখন ভারতীয় আক্রমণ প্রতিরোধের জন্য সীমান্তের দিকে বন্দুক তাক করে আছে। দেশের আভ্যন্তরীণ ভাগে এখন অতি কম সংখ্যক সৈন্য আছে।
কিন্তু সেনাবাহিনী সীমান্ত চলে গেলেও তারা পেছনে রেখে গেছে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও রাজাকার দল। জনসাধারণ ও অবশিষ্ট হিন্দুদের প্রতি তাদের বিদ্ধেষ সর্বজনবিদিত। তারা খেয়ালখুশিমতো এতদিন সেনাবাহিনীর যা করেছিল তাই করে চলছে। আর সামরিক আইন প্রশাসন তা দেখেও দেখছে না।
মার্টিন উলাকট লিখেছেন, পিন্ডির কর্তৃপক্ষের স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনার ব্যবস্থা পুলিশ যদি আন্তরিক ও প্রতারণাপূর্ণ হতো তাহলেও এই পুলিশ ও রাজাকাররা শহরে-বন্দরে গ্রামে বিষাক্ত আবহাওয়া রাখার পক্ষে যথেষ্ট ছিল, এমনই এদের চরিত্র।
তিনি লিখেছেন সম্প্রতি আমি ঢাকার উত্তরে একটি এলাকা সফর করি-এলাকায় তার নাম প্রকাশ করলে সেখানকার অধিবাসীদের উপর বিপদ নেমে আসতে পারে বিধায় আমি নাম প্রকাশ করলাম না। আমার সেখানে যাওয়ার পূর্ববর্তী এক সপ্তাহে রাজাকারেরা এক গ্রামে ৯ জন হিন্দুকে এবং অপর গ্রামে ১২ জনকে নেহাত অন্যায় ভাবে গুলি করে মেরেছে।’
মাইকেল উলাকট লিখেছেন, সাম্প্রতিককালে বাংলাদেশের হত্যার সংখ্যার, নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ এর সংখ্যা অনেক বেড়ে গেছে। তার মতে ভয় দেখিয়ে টাকা আদায়ের একটা কৌশল হচ্ছে লোকজনকে গ্রেফতার করা। গ্রেপ্তারের পর পণ হিসেবে পাঁচিশ বা হাজার টাকা আদায় করে এদের ছেড়ে দেওয়া হয়। এমনকি ক্ষেত্র বিশেষে দেখা গেছে যে, আত্মীয়-স্বজনের কাছ থেকে টাকা আদায় হওয়ার পর জেলখানা থেকে গ্রেপ্তারকৃত লোক ছাড়া পেয়ে গেছে।
তিনি লিখেছেন, বাংলাদেশের পুলিশের আগে হয়তো ফেরেশতা ছিল না এ কথা ঠিক ; কিন্তু বর্তমানে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও রাজাকাররা পুলিশের দুর্নীতি মূলক ব্যবস্থা গুলিকে বহুগুণে কার্যকর করে তুলেছে। একজন বিদেশি নাগরিকের বরাত দিয়ে সাংবাদিক উলাকট লিখেছেন, ২৫ শে মার্চের পূর্ববর্তী বারো মাসে একটা এলাকায় যেখানে মাত্র তিনটি নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছিল; পশ্চিম পাকিস্তানের পুলিশ ও রাজাকাররা সেখানে নারী ধর্ষণের ঘটনা ঘটিয়েছে তিন মাসে অন্ততঃ ১৫ টি।
রাজাকার দলের গঠন ও চরিত্র বর্ণনা করতে গিয়ে সাংবাদিক উলাকট লিখেছেন, সমাজের অত্যন্ত দরিদ্র শ্রেণীর লোকজন গুন্ডা চোর বদমাশদের নিয়ে গঠন করা হয়েছে রাজাকার দল। তবে মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা এদেরকে নিষ্ঠুর কাজকর্ম থেকে কিছুটা সংযত রেখেছে। মুক্তিবাহিনীর প্রতিশোধ এর ফলে ইচ্ছা থাকলেও সব সময় সব কিছু করতে সাহস পায় না। তিনি লিখেছেন, সামরিক শাসন ব্যবস্থা এবং তার অংশবিশেষ পুলিশ ও রাজাকারদের অনুরূপ দস্যুবৃত্তি মানুষকে ইসলামাবাদের স্বাভাবিকতার কপটতা সম্পর্কে অতিমাত্রায় সন্দিগ্ধ করে তুলেছে। তার মতে ইসলামাবাদের এই স্বাভাবিকতারদাওয়াই যে আসলে চাতুরীপূর্ণ কাজ তাতে কোন সন্দেহ নাই।
টিক্কা খানের বরখাস্ত এবং ডাক্তার মালিকের তদস্থলে সিভিলিয়ান গভর্নর নিয়োগ সম্পর্কে মার্টিন উলাকট লিখেছেন, বাহ্যত ব্যাপারটাকে সঠিক পথে একটি সঠিক পদক্ষেপ আসলে কিন্তু তা নয়। কেননা, একজন বাঙালি ভাষ্যমতে ডাক্তার মালিক হচ্ছেন এমন একজন সার্ভেন্ট যিনি সবসময় শুধু তারাই করেছেন ইসলামাবাদের প্রভুরা তাকে যা করতে বলেছেন। অর্থাৎ ডাক্তার মালিক হচ্ছেন একজন পোঁ ধরা মানুষ। ব্যক্তিসত্তা বলে তার কিছুই নাই। চাকুরীর মোহে কর্তার নামে কীর্তন করাই তার চিরকালের অভ্যাস।
তিনি আরো লিখেছেন ডাক্তার মালিক এমন একজন গভর্নর যিনি নিজে ইচ্ছা করলেও সবকিছু করতে পারেন না। কেননা একজন পাশ্চাত্য কূটনীতিকদের মতে প্রশাসন ব্যবস্থার অংশগুলোকে কাজে খাটাতে পারলে তিনি হয়তো কিছু করতে পারতেন কিন্তু সেই অংশগুলো আদৌ কাজ করছে না। অর্থাৎ বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা বলতে কিছুই নাই এবং কোন বাঙালি কর্মচারী প্রশাসনের সঙ্গে সহযোগিতা করছেন না।
সাংবাদিক উলাকট লিখেছেন, ঢাকা থেকে বলা হয় একরকম কিন্তু স্থানীয়ভাবে অধস্তন স্তরে করা হয় ভিন্ন রকম। নিম্নস্তরের সামরিক অফিসার রা ঢাকার আদেশ-নির্দেশ বহু ক্ষেত্রেই আমলে নেয় না। হিন্দু ও অন্যান্য সন্দেহভাজন পরিবারগুলোকে নিধণ, সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শন প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে একথা প্রযোজ্য। গত সপ্তাহ বা অনুরূপ সময়ে উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে কিছু কিছু লোককে মুক্তি দেওয়া হয়েছে। কিন্তু স্থানীয় পর্যায়ের কর্তারা এটা আদৌ পছন্দ করেনা। যেমন ময়মনসিংহের একজন পশ্চিম পাকিস্তানী সিনিয়র পুলিশ অফিসার বলেছেন ‘ইয়াহিয়ার পক্ষে অফিসে বসে ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা খুবই সহজ। কিন্তু আমরা যারা কর্মক্ষেত্রে আছে তাদের কাছে এটা আদৌ সঠিক নীতি নয়।’
উপনির্বাচন সম্পর্কে মার্টিন উলাকট লিখেছেন, এসব উপনির্বাচনে বাঙ্গালীদের মত প্রকাশের কোনো সুযোগ নাই, কেননা বর্তমানে একদিকে জামাতে ইসলাম ও পিডিপির নেতৃত্বাধীন প্রতিক্রিয়াশীল দক্ষিণপন্থী দলগুলোর সাথে তথাকথিত ইসলামী গণতন্ত্রবাদী পিপলস পার্টির নির্বাচনী যুদ্ধ চলছে তাতে বাঙ্গালীদের কিছুই করনীয় নাই। এর প্রতিটি দলকে গত নির্বাচনে তারা আস্তাকুড়ে নিক্ষেপ করেছে।
তিনি লিখেছেন, ইয়াহিয়ার উদ্যোগগুলো যদি আন্তরিক এই হত তাতেও কিছু আসতো- যেত না। কেননা, বাংলাদেশে বর্তমানে যে অবস্থা তাতে ৩৫ বছরের উর্ধ্বে বয়স্ক দু-চার জন লোককে পাকিস্তানের কাঠামোতে বাংলাদেশকে স্বায়ত্তশাসিত অঞ্চল হিসেবে রাখার পক্ষপাতী পাওয়া গেলেও ৩৫ বছরের নিম্নবয়স্ক কাকেও পাওয়া যাবে না। তারা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুতেই বিশ্বাস করে না।
সাংবাদিক মার্টিন উলাকট লিখেছেন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপক আমাকে বলেছেন, আমরা চার ভাই এবং আমাদের কেউই মুক্তিফৌজে যায়নি। কিন্তু আমাদের দু’বোন প্রতিদিন প্রতিমুহূর্ত আমাদের উপর পীড়াপীড়ি করছে, যাতে অন্ততঃ আমাদের একজন মুক্তিফৌজে যায়।’
মার্টিন উলাকটের মতে বাংলাদেশের প্রতিটি ঘরে আজ একই মনোভাব। উক্ত লেকচারার তাকে আরো বলেছেন, আমি শুধু এই জন্য বেচে আছি যে, একদিন আমরা স্বাধীন হব। অন্যথায় বর্তমান অবস্থায় ও পরিবেশে বেঁচে থাকার কোন সার্থকতা ছিলনা।’
ঢাকার মুক্তিবাহিনীর ক্রমবর্ধমান গেরিলা আক্রমণ সম্পর্কে তিনি বলেন, সম্প্রতি মুক্তিবাহিনী বেশ কয়েকবার একেবারে ঢাকার অভ্যন্তরে উপর্যুপরি আক্রমণ পরিচালনা করে এবং বোমা ব্যবহার করে। ঢাকার দয়াগঞ্জ এলাকায় মুক্তি বাহিনীর একটি দল রাজাকার এবং পুলিশ বাহিনীর ওপর আক্রমণ করলে একজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ নিহত হয়।
দুই ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী প্রচুর ক্ষতি সাধন করে পালিয়ে যেতে সক্ষম হয়। ১৩, ১৪ বছর বয়স্ক হতবুদ্ধি রাজাকারেরা মুক্তিবাহিনীর পুনঃ আক্রমণের আশঙ্কায় প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করে।
গত কয়েক সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী ব্যাংক, স্কুল এবং বিশ্ববিদ্যালয় ভবনে বোমা বিস্ফোরণ করে এবং সফলতা সঙ্গে ঢাকা বিমান ঘাঁটিতে মর্টার আক্রমণ পরিচালনা করে।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও জাতীয় পুনর্গঠন
(অর্থনৈতিক ভাষ্যকার)
পাক হানাদার বাহিনীর কবল থেকে বাংলাদেশের অবশিষ্ট দখলীকৃত এলাকা মুক্তির কাল আসন্ন, বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনের খবর থেকে আমার একটা প্রত্যাশা সকলের মনে জেগেছে।
দেশপ্রেম, আত্মবিশ্বাস ও উন্নততর রণকৌশল এবং দেশের মাটির সঙ্গে নারীর সংযোগের মুক্তিবাহিনীকে চূড়ান্ত বিজয়ের তোরণদ্বারে পৌঁছে দিতে পেরেছে।
তবে রণাঙ্গনের খবর নয়, বর্তমান নিবন্ধে আমার আলোচ্য বিষয় স্বতন্ত্র। মাতৃভূমির আসন্ন মুক্তি সম্ভাবনাকে সামনে রেখে যে প্রশ্ন টি ইতিমধ্যে অনেকের মনে জাগছে তা হচ্ছে হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ ও যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলাদেশকে কত দ্রুত পুনর্গঠন করা যাবে এবং পূনর্গঠনের জন্য আমাদের কোন বস্তুটির প্রয়োজন সবচেয়ে বেশি। একটিমাত্র বাক্যে এই প্রশ্নের উত্তর দেয়া যায়। জনগণের দেশপ্রেম ও সর্বস্তরের পূর্ণ দ্রুত পুনর্গঠন এর প্রাথমিক শর্ত।
মুক্তিসংগ্রামকে চূড়ান্ত বিজয়ের পথে নিয়ে যাবার জন্য উপরোক্ত দুটি উপাদানের যেমন প্রয়োজন হয়েছিল, জাতীয় পুনর্গঠন ও দেশকে দ্রুত সুদৃঢ় ও অর্থনৈতিক ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার জন্য ওই দুটি উপাদানের প্রয়োজন তার চেয়ে কিছু কম নয়। ওটা মুক্তিসংগ্রামের সফল পরিসমাপ্তিরই যুক্তিসংগত পরবর্তী ধাপ।
জাতীয় মুক্তিসংগ্রাম দেশের মানুষকে যেমন উদ্বুদ্ধ ও ঐক্যবদ্ধ করতে পেরেছে তেমনি অর্থনৈতিক নীতি ও সম্পদের সুষম বন্টন দেশের মানুষকে জাতীয় পুনর্গঠন এর ক্ষেত্রে বৈপ্লবিক প্রেরণায় উদ্বুদ্ধ করতে সমর্থ হবে। আওয়ামীলীগের ম্যানিফেস্টো খসড়া কর্মসূচিতে তার সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে। কাজের জাতীয় পূনর্গঠনের জন্য যে মানবিক উপাদানগুলোর প্রয়োজন সেই উপাদানের কোন অভাব হবে না সে সম্পর্কে আমরা স্থির নিশ্চিত। কিন্তু মানবিকে উপাদান ছাড়াও যে অর্থনৈতিক সম্পদ ও সংহতির প্রশ্ন এর সঙ্গে জড়িত রয়েছে স্বাধীনতা পরবর্তী অধ্যায়ে জাতীয় পুনর্গঠনের ব্যাপারে সে সম্পর্কেও বিশেষভাবে আলোচনা করার প্রয়োজন রয়েছে।
এ প্রসঙ্গটি সার্থক আলোচনার পূর্বে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাব্যতা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে প্রথমে আলোচনা করে নেবার প্রয়োজন রয়েছে। এ সম্পর্কে ইতিপূর্বেও বিচ্ছিন্নভাবে কিছু কিছু আলোচনা যে না হয়েছে তা নয়, তবু জাতীয় পুনর্গঠন এর প্রশ্ন কে সামনে রেখে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা ও সম্ভাবনা সম্পর্কে আরও কিছু আলোচনার অবকাশ আছে।
কিছু কিছু মানুষ এখনো আছেন যারা অনেক সময় প্রশ্ন করেন যে, আমাদের এই রাষ্ট্রের ছোট্ট পরিসরে অগুনতি মুখে খাদ্যের যোগান দিতে হবে। কাজে দেশের পক্ষে অর্থনৈতিক দিক থেকে টিকে থাকা ও এগিয়ে যাওয়া কি সম্ভব হবে? এ প্রশ্ন যারা করেন তারা অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের অর্থনৈতিক ইতিহাস জানেন না,, নয়তো মানসিক দিক থেকে পুরোপুরি সংশয়বাদী। তারা পাকিস্তানের বিলুপ্তির পূর্বেকার অর্থনৈতিক বিন্যাসকে সাধারণ দৃষ্টিতে দেখেছেন কিন্তু তার কার্যকারণ এবং তাৎপর্য অনুধাবন করার চেষ্টা করেননি। তা করলে বুঝতে পারতেন যে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের গোড়াতে এই কার্যকারণই প্রচন্ডভাবে কাজ করেছে, নিছক ভাবাবেগ দ্বারা পরিচালিত হননি।
বিলুপ্তির পূর্বেকার পাকিস্তানের যে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অক্টোপাশের শুর দেখে আমাদের অনেকের মনে উপরোক্ত সংশয় জাগে সেই অক্টোপাস টি আসলে বেড়ে উঠেছে বাংলাদেশের সম্পদ গ্রাস করে। এক কথায় বলতে গেলে পশ্চিম পাকিস্তান বাংলাদেশের অর্থনীতিকে বাঁচিয়ে রাখতে সাহায্য করেনি। বরং বাংলাদেশই নিজেকে রিক্ত করে পশ্চিম পাকিস্তানের এ বিপুল অর্থ ও শিল্প সম্পদকে গড়ে তুলেছে। বাংলাদেশ দীর্ঘ ২৩ বছর ধরে নিজের রক্ত দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানকে গড়ে তুলতে বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক পরাধীনতার শিকলে আবদ্ধ থাকায়। কাজেই পশ্চিম পাকিস্তানের বোঝা বহনের দায় থেকে মুক্ত, দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ অনেক সহজে এবং আরো ভালো ভাবে নিজেকে সমৃদ্ধ পথে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবে।
যারা বাংলাদেশের অর্থনৈতিক সম্ভাবনা সম্পর্কে কিছুটা দ্বিধাগ্রস্ত আপাতঃদৃষ্টিতে প্রধানত দুটি লক্ষণ দেখে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। সেই কারণের একটা হল বাংলাদেশের ঘনবসতি। মাত্র ৫৫ হাজার ১২৬ বর্গমাইল এলাকা সাড়ে সাত কোটি লোকের বাস। সম্ভবত বাংলাদেশই পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতি এলাকা। এই ছোট পরিসরে অগুনতি মানুষ যেন কোনোক্রমে হামাগুড়ি দিয়ে চলেছে। তার উপর প্রাকৃতিক দুর্যোগের পৌনঃপুনিক আঘাত। দ্বিতীয় কারণ হলো বাংলাদেশের অর্থনীতির পশ্চাৎপদতা। এই অর্থনৈতিক পশ্চাৎপদতাকেই তারা পশ্চিম পাকিস্তানের উপর বাংলাদেশের অর্থনৈতিক নির্ভরশীলতা বলে ভুল করছেন। কিন্তু এ কথাটা মনে রাখা প্রয়োজন রয়েছে যে গত ২৩ বছরে বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তানের সমৃদ্ধির জন্য বিভিন্নভাবে কমপক্ষে পাঁচ থেকে ছয় হাজার কোটি টাকার যোগান দিতে বাধ্য হয়েছে।
মানবতার মৃত্যু নাই
বিশ্বে নরপশু সংখ্যা এবং পাশবিক শক্তির তান্ডব বৃদ্ধি পেলেও বিশ্ব মানবতা আজও মরেনি। কোনদিন মরবে না। বরং চূড়ান্ত পর্যায়ে পাশবিক শক্তির বিরুদ্ধে এই মানবতারই জয় হবে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন গোপনে বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনা এবং সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতার সংগ্রাম বানচাল করার জন্য ইয়াহিয়ার মত নরপশুদের আর্থিক সাহায্য দিলেও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ কিন্তু বাংলাদেশের জনগণের পক্ষে। সে দেশের প্রতিনিধি পরিষদ ও সিনেট সদস্য সহ প্রায় সমস্ত গণ্যমান্য নেতৃবৃন্দই বাংলাদেশের প্রতি তাদের সমর্থনের কথা জানিয়েছেন।
এ ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ছাত্র সমাজ ও পিছিয়ে নেই। বরং তারা যে এ ব্যাপারে কত দূর এগিয়ে গেছে সামান্য ছোট একটা সংবাদ থেকেই তার প্রমাণ মেলে।
খবরে বলা হয়েছে যে গত ৩রা নভেম্বর মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৭০০ কলেজ ও ১২হাজার স্কুলের ছাত্রছাত্রীরা ভারতে অবস্থানরত বাঙালি শরণার্থীদের প্রতি সহানুভূতির নিদর্শন স্বরূপ দুপুরের খানা খায়নি।
অক্সফাম আমেরিকার শিক্ষা ডিরেক্টর সিনথিয়া ডিগল জানান যে ছাত্রছাত্রীরা তাদের দুপুরের খানার অর্থ বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য পাঠাবে।
ইতিপূর্বে অনুরূপ ধরনের আরো একটি খবর প্রচারিত হয়েছিল। তাতে বলা হয়েছে যে নিউইয়র্ক একদল লোক বাংলাদেশের শরণার্থীদের সমর্থনে একটা অভিনব অভিযান শুরু করেছে। ভারতে অবস্থানরত লাখো লাখো বাঙালীর শরণার্থীদের করুণ অবস্থার চিত্র টি জনগণের কাছে তুলে ধরার জন্য শরণার্থীরা যা খায় সেভাবে খানা খেতে শুরু করে, শরণার্থীরা যেভাবে বসবাস করে তারাও সেভাবে খোলা ময়দানে বসবাস করতে শুরু করে এবং শরণার্থীরা যে ধরনের ছেঁড়া কাপড় চোপড় পরে তারাও সেইরকম ছেঁড়া কাপড় চোপড় পড়তে শুরু করে। তাদের অভিযানের আসল উদ্দেশ্যটা হল শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশার প্রতি নিক্সন সরকার ও মার্কিন জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণ করা।
একই ধরনের খবর অতি সম্প্রতি অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরা থেকেও এসেছে। সেখানে এক কবি বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহের উদ্দেশ্যে অনুসরণ করেছেন এবং রাজপথে দাঁড়িয়ে দানশীল ব্যক্তিদের কাছ থেকে অর্থ আদায় করেছেন। অস্ট্রেলিয়া সরকার আইন ভঙ্গের অজুহাতে তাকে জেলে পাঠিয়েছে। কিন্তু জেল থেকে বের হয়েই কবি আবার অনশনের মাধ্যমে অর্থ সংগ্রহের কাজ শুরু করেছেন।
ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লিতেও এক কবি রাজপথে গান গেয়ে জনগণের কাছ থেকে শরণার্থীদের জন্য অর্থ সংগ্রহ করেছেন।
মানবতার আবেদন আর আহ্বান সমাজের কোনো বিশেষ স্তরের মানুষের মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয় একথা প্রমান করেছে ভারতের বোম্বাই শহরের জুতো পালিশ ওয়ালা বালকেরা, যাদের জীবন বলতে গেলে নিত্য ভিক্ষা তনু রক্ষার জীবন। তাদের তিরিশ জনের একটি দল গত বৃহস্পতিবার মহারাষ্ট্রের রাজ্যপালের হাতে দিনের রোজগার নগদ আড়াই হাজার টাকা তুলে দিয়েছে।
শতাব্দীর শিল্পী পাবলো পিকাসো
(সাংস্কৃতিক ভাষ্যকার)
এই সময় ইউরোপের শিল্পীরা ছবি আঁকতেন, মূর্তি গড়তেন বাস্তব জগতের আকার-আকৃতির অনুকরণে। কিন্তু ক্যামেরা আবিষ্কারের সাথে সাথে অনেক শিল্পীর মনে প্রশ্ন জাগে স্বভাবের অনুকরণে ছবি আঁকা সম্পর্কে। তারা বলতে থাকেন শিল্পীর আঁকা ছবিকে হতে হবে এমন যেটা হবে তার নিজের গুণেই আবেদনময়, কোন কিছুর প্রতি ভূ হিসাবে নয়। নানাভাবে বাস্তব জগতের বিভিন্ন বস্তুর আকার আকৃতিকে নানাভাবে সাজিয়ে-গুছিয়ে, পরিবর্তিত করে ছবি আঁকা ও পরে মূর্তি গড়ার প্রচেষ্টায় চলে। ফলে শিল্পকর্ম সাধারণ মানুষের কাছে মনে হতে থাকে হেঁয়ালি। পিকাসোর অনেক শিল্পকর্মের আবেদন সেই সাধারণ মানুষের কাছে। এসব জানবার ও বুঝবার জন্য আর বার দরকার করে, বিশেষজ্ঞরা বলেন, বিশেষ মানসিক প্রস্তুতির।
পিকাসোর শিল্পকর্মকে কয়েকটি পর্বে ভাগ করা যায়ঃ নীল রঙের যুগ, গৈরিক রঙের যুগ, কিউবিষ্ট শিল্পকর্মের যুগ ও মূর্তি আকার-আকৃতির বা ফর্মের যুগ।
নীল রঙের যুগ হলো শিল্পী পিকাসোর প্রথম যুগ। এ সময় বিশেষভাবে নীল রঙের প্রাধান্য দিতেন। এসব ছবিতে তিনি মানুষের দৈহিক আকার-আকৃতি অনেক সরল করে এঁকেছেন। গড়নের খুঁটিনাটি বাদ দিয়েছেন। কিন্তু বিশেষভাবে বিকৃত করেননি। এর মধ্যে আছে একটা করুণ রসের আবেদন। এ সময় পিকাশো ছবি এঁকেছেন তার শিল্পী বন্ধুদের, ভবঘুরেদের ও নানা কাজে লিপ্ত তার আশেপাশে দেখা মানুষদের।
এর পরবর্তী যুগে তার ছবিতে গৈরিক রঙের প্রাধান্য দেখা যায়। এসব ছবিতেও পিকাসো মানুষের দেহের ও গঠন এর খুঁটিনাটি বাদ দিয়ে ছবি এঁকেছেন। তবে নীল রঙের স্থানে প্রাধান্য পেয়েছে গৈরিক রং। আর ছবিতে কেটে গিয়েছে আগের বিষাদময়তা। তার জায়গায় দেখা দিয়েছে আগের ফুর্তির ভাব। এসময়ের ছবিতে পিকাচু যেসব মহিলার ছবি এঁকেছেন, তাতে প্রাধান্য লাভ করেছে দৈনিক আবেদন। স্থূলকায় মহিলাদের ছবি তিনি এ সময় এঁকেছেন অনেক।
কিউবিষ্ট যুগে পিকাসোর ছবি এঁকেছেন জ্যামিতিক আকার আকৃতির উপর প্রাধান্য দিয়ে। ত্রিভুজ, বৃত্ত, জ্যামিতি, সরলরেখা ইত্যাদি প্রাধান্য পেয়েছে তার ছবিতে। মানুষের দেহের আকৃতি কে তিনি পরিবর্তিত করেছেন নানাভাবে। যা দেখে মনে হয় ওরা বাস্তব জগতের মানুষ নয়, কলকব্জায় গড়া মানুষ।
এর পরবর্তী যুগে পিকাসো পরিচয় দিয়েছেন ব্যবচ্ছেদবাদী মনোভাবের। তিনি মানুষের ও অন্যান্য বস্তুর বিভিন্ন অংশের আকার আকৃতি গুলিকে পৃথক করে নিয়ে তাদের ইচ্ছামতো সাজিয়ে ছবি এঁকেছেন। তিনি একটি মানুষের নানা দৃষ্টিকোণ থেকে দেখে সবগুলি দৃষ্টিকোণকে একত্র করে ছবি আঁকতে চেয়েছেন। এ সময় তার শিল্পকর্মে আফ্রিকার আদিম জাতির বিভিন্ন শিল্পকর্মের জন্য মনমুখোশ-এর প্রভাব ও লক্ষ্য করা যায়।
পিকাসোর বয়স নব্বই। তিনি এখনো ছবি এঁকে চলেছেন। এত দীর্ঘ দিন ধরে কোন বিখ্যাত শিল্পী এভাবে ছবি আঁকা ও অন্যান্য শিল্পকর্মের সক্রিয়তা দেখাতে পারেননি। তার আঁকা ছবির সংখ্যা একটি হিসাব মতে, ১৫ হাজার। তার ছবির গড় পড়তা বর্তমান দাম ২৫ লাখ টাকার মতো।
বিকাশে জন্মগত দিক থেকে স্প্যানিশ। কিন্তু তার শিল্পী জীবন কেটেছে ফ্রান্সে। এখন তিনি ফ্রান্সের স্থায়ীভাবে বসবাস করছেন। কয়েক বছর আগেই প্যারিসে একজন চিত্রকর কে পুলিশ গ্রেফতার করে ও পরে বিচারে তার জেল হয়। এই চিঠিটি হুবহু পিকাসোর ছবি এঁকে তাতে পিকাসোর নাম সই করে, সেই ছবি বাজারে বিক্রি করতো। অনেকেই তাঁর আঁকা ছবি কে পিকাসোর ছবি বলে কিনতো। অনেক বিশেষজ্ঞকেও বোকা বানান তিনি। তিনি এরকম ছবি এঁকে করেন টাকাও অনেক।
পিকাসোর ফ্রাঙ্কোর বিপক্ষে তার দেশের মানুষের সন্ত্রাসকে সমর্থন করেন। তিনি বলেন, শিল্পীদের উচিত উন্নত মূল্য চেতনাকে নিয়ে মানুষের সংগ্রামে শরিক হওয়া। তিনি ফরাসি কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য হন। কিন্তু পরে সদস্য পদ থেকে ইস্তফা দেন। কারণ তিনি রুশ শিল্পীদের ওপর খবরদারি অপছন্দ করেন। তার মত সমাজ ও রাষ্ট্রকে স্বীকার করতে হবে শিল্পীর স্বাধীনতা। প্রকৃত সমাজতন্ত্র কখনো শিল্পীর স্বাধীনতার পরিপন্থী হওয়া উচিত নয়।
এটা কিসের আলামত?
তবে কি পাকিস্তানের জঙ্গির শাসকগোষ্ঠীর ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে লিপ্ত হতে যাচ্ছে? এ প্রশ্ন আজ অনেকের মনেই দেখা দিয়েছে।
বাংলাদেশ ও পশ্চিম পাকিস্তান বরাবর ভারতীয় সীমান্তে বিপুল সৈন্য, ট্যাংক, সাঁজোয়া বহর সমাবেশের পরও যারা যুদ্ধের ব্যাপারে সন্দিহান ছিলেন পাকিস্তান সরকারের কার্যক্রম এর প্রেক্ষিতে তারাও বর্তমানে পাল্টাতে শুরু করেছেন।
ইতিমধ্যে খবর পাওয়া গিয়েছিল যে পাকিস্তান সরকার তাদের নয়াদিল্লি হাইকমিশন থেকে প্রায় সমস্ত কর্মচারীকে মুহূর্তের নোটিশে পশ্চিম পাকিস্তান রওনা হবার জন্য প্রস্তুতি থাকার নির্দেশ দিয়েছে। এটা নিঃসন্দেহে পাকিস্তান সরকারের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ বাঁধাবার লক্ষণ।
দ্বিতীয়তঃ আরও খবর পাওয়া গিয়েছে যে পাকিস্তান সরকার তাদের ভারতে অবস্থিত হাইকমিশনকে সমস্ত গোপন দলিলপত্র পুড়িয়ে ফেলার নির্দেশ দিয়েছে। তদনুযায়ী পাক হাইকমিশনার সমস্ত গোপন দলিল পত্র পুড়িয়ে নষ্ট করে দিচ্ছে। এটাও যুদ্ধ বাড়াবাড়ি লক্ষণ বলে ওয়াকেফহাল মহল মনে করেন। এছাড়া এটা আর কিসের আলামত হতে পারে?
বিশ্ব মুরুব্বিদের ভূমিকা ও বাংলাদেশ
(মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী)
অবশেষে থলির বিড়াল বের হয়ে পড়েছে। আর সাথে সাথে বিড়ালগুলো রূপ-রঙ সবই প্রকাশ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশের নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সদস্যপদ কলমের এক খোঁচায় নাকচ করে দিয়ে, জল্লাদ নায়ক, দস্যু সর্দার, জেনারেল আগা ইয়াহিয়া খান তদস্থলে উপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের একটা মহড়া দেখাচ্ছিলেন। তদানুযায়ী ৭৮টি তথাকথিত শূন্য আসনে উপনির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়েছিল। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, ৭৮টি শূন্য আসনের মধ্যে ৫২টিতে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে গেছে। অবশিষ্ট আসনগুলোর মধ্যে আরও ২৩টিতে প্রার্থীরা বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হয়ে যেতে পারে বলে জানা গেছে।
২৫শে মার্চের পর, বাংলাদেশের ব্যাপারে পশ্চিম পাকিস্তানের সরকারের হস্তক্ষেপের কোন আইনগত বা নৈতিক অধিকার নাই, একথা বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিশীল সরকার বারংবার ঘোষণা করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী, পররাষ্ট্র মন্ত্রী একথা সুস্পষ্ট ভাবে ঘোষনা করেছেন যে, বাংলাদেশের মানুষের ভোটে নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সদস্যপদ বাতিলের ক্ষমতা ইয়াহিয়া জঙ্গী সরকারের নাই এবং সেখানে উপনির্বাচনের কোন এখতিয়ার ও তাদের নাই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। তার নিজস্ব সরকার আছে, পার্লামেন্ট আছে এবং সেনাবাহিনী (মুক্তিবাহিনী) আছে।
জঙ্গী চক্রের পুরোধা আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান যে এটা জানেন না তা নয়। তিনি সবই জানেন। তিনি এটাও জানতেন যে তার সরকার বাংলাদেশের ৭৮টি তো দূরের কথা, একটিতেও নির্বিঘ্নে ভোট গ্রহণের ব্যবস্থা করতে পারবেন না। কেননা, বাংলার মুক্তিপাগল তরুণেরা নিজেদের রক্ত ঢেলে ইয়াহিয়ার নির্বাচন বানচাল করতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। তাই বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন সমাধার ব্যবস্থা।
প্রশ্ন হলো, নির্বাচনের নামে তামাশার কারণ কি? সে কারণ অতি গভীর! বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির সংগ্রাম বানচালের যে বহুরূপী চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র চলছে, এটা তারই অঙ্গ। নিজেদের সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থ ও বিশ্ব স্ট্রাটেজির স্বার্থে বিশ্ব শান্তি ও গণতন্ত্রের তথাকথিত কতিপয় মুরুব্বী-এর পিছনে রয়েছে।
প্রথমে এই তথাকথিত শান্তি ও গণতন্ত্রের মুরুব্বিদের কথাই বলা যাক। এরা নাকি গণতন্ত্র ও মানবতার খাতিরেই হিটলার ও মুসোলিনির ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে। কিন্তু হিটলারের প্রেতাত্মা ইয়াহিয়া খান যখন তারা সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে বাংলাদেশের ইতিহাসের বৃহত্তম গণহত্যা সংঘটন করেছে, বাংলাদেশের শত সহস্র শহর-বন্দর গ্রামকে জ্বালিয়ে-পুড়িয়ে খাঁক করেছে, লাখো লাখো মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে ছিনিমিনি খেলেছে, সর্বোপরি লাখো লাখো মানুষকে চৌদ্দ পুরুষের ভিটা মাটি ছাড়া করে সীমান্তের ওপারে ঠেলে দিয়েছে, তখন কিন্তু এই তথাকথিত গণতন্ত্র ও মানবতা প্রেমিকদের মধ্যে কোন প্রতিক্রিয়া দেখা যায়নি। এরা নীরবে সবকিছু অবলোকন করে গেছে। এমনকি, কেউ কেউ অস্ত্র দিয়ে, অর্থ দিয়ে এ গণহত্যায় সহায়তা করেছে। কিন্তু শত শহীদের রক্তের কণায় কণায় জন্ম নেওয়া বীর মুক্তিযোদ্ধারা যখন নিজেদের পবিত্র মাতৃভূমিকে শত্রুমুক্ত করার এবং শত্রুর উপর প্রতিশোধ নেওয়ার ঝাঁপিয়ে পড়ল তথাকথিত মুরুব্বিরা নানা ছলনায় আসরে অবতীর্ণ হওয়ার প্রয়াস পেল। এদের কেউ কেউ ইয়াহিয়া চক্রকে যেনতেন প্রকারে একটা নির্বাচন অনুষ্ঠান করে বাংলাদেশে একটা সিভিলিয়ান সরকার খাড়া করার বুদ্ধি যোগায়। ইয়াহিয়ার এই তথাকথিত নির্বাচনের প্রহসন তারই ফলশ্রুতি।
ওদিকে মুরুব্বিরা মুক্তিযোদ্ধাদের মধ্যে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করার উদ্দেশ্যে এগিয়ে আসে তথাকথিত পলিটিকাল সেটেলমেন্ট বা রাজনৈতিক সমাধানের দাওয়াই নিয়ে। কিন্তু এই সমাধান টা যে কি চীজ প্রকাশ্যে আজ পর্যন্ত কেউ তা প্রকাশ করেনি। তবু যতদূর জানা গেছে এদের এক একজনের সমাধানের তাৎপর্য এবং লক্ষ এক এক রকম। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের সবার প্রস্তাবে মিল রয়েছে, তা হলো তাদের কেউই পাকিস্তান নামীয় বস্তুটি কে ভাঙতে চান না। যদিও এটা আজ দিবালোকের মত সত্য যে, “পাকিস্তান নামীয় দুধের কলসিটা” আজ ভেঙ্গে খান খান হয়ে গেছে।
রাজনৈতিক সমাধানের ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকারের অভিমত হলো ২৫শে মার্চ যেখানে আলোচনা শেষ হয়েছিল, সেখান থেকে আলোচনা পুনঃ আরম্ভ করা। নিক্সন সাহেব নাকি এ ব্যাপারে তার বংশবদ ইয়াহিয়া খান উপর চাপ ও দিয়েছেন, কিন্তু তাতে কোনো ফল হয়নি। ইয়াহিয়া সাহেব “বিদ্রোহীর” সাথে কথা বলতে পারেন না। সে যাই হোক মার্কিন সরকার যে পাকিস্তানকে ভাঙতে চায় না এবং ভাঙ্গা পাকিস্তানকে জোড়া দিয়ে বাঁচিয়ে রাখতে চায় তা আজ আর গোপন নেই। ভারতের বিরুদ্ধে একটা স্থায়ী “কন্টক” হিসেবে যুক্তরাষ্ট্র-পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে চায়।
রক্ষণশীল দলীয় ব্রিটিশ সরকার ও পাকিস্তানকে ভাঙার বিরোধী। ৬ দফাকে হিসেবে রেখে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে তারা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান করতে চান। পাকিস্তান না থাকলে তাদের ব্যবসা-বানিজ্যের ক্ষতি হবে এটাই নাকি তাদের আপত্তির কারণ।
সোভিয়েত ইউনিয়ন ও পাকিস্তানকে এক রাখার পক্ষপাতী বলে মনে হয়। কেননা সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগর্নি নাকি সম্প্রতি ইরানেরপার্সেপোলিসে ইয়াহিয়া খানকে পাকিস্তানের কাঠামোতেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে বলেছেন।
তবে একথা সত্য যে কূটনীতির একটা কৌশল হিসেবেই সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট অনুরূপ মত ব্যক্ত করেছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের প্রশ্নের তামাশা করতে থাকলে ইউনিয়ন যে বাংলাদেশের সংগ্রামীদের পক্ষ নেবে তাতে আজ আর সন্দেহের অবকাশ নেই।
সোভিয়েত ইউনিয়নও ভারতীয় বাদ দিলে অস্ট্রিয়ার রাষ্ট্রপ্রধান ডাক্তার ক্রণক্রিয়েঙ্কিই বিশ্বের সর্বপ্রথম রাষ্ট্রপ্রধান স্পষ্টভাবে ঘোষণা করেছেন যে, শেখ মুজিবের মত একজন গণ্যমান্য গণপ্রতিনিধি কে জেলে আটকে রাখা কোনো গণতান্ত্রিক সমাজতান্ত্রিক দলই বরদাশ্ত করতে পারেনা। ওদিকে মহাচীন তো পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক সরকারকে এতদিন মধ্য দিয়ে চলেছে বলে মনে হয়। বর্তমানে তার নীতি সম্ভবতঃ পরিবর্তিত হতে চলেছে।
আমাদের করণীয় কি?
সব জেনেশুনে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি, প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ ওয়ারকিং কমিটির বারবার স্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেছেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য এবং কোন অবস্থাতেই আমরা তা থেকে বিচ্যুত হবে না। তবে তারা কেন এমন ঘোষণা করলেন? এর কারণ তারা বিশ্বের স্বাধীনতা সংগ্রামের ইতিহাস জানেন। আর জানেন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের মন মানসের খবর। তারা জানেন পরের দয়া ভিক্ষা করে বা পরনির্ভরশীল হয়ে কোন জাতীয় স্বাধীনতা ছিনিয়ে আনা যায় না। মুক্তিকামী মানুষকে ছিনিয়ে আনতে হয় তার স্বাধীনতা। কেউ দাদা করে দেয় না। তাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি আত্মপ্রসাদে বলেছেন “আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই আনতে হবে, আমাদের যুদ্ধ আমাদেরকেই করতে হবে।’ অন্য কোন দেশ সাহায্য করলো কী করলো না তার দিকে তাকালে কোন জাতির স্বাধীনতা অর্জন করতে পারে না। আর নিজের শক্তিতে বলিয়ান হয়, আত্মশক্তিতে উদ্বুদ্ধ হ’য়ে এগিয়ে চললে একটি ছোট জাতিও বড় কোন শক্তিকে হটিয়ে দিতে পারে। আলজেরিয়া, কেনিয়া, ভিয়েতনাম তার সাক্ষ্য বহন করে। মাত্র এক কোটি মানুষের দেশ আলজেরিয়া বিশ্বের বৃহৎ পঞ্চ শক্তির অন্যতম ফ্রান্সকে বাধ্য করেছিল তাকে স্বাধীনতা দিতে। আরো ছোট দেশ কেনিয়া জননায়ক জোমুকেনিয়াত্তার নেতৃত্বে দেশের তরুণ সমাজ নিজেদের রক্ত দিয়ে ব্রিটিশ কে বাধ্য করেছিল সে দেশ ছাড়তে। ভিয়েতনাম তো আমাদের সামনেই রয়েছে। মহাপরাক্রমশালী মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নাকানি চুবানি খেয়ে আজ সে দেশ থেকে পালানোর পথ খুঁজছে।
শৌর্যবীর্য ও যুদ্ধের ব্যাপারে পারদর্শিতায় বাঙালি কারো চেয়ে কম নয়। গত সাত মাসের যুদ্ধে বাঙালি তরুণরা তার প্রমাণ রেখেছে বাংলাদেশের প্রতিটি শহর-বন্দর, গ্রাম ও পথ, প্রান্তরে। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের নাম শুনলে ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের আজ হৃৎকম্প শুরু হয়। বাঙালি মুক্তিযোদ্ধারা গত সাত মাসের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সংযোজন করেছে এক নতুন অধ্যায়। ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনী আজ হতোদ্যম। যুদ্ধ করার মতো সাহস ও মনোবল আজ আর তাদের মধ্যে নাই। তদুপরি ভারতীয় সীমান্তে যুদ্ধের মহড়া করতে গিয়ে ইয়াহিয়া আজ এমন অবস্থায় পড়েছে যে তার পক্ষে মূল ভূখণ্ড পশ্চিম পাকিস্তান থেকে উপনিবেশের নতুন করে সৈন্য-সামন্ত, অস্ত্রশস্ত্র প্রেরণ ও আর সম্ভব নয়। তাই বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা যদি আর একটা ধাক্কা দিতে পারেন তাহলেই আমাদের স্বপ্নের পাকিস্তান সাম্রাজ্য ধুলোয় মিশে যাবে। দুনিয়ার কোনো শক্তিই তাকে রক্ষা করতে পারবে না। অবশেষে অবস্থায় মুরুব্বীদের কেউ ইয়াহিয়াদের শেষ রক্ষায় এগিয়েও আসবে না।
শিল্প – সংস্কৃতি
আমি
অনু ইসলাম
আমি হাঁটছি
গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে
পোড়া বারুদ আর বিস্ফোরণের
পিচ্ছিল পথ দিয়ে।
হাঁটছি একমুঠো জীবনকে
সাথে নিয়ে লাশের মিছিলের
আগে আগে।
দুপকেটে বারুত নিয়ে
আমি হাঁটছি
সাতদিন
সাতরাত।
আমার চারপাশে বারুদের গন্ধ !
আমার দুচোখে বারুদ !
আমার নিঃশ্বাসে ও বারুদ জ্বলে।
এইতো সেদিন
আমার বৃষ্টি ভেজা ভাঙ্গা জানালায়
রজনীগন্ধার সৌরভ ছড়িয়ে থাকতো।
অথবাঃ
শুঁকে দ্যাখো
আমার দুই হাতের তালুতে
তোমার চুলের মাদকতা
আজও আমাকে নেশা ধরায়
এই দ্যাখো আমার
চোখের মুকুরে
কার ধর্ষিত মুখ
দ্যাখা যায়!
একি!
নগ্ন হাঁটুতে মুখ থুবরে
তুমি কাঁদছো!
তুমি কাঁদছো
একমুঠো বিষের জন্য ।
আর আমি হাঁটছি
সাতদিন সাতরাত
একটি নরপশুর জন্য।
এখন আর কেঁদোনা।
এইতো আকাঙ্ক্ষিত হায়েনার
কাছাকাছি এসে গেছি।
এখন মেশিনগানের ট্রিগারটা
লাফিয়ে উঠবে
যেমন করে ওরা তোমার উপরে
লাফিয়ে পড়েছিল।
এমনি করে হেটে হেটে
তোমার কাছে ফিরে যাবো…..
তারপর তোমার কোলে মাথা গুঁজে
অথবা তোমার বিষের পেয়ালা
মুখ রেখে
ফিরে যাবো
রজনীগন্ধার সৌরভ ছড়ানো
ঝলসানো বাড়ির
ভাঙ্গা জানালার পাশে।