জয় বাংলা ২৯ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
১ম বর্ষ ২৫শ সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার ১১ই কার্ত্তিক, ১৩৭৮, ২৯শে অক্টোবর, ১৯৭১
——————————————————————————-
রংপুর, সিলেট, কুমিল্লা ও নোয়াখালী সেকটরে হানাদার বাহিনীর নাভিশ্বাস
বিগত পক্ষকালে আরও চারটি জাহাজ বিনষ্ট
মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধাদের দুর্বার আক্রমণের মুখে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার হানাদার বাহিনীর নাভিশ্বাস উঠেছে। সম্প্রতি মুক্তিবাহিনীর অফসারদের যে প্রথম দল ট্রেনিং গ্রহণ করে বেরিয়েছেন তারা মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য স্ব স্ব দায়িত্ব গ্রহণ করায় বিভিন্ন রণাঙ্গনে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণের তীব্রতা অনেক বেশী বৃদ্ধি পেয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর মনোবল ভীষণভাবে ভেঙ্গে পড়েছে এবং বেলুচিস্থান, সীমান্ত প্রদেশ প্রভৃতি অঞ্চলের মুক্তিকামী মানুষের মনেও নতুন প্রেরণা সঞ্চার করেছে।
খুলনা, চট্টগ্রাম, সিলেট, দিনাজপুর, কুষ্টিয়া প্রভৃতি সেক্টরে ক্রমেই মুক্তিবাহিনীর চাপ বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং প্রতিদিনই মুক্ত এলাকার পরিসর বৃদ্ধি পাচ্ছে। এক্ষণে মুক্তিবাহিনী কুমিল্লা শহরের ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করেছে এবং ফেনী শহর ও তার সন্নিহিত অঞ্চল থেকে পাক হানাদারদের উৎসাদনের কাজ পূর্নোদমে চলেছে।
অসামরিক অধিবাসীদের ওপর বোমা বর্ষণ
ওদিকে রংপুরের চিলমারী এবং সিলেটের ছাতক এলাকাতেও মুক্তিবাহিনীর দুর্বার আক্রমণের মুখে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী দিশেহারা হয়ে নিরীহ অসামরিক অধিবাসীদের ওপরে নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে চলেছে।
ঢাকায় পাক সেনা নিহত
খাস ঢাকা শহরেও গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণের তীব্রতা বৃদ্ধি পেয়েছে। কয়েকদিন পূর্বে মতিঝিল বাণিজ্যিক এলাকায় হাবিব ব্যাংকের সামনে সামরিক বাহিনীর একটি গাড়ীতে মেয়াদী বোমা বিষ্ফোরণের ফলে কয়েকজন পাকিস্তানী হানাদার সেনা নিহত হয়েছে।
জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত
শুধু স্থলেই নয়, জল যুদ্ধেও মুক্তিবাহিনীর প্রাধান্য অব্যাহত রয়েছে। বিলম্বে পাওয়া খবরে জানা গিয়েছে যে, বিগত পক্ষ কালে মুক্তি যোদ্ধারা নৌ যুদ্ধে বিশেষ সাফল্য অর্জন করেছে। গত ১২ই অক্টোবর চট্টগ্রাম বন্দরে গ্রীক জাহাজ ‘এলবোস’ মুক্তি যোদ্ধাদের দ্বারা মারাত্নকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এই জাহাজে পাক সামরিক বাহিনীর জন্য বিশেষ প্রয়োজনীয় সরবরাহ বহন করে আনা হয়েছিল।
জলযুদ্ধে সাফল্য
ইতিপূর্বে মুক্তিবাহিনীর হাতে আরও বারোটি বিদেশী জাহাজ মার খেয়েছে। ফলে অধিকৃত বাংলাদেশের বন্দরে কোন বিদেশী জাহাজ আর আসতে চাইছে না। ওদিকে এই সকল জাহাজের ক্ষতিপূরণের ব্যাপারেও সমস্যা দেখা দিয়েছে। কোন বিদেশী বীমা কোম্পানীতে বীমা করা না হলে জাহাজ কোম্পানীর মালিকেরা পাকিস্তানের বন্দরে আসরে রাজী হছে না। অপর দিকে বিদেশী বীমা কোম্পানী যুদ্ধ শর্তের ভিত্তিতে বীমা করার দাবী জানাচ্ছে, স্বাভাবিক অবস্থায় বীমার যে শর্ত থাকে সে শর্তে রাজী হচ্ছে না। এতে সরাসরি পাকিস্তানী দায়িত্বে বিদেশী জাহাজে সামরিক সরবরাহের জন্য মাল আনতে জাহাজের ব্যয় কয়েকগুণ বৃদ্ধি পাবে এবং মুক্তিবাহিনীর হাতে জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত হলে বিপুল ক্ষতিপূরণের বোঝা বহন করতে হবে।
উপরোক্ত গ্রীক জাহাজটির ক্ষতি করা ছাড়াও মুক্তিবাহিনী পাকিস্তানের ন্যাশনাল শিপিং কর্পরেশনের একটা নামকরা জাহাজ ‘লালসিরা’ সুন্দরবনের কাছে ডুবিয়ে দিয়েছে এবং অপর একটি বার্জের গুরুতর ক্ষতি করেছে।
মুক্তিবাহিনী সিলেট সেক্টরের ছাতক অঞ্চলেও তিনটী লঞ্চ ও তিনটি মোটর বোট ডুবিয়ে দিয়েছে। এর কিছুদিন পূর্বে মুক্তিবাহিনী এম ভি ‘নাসিম’ সহ দুটি পাকিস্তানী জাহাজেরও গুরুত্বর ক্ষতিসাধন করেছে।
পাকিস্তানের হানাদার সেনারা মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে দিশেহারা হয়ে এখন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে পাক ভারত সংঘর্ষে পরিণত করার জন্য পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে উস্কানীমূলক কার্যকলাপ শুরু করেছে। তা নইলে পশ্চিম সীমান্তে কোন আপাততঃ বিরোধ না থাকা সত্তেও পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কেন পশ্চিম সিমান্তে যুদ্ধের পায়তারা শুরু করেছে।
কিন্ত বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর চরম আঘাতেই তাদের সকল ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হতে বাধ্য। মুক্তিবাহিনীর উন্নত রণকৌশল ও দুর্বার আক্রমণের গতিধারা দেখে পর্যবেক্ষক মহলের অনেকেই আশা করছেন যে পাক হানাদার বাহিনীর কবলিত এলাকার মুক্তি আসন্ন।
চীন জাতিসঙ্ঘের সদস্য হলো
দীর্ঘ বাইশ বছর পর গণপ্রজাতন্ত্রী চীন জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ লাভ করেছে এবং করমোজা সরকার জাতিসঙ্ঘের সদস্যপদ হারিয়েছে। এতে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ‘দুই চীন নীতর’ পরাজয় ঘটেছে এবং ন্যায় ও গণতন্তের মৌলনীতির বিজয় হয়েছে।
জাতিসঙ্ঘে চীনের অন্তর্ভূক্তি এবং এই বিশ্ব সংস্থা থেকে তাইওয়ানের বহিষ্কারের পক্ষে আলবেনিয়ার প্রস্তাব ৭৬ – ৩৫ ভোতে গৃহীত হয়েছে।
বাংলাদেশ সরকার কিছুই জানে না – কামরুজ্জামান
মার্কিন কর্তৃপক্ষ উপমহাদেশে উত্তেজনা হ্রাসের জন্য বাংলাদেশ সরকারের সঙ্গে সরকারীভাবে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন বলে’ লন্ডনের একটি সংবাদ সংস্থা যে রিপোর্ট প্রচার করেছেন বাংলাদেশ সরকারের স্বরাষ্ট্র, সাহায্য এবং পুনর্বাসন মন্ত্রী, জনাব এ, এইচ, এম, কামরুজ্জামান তা সরাসরি অস্বীকার করেছে। তিনি বলেন, মার্কিন কর্তৃপক্ষ সরকারী বা বেসরকারী কোন পর্যায়েই বাংলাদেশ সরকারের সংগে যোগযোগ স্থাপন করেন নি।
জনাব কামরুজ্জামান দৃঢতার সঙ্গে বলেন যে, পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধানই সম্ভবপর নয়।
তিনি বলেন, হানাদার বাহিনীর নির্মুল করে জন্মভূমিকে আজাদ করাই আমাদের জনগণের একমাত্র লক্ষ্য। পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য তারা আজ নিবেদিত।
তিনি আরও বলেন যে, আওয়ামী লীগের গতিশীল নেতৃত্বের ফলে বাংলাদেশের জনগণ এখন হানাদার বাহিনীকে নির্মূল করার মত শক্তি অর্জন করেছেন। তারা তাদের অধিকার আদায় করে ছাড়বেনই।
তিনি দৃঢতার সাথে বলেন যে, কিছু লোক যা ভাবছেন তার বহু আগেই মুক্তি বাহিনী নিজেদের অধিকার ও বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নকে বাস্তবায়ণ করবেন।
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী বৈঠক শুরু
গত বুধবার থেকে মুজিব নগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির মুলতবী বৈঠক শুরু হয়েছে।
‘মুক্তিবাহিনী তো যাদু জানতা হ্যায়, পাত্তা নেহি…কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার জাতা হ্যায় হামলোগ কেয়া করেগা
মাত্র কয়েকদিন আগের কথা। বেলা একটার দিকে ঢাকার মতিঝিল এলাকা দিয়ে যাচ্ছিলেন একজন পাঞ্জাবী মেজর। সাথে রয়েছে কেবল মাত্র তার জীপের ড্রাইভার। মেজরের জীপখানা যখন মতিঝিল টি এণ টি কলেজের সামনে গেল তখন হঠাত কোথা থেকে খান তিন গাড়ী এসে জীপের সামনে থেমে গেল। আর জীপের পেছনেও ছিল খান দু’এক মোটরগাড়ী। মেজর ব্যাপারটাকে স্বাভাবিক রাস্তা ‘জ্যাম’ মনে করে নিজের জীপ খানার গতি থামিয়ে দিলেন। সাথে সাথে চারিদিক থেকে ৮/১০ জন যুবক এসে মেজর সাহেবকে ঠেসে ধরল। ঘটনার আকস্মিকতায় মেজর পকেট থেকে রিভলভার বের করারই সুযোগ পেলেন না। ড্রাইভার ত দুই ঘুষিতেই কূপোকাত। তারপর তরুণরা মুখ বেধে গাড়ীতে তুলে মেজরকে যে কোথায় নিয়ে গেল তার হাদিস আজো পায়নি।
কিন্ত ব্যাপারটা ওখানেই শেষ নয়। ক্যান্টনমেন্টে খবর পৌছাতেই না পৌছাতেই সেনা বাহিনীর ছুটাছুটি শুরু হয়ে গেল চারিদিকে। তারা ঘিরে ফেলল সমগ্র এলাকা। কিন্তু কোথাও কোন খোজ হল না মেজরের। টিএন্ড টি কলেজ থেকে শ’দুয়েক গজ দূরে মতিঝিল পীর জঙ্গী মাজারের পাশেই ছিল সেনাবাহিনীর একটা চেক পোষ্ট। তার তত্বাবধানে নিয়োজিত ছিলেন একজন বেলুচ ক্যাপ্পটেন। মেজরকে কোথাও না পেয়ে পাগলের মত ছুটে আসলেন সেখানে আরেক জন পাঞ্জাবী মেজর। ‘সামরিক ভাষায়’ করলেন বেলুচ ক্যাপ্তেনকে যত সব অশ্রাব্য গালি-গালাজ।
ক্যাপ্টেন ধৈর্য ধরে সবই শুনলেন। তারপর সবিনয়ে বললেন, “মেজর সাব, মুক্তিবাহিনী তো যাদু জানতা হ্যায়, পাত্তা নেহি ঊয়োলোগ কিধার সে আতা হ্যায় আওর কিধার জাতা হ্যায়। মাগার স্রেফ গোলিয়া নজর আতা হ্যায়! হামলোগ কেয়া করেগা?”
* * *
অক্টোবর মাসের মাঝামাঝি সময় ২৪/২৫ বছরের এক বাঙ্গালী মহিলা ঢাকা থেকে একাকী যশোর যাচ্ছিলেন। গোয়ালন্দ ষ্টীমার ঘাটে তাকে দেখেই এক বেলুচ মেজর জিজ্ঞাস করলেন তিনি একা যাচ্ছেন কিনা। মহিলা বেশ কয়েক বছর ভায়ের সাথে করাচী ছিলেন। তাই তিনি ভাল উর্দু বলতে পারেন। ইংরেজীতে তিনি ভাল বলেনই। কেননা তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের এম, এ। যাক, অনেক কথাবার্তার পর তাদের যখন বিদায় হবার পালা আসল তখন মেজর মহিলাকে বললেনঃ “আপ হামারা লিয়ে দোয়া কিজিয়ে কে হামলোগ জিন্দা রহে।“ মহিলাও কম চালাক নন। তিনি কথাবাত্তায় বুঝে ফেলেছিলেন বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ দমনের ব্যাপারে বেলুচ মেজর পিণ্ডির সাম্রাজ্যবাদীদের সাথে একমত নন। তাই মহিলা জবাবে রসিকতা করে বললেনঃ আপ ভি হামারী লিয়ে দোয়া কিজিয়ে কে হামলোগ জিত জায়ে।“
মেজর মহিলার ইঙ্গিতটা বুঝতে পারলেন। কিন্তু মুখে কিছু না বলে একটু মুচকী হেসে চলে গেলেন।
* * *
গত রবিবার যশোর ক্যান্টনমেন্টের অদূরে অপারেশন করে ফিরে আসার সময় চারজন মুক্তি বাহিণীর গেরিলা পাকসেনাদের হাতে ধরা পড়েন। সৈন্যরা তাদের ধরে নিয়ে যায় ক্যান্টনমেন্টে। কিন্তু যার কাছে তাদের হাজির করা হয়েছিল তিনি ছিলেন একজন বেলুচ মেজর। তিনি মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের নিরস্ত্র করে অন্য সবাইকে ঘর থেকে চলে যেতে বললেন। মুক্তি বাহিনী গেরিলারা অভুক্ত আছেন সন্দেহ করে তিনি তাদেরকে চা-নাস্তায় আপ্যায়িত করলেন। তারপর ফিস ফিস করে বললেন ঃজয় বাংলা মাত বোলিয়ে। উওতো বাংলা মাত বোলিয়ে। উওতো হিন্দু লোককো জয় হিন্দকা মাফিক হ্যায়। মাগার আপলোগ স্বাধীন বাংলা বলিয়ে। আপলোগ স্বাধীন হো যাইয়ে উসকা বাদ হামলোগ ভি স্বাধীন হো জায়েগা। কথাগুলো শেষ হত্রে না হতেই মেজর হার ইশারা করে মুক্তি বাহিনী গেরিলাদের কেটে পড়তে বলেন। মেজরের মন, মানস ও ইঙ্গিত বুঝতে বাঙ্গালী তরুণদের এতটুকুও বিলম্ব হলো না। তারা মেজরকে সালাম জানিয়ে আস্তে কেটে পড়লো বদ্ধভূমি ক্যান্টনমেন্ট থেকে।
***
১৪ই অক্টোবর। দখলীকৃত ঢাকা থেকে মুক্ত এলাকায় পালিয়ে আসছিলেন এক বাঙ্গালী ভদ্রলোক। কুমিল্লা জেলার কসবার কিছু দূরে এসে দেখলেন ফেরী ঘাটের কাছে দাঁড়িয়ে আছে জনা পাঁচেক সৈন্য। ভয়ে তার প্রাণ ওষ্ঠাগত। কারণ, তার কাছে ছিল কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ দলিল ও কাগজপত্র। তাকে দেখেই সৈন্যদের একজন এগিয়ে এসে জিজ্ঞাসা করলেন কোথায় যাবেন? ভদ্রলোক আসল কথা না বলে অন্য একটি জায়গার নাম করলেন। সংশ্লিষ্ট সৈনিক জানালেন যে, তারা ওর কাছেই যাবেন। এবং তারা চান যে তিনি তাদের সাথেই যান, কেননা সাথে একজন বাঙ্গালী থাকলে তাদের উপর হয়ত কোন বিপদ আসবে না। ভদ্রলোকের ভিতরে ভিতরে অনিচ্ছা থাকলেও বাইরে তাদের প্রস্তাবে সম্মতি দিলেন। ইতিমধ্যে ঘতে গেলো একটা ব্যাপার যার থেকে বাঙ্গালী ভদ্রলোক বুঝতে পারলেন যে, তার সঙ্গে যিনি কথাবার্তা বলছেন তিনি একজন বেলুচ মেজর। সেই বেলুচ মেজরকে অন্য একজন পাঞ্জাবী মেজর বহন করতে দিয়েছিলেন তার টুপি ও হাতের ছড়িটি। কিছুদূর গিয়েই তিনি মনে করলেন তিনি কেন একজন পাঞ্জাবী অফিসারের টুপি ও ছড়ি বহন করবেন। তাই তিনি একটু ঘৃণা ভরে সাথের একজন পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনকে তার জাত ভাইয়ের টুপি ও ছড়ি বহন করতে হুকুম করলেন। কিন্ত যেভাবে ও ভঙ্গিতে তাকে আদেশটি দেওয়া হয়েছিল তাতে তিনি রীতিমত ক্রুব্দ হয়ে পড়েছিলেন। তারপর বেলুচ মেজর ও পাঞ্জাবী ক্যাপ্টেনের মধ্যে প্রকাশ্য রাস্তাতেই খন্ডযুদ্ধ বাধার মত পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়ে গেল। যাক, শেষ পর্যন্ত একজন পাঞ্জাবী হাবিলদার এগিয়ে এসে টুপি ও ছড়ি বহনের দায়িত্ব নিয়ে নেয়। যার ফলে একটা রক্তাক্ত সংঘর্ষ পরিহার করা সম্ভব হয়।
নিক্সনের “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম সমাধান” বনাম বাংলাদেশের স্বাধীনতা – মোহাম্মদ উল্লাহ চৌধুরী
লন্ডন থেকে সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এ, পি পরিবেশিত এক খবরে বলা হয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার ও বাংলাদেশের নেতাদের মধ্যে আলোচনা প্রারম্ভের প্রচেষ্টা হিসাবে মার্কিণ সরকার অনানুষ্ঠানিক পর্যায়ে বাংলাদেশ সরকারের নেতাদের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করেছেন।
সংবাদে বলা হয়েছে যে, লন্ডনস্থ এশীয়া কূটনীতিকরা মনে করেন যে এ আলোচনার লক্ষ্য হচ্ছে এমন একটা সমাধান খুজে বের করা – যেটাকে সংশ্লিষ্ট মহল “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম” সমাধান বলে অভিহিত করেছেন।
খবরে আরো বলা হয়েছে যে মার্কিণ কর্তৃপক্ষ “সর্ব্বোত্তম” সমাধানের ব্যাপারে ইয়াহিয়া সরকারকে সম্মত করাতে ব্যর্থ হয়েছেন বলেই প্রতীয়মাণ হয়। কেননা, তা করতে গেলে বাংলাদেশের নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে ইয়াহিয়াকে একতা মীমাংসায় আসতে হত।
খবরে অবশ্য একথাও বলা হয়েছে যে, ইয়াহিয়া সরকার শেখ মুজিবুর রহমানের সাথে একটা আপোষ করতে অনিচ্ছুক নয়। কিন্ত তাতে একতা শর্ত রয়েছে, তা হল শেখ মুজিবকে এক পাকিস্থানের কাঠামোতেই তা করতে হবে। কিন্ত কূটনীতিক মহলের মতে অনুরূপ আপোষের পথে কোন অগ্রগতি এ পর্যন্ত না হওয়া থেকে একথাই প্রমাণিত হয় যে আওয়ামী লীগ নেতা তখন আর এক পাকিস্তানে বিশ্বাসী নন, এবং তিনি সংশ্লিষ্ট মহলকে স্পষ্টভাবেই জানিয়ে দিয়েছেন যে বাংলাদেশ প্রশ্নে তিনি তার দলীয় সহকর্মীদের তথা বাংলাদেশ সরকারের ভূমিকারই পূর্ণ সমর্থক।
মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকারের “সর্ব্বোত্তম” সমাধানটা যে কি তা আমাদের জানা নেই। তবে তাদের আগাগোড়া ভূমিকা থেকে এ কথাই বুঝা যায় যে এ সর্ব্বোত্তম” সমাধানটা এক পাকিস্তানের কাঠামোতেই ছিল। মাত্র সেদিনও জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ রজার্স বাংলাদেশের ঘটনাবলীকে পাকিস্তানের জল্লাদ গোষ্ঠির আভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে অভিহিত করেছেন। সংবাদটা পর্যালোচনা করলে এ কথায় বুঝা যায় যেম পশ্চিম পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকার এক পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যেই ইদ্ভাবিত নিক্সন সরকারের “সর্ব্বোত্তম সমাধান” ও মানতে রাজী হয়নি। তার ফলেই নিক্সন সরকারকে “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম” সমাধান উদ্ভাবন করতে হয়েছে। সুতরাং এই তথাকথিত “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম” সমাধানও যে এক পাকিস্তানেরি কাঠামোতে এবং “সর্ব্বোত্তম” সমাধানের চেয়েও নিকৃষ্ট তা সহজেই বুঝা যায়। কেননা, নিক্সন সরকার এই তথাকথিত “সর্ব্বোত্তম” ও “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম” সমাধান এর বিচারটা নিশ্চয় ইয়াহিহা খানদের স্বার্থের আলোকেই করেছেন। সুতরাং মার্কিণ উদ্যোগের খবরটা সত্য হলেও তা যে কোন মতেই বাংলাদেশের সরকার ও জনগণের পক্ষে গ্রহ্ণযোগ্য হতে পারে না। তদুপরি যেক্ষেত্রে শেখ মুজিবুর রহমান যেক্ষেত্রে “সর্ব্বোত্তম সমাধান’ নাকচ করে দিয়েছেন সেক্ষেত্রে তথাকথিত “দ্বিতীয় সর্ব্বোত্তম” সমাধান মানার কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। (চলবে)
পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কোন সমাধান মেনে নিতে বাঙ্গালীরা রাজি নয়
বিখ্যাত মার্কিণ সাপ্তাহিক টাইম পত্রিকায় লেখা হয়েছেঃ যদিও ইয়াহিয়া খান নির্দেশ জারি করেছে সামরিক অত্যাচার কম করতে, তবু অত্যাচার বন্ধ হয়নি। দমন নীতি পুরাদমে এখনও চলছে বাংলাদেশে। প্রতিদিন প্রাণ ভয়ে ৩০ হাজার করে শরণার্থী যাচ্ছে ভারতে। গ্রামের পর গ্রাম এখনও হচ্ছে অগ্নিদদ্ধ। বিশিষ্ট রাজনৈতিক কর্মীদের ধরে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে, তারপর পাওয়া যাচ্ছে না আর তাদের কোন খবর। ফিরে আসছেন না আর তারা। একটি বীভৎস ঘটনা হল, ঢাকার মোরাং সামরিক ক্যান্টনমেন্টে আটকে রাখা ৫৬৩ জন বাঙালী যুবতীকে। এদের মধ্যে কারো কার বয়স ১৮ বছর। এরা সকলেই সামরিক বাহিনীর দুষ্ট কামনার শিকার। এদের সকলেই এখন গর্ভবতী। এরা বহন করেছে পাক-ফৌজের সন্তান। কারো কারো গর্ভপাত করবার চেষ্টা হচ্ছে। কিন্ত অনেকের অবস্থা এখন এমন পর্যায়ে যে, তাদের গর্ভপাত ঘটান সম্ভন নয়। কিছু কিছু মেয়েকে এখন মাঝে মাঝে ছেড়ে দেওয়া হচ্ছে। তারা যাতে সন্তান প্রসব করতে পারে বাইরে।
টাইম পত্রিকার সংবাদদাতা ডান কলিন লিখেছেনঃ ৬০ হাজারের উপর বাঙালী গেরিলারা এখন যুদ্ধ করছে বাংলাদেশের নানা স্থানে। কলিন বলেছেন, তিনি ফরিদপুরের গোপালগঞ্জ মহকুমার কোন এক গ্রামে গিয়েছিলেন গেরিলাদের একটি অস্থায়ী আস্তানা দেখতে। নৌকা করে লুকিয়ে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। সেখানে ২৫ জন গেরিলার সাথে আলাপ হয় তার। এদের সবার বয়সই কুড়ির কোঠায়। এদের মধ্যে অধিকাংশই কলেজের ছাত্র। কেবল কয়েকজন প্রাক্তন সেনা বিভাগের, প্রাক্তন পুলিশ ও ইপিআর এর লোক। তাদের অস্ত্র ও গোলাবারুদের কোন অভাব দেখেন নি তিনি। তাকে তারা নানা ধরণের অস্ত্রপাতি দেখায়। এসব অস্ত্রের মধ্যে মাইন ও হাত বোমাও ছিল।
টাইম পত্রিকার মতে, পাক ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনা যদিও এখন বিশেষভাবে হ্রাস পেয়েছে, তবু যুদ্ধের সম্ভাবনা একেবারে বিলুপ্ত হয়েছে, এমন কথা বলা যায় না।
ভারতে সরকারীভাবে ৯০ লক্ষ শরণার্থী এসেছে। বর্তমানে যে হারে শরণার্থীর আগমণ ঘটছে চারতে, তাতে চলতি বছর শেষ হবার আগেই শরণার্থীর সংখ্যা দাঁড়াবে এক কোটি বিশ লক্ষের মত। এই বিরাট ব্যয়ভার বহন, ভারতের মত দেশের একার পক্ষে সম্ভব নয়।
এমন একটা সময় ছিল, যখন ভাবা যেত, শেখ মুজিবুর রহমানকে ছেড়ে দিলে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হতে পারবে। পাকিস্তানের রাষ্ট্রিক কাঠামোর মদজ্যেই সম্ভব হবে এই সমাধান। কিন্ত আজ অবস্থা এমনই এক পর্যায়ে এসে দাড়িয়েছে যে, বাঙালীরা এই সমাধান মেনে নেবে বলে অনেক কূটনৈতিকই আর আশা পোষণ করেন না।
বাংলাদেশের আন্দোলন আরম্ভ হয়েছিল স্বায়ত্ত শাসনের দাবীতে। কিন্ত এখন পরিবর্তিত রাজনৈতিক অবস্থায়, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন সমাধান বাঙ্গালীরা আর সম্ববতঃ মেনে নিতে রাজি নয়। (টাইম, ২৫শে অক্টোবর)।
পাকিস্তান ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধাতে চাচ্ছে
আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা “ওয়াশিংটন পোষ্ট” তার সম্পাদকীয় তে বলেছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ আশঙ্কা প্রবল হয়ে উঠেছে। আর এ যুদ্ধাশংকার জন্য পাকিস্তান বিশেষভাবে দায়ী। পত্রিকাটিতে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান তার নিজের দেশের সমস্যাকে শরণার্থী রূপে ভারতে চালান করে উত্তেজনাকর পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে। সম্পাদকীয় প্রবন্ধে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলা হয়েছে, রাষ্ট্র সংঘ ভারত উপমহাদেশে সৃষ্ট সমস্যা সম্পর্কে যথেষ্ট মনযোগ দানে ব্যর্থ হয়েছে। পত্রিকাটিতে আরোও বলা হয়েছে যে, ভারতে এখন বাংলাদেশ থেকে এক কোটি শরণার্থী গিয়েছে। যাদের ত্রাণ কার্যের জন্য ১০০ কোটি ডলার দরকার। মার্কিন ণীতির সমালোচনা করে বলা হয়েছে যে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র বলেছে যে সে নিরপেক্ষ থাকতে চায়। কিন্ত কার্যত সে পাকিস্তান সরকারের পক্ষ গ্রহণ করেছে। যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তান ও ভারতকে মুখে সংযম দেখানোর কথা বললেও পাকিস্তান সরকার কে অস্ত্র শস্ত্র সরবরাহ করছে। এর অর্থ হলো পাকিস্তানের প্রতি পক্ষপাত প্রদর্শন ও তার যুদ্ধবাদী নীতিতে ইন্ধন প্রদান। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের এই ভূমিকা বিশেষভাবে কলঙ্কজনক। (২২শে অক্টোবর)।
গঙ্গা তীরে ট্রাজিডি
রুশ কম্যূনিষ্ট পার্টির মুখপাত্র প্রাভদা তে প্রকাশিৎ একটি প্রবন্ধে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের সম্পর্কে এক দির্ঘ প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। প্রবন্ধকার ছয় কলম জুড়ে এই প্রবন্ধের শরণার্থী সমস্যার বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেছেন। প্রবন্ধকার ইভান স্কেদ্গভ এর মতে অবস্থা এ ভাবে চলতে থাকলে ১৯৭২ সালের জানুয়ারির মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা দাড়াবে ১ কোটি ২০ লক্ষ থেকে ১ কোটি ৩০ লক্ষের মত। ভারতের পক্ষে এত বিপুল সংখ্যক শরণার্থিদের দায়ভার গ্রহণ করা কখনই সম্ভব নয়। গঙ্গার তীরে বিয়াগন্ত নাটক, এই শিরণামায় লিখিত প্রবন্ধে ইভান স্কেদ্গভ অভিযোগ করেছেন যে পশ্চিমে এক শ্রেনির পত্র পত্রিকায় শরণার্থীদের অবস্থা খুবই সঙ্গিন বলে বর্ননা করা হয়েছে এবং কৌশলে শরণার্থীদের দুঃখ দূর্দশার জন্য ভারতকে দায়ী করা হয়েছে। কিন্ত ভারত তার সাধ্য অনুযায়ী সবকিছু করবার চেষ্টা করছে। ভারতকে শরণার্থী সমস্যা সৃষ্টির জন্য দায়ী করা চলে না।
[প্রথম পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
জাতিসঙ্ঘ, গণচীন ও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ
মার্কীণ ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে জাতিসঙ্ঘে গণপ্রজাতন্ত্রী চীন আসন লাভ করেছে এবং মার্কীণ পদলেহী চিয়াং চক্র জাতিসঙ্ঘ থেকে বহিষ্কৃত হয়েছে। জাতিসঙ্ঘের ছাব্বিশ বছরের নাতিদীর্ঘ জীবনে এটাই সম্ভবতঃ উল্লেখ করার মত অন্যতম প্রধান একটি ঘটনা। গণচীণের জাতিসঙ্ঘভুক্তি উপলখ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ গণচীন সরকারকে অভিনন্দন জনিয়ে বাণী প্রেরণ করেছেন।
জাতিসঙ্ঘে গণচীনের অন্তর্ভূক্তি শুধু মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের চীনা নীতির ব্যর্থতা নয়, দুই চীন নীতিরও পরাজয়। গত বছর জাতিসঙ্ঘে গণচীনের অন্তর্ভূক্তির প্রশ্নটি তোলা হলে তখন প্রস্তাবের পক্ষে ভোট পড়েছিল ৫১ টি, বিপক্ষে ৪৯ টি। ২৫ টি দেশ ভোটাভুটিতে অংশ নেয়নি। তখনই সম্ভবতঃ মার্কিণী কর্তারা বুঝতে পেরেছিলেন জাতিসঙ্ঘের সদস্য রাষ্ট্রদের চোখ রাঙিয়ে তারা আর বেশী দিন গণচীনকে একঘরে করে রাখতে পারবেন না। ফলে এ বছর নাটকীয় ভাবে কিসিংগারের চীন সফর, প্রেসিডেন্ট নিক্সনের পিকিং সফরের ব্যবস্থা এবং পিংপং কূটনীতির সূচনা। যুক্তরাষ্টের বর্তমানে লক্ষ্য ছিল, গণচীনকে জাতিসঙ্ঘে ঢুকতে দেয়া এবং সেই সঙ্গে তাইওয়ানের সদস্যপদও বহাল রাখা। কিন্ত শেষ পর্যন্ত দুই চিন নীতির মার্কীণী ষড়যন্ত্র ব্যর্থ হয়েছে।
বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধে আমরা যারা প্রত্যাশা করি, আমেরিকা একটি গণতন্ত্রী দেশ এবং সে দেশের গণতন্ত্রী সরকার বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের গণতান্ত্রিক অধিকারের প্রতি সমর্থন জানাবেন,তাদের স্মরণ রাখা উচিৎ এই যুক্তরাষ্ট্র সরকারই ১৯৫০ সাল থেকে ১৯৭০ সাল পর্যন্ত প্রায় ৭০ কোটি মানুসের দেশ গণচীনকে জাতিসঙ্ঘে ঢুকতে দেয়নি এবং তার বৈধ সরকারের অস্তিত্ব স্বীকার করে নেয়নি। প্রায় ৭০ কোটি লোকের সরকারের বাস্তব অস্তিত্ব যে দেশের সরকার দীর্ঘ বাইশ বছর স্বীকার করে নেয়নি, তারা মাত্র ছ’মাসে সাড়ে সাত কোটি মানুসের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের বৈধ অস্তিতের প্রতি সহানুভূতি অথবা সমর্থন জানাবে এরূপ আশা করা বাতুলতা। গবচীন কারো কৃপায় বা দয়ার পাত্র হয়ে জাতিসঙ্ঘে প্রবেশ করেনি। সে নিজের শক্তি ও অস্তিত্বকে উপলদ্ধি করতে জাতিসঙ্ঘকে বাধ্য করেছে এবং শেষ পর্যন্ত গোঁয়ার নিক্সন সাহেব পর্যন্ত পিকিং্যের দরজায় ধর্ণা দিয়েছেন। এই ঘটনা থেকে বাংলাদেশের মানুষের একটা বড় শিক্ষা গ্রহণ করার রয়েছে। জাতিসঙ্ঘ কিম্বা কোন ছোট বড় দেশ কৃপা করে বা গণতন্ত্র বা মানবতার স্বার্থে বাংলাদেশের অস্তিত্বকে স্বীকার করে নেবেনা। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে শক্তি বলে স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্যে পৌছাতে হবে এবং সেদিন শুধু জাতিসঙ্ঘ নয়, নিক্সন সাহেবেরাও হয়ত নতুন করে বাণিজ্যের আশায় বন্ধুত্বের ডালি নিয়ে ঢাকায় এসে ধর্ণা দেবেন। গণচীন তার স্বাধীনতা অর্জনের পরও দীর্ঘ বাইশ বছর সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্তে জাতিসঙ্ঘে তার আসন পায়নি। সুতরাং বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধারাও ছ’মাসে, এক বছরে ধৈর্যহারা হবেন না। দরকার হলে তারাও তাদের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি আদায়ের জন্য বাইস বছরেরও বেশী সময় সংগ্রাম করবে। কায়েমী স্বার্থবাদী রাষ্ট্রজোট যেমন জাতিসঙ্ঘে গণচীনের অন্তর্ভূক্তি ঠেকাতে পারেনি, বাংলাদেশের স্বাধীনতার স্বীকৃতিও তারা ঠেকাতে পারবে না। সাময়িকভাবে বিঘ্ন ঘটাতে পারবে মাত্র।
জাতিসঙ্ঘে আসন লাভ – তথা বিশ্ব স্বীকৃতি লাভের পর নয়াচীনও তার বর্তমান ভূমিকা ত্যাগ করে প্রতিবেশীদের সঙ্গে সৌহার্দ রক্ষা এবং সাম্রাজ্যবাদ ও ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে বিশ্বেব্যাপী জনগণের সংগ্রামে দৃঢ সমর্থন দানের ভূমিকা গ্রহণ করবে এটাই আমরা আশা করি। জাতিসঙ্ঘে গণচীনকে গ্রহণের ব্যাপারে ভারত একটি গণতান্ত্রিক প্রতিবেশী দেশ হিসাবে প্রশংসনীয় মনোভাব দেখিয়েছে। ১৯৫০ সাল থেকে ভারত জাতিসঙ্ঘে গণচীনের অন্তর্ভূক্তির প্রতিটি প্রস্তাবে সমর্থন দান করেছে, ১৯৬২ সালের ভারত চীন সংঘর্ষ সত্ত্বেও এই সমর্থন সে প্রত্যাহার করেনি। যুক্তরাষ্ট্রের দুই চীন নীতিও ভারত সমর্থন করেনি। এশিয়ায় শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্তের ভিত্তি দৃঢ করার জন্যই গণচীনের উচিৎ, ইয়াহিয়ার গণবিরোধী ফ্যাসিষ্ট চক্রের প্রতি সমর্থন প্রত্যাহার করা এবং গবতন্ত্রী প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে মৈত্রী ও সৌহার্দ বৃদ্ধি করা। অন্যদিকে বাংলাদেশের জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রামেও গণচীনের সমর্ত্থন ও সাহায্য দান অবশ্য কর্তব্য। একমাত্র তাহলেই গণচীন তার বিঘোষিত নীতির যথার্থতা প্রমাণ করতে পারবে, যে নীতির ভিত্তি হল – গণবিরোধী ফ্যাসিবাদ ও সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে নিরবচ্ছিন্ন সংগ্রাম। আমরা গণচীনের জাতিসঙ্ঘে প্রবেশ উপলক্ষে চীনের জনগণকে আমাদের সংগ্রামী অভিনন্দন জ্ঞাপন করছি।
যা দেখছি যা ভাবছি – আবদুল গাফফার চৌধুরী
‘জয়বাংলা’ পাঠকেরা গত এক সপ্তাহের আগের কাগজে মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাডেট অফিসারদের ট্রেনিং সমাপ্তি অনুষ্ঠানে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ নিশ্চয়ই পাঠ করেছেন। এই ভাষণে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি বলেছেন, শীঘ্রই মুক্তিবাহিনী হানাদার দস্যুদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।‘ দৃঢ প্রত্যয়ের সঙ্গে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেছেন, ‘শত্রুর কবলমুক্ত ঢাকার রেসকোর্সে যেদিন বঙ্গবন্ধু মুক্তি বাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন, সেদিনই স্বাধীনতা ঘোষণার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জিত হবে।‘
সৈয়দ নজরুলের এই সন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী আশা করছিল, বর্ষার মৌষুম শেষ হলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিট গোপন চলাচল ও তৎপরতার ব্যাপারে অসুবিধায় পরবে এবং হানাদারেরা নতুন উৎসাহে আক্রমণ ও হত্যাভিযান চালাবে। কিন্ত বর্ষার মৌসুম শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে হানাদারেরা এখন হতচকিত, হতাশ এবং বিপন্ন। তাদের মনোবল এখন ভেঙ্গে গুড়িয়ে গেছে। কারণ, হানাদারেরা খবর পেয়ছে, মুক্তিবাহিনীর বহু দুর্ধর্ষ ইউনিট সামরিক ট্রেনিং শেষ করে এখন তাদের উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার জন্য প্রস্তর হয়েছে। এখন আর হিট এ্যান্ড রাণ পদ্ধতির আক্রমণ নয়। এবার মুক্তিযুদ্ধ। হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে নিয়ে প্রাথমিকভাবে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশের নৌবহর। এই নৌবহরের নাম বঙ্গবন্ধু নৌবহর। হানাদারদের বিমান আক্রমণ প্রতিরোধ এবং পাল্টা বিমান আক্রমণ পরিচালনার ব্যবস্থা গ্রহণে নিযুক্ত হয়েছেন বাংলাদেশের তরুণ ও সুদক্ষ পাইলটগণ।
********
পূর্ব রণাঙ্গন থেকে খবর এসেছে, ছাতক শিল্পাঞ্চল হানাদারদের কবলমুক্ত করা হয়েছে। ছাতকের সিমেন্ট কারখানা ও শহরের উপর এখন সগর্বে উড়ছে স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। সুরমা নদীর উত্তর তীরে এই শিল্পাঞ্চল দখল করার পর এখন দক্ষিণ তীরে ছাতক বাজার দখলের জন্য চলছে প্রচণ্ড লড়াই। সম্ভবতঃ এ সপ্তাহের জয়বাংলা পাঠকদের হাতে পৌছাবার আগেই ছাতক বাজারেরও পতন ঘটবে। মুক্তিবাহিনী ছাতক ও সিলেয় শহরের মধ্যে রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছে এবং সিলেট শহরের দিকে ত্রিমুখী সাড়াশী অভিযান শুরু করেছে।
এখন কুমিল্লা শহরের মাত্র ২০ কিলোমিটার দূরে যুদ্ধ চলছে। মুক্তিবাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণে গত ১৭ই অক্টোবর সকালে কোম্পানীগঞ্জের কাছে প্রায় তিনশো বর্গমাইল এলাকার গুরুত্বপূর্ণ ঘাঁটি ও ছাউনি ছেড়ে ইয়াহিয়ার হানাদার দস্যুরা পশ্চাদপসরণ করেছে। কুমিল্লা শহরের পশ্চিমে শহরতলি ও কর্ণেলের বাজারের মধ্যে অবস্থিত সমস্ত ঘাঁটি ছেড়ে হানাদারেরা পলায়ন করেছে। একমাত্র শালদা নদীর ঘাটিতে এখন হানাদারেরা অবস্থান করছে। কিন্তু এই ঘাটিও মুক্তিবাহিনী ঘেরাও করে ফেলেছে।
কুমিল্লা সেক্টরের যেদ্ধে শতাধিক হানাদার সৈন্য নিহত হয়েছে। তাদের বহু বাঙ্কার এবং সাজোয়া বাহিনীর সরঞ্জাম ধ্বংস হয়েছে। মুক্তিবাহিনী পলায়নরত হানাদারদের কাছ থেকে ৬ হাজার রাইফেল সহ বহু অস্ত্রসস্ত্র দখল করেছে। কোম্পানীগঞ্জ ও কর্ণেলের বাজারের যুদ্ধে পরাজিত হওয়ার পর হানাদার সৈন্যরা পলায়নের সময় সস্তিতোলা গ্রামে হানা দিয়ে কাপুরুষোচিত উপায়ে প্রায় শ’খানেক গ্রামবাসীকে হত্যা করে।
*******
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা তিনদিন যাবত ঘুরে সুইডেনের সাংবাদিক লাগার্নার এরল্যাণ্ডসন ভারতের রাজধানী নয়াদিল্লী পৌছে বলেছেন, ‘ঢাকা শহর এখন ভীত, সন্ত্রস্থ ও জীবন শূন্য একটি প্রেতপুরী’। মিঃ এরল্যাণ্ডসন রেডিও সুইডেনের প্রতিনিধি ও ভাষ্যকাররূপে ঢাকা শহরও ঘুরে দেখেছেন। তিনি বলেছেন, ‘শহরের প্রতিটা রাস্তায়, এমনকি ডাকঘরে এবং হোটেলে পাকিস্তানী সৈন্য মোতায়েন রয়েছে। বড় বড় হোটেলে প্রবেশ করা ও বাইরে আসার সময় খানা তল্লাশী করা জয়। সন্ধ্যার আগেই দোকান পাট বন্ধ হয়ে যায় এবং যুবা বয়সী লোকদের রাস্তায় দেখা যায় না। সংবাদপত্রে এখনও সেন্সরশীপ রয়েছে এবং ‘বাংলাদেশ’ কথাটি ব্যবহার করতে দেয়া হয় না। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব সংক্রান্ত কোন খবর ঢাকার কাগজে বে- আইনী কাজ।
সুইডেনের এই বিখ্যাত সাংবাদিক আরো প্রকাশ করেছেন। – “যেহেতু হানাদার বাহিনীর কর্তৃপক্ষের হাতে ত্রাণ সাহায্য বিলি বণ্টনের দায়িত্ব রয়েছে, সেহেতু বিভিন্ন দেশের প্রদত্ত ত্রাণ সাহায্যের বিলি বন্টন মোতেই আশানুরূপ নয়। বরং ত্রাণ সামগ্রির বেশীভাগই হানাদার সৈনদের ভোগে লাগছে।
******
যুগোশ্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটোও বাংলাদেশ প্রশ্নে ন্যায় সঙ্গত সমাধান, জনগণের মৌলিক অধিকার প্রতিষ্ঠা ও শরণার্থীদের নিরাপদে দেশে প্রত্যাবর্তনের পরিবেশ সৃষ্টির কাজে বাংলাদেশের মিত্র রাষ্ট্র ভারতের ভূমিকাকে সমর্থন জানিয়েছেন। প্রেসিডেন্ট টিটোর সাম্প্রতিক ভারত সফরও তাই অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
অন্যদিকে খুনী ইয়াহিয়ার এখন ‘মাথায় ঘায়ে কুকুর পাগল’ হওয়ার অবস্থা। ইয়াহিয়া ছুটে গিয়েছিল ইরাণে। সোভিয়েট প্রেসিডেন্টসহ চার চারজন রাষ্ট্র প্রধানের কাছে ধর্ণা দিয়েছিলেন। কেউ এই ক্ষিপ্ত জন্তুর কথায় কান দেয়নি। বরং রাশিয়া তাকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধায়োজন সম্পর্কে কড়া ধমক দিয়েছে। ভারতের প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগ জীবন রাম স্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন, ‘ইয়াহিয়া যদি ভারত আক্রমণের দুঃসাহস দেখায় তাহলে ভারত লাহোর এবং শিয়ালকোট দখল করে নেবে এবং সেই দখল আর ছাড়বে না’। ইয়াহিয়া পাগলের মতো সফর সংক্ষেপ করে দেশে ফিরে এসেছেন। ইয়াহিয়া এখন বুঝতে পেরেছে, আগামী ডীসেম্বরের আগেই বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাচ্ছে। পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তানেও বিপ্লব আসন্ন। এক বিদেশী জ্যোতিষী ভবিষ্যবাণী করেছেন, ‘ইয়াহিয়া শীঘ্রই হয় বদ্ধ উন্মাদ হবে অথবা তার সহযোগীদের হাতে নির্মমভাবে নিহত হবে’। এদিকে মার্কিণ সিনেটও পাকিস্তানকে সর্বপ্রকার সাহায্য দান বন্ধ রাখার পক্ষে মত প্রকাশ করেছেন। ইয়াহিয়া চক্রের এখন উভয় সংকট।
*******
‘আইয়ুবের গাথা’ মোনেমের মৃত্যুর পর কনভেনশন লীগের ‘এ’ টিমেও ভাঙ্গন শুরু হয়েছে। মুক্তি ফৌজের গেরিলাদের গুলি খাওয়ার ভয়ে ভীত রংপুরের কাজী কাদের ও ময়মনসিংয়ের হাসিমুদ্দীন কনভেনশন লীগ থেকে পদত্যাগ করেছে বলে খবরে প্রকাশ। ইয়াহিয়ার গাথা মালিকও ঢাকার গভর্ণর হাউজে স্বেচ্ছা বন্দী। এই চোখের ডাক্তার এখন ভয়ে আর বাইরে বেরুতে চাননা। ক্লাইবের গাথা মীরজাফর এবং আইয়ুবের গাথা মোনেমের মত ইয়াহিয়ার এই বৃদ্ধ গাধাটিরও যে শেষের সেদিন অত্যন্ত ভয়ঙ্কর, সে কথা বলাই বাহুল্য।
সাতাশে অক্টোবরের কালো রাত
এ বছরের ২৫ শে মার্চের নজিরবিহীন রক্তপাত ১৯৫৮ সালের ২৭শে অক্টোবরের কালো রাতটির কলঙ্কময় অস্তিত্ব একেবারেই মুছে দিয়েছে। সাবেক বৃটিশ ইন্ডিয়ান আর্মির এক বিশ্বাসঘাতক সেপাই আইয়ুব এইদিন দলবল নিয়ে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে ক্ষমতা দখল করেছিল এবং ক্ষমতা দখল করে বাংলাদেশের উপনিবেশে দীর্ঘ দশ বছর লুটপাট, হত্যা, ষড়যন্ত্রের এক দীর্ঘ ইতিহাস তৈরি করেছে। ক্লাইভের আমলে ইষ্ট ইন্ডীয়া কোম্পানীর বাংলাদেশ লুণ্ঠনের ইতিহাসও সেপাই আইয়ুবের লুণ্ঠনের ইতিহাসের কাছে ম্লান। আইয়ুবের পর চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্রের পথেই তার গদীতে বসেছে সাবেক বৃটিশ আর্মির আরেক সেপাই ইয়াহিয়া। ক্লাইভের তাবেদার মীর জাফর ইতিহাসে আখ্যা পেয়েছে ‘ক্লাইভের গাধা’ রূপে। সেপাই আইয়ুবের তাবেদার মোনেমও বাংলাদেশে আখ্যা লাভ করেছিল ‘আইয়ুবের গাধা’ রূপে। সম্প্রতি এই গাধাটিকে মুক্তি ফৌজের গেরিলারা হত্যা করেছে। এখন ঢাকার মসনদে রয়েছে ইয়াহিয়ার গাধা টেকো মালেক। খবর পাওয়া গেছে, এই গাধাটিকেও খতম করার জন্য মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। মুক্তি বাহিনীর হাতে চরম মার খেয়ে ইয়াহিয়ার অবস্থা এখন শাড়ীপরা বানরীর মত। তার গলার এখন আর যুদ্ধের হুঙ্কার নেই। পরিবর্তে উ থান্টের পা জড়িয়ে জাতিসঙ্ঘ পর্যবেক্ষক পাঠাবার জন্য যে কান্না শুরু করেছে। কিন্ত বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এখন দৃঢপ্রতিজ্ঞ। বুকের রক্তে তারা যেমন ২৭শে অক্টোবরের কালো রাতটিকে মুঝে দিয়েছে, তেমনি বাংলাদেশ থেকে সেপাই রাজত্বেরও চির অবসান ঘটাবে।
[দ্বিতীয় পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
ছবিঃ মুক্তাঞ্চলের একটি হাসপাতালে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি ও প্রধানমন্ত্রী
ইন্দিরা–টিটো যুক্ত ইশতেহারের তাৎপর্য
জনগণের ‘ব্যক্ত’ ইচ্ছার নিরিখেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে হবে
ভারত ও যুগোশ্লাভিয়া বিশ্ববাসীকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন যে, শরণার্থী সমস্যার মীমাংসা বিলম্বিত হলে পরিস্থিতি গুরুত্বর রূপ’ নিতে পারে।
প্রেসিডেন্ট টিটো এবং শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর মধ্যে আলোচনা শেষে প্রকাশিত এক যুক্ত ইশতেহারে বলা হয় যে, পূর্ব বাংলার সাম্প্রতিক ঘটনাবলীতে যে সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে তা ‘অত্যন্ত গুরুত্বর’ এবং শরণার্থী সমস্যা জিয়ে রাখা হলে তা আপনা আপনিই অত্রাঞ্চলে স্থিতিহীনতা ও উত্তেজনার একটি সূত্র হিসাবে প্রমানীত হবে।
ইভয় পক্ষই এ ব্যাপারে একমত হয়েছেন যে, জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য একটা রাজনৈতিক সমাধানের দ্বারাই কেবল বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সম্ভব।
গত ২০ শে অক্টোবর তারিখে যুগোশ্লাভিয়া প্রেসিডেন্ট টিটোর ৪ দিন ব্যাপী সরকারীভাবে ভারত সফর শেষে কায়রো যাত্রার অব্যবহিত পরে এই যুক্ত ইশ্তেহার প্রকাশিত হয়।
ইশ্তেহারে বলা হয়েছে, কয়েক মিনিয়ন (৯০ লক্ষাধিক) শরণার্থীর আগমনের ফলে ভারতে যে রাজনৈতিক ও সামাজিক সমস্যার সৃষ্টি হয়েছে এবং ভারতের অর্থনীতির উপর যে প্রচণ্ড চাপ পড়েছে সে ব্যাপারে ভারতের গভীর উদ্বেগের সাথে যুগোশ্লাভিয়া সম্পূর্ণ একমত। ইশতেহারে পরিস্থিতিটা “সত্যই গুরুতর” বলে মন্তব্য করা হয়।
উভয় পক্ষই এই অভিমত ব্যক্ত করেন যে, প্রস্তাবিত রাজনৈতিক সমস্যাটি “অবশ্যই জনগণের ইচ্ছা, জন্মগত অধিকার ও আইনানুগ অধিকার মাফিক” হতে হবে। সাথে সাথে উভয় পক্ষ এই মতও প্রকাশ করেন যে, ‘ইতিপূর্বে জনগণের সুস্পষ্টভাবে প্রদত্ত ইচ্ছাকে পাশ কাটানোর যে কোন প্রচেষ্টা পরিস্থিতিকে আরো ঘোরালো করে তুলবে।
উভয় পক্ষ আরো অভিমত প্রকাশ করেন যে সমস্যার সমাধান আরও বিলম্বিত হলে পরিস্থিতি আরো গুরুত্বর হয়ে উঠবে।
যুগোশ্লাভ পক্ষ শেখ মুজিবুর রহমানের ভাগ্যের ব্যাপারে উদ্বেগ প্রকাশ করেন এবং বলেন যে “এই প্রখ্যাত জননেতার প্রতি প্রদর্শিত বর্তমান ব্যবহার বহুবিধ প্রতিকূল পরিণামের সৃষ্টি করতে পারে।
প্রেসিডেন্ট টিটোর মতে “শেখের প্রতি মানবিক আচরণা সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান এবং উপমহাদেশে শান্তি ও স্থায়ীত্বের অনুকূলেই কাজ করবে”।
পক্ষন্তরে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, “সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের পূর্বশর্ত হিসাবে জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমানকে অবশ্যই বিনাশর্তে মুক্তি দিতে হবে”।
শ্রীমতি গান্ধী দৃঢতার সাথেই বলেন যে, শরণার্থীদের অবশ্যই অবিলম্বে স্বদেশে ফিরে যেতে হবে। সেজন্য অবশ্যই জরুরী ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
তবে শরণার্থীদের সত্তর স্বদেশে ফিরে যাওয়া সাপেক্ষে যুগোশ্লাভ পক্ষ এই ব্যাপারে একমত হন যে এই লাখো শরণার্থীর দায়িত্ব বিশ্ব সমাজকেই নিতে হবে।
বাংলাদেশ প্রশ্নে চীনা মনোভাবের পরিবর্তন
বিদেশী পর্যবেক্ষক মহলের মতে, বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে চীনের মনোভাব পরিবর্তিত হচ্ছে বলে মনে হয়। কারণ, পাক–ভারত সীমান্তে এখন যে উত্তেজনা কর পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে, সে সম্পর্কে পিকিং একদম নীরব রয়েছে। পাকিস্তান বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক–ভারত সমস্যায় পরিণত করে আন্তর্জাতিক কূটনীতির পক্ষপুটে আশ্রয় নিতে যাচ্ছে। কিন্ত অনেকেই মনে করছেন, পাকিস্তান ভারত আক্রমণ করলে, পিকিং তা সমর্থন করবে না বা পাকিস্তানের সাহায্যে এগিয়ে আসবে না। চীন ভাবছে, ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধি পেলে তা চীনের স্বার্থে অনুকূলে যাবে না।
পাকিস্তানকে সৌদি আরবের ৭৮ খানা মার্কিন বিমান প্রদান
নিক্সন সরকারের কৈফিয়ত কি?
লন্ডনের ‘ফিনান্সিয়াল টাইমস’ পত্রিকার এক খবরে প্রকাশ সৌদি আরব পাকিস্তানকে ৭৮ টি মার্কিন বিমান ধার দিয়েছে।
পত্রিকার সংবাদদাতা ‘উচ্চ পদস্থ পাকিস্তানী কূটনীতিক মহলের মন্তব্য উদ্ধৃত করে লিখেছে যে, বিমানগুলো ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তানের বিমান বন্দরে পৌছে গেছে।
রাজনৈতিক মগলের ধারণা, পাকিস্তানকে সরাসরি সামরিক সাহায্য দেওয়ার ব্যাপারে অসুবিধা থাকায় প্রেসিডেন্ট নিক্সন সৌদি আরবের মাধ্যমে পাকিস্তানকে এই সাহায্য দিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন তথা মার্কিণ সরকারের যদি এতে সম্মতি না থাকবে তাহলে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে পাওয়া এই সমস্ত সামরিক বিমান সৌদি আরব কি করে পাকিস্তানকে দিতে পারে? কেননা এই সমস্ত মার্কিণ বিমান নিশ্চয়ই স্বীয় প্রতিরক্ষার কাজে ব্যবহারের জন্যই সৌদি আরবকে দেওয়া হয়েছিল।
পর্যবেক্ষক মহলের মতে মার্কিণ সরকার আগাগোড়াই বাংলাদেশ প্রশ্নে দু মুখো নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা মুখে বাংলাদেশের জনসাধারণের প্রতি সহানুভূতি দেখালেও সেই মার্চ মাস থেকেই বাঙ্গালীর হত্যা করার জন্য ঘাতক ইয়াহিয়া দের অস্ত্র দিয়ে চলেছেন।
হাল আমলে তারা বাইরে ‘সংযম’ রক্ষার জন্য পাকিস্তান ও ভারতের প্রতি বাণী বর্ষণ করলেও ভেতরে ভেতরে পরোক্ষ ভাবে অর্থাৎ তৃতীয় দেশের মাধ্যমে পাকিস্তানকে সামরিক সরঞ্জাম দিয়ে চলেছেন। সৌদি আরব কর্তৃক পাকিস্তানকে ৭৮ খানা সামরিক বিমান তারই আরেকটি প্রমাণ।
মুলতুবীর পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে গৃহিত প্রস্তাবাবলীর পূর্ণ বিবরণ
মুজিব নগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কার্য নির্বাহক সংসদের (ওয়ার্কিং কমিটি) অধিবেশনের গৃহিত প্রস্তাবাবলীর পূর্ণ বিবরণঃ
১। এই সভা বিগত সাড়ে ছ’মাসব্যাপী বাংলাদেশে হানাদার পাকিস্তানী সৈনের বিরুদ্ধে জনতার মুক্তি ও স্বাধীনতার যুদ্ধে আত্নদানকারী দেশ প্রেমিক শহীদ দের আত্নত্যাগকে শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করে তাদের আত্নার মাগফেরাত (চিরশান্তি) কামনা করছে। সাথে সাথে সাধীন বাংলার শত্রু কবলিত পাকিস্তানী দস্যুদের হাতে লাঞ্চিত ও নিপীড়িত হয়ে আর অর্দ্ধাহারে অনাহারে থেকেও মুক্তিযুদ্ধে যে নতুন নজীর সৃষ্টি করে চলেছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে স্বাধীনতার এই সুংগ্রামকে দ্রুত ত্বরান্বিত করার বলিষ্ঠ শপথ নিচ্ছে।
২। এই সভা পৃথিবীর প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতিসঙ্ঘের কাছে বাংলাদেশের জাতীয় পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের অবিলম্বে মুক্তির জন্য প্রত্যক্ষ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের আবেদন জানাচ্ছে।
৩। এই সভা পূণরায় দ্ব্যররথহীন ভাষায় ঘোষণা করছে যে, সাড়ে সাত কোটি মানুসের পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান।
৪। স্বাধীন সার্বভৌম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের মাটিতে তথাকথিত উপ নির্বাচন অনুষ্ঠানের কথা ঘোষণা করে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাপতি ইয়াহিয়া খান যে ধৃষ্টতার পরিচয় দিয়েছে এবং এর মাধ্যমে বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার যে অপচেষ্টা গ্রহণ করেছে তার সমুচিত জবাব দেওয়ার শপথ নিয়ে এই সভা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিছে যে, নির্বাচন ত দূরের কথা স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় জীবনে তথা কথিত পাকিস্তানীদের কোন প্রকার হস্তক্ষেপই বাঙ্গালী জাতি ও বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ কিছুতেই সহ্য করবে না।
৫। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতসহ বিশ্বের যে সমস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুসের মুক্তি ও স্বাধীনতার এই যুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করে চলেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। সাথে সাথে বিশ্বের প্রতিটি মানুসও যে সমস্ত সংবাদপত্র ও প্রচার যন্ত্র স্বাধীনতার এই সংগ্রামে সমর্থন দান করেছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানাচ্ছি। একই সাথে এই সভা বাংলাদেশে নজীরবিহীন গণহত্যা, নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানবতার স্বার্থে সক্রিয় জনমত গঠনের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানান।
৬। স্বাধীন সার্বভৌম গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ আজ একটি বাস্তব সত্য। বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা পৃথিবীর প্রতিটি শান্তিকামী, গণতন্ত্রকামী ও স্বাধীনতাকামী রাষ্ট্রকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দিয়ে মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার সংগ্রামে যথাযোগ্য ভূমিকা গ্রহণের আহ্বান জানাচ্ছে।
৭। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা অধুনা সম্পাদিত ভারত–রাশিয়া মৈত্রী চুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশের বাস্তব সমস্যা অনুধাবনের প্রচেষ্টা গ্রহণ করা হয়েছে বলে মনে করে।
৮। বাংলাদেশ থেকে বাস্তচূত ৯০ লক্ষাধিক শরণার্থীকে ভারতের বুকে আশ্রয় দিয়ে ও তাদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করে ভারতবর্ষের জনসাধারণ ও ভারত সরকার মানবতার ইতিহাসে যে নজির সৃষ্টি করেছেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুসের পক্ষ থেকে তার জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছে। এবং পৃথিবীর যে সমস্ত রাষ্ট্র শরণার্থী সমস্যা মোকাবিলা করার প্রচেষ্টায় ভারতের প্রতি যে সাহায্য ও সহযোগিতা দান করেছে তাদেরকে কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করছে।
৯। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এই সভা দ্ব্যররথহীন ভাষায় ঘোষণা করছে যে, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে ভারতে আশ্রিত প্রতিটি শরণার্থীকে সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনতে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।
যুদ্ধ বাধালে কি হবে?
(কলকাতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
ভারতে নিযুক্ত জার্মান ডেমোক্রেটিক রিপাবলিকের কনসাল মিঃ এইচ ফিসার সম্প্রতি কলকাতায় বলেছেন যে, ভারতের সাথে যুদ্ধের মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান হতে পারেনা। বরং তা পরিস্থিতি কে আরো জটিল করে তুলবে। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করতে হলে, সে দেশের নেতাদের সাথে আলচনার মাধ্যমেই এই সমস্যার সমাধান সম্ভবপর। ভারত ৯০ লক্ষ শরণার্থীর
দেখাসুনা করছে। অন্য কোন বিষয়ের সঙ্গে ভারতের কোন সম্পর্ক নেই।
মিঃ ফিসার দৃঢতার সঙ্গে বলেন যে, পাকিস্তানকে অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানকে ছেড়ে দিতে হবে। এমন একটি পরিবেশ সৃষ্টি করতে যাতে শরণার্থীরা দেশে ফিরে যেতে সক্ষম হয়।
[তৃতীয় পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুতে মুজিব নগরে বুদ্ধিজীবীদের শোক সভা
বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর মৃত্যুতে গত ২০শে অক্টোবর মুজিবনগরে বাংলাদেশ বুদ্ধিজীবীদের এক শোক সভা অনুষ্ঠিক হয়।
সভায় সভাপতিত্ব করেন শওকত ওসমান। মরহুম সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর জীবনী ও সাহিত্যের বিভিন্ন দিক নিয়ে আলোচনা করেন জনাব আবদুল গাফফার চৌধুরী, শ্রী সন্তোষ গুপ্ত, জনাব ফজলুর রহমান। বক্তাদের সবাই তার সাহিত্যে গভীর দেশাত্নবোধ ও অন্যায়ের বিরুদ্ধে যে প্রতিবাদ প্রকাশ পেয়েছ্বে সে কথা গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করেন।
সভায় মরহুমের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানানোর উদ্দেশ্যে এক মিনিট মৌনতা পালন করা হয়।
সভাপতির ভাষণে জনাব শওকত ওসমান মরহুমের সঙ্গে তার গভীর বন্ধুত্বের কথা উল্লেখ করেন এবং বন্ধুত্বের বিভিন্ন পর্যায়ের স্মৃতিমন্থন করেন। তিনি বলেন দেশের এমন দুর্দিনে সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর অকাল মৃত্যু আমাদের সংগ্রামের প্রতি বিরাট আঘাত।
সভায় নিম্নলিখিত প্রস্তাব গৃহীত হয়ঃ –
বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের শিল্পী, সাহিত্যিক ও বুদ্ধিজীবিদের এই সভা খ্যাতনামা কথাশিল্পী ও অগ্রণী সাহিত্যিক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর অকাল মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছে এবং তার পত্নী মাদাম এ্যানিমেরী থিবো, দুই সন্তান এবং অন্যান আত্নীয় পরিজনকে তাদের এই গভীর শোকের মুহূর্তে আন্তরিক সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। প্যারিসের প্রবাস জীবনে এই লব্ধ প্রতিষ্ঠিত কথা শিল্পীর অকাল মৃত্যু তার গুণমুগ্ধ দেশ বাসীর কাছে আরো শোকাবহ এ জন্যে যে, জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের এই গুরুত্বপূর্ণ সন্ধিক্ষণে এক তীব্র তীক্ষন সমাজ সচেতন স্বদেশ প্রেমিক মনিষী ও ব্যক্তিত্বকে হারাবার ক্ষতি তাদের সহ্য করতে হচ্ছে। বেচে থেকে আরো দীর্ঘকাল তিনি বাংলা সাহিত্যের বিভিন্ন শাখাকে সমৃদ্ধ করবেন, এমন প্রত্যাশা অবশ্যই বাংলা ভাষাভাষি তার অনুরাগীদের মধ্যে ছিল। তার অকাল মৃত্যুতে শুধু এই প্রত্যাশাতেই আঘাত পড়েনি, বাংলাদেশের গঠনোম্মুখ কথাশিল্পী ও নাট্য সাহিত্যও যথার্থই ক্ষতিগ্রস্থ হবে, এ কথাও বলা চলে।
সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর এই শোকাবহ অকাল মৃত্যু উপলক্ষ্যে আমরা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে অনুরোধ জানাচ্ছি যে, বাংলাদেশ সরকার ও জনগণের পক্ষ থেকে যেন এই মৃত্যুতে শোক ও সমবেদনা প্রকাশ করা হয় এবং প্যারিসে পরলোকগত কথা শিল্পীর পত্নী ও শিশু সন্তানদের তত্বাবধানের ব্যাপারে যত্নবান হন। বাংলা একাডেমী কর্তৃক সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর প্রকাশিত ও অপ্রকাশিত রচনা গ্রন্থাবলি আকারে প্রকাশ এবং তার বিক্রয়লব্ধ অর্থের একটা অংশ দ্বারা তার শিশু সন্তানদের সাহায্যদানের ব্যবস্থা করার জন্যও এই সভা কর্তৃপক্ষের নিকট অনুরোধ জানাচ্ছে। সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহর বিভিন্ন উপযোগী গ্রন্থ বাংলাদেশের বিশ্ববিদ্যালয়ে পাঠ্যতালিকা ভুক্ত করা এবং বাংলাদেশ হানাদার পাকিস্তান বাহিনীর কবলমুক্ত হওয়ার পর তার স্মৃতি রক্ষার উপযুক্ত ব্যবস্থা করার জন্য এই সভা বাংলাদেশের শিক্ষা ও সাংস্কৃতিক বিষয়ক কর্তৃপক্ষের দৃষ্টি আকর্ষণ করে রাখছে।
নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্যই সামরিক জান্তা ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করতে চায় – এয়ার কমোডর জাঞ্জুয়া
সাবেক পাকিস্তান বিমান বাহিনীর প্রাক্তন কমোডর কে, জাঞ্জুয়া সম্প্রতি লন্ডনে এক বিবৃতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সর্বাত্নক সংগ্রামে লিপ্ত হওয়ার জন্য তার দেশবাসীর প্রতি আবেদন জানিয়েছেন।
এক বিবৃতিতে জাঞ্জুরা বলেন, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ফ্যাসীবাদের সনাতন পথ ধরেছে। তাদের কাজ কারবার আমাদের হিটলারের যুগের কথা স্মরণ করিয়ে দেয়। হিটলার পশুবল প্রয়োগ করে বহু জাতিকে নির্যাতিত ও লাঞ্চিত করেছে, প্রায় ৬০ লাখ মানুসকে শুধুমাত্র তাদের ‘সাংস্কৃতিক পশ্চাৎপদতার’ অভিযোগে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে।
এয়ার কমোডর বলেনঃ আমাদের সামরিক জান্তা সশস্ত্র প্রতিরোধ সংগ্রাম চালানোর ব্যাপারে বাঙ্গালীর দক্ষতা ও ক্ষমতাকে নেহায়েত খাটো করে দেখেছিল। তার ফলে তারা আজ বাংলাদেশে সঙ্কটের এক চোরা বালিতে আটকে পড়ে হাবুডুবু খাচ্ছে। বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর হাতে তাদের শোচনীয় পরাজয় যে অত্যাসন্ন তা তারা আজ বুঝতে পারছে। সেজন্য সমূহ সঙ্কট থেকে পরিত্রাণ লাভের জন্য তারা আজ অন্ধকারে হাতড়িয়ে মরছে। সুতরাং তার ব্যবস্থা হিসাবে তারা পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ উন্মাদনা শুরু করছে এবং ভারত বিরোধী প্রচারনা শুরু করেছে। সামরিক জান্তা নিজেদের উন্মত্ত কাজ কারবারের দ্বারা যে মারাত্নক ও ধ্বংসকর পরিস্থিতিতে নিপতিত হয়েছে তা থেকে পশ্চিম পাকিস্তানের মানুসের দৃষ্টি ভিন্ন দিকে ধাবিত করার জন্যই তারা তা ধরছে।
জাঞ্জুয়া বলেনঃ ভারতের বিরুদ্ধে সীমাবদ্ধ যুদ্ধ করার ব্যাপারে ইয়াহিয়া জান্তার দুটো উদ্দেশ্য আছে। প্রথমতঃ এর ফলে বাংলাদেশ সমস্যা একটা আন্তর্জাতিক রূপ নেবে, এবং সামরিক জান্তা বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে অপরাধ করেছে ও মুক্তিবাহিনীর হাতে যে বিপুল সংখ্যক পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য হতাহত হয়েছে তা চাপা দেওয়া যাবে।
দ্বিতীয়ত, তদ্বারা পশ্চিম পাকিস্তানে প্রগতিশীল সমাজতান্ত্রিক আন্দোলনও দমন করা যাবে।
সামরিক জান্তার এই চক্রান্ত ও প্রতারণার বিরুধে আমরা পশ্চিম পাকিস্তান ও ‘আজাদ কাশ্মীরের’ জনগণকে সতর্ক করে দিতে চায়। আমরা সামরিক জান্তার ও অপরাপর ফ্যাসীবাদী শক্তির বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ হামলার বিরুদ্ধে বিশেষভাবে পশ্চিম পাকিস্থানের প্রগতিশীল শক্তি গুলোকেও সতর্ক করে দিতে চাই।
উপসংহারে জনাব জাঞ্জুয়া স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের হত্যাকারী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে সংগ্রামে বাঙ্গালীদের পাশে দাড়াবার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি আবেদন জানান।
[চতুর্থ পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির বক্তব্যই আমাদের শেষ কথা
পশ্চিমাদের বাংলাদেশে নির্বাচন করতে আমরা দেব না
সর্বশেষ সংবাদে দেখা যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান গং বাংলাদেশে উপ–নির্বাচনের কাজ চালিয়ে যেতে বদ্ধপরিকর। এজন্য তারা ইতিমধ্যেই নির্বাচন প্রার্থীদের কাছ থেকে মনোনয়নপত্র আহ্বান করেছে। কিছু সংখ্যক গাদ্দার মনোনয়নপত্র দাখিলও করেছে। মোট ৭৮ টি শূন্য আসনের মধ্যে ৫৮ টি মনোনয়ন প্রার্থীদের যে হিসেবে পাওয়া গিয়েছে তাতে কমসে কম ১৪ জন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচিত হয়েছে। বাকীগুলোর কয়েকটিতে ২ জন, কয়েকটিতে ৩ জন এবং কয়েকটিতে ৪/৫ জন করেও প্রার্থী নাকি রয়েছে। বিভিন্ন সূত্র থেকে আমাদের কাছে যে সমস্ত সংবাদ এসে পৌছেছে তাতে দেখা যায় যে, এই প্রার্থী দের অনেকেই নির্বাচন প্রার্থী হতে ইচ্ছুক ছিল না। কিন্ত দখলীকৃত এলাকায় বাচতে হলে সামরিক–চক্রের তাবেদারদের হুকুম আহকাম মেনে চলতে হয়। তাই অনিচ্ছা সত্ত্বেও কেঊ কেউ মনোনয়ন প্রার্থী হয়েছেন। নির্বাচনে প্রার্থী হবার ব্যাপারে সামরিক চক্রের জোর প্রয়োগের কারণটা অবশ্য সবারই জানা। তারা বেশী বির্বাচন প্রার্থী দেখিয়ে একথাই বুঝাতে চায় যে বাংলাদেশে উপ–নির্বাচনগুলো অবাধ ও নিরপেক্ষ হচ্ছে। এত ধামকী ধূমকী দ্বারাও সামরিক শাসক গোষ্ঠী অন্ততঃ ১৪ টি কেন্দের জন্য এক জনের বেশি প্রার্থী যোগাড় করতে পারে নি। আবার এই ১৪ জন ‘বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায়’ নির্বাচন প্রার্থীরা কে একটু চিন্তা করলেই তা স্পষ্ট হয়ে উঠে। এদের মধ্যে ৫ জন দৌলতানা লীগের, ৪ জন মওদুদীর জামাতে ইসলামীর, ২ জন ফ,কা, চৌধুরীর কনভেনশন লীগের এবং বাকী ৩ জন সীমান্তের কাইয়ুম খানের কনভেনশন লীগের। সামরিক বাহিনীর ভয়েই হোক বা স্বেচ্ছা প্রণোদিতভাবেই হোক এই নির্বাচনে যারা দাড়িয়েছে এদের যে লজ্জা শরম বলতে কিছু নেই, তা স্পষ্ট। তারা নির্লজ্জ বেহায়ার দল। মাত্র গত ডিসেম্বরে সদল্বলে নির্বাচনে পরাজিত হওয়ার পর কিভাবে এরা আবার নির্বাচনের নাম মুখে আনতে পারে তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। তবে এদের লজ্জা, শরম থাকবে কি করে। এরা যে জাত দালাল? দালালী না করলে এদের চাকরী থাকবে না, এণাম পাবে না। তবে শ্রীমানদের আমরা স্মরণ করিয়ে দিতে চায় যে, নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতাকারী প্রতিটা দালালের নাম মুক্তি বাহিনীর লিস্টে উঠে গেছে। বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধারা এদের প্রাণ টিকেট করতে যে কোন সুযোগের এতটুকু অপচয় করবে না। আইয়ুব খানের ‘পোষ্যপুত্র’ দালাল শিরোমণি মোনেম খান এবং ডাক্তার মালিকের পোষ্য মোল্লা ইসয়াহাকের পরিণতি থেকে এদের সব বুঝে নেওয়া উচিৎ।
এব্বার দেখা যাক, ইয়াহিয়া খান গং রা এই উপ নির্বাচন দ্বারা কি উদ্দেশ্য সাধন করতে চায়? তারা নিশ্চিত গণতন্ত্রের স্বার্থে এ সমস্ত উপনির্বাচন করছে না। নির্বাচনের স্বার্থেই যদি তারা নির্বাচন করবে তাহলে আওয়ামী লীগের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা কি অন্যায় করেছিলেন? সুতরাং গণতন্ত্র নয়, বরং অন্য কোন অসৎ উদ্দেশ্য এ উপনির্বাচনের পেছনে রয়েছে। ইয়াহিয়া গং রা বিশ্বকে দেখাতে চায় যে বাংলাদেশে তারা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের শাসন কায়েম করতে যাচ্ছে। এটা তারা বিশ্বকে স্রেফ ধোকা দেওয়ার জন্যই যে করছে তা বুঝতে কারো এতটুকু কষ্ট হবার কথা নয়। এ দুর্বুদ্ধির পেছনে যে বিশ্ব মোড়লদের কেউ কেউ আছে তা বলাই বাহুল্য। এ ব্যাপারে নিশ্চিত করেই ‘সংখ্যা লোঘূ ভোটে’ নির্বাচিত মার্কিণ প্রেসিডেন্টের নাম উল্লেখ করা যেতে পারে। নিক্সনই থাকুন, বা অন্য যে কেউ থাকুন তাতে বাঙ্গালিদের কিছু আসে যায় না। নিক্সনদের ‘দুধও খাব আবার টামাকও খাব, নীতি আজ সর্বত্র আচল। তারা একদিকে গণতন্ত্রের নামে বিশ্বব্যাপী সব কিছু করবেন, অন্যদিকে দুনিয়াব্যাপী গণতন্ত্র হত্যাকারী জেনারেলদের মদদ জোগাবেন – তা আজ আর বিশ্বের কোন গণতন্ত্রকামী মানুস মেনে চলতে পারে না।
এ প্রসঙ্গে সম্প্রতি মুজিব নগরে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে শেষ কথা বলে দেয়া হয়েছে। প্রস্তাবে বাংলাদেশে ইয়াহিয়া গংদের নির্বাচন অনুষ্ঠানের প্রচেষ্টাকে একটা ‘অমার্জনীয় ধৃষ্টতা’ এবং তাদের এ কাজকে ‘বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ’ বলে অভিহিত করা হয়েছে। তাছাড়া এটা ‘বিশ্বজনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা’ বলেও আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি অভিমত প্রকাশ করেন।
যা হোক, আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমটির বক্তব্যই আমাদের শেষ কথা। ২৫শে মার্চ থেকে বাংলাদেশ একটা স্বাধীন ও সার্বভৌম জাতি, তার নিজস্ব সরকার ও পার্লামেন্ট রয়েছে। তার আব্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের ধিকার কারো নেই। ইয়াহিয়া গং দেরও নেই।
তারা যদি স্বেচ্ছায় এ অপচেষ্টা থেকে বিরত না হয় তা হলে বাংলাদেশের মুক্তি যোদ্ধারা তাদের বিরত হতে বাধ্য করবে। সে জন্য তারা প্রস্তত হয়েই আছে। ৪ ডিভিশন কেন তথাকথিত পাকিস্তানের সমস্ত সেনা বাহিনী মোতায়েন করেও তারা বাংলাদেশে নির্বাচন করতে পারবে না, এবং নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বীকারী কুহসলিংদের রক্ষা করতে পারবে না। মুক্তিযোদ্ধারা একজন একজন করে খুজে খুজে প্রার্থীদের হত্যা করবে।
বাংলাদেশে পণ্য বিক্রি হচ্ছে না
পাকিস্তানের শেয়ার বাজারে সৃষ্টি হয়েছে সংকট
(অর্থনৈতিক ভাষ্যকর) একটা দেশের ব্যবসা বাণিজ্যের হাল মোটামুটি ভাবে বুঝতে হলে সে দেশের শেয়ার মার্কেটের সাধারণ গতি প্রকৃতির উপর লক্ষ্য রাখতে হয়। ব্যবসার অবস্থা মোটের উপর ভাল হলে, শেয়ারের বাজারে শেয়ার কেনা বেচা বেশী হয়। ব্যবসায় মন্দা ভাব দেখা দিলে বিভিন্ন শেয়ারের দাম যেমন কমে তেমনি শেয়ার ক্রয় বিক্রয়ের হারও কমে যেতে থাকে। যুদ্ধের সম্ভাবনার কথা প্রচার করা হলে, একটা দেশের শেয়ার বাজারে সংকট দেখা দেয়। সকলে শেয়ার বেচে দিয়ে হাতে নগদ টাকা পেতে চায়। এছাড়া যুদ্ধের ফলে বিদেশে পণ্য রপ্তানী এবং বিক্রি হবার জন্য বাজারে জিনিস জমে যায়। এভাবে পণ্যের চলাচল বন্ধ হয়ে যাবার জন্যও শেয়ার মার্কেটে শেয়ারের দাম কমতে থাকে। শেয়ার কিনবার লোকের অভাব দেখা যায়। করাচীর ইংরেজী দৈনিক, ‘ডন’ এর এক খবরে প্রকাশ, করাচীর শেয়ার মার্কেটে খুব মন্দাভাব দেখা দিয়েছে। করাচীর শেয়ার মার্কেটে যেখানে আগে প্রতিদিন দশ থেকে কুড়ি হাজার শেয়ার হাত বদল হত, এখন তা হচ্ছে না। শেয়ারের দামও বাজারের দ্রুত নেমে যাচ্ছে। যা থেকে বোঝা যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যবসা বাণিজ্যে সঙ্কট সৃষ্টি হবার কথা। পত্রিকাটিতে আরো বলা হয়েছে যে, বাজারে পণ্য সামগ্রী ক্রমশই চাকিদার অভাবে জমে যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের পণ্য দ্রব্যের প্রধান বাজার ছিল বাংলাদেশ। পশ্চিম পাকিস্তানের কলগুলোতে যে পরিমাণ কাপড় তৈরি হত তার অধিকাংশ বিক্রি হত বাংলাদেশে। কিন্ত এই বাজার এখন বন্ধ। এছাড়া পাকিস্তান ও ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনা, পশ্চিম পাকিস্তানের সমস্ত ব্যবসা বাণিজ্যের অনিশ্চিত করে তিলেছে।
শুধু করাচীতেই যে শেয়ার বাজারে মন্দা দেখা দিয়েছে, কেনা–বেচা কমে গিয়েছে, তা নয়। লাহোরের শেয়ার মার্কেটেও সৃষ্টি হয়েছে বিরূপ প্রতিক্রিয়া। যুদ্ধের সম্ভাবনা তীব্র হবার সাথে সাথে লাহোর শেয়ার বাজারের অবস্থাও খারাপ হয়ে পড়েছে। লাহোর থেকে প্রকাশিত পাকিস্তানী টাইমস পত্রিকাতেও করাচীর ‘ডন’ পত্রিকার মত শেয়ার বাজারের সঙ্কটের কথা উল্লেখ করা হয়েছে। এ থেকে বোঝা যাচ্ছে যে, পাকিস্তানের অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে চলেছে এক বিরাট সংকটের পথে।
শিল্প–সংস্কৃতি
সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার
পাবলো নেরুদার সম্মান
এবার সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার পেয়েছেন চিলির বিখ্যাত কবিম পাবলো নেরুদা। তার সম্পর্কে বলতে গিয়ে নোবেল পুরস্কার কমিটি বলেছেঃ নেরুদার মধ্যে একট সমগ্র মহাদেশের আবেগ ও আকাঙ্খা কাব্যরূপ লাভ করেছে।
নেরুদা কেবল একজন কবি নন। একজন কূটনীতিজ্ঞ। তিনি ৩০ বছর বয়সে চিলির কূটনীতিক বিভাগে যোগ দেন। বর্তমানে তার বয়স ৬৭ বছর। তিনি এখন প্যারিসে চিলির রাষ্ট্রদূত হিসাবে কাজ করছেন।
রাজনৈতিক দিক থেকে নেরুদা কম্যুনিস্ট। তিনি স্পেনের গৃহযুদ্ধে যান ও সেখানেই কম্যুনিস্ট মতবাদকে পুরাপুরি গ্রহণ করেন। মতবাদে কম্যুনিস্ট হলেও তার কবিতা রাজনীতির প্রচার পত্র নয়। তার কবিতার উপর আধুনিক কাব্য আন্দোলনের প্রতীকবাদ ও সুরিয়ালিজম এর বিশেষ প্রভাব রয়েছে। তাছাড়া তিনি কম্যুনিস্ট হলেও কোন কম্যুনিস্ট পার্টির নির্দেশে পরিচালিত হন না। ১৯৫৮ সালে রুশ কবি ও ঔপনাসিক পাস্তারনেক কে যখন নোবেল পুরষ্কার গ্রহণ করতে রুশ সরকার বাধা প্রদান করেন, তখন নেরুদা হন সেই নীতির কঠোর স্মালোচক।
ল্যাতীন আমেরিকার অনেক শিল্পী সাহিত্যিকই খুব রাজনীতি সচেতন। নেরুদা একটি ব্যতিক্রম নন। ১৯৬৭ সালে গুয়াতেমালার আস্তরিয়াস কে সাহিত্যে নোবেল পুরষ্কার দেওয়া হয়। ইনিও বামপন্থি রাজনীতির প্রতি সহানুভূতিশীল এবং ইনিও একজন কূটনীতিজ্ঞ।
নেরুদার কবিতা বহু ভাষায় অনূদিত হয়েছে। সামগ্র ভাষাভাষী অঞ্চলে তিনি অনেক দিন থেকেই একজন শ্রেষ্ঠ গীতি কবি হিসেবে প্রখ্যাত। নেরুদাকে নোবেল পুরষ্কার দেওয়ায় প্রমাণিত হল, সাহিত্য বিচারে লেখকের ব্যক্তিগত রাজনৈতিক মতামত, বড় কথা নয়। সাহিত্যিক গুণাবলী থাকলে, লেখকের রাজনৈতিক মতাদর্শ যাই হোক, তার রচনার প্রভাব পড়ে নানা দেশের নানা মতের মানুসের উপর।
গেরিলা যোদ্ধাদের সফল আক্রমণ অব্যাহত
বেঈমান হামিদুল হকের প্যাকেজিং কারখানা ধ্বংস
(জয়বাংলা প্রতিনিধি প্রেরিত)
বীর প্রসবিনী বাংলার অসম সাহসী মৃত্যুঞ্জয়ী সন্তানরা হানাদার দখলীকৃত বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দস্যু সৈন্যদের ওপর অব্যাহতভাবে প্রচণ্ড ও দুর্বার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। শত চেষ্টা ও শক্তি নিয়োজিত করেও দখলদার সেনারা মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধাদের সম্মুখে এটে উঠতে পারছে না।
কড়া সামরিক পাহারা ও চেক পোষ্টের মধ্যেই সুসংগঠিত ৪০ জনের একটি গেরিলা দল হানাদার সৈন্যদের চোখে ধুলো দিয়ে খোদ ঢাকা শহরের প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত বাংলার দুশমন মীর জাফর ও কুখ্যাত হামিদুল হক চৌধুরির বিশাল প্যাকেজিং কারখানাটি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করে দিয়েছে।
ঢাকা থেকে আমাদের প্রতি নিধি জানাচ্ছেন যে, গত ১৯শে অক্টোবর রাত্রে ৪০ জনেরো অধিক একদল সশস্ত্র স্বাধীনতাকামী গেরিলা যোদ্ধা ঢাকা শহরের বিভিন্ন পথ দিয়ে সুকৌশলে পাকিস্তানী সৈন্যদের পাশ কাটিয়ে ঢাকার উপকণ্ঠে কাজলায় অবস্থিত উক্ত মীর জাফরের প্যাকেজিং কারখানায় উপস্থিত হন। অতঃপর তারা কার্যরত ষ্টাফদের ষ্টেনগানের মুখে বের করে আনেন। তারপর মুক্তিযোদ্ধাদের উপর্য্যুপরি কয়েকটি গ্রেনেড নিক্ষেপ করে এবং আগুন লাগিয়ে কারখানার যন্ত্রপাতি সম্পূর্ণরূপে ধ্বংস করেন। এই সফল আক্রমণের সময় একজন মীর জাফর খতম হয়। ভীত সন্ত্রস্থ পাকিস্তানী সৈন্য অথবা ফায়ার ব্রিগেড এই আক্রমণের ৬ ঘণ্টা পরও ঘটনাস্থলে যেতে সাহস পায় নি।
[পঞ্চম পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
বাংলাদেশ সমস্যায় উত্তর কোরিয়া ও চীনের ভূমিকা কি?
উত্তর কোরিয়া একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। বহু ঘাত প্রতিঘাতের মধ্য দিয়ে তাকে জাতীয় আজাদী রক্ষা করতে হয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র সহ বহু পশ্চিমা দেশ ও তাদের তাবেদার দের সাথে উত্তর কোরিয়াকে যুদ্ধ করতে হয়েছে। সে যুদ্ধে তৎকালীন পাকিস্তানকে ও টানার চেষ্টা হয়েছিল সাম্রাজ্যবাদীদের পক্ষে। কিন্ত তৎকালীন পাকিস্তানের এক মাত্র বিরোধী দল আওয়ামী লীগের তীব্র প্রতিবাদের মুখে পাকিস্তানের শাসকেরা তা করতে পারে নি।
পশ্চিম পাকিস্তানের মানুস বরাবরই সুবিধাবাদী ছিল। যখন যে দিক থেকে সাহায্য পাওয়া যেতো তারা সব সময় সে দিকেই থাকত। সুতরাং একমাত্র আওয়ামী লীগ এবং বাংলাদেশের জনগণের প্রতিবাদের ফলেই পাকিস্তানের শাসকেরা কোরীয়া যুদ্ধে পশ্চমা সাম্রাজ্য বাদীদের পক্ষ নিতে সাহস পায় নি।
উত্তর কোরিয়া চীন, রাশিয়ার মতই একটি সমাজতান্ত্রিক দেশ। যে কোন দেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলন এবং সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরধী আন্দোলনের তারা সমর্থন দিতে নৈতিক ভাবে বাধ্য। কারণ এটা তাদের বিঘোষিত নীতি। এ ব্যাপারে রাশিয়া বাংলাদেশ প্রশ্নে মোটামুটিভাবে তার নীতি মাফিক কাজ করে চলেছে। চীন ছাড়া অন্যান্য সমাজতান্ত্রিক দেশও বাংলাদেশকে সমর্থন দিচ্ছে – অন্ততঃ বিরোধীতা করছে না কেও। কিন্তু হালে আসলে সমাজতান্ত্রিক দেশ উত্তর কোরিয়া নাকি বাংলাদেশ প্রশ্নে এক নেক্কারজনক ভূমিকা নিয়েছে।
কয়েকদিন আগে খবর বেরিয়েছিলো যে, উত্তর কোরিয়া পাকিস্তান কে সামরিক সাহায্য দিতে অগ্রহী। যে ক্ষেত্রে নিক্সনের মতো প্রতিকৃয়াশীল লোক বাংলাদেশে মানুস মারার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গি চক্রকে প্রকাশ্যে সামরিক সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে লজ্জা পায়, সে ক্ষেত্রে উত্তর কোরিয়ার মত একটা সমাজতান্ত্রিক দেশ কি করে প্রকাশ্যে বাংলাদেশের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে নিয়জিত মানুসদের মারার জন্য একটি সাম্রাজ্যবাদী উপনিবেশিক সরকারকে সাহায্য দেয়ার ব্যাপারে আগ্রহ প্রকাশ করতে পারে তা ভাবলে আশ্চর্য হতে হয়। উত্তর কোরিয়া এ পর্যন্ত আলোচ্য খবরটার কোন প্রতিবাদ করে নি। তাহলে খবরটা কি সত্য?
এদিকে গত ২৩শে অক্টোবর একটা খবর বিভিন্ন দেশের পত্র পত্রিকায় স্থান পেয়েছে। বলা যায়, খবরটায় সমাজতান্ত্রিক উত্তর কোরিয়ায় বহু বিঘষিত নীতির হাটে হাড়ি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছে।
খবরে বলা হয়েছে যে, সম্প্রতি চারজন পদস্থ সামরিক অফিসারকে নিয়ে উত্তর কোরিয়ায় একটি সামরিক দল গোপনে পাকিস্তান সফর করে গেছেন এবং পাকিস্তানকে অস্ত্র ও গোলাবারুদ তৈরির জন্য বিপুল পরিমাণ সামরিক গুরুত্বপূর্ণ দ্রব্য সরবরাহের ওয়াদা করেছে।
প্রতিনিধি দলটির নেতৃত্ব করেন মিঃ সিপ ম্যান। তারা হুং ন’য়ং সূ-তে জাহাজে ওঠেন এবং গত ২২শে সেপ্টেম্বর পাকিস্তানে পৌছেন। তারা ৯ই অক্টোবর পর্যন্ত পাকিস্তানে অবস্থান করেন।
খবরে আরোও বলা হয়েছে যে, সামরিক প্রতিনিধি দলের পাকিস্তান যাত্রার আগে উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানে এক জাহাজ অস্ত্রসস্ত্র প্রেরণ করে। জাহাজে অন্তত সাড়ে তিন হাজার টন অস্ত্রশস্ত্র ছিলো। জাহাজ খানা ২৫ শে আগস্ট করাচির উদ্দেশ্যে উত্তর ভিয়েতনামী বন্দর ত্যাগ করে।
খবরে আরোও প্রকাশ উত্তর কোরিয়ার সামরিক প্রতিনিধি দল পাকিস্তানের দেশ রক্ষা সার্ভিসের কতিপয় উচ্চ পদস্থ লোকের সাথে সাক্ষাত করেন এবং তাদের সাথে একতা চুক্তিতে উপনীত হন। চুক্তিতে পাকিস্তানী অস্ত্র কারখানা গুলোতে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাবারুদ উৎপাদনের জন্য পাকিস্তানকে বিপুল পরিমাণ কাচামাল সরবরাহ করার বিষয় ঠিক হয়।
এ ব্যাপারে উত্তর কোরিয়া পাকিস্তানের জঙ্গি সরকারকে যেয়ে সমস্ত মালমশলা দেবে তার মধ্যে রয়েছে ২০০০ টন তাম্র পিন্ড, শেনের ১২০০০ টন স্পাতের ষোল, ৫০০ টন সীসা, ৫০০ টন জিংক, ১০০০ টন কার্তুজের ট্রিপ, ৫০০০ টন বিশেষ ইস্পাত।
আর চীনের ভূমিকা কি?
অন্য দিকে চীনের ভাষায় সাম্রাজ্যবাদী শক্তিসমূহ সমন্বয়ে গঠিত কনসোটিয়াম যখন বাংলাদেশে গণহত্যা পরিচালনার প্রতিবাদে ঔপনিবেশিক পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য দান বন্ধ করে দিয়েছে, মার্কিন সিনেট ও প্রতিনিধি পরিষদ পাকিস্তানকে সকল প্রকার সামরিক, অর্থনৈতিক ও অন্যবিধ সাহায্য বন্ধ করে দেবার জন্য সর্বসম্মত প্রস্তান নিয়েছে। সেক্ষেত্রে জঙ্গী শাহীকে সাহায্যের ব্যাপারে চীনের এগিয়ে আসার বিষয়টা সত্যিই বিস্ময়কর। আফ্রো এশিয়া ল্যাটিন আমেরিকার নির্যাতিত নিপীড়িত কোটি কোটি মানুস মহা চীনের কাছ থেকে কি এতোদিন এটাই আশা করেছিল? তারা চীনকে মনে করেছিল তাদের মুক্তির দূত হিসাবে। তারা আশা করেছিল মহাচীন এসব এলাকার প্রতিটি জাতীয় মুক্তি আন্দোলনে সক্রিয় সাহায্য সহযোগিতা করবে। সাম্রাজ্যবাদ ও ঔপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে লড়বে। কিন্ত বাংলাদেশ প্রশ্নে মহা চীনের সেই মহান ভূমিকা কোঁথায়? বরং তারা মুক্তি পাগোল একটা জাতীর নিধনযজ্ঞে হত্যাকারীকেই সক্রিয় সাহায্য করছে, তারা দিচ্ছে টাকা পয়সা, অস্ত্র শস্ত্র, গোলাবারুদ।
সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, চীন পাকস্তানকে বাংলাদেশের বিভিন্ন অংশে ছোট ছোট কতিপয় কলকারখানা নির্মানের ব্যাপারে পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করতে রাজী হয়েছে। তাছাড়া তারা উত্তর বঙ্গে ৫ হাজার টিউবওয়েল বসানোর ব্যাপারেও পাকিস্তান সরকারকে সাহায্য করবে। কিন্ত ইয়াহিয়া সরকার যে এসব কাজে টাকা এনে তা সামরিক কাজে ব্যয় করবে না তার নিশ্চয়তা কোঁথায়? তদুপরি চীনের সাহায্য তো স্বাধীনতার পর বাংলাদেশ সরকারকেও দেয়া যাবে। চীনের সাহায্যের প্রতি বাংলাদেশের মানুসের কোন বিতৃষ্ণা থাকার কথা নয়। তবে কেন এত তাড়াহুড়া ?
উন্নয়ন কাজের জন্য পাকিস্তানের সামরিক জান্তার তা সামরিক কাজে ব্যয়ের নজীর চীনের অজানা নয়। ঘূর্ণিবাত্যা দুর্গতদের জন্য পাওয়া সাহায্য ও নৌযানগুলো যে তারা বাঙ্গালী নির্ধনের কাজে খটিয়েছে তা সারা বিশ্বেরই জানা।
তাছাড়া মানুষকে কোন বিষয়ে চিরকাল অন্ধকারে রাখা কারো পক্ষেই সম্ভব নয়।চীনের পক্ষেও নয়।সাম্প্রতিক কালে পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বরতা শিকার-বাঙ্গালীদের জন্য চীন সাহায্য পাঠিয়েছিল। কিন্তু ;গুড়া দুধ’ বিস্কুটের বাক্স বলে কথিত সেই বড় বড় বাক্স গুলোতে আসলে কি ছিল? তাতে কি গুড়া দুধ ও বিস্কুটের বদলে অস্ত্র সশ্ত্র ও গোলাবারুদ ছিল না?
শয়তানের মুখপাত্র কি বলে –
ভারত-যুগশ্লাভ যুক্ত ইশতেহার পাকিস্তানকে যথেষ্ট বিচলিত করেছে। পাক পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র সম্প্রতি উক্ত ইশতেহারকে পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে প্রত্যক্ষ হস্তক্ষেপ বলে অভিহিত করেন।
পাকিস্তানকে ভেঙ্গে টুকরো টুকরো প্রকাশ্য ঘোষিত উদ্দেশ্যকে চরিতার্থ করার ভারতীয় উদ্ধ্যগ বোঝা গেলেও একটি বন্ধু রাষ্ট্রের রাষ্ট্র প্রধানের সফর উপলক্ষ্যে প্রকাশিত ইশ্তেহারে তারই প্রতিফলন অত্যান্ত বিস্ময়কর বলে উক্ত মুখপাত্র মনে করেন
উক্ত মুখপাত্র আরোও বলেন যে, রাষ্ট্র প্রধানদের আলাপ-আলোচনায় বিশ্বের উত্তেজনা হ্রাসের ব্যাপারে গঠনমূলক প্রস্তাবই সকলেই প্রত্যাশা করেন। কিন্তু উক্ত ইশতেহারে এমন একটি বিষয় আলোচিত হয়েছে যা একান্তই পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার। এবং তাতে অন্য রাষ্ট্রের হস্তখেপ করার কিছুই নেই।
নেতাজী আমাদের অনুপ্রেরণার উৎস
বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন যে, নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসুর জীবনী বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীর ও বাংলাদেশ সরকারের জন্য অনুপ্রেরণার উৎস।
আযাদ হিন্দ ফৌজের ২৮ তম প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে প্রেরিত এক বাণীতে সৈয়দ নজরুল ইসলাম এ কথা বলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন নেতাজীর লক্ষ ছিলো সশস্ত্র সংগ্রামের মাধ্যমে মাতৃভূমির মুক্তি আলোয়ন। সুতরাং শেখ মুজিবুর রহমানের নেতৃত্বে আমরা আজ যে ধরণের সশস্ত্র সংগ্রামে নিয়োজিত রয়েছি তার সাথে নেতাজীর সংগ্রামের অনেক সাদৃশ্য রয়েছে।
পরলোকে জনাব আতর আলী
যশোর আওয়ামী লীগের অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য জনাব আতর আলী গত ১২ই অক্টোবর রাত দেড়টার সময় ৬৫ বছর বয়সে মুক্তি বাহীনির একটা হাসপাতালে শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্নাহে লিল্লাহে … রাজেউন)। মৃত্যুকালে তিনি যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি এবং মাগুরা মহকুমা আওয়ামী লীগের সভাপতি ছিলেন। গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের কাজে মাত্রাতিরিক্ত পরিশ্রমের ফলে জনাব আতর আলীর স্বাস্থ একেবারেই ভেঙ্গে পড়েছিল এবং তিনি জণ্ডিস সহ কয়েকটি রোগে আক্রান্ত হয়ে পড়েন। মৃত্যুকালে তিনি ৫ পুত্র ও ৩ কন্যা রেখে গেছেন।
আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হয়ে পরার পর থেকে তিনি বিভিন্ন সরকারের হাতে নির্যাতিত হন। শুধুমাত্র আইয়ুব আমলেই তিনি কয়েকবার কারাগারে নিক্ষিপ্ত হন। গত নির্বাচনে তিনি মাগুরার সালিখা এলাকা থেকে তৎকালীন প্রাদেশিক পরিষদের সদস্য নির্বাচিত হন। মুক্ত এলাকায় কাশীপুর গ্রামে তার লাশ দাফন করা হয়েছে।
শোকবাণী
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মীজানুর রহমান চৌধুরী এক বিবৃতিতে জনাব আতর আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন। তার মৃত্যুতে আওয়ামীলীগের এক বড় রকমের ক্ষতি হয়েছে বলে অভিমত প্রকাশ করেন। তিনি মরহুমের পরিবার পরিজনের প্রতি গভীর সহানুভূতি প্রকাশ করেন।
অপর এক বিবৃতিতে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের কৃষি সম্পাদক, যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও জাতীয় পরিষদের সদস্য জনাব সোহারাব হোসেনও জনাব আতর আলীর মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেন এবং তাকে স্বাধীনতা সংগ্রামের এক বীর সৈনিক বলে অভিহিত করেন।
তিনি বলেন, জনাব আতর আলী বাংলাদেশের ম্নানুসের মঙ্গলের জন্য জীবনের শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত সংগ্রাম করেছেন। বৃদ্ধ বয়সেও তিনি কোন বিপদকেও বড় মনে করেন নি। আমাদের সকলেরই তার আদর্শে অনুপ্রাণিত হওয়া উচিৎ বলে তিনি মন্তব্য করেন।
ওরা অনুপ্রবেশকারী নয় বাঙ্গালী সন্তান
ইয়াহিয়ার মিথ্যা বেসাতির জবাবে কর্ণেল ওসমানী
মুক্তিবাহিনীর প্রধান সেনাপতি কর্নেল এম, এ, জি ওসমানী ইয়াহিয়া খানের অভিযোগ কে ‘ইচ্ছাকৃত সত্যের অপলাপ’ বলে বর্ণনা করেন।ইয়াহিয়া খান বলেছিলেন যে বাংলাদেশে ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা লড়াই করছে।
ফরাসী পত্রিকা ‘লেমদে জনৈক প্রতিনিধির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া খান ঐ অভিযোগ করেছিলেন।
কর্নেল ওসমানী বলেন যে, অনুপ্রবেশকারীরা ইয়াহিয়ার ২৫০০ সশস্ত্র সৈন্যকে নিশ্চিহ্ন করে দিতে পারেনা এবং বাংলাদেশের জনগনের অকুন্ঠ সমর্থন পেতে পারেনা। রাজনৈতিক এবং জাতিগতভাবে গঠিত বাঙ্গালী জাতি স্বাধীনতা এবং মানবধিকারের জন্য মরণপণ করে লড়াই করেছেন।
নিয়মিত সেনাবাহিনী এবং সর্বস্তরের লোকজন দিয়েই মুক্তি বাহিনী গঠিত হয়েছে। মুক্তি বাহিনীতে বিশ্ববিদ্যালয়ের থেকে পাশ করা শিক্ষিত লোক যেমন রয়েছে তেমনি এতে আছেন ছাত্র , শ্রমিক এবং গ্রাম বাংলার খেত মজুর। এরা সকলেই একনিষ্ঠতা ও সাহসিকতার সঙ্গে সত্য ও ন্যায় প্রতিষ্ঠা করার জন্য এবং জঘন্য ধরনের উপনিবেশ বাদের কবল থেকে মুক্তি লাভের জন্য দৃঢ মনোবল নিয়ে লড়াই করছেন।
শত্রু সেনারা উন্নত ধরনের অস্ত্র-শস্ত্রে সুসজ্জিত হয়ে মরিয়া হয়ে লড়াই করলেও যুদ্ধে পরাজয় বরণ করে চলেছে।
ইয়াহিয়া খান এখন সমস্যাটিকে আন্তজারতিক রূপদানের চেষ্টা চালাচ্ছেন এবং অনির্বায পয়াজয়ের কলঙ্ক ঢাকা
দিতে চেষ্টা করছেন।
[ষষ্ঠ পৃষ্ঠার এখানেই সমাপ্তি]
[সপ্তম পৃষ্ঠাই নতুন কিছুই নেই]
শেরে বাংলার জন্মদিনে – আবদুল গাফফার চৌধুরী
আজ ছাব্বিশে অক্টোবর। শেরে বাংলা ফজলুল হকের পুণ্য জন্মদিন। প্রায় শতাব্দীকাল পূর্বে এই দিনে বরিশাল জেলার চাখারে ফজলুল হক জন্ম গ্রহন করেন। সে দিন হয়তো স্বপ্নেও কেউ ভাবেনি, এই শিশু এক দিন সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী ইতিহাসের রূপরেখা তৈরী করবেন। তার ঝঞ্ঝাক্ষুব্ধ জীবনই হবে সংগ্রামী বাংলার সত্যিকার জীবনোতিহাস। মৃত্যুর কয়েক বছর আগে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তন উৎসবে চ্যান্সেলর হিসাবে ভাষণ দিতে গিয়ে এই বয়োবৃদ্ধ জননেতা বলেছিলেন, I am the living history of Bengal for the last 50 years। অর্থাৎ আমি বাংলাদেশের গত অর্ধ শতাব্দির জীবন্ত ইতিহাস। মধ্য যুগে ফরাসী সম্রাট চতুর্দশ লুই অহংকার করে বলেছিলেন I am state অর্থাৎ আমিই রাষ্ট্র। আর বর্তমান যুগে একমাত্র ফজলুল হকই বিনা দ্বিধায় বলতে পেরেছেন আমিই ইতিহাস। আমি বাংলাদেশের জীবন্ত ইতিহাস। আত্নপ্রত্যয় কত গভীর হলে একজন জন নায়ক অকুণ্ঠ আত্ন পরিচয় দিতে পারেন, তা আজ ভেবে দেখার মতন। শেরে বাংলার স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা জানাতে গিয়ে রমনার বিশাল জনসভায় দাঁড়িয়ে এ যুগের বাংলার ইতিহাস, নবীন বাংলার জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান তাই ঘোষনা করেছিলেন, আমি নেতা নয়, আমি আপনাদের মুজিব ভাই। বাংলাদেশের নেতা ফজলুল হক এবং সোহরাওয়ার্দী। তারা কবরে শুয়েও আমাদের সংগ্রামে আজ নেতৃত্ব দিচ্ছেন। আমি সেই সংগ্রামে আপনাদের সহকর্মী ও বন্ধুর ভূমিকা নিয়েছি মাত্র। বঙ্গবন্ধু অতুক্তি করেন নি। ফজলুল হক মারা গেছেন ১৯৬২ সালের ২৭ শে এপ্রিল তারিখে। তার দীর্ঘ ৮ বছর কেটে গেছে। এই ৮ বছরে বাঙ্গালীর স্মৃতি থেকে শেরে বাংলা মুঝে যাননি। বরং বাংলাদেশের স্বায়ত্তশাসনের আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা সংগ্রাম পর্যন্ত প্রতিটা পর্যায়ে বাংলার বাঘ যেন নতুন করে জেগে উঠেছেন। এবং বাঙালীর প্রেরণার উৎস হয়ে উঠেছেন। বাঙালীর কি সৌভাগ্য, ১৯৫৪ সালের বাংলা দেশের সাধারণ নির্বাচনে শতকরা ৯৯ ভোট পেয়ে যে শেরে বাংলা নির্বাচনে জীতেছেন, বাংলাদেশের পক্ষে ঐতিহাসিক ২১ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়িত করতে গিয়ে পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শাসকদের কাছ থেকে তিনি ট্রেইটর খেতাব লাভ করেছিলেন। তাকে বরখাস্ত করেন জরবন্দী করা হয়েছিল। এমন কি ঈদের দিনও তাকে জামাতে নামাজ পড়তে দেয়া হয়নি। পুলিশ ও সৈন্য বাহিনী দিয়ে তার ঢাকার সাতাশ নম্বর কে, এম, দাশ লেনের বাড়ি ঘিরে রাখা হয়েছিল। হুমকি দেয়া হয়েছিল, রাষ্ট্রদ্রহীতার অভিযোগে তাকে বিচার করে দরক্কার হলে ফাসি কাষ্ঠে ঝোলানো হবে। ১৯৭১ সালে ঘটেছে ১৯৫৪ সালেরই পুনরভিনয়। তবে আরোও বর আকারে এবং গণহত্যার নজিরবিহীন বীভৎসতার মধ্য দিয়ে। নবীন বাংলার জনক বঙবন্ধুরও অপরাধ তিনি এবার সারা পাকিস্তানের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছেন। তিনি তার নির্বাচনী ওয়াদা ঐতিহাসিক ৬ দফা কর্মসূচী বাস্তবায়িত করে বাংলাদেশ কে রাজনৈতিক বঞ্চনা ও অর্থনৈতিক শোষণ থেকে বাচাতে চেয়েছেন। তাই পিণ্ডির খুণী ইয়াহিয়ার চক্রের চোখে আজ তিনি দেশাদ্রহী বা ট্রেইটর। গোপনে তার বিচার প্রহসন চালানো হচ্ছে সদূর পশ্চিম পাকিস্তানের জেল খানায়। ইয়াহিয়ার হিজ মাস্টার্স ভয়েসেরা প্রচার করে বেড়াচ্ছে, শেখ মুজিব ভারতের এজেন্ট। তিনি ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু। আগেই বলেছি, পিণ্ডির এই প্রচারণা বাঙ্গালীর জন্য সত্যিই সৌভাগ্যের কারণ। কারণ, বাঙ্গালি আজ বুঝতে পেরেছে যারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি বঞ্চিত মানুসের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক অধিকার আদায়ের জন্য কথা বলছেন, তারাই করাচি ও পিন্ডির বেইমান ঔপনবেশিক শাসকদের কাছ থেকে ট্রেইটর, ইসলাম ও পাকিস্তানের শত্রু আখ্যা লাভ করেছেন। কয়েকটা উদহারণ দেই। ১৯৪০ সালের লাহোরে পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার শেরে বাংলা ফজলুল হক। ১৯৫৪ সালে তাকেই পাকিস্তানী শাসকেরা রাষ্ট্রদ্রহী আখ্যা দিয়ে তিনি ভারতের যোগসাযোশে স্বাধীন বাংলাদেশ কায়েম করতে চান এই অভিযোগ প্রমাণ করার জন্য মার্কিন মুল্লুক থেকে ক্যালহান নামের এক সাংবাদিক কে ভাড়া করে আনা হয়েছিল। ১৯৪৬ সালে পাকিস্তান ইস্যুর উপর অনুষ্ঠিত ভারতের স্বাধারণ নির্বাচনে যে শহীদ সহরাওয়ার্দী ছিলেন প্রথম কাতারের মুসলমান নেতা, যিনি অক্লান্ত পরিশ্রম না করলে বাংলাদেশের নির্বাচনী বিজয় ছিল মুসলিম লীগের কাছে অসম্ভব ব্যাপার। ১৯৫১ সালে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান তাকে ভারতের লেলিয়ে দেয়া কুত্তা বলে অশোভন ও অশ্লীল গালী দিতে লজ্জা বোধ করেনি। ১৯৫৫ সালে মওলানা ভাষাণী কে গুলি করে মারার হুমকি দিয়েছিলেন মেজর জেনারেল ইস্কান্দার মির্জা। ১৯৬৭ সালে বঙ্গবন্ধু এক বার আইয়ুব তথা কথিত আগরতলার মামলার আসামী ভারতের যোগসাযোশে বাংলাদেশে বিদ্রহ করার মিথ্যা অভিযোগে সামরিক আদালতে বিচারে সোপর্দ করে ছিলেন। ১৯৭১ সালে সেই আইয়ুবেরই মননীত পাকিস্তানের বেয়াইনী প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া একই অভিযোগে বঙ্গবন্ধুকে আবারও গ্রেফতার করেছেন। এবং ইসলাম ও পাকিস্তান রক্ষার নামে মাত্র ১০ লাখ বাঙালী নর নারী ও শিশু কে হত্যা করেছেন। দুখ্যে ক্ষোভে ক্রোধে অস্থির হয়ে উঠি যখন ভাবি, শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, ভাষাণী, বঙ্গবন্ধুর মত মহান দেশ প্রেমিক জন নায়কেরা ট্রেইটর আর দেশ প্রেমিক হলো ব্রিটিশের এক কালে পাচাটা বেতনভূক্ত সেপাই আইয়ুব, ইয়াহিয়া, টিক্কা আর নিয়াজীর দল। যে ইয়াহিয়ার হাত থেকে চব্বিশ ঘণ্টার এক মিনিটেরও জন্য মদের বোতল নামেনা, সেই ইয়াহিয়া হলো ইসলামের রক্ষক। ইসলামের সোনালী দিনে এই ভণ্ডামী করেছিল খুনি এজিদের বাবা মাবিয়া। হযরত আলীর সঙ্গে যুদ্ধে পরাজয় অনিবার্য জেনে বর্শার আগাই কোরআন শরীফ বেধে ইসলামের দোহাই পেরে সন্ধী ভিক্ষা করেছিল ইসলাম রক্ষার নামে। তারপর এই মাবিয়ার পুত্রের হাতেই মুসলমান এজিদের হাতেই কারবালার রক্তপাত এবং নবীবংশ ধ্বংস।
আপনাদের কাছে একটা মজার কথা বলি। এই বছর ২৭ শে এপ্রিল তারিখে অর্থাৎ শেরে বাংলার মৃত্যুর দিবসে বাংলাদেশে যখন ইয়াহিয়ার বর্বর হত্যাভিযান চলছে, তখন দখলকৃত ঢাকার বেতার থেকে খুব ইনিয়ে বিনিয়ে ফজলুল হক কত বড় পাকিস্তানী ছিলেন, পাকিস্তানের হেফাজতের জন্য তিনি কি কি করেছিলেন তার ফিরিস্তি দেয়া হচ্ছিল। কিন্ত একবারও এ কথা বলা হয়নি যে, ২৭ শে এপ্রিল শেরে বাংলার মৃত্যু দিবসে সরকারী ছুটির দিন ঘোষণা করতে ইয়াহিয়া সরকার রাজী হয়নি, রাজী হয়নি তার আগের আইয়ুব সরকারও। মৃত্যুর আগে তিনি ছিলেন ভারতের দালাল, পাকিস্তানের শত্রু। এখন মৃত্যুর পরে তাকে ইসলাম ও পাকিস্তানের শ্রেষ্ঠ বন্ধু বলে কুম্ভিরাশ্রু বিসর্জন করে ফজলুল হকের প্রতি কপট দরদ প্রচার করে বাংলাদেশের মানুসকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা চলছে। হয়ত আজও শেরে বঙ্গালার জন্ম দিনে দখলীকৃত ঢাকা বেতার থেকে ভাড়াটিয়া লেখক দ্বারা এ কপোট দরদ প্রচারের অভিনয় আরোও জোরে জোরে চলবে।
[অষ্টম পৃষ্ঠার সমাপ্ত]
জাতীয় স্বাধীনতা বিনিময়যোগ্য পণ্য নয়
(রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক)
ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ এবং ক্ষমতার লোভে উন্মাদ ইসলামাবাদ – পিন্ডি – লাহোরের সামরিক জান্তা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের জীবনে যে যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে, মুক্তি বাহিনীর পালটা মারে দিশেহারা হয়ে এখন সেই ভয়াবহ যুদ্ধের আগুন তারা সমগ্র উপমহাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার জন্যে মরীয়া হয়ে উঠেছে। মুক্তিবাহিনীর পালটা আক্রমণে তারা আজ নিশ্চিত মৃত্যুর ঘণ্টাধনি শুনতে পাচ্ছে। আর তাই তারা মরণকালে সারা উপমহা দেশে একটা লংকাকাণ্ড বাধিয়ে নিজেদের ভরাডুবির সঙ্গে সঙ্গে সমগ্র জন জীবনকে এক ভয়াবহ বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিতে উঠে পরে লেগেছে। এটা আসলে তাদের আত্নবিনাশেরই অন্তিম বিকৃতি।
বাংলাদেশের মানুস যুদ্ধ চায়নি। ইসলামাবাদ – পিন্ডি – লাহোরের সামরিক জান্তাএ ক্ষমতা লোভী উন্মাদেরা বাংলাদেশের মানুসের ওপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিয়েছে। বাংলাদেশের মানুস জানে যে, এক একটি যুদ্ধ ডেকে আনে ধ্বংস, এক একটি যুদ্ধে সহস্র সহস্র সন্তান হয় পিতৃহীন, বধু হয় স্বামী হারা, পিতা মাতা হয় সন্তান হারা, শত সহস্র পরিবারের দীপ নিভে যায়। কিন্তু ক্ষমতা লোভী যুদ্ধোন্মাদ দানবের কাছে মানবিক মূল্যবোধের আশা করা বাতুলতা। নিরস্ত্র মানুসের বিরুদ্ধে এক তরফা যুদ্ধের শুরুতেই তারা বাংলাদেশের শত শত পরিবারকে নিশ্চিহ্ন করেছে, লক্ষ লক্ষ পরিবারের দীপ চিরতরে নিভিয়ে দিয়েছে। দানবের পশু শক্তিকে নিশ্চিহ্ন করার জন্যে সেই মৃত্যুর মহা শ্মশানে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী। সত্য, ন্যায় ও শান্তি প্রতিষ্ঠার এই মহান সৈনিকদের আক্রমণে বিপর্যস্ত পাকিস্তানী পশু–শক্তি আজ ভীত, সন্ত্রস্থ, বুদ্ধিভ্রষ্ট। তারা এক্ষণে পূর্ব ও পশ্চিম সীমান্তে ব্যাপক সৈন্য সমাবেশ করেছে।
পাকিস্তানী সীমান্ত এবং দখলীকৃত বাংলাদেশ থেকে পাকিস্তানী সৈন্যদের যে সর্বাত্নক যুদ্ধের প্রস্ততি ও সামরিক সমাবেশের খবর পাওয়া যাচ্ছে, তাতে যে কোন মুহূর্তে সমগ্র উপমহাদেশে বিস্ফোরণ ঘটতে পারে বলে আশংকা করার কারণ রয়েছে। অবশ্য ব্লাকমেল করাই পাকিস্তানী জল্লাদদের সর্বাত্নক সমরস্ত্র প্রতির প্রাথমিক লক্ষ্য হওয়াও সম্ভব। বাংলাদেশে নিশ্চিত পরাজয় এড়াবার জন্যে পাক ভারত যুদ্ধের সম্ভাবনাকে আশংকাজনক পর্যায়ে নিয়ে গিয়ে পাকিস্তান বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রকে এই বিরোধি হস্তক্ষেপ করানোর উদ্দেশ্যে ব্লাকিমেল করতে চায়। কিন্ত আর একটি ক্ষেত্রে আরও প্রত্যক্ষ ও নির্লজ্জভাবে তাদের ব্লাকমেল করার মতলবটি প্রকট হয়ে উঠেছে।
রেডিও পাকিস্তানের খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানের স্বয়ং নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান নাকি শর্ত সাপেক্ষে সীমান্ত এলাকা থেকে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনী অপসারণ করতে প্রস্তত রয়েছে বলে ইরাণের পার্সি পোলিসে সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট মিঃ পদগণীকে জানিয়েছেন। এই শর্ত হচ্ছে (১) ভারতকেও সীমান্ত এলাকা থেকে সৈন্য সরিয়ে নিতে হবে, (২) পূর্ব বঞগে অনুপ্রবেশকারীদে প্রেরণা বন্ধ করতে হবে এবং (৩) অন্যান্য উস্কানীমূলক কার্যকলাপ বন্ধ করতে হবে। ইয়াহিয়ার এই শর্ত নির্লজ্জ ‘ব্লাকমেল’ ছাড়া আর কিছুই নয়।
যদিও বিশ্বের সকলেই জানে সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্যের সমাবেশ ও পাকিস্তানী হামলার সম্ভাবনা অত্যন্ত বাস্তব হয়ে ওঠার ফলেই ভারত পালটা রক্ষা ব্যবস্থা গ্রহণ করতে বাধ্য হয়েছে, তবু তাদের নিজস্ব ব্যাপারে ভারত কি করবে না করবে, তা একান্তই ভারতের ব্যাপার। তবে বাংলাদেশ সমস্যা ইয়াহিয়ার সামরিক জন্তার সৃষ্টি, ভারতের নয়; এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্ররূপও বাংলাদেশের মানুসের ইচ্ছানুযায়ীই নিরূপিত হবে – পাকিস্তান, ভারত বা বিশ্বের অন্য কোন রাষ্ট্রের ইচ্ছানুযায়ী নয়। কাজেই এ ব্যাপারে ভারতের ওপর কোন নৈতিক কারণ বা যোক্তিকতা পাকিস্তানের নেই এবং ভারতের পক্ষেও কোন শর্ত বাংলাদেশের ওপর চাপিয়ে দেয়া সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও শেষোক্ত দু’টি শর্তের অর্থ হচ্ছে শরণার্থীদের আশ্রয়দান এবং পাকিস্তানী বর্বরতার বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত গঠনের কাজ থেকে বিরত রাখা। তাদের মতে এটাই হচ্ছে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভারতের ‘উস্কানীমূলক কার্যকলাপ’।
ভারতের কাছে তাদের আব্দারটি হচ্ছে “পূর্ববঙ্গে অনুপ্ররবেশকারী” প্রবেশ বন্ধ করা। এ কথা সবাই জানে যে ভারত বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় তথাকথিত অনুপ্ররবেশকারী পাঠায়নি, পাঠানোর প্রয়োজন তাদের নেই। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় গেরিলা অভিযান পরিচালনা করছে বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনী। মুক্তি বাহিনী পালটা মার তারা সামাল দিতে পারছে না। তাই তারা চাইছে ভারত পাকিস্তানের হয়ে এই মুক্তি বাহিনীকে প্রতিহত করুক। ধৃষ্ঠতারও একটা সীমা থাকা উচিৎ। কিন্ত পাকিস্তানের উন্মাদরা সকল ঔচিত্যবোধ হারিয়ে ফেলেছে। যদিও বাংলাদেশের মানুস ও গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ৯০ লক্ষ শরণার্থীকে ভারতে আশ্রয়দান ও প্রতিপালনের জন্যে ভারত সরকারের প্রতি কৃতজ্ঞ কিন্ত তা সত্ত্বেও জাতীয় স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনের প্রশ্নে বাংলাদেশ সরকার বা বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী ভারত সরকারের ইচ্ছা বা ইঙ্গিতে চলতে বাধ্য নয় কিম্বা তার সঙ্গে ভারত সরকারের কোন সংশ্রবও থাকতে পারে না।
পাকিস্তানের সামরিক জান্তার এ কথা মনে রাখা উচিৎ ্যে, স্বাধীনতা বিনিময় যগ্য পণ্য নয়। বঙ্গবন্ধুর মুক্তি মূল্যের বিনিময় যেমন সাড়ে সাত কোটি মানুসের স্বাধীনতাকে বিক্রয় করা চলে না, তেমনি ভারতের প্রতি কৃতজ্ঞতার বিনিময়েও স্বাধীনতাকে বিকিয়ে দেয়া যায় না। সে অধিকার কারও নেই। দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা সংগ্রামকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্যে বঙ্গবন্ধু তার সর্বশেষ ভাষণে দেশের মানুসের প্রতি যে নির্দেশ দিয়ে গেছেন বাংলাদেশের বীর যোদ্ধারা, বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুস সেই পথ অনুসরণ করে চলেছে এবং মাতৃভূমির প্রতিটি ইঞ্চি পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মুক্ত না করা পর্যন্ত এই মুক্তি সংগ্রাম অব্যাহত থাকবে, আর পাকিস্তানী জনতা যে আগুন জ্বালাতে যাচ্ছে, সে আগুনে তারাই পুড়ে ছাই হয়ে যাবে।
ঢাকার অভ্যন্তরে – রেডিও সুইডেন
তিন দিন ব্যাপী বাংলাদেশ সফর শেষে নয়া দিল্লী ফিরে এসে সুইডেনের সাংবাদিক মিঃ লারগানার এরল্যান্ডুসন মন্তব্য করেন যে, ভীত সন্ত্রস্থ ঢাকা শহর।
রেডিও সুইডেনের প্রতিনিধি রূপে ঢাকা সফরের পর মিঃ এরল্যান্ডুসন বলেন যে, সর্বত্রই পাক বাহিনী মোতায়েন রয়েছে তা চোখে পড়বেই। সমস্ত সুবিধাজঙ্ক স্থানে এমনকি ডাকঘরে ও হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালেও সামরিক প্রহরা রয়েছে। হোটেলে ঢোকার সময় ও বাইরে আসার সময় তল্লাসী চালানো হচ্ছে।
তিনি বলে, ঢাকা সন্ত্রাস কবলিত শহরে পরিণত হয়েছে। সূর্য্যাস্তের পূর্বেই দোকান পাট বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে এবং এই সময়ে যুবকদের রাস্তায় দেখাই যায় না।
মিঃ এরল্যান্ডুসন বলেন যে, যদিও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ৫ হাজার ছাত্রের তালিকা রয়েছে কিন্ত ৩ থেকে ৪শ ছাত্র ক্লাশে যোগ দেয়।
তিনি বলেন যে, সংবাদপত্র গুলির ওপর সেন্সরের কড়াকড়ি ব্যবস্থা রয়েছে। ‘বাংলাদেশ’শব্দটির সংবাদপত্রের চৌহদ্দীর মধ্যে কোন স্থান নাই। শেখ মুজিব সম্পর্কিত কোন সংবাদই খবরের কাগজে ছাপা হয় না।
তিনি আরও বলে যে, সফররত সাংবাদিকের পক্ষে পরিশ্তিতির সঠিক চিত্র সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। ঢাকার বাইরে সফর নিষিদ্ধ করা হয়েছে। মুক্তি বাহিনী ও তার কার্যকলাপের সংবাদ বিভিন্ন সূত্রে শহরে এসে পৌছায়। গেরিলাদের মাইন আক্রমণে চট্টগ্রাম বন্দরে জাহাজ ধ্বংসের সংবাদ ঢাকায় পৌছে ছিল।
মিঃ এরল্যান্ডুসন বলেন, ‘যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের হাতে ত্রাণ বাবদ সাহায্য বিলিবণ্টনের দায়িত্ব রয়েছে সেহেতু বিভিন্ন দেশের প্রদত্ত ত্রাণ সাহায্যের বিলিবন্টন মোটেই আশাপ্রদ নয়।
তিনি এই মর্মে অভিমত প্রকাশ করেন যে, ত্রাণ বাবদ সাহায্যের বেশীর ভাগটাই পাক সেনারা ব্যবহার করেছে।
আরও ২ টি জাহাজ ধ্বংস
মুক্তিবাহিনীর বীর সৈনিকেরা সম্প্রতি আরো দুটি পাকিস্তানী জাহাজ সাফল্যের সাথে ডুবিয়ে দিয়েছেন। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোরা কয়েক দিন আগে দখলীকৃত চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙ্গর করা ‘নাসিম’ ও ‘এ্যাডলক’ নামে অস্ত্র বোঝাই দুটি পাকিস্তানী জাহাজ সম্পূর্ণ রূপে ডুবিয়ে দিয়েছেন।
ঢাকার বুকে
গেরিলা যোদ্ধাদের শত্রু নিধন অভিযান অব্যাহত
গত সপ্তাহে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী গেরিলা যোদ্ধারা কুখ্যাত বিশ্বাসঘাতক প্রাক্তন গভর্ণর আবদুল মোনায়েম খানকে হত্যার মাধ্যমে যে সাফল্যজনক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন তা ক্রমেই তীব্রতর হয়ে উঠছে। দখলীকৃত ঢাকার বুকে গেরিলা যোদ্ধারা হানাদার সৈন্যদের ওপর প্রকাশ্যে মারাত্নক আক্রমণ চালিয়ে শত্রু চলাচলের সব রকম গতিবিধি প্রতিরোধ করে ফাদে আটকিয়ে ফেলছেন।
গত ১৯শে অক্টোবর ঢাকার মতিঝিল এলাকায় একটি ব্যংকের সম্মুখে পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারের তাবেদরদের একটি মোটর গাড়ী দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে আমাদের দুঃসাহসিক বীর তরুণরা প্রকাশ্যে টহলরত হানাদার সৈন্যদের চোখ এড়িয়ে উক্ত গাড়ীর আসনের নীচক্সে একটা ‘টাইম বোমা’ বসিয়ে দেন। এর পর তাবেদারের ব্যাংকে লুটকৃত অর্থ সংক্রান্ত কার্যাদি শেষ করে মোটরে আসন গ্রহণ করার সঙ্গে সঙ্গে উক্ত বোমা বিস্ফোরিত হলে পাশ্ববর্তি অন্যান্য গাড়িও এক সঙ্গে ধ্বংসপ্রাপ্ত হয়। ফলে ঘটনা স্থলে ৫ জন তাবেদার খতম ও অন্য ১২ জন মারাত্নক আকারে জখম হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর অপেক্ষায় দুস্কর্মের শাস্তি ভোগ করছে।
বাংলাদেশের ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের’ প্রতি উত্তর ভিয়েতনামের সমর্থন
নয়া দিল্লীতে উত্তর ভিয়েতনামের কন্সাল জেনারেল কর্ণেল এন, এ ভূ সম্প্রতি এক সাংবাদিক সম্মেলনে জানান যে, তার দেশ বাংলাদেশের ‘জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম’ সমর্থন করে।
কর্ণেল ভূ বলেন, পূর্ববাংলার জনগণের প্রতি আমাদের পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। আমরা আশা করি পূর্ণ নিরাপত্তার সাথে ভারত থেকে লাখো লাখো শরণার্থীর স্বদেশে ফেরার জন্য বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান খুজে পাওয়া যাবে।
কয়েদীদের মানবতা
জেনেভার সেন্ট এ্যান্টোনি কারাগারের কয়েদিগণ ভারতে অবস্থানরত ‘পূর্ববাংলার’ শরণার্থী শিশুদের জন্য চাদা সংগ্রহের বিশেষ অনুমতি লাভ করে এ পর্যন্ত ২২৬ ডলার (১,৬৯৫ টাকা ভারতীয় মুদ্রায়)সংগ্রহ করেন।
‘বিশ্বের শিশু’ আন্দোলনের জন্য তারা প্রথমে ১ দিনের খোরকীর টাকাটাই দান করতে চেয়েছিলেন, কিন্ত এই প্রস্তাবটি অনুমোদন না পাওয়ায় কয়েদীগণ প্রতি সেল থেকে চাঁদা সংগ্রহ করেন।
[নবম পৃষ্ঠার সমাপ্ত]
‘ডেনমার্কের’ স্বঘোষিত যুবরাজের নতুন তত্বঃ সাম্প্রদায়িক সমাজবাদ
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
কিন্ত তাকে বাদ দিয়ে শাসন তন্ত্র রচনার কোন প্রশ্নই ওঠেনি। কারণ জাতীয় পরিষপদের অধিবেশনে ভুট্টো সাহেবের ও তার দলের নির্বাচিত সদস্যদের অংশগ্রহণের অধিকার কেওই হরণ করেনি। সেটা তিনিও জনতেন বলে পুনরায় নতুন তত্ব দিলেন, পাকিস্তানের একটি নয় দুটি মেজরিটি পার্টি রয়েছে। এর পেছনের প্রচ্ছন্ন ইঙ্গিতটি অবশ্যই ক্ষমতার অংশিদারিত্ব।
পরে আরোও এক ধাপ এগিয়ে তিনি ঘোষণা করলেন যে, পাকিস্তানের তিনটি রাজনৈতিক শক্তি রয়েছে। আওয়ামী লীগ, পিপলস পার্টি ও সশস্ত্র বাহিনী। ষড়যন্ত্রের রাজনীতিতে বিশ্বাসী ‘সাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্রবাদী’ ভুট্টো সাহেব ভেবেছিলেন, এভাবে সশস্ত্র বাহিনীর পিট চাপড়ে তিনি ক্ষমতার মসনদে বসতে পারবেন।
তিনি বঝেন নি যে, সশস্ত্র বাহিনীর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে ইতিপূর্বেই যিনি ক্ষমতার মসনদে জমিয়ে বসে আছেন, পিঠ চাপড়ে তাকে গদী থেকে নামানো যাবে না, তার জন্য চায় জনগনের সার্বভৌমের শক্তি ও ক্ষমতায় প্রতিষ্ঠা। কিন্ত সে পথে না গিয়ে পুরোণ শিক্ষা অনুযায়ী তিনি আরোও একধাপ এগিয়ে বললেন পাঞ্জাব ও সিন্ধুই পাকিস্তানের ক্ষমতার দূর্গ। কথাটা এক অর্থে তখন পর্যন্ত ঠিকই ছিল। কারণ অর্থ ও সমর শক্তীর চাবিকাঠি এ দুই প্রদেশের হাতে ছিলো। আর সে জন্যই তিনি ঐ প্রচ্ছন্ন ইংগিত করেছিলেন। কারণ, তার দলই ওই দুই প্রদেশের সংখ্যা গরিষ্ঠ। কিন্ত অপর শক্তিকে ক্ষমতার উৎস বলে ঘোষণার পর জনগণের ভোটের সংখ্যাগরিষ্ঠতার দাবির আর যে কোন মূল্য থাকে না ভুট্টোর রাজনৈতিক শিক্ষায় সে জ্ঞান জন্মেনি।
ভুট্টোর মুখে গণতন্ত্রের মৌল নীতিকে হত্যার বিরুদ্ধে কোন প্রতিবাদ ধণিত হয়নি। প্রতিবাদ ধনিত হয় নি বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুসকে হত্যার বিরুদ্ধে। প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় নি তার রাজনৈতিক শিক্ষা ও চারিত্রিক গঠনের জন্য। আবার প্রতিবাদ ধ্বনিত হয় নি কারণ এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের ষড়যন্ত্রের তিনিও একজন নায়ক।
ভুট্টো সাহেব জনগণের রায়ের উপরে নিজেকে স্থাপন করেছেন ডেনমার্কের যুবকের উপমা টেনে। তিনি পাকিস্তানের সশস্ত্র বাহিনীকে রাজনৈতিক শক্তি বলে স্বীকৃতি দিয়েছেন। সমাজতন্ত্রবাদী বলে দাবি করেও কেবলমাত্র পাঞ্জাব ও সিন্ধুকে ক্ষমতার দূর্গ বলে সার্টিফিকেট দিয়েছে। গণতন্ত্রবাদী হওয়া সত্ত্বেও পাকিস্তানের দুটি মেজোরিটি পার্টির অস্তিত্ব প্রচার করেছেন এবং আওয়ামী লীগকে প্রতিক্রিয়াশীল বলেও অভিহিত করেও প্রগতিশীল ভুট্টো খাটি ও নির্ভেজাল ইসলামী শাসনতন্ত্র রচিত হবে না এই আশংকায় খ্রিষ্টান কর্নেলিয়াসের প্রতি সন্দেহ প্রকাশ করেছেন।
এর পরে হালকা ভাবে কেও কেও হয়ত মন্তব্য করবেন যে, পাগলে কি না বলে আর ছাগলে কি না খায়, কিন্ত ভুট্টোর পূর্বাপর উক্তির মধ্যে সত্যই কি কোন স্ববিরোধিতা আঁছে? তবে ভুট্টো সাহেব যেদিন দেখবেন যে, তৃতীয় রাজনৈতিক শক্তি বলে যে সশস্ত্র বাহিনীকে তিনি স্বীকৃতি দিয়েছেন, তারা তৃতীয় শক্তির জায়গায় পশ্চিম পাকিস্তানে একক রাজনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে এবং ক্ষমতার মসনদের পরিবর্তে তাকে পথে বসিয়েছেন, ‘সাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্রি’ ভুট্টো সেদিন হয়ত সত্য সত্যি পাগোল হয়ে যাবে কিন্তু তার কথা নিয়ে লেখার আর কিছুই থাকবে না।
পূবাইলে ট্রেনের উপর হামলা করে চারজনকে খতম
মুক্তি যোদ্ধারা সম্প্রতি ঢাকা থেকে ১৮ মাইল দূরে পুবাইল স্টেশনের কাছে খান সেনা বাহী একটি ট্রেনের উপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ৪ জনকে নিশ্চিহ্ন এবং কয়েকজনকে মারাত্নক ভাবে আহত করেছেন। ফলে হানাদাররা এ পথেও ট্রেন চালাতে ঝুকি নিতে সাহস পাচ্ছে না।
জঙ্গি বিমান থেকে ব্যাপক গোলাবর্ষণ
মুক্তিবাহিনীর দুসাহসিক অভিযানের সম্মুখে টিকতে না পেরে খান সেনারা এক্ষণে বিমানের সাহায্য নিয়েছে।
গত সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধারা সিলেটের ছাতকে শত্রু সেনাদের উপর মরণ ছোবল চালাতে থাকলে বিপর্যস্ত খান সেনাদের সাহাযার্থে পাকিস্তানী স্যাবর জেটগুলো ছাতক শহরের নিরীহ বেসামরিক নাগরিকদের উপর নির্বিচারে বোমা বর্ষণ করে। গত কয়েক দিন যাবত এখানে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে খান সেনাদের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হচ্ছে। আমাদের তরুণরা এই শহরটা দখল করে নিয়েছে।
শরণার্থীরা মুজিবের বাংলাদেশেই ফিরবে – জগজীবন
গত ১৭ ই অক্টোবর জলন্ধর থেকে ১২ মাইল দূরে একজন সভাই বক্তৃতা প্রসঙ্গে ভারতের দেশ রক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম জোড়ের সাথে বলেন যে, এবার যদি পকিস্তান ও ভারতের মধ্যে কোন যুদ্ধ হয়, তবে তা পাকিস্তানের ভূখন্ডেই হবে। তিনি আরোও বলেন যে, এবারের যুদ্ধে ভারত যেসমস্ত পাকিস্তানী এলাকা দখল করবে তা আর কোন অবস্থাতেই ফেরত দিবে না।
শ্রী জগজীবন রাম বলেন, আমরা একেবারে লাহোর ও শিয়ালকোট পর্যন্ত এগিয়ে যাবো এবং পরিণতি যাই হোক না কেনো আমরা আর কোন অবস্থাতেই ঐ সব স্থান ছেড়ে আসব না।
একই দিন শ্রী জগজীবন রাম কপুর তলাতেও এক রাজনৈতিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন। ঐখানেও বক্তৃতাই তিনি বলেন যে, আমাদের উপর যদি পাকিস্তান শেষ পর্যন্ত যুদ্ধ চাপিয়ে দেয় তাহলে আমাদের সেনা বাহিনী পাকিস্তানী এলাকায় এগিয়ে যাবে এবং শহরের পর শহর দখল করে নিবে। বহি বিশ্বের চাপ যাই হোক না কেনো ভারত আর কোন অবস্থাতেই ঐ সব দখলকৃত এলাকা ছেড়ে আসবে না।
ভারতীয় দেশ রক্ষা মন্ত্রি বলেন যে, বাংলাদেশ সমস্যা অমীমাংসিত ভারত সীমান্ত অঞ্চল থেকে তার সেনা বাহিনী প্রত্যাহার করবে না। তিনি স্বীয় দেশ বাসীকে আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, পাকিস্তানের যে কোন দুর্ভিসন্ধি কার্যকরী ভাবে নস্যাৎ করার জন্য জাতীয় সশস্ত্র বাহিনী প্রস্তত আঁচে।
শ্রী জগজীবন রাম বাংলাদেশ পরিস্থিতির বিষয় উল্লেখ করে বলেন যে, সেখানে পরিস্থিতি দিনদিন মুক্তি বাহিনীর অনুকূলে চলে যাচ্ছে। সেখানে মুক্তি বাহিনির গেরিলারা পাকিস্তানের ৮০ হাজার সৈন্যকে জালে আটকিছে। এই অগ্রগতি যদি অব্যাহত থাকে তাহলে সেদিন বেশি দূরে নয় যে দিন বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাবে। মুক্তিবাহিনির হাতে এভাবে নাকানী চুবানি খেয়েই ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধর হুমকি দিতে শুরু করেছে।
শ্রী জগজীবন রাম বলেন, যদিও এটা সাধারণ জানা কথা যে, যে কুকুর বেশি ঘেও ঘেও করে সে কুকুর বেশি কামড়ায় না, শুধু অনুরুও হুমকি মোকাবেলার জন্য আমরা সম্পূর্ণ প্রস্তুত।
শ্রী জগজীবন রাম বলেন, পাকিস্তান ইতিমধ্যে প্রায় অর্ধেক শেষ হয়ে গেছেন। পাকিস্তানের সাথে হয়ত ভারতের যুদ্ধ করার কোন প্রয়োজন নাও হতে পারে।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খান আজ নিজেও বুঝতে পেরেছেন যে বাংলাদেশে তার সেনা বাহিণির উপর মুক্তিবাহিনী প্রাধান্য বিস্তার করেছে। বিশ্ব জনমতও দিন দিন পাকিস্তানের বিরুদ্ধে চলে যাচ্ছে। এমতা অবস্থায় বাংলাদেশকে স্বাধীন করার জন্য মুক্তিবাহিনির আর মাত্র একটি আঘাতের দরকার হবে।
ভারতীয় দেশরক্ষা মন্ত্রী শ্রী জগজীবন রাম শরণার্থীদের আশ্বাস দিয়ে বলেন যে, তারা শেখ মুজিবের বাংলাদেশেই ফিরে যাবেন, ইয়াহিয়ার পূর্ব পাকিস্তানে নয়।
সাভারে অরুণ নন্দীর বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি
(কলকতা প্রতিনিধি প্রেরিত)
কলকতা, ১৯শে অক্টোবরঃ বাংলাদেশের খ্যাতনামা সাঁতারু শ্রী অরুণ কুমার নন্দী একটানা ৯০ ঘণ্টা ৫ মিনিট সাতার দিয়ে এক বেসরকারী রেকর্ড সৃষ্টি করেছেন। এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের মিঃ বি, সি, মুন ৮৯ ঘণ্টা ৩৬ মিনিট পূর্বরর্তি বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টি করেছিলেন।
স্থানীয় বহুবাজার ব্যায়ামাগার সমিতি ও চাদপুর সম্মিলনি সমিতির যৌথ উদ্যোগে এই সাতার অনুষ্ঠানের ব্যবস্থা করা হয়। গত ৮ ই অক্টোবর তারিখে স্থানীয় স্কোয়ারের পুকুরে ভারতের হাই কমিশনের প্রধান জনাব এম, হোসেন আলী উক্ত অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন এবং অতঃপর শ্রী নন্দী সকাল ৮ টা ৩৫ মিনিটে বিশ্ব রেকর্ড সৃষ্টির এক দুঃসাহসিক উদ্দেশ্যে পানিতে নেমে পড়েন। তার এই প্রচেষ্টায় উৎসাহ যোগানোর জন্য বিশে বিখ্যাত সাঁতারু ব্রজেন দাসও সেই সময় পাশে ছিলেন।
অরুণ কুমার নন্দী বাংলাদেশে একটি পরিচিত নাম। স্কুল জীবন থেকেই সাতারে তিনি সুনাম অর্জন করতে থাকেন। এই সময় পর পর তিনবার প্রাদেশিক আন্তঃস্কুল প্রতিযোগিতায় চ্যাম্পিয়ান শীপ লাভ করেন। আন্তঃকলেজ প্রতিযোগিতায়ও তিনি ১৯৫৯ সালে ১৮ পয়েন্ট লাভ করে রানার্স আপ লাভ করেন।১৯৬০ সালে শ্রী নন্দী প্রথম বারের মত একটানা ৩০ ঘন্টা পানিতে সাতার কাটেন। ঐ বৎসরই ঢাকা থেকে চাদপুর দীর্ঘ ৬০ মাইল পথে প্রমত্ত পদ্মা,মেঘনা,বুড়ীগঙা,ধলেশ্বরী,ও সীতালক্ষ্যা নদী অতিক্রম করে ক্রীয়া জগতে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করতে সমর্থন হন। এরপর তিনি চাহপুর, কুমিল্লা, নোয়াখালী, ব্রিশাল, সিলেট ও ফরিদপুরে অনুষ্ঠিত বিভিন্ন প্রদর্শনীতে সাতার দিয়েও সুনাম অর্জন করেন।
১৯৬৯ সালে শ্রী নন্দীর প্রচেষ্টায় চাদপুর সুইমিং ক্লাব স্থাপিত হয়।বাংলাদেশে জঙী হানাদার সৈন্যর ধ্বংস যজ্ঞ শুরু শ্রী নন্দী প্রাণ বাচানোর জন্য ভারতে পালিয়ে আসেন।
বরিশালে ১২ জন দালাল অফিসার খতম
বরিশাল প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ,গেরিলা যোদ্ধারা গত ৮ই অক্টোবর খান সেনা তাবেদারদের একটি পুলিশ অফিসার দলের উপর চোরাগোপ্তা আক্রমন চালিয়ে একজন এস,ডি,ও সহ কমপক্ষে ১২ জনকে খতম করেন। অবশিষ্ট দালালরা হাতে পায়ে বুলেট ক্ষত নিয়ে কোন প্রকারে প্রাণ নিয়ে পালিয়ে যায়। মুক্তিযোদ্ধাদের এই দুঃসাহসিক অভিযানের ফলে খান সেনারদের দালাল অফিসাররা সম্ভাব্য মৃত্যুর চিন্তায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে বলে উক্ত খবরে প্রকাশ।
টিটো ইন্দিরা যুক্ত ইশতেহারে
বাংলাদেশ সরকারের সন্তোষ
বাংলাদেশের সরকারী মহল ভারত যুগোশ্লাভ যুক্ত ইশতেহারে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র দপ্তরের জনৈক মুখপাত্র বলেন, উভয় দেশ যে বাংলাদেশ সমস্যা সত্যিকারভাবে অনুধাবন করতে পেরেছেন তা যুক্ত ইশতেহার পাঠ করলেই বোঝা যায়। তাছাড়া মুক্তি সংগ্রামের প্রতি উভয় দেশের গভীর সহানুভূতি প্রকাশ পেয়েছে যুক্ত ইশতাহারে।
তিনি বলেন যে, যুগস্লাভ প্রেসিডেন্ট টিটো এবং ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী শেখ মুজিবুর রহমানের জন্য যে অস্বস্তি ও উদ্দ্যেগ প্রকাশ করেছেন তাতে বাংলাদেশের প্রতিটি মানুসেরই আবেগ প্রতিধ্বনিত হয়েছে।
শরণার্থীদের দেশে ফিরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে তার সরকারের নীতি উক্ত ইশতেহারে সমর্থিত হওয়ায় উক্ত মুখপাত্র সন্তোষ প্রকাশ করেন।
ইশতেহারে জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিকট গ্রহণযোগ্য রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলা হয়েছে। তিনি বলেন, আমরা জোর দিয়ে জানাতে চায় যে, বাংলাদেশে নির্বাচিত প্রতিনিধিরা পূর্ণ স্বাধীনতার পক্ষেই রায় দিয়েছেন। অন্য কিছুই তাঁদের কাছে গ্রহণযোগ্য নয়।
[দশম পৃষ্ঠার সমাপ্ত]
নিক্সন জল্লাদ ইয়াহিয়াকে রক্ষা করতে পারলেন না
পাকিস্তানে মার্কিণ সাহায্যের উপর সিনেটের নিষেধাজ্ঞা আরোপ
মার্কিন সিনেটের পররাষ্ট্র সম্প্র্রর্কিত কমিটি গত ১৪ই অক্টোবর পাকিস্তানের সকল প্রকারের সামরিক,অর্থনৈতিক,মঞ্জুরী,ঋণ ও ধারে বিক্রী সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার প্রস্তাব নিয়েছেন।
প্রেসিডেন্ট নিক্সন কংগ্রেসের কাছে অনুমোদনের জন্য বৈদেশিক সাহায্যের যে বিল প্রেরণ করেছিলেন তাতে তিনি পাকিস্তানকে ২২ কোটি ৫০লাখ ডলার (প্রায় ২শত কোটি টাকা) বৈদেশিক সাহায্য দানের প্রস্তাব করেছিলেন।কিন্তু সিনেট অনান্য সংশোধনী সহ পাকিস্তানের সাহায্যের অঙ্ক টি সম্পূর্ণ রূপে ছাটাই করে দেন।ইতি পূর্বে মার্কিন কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদও অনুরূপ মর্মে সিদ্ধান্ত গ্রহন করেন।ফলে কংগ্রেসের উভয় পরিষদের সর্বসম্মত সিদ্ধান্তের দরুণ পাকিস্তানে মার্কিন সাহায্য একেবারে বন্ধ হয়ে গেল।
সভা শেষে সিনেটের ফ্রাঙ্ক চার্চ সাংবাদিদের জানান প্রেসিডেন্ট নিক্সন যে পর্যন্ত কংগ্রেসকে জানাবেন যে পূর্ব বাংলায় রাজনৈতিক স্তিতিশীলতা যুক্তিযুক্ত পর্যায়ে ফিরে এসেছে এবং শরণার্থিদের স্বদেশে ফিরে যেতে দেওয়া হচ্ছে ততদিন পর্যন্ত পাকিস্তানে মার্কিণ সাহায্যের উপর এই নিষেধাজ্ঞা বলবৎ থাকবে।
সিনেটর ফ্রাঙ্ক চারর বলেন। গত আগস্ট মাসে প্রতিনিধি পরিষদ পাকিস্তানে মার্কিণ সাহায্য বন্ধের ব্যাপারে যে প্রস্তাব নেন সিনেটের প্রস্তাবের ভাষা তার চেয়ে অনেক কড়া।
তিনি বলেন, সিনেটের এই কড়া প্রস্তাবের ফলে পাকিস্তানের সকল রকমের মার্কিণ সাহায্য যথা সামরিক, অর্থনৈতিক, মঞ্জুরী, ধারে বিক্রী বন্ধ হয়ে গেল।
তিনি বলেন, বর্তমানে যে সমস্ত সাহায্য পাকিস্তানে যাওয়ার পথে ছিলো এ প্রস্তাবের ফলে তাও বন্ধ হয়ে গেলো।
ওলন্দাজ সাহায্যও বন্ধ
ওলন্দাজ প্রধানমন্ত্রী গত ১৪ই অক্টোবর পার্লামেন্টে ঘোষণা করেন যে, তার দেশ গত মাসের শেষ ভাগ থেকে পাকিস্তানে সর্ব প্রকার সাহায্য দান বন্ধ করে দিয়েছে এবং গত জুনের পর নতুন করে কোন ঋণের চুক্তি করে নাই।
এই সংবাদ প্রচার প্রসঙ্গে ওলন্দাজ বেতার জানান যে, পূর্ব বাংলার ব্যাপারে গণতন্ত্র সম্মত আচরন না করা পর্যন্ত পাকিস্তানে সমস্ত ওলন্দাজ সাহায্য বন্ধ করে দেয়ার দাবী জানান।
ব্লাক মেইলিং এর নয়া পায়তারা
তথাকথিত পাকিস্তান বেতারের এক খবরে প্রকাশ, সম্প্রতি ইরানের পারসেপোলিতে সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগর্ণীর সাথে দু’ঘণ্টাব্যাপী এক আলোচনা বৈঠকে পাকিস্তানের জংগীসাহীর নায়ক জেনারেল ইয়াহিয়া খান নাকি সীমান্ত থেকে সৈন্যবাহিনী সরিয়ে নেয়ার ব্যাপারে দুটো শর্ত আরোপ করেছেন।
এই শর্তগুলো হলোঃ ভারত নিজেও সীমান্ত থেকে সমস্ত সৈন্য সরিয়ে নিবে এবং ভারত পূর্ব পাকিস্তানের গেরিলাদের কোন রকম সাহায্য দিতে পারবে না।
আলোচনাকালে জেনারেল ইয়াহিয়া নাকি এই প্রস্তাব দিয়েছেন।
ইয়াহিয়ার সেদিন আর এদিন – —
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট দু’মাস আগে ঘোষনা করেনঃ মু৭ক্তিবাহিনী যদি পাকিস্তানের কোন অঞ্চল দখল করে তবে জগৎ জেনে রাখুক, আমরা যুদ্ধ ঘোষণা করব। আর এই যুদ্ধে আমরা একা থাকব না।
পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট এ বিবৃতি দেবার সময়, একা যুদ্ধ করবে না বলতে কি বোঝাতে চেয়েছিলো তা আমরা জানি না। তবে পাকিস্তানের পত্র পত্রিকায় চীনের নাম উল্লেখ করা হতো। পাকিস্তান টাইমস এর শিরোনামায় বলা হয়েছিল, ভারত পাকিস্তান যুদ্ধ দাড়ালে চীন নাকি পাকিস্তানের পক্ষে দাঁড়াবে। কিন্তু বর্তমানে দেখা যাচ্ছে চীন বাংলাদেশের সমস্যা নিয়ে আর মাথা ঘামাতে রাজী নয়। বর্তমানে সে তার অভ্যন্তরিন অবস্থা নিয়েই বেশি ব্যস্ত।
পাকিস্তান ভাবছিল, মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র যুদ্ধে তাঁদের সহায়তা করে চলবে অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে। তাছাড়া ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধাতে পারলে, আমেরিকার কূটনৈতিক সমর্থন লাভ করা চলবে। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এগিয়ে আসবে রাষ্ট্র সংঘের মাধ্যমে। ফলে সম্বব হবে বাংলাদেশ সমস্যা কে ধামাচাপা দেয়ার কিন্ত এখন সে আশাতেও ভাটা পড়েছে। কারণ, এবার পাক-ভারত যুদ্ধ বাধলে তার সমাধান আগের কোন যুদ্ধের মতন হবে না। ভারত প্রতিরক্ষা মন্ত্রী জগজীবন রাম বলেছেন, পাকিস্তানের পক্ষ থেকে যদি যুদ্ধ বাধানো হয়, তবে তার ফল মারাত্নক হবে। ভারত পাকিস্তানের কোন এলাকা দখল করলে, তা আর ছাড়বে না। ভারতের প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, ভারত যুদ্ধ চায় না। তবে পাকিস্তান ভারত কে আক্রমণ করলে ভারত তার প্রতিউত্তর যথাবিহীত ভাবে প্রদান করবে।
পাকিস্তান এখন প্রচার করছে সে যুদ্ধ চায় না। ভারত তার উপর যুদ্ধ চাপিয়ে দিতে চাচ্ছে। পাকিস্তান এ কথা প্রচার করেছিল যে, চারটি বৃহৎ শক্তি ভারতকে সংযত হবার অনুরোধ জানিয়েছে। এর মধ্যে অন্যতম হলো গ্রেট ব্রিটেন। কিন্ত ব্রিটেনের সরকারী মহল এমন কোন অনুরোধ ভারতকে জানাননী বলে বিবৃতি দিয়েছে।
এ থেকেই বোঝা যায় পাকিস্তান সরকার কি পরিমাণ মিথ্যার বেশাতি করছে।
পাকিস্ত্যান গোড়া থেকেই বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত সমস্যায় পরিণত করতে চাচ্ছিল। কিন্তু বিশ্ব জনমত আজ তার বিপক্ষে।
অন্য দিকে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনী আজ এত শক্তিশালী হয়ে দাড়িয়েছে যে, এই বাহিনীর হাতে তার পরাজয় নিশ্চিত। ইয়াহিয়া তাই আজ দিশেহারা।
২৬শে মার্চ ইয়াহিয়া তার বেতার বক্তৃতাই ঘোষণা করে, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব একজন বিশ্বাসঘাতক। তাকে দেশ দ্রোহিতার জন্য চরম শাস্তি প্রদান করা হবে। এখন একই ইয়াহিয়াকে বলতে হচ্ছে, যদি দেশবাসীকে চায় তবে শেখ মুজিবকে কোন প্রকার শাস্তি দেওয়া হবে না। নিজের হাতে সাজানো বিচার প্রহশনে দোষী প্রমাণীত হবার আগেই শেখ মুজিবকে শাস্তি দিতে চেয়েছিলেন ইয়াহিয়া। আর সেই ইয়াহিয়াকেই এখন বলতে হচ্ছে বিচার শেষ হবার আগেই শাস্তি মঔকুফ করার কথা। এ রক্ম কোন অবস্থার সম্মুখিন হলে অন্য যে কোন দেশের প্রেসিডেন্ট নিজে থেকেই পদত্যাগ করত। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গি চক্রের কোন লজ্জা নাই। একের পর এক মিথ্যা বলেই চলেছে পাক সামরিক সরকার। আর তাঁদের মিথ্যাবাদী চেহারা সারা দুনিয়ার কাছে নগ্ন হয়ে ফুটে উঠেছে।
সেদিন বেশি দূরে নয়, যেদিন ইয়াহিয়া বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের কাছে ইয়াহিয়া ও তার সহযোগীদের জবাবদিহী করতে হবে, কেন তারা বাংলাদেশে চালাতে গিয়েছিল তাঁদের ব্যর্থ অভিযান।
জনগন শেষ ক্ষমতার অধিকারী। জনতার রায়কে অস্বীকার করে রক্তস্নানের মাধ্যমে একটি জাতির আশা আখাঙ্খাকে চিরতরে রুদ্ধ করে রাখা যায় না। বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী গণতন্ত্রী জনগণের জয় অবধারিত।
মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমি উদ্ধার করবো। – প্রধানমন্ত্রী
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ সম্প্রতি তার ভাষণে বলেন, “বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি লোকের প্রত্যেকে এখন মুক্তিযোদ্ধা এবং মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি পবিত্র ভূমি উদ্ধারে তারা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ”।
মুক্তি সংগ্রামের ব্যাপারে ভারত সরকার যে অভূতপূর্ব সাহায্য দিচ্ছে সে জন্য তিনি ভারত সরকার ও ভারত বাসীদের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
সম্প্রতি বাংলাদেশের অস্থায়ী প্রেসিডেন্ট সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ, এম, এম, এন, এ, এবং এম, পি, এ, গণ বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গণ সফর করেন। তারা যুদ্ধক্ষেত্রের হাসপাতালগুলোতে আহত এবং সশস্ত্র বাহিনীর সৈনিকদের সংগে কথাবার্তা বলেন।
ইয়াহিয়াকে সদুপদেশ
ইরানে বাংলাদেশ সম্পর্কে ঘোরয়া আলোচনায় যুগোস্লাভিয়ার প্রেসিডেন্ট টিটো ইয়াহিয়া খা কে যথেষ্ট বোঝাবার চেষ্টা করেছেন বলে খবরে প্রকাশ। তিনি নাকি ইয়াহিয়াকে বলেছেন, বাঙালিদের আবেগ ও সাংস্কৃতিক বৈশিষ্টকে অস্বীকার করে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান করা যাবেনা। বাংলাদেশ সমস্যার সমধান করতে হলে বাঙ্গালীদের আবেগ ও সংস্কৃতির উপর গুরুত্ব আরোপ করতে হবে।