জয় বাংলা ২২ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাতা-১
সর্বত্র হানাদার বাহিনীর নাভিশ্বাসঃ মুক্তি সেনাদের অগ্রগতি
কুমিল্লা জেলায় গেরিলা যোদ্ধাদের আক্রমণে পাকিস্তানী সৈন্যবাহিনীর জনৈক মেজর ও অফিসারসহ ১৪১ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়। গেরিলাযোদ্ধারা উক্ত জেলার বিভিন্ন রাস্তা, সেতু, কালভার্ট ইত্যাদি ধ্বংস করেন এবং জেলার প্রধান যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। ফলে খান সেনাদের কাছে খাদ্য ও অন্যান্য জিনিষ পত্র পাঠানো বন্ধ হয়ে গেছে। এই অঞ্চলেই একদল রাজাকার প্রচুর অস্ত্র ও গোলাবারুদসহ মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। আশুগঞ্জের কাছে মুক্তিযোদ্ধারা ৩ হাজার টনের একটি মালবাহী জাহাজ এবং একটি ট্রেনের ৩টি কামরা ধ্বংস করে দেন । সমগ্র জেলাতেই মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা রেল লাইন তুলে ফেলেন এবং রেল যোগাযোগ ব্যবস্থা অচল করে দেন। গত সপ্তাহে একজন অফিসারসহ ৪জন বাঙালী সেনা পাকিস্তানী সামরিক অক্টোপাস থেকে কোন রকমে পলায়ন করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ভারতের সীমান্ত পেরিয়ে পাঞ্জাবে প্রবেশ গত ৪ঠা অক্টোবর একটি। সামরিক জীপে করে উক্ত অফিসার অন্য ৩জন বাঙালীকে সাথে নিয়ে ভারতীয় এলাকায় প্রবেশ করেন। গত মার্চ মাসে বাঙালীদের বিরুদ্ধে জঙ্গী সামরিক বাহিনীর আক্রমণ শুরু হওয়ার পর ও পর্যন্ত পাকিস্তান সামরিক বিভাগের ৫০ জনের অধিক বাঙালী ঘৃণ্য ভরে চাকরী ত্যাগ করে – ভারতে প্রবেশ করেন এবং তারা পরে মুক্তি বাহিনীতে যোগদান করে শত্রু হননের মহান দায়িত্ব নিয়েছেন।
ইন্দিরার প্রত্যাখ্যান
নয়াদিল্লীতে আহুত এক সাংবাদিক সম্মেলনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ প্রশ্নে পাকিস্তানের সঙ্গে ভারতের আলোচনার প্রস্তাব সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন এবং বলেন, পাকিস্তানকে বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথেই এ ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে।
দিনাজপুর রণাঙ্গনে মুক্তিযোদ্ধাদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী তাজুদ্দীনের ভাষণ
– বাংলাদেশের চূড়ান্ত মুক্তির দিন সমাগত প্রায়
(বিশেষ প্রতিনিধি )
দিনাজপুর রণাঙ্গন ঃ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন যে, বাংলার জাগৃতির মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান প্রচারিত বাঙালী জাতীয়তাবাদ রক্ষা এবং হানাদার বাহিনীর কবল থেকে মাতৃভূমিকে মুক্ত করার জন্য সাড়ে সাত কোটি বাঙালী আজ জল্লাদ পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে এক মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত রয়েছেন এবং তাদের চূড়ান্ত বিজয়ের দিন সমাগত প্রায়। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বিগত ১৩ই অক্টোবর দিনাজপুর রণাঙ্গনের একটি যুব ক্যাম্পে তিন হাজার শিক্ষাপ্রাপ্ত মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের উদ্দেশ্যে বক্তৃতা করছিলেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, গণতান্ত্রিক আন্দোলনের মাধ্যমে বাঙালীদের মৌলিক অধিকার আদায়ের সংগ্রামকে বিগত ২৫শে মার্চ ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনা বাহিনী নিরপরাধ নারী, পুরুষ ও শিশুর রক্ত আর লাশের নীচে চাপা দেওয়ার নৃশংসতম প্রচেষ্টা চালানোর পর বাংলার ছাত্র, যুবক, কৃষক এবং আপামর জনসাধারণ সশস্ত্র যুদ্ধ শুরু করতে বাধ্য হয়েছে। তিনি বলেন, বাঙালীদের অস্তিত্ব; মৌলিক ও মানবিক অধিকার এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমাদের এই যুদ্ধ। এই জনযুদ্ধে আমরা অবশ্যই বিজয়ী হবো। জনাব তাজউদ্দীন আবেগ জড়িত কণ্ঠে মাতৃভূমির প্রতি ইঞ্চি ভূমিকে বর্বর কসাই বাহিনীর বধ্যভূমিতে পরিণত করার জন্য মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের মৃত্যু শীতল কাঠিন্য ও দুর্জয় মনোবল নিয়ে এগিয়ে যাওয়ার আহ্বান জানান। জনাব,আহমদ রক্তাক্ত মুক্তি সংগ্রামে অবতীর্ণ স্বাধীনতার সূর্য সৈনিকদের সর্বপ্রকার বিভেদ, বিস্মৃত হয়ে প্রত্যেককে “মুক্তিযোদ্ধা” এই গৌরবোজ্জল পরিচয়ে চিহ্নিত হওয়ার জন্য আবেদন জানান। তিনি বলেন, জাতীয় ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে আমাদের মরণজয়ী মুক্তি সংগ্রামের রক্তপিচ্ছিল পথ রাজনৈতিক, স্বাধীন – তার কালিমায় কলঙ্কিত হওয়া উচিত নয় । প্রধানমন্ত্রী বলেন যে, হানাদার বাহিনী-মুক্ত স্বাধীন বাংলাদেশে ধর্মনিরপেক্ষ, গণতান্ত্রিক এবং সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্র কায়েমই আমাদের লক্ষ্য। তিনি বলেন -আমরা জোট নিরপেক্ষ বৈদেশিক নীতি অনুসরণ করে যাবো। স্বাধীনতার অগ্নিশপথে বলীয়ান মুক্তি যোদ্ধারা তার বক্তৃতার মাঝে মাঝেই উদাত্ত কণ্ঠে ‘জয়ু বাংলা’ ধ্বনিতে সমগ্র এলাকা প্রকম্পিত করেন। পরে তিনি আহত মুক্তি যোদ্ধাদের অবস্থা ব্যক্তিগতভাবে অবলোকনের জন্য হাসপাতাল পরিদর্শন করেন। হাসপাতালে রংপুরের রণাঙ্গনে – আহত সৈনিক হাসান তোরাবের সাথে তিনি কথা বলেন। মুক্তিযোদ্ধা তোরাব যুদ্ধে তার ডান হাত এবং বাম চোখ হারিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী একদিকে গর্ব এবং অন্যদিকে অশ্রুভারাক্রান্ত কণ্ঠে – যখন তোরাবকে জিজ্ঞাসা করেন যে, তিনি তার ( প্রধানমন্ত্রী ) কাছে কিছু চান কিনা তখন তিনি প্রধান মন্ত্রীর হাত বাম হাত দিয়ে আঁকড়ে ধরে আবেগ-বিহবল কণ্ঠে বলেন, “প্লাষ্টিক সার্জারী দ্বারা আমার হাতটি ঠিক করে দেওয়ার ব্যবস্থা করুন। হাত ঠিক হলেই আবার আমি যুদ্ধে যাবো এবং আমার বলিষ্ঠ কক্সী আবার শত্রু হত্যার কাজে ব্যাপৃত হবে। এ ছাড়া আমার আর কিছু চাওয়ার নেই।” পূর্বাহ্নে জনাব তাজউদ্দীন রংপুর জেলার তেতুলিয়া রণাঙ্গনের বেশ কয়েকটি ট্রেনিং ক্যাম্প পরিদর্শন করেন। এখানকার অসম সাহসী মুক্তিবাহিনী ৭০টি গ্রাম মুক্ত করেছে। এই বিস্তীর্ণ এলাকায় তিন লাখ লোক বসবাস করছে। তিনি দিনাজপুর ও রংপুরে বেশ কয়েকটি জনসভায় বক্তৃতা করেন।
টিটো বাংলাদেশের মানুষের পক্ষে
বর্তমানে ভারত সফররত যুগোশ্লাভ প্রেসিডেন্ট মার্শাল টিটো বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতের নীতির প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এ গত ১৭ই অক্টোবর নয়া দিল্লীতে ভারতীয় রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি প্রদত্ত এক ভোজ সভায় বক্তৃতা প্রসঙ্গে মার্শাল টিটো বলেন, শরণার্থীরা যাতে তাদের ফেলে আশা বাড়ীঘরে ফিরে যেতে পারেন তার জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হবে এবং সেখানে উপযুক্ত রাজনৈতিক পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। এটাই সমস্যার একমাত্র সম্ভাব্য ও স্থায়ী সমাধান। তার মতে এ সমস্যা লাখো লাখো লোকের জীবনে দুঃখ-দুর্দশা ডেকে আনা ছাড়াও একটা ব্যাপকতর রাজনৈতিক তাৎপর্যও রয়েছে। প্রেসিডেন্ট টিটো উপমহাদেশে শান্তি রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার ফলে সৃষ্ট বর্তমান পরিস্থিতি অব্যাহত থাকলে উপমহাদেশে শান্তি ও স্থিতিশীলতা ত বিনষ্ট হবেই, বরং তা তার বাইরেও ছড়িয়ে পড়তে পারে ১ পূর্বাহ্নে মার্শাল টিটোকে স্বাগত জানিয়ে ভাষণ দিতে গিয়ে ভারতের রাষ্ট্রপতি শ্রী ভি ভি গিরি বলেন যে, শরণার্থীরা এমন একটা সমস্যার সৃষ্টি করেছে যার দায়িত্ব সারা বিশ্ব সমাজেরই বহন করা উচিৎ। তিনি বলেন, ভারত বাংলাদেশ সমস্যার এমন একটা শান্তিপূর্ণ সমাধান চায় যা সেখানকার জনগণ ও তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে গ্রহণযোগ্য হবে। তিনি বলেন, শরণার্থী সমস্যা ভারতের আর্থিক সঙ্গতির উপর। একটা প্রবল চাপ সৃষ্টি করেছে। ভারতের পক্ষে শরণার্থীদের ভরণ পোষণের দায়িত্ব আর বেশীদিন বহন করা সম্ভব নয়।
পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সবত্রই ঘৃণার সঞ্চার হচ্ছে
-প্রাভদা
অগণিত মানুষের অন্তহীন মৌন মিছিল খালি পায়ের নীচে কাদা ভাঙ্গার শব্দ শুধু শোনা যায়। শিশু, অসুস্থ, বৃদ্ধ এবং পরিশ্রান্ত মানুষগুলো যারা হাঁটতে পারছে তাদের কাধে ভর দিয়ে পা টেনে টেনে চলছে। কম্বলের বা চটের ফেঁসে দিয়ে মাথা জড়িয়ে বৃষ্টিকে আড়াল – দিয়ে তারা চলেছে। কারো হাতে ঝুলছে হাঁড়ি কড়াই রান্নার বাসনপত্র। কখনো কোন শিশুর কান্নায় মৌন মিছিলের নিস্তব্ধতা ভেঙ্গে পড়ছে খান খান হয়ে। তাদের অনেকেরই পায়ে ফোস্কার দাগ। রক্ত ঝরছে পা ফেটে। অসুস্থদের মধ্যে অনেকেই কলেরা আক্রান্ত। পথ চলতি যাদের জীবন দীপ নিভে যাচ্ছে তাদের দাহ বা সমাহিত করার কেউ নেই। লক্ষ লক্ষ মানুষের ট্রাজেডি এই শিরোনামায় সোভিয়েট কমিনিষ্ট পার্টির সরকারী মুখপত্র “প্রাভদা”-য় ৭ই অক্টোবর প্রকাশিত এক সুদীর্ঘ রিপোর্টে উপরের মন্তব্যটি করা হয়েছে। রিপোর্টটি লিখেছেন বি, অরিখভ। রিপোর্টে আরও বলা হয়েছে, “শুধু নতুন খাদ্যের আশায় শকুন আর কাকেরা মিছিলের মাথার উপরে পাক খেয়ে চলেছে। রাস্তার পাশে গলিত মৃতদেহ গুলির কাছে এসে মানুষেরা ক্ষণিকের তরে থমকে দাঁড়ায়।তারপর নাকে কাপড় চাপা দিয়ে জায়গাটা পার হয়ে আসে। দিনে-রাতে অসংখ্য মানুষের এই অন্তহীন মিছিলের শেষ নাই। পূর্ব পাকিস্তান আর ভারতের সীমান্তে “টাইম”-এর সংবাদদাতা যা দেখেছেন উপরে তারই বর্ণনা দেয়া হলো। ঐ মিছিলের যে -অসংখ্য মানুষের কথা তিনি লিখেছেন তারা পূর্ব বাংলা থেকে আসা শরণার্থী। কয়েক মাস হলো দিনের পর দিন লক্ষ লক্ষ মানুষ ভারতে চলে আসছে। পনের দিন আগের হিসেবে হলো ৮৫ লক্ষ শরণার্থী ইতিমধ্যে ভারতে প্রবেশ করেছে। বর্তমানে এই সংখ্যা ১০ লক্ষ ছাড়িয়ে গেছে। এদের – বেশীর ভাগ প্রায় ৭০ লক্ষ শরণার্থী পশ্চিম বঙ্গে এবং প্রায় ১৫ লক্ষ ভারতের পূর্ব সীমান্ত ত্রিপুরায় রয়েছে। বাকীরা আসাম, বিহার ও মেঘালয়ে ছড়িয়ে রয়েছে। ভারতের সংবাদপত্র গুলির তথ্য অনুযায়ী পূর্ব বাংলার শরণার্থীদের জন্য কমবেশী প্রায় দু’শে শিবির স্থাপিত হয়েছে। শিবির গুলিতে অত্যন্ত গুরুতর পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। ঘিঞ্জি শিবির, চিকিৎসকের সংখ্যাল্পতা, পয়ঃপ্রণালীর অব্যবস্থা এবং খাদ্য সঙ্কট থেকে প্রায় মহামারী অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মৃত্যুও হয়েছে অনেকের। যারা শিবিরে রয়েছে বর্ষাকাল তাদের কাছে অভিশাপ হয়ে দেখা দিয়েছে। মৌসুমী বৃষ্টিতে বহু শরণার্থী শিবির কর্দমাক্ত হ্রদে পরিণত হয়েছে বলে ‘টাইম’-এর সংবাদদাতা লিখেছেন। ফ্রান্সের ‘ফিগারোর সংবাদদাতা কৃষ্ণনগরের অদূরবর্তী একটি শরণার্থী শিবিরের বর্ণনা দিয়েছেন স্থানীয়ভাবে এখানে রাজ্য সরকারের একটি ডেইরী ফারমেই ৬৪ হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছে । ফারমের বাঁধানো মেঝেতে গরুর গোবরের মধ্যেই এক একটি ছাদের তলায় পাঁচ হাজার করে মানুষ বসবাস করছে। ফারমের সুপারিন্টেডেন্ট একজন অবসরপ্রাপ্ত অফিসার। তিনি জানান। যে, প্রতিদিন ২০ জন করে লোকের কলেরায় মৃত্যু ঘটছে। “এখানে ভালো ঔষধপত্র এবং কম্বলের অভাব শিবিরে সব মিলিয়ে ডাক্তার মাত্র তিন জন। পত্রিকাটি লিখেছে, কিন্তু শিবিরে এই দুঃখ-দুর্দশা সত্ত্বেও শরণার্থীরা যেখান থেকে পালিয়ে এসেছেন তা আরো ভয়াবহ। কারণ, শরণার্থীদের প্রত্যেকের মনে পাক সৈন্যদের ভয়ঙ্কর হত্যালীলা, হিংস্রতা আর নিষ্ঠুরতার কথা দগদগে হয়ে আছে। ই পরিশেষে প্রাভদার নিজস্ব ভাষ্যকার মন্তব্য করেছেন, “শরণার্থীদের দুর্দশা মোচনের জন্য। ভারত সরকার অনেকগুলো ব্যবস্থা নিয়েছেন। বর্তমান আর্থিক বৎসরে শরণার্থীদের জন্য একশ কোটিরও বেশী অর্থ বরাদ্ধ করা হয়েছে। কিন্তু শরণার্থী আগমনের বর্তমান হার বজায় থাকলে (দৈনিক যা প্রায় ৩০ হাজার) আগামী দু’মাসে প্রায় চারশ’ কোটি টাকার দরকার হবে বলে ভারত সরকারের তথ্য ও প্রেস ব্যুরো জানিয়েছে। পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতে আগত লক্ষ লক্ষ শরণার্থী প্রকৃতই ট্রাজেডির মধ্যে জীবন ধারণ করেছেন। এই মানুষগুলির দুর্ভাগ্যে বিশ্বের প্রগতিশীল জনগণ উদ্বিগ্ন। বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্রগুলি প্রকৃতই বলেছে যে, পূর্ব পাকিস্তান থেকে ভারতের দিকে এই জনস্রোতের মূল কারণ হলো। তাদের নিজেদের দেশে অসহনীয় অবস্থা। লক্ষ লক্ষ মানুষ যে কারণে ঘরবাড়ী আর সম্পত্তি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন—পাকিস্তান কর্তৃপক্ষের সে ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সর্বত্রই ঘৃণার সঞ্চার করেছে। এই ধরণের কাজের – কোন যুক্তি থাকতে পারে না। লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ মানুষ যে দুর্দশা বোধ করছেন পৃথিবীর মানুষ তার থেকে উদাসীন থাকতে পারে না। তারা পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষের কাছে আশা করে যে, শরণার্থীদের গৃহে প্রত্যাবর্তনের এবং শান্তিপূর্ণ ও নিরুপদ্রব জীবন ধারণের জন্য অনতিবিলম্বে ব্যবস্থা নেওয়া হোক।আন্তর্জাতিক কমুনিটি সমস্যা সমাধানে ব্রতী না হলে । বাংলাদেশ প্রশ্নে পাক-ভারত যুদ্ধ অনিবার্য।আল আহরাম কায়রোর আধা-সরকারী সংবাদপত্র ‘আল-আহরাম’ এক বিশেষ নিবন্ধে এই মর্মে সতর্ক বাণী উচ্চারণ করেন যে আন্তজাতিক কম্যুনিটি অবিলম্বে প্রতিরোধে অগ্রসর না হলে আগামী কয়েক মাসের মধ্যে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে যুদ্ধ বেধে যেতে পারে পত্রিকার অন্যতম সম্পাদক উঃ ক্লোভিস মকসুদ নিজ নামে এই নিবন্ধটি লিখেন। তিনি সম্প্রতি নয়া দিল্লীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগদান করেছিলেন। নিবন্ধে ডক্টর মকসুদ বাংলাদেশ শঙ্কটের একটা রাজনৈতিক সমাধানের উপর গুরুত্ব আরোপ করেন যাতে ভারত থেকে – শরণার্থীরা পূর্ণ নিরাপত্তাবোধ নিয়ে স্বদেশে ফিরতে পারে। কায়রোর সংবাদ পত্রগুলোতে এ পর্যন্ত বাংলাদেশ প্রশ্নে যে মতামত প্রকাশ করা হয়েছে তন্মধ্যে সম্ভবতঃ ডক্টর মকসুদই সর্ব প্রথম একটা স্পষ্ট মনোভাব প্রকাশ করেছেন। নিবন্ধে ডঃ মকসুদ বাংলাদেশ সঙ্কটের একটা রাজনৈতিক সমাধানকে উৎসাহীত করার জন্য আরবদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন। রাজনৈতিক সমাধান বলতে তিনি কি বুঝেন ডঃ মকসুদ তাও পরিষ্কার করে বলেছেন। তিনি বলেন যে, এ প্রশ্নে প্রথম যে করণীয় তা হচ্ছে অবিলম্বে শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং ১৯৭০ সালের ডিসেম্বরের নির্বাচনের বৈধতায় ফিরে যাওয়া। তিনি বলেন, আমরা যদি পূর্ণ,সার্বিকও সমান অংশীদারীত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তানীদের জাতীয় ঐক্য বজায় রাখতে চাই তাহলে এটাই একমাত্র পয়েন্ট যেখান . থেকে আমরা ও সারা বিশ্ব আমাদের নৈতিক ও রাজনৈতিক দায়িত্ব পালনের যাত্রা শুরু করতে পারি। বিশ্ব শান্তি পরিষদ ইত্যবসরে বিশ্ব শান্তি পরিষদ হেলসেন্ধিতে প্রদত্ত আবেদনে বাংলাদেশের সশস্ত্র সংগ্রামকে ‘জাতীয় মুক্তিযুদ্ধ’ বলে অভিহিত করেন। আবেদনে বলা হয় যে;ভারতের সংযম সর্বত্র প্রশংসা লাভ করলেও পাশ্চাত্য জগত সমস্যার মৌলিক বিষয় গুলোকে এড়িয়ে গেছে। ৪৫০ শব্দ বিশিষ্ট এই আবেদনে বিলম্বে হলেও যুক্তির ভাষা অনুধাবন করে শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদান এবং সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধানে ব্রতী হওয়ার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়াকে অনুরোধ করা হয়। সমগ্র আবেদনের একটি জায়গা ছাড়া অন্য সবখানে পরিষদ ‘বাংলাদেশ’ কথাটি ব্যবহার করেছেন। সেই জায়গাতেও অবশ্য পূর্ব পাকিস্তান কথাটির পাশে বন্ধনীতে ‘বাংলাদেশ’ ব্যবহার করা হয়েছে। এই বিশ্ব শান্তি পরিষদের এই আবেদনে বলা হয় যে, বাংলাদেশ ও বাঙ্গালীর অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবুর রহমান কারান্তরালে থাকা পর্যন্ত শরণার্থীদের সসম্মানে ও পূর্ণ নিরাপত্তা সহকারে স্বদেশে ফিরে যাওয়ার বিষয়টা স্বপ্নই থেকে যাবে।
“বঙ্গবন্ধু কে ফিরিয়ে দিন”
নীচের ছবিটি লণ্ডনের ওয়েভ, নেসবারির জনাব আবদুল মতিনের ৯ বছর বয়স্কা মেয়ে বেবি আয়শা মতিনের। কিছু দিন আগে এই মেয়েটিই বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথের কাছে একটি চিঠি লিখে তার প্রিয় নেতা শেখ মুজিবকে খুনী ইয়াহিয়ার কারাগার থেকে মুক্ত করা এবং বাঙ্গালীদের মধ্যে ফিরিয়ে আনার সংগ্রামে সাহায্য দানের জন্য আকুল আবেদন জানায়। পত্রটি বৃটিশ প্রধানমন্ত্রীর ১০নং ডাউনিংটের বাসভবনে পাঠানো হয়। প্রধানমন্ত্রী মিঃ হীথের পক্ষে তার রাজনৈতিক সেক্রেটারী বেবি আয়শাকে চিঠি লিখে ধন্যবাদ জানিয়েছেন এবং বলেছেন, প্রধানমন্ত্রী তার অনুরোধের বিষয়টি মনে রাখবেন। (ছবি: লণ্ডনের জনমত পত্রিকার
সৌজন্যে)
পাতা-২
চলো চলো ঢাকা চলো
মাত্র ক’দিন আগে মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর ক্যাডেট অফিসারদের ট্রেনিং সমাপ্তির অনুষ্ঠানে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ভাষণ দিতে গিয়ে বলেছেন, “সেদিনের আর বেশী দেরি নেই, যেদিন শত্রুর জেল থেকে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে এসে রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব ঢাকায় মুক্তিবাহিনীর অভিবাদন গ্রহণ করবেন। সেদিনই হবে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পূর্ণতা প্রাপ্তি।’ অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি আরো বলেছেন, “মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা “ই পাকিস্তানী হানাদারদের বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করবে।’ সৈয়দ নজরুলের এই ভাষণের বিবরণ বাসি হতে না হতেই খবর এসেছে, এিেসলেটের শিল্প নগরী ছাতক স্বাধীন বাংলার পতাকা উড্ডীন হয়েছে। এই নিবন্ধ যখন লেখা হচ্ছে, তখন ছাতক বাজার দখলের জন্য হানাদারদের সঙ্গে মুক্তি বাহিনীর প্রবল যুদ্ধ চলছে। সম্ভবতঃ এই সংখ্যা ‘জয়বাংলা’ প্রকাশিত হওয়ার আগেই শুধু ছাতক বাজার নয়, সিলেট শহরেও স্বাধীন বাংলার পতাকা উড়বে। মুক্তিবাহিনী ইতিমধ্যেই সুরমা নদীর উত্তর পারে শিল্পনগরী ছাতক দখল করার পর সিলেট টাউনের সঙ্গে ছাতকের রেল ও সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। মুক্তি বাহিনীর ট্রেনিং সমাপ্তির সঙ্গে সঙ্গে সর্বাত্মক মুক্তি যুদ্ধেরও প্রস্তুতি গ্রহণ করা হয়েছে। হানাদারদের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনা নৌযান দ্বারা ইতিমধ্যেই স্বাধীন বাংলাদেশের নৌবহর গড়ে তোলা হয়েছে। বাঙালী বৈমানিকেরা আকাশ-যুদ্ধেরও প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন। অর্থাৎ এবার শুধু ‘হিট এ্যাণ্ড রান’ পদ্ধতির গেরিলাযুদ্ধ নয় এবার সম্মুখ যুদ্ধ। নারীঘাতী-শিশুঘাতী হানাদার বর্বরদের সমুচিত শিক্ষা দেয় এবং তাদের সমূলে ধ্বংস করার জন্য মুক্তি বাহিনী এখন সবরকমে প্রস্তুত। সুনিশ্চিত পরাজয়ের আশঙ্কায় ইয়াহিয়ার অবস্থা এখন ফঁাদে পড়া পাগলা কুকুরের মত। বিদেশী সাংবাদিকের ভাষায় এখন সে trapped animal। ইরান সফরে গিয়ে ইয়াহিয়া সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট পদগনি সহ কয়েকজন রাষ্ট্রপ্রধানের কাছে ধরণা দিয়েছেন। কিন্তু এই মিথ্যাবাদী রাখাল বালককে বাচার জন্য এবার আর কেউ এগিয়ে আসতে রাজি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রও সাফ বলে দিয়েছে, কোন সালিশির মধ্যে সে নেই। এখন ইয়াহিয়ার সামনে একটি মাত্র পথ খোলা রয়েছে, তাহল, মুক্তিবাহিনীর হাতে পরাজয় স্বীকারের চাইতে ভারতের উপর সব দোষ চাপিয়ে ভারত আক্রমণ এবং ভারতের হাতে পরাজিত হওয়ার গৌরব অর্জন। এই গৌরব অর্জনের জন্যই এই পশুর চাইতেও নিকৃষ্ট দ্বিপদ জন্তুটি ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধায়োজনে মেতে উঠেছে। এই যুদ্ধায়োজনের মধ্যেই ইয়াহিয়া সহ পাকিস্তানের বর্বর জঙ্গীতন্ত্রের পতন ও মৃত্যু নিহিত। এই অবধারিত পতন ও ধ্বংসের দিকেই এগিয়ে চলেছে আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের জারজ সন্তান পাকিস্তানী জঙ্গীতপ্ত। এই অঙ্গীতন্ত্রের কবরের উপরেই সারা এশিয়ার জন্য শান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের নতুন ফুল প্রস্ফুটিত হবে।
দ্বিতীয় মীরজাফরের মৃত্যু
বাংলাদেশের আকাশে এক জঘন্য কুগ্রহের আবির্ভাব ঘটেছিল প্রায় এক দশক পূর্বে। সেই কুগ্রহের নাম আল মোনেম খান। বাংলাদেশের মৃত্যু ভাবনাহীন দুই দামাল মুক্তি যোদ্ধা সেই মোনেম নামধারী পাপাত্মা কুগ্রহকে বধ করেছে। বাংলাদেশের মানুষের কাছে মোনেম খান শুধুমাত্র একটি নাম নয়, শুধুমাত্র একটি ব্যক্তি নয়। মোনেম খান অত্যাচারী, ষড়যন্ত্রকারী আর দেশদ্রোহীদের প্রতীক। পিণ্ডি-ইসলামাবাদের এই পা-চাটা জীর বিশেষ বাংলাদেশের মানুষের অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক অধিকার হরণের বিশ্বস্ত লাঠিয়াল হিসেবে সারা বাংলায় ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। মুছে দিতে চেয়েছিল বাংলাদেশের মানুষের জাতীয় সত্বা। নিশ্চিহ্ন করতে চেয়েছিল বাঙালীর নিজস্ব ভাষা, সাহিত্য আর সংস্কৃতি। অথন্য আক্রমণ চালিয়েছিল বাংলাদেশের স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের মুক্তবুদ্ধি সম্পন্ন বিবেকবান শিক্ষকদের ওপর। জাতীয়তাবাদী ও প্রগতিশীল জাগ্রত ছাত্র সমাজের নৈতিক চরিত্র ভেঙে দেয়ার জন্যে শিক্ষায়তনের অভ্যন্তরে গড়ে তুলেছিল একশ্রেণীর পোষা গুণ্ডাবাহিনী। শিক্ষায়তনে তারা ত্রাসের রাজত্ব প্রতিষ্ঠিত করেছিল, শিক্ষার পবিত্র অঙ্গনকে করেছিল কলুষিত। এরই আরও ঘৃণ্য, আরও বর্বর আর পৈশাচিক রূপ আমরা প্রত্যক্ষ করেছি পচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে, ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনীর হত্যাকাণ্ডের মধ্যে। এটা মোনেম খান অনুসৃত নীতিরই পরবর্তী চরম পর্যায়। তাই মোনম খান নিধনের তাৎপর্য কেবলমাত্র একটি ব্যক্তিকে বধ করার তাৎপর্যই নয়। বাংলাদেশের মানুষকে ঔপনিবেশিক শাসনের শৃঙ্খলে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে রাখার জন্যে পিণ্ডি-ইসলামাবাদলাহোর চক্রের যে দৃশ্য অদৃশ্য সহ বহু বাংলাদেশের মানুষের জীবনের বিভিন্ন ক্ষেত্রে শাখা প্রশাখা বিস্তার করেছিল এদেশী দালালদের সহযোগিতায় মোনম খান নামটি তারই প্রতীক। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মুক্তিকামী মানুষ ও তাদের মুক্তি যুদ্ধের অগ্রসেনা মুক্তি বাহিনীর সংগ্রামও সেই সহবাহু উপনিবেশিক দানবেরই বিরুদ্ধে। বাংলাদেশের মাটিতে জন্মে বাংলাদেশের জলবায়ুতে বর্ষিত হয়ে যে দালালরা সেই সহস্র বাহু উপনিবেশিক দানবকে এদেশের অধিকার হরণে, রক্তমোক্ষনে সাহায্য করেছে ও করছে তাদেরকে সমূলে উচ্ছেদ করাও এই মুক্তি সংগ্রামের অপরিহার্য অঙ্গ। তাই মোনেম-বধের তাৎপর্য শুধু ওই একটি ব্যক্তিকে বধ করার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। স্বৈরাচার আর দেশদ্রোহীতার এই প্রতীককে হত্যা বাংলাদেশের সকল দেশদ্রোহী দালাল, বাংলাদেশের ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতি এবং রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বাধীনতার শত্রুর, নারী ও শিশুঘাতী, গণহত্যাকারী জল্লাদদের সমর্থকদের মৃত্যু পরোয়ানা আরও বাস্তব আরও প্রত্যক্ষ করে তুলেছে।
( গান )
আবদুল গাফফার চৌধুরী
আমার নেতা তোমার নেতা শেখ মুজিব বাংলাদেশের প্রাণে গানে চিরঞ্জীব
শেখ মুজিব, শেখ মুজিব
ধানের শিষে নদীর ঢেউয়ে
বাতাস গায়
আকাশে আজ পাখীর যে গান
সুৱ ছড়ায়
তারায় তারায় নাম ছড়ালো
প্রাণে প্রাণে বান ডাকালো
স্বাধীনতার স্বপ্নে রাঙায় সাগরদ্বীপ
শেখ মুজিব, শেখ মুজিব
নতুন ভোরের সূর্য বলে
রক্ত চাই
বন্ধু বলে খুনের দামে
ও মুক্তি চাই
রক্ত দিলাম আরো দেবো
লৌহ কবাট আজ টুটাবে
আমার প্রাণের সূর্য সোনায়
ছড়াবো রোদ সব আঙিনায়
বাংলাদেশের আকাশে চাই মুক্তিদীপ
শেখ মুজিব, শেখ মুজিব
পাতা-৩
নিরস্ত্র প্রতিবাদ নয় এবার সশস্ত্র সংগ্রাম
-সৈয়দ নজরুল
( বিশেষ প্রতিনিধি)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তাঞ্চলে। সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশে প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং বাঙ্গালী জাগৃতির মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমান যেদিন ঢাকার বুকে আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন, সেদিন হবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সার্থকতা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশবাসী এবং বিশ্বের কাছে পুনরায় সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে তিনি স্বার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, লাখোশহীদের পবিত্র রক্তে সিক্ত বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই আমরা স্বীকার করে নেবো না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান গত ৯ই অক্টোবর মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীঅধিকৃত মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তি বাহিনীকে উদ্দেশ করে সমগ্র বিশ্বকে তিনি পুনরায় জানিয়ে দেন যে, বর্বর বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটিতে রেখে কোন রূপ আপোষের প্রশ্ন উঠতে পারে তিনি বলেন, “আমরা রক্তাক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আমাদের অস্ত্র বিশ্রাম নেবে না। সৈয়দ নজরুল গর্বের সাথে ঘোষণা করেন যে, আজকের এই একাত্তর সালের প্রতিবাদ—-নিরস্ত্র প্রতিবাদ নয়। আমাদের আজকের সংগ্রামও নয় নিরস্ত্র সংগ্রাম। এর আগে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি ওসমানী কুচকাওয়াজ মাঠে অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে বেতার ও তথ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এম, এন, এ, এবং ‘জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি জনাব আবদুল মান্নানও উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বলেন : আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পর যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছি বর্বর হানাদার বাহিনীর প্রতিটি সৈন্যকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমরা থামবে না ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী। শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ইতিহাসের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের সৈয়দ নজরুল বিষয়ে উল্লেখ করে অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলেন, “জাতীয় স্বাধীনতাকে কেউ হাতে তুলে দেয় না। রক্তাক্ত লড়াই-এর মাধ্যমে স্বাধীনতা অর্জন করতে হয়।” অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পবিত্র সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার আহ্বান জানিয়ে ইতিহাসের পুনরুল্লেখ করে বলেন যে, বিশ্বের কোথাও জাতীয় স্বাধীনতার সংগ্রাম ব্যর্থ হয়নি। আমাদের সংগ্রামকেও আমরা ব্যর্থ হতে দেবো না। আমাদের আজকের যুদ্ধ জাতীয় যুদ্ধ, এই যুদ্ধ গণযুদ্ধ। জনগণের সাথে একাত্ম হয়ে শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার দুর্বার সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়তে হবে। নব শিক্ষা প্রাপ্ত অফিসারদের উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, বাংলার পদানত নিপীড়িত জনগণ আপনাদের পাশে আছেন। এই দুঃসাহসী জনগণই অতীতে দেশী বিদেশী সমস্ত স্বৈরাচারী শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করেছে— রক্ত দিয়েছে, জীবন দিয়েছে কিন্তু মাথা নত করেনি। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান ক্ষোভ ও বেদনার সাথে বলেন, গণতন্ত্রের পুরোধা ও সংগ্রামী সাধক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ শত্রুর কারাগারে দুঃসহ অবস্থায় বন্দী জীবনযাপন করছেন। যেদিন সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ মুজিবর ঢাকার বুকে আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন সেদিন হবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সার্থকতা। তিনি সংগ্রামী ইষ্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট, ই, পি, আর ও পুলিশ বাহিনীর অপূর্ব দেশপ্রেম ও বীরত্বের ভূয়সী প্রশংসা করেন। তিনি বলেন ঢাকা ও অন্যান্য স্থানে শত্রু বাহিনীর অতর্কিত ও বিশ্বাসঘাতকতাপূর্ণ আক্রমণের মুখে তার তুলনাহীন বীরত্বের সাথে দীর্ঘস্থায়ী যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়ে দেশের স্বাধীনতার রক্ত-পিচ্ছিল সংগ্রামকে জোরদার করে তুলেছিলেন। তারা সবাই দেশকে শত্রুর কবল থেকে মুক্ত করার জন্য ব্যাপক যুদ্ধে লিপ্ত হয়েছেন। সর্বাধিনায়ক এর আগে মুক্তিবাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল ওসমানী অফিসারদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন। . ভাষণের শুরুতে সেকেণ্ড লেফট্যানেন্ট হিসেবে কার্য পরিচালনার দক্ষতা অর্জনের জন্য অফিসার ক্যাডেটদের তিনি অভিনন্দন জানান। মাতৃভূমির চুড়ান্ত স্বাধীনতা অর্জনের জন্য তিনি অফিসারদের আত্মত্যাগের মনোভাবে উদ্বুদ্ধ হয়ে স্বাধীনতা সংগ্রামে ঝাপিয়ে পড়ার উপদেশ দেন। – কর্ণেল ওসমানী বলেন, দেশের প্রতি পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে এবং বিজয় সম্পর্কে সম্পূর্ণ নিশ্চিত হয়েই স্বাধীনতা সংগ্রামীদের চূড়ান্ত লক্ষ্যে পেঁৗছতে হবে। সর্বাধিনায়ক ওসমানী সর্বশেষে বলেন, স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে রণ-কৌশলগত যোগ্যতা ও কৃতিত্ব প্রদর্শনের জন্য আমাদের ধর্মীয় অনুশাসনের মতো নিয়ম-শৃঙ্খলা মেনে চলতে হবে এবং প্রত্যেকের সাহসিকতাপূর্ণ – কাজ যেন অন্যকে অনুপ্রাণিত করে তোলে সেভাবে যুদ্ধ করে যেতে হবে। আরো একজন আর্জেনটিনার পাক রাষ্ট্রদূত জনাব আবদুল মোমিন গত ১১ই অক্টোবর এক সাংবাদিক বৈঠকে – বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্যের কথা ঘোষণা করেন।
বিশ্বজনমত
সোভিয়েট প্রচেষ্টা
( বিশেষ প্রতিনিধি)
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম মুক্তাঞ্চলে সামরিক অফিসারদের এক সমাবেশে প্রত্যয় দৃঢ় কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রাণপ্রিয় নেতা এবং বাঙ্গালী জাগৃতির মহানায়ক শেখ মুজিবর রহমান যেদিন ঢাকার বুকে আপনাদের অভিবাদন গ্রহণ করবেন, সেদিন হবে মুক্তি সংগ্রামের চূড়ান্ত সার্থকতা। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সমাবেশে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রশ্নে দেশবাসী এবং বিশ্বের কাছে পুনরায় সুস্পষ্ট বক্তব্য রাখেন। পাকিস্তানী কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান প্রস্তাব দৃঢ়তার সাথে প্রত্যাখ্যান করে তিনি স্বার্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেছেন যে, লাখোশহীদের পবিত্র রক্তে সিক্ত বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া আর কিছুই আমরা স্বীকার করে নেবো না। অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান গত ৯ই অক্টোবর মুক্তাঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর অফিসারদের প্রথম শিক্ষা সমাপনী কুচকাওয়াজ অনুষ্ঠানে অভিবাদন গ্রহণ করেন এবং কুচকাওয়াজ পরিদর্শন করেন। পাঞ্জাবী হানাদার বাহিনীঅধিকৃত মাতৃভূমির শৃঙ্খল মোচনের রক্তাক্ত সংগ্রামে লিপ্ত মুক্তি বাহিনীকে উদ্দেশ করে সমগ্র বিশ্বকে তিনি পুনরায় জানিয়ে দেন যে, বর্বর বাহিনীকে বাংলাদেশের মাটিতে রেখে কোন রূপ আপোষের প্রশ্ন উঠতে পারে ।তিনি বলেন, “আমরা রক্তাক্ত সংগ্রামে অবতীর্ণ হয়েছি এবং পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া আমাদের অস্ত্র বিশ্রাম নেবে না। সৈয়দ নজরুল গর্বের সাথে ঘোষণা করেন যে, আজকের এই একাত্তর সালের প্রতিবাদ—-নিরস্ত্র প্রতিবাদ নয়। আমাদের আজকের সংগ্রামও নয় নিরস্ত্র সংগ্রাম। এর আগে আমাদের মুক্তি বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্ণেল এম, এ, জি ওসমানী কুচকাওয়াজ মাঠে অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদকে স্বাগত জানান। অনুষ্ঠানে বেতার ও তথ্য দপ্তরের ভারপ্রাপ্ত এম, এন, এ, এবং ‘জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদনা পরিষদের সভাপতি জনাব আবদুল মান্নানও উপস্থিত ছিলেন। সৈয়দ নজরুল ইসলাম অনুষ্ঠানে বলেন : আমাদের ওপর চাপিয়ে দেয়ার পর যে যুদ্ধ আমরা শুরু করেছি বর্বর হানাদার বাহিনীর প্রতিটি সৈন্যকে বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত না করা পর্যন্ত আমরা থামবে না। ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শাসন ও শোষণের বিরুদ্ধে ইতিহাসের বিভিন্ন স্বাধীনতা সংগ্রামের মন্তব্য করতে যেয়ে বলেছেন : পূর্ব পাকিস্তানে সামরিক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে পাকিস্তানকে রক্ষা করবার জন্য। সোভিয়েট রাশিয়ায় অনুরূপ অবস্থা ঘটলে সোভিয়েট সরকারকেও একই ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হত। সোভিয়েট সরকার কি ধরণের ব্যবস্থা গ্রহণ করতেন তা আমরা জানি না। কারণ সোভিয়েট সংবিধানে আছে, কোন অঙ্গ রাষ্ট্র যদি সোভিয়েট সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে না থাকতে চায়, তবে সে বিছিন্ন হয়ে স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র হিসাবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পারে; সোভিয়েট সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের সংবিধানে সবগুলি অঙ্গ রাজ্যকে আলাদা আলাদা রিপাবলিক বলে উল্লেখ করা হয়। বজিলো রাশিয়া ও ইউক্ৰেণ, রাষ্ট্রসংঘে আলাদা প্রতিনিধি পাঠাতে পারে। সংবিধানিক দিক থেকে, মানে মৌলিক নীতিগত ভাবে সোভিয়েট সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রে সব জাতির সমান অধিকার আছে। তাছাড়া পাক বাহিনী বাঙলাদেশে পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার নামে যেভাবে নিরস্ত্র নরনারী এমনকি শিশুদের গুলি করে হত্যা করেছে, আধুনিক বিশ্ব ইতিহাসে তার নজীর পাওয়া যায় না। পাকিস্তান, সোভিয়েট সংযুক্ত সমাজতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্রের কোন একটি সংযুক্ত রাষ্ট্র নয়। ভৌগলিক দিক থেকে পাকিস্তান একটি বিরাট অযৌক্তিকতা। পাকিস্তানের দুই অঞ্চলের মধ্যে কোন ভৌগলিক যোগাযোগ নেই। এই দুই অঞ্চলের মধ্যে যা হতে পারত, তাহল আলাদা ধরণের কনফেডারেশন। সে চেষ্টা কোন দিনই করা হয়নি, জঙ্গী রাজের পক্ষ থেকে। এক রাষ্ট্রের ধূয়া তুলে বাঙালীদের শোষণ ও শাসন করবার প্রচেষ্টা চলেছে পাকিস্তান হবার পর পর থেকেই। বাঙালীদের সাথে করা হয়েছে একটা পরাধীন জাতির সঙ্গে শাসক জাতি যেভাবে ব্যবহার করে ঠিক তেমনি ভাবে। তাই বাঙালী চেয়েছিল ছয় দফা দাবীর ভিওিতে শাসনতন্ত্র। এই দাবী মেনে নিলে পাকিস্তান টিকে থাকতে পারতো। কিন্তু তা না করে বাঙলাদেশের মানুষের উপর করা হয়েছে ও হচ্ছে নজীরবিহীন ফৌজি অত্যাচার। বাঙালীর কাছে আজ তাই পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে থেকে শান্তিপূর্ণ সমাধান কথাটা অর্থহীন হয়ে পড়েছে। বাঙালী আজ যা চায়, তাহল তার স্বারভৌম অধিকার। আলোচনার মাধ্যমে এই অধিকার লাভের কোন সম্ভাবনাই আর আছে বলে মনে হয় না।
অতি চালাকের গলায় দড়ি
ভুট্টো সাহেব গেড়াকলে
আটকে গেছেন
জুলফিকার আলী ভুট্টো লোকটি পাগল না মাথা খারাপ তা নিয়ে মতভেদ থাকতে পারে। কিন্তু লোকটা যে গরজে-পাগল বা জাতে মাতাল তালে ঠিক তাতে দ্বি-মতের কোন অবকাশ নাই। পিণ্ডির মসনদে আসীন জেনারেল-চক্রের সাথে ষড়ষন্ত্র করে বাংলাদেশে নরমেধযজ্ঞ শুরুর সাড়ে ৬ মাস পর ভূট্টো সাহেব হঠাৎ করে বুঝতে পেরেছেন যে “বাংলাদেশে রক্তস্রোত বয়ে গেছে। পাকিস্তানীদের স্বদেশবাসী হত্যা বন্ধ করতে হবে এবং শান্তিপূর্ণভাবে বসবাস করতে হবে।’ জনাব ভুট্টো নাকি আরো বলেছেন : ‘অতীতে পূর্ব বঙ্গকে শোষণ করা হয়েছে এবং সেখানকার মানুষ গরীব হয়ে গেছে। বাংলাদেশের সেই সব মানুষের সংখ্যাধিক্যের মতামতের উপর গুরুত্ব দিতে হবে। জনাব ভুট্টো অবশ্য একই বক্তৃতায় একথাও বলেছেন যে তার দল বাংলাদেশের শূন্য আসনগুলোর আসন্ন উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দিতা করবে। বক্তৃতার এক পর্যায়ে ভূট্টো সাহেব আওয়ামী লীগকে একটি ‘প্রতিক্রিয়াশীল দল’ বলে মন্তব্য করেছেন। ইতিপূর্বে গত ৯ই অক্টোবর মুলতানে এক কর্মী সম্মেলনে বক্তৃতায় জনাব ভুট্টো বাংলাদেশে গণহত্যার নায়ক ইয়াহিয়া খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেন যে তিনি (ইয়াহিয়া) তার দলে ভাঙ্গন সৃষ্টির জন্য সরকারী তহবিল থেকে প্রচুর অর্থ ব্যয় করছেন। জনাব ভূট্রো আরো অভিযোগ করেন যে শেখ মুজিবর রহমানের আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণার পর তার দলই পাকিস্তানে সংখ্যাগরিষ্ঠ পার্লামেন্টারী দলে পরিণত হয়। সুতরাং ইয়াহিয়ার উচিৎ ছিল প্রতিটি গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারে তার দলের সাথে পরামর্শ করা কিন্তু তিনি তা করেন নি। এ ছাড়া ভূট্টো সাহেব আরো অভিযোগ করেন যে পূর্ব বাংলায় ডাঃ মালেকের তথাকথিত বেসামরিক মন্ত্রীসভায় গত নির্বাচনে পরাজিত ব্যক্তিদের নেওয়া হলেও তার দলের কাউকে নেওয়া হয়নি। বাংলাদেশে রক্তস্রোত বয়ে গেছে এটা জনাব ভুট্টোর জন্য নতুন আবিষ্কার হলেও বিশ্বের বিবেকবান মানুষ তা গত ২৫শে মার্চের পর পরই প্রত্যক্ষ করেছেন। জনাব ভুট্টোর আন্তরিকতায় সন্দেহ প্রকাশ না করে আমরা বলব তিনি এ অধিকারের ব্যাপারে বড় বিলম্ব করে। ফেলেছেন। তবে এজন্য ‘জাতে মাতাল’ জনাব ভুট্টোকে দোষ দিয়ে লাভ নেই। কারণ অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় ২৫শে মার্চ বাঙ্গালী জাতের বিরুদ্ধে পাঞ্জাবী-কুকুরগুলোকে লেলিয়ে দিয়ে কয়েক দিন ঔপনিবেশিক মদ গলধকরণের পর তিনি যে নেশাগ্রস্ত। হয়ে ঘুমিয়ে পড়েছিলেন তা থেকে জাগতে তার সাড়ে ৬ মাস। লেগেছে। তাই রিপ ভ্যান উইলের মত তিনি পৃথিবীটাকে নতুন করে দেখতে পেয়েছেন। তবে জনাব জুলফিকার আলী ভূট্টো কাদের রক্তে এ স্রোত বয়েছে তা পরিষ্কার করে বলেন নি। তিনি নিশ্চয় বাঙ্গালীদের রক্তে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে স্রোত বহাইয়েছে তার কথা বলেননি। কেননা, তিনি তা বলতে পারেন না। কারণ তিনি নিজেও ঐ রক্তস্রোত বহালনার ষড়যন্ত্রের অন্যতম স্থপতি ছিলেন। তবে কি তিনি পাল্টা আক্রমণে বাঙ্গালী মুক্তিবাহিনী আজ পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক বাহিনীর যে রক্ত ঝরাচ্ছে তার কথাই বলতে চেয়েছেন ? নইলে জনাব ভুট্টোর মত রক্ত লোলুপ মানুষের অমৃতে এমন অনাম্বাদ হবে কেন ? বাঙ্গালী রক্তের জন্য তার ত কোন দরদ থাকার কথা নয়। তবে জনাব ভুট্টোকে আমরা আশ্বাস দিতে পারি যে বাঙ্গালী একটা শান্তিপ্রিয় জাতি। তারা কারো রক্ত ঝরাতে চায় না! যারা পর দেশকে পদানত রেখে শশাষণ করতে চায় কেবল তারাই পরের রক্তে হোলী খেলা করতে অভ্যস্ত। ইতিহাস প্রমাণ দেবে বাঙ্গালীর সে ঐতিহ্য নাই। তাই জনাব ভুট্টোকে আমরা অনুরোধ করব তিনি যদি নিজ জাত-ভাই দের রক্ত ঝরাতে না চান তাহলে তার উচিৎ হবে অবিলম্বে বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে সমস্ত পাকিস্তানী সৈন্য প্রত্যাহারের দাবী তোলা এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতাকে বাস্তব সত্য হিসাবে মেনে নেওয়া। অন্যথায় বাঙ্গালীর প্রতি রক্ত কন্যায় যে লাখোলাখোমুজিবের জন্ম হয়েছে তারা প্রতিটি প্রশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের রক্ত ঝরাতে হলেও নিজেদের মাতৃভূমিকে মুক্ত করতে বদ্ধপরিকর এবং তার তা করবেই। জনাব ভুট্টো গণতান্ত্রিক বিধি বিধান সম্পর্কিত কিছু কিছু কথাবার্তা বলেছেন। কিন্তু তা যে ক্ষমতা ভাগ বাটোয়ারার ব্যাপারে মতানৈক্যের ফলশ্রুতি তা সহজেই বুঝা যায়। আসলে গণতন্ত্রের প্রতি তার আদৌ কোন শ্রদ্ধা নাই। তার যদি এ ব্যাপারে সামান্য শ্রদ্ধাও থাকত তাহলে তিনি কি আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষণা করবার বিষয়ে সায় দিতে পারতেন ? তিনি কি নির্বাচনের রায় বানচাল করে বাঙ্গালীদের রক্ত নিয়ে তাদেরই অর্থে পোষ সেনাবাহিনীকে হোলি খেলার অনুমতি দিতে পারতেন? যে ক্ষেত্রে তিনি নিজে আওয়ামী লীগকে বেআইনী করার ব্যাপারে ইয়াহিয়াটিকা চক্রের সাথে শরীক ছিলেন সে ক্ষেত্রে তিনি কি করে আশা করতে পারেন যে জল্লাদের তার দলকে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে দেশের বৃহত্তম দলের মর্যাদা দেবে? ভূট্টো সাহেব একটু চিন্তা করলেই বুঝতে পারবেন যে ট্রিকস খেলতে গিয়ে তিনি, নিজেই আজ ট্রিকসে পড়ে গেছেন।
বাংলাদেশ প্রশ্নে রুশ নীতির কোন পরিবর্তন হয়নি
খবরে প্রকাশ, সোভিয়েট ইউনিয়ন ভারতকে পুনরায় আশ্বাস দিয়ে বলেছে যে বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েট নীতি অপরিবর্তনীয় রয়েছে। গত ১৩ই অক্টোবর মস্কোতে সোভিয়েট পররাষ্ট্র দফতর ও ভারতীয় দূতাবাসের কর্মকাদের এক বৈঠকে সোভিয়েট পক্ষ থেকে ভারতকে এ আশ্বাস দেওয়া হয়। সম্প্রতি রুশ প্রেসিডেন্টের আলজেরীয়া সফর শেষে প্রকাশিত রুশ-আলজেরীয় ইশতেহারে বাংলাদেশ প্রশ্নে যে মনোভাব ফুটে উঠেছে তার বিরুদ্ধে ভারতে তীব্র প্রতিদ্বন্দিতার সৃষ্টি হয় এবং তারই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ প্রশ্নে সোভিয়েট নীতি পুনর্ঘোষিত হয়। সোভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে ভারতকে বলা হয় যে তৃতীয় পক্ষের সাথে যুক্ত ঘোষণায় কি বলা হল না হল তা দিয়ে সোভিয়েট মনোভাব বিচার করা ভুল হবে। পররাষ্ট্র দফতরের পক্ষ থেকে ভারতীয় দূতাবাসকে বলা হয় যে ভারতীয় প্রধানমন্ত্রীর মস্কো সফরশেষে প্রকাশিত উক্ত ইশতেহারে যে নীতি ঘোষণা করা হয়েছে এবং বর্তমানে সারা দেশে শেখ মুজিবর রহনানের মুক্তি ও বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দাবীতে পরিচালিত অভিযানের মাধ্যমে যে নীতি প্রতিফলিত হয়েছে সোভিয়েট সরকার তা থেকে এক বিন্দুও নড়াচড়া করেন নি। জানা গেছে যে, সোভিয়েট নেতৃবৃন্দ নিজেরাই সোভিয়েট-আলজেরীয় যুক্ত ইশতেহারের ব্যাপারে সন্তুষ্ট ছিলেন না। তবু একতরফা ব্যবস্থা এবং কম মতৈক্যপূর্ণ পরিস্থিতি পরিহারের খাতিরে তারা তা অনিচ্ছা সত্তেও গ্রহণ করেছেন।সোভিয়েট বক্তব্যের সমর্থনে তাদের পররাষ্ট্র দফতর ভারতীয় দূতাবাস কর্মকর্তাদের সামনে বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর গণহত্যার বিরুদ্ধে এবং সেখানকার গণতান্ত্রিক শক্তি সমূহের পক্ষে প্রদত্ত সোভিয়েত নেতৃবৃন্দের বিবৃতি বিশেষ করে, প্রধানমন্ত্রী কোসিগিনের সুস্পষ্ট বক্তব্য সমূহ তুলে ধরেন।
পাতা-৪
ভেজাল গণতন্ত্রে ইয়াহিয়ার সঙ্কট
( রাজনৈতিক ভাষ্যকার )
সম্প্রতি করাচীর ‘ডন’ পত্রিকা এই অভিমত প্রকাশ করেছে যে, পাকিস্তানের পুনর্গঠিত জাতীয় পরিষদ যে শাসনতন্ত্রই প্রনয়ন করুন না কেন, তা গণতান্ত্রিক হবে কারণ তার পেছনে জনগণের রায় নেই। দৈনিক ডন’ করাচীর হারুণ পরিবারের পত্রিকা। এই পরিবারটি পশ্চিম পাকিস্তানের বিশিষ্ট ভাগ্যবান ধনকুবের পরিবারের একটি ‘ডন’অকস্মাৎ এমন বেমক্কা বেয়াড়া মন্তব্য কেন করেছে আমরা বলতে পারিনে। কালনেমির লংকা ভাগে কিম্বা ক্ষমতার বাঁটোয়ারায় তাদের কিঞ্চিৎ অসুবিধা দেখা দিয়ে থাকতে পারে। তবে কারণ যাই হোক, ইয়াহিয়া খানের চাপিয়ে দেয়া শাসনতন্ত্র এবং ২৭শে ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের অধিবেশন সম্পর্কে ‘ডন’ যে মন্তব্য করেছে তা খুবই প্রনিধানযোগ্য। ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা অনুযায়ী আগামী ২৭শে ডিসেম্বর পাকিস্তানের তথাকথিত জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বসবে। জনসংখ্যার এবং সদস্য সংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্ত্বেও এই অধিবেশনে বাংলাদেশ সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে ডনের। উপরোক্ত মন্তব্যে কারণ এই। স্বভাবতঃই প্রশ্ন জাগতে পারে যে সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া সত্বেও বাংলাদেশ কেন সংখ্যালঘুতে পরিণত হবে ? সত্তরের নির্বাচন এবং শাসনতন্ত্র সম্পর্কে ইয়াহিয়া খান যে সমস্ত অগণতান্ত্রিক ও স্বৈরাচারী ব্যবস্থা ও পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে গণতন্ত্রের মাপকাঠিতে তার বৈধতার প্রশ্নে আলোচনা স্থগিত রেখে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার বর্তমান পরিস্থিতির ভিত্তিতেই না হয় বিষয়টি বিবেচনা করা যাক। পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের মোট আসন সংখ্যা তিন শত। তার মধ্যে বাংলাদেশের আসন ১৬৯ এবং পশ্চিম পাকিস্তানের অবশিষ্ট টারটি প্রদেশের মোট আসন ১৩১টি। বাংলাদেশের ১৬৯টি আসনের মধ্যে আওয়ামী লীগ ১৬৭টি আসনে বিপুল ভোটাধিক্যে জয়লাভ করে সারা পাকিস্তানে একক ও নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করেছিল। ইয়াহিয়া খান এর মধ্যে ৭৯ জন আওয়ামী লীগ সদস্যের সদস্য পদ বাতিল করে দেয়। এর মধ্যে ৭৭টি আসনে আগামী ডিসেম্বর মাসে নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। তা হলে উপনির্বাচনের দ্বারা যে ৭৭টি আসন পূর্ণ করা হবে ২৭শে এবং অপর আসনগুলির সদর হয় মুক্তাঞ্চলে, নয়তো স্ব স্ব এলাকায় অবস্থান করে মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন ও পরিচালনার কাজে – আত্মনিয়োগ করেছেন। কাজেই বাংলাদেশের ৮০টি শূন্য আসন জাতীয় পরিষদের অধিবেশনকে উপহাস করবে, উক্ত অধিবেশনের বৈধতাকে নিঃশব্দ চ্যালেঞ্জের দ্বারা অভিনন্দিত করবে।কাজেই উপনির্বাচনের প্রহসনের পরও কেবল মাত্র বাংলাদেশের এতগুলি শূন্য আসনের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকৃষ্ট না হয়ে পারে না। আওয়ামী লীগকে অবৈধ ও ৭৯টি আসন বাতিল ঘোষণা এবং ৭৭টি আসনে উপ নির্বাচনের হাস্যকর প্রহসনের পরও ইয়াহিয়া খানের নিজস্ব পদ্ধতিতেও পাকিস্তানের দেহে তার অভিনব গণতান্ত্রিক পলস্তারার প্রলেপ ধরানো যাবে না। এতে ইয়াহিয়া খানের মুখে আরও ভালভাবে চুনকালী পড়বে, বিশ্বের দরবারে তার মুখোশ – আরও মর্মান্তিকভাবে উন্মোচিতচি হবে। এই সম্ভাব্য অবস্থার পরিনামের কথা অনুমান করেই ‘ডন’ পূর্বাহ্ েইয়াহিয়া খানকে হুশিয়ার করে দিয়েছেন কিনা আমরা বলতে পারব না, তবে এটুকু বলতে পারি যে মরণকালে মানুষের বুদ্ধি নাশ হয়। বর্তমানে ইয়াহিয়া খানেরও সেই দশায় ধরেছে। তাই সে ক্রমাগত নিজের জালে আরও বেশী করে জড়িয়ে পড়ছে। কারণ ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জান্তা জনগণের মিলিত শক্তির চেয়ে বন্ধুকের নলকেই অধিক ক্ষমতাশালী বলে মনে করেছিল। কিন্তু বন্ধুকের নল রক্তস্রোত বইয়ে দিতে পারে, সমস্যার সৃষ্টি করতে পারে—কিন্তু সেই রক্তের ধারাকে মুছে দিতে পারে না, সমস্যার সমাধানও করতে পারে না। বন্ধুকের নলের সাহায্যে উপ নির্বাচনও করতে পারে, পূর্ববর্তী নির্বাচনে জনগণ কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত ধিকৃত ব্যক্তিদের ফাকা মাঠে বিজয়ী করতে পারে, কিন্তু সৃষ্ট সংকটের গণতান্ত্রিক চরিত্র সম্মত । সামাধানের আকৃতি কোন ক্রমেই আনতে পারে না। তবে বাংলাদেশের মানুষ ” তাকে একটা আশ্বাস দিতে পারে। নিজের সৃষ্ট সংকটের জালে – ইয়াহিয়া খান ও তার সামরিক জান্তা যেভাবে জড়িয়ে পড়েছে তাতেই সেই সংকট থেকে কেবলমাত্র বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামী মানুষই তাদেরকে উদ্ধার করতে পারে। আর তা পারে বাংলাদেশের মাটি থেকে তাদের সমুলে উচ্ছেদ করার মাধ্যমে সেই পরিণতিই ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তাকে অদূর ভবিষ্যতে বরণ করতে হবে। তাতে তারাও কমলির হাত থেকে রেহাই পেয়ে হাঁফ ছেড়ে বাচবে এবং এই উপমহাদেশের স্থায়ী শান্তিও প্রতিষ্ঠিত হবে। শান্তি বিপন্ন হবার উদ্বেগ থেকে বিশ্বের মানুষও মুক্তি পাবে।
রমজান মাসে অফিসের সময় পবিত্র রমজান মাসে বাংলাদেশ সরকারের সকল অফিস শুক্রবার ছাড়া অন্যান্য দিনে সকাল ন’টা থেকে দু’টো এবং শুক্রবার সকাল সাড়ে আটটা। থেকে ১২টা পর্যন্ত চলবে।
ইয়াহিয়ার আব্দার খারিজঃ – নিক্সন বাংলাদেশ প্রশ্নে ,
মধ্যস্থতা করবেন না
রতনে রতন চেনে বলে যে একটা কথা আছে সাবেক পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তার সত্যতা আর একবার প্রমাণ করেছেন। এ খবরটা আমাদের পরিবেশন করেছেন পাকিস্তানের সরকারী নিয়ন্ত্রণাধীন প্রেস ট্রাষ্টের পত্রিকা ‘মর্নিং নিউজ’ পত্রিকাটির রাওয়ালপিণ্ডির সংবাদদাতা জানিয়েছেন যে ওয়াশিংটনে পাকিস্তানী প্রতিনিধির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার একখানা পত্র প্রেসিডেন্ট নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিভাগীয় উপদেষ্টা হেনরী কিসিংগারের হাতে অর্পণ করা হয়েছে। পত্ৰখানা দেওয়া হয়েছে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে। পাকিস্তান সরকারের পক্ষ থেকে পত্রের বিষয়বস্তু সম্পর্কে কিছু বলা না হলেও মনিং নিউজের প্রতিনিধি বিশ্বস্তসূত্রে জানতে পেরেছেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পাক-ভারত উপমহাদেশের দ্রুত অবনতিশীল পরিস্থিতির উন্নতিকল্পে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ব্যক্তিগতভাবে হস্তক্ষেপ করতে অনুরোধ করেছেন। তিনি এ ব্যাপারে প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে ‘শান্তি দূতের ভূমিকা গ্রহণ করতে আকুল আবেদন জানিয়েছেন। সর্বশেষ খবরে প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ‘পূর্ববাংলা’ ও পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যে অথবা পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে বিরোধের মধ্যস্থতা করবে না বলে ইয়াহিয়াকে জানিয়ে দিয়েছে। পররাষ্ট্র দফতরের প্রেস অফিসার মিষ্টার রবার্ট জে মেলকি এই সংবাদ দিয়ে বলেন, যে দক্ষিণ এশিয়ায় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ভূমিকার সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় মার্কিন কার্যাবলীর তুলনা করার মত কোন ভিত্তি নেই। তিনি বলেন,‘মাকিণ যুক্তরাষ্ট্র কোন পক্ষেই শুভেচ্ছার হস্ত প্রসারণ করবে না। মিষ্টার মেলকি বলেন ‘উভয় সরকারের সাথে (পাকিস্তান ও ভারত:) আলাপ-আলোচনা – করেই আমরা আমাদের কাজ করছি। পরিস্থিতির অবনতি প্রতিরোধ করার জন্য আমরা তাদেরকে অনুরোধ করেছি। আমরা সীমান্ত এলাকায় সৈন্য। সমাবেশের দরুণ উদ্বিগ্ন। পূর্ব বাংলার সমস্যার ব্যাপারে তিনি বলেন আমরা রাজনৈতিক পুনর্বিবেচনা করার জন্য অনুরোধ করেছি পাকিস্তান এবং ভারতের মধ্যে যুদ্ধের আশঙ্কা সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করা হলে তিনি বলেন ‘আমি আশা করি ঐ ধরণের পরিস্থিতির উদ্ভব হবে না। কিন্তু শান্তি বজায় রাখার এ ব্যাপারে উভয় রাষ্ট্রকেই সংযম ও সৌহার্দ প্রদর্শনের প্রয়োজনীয়তা রয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন ।
বাঙলাদেশে ত্রাসের
রাজত্ব অব্যাহত ভাবে চলেছে
বিখ্যাত মার্কিন দৈনিক পত্রিকা ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এ বলা হয়েছে যে, বাঙলাদেশে এখন ত্রাসের রাজত্ব চলেছে। অধিকাংশ বিদেশী, যারা বাঙলাদেশে সাহায্য করতে গিয়েছেন, তারা খুবই হতাস হয়ে পড়েছেন। তাঁরা মনে করছেন, শরণার্থীরা দেশে ফিরবার মত অবস্থা সহজে। সৃষ্টি হতে পারবে না।
পত্রিকার সং বাদদাতা ম্যালকম ব্রাউন বলেছেন, ঢাকা থেকে তরুণদের বিনা কারণে পাক ফৌজ কর্তৃক ধরে নিয়ে যেতে দেখা যাচ্ছে। বহু গন্যমান্য লোককেও, গ্রেফতার করা হচ্ছে। যদিও ইয়াহিয়া ঘোষণা করেছে, সকলকে সাধারণ ভাবে মাফ করে দেওয়ার কথা।
অস্ত্র ও গোলাবারুদ চাই
বৃটিশ কমিউনিস্ট পার্টির রাজনৈতিক কমিটির সদস্য এবং ঐ পার্টির মুখপত্র “মর্নিংষ্টার”-এর সহকারী সম্পাদক ওয়েন রাইট – বাঙলাদেশের কোন অঞ্চলে পরিভ্রমণ করে বলেছেন: বাঙলাদেশের তরুণ যোদ্ধাদের দেখে মনে অনুপ্রেরণার সঞ্চার হয়। তাদের সবচেয়ে বেশী প্রয়োজন কি একথা জিজ্ঞাসা করলে, – ওরা আমাকে উত্তর দিলেন ‘অস্ত্র ও গোলা-বারুদ। ওয়েন রাইট আরো বলেন : বাঙলাদেশের মানুষ একটা স্বতন্ত্র জাতি।তাদের ভাষা, সংস্কৃতি, ভৌগো লিক অবস্থান, অর্থনৈতিক স্বার্থ, সামাজিক মনবিজ্ঞান—সবকিছুই প্রমাণ করে তারা একটি জাতি।১৯৪৭ সাল থেকে বাঙালীদের উপর দমন পীড়ন অনুষ্ঠিত হয়েছে বলে তিনি মন্তব্য করেন।
শিল্প-সংস্কৃতি
অর্থনৈতিক অসহযোগিতা
ও মুক্তি সংগ্রাম
-ইলিয়াস আহমদ
আমাদের শৃঙ্খলিত স্বদেশভূমিকে দানবীয় শক্তির থাবামুক্ত করার জন্য প্রতিশোধের গ্রীনেড হয়ে আমাদের দুর্জয় মুক্তি বাহিনী হানাদার সৈন্যদের ওপর ঝাপিয়ে পড়ে হত্যা করছে, আহত করছে । তারা এক ফন্টে লড়ে যাচ্ছেন। আর এক ফ্রন্টেও আমাদের। তেমনিভাবে ক্ষমাহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তা হলো অর্থনৈতিক ফ্রন্টে। শত্রু আমাদের হত্যার জন্য, আমাদের স্বাধীনতা কেড়ে নেওয়ার জন্য, আমাদের মা-বোনদের সম্ভ্রম সম্মান বিনষ্ট করার জন্য আর্থিক শক্তি আর সঙ্গতি অর্জন করছে পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্য দ্রব্য বাংলাদেশে বিক্রয় করে। বাংলাদেশকে তাদের উৎপাদিত পণ্যের নিরুপদ্রব বাজার করে রাখার জন্যই ইসলাম আর ভ্রাতৃত্বের পশ্চিম পাকিস্তানী প্যাকেটে মোড়া কথাবার্তা বলেছে এতদিন, বলছে এখনও। = শত্রুদের পাঁজর ভাঙ্গার জন্য, তাদের শক্তিহীন ও হীনবল করে তোলার জন্য অর্থনৈতিক বয়কট পূরোদমে অব্যাহত রাখতে হবে। আমাদের প্রতিটি সজাগ মুহূর্তে স্মরণ রাখতে হবে যে, আমরা আজ ইতিহাসের নিষ্ঠরতম জল্লাদদের বিরুদ্ধে এক রক্তসিক্ত দুঃসাহসী অভিযান চালিয়ে যাচ্ছি। এ অভিযানের প্রতিটি। মূহুর্তের অধ্যায় অনেক অনেক রক্ত ফোটায় পবিত্র। পঁচিশে মার্চের সে কালো বীভৎস রাতের পর থেকে লাখ লাখ তাজা প্রাণ আজ প্রতিশোধ গ্রহণের জন্য বাবার, মায়ের আর ধর্ষিতা বোনের স্ত্রীর দেহ দুয়ে শপথ নিয়ে কসাই খান সেনাদের রক্তে হোলি খেলার জিঘাংসা নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছেন। মুক্তি পাগল মুক্তি সেনাদের প্রতিটি সজাগ মুহুর্তের শক্তি শক্র হননের রক্তাভ প্রতিজ্ঞায় সতত সতর্ক। আমাদের মুক্তি সংগ্রামকে সামগ্রীক সফলতার স্বর্ণ তোরণে পেীছিয়ে দেওয়ার জন্য দুর্গন্ধময়। পঁচা দ্রব্যের মতো অপরিসীম। ঘৃণায় পাকিস্তানী দ্রব্যাদি বর্জন অব্যাহত রাখতে হবে। মনে রাখতে হবে আমরা যদি একটি আলপিনও খরিদ করি তার জন্য জল্লাদ ইয়াহিয়ার সরকারকে ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। আপনারা জানেন, বিগত ২৪ বছর যাবত বাঙ্গালীদের আলপিন থেকে গাড়ী সংযোজনের কোন কারখানাই বাংলাদেশে স্থাপন করতে দেওয়া হয়নি। কারণ আমাদের এলাকা ছিল উপনিবেশ আর আমাদের গণ্য করা হতো। উপনিবেশের ঘৃণ্য নিগার রূপে। তাই জল্লাদ পশ্চিম পাকিস্তানী। শাসক চক্র—জিন্না থেকে জালিম ইয়াহিয়া সবাই আমাদের ৬০ হাজার গ্রামকে তাদের নিরুপদ্রব বাজারে পরিণত করেছিল। দু’টাকার জিনিস সাড়ে পাঁচ টাকায় খরিদ করতে বাধ্য করে। ২৪ বছরে প্রতিদিন প্রতি মুহূর্তে তারা ঝোকের মতো আমাদের অর্থনৈতিক প্রাণ শক্তিকে শুষে, নিংড়ে, ছিবড়ে করে দিয়েছে। প্রতি বছর বাংলাদেশের মানুষ শুধু পশ্চিম পাকিস্তানী দ্রব্য খরিদ করে কেন্দ্রকে শত শত। কোটি টাকার আবগারী tax দিয়েছে। সে অর্থেই তাদের উদর স্ফীত হয়েছে, কজিতে আমাদেরকে হত্যার শক্তি হয়েছে। সঞ্চারিত। মনে রাখবেন বাংলাদেশের বিরাট বিশাল বাজার দখলে রাখার জন্যই হিংস্র হায়েনার মতো কসাই বাহিনী আমাদের মাংস খাবলে খাবলে খেয়ে ভয় আর ভীতি সৃষ্টির দ্বারা এই লোভনীয় বাজার তাদের বুটের তলায় পদানত রাখতে চাচ্ছে। । আমি কয়েকটি ঘটনা উল্লেখ । করছি। বাংলাদেশে গায়ে মাখার কোন সাবান প্রস্তুত হয় না। তাই বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় সাবান মাখতে অভ্যস্ত অনেককে। আমি বাংলা সাবান বা কাপড় কাচা সাবান গায়ে মাখতে দেখেছি। দাঁত পরিষ্কারের জন্য Paste ব্যবহার করা ছাড়া অন্য কোন বিকল্প যারা ভাবতেই পারতো না তারা আজ কাঠ কয়লা, দেশে তৈরী চক পাউডার, – নিমের আর আমের ডাল ব্যবহার করছেন। প্রয়োজনসাংঘাতিক প্রয়োজন ছাড়া। অনেকেই কোন প্রকার কাপড়চোপড় ক্রয় করছেন না। যদি না _ কিনলেই নয় তাহলে তাতের শাড়ী, তাঁতের কাপড় কিনছেন। আমরা জানি, তাঁতের কাপড় কিনলেও জল্লাদ সরকারকে tax দিতে হচ্ছে। কোটি কোটি বাঙ্গালীর দুঃখ-দুর্দশা দীর্ঘতর করার জন্য যে নরপশু বাহিনী হন্যে হয়ে উঠেছে আমরা যদি তাদের আর্থিক মদদ দেই তবে তা দেশদ্রোহীতা বলেই বিবেচিত হবে। এক • প্যাকেট সিগারেটের কথাই ধরুণ । ১০টি বা ২০টির প্রতি প্যাকেট সিগারেট ধূমপানের জন্য আপনি কি জানেন আমরা কি পরিমাণ অর্থ ট্যাক্সের আকারে । জল্লাদদের হাতে তুলে দিচ্ছি। ২০টি সিগারেটের (প্রতি প্যাকেট)। সাড়ে তিন টাকা। বেশী দামের তিনটি ব্ৰাণ্ডের সিগারেটের কথাই ধরা যাক। এ জাতীয় প্রতি প্যাকেট সিগারেট ধূমপান করে আমরা পৌনে দু’টাকা করে সাহায্য দিচ্ছি কসাই খান সেনা দের কজীতে শক্তি সঞ্চয়ের জন্য। নির্ধারিত এক। টাকা পনের। পয়সা মূল্যের ১০টির এক প্যাকেট সিগারেটের ধূমপান করে ৬৫ পয়সা ইয়াহিয়ার পশ্চিম পাকিস্তান সরকারকে ট্যাক্স দিচ্ছি। দিনে চার প্যাকেট এ ব্ৰাণ্ডের সিগারেট ধূমপান করা হলেই প্রতিদিন শুধু সিগারেট বাবত। ২ টাকা ৬০ পয়সা আমাদের হত্যার ইন্ধন যোগানোর জন্য ঘাতক সেনাদের পেছনে ব্যয় হয়। একজন বাঙ্গালী হিসেবে আজকের এ পরিস্থিতিতে ইতিহাসের এই নিষ্ঠুরতম জল্লাদদের এভাবে সাহায্যদান নিশ্চয় আমাদের দেশপ্রেমের পরিচায়ক নয়। আমরা যারা ধূমপানে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছি তাদের পক্ষে এ অভ্যাস বর্জন করা হয়তো সম্ভব নয় । তা হলে কি করা যায় ? যে সিগারেটে বেশী কর দিতে হয়, সে সিগারেটের ধূমপান না করে। আরও অনেক কম দামের সিগারেট ব্যবহার করতে পারি আমরা। ভাবছেন পারবো কি ? পঁচিশে মার্চের মধ্যরাত থেকে আজকের এ মুহূর্ত পর্যন্ত আমাদের ধর্ষিতা মাতৃভূমিতে দখলদার হিংস্র খান সেনাদের উন্মত্ততা নিজের চোখে দেখার পরও কি আমরা এটুকু ত্যাগ স্বীকার করতে পারবো? কেন পারবো না যখন দেখি আমাদের সিগারেটের আগুন দুশমনের হাতে কামানের আগুন। হয়ে বেরুচ্ছে। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় ১০টির যে সিগারেটের প্যাকেট এক টাকা পনের পয়সা নির্ধারিত মূল্যে বিক্রী হচ্ছে এমন ব্ৰাণ্ডের সিগারেট এক ভদ্রলোক প্রায় ২৪ বছর ধরে ব্যবহার করে আসছিলেন। পোষাকের প্রতি নয়, খাওয়ার প্রতি নয়- শুধু এ ব্ৰাণ্ডের সিগারেটের প্রতি এ ভদ্রলোকের অপরিসীম দুর্বলতা ছিল। ২৭শে মার্চ সকাল বেলায় কারফিউ কয়েক ঘণ্টার জন্য উঠিয়ে নেয়ার পর থেকে তিনি ৩০/৩৫ পয়সা মূল্যের সিগারেট ধরেছেন। এতে তিনি ট্যাক্স দিচ্ছেন। তবে তার পরিমাণ তুলনামূলকভাবে খুবই কম। সিগারেট সম্পূর্ণরূপে ছেড়ে না দিতে পারায় তাকে, এ ট্যাক্স দিতে হচ্ছে। এ জন্যেও তিনি লজ্জিত। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় হাজার হাজার এক কালের সৌখিন ধূমপায়ীকে আমি অতি কম দামের সিগারেট ব্যবহার করতে দেখেছি। সত্যি ভাবতে অবাক লাগে, প্রতি বছর আমরা শুধু সিগারেট বাবত জঙ্গী শাহীকে গত ২৩ বছর যাবত, বার্ষিক ৭৫ কোটি টাকা tax দিয়ে এসেছি। ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনা সরকার। চলতি আর্থিক বছরের বাজেটে বাতাস ছাড়া আর সবকিছুর ওপর ট্যাক্স বসিয়েছে অথবা হার বাড়িয়েছে। শুধু সিগারেট থেকে এ বছরে আরও সতের কোটি টাকা অতিরিক্ত ট্যাক্স পাবে বলে ইয়াহিয়া সরকার আশা করছে। আসুন, আমরা জল্লাদদের সে আশার ললুপ জিহ্বাকে অসহযোগিতার অস্ত্র দিয়ে কেটে ছিন্ন ভিন্ন করে দেই। আমাদের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার সম্প্রতি বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার জনগণের প্রতি জীবন বীমার কিন্তীর দেয় টাকা দেশ শত্রু মুক্ত না হওয়া পর্যন্ত আদায় না করতে অনুরোধ জানিয়েছেন। আপনি-আমি সবাই জানি ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা তার সমর যন্ত্রের চাকা ঘূর্ণায়মাণ রাখার জন্য ক্ষিপ্ত কুকুরের মতো হন্যে হয়ে অর্থের সন্ধানে এ-দুয়ার, সে-দুয়ার ঘুরে বেড়াচ্ছে। এ-পকেট, সে-পকেট হাতড়াতে শুরু করেছে। কোন অর্থই তাদের থাবা থেকে নিরাপদ নয়। সে তার ন্যাংটো শরীরকে আপনার-আমার অর্থ দিয়ে ঢাকতে চেষ্টা করছে যাতে তার কুষ্ঠ গলিত রূপ অপরের চোখে ধরা না পড়ে। সামরিক জান্তার গলিত বীভৎস দুর্গন্ধময় দেহ ঢাকতে আপনি-আমি তো সহাযুতা করতে পারি না। আরো আছে আপনারা ইতিমধ্যেই – প্রতিটি প্রাইজবন্ড ও নিশ্চয়ই ভাঙ্গিয়ে টাকা করে নিয়েছেন। একটি প্রাইজবন্ডও ঘরে রাখবেন না। সব ভাঙ্গিয়ে ফেলুন। পোষ্ট অফিস থেকে, ব্যাঙ্ক থেকে আপনার সব টাকা উঠিয়ে ফেলে নিরাপদ জায়গায় রাখুন। Defence Savings Certificate, National Investment Trust Unit বা কোন নতুন শিল্প ইউনিটের শেয়ার কেনা একেবারেই উচিত হবে না আপনার-আমার।
একটি জাতিকে এক বর্বর, ঘৃণ্য ও পৈশাচিক চক্রের অক্টোপাস। বন্ধন থেকে মুক্ত করার জন্য অর্থনৈতিক প্রতিটি ফ্রন্টে বিজয় সুনিশ্চিত হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত আমাদেরকে আপোষহীন সংগ্রাম চালিয়ে যেতে হবে। তাই যে কোন কোম্পানীতেই আপনি। জীবন বীমা করে থাকুন না কেন সেখানে প্রিমিয়াম জমা দিলে তা ক্ষুধার্ত নেকড়েদের উদরে চলে যাবে। আমরা জানি বীমা কোম্পানী গুলো প্রাপ্ত অর্থ দেশের উন্নয়নের কাজে লগ্নি করে থাকে। আজ শুধু বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা কেন ইয়াহিয়ার। পশ্চিম পাকিস্তানেও একটি মাত্র বাদে প্রতিটি খাতের উন্নয়ন বন্ধ হয়ে গেছে। আর সে একটি হচ্ছে সামরিক খাত। শুধু মাত্র সামরিক খাতের ফুটো কলসীতে সারা দেশের অর্থ লুট করে এর বিগত পাঁচ মাস যাবৎ ঢেলে দেওয়া হচ্ছে। এই আত্মঘাতী, মানবতা ও সভ্যতা বিরোধী ঔপনিবেশিক যুদ্ধ পরিচালনা করতে গিয়ে ইয়াহিয়া সরকারের হাল হয়েছে সৈয়দ মুজতবা আলীর’ গল্পের সেই বিখ্যাত Senior Apprentice-এর মতো। অর্থাৎ সে ন্যাংটো হয়ে পড়েছে।
পাতা–৫
দুইটি ডানা ও পাকিস্তান
সেতাবউদ্দিন বিশ্বাস
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)
ধর্মীয় উন্মাদনার কুয়াশাকে ভিত্তি করে জন্মলাভ করল পাকিস্তান। শুরু হল পূর্ব ও পশ্চিমা ভাইদের অপূর্ব মিলন। শুরু হল ইসলামের ‘আবাদ পশ্চিমা ভাই শুরু করল পূর্বের ভাইকে শোষণ করে শক্তি অর্জন। যুক্তি হল, শক্তি যদি চারদিকে ছড়িয়ে থাকে তাহলে ইসলামের ‘আবাদ’ অসম্ভব। ইসলামের ‘আবাদকে সম্ভব করার জন্যই শক্তিকে সংযত করার দরকার এবং তা পশ্চিম পাকিস্তানেই হওয়া প্রয়োজন। কারণ, পশ্চিমারাই হচ্ছে খাঁটি পাকিস্তানী এবং খাটি মুছলমান ! ইসলামের ‘আবাদ করার যোগ্যতা তারাই রাখে! প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে পশ্চিমারা প্রকারান্তরে পাকিস্তানের ই বিরোধীতা করেছিল পাকিস্তানের বিরুদ্ধে ভোট দিয়ে। সেখানে কোথায়ও গঠিত হয়নি মুসলিম লীগ সরকার। পাকিস্তান আনয়নে ধর্মীয় উন্মাদনায় আচ্ছন্ন বাঙালীদের দানই বলতে গেলে একক। তাহলে কী হয়। পশ্চিমারা পীর পয়গম্বরের বংশধর ; তারা সব পীরজাদা, মকদুম জাদা, নবাব জাদা এবং সাহেবজাদা—অর্থাং হারামজাদা নয়। তারা যতই অবৈধ, অন্যায় এবং জঘন্য কাজই করুক না কেন তাদের মুছলমানিত্ব নষ্ট হবার উপায় নাই। তারা এমনই পাকা ইমানদার এবং এমনই খাটি। ইসলামের নামে, ইসলামকে ‘আবাদ করার জন্য শক্তিকে সংঘত করার নামে পশ্চিমারা শুরু করল পূর্বের ভাইকে নিম্মমভাবে শোষণ করতে। চব্বিশ বছর ধরে এই শোষণ চলল একটানা এবং এই শোষণকে তাদের ন্যায়সঙ্গত বিধি ও অধিকার হিসেবে স্থায়ী করার জন্য চালাল বাঙ্গালীদের উপর অকথ্য বব্বর এবং পাশবিক অত্যাচার। একে অপরের ভাই কিনা! বাঙ্গালীর করল ত্যাগ, পশ্চিমারা করল। ভোগ ; বাঙ্গালীর হল শোষিত, পশ্চিমারা হল শোষক, বাঙ্গালীরা দিল প্রেম-প্রীতি-ভালবাসা, পশ্চিমারা দিল প্রতারণা, অত্যাচার, লাঞ্চনা তাদের সমস্ত পশু প্রবৃত্তি এবং পশু শক্তির বিভৎস বিকাশ ঘটিয়ে। অপূর্ব ‘ভাতৃ-প্রম’-অপূর্ব ‘মিলন। আর এই অপূর্ব মিলনের ফলশ্রুতি হিসেবে পশ্চিমাদের যে সাংঘাতিক শক্তির সৃষ্টি হল তা দিয়ে তারা ১৯৭১ সালের ২৫শে মার্চ তারিখে বাংলায় বাঙ্গালীদের উপর ভয়ঙ্কর রূপে ইসলামের ‘আবাদ করল আরম্ভ—লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে করল নৃসংশভাবে খুন, হাজার হাজার মা-বোনের উপর চালাল অশ্রুতপূৰ্ব অবর্ণনীয় পাশবিক অত্যাচার ; অসংখ্য বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে করল নিশ্চিহ্ন, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালীকে কবুল ভিটে মাটি ছাড়া, দুই হাতে লুট করল তাদের সমস্ত সম্পদ, গরু-ছাগলের মত তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ান হল কোটি কোটি বাঙ্গালীকে এখান থেকে ওখানে। ইসলাম আবাদের এই ভয়াবহ বিভৎস তাণ্ডব নৃত্য আজও চলছে বাংলাদেশে বাঙ্গালীদের উপর। তবুও তারা অর্থাৎ পশ্চিমারা আজও দোহাই পড়ছে পাকিস্তান ও ইসলামের তাদের এই নজীরবিহীন পাশবিক অত্যাচার, বর্বরতা এবং জঘণ্য। অপরাধকে যুক্তি যুক্ত বলে প্রমাণ। করার জন্য। কী অপূৰ্ব্ব পাকিস্তান ও ইসলাম-প্রীতি’! আর তাদের এই প্রীতি’তে ঢেউ সৃষ্টি করতে সাহায্য করে চলেছে কতিপয় দেশদ্রোহী বাঙ্গালী মীরজাফর তাদের ব্যক্তি স্বার্থে—মাতৃরক্তের বিনিময়ে। ধর্মীয় উন্মাদনার যে কুয়াশা বাঙ্গালীকে রেখেছিল আচ্ছন্ন করে তা ধীরে ধীরে কাটতে অবশেষে ১৯৭০ সালে এসে সম্পূর্ণরূপে কেটে গেল। বাঙ্গালীরা পরিষ্কারভাবে বুঝল তারা বাঙালী-তারা পাকিস্তানী নয়। এবং তারা যে বাঙালী-পাকি স্তানী নয়—তা স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিল বিশ্ববাসীকে ১৯৭০ সালের নির্বাচনে। বাঙালীরা পশ্চিমাদের বলল, আমরা আমরা। তোমরা তোমরা। আমরা উদয় অচলে আর তোমরা অস্তাচলে। আমরা মানব মর্যাদায় বিশ্বাসী তোমরা মনুষ্যত্বের হত্যাকারী। আমরা এবং তোমরা মিলে আবার তথাকথিত পাকিস্তান বা অন্য কিছু হবার জো নেই। আমরা ও তোমরা দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ও আলাদা জাত-মাঝখানের ধর্মীয় উন্মাদনার সেতু বন্দন সম্পূর্ণরূপে আলাদা; নূতন করে গাঁটছড়া বাঁধার আর কোন উপায় নেই। বাংলাদেশ পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বারোশো মাইল দূরে আপন জায়গায় আপন মহিমায় মণ্ডিত, বিরাজ করছে এবং করবে চিরকাল।
পশ্চিমারা প্রথম থেকেই ভালভাবে জানত, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক এবং আলাদা রাষ্ট্র। ধর্মীয় কুয়াশার সেতুবন্দন দিয়ে তারা এই দুইটি সম্পূর্ণ পৃথক ও স্বাধীন রাষ্ট্রকে এক করে রাখতে চেয়েছে তাদের লোভ-লালসাকে চরি- তার্থ করার জন্য—ইসলামের জন্য নয়। এই ধর্মীয় কুয়াশার উপর দিয়ে তারা পাড়ি জমিয়েছে বাংলাদেশে বাংলার সম্পদ লুণ্ঠন করতে। তারা জানত এক দিন এ’ কুয়াশা দূর হবেই। তবুও যে কয়দিন লাভ। এখন এটা সুস্পষ্ট, বাংলাদেশ ও পাকিস্তান দুটো সম্পূর্ণ পৃথক ও আলাদা স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র—তাদের জন্মের দিন তারিখ থেকেই। যাহা আগে হইতেই – বিচ্ছিন্ন তাহাকে নূতন করিয়া বিচ্ছিন্ন করার কোন প্রশ্নই উঠেনা। অতএব, বাংলার নয়ন মনি এবং মুকুটহীন রাজা বঙ্গ বন্ধু। শেখ মুজিবকে এবং তার সাড়ে সাত কোটি বাংগালীকে বিচ্ছিন্নতা বাদীর অপরাধে অপরাধী করার কোন উপায় নেই। বাংলা বাংগালীর। পশ্চিমারা তোমর। বাংলা ছাড়। তোমরা তোমাদের অস্তাচল—অবস্থিত ঠুটো জগন্নাথ পাকিস্তানকে নিয়ে সেখানে ইসলামের আবাদ যত খুশী কর আমাদের আপত্তি নাই। কিন্তু, বাংলায় ওসব চলবে না। তোমাদের নজীরবিহীন অসংখ্য ব্যভিচার এবং বৰ্বর পাশবিক নারী নির্যাতনের উপর তোমাদের গণহত্যার শিকার লাখোলাখোবাংগালীর লাশ দিয়ে পূর্ব ও পশ্চিমের মধ্যে সেতুবন্দন সম্পূর্ণ অসম্ভব। তোমরাও একটু চিন্তা করে দেখা সম্ভব কিনা। কিন্তু, তোমাদের ত কোন বিবেক নাই।পশুরও অধম তোমরা।
অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণ।
‘মুক্তি সংগ্রামে আমরা আজ একা নই’
[ বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতির ভাষণের কিয়দংশ প্রকাশিত হয়েছে
বাকি সম্পূর্ণ অংশ নীচে দেয়া হল ]
বাংলাদেশের স্বাধীনতাই আজ সবার কাছে সব চেয়ে বড় কথা। বাঙালী মাত্রই আজ মুক্তি সেনা। দেউলিয়া হওয়ার পথে জান্তা জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা দেউলিয়া হওয়ার মুখে। অন্তকলহে তারা বিপর্যস্ত। পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনৈতিক কাঠামো প্রায় ভেঙে পড়েছে। সেখানকার অধিকাংশ কলকারখানা বন্ধ হওয়ার দরুন শ্রমিক অসন্তোষ দেখা দিয়েছে। বাংলাদেশের বাজার হাতছাড়া হওয়ার দরুণই আজ পশ্চিম পাকিস্তানে এ ভয়াবহ অর্থনৈতিক বিপর্যয় দেখা « দিয়েছে। তাই আপনারা পশ্চিম পাকিস্তানী জিনিসপত্রের উপর বয়কট অব্যাহত রাখুন। সামরিক জান্তা বাংলাদেশের পাট, পাট জাত দ্রব্য, চা, চামড়া ইত্যাদি বিদেশে রফতানী করতে না পেরে বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে বিশ্বের দরবারে ভিক্ষার ঝুলি হাতে নিয়ে বেড়াচ্ছে। পাকিস্তান এইড কনসোর্টিয়াম এখন এই সামরিক জান্তাকে আর অর্থ সাহায্য বা ধার হিসাবে টাকা দিচ্ছে না। এ ছাড়া মনে রাখা প্রয়োজন, যে কোন দেশের সরকারের পক্ষে শুধুমাত্র বিদেশী সাহায্য ও ধারের উপর বেঁচে থাকা সম্ভব নয়। উপরন্তু এই সামরিক জান্তা। নিজেরাই দেড় হাজার মাইল থেকে একটা যুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানে জনসাধারণের মাঝেও নৈরাশ্য ও হতাশ দিন দিন দানা বেঁধে উঠেছে। সত্তরের নির্বাচনে গণতন্ত্র ও অর্থনৈতিক মুক্তির আশায় তারা নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল। আজ তারা দেখতে পাচ্ছে তাদের সন্তানরা সামরিক জান্তার ক্ষমতা দখলের লড়াই ও – ২২ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় প্রাণ দিচ্ছে।সে কারণে আজ পশ্চিম পাকিস্তানের বেলুচ, সিন্ধি ও পাঠানদের মধ্যে আত্মজিজ্ঞাসা। জেগে উঠছে। তাই আমর। দেখতে পাই বেলুচ ও পাঠান সৈন্যদের সাথে পশ্চিম পাঞ্জাবী, অফিসারদের সংঘাত শুরু হয়েছে। পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা, যারা সামন্তবাদ ও পুজিবাদ থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য বিগত নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেছিল তাদেরও মোহমুক্তি ঘটতে শুরু করেছে। আমি বাংলাদেশের জনগণের তরফ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী নির্যাতিত মানুষদের আশ্বাস দিতে পারি, – পাঠান বেলুচ ও সিন্ধি জনগণ যদি তাদের আত্মনিয়ন্ত্রণের জন্য। আন্দোলনে ঝাপিয়ে পড়ে তাহলে বাংলার সাড়ে সাত কোটি নির্যাতিত মানুষ তাদের পাশে গিয়ে দাড়াবে । পশ্চিম পাঞ্জাবের কৃষক শ্রমিকেরা যদি তাদের অধিকার আদায়ের জন্য লড়াই শুরু করে তাহলে বাংলার নির্যাতিত কৃষক শ্রমিকেরা তাদের সহানুভূতি জানাবে । তাই আজকের দিনে আমি পশ্চিম পাকিস্তানী সর্বহারা মানুষদের জানাই সামরিক জান্তা নিজের ক্ষমতা বজায় রাখার জন্য আপনাদেরও শোষণ করে চলেছে। আপনাদের মিথ্যে ধোঁকা দিয়ে বাঙ্গালীদের উপর তারা যে লড়াই চালিয়ে যাচ্ছে এ লড়াইয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষের কিছু লাভ হবে না। ঘরোয়া ব্যাপার আর বাজারে বিকাচ্ছে না সত্যিকারভাবে বলতে গেলে আজকে পরিস্থিতির দ্রুত পরিবর্তন ঘটেছে। প্রতি পদে পদে আমাদের শত্রু’ জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা শুধু দুর্বল হয়েই পড়ছে না, বাংলাদেশের ব্যাপারটাকে ঘরোয়া ব্যাপার’ দেখাবার জন্য সারা পৃথিবীব্যাপী তারা যে প্রচেষ্টা চালিয়েছিল তাদের সে প্রচেষ্টা – ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। সমগ্র বিশ্বজনমত আজ বাংলাদেশের ব্যাপারে সোচ্চার হয়ে উঠেছে। বুদাপেস্টের শান্তি সম্মেলন, সিঙ্গাপুরে পার্লামেন্টারী সম্মেলন – এবং নয়াদিল্লীতে আন্তর্জাতিক সম্মেলন গুলিতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের যোগদানকারী সদস্যরা বঙ্গবন্ধুর মুক্তি এবং বাংলাদেশের মানুষের গণতন্ত্র রক্ষার লড়াইয়ের সপক্ষে রায় দিয়েছে। ওয়াসিংটন, নিউইয়র্ক, অটোয়া, লণ্ডন, বৈরুত, হংকং, মানিলা, টোকিও সর্বত্রই আজ নানা ধরণের সভা ও শোভাযাত্ৰা জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিক্ষোভে ফেটে পড়ছে। বৃটিশ পার্লামেন্টের কয়েক শ সদস্য কয়েক দফাই একযোগে ইসলামাবাদের শাসকচক্রের বিরুদ্ধে ধিক্কার দিয়েছেন । বৃটিশ পার্লামেন্টে এর মধ্যে একাধিকবার বাংলাদেশ ইস্যু আলোচিত হয়েছে। সীমান্ত অতিক্রমকারী বাঙালী শরণার্থী এবং অধিকৃত এলাকায় কোটি কোটি আমার ভাই-বোনেরা যে দুর্বিসহ জীবন যাপন করছে, তাতে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের নেতৃবৃন্দ মানবতার সেবায় এগিয়ে আসবার জন্য সকলের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। তাদের প্রতি আমার আশ্বাস বাংলাদেশের অভ্যন্তরে আজকে যারা অসহায় অবস্থায় অনাহারে দিন কাটাচ্ছে, সে-সমস্ত বন্ধুদেরকে আমি আশ্বাস দিতে পারি আমাদের তরফ থেকে আমরা দ্রুত অধিকৃত এলাকাকে শত্রুমুক্ত করার সাথে সাথেই তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন সম্ভব হবে অন্যথায় তাদের দুঃখ-দুর্দশা মোচন সম্ভবপর নয় ! এতদ্সত্বেও বিদেশী রাষ্ট্রগুলো থেকে যে-সব সাহায্য বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় পাঠানো হয়েছে, আমরা _ শুনে ব্যথিত হয়েছি, দুঃখিত হয়েছি এবং আশ্চর্যান্বিত হয়েছি যে জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক কর্তৃপক্ষ সে-সর সাহায্য থেকে আপনাদের বঞ্চিত করে তা হানাদার বাহিনীর কাজে লাগিয়েছে। এমনকি এ-সব সাহায্য দ্রব্য সরবরাহের জন্য যে-সব যানবাহন বিদেশ থেকে এসেছে সে-সব হানাদার সৈন্যদের যাতায়াতের জন্য ব্যবহার করা হচ্ছে। আমি রাষ্ট্রসংঘ ও বিদেশী রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি এদিকে আকর্ষণ করছি। দেশকে শত্রু মুক্তির জন্য চালান হচ্ছে সমস্ত প্রচেষ্টা সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী ভাই-বোনেরা আমার, আপনাদের সমর্থনপুষ্ট স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার দেশকে শত্রুর কবজামুক্ত করবার জন্য সমস্ত রকমে প্রচেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এর মধ্যেই _ সরকারের প্রতিনিধিরা জাপান,ফিলিপাইন, থাইল্যান্ড, হংকং, – সিঙ্গাপুর, সিংহল, নেপাল, লেবানন, বৃটেন, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে আমাদের সপক্ষে জনমত গড়ে তোেলবার জন্য সফর করছে।এই সমস্ত সফরের ফলে আমরা পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে যে সাড়া পেয়েছি তাতে বিশ্বাস করবার কারণ ঘটেছে যে, বিশ্বের ছোট বড় বহু দেশ অচিরেই সক্রিয়ভাবে আমাদের। সমর্থনে এগিয়ে আসবে। আমরা আজ আর একা নই। এর মধ্যেই সোভিয়েট রাশিয়া বাংলাদেশ ইস্যুতে তাদের বক্তব্য ঘোষণা করেছেন। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট পদগণী এবং আফগানিস্তানের রাজা জাহীর শাহের যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশ সম্পর্কে মত প্রকাশ করা হয়েছে। পূর্বইউরোপের দেশগুলোও আমাদের প্রতি সমর্থনের মনোভাব প্রকাশ করেছেন। তা ছাড়া কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, নরওয়ে, সুইডেন, আফ্রিকা ও লেটিন আমেরিকার কোন কোন দেশ আমাদের স্বপক্ষে কথা বলেছেন। এ সমস্ত বিশ্ব রাষ্ট্রগুলো আজকে আমাদের সংগ্রামের সত্যতা উপলব্ধি করতে সক্ষম হয়েছেন। কেন না আমাদের সংগ্রাম ন্যায়ের সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম গণতন্ত্র রক্ষার সংগ্রাম, আমাদের সংগ্রাম ঘষিত স্বাধীনতাকে রক্ষা করার সংগ্রাম ইয়াহিয়ার নতুন ধোকাবাজী। তাই আজ অবস্থা বেগতিক দেখে ইয়াহিয়া খানের সামরিক জান্তা বিশ্বজনমতকে ধোকা দেওয়ার ষড়যন্ত্রে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় বেসামরিক শাসন চালু হয়েছে বলে একটা মুখোস পরাবার চেষ্টা করছে। ডাক্তার মালিককে গভর্ণর নিয়োগ করে, নির্বাচনে পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলির অধিকার বা সদস্য নিয়ে একটি মন্ত্রীসভা গঠন করা হয়েছে। এর পেছনে দুটো মাত্র উদ্দেশ্য রয়েছে। এক নম্বর হচ্ছে, বিশ্ববাসীকে ধোঁকা দিয়ে বোঝননা যে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আর দুই নম্বর হচ্ছে, বেসামরিক কতৃপক্ষের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের লোভ দেখানোর প্রচেষ্টা। অথচ কার্যক্ষেত্রে এটা প্রহসন ছাড়া। আর কিছুই নয়। জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া খানের রাজনৈতিক সহচরেরা পর্যন্ত এই লোভ দেখানো প্রহসনকে স্বীকার করে নিতে পারেন নি। স্বয়ং ভূট্টো সাহেব এই লোভ দেখানো বেসামরিক । সরকার প্রতিষ্ঠাকে একটি ভাওতা বলে উল্লেখ করেছেন। এমন কি চরম দক্ষিণ পন্থী, রাজনৈতিক দল জামাতে ইসলামীর সাধারণ। সম্পাদক চৌধুরী রহমত এলাহী। বলেছেন এ ধরণের বেসামরিক সরকার না হবে গণপ্রতিনিধিত্ব মূলক, না হবে জনপ্রিয়। এর দ্বারা কোন কাজই সফল হবে। । । ইয়াহিয়ার প্রচেষ্টা ব্যর্থ
বন্ধুরা আমার, এই লোক দেখানো সরকার প্রতিষ্ঠা করে। ইয়াহিয়া খান মনে করেছিলেন যে, বাংলাদেশের জনসাধারণের মধ্যে একটা বিরোধ সৃষ্টি করবেন, এবং অন্যদিকে আওয়ামী লীগ দলের মধ্যে একটা ভাঙন। ধরাবেন। ইয়াহিয়া খানের এ প্রচেষ্টা ব্যর্থতায় পর্যবসিত হয়েছে। এ লোক দেখানো সরকারের সদস্য কারা ? বাংলাদেশের আপামর জমসাধারণ তা জানেন। পরাজিত রাজনৈতিক দলগুলোর সদস্য নিয়ে যে মন্ত্রীসভা আজকে ইয়াহিয়া সাহেব গঠন করেছেন সে মন্ত্রীসভার সদস্যদের, আর যে গভর্ণর তিনি নিয়োেগ করেছেন সেই ডাক্তার মালেক সাহেবকে আমি জিজ্ঞাসা করতে চাই, আপনারা বলেছেন যে, আপনারা স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনছেন কিন্তু আপনারা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর বাংলাদেশে যে ভয়াবহ অবস্থা নতুন করে সৃষ্টি করা হয়েছে তার কি কোন কৈফিয়ত আপনারা দিতে পারবেন ? মালেক সাহেব গভর্ণর হিসেবে শপথ গ্রহণ করার। পর কুমিল্লা জেলার কসবা,চৌদ্দগ্রাম, সরাইল, ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় বিগত সেপ্টেম্বর মাসের প্রথম থেকে যে ভয়াবহ নরহত্যা ঘটেছে তার কি কোন কৈফিয়ত মালেক সাহেব দিতে পারবেন? নির্মমভাবে মানুষকে হত্যা করা হয়েছে। শুধু কুমিল্লার পূর্বাঞ্চলেই নয়, সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, ময়মনসিংহ জেলার কিশোরগঞ্জ ও নেত্রকোনার ভাটি অঞ্চলে বিগত ১৮ই আগষ্ট থেকে শুরু করে আজ পর্যন্ত যে ভয়াবহ তাণ্ডবলীলা চলেছে তার খবর কি মালেক সাহেব রাখেন? শত শত নারীকে আজকে আবার নির্যাতনের শিকারে পরিণত করা হয়েছে। বাঙ্গালী মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা করতে যারা পারবে না, বাংলার নিরীহ মধ্যবিত্ত চাষীর জীবনকে যারা বাঁচাতে পারবে না, বাংলাদেশের মানুষকে প্রতিনিধিত্ব করার অধিকার তাদের নেই। বাংলাদেশের মানুষ ঘৃণা ভরে ইয়াহিয়া খানের এই পুতুল সরকারকে প্রত্যাখ্যান করেছে। আমি বিশ্বাস। করি তাদের সঙ্গে জনগণ কোন ভাবেই সহযোগিতা করবে না। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের মধ্যে ভাঙন ধরাতে ইয়াহিয়? খান শুধু ব্যর্থই হন নাই, তার সমস্ত প্রচেষ্টাকে আজ আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেছেন। তিনি মনে করেছিলেন আওয়ামী লীগের ৮৮ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের সদস্য। পদ বহাল রেখে আওয়ামী লীগ। পার্লামেন্টারী দলের মধ্যে ভাঙন সৃষ্টি করবেন। কিন্তু দেশবাসী ভাইয়েরা, আপনারা শুনে সুখী হবেন যে, আপনাদের নির্বাচিত। সদস্যদের অধিকাংশই এখন মুক্ত এলাকায় এসে স্বাধীনতার সংগ্রামে। শরিক হয়েছেন। বাকী সদস্যরা আত্মগোপন করে মুক্তি যুদ্ধে সক্রিয়ভাবে সাহায্য করে চলেছেন। আমি স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আওয়ামী লীগের এ সমস্ত সংগ্রামী পরিষদ সদস্যদের ” তঁাদের ত্যাগ তিতীক্ষা এবং ঘোষিত স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে শরিক হবার জন্য আন্তরিক অভিনন্দন জানাচ্ছি। আমি দেশবাসী ভাইদের এ আশ্বাস দিতে পারি যতদিন পর্যন্ত না বাংলার মাটি থেকে হানাদার বাহিনী উৎখাত হবে, যতদিন। পর্যন্ত বাংলাদেশের সার্বভৌমত্ব স্বীকৃত হবে, গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠিত হবে, ততদিন পর্যন্ত আপনাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিরা আপনাদের সঙ্গে কাধে কাধ মিলিয়ে সংগ্রাম করে যাবেন। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত সদস্যরা তাদের নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আদর্শ এবং নীতিতে বিশ্বাসী। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজীবন গণতন্ত্রের জন্য লড়াই। করে গেছেন। যে গণতন্ত্র বহু পরীক্ষা নিরীক্ষা, বহু মনীষীর ত্যাগ ও তিতীক্ষা আজও পৃথিবীতে স্বীকৃত এবং রাজনৈতিক শ্রেষ্ঠতম। আদর্শ হিসেবে পরিগণিত সেই গণতন্ত্রের লড়াই আজকের বাংলাদেশের ভূমিতেই চলছে।
সেই গণতন্ত্রের লড়াই-এ। ফ্যাসিষ্ট সরকারের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করতে গিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান আজ ফ্যামিষ্ট ‘সরকারের কারাগারে বন্দী।
সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, সাড়ে সাত কোটি মানুষের নেতা, গণতন্ত্রের মহান সাধক বাঙ্গালীর প্রাণ প্রিয় নেতা জনাব শেখ মুজিবর রহমানকে আজকে এক প্রহসনমূলক বিচারে শাস্তি দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানের সরকার। ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়েছে। ইয়াহিয়া। খান বঙ্গবন্ধুর বিচারের ধৃষ্টতা দেখিয়ে সারা পৃথিবীর মানুষের কাছে ধিকৃত হয়েছেন। গণতন্ত্রকামীদের প্রতি আহ্বান। বাংলাদেশের ভাই-বোনেরা আপনাদেরকে আমি সুস্পষ্ট ভাষায় জানাতে চাই পৃথিবীর ছোট বড় সমস্ত রাষ্ট্রই এই বিচার প্রহসন বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ প্রয়োগ। করেছেন। আমি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর তরফ থেকে ইয়াহিয়া খানকে সাবধান করে দিতে চাই যে বঙ্গবন্ধুর মিথ্যা প্রহসনমূলক বিচার যদি আপনি চালিয়ে যান এবং বঙ্গবন্ধুকে, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রিয়তম নেতার যদি আপনি কোন ক্ষতি করেন তাহলে বাংলার মানুষ এ অন্যায়কে সহ্য করবে না। আমি সঙ্গে সঙ্গে বিশ্বের গণতন্ত্র কামীসমস্ত মানুষের কাছে আকুল আবেদন জানাই—যারা গণতন্ত্রের সংগ্রামে আজকে লিপ্ত আছেন সে সমস্ত মানুষের কাছে আমি ফরিয়াদ করি ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়া সরকারের কারাগারে আবদ্ধ পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ গণতন্ত্রকামী নেতার মুক্তির জন্য আপনারা। আরও সক্রিয়ভাবে এগিয়ে আসুন এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের। প্রিয় নেতাকে তাদের মধ্যে ফিরিয়ে দিতে সাহায্য করুন। সে সঙ্গে সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে আমি। স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের তরফ থেকে আবেদন। জানাই অবিলম্বে বাংলাদেশে বৃক্তপাত বন্ধ করার জন্য সক্রিয় ব্যবস্থা গ্রহণ করুন। শেখ মুজিবকে বিনা শর্তে মুক্তি, বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার। বাহিনী প্রত্যাহার এবং এই যুদ্ধে। ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করুন অন্যথায় আমাদের মুক্তি বাহিনী দুর্বার গতিতে হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করে দেশকে মুক্ত করবেই। সে ক্ষেত্রে ভয়াবহ ধরণের রক্তপাতের মধ্য দিয়েই তা বাস্তবে পরিণত হবে। কেননা । স্বাধীনতা, শান্তি ও গণতন্ত্রের লড়াই-এ আমরা সবাই প্রতিজ্ঞাবদ্ধ। হয়েছি। । আমাদের জয় সুনিশ্চিত। বিশ্বের চোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানানোর সঙ্গে সঙ্গে আমি দেশবাসী ভাইদের জানাতে চাই যে আমরা শান্তিপূর্ণ সমঝােতার মাঝ দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষার ব্যাপারে জাতিসঙ্ঘের সাধারণ বৈঠক উপলক্ষ্যে বিভিন্ন দেশ থেকে আগত প্রতিনিধিদের গুরুত্ব বোঝাবার জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালিয়েছি। বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরীর নেতৃত্বে একটি শক্তিশালী প্রতিনিধিদল আমার সরকারের পক্ষ থেকে নিউইয়র্কে জাতিসঙ্ঘের সদর দফতরে গিয়ে হাজির হয়েছেন। আমি আশা করি বিশ্বের বিভিন্ন দেশ পরিস্থিতির গুরুত্ব উপলব্ধি করবেন এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার শান্তির প্রয়োজনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি দিয়ে একটা শান্তিপূর্ণ মীমাংসায় পেীছবার জন্য প্রচেষ্টা চালাবেন। সার্বিক লড়াইয়ের জন্য প্রস্তুত বন্ধুরা আমার, জাতিসঙ্ঘে শান্তিপূর্ণ উপায়ে স্বাধীনতার জন্য প্রচেষ্টা চালানোর সঙ্গে সঙ্গে আমরা সার্বিক ‘লড়াই-এর জন্য প্রস্তুত। আমাদের শক্তি এখন দিন দিনই বেড়ে চলেছে। দেশবাসী ভাই-বোনেরা, আপনারা মনে রাখবেন বিশ্বের ইতিহাসে মুক্তি যুদ্ধ কখনো বিফলে যায়নি। উপনিবেশবাদ,সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আলজেরিয়ার বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে সাইপ্রাসের বীর জনতা সফলকাম হয়েছে। জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে ভিয়েৎনামীরা সফলকাম হয়েছে। এই সফলতার জন্য আজ চাই সকল শ্রেণীর মানুষের মধ্যে ঐক্য । বাংলাদেশের এই জাতীয় মুক্তি সংগ্রামে আজ প্রতিপক্ষ হচ্ছে ইয়াহিয়ার বর্বর ফ্যাসিষ্ট সরকার আর তার বিরুদ্ধে আমরা লড়ছি সারা বাঙ্গালী জাতি। তাই বন্ধুরা এবং ভাইয়েরা—দল, মত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে আমি সমস্ত বাঙ্গালী জাতির কাছে আবেদন জানাই আপনারা ঐক্যবদ্ধ হউন, কঠিন সংগ্রামের শপথ নিন। আমাদের বীর মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে হানাদার, ফ্যাসিষ্ট, সাম্রাজ্যবাদী ইয়াহিয়া। সরকারকে নস্যাৎ করে দেওয়ার। জন্য দুর্বার গতিতে এগিয়ে যান। শত্রু সেনাকে নির্মুল করতে বন্ধুরা আমার, বীর মুক্তি সেনানী ভায়েরা আমার, তোমাদের স্মরণ রাখতে হবে এই মুক্তি যুদ্ধে হয় আমরা জয়লাভ করবে, নয় জাতি হিসেবে ( নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবে। এর মধ্যে মধ্যবর্তী কোন অবস্থা নেই। যে বর্বর সেনাদল আমাদের মাবোনদের ইজ্জত নষ্ট করেছে, যে বর্বর হানাদার বাহিনী আজও আমার দেশের শত শত মা-বোনকে বিভিন্ন ক্যান্টনমেন্টে আটকে রেখে তাদের উপর পাশবিক অত্যাচার চালাচ্ছে সেই নির্মম সেনাবাহিনীকে সমূলে উৎখাত না করা। পর্যন্ত, আমাদের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষা না করা পর্যন্ত। আমাদের কোন প্রকার বিশ্রাম থাকতে পারে না। আপোষ নেই। বাংলার সংগ্রামী কৃষক ভায়েরা—আপনাদেরকে আমি স্মরণ করিয়ে দিতে চাই আপনাদের মেহনতের ফলে ২৩ বছর পর্যন্ত পশ্চিম পাকিস্তানী লুটেরারা শোষণ করে নিয়েছে। আর আপনারা অসহ্য দুঃখের মধ্যে জীবন যাপন করেছেন। হানাদার বাহিনী বাংলার গ্রামে গ্রামে হানা দিয়ে আজকে আপনাদের ঘরবাড়ী ধূলিস্যাৎ করে দিয়েছে। আপনাদেরকে তারা শেয়াল কুকুরের মতো হত্যা করেছে। এমনকি আমি নিজে জানি, অনেক পরহেজগার মুসলমান। যাদেরকে সেনাবাহিনী হত্যা করেছে তাদেরকে দাফন-কাফন পর্যন্ত করতে দেয় নাই। অনেক ধর্মপ্রাণ হিন্দুকে শ্মশানের চিতায় শুইয়ে তার অভীষ্ট লক্ষ্যে পেীছাবারও সুযোগ দেয় নাই। বাংলার কৃষক জনতা, এই বর্বর বাহিনীর সঙ্গে আমাদের কোন আপোষ হতে পারে না। মেহনতী মানুষের শত্রুদের আঘাত হাননা বাংলার শ্রমিক ভাইয়েরা, তোমাদের মেহনতের সব ফসল বাইশ পরিবার লুটে খেয়েছে। সেই বাইশ পরিবারের অর্থনৈতিক শশাষণকে চুরমার করে স্বাধীন বাংলার বুকে এক সমাজতান্ত্রিক অর্থনীতি প্রবর্তন করার জন্য, আমি এবং সরকারের প্রতিনিধিরা। কুকুরের ঘেউ ঘেউ কমছে। সম্প্রতি জেনারেল ইয়াহিয়া ফরাসী পত্রিকা লে মণ্ডের সংবাদদাতার সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, দেশবাসী যদি চায়, তাহলে তিনি শেখ মুজিবকে ক্ষমা করে দিতে পারেন। তবে সামরিক ট্রাইবুনাল তাকে নির্দোষ ঘোষণা না করা পর্যন্ত । তিনি শেখ সাহেবের সঙ্গে আলোচনায় বসতে পারেন না। আমরা লড়ে চলেছি। তাই বাংলার মহান শ্রমিকেরা, তোমাদের কাছে আমি আহ্বান জানাই তোমাদের মেহনতের ফসলকে যারা শোষণ করেছে। সেই বাইশ পরিবারের স্বার্থ রক্ষায় যে সেনাবাহিনী আজ তোমাদের উপর আঘাত হেনেছে তাদের প্রতি প্রতিঘাত হানার জন্য মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে ‘তোমরা শরীক হও, দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাও। বাংলার মধ্যবিত্ত বুদ্ধিজীবীরা, বাইশ তেইশ বছর পর্যন্ত বাঙ্গালী সংস্কৃতি বিকাশের পথে যে পশ্চিম পাকিস্তানী কুচক্রীরা একটার পর একটা ষড়যন্ত্র করে চলেছে সে ষড়যন্ত্রকে ব্যর্থ করে। দিয়ে বাঙ্গালী সংস্কৃতির পূর্ণ বিকাশের জন্যেই আজকে স্বাধীনতার সংগ্রামে আমরা লিপ্ত হয়েছি। এই বাংলার অধ্যাপক, বাংলার শিক্ষক, বাংলার সঙ্গীত শিল্পী, বাংলার নাট্য-শিল্পী,বাংলার সাংবাদিক সহ সকল শ্রেণীর বুদ্ধিজীবীদের কাছে আমি আকুল আবেদন জানাই এই সংগ্রামে আপনাদের লেখনী, আপনাদের প্রতিভা, আপনাদের চিন্তাধারা আজকে মুক্তি সেনানীদের বিপুল-বিজয়কে এগিয়ে নিয়ে যাক। আপনারা পিছনে পড়ে থাকবেন না, কারণ আগামী। দিনের ইতিহাসে আপনাদের। নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাক এই আমরা চাই ।
সংগ্রামী ছাত্র সমাজ বাংলার ছাত্ররা, ২৩ বৎসর পর্যন্ত তোমরা সংগ্রামের পুরোভাগে ছিলে। সালাম, বরকত, রফিক যেদিন বুকের তাজা রক্ত ঢেলে দিলো সেদিন থেকে বারবার বাংলার সংগ্রামী ছাত্ররা তোমরা অন্যায়ের বিরুদ্ধে, অবিচারের বিরুদ্ধে, শোষণের বিরুদ্ধে। মাথা তুলে দাঁড়িয়েছ। ৬২ সালের আন্দোলন, ৬৯ সালের মহান আন্দোলনে তোমরা ছিলে। অগ্র-সেনানী। আমি জানি। আজকের এই মহান মুক্তি যুদ্ধে তোমরা সংগ্রামের পুরোভাগে। আমি জানি আজকে তোমরা বিশ্ববিদ্যালয়ের চত্বর ছেড়েছ, স্কুল ছেড়েছ, কলেজ ছেড়েছ ; বাপমায়ের স্নেহের কোল ছেড়ে আজকে বাংলার পথে-প্রান্তরে তোমরা মুক্তি সেনানীদের অগ্রভাগে লড়াই করে চলেছ। তোমাদেরকে আমার অসীম ভালবাসা ও সঙ্গে সঙ্গে আমার। সশ্রদ্ধ অভিনন্দন জানাই। বাংলার ছাত্র-যুবকেরা! যে। স্বাধীনতার লড়াই আজ চলেছে। সে স্বাধীনতার লড়াই সফল হলে। ভবিষ্যতে স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ হবে—সে বাংলাতেই তোমরা স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসাবে মাথা তুলে দাড়াতে পারবে। মানুষের মতো বাঁচতে পারবে। অন্যথায় তোমা দের গোলাম হয়ে গোলামীর জীবন যাপন করতে হবে। তরুণ ভাই-বোনেরা, ভবিষ্যৎ তোমাদের। আমাদের দিন গত প্রায়। আমরা যারা আজ বয়সে প্রবীন হয়ে গেছি আমরা জানি জীবনের মাত্র অবশিষ্ট কয়েকটি দিন আমাদের বাকী আছে। তোমাদের ভবিষ্যতের জন্যেই আজকে জীবনের সুখ-সম্পদ ছেড়ে আমরা গৃহহারা, সর্বহারা হয়ে আজকে পথে-প্রান্তরে ঘুরে বেড়াচ্ছি। ঐতিহাসিক দায়িত্ব ভাই,বন্ধুরা-সংগ্রামী ছাত্ররা, যুবকেরা, আজকে তোমাদের মধ্যে আর আমাদের মধ্যে কোন তফাৎ নেই। আমি তোমাদের কাছে আকুল আবেদন জানাবো, ইতিহাসের এই যুগ সন্ধিক্ষণে আজকে যে ঐতিহাসিক দায়িত্ব তোমরা মাথায় তুলে নিয়েছ সে। দায়িত্বকে পালন করার জন্য তোমরা দীপ্ত গতিতে এগিয়ে যাও। ইনশআল্লাহ তোমাদের প্রতি আল্লাহ সহায় আছে। জয়লাভ তোমরা করতে পারবে। বাংলার মা-বোন সর্বশেষে আমি বাং লা র মা-বোনদের উদ্দেশ্যে দু’টি কথা বলতে চাই। বাংলাদেশের মা-বোনেরা, বহু অশ্রু আপনাদের চোখ গড়িয়ে পড়ছে আমি জানি। আমি জানি আপনার বোনরা, যখন বেইজ্জতি হয়েছে আপনার সামনে কি মর্মন্তুদ মর্মবেদনায় আপনার বুক জ্বালা করেছে। কি অসহনীয় অপমানে আপনি ঘরের ভেতর এবং বাইরে ঘুরেছেন। আপনার সন্তানদেরকে আপনি রণক্ষেত্রে পাঠিয়েছেন, আপনাদের বুক আপনারা খালি করেছেন। কিন্তু মা-বোনেরা, বীর সন্তানের মা হওয়ার যে সৌভাগ্য সে সৌভাগ্যের অধি কারী আপনারা হয়েছেন। আপনার যে সন্তান আজকে বাংলার পথে-প্রান্তরে লড়াই করে চলেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষকে মুক্তি দেওয়ার জন্য আজ যারা বুকের তপ্ত রক্ত ঢেলে দিচ্ছে মা-বোনেরা মনে রাখবেন এরা সারা বাঙ্গালী জাতির সন্তান। আমি আপনাদের কাছে সবিনয়ে আবেদন করবো, আপনারা এদের জন্য গর্ব অনুভব করুন । স্বাধীন বাংলাদেশের ইতিহাসে তাদের সঙ্গে সঙ্গে আপনাদের নামও স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে। অন্ধকার রজনী অবসান প্রায় বাংলাদেশের নিপীড়িত, নির্যাতিত মানুষেরা—আপনা- দের দুঃখ, আপনাদের কষ্ট, আপনাদের আজকের ত্যাগ ও তিতীক্ষা শুধু শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করলেই ভুল করা হবে। আমরা আপনাদের এখন পর্যন্ত কোন স্বস্তি,কোন শান্তি দিতে পারিনি। সে অপরাধ যদি আমাদের হয়ে থাকে, সে অপরাধে আমরা অপরাধী। সে বিচার আপনারা করবেন। কিন্তু বাংলার মানুষেরা আপনাদেরকে আমি আমার সরকারের তরফ থেকে আশ্বাস দিতে পারি আপনাদের চোখে মুখে হাসি ফুটাবার জন্য, আপনাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎকে সুখী করার জন্যে আমরাও সারা বাঙ্গালী জাতির সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়ে চলেছি। বাংলাদেশের ভাই-বোনেরা, ন্যায়ের সংগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হয় নাই। বাংলাদেশের মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রাম কোনদিন ব্যর্থ হবে না। আঁধার রজনীর বিভীষিকা আমরা পার হয়ে এসেছি। বন্ধুরা আমার যে বিভীষিকাময় রাত্রির ওপারে আজকে নতুন সূর্য উদয় হচ্ছে, সে নতুন সূর্যালোকে যেদিন সারা বাংলার প্রান্তর উদ্ভাষিত হবে সেদিন আমি বিশ্বাস করি সেদিন বাঙ্গালী জাতি মাথা তুলে দাড়াবে। আর পৃথিবীর যেখানে যারা আজো বাঙ্গালী জাতির বৃহত্তর ত্যাগ সম্পর্কে কোন সন্দেহ পোষণ করেন সেদিন তাদের মোহমুক্তি ঘটবেই ঘটবে। সমস্ত দেশবাসীর জন্য আমি আমার তরফ থেকে, সরকারের তরফ থেকে আবার জানাই ভালবাসা, শ্রদ্ধা আর সালাম। ইনশআল্লাহ জয় আমাদের হবেই।
জয় বাংলা।
পাতা-৬
জঙ্গিশাহীর মুখে লাথি
বিভিন্ন পাকিস্তানী দূতাবাসে কর্মরত বাঙ্গালী কূটনীতিক ও দূতাবাস কর্মীগণ একে একে জঙ্গী সরকারের মুখে লাথি মেরে বাংলাদেশের ‘বৈধ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করে চলেছেন। জঙ্গী সরকার নানা রকম নিবর্তনমূলক ব্যবস্থা। গ্রহণ করেও সুবিধা করে উঠতে পারেনি। পাসপোর্ট আটক, মিশনের অভ্যন্তরে নজরবন্দী করে রাখা, বদলির হয়রাণী থেকে শুরু করে দৈহিক নির্যাতন নরপশুরা কিছুই বাদ রাখেনি। মানবতার ইতিহাসকে যারা কলঙ্কিত করতে পারে কূটনীতির আদব কায়দাকে তারা যে সম্মান দেখাবে না এ সম্পর্কে কোন মোহ বাঙ্গালী কর্মীদের অন্ততঃ নেই। যারা জল্লাদ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রত্যাহার করেছেন। কী কূটনীতিক কী সাধারণ কর্মী। তাদের বিবৃতির ভাষা এমনকি ধিক্কার জানানোর বিশেষণটি পর্যন্ত প্রায় একই রকমের। স্বাধীনতা সংগ্রামে একাত্মতার কথা ঘোষণায় তারা সকলেই সোচ্চার।
নেপালে নিযুক্ত পাকিস্তানী দূতাবাসের ২য় প্রধান ৩০ বছর বয়স্ক বাঙ্গালী কূটনীতিক জনাব মুস্তাফিজুর রহমান পাকিস্তানের স্বৈরাচারী সরকারের সঙ্গে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করার কথা ঘোষণা। করে এবং বাংলাদেশের বৈধ সরকারের প্রতি তার পূর্ণ আনুগত্য প্রকাশ করে বলেন, “আমি এমন এক সরকারের সঙ্গে যুক্ত থাকতে পারছি না যে-সরকার গোটা বাঙ্গালী জাতির সামগ্রিক বা আংশিক ধ্বংসের উদ্দেশ্যে আমার আপন মানুষদের অধিকার, জীবন, স্বাতন্ত্র্য, ধর্মীয় ও চিন্তার স্বাধীনতা এবং সমস্ত রকম মৌলিক অধিকার নির্মমভাবে পদদলিত করে চলেছে। কাঠমুণ্ডুর নিজস্ব বাসভবনে জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে। জনাব রহমান ৩রা অক্টোবর যে অভিযোগ করেন তারই পুনরা বৃত্তি ঘটেছে দিলীতে, ৪ঠা অক্টোবরে। পাক-দূতাবাসের মন্ত্রী পর্যায়ের উপদেষ্টা ও চ্যান্সারীর প্রধান জনাব হুমায়ুন রসীদ চৌধুরী বলেন, একটি প্রাচীন জাতিকে ধ্বংস করার উদ্দেশ্যে গণহত্যায় লিপ্ত ইয়াহিয়া খান লক্ষ লক্ষ মানুষকে হত্যা করেছে।’ জনাব চৌধুরী আরও বলেন, ‘পাকিস্তান ধ্বংসের জন্য ইতিহাস ইয়াহিয়া খানকেই দায়ী করবে শেখ মুজিবুর রহমানকে নয়। শুধু পাকিস্তানের বিরুদ্ধে নয়,মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্য অপরাধ করার জন্য ইয়াহিয়া খানের বিচার হওয়া উচিত। ৪৩ বছর বয়স্ক কুটনীতিক জনাব চৌধুরী ১৯৫৩ সালে। পাকিস্তান ফরেণ সার্ভিসে যোগ দেন। তিনি রোম, বাগদাদ, লিসবন ও জাকার্তায় পাক মিশনে কাজ করেন। শুধু কূটনীতিকই নন তাদের পরিবারের লোকেরাও বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে তাদের ভূমিকা পালনে আজ ব্যর্থ। জনাব চৌধুরী বলেন যে, বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশের সিদ্ধান্ত নেওয়ার ব্যাপারে তার পরিবারের লোকেরা তাকে। বিশেষ সহায়তা করেন। জনাব চৌধুরীর সহকর্মী পাক হাই কমিশনের পার্সোনাল এ্যাসিস্ট্যান্ট জনাব ফরিদ আহমদ নাটকীয়ভাবে কমিশন ভবনের দেয়াল টপকে স্ত্রী ও ৪ সন্তান সহ ট্যাক্সী করে বাংলাদেশ মিশনে। পৌছেই বাংলাদেশের প্রতি তার আনুগত্য প্রকাশ করেন। সাংবাদিকদের তিনি আবেগময় ভাষায় বলেন, হাই কমিশনের পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মীরা। বাঙ্গালী কর্মীদের উপর উৎপীড়ন। চালাচ্ছে।’ তিনি অভিযোগ করেন যে তাকে হাই কমিশনার সাজ্জাদ হোসেন এবং প্রেস উপদেষ্টা এম, আই, বাট মারধর করে এবং বলে “বাঙ্গালী বিশ্বাসঘাতক, হাই কমিশন থেকে বেরিয়ে যাও। তিনি বলেন, আমাদের আরও মারধর করা হবে এই আশঙ্কায় আমরা তাড়াতাড়ি সেখান থেকে পালিয়ে আসি। হাই কমিশনের ভিতরে আমাদের জীবন অসহনীয় হয়ে ওঠে। প্রতিদিনই অপমানিত হতে হয়।’ এর মাত্র কিছুদিন পূর্বে ভারত পাকিস্তানী দূতাবাসের ৪ জন বাঙালী কর্মী পরিবার পরি[ জন সহ নাটকীয়ভাবে বাংলাদেশ মিশনে আশ্রয় নেন এবং বাংলাদেশের প্রতি তাদের আনুগত্য ঘোষণা করেন। লণ্ডনস্থ বাংলাদেশ মিশনে আরও ৩ জন বাঙালী কূটনীতিক পাকিস্তানীজঙ্গীশাহীকে ধিক্কার জানিয়ে তাদের আনুগত্য প্রত্যাহার করেন এবং বাংলাদেশের বৈধ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেন। নিক্সন সরকার কি করেন ? মার্কিন সংবাদ সরবরাহ সংস্থা এসোসিয়েটেড প্রেস খবর দিয়েছেন যে, মার্কিন সিনেটের বৈদেশিক সংক্রান্ত কমিটি পাকিস্তানকে মার্কিন সাহায্যদান স্থগিতের একটি প্রস্তাব অনুমোদন করেছে। গৃহীত প্রস্তাবে বলা হয়েছে যে, যতদিন না পাকিস্তান সরকার পূর্ব বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে সহযোগিতা এবং ভারত থেকে শরণার্থীদের দেশে ফিরে যেতে অনুমতি দিচ্ছে তত দিন পর্যন্ত মার্কিন আর্থিক, সামরিক এবং সামরিক যন্ত্রাংশ ও কৃষি পণ্য সহ সর্ববিধ সাহায্য দান স্থগিত রাখা হবে। উল্লেখিত সর্তাদি পূরণ হয়েছে বলে প্রেসিডেন্ট নিক্সনের সাটিফিকেট দানের পরেই সাহায্য দান পুনরায় আরম্ভ করা হবে।
অন্ধকারের অতলে ঢাকা শহর
মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা দখলীকৃত ঢাকা শহরে আরো ব্যাপক ও জোরদার আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গেরিলা যোদ্ধারা সম্প্রতি চাকা শহরের চার পাশের বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোতে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে সারা শহর গভীর অন্ধকারের ভিতর ডুবিয়ে দিয়ে হানাদার সৈন্যদের বিব্রত করে ফেলেন। এ আক্রমণে একটি বৈদ্যুতিক সাবট্রান্সমিশন সেন্টার বিধ্বস্ত করেন এবং একটি গ্যাস লাইন উড়িয়ে দিয়ে সিদ্ধেশ্বরী ও ঘোরাশালের মধ্যে সরবরাহকারী লাইন বিপর্যস্ত করেছেন। এ ছাড়াও ঢাকার সন্নিকটে কাঞ্চনে অবস্থিত একটি পাটকলের বৈদ্যুতিক সাব-স্টেশন ধ্বংস করে দিয়েছেন।
মুক্ত এলাকায় শবে বরাত
বাংলাদেশের মুক্ত এবং অধিকৃত এলাকায় যথাযোগ্য। মর্যাদার সাথে পবিত্র শবে বরাত উদযাপিত হয়েছে। হানাদার দস্যুদের খতম করে বাংলাদেশকে শত্রু মুক্ত এবং বাঙ্গালী জাতির মহা জাগৃতির প্রতীক শেখ মুজিবর রহমানের কারা মুক্তির জন্য দোয়া করা হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম শবে বরাত উপলক্ষে বিশ্বের মুসলমান দের প্রতি বাংলাদেশ সরকার ও বাংলাদেশের জনগণের শুভেচ্ছা জ্ঞাপন করেন। অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান বিশ্বের মুসলমানদের কাছে বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা, সত্য ও ন্যায়ের সংগ্রামের প্রতি সমর্থন দানের আবেদন জানিয়েছেন। শবে বরাত উপলক্ষে বাংলা দেশ সরকারের সদর দফতরে এক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়। বাংলাদেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন সহ বাংলাদেশের বহু বিশিষ্ট নেতা এতে যোগদান করেন। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে যে, অধিকৃত এলাকার জনসাধারণও পবিত্র শবে বরাতের রাতে মাতৃ ভূমির সার্বিক মুক্তির জন্য বিশেষ মোনাজাত করেন। এতদুপলক্ষে মুজিবনগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের অফিসেও এক মিলাদ মহফিলের আয়োজন করা হয়।
বিমান কর্মচারীদের
সভা
পি, আই, এর প্রাক্তন কর্মচারীদের মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত এক সভায় বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক বিমান সংস্থা চালুর সম্ভাব্যতা এবং সংশ্লিষ্ট বিষয় সম্পর্কে গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণ করা হয়।সাবেক পি, আই, এ, কর্মচারীদের বিভিন্ন এসোসিয়েশন ও ইউনিয়নের প্রতিনিধিরা সভায় অংশ গ্রহণ করেন। সভায় পি, আই, এর প্রাক্তন সিকিউরিটি অফিসার জনাব এস, এ, হোসেন সভাপতিত্ব করেন। সভায় পি,আই, এর প্রাক্তন বাঙ্গালী কর্মচারীদের পূর্ণাঙ্গ তালিকা প্রস্তুতের জন্য জনাব এস,এ,হোসেন, ২২।৩ ব্রাইট স্ট্রিট, পার্ক সার্কাস, কলিকাতা-১৭ এই ঠিকানায় নাম ও চাকুরীর বিবরণ পাঠাতে অনুরোধ করা হয়েছে।
পাতা-৭
ইয়াহিয়ার ভাষণ না পাগলের প্রলাপ
- মতিন আহমদ চৌধুরী
দুরাশা হলেও অনেকেই আশা। করেছিলেন যে তথাকথিত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল। আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান তার ১৩ই অক্টোবরের বহু ঘোষিত বেতার ভাষণে কিছু নতুন বা ভাল কথা শোনাবেন। কিন্তু তিনি তা মোনান নি। তিনি ঔপনিবেশিক শাসকদের ঐতিহ্য এবং শোষকদের চরিত্র অক্ষু। রেখে মূল সমস্যার ধারে কাছেও না এসে শক্তির বাহাদুরী দেখাবার প্রয়াস পেয়েছেন। কিন্তু ইয়াহিয়া সাহেব ভুলে গেছেন। যে তিনি পরলোকগত বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী মিঃ উইনষ্টোন। চাচিলের চেয়ে প্রতিভাবান বা শক্তিশালী ব্যক্তি নন। অথবা তার সেনাবাহিনীর শক্তিও তৎকালীন বৃটিশ জাতির সামরিক শক্তির চেয়ে বেশী নয়। মিঃ উইনস্টোন চার্চিলও এক সময় সদম্ভে ঘোষণা করেছিলেন যে তিনি বৃটিশ সাম্রাজ্য লাটে তোলার জন্য বৃটিশ প্রধান মন্ত্রীর গদিতে আসীন হননি। কিন্তু নিজের জীবদ্দশাতেই মিঃ চার্চিল দেখে গিয়েছেন যে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য। লাটে উঠছে এবং ভারত স্বাধীন হয়েছে। তাই জনাব ইয়াহিয়া। খানও বেঁচে থাকলে ( অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানের ক্ষমতা। পাগল জেনারেলদের কৃ বা পাল্টা ক’তে অকালে প্রাণ না হারালে) দেখতে পারবেন যে তার সামরিক শক্তি বাংলাদেশকে তাদের কলোনী করে রাখতে পারে নি এবং তাদের সাধের পাকিস্তান যে ২৫শে মার্চ রাতে পরলোকগত হয়েছে তাকে আর পুনজীবন দান করতে পারে নি।ভদ্র লোকের কাছ থেকেই মানুষ ভদ্র কথা আশা করতে পারে এবং যুক্তিবাদী লোকের কাছ থেকেই মানুষ যুক্তির কথা আশা করতে পারে। কিন্তু যারা সংখ্যালঘু হয়েও শুধুমাত্র চক্রান্ত, ষড়যন্ত্র ও গায়ের জোরে দীর্ঘ ২৫ বছর একটা দেশকে শাসন ও শোষণ করেছে, নির্ভেজাল বাজার। হিসাবে ব্যবহার করেছে তাদের কাছ থেকে ত আর যুক্তির কথা আশা করা যায় না। জেনারেল য়াহিয়া খান তার ৪০ মিনিট স্থায়ী বক্তৃতায় ত্রিশ মিনিট ব্যয় করেছেন বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধ হিসাবে প্রতিপন্ন করার কাজে। তিনি ভারতের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ প্রচারের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন। কিন্তু কাদের বিভ্রান্ত করার জন্য তার এই অপপ্রয়াস? যদি পশ্চিম পাকিস্তানীদের ভারত-বিদ্বেষের মদিরায় বিভোর করে রাখাই তার এই প্রাণান্তকর প্রয়াসের উদ্দেশ্য হয়ে থাকে তবে তিনি ঠকই করেছেন। তবে এ প্রসঙ্গে তার মনে রাখা উচিত ছিল তারই প্রভু ফিল্ড মার্শাল আইয়বের পতনের কাহিনী। ১৯৬৫ সালে ভারতের সাথে যুদ্ধের সময়ে ও তৎপূর্বে আইয়ুর সাহেব পশ্চিম পাকিস্তান ভারত-বিদ্বেষ প্রচার করে যে পরিস্থিতির সৃষ্টি করেছিলেন পরবর্তীকালে তাকেই তার শিকার হতে হয়েছিল। হাজার বছর যুদ্ধ করার নামে যে ভুট্টো সাহেব তাকে উদ্ধানী দিয়ে ভারতের বিরুদ্ধে দুঃসাহসিক অভিযান শুরু করতে উদ্ধ করে ছিলেন ‘তাসখন্দ চুক্তির পর সেই ভূট্টোই আইয়ুব খানের বিরুদ্ধে তারই সৃষ্ট জনমতকে কাজে লাগিয়েছিলেন। বর্তমানেও যারা আইয়ুবের এককালীন বরকন্দাজ ইয়াহিয়া খানকে ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নামার জন্য। উস্কানী দিচ্ছেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষের মনকে ভারত-বিদ্বেষে বিষিয়ে তুলতে উদ্ধ করছেন ২৪ দিনের যুদ্ধের পর যখন ইয়াহিয়া সাহেব লেজ গুটিয়ে তাসখন্দের ন্যায় আরেকটা চুক্তিতে সই করতে বাধ্য হবেন। তখন আবার তারাই পশ্চিম পাকিস্তানের বিষিয়ে তোল জনমতকে ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে কাজে লাগাবেন। পক্ষান্তরে জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে বাংলার মানুষের মনে ধর্মের নামে কোন রকমে রেখাপাত। করা তাহলে তিনি ভুল করেছেন। কেননা, বাংলার মুসলমানরা গত ২৪২৫ বছর ধরে একই রাষ্ট্রে বসবাসের মাধ্যমে বুঝতে পেরেছে ইয়াহিয়া খানদের আসল ধর্ম কি। শাসন, শোষণ, অত্যাচার – ও নিপীড়নই যে ওদের একমাত্র ধর্ম বাংলার মানুষ তা হাড়ে হাড়ে অনুভব করতে শিখেছে আর জেনারেল ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য যদি হয়ে থাকে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্ত করা হলেও বলতে হবে তিনি পশুভ্রম করে ছেন মাত্র। কেননা, সমগ্র বিশ্বের বিবেকবান মানুষ আজ জেনে ফেলেছে ইয়াহিয়া-টিজাদের গণতান্ত্রিক অধিকার হরণের কাহিনী, রাতের অন্ধকারে লাখোলাখোনিরীহ বাংগালীকে হত্যার লোমহর্ষক কাহিনী। আরো জেনে ফেলেছে লাখোলাখোমা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার পৈশাচিক কাণ্ড কারখানার কাহিনী। দু’চারজন রাষ্ট্র নায়ক আজো হয়ত বাংলাদেশ প্রশ্নে দানাই পানাই করে চলেছেন, গোপনে গোপনে হয়ত ইয়াহিয়াকে উদ্ধানীও দিয়ে চলেছেন। কিন্তু তারাই ঐ সব দেশের সব কিছু নন্। তাদের স্ব স্ব দেশের সর্বস্ত বিবেকবান মানুষই আমাদের সাথে আছেন ও থাকবেন। ভিয়েৎনাম প্রশ্নে জনসনকে যেভাবে অসম্মানজনক পন্থায় হোয়াট হাউজ ত্যাগ করে টেঝাসের খামার বাড়ীতে গিয়ে আশ্রয় নিতে হয়েছে অদূর ভবিষ্যতেই সেভাবে বাংলাদেশ প্রশ্নে অনেক রথী মহারথীকে সেই একই মহাজনী পন্থায় আশ্রয় নিতে হবে। সুতরাং বাংলাদেশ প্রশ্নে ভারতকে জড়াতে গিয়ে ইয়াহিয়া চক্রের কোন লাভই হবে না। ভারত অবশ্য বাংলাদেশে সৃষ্ট সংকটের ফলে একটা ব্যাপারে। জড়িত হয়ে পড়েছে এবং জেনারেল ইয়াহিয়া খানরাই তা করেছেন। ইয়াহিয়া খানরাই মেরে ধরে বাংলাদেশ থেকে ৯০ লাখের বেশী হিন্দু-মুসলমানকে ভারতে তাড়িয়ে দিয়েছেন। ভারত মানবতার খাতিরে তাদেরকে আশ্রয় দিয়েছেন, তাদের ভরণ-পোষণের এক বিরাট দায়িত্ব বহন করেছেন। ভারত এতদ্বারা কোন। অন্যায় করেনি। তবে ভারত চিরকালের জন্য এদেরকে ‘ ঘাড়ের উপরও রাখতে পারে না, তাদেরকে স্বদেশে ফেরৎ পাঠাতেই হবে। কিন্তু নিজেদের জান-মালের নিরাপত্তা ও মানবিক অধিকারের নিশ্চয়তা ছাড়া তারা ফেরৎ যাবে না-যেতে পারে না। সুতরাং বাংলাদেশে তাদের ফিরে আসার মত পরিবেশ ও আস্থা সৃষ্টি করার দায়িত্ব জেনারেল ইয়াহিয়া খানদেরই। ভারতের তাতে কিছু করণীয় নাই। বরং করতে গেলে তা হবে বাংলাদেশ ও পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপের সামিল। কিন্তু কি ভাবে উপযুক্ত পরিবেশ ও অবস্থার সৃষ্টি করা যাবে তার পূর্ণাঙ্গ চিত্র স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বহু আগেই ঘোঘণা করেছেন। সেই ঘোষণা মোতাবেক ইয়াহিয়া খানরা বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে তাদের দখলদার বাহিনীকে প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দিলেই সমস্যা মিটে যায়। আর – সেই অবস্থায় ভারত থেকে শরণার্থীরাও স্বদেশে ফিরে এসে ভারতকে বিরাট দায়িত্ব থেকে মুক্ত করতে পারে। , ইয়াহিয়া খান তার ভাষণের বাদবাকী সময় নষ্ট করেছেন তথাকথিত পাকিস্তানবাসীকে একটা শাসনতন্ত্র দেওয়ার নামে । সাম্রাজ্যবাদী ও উপনিবেশবাদী দের চরিত্রই এমন। তারা ভাংগেত মচকাবে না। বাংলাদেশ। স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশের বীর তরুণেরা বুকের তাজা লহু ঢেলে দিয়ে বাংলাদেশে এলাকার পর এলাকা মুক্ত করে চলেছেন। আর ইয়া হিয়ার ভাড়াটিয়া বাহিনীর সর্বত্র শুরু হয়েছে ত্রাহি ত্রাহি ডাক। বাঙ্গালী মুক্তি বাহিনীর চুড়ান্ত মারের চোটে কবে ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের সমুদ্র পাড়ি দিতে হবে তারা আজ ক্যান্টন, মেণ্টের সুরক্ষিত গুহায় বসে তার দিন তারিখ গুণছে। আর এরই মধ্যে জল্লাদ ইয়াহিয়া “এক পাকিস্তানের নামে শাসনতন্ত্র ঘোষ ণার কথা প্রচার করছে। এটাকে পাগলের প্রলাপ ছাড়া আর কিই বা বলা যায় !পরপদ লেহন করে জেনারেলগেরি’ অর্জনকারী এককালের হাবিলদার ইয়াহিয়া সাহেবের হয়ত ইতিহাস পড়ার মত। বিদ্যাবুদ্ধির অভাব আছে। তবে সেনাবাহিনীর লোক হিসাবে তিনি অন্ততঃ অন্যের মুখে হলেও ওয়াটারলু এবং দিয়েন বিয়েন। ফু’র কথা কাহিনী শুনেছেন। সেদিন বেশী দূরে নয় যেদিন তিনি বাংলাদেশের বুকেই নিজ চোখে ওয়াটারলু ও দিয়েন বিয়েন ফু’র পুনরাবৃত্তি দেখতে পাবেন। বাংলার বীর মুক্তি যোদ্ধারা সেজন্য চূড়ান্ত প্রস্তুতি নিচ্ছেন।জেনারেল ইয়াহিয়া খানকে আমরা আশ্বাস দিতে পারি যে বাংলাদেশ সরকার ও বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ ইতিমধেই তাদের তথাকথিত উপ নির্বাচনকে চ্যালেঞ্জ হিসাবে গ্রহণ করেছে। আওয়ামী লীগের নির্বাচিত গণ-প্রতিনিধিদের ‘অযোগ্য ঘোষণা করে তারা বাংলাদেশে উপনির্বাচন করবেন ” আর বাঙ্গালী মুক্তি যোদ্ধারা। তা নির্বিকারভাবে অবলোকন করে যাবেন এমনটা আশা করা পাগলামীর পরিচায়ক। সুতরাং বাংলাদেশে উপনির্বাচনও হবে না, আর তার কোন শাসনতন্ত্রও পাশ করতে পারবে না—এ নিশ্চয়তা আমরা জেনারেল ইয়াহিয়াকে দিতে পারি । উপসংহারে জেনারেল ইয়া হিয়াকে আমরা এ প্রসঙ্গে দু’টো কথা জিজ্ঞেস করতে চাই। গত মার্চ মাসে বাংলার অবিসংবাদিত নেতা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নয়নের মনি বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান জাতীয় পরিষদ বসার – আগে গণ-প্রতিনিধিদের হাতে দেশের ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবী জানালে জেনারেল ইয়াহিয়া বলেছিলেন যে তা করার মত – কোন আইন দেশে নাই। কিন্তু আজ আমরা তাকে সবিনয়ে। জিজ্ঞেস করতে চাই যে, কোন আইন বলে তিনি নিজ হাতে শাসনতন্ত্র রচনা করে তথাকথিত জাতিকে দিচ্ছেন ? কে তাকে এই অধিকার দিয়েছে। তিনি ত একটা পরগাছা মাত্র। তার মনিব আইয়ুব খান জনগণের লাথি খেয়ে পালানোর সময় তার হাতে। ক্ষমতা তুলে দিয়ে গিয়েছিলেন। সুতরাং তার ত পশ্চিম পাকি স্তানেও একমুহুর্তে ক্ষমতার আসনে থাকার কোন আইনগত ভিত্তি নাই। সুতরাং যার নিজ দেশেই ক্ষমতায় থাকার কোন আইনগত ভিত্তি নাই তিনি কিভাবে সম্পূর্ণ স্বাধীন আলাদা একটা জাতিকে শাসনতন্ত্র দিতে পারেন ?
‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে বীর মুক্তিযোদ্ধাদের জানাই আমাদের আন্তরিক সহানুভূতি
নারায়ণগঞ্জ টানবাজারের প্রসিদ্ধ সূতা ব্যবসায়ী
শ্যামাপদ সাহার প্রতিষ্ঠান মদন মোহন ইয়ান ট্রেডিং ৩১, মদন মোহনতলা স্ট্রীট,
কলিকাতা-৫
পাতা-৮
বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতাই সমস্যার একমাত্র সমাধান
আওয়ামী লীগের ওয়াকিং কমির্টর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা ও বঙ্গবন্ধুর আশুমুক্তির ব্যবস্থা ও বাংলাদেশ
সরকারকে অবিলম্বে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি আবেদন
গত বৃহস্পতিবার মুলতবী হয়ে যাওয়ার পূর্বে পূর্ব নীতির পুনরুল্লেখ করে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে দ্ব্যর্থহীন ও স্পষ্টভাবে ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই বাংলাদেশ সমস্যার একমাত্র সমাধান। ওয়ার্কিং কমিটি এই সংগ্রাম এরান্বিত করার জন্য বলিষ্ঠ শপথ গ্রহণ করে। ওয়ার্কিং কমিটির অপর এক প্রস্তাবে বাঙ্গালী জাতির অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের আশু মুক্তির জন্য প্রত্যক্ষ কার্যকরী ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য বিশ্বের প্রতিটি রাষ্ট্র ও জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান হয়। ওয়ার্কিং কমিটি জনগণের বিপুল ভোটে নির্বাচিত আওয়ামী লীগ দলীয় সদস্যদের সদস্যপদ খারিজ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবের পূর্ণ বিবরণআগামী সপ্তাহে করে তদস্থলে ইয়াহিয়ার উপ-নির্বাচন অনুষ্ঠান প্রচেষ্টাকে ধষ্টতার পরিচায়ক এবং বিশ্ব জনমতকে বিভ্রান্ত করার অপচেষ্টা’ বলে অভিহিত করে এবং এ প্রসঙ্গে স্পষ্টভাবে ঘোষণা করে যে বাংগালী জাতি ও আওয়ামী লীগ স্বাধীন বাংলায় জাতীয় জীবনে তথাকথিত পাকিস্তানীদের কোন হস্তক্ষেপই সহ্য করবে না। ভারতসহ বিশ্বের যে সমস্ত রাষ্ট্র বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি ও স্বাধীনতাযুদ্ধের প্রতি অকুণ্ঠ সমর্থন জ্ঞাপন করছেন আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি তাদের প্রতি আন্তরিক কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির প্রস্তাবে বিশ্বের প্রতিটি মানুষ ও যে সমস্ত সংবাদপত্র প্রচার মাধ্যমে বাংলাদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামকে সমর্থন দান করেছেন তাদের প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানান হয়। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটি বাংলাদেশে ইয়াহিয়া চক্রের নজীরবিহীন গণহত্যা,নারী নির্যাতন ও ধ্বংসযজ্ঞের বিরুদ্ধে মানবতার স্বার্থে সক্রীয় জনমত গঠণের জন্য বিশ্ববাসীর প্রতি আকুল আবেদন জানান ভারত সরকার ৯০ লক্ষাধিক শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে ও তাদের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব নিয়ে। মানবতার ইতিহাসে যে নজীর। সৃষ্টি করেছেন তজ্জন্য আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন। সাথে সাথে ওয়ার্কিং কমিটি দ্ব্যর্থহীন ভাবে ঘোষণা করেন যে, জাতিধর্ম নির্বিশেষে ভারতে আশ্রিত প্রতিটি শরণার্থীকে সসম্মানে বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে আওয়ামী লীগ বদ্ধপরিকর।
যুদ্ধের দায়িত্ব পাকিস্তানের
-ইন্দিরা
ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বলেন যে, ভারত শান্তিকামী দেশ, যুদ্ধ হবে কি না, পাকিস্তানই জানে। যুদ্ধ হওয়া ৭ বা হওয়া পাকিস্তানের উপর নির্ভর করছে। ভারতের সীমান্তে পাকিস্তানী সৈন্য সমাবেশের যে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে সে সম্পর্কে তার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে তিনি সাংবাদিকদেরকে এই জবাব দেন। শ্ৰীমতী গান্ধী আরও বলেন,বেশ কিছুদিন ধরে পাকিস্তান তলোয়ার ঘুরিয়ে চলেছে। সোভিয়েট ও আলজেরিয়ার সাম্প্রতিক যুক্ত বিবৃতিতে বাংলাদেশের যে উল্লেখ রয়েছে সে সম্পর্কে কোন মন্তব্য করতে শ্ৰীমতী গান্ধী অসম্মতি প্রকাশ করেন। পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান সংক্রান্ত শরণ সিং-এর বিবৃতির প্রতি দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে শ্ৰীমতী গান্ধী বলেন যে, খুব সম্ভব পররাষ্ট্র মন্ত্রীর বক্তব্য ঠিকমত রিপোর্ট করা হয়নি। শ্রীমতী গান্ধী বলেন, সম্মানের সঙ্গে শরণার্থীদের ফিরিয়ে দিতে হবে এবং তাদের জীবনের নিরাপত্তা দিতে হবে।
লণ্ডন থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন সংবাদে প্রকাশ, সম্প্রতি ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত বৃটিশ রক্ষণশীল দলের সম্মেলনে পর্দার অন্তরাল থেকে বৃটিশ সরকারের উপর বাংলাদেশের ঘটনাবলীর ব্যাপারে একটা চুড়ান্ত নীতি নির্ধারণী কর্মপন্থা গ্রহণের জন্য জোর চাপ পড়েছে। তার মধ্যে একটা প্রস্তাব ছিল বৃটিশ সরকারের একজন সিনিয়র মন্ত্রীকে পাকিস্তানে পূর্ব ও পশ্চিম উভয় অংশে—প্রেরণ করে সরেজমিনে তথ্যানুসন্ধান করা। তবে বৃটিশের রক্ষণশীল সরকার শেষ পর্যন্ত কি নীতি গ্রহণ করবেন তা বুঝা যায়নি। এদিকে ইয়াহিয়া সরকার। নিজেদের লোকজনদের দিয়ে খবর প্রচার করে বৃটিশবাসীকে এ ধারণাই দেওয়ার চেষ্টা করছিলো যে অসামরিক কতৃপক্ষের হাতে তাদের ক্ষমতা হস্তান্তরের কাজ সন্তোষজনকভাবেই এগিয়ে চলেছে। কিন্তু ডেইলি টেলিগ্রাফ তাদের হাটে হাঁড়ি ভেঙ্গে দিয়ে বলেছেন যে আসলে ব্যাপারটা সম্পূর্ণ ভিন্ন রকম। এ খবরে প্রকাশ, এই হাটে। হাঁড়ি ভাঙ্গার ব্যাপারে বৃটেনে। বাংলাদেশের পক্ষে কার্যরত লোেকদেরও বেশ কিছু অবদান রয়েছে। বৃটিশ রক্ষণশীল দলের জনা কয়েক ছাড়া বাদবাকী প্রায় সবই ইসলামাবাদের জঙ্গী শাসকদের পক্ষে। শুধু বাংলাদেশের ব্যাপারেই নয় অন্য সব ব্যাপারেও রক্ষণশীল দল সব সময় প্রতিক্রিয়াশীলদের পক্ষে থাকে। এটা তাদের এক কথায় বলতে গেলে মাজগত। কিন্তু রক্ষণশীল দলের এই অতি রক্ষণশীলরাও এখন আর হালে পানি পাচ্ছেন না। তাই তারা বলতে চান যে, বৃটিশ সরকারের বাংলাদেশের ব্যাপারে একটা কিছু করণীয় আছে। মিসেস জুডিথ ব্যারি ত প্রকাশ্যেই বলেছেন যে গণতন্ত্র বিরোধী ইসলামাবাদ সরকারের জন্য না । হলেও অন্ততঃ ‘বাংলাদেশ ও ভারতের ব্যাপারে বৃটিশ সরকারের কিছু করণীয় আছে এবং তাদের তা করা উচিৎ। তবে তারা যাই করুক না কেন অতি তাড়াতাড়িই করতে হবে। কেননা, বিলম্বের পরিণাম বৃটিশ জাতির জন্যও ক্ষতিক্ষর হতে পারে।এই মতবাদের প্রবক্তারা নজীর তুলে বলতে চান যে নাইজেরিয়ার গৃহযুদ্ধের সময় বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলসন স্বয়ং সেদেশে গিয়েছিলেন এবং সমস্যা সমাধানে কিছু করা যায় কিনা তার চেষ্টা করেছিলেন। এমন কি একতরফাভাবে বোডেসিয়ার স্বাধীনতা ঘোষণার সময়ও বৃটিশ প্রধানমন্ত্রী উইলসন একে একে তার কমনওয়েলথ মন্ত্রীদ্বয় মিঃ আর্থার বটমলী ও জর্জ থমসনকে স্যালিসবারি পাঠিয়েছিলেন। উইলসন নিজেও প্রথমে স্যালিসৰারিতে। এবং পরে দু’দফায় ‘টাইগার’ ও ‘ফিয়ার লিস’ জাহাজে শ্মীথের সাথে দেখা করেছিলেন।তারা যুক্তি হিসাবে বলছেন যে প্রধানমন্ত্রী হীথ যদি অন্য কাজেব্যস্ততার জন্য যেতে না পারেন এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী স্যার আলেক। ডগলাস হিউম যদি মনে করে থাকেন যে তার পাক-ভারত সফরে কোন ফলোদয় হবে না, তাহলে বাংলাদেশ সমস্যার মূল কোথায় এবং কেনই বা বাঙ্গালীর পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে সরেজমিনে তা জানার জন্য প্রধানমন্ত্রীর উচিৎ অন্য কোন সিনিয়র মন্ত্রীকে উপমহাদেশে প্রেরণ করা। তবে আজকাল বৃটেনে একটা জিনিষ লক্ষ্যনীয়। সারা দেশে। একজন মানুষও আজ আর ইয়াহিয়ার কথায় বিশ্বাস করেনা। তারা আজ বুজতে পেরেছেন। যে আসলে নিজের অপকর্ম ঢাকার জন্যই ইয়াহিয়া চক্র বাংলাদেশের প্রশ্নে যত দোষ নন্দ ঘোষ অর্থাৎ ভারতের উপর চাপানোর প্রয়াস পাচ্ছে। গত ১৪ই অক্টোবর ডেইলি টেলিগ্রাফের নয়াদিল্লীস্থ প্রতিনিধি ডেভিড লোশীকের এক ডেসপ্যাচে এ বিষয়টি অত্যন্ত পরিষ্কারভাবে তুলে ধরা হয়েছে। তিনি লিখেছেন : পাকিস্তান আসলে নিজেদের মেকি যুদ্ধ প্রস্তুতি সম্পর্কে একটা ধূম্রজাল সৃষ্টির একটা ব্যর্থ প্রয়াস চালাচ্ছে। সত্যিকার যুদ্ধ প্রস্তুতি বলতে যা বুঝায় তা হয়ত তারা করছে না। তারা চাচ্ছে এমন একটা উত্তেজনাকর ভীতিপ্রদ পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে যাতে তাদের নিজেদেরই সৃষ্ট বাংলাদেশ সঙ্কটের দায় দায়িত্ব। ভারতের উপর চাপিয়ে সঙ্কটটাকে – একটা আন্তর্জাতিক রূপ দেয়া যায়।ভারত পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে চাচ্ছে বলে জেনারেল । ইয়াহিয়া খান তার বেতার ভাষণে – যে অভিযোগ করেছেন তার। উল্লেখ করে মিঃ লোশীক মন্তব্য করেছেন পাকিস্তানের সামরিক গোয়েন্দা বিভাগ নিশ্চয় অত্যন্ত ভালভাবেই জানেন যে ভারতের যুদ্ধ প্রস্তুতি আক্রমণাত্মক ধরণের কিছু নয়, এবং ইয়াহিয়া খান নিজেও একথা বলেছেন যে যুদ্ধ করতে গেলে ভারতের যে লাভ হবে তার চেয়ে লোকসানের পরিমাণই হবে বেশী। সাংবাদিক লোশীকের মতে, স্বদেশের লোকদের মনোরঞ্জনের জন্যই আসলে জেনারেল ইয়াহিয়া। ভারতের বিরুদ্ধে এসমস্ত আজগুবী অভিযোগ তুলেছেন। ইয়াহিয়ার উদ্দেশ্য হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের চরম ভারত-বিরোধী। পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং তা করতে পারলে তারা বহু আভ্যন্তরীণ সঙ্কট থেকে রেহাই পেতে পারেন।
শয়তান ইয়াহিয়া-চক্রের
নতুন খেলা
মুক্তিবাহিনীর সুপরিকল্পিত ক্রমাগত গেরিলা আক্রমণ, জনসাধারণের স্বতঃস্ফুর্ত অসহযোগিতা, খন্ধু এবং দুর্বল প্রশাসনিক ব্যবস্থা এবং সামরিক বাহিনীর বেসামাল অবস্থার মধ্যে অধিকৃত বাংলাদেশে উপনির্বাচন পরিচালনা করা সম্ভব নয়। সুতরাং সামরিক জান্তার অন্ধ সমর্থক এবং পদলেহী দালাল রাজনৈতিক দলগুলো সুপরিকল্পিতভাবে আপোষের মাধ্যমে একটি মাত্র প্রার্থীকে দাড় করিয়ে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচন নামক প্রহসনের কাজটা দ্রুত শেষ করে ফেলতে চায়। বিশ্ববিবেককে ধোকা দেওয়ার জন্য সামরিক জান্তার এ-ও একটি ফন্দী। স্বাভাবিক কারণেই এই নির্বাচনে জনসংযোগ রক্ষা করা, প্রচার কার্যচালনা বা জনমত গঠন করার কোন প্রয়োজন থাকতে পারে না এবং নেইও। স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত বাঙ্গালীর কাছে এই সর যেমন অনাবশ্যক এবং অর্থহীন ভিন্ন অর্থে হানাদার সরকার এবং দালাল রাজনৈতিক দলগুলোর কাছেও তেমনি অনাবশ্যক। নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করার পরই বাংলাদেশের বঞ্চিত মানুষের বেদনায় ভূট্টো ভীষণ ভাবে বিচলিত হয়ে পড়েছেন। তাহরিখ-ই-ইন্তেকলাল পাটির চেয়ারম্যান, বিশুদ্ধ গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল এয়ার মার্শাল। আসগর খানও ঢাকায় এসে। বেফাস দু’এক কথা বলে ফেলেছিলেন। তাহরিখ-ই-ইন্তেকলাল পাটির প্রধানের কাছে যে-বিশ্বাস ঘাতক গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের টিকিটের জোরে নির্বাচিত হয়েছিল তার দীক্ষা গ্রহণের সংবাদও নাকি খবরের কাগজে ছাপা হয়নি। অতএব, করাচীতে ফিরে গিয়েই আসগর খান ক্রুদ্ধ হয়ে ‘এমন দু’একটি কথা বলেছেন যাতে করে আসন্ন নির্বাচনের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে কিছু আঁচ পাওয়া যায় । গত ১১ই অক্টোবর করাচীতে তিনি বলেন যে, আগামী ডিসেম্বরে পূর্ব বাংলায় যে উপনির্বাচন হবে তাতে উক্ত পার্টি অংশ গ্রহণ করবে না। কেননা তার পাটি মনে করে না যে নির্বাচন অবাধ এবং নিরপেক্ষভাবে অনুষ্ঠিত হবে। তিনি বলেন,‘রাজনৈতিক দলগুলো ভোটারদের কাছে অপদস্থ হয়েছে। আসগর খান আরও বলেন যে, তার বিবৃতি এবং সাক্ষাৎকার পূর্ববাংলার খবরের কাগজে প্রকাশ করতে দেওয়া হয়নি। এর মানে হচ্ছে, তিনি সেখানে নির্বাচনী প্রচারে নামতে পারবেননা। এ প্রসঙ্গত উল্লেখযোগ্য যে, গণতন্ত্রের প্রতি শ্রদ্ধাশীল’ আসগর খান দীর্ঘ ছয় মাস গণতন্ত্র এবং মানবতার অপমানে একবারও মুখ খোলেন নি এবং গত নির্বাচনে তিনি অথবা তার পার্টি একটি আসনে জয়লাভ করতে পারে নি।
পাখতুর্দিস্তান প্রশ্নে জাতিসংঘে
পাকিস্তান নাজেহাল
জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পাক জঙ্গী শাহীর প্রধান প্রতিনিধি, মাহমুদ আলী বাংলাদেশ সম্পর্কে সাফাই দিতে গিয়ে যে সব আবোল তাবোেল মন্তব্য করেছিলেন তাতে আপত্তি তুলে ভারতের স্থায়ী প্রতিনিধি শ্রী সমর সেন এক ভাষণ দেন। শ্রী সেনের বক্তৃতায় জবাব দিতে গিয়ে। পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগাশাহী বলে ওঠেন ‘ঐতিহাসিক ও আইনের দৃষ্টিতে পাখতুনিস্তান। সমস্যা বলে কিছুই নেই।’পাকিস্তানের এই দাবী আফগানিস্তান জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ঘৃণাভরে, প্রত্যাখ্যান করেছেন।জাতিসংঘে আফগানিস্তানের স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব আবদুর রহমান রাজ্জাক আলোচনার শেষ দিকে পাকিস্তানের প্রতিনিধি আগাশাহীর বক্তব্যের জবাব দিচ্ছিলেন। তিনি তার জবাবে বলেছেন যে পাখতুনিস্তান সমস্যা ছিল এবং আজো আছে। পাকিস্তান স্রেফ গায়ের জোরে পাখতুনদের দাৰীয়ে রেখেছে। – পাক প্রতিনিধি আফগানিস্তানের সঙ্গে পাকিস্তানের যে ভ্রাতৃ-বন্ধনের কথা বলেছেন তার জবাবে আফগান প্রতিনিধি বলেন, সেই বন্ধন আফগানিস্তনের অধিবাসীদের সাথে পাকিস্তানের অধিবাসীদের। অর্থাৎ তিনি একথাই বুঝাতে চেয়েছেন।যে পাকিস্তানের নরঘাতক জঙ্গী সরকারের সাথে আফগানিস্তানী দের বা আফগান সরকারের ভ্রাতৃত্বের বন্ধনের কোন প্রশ্নই উঠতে পারে না। 1 আফগান প্রতিনিধির এহেন জবাবের আকস্মিকতায় পাকপ্রতিনিধিরা দারুণভাবে বিস্মিত ও হতভম্ব হয়ে পড়েন। কেননা, তারা কোন ক্রমেই আফগানি স্তানের পক্ষ থেকে এমনতর জবাব আশা করেনি।সুতরাং অন্যান্য প্রতিবেশী। রাষ্ট্রের সাথে সদ্ভাবের নজীর দেখিয়ে পাকিস্তান বাংলাদেশের ব্যাপারে ভারতকে দায়ী করার যে চেষ্টা করছিল আফগান প্রতিনিধির কড়া প্রতিবাদের প্রেক্ষিতে তা লণ্ডভণ্ড হয়ে গেছে। এ প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য পাখতুন আন্দোলনের অন্যতম নেতা খান আব্দুল গফফার খান বাংলাদেশে অনুষ্ঠিত গণহত্যা এবং পাইকারী নির্যাতনের নিন্দা করে এবং বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের সফলতা কামনা করে ইতিপূর্বে যে বিবৃতি দিয়েছিলেন, তাতে সীমান্তের সাধারণ নরনারীর ক্রমবর্ধিষ্ণু অসন্তোষ ও স্বাধীকার কামনার ইঙ্গিত ছিল। সীমান্ত গান্ধী বা বাদশাহ খান নামে পরিচিত অশীতিপর বৃদ্ধ জননায়ক জনাব আব্দুল গাফফার খান বর্তমানে প্রতিবেশী রাষ্ট্র আফগানিস্তানে বাস করছেন।
ডেনমার্কের স্বঘোষিত যুবরাজের নতুন তত্ব ও সাম্প্রদায়িক সমাজবাদ
-আবদুর রাজ্জাক চৌধুরী।
পাকিস্তানে স্বনযুক্ত আর স্বঘোষিত ব্যক্তিদের ছড়াছড়ি। ইয়াহিয়া খান পাকিস্তান নামক অধুনালুপ্ত রাষ্ট্রে স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট। লারকানার সামন্ত প্রভু জুলফিকার আলী ভুট্টো স্বঘোষিত “ছেন মার্কের যুবরাজ।” এখন এই স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট আর স্বঘোষিত যুবরাজের মধ্যে দুষ্ট এডের গুততাগুতি চলছে। এর মধ্যেই দুষ্ট এ ডেটি আর একটি অদ্ভুত নতুন তত্ত্ব আবিষ্কার করেছে। এই তত্বের নাম দেয়া যেতে পারে সাম্প্রদায়িক সমাজবাদ। পাকিস্তানের স্বনিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের আইন উপদেষ্টা মিঃ এ, আর, কর্ণেলিয়াস পদত্যাগ করেছেন এবং যত শীঘ্র সম্ভব তার পদত্যাগ পত্র গ্রহণ করার জন্যে ইয়াহিয়া খানের প্রতি অনুরোধ জানিয়েছেন। পদত্যাগের কারণ কি? না, কর্ণেলিয়াসের মত একজন অমুসলমানকে অর্থাৎ খৃষ্টানকে নতুন শাসনতন্ত্র রচনার জন্য ইয়াহিয়া খান বিশেষজ্ঞ কমিটির প্রধান নিযুক্ত করায় ভূট্টো সাহেব ক্ষুব্ধ হয়েছেন। কারণ তার মতে একজন অমুসলমানের পক্ষে একটি খাঁটি ও নির্ভেজাল ইসলামী শাসনতন্ত্র রচনা করা সম্ভব নয়। তাই কর্ণেলিয়াস সাহেব তার পদত্যাগ পত্রে বলেছেন যে, ভুট্টো সাহেব তার সততায় সন্দেহ প্রকাশ করে ছেন বলেই তাকে পদত্যাগ করতে হয়েছে। অবিশ্যি কর্ণেলিয়াস সাহেবদের মৃত ব্যক্তিদের ভাগ্যে এই ধরণের পরিণতিই অপেক্ষা করে থাকে। এককালে তিনি ছিলেন পাকিস্তানের সুপ্রীম কোর্টের প্রধান বিচারপতি। বহু আন্তর্জাতিক জুরিস্ট সম্মেলনে তিনি মানুষের মৌলিক অধিকার, জনগণের সার্বভৌমত্ব ও বিচার বিভাগের স্বাধীনতা সম্পর্কে অনেক বড় বড় কথা বলেছেন। কিন্তু তিনিই শেষে গণহত্যাকারী, নারীও শিশু ঘাতী, নারীর সম্ভ্রম হরণকারী ও গণতান্ত্রিক রীতি নীতি লংঘনকারী বিশ্বের ঘৃণ্যতম যুদ্ধাপরাধী হিসেবে যাদের বিচার হওয়া উচিত, সেই সামরিক জান্তার খোঁয়াড়ে নাম লিখিয়াছেন। কাজেই তার পরিণতি সম্পর্কে আমাদের বিন্দুমাত্র মাথা ব্যাথা নেই। নির্বিচারে হিটলারের তাবেদাবী করেছিল বলে নুরেমবার্গের ঐতিহাসিক বিচারে জার্মানীর বিচারপতিরা মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধী সাব্যস্ত হয়েছিলেন (আশ্চর্যের ব্যাপার সে দিন যারা সে বিচার করেছিল, আজ তাদেরই অনেকে ততোধিক ঘৃণ্য অপরাধে অপরাধী ব্যক্তিদের উদার হস্তে সাহায্য দিয়া চলেছে)। ঠিক তেমনিভাবে কর্ণেলিয়াসের মত বিচারপতিরাও নুরেমবার্গের বিচারের নজীর অনুযায়ী মানবতার বিরুদ্ধে জঘন্যতম অপরাধের সহযোগী ও সমর্থক হিসেবে অপরাধী সাব্যস্ত হয়ে আছে। কিন্তু কর্নেলিয়াসদের মত চাকুরীজীবী তাবেদারদের কথা এখন থাক আইয়ুব খানের ভাবশিষ্য ও ভুইফোড় রাজনীতিক ভূট্টো সাহেবের প্রসঙ্গই আলোচনা করা যাক। মাত্র কদিন পূর্বে এই ব্যক্তিটি মন্তব্য করেছিলেন = যে, আওয়ামী লীগ নাকি একটি প্রতিক্রিয়াশীল দল । ভালো কথা, কিন্তু ভূট্টো সাহেবের প্রগতিশীলতার রূপটি কেমন, এই তথাকথিত প্রগতিশীল ব্যক্তিটি সরবে এবং সদম্ভে নিজেকে সমাজতন্ত্রবাদী বলে ঘোষণা করে থাকেন এবং সুযোগ। পেলেই চীনের জয়গানে মুখর হয়ে ওঠেন। কিন্তু কেমন সেই । সমাজতন্ত্রবাদ? কর্ণেলিয়াস সাহেবেরপদত্যাগ পত্রেই তার ইঙ্গিত রয়েছে। সেই ইঙ্গিতটি কি? না, কর্ণেলিয়াস সাহেবের মত অমুসলমান লোকের দ্বারা পাকিস্তানের জন্যে একটি খাটি ও নির্ভেজাল ইসলামী শাসনতন্ত্র কোন ক্রমেই বুচনা করা সম্ভব। নয়। এটাই হচ্ছে ভুট্টো সাহেবের অভিমত। কিন্তু চীন প্রেমিক সমাজতন্ত্রীর মুখে এ কি কথা, সমাজতান্ত্রিক শাসনতন্ত্র – নয়, ইসলামী শাসনতন্ত্র নয়, একেবারে ইসলামী শাসনতন্ত্রের জিগির। এবং তা প্রণয়ন করার ব্যাপারেও মুসলমান প্রণেতা আর অমুসলমান প্রণেতার প্রশ্ন উত্থাপন। তবে কি তার সমাজতন্ত্রবাদ সাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্রবাদ? সোনার পাথর বাটি আমাদের মত মানুষের কল্পনায় ঠিক আসেনা। তাই তার সাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্র নামক বস্তুটির আদল কেমন তা অনুমান করা একটু দুঃসাধ্য। বৈ কি আমরা কিন্তু লারকানার ডিউকের মন্তব্যে বিস্মিত হইনি। জন্ম সূত্রের ভিত্তিতে মানুষের বিচার করতে বসা বর্তমান যুগের রীতি ও নীতির বিরোধী। কাজেই লারকানার ডিউক কয়েক লক্ষ একর জমির মালিক সমাজতন্ত্রী ভূট্টোর বিচার আমরা করবোই আধুনিক যুগের মাপ কাঠিতেই। সিন্ধুর এই সামন্ত ভূস্বামী তার মধ্যযুগীয় শ্রেণী। চরিত্র বর্জন করতে পারেনি, বর্জন করতে পারেনি পশ্চিম পাকিস্তানের মধ্যপ্রাচ্য প্রভাবিত রাজনৈতিক পরিমণ্ডল। তাই আমরা দেখেছি যে, তিনি উপমা। প্রয়োগের ক্ষেত্রেও মধ্যযুগীয় সামন্তবাদী মনোভাবের পরিচয় না দিয়ে পারেন না। আর সেই মনোভাব থেকেই তিনি নিজেকে ডেনমার্কের যুবরাজ পদে অধিষ্ঠিত করেছেন। ছয় দফা কর্মসূচীর ভিত্তিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের। নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ যখন ১৬৭টি আসনে জয়ী হয়ে সারা পাকিস্তানে একক ও নিরংকুশ সংখ্যা গরিষ্ঠতার অধিকারী হয়েছিল তখন ক্ষমতার গদী হাত ছাড়া হয়ে যাচ্ছে দেখে তিনি। নিজেই নিজেকে ডেনমার্কের যুবরাজের আসনে বসিয়েদেন। অর্থাৎ পাকিস্তানের রাজনীতিতে তিনিই আদি ও অকৃত্রিম “আসল। লোক”। তা, জনগণের রায় যাই হোক না কেন। অর্থাৎ – তাকে বাদ দিয়ে কিছুই হতে পারবে না। মা তার আগেকার কথাবার্তা গুলোও সাম্প্রদায়িক সমাজতন্ত্রের মতই উল্টো-পাল্টা মনে হলেও একটু তলিয়ে বিচার করলেই দেখা যাবে যে, তারা রাজনৈতিক ধ্যানধারণার সবগুলোই আসলে ঠিক খাপে খাপে মিলে যাচ্ছে। তিনি মন্তব্য করেছিলেন যে, তাকে বাদ দিয়ে শাসনতন্ত্র রচনা বা ক্ষমতা হস্তান্তরের উদ্যোগ গ্রহণ করা আর ডেনমার্কের যুবরাজকে বাদ দিয়ে হামলেট অভিনয় করা একইকথা। (চলবে)