জয় বাংলা ৮ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জয় বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
১ম বর্ষ ২২শ সংখ্যা, মুজিবনগর, শুক্রবার ২১শে আশ্বিন, ১৩৭৮, ৮ই অক্টোবর, ১৯৭১
মুজিবনগর বৈঠকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া কোনো প্রস্তাব গ্রহণযোগ্য নয়
সম্প্রতি মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত তিন দিনব্যাপী বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠক এক ঐতিহাসিক গুরুত্ব অধিকারী বৈঠক। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ উত্থাপন, ভারত সোভিয়েত ইউনিয়ন যুক্ত বিবৃতি এবং জাতিসংঘে ইঙ্গ-মার্কিন ভূমিকার পরিপ্রেক্ষিতে এই বৈঠকের সিদ্ধান্ত ও ঘোষণা সকল জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটিয়ে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জন সম্পর্কে সংগ্রামী প্রত্যয়কে আরও উজ্জ্বল করে তুলেছে। বৈঠকে ভারত রুশ যুক্ত বিবৃতিতে অভিনন্দিত করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সমস্যা অনুধাবনের সোভিয়েত নেতৃবৃন্দ অনেক এগিয়ে এসেছেন।
শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের প্রশ্নে বৈঠকে বলা হয়েছে, একমাত্র স্বাধীন এবং সার্বভৌম বাংলাদেশেই শরণার্থীরা ফিরে যেতে পারে। বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানে ভারতের ভূমিকা বাংলাদেশের জনগণের পক্ষ থেকে গভীর কৃতজ্ঞতা সঙ্গে স্মরণ করা হয়েছে এবং বলা হয়েছে, ভারতের আন্তরিক প্রচেষ্টা সত্ত্বেও বিশ্বের কোন কোন দেশ এখনো বাংলাদেশে সমস্যার জটিলতা গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পারেনি। বৈঠক যে বক্তব্যটিকে বিশ্ববাসীর কাছে স্পষ্ট করে তুলেছেন তা হল, বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ক্রমবর্ধমান সাফল্য এই সত্যটাকে প্রমাণ করতে চলেছে যে, বাংলাদেশের মানুষ নিজেরাই নিজেদের ভবিষ্যত নিয়ন্ত্রণ করবেন। অন্যান্যদের যদি বাস্তব সত্য উপলব্ধিতে দেরী করে তাতে মুক্তিযোদ্ধাদের মনোযোগ নষ্ট হবে না। বাংলাদেশ মন্ত্রিসভার বৈঠকে স্পষ্ট ভাষায় বক্তব্য তুলে ধরা হয়েছে তাহলো, পূর্ণ স্বাধীনতা ভিন্ন অন্য কোন রাজনৈতিক মীমাংসা প্রস্তাব তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হবে না।
নেতৃদ্বয়ের শরণার্থী শিবির পরিদর্শন
গত ১৫ই সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের মহিলা সম্পাদিকা ও পরিষদ সদস্য বেগম বদরুন্নেসা আহমদ এবং বিশিষ্ট নেত্রী বেগম আইভি রহমান মুজিবনগর থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের আগরতলায় গমন করেন এবং সেখানকার বিভিন্ন শরণার্থী শিবির পরিদর্শনের সময় শরণার্থীদের মধ্যে কাপড় বিতরণ করেন। তারা বাংলাদেশের অভ্যন্তরে বিভিন্ন যুব শিবির পরিদর্শন কালে বাঙালি যুব সমাজের মনোভাব দেখে তার ভূয়শী প্রশংসা করেন। বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরের মহিলারা তাদের উপর নির্যাতনের মর্মান্তিক বিবরণ জানান। বেগম বদরুন্নেসা এবং বেগম রহমান উভয়েই এই মর্মে আশ্বাস দেন যে, আত্মীয়-স্বজনহীন মেয়েদের জন্য আবাসস্থল তৈরীর প্রয়োজনীয়তা তারা বাংলাদেশ সরকারকে জানাবেন এবং শীঘ্রই এ ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে
-প্রধানমন্ত্রী
আমাদের যুদ্ধ আমাদেরই করতে হবে, আমাদের স্বাধীনতা আমাদেরই অর্জন করতে হবে। যুদ্ধক্ষেত্রেই বাংলাদেশ প্রশ্নের সমাধান নিহিত।
গত বুধবার মুজিবনগরে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে জয়বাংলা প্রতিনিধির কাছে বাংলাদেশ সরকারের প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দীন আহমদ উপরোক্ত ঘোষণা করেন।
বাংলাদেশ প্রশ্নে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের মতিগতি সম্পর্কে জিজ্ঞেস করা হলে প্রধানমন্ত্রী বলেনঃ যারা মানব স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারের বিশ্বাসী তারা আমাদের সংগ্রাম কে সমর্থন করতে ন্যায়তঃ বাধ্য। তবু সংকীর্ণ জাতীয় স্বার্থে স্ট্রাটেজির স্বার্থে যারা আমাদের সাহায্য ও সমর্থন দিতে অপারগ তাদের উচিত বাংলাদেশ প্রশ্নের সম্পূর্ণ নিরপেক্ষ থাকা। কেননা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ধ্বংসযজ্ঞ তাদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষভাবে সাহায্য করা স্বাধীনতা ও মানবিক মূল্যবোধের ধ্বংস সাধনেরই সামিল।
বিভিন্ন স্বার্থবাদী মহল এর পক্ষ থেকে রাজনৈতিক আপোষ’ সমঝোতা, প্রকৃতির যে ধুয়া তোলা হচ্ছে তৎসম্পর্কে প্রশ্ন করা হলে জনাব তাজউদ্দিনের সাথে বলেন, বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি পুনর্বার দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করতে চাই যে আমাদের সরকারের চার দফা পূর্ব শর্ত পূরণ, যথা-বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের স্বীকৃতি, বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিনাশর্তে মুক্তি, বাংলাদেশ থেকে সমস্ত পাকিস্তানি সৈন্য প্রত্যাহার এবং বাংলাদেশে ইয়াহিয়া বাহিনীর ধ্বংসলীলার পূর্ণ ক্ষতিপূরণ না হওয়া পর্যন্ত কারো সাথে কোন আলোচনারই প্রশ্ন উঠতে পারে না।’
এ প্রসঙ্গে আরও প্রশ্ন করা হলে প্রধানমন্ত্রীর জনাব তাজউদ্দীন বলেনঃ মুক্তিবাহিনী আজ সুসংগঠিত, জাতিসংঘবদ্ধ এবং দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ। আমাদের মুক্তিযুদ্ধা ভাইয়েরা মাত্র কয়েক মাসে যা করেছেন তা বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক নয়া নজির হিসাবে ভাস্কর হয়ে থাকবে। তাদের প্রতি আমার আবেদন, শত্রুর উপর আঘাতের পর আঘাত করে যান এবং শত্রুর দুর্গ কে ভেঙে চুরমার করে দিন। যুদ্ধক্ষেত্রেই হবে বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার চূড়ান্ত ফয়সালা।
দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম
মুক্তিবাহিনী ক্যাম্প থেকে কথাবার্তা শেষে রওনা হলাম গন্তব্যস্থলের উদ্দেশ্যে। বেলা তখন পশ্চিমে কিঞ্চিত হেলে পড়েছে। সুবেদার মেজর আমাকে পথ দেখিয়ে দেওয়ার জন্য সাথে একজন গাইড দিলেন। কেননা, সামনের কিছুটা এলাকা সেদিনের জন্য বিপদ এলাকা ছিল। আগের দিন মুক্তিবাহিনীর যে কয়টা গেরিলা দল অপারেশনের গিয়েছিল তাদের দুটো তখনো ফিরে আসেনি। ওইদিকে পাকিস্তান বাহিনীও নাকি ওই এলাকায় অবস্থান করছিল। সুতরাং ভয়টা ছিল আমার দুদিক থেকেই। তাই গাইডের ব্যবস্থা।
মাঠ ঘাট ও বাগানের মধ্যে দিয়ে যাওয়ার পর গাইড আমাকে এক জায়গায় দাঁড়াতে বলে পাশে কোথায় চলে গেল। চারো দিকে তাকিয়ে জঙ্গল আর জঙ্গল ছাড়া কিছুই দেখা গেল না। মিনিট তিনেকের মধ্যেই গাইড ১৮/১৯ বছরের একজন তরুণকে সাথে নিয়ে আসলো এবং আমাকে তার হাওলা করে দিয়ে চলে গেল।
তরুণ আগে চললো আর আমি তার পেছনে পেছনে চললাম। পথিমধ্যে জিজ্ঞেস করে জানতে পারলাম সে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের অনার্সের ছাত্র ছিল, আর বর্তমানে মুক্তিবাহিনীতে কাজ করছে। সে আমাকে বলল যশোর জেলায় তার বাড়ি। বাবা বহু আগেই মারা গেছেন। এপ্রিল মাসে পাকিস্তানি সৈন্যরা তার কলেজে পড়া ছোট বোনকে ধরে নিয়ে যায়। ছোট ভাই তাতে বাঁধা দিলে তাকে গুলি করে হত্যা করে। অবশ্য পরে ছোট বোনটিকেও মৃত অবস্থায় পাওয়া যায় বাড়ি থেকে কিছু দূরে। খবর পেয়ে সে বাড়ি গেলে মা বলেছিলেন; বাবা তুই যদি আমার সন্তান হোস, তাহলে প্রতিশোধ নিবে যা চলে যা; এক্ষুনি বের হয়ে পর।’
মায়ের হুকুম শিরোধার্য করে তরুণ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্র টি বের হয়ে পড়েছিল। তারপর ট্রেনিং নিয়ে যুদ্ধ করে চলেছে শত্রুর বিরুদ্ধে। ছোট ভাই বোনের হত্যার প্রতিশোধ সে নিয়েছে। নিজ হাতে হত্যা করেছে সে সাতজন পশ্চিম পাকিস্তানের সৈন্যকে। তবে তার সত্যিকার প্রতিশোধ নেওয়া হবে সেদিন যেদিন বঙ্গবন্ধুর বাংলা শত্রু মুক্ত হবে, ঢাকার ইডেন বিল্ডিং উত্তোলিত হবে স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা।
তরুণের উদ্দেশ্যের মত অভীষ্ট লক্ষ্যের প্রতি অবিচলতার প্রমাণও আমি পেলাম একপর্যায়ে। সে আমাকে বলল যারা আমার বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছিল তাদের মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করার সুযোগ আমি পেয়েছিলাম একদিন। কিন্তু তা করিনি। এমনকি সহকর্মীদেরও তা থেকে বিরত করেছিলাম। তাদের বলেছি, ওরা পশু, বর্বর, নরপিশাচ। তাই ওরা মনুষ্যত্বের অবমাননা করছে, পশুত্বের পরিচয় দিয়েছে। আমরা কেন সারা দুনিয়ার বিবেকবান মানুষ আজ তাদের নিন্দা করেছে।’ সুতরাং যে বর্বরতা ও পশুত্বের জন্য তারা বিশ্ব-নিন্দিত সে কাজ আমরা করতে পারি না।’
একটা মাঠের মধ্যে দিয়ে যাচ্ছিলাম। মাঠের বিভিন্ন জায়গায় লোকজন কাজ করছে। কেউ পাট কাটছে, কেউ ধান কাটছে, আবার কেউ ঘাস কাটছে। একটা পাটক্ষেতের আড়ালে ছিল একটা ধানক্ষেত। দুই ক্ষেতের মাঝখানে আইলে ঘাস কাটার ভান করতে দেখা গেল ১৫/১৬ জন লোককে। তাদের মাথায় গেঞ্জি, পরনে লুঙ্গি। দেখে কারও পক্ষে বোঝার উপায় ছিল না যে ওরা চাষাভূষা ছাড়া আর কেউ।
তরুণ ওদের প্রতি আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলল ওরা আমাদেরই লোক। সামনে যে নদী টা দেখছেন তার উপরে রয়েছে একটি বাজার। বাজারে আগে পাকিস্তানি সৈন্যদের ঘাঁটি ছিল তাদের সাথে মুক্তিবাহিনীর প্রচন্ড যুদ্ধ হয়। যুদ্ধে বেশিরভাগ খান সেনাই নিহত হয়। অন্যরা পালিয়ে প্রাণ বাঁচায়। তারপর বহুদিন এদিকে আসেনি ওরা। কিন্তু গতকাল নাকি একটা দল এসেছিল। শুনেছি আজ আবার আসতে পারে। তাই আমাদের ফৌজ অপেক্ষা করছে ওদের সাদর অভ্যর্থনা জানাতে।
একটু সামনেই ছিল নদী পারাপারের খেয়া। খেয়া ঘাটে গিয়ে পাটনীর সাথে কিছু কথা বলে তরুণ বিদায় নিল। অপর তীরে গিয়ে আমি নেমে পড়লাম। যাত্রী ও ছিলাম আমি একা। আমি খেয়া থেকে নেমে পড়লাম। পাটনীও আমার পেছন পেছন নেমে পড়ল, এবং আমাকে একটা নির্দিষ্ট পথ পরিহার করে চলতে বলল।
বাজারের উপর দিয়ে যেতে বুকটা আমার আনন্দে ফুলে উঠলো। কেননা বাজারের প্রায় প্রতিটি দোকানের উপর উঠছিল পতপত করে আমাদের জাতীয় পতাকা। যার ইজ্জত রক্ষার জন্য আমাদের তরুণরা লড়েছে প্রাণ দিচ্ছে।
আরো মাইল তিনেক এগিয়ে গেলাম। সে কি ভয়াবহ দৃশ্য। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা যাওয়ার আগে সমগ্র এলাকাটিকে লন্ডভন্ড করে রেখে গিয়েছিল। প্রতিটা বাড়ি লুটপাট করে নিয়েছিল। পিপাসা পেয়েছিল খুব। বারান্দায় এক বুড়ি কে দেখে গিয়ে বসে পড়লাম সেখানে। বললাম বুড়িমা পানি খাবো বুড়ির বয়স ৭০/৭৫ হবে। একটা বাচ্চাকে পানি আনতে বলে বুড়ি আমাকে জিজ্ঞেস করতে থাকলেন নানা কথা। আমি কোথা থেকে আসছি, কোথায় যাবো, কি করছি ইত্যাদি অনেক কথা তিনি একনাগাড়ে জিজ্ঞেস করে ফেললেন। বললাম মুজিবনগর থেকে আসছি, বাড়ি যাবো।
বাড়ি যাবো কথাটা শুনেই বুড়িমা আঁতকে উঠলেন। বললেন, ‘বাড়ি যেও না বাবা’ পাঞ্জাবীরা গুলি করে মেরে ফেলবে। দেখছো না আমার বাড়ি ঘর সব খালি। সৈন্যরা আমার দুই ছেলে ও চার নাতি কে গুলি করে মেরে ফেলেছে। আমি কেন বেঁচে রইলাম….।’
পানি খেয়ে আমি উঠতে যাচ্ছিলাম! বুড়িমা তখন হঠাৎ বললেনঃ আচ্ছা বাবা, ওই যে আমরা ভোট দিয়েছিলাম, সেই মুজিবুর বেঁচে আছে তো? সে বেঁচে থাকলে এর শোধ সে একদিন নেবে। বেটারা জানেনা…।’
দেখলাম বৃদ্ধা বঙ্গবন্ধুর ও খবর রাখেন। সর্বোপরি একটা পাড়া গেঁয়ে বৃদ্ধার মধ্যে তার নেতৃত্বের প্রতি এমন আস্থা দেখে আমি স্তম্ভিত হয়ে গেলাম। কিন্তু কোনো জবাব না দিয়ে একটা আদাব জানিয়ে আস্তে বের হয়ে পড়লাম।
যশোরের প্রবীণ আওয়ামী লীগ নেতা এবং জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব মশিউর রহমানের নির্বাচনী এলাকা। চারদিকে থমথমে ভাব, কোথাও কোন মানুষ দেখা গেল না। হঠাৎ রাস্তার উপর একটা লোকের সাথে দেখা। ২৭/২৮ বছরের লোকটির মুখে দাড়ি, গায়ে পাঞ্জাবি। দেখে মনে হল যেন জামাতপন্থী লোক। পাশাপাশি চলছি দু’জন। কারো মুখে কোন কথা নেই, তবু এক। পর্যায় নেহায়েত ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলাম,’ আচ্ছা ভাই মশিউর রহমান সাহেবের খবর কি? তিনি কি বেঁচে আছেন? কথাটা শুনে লোকটি আমার দিকে এমন ভাবে চাইলেন যেন তার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়েছে। তার চোখ দুটোও ছল ছল করছিল। জিজ্ঞেস করলাম, আপনি এমন হতবাক হয়েছেন কেন? ততক্ষণে তার দুই চোখ দিয়ে পানি পড়তে শুরু করেছে। তারই মধ্যে আমাকে বললেন, দেখুন শেখ সাহেব বা মশিউর রহমানের কথা তো কেউ এভাবে প্রকাশ্যে বলাবলি করতে সাহস পায় না। তাই আপনার কথা শুনে অনেক কিছু মনে পড়ে গেল। আপনি বোধহয় এ এলাকায় নতুন এসেছেন।’
পরে আলাপে জানতে পারলাম লোকটি প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষক। গত নির্বাচনে আওয়ামী লীগের জন্য প্রাণ দিয়ে খেটেছেন, ইত্যাদি। মাইল খানেক একসাথে যাবার পর তিনি চলে গেলেন ভিন্ন দিকে। তবে আমাকে সাবধান করে দিয়ে গেলেন যাতে প্রকাশ্যে এসব কথা আমি আর কারো সাথে আলোচনা না করি।
মশিউর রহমানের পৈত্রিক গ্রাম সিংহ ঝুলি। সেখানে গড়ে উঠেছে ছোটখাট একটা উপশহর। তারই উপর দিয়ে চলে গেছে যশোর চৌগাছা সিএন্ডবি রোড। রোড থেকে প্রায় এক ফালং দূরে আছি। চলেছি একমনে সিএন্ডবি রোড অতিক্রমের উদ্দেশ্যে। হঠাৎ পাশের বাড়ি থেকে দৌড়ে এসে একটা লোক বলল, বসে পড়ুন, সাহেব বসে পড়ুন। ওই যে মিলিটারির গাড়ি আসছে যশোরের দিক থেকে।’লোকটি আমাকে একরকম জোর করেই রাস্তার একপাশে বসিয়ে দেয়।
ইত্যবসরে তিনগাড়ি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য বাজারের উপর এসে পড়ল এবং মিনিট খানেকের জন্য গাড়ির গতি কমিয়ে চারদিকে দেখে নিল। তারপর ভোঁ করে চৌগাছা অভিমুখে চলে গেল।
লোকটার কাছে শুনলাম, ওই অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর হাতে বারবার প্রচন্ড মার খেয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা আজকাল আর মাটিতে পা দেয় না।এমনকি গাড়ি পুরোপুরি থামাবার ও তাদের সাহস নেই।
মিলিটারির গাড়িগুলো চলে যাবার পর আমি রাতারাতি সিএন্ডবি রাস্তা অতিক্রম করে গেলাম। যাবার সময় ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখলাম ধ্বংসস্তূপের পর ধ্বংসস্তূপ। সমগ্র বাজারের শতকরা ৯০টি বাড়ি হার্মাদ পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা ধ্বংস করে দিয়ে গেছে। আর জনাব মশিউর রহমানের বাড়িটা তো ছিল দস্যুদের বিশেষ লক্ষ্যবস্তু। সুতরাং সেই বাড়ির যে কিছুই দাঁড়িয়ে থাকবে না তা সহজেই অনুমেয়।
রাত তখন সাড়ে আটটা। সিংহঝুলী ও বারবাজারের মাঝখানে গিয়ে পৌঁছেছে কোথায় রাত কাটাই। ঠিক করে উঠতে পারলাম না। একজন লোককে থাকার কথা বলে তিনি দেখিয়ে দিলেন স্থানীয় ইউনিয়ন কাউন্সিল সদস্যের বাড়ি। তবে একথাও শুনলাম, ওই সদস্য আগে জামাতে ইসলামীর লোক ছিলেন। সোজা চলে গেলাম তার বাড়িতে। ডেকে বললাম, আমি অমুক জায়গায় যাব। রাতে আমাকে থাকতে দিতে হবে। আর যদি আমাকে মিলিটারি বা রাজাকারের হাতে তুলে দিতে চান তাও করতে পারেন। তবে তার আগে খেতে দিতে হবে।
ভদ্রলোক তার ভাইপোকে হাত-পা ধুইবার পানি আনতে হুকুম দিলেন। তারপর আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, সত্য কথা আমি আগে জামাত মধ্যে ছিলাম। কিন্তু গতকাল থেকে আমি বাঙালি এবং এখন এটাই আমার একমাত্র পরিচয়। জানেন, গতকাল সৈন্যরা আমাদের চেয়ারম্যান সাহেবের বাড়ি এসে তাকে ২০টি তরুণ এবং কয়েকটি মেয়েমানুষ দিতে বলে। তিনি দুই দিনের সময় চেয়ে ছিলেন মাত্র। তারপর সোজা তার বাড়িতে ঢুকে পড়ে এবং চেয়ারম্যান সাহেবের পুত্রবধূ ও যুবতী মেয়েকে ক্যাম্পে ধরে নিয়ে যায়। তারপর তাদের ভাগ্যে কি ঘটেছে তা বুঝতেই পারছেন।
পাকিস্তানের অস্ত্র বোঝাই জাহাজ পরিবহন বন্ধ করে মানবিক সাহায্য শুরু করুন
মার্কিন সরকারের প্রতি কেনেডির আবেদন
উদ্বাস্তু সংক্রান্ত সিনেট কমিটির চেয়ারম্যান এডওয়ার্ড কেনেডি সম্প্রতি সিনেটে তিনি বলেন, বাংলাদেশের কাহিনী আধুনিক কালের সবচেয়ে বড় দুঃস্বপ্ন বলে বিবেচিত হবে। তিনি বলেন যে, দক্ষিণ এশীয়া দ্রুত বিপর্যয়ের দিকে এগিয়ে চলেছে, সেখানকার পরিস্থিতির উন্নতি সাধনের সাহায্যের জন্য মার্কিন প্রশাসনকে নিরব না থেকে নেতৃত্ব দিতে হবে। তিনি প্রশ্ন করেন যে, ওই এলাকার শাসকদের উপর প্রভাব অক্ষুন্ন রাখার উদ্দেশ্যে জাহাজ বোঝায় অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহ কবে বন্ধ হবে, এবং তার পরিবর্তে কবে থেকে মানবিক সাহায্য দেওয়া হবে? এটা যদি না হয়, তাহলে প্রাণহানির সংখ্যা বাড়তেই থাকবে।
বাংলাদেশ প্রসঙ্গে তিনি বলেন, প্রতিদিন নতুন করে মানুষের দুঃখ দূর্দশা বাড়ছে, মৃত্যুর সংখ্যা বাড়ছে এবং ভারতীয় বাধ্য হয়ে ক্রমবর্ধমান বোঝা বহন করতে হচ্ছে।
ভারতে আগত বাংলাদেশের শরণার্থীদের প্রসঙ্গে তিনি বলেন যে, তিনি নিজে যে পরিস্থিতি দেখে এসেছেন, তা ভাষায় প্রকাশ করা যায় না এবং এই পরিস্থিতি দিন দিন খারাপ হচ্ছে। সিলেটের কেনেডি নিউইয়র্ক টাইমসে প্রকাশিত একটি খবরে প্রতি সিনেটের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। উক্ত খবরের নবাগত জনৈক শরণার্থীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে বলা হয়েছে যে, পাকিস্তান সরকার ও স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনতে এবং বাঙ্গালীদের আস্থা অর্জনে বদ্ধপরিকর বলে ঘোষণা করলেও আসলে পাকিস্তানি সেনারা অসামরিক ব্যক্তিদের সহযোগিতায় সেখানে এখনো হত্যা, লুণ্ঠন অগ্নিসংযোগ চালিয়ে যাচ্ছে।
সিনেটর বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে রানের উদ্দেশ্যে ভারতের প্রচেষ্টায় ৪০ কোটি ডলার (৩০০ কোটি টাকা) সাহায্য করার সুপারিশ করে সিনেটে একটি বিল উত্থাপন করেন। তিনি বলেন যে চলতি আর্থিক বছরে শরণার্থী ত্রাণ এর জন্য ভারতের মোট ৫২২ কোটি ৫০ লক্ষ টাকা লাগবে বলে মার্কিন সরকার আনুমানিক হিসাব করেছেন। তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে এ বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করার জন্য আবেদন করেছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনকে এই বলে অনুরোধ করা হয়েছে যে, তিনি যেন এ বিষয়টি চাপা দেওয়ার চেষ্টা না করেন।
শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে পশ্চিম সৈন্যদের বিতাড়িত করবো
মুজিবনগর, ২৩শে সেপ্টেম্বরঃ সম্প্রতি দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগাঁও মহাকুমার মুক্ত এলাকায় আওয়ামী লীগের উদ্যোগে এক জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। তেঁতুলিয়ায় অনুষ্ঠিত জনসভায় যেকোনো ত্যাগের বিনিময় মুক্তি সংগ্রাম চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণার পুনরুল্লেখ করা হয়।
সভায় বাঙালির শেষ রক্তবিন্দু বিনিময়েও বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ থেকে প্রতিটি পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করার সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হয়।
জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব আজিজুর রহমানের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত জনসভায় আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ প্রতিটি বাঙালি সন্তানকে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান। নেতৃবৃন্দ বলেন যে, একজন বাঙালি সন্তান বেঁচে থাকা পর্যন্ত আমরা মানবতার শত্রুদের কাছে মাথা নত করব না। তারা দল-মত-নির্বিশেষে প্রত্যেক বাঙালিকে মুক্তিযুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ার আহ্বান জানান।
আভ্যন্তরীণ ব্যাপার নয়
সোভিয়েত পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিস্টার গ্ৰোমিকো জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ২৯শে সেপ্টেম্বর বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, পূর্ব বাংলায় সৃষ্ট ভয়াবহ পরিস্থিতির পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপার হতে পারে না। ‘তাস’ সে খবর দিয়েছেন।
বাংলার সূর্য সৈনিক অমৃতের সন্তানেরা আঘাতে আঘাতে ভাঙ্গো শয়তানের দুর্গ
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা থেকে প্রাপ্ত বিভিন্ন খবরে প্রকাশ, বিগত মাস দেড়েকের মধ্যে দখলীকৃত এলাকায় পশ্চিম পাকিস্তানী বাহিনীর মনোবল একেবারে ভেঙে পড়েছে। মুক্তিবাহিনীর সাথে সম্মুখ সমরের কথা শুনে তাদের এখন ভিমরি খাবার মত অবস্থা। একটা যুদ্ধ জয়ের জন্য যে অটুট মনোবল, নিজেদের প্রতি অবিচল আস্থা ও উদ্দেশ্যের সততার প্রয়োজন তার কোনটাই এখন আর দখলদার বাহিনীর মধ্যে নেই।
সামরিক ভাষ্যকারদের মতে এর কারণ ত্রিবিধ। প্রথমতঃ লুটতরাজ, নারী ধর্ষণ প্রভৃতি কাজ করে পশ্চিমা সৈন্যরা তাদের পেশাদার সৈনিকের পরিচয় হারিয়ে ফেলেছে।৮০/১০০ টাকার সেপাই বাড়িতে লাখ লাখ টাকা পাঠিয়েছে। সুতরাং যুদ্ধ করে প্রাণে মারা গেলে টাকা খাবে কে-এ চিন্তায় তারা আর এখন যুদ্ধ করতে চায় না, তারা যুদ্ধ বিমুখ হয়ে পড়েছে।
দ্বিতীয়তঃ যুদ্ধে মারা গেলে বা আহত হলে ইন্স্যুরেন্সের টাকা পাওয়ার যা বিধান ছিল ইয়াহিয়ার কাণ্ড কারবারে তা ভেস্তে গেছে।
সর্বশেষে যে বিষয়টা ইয়াহিয়ার ভাড়াটিয়া সৈন্যদের মনোবল একেবারে ভেঙে চুরমার করে দিয়েছে তা হলো আমাদের মুক্তিবাহিনীর শত্রুর উপর আঘাত হানার ক্ষমতা, ক্ষিপ্রগতি এবং ক্রমবর্ধমান শক্তি।
প্রথমদিকে তাদেরকে মাত্র ৪৮ ঘন্টায় যুদ্ধজয়ের আশ্বাস দেওয়া হলেও বাস্তবের কঠোর আঘাতে তারা আজ বুঝতে পারছে যে ৪৮ বছরেও তাদের পক্ষে বাংলাদেশের যুদ্ধ জয়ের কোন সম্ভাবনা নাই।
পাকিস্তান বাহিনীর মনোবল ভেঙে পড়ার প্রমাণ পাওয়া যায় বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে সাবেক পাকিস্তানের আমলে স্থাপিত ২২৫টি প্রহরা ফাঁড়ির ১৭১টি থেকে তাদের সরিয়ে নিয়ে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে আশ্রয়গ্রহণ থেকে। যে ৫৪টিতে তারা এখনো অবস্থান করছে তাতেও তারা নিয়মিত থাকে না। মুক্তিবাহিনীর আগমনবার্তা ফেলে পালিয়ে যায় এবং পরে সুযোগ মত আবার এসে দখল নেয়।
সামরিক বিশেষজ্ঞদের মতে বিগত মাস দেড়েকের মধ্যে ৪/৫ হাজার সৈন্য হতাহত হওয়া ছাড়াও অন্য একটি কারণ তাদের ভগ্নপ্রায় মনবলকে আরো ভেঙে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছে। বিষয়টা হলো মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকিস্তানি ও বিদেশী মিলিয়ে ডজন খানেক এর ও বেশী জাহাজ, স্টিমার ডুবি। বস্তুত যেভাবে ও যে পদ্ধতিতে মুক্তিবাহিনীর কমান্ডার জাহাজ স্টিমারগুলো ডুবিয়ে দিয়েছে তা যে কোন জাতির জন্য গর্বের বিষয়।
গত ১৬ই আগস্ট মুক্তি বাহিনীর প্রথম চট্টগ্রাম বন্দরে মজিনের সাহায্যে দু’খানা জাহাজ ধ্বংস করে দেয়। তারমধ্যে একখানা ছিল পশ্চিম জার্মানির এবং অপরটি ছিল লাইবেরিয়ার। তারপর ১৬ই আগরতলা থেকে আগস্টের মধ্যে যুগপৎ আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী খুলনা, চালনা, রাজশাহী ও চট্টগ্রাম ছোট-বড় মিলিয়ে পুরা এক ডজন জাহাজ, স্টিমার ও স্পিডবোট বিনষ্ট করে। এরমধ্যে একখানা আমেরিকান জাহাজ এবং পাকিস্তানী জাহাজ “পদ্মা”, “সুন্দরবন” ও ছিল। শেষোক্ত জাহাজদ্বয় মার্কিন মুল্লুক থেকে বাঙালি হত্যার জন্য অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চালনা এসে নোঙ্গর করেছিল।
সর্বশেষে গত সপ্তাহে চালনা বন্দরে মুক্তিবাহিনী আরেকখানা মার্কিন জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে। তথাকথিত পাকিস্তানের গোয়েবলসরা বোধগম্য কারণেই পূর্বেকার জাহাজগুলো ডুবিয়ে দেওয়ার কথা বেমালুম চেপে যায়। অস্ত্রবাহী জাহাজ মুক্তিবাহিনীর ডুবিয়ে দিয়েছে সংবাদ শুনলে বাঙ্গালীদের মন আনন্দে নেচে উঠবে আর পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষ আসল ব্যাপার জেনে ফেলবে সেই কারণে তারা এত বড় ক্ষতির কথা চেপে গিয়েছিলো।
কিন্তু সর্বশেষ জাহাজ ডুবির কথা তারা নানা কারণে চেপে যেতে পারেনি। এর প্রথম কারণ হলো গোয়েবলসীয় প্রচারণার ধারা। মুক্তিযোদ্ধারা খাদ্যবাহী জাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে এই সংবাদ শুনলে বাংলাদেশের মানুষ মুক্তি বাহিনীর ওপর ক্ষেপে যাবে মনে করেই তারা ঘটনাটা স্বীকার করেছে।
দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তানের ভাড়া খাটতে এসে বারবার জাহাজ ধ্বংসের ফলে কোন কোন ব্রিটিশ ও মার্কিন জাহাজ কোম্পানি নাকি পাকিস্তান সরকারকে জানিয়ে দিয়েছে যে ক্ষতিপূরণ না দিলে অতঃপর তারা আর কোন জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে পাঠাবে না। অথচ বেসরকারিভাবে জাহাজ ধ্বংস কথা স্বীকার করা না হলে তারা ইন্স্যুরেন্স কোম্পানির কাছ থেকে ক্ষতিপূরণও পেতে পারে না। তাই ঠেলায়য় পড়ে ইয়াহিয়া এবার জাহাজ ডুবির কথা স্বীকার করে নিয়েছেন। অবশ্য এ ঘোষণার পরও ব্রিটিশ-মার্কিন নাবিকরা নিজেদের জানের ওপর ঝুঁকি নিতে আসবে বলে মনে হয় না।
সামরিক মহলের মতে এই সমস্ত জাহাজডুবি অন্যভাবেও ইয়াহিয়ার যুদ্ধ প্রচেষ্টাকে ব্যাহত করে তুলেছে। এতদিন সমুদ্রপথেই ছিল ইয়াহিয়ার বাংলাদেশের সৈন্য, অস্ত্রশস্ত্র ও রসদ প্রেরণের প্রধানতম অবলম্বন। কিন্তু বর্তমানে তাও অকেজো হয়ে পড়ার উপক্রম হয়েছে। সুতরাং সৈন্য আনাত দূরের কথা চরম বিপদের মুখে পশ্চিমা সৈন্যদের বাংলাদেশ থেকে পালাবার দ্বিতীয় কোনো উপায় আর থাকবে না। তাই যারা এতদিন ভাবছিলেন যে বর্ষা শেষে পাকিস্তানি বাহিনীর বাংলাদেশের মুক্তিবাহিনীর ওপর প্রচণ্ড চাপ সৃষ্টি করে তাদেরকে নাস্তানাবুদ করতে পারবে তারা এখন মত পাল্টাতে শুরু করেছেন। কেননা, গত কয়েক মাসে মুক্তি বাহিনী যেভাবে পাকিস্তান বাহিনীর চলাচলের পথ ও সরবরাহ লাইন চুরমার করে দিয়েছেন তাতে পশ্চিমবঙ্গের পক্ষে কলাম নিয়ে আর অভিযান পরিচালনা সম্ভব হবে না। দ্বিতীয়তঃ মুক্তিবাহিনীর লোক সংখ্যা গত মার্চ এপ্রিল এর তুলনায় বহুগুণে বেশি, এবং তারা বাংলাদেশের প্রতিটি গ্রামে ছড়িয়ে আছে। পশ্চিম পাকিস্তানিদের তুলনায় তাদের গেরিলা ট্রেনিং উন্নত মানের। এমতাবস্থায় পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের কে বর্ষা শেষে সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়ে যুদ্ধ করতে হবে। তাতে তাদের প্রাণ দিতে হবে গত মার্চ, এপ্রিল এর চেয়েও অনেক বেশি হারে। অথচ সেই মানসিকতা আজ আর পশ্চিমা সৈন্যদের নাই।
তদুপরি বর্ষা শেষে হানাদার বাহিনীর পক্ষে যেমন ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে চলাচল করা সহজতর হবে তেমনি ভাবে মুক্তিবাহিনীর পক্ষেও ভারী অস্ত্রশস্ত্র ভেতরে নিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে। সুতরাং সমানে সমানে যুদ্ধ সবসময়ই মুক্তিবাহিনীর পক্ষে যাবে। কেননা, হানাদার বাহিনী আজ আর কামান, মর্টার প্রভৃতির একচেটিয়া অধিকার নয়। মুক্তিবাহিনীর হাতেও বর্তমানে এসব রয়েছে।
আর কতদিন?
বাংলাদেশের সোনালী আঁশের বিনিময়ে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জৌলুসের জন্য বিদেশি মুদ্রা আয়ের পথ বন্ধ হওয়ায় এবং বাংলাদেশে ইয়াহিয়া-টিক্কাদের বাপদাদার সংরক্ষিত বাজার হাতছাড়া হয়ে যাওয়ায় তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক চক্র বেকায়দায় পড়েছে। ওয়াশিংটন, লন্ডন ,প্যারিস, টোকিও প্রভৃতি রাজধানীতে সুবিধা করতে না পেরে ভিক্ষার ঝুলি হাতে এখন তারা ‘ইসলাম পছন্দ’ রাষ্ট্রনায়কদের কাছে দৌড়াদৌড়ি শুরু করেছে। অনুরোধ দুইজন রাষ্ট্রনায়ক হলেন ইরানের শাহ এবং সৌদি আরবের বাদশাহ।
প্রকাশ ইয়াহিয়ার সাম্প্রতিক ইরান সফরের পশ্চাতে অন্যান্য কারণের মধ্যে টাকা চাওয়াটাও অন্যতম ছিল। কিন্তু শাহানশাহ নাকি পাকিস্তানের জল্লাদ বাদশাহকে স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছেন যে পাকিস্তানকে টাকা দিয়ে সাহায্য করার মত অবস্থা তার নাই। অথবা ইয়াহিয়া সাহেব ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে তার বংশ বাদ রশিদকে সৌদি আরবে পাঠিয়েছেন টাকার জন্য। কিন্তু কত টাকা জানেন? মাত্র ৫ কোটি ডলার।
যে পাকিস্তান বাংলাদেশের পাট বিক্রি করে বছরে দশ হাজার কোটি টাকা আয় করতে তাকে মাত্র পাঁচ কোটি ডলারের জন্য ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে সৌদি আরবে ধর্না দিতে হচ্ছে। তাই রাজনৈতিক মহলের ধারণা ইয়াহিয়া চক্র আর বেশিদিন বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে পারবে না।
লন্ডনে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নাও’ নৃত্য নাট্য
ব্রিটেনে বিভিন্ন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতি অর্থ সংগ্রহের জন্য বিচিত্রানুষ্ঠান, চলচ্চিত্র প্রদর্শন ও নৃত্যানুষ্ঠানের আয়োজন করেছেন। বাংলাদেশ গণসংস্কৃতি সংসদের উদ্যোগে ‘অস্ত্র হাতে তুলে নেও’ নামে নৃত্য নাট্য এবং গীতি বিচিত্রা অনুষ্ঠিত হয় হোবর্ন- এর কনওয়ে হলে। প্রবেশ মূল্য ছিল এক পাউন্ড। বাংলাদেশ অ্যাকশন কমিটির উদ্যোগে সত্যজিৎ রায়ের আন্তর্জাতিক পুরস্কার প্রাপ্ত ছবি গুপি গাইন বাঘা বাইন এবং সুচিত্রা সেন অভিনীত মমতা নামে একটি হিন্দি ছবিও প্রদর্শিত হয়।
বাংলার পবিত্র ভূমি থেকে শত্রুকে উৎখাত না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চলবে
-সৈয়দ নজরুল ইসলাম
বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষে গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দেন নিম্নে তার পূর্ণ বিবরণ প্রদত্ত হলো:
আমার প্রাণ প্রিয় দেশবাসী ভাই-বোনেরাও আমাদের মুক্তিবাহিনীর মহান বীর সেনারা-
প্রথমে জানাই আপনাদের আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও সশ্রদ্ধ সালাম। আজ রক্তাক্ত ২৫শে সেপ্টেম্বর। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ৬ মাস পূর্ণ হলো আজ থেকে ঠিক ছয় মাস আগে ২৫শে মার্চ তারিখে গণতন্ত্রের সমাধি রচনা করে বর্বর হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের উপর বীভৎস হত্যাকাণ্ড শুরু করেছিল। সেদিন থেকে শুরু হয় বাংলাদেশের স্বাধীনতার লড়াই। স্বাধীনতা ঘোষণার মাধ্যমে শুরু হয় আমাদের মুক্তিযুদ্ধ। এই ছয় মাস সময়ের মধ্যে যেসব নিরীহ-নিরস্ত্র বাঙালি ভাই-বোনেরা আত্মহুতি দিয়েছেন এবং যেসব মুক্তিসেনা লহর মাঝ দিয়ে শাহাদাত বরণ করেছেন প্রথমে তাদের রুহের মাগফেরাত কামনা করছি। বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার লড়াইয়ে এদের নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা থাকবে।
এর সঙ্গে সঙ্গে আমার সরকারের তরফ থেকে আমি যুদ্ধরত মুক্তিবাহিনীর বীর সেনানীদের অভিনন্দন জানাচ্ছি। যে প্রতিকূল অবস্থার মধ্য থেকে স্বাধীনতার অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের মুক্তিবাহিনী বঙ্গবন্ধুর আদর্শকে সামনে রেখে দুর্বার গতিতে এগিয়ে চলেছেন তাতে সমগ্র সভ্য জগৎ স্থম্ভিত হয়ে পড়েছে। বিশ্বের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে আপনারা উজ্জ্বল নক্ষত্র। আপনাদের মৃত্যু নেই। আপনারা মহান ও অমর। আমার সরকার ও বাঙালি জাতির জন্য গর্ব অনুভব করছে।
এটা আমাদের জীবন মরণের যুদ্ধ
আজকে জাতির উদ্দেশ্যে দুটো কথা বলতে যেয়ে বারবার দখলীকৃত এলাকার ছাত্র-জনতা, কৃষক-শ্রমিক, বুদ্ধিজীবী, মধ্যবিত্ত, লাখ লাখ বাঙ্গালীদের দুর্বিষহ জীবন চিত্র আমার চোখের সামনে ভেসে উঠছে। আপনাদের দুঃখে আমরা ব্যথিত। তবুও আপনারা যেভাবে মুক্তিযুদ্ধে সহযোগিতা করছেন তা আমাদের অভিভূত করেছে। তাই আমরা সর্বশক্তি নিয়ে বাংলাদেশকে শত্রুমুক্ত করবার জন্য মরণপণ লড়াইয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছি। জেনারেল ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তা যখন যুদ্ধকে আমাদের উপর চাপিয়ে দিয়েছে, তখন আমরা সে চ্যালেঞ্জ গ্রহণ করে মৃত্যুর সঙ্গে পাঞ্জা লড়ছি। বাঙালিরা একতা, অটুট মনোবল, অদম্য সাহস আর দেশপ্রেমই হচ্ছে আমাদের স্বাধীনতা লড়াইয়ের মূল মন্ত্র। আজ বাংলাদেশের পথে-প্রান্তরে একটা দানবীয় পশুশক্তির বিরুদ্ধে আমাদের তাজা তরুণ প্রাণ গুলি রক্তক্ষয়ী লড়াইয়ের মাঝ দিয়ে বিজয়ের বরমাল্য আনতে শুরু করেছে। এই যুদ্ধ আমাদের জাতীয় মুক্তির যুদ্ধ -এ জুতা বাংলাদেশের ছাত্র-জনতা কৃষক মজুরের জীবন- মরণের যুদ্ধ। তাই এ যুদ্ধ এখন জনযুদ্ধ। ছয় মাসের মধ্যে আমাদের অবিশ্বাস্য রকমের সাফল্যে শত্রুপক্ষ হতভম্ব, বিপর্যস্ত ও তাদের মনোবল নিঃশেষিত।
সামরিক শাসক চক্র ভেবেছিল মাত্র ৭২ ঘন্টার মধ্যেই তারা কার্য সমাধা করতে পারবে এবং পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলে বিশ্ববিবেককে বোঝাতে পারবে। কিন্তু কোনোটাই আর বাস্তবে পরিণত হয়নি। ছয় মাসের মধ্যে তারা পরিস্থিতি আয়ত্তে আনতে পারেনি এবং বিশ্ব জনমতকেও বিভ্রান্ত করতে পারেনি। বরঞ্চ ছমাসের মুক্তিযুদ্ধের খতিয়ান করলে দেখা যায়, এই সময়ের মধ্যে আমাদের মহান মুক্তিযুদ্ধের সেক্টরেই অবিশ্বাস্য রকমের সফলতা অর্জন করেছে।
রজার্স সাহেবের দাওয়াই
একটা কথা আজ স্পষ্টভাবে বলা প্রয়োজন, বাংলাদেশ সমস্যায় যুক্তরাষ্ট্রের সাধারণ মানুষ এবং অধিকাংশ পত্র পত্রিকার ভূমিকায় আমরা গভীরভাবে কৃতজ্ঞ। ডেমোক্র্যাট দলের সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি সহ অন্যান্য মার্কিন সিনেটর বাংলাদেশ সমস্যা যে গভীর বাস্তব বুদ্ধি ও বলিষ্ঠ মনোভাবের পরিচয় দিয়েছেন, তাও বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ নিশ্চয়ই সকৃতজ্ঞভাবে স্মরণ রাখবেন। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের জনসাধারণ এবং সংবাদপত্র সুনিশ্চিতভাবেই বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের মিত্র। এ কথা অস্বীকার করার উপায় নেই যে, যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন এডমিনিস্ট্রেশন এবং রিটেনের রক্ষণশীল সরকারের বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কিত দুমুখো নীতিকে আমরা যতই ক্ষুব্ধ এবং বিরক্ত হই না কেন, এই দুটি দেশের সংবাদপত্র,বেতার, টেলিভিশন ও গণতন্ত্রের নেতাগণেই বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ফ্যাসিবাদী চক্রের অমানুষিক বর্বরতার খবর অত্যন্ত বিশ্বস্ততার সঙ্গে বিশ্ববাসীর কাছে পৌঁছে দিয়েছেন। এ ব্যাপারে ভারতের বেতার, সংবাদপত্র ও সরকারি-বেসরকারি নেতাদের ভূমিকা ও বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামে সর্বাত্বক প্রেরণা ও সহায়তা যুগিয়েছে। প্রতিবেশী সিংহলের শ্রীমাভো সরকার যাই করুন না কেন, সেখানকার জনগণ ও পার্লামেন্ট সদস্যগণ আজ বাংলাদেশের স্বাধীনতার সমর্থনে এবং বঙ্গবন্ধুর মুক্তি দাবিতে মুখর। সোভিয়েত ইউনিয়নের দুইটি প্রধান দৈনিক, সাংবাদিক সমিতি, ট্রেড ইউনিয়ন, বিশ্ব শান্তি কমিটিও আজ কন্ঠ মিলিয়েছেন বিশ্বজনমত সঙ্গে। আমাদের বিশ্বাস, নয়া চীনে যদি সংবাদপত্রের স্বাধীনতা থাকতো এবং বাংলাদেশের প্রকৃত ঘটনাবলী চীনের জনগণ জানতে পারতেন তাহলে তারাও বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সমর্থনে সোচ্চার হয়ে উঠতেন।
এই যেখানে অবস্থা, সেখানে জাতিসংঘের দাড়ি অনেকজনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী উইলিয়াম রজার্স কি বললেন, কিংবা বৃটেনের টোরি দলের মিস্টার আলেক হিউম বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে কতটা চাতুরির খেলা খেললেন, তা নিয়ে আমাদের মাথা ব্যথার কারণ নেই। ভিয়েতনামে গণবিরোধী ও মানবতাবিরোধী ভূমিকা গ্রহণের জন্য মার্কিন জনগণের কাছে ধিকৃত হয়ে প্রেসিডেন্ট জনসনকে যেমন হোয়াইট হাউজ ত্যাগ করতে হয়েছে, তুমি বাংলাদেশে সমস্যায় একটি বর্বর ফ্যাসিস্ট চক্রকে শতাব্দীর সবচাইতে জঘন্য হত্যাকান্ডের সহায়তা জুগিয়ে নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনও যে আরও অধিকৃত হয়ে হোয়াইট হাউস ত্যাগে বাধ্য হবে, তাতে আমাদের কোন সন্দেহ নেই। বাংলাদেশ সমস্যায় যুক্তরাষ্ট্র সরকার আজ যে ভূমিকা গ্রহণ করেছেন, তা শুধু বাংলাদেশের জনগণের শত্রুতার ভূমিকা নয়, গোটা বিশ্বে গণতন্ত্র ও মানবাধিকার প্রতিষ্ঠার বিরুদ্ধে শত্রুতার ভূমিকা। বাংলাদেশে দুর্ভিক্ষ নিবারণ ও শরণার্থী পূনর্বাসনের নামে নিক্সন ও তার চাঁইদের কন্ঠে মায়াকান্না তাতে বিশ্বজনমত বিভ্রান্ত হবে না। কারণ, বিশ্ববাসী জানে, বাংলাদেশে ইয়াহিয়া চক্র এখনো বীভৎস হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। সুতরাং যাদের হত্যা করা হচ্ছে, তাদের ঘাতকের থেকে বাঁচাবার ব্যবস্থা না করে, ক্ষুধার অন্ন সরবরাহের নামে মায়াকান্না আসলে বাঙালীদের খাইয়ে বাঁচিয়ে রাখার নামে রাজনৈতিক উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার ষড়যন্ত্র বিশেষ। যারা প্রত্যহ দলে দলে ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনীর হাতে নিহত হচ্ছে, তাদের জীবনের নিরাপত্তার ব্যবস্থা না করে, নাগরিক অধিকার পুনঃপ্রতিষ্ঠা না করে দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচানোর নামের অর্থ বরাদ্দ করা কি চরম পরিহাসপূর্ণ ও প্রতারণামূলক কাজ নয়? জাতিসংঘে মিস্টার রজার্স দক্ষিণ এশিয়ায় শান্তিভঙ্গের আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ভদ্রলোক উন্মাদ কিনা আমরা জানি না। এক বাংলাদেশেই দশ লাখ লোক নিহত এবং ৯০ লাখ লোক উদ্বাস্তু হওয়ার পরও যিনি শান্তিভঙ্গের আশঙ্কায় বিব্রতবোধ করেন, তার বা তাদের সম্ভবত অবিলম্বে মানসিক চিকিৎসার ব্যবস্থা হওয়া দরকার।
বাংলাদেশ ও ব্রিটিশ শ্রমিকদল
বৃটেনের ব্রাইটনে অনুষ্ঠিত শ্রমিকদলের সম্মেলনে গৃহীত প্রস্তাব বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে নতুনভাবে প্রেরনা যোগাবে তাতে কোন সন্দেহ নেই। প্রস্তাবগুলি থেকে কোনো কূটনৈতিক খেলার মারপ্যাচ না দেখিয়ে স্পষ্টভাষায় বলা হয়েছে, (ক) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সরিয়ে নিতে হবে। (খ) গণহত্যার দায়ে জাতিসংঘে পাকিস্তানকে অভিযুক্ত করতে হবে। (গ) ব্রিটেনসহ অন্য কেউ যাতে ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য না দেয় তার ব্যবসা করতে হবে।(ঘ) ইয়াহিয়া চক্রকে আমেরিকা যাতে অস্ত্র সাহায্য না দেয় তার জন্য চাপ দিতে হবে। (ঙ) এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি জ্ঞাপনের ব্যবস্থা করতে হবে।
বস্তুতঃ এই প্রস্তাবগুলো গ্রহণ যারা বিশ্বশান্তি, স্বাধীনতা ও গণতন্ত্র রক্ষার ক্ষেত্রে ব্রিটিশ শ্রমিকদের হারানো সংগ্রামী ঐতিহ্য অত্যন্ত বলিষ্ঠ মনোভাব নিয়ে আবার পুনরুদ্ধার করলেন, একথা বিনা দ্বিধায় বলা চলে। ব্রিটিশ শ্রমিকদের প্রতি আমাদের ও সংগ্রামী অভিনন্দন রইল।
বাংলাদেশের যা ঘটছে, তা হলো একটি জাতীয় জনসমাজের আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। বাংলাদেশের যা ঘটছে, তা নজিরবিহীন নয়। বাঙালি আজ যে দাবি তুলেছে, ইতিহাসে অন্যান্য অনেক জাতীয় জনসমাজ তা আগে দাবি করেছে। বাঙ্গালীদের আজকের দাবি তাই অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব কিছু নয়। আন্তর্জাতিক আইন শৃঙ্খলা বিরোধী ও নয়।
জাতীয় জনসমাজ বলতে বোঝায় এমন একটি জনসমষ্টি যারা ভাষাগত দিক থেকে এক। যারা বাস করে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে। যারা নিজেদের মধ্যে অনুভব করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ঐক্য। এই ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয় ইতিহাসের ধারায়। যখন কোন জাতীয় জনসমাজের লোক, অন্য জাতীয় জনসমাজের লোকদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নিতে চায়, তখন উদ্ভব হয় বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদের। প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজ গড়ে ওঠে ইতিহাসের ধারায়। ইতিহাসের ধারায় তাদের মধ্যে জেগে ওঠে বিশেষ স্বাতন্ত্র চেতনা। দেখা দেয় পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে আপন বৈশিষ্ট্য ও স্বার্থ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে একটি জাতীয় জনসমাজ আধুনিক অর্থে একটি জাতিতে পরিণত হয়। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ইতিহাস বহুলভাবে বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজের জাতীয় রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার ও রক্ষার সংগ্রামের ইতিহাস।
সংগ্রামী অভিনন্দন
ভিয়েতনামে নির্বাচন
‘জয়বাংলাকে’ সংগ্রামী অভিনন্দন জানাই। ভিয়েতনামের মার্কিনী পৃষ্ঠপোষকতায় অনুষ্ঠিত তথাকথিত নির্বাচনে গণতন্ত্রী বিশ্বের সকলের চোখ খুলে দেওয়া উচিত। মার্কিনী সমর্থক পত্রপত্রিকা পর্যন্ত বলছেন, এ নির্বাচন ‘ওয়ান ম্যান শো’ এবং নির্বাচনী প্রহসন। ওদিকে মার্কিনী সেনাধ্যক্ষ (সায়গনে অবস্থিত) নাকি প্রেসিডেন্ট থিউর সামরিক প্রতিদ্বন্দ্বীগণকে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তার বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভ্যুত্থানের চেষ্টা করা হলে তারা নীরব দর্শক হয়ে থাকবেন না। অর্থাৎ ভিয়েতনামে গণতন্ত্রের নামে নিক্সন সাহেব তার তাবেদার আরেকজনকে ডিরেক্টরকে বহাল তবিয়তে রাখতে চান। গোটা দুনিয়ায় আজ নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন ইয়াহিয়া, থিউর মতো বর্বর দেশদ্রোহী ফ্যাসিস্টদের মিত্র, গণতন্ত্র ও গণতান্ত্রিক সরকারের নয়। সুতরাং বাংলাদেশ সমস্যা নিরসনে সরকার কি ভূমিকা গ্রহণ করবেন, সে সম্পর্কে আমাদের মনে কোন সংশয় থাকা উচিত নয়।
-বেলায়েত হোসেন
সূর্যসেন সড়ক,
মুজিবনগর বাংলাদেশ
পূর্ব-পশ্চিম রণাঙ্গণে হানাদার দস্যুদের নাভিশ্বাস
ঢাকা
ঢাকা জেলার আড়াইহাজার থানাধীন কামসদিচার এলাকায় মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে ১১জন হানাদার সৈন্য খতম হয়। এই অঞ্চলের একটি বাড়ি থেকে গেরিলা যোদ্ধারা ২৪ গ্রাম্যবালিকাকে উদ্ধার করেন। এদের পাকিস্তানী সৈন্যরা আটক করেছিল।
উক্তদিন নোয়াখালী জেলার ফেনী মহাকুমার মুন্সিরহাট ও ফুলগাজীর মধ্যে অস্ত্র-শস্ত্র , গোলাবারুদ ও রেশনবাহী একটি রেলওয়ে ট্রলি ট্যাঙ্কবিধ্বংসী মাইনে উড়ে যায়।
৩০শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লার জামবাড়ি এলাকায় মুক্তি বাহিনীর আক্রমণে ৪ জন সেনা নিহত হয়।
গত ২৮শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার কসবার কাছে কারুমপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও দখলদার সৈন্যদের মধ্যে তিন ঘণ্টাব্যাপী প্রচন্ড সংঘর্ষ হয়। এটি ৩৫ জন খান সেনা নিহত হয়। মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা মর্টার ও মেশিনগান নিয়ে হানাদার ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়েছিলেন।
অন্য এক খবরে প্রকাশ, গত ২৮শে সেপ্টেম্বর মুক্তি বাহিনী মোতায়েনের নিয়ে আঁধারমানিক এলাকায় পাক সৈন্যের উপর আক্রমণ চালায়।
গত ২৮শে ও ২৯শে সেপ্টেম্বর মুক্তি বাহিনীর বীর যোদ্ধারা অমরখানা ও জগদল হাটে দুটি পাকিস্তানি ঘাঁটির উপর আক্রমণ চালিয়ে ৫১ জন পাকিস্তানী সৈন্য কে হত্যা করেছেন। তাছাড়া আক্রমণ খানসেনা গুরুতরভাবে আহত হয়েছে।
নোয়াখালী জেলার ফেনী মহাকুমার নোয়াপাড়া অঞ্চলের স্বাধীনতাকামী যোদ্ধা ও পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে প্রচন্ড সংঘর্ষের পর কমপক্ষে ২১ জন সেনা নিশ্চিহ্ন হয়ে যায়। এছাড়া আরো ২০ জন গুরুতররূপে আহত হয়।
ফেনী মহাকুমার পরশুরাম আর চিতলিয়ার মধ্যবর্তী স্থানে এক গুরুত্বপূর্ণ কালভার্ট ওই অঞ্চলের সৈন্য চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
গত ২রা ও ৩ রা অক্টোবর সিলেটের রাধানগর ও জয়ন্তীপুরে মুক্তিযোদ্ধা ও পাকিস্তানী সৈন্যদের মধ্যে সংঘর্ষে ১২ জন সেনা নিহত ৩৭ জন আহত হয়।
জলা অঞ্চলে সান্ধ্য আইন
মুক্তবাহিনীর দুঃসাহসিক যোদ্ধাদের ব্যাপক আক্রমণে পাকিস্তানি জঙ্গি সরকার ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে এক্ষণে সামরিক আইন প্রশাসক ব্রাহ্মণবাড়িয়া, কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহ জেলার অঞ্চলগুলোতে অনির্দিষ্টকালের জন্য সান্ধ্য আইন জারি করেছে। ওইসব এলাকায় সামরিক কর্তৃপক্ষ সাধারণ লোকের সমস্ত নৌকা জবর দখল করেছে।
স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ২৮শে সেপ্টেম্বর তারিখে বাহাদুরাবাদ ঘাটে পাকিস্তানি সৈন্য বাহিনী একটি লঞ্চের উপর আক্রমণ চালিয়ে ২০জন পাক সেনাকে হতাহত করেছেন।
কুমিল্লা নোয়াখালীতে বহু খান সেনা হতাহত
গত ৩০ শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের কুমিল্লা নোয়াখালী অঞ্চলের মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা কয়েকটি রেলসেতু উড়িয়ে দেওয়ার ফলে কুমিল্লা-নোয়াখালী মধ্যে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছে। এই অঞ্চলের মুক্তি বাহিনীর হাতে ৬১ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়। উত্তর কুমিল্লার আনন্দপুর গেরিলারা তিনজন কুখ্যাত রাজাকার সহ আটজন দস্যু খতম করেন।
দালাল হালাল চলছে
দখলীকৃত বাংলাদেশের চাঁইদালাল, পাতিদালাল এবং দালালের দালালরা সামরিক অপচ্ছায়াকেই তাদের কথা ভেবে পরম নিশ্চিন্তে দেশদ্রোহিতার মহান ব্রত পালন করে চলেছিল। কিন্তু মহাসমারোহে দালাল নিধণের কাজ চলতে দেখে তাদের চোখে মুখে এখন মৃত্যুর আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। সামরিক জান্তার বাহু আর তাদের রক্ষা করতে পারছেনা। এমনকি মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের আক্রমণ থেকে ইয়াহিয়া খানের খাস নফর ডাক্তার মালিকের তাবেদার মন্ত্রিসভার সদস্যদেরও রেহাই নেই। এই আক্রমণ কখন কোন দিক থেকে আর কিভাবে আসবে বুঝতে না পেরে তাদের আতঙ্ক আরো শতগুণে বৃদ্ধি পেয়েছে। পাকিস্তানের সামরিক সরকার এই তাবেদারদের জন্য পাহারাদারদের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও কঠোর করা সত্ত্বেও দালালরা আত্মরক্ষা করতে পারছে না।
সম্প্রতি ডাক্তার মালিকের তাবেদার মন্ত্রিসভার সদস্য জামাতপন্থী মাওলানা ইসহাক এবং তার গাড়ির ড্রাইভার বোমা বিস্ফোরণে আহত হয়েছে। পাকিস্তানি বেতারের খবরে এই ঘটনাটিকে মেয়াদী বোমার বিস্ফোরণ বহুল অনুমান করা হয়েছে।
শুধু ইনিই নন। চট্টগ্রামের কুখ্যাত ফ,কা, চৌধুরীর গুণধর পুত্র স্বঘোষিত ব্রিগেডিয়ার নুরুল কাদের চৌধুরীর সম্প্রতি বোমার আঘাতে আহত এবং তার ড্রাইভার নিহত হয়েছেন। ফ, কা, চৌধুরীর এ গুণধর নন্দনটি নির্বাচনের পর চট্টগ্রামে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। সামরিক অভিযান শুরু হবার পর চট্টগ্রামে হাজার হাজার লোককে এই ব্যক্তি হত্যা করেছে। কিন্তু মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় পাশার দান উল্টে যাওয়ায় পুত্র-স্নেহাতুর পিতা ফ,কা, চৌধুরী পুত্র নুরুল কাদেরকে ওয়াশিংটনের নিরাপদ দূরত্বে পাঠাবার ব্যবস্থা করেন।
গত ১লা অক্টোবর হাজীগঞ্জের বিশমাইল উত্তর-পশ্চিমে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা একটি কারখানার পাকিস্তানি সৈন্যদের উপর আক্রমণ চালান। ঘটনাস্থলে কয়েকজন প্রতিপক্ষ সৈন্য হতাহত হয়।
গত ২৭শে অক্টোবর মুক্তি বাহিনি আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে দুইজন পাকিস্তানি সেনাকে হত্যা করেছেন। ঐদিনের দিনাজপুর জেলার ঠাকুরগায়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংঘর্ষে ৬ জন দস্যু সৈন্য খতম হয়।
ওয়াশিংটনে নির্বাসন যাত্রা উপলক্ষে চট্টগ্রাম এর দালালরা একটি সংবর্ধনা সভার আয়োজন করেছিল। কিন্তু কপালের ফেরে সেই সংবর্ধনা সভা থেকে বেরিয়ে গাড়িতে ওঠার সঙ্গে সঙ্গে তাকে বোমার শিকারে পরিণত হতে হয়।
বঙ্গবন্ধুর বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার ষড়যন্ত্র
এপ্রিল থেকে জুলাই পর্যন্ত এই চার মাস সময় কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা এবং সেনাবাহিনীর গোয়েন্দা সংস্থা মিলিতভাবে ঢাকার ১১ নম্বর মিন্টো রোডের একটি গোপন বাঙালি সমাজের বিশিষ্ট ব্যক্তিদের পাকিস্তান দন্ডবিধির ১৬৪ ধারা মতে পূর্বাহ্নে প্রস্তুত বিবৃতিতে সই আদায় করে নেয়। গোয়েন্দা সংস্থা দুটি বাঙালি জাতির চেতনার দীক্ষাগুরু ও মুক্তিসংগ্রামের অগ্রনায়ক শেখ সাহেবের বিরুদ্ধে মামলা সাজানোর জন্য নিজেরাই অভিযোগ এবং বিবৃতি তৈরি করে সন্ত্রাসের চাবুক হেনে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমদানি করা ই,এ, হাসমী নামক প্রথম শ্রেণীর ম্যাজিস্ট্রেট কে দিয়ে অভিযোগ বিবৃতিতে সই আদায় করে নেয়। এই বিবৃতিতে সই করার পর যাতে কোনো সাক্ষী পালাতে না পারে সেজন্য তাদের সশস্ত্র সামরিক মহড়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয় এবং তাদের অনেককেই কোন ক্যান্টনমেন্টে আটক রাখা হয়েছে।
এই তথাকথিত বিচারে সভাপতিত্ব করছেন ইয়াহিয়ার জনৈক স্নেহাস্পদ লেফটেন্যান্ট জেনারেল। জঙ্গী আদালতে বিচার শুরু হওয়ার পূর্ব থেকেই এবং বিচার চলাকালীন সময়েও জঙ্গী নায়ক ইয়াহিয়া বিচারে শেখ মুজিবুর রহমানের প্রাণদণ্ড বলে হুমকি দিয়েছে এবং বাঙালির প্রাণ প্রিয় নেতাকে একজন ক্রিমিনাল বলে আখ্যায়িত করার মধ্যযুগীয় ধৃষ্টতা দেখিয়েছে।
শেখ মুজিব যদিও এই তথাকথিত বিচারে তার পক্ষ সমর্থনের জন্য কোনো আইনজীবী নিয়োগে অস্বীকৃতি জানিয়েছেন তবু আইনের কোটিং দেওয়ার জন্য ইয়াহিয়া সিন্দুর আইনজীবী এ, কে, ব্রোহীকে বিবাদীপক্ষের কৌশলী নিয়োগ করেছে বলে সংবাদ প্রচার করা হয়েছে।
অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের দপ্তর থেকে প্রচারিত ঘোষনায় আরও বলা হয়েছে যে শেখ সাহেবের বিচার ৭ই সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়েছে। অভিযোগঃ শেখ মুজিব পাকিস্তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।
ইয়াহিয়ার দপ্তরের ঘোষণায় আরো বলা হয়েছে, মামলার অগ্রগতি সম্পর্কে সময় সময় সংবাদ প্রচার করা হবে।
স্বাধীনবাংলা স্থায়ী হওয়ার জন্যই কায়েম হয়েছে
-মনসুর আলী
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন যে, পৃথিবীর মানুষ আজ উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে, স্বাধীন বাংলাদেশ চিরস্থায়ী হবার জন্যই কায়েম হয়েছে।
বাংলাদেশ মুক্তিসংগ্রামের ৬ মাস পূর্তি উপলক্ষে প্রদত্ত বিবৃতিতে বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানের বর্বর সেনাবাহিনী যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তা ইতিহাসে বর্ণিত যাবতীয় ধ্বংসলীলাকে ম্লান করে দিয়েছে। আমাদের দেশ প্রেমিক জনগণ ও বিক্রমশালী মুক্তিবাহিনী প্রতিরোধ সংগ্রামের ক্ষেত্রে নতুন ইতিহাস সৃষ্টি করেছেন।
জনাব আলী দৃঢ়তার সঙ্গে বলেন, আমাদের পবিত্র মাতৃভূমি থেকে সর্বশেষ পাঞ্জাবির সঙ্গে সম্পূর্ণ তাড়ানো পর্যন্ত এই সংগ্রাম চালিয়ে যেতে আমরা বদ্ধপরিকর। সূচনায় আমরা কোন প্রকার সশস্ত্র সংগ্রামের জন্য প্রস্তুত ছিলাম না, এই যুদ্ধ আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে। পৈশাচিক সামরিক জান্তা যা আরম্ভ করেছে তারা চিরদিনের জন্য শেষ করে দেওয়ার দায়িত্ব আমাদেরই।
জনাব আলী বলেন, কোনো সন্দেহ নেই যে, আমরা অনেক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছি। খুব সম্ভব ভবিষ্যতে আরো অনেক ক্ষতির স্বীকার নিতে হবে, কিন্তু মাতৃভূমির জন্য যেকোনো মূল্যে এক স্বীকার করতে আমরা প্রস্তুত।
তিনি বলেন, হাজার হাজার দেশপ্রেমিক নাগরিক মুক্তিসংগ্রামে আত্মবিসর্জন দিয়েছেন। তাদের শাহাদাতের মর্যাদা রক্ষা করতে আমরা অঙ্গিকার বদ্ধ।
বিদেশের যেসব শুভানুধ্যায়ী এই সংগ্রামে সাহায্য দান করেছেন জনাব মনসুর আলী তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
দালালদের দ্বৈরথ
দখলীকৃত বাংলাদেশের তাবেদার মহলে ইতিমধ্যেই জীব বিশেষের খেয়োখেয়ি শুরু হয়ে গিয়েছে। শোনা যাচ্ছে যে কাউন্সিল মুসলিম লীগের দুজন সদস্যকে পূর্ববঙ্গ মন্ত্রিসভায় গ্রহণ করায় কাউন্সিল লীগ যৎপরনাস্তি ক্রুদ্ধ হয়েছে। খবরটি করাচির ডন পত্রিকার। দলের অনুমতি না নিয়ে মল্লিক ডাক্তারের অধীনে প্রাদেশিক মন্ত্রী সভায় যোগদান করা মাইনকারচর এর আবুল কাশেম এবং নওয়াজেশ আহমদ কে দল থেকে বহিষ্কার করা হবে বলে শোনা যাচ্ছে।
আহা, বেচারা শফিকুল ইসলাম ও খাজা খয়ের উদ্দিন! হাঁড়ির খবর প্রকাশ, মন্ত্রীত্বের শিখে তাদের ভাগ্যে না ছেঁড়ার ফলেই বঞ্চিত দল গোঁসা করেছে। বেচারারা এত দুর্নাম আর প্রাণহানির বিপদ মাথায় নিয়ে শান্তি কমিটি গঠন করে দেশপ্রেমিকদের নিধনকারীদের জল্লাদদের সহযোগিতা করেছিল, অথচ দুদিনের জন্য হলেও মন্ত্রিত্বের মসনদে বসতে পারলো না, এ কি কম আফসোসের কথা!
সেই জন্যই এখন পূর্বাহ্নে অনুমতি গ্রহণের নিয়ম তান্ত্রিক প্রশ্ন উত্থাপন করা হয়েছে। কিন্তু শফিকুল ইসলাম ও খাজা খাইরুদ্দিন গোষ্ঠীর যখন শান্তি কমিটির নেতৃত্ব গ্রহণ করে ইয়াহিয়ার অবৈধ অনিয়মতান্ত্রিক কার্যকলাপের প্রতি প্রত্যক্ষভাবে সহযোগিতা দান করতে এগিয়ে এসেছিল তখন কি তারা নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে দলের অনুমতি গ্রহণ করেছিল? ইয়াহিয়া খান ও তার বর্বর বাহিনী যখন বাংলাদেশে নৃশংসতম হত্যাকান্ড শুরু করেছিল, যখন নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের ওপর নির্যাতন চালানো ও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আস্থাভাজন রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠানকে বেআইনি ঘোষণা করা হয়েছিল তখন তাদের রাজনৈতিক ও সাংগঠনিক নিয়মতান্ত্রিকতা কোথায় ছিল সে প্রশ্ন না হয় স্থগিতই থাক।
তবে ক্ষমতা ত্যাগ ষড়যন্ত্রের রাজনীতি যাদের আবোহনের সোপান তারা একে অপরের কাছ থেকে ল্যাং খেলে কামড়াকামড়ি শুরু করবে এ তো জানা কথা।
কিন্তু এই বহিষ্কারের শাসানীতে কাশেম-নওয়াজেসের ভয় পাবার কিছু নেই। পাকিস্তানের রাজনীতির সর্বময় কর্তৃত্ব যে সামরিক বাহিনীর হাতে, তার কৃপা দৃষ্টি যতদিন থাকবে ততদিন অপর দালালদের ভয়ে ভীত হবার কোন কারণ নেই। প্রয়োজন হলে কাশেম নওয়াজেসরাই অপরপক্ষকে সংহতি বিরোধী কার্যকলাপের দায়ে বহিষ্কার করতে পারবে।
তবে বহিষ্কার তারা অবশ্যই হবেন, এ দুনিয়ার মাটি থেকেই বহিস্কৃত হবেন, আর সে দায়িত্ব গ্রহণ করেছে বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা। তারা যেদিন আঘাত হানবে সেদিন তাদের কোনো প্রভুই রক্ষা করতে পারবে না।
বিজয় উপলক্ষে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর শুভেচ্ছা বাণী
আজ অত্যন্ত সংকটজনক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশের হিন্দু সম্প্রদায়ের জীবনে আনন্দময়ীর আগমন ঘটেছে। এদিকে স্বজন হারানোর বেদনা, অন্যদিকে জন্মভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রাম এর মধ্যে মুক্তাঞ্চলে ও শরণার্থী শিবিরে দূর্গা পূজার অনুষ্ঠান করছেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পক্ষ থেকে আমি তাদেরকে বিজয়ের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। আর দখলীকৃত এলাকা যারা পুজা অনুষ্ঠানের স্বাধীনতা হারিয়েছেন তাদের কে গভীর সমবেদনা জ্ঞাপন করছি।
এই উপলক্ষে আমি স্বদেশবাসীকে আরেকবার বলতে চাই যে, দেশকে সম্পূর্ণরূপে শত্রুমুক্ত করার দিনটি ঘনিয়ে এসেছে। আমি আশ্বাস দিতে চাই যে, ফ্যাসিবাদী হানাদারের বিতাড়িত করে আমরা যে ধর্মনিরপেক্ষ সমাজ গড়ে তুলবো সেখানে সকল সম্প্রদায়ের ধর্মীয় স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হবে।
চূড়ান্ত বিজয় বাঙ্গালীদের হাতের মুঠোয়
আফগান মিল্লাত পত্রিকার প্রধান সম্পাদক জনাব কুদরতুল্লাহ হাদাদ জোর দিয়ে বলেন যে, তিনি স্থির নিশ্চিত, বাংলাদেশের জনগণের চূড়ান্ত বিজয় বাঙ্গালীদেরই হাতের মুঠোয় রয়েছে। তিনি বলেন যে, অচিরেই বাংলাদেশের জনগণ দেশত্যাগী শরণার্থী ভাই-বোনকে দেশে ফিরিয়ে নিতে সক্ষম হবেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে সমস্যা, আন্তর্জাতিক সমস্যা’, মুসলমানদের সমস্যা, মানসিক সমস্যা এবং সর্বোপরি এই অঞ্চলের শান্তি ও নিরাপত্তার সঙ্গে ঘনিষ্ঠভাবে সম্পর্কিত সমস্যা বলেই তিনি বাংলাদেশকে সমর্থন করেন।
জনাব হাদাদ বলেন যে, তিনি জুলুমের প্রতিবাদ করার আফগান ঐতিহ্য অনুসরণ করেছেন এবং স্বাভাবিক কারণেই বাংলাদেশের জনগণের সমর্থন জানিয়েছেন।
তিনি বাংলাদেশের সমস্যার পাশাপাশি পাখতুনিস্তানের সমস্যার কথাও তুলে ধরেন এবং শান্তিপূর্ণ গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধানের সকল পথ সামরিক শক্তি দিয়ে রুদ্ধ করে তিনি কঠোর ভাষায় তার নিন্দা করেন। তিনি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেন যে, বাংলাদেশের জনগণের উপর কোন বৈদেশিক কর্তৃত্ব চাপিয়ে দেওয়া যাবে না।
তিনি ইয়াহিয়াকে বিপর্যয় বন্ধ করার জন্য অনুরোধ করেন এবং বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাকে মেনে নেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বালুচ ও পাখতুনদের অধিকারকে মেনে নেওয়ার জন্য ও ইয়াহিয়াকে অনুরোধ জানান।
শিল্প ও সংস্কৃতি
দেশ মুক্তির গান
শ্রী নৃপেন্দ্র কুমার বসু
(ভাইরে) দেশের মুক্তি হাতের মোয়া নয়,
তাকে ছিনিয়ে নিতে হয়;
(গায়ের জোরে লড়াই করে ছিনিয়ে নিতে হয়)।
(প্রাণে) ভক্তি রেখে শক্তি ধ’রে
বুকের রক্ত করে ক্ষয়,
তাকে ছিনিয়ে নিতে হয়।।
আছে জঙ্গিশাহীর প্রচুর সৈন্যদল
কত কামান, বিমান, গোলা-বারুদ,
মানুষ-মারা কল;
আছে তোমার শুধু ধৈর্য , সাহস, মনের বল
(সবার) জাগাতে বিস্ময়।।
ঘর শত্রুদের আগেই খতম করো,
তারপরেতে দুশমনের টুঁটি টিপে ধর।
মারো তাদের অন্নবস্ত্রে, ধনে প্রাণে-অস্ত্রে শস্ত্রে,
লাগাও প্রাণে দারুন ভয়।।
লাখ পঞ্চাশেক মরেই যদি,
সাত কোটি তো বাঁচবে;
শোকের অশ্রু মুছে বাংলা
সোনার হাসি হাসবে।
হবে ইয়াহিয়ার দর্প চূর্ণ, শেখ মুজিবের স্বপ্ন পূর্ণ,
পাক দানোরা শোবে গোরে
বীর বাঙ্গালীর হবে জয়।।
আত্ম নির্ধারণ নীতি ও বাংলাদেশ
(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)
বাংলাদেশের যা ঘটছে তাহল একটি জাতীয় জনসমাজের(Nationality) আত্ম নির্ধারণ (self determination) অধিকার প্রতিষ্ঠার যুদ্ধ। বাংলাদেশের যা ঘটছে, তা নজিরবিহীন নয়। বাঙালি আজ যে দাবি তুলেছে, ইতিহাসে অন্যান্য অনেক জাতীয় জনসমাজ তা আগে দাবি করেছে। বাঙ্গালীদের আজকের দাবিতে অভাবনীয় ও অভূতপূর্ব কিছু নয়। আন্তর্জাতিক আইন শৃঙ্খলা বিরোধী ও নয়।
জাতীয় জনসমাজ বলতে বোঝায় এমন একটি জনসমষ্টির যারা ভাষাগত দিক থেকে এক। যারা বাস করে একটি নির্দিষ্ট ভূখন্ডে। যারা নিজেদের মধ্যে অনুভব করে রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক স্বার্থের ঐক্য। এই ঐক্যবোধ সৃষ্টি হয় ইতিহাসের ধারায়। যখন, কোন জাতীয় জনসমাজের লোক, অন্য জাতীয় জনসমাজের লোকদের থেকে নিজেদের পৃথক করে নিতে চায়, তখন উদ্ভব হয় বিশিষ্ট জাতীয়তাবাদের। প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজ গড়ে ওঠে ইতিহাসের ধারায়। ইতিহাসের ধারায় তাদের মধ্যে জেগে ওঠে বিশেষ স্বাতন্ত্র্য চেতনা। দেখা দেয় পৃথক রাষ্ট্র গঠন করে আপন বৈশিষ্ট্য ও স্বার্থ সংরক্ষণ প্রচেষ্টা। স্বাধীন-সার্বভৌম রাষ্ট্র গঠনের মাধ্যমে একটি জাতীয় জনসমাজ আধুনিক অর্থে একটি জাতিতে (Nation) পরিণত হয়। আধুনিক যুগের রাজনৈতিক ইতিহাস বহুলভাবে বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজের জাতীয় রাষ্ট্র (Nation -state) প্রতিষ্ঠার ও রক্ষার সংগ্রামের ইতিহাস।
প্রত্যেক জাতীয় জনসমাজ চায় তার আপন চরিত্র বজায় রাখতে। একটি জাতীয় জনসমাজ তার মধ্যে অনুভব করে উৎপত্তিগত, ভাষাগত, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক স্বার্থ গত ঐক্য। ইচ্ছা ও স্বার্থ থেকে আসে এক জাতি এক রাষ্ট্রের যুক্তি।
গত শতাব্দীতে বিখ্যাত ব্রিটিশ রাজনৈতিক দল শনি ও অর্থনৈতিক জন স্টুয়ার্ট মিল ঘোষণা করেন যে, প্রত্যেকটি স্বাধীন রাষ্ট্র গঠিত হওয়া উচিত একেকটি জাতীয় জনসমাজের ভিত্তিতে। তাই এই নীতিই আত্ম নির্ধারণের নীতি রূপে খ্যাত (right of self-determination) ।
মিলের মতে যখন কোন জাতীয় জনসমাজের মনে তার আত্মসাতন্ত্রের ধারণা প্রবল হয়ে ওঠে, তখন তাকে স্বতন্ত্র রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার অধিকার দেওয়া উচিত। কারণ, এই পথেই সম্ভব যুদ্ধ-বিগ্রহ এড়ানো, স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠা।
মিলের যুক্তি নতুন করে শোনা যায় প্রথম বিশ্বযুদ্ধের সময়। এ সময়কার বিখ্যাত মার্কিন প্রেসিডেন্ট উড্রো উইলসন বলেন, বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজকে স্বাধীন স্বতন্ত্র রাষ্ট্র গড়বার অধিকার দিলে পৃথিবী থেকে যুদ্ধের সম্ভাবনা অনেক কমে যাবে। এসময় এক একটি জাতীয় জনসমাজকে নিয়ে এক একটি আলাদা রাষ্ট্র (mono -national state) গড়বার দাবি ইউরোপে প্রবণ হয়ে ওঠে।
প্রথম মহাযুদ্ধের পর পুরান austro-hungarian ভেঙে গিয়ে অস্ট্রিয়া-হাঙ্গেরি, – দুটি আলাদা রাষ্ট্রে পরিণত হয়। পোল্যান্ড একটি নূতন রাষ্ট্র হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে। আরো নানা পরিবর্তন ঘটে ইউরোপের মানচিত্রে। প্রথম মহাযুদ্ধের পর বিভিন্ন জাতীয় জনসমাজের পৃথক রাষ্ট্র গঠনের অধিকারের দাবী এত প্রবল আকার ধারণ করে যে, রাশিয়ায় বলশেভিক বিপ্লবের পর, বিপ্লবীদের মেনে নিতে হয় যে রুশ ও সাম্রাজ্যের চেহারা হবে একটি যুক্তরাষ্ট্রের। এই রাষ্ট্রে সমস্ত জাতীয় জনসমাজের থাকবে আত্মনির্ধারণের সমান অধিকার। যদি প্রয়োজন হয়, তবে এই যুক্তরাষ্ট্রের মধ্য থেকে যে কোন জাতীয় জনসমাজ আলাদা রাষ্ট্র গঠন করতে পারবে। পরিণত হতে পারবে স্বাধীন সার্বভৌম জাতিতে।
আত্ম নির্ধারণের অধিকার সব জাতীয় জনসমাজের থাকা উচিত, একথা জাতিসংঘের সনদেও বলা হয়েছে [আর্টিকেল 1 (2)] আত্ম নির্ধারণবাদ তাই বর্তমান বিশ্বে একটি জীবন্ত বাস্তবতা, মৃত অতীতের মতবাদ নয়। বাংলাদেশের মানুষ আকার নির্ধারণ নীতির যুক্তির উপর ভিত্তি করেই তার স্বাধীনতা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে। আধুনিক রাজনৈতিক বিজ্ঞান এর পক্ষ থেকে তাই তাকে সমর্থন না জানিয়ে পারা যায় না।
জাতীয় জনসমাজের ভিত্তিতে একটি নতুন রাষ্ট্র গড়তে গেলে নানা বাস্তব সমস্যার সম্মুখীন হতে হয়। এর মধ্যে একটা বড় সমস্যা হল, নতুন সীমান্তরেখা প্রতিষ্ঠার সমস্যা। দুটি নতুন রাষ্ট্রের ভৌগোলিক সীমানা নির্ধারণের জন্য ঘটতে পারে অনেক রক্তপাত।
কিন্তু বাংলাদেশের ক্ষেত্রে এই সমস্যা নেই। বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক সীমানা রেখা আগে থেকে নির্ধারিত হয়ে আছে। তাই বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের একটা স্বাধীন সার্বভৌম জাতি হিসেবে স্বীকৃতি দেবার পথে ভৌগলিক দিক থেকে কোনো বাস্তব বাধা নেই। বাধা নেই, আত্ম নির্ধারণ নীতি প্রয়োগের।