You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ৪ অক্টোবর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পৃষ্ঠা ১

হয় জিতবো না হয় ধ্বংস হয়ে যাবো তবু…

– সৈয়দ নজরুল ইসলাম

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্র প্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশে ইয়াহিয়া জল্লাদ চক্রের ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা শুরুর পর ঐক্যবদ্ধ বাঙালী জাতির মরণজয়ী  স্বাধীনতা সংগ্রামের ছ’মাস পুর্তি উপলক্ষে চাপিয়ে দেয়া যুদ্ধ শেষ নিঃশ্বাস পর্যন্ত চালিয়ে যাওয়ার দৃঢ সংকল্প করে বলেছেন যে, আমরা হয় জিতবো নয় জাতি হিসেবে নিশ্চিহ্ন হয়ে যাবো, তবু আত্মমর্যাদায় উদ্বুদ্ধ বাঙ্গালীর মস্তক ইয়াহিয়াশাহীর সঙ্গীনের সন্ত্রাসের সামনে মাথা নত করবে না।

২৫শে সেপ্টেম্বর রাতে যুদ্ধরত বাঙালী জাতির আশা আকাঙ্ক্ষার সম্মিলিত কন্ঠ স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে আবেগ ও সংকল্পে উদ্বুদ্ধ ৪৫ মিনিট স্থায়ী এক ভাষণে অস্থায়ী রাস্ট্র প্রধান মুক্তি সংগ্রামের বিভিন্ন গৌরবোজ্জ্বল দিক পর্যালোচনা করেছেন, বাঙালী জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নিঃশর্ত মুক্তি দাবী করেছেন এবং বাংলাদেশ সরকারের প্রতি স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্ব রাষ্ট্র সমূহের কাছে উদাত্ত আহ্বান জানিয়েছেন।

বেতার ভাষণে অস্থায়ী রাস্ট্র প্রধান ঘোষণা করেন যে, বাংলাদেশ মুক্তি বাহিনীকে নৌ ও বিমান বহর দিয়ে সজ্জিত করা হচ্ছে।  তিনি গর্বের সাথে উল্লেখ করেন যে, মুক্তি বাহিনীর নৌ শাখা ইতিমধ্যেই চালনা, মঙ্গলা ও চট্টগ্রাম বন্দরে বীরত্বপূর্ণ তৎপরতা চালিয়ে অনেকগুলো শত্রুজাহাজ ডুবিয়ে দিয়েছে।

(ভাষণের পূর্ণ বিবরণ আগামী সংখ্যায়)

***

ভারত-সোভিয়েট যুক্ত ইস্তাহার

‘”জনগণের আইনানুগ স্বার্থ, অধিকার এবং ইচ্ছার প্রতি সম্মান রেখে ” পূর্ব বাংলায় সৃষ্ট  পরিস্থিতির ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ জন্য ভারত এবং সোভিয়েট ইউনিয়ন গুরুত্ব আরোপ করেছেন।

মস্কো সফরকারী ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধীর সাথে বাংলাদেশ সহ উভয় রাষ্ট্রের পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সোভিয়েট নেতা মিঃ ব্রেজনেভ, পদগর্নি এবং কোসিগিনের সাথে আলোচনার পর যুক্ত ইস্তাহার প্রকাশিত হয়েছে। 

যুক্ত ইস্তাহারে বলা হয়েছে যে, এ জাতীয় সমাধানের ফলেই লাখ লাখ শরনার্থীদের স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের নিশ্চয়তা বিধান হবে।

কোসিগিনের বক্তৃতা

সোভিয়েট রাশিয়ার প্রধান মন্ত্রী মিঃ কোসিগিন বাংলাদেশ পরিস্থিতির রাজনৈতিক মিমাংসার জন্য “সবচেয়ে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহন” এবং তথাকার “জনগণের আইন সঙ্গত বৈধ অধিকারের” প্রতি লক্ষ্য রেখে যত শীঘ্র সম্ভব সমাধানের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেছেন। 

***

রক্ত যতই দিতে হোক না কেন মাতৃভূমিকে মুক্ত করবোই

– প্রধান সেনাপতি

গত ২৫শে সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এক ভাষণে মুক্তি বাহিনীর প্রধান সেনাপতি জেনারেল এম, এ, জি, উসমানী দ্ব্যর্থহীন কন্ঠে ঘোষণা করেনঃ আমরা অন্যায় ও অবিচারের বিরুদ্ধে সত্য ও ন্যায়ের জন্য যুদ্ধ করছি। বাংলাদেশে সাড়ে সাত কোটি মানুষের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব রক্ষা এবং আমাদের জাতীয় পতাকার মর্যাদা সমুন্নত রাখার জন্য যুদ্ধ করছি৷ বাংলাদেশের পবিত্র ভূমি থেকে শেষ হানাদার সৈন্যটিকে নিশ্চিহ্ন করার আগে পর্যন্ত আমাদের এ যুদ্ধ ক্ষান্ত হবে না। জয় আমাদের অবধারিত।

কর্ণেল উসমানী বাংলাদেশের বীর মুক্তি বাহিনীর শৌর্যবীর্যের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করে বলেন, বাংলার বীর সন্তানেরা মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসে এক অভূতপূর্ব ও যুগান্তকারী দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন। উন্নত মানের অস্ত্রশস্ত্রে সজ্জিত এবং সংখ্যায় বহুগুণে বেশি শত্রুর বিরুদ্ধে তারা নিঃস্বার্থ, আত্মত্যাগ, কঠোর সংকল্প ও আত্বপ্রত্যয়ের সাথে লড়ে চলেছেন। এ পর্যন্ত তারা কম করে হলেও ২৫ হাজার শত্রু সেনাকে খতম করেছেন।

প্রধান সেনাপতি মুক্তি বাহিনীর সাংগঠনিক তৎপরতার বিষয় বিশ্লেষণ করে বলেন, আমাদের সুযোগ্য সামরিক অফিসারগণ মুক্তি বাহিনীকে দ্রুত সংগঠিত করে তুলছেন এবং বর্তমানে তারা একটি সুসংগঠিত বাহিনীতে পরিণত হয়েছে।  এতে রয়েছেন নিয়মিত সৈনিক, নাবিক এবং বৈমানিক। এজন্যই বাংলাদেশ বাহিনীকে মুক্তি ফৌজের বদলে মুক্তি বাহিনী বলা হয়ে থাকে।

নিয়মিত সৈনিক ছাড়াও যারা মুক্তি বাহিনীর প্রধান অঙ্গ এবং অতি বীরত্বের সাথে যুদ্ধ করে চলেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছে বহু অনিয়মিত বাহিনী,  বেসামারিক সেচ্ছাসেবক (গণবাহিনী)। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষিত ব্যাক্তি এবং ছাত্র থেকে শুরু করে শিল্প কারখানার শ্রমিক ও কৃষক যুবকসহ সকল স্তরের ফৌজদের নিয়ে এ বাহিনী গঠন করা হয়েছে।

প্রধান সেনাপতি বলেন, শত্রুর উপর আমাদের আঘাত দিন দিন দই প্রত্তোতর হচ্ছে। অন্যদিকে দিশেহারা শত্রু বাহিনী নিরস্ত্র মানুষকে হত্যা করে ‘বীরত্ব’ দেখাচ্ছে।

তিনি বলেন, আমাদের দুঃসাহসিক মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড আঘাতে তারা আজ আতঙ্ক গ্রস্থ। সদলবলে ছাড়া তারা আজ চলা ফেরা করতেও ভয় পায়। এর পরও তারা নিরাপদ বোধ করতে পারছে না। প্রতিদিনই আমাদের মুক্তি বাহিনী বিপুল সংখ্যক শত্রু সেনা খতম করে চলেছেন।

বাঙালীর জীবনমরণ প্রশ্নের এই সংকট সময়ে আজ যারা শত্রুর দালালী করছে, তাদের প্রতি কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করে প্রধান সেনাপতি বলেন, ন্যায়দণ্ড আজ শত্রুদের দালাল ও দেশদ্রোহীদের ওপরও নিপতিত হচ্ছে৷ রাজাকার সহ যারা শত্রুদের সাথে আজ সহযোগিতা করছে তাদেরকে তিনি অবিলম্বে একাজ থেকে বিরত হয়ে অস্ত্রশস্ত্র সহ মুক্তি বাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণের অনুরোধ করেন। যারা আত্মসমর্পণ করবে, তাদের প্রতি ভালো ব্যবহার করা হবে বলেও তিনি আশ্বাস দেন।

এছাড়াও তিনি অন্য সকলের৷ প্রতি মুক্তি বাহিনীর সাথে সর্ব প্রকারে শত্রু ধ্বংসের ব্যাপারে সহযোগিতা করার আবেদন জানান। তবে তিনি সকলাে মুক্তি বাহিনীর ব্যাপারে গোপনীয়তা রক্ষা করে চলার অনুরোধ জানান।

তিনি সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, কোন কোন বিশ্বাসঘাতককে সল্প সময়ের মধ্যে চরম শাস্তি দেওয়া হবে।

মুক্তি বাহিনীর বীরত্ব ও সাহসিকতার প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে প্রধান সেনাপতি বলেন, এই যুদ্ধে আমাদের অনেক ভাই শহীদ হয়েছেন, আহত ও পঙ্গু হয়েছেন কিন্তু মরার আগে তারা চল্লিশ গুণ বেশি শত্রু সৈন্যকে আহত বা নিহত করেছেন।

তিনি বলেন মুক্তি যুদ্ধে যারা শহীদ হয়েছেন তাদের পরিবারবর্গকে এককালীন এক হাজার টাকা ও তৎসহ তাদের থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করে দেবেন। যুদ্ধ শেষ হওয়ার পর তাদের মাসিক ভাতা দেওয়া হবে।  অক্ষম ব্যক্তিদের সুচিকিৎসা ও সমাজে পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা হচ্ছে।

***

বাংলাদেশ সমস্যার সামরিক না রাজনৈতিক সমাধান?

মহলবিশেষ কর্তৃক উড়ো খবর প্রচার

(জয়বাংলা প্রতিনিধি)

সম্প্রতি জাতিসংঘে সোভিয়েট ইউনিয়ন, কানাডা ও ফ্রান্স কর্তৃক বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান দাবী করা, ভারত সোভিয়েট ইউনিয়ন যুক্ত ইশতেহারে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ কথাটা ব্যবহার হওয়া প্রভৃতি ঘটনায় কোন কোন মহল বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ মহলে নৈরাশ্য দেখা দেওয়ার এবং ইয়াহিয়ার শর্তে রাজনৈতিক আপোষ আলোচনার সম্ভাবনার উড়ো খবর প্রচার করছেন। বাংলাদেশ সরকার এবং আওয়ামী লীগ মহলের সাথে যোগাযোগ করে জয়বাংলা প্রতিনিধি জানতে পেরেছেন যে, এই ধরণের নৈরাশ্য সৃষ্টি ও আপোষ আলোচনার সম্ভাবনা সম্পূর্ণ উড়ো খবর। আওয়ামী লীগ মহল দৃঢতার সাথে বলেন, রাজনৈতিক আলোচনার অর্থ নিশ্চিত ভাবেই আপোষ কিম্বা স্বাধীনতার ঘোষণা প্রত্যাহার করা নয়। বাংলাদেশের স্বাধীনতা দুই-ই উপায়ে অর্জিত হতে পারে – আলোচনা বৈঠক বা রাজনৈতিক মিমাংসার মাধ্যমে,  অথবা রণক্ষেত্রে যুদ্ধজয় বা সামরিক মিমাংসার মাধ্যমে।  ১৯৪৭ সালে ব্রিটেন রাজনৈতিক সমাধান মেনে নিয়ে ভারতীয় উপমহাদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছে। ভিয়েতনামে মুক্তি যুদ্ধ চলছে এবং সেই সঙ্গে মুক্তি যুদ্ধের প্রতিনিধিরা প্যারিসে অপর পক্ষের সঙ্গে আলোচনা বৈঠকে বসেছেন সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের আশায়। তারা নিজেদের ন্যায্য দাবী ছেড়ে দেননি।

বাংলাদেশেও বর্তমানে মুক্তি যুদ্ধ চলছে।  এই মুক্তি যুদ্ধ সার্বিক স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জিত না হওয়া পর্যন্ত অব্যাহত থাকবে। তবে ইয়াহিয়া চক্র যদি বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য রাজনৈতিক পদ্ধতিতে স্বীকৃত হয়, তাহলে কিভাবে আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে, বেশ কিছুকাল আগে রাষ্ট্র প্রধান নজরুল ইসলাম তার চার দফা শর্ত ঘোষণা করেছিলেন। এই চার দফা হচ্ছে,

(ক) অবিলম্বে বিনাশর্তে বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি প্রদান

(খ) সকল হানাদার সৈন্য বাংলাদেশ থেকে প্রত্যাহার

(গ) যে সব বাঙালী পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে, তাদের ক্ষতিপূরণ

(ঘ) গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের বৈধ অস্তিত্ব মেনে নেয়া।

একমাত্র এই চারটি শর্ত মেনে নেয়া হলে বিনা রক্তপাতে সমস্যা সমাধানের রাজনৈতিক পদ্ধতিতে অবশ্যই গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার এবং আওয়ামী লীগ মহল আগ্রহী হতে পারেন। সুতরাং রাজনৈতিক সমাধান বলতে তারা আপোষ বা ঘোষিত লক্ষ্য থেকে দূরে সরে যাওয়া মনে করেন না। তবে বাংলাদেশ সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান না হলে তারা সামরিক সমাধানকেই একমাত্র পন্থা মনে করেন – এবং যে পথ তারা ইতিপূর্বেই বেছে নিয়েছেন।

***

‘স্বাধীনতার জন্য মরতে দিন’

– মোস্তাক

স্বাধীনতা যুদ্ধের ছয় মাস পূর্তি উপলক্ষ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে পররাষ্ট্র মন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ শক্তি-ব্লকের স্বার্থে রাজনৈতিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে বাংলাদেশের রক্তকে ব্যবহারের বিরূদ্ধে কঠোর হুঁশিয়ারী উচ্চারণ করেছেন।

তার সরকারের বহু বিঘোষিত নীতির কথা উল্লেখ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রী দৃঢতার সাথে বলেন যে, পূর্ণ স্বাধীনতাই আমাদের একমাত্র লক্ষ্য।

খন্দকার মোশতাক আহমদ বলেন, জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর বাঁচা-মরার প্রশ্নে জাতিসংঘে কি আলোচনা ও সিদ্ধান্ত হয় তা প্রত্যক্ষ করার জন্য সারাবিশ্বের মুক্তিকামী মানুষ সাগ্রহে অপেক্ষা করছে৷ কিন্তু অতীব দুঃখের বিষয় কতিপয় সরকার ইয়াহিয়াদের সামরিক জান্তার ঔপনিবেশিক স্বার্থ সংরক্ষণ ও স্থায়ী করার জন্য বাংলাদেশ প্রশ্নে ধুম্রজাল সৃষ্টির চেষ্টা করছে।

অনুরূপ কতিপয় শক্তি বাংলাদেশ প্রশ্নে প্রকাশ্য মতামত দিতে শুরু করেছে এবং ‘রাজনৈতিক সমাধান’,  ‘মিমাংসা বোঝাপড়া ‘ প্রভৃতির জন্য ওকালতি করছে। এ প্রশ্নে আমাদের নীতি অতি স্পষ্ট, কোন শক্তি-ব্লকের স্বার্থে যখন কারো উপর তাদের রাজনৈতিক প্রভাব অক্ষুণ্ণ রাখার কাজে বাংলাদেশের রক্তস্রোতকে ব্যবহার করতে দেওয়া হবে না। 

পৃষ্ঠা ২

ছয় মাসের খতিয়ান

বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ছ’মাস পূর্তি হয়েছে। এই ছ’মাসে আমরা কতটা এগিয়েছি, কতজন শত্রুবধ করেছি সেটা বড় কথা নয়, বড় কথা বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার মুক্কিসাধন এবং লক্ষ লক্ষ শরনার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ত্বরান্বিত করার ব্যাপারে আমরা কতটা সাফল্য অর্জন করেছি। তাছাড়া বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় যে কোটি কোটি বাঙালী ইয়াহিয়ার দস্যু বাহিনীর নির্দেশে দুঃসহ জীবনযাপনে বাধ্য হয়েছেন, তাদের দূর্দশা মোচনের কাজেই বা আমরা কতটা এগিয়েছি?

এই প্রশ্নগুলোর ভিন্ন ভিন্ন জবাব দেবার প্রয়োজন নেই। কারণ, সকল প্রশ্নের জবাব একটিই, বাংলাদেশের স্বাধীনতা।

বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতা যদি অর্জিত হয়, তাহলে ভারতে আশ্রয়গ্রহণকারী লাখ লাখ শরনার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন যেমন নিশ্চিত ও দ্রুততর হবে, তেমনি দখলীকৃত এলাকার কোটি কোটি মানুষও জীবনের দুর্বিষহ অবস্থা থেকে মুক্ত হবে৷

বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান, প্রধান মন্ত্রী এবং প্রধান সেনাপতি তাদের বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ভাষণে এই সত্যটাই তুলে ধরেছেন যে, স্বাধীনতা অর্জন ছাড়া বাংলাদেশের দুর্গতি মোচনের অপর কোন দ্বিতীয় পথ নেই৷ এখন প্রশ্ন এই ঘোষিত স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে আমরা কতদূর এগুতে পেরেছি?

এই প্রশ্নটির জবাব দেবার আগে আরেকটি প্রসঙ্গের সংক্ষিপ্ত আলোচনা প্রয়োজন। দেশে ও বিদেশে সংখ্যায় অল্প হলেও এমন একটি মহল আছে, যারা বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের ব্যাপারে কিছুটা নৈরাশ্যবাদী।  তাদের ধারণা, ইয়াহিয়ার রণনীতি এবং কুটনীতি দুই ই সফল হতে চলেছে। আমরা এই ধরণের হতাশাবাদীদের প্রচারণার কোন জবাব দিতে চাই না। কারণ, প্রচারণা নয়, বাস্তব সত্য এবং তথ্যই বর্তমান পর্যায়ে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের একমাত্র সহায়ক শক্তি। বাস্তব  সত্য এই যে, গত ছয় মাসে ইয়াহিয়ার রণনীতি ব্যর্থ হয়েছে। বাংলাদেশ থেকে পাট, চা, তামাক এবং চামড়া রপ্তানী দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন যে একেবারেই হ্রাস পেয়েছে, বিদেশী সংবাদপত্রগুলোই তা স্বীকার করেছেন। তবে এও সত্য, অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সাময়িকভাবে কিছুটা বেড়েছে। তার কারণ শিল্পোন্নত লাহোর, করাচি, মুলতান এবং লায়ালপুর থেকে অধিক হারে বিদেশে শিল্প-সামগ্রী রপ্তানী। কিন্তু জঙ্গীচক্রের এই সাময়িক আর্থিক সুবিধা যে টেকসই কোন ব্যাপার নয়, করাচি ও লাহোরের পত্রপত্রিকাই তা স্বীকার করেছে। এসব পত্রিকার খবরেই প্রকাশ, বাংলাদেশ থেকে কাঁচামাল না পাওয়ায় এবং বাংলাদেশের বাজারে একচেটিয়া ভাবে পণ্য বিক্রির সুবিধা না থাকায় লাহোর, লায়ালপুর ও করাচির অনেক কারখানা বন্ধ হয়ে গেছে এবং অনেকগুলো বন্ধ হওয়ার মুখে। এইভাবে শিল্পোৎপাদন হ্রাস পেতে থাকলে ইউরোপে বা মধ্যপ্রাচ্যে শিল্পসামগ্রী রপ্তানী দ্বারা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনও আর সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে ৭২ ঘন্টায় কেন, ছ’মাসেও ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্র ‘স্বাভাবিক অবস্থা’ ফিরিয়ে আনতে পারেননি, এটা তাদের রণনীতির ব্যর্থতার সবচেয়ে বড় প্রমাণ। তাদের কুটনৈতিক ব্যর্থতার বড় প্রমাণ, শেষ পর্যন্ত বিশ্ব ব্যাংকের টাকার লোভে ও চাপে টিক্কাকে সরিয়ে ঢাকায় তাবেদার অসামরিক সরকার প্রতিষ্ঠা করতে হয়েছে। এতদ্সত্ত্বেও ঢাকায় নিযুক্ত বিশ্ব ব্যাংকের প্রতিনিধি পদত্যাগ করেছেন এবং বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ইয়াহিয়া চক্রের বর্বরতার কথা বিশ্ববাসীর কাছে আরেক দফা উদঘাটন করেছেন। জাতিসংঘে বাংলাদেশের প্রতিনিধিরা সাফল্যের সঙ্গে বাংলাদেশ সমস্যা বিশ্বসভার প্রতিনিধিদের কাছে তুলে ধরেছেন এবং সোভিয়েট ইউনিয়নের পক্ষ থেকে স্পষ্ট ভাষায় বলা হয়েছে, “বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার নয়।” সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে ফ্রান্স এবং কানাডাও বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান দাবী করেছেন।

‘স্বাধীনতা ‘ ছেলের হাতের নাড়ু নয় যে, কেউ রূপালী প্লেটে সাজিয়ে তা আমাদের এনে দেবে। স্বাধীনতা ভিক্ষার সামগ্রী নয়, অর্জনের সামগ্রী। এই স্বাধীনতা অর্জনে প্রতিবেশী গণতান্ত্রিক ভারত আমাদের যে সাহায্য ও সহযোগিতা দান করেছে, বাংলাদেশের মানুষ তা চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্বরণ করবে। মাত্র ছয় মাসে পৃথিবীর কোন জাতি স্বাধীনতা যুদ্ধ সফল হয়েছে এম নজির ইতিহাসে নাই৷ তাই বাংলাদেশের মাত্র ছ’মাসের মুক্তিযুদ্ধের খতিয়ান দেখে যারা হতাশ হন, আমরা বলবো, তারা ইতিহাসের মনোযোগী ছাত্র নন। অনেক ত্যাগের মূল্যে, অনেক রক্তমূল্যে, দীর্ঘকালের সাধনায় স্বাধীনতা অর্জিত হয়। বিশ্বের দুটি বৃহৎ শক্তির কাছে থেকে সার্বিক সাহায্য লাভ সত্ত্বেও ভিয়েতনাম মুক্তি যুদ্ধ এখনো শেষ হয়নি। এশিয়ায় ‘বৃহৎ শক্তির ভূমিকা গ্রহনে’ অভিনাষী নয়াচীনের তাইওয়ান, হংকং, কিময়, মুৎসুদ্বীপ প্রভৃতি এখনো দখলীকৃত এলাকা।  সেদিক থেকে বাংলাদেশের প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধ সবে শুরু হলো বলা যায়। তবে এ যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হবে এমন আশঙ্কা আমরা করি না। তার কারণ, ইয়াহিয়া চক্রের রণনীতি ও কুটনীতি ঘরে বাইরে মার খাওয়ায় এবং আর্থিক বিপর্যয় ক্রমাগত বেড়ে চলায় এই গণসংযোগশুন্য ফ্যাসিস্ট বাদী চক্রের পতন তরান্বিত হচ্ছে। ইতিহাসের ছাত্র মাত্রই জানেন, দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে পতনের মুখে ইতালির ফ্যাসিস্ট সরকারের সৈন্যরাই তাদের নেতা মুসোলিনীকে মিত্রপক্ষের হাতে সমর্পন করেছিল। অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের ইয়াহিয়া সরকারও গণসংযোগ ও গণসমর্থনশুন্য একটি ফ্যাসিস্ট সরকার।  এই সরকারের পেছনে সিন্ধী, বেলুচ, পাঠান জনগণেরও কোন সমর্থন নেই। এই অবস্থায় এই জঙ্গীচক্রের অধঃস্তন কোন ব্যাক্তি বা গ্রুপ – ক্রমাগত বিপর্যয়ের মুখে ইয়াহিয়া ও তার সঙ্গীদের লাথি মেরে ক্ষমতা থেকে তাড়ালে আমরা বিষ্মিত হবো না। বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা এখন আগের চাইতে অনেক বেশী সঙ্ঘবদ্ধ। শত্রুর উপর আকস্মিক হামলা চালিয়ে তারা বহু আধুনিক অস্ত্র লাভ করেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রাম, খুলনা এবং রাজশাহীতে গেরিলা ইউনিটের তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে৷ সর্বত্রই আশাতীত সাফল্য লাভ হচ্ছে, এমন দাবী করা উচিৎ নয়। তবে বাঙালী ছেলেরা অস্ত্র ধরতে এবং শত্রু বধ করতে শিখেছে, এটা গত ছয় মাসে আমাদের জাতীয় রাজনীতির ধারায় একটি নতুন ও যুগান্তকারী ঘটনা। এই বাস্তব সত্যের থেকে কারো চোখ মুদে থাকা উচিত নয়৷ বাঙালী যখন অস্ত্র ধরতে শিখেছে, রক্ত দিতে জেনেছে, তখন অদূর ভবিষ্যতে মাতৃভূমির সকল দখলীকৃত এলাকা মুক্ত করে ছাড়বে, এই দৃঢ বিশ্বাস আমরা পোষণ করি।  একদিকে মুক্তি বাহিনীর কর্মতৎপরতা, অন্যদিকে অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং বিশ্ব নেতাদের কুটনৈতিক চাপ – এই তিনে মিলে ইয়াহিয়া চক্রের পতন দ্রুততর হবে এবং বাংলাদেশের ঘোষিত স্বাধীনতা অর্জন ত্বরান্বিত হবে একথা আজ আমরা নির্দ্বিধায় ঘোষণা করতে পারি৷

***

বিশ্বজনমত

হাওয়া ঘুরছেঃ আরব বিশ্বেও ইয়াহিয়ার স্বরূপ উন্মোচন

বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে বলতে গিয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলের সদস্য ফ্রেড ইভান বলেছেন, বাংলাদেশ সমস্যার মূলে আছে পাকিস্তান সামরিক চক্রের গনবিরোধী নীতি৷ ভোটের রায়কে যদি ইয়াহিয়া সরকার বানচাল করতে না চাইতো, তবে বাংলাদেশ সমস্যার সৃষ্টিই হতো না৷ বিশ্ববাসীর সহানুভূতি আজ বাংলাদেশের পক্ষে কারণ বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ করছে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার জন্য। ভোটের রায়কে যারা সামরিক শক্তির সাহায্যে দাবিয়ে রাখতে চায়, তারা শান্তির শত্রু। মিঃ ইভান আরো বলেন, বাংলাদেশের মানুষ ভাষা, ভূগোল, অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে পশ্চিম পাকিস্তান হতে  আলাদা। তাই জাতিপুঞ্জের সনদ অনুসারে, তাদের আলাদা রাষ্ট্র গঠনের অধিকার আছে। বাংলাদেশের ব্যাপার পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার বলে বিবেচিত হতে পারে না। কারণ বাংলাদেশে মানব অধিকার লঙ্ঘিত হয়েছে। মানব অধিকার লঙ্ঘন করে পাকিস্তানের সামরিক জঙ্গী সরকার যে অপরাধ করেছে, তা বিশ্বের সকলেরই বিবেচ্য। বাংলাদেশ থেকে ৯০ লক্ষেরও বেশী শরনার্থী ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে।  শরনার্থীরা তাদের দেশ ছেড়ে ভারতে আসতে বাধ্য হয়েছে রাজনৈতিক কারণে। তাই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান না হলে তারা তাদের দেশে ফিরে যেতে পারবে না। সারা বাংলাদেশে আজ দুর্ভিক্ষাবস্থা বিরাজ করছে৷ রাজনৈতিক সমস্যার  সমাধান সম্ভব না হলে দুর্ভিক্ষ পীড়িত মানুষও দলে দলে যেতে থাকবে ভারতে। অক্টোবর নভেম্বর মাসে দুর্ভিক্ষের জন্য যে পরিমাণ লোক বাংলাদেশ থেকে ভারতে চলে যাওয়া সম্ভব, তার চাপে ভারতকে চরম ব্যবস্থা গ্রহন করবার বিষয় চিন্তা করতে হতে পারে।  ফলে এই অঞ্চলের শান্তি মারাত্বক ভাবে বিঘ্নিত হতে পারে।  আজ যারা বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে কিছু ভাবছেন না তাদের বুঝতে হবে, পাক-ভারত যুদ্ধ হবে বিশ্ব শান্তির জন্য খুবই মারাত্বক।  তাই সব রাষ্ট্রের উচিৎ হবে বাংলাদেশ সমস্যা সমাধানের জন্য ইয়াহিয়া সরকারের উপর চাপ সৃষ্টি করা। আমেরিকা ও ব্রিটেন সরকারের উচিৎ ইয়াহিয়া সরকারকে সর্বপ্রকার সাহায্য স্থগিত করা। মার্কিন ও অন্যান্য বৈদেশিক সাহায্য না পেলে ইয়াহিয়া সরকার বাধ্য হবে বাংলাদেশের নেতাদের সঙ্গে বোঝাপড়া করতে। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ ভয়াবহ সঙ্কটের পথে। মার্কিন সাহায্য বন্ধ হলে এই সঙ্কট রোধ করা ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গীচক্রের পক্ষে কখনোই সম্ভব হবে না। সর্বপ্রকার সাহায্য বন্ধ করে দিলে সামরিক জান্তা এতটা দূর্বল হয়ে পড়বে যে পশ্চিম পাকিস্তানের গণতান্ত্রিক শক্তিগুলোও সক্রিয় হয়ে উঠবে। আর তাদের আন্দোলন বাংলাদেশের মানুষের যুদ্ধ জয়ের সহায়ক হবে।

বাংলাদেশের অভ্যন্তরে

একজন ফরাসী সাংবাদিক বলেছেন, ঢাকা থেকে মাত্র চল্লিশ মাইল দূরে তিনি মুক্তি বাহিনীর লোকদের দিনের বেলায় দু’জন খান সেনা এবং ছয় জন রাজকারকে ধরে রাস্তা দিয়ে হাঁটিয়ে নিয়ে যেতে দেখেছেন। এ থেকে বোঝা যায় যে ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশের আভ্যন্তরীণ অবস্থা সম্মন্ধে যে সব কথা প্রচার করছে তা কত মিথ্যা।  একজন জার্মান সাংবাদিক বলেছেন, পান্জাবী অফিসারদের সাথে কথা বললে মনে হয় যেন নাৎসী সেনাবাহিনীর অফিসারদের সাথে কথা বলছি। পান্জাবীরা বাঙালীদের যেভাবে ঘৃণা করে তাতে মনে হয়, পান্জাবীরা বোঝাতে চায় তারা প্রভুর জাত। তারা বাঙ্গালীদের চিরকাল পদানত করে রাখবে। পান্জাবীরা মনে করে তারা জাতি হিসেবে শ্রেষ্ঠ। অন্যের উপর রাজত্ব করবার আছে তাদের জন্মগত অধিকার। যেমন মনে করতো হিটলারের আমলে নাৎসী সেনাবাহিনীর সদস্যরা। জার্মান সাংবাদিকটি আরো বলেছেন, ইসলামাবাদে ইয়াহিয়া এখন বিদেশী কুটনৈতিকদের সাথে অত্যন্ত অসৌজন্যমূলক আচরণ করছে।  ইয়াহিয়ার ভাষা ক্রমশ হয়ে উঠছে অসংলগ্ন এবং অশালীন। বিদেশী কুটনৈতিকরা এখন তার সাথে দেখা সাক্ষাৎ করছেন খুবই কম। অপর একজন বিদেশী সাংবাদিক লিখেছেন,  বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর কমান্ডোদের আক্রমণে প্রশাসন ব্যবস্থা বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। কোন কলকারখানা ভালভাবে চলছে না। চট্টগ্রাম বন্দরকে দেখলে মনে হয় মৃত কোন পরিত্যক্ত বন্দর।

বৃহত্তম মানবিক বিপর্যয়

জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের বিদায়ী সভাপতি মিস্টার এডওয়ার্ড হ্যামব্রো বাংলাদেশের পরিস্থিতিকে মহাযুদ্ধত্তর কালের বৃহত্তম ‘মানবিক বিপর্যয় ‘ বলে বর্ণনা করেন। তিনি জাতিসংঘের ২৬ তম সাধারণ পরিষদের উদ্বোধনী ভাষণে ভারতে আগত লক্ষ লক্ষ শরনার্থী প্রসঙ্গে বলেন যে, যদিও বিভিন্ন রাষ্ট্র ও ত্রাণসামগ্রী সাহায্য দিয়ে এই বিপুল সমস্যা সমাধানে সচেষ্ট রয়েছেন তবু প্রয়োজনের তুলনায় এই সাহায্য অতি নগণ্য।  এই প্রসঙ্গে যে কোন বিপর্যয়ে আন্তর্জাতিক ত্রাণ সামগ্রী প্রেরণের মতো জরুরী কাজকে আরও আন্তর্জাতিকী করণের প্রয়োজনীয়তার কথাও তিনি উল্লেখ করেন।

মিস্টার হামব্রো আশা প্রকাশ করেন যে, অচিরেই এমন অনুকূল পরিস্থিতির উদ্ভোব হবে যাতে করে শরনার্থী আগমনের ঢেউ থেমে যাবে এবং যারা দেশত্যাগী হয়েছেন তারা দেশে ফিরে যেতে পারবেন।

আরব দেশে

মিশরের আধা সরকারী পত্রিকা ‘আল আহরাম’  এর সিনিয়র সম্পাদক ডঃ মকসুদ বলেছেন, কয়েকটি আরব রাষ্ট্রের নেতারা কুটনৈতিক পন্থায় ইয়াহিয়াকে প্রভাবিত করার চেষ্টা করছেন। তারা বাংলাদেশে বেসামরিক মানুষ হত্যা বন্ধের জন্য ইয়াহিয়াকে ব্যাক্তিগত ভাবে পত্র লিখেছেন।

ডঃ মাকসুদ বলেছেন, অধিকাংশ আরব মনে করেন, বাঙালীদের বিরূদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানে বিদ্বেষ সৃষ্টি করা হয়েছে। এই জাতির বিদ্বেষমূলক মনোভাবের জন্যই আওয়ামী লীগকে ক্ষমতায় আসতে দেয়া হয়নি৷ ডঃ মাকসুদ আরো বলেন, বাংলাদেশ সমস্যাকে পাক – ভারত সমস্যা হিসেবে বিবেচনা করা উচিৎ নয়। তিনি বলেন,  আরবরা একটি দেশের ঐক্যে বিশ্বাস করে। কিন্তু দেশের ঐক্যের চাইতে একটি দেশের জনসাধারণের আভ্যন্তরীণ ঐক্য অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ।  এই ঐক্য গড়ে উঠবার জন্য প্রয়োজন একটা দেশের সকল অংশের মানুষের সমান অধবকার এবং মর্যাদা। সমান অধিকার ও মর্যাদার সঙ্গে বসবাস করতে না পারলে একটি দেশে ঐক্য থাকতে পারে না। বাংলাদেশে যা ঘটছে তা ইতিহাসের অন্যতম ভয়াবহ বিয়োগান্ত ঘটনা৷

।সম্প্রতি নয়াদিল্লীতে অনুষ্ঠিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংবাদ সম্মেলন শেষে আকাশবাণীর সংবাদদাতার সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ডঃ মকসুদ ঐসব মন্তব্য করেন। এ ছাড়া চার জন আরব সাংবাদিক নয়াদিল্লীস্থ পাকিস্তান হাই-কমিশন অফিসে প্রদত্ত একটি স্মারক লিপিতে বলেছেন, ১৯৭০ সালের ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনের ফলাফলের উপর ভিত্তি করে বাংলাদেশ সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধান হওয়া উচিৎ।

এই চার জন সাংবাদিক হলেন, সুদান-এর আলী সালে, লেবানন-এর হান্নান, মিশরের ডঃ মকসুদ ও লিবিয়ার সিয়ালা।

ফরাসী প্রেসিডেন্ট পম্পিডু

প্যারিস-এ এক সাংবাদিক সম্মেলনে মিঃ পম্পিডু বলেছেন, তিনি বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন বলে মনে করেন। যুদ্ধের মাধ্যমে এই সমস্যা সমাধান তিনি সংগত বলে বিবেচনা করেন না।

পৃষ্ঠা ৩

আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের অসাম্প্রদায়িক রাজনীতি

(রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক)

দেশ ভাগ হওয়ার পরপরই দ্বিজাতিতত্ত্বের উদ্ভাবক মিঃ জিন্না বুঝতে পারেন, ধর্মের ভিত্তিতে পাকিস্তানে একজাতি গঠন সম্ভব নয়। তাই ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান গণপরিষদের প্রথম অধিবেশনেই তিনি ঘোষণা করেন, ‘পাকিস্তানে এখন আর কেউ হিন্দু, বৌদ্ধ, মুসলমান বা জৈন নয়, সকলে মিলে আমরা এক মহাজাতি, পাকিস্তানী। ‘ ভিন্নার এই বয়ানে ভিত্তিতে তৎকালীন মুসলিম লীগের একটি প্রগতিশীল অংশ মুসলিম লীগের নাম পরিবর্তন করে ন্যাশনাল লীগ নামে একটি দল গঠনের প্রস্তাব করেন এবং সংখ্যালঘুদের জন্য দ্বার উন্মুক্ত রাখাে কথা বলেন। কিন্তু লিয়াকত -কাইয়ুম-নাজিম চক্রের বিরোধিতায় এবং জিন্নার নিজের সংখ্যালঘু বিরোধী মনোভাবের দরুণ এই প্রস্তাব পরিত্যক্ত হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব যদিও তখন একজন ছাত্র ও যুবনেতা, তথাপি মুসলিম লীগের ন্যাশনাল লীগে রূপান্তরের প্রস্তাবে উৎসাহের সঙ্গে সমর্থন জানান।

দেশভাগের দু’বছরের মধ্যেই ক্ষমতাসীন মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক, ফ্যাসিবাদী ও বাঙালী বিরোধী নীতির দরুণ দলের প্রগতিশীল বাঙালী অংশ মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক বর্জন করে আওয়ামী মুসলিম লীগ বা জনতার মুসলিম লীগ গঠন করেন।

এই জনতার লীগ গঠনে সবচেয়ে উদ্যোগী হন তৎকালীন যুবনেতা শেখ মুজিব। মাওলানা ভাসানী ও জনাব সোহরাওয়ার্দীও আওয়ামী মুসলিম লীগে যোগদান করেন। মুসলিম লীগের সাম্প্রদায়িক ও বাঙালী বিরোধী নীতি ও অগণতান্ত্রিক পন্থায় বাঙালী জাতির দাবী দাওয়া অস্বীকার করার প্রবণতার দরুণ বাংলাদেশে অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে গণ-আন্দোলন গড়ে উঠতে শুরু করে এবং প্রথম বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনে। বঙ্গবন্ধু ছিলেন এই আন্দোলনের অন্যতম প্রধান নেতা। পশ্চিম পাকিস্তানের মুসলিম লীগ সরকার আজকের ইয়াহিয়া চক্রের মতই এই ভাষা আন্দোলনকে ‘ভারতীয় এজেন্টদের আন্দোলন’ বলে চিত্রায়িত করার অপচেষ্টা করেন। ভাষা আন্দোলনের পরেই বাংলাদেশে  গণ-আন্দোলনের ব্যাপক অসাম্প্রদায়িক ভিত্তি  গড়ে ওঠে এবং শেখ মুজিবের প্রত্যক্ষ উৎসাহ ও সমর্থনে পূর্ব পাকিস্তান মুসলিম ছাত্র লীগ থেকে ‘মুসলিম’ শব্দটি বাদ দিয়ে অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে ১৯৫৩ সালের দিকে শুধু মাত্র ছাত্র লীগ নামে পুনঃগঠিত হয়। অতঃপর শেখ মুজিব আওয়ামী মুসলিম লীগকেও অসাম্প্রদায়িক ভিত্তিতে পুনর্গঠনের জন্য উদ্যোগ গ্রহণ করেন এবং দলের দক্ষিণ পন্থী অংশের প্রবল বিরোধিতার মুখে শুধু মাওলানা ভাসানীর সমর্থনে শুধু মাত্র আওয়ামী লীগ নামে দলটি ১৯৫৫ সালে পুনর্গঠিত করেন। কেন্দ্রে আওয়ামী লীগ মন্ত্রীসভা ক্ষমতাসীন হওয়ার পর ১৯৫৬ সালের শাসনতন্ত্রে যুক্ত নির্বাচন পদ্ধতি প্রবর্তনের জন্য শেখ মুজিব দলের সভাপতি মাওলানা ভাসানীর সমর্থন পূর্বক প্রবল আন্দোলন শুরু করেন। এই সময়েও পশ্চিম পাকিস্তানী পত্র-পত্রিকা ও মুসলিম লীগ চক্র এই আন্দোলনকে ‘ভারতীয় চরদের কারসাজি’ আখ্যা দিয়ে শেখ মুজিবকে ‘ভারতীয় চর’ প্রমাণের চেষ্টা করে।  কিন্তু শেষ পর্যন্ত আন্দোলন জয়ী হয়৷ ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ যে সরকার গঠন করে তাতে কংগ্রেস সহ সংখ্যালঘু নেতাদের গুরুত্বপূর্ণ পদ দেয়া হয়। 

১৯৫৮ সালে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে সামরিক শাসন জারি করা হয় এবং হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিস্টান নির্বিশেষে সকল বাঙালীর উপর অত্যাচারের স্টীমরোলার নেমে আসে। ১৯৬৪ সালে শেষ সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা অনুষ্ঠিত হয় এবং আইয়ুব সরকার এই দাঙ্গা অনুষ্ঠানে মূল ভূমিকা গ্রহন করে। শেখ মুজিব এই দাঙ্গা প্রতিরোধের জন্য দাঙ্গা প্রতিরোধ কমিটিতে নেতৃত্ব দান এবং পূর্ব বাংলার অন্যান্য নেতার সঙ্গে সম্মিলিত ভাবে ‘পূর্ব বাঙলা রুখিয়া দাড়াও’ শীর্ষক একটি বিবৃতি প্রচার করেন। শেখ মুজিবের অনুপ্রেরণায় বহু মুসলমান পরিবার তাদের প্রতিবেশী হিন্দু পরিবারগুলোকে রক্ষা করার ব্যবস্থা করেন এবং এই প্রয়াসে একজন কবি সহ অনেকেই সাম্প্রদায়িক গুন্ডাদের হাতে প্রাণ দেন।

১৯৬৫ সালে নিজের ফ্যাসিবাদী শাসন অব্যাহত রাখার জন্য আইয়ুব চক্র ভারতের সাথে এক আত্মঘাতী যুদ্ধে লিপ্ত হয় এবং শেখ মুজিবর রহমান এই যুদ্ধে সমর্থন জানিয়ে বেতার বক্তৃতা দিতে অস্বীকৃতি জানান।  যুদ্ধের সমর্থনে বেতার ভাষণের জন্য সরকারী আমন্ত্রণ তিনি প্রকাশ্যই সরাসরি প্রত্যাখ্যান করেন। সেপ্টেম্বরে যুদ্ধের পর লাহোরে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রতিক্রিয়াশীল নেতারা তাসখন্দ চুক্তি বিরোধী আন্দোলন করার সিদ্ধান্ত নেন, তিনি তাতে সমর্থন জানাতেও অস্বীকৃতি জানান।  অন্যদিকে তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফার ভিত্তিতে বাঙালীর গণতান্ত্রিক অধিকার আদায়ের ফর্মুলা ঘোষণা করেন ।  ফলে হিন্দু – মুসলিম-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান নির্বিশেষে সকল মানুষ বঞ্চনা ও বৈষম্যের বিরুদ্ধে অসাম্প্রদায়িক আন্দোলনে অভূতপূর্ব সমর্থন জানান। ১৯৬৬ সালে ৭ই জুনের আন্দোলন নামে খ্যাত এই আন্দোলনকে আইয়ুব অস্ত্রের প্রয়োগের মাধ্যমে দমনের ব্যবস্থা করেন এবং ১৯৬৭ সালে নিজেদের তৈরী তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় শেখ মুজিবকে জড়িত করে আরো ২৮ জন নেতাকে সামরিক ট্রাইবুনালে বিচারের ব্যবস্থা করেন। ১৯৬৮ সালের গণআন্দোলনে এই বিচার নামের প্রহসনের সমাপ্তি ঘটে।

অসাম্প্রদায়িকতার ভিত্তিতে পুনর্গঠিত আওয়ামী লীগ এখন বাঙালী হিন্দু, মুসলমান, বৌদ্ধ, খ্রিস্টান প্রভৃতি কোন একটি নির্দিষ্ট সম্প্রদায়ের দল নয় বরং সকলের মিলিত জাতীয় প্রতিষ্ঠান এবং শেখ মুজিব সকলের জাতীয় নেতা। এই অবিমিশ্র জাতীয়তাবোধ থেকেই জাতীয়তার জন্ম। ১৯৭০ সালের ৭ ই ডিসেম্বর সাধারণ নির্বাচনেও শেখ মুজিব সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর সর্ববাদিসম্মত নেতা প্রমাণিত হয়েছেন। বাঙালীর জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের আজ তিনিই অগ্রনায়ক।  পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পর জিন্না কতৃক রাষ্ট্র ক্ষমতায় বাঙালীদের অধিকার অস্বীকার, বাঙালীদের উপর উর্দু ভাষা চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা এবং পরবর্তী কালে ফজলুল হক, নাজিমুদ্দিন, সোহরাওয়ার্দী প্রমুখ নিয়মতান্ত্রিক নেতাদেরকেও দেশদ্রোহী আখ্যা প্রদান পূর্বক রাষ্ট্র ক্ষমতা থেকে বিতাড়ণ এমন কি অনেককে কারাগারে প্রেরণ এবং ১৯৬৫ সালের প্রথম শাসনতন্ত্রে বাঙালীর সংখ্যাগরিষ্ঠতা অস্বীকার পূর্ব্বক সংখ্যাসাম্য প্রবর্তন এবং বাংলার টাকা অবাধে লুন্ঠন এবং পশ্চিম পাকিস্তানের উন্নয়নে ব্যবহার থেকে পূর্ব বাংলার বাঙালী  মুসলমারাও বুঝতে পারে, জিন্নার ধর্মভিত্তিক জাতীয়তা একটি ফাঁদ মাত্র, বাঙালী সেই ফাঁদে পা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শোষণের কলোনীতে পরিণত হয়েছে। পাকিস্তানকে একটি বহু জাতি এবং বহু সংস্কৃতি ভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করার ইচ্ছা এই শাসন চক্রের নেই। ফলে ধীরে ধীরে দানা বেঁধে ওঠে বাঙালীর শোষণমুক্তির সংগ্রাম। এই সংগ্রামের বড় বৈশিষ্ট্য হলো, বহু বছর পর বাঙালী হিন্দু ও মুসলমান পাশাপাশি দাড়িয়ে একই উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য অর্জনের জন্য সংগ্রাম করছে। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব সরকারের চক্রান্তে সৃষ্ট সাম্প্রদায়িক দাঙ্গার আগুন থেকে সংখ্যালঘু ভাইদের রক্ষার জন্য বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে গঠিত আন্দোলনে সংখ্যাগুরুরা যেমন অংশগ্রহণ করেছে, এমন কি প্রাণও দিয়েছে, তেমনি এ বছর ২৫ শে মার্চের পর তারা বর্বর ইয়াহিয়া খানের বিরূদ্ধে সংগ্রাম করছে,  পরস্পরকে রক্ষা করার চেষ্টা করছে, তেমনি প্রাণবলিও দিচ্ছে। এই সার্বজনীন সংগ্রাম ও আত্মদানই বাঙালী জাতীয়তার ভিত্তি এবং এই জাতীয়তাবাদী সংগ্রামের পতাকা সর্বাগ্রে সর্বোচ্চে তুলে ধরেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব।  জিন্নার ধর্মীয় দ্বিজাতিতত্ত্বের গলিত শবের উপর অসাম্প্রদায়িক ও সার্বজনীন বাঙালী জাতীয়তার সংগ্রামী পতাকা আজ সগর্বে উড্ডীয়মান।

***

জল্লাদদের গণহত্যার নতুন কৌশল

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার) 

মানুষের চেহারার সাথে সাদৃশ্য পূর্ণ খাকী ইউনিফর্ম পরিহিত পশ্চিম পাকিস্তানী মানবেতর প্রাণীরা বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সাথে আর এক ধরণের মর্মন্তুদ ও নিষ্ঠুর খেলায় মেতে উঠেছে। এক কালের দন্ত চিকিৎসক আবদুল মোতালিব মালিককে দখলীকৃত এলাকার পুতুল গভর্নর এবং তথাকথিত সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের অন্তরালে জল্লাদ বাহিনী আর এক ধরণের হত্যার নেশায় হিংস্র হায়েনার মত পুনরায় মেতে উঠেছে। 

বর্তমানে ক্ষমা প্রদর্শনের টোপ ফেলে দখলীকৃত এলাকায় প্রত্যাবর্তনকারীদের বিরূদ্ধে ভারতীয় চরের অজুহাত খাড়া করে নির্বিচারে হত্যা করা হচ্ছে। সবলদেহী পুরুষ দের কোন অবস্থাতেই রেহাই দেয়া হচ্ছে না।  আর আমাদের যুবতী মা-বোনদেন টেনে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে হিংস্র পশুদের আবাসস্থল ক্যান্টনমেন্টে। আমাদের মা বোনদের আর্তচিৎকারে আকাশ বাতাস ভারী হয়ে উঠছে। বর্তমানে প্রকাশ্য হত্যার বদলে গোপনে হত্যা করা শুরু হয়েছে। হত্যার পর দুর্বৃত্তরা মৃতদেহ নদীতে ফেলে দিচ্ছে। অন্য দিকে তারা এসব মর্মন্তুদ হত্যাকাণ্ডের  জন্য আমাদের মুক্তি বাহিনীকেই দায়ী বলে প্রমাণের অপচেষ্টা চালাচ্ছে। উদ্দেশ্য স্বাধীনতা সংগ্রামকারীদের বিরুদ্ধে জনমত বিক্ষুদ্ধ করে তোলা। ডুবন্ত জাহাজের বিপন্ন যাত্রীরা যেমন সমুদ্রে ভেসে যাওয়া খড় কুটো আশ্রয় করেও বাঁচতে চেষ্টা করে, কেমনি হয়েছে সামরিক জান্তার অবস্থা৷ একের পর এক চেষ্টা বিফল ও ব্যর্থ হওয়ার পর খান সেনারা নতুন আর এক ধরণের চাতুরী করার চেষ্টা করছে। একুশে আগস্ট তারিখে অধিকৃত ঢাকা বেতার থেকে একটু জবর খবর পরিবেশন করা হয়েছে। ইন্টার সার্ভিসেস পাবলিক রিলেশনস ডিরেক্টরেটের মেজর সালেক সাক্ষরিত এক হ্যান্ড আউট উদ্ধৃত করে ঢাকা বেতার জানিয়েছে যে, সুন্দরবন এলাকায় তাদের ভাষায় দুষ্কৃতিকারীদের এক গুপ্ত ঘাঁটীতে আক্রমণ করে ৫১ জনকে হত্যা, নয় জনকে বন্দী ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। এ সংবাদে হত্যা ও বন্দীর সংখ্যা নির্ভুলভাবে পরিবেশন করা হয়নি। হত্যা করা হয়েছে শতাধিক এবং বন্দী করা হয়েছে অর্ধ শতাধিক। অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধারের কাহিনী কাল্পনিক।  প্রকৃত সংবাদ হচ্ছে সুন্দরবন এলাকায় আমাদের অকুতোভয় মুক্তি বাহিনীর সুসজ্জিত কমান্ডোরা খান সেনাদের একটি ঘাঁটীর উপর হামলা চালিয়ে শতাধিক খান সেনাকে হত্যা করে গেরিলা যুদ্ধের রীতি অনুযায়ী নিরাপদ এলাকায় চলে যায়। আক্রান্ত এই খান সেনারা মুক্তি বাহিনীর এই আক্রমণের সময় কয়েক মাইল দূরে অপর একটি পাকিস্তানী ফৌজি ক্যাম্পে সাহায্যের আবেদন জানিয়েছিল। কিন্তু রাতের মধ্যে তারা তাদের স্যাঙাতদের উদ্ধারের জন্য যায়নি। মুক্তি বাহিনী আক্রান্ত ঘাঁটী ছেড়ে চলে যাওয়ার নির্ভূল খবর পাওয়ার পর খান সেনারা ওই এলাকায় যায়। যাওয়ার পর তাদের প্রমাণ করতে হবে যে, মুক্তি সেনাদের হত্যা করতে সক্ষম হয়েছে। এই প্রমাণ খাড়া করার জন্য গ্রামের নিরস্ত্র – নিরীহ লোকদের পাইকারীভাবে হত্যা করে বর্বররা নিজেদের পৌরুষের পরিচয় দান করে। কমান্ডিং অফিসারকে দেখানোর জন্য প্রায় অর্ধশত গ্রামবাসীকে ধরে নিয়ে গিয়ে পরে হত্যা করে। তারপর অধিকৃত ঢাকা বেতার থেকে তাদের হীন পৌরুষের বিবরণ প্রচার করা হয়। মুক্তি সেনাদের নামে নিরীহ  গ্রামবাসীদের যখন হত্যা করা হয়েছে তখন স্বাভাবিকভাবেই কিছু অস্ত্রশস্ত্র দখলেরও সংবাদ প্রচার করা উচিৎ। তাই অধিকৃত বেতার থেকে অস্ত্র দখলের সংবাদ সরবে প্রচার করা হয়। 

সম্প্রতি নোয়াখালীর সদর থানার সোনাপুর এলাকার শ্রীপুর ও সোনাপুর বাজারে হিংস্র খান সেনারা বিভিন্ন ধরনের স্বয়ংক্রিয় সমরাস্ত্র নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের রক্ত তৃষ্ণা মেটায়। শিশু বৃদ্ধ, নারী, পুরুষ কেউ তাদের মধ্যযুগীয়  নাদিরশাহী জিঘাংসা খেকে রেহাই পায়নি। এ ছাড়াও নারীদের ওপর যে নির্যাতন চালানো হয়েছে  তা ভাষায় রূপ দেয়া সম্ভব নয়। নিহত স্বাসীর সামনে স্ক্রীকে ধর্ষণ করা হয়েছে৷ গৃহের মধ্যে আগুন লাগিয়ে দিয়ে লোককে তার মধ্যে নিক্ষেপ করে দরজা বন্ধ করে জীবন্ত পুড়িয়ে মেরে পৈশাচিক উল্লাসে মেতে উঠেছিল হিংস্র ইয়াহিয়া বাহিনী। 

নির্যাতনের পরিসমাপ্তি এখানেই হয়নি। এরপর হিংস্র হায়েনারা কয়েকটি গ্রামে গিয়ে নিহত ব্যক্তি দের স্ত্রী দের কাছে মুক্তিবাহিনীই এই হত্যাকান্ড চালিয়েছে বলে পূর্বেই প্রস্তুত বিবৃতিতে বেয়নেটের ভয় দেখিয়ে দস্তখত ও হাতের টিপ আদায় করে নেয়৷

ইয়াহিয়ার জঙ্গী হায়েনার দল বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় এমনি ধরণের হত্যাকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে।

এ ঘটনার বিবরণও ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচার করা হয়েছে।  তাতে বলা হয়েছে, নোয়াখালীর সোনাপুর এলাকার দেশপ্রেমিক নাগরিকদের সহযোগিতায় সেনাবাহিনী দেড় শতাধিক দুস্কৃতিকারীদের হত্যা করেছে এবং তাদের কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র উদ্ধার করেছে। পাকিস্তানী সৈন্যরা এই এলাকায় যাওয়ার আগে দুষ্কৃতকারীরা এ এলাকায় ত্রাশের রাজত্ব কায়েম করে রাখে এবং বহু নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।  এমনি সব স্বকৃত কুকর্মের জন্য মুক্তি বাহিনীকে দায়ী করে এবং সে ব্যাপারে ব্যপক প্রচারণা চালিয়ে তারা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীকে বিভ্রান্ত করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু তারা তো জানে না প্রতিটি মুক্তি যোদ্ধা সাড়ে সাত কোটি বাঙালীরই একজন। প্রত্যেকেই তারা বাঙ্গালী মা-বাপের সন্তান, বাঙালী বোনের ভাই, বাঙালী বধূর প্রিয়তম স্বামী।  কাজেই শত চেষ্টা ছেলের বিরুদ্ধে বাপকে, সন্তানের বিরুদ্ধে মাকে, ভাইয়ের বিরুদ্ধে বোনকে, প্রিয়জনের বিরুদ্ধে বঙ্গললনাকে বানোয়াট কাহিনী প্রচার করে বিভ্রান্ত করা যাবে না। কেননা পাকিস্তানী হানাদারদের ভাষায় আজ গোটা বাঙালী জাতি দুষ্কৃতিকারীর শিরোপা পেয়েছে। আর সাড়ে সাত কোটি বাঙালীই মুক্তি বাহিনীর সদস্য। এ অবস্থায় বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় দুশমনদের গণহত্যার নব নব কৌশল ও অপপ্রচারের সকল উদ্দেশ্যই ব্যর্থ হতে বাধ্য। 

***

বই ও পত্রিকা

বাংলার মুখ। শান্তনু দাস সম্পাদিত।  অনির্বাণ প্রকাশনী, ৩/এ গঙ্গাধর বাবু লেন, কলিকাতা – ১২। (পশ্চিমবঙ্গ) 

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে কেন্দ্র করে পশ্চিম বাংলায় বিভিন্ন ধরণের এবং সেজাজের বিস্তর বই প্রকাশিত হয়েছে।  বাংলাদেশের প্রবন্ধ, কবিতা, গল্প, উপন্যাস যেমন মুদ্রিত হয়েছে তেমনি বাংলাদেশের উপর পশ্চিম বাংলার লেখক, সাংবাদিক, রাজনীতিকদের রচনাবলীও প্রকাশিত হয়েছে৷

বিশিষ্ট কবি শান্তনু দাস সম্পাদিত ‘বাংলার মুখ’ নামে একটি সুন্দর ছড়ার সঙ্কলন সম্প্রতি আমাদের হাতে এসে পৌছেছে। পশ্চিম বাংলার ১০৮ জন কবির, বাংলাদেশের ৫ জন কবির – এবং বাংলার বিভিন্ন জেলায় প্রচলিত ১৪ টি ছড়া এই সঙ্কলনে স্থান পেয়েছে। ‘পাক চক্রের বর্বরোচিত হামলার প্রতিবাদে’ রচিত ছড়াগুলো সাম্প্রতিক দৃষ্টিভঙ্গিকে প্রতিফলিত করেছে ম

ছড়ার আবেদন সার্বজনীন।  যে শিশু কথা বলতেও শেখেনি তাকেও মায়ের কোলে বসে মায়ের মুখের ছড়া শুনতে হয়৷ শিক্ষিত অশিক্ষিত সকল শ্রেণীর লোকই ছড়ায় আনন্দ পান। রচনাকারদের মতামত বিশ্বাস এবং আবেগ ছড়ার মাধ্যমে রচিত হওয়ায় সকল বয়সের পাঠকই ‘রসাস্বাদন ‘ করতে পারবেন।

সঙ্কলনে নবীন ও প্রবীণের ছড়া পাশাপাশি মুদ্রিত হয়েছে।  কবি সম্পাদক দাবী করেছেন,’ এখানে অনেক কবি পাওয়া যাবে যাতের নাম জন্মেও কেউ শোনেন নি কিন্তু ছড়া দেখুন, অনেক বাঘা কবির সমকক্ষ। ‘

বাঘা সমালোচকরা এই স্পর্ষিত উক্তির বিচার বিশ্লেষণ অবশ্যই করবেন, আমরা প্রতিটি ছড়ায় আনন্দ ছাড়াও অপরিসীম দরদ পেয়েছি, আন্তরিকতা ও শুভেচ্ছা পেয়েছি, উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছি, স্বীকার করি। একটি প্রাচীন ছড়ায় আছে-

কত পোড়া পুগলা গো আল্লাহ

পুড়াইয়া করলা ছাই।

কার কাছে করবাম নালিশ

জাহা ত আর নাই।

আমাতের মর্মান্তিক অভিজ্ঞতাই মর্মচিত হয়েছে।

বইটির ছাপা ও বাঁধাই সুন্দর। শ্রী কমল সাহার রূচি-ঋদ্ধ প্রচ্ছদ এবং প্রখ্যাত শিল্পী শ্রী দেবব্রত মুখোপাধ্যায়ের আবেগময়, ‘বোল্ড’ ব্যাঙ্গাত্মক অলংকরণ গ্রন্থের চরিত্রানুযায়ী হয়েছে।

পৃষ্ঠা – চার

জঙ্গী চক্রের নাভিশ্বাসঃ মুদ্রাস্ফীতির চাপে ঘনায়মান সঙ্কট

(অর্থনৈতিক ভাষ্যকার)

যুদ্ধ চালাতে লাগে সৈন্য, অস্ত্র আর রসদ। আর এই তিন জিনিসের জন্য প্রয়োজন হয় শক্ত অর্থনৈতিক বুনিয়াদ৷ দেশপ্রেমের জন্য যখন মানুষ লড়ে, লড়াই যখন চলে গেরিলা কায়দায়, তখন যে পরিমাণ আর্থিক সঙ্গতির প্রয়োজন হয়, তার চাইতে পেশাদার বাহিনী নিয়ে লড়াইয়ে খরচা অনেক বেশি।  বাঙালীরা যুদ্ধ করছে গেরিলা পদ্ধতিতে। তারা লড়াই করছে দেশকে দখলদার বাহিনীর হাত থেকে মুক্ত করবার জন্য। অন্যদিকে পাকিস্তানের দখলদার জঙ্গী অধিপতিরা যুদ্ধ চালিয়ে যাচ্ছে পেশাদার সৈন্য দিয়ে।  এই দুই যুদ্ধ-ডদ্ধতির অর্থনীতি আলাদা। বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ চালাতে যে পরিমাণ অর্থের প্রয়োজন তার চাইতে বহুগুণ বেশি অর্থ প্রয়োজন পাকিস্তানের দখলদার বাহিনীর সমর প্রচেষ্টায়। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে পাকিস্তানের অর্থনীতির ওপর ক্রমশ সৃষ্টি হচ্ছে প্রবল চাপ৷ পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ দ্রুত ভাঙনের মুখে। বিদেশ থেকে আর্থিক সাহায্য নিয়ে এই অর্থনৈতিক সঙ্কট রোধ করার চেষ্টা চলছে। কিন্তু শেষ রক্ষা হবে বলে মনে হয় না। বিশেষজ্ঞদের মতে, পাকিস্তানের অর্থনৈতিক বিপর্যয় আসন্ন।  গত ১৯শে সেপ্টেম্বর প্রকাশিত পাকিস্তানের স্টেট ব্যংক রিপোর্টে বলা হয়েছে, গত ৩০শে জুন যে আর্থিক বছর শেষ হয়েছে, সেই বছর পাকিস্তানের জাতীয় উৎপাদন শতকরা ১.৪ ভাগ বেড়েছে। এর আগের বছর বেড়েছিল শতকরা ৬.৬ ভাগ। বলা হয়েছে,  প্রাকৃতিক দুর্যোগ এবং গৃহ যুদ্ধের দরুন জাতীয় উৎপাদন হ্রাস প্রাপ্ত হয়েছে।

যুদ্ধ চলতে থাকলে জাতীয় উৎপাদনের শতকরা হার যে আরো অনেক কমে যাবে, সে কথা অনুমান করতে অসুবিধে হয় না।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধ আরম্ভ হবার চার পাঁচ মাসের মধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনীতির উপর প্রচন্ড চাপ সৃষ্টি হয়। এই জন্য পাকিস্তানের বাজেটে প্রতিরক্ষার খাতে ব্যয় বরাদ্দ ভয়ংকর ভাবে বৃদ্ধি করা হয়।  পাকিস্তানের সামরিক খাতে ব্যয় বরাদ্দ সবসময়ই বেশি ছিল। পাকিস্তানের বাজেটের প্রায় অর্ধেক ব্যয় করা হয় সামরিক খাতে। কিন্তু ১৯৭১-৭২ অর্থ বরছে পাকিস্তানের মোট প্রত্যাশিত বাজেটের অর্ধেকেরও বেশি অর্থ প্রতিরক্ষা খাতে বরাদ্দ করা হয়। পাকিস্তানের ১৯৭০-৭১ সালের বাজেটে ৬’শ কোটি টাকার মধ্যে ৩০০ কোটি টাকা ব্যয় করা হয় সামরিক খাতে।  ১৯৭১-৭২ অর্থ বছরে ৬’শ কোটি টাকার মধ্যে ৩৪০ কোটি টাকা ধরা হয় প্রতিরক্ষার জন্য।  বাজেট বক্তৃতায় ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম, এম আহমদ ঘোষণা করেন, ‘এক সঙ্কটজনক পরিস্থিতির মধ্যে এই বাজেট তৈরী করা হয়েছে। চার মাস আগে দেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী শক্তি মাথা চাড়া দিয়ে উঠে। পাকিস্তানের মৌলিক ধারণা ও আদর্শ বিপন্ন হয়েছে। ” আহামদ পাকিস্তানের আদর্শ ও মৌলিক ধারণার দোহাই দিয়ে বলেন, “সামরিক বিভাগে ব্যয় বরাদ্দ না বাড়িয়ে উপায় নেই। তাই বাজেটে বরাদ্দ করা হয়েছে সামরিক খাতে অর্ধেকের বেশি অর্থ।  আহামদ বলেন, ” পাকিস্তানকে হতে হবে স্ব-নির্ভর। সরকারী ও বেসরকারী স্তরে সর্বাধিক কৃচ্ছতা অনুসরণ করতে হবে।  “

কিন্তু সর্বত্র কৃচ্ছতা সাধন করেও অর্থনীতিতে বিপর্যয় রোধ সম্ভব হচ্ছে না।  বাংলাদেশে যুদ্ধ চলছে বলে প্রত্যাশিত রাজস্ব আদায় হচ্ছে না। বাংলাদেশের পাক প্রশাসন যন্ত্র আজ অচল হয়ে পড়েছে।  টাকার অভাব তাই আজ অনুভূত হচ্ছে সর্বত্র। পাকিস্তানের সরকার টাকার এই অভাব পূরণের জন্য বাজারে ছাড়ছে বাড়তি মুদ্রা।  এভাবে বাড়তি মুদ্রা বাজারে ছাড়ার ফলে কিছুদিনের মধ্যে পাকিস্তানের অর্থনীতিতে দেখা দিতে বাধ্য মুদ্রাস্ফীতির সর্বপ্রকার কুফল৷ কারণ, পাকিস্তানের উৎপাদন হার এখন নিম্নমুখী।  উৎপাদনের হার এবং কর্মসংস্থানের সম্ভাবনা, (একমাত্র সেনাবাহিনীতে ছাড়া) এখন দ্রুত হ্রাস পাবার পথে।

এক্ষেত্রে বাজারে মুদ্রার পরিমাণ বৃদ্ধির ফলে অন্যান্য পণ্যের মূল্য দ্রুত বৃদ্ধি হতে বাধ্য। চাহিদা এবং উৎপাদনের মধ্যে  সঙ্গতি না থাকায় অর্থনৈতিক বিপর্যয় হতে বাধ্য।  যেহেতু এই বাড়তি টাকা খরচ করা হবে সামরিক খাতে, বেসামরিক লোকেরা তাই দ্রব্য মূল্যের জন্য থাকতে বাধ্য হবে অর্ধাহারে, অনাহারে, দারুণ অর্থকষ্টের মধ্যে। পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর সকল সদস্যই পশ্চিম পাকিস্তানী।  তাই যুদ্ধ চালাতে গিয়ে যে মুদ্রাস্ফীতি ঘটছে তার অপকারী প্রভাব বেশিরভাগ পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানের বেসামরিক জনসাধারণের ওপর।

করাচির দৈনিক ‘ডন’ পত্রিকায় এক খবরে বলা হয়,  পাকিস্তান সরকার ইতিমধ্যেই বহু কোটি টাকার বাড়তি নোট বাজারে ছাড়তে বাধ্য হয়েছে। 

পাকিস্তানের অর্থনীতিতে অন্য দিক থেকেও সঙ্কট দেখা দিতে বাধ্য। পশ্চিম পাকিস্তানে যত বস্ত্র উৎপাদিত হতো, তার অর্ধেক বিক্রি হতো বাংলাদেশের বাজারে। কিন্তু এখন এই বাজার কার্যত বন্ধ।  বাংলাদেশ থেকে পাট, চা, চামড়া ইত্যাদি রপ্তানি করে আয় হতো প্রতিদিন প্রায় ৬৫ লক্ষ টাকার বেশি বৈদেশিক মুদ্রা।  এখন এই রপ্তানী প্রায় বন্ধ।  পশ্চিম পাকিস্তানে গত তেইশ বছরে যত শিল্প গড়ে উঠেছে, তার মধ্যে বেশিরভাগ শিল্পই চলে বিদেশ থেকে কাঁচামাল আমদানি করে। কিন্তু এখন এইসব কাঁচামাল আমদানি করার মত বৈদেশিক মুদ্রা পাকিস্তানের নেই৷ তাই বহু কলকারখানা যুদ্ধ চলাকালীনই বন্ধ হয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে।  ফলে শ্রমিকরা হয়ে পড়ছে বেকার৷ শ্রমজীবী জনসাধারণের হাতে টাকা নেই। অথচ বাজারে মুদ্রাস্ফীতি দর জন্য নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ঘটবে বহু গুণে মূল্য বৃদ্ধি। ফলে দেখা দেবে শ্রমিক অসন্তোষ। কিছুদিন আগে পত্রিকার খবরে বেড়িয়েছিল, পাকিস্তানের প্রধান অর্থনৈতিক উপদেষ্টা এম, এম আহামদ স্বয়ং এক বেকার কেরাণীর দ্বারা ছুরিকাঘাত হন। এটা তো শুরু মাত্র। এমনি অবস্থায় যুদ্ধ চললে শেষে যে কি অবস্থার সৃষ্টি হবে তা সহজেই অনুমেয়।  পাকিস্তানের সমরাধিপতি ইয়াহিয়া ভেবেছিলো বাঙ্গালীদের মাত্র কয়েক ঘন্টার মধ্যে সমস্ত প্রতিরোধকে চূর্ণ করে দেয়া যাবে,  তাদের চিরতরে দমন করা যাবে। কিন্তু প্রতিরোধ যুদ্ধ ক্রমেই জোরদার হচ্ছে।  যুদ্ধের এই পরিণতির কথা আগে ভেবে দেখেনি পাকিস্তানের সামরিক শাসন-চক্র। পাকিস্তানের অর্থনীতিতে যে বিপর্যয় আসছে, তার প্রভাব পড়বে সর্বত্র। সমরাধিপতি ইয়াহিয়ার অর্থনীতি শাস্ত্রের কোন জ্ঞান না থাকলেও এর বাস্তব ফল অনুভব করতে অসুবিধা হবে না কিন্তু। 

***

সোনার বাংলার সংগ্রামী রূপ

বাংলা দেশ৷ দুই শব্দের একটি নাম। কিন্তু এক মুহূর্তে সমস্ত মনপ্রাণ রাঙিয়ে তোলে। কবি সত্যই বলেছেন, স্বপ্ন দিয়ে তৈরী আর স্মৃতি দিয়ে ঘেরা এই বাংলাদেশ।  এই স্বপ্ন শত শত বছরের৷ এই স্মৃতি হাজার হাজার বছরের৷ সারা বিশ্বের এক নিখুঁত ভূচিত্র যেন বাংলাদেশ৷ কোথাও নিবিড় অরণ্যানী।  কোথ্ও দিগন্ত বিস্তৃত সমূদ্র সীমা৷ কোথাও ধ্যান গম্ভীর আকাশ ছোঁয়া পাহাড়৷ আবার কোথাও সমতলের উতার বিস্তৃত সবুজ শ্যামল অঞ্চল।  ছয় ঋতুর চির চঞ্চলা বাংলা। বৈশাখে চোখে স্থির বিদ্যুৎ, কালবৈশাখীর ঝড়ে আর বজ্রে নতুন প্রাণের ঘোষণা৷ জলগর্ভা আষাঢের বাংলা যেন মেঘের কালো ঘোমটায় ঢাকা ক্রন্দসী মেয়ে। শরতে সেই মেয়েই যেন হাস্যে লাস্যে মুখরা। তার রূপ আর বিচিত্র বর্ণের তখন তুলনা নেই৷ অঘ্রানের কুয়াশায় হেমন্তের কত কারুকার্য। ঘরে ঘরে নবান্নের উৎসব৷ শীতে রুক্ষতায় বৈরাগী আর বাউলের উদাস একতারা যেন বাজতে থাকে। তারপর সেই শীতার্ত মৃত্যু প্রহর শেষে ফাল্গুনের আগমণে রূপে রসে বর্ণে হেসে ওঠে আমার সোনার বাংলা, আমার রূপসী বাংলা।  যে বাংলাকে বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ বলেছেন, জননী বাংলা। জীবনানন্দ দাস যে বাংলার বুকে ধানসিঁড়ি নদী  বেয়ে হাজার বছর ধরে পথ চলতে চেেয়েছেন। যে বাংলাদেশের মুখের দিকে তাকালে,

মা বলিতে প্রাণ

করে আনচান

চোখে আসে জল ভরে

আমার জননী, আমার জন্মভূমি এই বাংলাদেশ। কবির কাছে সোনার বাংলা। সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে জননী বাংলা।

বাংলার রূপ, বাংলার সৌন্দর্য, বাংলার সম্পদ চিরকাল লুব্ধ বহিরাক্রমণকারীর, অত্যাচারীর, লুঠেরার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে। কবে কোন বিস্মৃত যুগে সমুদ্র গর্ভ থেকে উঠে এসেছে জননী বাংলা, গাঙ্গেয় বদ্বীপ,  গাঙ্গেয় বাংলা।  সেই সমুদ্রগুপ্তের যুগে যার এক অংশের নাম ছিল সমতট৷ সেই যুগেও সমুদ্রগুপ্তের দ্বিগিজয়ী বাহিনীর বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছিলেন বাংলার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য বাঙালী রাজারা৷ যুগে যুগে এই ভাবে বাংলাদেশ আক্রমণ ও লুন্ঠন করতে এসেছে হিংস্র আক্রমণকারীর দল। এসেছে পাঠান, মোগল, তুর্কী, তাতার, মগ, ফিরিঙ্গি, হার্মাদ, ফরাসি, পর্তুগীজ আর ইংরেজ, আর সবশেষে ইয়াহিয়া আর টিক্কার পশু বাহিনী।  বাংলার স্বাধীনতা, জননী জন্মভূমির মর্যাদা রক্ষার জন্য যুগে যুগে আত্মদান করেছেন কেদার রায়, ঈশা খাঁ, মুসা খাঁ, সিরাজ, মীর মর্দান, মোহনলাল প্রমুখ সহ অসংখ্য বীর শহীদ৷ যেমন এ যুগে ইয়াহিয়া টিক্কার পাশব বর্বরতার মোকাবিলায় সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি যুদ্ধের অকুতোভয় নেতৃত্ব নিয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।  অতীতে যেমন মীরজাফর, জগৎশেঠ, মীরণ, উঁমিচাদ, রায় দূর্লভদের মত মুষ্টিমেয় দেশদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতকদের অস্তিত্ব ছিল এ দেশে, ানজো তেমনি পরপদলেহী দেশদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকের অস্তিত্ব আছে বাংলাদেশে৷ সে যুগের মীর জাফরের ভূমিকায়৷ নেমেছে এ যুগের ফজলুল কাদের চৌধুরী ও সঁবুর খাঁ, জগৎশেঠের ভূমিকায় নেমেছে হামিদুল হক চৌধুরী,  রায় দূর্লভের ভূুমিকায় নেমেছে মাহমুদ আলী আর উঁমিচাদেের ভূমিকায় নেমেছে ঢাকার নবাব পরিবারের খাজা খয়েরুদ্দিন এবং সঙ্গে ডাঃ সালেক ও তার সাঙ্গপাঙ্গরা। এদের সঙ্গে আরো কুলাঙ্গার বেঈমান দেশদ্রোহী আছে, যেমন ফরিদ আহমদ, ওয়াহিদুজ্জামান,  গোলাম আজম, শফিকুল ইসলাম এবং আরো দুয়েকজন। কিন্তু এরা বাংলাদেশের ইতিহাস নয়। এরা আস্তাকুঁড়ের জঞ্জাল।  জঞ্জালের মতই এরা একদিন বাংলার বুক থেকে মুছে যাবে।  বাংলার মানুষ চিরকাল উদ্ভাসিত থাকবে, তিতুমীর, সূর্যসেন, প্রীতিলতা, বাঘা যতিন, ক্ষুদিরামদের নামে। সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর মনে মানসে চৈতন্যে যেমন ভাস্বর ও উদ্ভাসিত রয়েছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান।  বাংলার ইতিহাস তাকে তৈরী করেছে। তিনি বাঙালীর ইতিহাস তৈরী করছেন।

বাংলাদেশ অজেয়। বাংলাদেশের সংস্কৃতি অপরাজেয়।  তাই তো হিংস্র অত্যাচার ও ধ্বংসলীলার মধ্যে সেই অতীকেও বেঁচে রয়েছে বাংলা ভাষার আদি নিদর্শন চর্যাপদ। সুদূর নেপাল থেকে তাকে উদ্ধার করেছেন বাংলাদেশেরই এক পন্ডিত শীহরপ্রসাদ শাস্ত্রী।  বাংলাদেশ, বাংলার মানুষ, বাংলার ভাষা আর সংস্কৃতির এটা এক গৌরবোজ্জ্বল সংগ্রামের ইতিকথা।

পৃষ্ঠা পাঁচ

বৃটিশ কোম্পানী আর ইয়াহিয়া সরকারকে জাহাজ ভাড়া দেবে না

জন্মভূমিকে শত্রুমুক্ত করার দুঃসাহসিক অভিযানে ব্যাঘ্রের ক্ষিপ্রতা নিয়ে মুক্তি বাহিনী শত্রুর উপর আঘাতের পর আঘাত হেনে চলেছে। মুক্তি বাহিনীর কতিপয় অকুতোভয় কমান্ডো মঙ্গলা এবং খুলনা বন্দরে গত সপ্তাহে একটি মার্কিন জাহাজ ধ্বংস এবং একটি পাকিস্তানী মালবাহী জাহাজের ব্যপক ক্ষতি সাধন করে। 

গত ১৯/২৯ সেপ্টেম্বর রাতে মুক্তি বাহিনীর কয়েকজন কম্যান্ডো ‘ইউ এস এস লাইটনিং’ নামক একটি জাহাজকে তলদেশে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে ডুবিয়ে দিয়েছে।  পাকিস্তানী মালবাহী জাহাজ ‘আল-মুর্ত্তাজা’ ও অপর একটি বিস্ফোরণে মারাত্মক ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে।  জাহাজটির গায়ে বিরাট ছিদ্র হয়ে যায় এবং একদিকে হেলে পড়ে।

মুক্তি বাহিনীর মুখপাত্র আরও বলেন, খুলনা বন্দরে অপর একটি বিদেশী মালবাহী জাহাজের উপরও মুক্তি বাহিনী আক্রমণ চালিয়ে তার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করে।

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় মুক্তি বাহিনী রাস্তাঘাট ও পুল এবং কালভার্টের ব্যাপক ক্ষতি সাধন করায় জল্লাদ বাহিনীকে সামরিক রসদ চলাচলের জন্য নৌ পথ ব্যবহার করতে হচ্ছে। সে জন্য আমাদের বীর মুক্তি সেনারা নদী পথে সামরিক কাজে ব্যবহৃত নৌ-যানের উপর অতর্কিত হামলা অব্যাহত রেখেছে।

একটি বৃটিশ জাহাজ বিদ্ধস্ত

বৃটেনের অন্যতম শিপিং লাইন ‘ দ্য ব্যাঙ্ক লাইন’ ঘোষণা করেছে যে, সাম্প্রতিক ধ্বংসাত্মক কার্যকলাপের জন্য তাদের জাহাজ আর চট্টগ্রাম ও চালনা বন্দরে যাবে না। এ কোম্পানির বহু জাহাজ বাংলাদেশের বন্দরে আসা যাওয়া করতো।

এ কোম্পানীর ‘টিভিয়ট ব্যাঙ্ক ‘ নামক একটি মালবাহী জাহাজকে মুক্তি বাহিনী সম্প্রতি চট্টগ্রামে বিদ্ধস্ত করেছে।

***

কান কাটা রাজাকার

মুজিবনগরঃ ময়মনসিংহের একটি গ্রামের ক্রুদ্ধ জনসাধারণ ৪০ জন রাজাকারের কান কেটে নিয়েছে। এরা বর্তমানে ময়মনসিংহ হাসপাতালে রয়েছে।

পশ্চিম পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর সাথে সহযোগিতার অপরাধে গ্রামবাসীরা রাজাকারদের এক রাতে ঘিরে ফেলে সবাইর কান কেটে দেয়৷

পৃষ্ঠা ৭

শিল্প সংস্কৃতি

অন্যের ডায়েরী থেকে

– ইলিয়াস আহমদ

আমি নির্বাচনের দিন বিকেলে মেয়েদের একটি পোলিং রুমে ঢুকতে যাচ্ছিলাম।  এমন সময় সন্তান ক্রোড়ে এক উদ্বেগাকুল ভদ্রলোক আমাকে থামালেন।

বললেন- ‘আপনি তো ভেতরে যাচ্ছেন,  সেখানে আমার স্ত্রী রয়েছেন। আমার এই কোলের মেয়েটি তার কোলেই থাকার কথা।  কিন্তু ভোট দিতে অসুবিধে হবে বলে লোপাকে আমার কাছেই রেখে যান। চার ঘন্টা হলো তিনি লাইনে। মেয়েটিকে বোতলের দুধ খাইয়েছি৷ কিন্তু দুধ খেয়েই মেয়েটি বমি করে কেমন নেতিয়ে পগেছে – দেখেছেন?  এখন হয়তো তার মায়ের দুধ পেলে একটু চাঙা হয়ে উঠতে পারে।  আমি অনেক ডাকাডাকি করেছি। স্ত্রী আসেননি। পুরুষ মানুষ বলে ভেতরে ঢুকার সাহস করতে পারছি না। আপনি তো প্রার্থী। ঐ যে উনি আমার স্ত্রী। আপনি একটু বুঝিয়ে বললেই তিনি বাইরে আসবেন।

আমি ভেতরে ঢুকেই মহিলাকে বাইরে যেতে বিনয়ের সাথে অনুরোধ জানালাম। তিনি আমার দিকে না তাকিয়েই গুটি গুটি পায়ে লাইনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে এগুচ্ছিলেন। এবার আমি বললাম, ‘আপনার মেয়েটির অবস্থা খারাপ, আপনি বাইরে যান দয়া করে। ‘ এবারও মহিলা আমার মুখের দিকে তাকালেন না। আমি এর পরে বললাম, নৌকা মার্কার বক্সে একটা ভোট কম হলেও চলবে, আপনি আপনার সন্তানকে দেখতে যান দয়া করে।  এবার মহিলা আমার দিকে চোখ তুলে তাকালেন। আমি একটু ভয় পেয়ে গেলাম। মহিলার চোখে রক্তের আভাস যেন৷

সক্রোধে তিনি বললেন, ‘আমার সন্তান মরে গেলেও আমি লাইন ছাড়বো না। ভোট আমি দেবোই৷ আপনার কথায় তো আমি ভোট দিতে আসিনি। আপনার কথায় লাইন ছাড়বো কেন? ‘ এ উত্তরের পর আমি লাইনের মাথার দিকে তাকালাম। দেখলাম যে, আমার নানী শাশুড়ী লাইনের মাথায়৷ কুব্জ দেহ, লাঠির উপর ভর করে কোন রকমে জীবন পার করে দিচ্ছেন। লাঠির মাথায় শেখ মুজিবের একটি ছবি। কেউ হয়তো লাগিয়ে দিয়েছে।

আমি কিছুক্ষণ ভাবলাম। তার পরই নানী শাশুড়ীর কাছে যেয়ে তাকে লাইন থেকে সরিয়ে এনে তার জায়গায় মহিলাকে প্রায় জোর করে দাঁড় করিয়ে দিলাম।

আমার বৃদ্ধা কুব্জ আত্মীয়া মহিলার জায়গায় এসে দাড়ালেন৷ আমি মহিলার ভোট দেওয়া পর্যন্ত সাঙ্গ হওয়ার পর তাকে বাইরে নিয়ে গিয়ে স্বামীর হাতে সঁপে দিলাম। মুহূর্তের ঝটকায় স্বামীর কোল থেকে বাচ্চাটাকে প্রায় কেড়ে নিয়ে চুমোয় চুমোয় তাকে ভরে তুললো।

~~~~~~~

একটি বিদেশী সংবাদ সরবরাহ প্রতিষ্ঠানের ভিয়েতনাম-লাওস খ্যাত জনৈক সংবাদদাতার সাথে বাংলাদেশের মুক্ত এলাকায় একটি মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্পে আলাপ হচ্ছিল। পাঁচ সাতটা নানা আকৃতির ক্যামেরা তার কাঁধে। পরনে হাঁফ প্যান্ট আর পায়ে গাম বুট। টেপ রেকর্ডারের মাউথ -পিসটা পকেটে নেতিয়ে রয়েছে। আমাকে একটা হাভানা সিগার বাড়িয়ে দিয়ে নিজে আর একটি ধরিয়ে ক্যাম্পের ভেজা মাটির ওপর চেপে বসে পড়লেন।  মুক্তি বাহিনীর একজন লুঙ্গি পড়া সৈনিক এনামেলের বাটিতে করে দু’কাপ দুধহীন চা দিয়ে গেলেন। সৈনিকটি পঁচিশে মার্চের আগেও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বায়োলজির ফাইনাল বর্ষের ছাত্র ছিলেন।

চায়ে একটি আরামের চুমুক দিয়ে আঃ বলে একটি তৃপ্তির শব্দ তুললেন বিদেশী সাংবাদিক।  তারপর বললেনঃ “আমি এখন ভারত সীমান্তের শরনার্থী ক্যাম্প থেকে ফিরছি। আমার সাথে চৌদ্দ বছরের একটি ছেলে ছিল। তাকে ক্যাম্পে তার মায়ের সাথে দেখা করিয়ে দিয়ে আবার তার ক্যাম্পে ফিরিয়ে দিয়ে এসেছি। আমি এই ছেলেটির চাইতে আর কম বয়সী মুক্তি সেনা আর দেখিনি। বাংলাদেশের কোন মুক্তি ফৌজ ক্যাম্পে নয়, ভিয়েতনামের কোন ভিয়েং কং ক্যাম্পেও নয়। সে যখন রাইফেলটি তার কাঁধে ঝুলিয়েছিল তখন তার বাটটি তার গোড়ালী ছুঁই ছুঁই করছিল। কিন্তু তার তাঁক অব্যর্থ।  বাম চোখে নিশানা করে গুলি ছুড়লে গুলিটি চোখের পাতায় লাগবে না, একেবারে রাজ্য বিদ্ধ করবে৷ বিত্তশালী শিক্ষিত পিতার একমাত্র সন্তান যুদ্ধের আগে ফৌজদারহাট ক্যাডেট কলেজের নীচু ক্লাসের ছাত্র ছিল। রাইফেল ক্লাবে নিয়মিত  শ্যুটিং প্রাকটিস করতো।

ঢাকার রাজারবাগ পুলিশ লাইনের বিপরীতে ছিল তাদের দ্বিতল ভবন। একজন বাঙালী বিত্তশালী পরিবারের যা থাকার কথা,  তার সবই ছিল।  টেলিভিশন, রেডিওগ্রাম, দামী রেডিও, কার্পেট, সেগুনের আসবাবপত্র  আরো কত কি! অনেক স্বপ্ন দিয়ে ঘেরা সংসার।  ছেলেটির মা সংসারে একটি মেয়ের অভাব বিশেষ ভাবে অনুভব করতেন। পাড়ার অন্য বাসার ছেলে মেয়েরা এলে গভীর আবেগে তাদের আদর করতেন, খাওয়াতেন। যাওয়ার সময় হাতে দু চারটে টফি লজেন্স তুলে দিতেন। তাদের থেকে আবার আসার জন্য প্রতিশ্রুতি আদায় করতেন। এশিয়া আফ্রিকায় যেখানে অনভিপ্রেত অবাঞ্ছিত মনে করা হলেও কন্যার তোড়ের মত সন্তান আসে, সেখানে ছেলেটির মার একটি মেয়ের অভাব পূরণ হয় নি। তাই ছেলেটিকে ঘিরেই বাবা মায়ের স্বপ্ন অর্কিডের মতো আকাশ ছোঁয়ার স্পর্ধা করতো।

পঁচিশে মার্চের আগে একটি পশ্চিম পাকিস্তানী মালিকানাধীন ব্যাঙ্কে গচ্ছিত এক লাখ বাষট্টি হাজার টাকা ভদ্রলোক উঠিয়ে নেন। আশঙ্কা ছিল ব্যাঙ্ক লাল বাতি জ্বালাবে। আর পশ্চিম পাকিস্তানী ব্যাঙ্কে টাকা রাখবেই বা কেন! সব টাকা উঠিয়ে তাই ঘরে রেখে দেন।

তারপর এলো সেই ভয়ঙ্কর রাত। চার দিকে শুরু হলো আক্রমণ।  আমেরিকান সৈন্যরা ভিয়েতনামে যে সব অস্ত্র নিয়ে আক্রমণ করে তেমনি সব অস্ত্র।  সর্বাধুনিক সব অস্ত্র।  আমি দীর্ঘ সাত বছর আমার নিউজ এজেন্সির জন্য সংবাদ সরবরাহ করেছি ভিয়েতনাম থেকে। এর আগে আমেরিন ফোর্মের অফিসার ছিলাম। সুতরাং শব্দ শুনেই আমি বুঝতে পেছেছিলাম সব ধরণের সামরিক অস্ত্রই পান্জাবী জল্লাদরা ব্যবহার করছে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের ওপর। আমি সারা রাত ঢাকার হোটেল ইন্টার কন্টিনেন্টালের ছাদে ছিলাম। রাত বারোটার সময় রিসেপশনে এসে দেখি খাকী ইউনিফর্মধারীর লাউন্জে গিজগিজ করছে।  হিংস্র হায়েনার মত তাদের চোখ জ্বল জ্বল করছে। কন্টিনেন্টালের সামনের ফ্লাগ মাস্টে তখনও উড়ছিলো কালো পতাকা আর স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা। দুটিই নামিয়ে তারা পুড়িয়ে দেয়। রাইফেলের বাট দিয়ে বাঙালী কর্মচারীদের অমানুষিক ভাবে পেটাতে লাগলো। পরে খবর নিয়েছিলাম, প্রথমে হোটেলে ঢুকেই ক্ষিপ্ত কুকুরের চাইতেও পাশবিক উত্তেজনায় পান্জাবী সৈন্যরা অনেককে ধরে সামনে বটগাছের তলায় দাড় করিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এরপরও যারা পালাতে পারেনি তাদের ওপর চলে নির্মম নির্যাতন।  তাদের একমাত্র অপরাধ তারা বাংলা ভাষায় কথা বলে৷

আমি যে ছেলেটির কথা বলছি তার বাবারও অপরাধ তিনিও বাংলা ভাষায় কথা বলতেন। রবীন্দ্র সঙ্গীতের রেকর্ডের কালেকশন ছিল। বাঙালী বলে ভাবতে নিজেকে গর্ববোধ করতেন। আর কিছু নয়। রাজনৈতিক আঙিনায় কোনদিন তার পদক্ষেপ পড়েনি৷ তার রাজনীতি ছিল তিনি বাঙালী। তাই রাত বারোটার সময় তার দ্বিতল বাড়িতে হামলা চালানো হয়। ছেলেটি জানালা দিয়ে দেখলো একজন অবাঙ্গালী মুসলমান সৈন্যদের বাড়িটি দেখিয়ে দিচ্ছে। সামনের ছোট স্টেশনারি দোকানের মালিক ছিল সে। ছেলের বাবা মা সদাই করতেন সে দোকান থেকে। 

এ দৃশ্য দেখার পর ছেলের বাবা ছেলে আর তার মাকে ছাদে উঠিয়ে দিয়ে দরজা বন্ধ করে দেয়।  ছাদে থেকে টের পেলো খান সেনারা ঘরে ঢুকছে এবং কুকুরের মতো চীৎকার করছে। তারপর হঠাৎ শুনলো সে তার বাবার করুণ আর্তনাদ।  সাইরেনের মতো উর্দু শব্দ গুলো তাদের কানে আছড়ে পড়ছিল। তার বাংলা হলো- ছয় দফা চেয়েছিলে। বাঙালী কুত্তার বাচ্চারা ছয় দফা বলার একটি লোককেও অবশিষ্ট রাখবোনা। লেও ছে দফা। তারপর ছেলেটির বাবাকে ফ্লোরে শুইয়ে ছ’জন পান্জাবী পশু ছ’দফাে প্রতীক হিসেবে দেহের ওপর বুট সমেত ছ’বার ঝাঁপিয়ে পড়ে থেতলেে তাঁককে হত্যা করেছিল।

চব্বিশে মার্চ ছেলেটি তার কয়েক ঘন্টা পূর্বের সধবা কিন্তু হঠাৎ বিধবা হয়ে যাওয়া মাকে নিয়ে নীচে নেমে পিতার নাড়িভুড়ি বের হয়ে যাওয়া বিকৃত বিভৎস দেহ দেখে বিকট চিৎকার দিয়ে জ্ঞান হারিয়ে ফ্লোরে পড়ে যায়।  কতক্ষণ এ অবস্থায় ছিল জানে না। হঠাৎ চোখে মেলে দেখে তার বিধবা মা তখনও অজ্ঞান।  মুখের কোল বেয়ে ফেনা গড়িয়ে পড়ছে। তারপর ছেলেটি তাড়াতাড়ি মায়ের চোখে মুখে পানি ছিঁটিয়ে দিতে লাগলো। কতক্ষণ পরে মা চোখ তুলে তাকিয়ে ছেলেকে বুকের মধ্যে টেনে নিয়ে সে কি কান্না।  যেন হিমালয়ের উচ্চতা থেকে নদী নীচের দিকে ছুটে চলেছে।

তখনই তারা পালাবার সিদ্ধান্ত নেয়৷ ঘরের চারদিকে তাকিয়ে দেখে অবশিষ্ট কিছুই নেই। সব ট্রাকে উঠিয়ে নিয়ে গেছে। হাতের দিকে হঠাৎ চোখ পড়লো। দেখলো সোনার কয়েকটি চুড়ি দু’হাতে রয়েছে। তাড়াতাড়ি সব খুলে ফেলে কোমরে গুঁজে নিল। এমন সময় শুনলো ভারী বুটের শব্দ।  তাড়াতাড়ি গিয়ে তারা বাথরুমে আশ্রয় নেয়। কিছুক্ষণ পরে বুটের শব্দ মিলিয়ে গেলে বাথরুম থেকে বের হয়ে এসে দেখে ছিন্নভিন্ন মৃতদেহটি গায়েব। একজনের স্বামী আর একজনের বাবার কবরে দু’ফোঁটা চোখের জল ফেলারও সুযোগ দিতে নারাজ ইয়াহিয়া – টিক্কারা।

ছেলেটির বাবা তার দেশের বাড়িতে তার কবরের জায়গা ঠিক করে রেখেছিল। একটা বকুল গাছের নীচে। ছায়া ঘেরা জায়গা। ছায়া ঘেরা কবরে চির নিদ্রায় থাকতে চেয়েছিলেন। এখন পাইকারী গোরস্থানে শায়িত। কোথায় তিনি সমাহিত কেউ আর কোনদিন বলতে পারবে না।

পালাবার আগে টাকা নেবার পালা। কিন্তু কিছুই যে নেই। দুর্বৃত্তদের ভয়ে টেলিভিশনের মধ্যে এক লাখ আর রেডিওগ্রামের মধ্যে বাষট্টি হাজার টাকার নোট লুকিয়ে রেখেছিলেন। টেলিভিশনও নেই, রেডিওগ্রামও নেই। সারা বাড়ি খুঁজে একশ’ পনেরো টাকা যোগাড় করলো তারা। তারপরই যাত্রা শুরু করলো অনির্দিষ্টের পানে। এসে ঠেকলেন আগরতলায়৷ এককানেই এখন মায়ের বাস। ছেলেটি থাকে ক্যাম্পেম মুক্তি বাহিনীর ক্যাম্প৷

ছেলেটি এই ক্যাম্পের সৌভাগ্যের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে। ওরা যখন কোন অপারেশনে যায়, তখনন ছেলেটিও সাথে যায়। লক্ষ্য বস্তুর প্রথম গুলিবর্ষণের অধিকার ছেলেটির। সে তার৷ থ্রি নট থ্রি রাইফেল থেকে প্রথম গুলি ছোড়ে শত্রুর ওপর। তারপর শুরু হয় স্বয়ংক্রিয় অস্ত্রের আক্রমণ। 

ক্যাম্প থেকে বেরুবো এমন সময় কম্যান্ডার আমাকে একটি অনুরোধ জানালেন। তিনি ছেলেটিকে ভারত সীমান্তের কোন এক শরনার্থী শিবিরে তার মায়ের কাছে পৌছে দিয়ে আবার মুক্তি ফৌজ ক্যাম্পে ফিরিয়ে দিয়ে যাবার অনুরোধ জানালেন।

কম্যান্ডার পঁচিশে মার্চের আগে সেনাবাহিনীর মেডিকেল ক্যোবের অফিসার ছিলেন৷ ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল থেকে এম, বি, বি, এস ডিগ্রী নিয়েছিলেন। এখন তিনি পুরোদস্তুর যোদ্ধা। যে হাত স্টেথোস্কোপ কানে লাগিয়ে রোগীর রোগ নির্ণয় করতো এখন সে হাতে থাকে আগ্নেয়াস্ত্র।  শত্রুর বক্ষ বিদীর্ণ করা এখন তার পেশা।

আমি আমার জিপে ছেলেটিকে উঠিয়ে নিলাম। অনেক কথা জিজ্ঞেস করলাম কিন্তু বিশেষ জবাব পেলাম না। ছেলেটির চোখে যেন বৃদ্ধের সৃষ্টি বাসা বেঁধেছে।  দৃষ্টি যেন এখানে নয়, ওখানে নয় – কোন সুদূরে। হয়তো সে তার বাবার বুটের আঘাতে থেৎলানো দেহের বিভৎস দৃশ্য দেখে চমকে চমকে উঠছিল।

তার মা যে ক্যাম্পে থাকে সেখানে তাকে নামিয়ে দিলাম। বললাম – পনেরো মিনিট পরে আমি ফিরে আসবো। তুমি সামনে দাড়িয়ে থেকো। আমি ষোল মিনিটের সময় নির্দিষ্ট স্থানে এসে আমার ভাড়া করা জিপ দাঁড় করালাম। দেখলাম ছেলেটি আমার দিকে এগিয়ে আসছে। সে জীপে উঠে বসলো। আমি জীপ ছেড়ে দিলাম।

ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করলাম, তোমার মা তোমাকে ছেড়ে দিলো? যুদ্ধে যেতে দিলো?

ছেলেটি বললোঃ আমি যতক্ষণ মায়ের কাছে ছিলাম মা সারাক্ষণ আমাকে ছোট ছেলেটির মতো বুকে জড়িয়ে বসেছিল। আমার দুঃখী মা আমাকে সারাক্ষণ উত্তাপ দিয়েছিলেন। সে উত্তাপের ভাষা যেন ছিল, ‘তোমার বাবার মৃত্যুর প্রতিশোধ নাও, তোমার দেশবাসীর মৃত্যুর প্রতিশোধ নাও।’

‘মা, আমার মা আমাকে আর কিছু বলেনি’ আমি যখন বললাম, ‘আমি ক্যাম্পে যাচ্ছি’ মা ই তখন আমাকে এগিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন।

***

পৃষ্ঠা- আট

প্রকাশিত সংবাদের প্রতিবাদ

গত বৃহস্পতিবার বাংলাদেশ সরকারের এক বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়ঃ “ভারত-সোভিয়েট নেতৃবৃন্দের যুক্ত বিবৃতি বর্তমান সরকারের পর্যালোচনাধীন। কিন্তু অত্যন্ত বিস্ময়ের বিষয় মুজিবনগরের ঘনিষ্ঠ মহলের বরাত দিয়ে কতিপয় সংবাদপত্রে আলোচ্য যুক্ত বিবৃতির একটা প্রতিক্রিয়া ছাপানো হয়েছে।  বাংলাদেশ সরকার পরিষ্কার ভাবে জানিয়ে দিতে চান যে, আলোচ্য সংবাদে ঘনিষ্ঠ মহলের বলে কথিত যে মতামত ব্যক্ত করা হয়েছে তার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোনও সম্পর্ক নেই।

***

২০শে অক্টোবর বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভা

আগামী ২০শে অক্টোবর মুজিবনগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক সভা আহ্বান করা হয়েছে।

এ সম্পর্কে এক বিজ্ঞপ্তিতে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জানান যে, উক্ত সভায় অন্যান্য বিষয়ের সাথে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করা হবে। 

প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর এটা হবে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির দ্বিতীয় সভা। প্রথম সভা বিগত ৫ই ও ৬ই জুলাই মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়।

***

মাহমুদ আলীর গৃহে গেরিলাদের হামলা

রাষ্ট্র ঘংঘের সাধারণ অধিবেশনের পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা মাহমুদ আলীর ঢাকার বাস ভবনে গেরিলা বাহিনী আক্রমণ চালিয়েছেন। মাহমুদ আলীকে প্রতিনিধি দলের নেতা নির্বাচন করার পরই এই ঘটনা ঘটে৷ পরে মাহমুদ আলীর স্ত্রী ও ছেলে মেয়েদেরকে ভিন্ন বাড়ীতে স্থানান্তরিত করা হয়।  সেপাই সান্ত্রী দিবারাত্রি পাহারা দিলেও পদলেহী দালালের পরিবারকে নিজেদের ঘরে রাখার সাহস হয়নি জল্লাদদের৷

জঙ্গী সরকারের অপর একজন উগ্র সমর্থক, বাংলা একাডেমির সাবেক ডিরেক্টর ডঃ কাজী দীন মোহাম্মদের বাসভবনটিও গেরিলা আক্রমণে ধ্বংস হয়ে যায়।  কিছুদিন পূর্বে বাংলা একাডেমির এক সভা থেকে দর্শকদের আক্রমণের ভয়ে তাকে পাঁচিল টপকে পালাতে হয়েছিল৷

***

আর একজন কুটনৈতিক মিশন কর্মচারীর আনুগত্য বদল

নয়াদিল্লীর পাকিস্তান হাই কমিশনের আরও একজন বাঙালী কর্মচারী ২৭ বৎসর বয়স্ক টেলিফোন একচেন্জের সুপারভাইজার জনাব এস, এস, নুরুল হুদা বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তার আনুগত্য ঘোষণা করেন। তাকে নিয়ে এ পর্যন্ত দিল্লীর পাক হাই কমিশনের ৬ জন কর্মী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য  প্রকাশ করেছেন।  এদের মধ্যে ২ জন কুটনৈতিক রয়েছেন।

হাই কমিশন অফিসের দেয়াল টপকে ট্যাকসি নিয়ে সোজা বাংলাদেশ মিশনে চলে আসেন৷

এক বিবৃতিতে জনাব নুরুল হুদা বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যের বর্বরতা তিনি গভীর উদ্বেগ ও আতঙ্ক নিয়ে লক্ষ্য করেছিলেন এবং স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের অধীনে কাজ করার জন্য আগ্রহী ছিলেন।

তিনি বলেন যে, তিনি হানাদারদের অধীনে চাকুরী করতে পারেন না। হানাদারদের নিন্দা করার জন্য এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে সমর্থন করার জন্য তিনি বিশ্বসমাজের প্রতি আবেদন জানিয়েছেন। 

***

এ সপ্তাহে 

সেপ্টেম্বর ২২ঃ  সোভিয়েট জেনারেলের স্টাফের পদে মার্শাল মতভে যখরভের স্থলে ৫০ বৎসর বয়স্ক জেনারেল ভিক্টর কুলিকভকে নিয়োগ করা হয়েছে।

চীনের ১লা অক্টোবরের কুচকাওয়াজ বাতিল ঘোষিত হওয়ার সংবাদ পিকিং বেতার থেকে প্রচার করা হয়েছে। সাধারণত এই কুচকাওয়াজে মাও সেতুং উপস্থিত থাকেন এবং অভিবাদন গ্রহণ করেন।  ফ্রান্সে নিযুক্ত চীনের রাষ্ট্রদূত ফ্রান্সের একটি বার্তা প্রতিষ্ঠানের পরিবেশিত সংবাদের সত্যতা অস্বীকার করেন। উক্ত সংবাদে বলা হয়েছিল যে, হয় মাও সেতুং মারা গিয়েছেন না হয় তিনি গুরুতর রূপে অসুস্থ।

সেপ্টেম্বর ২৩ঃ বৃটেনের শ্রমিক দলীয় সাবেক প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মিঃ ডেনিস হীলে বলেন যে, জাতিসংঘ যদি প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন না করে তাহলে বাংলাদেশে লক্ষ লক্ষ লোক অনাহারে মারা যাবেন।

ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট পম্পিড্যু বলেন যে, যুদ্ধের মাধ্যমে নয়, রাজনৈতিক ভাবেই বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান করা প্রয়োজন।

সেপ্টেম্বর ২৪ঃ দখলীকৃত ঢাকা বেতারের খবরে জানা যায় যে, ঢাকায় ব্ল্যাক আউটের মহড়া চলছে। ব্ল্যাক আউট ভঙ্গকারীদের শাস্তি দেয়া হবে বলে বেতারে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।  বৃটেন থেকে ১০৫ জন রুশ কুটনীতিক বহিষ্কৃত হয়েছেন। কুটনীতির ইতিহাসে এক সাথে এতো সংখ্যক কুটনীতিক বিতাড়নের ঘটনা এই প্রথম।

সেপ্টেম্বর ২৫ঃ ভারতের কাছাড় জেলার নাথানপুরে এবং কৃষ্ণনগরের শিকারপুরের কাছে পাকিস্তানী সৈন্যরা গোলাবর্ষণ করে। শত শত ভয়ার্ত গ্রামবাসীকে সুরক্ষিত এলাকায় স্থানান্তরিত করা হয়। 

সেপ্টেম্বর ২৬ঃ ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী মস্কোতে বিপুল ভাবে সম্বর্ধীত হন।

সোভিয়েট ইউনিয়ন পৃথিবীর বৃহত্তম আন্ডারগ্রাউন্ড পারমাণবিক বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে। 

ভারতের ত্রিপুরা রাজ্যের কৃষ্ণ নগর, শ্রীনগর ও করিমাটিল্লা গ্রামে পাক সেনাদের গোলাবর্ষণের ফলে ৪ জন ভারতীয় নাগরিক নিহটহন এবং অপর ৪ জন গুরুতর রূপে আহত হন।

***

গত মাসে কুমিল্লার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর হাতে সাড়ে তিন শত সৈন্য নিহত

আমাদের বীর মুক্তি যোদ্ধারা গত মাসের শেষ সপ্তাহে শত্রু সৈন্যের ওপর আরো তীব্রতর আঘাত হেনে বীরত্বের সাথে পূর্ব রণাঙ্গনে, বিশেষ করে কুমিল্লা, সিলেট, নোয়াখালী ও চাটগাঁয়ে আড়াই শতাধিক হানাদার সৈন্য ও তাদের তাবেদার সহযোগী রাজাকারকে নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। মুক্তি বাহিনীর তরুণ সেনানীরা গেরিলা কৌশল অবলম্বন করে এই প্রশংসনীয় সাফল্য অর্জন করেন।

সংবাদ বিবরণীতে প্রকাশ মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লার পার্শ্ববর্তী এলাকা গুলোতে এবং মেহারী অঞ্চলে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়ে শত্রু সেনাকে কাবু করে ফেলেন। মুক্তি যোদ্ধাদের আক্রমণে দিশেহারা হয়ে ৬৩ জন কুখ্যাত বেঈমান রাজাকার অস্ত্রশস্ত্র সমেত মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা পড়ে।  গত ১৭ই সেপ্টেম্বর গেরিলা যোদ্ধাদের  অনুরূপ আক্রমণে একজন অফিসারসহ ৬৫ জন হানাদার সৈন্য নিহত হয়।

মুক্তি বাহিনীর অকুতোভয় অসীম সাহসী যোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে হানাদার সৈন্যের ওপর ক্রমাগত চাপ অব্যাহত রেখেছেন এবং শত্রু চলাচলের জল-স্থলের সব ধরণের যোগাযোগ ব্যবস্থার ওপর প্রচন্ড আঘাত হেনে চলেছেন।

গত মাসে আমাদের তরুণ মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে প্রতিপক্ষ শত্রু বাহিনীর ব্যাপক সৈন্য নিহত ও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে।  এছাড়া প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।

এ সম্পর্কে সর্বশেষ প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত ২৯শে সেপ্টেম্বর কুমিল্লা জেলার বশমঙ্গল ও লেহাই মুরির মধ্যবর্তী এলাকায় শত্রু অবস্থানের ওপর চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে হানাদার সৈন্য দের পর্যুদস্ত করে ফেলেন। ইয়াহিয়া সরকারের ১৫ জন দস্যু সৈন্যকে হত্যা করেন। একই দিনে আমাদের তরুণরা ফাঁদ পেতে বিভিন্ন স্থান থেকে আক্রমণ চালিয়ে বামপুর ও কোটেশ্বরের মধ্যবর্তী এলাকায় আরও ২ জন সৈন্যকে খতম করেন। এছাড়া তালশহরের ২টি বৈদ্যুতিক ও ৫টি টেলিফোন পোল বিদ্ধস্ত করে যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিয়েছেন। 

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, সেপ্টেম্বর মাসের ১ম পক্ষ কালে কুমিল্লা জেলার নবীনগর ও কসবা থানার পল্লী এলাকাগুলোতে মুক্তিযোদ্ধারা ১৩০ জনের অধিক খান সেনা ও রাজাকারকে খতম করেছেন। 

হানাদার বাহিনীর এই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতিতে ক্ষিপ্ত হয়ে পাল্টা ব্যবস্থা নেয় এবং ৩০ জন নিরীহ গ্রামবাসীকে হত্যা করে।  এছাড়া ব্যাপক লুটপাট ও ৫ শত গৃহ ভস্মীভূত করে।

গত মাসের প্রথম সপ্তাহে হানাদার সৈন্যরা নবীনগর থানাধীন মীরপুর গ্রামে আক্রমণ ও প্রায় সব ঘরবাড়ি লুন্ঠন করে। হানাদাররা রাজাকারদের সঙ্গে  নিয়ে ৫টি নৌকায় গমন করে অলঙ্কার পত্র, পাট, ধান নিয়ে যায় এবং ঘরবাড়িতে অবাধে আগুন লাগিয়ে দেয়।

মুক্তি বাহিনী পাক-সৈন্যদের প্রতিরোধের জন্য এগিয়ে গেলে প্রচন্ড গুলি বিনিময় হয়। সংঘর্ষে ৩১ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত ও ৩ জন আহত হয়। পরে আরো একদল সৈন্য হানাদারদের সাহায্যের জন্য মোটর লঞ্চ যোগে গ্রামে ঢুকে গ্রামবাসীদের ওপর বেপরোয়া গুলী বর্ষণ করে তিন জন নিরস্ত্র লোককে হত্যা ও অপর ৬ জনকে আহত করে।

মীরপুর গ্রামের পর পাকিস্তানী সৈন্যরা গ্রাম ডাকুনিয়ায় হানা দেয়।  মুক্তিবাহিনী বিদ্যাকূট গ্রামে হানাদারদের বিরুদ্ধে এর দাঁতভাঙা জবাব দেন। এই সংঘর্ষে শতাধিক খানসেনা প্রাণ হারায়।

গত ১৯শে সেপ্টেম্বর স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা কাইয়ুমপুরে দখলদার সৈন্যদের উপর অভিযান চালিয়ে ৩২ জনকে খতম এবং ৭ জনকে গুরুতরভাবে আহত করেন। পরের দিন গেরিলা যোদ্ধারা দস্যু সৈন্যবাহী দুটি নৌকা ডুবিয়ে দেন। ফলে ১৫ জন সৈন্যের সলিল সমাধি হয়।

মুক্তি যোদ্ধারা গত মাসের ১৫ তারিখে আজনাপুরে জল্লাদ সৈন্যদের ওপর এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১৫ জন সৈন্যকে খতম করেন।

***

বিজ্ঞপ্তি

জয়বাংলা প্রেসের টাইপ পরিবর্তন ও অন্যান্য কারণে জয়বাংলার এই সংখ্যা শুক্রবারের বদলে সোমবার প্রকাশিত হল৷ পরবর্তী সংখ্যা যথারীতি শুক্রবারে প্রকাশিত হবে। 

– কর্মাধ্যক্ষ, জয়বাংলা

***

বিপ্লবী হীরালাল নেই

বাংলাদেশের বিশিষ্ট বিপ্লবী নেতা শ্রী হীরালাল দাশগুপ্তকে সম্প্রতি পাকসেনারা পটুয়াখালীতে গুলি করে হত্যা করেছে। ৬৮ বৎসর বয়স্ক শ্রী দাশগুপ্ত আইয়ুব আমল থেকেই জেলে ছিলেন।

***

ইউনিকোডে টাইপ – Maruf Muktadir Khan

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!