You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ২৪ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পাতা-১

বিশ্বমানবতা জল্লাদ ইয়াহিয়ার বিচার চায়

জাতিসংঘ কি তা করতে পারবে?

                                                         (রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

গত ২১শে সেপ্টেম্বর থেকে বহু বিঘোষিত জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়েছে।বিশ্বের সদস্য রাষ্ট্রগুলোর প্রতিনিধিগণ প্রতি বারের মতোই এবারও এই বিশ্ব সম্মেলনে যোগদান করেছেন। কিন্তু এবারের জাতিসংঘ সম্মেলনে আরো । একটি নতুন স্বাধীন দেশের প্রতিনিধিরা। যোগ দিতে গিয়েছেন। এ দেশটি হলো স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। যদিও জাতিসংঘের সদস্য পদ তার অর্জিত হয়নি কিংবা পৃথিবীর কোনো দেশের কাছ থেকে এখনো রাজনৈতিক স্বীকৃতি পায়নি, তবুও এই বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের কাছে বাংলাদেশ তার নিজস্ব গণতান্ত্রিক অধিকারেই হাজির হয়েছে।

জাতিসঙ্ঘের অধিবেশনে পৃথিবীর প্রতিটি অঞ্চলের অধিবাসীদের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ব্যক্তি স্বাধীনতা ও মানবিক অধিকারগত সমস্যার প্রশ্ন উত্থাপিত হয়। গণহত্যা, মানবাধিকার লঙ্ঘন, -বর্ণ বৈষম্য, ধর্মান্ধ সাম্প্রদায়িকতা, নারীনির্যাতন, কোনো অঞ্চলে উত্তেজনা ও যুদ্ধের আশংকা প্রভৃতি বিষয়ের বহু জটিল প্রশ্ন নিয়ে বহুত্তর বিতর্কের সূত্রপাত ঘটে থাকে। কিন্তু দুর্ভাগ্যজনক ও নিষ্ঠুর সত্য এই যে এই সব সমস্যা  সমাধানে প্রায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই জাতিসংঘের ভূমিকা খুব উজল নয় ; বরং বিশ্বরাজনীতির দাখেলায় বহু মানবিক প্রশ্নই নানাভাবে উপেক্ষিত হতে দেখা গেছে। একদা লীগ অব  নেশন্সের ব্যর্থতা মানবজাতির ভাগ্যে  যে মর্মান্তিক পরিণতি নিয়ে এসেছিলো,  আজকের জাতিসংঘ কর্মকর্তাদের সে ব্যর্থতার নজির থেকেই শিক্ষা গ্রহণ করতে হবে । সম্ভবত তাহলেই কেবল জাতিসংঘ ইতিহাসের সেই নিষ্ঠুরতম পুনরাবৃত্তিকে ঠেকাতে সক্ষম হবে।

 বাংলাদেশে গত ছয় মাসে পৃথিবীর  বৃহত্তর গণহত্যা সংঘটিত হয়েছে। এ  শতাব্দীর সবচেয়ে নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড; নারী-নির্যাতন, লুণ্ঠন ও বর্বরোচিত ধ্বংসলীলার যে নারকীয় ইতিহাস রচিত হয়েছে, যার কাছে চেঙ্গিস। হালাকু কিংবা হিটলরের নৃশংসতাও  ম্লান হয়ে যায়, মানবইতিহাসের এমন।  বীভৎস দৃশ্য দেখেও জাতিসংঘের মতো বিশ্বপ্রতিষ্ঠানের কণ্ঠ তীব্রতর  প্রতিরোধের ভাষায় সোচ্চার হয়ে – ওঠেনি, সক্রিয় হস্তক্ষেপ মানবতার এই  অপমান রোধে অগ্রসর হননি। বরং  প্রিন্স সদরুদ্দিন আগা খানের মতো পশ্চিম পাকিস্তান ঘেষা পূজিপাতকে মামুলি সফরে পাঠিয়ে জাতিসংঘ মোটামুটিভাবে তার দায়িত্ব শেষ করেছেন এমন বললে বোধকরি বাড়িয়ে বলা হবে না।

বাংলাদেশের এই মর্মান্তিক ঘটনা কে জাতিসংঘের সেক্রেটারী মিঃ উ থান্ট কেবল ‘মানব সভ্যতার দূরপনেয় কলংক’ বলেই খালাস হলে চলবে না ; মানব সভ্যতার এই দূরপনেয় কলংকের যে হোতা, যে স্বনির্বাচিত প্রেসিডেণ্টের ষড়যন্ত্র ও ক্র র ইচ্ছায় এ শতাব্দীর এতোবড়ো একটা ধবংস যজ্ঞ সংঘটিত হচ্ছে, দশ লক্ষ নরনারী পশুর মতো প্রাণ দিয়েছেন, পঁচাশি লক্ষ লোক ঘরবাড়ী সর্বস্ব হারিয়ে অন্যদেশে আশ্রয় নিয়েছেন, আরে লক্ষ লক্ষ মানুষ যেখানে প্রতিনিয়ত মৃত্যুর মুখোমুখি বসবাস করছে, যার উন্মাদ খেলায় মানব সভ্যতার এমন দূরপনেয় কলংক সূচিত হতে পারলে, বিশ্বমানবের প্রতিষ্ঠান জাতিসংঘেরই দায়িত্ব সেই একরোখা ক্রর দানবের শান্তি বিধান করা।

কেনোন ১৯৪৮ সলে জাতিসংঘের সাবারণ পরিষদেই গণহত্যা  বন্ধ ও তার শান্তি বিধানের সনদ গৃহীত হয়েছে।

 এই সনদে গণহত্যা, গণহত্যার ষড়যন্ত্র করা ও সহযোগিতা করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ রূপে গণ্য হয়েছে। ১৯৪৮ সালে গৃহীত জাতিসংঘের এই  সনদ অনুযায়ী গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোনো অপরাধের জন্য দায়ী ব্যক্তি।

অবশ্যই শান্তি পাবে, সে শাসনতান্ত্রিক — ভাবে কোনো দেশের শাসনকর্তাই – হোক, কোনো সরকারী কর্মচারীই হোক কিংবা বেসরকারী লোকই হোক। এ সংগে আরো বলা হয়েছে যে গণহত্যা কিংবা অনুরূপ কোনো অপরাধে দায়ী ব্যক্তির বিচার সে দেশেরই ক্ষমতাসম্পন্ন আদালতে নিষ্পন্ন হবে কিংবা আন্তর্জাতিক ট্রাইবুন্যালে তার বিচার করতে হবে ।

ইয়াহিয়ার সর্বশেষ চ্যালেঞ্জ

গ্রহণে আমরা প্রস্তুত

 

অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট জেনারেল আগা মোহাম্মদ ইয়াহিয়া খান সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে আরেকটী অগ্নিপরীক্ষায় নিক্ষেপ করেছে। জল্লাদ, ইয়াহিয়ার দরবার থেকে ঘোষণা করা: হয়েছে যে তারা আগামী ২৫শে নবেম্বর তারিখের বদলে জাতীয় পরিষদের ৭৯টি আসনে ১২ই থেকে ২৩শে ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদে একই সময়ে উপনির্বাচন অনুষ্ঠান করবে।

মুজিবনগরের রাজনৈতিক মহলের কারো কারো মতে পাকিস্তানের কোন কোন মহল তাদের দেশে গণ প্রতিনিধি। ত্বশীল সরকার প্রতিষ্টার জন্য যে হৈ চৈ শুরু করেছে তাদের জন্য জল্লাদ ইয়াহিয়ার এটা আরেকটা ধাপপা। কেননা, বাংলাদেশে উপনির্বাচনের নতুন সময়সূচী ঘোষণার মাধ্যমে  অন্তদ্বন্ধে ক্ষতবিক্ষত শেষ কচক্র আরো কয়েক মাস হয়ত দেশের ক্ষমতার আসনে বসে থাকতে পারবে।

এদিকে জনৈক প্রবীন আওয়ামী লীগ নেতা ‘জয় বাংলা প্রতিনিধিকে বলেন : ‘জল্লাদ ইয়াহিয়ার সর্বশেষ পদক্ষেপ থেকে আমাদের হিতাকাঙ্খী বলে পরিচিত বিভিন্ন মহলের শিক্ষা নেওয়া উচিত। স্বার্থবাদী মহলের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক সমাধানের ধূয়া তোলার পর যারা আশা করছিলেন যে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে বাংলাদেশ সমস্যার একটা সমাধান খুঁজে পাওয়া যাবে ইয়াহিয়া। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্ব মেনে নবে তাদের এখন মত পরিবর্তন করা উচিত। অন্ত্রের ভাষাই যে  বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের একমাত্র পথ তা আজ তাদের অনুধাবণ করা উচিত। সুতরাং আর কোনরূপ দ্বিধা-দ্বন্ধে ন’ ভুলে তাদের উচিত বাংলাদেশের স্বীকৃতি ও মুক্তি বাহিনীর জন্য সর্বপ্রকার সাহায্য নিয়ে এগিয়ে আসা।

জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ প্রসঙ্গ

ইয়াহিয়ার দালালেরা হালে পানি পাচ্ছে না

জাতিসঙ্ঘ সাধারণ পরিষদের ২৬ তম অধিবেশন গত ২১শে সেপ্টেম্বর শুরু হয়েছে। এই অধিবেশনে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিনিধি যারা প্রেরিত হয়েছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক উপদেষ্টা ও পালমেন্ট-সদস্য জনাব এম, এ, সামাদ, নবগঠিত। কনসালটেটিভ কমিটির সদস্য অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ, বাংলাদেশ পরিষদের সদস্য শ্রীনিভূষন মজুমদার, পালমেন্ট-সদস্য জনাব সিরাজুল হক ও সৈয়দ আবদুস সুলতান, বাংলাদেশ পরিষদের সদস্য ফকির শাহাবুদ্দিন, পালামেন্ট সদস্য ডক্টর মফিজ চৌধুরী, বাংলাদেশ পরিষদ-সদস্য ডক্টর আসাবুল হক, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলর ডক্টর এ, আর, মল্লিক; অর্থনৈতিক বিষয়ে বিশেষ দূত জনাব রহমান সোবহান, পালমেন্ট সদস্য – ও যুক্তরাষ্ট্রে নিযুক্ত বালাদেশ প্রতিনিধি জনাব এম, আর, সিদ্দিকী, দূরপ্রাচ্য ও  দক্ষিণ পুর্ণ এশিয়ায় ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত জনাব কে, কে, পন্নি এবং ভ্রাম্যমান রাষ্ট্রদূত জনাব আবুল ফতেহ। এছাড়া  বর্তমানে বিদেশে অবস্থানরত অপর যে কয়েকজন সদস্য নিউ ইয়র্কে এই প্রতি নিধি দলে রয়েছেন জাতিসঙ্ঘে বাংলা  দেশের স্থায়ী সহকারী প্রতিনিধি জনাব এস, এ, করিম এবং যুক্তরাষ্ট্রে বাংলাদেশ মিশনের কাউন্সিলর জনাব এ,  এম, এ, মুহিত এই প্রতিনিধি দলে নেতৃত্ব করছেন জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি, যুক্তরাজ্যে বাংলাদেশের প্রতিনিধি বিচারপতি আবু সাইদ চৌধুরী জাতিসঙ্ঘে বাংলাদেশ সমস্যা  উপস্থাপিত হওয়ায় ইসলামাবাদের হানাদার সরকার অত্যন্ত বিব্রত হয়ে পড়েছেন। নিউইয়র্ক থেকে আমাদের নিজস্ব প্রতিনিধি জানাচ্ছেন বহু দেন দরবারের পরেও একমাত্র  রাজতন্ত্রী মরক্কো সরকার ছাড়া পাকিাস্তন অন্য কারো সহানুভূতি লাভ করে নাই। বাংলাদেশের পক্ষে যে সব  দেশ দৃঢ়ভাবে দাড়িয়েছেন তাঁরা হলেন সোভিয়েত ইউনিয়ন, কানাডা, যোগশ্লাভিয়া। নিউজিল্যাণ্ডও ইয়াহিয়া  সরকারের পাশব নীতির বিরুদ্ধে  নিন্দায় মুখর। শুধু জাতিসংঘ সাধারণপরিষদে নয়, নিরাপত্তা পরিষদেও  বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপিত হওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে ও সামাজিক পরিষদের তৃতীয় ও পঞ্চম কমিটির বৈঠকেও বাংলাদেশ সমস্যা আলোচিত হতে যাচ্ছে।জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনের বৈঠকেও বাংলাদেশ সম্বন্ধে পূর্ণাঙ্গ বিতর্ক অনুষ্ঠিত হবে।জাতিসংঘের জোট বহিভূত ৬৪টি সদস্যদেশ বাংলাদেশ সম্বন্ধে একটি সর্ব সম্মত প্রস্তাব গ্রহণ করেছেন।

জাতিসংঘের এই অধিবেশনে মুখ রক্ষার জন্যে এই প্রথম বারের মতো। ইয়াহিয়া সরকার কয়েকজন মুখচেনা বাঙ্গালী দালালকে জাতিসংঘের প্রতিনিধি করে প্রেরণ করেছে। – কিন্তু তারা কোন দেশের কূটনৈতিক মহলেই কোন পাত্তা পাচ্ছে না।

বহু মুক্তিযুদ্ধের অভিজ্ঞতার আলোকে আদ্রে মালরো  বলছেন

যে কজন ফরাসী সাহিত্যিকের নাম আজ বিশ্ব জোড়া, আঁদ্রে মালরো তার অন্যতম। মালরো ব জীবন খুবই ঘটনা বহুল। মালরো তঁার যৌবনে স্পেনের গৃহ যুদ্ধে যান। লড়াই করেন সাহসিকতার সঙ্গে ফ্রাঙ্কোর সেনাবাহিনীর সাথে। স্পেনের গৃহ যুদ্ধ শেষ হবার পর, মালরো যান চীনে। সেখানে চীনের পক্ষ নিয়ে লড়াই করেন বিদেশী শক্তির বিরুদ্ধে। তারপর চীন থেকে নিজের দেশে ফিরে অংশ নেন, নাৎসিবাহিনীর বিপক্ষে তাঁর দেশবাসীর প্রতিরোধ সংগ্রামে। এই সংগ্রামের সময় তার পরিচয় হয় জেনারেল ছাগোল-এর কর্মধারার সাথে  মালরো এর আগে ছিলেন বামপন্থি। কিন্তু এখন থেকে হয়ে ওঠেন দ্বগলের ত স্বদেশ পন্থি। যার গোড়ার কথা হল, দেশের স্বাধীনতা ও ক্ষমতাকে বিলুপ্ত করে আন্তর্জাতিক অর্থ হীন। জাতীয় রাষ্ট্র (Nation-State) আজকের পৃথিবীতে একটি বিরাট রাজনৈতিক স্বত্তা। তাকে বাদ দিয়ে বিশ্বের রাজনীতির কথা, মানুষের মুক্তির কথা ভাবতে যাওয়া অবান্তর। ছাগলের আমলে মালরো মন্ত্রি হন। তার উপর ভার পড়ে অবিচল সঙ্কল্পের কথা দ্ব্যর্থহীন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভা- মান। এরপর সভায় বিলুপ্ত  ভাষায় পুনরায় ঘোষণা করা হয়। পতিত্ব করেন। বিলুপ্ত নিখিল নিখিল পাকিস্তান আওয়ামী ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়া সরকারের পাকিস্তান আওয়ামী লীগ এবং লীগের কর্মকর্তা এবং ওয়ার্কিং অধীনে বন্দী সাড়ে ৭ কোটি বাংলা দেশ আওয়ামী লীগের কমিটির সদস্যগণকে বাংলাদেশ  বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা ৩৯ জন সদস্য এই সভায় আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র- উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের সদস্যভুক্ত করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত প্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে।  সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। রহমানের অসুস্থতায় গভীর ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে এ সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে। উদ্বেগ প্রকাশ করে সভায় গৃহীত পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজনদের / এক প্রস্তাবে গণতন্ত্রের এই জান্তা কর্তৃক নিরস্ত্র নিরীহ উপর যাতে পাষণ্ড জল্লাদ নির্ভীক সিপাহসালারের নিরা- বাঙ্গালীর উপর অতর্কিত নগ্ন ইয়াহিয়া সরকার আর নির্যাতন পত্তার নিশ্চয়তা বিধান এবং হামলা এবং নির্বিচারে ইতি- নিপীড়ন না চালায় তার নিশ্চয়তা তাকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে হানা- হাসের নৃশংসতম গনহত্যা বিধান এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারের দাৱ বিদেশী ইয়াহিয়া সরকারের চালানোর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে লোকজনদের বাংলাদেশ সর উপর কার্যকরী চাপ প্রদানের স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত কারের হাতে অর্পনের সুনিশ্চিত জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্র-বিশেষ সার্বিক পরিস্থিতি সভায় বিস্তা- ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘের  করে জাতি সংঘের প্রতি আহ্বান রিতভাবে পর্যালোচনা করেন প্রতি আহবান জানান হয়। সংগ্রাম সম্পর্কে কতগুলি মূল্যবান মন্তব্য করেছেন। মালরো বলেছেন : বাংলাদেশের ঘটনা বিশ্বের করুণতম ঘটনাবলীর অন্যতম। কিন্তু বাঙালী  দের বুঝতে হবে, বর্তমান যুদ্ধ তাদের – অস্তিত্বের লড়াই। হয় তারা জাতি হিসাবে জিতবে, নয়ত চিরতরে বিলীন হয়ে যাবে। আবেদন নিবেদনে কোন ফল হবে বলে মনে হয় না। বাঙালীকে – তার অধিকার প্রতিষ্ঠা করতে হবে যুদ্ধ করেই। এখন বাঙলীরা কেবল নির্ভর করতে পারে আত্ম সাহস ও রণ শক্তির উপর। অবশ্য মুক্ত রণাঙ্গনে, সম্মুখ সমরে পাক বাহিনীর সাথে যুদ্ধে লিপ্ত  হওয়া উচিত হবে না বাঙালীদের। বর্তমানে তা সম্ভব নয়। তাদের উচিৎ হবে গেরিলা যুদ্ধই ভালভাবে চালিয়ে যাওয়া। বিদেশের কাছে গণতন্ত্র ও মানবতার নামে দরখাস্ত দাখিলের । চাইতে বঙালীদের আজ বেশী, প্রয়োজন, ১ মিরিক সংগঠন। বছর চল্লিশেক আগের অ্যাংগ্লো -স্যাকসন উনার নৈতিক বিবেক এখন আর বাস্তব নয়। আপন ভোলা আমেরিকানদের শুভেচ্ছার উপর নির্ভর। করতে যাওয়া হবে ভুল মালরো উপরের কথাগুলি লিখেছেন একটি চিঠিতে ভারতের বিখ্যাত  নেতা জয়প্রকাশ নারায়ণ-এর কাছে। – কিছুদিন আগে মালরো আমেরিকার  বিখ্য’ত সাপ্তাহিক ‘টাইম’-এর একজন সাংবাদিককে বলেন : “মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রকে অচিরে এশিয়া  ভূখণ্ডে একটি নতুন সমস্যার সম্মুখীন” হতে হবে। সমস্যাটি হল, বাংলাদেশ ভিয়েতনামের অনুরূপ রূপ নিয়ে দেখা – দেবে এই সমস্যা। কিন্তু ভিয়েতনামের সাথে ব্য তক্রম আছে বাংলাদেশের। বাংলাদেশের জনসংখ্যা ৭৮ মিলিয়ন। আর এই জনসংখ্যা মাওবাদ দ্বারা নয়, অনুপ্রানীত জাতীয়তাবাদ দ্বারা। আমেরিকানদের বংলাদেশ সম্পর্কে বর্তমান শান্ত অচঞ্চল ভঙ্গির পরিবর্তন করতে হবে ( টাইম, আগষ্ট, ২) ও মালবো-র এই উক্তির কোন ফল হয়নি বলেই সম্ভবত জয় প্রকাশের কাছে লিখিত চিঠিতে তিনি উল্লেখ করেছেন, সভা করে আবেদন নিবেন করবার নিস্ফলতার কথা।  বাঙালীরা আজ এক জীবন মরণ যুদ্ধে জড়িয় পড়েছে। দূর বিদেশে বসে সংবেদনশীল সাহিত্যিক মালবো-র পক্ষে বুঝতে অসুবিধা হচ্ছে না সেকথা। যুদ্ধ ও যুদ্ধ জয় ছাড়া বাঙালী সম্মুখে ‘আজ আর কোন পথ খোলা নেই।

শেষ সংবাদ

গত ২১শে সেপ্টেম্বর দিবাগত রাত্রি ১টা ১৪ মিনিটের সময় (বাংলা দেশ সময়) জাতিসংঘ সাধারণ  পরিষদের ২৬ তম অধিবেশন শুরু হয়। ইন্দোনেশিয়ায় ১৯৬৫ সালের ব্যর্থ অভুত্থানের পর কনিষ্ট মারার 1 নামে দেশে ৮ লাখ লোককে হত্যাকারী জেনারেল সুহার্তোর পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ আদম মালিক জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের চলতি অধিবেশনের সভাপতি নির্বাচিত হয়েছেন। গত ২২শে সেপ্টেম্বর নিউ ইয়র্কে এক সাংবাদিক সম্মেলনে ডঃ আদম মালিক বলেছেন যে তিনি পূর্ববাংলা’ সমস্যা জাতিসংঘে উত্থাপনের বিরোধী। তিনি পর্দার অন্তরালে থেকে কাজ করে এ ‘রাজনৈতিক সমস্যা সমাধানের জন্য পাকিস্তান ও ভারতকে এক জায়গায় আনার জন্য চাপ সৃষ্টির দাওয়াই বা তলিয়েছেন। ডঃ আদম মালিকের মতে  বাংলাদেশ সমস্যা নাকি পাকিস্তানের ঘরোয়া সমস্যা। বর্তমানে ভারত সফররত ৪ সদস্য বিশিষ্ট জাপানী প্রতিনিধিদলের নেতা এবং জাপানের প্রতিনিধি 1 পরিষদের পররাষ্ট্র সম্পর্কিত কমিটির চেয়ারম্যান মিঃ ওয়াই সাকুবাউচি ভারতীয় প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা।  গান্ধীকে নাকি বলেছেন যে তার দেশ জাতিসংঘে বাংলাদেশ সমস্যা উত্থাপন করবে। ভূটান, বাহরায়েন ও কাতার গত  বুধবার জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করেছে। ফলে বিশ্বসংস্থার সদস্য সংখ্যা ১৩০-এ উন্নীত হল। – ভূটানের জনসংখ্যা দশ লাখের কম এবং কাতার ও বাহরায়েনের জনসংখ্যা আরো অনেক কম।

মুক্তি বাহিনীতে অফিসার

পদে লোক নিয়োগে

 

বাঙলাদেশ মুক্তি বাহিনীতে দ্বিতীয় পর্যায়ে অফিসার ট্রেনিং  কোর্সের জন্য প্রার্থী মনোনয়ন করা হবে। আগামী ২৩শে অক্টোবর থেকে এই ট্রেনিং শুরু হবে। । যোগ্যতা: যারা পূর্ব থেকেই চাকুরীতে বহাল রয়েছেন তাদের  ক্ষেত্রে –

(i) প্রার্থীর বয়স চলতি বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর অনুধ ২৭ বছর ;

(ii)সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা : ম্যাট্রিক অথবা সমপর্যায়ের পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হবে। বীরত্বমূলক কাজের বিশেষ যোগ্যতা  এবং প্রথম শ্রেণীর শিক্ষা সার্টিফিকেট ( ফাষ্ট ক্লাশ সাটিফিকেট অব

এডুকেশান) থাকা বাঞ্ছনীয়। – অন্যান্য প্রার্থীর ক্ষেত্রে : (i) চলতি বছরের ৩০শে সেপ্টেম্বর  বয়স অনূর্ধ ২৫ বছর। (ii) সর্বনিম্ন শিক্ষাগত যোগ্যতা: কোন  অনুমোদিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে ইন্টারমিডিয়েট পাশ অথবা  সমপর্যায়ের শিক্ষাগত যোগ্যতা। দৈহিক যোগ্যতা : প্রার্থীকে অবশ্যই সুস্থ-সবল স্বাস্থ্যের  অধিকারী এবং ডাক্তার কর্তৃক দৈহিক যোগ্য বলে ঘোষিত হতে হবে।আবেদন পত্র ঃ এমাসের ২৫ তারিখের মধ্যে সংশ্লিষ্ট সেক্টর কমাণ্ডারের নিকট প্রার্থীদের আবেদন পত্র অবশ্যই পৌঁছাতে হবে। আবেদন পত্রে প্রার্থীর নাম, বয়স এবং পূর্ণ ঠিকানা উল্লেখ থাকতে হবে। মনোনয়ন প্রসঙ্গে : (১) ৩০শে সেপ্টেম্বরের মধ্যেই প্রাথমিক মননানয়নের কাজ সম্পন্ন হবে। (২) প্রাথমিক মনোনয়নে যারা নির্বাচিত হবেন, তাদের পরীক্ষা ( ইন্টারভিউ) গ্রহণ করা হবে এবং আগামী ১০ই অক্টোবর নাগাদ মনোনয়ন বোড় চূড়ান্ত নির্বাচনের কাজ সম্পন্ন করবেন।

এ সপ্তাহে

          ১৫ই সেপ্টেম্বর-বৃটেনস্থ বাংলাদেশ মেডিক্যাল-এ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক ডাঃ এ, টি,এম,জাফরুল্লাহ চৌধুরী বাংলাদেশের মুক্ত অঞ্চলে। কয়েকটি হাসপাতাল স্থাপনের জন্য লণ্ডন থেকে মুজিব নগরে এসে পৌঁছেছেন। নদীয়া–বাংলাদেশ সীমান্তে ভারত পাকিস্তানের মধ্যে গুলি বিনিময়ে ৩জন। পাকসেনা নিহত হয়। ১৬ই সেপ্টেম্বর ভারতীয় পররাষ্ট্র দফতরের নীতিনির্ধারণ কমিটির সভাপতি শ্ৰী ডি, পি, ধর মুজিব নগরে বাংলাদেশ সরকারের মন্ত্রীদের সঙ্গে। রাষ্ট্রসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বাংলাদেশের প্রতিনিধি প্রেরণের ব্যাপারে আলাপ আলোচনা করেন। অধিকৃত বাংলাদেশে তথাকথিত অসামরিক মন্ত্রী পরিষদের সদস্যগণের শপথ গ্রহণ। দশ সদস্যের মধ্যে নয় জন সদস্য শপথ নেন বাকী একজন কেন শপথ নেননি, তা জানা যায়নি।

বিশেষ বিজ্ঞপ্তি

          জয়বাংলার সম্পাদক মণ্ডলির  সভাপতি জনাব আবদুল মান্নান। এতদিন পর্যন্ত আহমদ রফিক এই নামে পত্রিকা সম্পাদন করেছেন। বর্তমান সংখ্যা থেকে তিনি তার প্রকৃত নামেই জয়বাংলার সম্পাদক মণ্ডলির সভাপতির দায়িত্ব গ্রহণ করলেন।

– কর্মাধ্যক্ষ, জয়বাংলা।

পূজা উপলক্ষে ছুটি

          বাংলাদশ সরকারের এক  বিজ্ঞপ্তিতে ঘোষণা করা হয়েছে যে, দুর্গা পূজা উপলক্ষে আগামী ৩০শে  সেপ্টেম্বর সরকারী ছুটি পালিত হবে। বাংলাদেশ সরকারের হিন্দু সম্প্রদায়ভুক্ত কর্মচারীরা আগামী ২৭, ২৮ এবং ২৯শে সেপ্টেম্বর সেকশনাল দুটি ভোগ করতে পারবেন।

 

                                    পাতা -৩    

পাকিস্তানের ধ্বংসসান্মুখ অর্থনীতি জল্লাদচক্র টিকিয়ে রাখতে

পারবে কি ?

          নিজেদের সৃষ্ট বাংলাদেশ সঙ্কট জল্লাদ ইয়াহিয়া গোঞ্জকে অক্টোপাশের – মত ঘিরে ধরেছে। কি রাষ্ট্রীয়, কি রাজনৈতিক, কি অর্থনৈতিক কোন ক্ষেত্রেই আজ আর তারা বাঁচার পথ খুঁজে পাচ্ছে না। ( ২৫শে মার্চ বাঙলাদেশে ইতিহাসের ঘৃণ্যতম ও বৃহত্তম গণহত্যা শুরুর পূর্বে তারা ভেবেছিল কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই সব ঠিক হয়ে যাবে। তা যখন সম্ভব হল না তখন হয়ত ভেবেছিল কয়েক মাসের মধ্যে ঠিক হয়ে যাবে। তাই বোধ হয় ১লা মে তারিখে ৬ মাসের জন্য বিদেশী ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধে বন্ধ রাখার কথা ইয়াহিয়া খানরা ঘোষণা করেছিল। এটা ছিল ইয়াহিয়াদের ‘একতরফা’ ব্যবস্থা। এই একতরফা ব্যবস্থার মেয়াদও শেষ হওয়ার পথে। আগামী ৩১শে অক্টোবর এ মেয়াদ শেষ হবে। কিন্তু ইত্যবসরে কি অবস্থার উন্নতি হয়েছে? নিশ্চয়ই হয়নি এবং হয়নি বলেই জল্লাদ-চক্র সাহায্যকারী কনসোর্টিয়ামের কাছে ধর্না দিয়েছে তাদের একতরফা ব্যবস্থাকে রেগুলারাইজ করা এবং তা আরো ৬ মাসের জন্য সম্প্রসারিত করার জন্য। জাপান এবং দশটি পশ্চিমা রাষ্ট্র নিয়ে এই কনসোর্টিয়াম গঠিত। পাকিস্তানের আবেদন বিবেচনার জন্য অক্টোবরে তারা প্যারিসে বৈঠকে মিলিত হবে।

প্রশ্ন হল কনসোর্টিয়াম কি পাকিস্তানের প্রস্তাবে সম্মত হবে? কনসোর্টিয়ামভুক্ত দেশসমুহের অর্থনীতিকদের মতে তাদের পক্ষে পাকিস্তানের প্রস্তাবে সম্মত হওয়া ছাড়া গত্যন্তর নাই। কেননা পাকিস্তানকে তারা এতদিন ষে ঢাকা দিয়ে এসেছে তা যদি ফেরৎ পেতে হয় তাহলে তাদেরকে পাকিস্তানের প্রস্তাবে সম্মত হতেই হবে।

পাকিস্তান কি চেয়েছিল আর কি পেয়েছে ১লা মে ঋণ ও ঋণের সুদ পরিশোধ স্থগিত ঘোষণার সময় পাকিস্তান চেয়েছিল ৬৩ মিলিয়ন মার্কিন ডলার বাঁচাতে। কনসোর্টিয়ামের ঋণ ও ঋণের সুদ বাবদ এই টাকাটা বাঁচলেত কনসোটিয়াম চুক্তির বাইরে দ্বি পাক্ষীক চুক্তিতে পাকিস্তান ঐ সমস্ত দেশের কাছ থেকে যে ঋণ নিয়েছিল  তার কিস্তি পরিশোধ ঠিক মত করতেই হয়েছে। এ বাবদ পাকিস্তানকে

অক্টোবর পর্যন্ত দিতে হবে ৪৬ মিলিয়ন্ মার্কিণ ডলার।  পাকিস্তানের দেনা কত ? পাকিস্তান সরকারের হিসাব মতে সে বহিঃবিশ্বকে দেন। রয়েছে  ৫০০ কোটি মার্কিণ ডলার। পাকিস্তানী টাকার হিসাবে এ দেনার পরিমাণ  তিন হাজার কোটি টাকার উপর। গত ১লা জুলাই যে আর্থিক বছর শুরু হয়েছে তাতে ঋণ পরিশোধ বাবদ বাজেটে ধরা হয়েছে ১৫৮ মিলিয়ন ডলার। পূর্ববর্তী আর্থিক বছরে শশাধ করতে হয়েছিল ২১৬ মিলিয়ন ডলার। মে এবং জুন মাসে যে টাকা শোধ করা হয়নি তা এ হিসাবে ধরা হয়নি। অর্থনীতিকদের হিসাব মতে বর্তমানে পাকিস্তানকে যে পরিমান টাকা। ঋণের কিস্তি ও সুদ হিসাবে পরিশোধ করতে হয় তা ঐ দেশের মোট বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের শতকরা ৩০ ভাগের উপর। অথচ এই হারটা শতকরা ২০ ভাগ অতিক্রম করলে সে দেশের পক্ষে ঋণ পরিশোধ করা দুঃসাধ্য হয়ে উঠে।

পাকিস্তানের অবস্থা কি

          পাকিস্তান আবার আশা করেছিল ৬ মাসের জন্য ঋণ পরিশোধ বন্ধ রেখে তারা অবস্থার উন্নতি ঘটাতে পারবে । ইত্যবসরে বাংলাদেশের অবস্থা। স্বাভাবিক হবে, দেশের বৈদেশিক বাণিজ্য বাড়বে এবং সঙ্গে সঙ্গে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের পরিমাণও বাড়বে। কিন্তু শেষ পর্যন্ত সবই মিথ্যা প্রমাণিত। হয়েছে। যে বাঙলাদেশ ছিল পাকিস্তানের জন্য ‘কামধেনু’ বিশেষ, সে বাঙলাদেশ থেকে বৈদেশিক মুদ্রা আয় প্রায় বন্ধ। পাট বা পাটজাত দ্রব্য আজ আর বিদেশে রপ্তানী হচ্ছে না। একটা মাত্র তথ্য থেকেই ব্যাপারটা। আঁচ করা যাবে। গত এপ্রিল মাসে পাকিস্তান বিদেশে মাত্র ৭ লাখ টাকা। মূল্যের পাট ও পাটজাত দ্রব্য রপ্তানী করতে পেরেছে। অথচ পূর্ববর্তী বছর এপ্রিল মাসে এ বাবদ রপ্তানীর পরিমাণ ছিল ২৫ মিলিয়ণ ডলার (প্রায় ১৫ কোটি টাকা)।

অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়তে বাধ্য

          অর্থনৈতিক বিশেষজ্ঞদের মতে ইতিমধ্যেই পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে পড়ার কথা ছিল। কিন্তু মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র ও কমুনিষ্ট চীনের সহায়তায় তা আপাততঃ পরিহার করা গেলেও আর বেশী দিন ঠেকান যাবে না। তিনটি উপায়ে জোড়াতালি দিয়া আপাততঃ পাকিস্তান  টলটলায়মান অর্থনীতিকে সম্পূর্ণ ধ্বসে পড়ার হাত থেকে রক্ষা করেছে।

প্রথমতঃ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ঋণ পরিশোধ না করে পাকিস্তান এই ৬ মাসে যে ৬৩ মিলিয়ন ডলার বাঁচিয়েছে তা অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষার – কাজে ব্যবহার করেছে।

 দ্বিতীয়তঃ পাকিস্তান চীনের কাছে যে তিনখানা ট্রাইডেন্ট বিমান বিক্রয় করেছে এ বিমান হস্তান্তরের আগেই তার মূল্যটা (৭০ মিলিয়ন ডলার)  আদায় করে নিয়েছে।

 তৃতীয়তঃ ১৯৭০-৭১ অর্ধ বছরে প্রতিশ্রুত বৈদেশিক ঋণের ও সাহায্যের  অব্যবহৃত অংশটা পাকিস্তান সরকার শত তাড়াতাড়ি ব্যবহারের ব্যবস্থা করেছে। যে গতিতে পাকিস্তানের সরকারী কর্মচারীরা একাজটি সমাধা করেছে তা সত্যই প্রশংসনীয়।  কিন্তু এতদ সত্ত্বেও পাকিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা  যাবে বলে অর্থনীতিকরা মনে করেন না। কেননা, পাকিস্তানের খাস  তালুক বাঙলাদেশের সুরক্ষিত রাজার নষ্ট হওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানের  কলকারখানাগুলি অচলাবস্থার সম্মুখীন হয়েছে। বিক্রীর অভাবে প্রতিটা কারখানার গুদামে উৎপাদিত পণ্য জমে উঠেছে প্রচুর পরিমাণে। সরকার অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানী পণ্যের জন্য অন্যত্র বাজার খোঁজার চেষ্টায় ক্রটি করছে না। কিন্তু ইচ্ছা করলেই ত আর বাজার পাওয়া যায় না। – দ্বিতীয়তঃ পশ্চিম পাকিস্তানী কলকারখানার জন্য যে বিদেশী কাচা মাল ও খুচরা যন্ত্রপাতি দরকার প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার অভাবে তা  কেনা যাচ্ছে না। বৈদেশিক মুদ্রার ব্যবস্থা না হলে অদূর ভবিষ্যতে  কলকারখানাগুলো বন্ধ হয়ে যেতে বাধ্য। আর তার সম্ভাব্য প্রতিক্রিয়ার আলামত ইতিমধ্যেই শুরু হয়ে গেছে। মোট কথা অল্পদিনের মধ্যে বাঙলাদেশের যুদ্ধ বন্ধ করতে না পারলে পাকিস্তানের অর্থনীতিকে কোন মতেই পুরাপুরি ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।

বাংলাদেশের কূটনৈতিক স্বীকৃতি

অধ্যাপক সামাদ

          কূটনৈতিক স্বীকৃতি কথাটি দুটি স্বতন্ত্র অর্থে ব্যবহার করা হয়। কূটনৈতিক স্বীকৃতি বলতে কখন বোঝায় একটি নবজাত রাষ্ট্রকে অপর একটি। রাষ্ট্র দ্বারা বৈধ বলে মেনে নেওয়া। আবার কূটনৈতিক স্বীকৃতি বলতে বোঝায় একটি পুরাতন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্রে নব গঠিত সরকারকে বৈধ বলে স্বীকৃতিদান। রাষ্ট্র আর সরকার এক কথা নয়। তাই কুটনৈতিক স্বীকৃতি কথাটি অনেক ক্ষেত্রে বিভ্রান্তির সৃষ্টি করে। বিশেষত নবজাত রাষ্ট্রের বেলায়। নবজাত রাষ্ট্রের বেলায় কূটনৈতিক স্বীকৃতি বলতে একটি নতুন রাষ্ট্রকে ও সেই রাস্ট্রের সরকারকে যুগপৎ অন্য একটি রাষ্ট্র কর্তৃক বৈধ বলে মেনে নেওয়া বোঝায়। কারণ এক্ষেত্রে রাষ্ট্রকে বৈধ বলে মেনে না নিলে সরকারকে বৈধ বলে মেনে  নেওয়া যায় না। আবার সরকারকে বৈধ বলে মেনে না নিলে রাষ্ট্রকেও স্বীকৃতি দেওয়া চলে না। বাঙলাদেশকে স্বীকৃতি দান প্রসঙ্গে তাই রাষ্ট্র ও সরকার উভয়েরই একত্রে স্বীকৃতিদান প্রশ্ন জড়িত। কূটনৈতিক স্বীকৃতিও দান যতনা আন্তর্জাতিক বিধি বিধান দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়, তার চাইতে অনেক বেশী নিয়ন্ত্রিত হয় স্বীকৃতিদানকারী রাষ্ট্রের স্বার্থ ও দৃষ্টি ভঙ্গির দ্বারা। তাই কূটনৈতিক স্বীকৃতির বিষয়টিকে বুঝতে হলে আইনের আলোচনার চাইতে কূটনৈতিক স্বীকৃতির বিভিন্ন সময়কার ইতিহাস আলোচনার গুরুত্ব অনেক বেশী । এ মাকিণ যুক্তরাষ্ট্র তার স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৭৭৬ খৃষ্টাব্দে মাকিন যুক্তরাষ্ট্রের সাথে বৃটেনের ভেরসাই শান্তি চুক্তি হয় ১৭৮৩ খৃষ্টাব্দে। এই চুক্তিতে বৃটেণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়। ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কে এই চুক্তির পর বৈধ বলে মেনে নেয়। কিন্তু ফ্রান্স মার্কিণ যুক্ত রাষ্ট্রকে ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই স্বীকৃতি প্রদান করে ও সেনাপতি লাফায়েত মারফত সামরিক সাহায্য পাঠায়। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ভূ-খণ্ড। ছিল বৃটিশ বাহিনীর হাতে। নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোন কতৃত্বই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এ-সময় বলতে গেলে আমেরিকার উপর। অন্যদিকে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র নবগঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সরকারকে বৃটেন কতৃক বৈধ বলে মেনে নেবার পর স্বীকৃতি দিলেও রাশিয়া মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রায় যোল বছর পরে। কারণ, এ সময়কার রাশিয়ার বিখ্যাত রাণী ক্যাথেরিণ মনে করতেন মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ ইউরোপে প্রজাতন্ত্রী মনোভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া। গণরাজ্যবাদী মনোভাবকে সমর্থন করা। চুক্তিতে বৃটেণ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের স্বাধীনতাকে স্বীকার করে নেয়। ইউরোপের অধিকাংশ রাষ্ট্র মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কে এই চুক্তির পর বৈধ বলে মেনে নেয়। কিন্তু ফ্রান্স মার্কিণ যুক্ত রাষ্ট্রকে ১৭৭৮ খৃষ্টাব্দে যুদ্ধ চলাকালীন অবস্থাতেই স্বীকৃতি প্রদান করে ও সেনাপতি লাফায়েত মারফত সামরিক সাহায্য পাঠায়। এসময় মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অধিকাংশ ভূ-খণ্ড। ছিল বৃটিশ বাহিনীর হাতে। নবগঠিত যুক্তরাষ্ট্র সরকারের কোন কতৃত্বই প্রতিষ্ঠিত হতে পারেনি এ-সময় বলতে গেলে আমেরিকার উপর। অন্যদিকে ইউরোপের বিভিন্ন রাষ্ট্র নবগঠিত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও তার সরকারকে বৃটেন কতৃক বৈধ বলে মেনে নেবার পর স্বীকৃতি দিলেও রাশিয়া মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি প্রদান করে প্রায় যোল বছর পরে। কারণ, এ সময়কার রাশিয়ার বিখ্যাত রাণী ক্যাথেরিণ মনে করতেন মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দেওয়ার অর্থ ইউরোপে প্রজাতন্ত্রী মনোভাবকে প্রশ্রয় দেওয়া। গণরাজ্যবাদী মনোভাবকে সমর্থন করা। উনবিংশ শতকে ইউরোপের বৃহৎ রাষ্ট্রশক্তি একত্রে বলকান অঞ্চলের – একাধিক রাষ্ট্রকে বৈধ বলে স্বীকৃতি। দেয়। যদিও এসব দেশ তখন ছিল,তুর্কীদের অধিন। বলকানে গণ্ডো গোল বাধিয়ে তুকী ক্ষমতার লাঘবই ছিল এই স্বীকৃতি প্রদানের বিশেষ। উদ্দেশ্য। দৃষ্টান্ত স্বরূপ উল্লেখ করা । যায় গ্রীস-এর কথা (১৮২৭) ও রুমানিয়ার কথা (১৮৭৮)। গ্রীস ও রুমানিয়া উভয় দেশ এ-সময় ছিল তুর্কী দখলদার বাহিনীর নিয়ন্ত্রণে।  আমাদের বিংশ শতকেও কুটনৈতিক স্বীকৃতির ব্যাপারে রাজনৈতিক বিবেচনা প্রাধান্য লাভ করেছে। এর  একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত ১৯৪৮ সালে। * মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক ইজরাইলকে  স্বীকৃতি দান। ট্রম্যান তার নির্বাচনে  জয়লাভ করবার জন্য ইজরাইলকে স্বীকৃতি দেন। মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান অনুসারে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট যে কোন রাষ্ট্র ও যে কোন রাষ্ট্রের যে কোন সরকারকে বৈধ – বলে স্বীকৃতি দিতে পারেন। নব গঠিত ইজরাইল সরকারের কাছ থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কোন অনুরোধ পাবার আগেই প্রেসিডেন্ট ট্র ম্যান। নবজাত ইজরাইল রাষ্ট্র ও সরকারকে স্বীকৃতি প্রদান করেন। এসময় জাতি সঙ্ঘে আলোচনা চলেছিল প্যালেষ্ট্যাইন-এর ভবিষ্যৎ নিয়ে। ট্রম্যানের সিদ্ধান্তের কথা আগে থেকে জাতিপুঞ্জের মার্কিণ প্রতিনিধিদের জানা ছিল না। ফলে তাদের পড়তে হয় বিভ্রান্তিকর পরিস্থিতিতে। পুরাতন রাষ্ট্রে যখন নতুন সরকার গঠিত হয়, তখন তাকে স্বীকার অস্বীকারের ব্যাপারেও রাজনৈতিক বিবেচনাই প্রাধান্য লাভ করে থাকে। রাশিয়ায় বিপ্লবের মাধ্যমে বলসোভিক-রা ক্ষমতায় আসবার প্রায় ষোল বছর পর মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র বলসেভিকদের দ্বারা গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দান করে। ১৯৩৩ সালে যখন প্রেসিডেন্ট রুজভেল্ট রাশিয়ার।কম্যুনিষ্ট সরকারকে বৈধ বলে স্বীকৃতি দেন তখন তিনি তা দেন তখনকার ইউরোপের রাজনৈতিক অবস্থার ও এশিয়ায় জাপানের কথা বিবেচনা করে। আজ যেমন প্রেসিডেন্ট নিস্কন চীনের কনিষ্ট সরকারকে স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছেন রাজনৈতিক সুবিধা লাভের কথা বিবেচনা করে। বাঙলাদেশ রাষ্ট্রের ও সরকারের স্বীকৃতি দান প্রসঙ্গে এই ইতিহাসটুকু জানা প্রয়োজন। কারণ, কূটনৈতিক  স্বীকৃতি কথাটা কেবল ন্যায় নীতির  উপর প্রতিষ্ঠিত নয়। স্বীকৃতির পশ্চাতে কাজ করে বিশ্ব পরিস্থিতি ও নানা প্রকার রাজনৈতিক বিবেচনা।এবারে আইন প্রসঙ্গে আসা যাক। আজকের দিনে সাধারণভাবে মনে করা হয়, প্রত্যেক জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণাধিকার থাকা উচিত। জাতি। সঙ্ঘের সনদের প্রথম অনুচ্ছেদের দ্বিতীয় ধারায় বলা হয়েছে, সকল জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ থাকা উচিত। কিন্তু এই ঘোষণাটি এখনও আন্তর্জাতিক আইনে পরিণত হতে পারেনি। কারণ জাতি কথাটির তখনও একটা সবজন স্বীকৃত আইনগত সংজ্ঞা নিরূপণ সম্ভব হয়নি। কিন্তু মোটের উপর মনে করা হয়, ষে জনসমষ্টি একটি নির্দিষ্ট ভূখণ্ডে বসবাস করে ; যারা একই ইতিহাসের ঘটনা-পঞ্জি দ্বারা বিশেষভাবে গ্রথিত ; যারা একই সংস্কৃতির ধারক বাহক; যারা একই ভাষায় তাদের মনভাব ব্যক্ত করে ; ‘যারা অর্থনৈতিক স্বার্থের দিক থেকে এক; যারানিজেদের পরস্পরের মধ্যে অনুভব করে জন্মগত ঐক্য তাদের চিহ্নিত করা যায় একটি জাতি। বলে। জাতি প্রসঙ্গে আলোচনা। করতে গিয়ে ১৯৬৪ সালে ইউনেসকো কতৃক প্রকাশিত বিখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানের অভিধানে বলা হয়েছে ? “In all the social sciences factors such as the individuality of a people due to stable geographic contiguity, a historical and cultural tradition and an economic interest are taken into consideration in defining a nation.” (A Dictionary of Social Sciences Edt. J. Jonld and W. L. Kob. UNESCO . pp 451-52) Iকালচার বা সংস্কৃতি কথাটা বলতে এই অভিধানে ভাষাকেও বোঝান হয়েছে। ভূগোল, ভাষা, ইতিহাস, মানসিকতা, – অর্থনৈতিক স্বার্থসর্বদিক থেকে  বিচার করলেই বলতে হয় বাঙলাদেশের বাঙালীরা একটি জাতি। আর তাই আধুনিক রাষ্ট্র বিজ্ঞানের দৃষ্টি কোন থেকেও জাতি পুঞ্জের সনদের উপর ভিত্তি করে বলতে হয় বাঙলাদেশের বাঙালীদের আছে একটি আলাদা রাষ্ট্র গঠন করে আত্মনিয়ন্ত্রণের পূর্ণ অধিকার।

কোন নব গঠিত সরকারকে স্বীকৃতি দেবার আগে কূটনীতি শাস্ত্রে দুটি বিষয়কে বিশেষভাবে ভেবে দেখতে বলা হয়। নতুন সরকার পুরাতন সরকারের কর্মকর্তাদের হত্যা করে ক্ষমতা অধিকার করেছে কিনা এবং নতুন সরকারের পিছনে গণ-সমর্থন আছে কিনা। বাঙলাদেশ সরকারের সভাপতি ও মন্ত্রিরা কাউকে খুন করে ক্ষমতা অধিকার করেন নি। তারা সকলেই জন সাধারণের স্বাধীন ভোটে নির্বাচিত। এই সরকারের পিছনে রয়েছে বাঙলাদেশের মানুষের অকুণ্ঠ সমর্থন। তাই এই সরকারকে বৈধ বলে মেনে নেবার পক্ষে কোন আইনত বাধা নেই।বাঙলাদেশের ঘটনা প্রবাহ দক্ষিণ এশিয়ার শান্তিকে বিপন্ন করে। তুলেছে। তাই এই অঞ্চলের শাস্তি রক্ষা ও রাজনৈতিক নিশ্চয়তা বিধানের জন্যও বাঙলাদেশ সরকার ও গণপ্রজাতন্ত্রি বাঙলাদেশ রাষ্ট্রকে স্বীকৃতি দানের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে।

পাতা-৪

 

জয় বাংলা

৭ই আশ্বিন, ১৩৭৮

ইয়াহিয়ার ইরান সফর

     একদিনের জন্যে ইয়াহিয়া খানের আকস্মিক ইরান সফর সম্পর্কে পর্যবেক্ষক মহলের মধ্যে জল্পনা শুরু হয়েছে। ভারত ও পাকিস্তানের সঙ্গে ইরানের সম্পর্ক সৌহার্দমূলক। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বিরুদ্ধে যুদ্ধ শুরু করে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামরিক সংকটের বেড়াজালে আটকা পড়েছে। বাঙলাদেশের মানুষ। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে মরণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে। মুক্তিবাহিনীর হাতে প্রচণ্ড মার খাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ বাহিনী। অপর দিকে যুদ্ধ পরিস্থিতির দরূণ এবং ঘাতক বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের ফলে দখলীকৃত বাঙলাদেশে অস্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। মুক্তি বাহিনীর তৎপরতায় বিব্রত সামরিক সরকার কলকারখানা, ব্যবসা-বাণিজ্য প্রভৃতি অর্থনৈতিক কাজকর্ম চালু করতে ব্যর্থ হয়েছে। এর ফলে পাকিস্তানের অর্থনীতি সম্পূর্ণভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। অপর দিকে জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে সত্যিকারের রাজনৈতিক ক্ষমতা ফিরিয়ে দেয়ার সম্ভাবনা সুদূর পরাহত হওয়ায় খাস পশ্চিম পাকিস্তানেও রাজনৈতিক সংকট ঘনীভূত হয়ে উঠছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর বর্বর অত্যাচারের সাক্ষী ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বাঙলাদেশের ৮৫ লক্ষ শরণার্থী। এই বিপুল সংখ্যক শরণার্থীর জন্যে বিশ্বের কাছে পাকিস্তানের মুখরক্ষা করা সম্ভব। হচ্ছে না, তাদের কোন কৈফিয়তও খাটছে না। এই ভাবেই তৈরী হয়েছে তাদের সংকটের বেড়াজাল ।

এই সংকটের জাল এড়াবার জন্যে পাকিস্তান ভারতের সঙ্গে ইরানের হৃদ্যতামূলক সম্পর্কের সুযোগে পাকিস্তান ও ভারতের মধ্যে ইরানকে মধ্যস্থতার ভূমিকায় অবতীর্ণ করাতে চায়। বাঙলাদেশ সমস্যাকে এড়িয়ে বর্তমান সমস্যাকে পাক-ভারত বিরোধের রূপ দেয়ার এই পাকিস্তানী। আগ্রহ নতুন নয়। বাঙলাদেশে সামরিক এ্যাডভেঞ্চার শুরু করার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই তারা নিজেদের সৃষ্ট সংকটের গুরুত্ব অনুধাবন করতে। পেরেছিল। তার পর থেকেই ইয়াহিয়া সরকার বিশ্বের বিভিন্ন দেশে একজন মধ্যস্থ খুঁজে বেড়াচ্ছে। ইতিপূর্বে আমরা মধ্যস্থ হিসেবে কানাডা, অস্ট্রেলিয়া,  মালয়েশীয়ার টেংকু আবদুর রহমান প্রভৃতির নাম শুনেছি। আবার বাঙলাদেশ ও ভারত সীমান্তে পর্যবেক্ষক বাহিনী মোতায়েন করে বাঙলাদেশ। ও পাকিস্তানের বিরোধকে পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার প্রয়াস আমরা লক্ষ্য করেছি। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কোনটাই সফল হয়নি। এক্ষণে পাকিস্তানের হয়ে এই কাজটি করে দেয়ার জন্যে ইয়াহিয়া খান ইরানের। শাহের দ্বারস্থ হয়েছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বর্তমান সংকটটি বাঙলাদেশ। সমস্যা থেকে উদ্ভূত। এই সমস্যার কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে বাংলাদেশ সমস্যা। একে এড়িয়ে গিয়ে সমস্যার প্রকৃত সমাধান হতে পারে না। ইরানের শাহ সত্যিই যদি পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সমস্যার সমাধানের আন্তরিক ইচ্ছা পোষণ করেন তা হলে তাকে প্রকৃত বিবদমান পক্ষকেই বেছে নিতে হবে। এই বিরোধের বিবদমান পক্ষ পাকিস্তান ও ভারত নয়, আসল বিরোধ বাঙলাদেশ ও পাকিস্তানের মধ্যে। এটাকে এড়িয়ে গিয়ে বাঙলাদেশ সমস্যার সমাধান হওয়া সম্ভব নয়। ভারতের বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে যে ৮৫ লক্ষ শরণার্থী আশ্রয় গ্রহণ করেছেন, তারা সরাসরি ভাবে বাঙলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক সৃষ্ট সংকটের শিকার। কাজেই এ সংকটের সমাধানও নির্ভর করছে বাঙলাদেশ সরকারকে স্বীকার করে নেওয়ার মধ্যে, পাক-ভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার মধ্যে নয়।

কিন্তু এই বাস্তব সত্য কি ইরানের শাহ স্বীকার করে নেবেন। ইয়াহিয়াশাহ আলোচনার পর যে সংক্ষিপ্ত যুক্ত ঘোষণা প্রকাশিত হয়েছে তাতে বাঙলাদেশ সমস্যার ক্ষীনতম ইঙ্গিতও নেই। বরং যা আছে তাকে প্রকারান্তরে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর প্রতি পরোক্ষ সমর্থন বলা চলে। উক্ত যুক্ত ঘোষণায়  পাকিস্তানের প্রতি ইরানের সমর্থনের প্রতি জোর দেয়া হয়েছে। কাজেই এই  কথিত মধ্যস্থতার চরিত্র ও পরিণতি সম্পর্কে এর পরে আর কারো মনেই কোন মোহ থাকবার কথা নয়। অবশ্য ইরানের কাছ থেকে সত্যিকারের কোন গণতান্ত্রিক ভূমিকা আশা করা চলে না। ইরানের পূর্বাপর ভূমিকা আলোচনা করলে দেখা যাবে যে, ইরানের রাজতন্ত্র এ পর্যন্ত কোন গণতান্ত্রিক, প্রগতিশীল  ও গণমুখী ভূমিকা গ্রহণ করেনি। মধ্যপ্রাচ্যে আরব জাতীয়তাবাদের প্রতি  ইরান কোনদিন সক্রিয় সমর্থন তো দূরের কথা, নৈতিক সমর্থনও জানায়নি।  বরং আরব জাতীয়তাবাদের জোয়ারে পাছে ইরানের রাজতন্ত্র বিপন্ন হয় সেই  ভয়ে ইরানের রাজতন্ত্র বরাবর পরোক্ষভাবে জাতীয়তাবাদী শক্তির  বিরোধিতাই করেছে। এমন কি ইরানের মহান জাতীয়তাবাদী নেতা।  ডঃ মোসাদ্দেককে পর্যন্ত ইরানী রাজতন্ত্রের পক্ষে সহ্য করা সম্ভব হয়নি।

অথচ এই ডঃ মোসাদ্দেকই ইরানের বর্তমান অর্থনৈতিক প্রাচুর্যের দ্বার উন্মুক্ত করে দিয়েছিলেন। ইরানে আধুনিক গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থার পরিবর্তে এখনও এ কটি মধ্যযুগীয় রাজতন্ত্র বহাল রাখা হয়েছে।  মধ্যপ্রাচ্য তথা পশ্চিম এশীয়ায় নব জাগ্রত জাতীয় চেতনার ফলে  আন্তর্জাতিক সাম্রাজ্যবাদের স্বার্থ ও শক্তির ভারসাম্য বিপন্ন হতে বসেছিল, ইরানের রাজতন্ত্র, পেছন দুয়োর দিয়ে সেই সাজ্যবাদী স্বার্থের বিশ্বস্ত প্রহরী। হিসেবে কাজ করে আসছে। বাঙলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের প্রতি  পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তার চরম বিশ্বাস ঘাতকতা ও বাঙলাদেশের বিরুদ্ধে যুদ্ধে অবতীর্ণ হবার পরও ইরান গোপনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাকে অর্থ ও সমর সম্ভার যুগিয়েছে বলে অভিযোগ শোনা গিয়েছে।

বাঙলাদেশের জাতীয় প্রতিনিধিদেরকে সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত করার উদ্দেশ্যে ইরানের শাহ নির্বাচনের পূর্বেও একবার চেষ্টা চালিয়ে ছিলেন। সে সময় ইসলামবাদ হয়ে ইরানের শাহ আকস্মিকভাবে ঢাকা সফরে এসে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের সঙ্গে এক সাক্ষাতে মিলিত হন। কিন্তু শেখ সাহেব যে জাতীয় স্বার্থকে জলাঞ্জলী দিয়া সাম্রাজ্যবাদের লেজুড়ে পরিণত হতে রাজী।

হননি, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক বাঙলাদেশের জনগণ ও  জাতীয় নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান ও ঘৃণ্যতম গণহত্যার ইতিহাস থেকেই  তার প্রমাণ পাওয়া যায়। বাঙলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হলেও সাম্রাজ্যবাদী সরকার সমূহের নিষ্ক্রিয়তা এবং পশ্চিম পাকিস্তানী। সামরিক জান্তাকে পরোক্ষ সমর্থন ও উৎসাহদানের ঘটনা থেকে বুঝতে  অসুবিধা হয় না যে, ইরানের শাহ বা করিম আগা খানের মাধ্যমে বাঙলাদেশে সাম্রাজ্যবাদীরা কোন স্বার্থ হাসিল করতে গিয়ে ব্যর্থ হয়েছে । আমরা অবশ্য জানি যে, ঠিক তেমনিভাবে বাঙলাদেশ সমস্যাকে পাকভারত বিরোধে রূপান্তরিত করার প্রয়াসও তাদের ব্যর্থ হবে। বাঙলাদেশ সমস্যার সমাধান নির্ভর করে কেবলমাত্র বঙ্গবন্ধুর মুক্তিদান, বাঙলাদেশ সরকারের হাতে শাসন ক্ষমতা অর্পণ এবং হানাদার বাহিনীর অপসারণের ওপরে। অন্যথায় নয়। ইরানের শাহের সত্যই যদি এই সমস্যা সমাধানের কোন সদিচ্ছা থাকে, তা হলে ইয়াহিয়া সরকারে ওপরেই তিনি তার প্রভাব  বিস্তার করুন।

                                              

 যা দেখছি যা ভাবছি

                আবদুল গাফ্ফার চৌধুরী

যা দেখি তা নিয়ে যেমন সব সময় – ভাবি না, তেমনি যা ভাবি, তাও সব।  সময় চার পাশে দেখি না। এবং  যা ভাবি এবং দেখি তা যে সব সময়।  লিখতে পারি, তাও নয়। অর্থাৎ এই দেখা, ভাবা এবং লেখার মধ্যে। সব সময় একটা বিরোধ চলছে। আর এই বিরোধ নিয়েই নাকি বুদ্ধিজীবীদের কারবার। আমি বুদ্ধিজীবী – নই, কলমজীবি। কলম চালিয়ে এই বিশ্ব শতকের শেষার্ধে বেঁচে আছি। কদিন বাঁচবো জানি না। তবু যে ক’দিন বেঁচে আছি, সে ক’দিন নিঝঞাটে নির্বিবাদে বাঁচবে। এটাই একদিন আশা করেছিলাম। রবীন্দ্রনাথের কবিতা ছিল আমার। কামনা

যার যাহা আছে

তার থাক তাই

কারো অধিকারে

যেতে নাহি চাই

শান্তিতে যদি থাকিবারে পাই।

একটি নিভৃত কোণে…

 কিন্তু ইয়াহিয়া সাহেব শান্তিতে থাকতে দিলেন না। পঁচিশে মার্চ গভীর রাত্রে হঠাৎ ঘুম ভেঙে শুনলাম।কামান গর্জন। তখন বুঝতে পারিনি এই কামানে আমারই ঘর ভঙেছে আমারই ভাই বোন মরছে। যখন বুঝতে পারলাম, তখন নিজের প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে সটান মুক্ত এলাকার দিকে। মুক্ত এলাকায় এসেছি তাও আজ দু’মাসের উপর। হয়ে গেছে। তারপর থেকে যা দেখছি তা নিয়ে আর ভাবছি না। যা ভাবছি, তা চারপাশে দেখছি না। এবং যা দেখছি এবং ভাবছি, তা লেখার হিম্মত পাচ্ছি না।আগেই কবুল তরে নিই, যদিও “জয় বাংলায় লিখছি, তথাপি এই কলামটি ( কলম নয়) আমার ব্যক্তিগত কলাম । এতে আমার ব্যক্তিগত মতের প্রতিফলন ঘটবে। সুতরাং কোন পাঠক বা পাঠিকা যেন একে “জয় বাংলার সরকারী বা। বেসরকারী মতের প্রতিফলন বলে না ভাবেন।

গৌর চন্দ্রিকা সারলাম। এবার আসল কথা বলি। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় একটি তাবেদার মন্ত্রিসভা গঠন করা হয়েছে। এই যন্ত্রিসভায় দশটি ‘নবরত্নও জুটেছে। তাতে বাংলাদেশের মুক্তাঞ্চলের কেউ কেউ হতাশ হয়েছেন। কেউ কেউ ক্ষোভ প্রকাশ করে এমন কথাও বলেছেন, বাংলাদেশে এত কাণ্ডের পরও ইয়াহিয়া তাবেদার জোটাতে পারলেন ? আমি কিন্তু আমার বন্ধুদের মত অমন হতাশ হইনি। আর হতাশ হব কেন ? পৃথিবীর সব যুগে সব দেশে একদল জাতিদ্রোহী বিশ্বাসঘাতকের অস্তিত্ব ছিল এবং এখনো আছে। বাংলাদেশেও থাকবে, তাতে বিস্মিত হবার কি আছে? হিটলার ফ্রান্স দখল করার। পর পেতার মত জাদরেল মার্শালকে পেয়েছিলেন তার তাবেদার হিসাবে। বৃটেন যদি দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে হারতোতাহলে লনডনে তাবেদার মন্ত্রিসভা গঠনের জন্য কি হিটলার অন্ততঃ কয়েক ডজন বৃটিশকে জোগার করতে পারতেন না ? খুব পারতেন। বৃটেন যুদ্ধে হারেনি, তাতেই যুদ্ধ চলাকালে বৃটেনের চাচিল মন্ত্রিসভার এক জবরদস্ত মন্ত্রী মিঃ আমেরির ছেলে জার্মানীতে পালিয়ে গিয়ে হিটলারের শিষ্যত্ব নিয়েছিল এবং জার্মান বেতার থেকে অহোরাত্র বৃটেনের নিন্দা করা ছিল তার কাজ। সুতরাং ইয়াহিয়া বাঙালীর রক্তে হাত লাল করে তার তাবেদার হিসাবে এক ডজন বাঙালীকে সংগ্রহ করবেন,  তাতে বিস্ময়ের কিম্বা হতাশার কি  আছে ? আর বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকার নতুন লাট মোতালিব মল্লিক থেকে শুরু করে আসামের মাইনকারচরের কাসেম খাঁ কিম্বা পশ্চিম পাকিস্তানী বীমা কোম্পানীর অর্ধ শিক্ষিত দালাল সুলায়মান এরা – কেউতো আর নতুন মুখ নয়। মল্লিকের রাজনৈতিক বিশ্বাসঘাতকতার শুরু সময় থেকে। মাইনকারচরের কাসেম আইয়ুবের আমলে ছিল আইয়ুবী পরিষদের ডেপুটি স্পীকার। আর তাতেই এই এককালের দরিদ্র ইস্কুল শিক্ষক রাতারাতি একটি টেক্সটাইল। এবং একটি পলিথিনের । কলের মালিক হয়েছেন। এইসব পুরনো। মুখ নিয়েই ইয়াহিয়া আবার নতুন খেলা জমিয়েছেন। কিন্তু বেচারা বোধ হয় জানেনা, এটাই তার শেষ খেলা এবং তার সংগৃহীত দালালদেরও এটাই শেষবারের দালালী। _ আমিও মাঝে মাঝে হতাশ হই। তবে সেটা এই কারণে নয় যে, ঢাকায়। মোতালিব মল্লিক নামে এক অবসর ভোগী বৃদ্ধ দালাল আবার দালালীর চাকরী পেয়েছেন, কিম্বা সুলায়মান নামে এক বীমা কোম্পানীর দালাল মন্ত্রিত্বের চাকরি পেয়েছেন। আমি হতাশ হই তখন, যখন—রবীন্দ্রনাথের ভাষায়

‘আমি যে দেখেছি

তরুণ বালক

উন্মাদ হয়ে ছুটে

কি যন্ত্রণায়।

মরিছে পাথরে

নিস্ফল মাথা কুটে

আমিও হতাশ হই, যখন মুক্তি বাহিনীর ক্যামপে দাঁড়িয়ে দেখি, তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা ভারী অস্ত্রের অভাবে পাথরে নিস্ফল মাথাকুটে মরছে। এ যুগে কেবল মনোবল দিয়ে যুদ্ধজয় হয় না। যদি হত, তাহলে ভিয়েৎনামের গেরিলারা কেবল মনোবল দিয়ে আমেরিকানদের ইন্দোচীন থেকে তাড়িয়ে দিতে পারতো, সোভিয়েট রাশিয়ার কাছ থেকে আধুনিক মারণাস্ত্র এনে এত দীর্ঘকাল যুদ্ধে ব্যাপৃত থাকতে হত

– ভিয়েৎনামের চাইতেও আমি আমার দেশের মুক্তি বাহিনীকে নিয়ে গর্বিত। বলতে গেলে প্রায় খালি হাতে—কিছু সেকেলে অস্ত্র নিয়ে তারা গত ছ’মাস ধরে আধুনিকতম চীনা ও আমেরিকান অস্ত্রে সজ্জিত, সিয়াটো ও মেডাের ট্রেনিংপ্রাপ্ত পাকিস্তানী বাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে। এটাতে কম কথা নয়। কেবল সহানুভূতি, কিছু সেকেলে অস্ত্র ছাড়া গত ছ’মাস এরা বলতে গেলে কিছুই পায়নি। তবু ।  এরা লড়ছে। আর এখানেই আমার। শেষ ভরশা, শেষ সান্তনা। বাংলা দেশের দখলীকৃত এলাকায় আবার। যদি বাংলা দেশের পতাকা ওড়ে, তবে এদের জন্যই উড়বে, যদি ঢাকায়। সেই ছায়া সুনিবিড় বাড়ীটিতে আবার ফিরতে পারি, তবে এদের জন্যই পিরবো। বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের সাফল্যও প্রকৃত পক্ষে নির্ভর করে এই মুক্তিবাহিনীর সফল রণনীতির উপর।ভরসার কথা যখন উঠলো, তখন একটা কথা বলি। জাতিসঙ্ঘ, – আমেরিকা এবং রাশিয়া কোন সমস্যায় যখন এই ব্রাহ,স্পর্শের যোগ ঘটেছে, তখন সেই সমস্যার আর সমাধান হয়নি। ইউরোপে ৰালিন বিভক্ত হয়েছে সেই কবে ১৯৪৫ – সালে। তা আর জোড়া লাগেনি।কোন্দলও থামেনি। দুঃখ দুর্দশা বাড়ছে কেবল জার্মান জাতির। আমেরিকা এতবড় বন্ধু তাইওয়ানের। চিয়াং কাইশেকের। আজ তাকেই। কলা দেখিয়ে নিক্সন চলেছেন পিকিংয়ে নতুন পীরিতির নেশায়। আরব জাতীয়তাবাদের এত বড় বন্ধু। সোভিয়েট রাশিয়া। ১৯৬৬ সালের জুন যুদ্ধে যে ভূখণ্ড আরবেরা। হারিয়েছে, তার এক ইঞ্চিও আর পুনরুদ্ধার করতে পারেনি। সমস্যা পৃথিবীর সর্বত্র। প্যালেষ্টাইন, এঙ্গোলা, মোজাম্বিক, ভিয়েৎনাম, রোডেশিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা। জাতিসঙ্ঘ কিম্বা রাশিয়া আমেরিকা মিলে কোথায় কোন্ সমস্যার সমাধান হয়েছে, আমি জানিনা।

ফরাসী বুদ্ধিজীবি আদ্রে মার  লোর সঙ্গে আমি তা-ই একমত।  যুদ্ধ ছাড়া বাংলাদেশের মুক্তির দ্বিতীয় কোন পথ নেই।আর এই যুদ্ধ।অব্যাহত রাখার জন্য পৃথিবীর যে  কোন প্রান্ত থেকে যে কোন প্রয়াসে

অস্ত্র সংগ্রহ করতে হবে—মুক্তি ফৌজের হাতে অস্ত্র তুলে দিতে হবে। যার। ভাবছেন, বিশ্ব-বিবেকের তাড়ায়। ইয়াহিয়া মাথানত করবেন কিম্বা বিশ্ব রাজনীতির হাওয়া বদলানোর দরুণ। বাংলাদেশের স্বাধীনতা তরান্বিত হবে, তারা হয়তো একটা সত্য এখনো। উপলব্ধি করতে পারেননি যে, বাংলাদেশ সমস্যা ইতিমধ্যেই আন্তর্জাতিক স্নায়ুযুদ্ধের হিমাগারে পৌছে গেছে।এখন মুক্তির একটিই পথ এবং তাহল সশস্ত্র সংগ্রাম। অপরের কৃপা। কিম্বা অনুগ্রহ ভিক্ষা নয়।

সংগ্রামী অভিনন্দন

জয়বাংলার জয় হোক “জয়বংলা নতুন টাইপে নতুনভাবে ও আঙ্গিকে প্রকাশিত হতে চলেছে শুনে আনন্দিত হলাম। মুজিব নগর থেকে বেশ ক’টি সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়েছে। এগুলোর সঙ্গে জয়বাংলার পার্থক্য এই যে, জয়বাংলা মতামত-প্রধান পত্রিকা এবং এই মতামতও সুষ্ঠু এবং যুক্তি নির্ভর। গুজবকে খবর বলে চালানোর প্রয়াস বা খবরে ‘অতিরঞ্জন’ ‘জয়বাংলায় নেই। আপনাদের কাছে আমাদের অনুরোধ, জয়বাংলার এই সাংবাদিকতা অক্ষুন্ন রাখবেন । এটা সংগ্রামী পত্রিকা। কোন প্রকার ব্যবসায়িক মনোবৃত্তি যেন আপনাদের মধ্যে দেখা না দেয়। দয়া করে। কুষ্টিয়ার মুক্তাঞ্চলে আরো বেশী জয়বাংলা পাঠানোর ব্যবস্থা করবেন।

—শিবানী মিত্র চুয়াডাঙ্গা, (মুক্তাঞ্চল ) কুষ্টিয়া,

এই বাংলাদেশ ‘ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃতি প্রসঙ্গে ‘জয়বাংলায় সম্পাদকীয় ‘ইয়াহিয়ার মস্তিস্ক বিকৃতি’ পড়লাম। ইয়াহিয়ার প্রলাপপাক্তির এই সুস্থ। সমালোচনার জন্য ধন্যবাদ । এই সঙ্গে জয়বাংলার সম্পাদক হিসাবে  একটি অনুরোধ জানাব। জয়বাংলায় আরো বেশী তথ্যপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা চাই। ইয়থ ক্যাম্প এবং মুক্তি যোদ্ধাদের শিবিরে জয়বাংলা আরো বেশী করে পাঠান। এদের রাজনৈতিক প্রশিক্ষণ ও চিন্তাধারার বিকাশের জন্য সুই ও এ তথ্যপূর্ণ রাজনৈতিক আলোচনা। আরো বেশী দিন।

—আউয়াল মজুমদার। ইয়থ ক্যাম্প, পূর্ব রণাঙ্গন বাংলাদেশ শরণার্থী শিবিরে। আমি কুমিল্লা থেকে আগত একজন শরণার্থী। যদিও পশ্চিম বঙ্গের এক শরণার্থী শিবিরে আমি আমার পরিবার পরিজন রেখেছি, তথাপি এখনও প্রায়ই আমি মুক্তাঞ্চলে গিয়ে থাকি। পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন শরণার্থী শিবিরে শরণার্থীরা যদিও নানারকম দুঃখ কষ্টে রয়েছেন, তথাপি তারা দেশের খবর এবং মুক্তিযুদ্ধের খবর জানতে চান। প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে তাই জয় বাংলার আরো ব্যাপক ও সুষ্ঠু বিলিবণ্টন ব্যবস্থা আবশ্যক। এছাড়া শরণার্থীদের মনে প্রেরণা ও আশা সৃষ্টির জন্য জয়বাংলায় শরণার্থী শিবির’ নামে একটি নিয়মিত ফিচার। প্রকাশের ব্যবস্থা হওয়া দরকার। —কল্পনা চৌধুরী ও শওকত জামাল।

কল্যাণী, নদীয়া (পঃ বঙ্গ )

পাতা-৫

মালেকের ‘দশনরত্ন

(রাজনৈতিক ভাষ্যকার)

ডাঃ মোতালিব মল্লিক—ওরফে চোখের ডাক্তার মালিক—বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গভর্ণর নিযুক্ত হওয়ার পর দশ জনের এক তাবেদার মন্ত্রিসভা নিযুক্ত করেছেন। এতে পশ্চিম পাকিস্তানের দাউদ কোম্পানীর দালাল সোলায়মান, মাইনকার চরের আবুল কাসেম সহ বেশ ক’টি রত্ন স্থান পেয়েছে। তবে দশ নবরত্নের দশম রত্নটিকে নাকি শপথ গ্রহণের জন্য (এই প্রবন্ধ লেখা পর্যন্ত ) পাওয়া যায়নি। মুজিব নগরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকেরা এই খবরে মন্তব্য করেছেন, মুক্তি যোদ্ধাদের দালাল  নিধনের তালিকায় আরো ক’টি নাম যুক্ত হল মাত্র।

ডাক্তার মালিক দখলীকৃত এলাকার তাবেদার গভর্ণর নিযুক্ত হবার পরই হরেক রকমের মজার মজার কথাও বলতে শুরু করেছেন। তিনি নাকি পাকিস্তানের চিকিৎসা করবেন। কিন্তু ডাক্তার মালিক সাহেব চোখের মাথা খেয়ে বসে আছেন বলেই বুঝতে পারছেন না যে, ২৫শে মার্চ রাতেই পাকিস্তান নামক রোগীর মৃত্যু ঘটেছে। তারই ইসলামাবাদী প্রভুরা ওই রাতে পাকিস্তান নামক রোগীটিকে হত্যা করেছে। শুধু মালিক ডাক্তার  কেন,

কোন ডাক্তারের পক্ষেই নিহত পাকিস্তানকে বাঁচানো সম্ভব নয়। ইসলামাবাদের কাপালিকরা পাকিস্তান নামক একটি রাষ্ট্রের শব দেহের ওপর বসে শব সাধনা করছে। বাঙলাদেশের লক্ষ লক্ষ মানুষ, বাঙলাদেশের মা-বোনের ইজ্জত সেই শব সাধনার বলি। এতে। রক্তের ধারায়, এতো মানুষের দীর্ঘ শ্বাসে যে রাষ্ট্ররূপের মৃত্যু ঘটেছে, তাকে কোন কাপালিকের তন্ত্র সাধনায় বাঁচিয়ে তুলতে পারবে না।

 তা সত্ত্বেও, ডাক্তার মালিক বলেছেন যে, তিনি সমঝোতার জন্যে। আওয়ামী লীগ নেতাদের বৈঠকে বসবার আহ্বান জানাবেন। তবে তাঁর মতে সেই বৈঠকের সময় নাকি এখনো আসেনি। এটাই হলো ডাক্তার মালিকের সেই প্রস্তাবিত চিকিৎসার প্রয়াস। তবে পদ্ধতিটা কূটনৈতিক । মালিক সাহেব তার প্রভুদের কৃপায় বেশ কিছুকাল কূটনীতিকের চাকরী করেছেন বলে হয়তো ভাবছেন যে, কূটনৈতিক পদ্ধতির চিকিৎসায় তার অধিকার জন্মেচ্ছে।  কিন্তু ডাক্তার সাহেবের মনে থাকা উচিত যে, ২৫শে মার্চের ঢের আগে, যখন পাকিস্তান নামক রোগীটির মৃত্যু ঘটেনি তখনই সাড়ে  সাত কোটি বাঙালীর নেতা বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিব এই মালিক সাহেবের প্রভু ইয়াহিয়া খানের উদ্দেশ্যে  বজ্রকণ্ঠে ঘোষণা করেছিলেন । “কিসের বৈঠক, কার সঙ্গে বৈঠক ? যারা আমার দেশের ছেলেদের বুকে ভাইয়ের বুকে গুলি চালিয়েছে, হত্যা করেছে তাদের সাথে বৈঠক •••?” তেমন বৈঠকের প্রস্তাব তিনি ঘৃণার সাথে প্রত্যাখ্যান করেছিলেন।  ইয়াহিয়ার ঘাতকরা তখন হত্যা করেছিল বাঙলাদেশের কতকগুলো  তরুণ প্রাণ, আর ২৫শে মার্চের পর থেকে তারা হত্যা অভিযান  চালিযেছে একটি জাতির বিরুদ্ধে। সেই গণ হত্যাকারী ঘাতকের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর অনুগামীরা বৈঠকে বসবে? – না, সে আশা ইসলামাবাদের – ঘাতকরা করে না। সমঝোতার কথাটাও একটা ভাওতা মাত্র। পাকিস্তানকে সাহায্যদানের যে  প্রস্তাবটি একদা মার্কিণ কংগ্রেস  প্রত্যাখ্যান করেছিল সিনেট এপ্রোপিয়েশন কমিটি যাতে তা অনুমোদনের পক্ষে মত প্রকাশ করে, অক্টোবরের শেষাশেষি প্যারিসে পাকিস্তানকে বৈদেশিক সাহায্য দানকারী দেশসমূহের কনসোটিয়ামের বৈঠক বসবে, সেই বৈঠক যাতে পাকিস্তানকে পুনরায় ঋণ দিতে। সম্মত হয়, জাতিসংঘ সাধারণ। পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানের ঘাতক সামরিক জান্তা যাতে নিজেদের মুখ রক্ষা করতে সমর্থ হয়, সেই উদ্দেশ্যে এই কূটনৈতিক ধাপ্পাবাজীর চেষ্টা।তবে কয়েকটা সত্যি কথা এতে  ফাস হয়ে গিয়েছে। বাঙলাদেশের এ ব্যাপারে পাকিস্তান যে এখনো হালে। পানি পাচ্ছে না, এখনো স্বাভাবিক অবস্থা’ যে ফিরিয়ে আনতে তারা সমর্থ হয়নি, বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা প্রবর্তনের প্রয়াসটা যে ভাওতা, আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছা প্রকাশের ভেতর দিয়ে তা প্রকারান্তরে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। তা ছাড়া আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও প্রতিনিধিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করে তারা নিজেরাই যে সমস্যাকে জটীল করেছে। এবং সেই জটীলতার জট একমাত্র আওয়ামী লীগ নেতাদের পক্ষেই খোলা সম্ভব, সমঝোতার জন্যে আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে বৈঠকের ইচ্ছায় তারই স্বীকৃতি দেয়া হয়েছে। মুষ্টিমেয় ‘দুষ্কৃতিকারী’ আর ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ বলে মুখে সামরিক জান্তা যতই প্রচার করুক, আওয়ামী লীগ ছাড়া বাঙলাদেশ সমস্যার কোন সমাধানই সম্ভব নয়।

 কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী

সম্মেলনে বাংলাদেশ।

কুয়ালালামপুর, ১৪ই সেপ্টেম্বর আজ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী সম্মেলনের দ্বিতীয় দিবসে একজন বৃটিশ এম, পি ‘ভারতে বাংলাদেশ শরণার্থীদের ৯৫oটি শিবিরকে ৯৫০টি গাজা ব-দ্বীপ, বলে অভিহিত করেন। এবং বলেন এই ৯৫০টি শরণার্থী শিবির পাক-ভারত যুদ্ধের ৯৫০টি সম্ভাব্য কারণ হিসাবে বিরাজ করছে।

উক্ত বৃটিশ এম, পি হচ্ছেন বৃটিশ চাকরী-বিনিয়োগ দফতরের উপমন্ত্রী মিঃ কে বেকার। তিনি বলেন, প্রতিটি শরণার্থী শিবিরে দেড় লাখ লোককে রেশনের জন্য সীমাহীন লাইন দিয়ে দাঁড়াতে দেখার চেয়ে মানুষের চোখের পক্ষে বিরক্তিকর দৃশ্য আর কিছু হতে পারে না।

নিউজিল্যাণ্ডের প্রতিনিধি মিঃ এইচ, সি, টেম্পেল্টন সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, কমনওয়েলথ ভুক্ত রাষ্ট্রগুলো যদি অবিলম্বে প্রত্যক্ষ ব্যবস্থা গ্রহণ না করে তাহলে ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে পড়বে, যার ফলে উভয় দেশের অর্থনীতি সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়বে।তিনি আরও বলেন যে, নিউজি ল্যাণ্ডের প্রধান মন্ত্রী মিঃ কিথ হলিওক ইতিমধ্যেই ইয়াহিয়া খানকে পূর্ব পাকিস্তানের জনগণ যা চায় তা মেনে নিতে অনুরোধ জানিয়েছেন। এ সম্মেলনে একাধিক বক্তা বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য সাহায্য প্রেরণের কাজ ত্বরান্বিত করার আহ্বান জানান।

কুয়ালালামপুরে বিপন্ন মানবতা ও মরনোন্মুখ গণতন্ত্রের স্বপক্ষে যে সামান্য কয়েক পংক্তি বিবেকবাণী। উচ্চারিত হয়েছে, পাকিস্তানের জঙ্গী সরকার তা প্রসন্ন চিত্তে গ্রহণ করতে পারেনি। কেন না, মালয়েশিয়ায় নিযুক্ত পাকিস্তানী হাইকমিশনার উক্ত সম্মেলনে বাংলাদেশ সমস্যা আলোচিত হয়েছে বলে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন।  বাংলাদেশে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নৃশংস অত্যাচারের কঠোর

সমালোচনার মধ্য দিয়ে পূর্বদিন। সপ্তদশ কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারী। সমিতির সপ্তাহব্যাপী সম্মেলন শুরু

সাবেক কমনওয়েলথ সচিব মিঃ আর্থার বটমলী ইয়াহিয়া খানকে এই সত্যটি উপলব্ধি করতে বলেছেন যে, ‘একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানই পূর্ব বাংলার জনগণের পক্ষে কথা বলতে পারেন। তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি দাবী করে বলেন জন নেতাদের কারাগারে রেখে দুনিয়ার কোন সমস্যার যে সমাধান করা যায় না বৃটিশ সাম্রাজ্যের ইতিহাস থেকে ইয়াহিয়ার শিক্ষা গ্রহণ করা উচিৎ। মিঃ বটমলী তার ভাষণে বাংলাদেশ সমস্যা, অধিকৃত বাংলাদেশ এবং ভারত সরকারের অভিজ্ঞতার উপর আলোকপাত করেন। ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে তিনি মন্তব্য করেন যে, ইয়াহিয়া খান রাজনৈতিক নেতা নন। অথচ তাকে মোকাবেলাকরতে হচ্ছে নির্ভেজাল রাজনৈতিক সমস্যার।

উক্ত অধিবেশনে ভারতীয় প্রতি নিধিদলের নেতা শ্ৰী জি, এস, ধীলন বাঙলাদেশের প্রশ্নে বলেন যে, বর্তমান সঙ্কট ভারত-পাকিস্তানের মধ্যে বিরোধের ফল নয়, বরং সংস্কৃতি ও ভাষার দিক দিয়ে পাকিস্তানের দুইটি ভিন্ন জাতির মধ্যকার বিরোধ।ঘানার প্রতিনিধি মিঃ সাকিস্তেক। কমনওয়েলথের পক্ষ থেকে পূর্ববাঙলার শরণার্থীদের সাহায্য করার। জন্য আবেদন জানান।বৃটেনের স্যার রোনাল্ড রাসেল। বলেন যে, পূর্ব বাঙলার মানুষের নিরাপত্তা সুনিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত। ভারত উদ্বাস্তুদের ফেরৎ পাঠাতে পারবে না। তিনি পূর্ব বাঙলার সমস্যার একটি রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তার উপর জোর দেন।গায়ানার প্রতিনিধি মিঃ নেভিল জেমস বলেন যে, পাকিস্তানকে নিন্দা করার অধিকার কমনওয়েলথভুক্ত দেশগুলোর আছে, কারণ পাকিস্তান পূর্ব বাঙলাকে অবদমিত করে এবং শেখ মুজিবুর রহমানকে আটক রেখে নীতি ও ন্যায় ধর্মের সকল বিধি লঙ্ঘন করেছে। কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারীসভার এই অধিবেশনে পাকিস্তানের প্রতিনিধি প্রেরণের অধিকার নেই। কেননা পাকিস্তানে কোন পার্লামেন্ট নেই। ঐ একই কারণে নাইজেরিয়া ও উগাণ্ডাও প্রতিনিধি প্রেরণ করতে পারেনি।

বিশ্বজনমত

পদগর্ণির ঘোষণা ও বাংলাদেশ

(রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক)

সোভিয়েট ইউনিয়নের প্রেসিডেন্ট পদগণি সম্প্রতি এক ভোজ সভায় ঘোষণা করেছেন যে বাংলাদেশ সমস্যার একটি দ্রুত রাজনৈতিক সমাধান হওয়া প্রয়োজন। দক্ষিণ এশিয়ার শান্তির জন্যই এই সমাধান _ বিশেষভাবে প্রয়োজন। পদগর্ণির  বক্তব্য থেকে একথা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে  যে বাংলাদেশ বর্তমানে আন্তর্জাতিক সমস্যা হিসাবে রূপ লাভ করতে আরম্ভ করেছে এবং শেষ পর্যন্ত। বাংলাদেশ নিয়ে এশিয়া ভূ-খণ্ডের শান্তি বিঘ্নিত হতে পারে। অর্থাৎ ব্যাপক যুদ্ধ শুরু হতে পারে। পদগণি রাজনৈতিক সমাধান বলতে ঠিক কি বোঝাতে চান, সে সম্পর্কে কিছু পরিষ্কার করে বলেন নি। তবে তিনি ভোজ সভায় ইঙ্গিত করেছেন, এই সমাধান হতে হবে বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছার সাথে সঙ্গতি রেখে।

বাংলাদেশের মানুষের ইচ্ছা আজ পরিষ্কার। তারা আজ চায় পূর্ণ স্বাধীনতা। বাংলাদেশের মাটি থেকে দখলদার পশ্চিম পাকিস্তান বাহিনীর – অপসারণ। রাজনৈতিক সমাধান বলতে তারা মনে করে, পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে তাদের সম্পর্ক ছেদের ব্যাপারে সহায়তাকর রাজ- নৈতিক সিদ্ধান্ত। কিন্তু ইয়াহিয়া সরকার এখন ব্যাপক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিয়ে চলেছে। আন্তর্জাতিক চাপকে সে এখনও যথেষ্ট গুরুত্ব দিচ্ছে না! জঙ্গীশাহীর কার্যকলাপ দেখে মনে হচ্ছে, রাজনৈতিক সমাধান ব্যাপারটি তাদের মনঃপুত নয়। তারা এখন চায় বাংলাদেশের মানুষকে অধিনতার পাশে আবদ্ধ রাখতে। – বিরাট দেশ সোভিয়েট ইউনিয়ন। তার সামরিক শক্তি অপরিসীম। পশ্চিম পাকিস্তান থেকে তার সীমান্তের দূরত্ব বেশী নয়। সোভিয়েট ইউনিয়নের উক্তি তাই তার মনে রেখা পাত করা উচিৎ। কিন্তু আপাতত ইয়াহিয়া সরকারের কার্যকলাপ থেকে এই প্রভাব পড়ার। কোন চিহ্ন পরিলক্ষিত হচ্ছে না। তাছাড়া রাজনৈতিক সমাধান বলতে ঠিক কি বোঝান হচ্ছে সে সম্পর্কে এখনও কোন পরিষ্কার ধারণা পাওয়া সম্ভব হচ্ছে না সোভিয়েট ইউনিয়নের সভাপতির বক্তব্য থেকে। এ বিষয় পরিষ্কার পরিকল্পনা ছাড়া সমাধানের পথে অগ্রগতি সম্ভব নয়। বাংলাদেশের মানুষ সব সময় তাদের সমস্যার সমাধান শান্তিপূর্ণ ও নিয়মতান্ত্রিক উপায়েই চেয়েছিল। তারা কোন সামরিক সমাধান চায়নি। কিন্তু ইয়াহিয়া ও তার সামরিক  চক্রের নীতির ফলেই বর্তমান পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশের মানুষ বাধ্য হয়েছে অস্ত্র ধারণ করতে। ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গীচক্র । যদি তাদের নীতি না বদলায়, তবে কোন রাজনৈতিক সমাধান সম্ভবপর হবে না।পঁচিশে মার্চের পর সোভিয়েট প্রেসিডেন্ট নিকোলাই পদগণি শেখ – সাহেবের নিরাপত্তা সম্পর্কে উদ্বেগ প্রকাশ করে চিঠি লেখেন। পদগর্ণির চিঠিকে পাকিস্তানের নানা পত্র পত্রিকায় কঠোর সমালোচনা করা হয়। পিপলস পার্টির নেতা জুলফিকার আলী ভুট্টো বলেন, পাকিস্তানের অভ্যান্তরীন ব্যাপারে রুশ হস্তক্ষেপ সহ্য করা হবে না। সরকারীভাবে পাকিস্তান সোভিয়েট প্রেসিডেন্টকে জানায়, যে বাংলাদেশের ঘটনাবলী পাকিস্তানের অভ্যান্তরীন ব্যাপার এবং শেখ দেশদ্রোহী। কিন্তু বর্তমানে পাকিস্তান। সরকার আর আগের মত জোরাল ভাষায় কিছু বলছেন না। এ থেকে একটি কথা প্রমাণিত হয় যে আন্তজাতিক জনমত পাকিস্তানের উপর কিছুটা চাপ সৃষ্টি করেছে। কিন্তু এই চাপ সৃষ্টি সমস্যা সমাধানের পক্ষে এখনো যথেষ্ট বলে মনে করবার কোন কারণ নেই। সোভিয়েট প্রেসিডেন্টের মন্তব্য থেকে একথা পরিষ্কার বোঝা যাচ্ছে সোভিয়েট সরকার বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান চান এবং বাংলাদেশ সমস্যাকে পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার বলে মনে করেন না। জঙ্গীশাহী বিশ্বকে বাংলাদেশের ঘটনাবলী পাকিস্তানের  অভ্যান্তরীণ ব্যাপার একথা বোঝাতে এখন সম্পূর্ণভাবে অক্ষম। কিন্তু বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান হতে হলে বিশ্বজনমতকে আরো সক্রিয় হতে হবে। ইয়াহিয়া সরকার জঙ্গী সরকার। – যুদ্ধ নীতিই তার পক্ষে সহজে বোধগম্য। এছাড়া ইয়াহিয়া নিজেকে প্রমাণ করেছে ধাপ্পাবাজ। তাই বাঙ্গালীকে সজাগ থাকতে হবে। ইয়াহিয়া সরকার আলোচনা করতে তখনই রাজি হতে পারে, যখন সামরিক দিক থেকে বাংলাদেশকে দখলে রাখা তার পক্ষে মনে হবে অসম্ভব। বাংলাদেশের মানুষ যুদ্ধ চায় না। কিন্তু সামরিক চাপ বজায়। না রাখলে ইয়াহিয়া কখনই কোন রাজনৈতিক সমাধানে আসতে রাজি হতে পারে না। তাই আজ বাংলা- দেশের মানুষের লক্ষ্য হওয়া উচিৎ একদিকে রাজনৈতিক সমাধানের পথ খোলা রাখা অন্যদিকে শত্রু সৈনের – উপর সামরিক চাপ অব্যাহত রাখা। পথ খোলা রাখতে হবে কুটনৈতিক ক্ষেত্রে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে রণক্ষেত্রে।আমরা শান্তি চাই। আমরা চাই না এশিয়ার ভূখণ্ডে ব্যাপক সমরানল প্রজ্জ্বলিত হোক। কিন্তু বাঙ্গালীর ন্যায্য দাবী স্বীকৃত না হলে। শান্তি সম্ভব হবে না এই অঞ্চলে। বরং দেখা দিতে পারে ব্যাপক যুদ্ধের সম্ভাবনা।

পাতা-৬

রনাঙ্গন ঘুরে  এলাম

সেদিন ছিল ১৪ই আগষ্ট। অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জন্ম দিবস। বাজারে গুজব পাকিস্তানী সৈন্যরা সেদিন পুরো বাংলাদেশকে তাদের। আরও কবলে নেবার চেষ্টা কোরবে। এবং পাকিস্তানী পতাকা বাংলাদেশের প্রতিটি থানায় উত্তোলন কোরবে। আরও গুজব ছিল মুক্তি যোদ্ধারাও নাকি সেদিন বহু বিশেষ বিশেষ স্থানে তাদের স্বাধীন বাংলাদেশের। পতাকা উত্তােলন কোরবে। আমরা। যারা বাংলাদেশের ভেতরেই মুক্তি যোদ্ধাদের আশে পাশেই থাকি তারা কিন্তু মুক্তি যোদ্ধাদের ঐ ধরণের বিশেষ কোন প্রোগ্রাম আছে বলে শুনিনি। পাক ফৌজের বিশেষ প্রোগ্রামের কথা অবশ্য আমাদের জানবার কথা নয়। তাই পাক ফৌজের যে ওধরণের কিছু প্লান। থাকতে পারে তা অবিশ্বাস করিনি।

তবে, সেদিন আমাদের নিজেদের যে কোন বিশেষ প্রোগ্রাম ছিল না, তা সত্যি। বিশেষত্বের মধ্যে ছিল। শুধু এক বাড়ীতে খাবারের নিমন্ত্রণ। ফলে রান্নার হাঙামা ছিল না। তাই আডড়াও আমাদের জমে উঠে ছিল বেশ গুলজার হ’বার মতই। আমাদের ঐ গুলজার আডড়ার মধ্যে। হঠাৎ এক অপরিচিত ভদ্রলোক এসে হাজির হলেন। ঠিক হাজির হলেন তা’ নয়। । দু’টো ছেলে এনে তাকে হাজির করলো। পরিচয়ে জানা গেল তিনি হচ্ছেন কলকাতার স্বনাম। ধন্য এ্যামেচার ফটোগ্রাফার শ্রী স্বরাজ ভট্টাচাৰ্য। অতি দুঃসাহসিকতার সঙ্গে পাক অধিকৃত বাংলাদেশের অভ্যন্তরে ঢুকে বহু রোমাঞ্চকর। এবং লোমহর্ষক ছবি তিনি সংগ্রহ করেছেন। যার তোলা ছবিগুলোই কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বহু সংস্থা থেকে ছাপিয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয় এবং অন্যান্য বহু স্থানে পাঠানো হয়েছে। তিনিই। এবার এসেছেন আমাদের ফ্রন্টে । কিছু ভাল ছবি তুলবার আশায় তাই আমাদের এক নতুন প্রোগ্রাম তৈরী কোরবার কাজ শুরু হলো। ধারে কাছেই বহু পোড়া বাড়ীঘরের অবশ্য অভাব ছিল না। তবুও কিছুটা ভেতরে ঢুকে কিছু চোখে লাগবার । মত ছবি তোলার প্রোগ্রাম ঠিক করা হল।

পরের দিন ১৫ই আগষ্ট। আমরা রওয়ানা হলাম ফটো তুলবার উদ্দেশ্যেই। বেশী ভেতরে ঢুকতে হলে একেবারে খালিহাতে যাওয়া যে বুদ্ধিমানের কাজ নয় তা অবশ্যই আমর। জানতাম। তাই কাছেই যে। মুক্তিফৌজের দলটি রয়েছে তাদের। খবর করা গেল। কিন্তু জানা গেল আগেই টহল দিতে তারা বেড়িয়ে গেছে। তবে কোন দিকে গেছে তার কিছুটা ইঙ্গিত পাওয়া গেল। সেদিকটাও ছিল আমাদেরই দিক। আমরা তখন ফটোগ্রাফার স্বরাজ বাবুকে নিয়ে বেড়িয়ে পড়লাম। সেদিকেই।

 মাইল খানেক যাবার আগেই দেখা হলো আমাদের পাগলা জব্বারের সংগে। সে দু’দিন আগে। আমাদের আস্তানার মাধ্যমেই ডিনামাইট এবং মাইন নিয়ে গিয়েছিল। এক বিশেষ মিশনে। জিজ্ঞেস করলাম কাজ হয়েছে? হেসে বললোঃ হয় আবার। পরে নিজেই জিজ্ঞেস করলো আমাদেরকে কিন্তু তা হ’বার নয়। জব্বার পাগলা তা মানতে রাজী নয়। সে  একলাই যে ঐ দুটো গ্রেনেড মেরে পাক বাহিনীকে খতম করতে বদ্ধ

পরিকর—সে এগোবেই। পাগলা _ তার বিশেষ মিশন সম্পন্ন করে ঐ রাস্তায় ফিরছিলো এবং পাকফৌজ  আদৌ এদিকে আসা সম্ভব কিনা সে সব খবর তার ভালই জানা। তাই ফটোগ্রাফার স্বরাজবাৰু স্থানীয়  আওয়ামী লীগ নেতা হামিদ ডাক্তার, অন্য একটি ছেলে, ঐ পাগলার সংগে যেতে সম্মত হলেন। আর আমরা ক’জন মুক্তি ফৌজের ছেলেদের খবর পাঠিয়ে তাদের জন্যই অপেক্ষা। করতে থাকলাম। * মুক্তি ফৌজের ছেলেরা খবর পেয়েই তাড়াতাড়ি চলে আসলো। তারা অবশ্য স্বরাজবাবুকে বিশ্বাস। করতে পারছিল না তেমন। তবুও তাড়াতাড়ি চলে এসেছে। যদি একটা সুযোগ পাওয়া যায় এইভাবে তবে ধারে কাছে পাক ফৌজদেরকে পাওয়া নাকি একটা ভাগ্যের ব্যাপার। আজকাল অটোমেটিক রাইফেল পাওয়ার পর মুক্তি ফৌজের ছেলে দের উৎসাহ খুব বেড়ে যায়। তারা চলছিল মাত্র এগার জন। তার মধ্যে দু’জনের হাতে মাত্র ষ্টেনগান। তবুও যদি একশো পাকফৌজ তাহাদের রেঞ্জের মধ্যে আসে তাহলে একটাকেও আর ফিরে যেতে হবে। না। এরকম নানাবিধ কথা বলাবলি হচ্ছিল। মুক্তি ফৌজের ছেলেদের সংগে এগুতে থাকলাম। স্বরাজবাবু। ইতিমধ্যে আশেপাশের বহু পোড়বাড়ীর ছবি তোলেন। তিনি

বললেন ছবিগুলো সবই ফ্লাশ ছবি। – হত যদি আরও কিছুদিন আগে। তোলা যেত। পড়বার পর দু’মাস হয়ে গেছে। তাই জৌলুষ কমে। গেছে।

রংপুর জেলার একটি সবচেয়ে বড় হাট এবং ব্যবসা কেন্দ্র “চাপারহাট” পুড়ে যাবার পর যে কেমন ভূতরে পোড়া জঙ্গলে পরিণত হয়েছে তা’ না দেখলে বোঝা কঠিন। তবে শুধু চাপারহাটই নয় শ’য়ে শ’য়ে হাট, এবং হাজার হাজার বাড়ীঘর আমাদের এক রংপুর জেলাতেই অগ্নিশুদ্ধ হয়েছে। ও ফিরে আসছিলাম যখন, তখন বেলা তিনটে। মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা আমাদেরকে খাবারের নিমন্ত্রণ দিলে। দিল অবশ্য যে। বাড়ীতে তারা নিমন্ত্রণ পেয়েছে, সে বাড়ীর পক্ষ থেকেই। আমরা যেতে। আপত্তি জানালাম। মুক্তি ফৌজেরা আনাদের আপত্তির কারণ বুঝতে শান্তনু নাহার

পেরে বল্লে, যেয়েই দেখতে পাবেন, খাবার কম পড়বে না। তাদের  কথা শুনে তাড়াতাড়ি চলতে শুরু  করলাম। পেট তখন ক্ষিধেয়  জ্বলছিল। কিন্তু দেখলাম আমাদের মুক্ত এলাকায় তাড়াতাড়ি হাটবার উপায় নেই। যার বাড়ীর সামনে – দিয়ে যাব, সেই ডাকবে, বসাবে। তারপরে অন্তত সামান্য খেয়েও, তাদের কাছ থেকে বিদায় নিতে হবে। নিমন্ত্রণ খেতে যেতে যেতেও অন্তত: দু’জায়গায় আমাদের নাস্তা করে এগুতে হলো। পরে নিমন্ত্রণ বাড়ীতে যে আহার হলো, তা অনেকটা মুক্তি যোদ্ধাদের বিজয় উৎসবেরই মত। ঐ আহারে রসালো বস্তু সমূহের অভাব থাকলেও আথিতেয়তার উৎসাহে এবং অমায়িকতায় তা পুরন করে দেন গৃহস্বামী। ভোজনের পর আবারও আমরা এক  চক্কর ঘুরে আসলাম। নানাবিধ ফটো তুলে আস্তানায় ফিরে আসলাম। উ পরেরদিন আবার বের হবার প্রোগ্রাম করা ছিল। কিন্তু মুষলধারে। বৃষ্টির দরুন তা হল না। বিরামহীন আডডা জমিয়েই সেদিনটার সৎ-গতি করা হলো। দেখা গেল স্বরাজবাবু দুঃসাহসিক ফটোগ্রাফারই নন। ভাল গল্প বলার লোক ও বটেন। তবে সেদিন আমরা একটা খবর পেয়েছিলাম পাক সৈন্যরা নাকি বুকশিলানদীর ওপারে মাইল সতের দুরে এসে হাজির হয়েছে। মুক্তি ফৌজের  ছেলেরাও খবরটা পেয়ে এগিয়ে।গেছে। তবে সেদিনের খবর ওইটুকুনই মাত্র।পরেরদিন সকালে খবর পাওয়া গেল, বুকশিলাতে মুক্তিবাহিনীর ছেলেরা অপারেশন করেছে, এবং সফলতা লাভ করেই ফিরে এসেছে। পাক বাহিনীর ক’জন যে হতাহত হয়েছে তা কেউ বলতে পারলো না। সেদিনও খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। তাই বেশী কিছু জানা আর সম্ভব হল না। – দুপুরে আমরা রান্নার কাজে ব্যস্ত * ছিলাম। তখন জলে ভেজা কাদামাটি মাখা গায়ে, দু’টি মুক্তিফৌজের ছেলে এসে হাজির। দেখেই কিন্তু খারাপ ব্যাপার বলে মনে হলো। – ছেলে দু’টি আমাদের চেনা। ওর। বললো কাল থেকে খাওয়া হয়নি। আগে খাবার। তারপর কথা। খাবার খেতে খেতে বললে, লড়াইতে আমরা হারিনি। বরং দু’টোতেই  জিতেছি। লড়াই এ জিততে হলে একটু কাদামাটি মাখতেই হয়। তবে এখনও এক জনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। তাই আমরা একটু – চিন্তিত আছি। তবে সে যে মারাও পড়েনি, ধরাও পড়েনি, সে বিষয়ে * নিশ্চিন্তিত। আপনাদেরকে খবরটা জানাতেই এসেছি  অন্যেরা সব অন্য আর এক আস্তানায় তৈরী ভাত দেখেই বসে পড়েছে। পরে ওদের কাছে ডিটেল যা। শোনা গেল, তা হচ্ছে ওরা গতকাল বিশ্বস্তসূত্রে খবর পেয়ে বুকশিলানদীর পুল পর্যন্ত এগিয়ে যায়। নদীর ওপারে পুল ছারবার পরেই দেখতে পেল যেখানে কালীগঞ্জের রাস্তাটি বেরিয়ে গেছে, সেখানে রাস্তার উপর। সোজা হয়ে দাড়িয়ে ১৫/১৬ জন। স্থানীয় লোকদের দ্বারা পাক সৈন্যরা গর্ত খুড়িয়ে বাঙ্কার তৈরী করাচ্ছে। সম্ভবত: বৃষ্টির কারণেই তারা খুব সতর্ক ছিল না। এবং সেই কারণেই এরা ( মুক্তি ফৌজেরা ) আরও এগিয়ে যাবার সুযোগ পেয়েছিলে।। এগুতে এগুতে যখন ২০০/২৫০ গজের মধ্যে গিয়ে পড়েছে, তখন অর্ডার হল ‘ফায়ার’। এক পশলা বৃষ্টির মতই গুলিবৃষ্টি হয়ে গেল পাক সেনাদের উপর। ক’জন যে হতাহত হল, তা বোঝা গেল না। কারণ নিমিষেই পুরোদলটি রাস্তার দক্ষিনের নীচুতে ঘা ঢাকা দিল। এবং সম্ভবতঃ পজিশন নিয়ে গুলির প্রত্যুত্তর দেবার জন্য তৈরী হয়েছিল। যদিও গুলির উত্তরে গুলি চালাবার সাহস শেষ পর্যন্ত তারা আর দেখায়নি। পরে যখন আবার তাদেরকে দেখা গেল তখন তারা অনেক দুরে চলে। গেছে ঐ রাস্তাটিকে আড়াল হিসেবে  ব্যবহার করেই । ক’জনকে কাধে চড়ে নিয়ে যেতেও দেখা গেল।

মুক্তি বাহিনীর ছেলের সামনের দিকে আর না এগিয়ে, দল গ্রামের দিকে ফিরে আসে। কিন্তু আবার তারা দেখতে পায় একটি বড় আম গাছের উপরে একটি ছোট ঘর তৈরী করে এক অবজার্ভেসন পোষ্ট খাড়া করা হয়েছে। গাছের উপরের  ঘরটিতে কোন লোক আছে কিনা তা _ অবশ্য কিছুই দেখা যাচ্ছিল না। তবুও ছেলেরা ঐ পোষ্টকে লক্ষ্য করে কয়েক রাউন্ড গুলি ড়ে। এবং গাছের সঙ্গে বাধা মইটি দিয়ে উঠে গিয়ে ঘরটিকে ভেঙ্গে ফেলে দেয়। এইভাবে কর্ম সমাধা করতে করতে তারা “দলগ্রাম” ছাড়িয়ে পূর্বের * দিকে চাপারহাট রাস্তা দিয়ে চাপার

হাট খোলাতে গিয়ে পৌঁছায়। এই – চাপার হাটেই আগেরদিন আমরা  ফটো তুলতে গিয়েছিলাম। চাপার হাটে যখন তারা পেীছোয়, তখন  বেলা গড়িয়ে বিকেল হয়ে গেছে।  বৃষ্টি তখনও চলছেই। এবং সকাল থেকে তাদের খাওয়াও হয়নি। কিন্তু চাপারহাট তো আজ আর হাট নয়। এক পরিত্যক্ত পোড়াে জায়গা। ঐ হাটের একমাত্র অক্ষত গুদাম ঘরটিতে তারা আশ্রয় নিয়ে কিছু খাবার সংগ্রহ করা যায় কিনা তারই চেষ্টা করতে লাগলো। মুক্তি যোদ্ধাদের যে সাহায্য এবং সহানুভূতির অভাব হয়। না কোনদিন তার প্রমাণ পেতেও _ দেরী হলো না। খবর পেয়ে পাশের  গ্রামের কয়েকজন চাল ভাজা, তেল,নুন, লঙ্কা নিয়ে এসে হাজির হয়। ঐ খারার গুলোন মুক্তি যোদ্ধাদের প্রিয় খাদ্য। সংগে সংগে মুক্তি যোদ্ধারা তাদের প্রিয় খাবারের সদ্ব্যবহারে লেগে যায়। বাইরে দু’জন পাহারায় ছিল। কিন্তু হাটটির চারিদিকে এত জঙ্গল যে বাইরে থেকে কেউ আসছে কিনা তা বুঝবার কোন উপায়ই ছিল না। এক মুক্তিযোদ্ধারা সেজন্য যথাযথ ব্যবস্থাও গ্রহণ করেনি। আর সেটাই হয় তাদের মারাত্মক ভুল। মুক্তিযোদ্ধারা তাদের খাবার খাওয়া শেষ করতেও পারেনি। – ঐ চাল ভাজা খেতে খেতেই বারান্দার দু’জন দেখতে পেল উত্তর দিকে তাদের সম্মুখে মাত্র পঞ্চাশ গজের মধ্যে ১৪/১৫ জন পাক রেগুলার আর্মির লোক এসে পড়েছে। কপালক্রমে তারা মুক্তি যোদ্ধাদের। আগে দেখেনি। মুক্তি যোদ্ধারাই তাদেরকে আগে দেখে। এবং গুদামের ভেতরে গিয়ে ঢুকে পড়ে। কিন্তু হানাদারদের মেশিনগান গুলি গর্জে উঠতে দেরী করে না। গুলি বৃষ্টি করে দেয় তারা। কিন্তু সৌভাগ্য – ক্রমে মুক্তি যোদ্ধারা পেছনের দিক দিয়ে পালিয়ে পেছনের জঙ্গলে ঢুকে পড়ে। এবং সেখান থেকেই পজিশন নিয়ে গুলি এবং তাদের একমাত্র দুই= ইঞ্চি মর্টারটি থেকে গোলাবর্ষন শুরু – করে। মুক্তি ফৌজদের দিক থেকে – পাল্টা গুলিবর্ষনে বীরপুরুষ হানাদার বাহিনীরা পালিয়ে ছত্রভঙ্গ হয়ে পড়ে। পরে জানা যায় সেদিন হানাদার বাহিনীতে ১০০ জন পাক রেগুলার আর্মি ছিল। তারা – পালিয়ে যাবার সময় কয়েকজনকে কাধে চড়িয়েও নিয়ে যেতে বাধ্য হয়।তবে মুক্তি বাহিনীর ছেলেরা অবশ্য সন্ধ্যার অন্ধকার না হওয়া পর্যন্ত যে যার জায়গায় ছিটকে পজিশন নিয়েছিল সেখান থেকে বের হতে পারেনি। তারপর অন্ধকারে যে তারা কোন দিকে এগুতে থাকে তারা নিজেরাই তা’ বুঝতে পারেনি। পরেরদিন সকালে , এক দুই করে তারা নিজেদের আস্তানার দিকে ফিরে এসে মিলিত হয়। কিন্তু তবুও একজনের খোঁজ পাওয়া যায়নি।তারপর সন্ধ্যের সময় একখানা চিঠি পেলাম। তাতে জালাম সেই এগার “নম্বরও” এসে পৌছিয়েছে। ছেলেদের নিমন্ত্রন করা হলে পরেরদিন আমরা সবাই মিলে খাব বলে ৬ যখন ওরা এলো, ‘ওদের হল্লা। দেখেই বুঝতে পারলাম আরও কিছু হয়েছে। হানাদার বাহিনী এক বাক্স-গুলি-ফেলে গেছে। মুক্তিযোদ্ধারা সেগুলোনও নিয়ে এসেছে। ব্যাপারটা অনেক কিছু না ঠিক।তবে বেশ কিছু এবং সেটাই ছেলেদের আনন্দের কারণ।

বই ও পত্রিকা

পরিচয় বাংলাদেশ সংখ্যা সম্পাদক, দীপেন্দ্রনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় তরুণ ন্যাল, ৮৯, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলিকাতা(পশ্চিম বঙ্গ)

ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের কলকাতা থেকে প্রকাশিত ঐতিহ্যবাহী মাসিক পরিচয়’ পত্রিকার বাংলাদেশ। সংখ্যারূপে প্রকাশিত দুটি সংখ্যা। মুজিব নগরে আমাদের হাতে এসে। পৌচেছে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে অকুণ্ঠ সমর্থন ও সাহায্যদানের জন্য আমরা ভারতের সরকার ও জনগণ—বিশেষ করে পশ্চিমবঙ্গের জনগণ ও বুদ্ধিজীবিদের কাছে বিশেষ ভাবে কৃতজ্ঞ ও ঋনী। কলকাতার প্রতিটি পত্র পত্রিকা বাংলাদেশ সমস্যাটিকে যেভাবে নিজদেশের ও বিদেশের জনগণের কাছে স্পষ্টভাবে তুলে ধরেছেন, তাতে বাংলাদেশের সংগ্রামী বুদ্ধিজীবিরা, এমনকি ফ্রন্টের মুক্তি সেনানীরা যথেষ্ট উৎসাহ ও অনুপ্রেরণা লাভ করেছেন। গত তিন চার মাসে কলকাতার বহু পত্রপত্রিকার বাংলাদেশ সংখ্যা আমাদের হাতে এসে পৌচেছে। “পরিচয়ের বাংলাদেশ সংখ্যাটি, হাতে পেয়ে আমরা আনন্দিত হয়েছি এ জন্যে যে,শুধু বক্তব্য বিষয় উপস্থাপনার দিক থেকে নয়, রাজনৈতিক দৃষ্টিকোন থেকে বাস্তব বিচার বিশ্লেষণেও পরিচয়ের প্রবন্ধগুলো যথেষ্ট তাৎপর্যপূর্ণ। ‘পরিচয়ের নাম বাংলাদেশের পাঠকদের কাছে অপরিচিত নয়। পরিচয়ের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গের খ্যাতনামা বুদ্ধিজীবিদের সম্পর্ক যেমন বহুদিনের তেমনি বাংলাদেশের পাঠকদেরও যোগাযোগ দীর্ঘকালের। মাঝখানে কিছুকাল পাকিস্তানী শাসকদের চক্রান্তে পশ্চিমবঙ্গের সঙ্গে বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় পরিচয় সহ অন্যান্য পত্র পত্রিকার সঙ্গে বাংলাদেশের পাঠকের সম্পর্ক প্রায় রহিত হয়েছিল। পাঞ্জাবী ঔপনিবেশিক শাসন ছিন্ন করে বাংলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করার পর এই সম্পর্ক আবার পুনঃ প্রতিষ্ঠিত হতে চলেছে, এটা দু’দেশের বাংলাভাষাভাষী জনগণের জন্যই একটা মস্তবড় লাভ তাতে সন্দেহ নেই। আমরা দেখে খুশি হলাম, দীর্ঘ ৩৯ বছরের নানা উত্থান পতনের মধ্যেও ‘পরিচয়’ তার পূর্বমান ও সৌষ্ঠব বজায় রেখেছে—এই প্রমোদ পত্রিকার হিড়িকের যুগে যা বজায় রাখা সত্যই দুষ্কর।

 পাতা-৮

মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণে সিলেটে ২টী শত্রু সৈন্যবাহী

লঞ্চ নিমজ্জিত শত খান সেনা নিহত

আমাদের যোদ্ধারা গত সপ্তাহে সবচেয়ে বেশী সাফল্য অর্জন করেন। সুনামগঞ্জ অঞ্চলে। ছাতক ও সুনামগঞ্জের মধ্যবর্তী একটি এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা শত্রু সৈন্যবাহী ৪ টি লঞ্চের একটি কনভয়ের উপর প্রচণ্ড চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ২টি লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছেন। এই আক্রমণে কমপক্ষে ৪ শত পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়েছে। এছাড়া কয়েকদিন  আগে তারা ছাতকের উত্তর দিকে শত্রু অবস্থানের উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালান। এই আক্রমণে শত্রুপক্ষের  হতাহতের সংখ্যা নির্ণয় না করা  গেলেও রেড ক্রসের গাড়ীতে করে খান সেনাদের লাশ সরাতে দেখা যায়।নীলপুর গ্রামের নিকটে মুক্তি সেনাদের পোতা মাইনে অন্ত্রশস্ত্র বোঝাই একটি পাক সামরিক যান বিধ্বস্ত হয়। জলিলপুরে মুক্তি বাহিনী ও পাক ফৌজের সাথে গোলণ্ডলী বিনিময়ের ফলে ৬ জন খান সেনা নিহত ও আরও ৭ জন আহত হয়।

খুলনায় দুই জন পাকসেনা এ খতম

গত ১৩ই সেপ্টেম্বর খুলনা জেলার – হরিনগরে গেরিলা বোদ্ধারা একটি পাকিস্তানী গানবোটের ওপর হাত  বোমা নিক্ষেপ করে ২ জন পাক সৈন্যকে হত্যা করেছেন। গানবোটটি পানিতে ডুবে যায়। 

বানরীপাড়ায় ২৮জন পাক সৈন্য নিহত

বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ,বরিশাল জেলার বানরীপাড়া থানায়।এক সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী গত ৯ই সেপ্টেম্বর ২৮ জন পাক সৈন্য ও রাজাকারকে হত্যা করেছেন।প্রকাশ বাংলাদেশের গেরিলা যোদ্ধারা থানা সংলগ্ন একটি পুকুর সঁাতার কেটে পার হয়ে বোমা ও – আগ্নেয়াস্ত্রসহ শত্রু সৈন্যদের আক্রমণ। করেন এবং ট্রেঞ্চ ও প্রাচীর ধবংস করে।  তাদের হত্যা করেন।

দিনাজপুরে ৪২ জন শত্রু সৈন্য ও রাজাকার

খতম গত ১৫ই সেপ্টেম্বর রাত্রে দিনাজপুরের বুড়ীমারী গ্রামে মুক্তিযোদ্ধারা  একজন ক্যাপ্টেনসহ ১৩ জন হানাদার সেনাকে খতম করেছেন। ঐ রাত্রেই মুক্তি যোদ্ধারা আরেকটি সফল আক্রমণ। চালিয়ে হেমকুমারীতে ৯ জন রাজাকারকে হত্যা করেন।গত ১৭ই সেপ্টেম্বর জলপাইগুড়ি জেলার চাউলহাটি সীমান্তের নিকটে, দিনাজপুরের পচাগড়, দেবীগঞ্জ ও  ঠাকুরগাঁও খণ্ডে মুক্তি বাহিনীর সঙ্গে পাক-ফৌজের প্রণ্ড সংঘর্ষ হয়। কিছুদিন আগে অত্র এলাকায় মুক্তি বাহিনী কমপক্ষে ২০ জন পাক সৈন্যকে খতম করেন।স্বাধীনতাকামীরা পার্বতীপুর ও শান্তাহারের মধ্যে টেলিফোন যোগাযোগ নষ্ট করে দিয়েছেন।

রংপুরে ১২ জন খতম

গত ১১ই সেপ্টেম্বর রংপুরের ডিমলা এলাকায় গেরিলা যোদ্ধারা। মাইন দিয়ে একটি ট্রাক উড়িয়ে দেন, ফলে ১২ জন হাদাদার সৈন্য নিশ্চিহ্ন হয়। গেরিলা যোদ্ধারা আলিনগর এলাকায় কয়েকজন তাবেদারের বাড়ী। আক্রমণ করে বহু অস্ত্র উদ্ধার করেছেন।মুক্তি যোদ্ধার চিলমারীতে একটি পাক টহলদার দলের ওপর হামলা করলে কয়েকজন দত্ম্য সৈন্য হতাহত হয়।গেরিলা যোদ্ধারা ১৩ই ও ১৪ই সেপ্টেম্বর রাণী সান্ধাইল ও ভূরুঙ্গামারী অঞ্চলে কয়েকজন সামরিক ও তাবেদার অসামরিক সশস্ত্র লোককে হতাহত করেন।

রাজশাহীতে ৮০ জন খানসেনা হতাহত

 স্বাধীনতাকামীরা গত ১৭ই সেপ্টেস্বর ভোরে রাজশাহী ও নাটোরের মধ্যে দুটি বড় মাইন চার্জ করে একটি মালবাহী ট্রেনের ১২টি ওয়াগন লাইনচ্যুত করে। ফলে প্রায় ৫০ জন পাকি* স্তানী সৈন্য নিহত ও আরও ৩০ জনআহত হয়।

চট্টগ্রামে টাগবোট ক্ষতিগ্রস্ত

চট্টগ্রামে গেরিলা যোদ্ধারা ১১ই  সেপ্টেম্বর শত্রু বাহিনীর একটি টাগ বোট আক্রমণ করেন। তাঁরা বোটের। পাইলটকে অপহরণ করে নিয়ে যান। বোটটি ভীষণভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

নোয়াখালীতে ৮৪ জন শত্রু সৈন্য নিহত

গত ১৩ই সেপ্টেম্বর আমাদের  দুঃসাহসিক যোদ্ধারা নোয়াখালীর একটি এলাকায় শক্ত অবস্থানের ওপর এক অতর্কিন অভিযান চালিয়ে কমপক্ষে ১১ জনকে খতম ও ১৬ জনকে গুরুতররূপে আহত করেছেন। সম্প্রতি ফেণীতে ৬ ঘণ্টাব্যাপী সংঘর্ষে একজন মেজর সমেত ৫৮ জন (পাক সেনা মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে খতম হয়েছে।  সেক্টরে ৭২ জনপাক সেনা নিহত

 গত ১৩ই ও ১৪ই সেপ্টেম্বর কুমিল্লার বিভিন্ন এলাকায় মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা সফল আক্রমণ চালিয়ে ৬০ জন পাক সৈন্য নিহত ও ২৪ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন। কুমিল্লার সালদার, কায়েমপুর, লক্ষীপুর, মীজানগর, রঘুরামপুর ও জগন্নাথ দীঘিতে শত্রু সেনার উপরোক্ত ক্ষয়ক্ষতি হয়। গত ১২ই সেপ্টেম্বর আখাউড়ার।  উত্তর-পূর্বে মুকুন্দপুরে মুক্তিবাহিনী – শত্রু সেনাবাহী একটি ট্রেন আক্রমণ করে কিধ্বস্ত করে দিয়েছেন। এতে ট্রেনের যাত্রী, একজন পাকিস্তানী _ সামরিক অফিসার, ইঞ্জিন ড্রাইভার  ও এক ডজনেরও বেশী রাজাকার  নিহত হয়েছে চলতি মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহের গোড়ার দিকে মুক্তি বাহিনীর সাথে হানাদার সেনাদের কয়েকটি বিচ্ছিন্ন সংঘর্ষে রাজাকারসহ প্রায় দু’শ পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়েছে।

মুক্তিযোদ্ধরা কুমিল্লা অঞ্চলে শত্রুপক্ষের ৫টি গুরুত্বপুর্ণ বাঙ্কার উড়িয়ে দেন এবং প্রচুর পরিমাণ অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাগুলী উদ্ধার করেন। মুক্তিবাহিনী গ্রামাঞ্চলে সৈন্য বাহিনীর সরবরাহ লাইনটি সাফল্যের সঙ্গেই বানচাল করে দিয়েছেন।

 

জল্লাদের প্রেম!

তথাকথিত পাকিস্তান সরকার সিলেটের জনৈক মাহমুদ আলীর নিতৃত্বে এবার জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যে প্রতিনিধি। দলটি পাঠিয়েছে তাতে মোট ১০ জন সদস্য রয়েছে। এর মধ্যে ৭ জনই ‘বাঙ্গালী”। অতীতে যেখানে এসব প্রতিনিধিদলে প্রায় ক্ষেত্রেই কোন বাঙ্গালী স্থান পেতনা সেক্ষেত্রে এবার শতকরা ৭০ ভাগ বাঙ্গালীদের জন্য ছেড়ে দেওয়ায় কেউ হয়ত ভাবতে পারেন যে বাঙ্গালী-প্রেমে ইয়াহিয়ার দিল একেবারে গলে গেছে। আসলে কিন্তু তা নয়। মুক্তিকামী বাঙ্গালীদের বিভ্রান্ত করার এটা আরেকটা চাল মাত্র।এবার দেখা যাক এরা কারা? ১। মাহমুদ আলী ওরফে চো। / পাজামা-গত নির্বাচনে শোচনীয়ভাবে পরাজিত ও জামানত বাজেয়াপ্ত। ২। শাহ আজিজুর রহমান—ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের সময় মুসলিম লীগের যুগ্ম সম্পাদক। আজীবন দালাল ও ডিগবাজী বিশারদ। গত নির্বাচনে জামানত বাজেয়াপ্ত।  জুলমাত আলী খান ময়মনসিংহের এক অখ্যাত উকিল, পুলিসের টাউট, পাড়-মাতাল। গত  নির্বাচনে জামানতবাজেয়াপ্ত। ৪ । বেগম এনায়েত উল্লাহ-পেশা ও স্বামীর নাম জানা যায়নি। ৫। এ, টি, সাদী- মাঝে মাঝে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটে। কিছুকাল আগেও উলঙ্গ অবস্থায় রাস্তায় বের হয়ে পড়ত। তাই আত্মীয়-স্বজন ও বন্ধুরা তাকে ঘরে শিকল দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। সেই মধু লোকটি এক সদস্য বিশিষ্ট একটি সংস্থা গঠন করে এবং আজও তার প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। মাথা। এখনও বিকল এবং সেই অবস্থায় ডাঃ মালিকের কারখানায় স্থানান্তরিত। ডঃ ফাতিমা সাদিক-জনৈক উদুভাষী সাদিকের দ্বিতীয় পত্নী। রাজিয়া ফয়েজ নাম দেখে মনে হয় ফয়েজ নামক কোন লোকের স্ত্রী। তবে তিনি কে তা জানা যায়নি।প্রতিনিধি দলের পশ্চিম পাকিস্তানী সদস্যগণ হলেন : ১। জাকিউদ্দিন খান-লাহোরের এক উকিল। তিনি যখন যেমন তখন তেমন নীতিতে বিশ্বাসী। ডঃ কামাল ফারুকী-তিনি কিসের ডাক্তার তা জানা যায়নি। যাকন বাবর – কুখ্যাত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার অন্যতম। স্থপতি ও সরকার পক্ষের অন্যতম কেঁৗশলী। বাঙ্গালীর রুদ্ররোষে পড়ে কিভাবে যে পালিয়ে ছিল তা আজো অজ্ঞাত।এছাড়া প্রতিনিধিদলে কয়েকজন – সরকারী কর্মচারীও রয়েছে। কিন্তু তাদের মধ্যে একজনও বঙ্গবাসী বা বঙ্গ সন্তান নাই।

পাতা

তিনটি পূর্ব শর্ত পূরণ না হলে একটি শরণার্থীও দেশে যাবে নাজাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে সেক্রেটারী জেনারেলের রিপোর্ট

জাতিসংঘ, ১৯শে সেপ্টেম্বর ঃ‘সমঝোতা এবং মানসিকতার প্রতি শ্রদ্ধাবোধের ভিত্তিতে একটি রাজনৈতিক সমাধান অর্জিত হলেই কেবল বাংলাদেশের মূল সমস্যার সমাধান হতে পারে।জাতিসংঘের কার্যাবলী সম্পর্কে সেক্রেটারী জেনারেলের নোটের ভূমিকায় উ থান্ট আজ একথা বলছেন।উ থান্ট তার রিপোর্টে বলেন : ‘একটি রাজনৈতিক সমঝোতার। অভাবে উক্ত অঞ্চলের আইন শৃঙ্খলা ও প্রশাসন ব্যবস্থার উপর যে প্রতিক্রিয়া পড়েছে তাতে পূর্ব পাকিস্তানে আন্তর্জাতিক ও সরকারী সাহায্য প্রচেষ্টা ভারত হচ্ছে—এটাই সমস্যার মূল কথা।’বর্তমানে বিশ্ব যে সব সমস্যার সম্মুখীন উ থান্ট পূর্ব বাংলার সমস্যাকে তার অন্যতম বলে অভিহিত করেন।তিনি বলেন, শরণার্থীদের ফিরে যাওয়ার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান যে আবেদন জানিয়েছিলেন। শরণার্থীরা তাতে আদৌ সাড়া দেয়নি। তিনি বলেন, “অনুরূপ একটা বিরাট আকারের বিপর্যয়ে সংশ্লিষ্ট সরকার ও জাতিকে সর্বপ্রকারে সাহায্যের ব্যাপারে আন্তর্জাতিক কমুনিটির একটা সুস্পষ্ট দায়িত্ব রয়েছে।’উ থান্টের মতে পূর্ব বাংলায় তীব্র খাদ্য সঙ্কট এমনকি দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা রয়েছে। ইত্যবসরে বিরাট আকারের রিলিফ ব্যবস্থা চালুর মত পরিস্থিতি সৃষ্টি করতে না পারলে জনগণের দুঃখ দুর্দশা অচিরেই গুরুতর রকমে বৃদ্ধি পাবে বলে তিনি জানান।সেক্রেটারী জেনারেল বলেন : ‘সমঝোতা’ উন্নত রাজনৈতিক পরিবেশ এবং রিলিফ প্রচেষ্টার

বিচ্ছিন্নতার নয়, স্বাধীনতার লড়াই

[ত্রিবান্দ্রম প্রতিনিধি ]

 ত্রিবান্দ্রম : রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাঙলাভাষার বিভাগীয় প্রধান ডঃ ময়হারুল ইসলাম বলেন। যে, বাংলাদেশের জনগণের এ সংগ্রাম বিচ্ছিন্নতার জন্য নয়—পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনের জন্য আমরা এ জীবন মরণ সংগ্রামে অবতীর্ণ) হয়েছি। : ভারত সফররত ডঃ ইসলাম ত্রিবান্দ্রমে শহর কর্পোরেশন আয়োজিত এক সম্বর্ধনা সভায় বলেন : “আমাদের এটা বিচ্ছিন্নতার সংগ্রাম। নয়। পাকিস্তানের সামগ্রীক জনসংখ্যার শতকরা ৬০ ভাগ হচ্ছি। আমরা। সংখ্যালঘুর কাছ থেকে সংখ্যাগুরু কিভাবে বিচ্ছিন্ন হতে চায় ?”ডঃ ইসলাম বলেন, “বাংলাদেশের জনগণের নিজস্ব স্বকীয়তা, রয়েছে, রয়েছে স্বতন্ত্র জীবন ধারা। তাদের সাহিত্য, সংস্কৃতি, ঐতিহ্য ও জীবন ধারা আমাদের থেকে সম্পূর্ণ ভিন্ন।তিনি বলেন, “পাকিস্তানের কাঠামোর মধ্যে কোন আপোষ হতে পারে না। পশ্চিম পাকিস্তানী হারমাদ দস্যুদের শৃঙ্খল থেকে বাংলাদেশের  অধিকৃত এলাকা মুক্ত করার ব্যাপারে আমরা দৃঢ় প্রত্যয়শীল। আমরা যুদ্ধ করে চলেছি এবং বিজয় না হওয়া। পর্যন্ত আমরা থামতে পারি না।

বাংলাদেশের প্রতি বিশ্ব মানবের স্বীকৃতি

                          ( বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত )

নয়া দিল্লী : বাংলাদেশকে পৃথিবীর কোন রাষ্ট্র এখনও সরকারী ভাবে স্বীকৃতি দেয়নি। কিন্তু নয়া দিল্লীতে বিশ্বের ছয়টি মহাদেশের ২৫ টি রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বাংলাদেশকে – বিশ্বমানবের স্বীকৃতি দানের ব্যবস্থা – নিয়েছেন। বাংলাদেশ প্রশ্নে এখানে আয়োজিত আন্তর্জাতিক সম্মেলনের প্রতিনিধিরা স্বাধীন বাংলাদেশকে ‘মানব জাতির স্বীকৃতি দানের পদক্ষেপ হিসেবে সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে প্রবেশের সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছেন।

সিঙ্গাপুর বাংলাদেশের প্রতি সহানুভূতি জানিয়েছে

সিঙ্গাপুরের প্রধান মন্ত্রী মিঃ লি কুয়ান ইয়ু বাংলাদেশ সমস্যার মানবিক এবং রাজনৈতিক প্রশ্নে বাংলাদেশের জনগণের প্রতি সহানু ভূতি প্রকাশ করেছেন।

ভারতের রাষ্ট্রপতি মিঃ ভি, ভি, গিরি এক রাস্ট্রীয় সফরে সিঙ্গাপুর গমন করেন এবং সিঙ্গাপুরের প্রধান মন্ত্রীর সাথে বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন।

রাষ্ট্রপতি গিরি সিঙ্গাপুরে বলেছেন যে, ভারত বিশ্বের নাগরিকদের পক্ষে বাংলাদেশের শরণার্থীদের অস্থায়ীভাবে তাদের দেশে আশ্রয় দিয়েছেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান হলেই শরণার্থীরা তাদের দেশে ফিরে যাবে।

মুজিবকে মুক্তি দাও

নয়া দিল্লী : কায়রোর আধাসরকারী সংবাদপত্র ‘আল-আহরাম’এর সিনিয়র সম্পাদক জনাব ক্লোভিস মাকসুদ এখানে বলেছেন, বাংলাদেশ  সমস্যার যে কোনরূপ সমাধানের জন্য = সর্বাধিক প্রয়োজনীয় হচ্ছে বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের আশু মুক্তি।

তিনি বলেছেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার যে কোনরূপ রাজনৈতিক সমাধানের প্রচেষ্টা চালানোর আগে পূর্বসৰ্ত্ত হিসেবে শেখ সাহেবকে অবস্যই মুক্তির ব্যবস্থা বিশ্বকে করতে হবে।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকেও হিন্দুদের বিতাড়ন করা হচ্ছে

বাংলাদেশে ধর্ম, বর্ণ, গোত্র নির্বিশেষে বাঙ্গালী হত্যাভিযান চালানোর পর ইয়াহিয়ার নরঘাতক বাহিনী (পশ্চিম) পাকিস্তানে যে  অল্প কিছু সংখ্যক হিন্দু রয়েছে তাদের গোপনে হত্যা এবং দেশত্যাগে বাধ্য করছে। ইয়াহিয়ার মাতাল প্রশাসন যন্ত্র পাকিস্তানে ধর্মান্ধ মোল্লা জাতীয় মুসলমান ছাড়া আর কাউকে যে। বাঁচার সুযোগ দেবে না তাদের সাম্প্রতিক কার্যক্রম সে প্রমাণ বহন করছে।শিয়ালকোট জেলা থেকে আরও পাঁচটি হিন্দু পরিবারকে সর্বস্ব কেড়ে নিয়ে ভারতে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এ পাঁচটি পরিবারের সদস্য সংখ্যা ৭৫ জন।র সিন্দু, বান্ন, এবং সোয়াত থেকে গত এক মাসে আরও ৬০টি হিন্দু পরিবারকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। তারা সকলেই পূর্ব পাঞ্জাবের মগা সীমান্ত পোষ্ট দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। সংসর চন্দ নামক একজন শরণার্থী বলেছেন, হিন্দুদের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাস করা অসম্ভব।শিয়ালকোটে প্রায় দু’হাজার  হিন্দু বসবাস করতো। এদের অধিকাংশই ক্ষেত মজুর। সংসর চন্দ বলেন যে, দু’ চার মাসের মধ্যে তারা প্রত্যেকটি হিন্দুকেই খেদিয়ে দেবে। এ সংসর চন্দ বলেন, বাংলাদেশ সঙ্কট সৃষ্টির পর থেকেই সামরিক কর্তৃপক্ষ হিন্দুদের নানা অজুহাতে গ্রেফতার এবং হয়রানী করতে শুরু করে।

নেপালের জনগণ বাংলাদেশের পক্ষে

মালেক উকিল

নেপালে পক্ষকালব্যাপী কুটনৈতিক সফর সমাপ্ত করে বাংলাদেশের একটি প্রতিনিধিদল মুজিব নগরে ফিরে এসেছেন। পার্লামেন্ট সদস্য জনাব আবদুল মালেক উকিল, শ্রী সুবোধকুমার মিত্র এবং জনাব আবদুল মোমেন তালুকদার প্রতিনিধিদলের সদস্য ছিলেন। প্রতিনিধিদলের নেতা জনাব আবদুল মালেক উকিল মুজিব নগরে এক সাক্ষাৎকারে এ সফরকে ‘অত্যন্ত তাৎপৰ্যপূর্ণ বলে আখ্যায়িত করেন। জনাব মালেক উকিল বলেন, বাংলাদেশ প্রতিনিধিদল নেপালের মন্ত্রী, সাংবাদিক, ছাত্র নেতা এবং বিশিষ্ট ব্যক্তিদের সাথে সাক্ষাৎ করে বাংলাদেশ প্রশ্ন এবং বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামসম্পর্কে বিষদ আলোচনা করেন। তিনি বলেন, জাতি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে নেপালের সর্বস্তরের মানুষ বাংলাদেশের জনগণের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সার্বিক সহানুভূতি ও সহযোগিতা প্রকাশ করেন। প্রতিনিধিদল এছাড়া নেপাল প্রেস ক্লাব সদস্যদের মধ্যে বাংলাদেশের পতাকা এবং জনগণের ওপর সেনা বাহিনীর নির্যাতনও পরবর্তী পর্যায়ে মুক্তি বাহিনীর কার্যক্রম সম্বলিত বাংলাদেশ সরকারের পুস্তক প্রদান করেন।

স্বাধীনতাই সমাধান

[ কলকাতা প্রতিনিধি ]

কলকাতা : আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জম হোসেন বলেছেন : বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে। হানাদার পাকিস্তানী বাহিনীর সম্পূর্ণ অপসারণের মধ্যেই বাংলাদেশ সমস্যার সমাধান নিহিত রয়েছে।

“ফ্যাসিষ্ট সামরিক একনায়কত্বের। বিরুদ্ধে সঙ্ঘবদ্ধ হও” শীর্ষক সর্বভারতীয় শিক্ষক ও ছাত্রদের কনভেশনে আওয়ামী লীগ নেতা বক্তৃতা করছিলেন। এই কনভেনশনে যোগদানের জন্য আওয়ামী লীগ নেতা শাহ মোয়াজ্জম হোসেন ছাড়াও মোজাফফর ন্যাপ নেতা সৈয়দ আলতাফ হোসেন এবং বেগম মতিয়া চৌধুরী মুজিবনগর থেকে কলকাতা আগমন করেন।

. ইয়াহিয়া ও তার কসাই জান্তাকে শাহ মোয়াজ্জম “নিকৃষ্ট ধরণের পশু হিসেবে অভিহিত করে বলেন, পরিতাপের বিষয় যে মানব সভ্যতার এই ঘৃণ্যতম পশুদের বিরুদ্ধে এখন পর্যন্তও বিশ্ব-বিবেক যথার্থভাবে জাগ্রত হয়নি, সভ্য মানুষ ঘৃণা আর ধিক্কারে ফেটে পড়েনি।

গোলামের গোলাম

জল্লাদ ইয়াহিয়ার তীবাহক গভর্ণর ডাঃ আবদুল মোত্তালিব মল্লিক ওরফে (মালিক) তার নিজের তল্পীবহনের জন্য ৯টি রত্নকে খুঁজে বের করেছে। প্রাথমিক তালিকায় এদের। সংখ্যা দশ বলে জানান হলেও শেষ পর্যন্ত একজনকে খুঁজে পাওয়া। যায়নি। – বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায়। প্রতিনিধিত্বশীল বে-সামরিক সরকার। চালুর নামে এই রত্নদের খুঁজে বের করা হলেও আসলে এদের একজনেরও প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্র নেই এবং কোনদিন ছিলও না নিয়ে তাদের প্রতিনিধিত্বশীল চরিত্রের পরিচয় দেওয়া গেল

 ১। আবুল কাসেম ওরফে মাইন কারচরের আবুল কাসেম। পাকিস্তানে বিশ বছরের জন্য সমস্ত বিরোধীদল নিষিদ্ধ করার প্রস্তাবের জন্য কুখ্যাতি অর্জন করে। ১৯৫৪ সাল থেকে জনগণের ভোটে কোন দিন। নির্বাচিত হতে পারেনি। গত ডিসেম্বরের নির্বাচনে তিন। কে হতে প্রার্থী হয় এবং প্রত্যেকটিতে পরাজিত ও জামানত বাজেয়াফত। দু’, পাটির ৩২টি দাতই নকল চরম হিন্দু বিদ্বেষী।

২/এ, এস, এম, সোলায়মান ৬০ টাকা বেতনের টেলিফোন অপারেটার। এক সদস্য বিশিষ্ট কৃষক-শ্রমিক পার্টির সভাপতি।

শ্রমিকহীন শ্রমিক সংস্থার নেতা। দালালীর এনাম হিসাবে আইয়ুব খানের ভ্রাতা বাহাদুর খানের খাইবার ইলরেন্স কোম্পানীর আঞ্চলিক জেনারেল ম্যানেজার, পাকিস্তানের কুখ্যাত ২২ পরিবারের অন্যতম দাউদের বেতন-ভোগী গোলাম ও তাদের কর্ণফুলী পেপার মিলের রেসিডেন্ট ডিরেক্টর। গত নির্বাচনে জামানত বাজেয়াফত।

৩/মওলানা এ, কে, এম, ইউসুফ

জামাতপন্থী কাঠ মোল্লা। গত নির্বাচনে জামানত বাজেয়াফত।

৪। আব্বাস আলি খান-জামাত

নেতা মওদুদীর বেতনভোগী * দালাল—লেখাপড়া বলতে যা বুঝায় তার কিছুই নেই। চার আনার মোল্লা। গত নির্বাচনে

জামানত বাজেয়াফত

৫।আখতারুদ্দীত আহমদ – সারটিফিকেট অনুসারে ব্যারিষ্টার । তবে আইন পেশায় কোনদিন পয়সা উপার্জন করতে পেরেছে কিনা তা গবেষণার বিষয়। তাই হাই কোর্টে ওকালতির বদলে তিনি বেছে নিয়েছেন ভিন্ন পথ—মানে দালালীর পেশা। একজন ডিগবাজী বিশারদ—গত কয়েক বছরে তিনি কয়েকবার দল বদল করেছেন। গত নির্বাচনে জামানত ব্যজেয়াফত।

৬/নওয়াজেশ আহমদ—কুষ্টিয়ার এক মুসলিম লীগ পন্থী রাখাল।

বালক।

৭। মওলানা ইসহাক—নিজের ও বাপ-দাদার পরিচয় জানার জন্য গবেষক দল নিযুক্তির দরকার।

৮। ওবায়দুল্লাহ মজুমদার – বেঈমান, বিশ্বাসঘাতক দালাল।

৯। শামসুল হক ঐ।

১০। মং সু প্রো—সেই পুরানো মাল (মোনেম খানের মন্ত্রী), গত নির্বাচনে ধরাশায়ী, জামানত বাজেয়াফত।

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ওপর শ্রেষ্ঠ দুটি বই

গাজী উল হকের

‘এবাৱেৱ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম

বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের একটি প্রামাণ্য দলিল

* সুদৃশ্য প্রচ্ছদপট,

আটটি সুন্দর ছবি সম্বলিত * নির্ভরশীল তথ্যে পূর্ণ

এবং

সুসাহিত্যিক হাসান মুরশিদের ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের সাংস্কৃতিক পটভূমি’

সর্ব ভারতীয় পরিবেশক :

ইন্ডিয়ান অ্যাসোসিয়েটেড পাবলিশিং কোং প্রাঃ লিঃ

৯৩, মহাত্মা গান্ধী রোড, কলিকাতা-৭

ফোন নং ৩৪-২৬৪১

পাতা১০

নয়াদিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্মেলনে বিশ্ব নেতৃৱন্দেৱ আবেদন

আর আবেদন নয়, এবার সক্রিয় সাহায্য দিতে হবে

(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত )

নয়াদিল্লী :—পৃথিবীর ছয়টি মহাদেশের ২৫টি রাষ্ট্রের ৬৫ জন প্রতিনিধি নয়াদিল্লীতে আয়োজিত বাংলাদেশ সম্পর্কিত এক আন্তর্জাতিক সম্মেলনে (১৮—২০শে সেপ্টেম্বর) বাংলাদেশে শতাব্দীর নিষ্ঠরতম ও মর্মন্তুদ গণহত্যার বিরুদ্ধে তীব্র ধিক্কার ও ঘৃণ! প্রকাশ করেন। সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তি বাহিনীর সাথে কাধে কঁধ মিলিয়ে জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনীর বিরুদ্ধে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার ব্যাপারে একটি আন্তর্জাতিক ব্রিগেড’ গঠনের আহ্বান জানান হয়।  সম্মেলনে বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের প্রতি সর্বাত্মক সমর্থন প্রকাশ করে বলা হয় যে, সমসাময়িক মানব ইতিহাসে এর চাইতে জঘন্যতম হত্যাকাণ্ড আর সংগঠিত হয়নি।সম্মেলনে সৰ্ব্বসম্মতিক্রমে গৃহীত এক প্রস্তাবে বাংলাদেশের গণজাগৃতির উগ্ধতা ও বাঙ্গালী  জাতীয়তাবাদের জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের অবিলম্বে বিনা শর্তে মুক্তি দাবী করা হয়েছে।আন্তর্জাতিক সম্মেলনে যোগ দান- কারী  িভিন্ন রাষ্ট্রের বিশিষ্ট প্রতি । নিধিরা বলেন যে, বর্তমানে বাংলা। দেশ প্রশ্নে সরাসরি সাহায্য দান করতে – হবে—শুধু মাত্র সুন্দর প্রস্তাব গ্রহণের মধ্যে স স্মলনের কার্য্যক্রম সীমাবদ্ধ রাখা উচিত হবে না।নেপালের সাবেক প্রধান মন্ত্রী মিঃ বি, পি, কৈরালা সিংহলের স্যার গুনাওয়ারধানা এবং ফ্রান্সের মি: ২ ডানিয়েল মায়ার উল্লেখিত অভিমত প্রকাশ করেন।নয়াদিল্লীতে আয়োজিত এই আন্তর্জাতিক সম্মেলনের উদ্বোধন করেন সৰ্বেদয় নেতা শ্রীজয় প্রকাশ নারায়ন।

সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বাধীনতা। সংগ্রামে শহীদ লাখো লাখো নারী, পুরুষ ও শিশুর প্রতি সংগ্রামী অভিনন্দন জানিয়ে তাদের স্মৃতির প্রতি শ্রদ্ধা প্রদর্শনের জন্য দু’মিনিট নীরবতা পালন করা হয়।জনৈক মার্কিণ প্রতিনিধি হ সম্মেলনে যোগদানকারী বেশ কয়েক – জন প্রতিনিধি বাংলাদেশে মানবিক মূল্যবোধ অক্ষুন্ন রাখার ব্যপারে ইয়াহিয়া সরকারের ওপর বিশ্ব চাপ সৃষ্টি এবং সমস্যার সমধান না হওয়া। – পর্যন্ত পাকিস্তান যাতে কোনরূপ অস্ত্র সাহায্য না পায় তার নিশ্চয়তা বিধানের দাবী জানান। এ ইন্দোনেশিয়ার জনৈক সাবেক পররাষ্ট্র মন্ত্রী ডঃ মোহাম্মদ রোয়েম আন্তর্জাতিক আইনের উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, বাংলাদেশ সমস্যা পাকিস্তানের আভ্যন্তরীন ব্যাপার হতে পারে না। এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার জাতিসংঘের রয়েছে। সম্মেলনের সাফল্য কামনা করে – অন্যান্যদের মধ্যে বিশ্ব বন্দিত ব্যক্তিত্ব ইহুদি মেনুহিন, মিঃ আন্দ্রে মারলো, সিনেটর কেনেডী, ফুলব্রাইট, কানাডার  প্রাক্তন প্রধান মন্ত্রী লেষ্টার পিয়ারসন। বাণী পাঠিয়েছেন।ভারতের প্রেসিডেন্ট গিরি এক বাণীতে সম্মেলন বাংলাদেশ প্রশ্নে। আন্তর্জাতিক বিবেক জাগ্রত করতে সহায়ক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন।শ্রী নারায়ন সম্মলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন যে, বিশ্ব আজ অবহিত যে, – লাখো শহীদের লাশের নীচে পাকি. স্তান চাপা পড়ে গেছে। তিনি বলেন : একমাত্র মুক্তি বাহিনীন সফলতার ওপরই বাংলাদেশের জনগণের নিকট গ্রহণযোগ্য। রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। অন্য । দিকে মু ক্ত বাহিনীর সফলতা বিশ্বের সকল দেশের জনগন ও সরকারের সার্বিক সহায়তা ও সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল।সম্মেলনে বে-সরকারীভাবে বাংলা। দেশ সরকারের প্রতিনিধিত্ব করেন। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ডঃ এ, আর, মল্লিক।  তুমুল করতালির মধ্যে কায়রোর ‘আল আহরাম পত্রিকার সম্পাদক ডঃ মকসুদ বলেন, বাংলাদেশে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার নজিরবিহীন এিঞ্জুর। কার্যক্রমে বিশ্ববিবেক স্তম্ভিত হয়ে। পড়েছে বৃটীশ এম, পি এবং ওয়েলসে সৰ্ব্বদলীয় বাংলাদেশ কমিটির চেয়ারম্যান – মিঃ ফ্রেড ইভান্স বলেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যা বিনা বাধায় চালিয়ে যেতে দেওয়া হলে আমরা অচিরেই উপলদ্ধি করতে পারবো যে আমাদের নিণেদের স্বাধীনতাও বিপন্ন হয়ে পড়েছে।  সিংহলে বাংলাদেশ মানবিক অধিকার কমিটির চেয়ারম্যান স্যার। সেনারট গুন ওয়াদ্ধ ন বলেন যে, বাংলাদেশে গণহত্যার ব্যাপারটি জাতিসংঘে যথার্থভাবে আলোচিত হওয়ার যোগ্যতা রাখে।মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মিঃ ষ্টেনলি প্লাষ্ট্রিক বলেন, বাংলাদেশে গণহত্যা এবং অকল্পনীয় নিষ্ঠুরতার নিন্দা জ্ঞাপন। নিক্সন সরকারের কাছ থেকে আশা করা ভুল হবে। – তিনি বলেন, তবে আশার কথা হচ্ছে আমেরিকার যুব সমাজ, ছাত্র সমাজ, বুদ্ধিজীবী সমাজ বাংলাদেশের। জনগণের পক্ষে রয়েছেন।ফ্রান্সের মিঃ ডেনিয়েল মেয়র বলেন। বাংলাদেশ সমস্যা ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যকার ব্যাপার নয়। বাংলাদেশ। সমস্যা হচ্ছে পাকিস্তানের সাথে বিশ্ব। বিবেকের। তিনি বাংলাদেশে গণহত্যার জন্য দায়ী জল্লাদ ইয়াহিয়া। জান্তাকে সকল প্রকার সামরিক সাহায্য প্রদান বন্ধের দাবী জানান।যুগোেশ্লাভ শান্তি লীগের মিঃ জোভরেমেভিক বলেন, সমসাময়িক ইতিহাসে বাংলাদেশ ট্রাজেডির কোন নজির নেই।বৃটেনের বিশ্ব কলা ও বিজ্ঞান একাডেমীর ডিরেক্টর স্যার জর্জ কেটলিন বলেন, বাংলাদেশে মানবিক মূল্যবোধ এবং গণতন্ত্রের আকাঙ্ক্ষার যাতে সমাধি না ঘটে তা দেখার দায়িত্ব বিশ্বের প্রতিটি মানুষের। – “আফগান মিল্লাত’-এর সম্পাদক জনাব কিউ, হাদাদ, আফ্রো-এশীয় সংহতি কাউন্সিলের নাইজেরীয় শাখার সদস্য মিঃ গনি ফাওয়াহিমি,টোকিওর অধ্যাপক নারা, সালভাদার _ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ফাদার ইসমাইল কুইলেম, অটোয়ার বিশ্ব কাউন্সিলের চেয়ারম্যান মিঃ নিয়েলমেল, অসোর মিসেস মিগরিড এবং বিশ্ব ধর্মীয় শান্তি সম্মেলনের সেক্রেটারী জেনারেল ডঃ হোমার জগক সম্মেলনে বক্তৃতা প্রসঙ্গে পাকিস্তানী জল্লাদ বাহিনীর নাদিরশাহী বৰ্ব্বরতার নিন্দা করে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিশ্ব জনমত  সংগঠিত করার ব্যাপারে গুরুত্ব আরোপ – করেন। ‘ অন্যান্যদের মধ্যে ভারতের বিশিষ্ট জননেতা মেসাস সাদিক আলী, আচাৰ্য কৃপালনী, সুচেতা কৃপালনী,বিজয় লক্ষী পণ্ডিত, অধ্যাপক রাঙ্গা এবং শাহ নওয়াজ খান সম্মেলনে যোগদান করেন।

 

 

চামচা মল্লিকের জনসভা

ইয়াহিয়ার পাদুকালেহী চামচা গভর্ণর আবদুল মোত্তালেব মল্লিক বড় শখ করে চুয়াডাঙ্গায় জনসভা করতে গিয়েছিল। গভর্ণর নিযুক্ত হয়েছেন তাই ষ্টেডিয়ামে জনসভা করতে হবে। কয়েকদিন থেকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সভার কথা ঘোষণা করা হলেও লোক হবে না বুঝতে পেরে সভার স্থান মল্লিকের বাড়ীতে করা হয়। জনশূণ্য চুয়াডাঙ্গা শহর থেকে। দু’শো লোককে ধরে এনে সভায় শ্রোতার আসনে বসিয়ে দেওয়া হয়। দু’শো লোকের ‘বিশাল মহতী জনসভা পাহারা দেওয়ার জন্য তিন শ’ সেনাবাহিনী নিয়োগ করা হয়।দু’শোযোগ তিন শ’ এই পাঁচ শ’ সাদা এবং খাকী পোষাক পরিহিতদের ‘মহতী জনভায়’ চামচা মালিক নাকি ‘উদ্দীপক’ ভাষণ দিয়েছেন।

রাজাকারেরা দলে দলে ধরা দিচ্ছে

হানাদার খান সেনারা মুক্তিবাহিনীর ব্যাপক তৎপরতা প্রতিহত করার জন্য লুটপাটের লোভ দেখিয়ে মাত্র দু-সপ্তাহের ট্রেনিং দিয়ে যে রাজাকার দল গঠন করেছিল তারা। এখন প্রতিদিন দলবদ্ধভাবে আমাদের মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করছে।গত ১৬ই সেপ্টেম্বর কুষ্টিয়ার বাবলা চড়া ইউনিয়ন শান্তি কমিটির চেয়ারম্যান তার অধীনে ২২ জন রাজাকারকে সঙ্গে নিয়ে মুক্তিবাহিনীর হাতে আত্মসমর্পণ করেছে। সেই সঙ্গে উক্ত দলটি তাদের কাছে রক্ষিত সমস্ত রসদসহ রাইফেল, হাল্কা মেশিনগান, সর্টগান, স্টেনগান প্রভৃতি বিপুল অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনীর হাতে তুলে দেয়। – এ ধরনে বেশ কয়েকটি রাজাকার দল মুক্তি বাহিনীর হাতে ধরা দিয়েছে। একমাত্র খুলনা জেলাতেই এ ধরণের দলত্যাগীর সংখ্যা ৬০। তারা তাদের সব অস্ত্রশস্ত্র সমেত। মুক্তি বাহিনীতে গিয়ে আত্মসমর্পণ করেছে।

বর্বরতার নতুন রেকর্ড

পাকিস্তানী সৈন্যরা নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের হত্যা ও তাদের বাড়ীঘর পুড়ে দেওয়ার চণ্ডনীতি অব্যাহত রেখেছ। মুক্তি বাহিনীর হাতে মার খেয়ে পশ্চিম পাকিস্তানেরজানোয়ারগুলো তার প্রতিশোধ নিচ্ছে নিরীহ মানুষের উপর।করিমগঞ্জে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, গত ১৫ই সেপ্টেম্বর সকালে করিমগঞ্জ বর্ডারের উল্টো দিকে লাতু সেক্টরে বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যরা প্রায় দু’হাজার নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা করে।খবরে আরো প্রকাশ, সারাপারে ভারে ফজরের নামাজান্তে মুসল্লীরা মসজিদ থেকে বের হয়ে আসলে পাকিস্তানী সৈন্যরা তাদের উপর নির্বিচারে মেসিনগান চালায়। ফলে বহু মুসল্লী নিহত হন।প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে ঐ ঘটনার পর মুক্তি বাহিনী বর্বর পশ্চিমা সৈন্যদের বিরুদ্ধে এক প্রচণ্ড যুদ্ধে লিপ্ত হয়। এই যুদ্ধে প্রায় সাড়ে তিনশত পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও রাজাকার প্রাণ হারায়।

তাদে বাঁধন যত শক্ত হবে

দখলীকৃত বাংলাদেশের ক্রীড়নক গভর্ণর ডাঃ মালিকের পুতল সরকারের আড়ালে পাকিস্তানী জঙ্গীচক্র বাঙালী শিক্ষাবিদ, সংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীদের উপর নতুন করে হামলা, শুরু করেছে।এখানে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে ছাত্রদের উদ্দেশ্যে বার বার হুমকী দেওয়া সত্ত্বেও বাংলাদেশের সব বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ফাকা রয়েছে।হানাদারচক্র ছাত্রদের শায়েস্তা করতে না পেরে বর্তমানে শিক্ষাবিদদের উপর খড়গহস্ত হয়েছে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ও ইসলামিক ইতিহাস বিভাগের প্রধান অধ্যাপক হাবিবুল্লাহ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রোফেসর এমিরেটাস ডাঃ এনামুল হক ও বাংলা বিভাগের সিনিয়র লেকচারার ডঃ মোহাম্মদ মনিরুজমানকে চাকুরী থেকে বরখাস্ত করা হয়েছে। ডঃ মনিরুজ্জমানের ওপর হুকুম জারী হয়েছে যে, আগামী ৬ মাস তিনি কোন সরকারী বা বেসরকারী চাকরীই করতে পারবেন না । তাছাড়া রাষ্ট্রবিরোধী কার্যকলাপের জন্য ডঃ কুদরত-ই-খুদা, ডঃ নীলিমা ইব্রাহিম ও ডঃ সিরাজুল ইসলাম চৌধুরীকে সতর্ক করে দেওয়া হয়েছে।

ইতিপূর্বে ডঃ আবুল খয়ের ,জনাব রফিকুল ইসলাম, জনাব সহিদুল্লাহ, জনাব শাদউদদীন ও জনাব আশাবুল হক সহ বেশ কিছু সংখ্যক বিক্ষাবিদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। এ এদিকে গত মাসের গোড়ার দিকে হানাদার সৈন্যরা মর্ণিং নিউজের চীফ রিপোটর জনাব শহিদুল হক, ঢাকা বেতারের বার্তা সম্পাদক জনাব সাইফুল বারী, এপিপির রিপোর্টার জনাব মোজাম্মেল হক ও পিপিআইএর রিপোর্টার জনাব নাজমূল হককে ধরে নিয়ে যায়। তারপর থেকে তাদের আর কোন সংবাদ পাওয়া যায়নি।সদর ঘাটের বুড়ীগঙ্গা তীরের চারিদিকে কাটা তারের বেড়ায়। আটকানো হয়েছে। ষ্টিমার, লঞ্চ বা অন্য কোন জলযানে যে সব যাত্রী। ঢাকায় আসেন তাদের তল্লাসী করার জন্যই এই ব্যবস্থা।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!