জয় বাংলা ১০ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
জয়বাংলা
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
রেজিস্টার্ড নম্বর – ১ ( বাংলাদেশ সরকার)
মুজিব নগরঃ ১ম বর্ষ সংখ্যা
শুক্রবার, ২৪শে ভাদ্র, ১৩৭৮
১৭ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭১
মূল্যঃ) ২৫ পয়সা
*বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের নবতর পর্যায়*
সরকারকে উপদেশ দানের জন্য উপদেষ্টা কমিটি গঠন
বাংলাদেশের বর্তমান মুক্তিযুদ্ধের ব্যাপারে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের উপদেষ্টা হিসেবে বাংলাদেশের ৪টি প্রগতিশীল রাজনৈতিক দলের সমন্বয়ে একটি ‘উপদেষ্টা কমিটি’ গঠন করা হয়েছে৷ কমিটির সদস্য গণ হচ্ছেনঃ মাওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী (ভাসানী ন্যাপ), মিঃ মণি সিং(বাংলাদেশ কম্যুনিস্ট পার্টি), মিঃ মনোরঞ্জন ধর(বাংলাদেশ জাতীয় কংগ্রেস), অধ্যাপক মুজাফফর আহমদ (মুজাফফর ন্যাপ) জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ, প্রধানমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ও খন্দকার মোশতাক আহমদ, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। এছাড়া কমিটিতে আওয়ামী লীগের আরও দুইজন সদস্য অন্তর্ভুক্ত করা হবে।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদ উপদেষ্টা কমিটির বৈঠক আহবান ও পরিচালনা করবেন।
গত বৃহস্পতিবার প্রচারিত বাংলাদেশ সরকারের এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয় যে, মুজিব নগরে দলগুলোর নেতৃবৃন্দের দুই দিন ব্যাপী বৈঠক শেষে সর্বসম্মতিক্রমে এই কমিটি গঠন করা হয়।
মুজিব নগরের বৈঠকে যোগদানকারী নেতৃবৃন্দ মুক্তিযুদ্ধকে চূড়ান্ত বিজয়ের লক্ষে নিয়ে যাওয়ার ব্যাপারে বাংলাদেশ সরকারের প্রচেষ্টার প্রতি দৃঢ আস্থা ও দ্ব্যর্থহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেন। নেতৃবৃন্দ বিজয়ের দিনটিকের নিকটতর করার জন্য জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমবায়ে গঠিত বাংলাদেশ সরকারের পশ্চাতে ঐক্যবদ্ধ থাকার জন্য জনগণের প্রতি আহবান জানান।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান, আওয়ামী লীগ এবং গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের – বাংলাদেশে একমাত্র বৈধ সরকার – প্রতি আস্থাবান বাংলাদেশের সর্বস্তরের মুক্তিকামী মানুষের সার্বিক ঐক্যের অভিব্যক্তি ঘটেছে এই কমিটির মাধ্যমে। এতে বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক ও সাম্রাজ্যবাদী শোষণের বিরুদ্ধে সক্রিয় সংগ্রামে লিপ্ত সকল মত ও পথের মানুষের মুক্তি সংগ্রামে অংশ গ্রহণের ধারণা নিশ্চিত করা হয়েছে।
সভায় সর্বসম্মতিক্রমে গুহীত এক প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা কতৃক বাংলাদেশের অবিসম্বাদিত জাতীয় নেতা শেখ মুজিবর রহমানের বে-আইনী আটকের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও ক্ষোভ প্রকাশ করা হয়। প্রস্তাবে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক শাসকগণ কর্তৃক শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসনের নির্লজ্জ প্রচেষ্টার নিন্দা করা হয়।
সভায় দ্বিতীয় প্রস্তাবে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি পূর্ণ আন্তরিক আস্থা ও বিশ্বাস জ্ঞাপন করা হয় এবং বাংলাদেশ সরকারকে সার্বিক সমর্থন দানের কথা ঘোষণা করা হয়।
তৃতীয় প্রস্তাবে ভারতসহ বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অবিলম্বে বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দান করে বাংলাদেশের শান্তি ও গণতন্ত্রকামী সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তি সংগ্রামের বাস্তবতাকে মেনে নেওয়ার জন্য আহবান জানানো হয়। সভা বাংলাদেশ সরকারকে অস্ত্রশস্ত্র ও গোলা বারুদ প্রদান সহ সর্বপ্রকার সক্রিয় সাহায্য দানের জন্য বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের প্রতি অনুরোধ জানানো হয়।
চতুর্থ প্রস্তাবে সভা মাতৃভূমিকে পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী দখলদার বাহিনীর কবলমুক্ত করার জন্য শত প্রতিকূলতার মধ্যেও বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা যে বীরত্বের পরিচয় দিয়েছেন কৃতজ্ঞচিত্তে তা স্বরণ করা হয় এবং এ কাজে মাতৃভূমির যে সমস্ত বীর সন্তান শাহাদৎ বরণ করেছেন তাদের প্রতি অকুন্ঠ শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয়।
পঞ্চম প্রস্তাবে বাংলাদেশের সর্বহারা বাস্তুত্যাগীদের প্রতি অকাতরে সাহায্যের হস্ত প্রসারের জন্য ভারতের জনগণ এবং ভারত সরকারের প্রতি গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করা হয়। বাংলাদেশের সংগ্রামী জনগণের প্রতি ভারত সরকারের সমর্থনের জন্যও সভা সন্তোষ প্রকাশ করে।
অপর এক প্রস্তাবে সভা শোষণের শৃঙ্খল থেকে মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি একাত্মতা ঘোষণা এবং বাংলাদেশ তাদের ভাইদের মুক্তি সংগ্রামের প্রতু পূর্ণ সমর্থন জ্ঞাপনের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহবান জানানো হয়।
সভায় ৭ম ও সর্বশেষ প্রস্তাবে দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় যে, পূর্ণ স্বাধীনতা ছাড়া অন্য কোন রাজনৈতিক সমাধান বাংলাদেশের মানুষের কাছে গ্রহনযোগ্য হবে না। প্রস্তাবে বলা হয়, মুক্তি অর্জনের জন্য বাংলাদেশের জনগণ সর্বোচ্চ ত্যাগ স্বীকার করেছেন এবং রক্ত যদি মুক্তির মূল্য হয়ে থাকাে, তাহলে বাংলাদেশের নিরস্ত্র জনগণ প্রতি মুহূর্তেই তা দিয়ে চলেছেন।
দুইদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত সভায় উপদেষ্টা কমিটিতে অন্তর্ভূক্ত ৬জন জননায়ক ছাড়াও বাংলাদেশ সরকারের অর্থ মন্ত্রী জনাব মনসুর আহমেদ, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী জনাব এ.এইচ.এম কামারুজ্জামান ও বাংলাদেশ সরকারের রাজনৈতিক পরামর্শদাতা জনাব এম.এ সামাদ উপস্থিত ছিলেন।
***
শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটি নিশ্চিতরূপে ঘনিয়ে এসেছে
গত ৫ই সেপ্টেম্বর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রচারিত এক ভাষণে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ দৃপ্ত কন্ঠে ঘোষণা করেনঃ ঘুর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের ওপরে বাংলার প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী। তিনি বলেন,শত্রুর অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃঢনীতি, জলে স্থলে, আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জল সাফল্য শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটি এগিয়ে নিয়ে এসেছে।
বাংলাদেশের দূর্গত মানবতার জন্য প্রেরিত ত্রাণসামগ্রী পাকিস্তান সরকার যেভাবে দখলদার সৈন্যের জন্য ব্যবহার করছে তা উল্লট করে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের প্রতি হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, বিশ্ব প্রতিষ্ঠান যদি বিশ্বের এই অঞ্চলে তাদের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে চায়, তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণ কার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত হতে না পারে৷
মাঝে মাঝে আপোষের নামে সমাজের বিভিন্ন মহল থেকে যে সব প্রস্তাব করা হয় সেগুলোকে ‘ছলনাময়’ উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ দৃঢতার সাথে বলেন, ‘এসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে আপোষহীন সংকল্পকে দূর্বল করে দেয়া’। এটা আমাদের জন্য ফাঁদ হতে পারে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।
বঙ্গবন্ধুর বিচার প্রহসনের বিষয় উল্লেখ করে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা মেখে যিনি তাদের সুখের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দী জীবন যাপন করছেন৷ আমি দেশবাসীকে এই প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে, বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবর রহমানের প্রাণ নাশের ষড়যন্ত্র করেছে পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাতেরকেই।’
উপসংহারে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ জাতিকে ধৈর্য্য, সাহস ও একতার কথা স্বরণ করিয়ে দিয়ে বলেন, শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনঃগঠনের জন্য এই গুণগুলো অর্জন করা আমাদের জন্য অত্যাবশ্যক।
প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমেদ তার বরতার ভাষণে বলেনঃ “আপনাদের উদ্দেশ্যে গতবার আমার বক্তব্য পেশ করার পরে পৃথিবীতে অনেক কিছু ঘটে গেছে৷ হানাদার বাহিনীর সঙ্গে জীবন মরণ সংগ্রামে লিপ্ত বাংলাদেশের জনগণের কাছে সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ঘটনা হলো এই যে, সামরিক শাসনচক্রের পশ্চিম পাকিস্তানী ক্ষমতার ভাঙন ধরেছে এবং বাংলাদেশে তাদের মুষ্টিমেয় এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ শিথিল হয়ে এসেছে৷ তাদের অর্থনীতিকে বানচাল করার জন্য আমাদের দৃদঢ নীতি, জলে স্থলে আমাদের মুক্তিযোদ্ধাদের উজ্জ্বল সাফল্য এবং আমাদের প্রতিরোধের ক্রমবর্ধমান শক্তি ও গভীরতা-শত্রুর সম্পূর্ণ পরাজয়ের দিনটিকে নিশ্চিতরূপে সামনে এগিয়ে নিয়ে এসেছে। এ সত্ত্বেও ধৈর্য্য ও সাহসের প্রয়োজনীয়তার উপরে আমি জোর দিতে চাইম শত্রুকে নিশ্চিহ্ন করার জন্য এবং এই নিষ্ঠুর যুদ্ধের অবসানে দেশের পুনর্গঠনের জন্য এই গুণ দুটি অর্জন করা আজ আমাদের পক্ষে অত্যাবশ্যক।
বিশ্বে ক্ষমতার ভারসম্যের সুযোগলাভে তারা ব্যর্থ হয়েছে
বিশ্বে ক্ষমতার ভারসম্যের ক্ষেত্রে সম্প্রতি তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন ঘটেছে৷ এই ভারসাম্যের উপর ভরসা করে শত্রুপক্ষ যা লাভ করতে চেয়েছিল, তাতে তারা সাফল্য লাভ করতে পারেনি। এর নবতম প্রমাণ ভারত – সোভিয়েত মৈত্রী চুক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মধ্য দিয়ে নিজেদের শক্তির যে বিষ্ময়কর পরিচয় আমরা লাভ করেছি, নিঃসন্দেহে আমরা তার উপরই নির্ভর করি। তবে যে সব মহলে আগে শুধু সতর্কতার মনোভাব পাওয়া গেছে, সেখান থেকে যখন সমর্থনের ইঙ্গিত পাওয়া যায়, তখন আমাদের সন্তোষের কারণ ঘটে বৈ কি। কোন কোন দেশের সরকার এখনও অবশ্য নীতিবিবর্জিত ভূমিকা পালন করছে – যদিও সে সব দেশের জনসাধারণ আমাদের প্রতি দ্বিধাহীন সমর্থন জ্ঞাপন করেছে। আমরা শুধু আশা করব যে, এসব দেশের জনসাধারণ ও তাদের প্রতিনিধিদের আচরণের এই অসংগতি শীঘ্রই দূর হবে৷
জাতিসংঘ যদি স্বীয় মর্যাদা বজায় রাখতে চায়….
পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর লক্ষ্য যে বাংলাদেশের জনগণের ধ্বংস সাধন, সে বিষয়ে আর কোন সন্দেহের অবকাশ নেই। সুতরাং, তারা যে জনগণকে ত্রাণসামগ্রী ঠিক মতো পৌছে দেবে, সেকথা বিশ্বাস করার মতো লোক পৃথিবীতে বিরল৷ তবু বাংলাদেশের মানুষের জন্য বিভিন্ন দেশ থেকে যে সাহায্য দিয়েছেন, পাকিস্তান সরকারের মাধ্যমে তা দখলীকৃত এলাকায় বিলি করার ব্যবস্থা সংগত বিবেচনা করেছে জাতিসংঘ। বিগত ঘুর্ণিঝড়ের পর যে রিলিফ এসেছিল, বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধেই পাকিস্তান সরকার নির্বিকার চিত্ত্বে সে সব ব্যবহার করেছে। দুর্গত মানুষের জন্য নির্দিষ্ট বহু সামগ্রী দখলদার সৈন্যদের প্রয়োজনে ব্যবহৃত হচ্ছে। জাতিসংঘের সেবাদলে এখন একদল যোগাযোগ বিশেষজ্ঞ এসেছেন উন্নত ধরণের যন্ত্রপাতি নিয়ে। এতে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর রণকৌশলে সহায়তা হবে, তাতে সন্দেহ নেই। এই অবস্থায় ত্রাণ কার্যক্রমের মানবতাবাদী উদ্দেশ্য বিপর্যস্ত হবার ঘোরতর আশঙ্কা রয়েছে৷ জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল যদি পৃথিবীর এই অংশে বিশ্ব প্রতিষ্ঠানের মর্যাদা অক্ষুণ্ণ রাখতে চান তাহলে তাকে এমন ব্যবস্থা নিতে হবে যাতে ত্রাণ কার্যের নামে নিষ্ঠুর প্রহসন অনুষ্ঠিত না হয়।
আপোষ প্রস্তাবের আসল উদ্দেশ্য কি –
ব্যাপক হত্যাকাণ্ড ও লুন্ঠনের মাধ্যমে শত্রুপক্ষের আসল পরিচয় আমরা পেয়েছি। মাঝে মাঝে আপোষের কতকগুলো প্রস্তাবের মাধ্যমে তার গোপন ছলনার পরিচয়ও আমরা পাচ্ছি৷ এইসব প্রস্তাব চালু করার উদ্দেশ্য হচ্ছে জনগণকে বিভ্রান্ত করা এবং আমাদের পূর্ণ স্বাধীনতা অর্জনে আপোষহীন সংকল্পকে দূর্বল করে দেওয়া। শত্রুপক্ষ আপোষ চাইতে পারে দুটো কারণেঃ হয় সে দূর্বল, না হয় সে আমাদের জন্য ফাঁদ পেতেছে, সে ফাঁদ সম্পর্কে আমাদের সচেতন থাকতে হবে।
ক্রীড়ানক বসানোর অন্তরালে
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশন আসন্ন। এই পরিপ্রেক্ষিতে সামরিক জান্তার কৌশল হলো বাংলাদেশে বেসামরিক শাসন প্রবর্তনের ভান করা। ঘৃণ্য টিক্কা খানের আসনে ক্রীড়ানক বসানো এবং জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন কয়েকজন ধিক্কৃত বাঙালীকে জাতিসংঘের প্রতিনিধিরূপে পাঠানো – এ সবই তার ছদ্ম আবরণ। সে মিথ্যা আশা করে যে, এতে অব্যাহত সামরিক শাসন এবং বাংলাদেশের গণহত্যা ও জনমতদলনের নিষ্ঠুর সত্যকে ঢাকা দেওয়া যাবে।
গণপ্রতিনিধিরা ফাঁদে পা দেবেন না
জাতীয় ও প্রদেশিক পরিষদের কিছু সংখ্যক প্রতিনিধির আসন বাতিল করে আর কিছু সংখ্যক আসন বজায় রেখে ইয়াহিয়া কাকে ধোঁকা দিতে চাইছেন? তিনি এমন ভান করছেন যে, যাদের আসন বাতিল হয়নি, তারা বুঝি চক্রান্তের সমর্থক। জনসাধারণের সুস্পষ্ট অভিপ্রায়ই জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের ক্ষমতার উৎস৷ তারা কোন ক্ষমতা দখলকারীর আজ্ঞাবাহী নন। এবং তার উদ্ভাবিত ফন্দি ফিকিরের সঙ্গেও তাদের কোন সম্পর্ক নেই। গত জুলাই মাসের সম্মেলনে এম,এন,এ ও এম, পি, এ-রা বাংলাদেশের পূর্ণ স্বাধীনতার জন্য অবিরাম সংগ্রামের প্রতিজ্ঞা পুনরায় ঘোষণা করেন। জন প্রতিনিধিদেরকে বিচার করার হাস্যকর প্রচেষ্টা কিংবা তাদের বিষয় সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করা প্রয়াস – তাদের প্রতিজ্ঞা থেকে টলাতে পারবে না।
শাস্তি পেতে হবে পরিণামে তাদেরকেই…
বাংলাদেশে গণহত্যায় যে বিশ্ববাসী শিউরে উঠেছে, তারাই এখন লক্ষ্য করছে যে, জনগণের অবিসংবাদিত নেতা শেখ মুজিবর রহমানকে কারারুদ্ধ করে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের আয়োজন করা হয়েছে এবং তার পক্ষ সমর্থনের জন্য ইয়াহিয়া সন্দেহজনক ভাবে আইনজ্ঞ চাপিয়ে দিয়েছেন। পৃথিবীর মানুষ তাই আবার ঘৃণায় মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। পাকিস্তানী শাসক-চক্রের মিথ্যা ভাষণে এবং তাতের কলংক মোচনের কলাকৌশলে কেউ প্রতারিত হবে না৷
বঙ্গবন্ধু দর বিচার প্রসঙ্গে আমি পৃথিবীকে স্বরণ করিয়ে দিতে চাই যে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের ভালোবাসা মেখে যিনি তাদের সুখের স্বপ্ন দেখেছিলেন, দস্যুদের কবলে পড়ায় তিনি আজ বন্দী জীবন যাপন করছেন। তার বিচারের প্রহসনের বিরুদ্ধে অন্যান্য দেশের সরকার ও জনগণ এবং আইন বিশেষজ্ঞসহ নানা আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানকে সক্রিয় করে তুলতে সর্বপ্রকার চেষ্টা করছে বাংলাদেশের সরকার ও জনগণ। কিন্তু বর্বর চক্রের অন্ধ ঔদ্ধত্যের উপর এর তেমন কোন প্রতিক্রিয়া ঘটেনি। তবে দেশবাসীকে আমি প্রতিশ্রুতি দিতে চাই যে বিচারের নামে যারা শেখ মুজিবর রহমানের প্রাণনাশের ষড়যন্ত্র করছে, পরিণামে শাস্তি পেতে হবে তাদেরকেই। আর ইসলামাবাদের উপর যেসব সরকারের কিছুমাত্র প্রভাব আছে, শেখ সাহেবের মুক্তি সাধনের জন্য তাদের কাছে আমি আবার আবেদন জানাই।
স্বীকৃতির প্রশ্নে আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে…
পাকিস্তান সরকারের কর্মরত কূটনীতিবিদরা দলে দলে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। এতে আমাদের শক্তির প্রমাণ ঘটেছে এবং অন্যান্য দেশের সরকারের পক্ষে আমাদেরকে স্বীকৃতিদানের আরেকটি কারণ যুক্ত হয়েছে। আসলে স্বীকৃতি লাভ হল মুক্তিযুদ্ধের দ্রুত ও সফল পরিসমাপ্তির সোপান স্বরূপ। বর্বর শক্তির দ্বারা যারা গণতান্ত্রিক অধিকার হরণ করেছে তাদের বিরুদ্ধে বাংলাদেশের মানুষ আজ অস্ত্রধারণ করেছে। আমাদের জনসাধারণ যেভাবে অত্যাচারিত হয়েছে, বোধ হয় আর কোন জাতির ভাগ্যে এমন ঘটনা ঘটেনি৷ সুতরাং, যারা গণতন্ত্রের অনুসারী এবং আমাদের প্রতি মানবিক সহানুভূতি সম্পন্ন, তাদের কাছ থেকে আমরা আরও অনেক প্রত্যাশা করি।
ওদেরই পাপে বাংলার মানুষ হাবুডুবু খাচ্ছে
পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নিষ্পেষণের সঙ্গে সঙ্গে প্রকৃতি আমাদেরকে আবার এক নিষ্ঠুর আঘাত হেনেছে। তা হলো সাম্প্রতিক বন্যার তান্ডবলীলা। বাৎসরিক দুঃখের বন্যায় বাংলাদেশের বহু অঞ্চল আজ প্লাবিত। এই প্লাবন পশ্চিম পাকিস্তানের মানবতা বিরোধী শোষণনীতির প্রতি এক সুস্পষ্ট অভিযোগ। কেননা, এই শাসকগোষ্ঠীই বাংলাদেশের বন্যা নিয়ন্ত্রণের কোন ব্যবস্থা করেনি। একথা আজ পরিষ্কার যে, বাঙালীরা নিজেদের ভাগ্য নিয়ন্ত্রণের ভার গ্রহন না করা পর্যন্ত বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হবে না।
বাঙালীর দুঃখের ব্যাপকতা ও গভীরতা আজ মানবীয় পরিমাপ শক্তির বাইরে। তবু আমি বাংলার অজেয় প্রাণশক্তিতে বিশ্বাসী। তাই আমার দৃঢ প্রত্যয় ঘুর্ণিঝড়, বন্যা ও যুদ্ধের সর্বনাশের উপরে বাংলার এই প্রাণশক্তির জয় অবশ্যম্ভাবী।
মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কামনা করি…
পরিশেষে, যাদের সাহস, আত্মোৎসর্গ ও সাফল্য সারা জাতিকে গৌরবে পূর্ণ করেছে এবং মহান ভবিষ্যতের আশায় উজ্জীবিত করেছে, সেই মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য কামনা করি সকল শক্তি। বর্তমান সংগ্রামের মাধ্যমে বাংলাদেশের জনসাধারণ নিজেদের ঐক্যকে সুদৃঢ় করেছে। এই ঐক্যই যেন আমাদের শক্তির চিরকালীন উৎস হয়। – জয়বাংলা”
***
“যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে,
যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে
ততদিন বাংলার সংস্কৃতিও থাকবে। “
***
সম্পাদকীয়
ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃতি
ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃতি সম্পর্কে অনেকেই সন্দেহ পোষণ শুরু করেছেন। সম্প্রতি ফ্রান্সের ‘লা ফিগারো’ পত্রিকার এক প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে ইয়াহিয়া এমন কয়েকটি কথা বলেছেন, যাতে অনেকেই ভাবছেন, ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক পুরোপুরি বিকৃতি না হলেও তার লক্ষণ অতি স্পষ্ট। লা ফিগারোর সম্পাদক পর্যন্ত ইয়াহিয়ার মন্তব্যগুলো প্রকাশের পাশে নিজেদের তরফ থেকে একটি ক্ষমা প্রার্থনা করে বলেছেন, “ইয়াহিয়ার মন্তব্যগুলো ছাপার অযোগ্য। তবু আমরা ছেপেছি এজন্যে যে, তার মত ব্যক্তিই এখন পাকিস্তানের সর্বোচ্চ পদে অধিষ্ঠিত। “
‘লা ফিগারো’ পত্রিকার সম্পাদকের ক্ষমা প্রার্থনার কোন প্রয়োজন ছিল না। কেননা বিশ্ববাসী জানে, পাকিস্তান নামের একটি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব এখন লুপ্ত এবং ইয়াহিয়াও পাকিস্তানের কোন বৈধ রাষ্ট্রপতি নয়। একজন বিশ্বাসঘাতক ভাড়াটিয়া সামরিক জেনারেল মাত্র৷ ইয়াহিয়ার বর্তমান ভূমিকার সাথে একমাত্র তুলনা চলে, ঘরের কোন দারোয়ানের যে হাতে বন্দুক পেয়ে গৃহস্বামীকে শাসায়৷ সুতরাং, ইয়াহিয়ার মন্তব্য শুধু মুদ্রন অযোগ্য নয়, কোন প্রকার গুরুত্বলাভেরও অযোগ্য।
আগেই বলেছি, ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষ্মণ দেখা দিয়েছে৷ তার প্রমাণ, শেখ মুজিব, শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী প্রমুখ সম্পর্কে তার অভদ্র উক্তি৷ ভদ্রলোকের কাছে থেকেই মানুষ ভদ্র ব্যবহার আশা করে। কোন ইতরের কাছ থেকে নয়। সুতরাং ইতরেরও অধম ইয়াহিয়ার কাছে থেকে ভদ্র ও শালীন আচরণ আশা করাই বাতুলতা। তার উপর মস্তিষ্ক বিকৃতির লক্ষ্মণ যেখানে স্পষ্ট, সেখানে অন্য বিবেচনার অবকাশ কোথায়?
ইয়াহিয়ার মস্তিষ্ক বিকৃতির কারণ স্পষ্ট। তিনি নিজেই বলেছেন, ‘তার কথা কেউ বিশ্বাস করছে না।’ বিশ্বাস করবে কি? এইতো সেদিন তিনি বলেছেন ভারতে মুষ্টিমেয় ‘দুষ্কৃতকারী ‘ আশ্রয় নিয়েছে, লাখ লাখ শরনার্থী গমনের কথা প্রচারণা। এখন তার সরকারই বলছে, শরনার্থীরা ভারতে গেছে তবে তাদের সংখ্যা আশি লাখ নয়, বিশ লাখ। দুদিন আগেও ইয়াহিয়া দাবী করেছেন, বাংলাদেশে গণহত্যা হয়নি। এখন বলছেন, ‘তার সৈন্যরা পেশাদার ঘাতক। তারা ঢাকা শহরে ফুটবল খেলতে যায়নি। সুচারুভাবে হত্যাকাণ্ড সমাধা করতেই গিয়েছিল। ‘
কথায় বলে, ধর্মের ঢাক আপনিই বাজে৷ ইয়াহিয়ার মুখ দিয়ে সেই ধর্মের ঢাক আপনিই বাজতে শুরু করেছে৷ তবু ইয়াহিয়ার জন্য আমাদের দুঃখ হয়। পাকিস্তানের প্রথম বড়লাট গোলাম মোহাম্মদেরও ক্ষমতাচ্যুতির আগে মস্তিষ্ক বিকৃতি ঘটেছিল। গোলাম মোহাম্মদ ছিলেন পাকিস্তানের গণতন্ত্র হত্যার নায়ক৷ আর ইয়াহিয়া গণহত্যার নায়ক। সুতরাং তিনি এখন গোলাম মোহাম্মদের মহাজন পন্থা অনুসরণ করতে চললে বিস্ময়ের কিছু নেই। হায়, ভাড়াটিয়া জেনারেল ইয়াহিয়া!
***
খাদ্য-রাজনীতি
বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় দুর্ভিক্ষের পদধ্বনি স্পষ্ট হয়ে উঠেছে। এই দুর্ভিক্ষ ছিয়াত্তর অথবা পন্চাশের মনন্তর অপেক্ষা ভয়াবহ হবে। এই অভিমত আমাদের নয় যে, সম্প্রতি কানাডার অক্সহামের উদ্যোগে টরেন্টোতে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় বেসরকারী বিশেষজ্ঞদের যে অধিবেশন অনুষ্ঠিত হয়েছে, সেই অধিবেশনের অভিমত৷ যুক্তরাষ্ট্রের এডমিনিস্ট্রেশন ফর ইন্টারন্যাশনালের হিসাব মতে, এবার বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় ৫০ সালের (ইংরেজি ১৯৪৩ সাল) চাইতেও ভয়াবহ খাদ্য সংকট সৃষ্টি হবে। এবং এই ভয়াবহ দুর্ভিক্ষ যে অক্টোবর – অর্থাৎ আগামী মাস থেকেই শুরু হবে, সে সম্পর্কেও বিশেষজ্ঞরা একমত।
এখন প্রশ্ন এই দুর্ভিক্ষের কারণ কি এবং প্রতিকার কি? দুর্ভিক্ষের কারণ, গত চব্বিশ বছর ধরে বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানের ঔপনিবেশিক শাসন। এই শাসনামলে বাংলাদেশে কৃষি উন্নয়ন ও কৃষি সংস্কারের কোন ব্যবস্থা করা হয়নি। বন্যা নিরোধের ব্যবস্থা দ্বারা প্রতি বছর দুশো কোটি টাকার ফসল হানি রোধ করার ব্যবস্থা করা হয়নি৷ ফলে বাংলাদেশ এমনিতেই খাদ্য ঘাটতি এলাকা। তার উপর গত পাঁচ মাস পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী কতৃক শত শত গ্রাম ও বাজারের খাদ্যের গুদাম লুন্ঠন, ক্ষেতের ফসল ধ্বংস করা অব্যাহত থাকায় বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা আজ ভয়াবহ দূর্ভিক্ষাবস্থার সম্মুখীন।
সম্প্রতি একজন বিদেশী বিশেষজ্ঞ বলেছেন, বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার দূর্ভিক্ষাবস্থার আরেকটি কারণ, হানাদার বাহিনীর অত্যাচারে হাজার হাজার কৃষকের বাস্তুত্যাগ। দখলীকৃত এলাকার বহু ক্ষেত খামারে এবার কৃষকেরা কোন ফসল রোপণ করেনি এবং বহু ক্ষেত খামার পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর নির্বিচার বোমা ও গোলা বর্ষণে চাষের অযোগ্য হয়ে গেছে। বস্তুতঃ বিদেশী বিশেষজ্ঞের এই অভিমতই প্রমাণ করে, বাংলাদেশের মানুষকে আসন্ন দুর্ভিক্ষ থেকে বাঁচাতে হলে অবিলম্বে হানাদার বাহিনীর কবল থেকে এই এলাকার মুক্তি প্রয়োজন। কারণ, বাংলাদেশের প্রকৃত গণ প্রতিনিধিত্বশীল সরকারই একমাত্র সেখানকার জনগণের মনে আস্থা ও সাহসের ভাব ফিরিয়ে আনতে পারেন এবং জাতিসংঘ ও অন্যান্য বন্ধু রাষ্ট্রের সাহায্য নিয়ে আরো কয়েক লাখ বাঙালী নরনারীর অনাহারে মৃত্যুবরণের আশঙ্কাকে প্রতিরোধ করতে পারেন।
কিন্তু এমন একটি বিরাট মানবিক সমস্যার ন্যায়সঙ্গত সমাধানে জাতিসংঘ ও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মত সাহায্যকারী দেশ এখনো উদাসীন। জাতিসংঘের উ থান্ট সাহেব এবং যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন সরকার এখনো মনে করেন, ইয়াহিয়া চক্রের মতো খুনী দস্যুদের হাতে খাদ্যসম্ভার ও সাহায্য তুলে দিয়ে তারা বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার মানুষকে অনাহারে মৃত্যুবরণের হাত থেকে বাঁচাবেন। এটা যুক্তরাষ্ট্রের খাদ্য সাহায্য নয়, খাদ্য রাজনীতি।৷ কারণ যুক্তরাষ্ট্র সরকার জানেন, গত বছর ১২ই নভেম্বরের প্রলয়ঙ্করী ঝড়ের পর বাঙালীদের রক্ষা করার জন্য তারা পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী সরকারকে যে জলযান ও হেলিকপ্টার প্রদান করেছিলেন, গত পাঁচমাস যাবৎ তা থেকেই কামানেরর গোলা ও বোমাবর্ষণ দ্বারা বাঙালী নিধন করা হয়েছে ও হচ্ছে। যুক্তরাষ্ট্রের মত জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষও জানেন, তাদের প্রেরিত খাদ্যসম্ভার ও সাহায্য সামগ্রী ক্ষুধার্ত বাঙালীদের কাছে যাচ্ছে না। তা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর রেশন ঘাটতি পুরো করা হচ্ছে এবং বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় তাদের অবস্থানের মেয়াদ বাড়ানোর কাজে সাহায্য দেয়া হচ্ছে৷ সুতরাং বাংলাদেশের দূর্ভিক্ষ-পীড়িত মানুষের জন্য মায়াকান্না কেঁদে লাভ কি? সারা এশিয়ায় আজ নিক্সন সরকারের মানবতাদ্রোহী ভূমিকা আজ স্পষ্ট। অতএব বাংলাদেশের দূর্ভিক্ষ নিবারণে জাতিসংঘ অথবা নিক্সন সরকার যদি কোন আন্তরিক তাগিদ অনুভব করেন, তাহলে তাদের উচিৎ হবে অবিলম্বে পিন্ডির দস্যু চক্রের প্রতি সকল প্রকার সাহায্য ও সমর্থন প্রত্যাহার করা।
***
পৃষ্ঠা – ৪
বিশ্বজনমতঃ আরব জাহানে জঙ্গী চক্রের মিথ্যা প্রচারণার গোমর ফাঁস
বাংলাদেশের জনগণের সমর্থনে বিশ্বের সকল শান্তিকামী দেশগুলোতে জনমত প্রবল হয়ে উঠেছে, আরব জাহানও এর ব্যতিক্রম নয়। অবশ্য ‘পাকিস্তানী’ এ্যামবেসী ও বেতারের জঘন্য ও উদ্দেশ্যমূলক অপপ্রচারের ফলে দীর্ঘদিন পর্যন্ত আরব রাষ্ট্রগুলো বাংলাদেশ সম্মন্ধে সত্য খবর থেকে বঞ্চিত ছিল।
আবাল বৃদ্ধ বণিতা নির্বিশেষে লক্ষ লক্ষ নিরস্ত্র বাঙ্গালীকে নির্বিচারে হত্যা, পাইকারী লুন্ঠন, নজিরবিহীন নারী নির্যাতন, অগ্নি সংযোগ, ভারী ট্যাংক ও উড়োজাহাজ ব্যবহার করে নাপাম বোমা প্রয়োগ এবং প্রায় এক কোটি বাঙালীকে মাতৃভূমি ত্যাগ করেও জল্লাদ ইয়াহিয়া বাহিনী স্বাধীনতা সংগ্রাম স্তব্ধ করে দিতে তো পারেই নি বরং দিন দিন তা জোরদার হচ্ছে, শত চেষ্টা করেও জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকার আরব জাহানে এই সব সংবাদ গোপন রাখতে পারেনি।
‘পূর্ব পাকিস্তানে’ মুসলমান সংখ্যা গরিষ্ঠ এই সংবাদেই আরব জাহানের সাধারণ নরনারী বাংলাদেশের বিরুদ্ধে পাকিস্তানী প্রোপাগাণ্ডায় ক্ষুব্ধ ও বিস্মিত হয়েছেন।
মধ্যপ্রাচ্যের ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব আবুল ফতেহ সম্প্রতি লন্ডনের এক সাংবাদিকের কাছে তার তিক্ত অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন। তিনি বলেছেন, খামাখা বাংলাদেশ বিরোধী এবং ভারত বিরোধী প্রচার কার্য চালিয়ে তিনি হয়রান হয়ে পড়েছিলেন। রাওয়ালপিন্ডির নির্দেশে পাকিস্তানের এক নম্বর দুশমন হিসেবে আরব জাহানের নরনারীর সামনে উপস্থাপন করা হয়েছে। এমনকি সর্বদা প্রচারিত হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশ সমস্যা নিয়ে ভারতের প্রধান মন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর পক্ষে যে কোন জায়গায় আলাপ আলোচনা করার জন্য প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া সবসময়ই রাজি আছেন।’
জনাব ফতেহ বলেন যে, অধিকাংশ আরব নেতা অবশ্য মনে করেন ইয়াহিয়া খান মিসেস গান্ধীর সঙ্গে আলাপ আলোচনা না করে বরং নির্বাচিত সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গে আলাপ আলোচনা করা উচিৎ।
আরব জাহানের সমর্থন লাভের প্রত্যাশায়, ভারত ও বাংলাদেশ বিদ্বেষ সৃষ্টি করার জন্য ‘পাকিস্তান সরকার’ বিভিন্ন পুস্তিকা ও ইস্তাহার গোপনে বিলি করেছে৷ তন্মধ্যে একটি হলো, ‘ভারতে অবস্থানরত ইস্রাইলীদের উস্কানীর দরুণ বাংলাদেশের আন্দোলন।’
আরব জাহানে পাকিস্তান সরকারের মিথ্যা অপপ্রচার অব্যাহত থাকলেও জনাব ফতেহ মনে করেন, আরব জাহানে এই প্রচার অবশ্যই ব্যর্থ হবে। তিনি জোর দিয়ে বলেন, আরবরা জাতি হিসেবে অভিন্ন ও এক হওয়া সত্ত্বেও ইসলাম ধর্মাবলম্বী আরববাসীরা নিজেদের প্রয়োজনেই ভিন্ন ভিন্ন স্বাধীন রাষ্ট্র গঠন করেছেন৷ সেক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জাতি হিসেবে বাংলাদেশ আলাদা। অতএব একমাত্র ধর্মীয় সংযোগের সুযোগ ধরে এক হাজার মাইল দূরত্বের বাংলাদেশের স্বাধীনতার বিপক্ষে কোন যুক্তিই আজ আরব জাহানের কাছে গ্রহন যোগ্য নয়। বাংলাদেশে পাক সেনাবাহিনীর নজিরবিহীন নিষ্ঠুরতা এবং ব্যপক গণহত্যা পাকিস্তানকে সমর্থনের ব্যাপারে আরব জাহানের নৈতিক অন্তরায়।
জঙ্গী নেতা ইয়াহিয়া খান অনর্গল বানোয়াট মিথ্যা প্রচার করে, সত্য গোপন করে আরব জাহানের কোটি কোটি নরনারীর শুভ বুদ্ধি, কল্যাণ বুদ্ধি এবং জাগ্রত বিবেককে আর ধোঁকা দিতে পারছে না। স্বাধীনতা ও গণতন্ত্রের সপক্ষে, সংগ্রামী বাংলাদেশের সমর্থনে আরব জাহানে দিন দিন জনমত গড়ে উঠছে।
***
পাকিস্তানঃ দুই রাষ্ট্র
বাংলাদেশের নির্যাতিত জনগণের সমর্থনে অস্ট্রেলিয়াতে জনসমর্থন তৈরী হচ্ছে। বুদ্ধিজীবী মহলে বাংলাদেশের সমস্যা গভীর আবেদন সৃষ্টিতে সক্ষম হয়েছে।
অস্ট্রেলিয়ার বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপকগণ সম্প্রতি ‘পাকিস্তানঃ দুই রাষ্ট্র ‘ এই শিরোনামায় সির্ডান মর্নিং হেরাল্ড-এ এক পত্র লেখেন। উক্ত পত্রে সাক্ষর করেন ডক্টর কলিন ম্যাকেরাস(মেলবোর্ন), ডক্টর এ, জি, এইচ, রেড (ক্যানবেরা), প্রফেসার ও, এইচ, কে, স্পেট, ডক্টর দেবেশ ভট্টাচার্য (সিডনি) এবং প্রফেসার ওয়াং গানউ ( ক্যানবেরা)।
পত্র লেখকগণ ইয়াহিয়া খানের নিষ্ঠুর নীতির কঠোর সমালোচনা করে বলেন যে, পাকিস্তানের সাম্প্রতিক ঘটনাই প্রমাণ করে যে ক্রমাগত বর্বর সন্ত্রাসবাদ চালিয়ে যেতে না পারলে বর্তমান সীমারেখা নিয়ে পাকিস্তান কিছুতেই টিকে থাকতে পারবে না। ইয়াহিয়া খানের জুয়াখেলার নীতি যে ব্যর্থ হচ্ছে বিভিন্ন সংবাপত্রে প্রকাশিত মুক্তি বাহিনীর গেরিলা আক্রমণের সফলতার সংবাদেই তা বোঝা যাচ্ছে। তদুপরি বিভিন্ন পররাষ্ট্র দফতরে কার্যরত বাঙ্গালী কুটনীতিবিদদের আচরণ বর্তমান সরকারের ব্যর্থতাকে সপ্রমাণ করে।
বাংলাদেশে সম্ভাব্য প্রচন্ড খাদ্যাভাবের সম্পর্কে তারা মন্তব্য করেন যে, সামরিক বাহিনীর অত্যাচার ও সন্ত্রাসের প্রতিক্রিয়ার ফলে দ্বিতীয় মহাযুদ্ধত্তর কালের প্রচন্ড খাদ্যাভাবের পরিস্থিতি বাংলাদেশেও বিরাজ করবে।
উক্ত পত্রে বায়াফ্রার ঘটনার সঙ্গে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের তুলনা করে বলা হয় যে, বাংলাদেশে যারা স্বাধীনতা সংগ্রামে নিয়োজিত তারাই পাকিস্তানের সংখ্যা গরিষ্ঠ এবং উভয় অঞ্চলের দূরত্ব প্রায় এক হাজার মাইল৷
উক্ত পত্রে বাংলাদেশের নির্যাতিত মানুষের আত্মনিয়ন্ত্রণের ন্যায় সঙ্গত দাবীকে সমর্থন করে এবং অবিলম্বে শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবী করে অস্ট্রেলিয়া সরকারকে সক্রিয় ভূমিকা গ্রহন করতে আবেদন করা হয়।
***
পৃষ্ঠা ৫
কালনেমীর লঙ্কা ভাগ নিয়ে ‘পাকিস্তানের’ শাসক চক্রের অন্তর্বিরোধ
[রাজনৈতিক ভাষ্যকার ]
হালে ভুট্টো সাহেবের মুখ থেকে কিছু বেসুরো বুলি বেরুতে শুরু করেছে। কিন্তু তিনি হয়তো এখনো বুঝতে পারেননি যে, নিজের কাঁধে বন্দুক রেখে পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে বাঙলাদেশের মানুষ শিকারের সুযোগ করে দেয়ায় শুধু বাঙলাদেশই নয় – তাদের নিজেদের স্বদেশ – খোদ পাকিস্তানেও গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করে দিয়েছেন। এখন বেসুরো বুলিতে তার পক্ষে কুল রক্ষা করা তার পক্ষে সম্ভব হবে না – শেষ পর্যন্ত মুখ রক্ষা করতে পারবেন কিনা সে সম্পর্কেও সন্দেহ রয়েছে।
টু মেজরিটি পার্টির থিয়োরির আবিষ্কর্তা ভূট্টো সাহেব বাঙলাদেশের গবর্নর পদে ডাঃ মালিকের নিয়োগ সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন যে, এর কোন জন প্রতিনিধিত্বশীল মর্যাদা নেই এবং এটা নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর বোঝায় না।
বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গবর্নর পদে ডাঃ মালিকের নিয়োগ যে অসামরিক ভৃত্য বহাল করার অধিক কোন ব্যাপার নয়, এই সহজ ও সাদা কথাটা দুনিয়ার সবাই বুঝেছে, তার জন্য ভূট্টো সাহেবের উর্বর মস্তিষ্কের ব্যাখ্যার কোন প্রয়োজন নেই। শুধু তার ওই বাঁকা সুরটাই যা একটু কৌতুকের উদ্রেক করে। ভূট্টোর কন্ঠে বেসুরো আওয়াজ কেন বাজতে শুরু করেছে সেইটেই বিচার্য।
আমরা জানি যে, পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বাঙলাদেশের এবং পশ্চিম পাকিস্তানের চারটি প্রদেশের উপর নিজেদের কর্তৃত্ব অটুট রাখার উদ্দেশ্যে কয়েকটি ব্যবস্থা গ্রহণ করেছে। বাঙলাদেশের নিরস্ত্র জন সাধারণের বিরুদ্ধে সশস্ত্র অভিযান এবং আওয়ামী লীগকে অবৈধ ঘোষণা করা এই পদক্ষেপের প্রথম ধাপ। দ্বিতীয় পদক্ষেপ হচ্ছে জাতীয় পরিষদের ৭৯ জন নির্বাচিত আওয়ামী লীগ প্রতিনিধির সদস্য পদ বাতিল করা। এখন সামরিক জান্তা তিনটি মুসলিম লীগকে একটি মুসলিম লীগে মিলিত করতে চাচ্ছে। সামরিক জান্তার চাপে তিন লীগের তিন নেতার আভ্যন্তরীণ কোন্দল সত্ত্বেও তিন লীগ শেষ পর্যন্ত একত্রিত হলে সামরিক জান্তা মুসলিম লীগের আটক তহবিল তাদের হাতে ছেড়ে দেবে বলে লোভ দেখিয়েছে। তা ছাড়া ২৮ জুনের ঘোষণাতেই ইয়াহিয়া খান জানিয়ে দিয়েছেন যে, পরিষদের উভয় অঞ্চল থেকে যে রাজনৈতিক দলের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না, সেই দল বা দলসমূহকে রাজনৈতিক দল হিসেবে কাজ করতে দেয়া হবে না।
বাঙলাদেশের বাতিল আসন গুলো এক্ষেত্রে টোপ হিসেবে ব্যবহার করা হবে৷ ইতিমধ্যেই তিন মুসলিম লীগের নেতাকে সামরিক জান্তা জানিয়ে দিয়েছে যে, তারা একত্রিত হতে পারলে এই আসনগুলো তাদের প্রার্থীদের মধ্যে বন্টন করা হবে। প্রাদেশিক পরিষদের ক্ষেত্রেও এই একই ব্যবস্থা গৃহীত হবে। তাহলে তারা সহজেই মুসলিম লীগের মাধ্যমে নিজেদের শাসন পাকা করে নিতে পারবে। অন্ততঃ সামরিক জান্তার কর্তৃত্ব বজায় রাখার জন্য এই স্ট্র্যাটেজিই তারা গ্রহণ করেছে।
এখানেই তাদের আভ্যন্তরীণ কোন্দল ঘনীভূত হয়ে উঠেছে। জানা গিয়েছে যে দৌলতানা এই মিলন প্রস্তাব বিবেচনার জন্যে কাউন্সিল লীগের মিটিং ডেকেছে। অপর দিকে কাইয়ূম খান ঘোষণা করেছে যে, ‘কভভি নেহি’। এদিকে যে ভূট্টোকে শিখন্ডী হিসেবে সামনে রেখে তারা বাঙলাদেশে সামরিক অভিযান চালাবার সুযোগ করে নিয়েছিল, বাঙলাদেশে সেই ভূট্টো সাহেবের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। বাঙলাদেশের সবকটি আসন মুসলিম লীগের দখলে গেলে ভূট্টো সাহেবের মসনদে বসবার কোন ভরসাই থাকে না। টু মেজোরিটি পার্টির থিয়োরীও খাড়া করা সম্ভব হবে না। এ অবস্থায় ভূট্টোর পক্ষে কিল খেয়ে কিল হজম করা ছাড়া গত্যন্তর থাকছে না। ইয়াহিয়া খানের চৌকিদারী মেনে নিয়ে জুনিয়র পার্টনার এবং ‘হাঁ হুজুরী মসনদদার’ হিসেবে থাকতে রাজি হলে ইয়াহিয়া সামরিক চক্র দু একটা আসন তার দলকে ছেড়ে দিয়ে উভয় অঞ্চলের প্রতিনিধিত্বের অধিকারী হবার সুযোগ দিলেও দিতে পারে। অবশ্য তাও নির্ভর করছে পশ্চিম পাকিস্তানে ভূট্টোর প্রভাব কতটা অক্ষুণ্ণ থাকছে এবং নিজের দলকে কতটা বাগে রাখতে পারছে তার ওপর। কিন্তু ভূট্টোর একজন জাঁদরেল শত্রু প্রাক্তন তথ্য মন্ত্রী শের আলী খান তাকে সহজে পথ করে নিতে দেবে বলে পর্যবেক্ষক সহল মনে করেন না। সেই জন্যেই বর্তমানে অভিমমানী দুলালীর মত মাঝে মাঝে বাঁকা সুরে কথা বলতে চেষ্টা করছে।
এই লঙ্কা ভাগের পরিকল্পনায় সব চেয়ে বেকায়দায় পড়েছে জামাতে ইসলামী। জাতীয় পরিষদে বাঙলাদেশ থেকে তাদের কোন প্রতিনিধিত্ব নেই। অথচ এই বাতিল আসনের কোন অংশও তাদের বরাদ্দ করতে সামরিক চক্র প্রস্তুত নয়। অথচ মুখ বুঁজে কিল হজম করে সামরিক চক্রকে সমর্থন জানিয়ে যাওয়া ছাড়া অন্য কোন পথও বর্তমানে তারা খুঁজে পাচ্ছে না।
পশ্চিম পাকিস্তানের পান্জাবী সামরিক চক্রের এই নতুন রাজনৈতিক উদ্যোগের ফলে পশ্চিমা পাকিস্তানের বিভিন্ন প্রদেশের এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে অসন্তোষ প্রকট হয়ে উঠছে। তারা এখন উপলব্ধি করতে শুরু করেছে যে, বাঙলাদেশে সমস্যা সৃষ্টি করে সামরিক জান্তা স্থায়ীভাবে পশ্চিম পাকিস্তানের কাঁধে সিন্দাবাদের সাগর বুড়োর মত চেপে বসেছে। তাদের নিরঙ্কুশ গণতান্ত্রিক জীবন ব্যবস্থায় ফিরে যাবার কিম্বা বিভিন্ন প্রদেশের পূর্ণ স্বায়ত্ত শাসনের অধিকার পাবার সম্ভাবনা এর ফলে বানচাল হয়ে গিয়েছে। চারটি প্রদেশে বিভক্ত হলেও সামরিক জান্তার চৌকিদারীত্বের আড়ালে পান্জাবী শাসন ও শোষণের এক ইউনিট ব্যবস্থাই প্রকৃত পক্ষে বহাল থাকছে অথচ প্রাদেশিক প্রশাসন ব্যবস্থার বাড়তি খরচাটা জুগিয়ে যেতে হবে প্রদেশ গুলোকে।
সীমান্তের উপজাতীয় এলাকার মানুষগুলো সামরিক জান্তার এই ষড়যন্ত্রকে সহজ ভাবে মেনে নিতে পারেনি। তার ওপর বাঙলাদেশে হত্যা যজ্ঞের খরচ তুলে নেবার জন্য একশ’ ও পাঁচশ’ টাকার নোট অচল করে দেয়ায় সীমান্তের বহু লোক রাতারাতি নিঃস্ব হয়ে গিয়েছে। সামরিক শাাসন চক্র পেছন দরজা দিয়ে এভাবে সম্পূর্ণ অজ্ঞাতে তাদের পকেট কাটবে বা কাটতে পারে সীমান্তের এবং উপজাতীয় এলাকার মানুষেরা তা ভাবতে পারেনি। হঠাৎ করে পথে পকেট কাটার ঘটনায় তারা আরও বেশি চটেছে।
এখন তারা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাকে প্রতিহত করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। উপজাতি অঞ্চলে বিশ হাজারেরও বেশি লোখ গেরিলাযুদ্ধের জন্যে প্রস্তুত হচ্ছে বলে জানা গেছে। এককালে ইপির ফকিরের অনুগামীদের অনেকেই এতো যোগ দিয়েছেন। সীমান্তের উপজাতি এলাকায় প্রচলিত পথে যুদ্ধ করাও সম্ভব নয়। একমাত্র পথ আকাশ পথে বোমা বর্ষণ। এতে পরিস্থিতি আরও অবনতি ঘটার আশঙ্কা রয়েছে। বাঙলাদেশেই তাদের নাজেহাল অবস্থা। তারপর একেবারে নিজের ঘরে আরেকটা যুদ্ধে লিপ্ত হওয়ার মারাত্মক পরিণতির কথা ভেবে তারা খুবই সন্ত্রস্ত। তাই তারা বাঙলাদেশে মুক্তি যুদ্ধ সম্পর্কে বিভ্রান্তিকর প্রচারণা, ভারতের ভূমিকা সম্পর্কে মিথ্যা ও মনগড়া কুৎসা রটনা এবং ইসলামের দোহাই পেড়ে সেখানকার পরিস্থিতি নিজেদের আয়ত্তে রাখার চেষ্টা করছে। রেডিও পাকিস্তানের সাম্প্রতিক প্রচারণার ধারা থেকে এই সত্য আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
কিন্তু বাঙলাদেশে রাজনৈতিক বাঁটোয়ারার কোন পরিকল্পনাই তারা কাজে লাগাতে পারছে না মুক্তি বাহিনীর দূর্বার আক্রমণের মুখে। মাঝখান থেকে আরো জটিল জালে তারা জড়িয়ে পড়ছে।
পৃষ্ঠা ৬
গেরিলা যুদ্ধ কি ও কিভাবে
গেরিলা যুদ্ধ বলতে বোঝায় হঠাৎ আক্রমণ করে শত্রু নিধন, শত্রুর সরবরাহ ব্যবস্থা বানাচাল করে সরে পড়া। গেরিলাদের থাকতে হয় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে, জনসাধারণের সাথে মিশে। বিখ্যাত যুদ্ধ বিশারদ জেনারেল গ্রিভাস বলেছেন, গেরিলা যুদ্ধের জয় পরাজয় নির্ভর করে গণসমর্থণের ওপর। সব সময়ই তাকে মনে রাখতে হবে গণ সমর্থনের কথা। গেরিলা যুদ্ধের মূল ভিত্তি হচ্ছে একটি দেশে সংখ্যা গরিষ্ঠ জনসাধারণের অকুণ্ঠ সহযোগিতা ও বিশ্বাস।
গেরিলা যোদ্ধাদের নানা গুণ থাকতে হয়। গেরিলা যোদ্ধাদের হতে হয় প্রত্যুৎপন্ন মতিত্ব বুদ্ধি সম্পন্ন। ধরা বাঁধা পথে এই যুদ্ধ হয় না৷ সব সময় নিতে হয় অবস্থা বুঝে ব্যবস্থা। যেহেতু গেরিলারা যুদ্ধ করে আপন ইচ্ছায়, তাই তাদের একতার মূল উৎস হচ্ছে লক্ষের প্রতি অটুট বিশ্বাস। সবাইকে নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ চলে না। যারা একটি নির্দিষ্ট নীতিতে অটুট বিশ্বাস রাখে, তারাই চালিয়ে যেতে পারে গেরিলা যুদ্ধ। সাধারণ যুদ্ধে যুদ্ধরত দুই পক্ষ যেসব সুযোগ সুবিধা পায়, গেরিলারা তা পায় না। দুটি দেশ বা ফৌজ যখন যুদ্ধ করে, তখন ধরে নেওয়া হয়, তারা লড়াই করছে দুটি দেশ বা রাষ্ট্রের স্বার্থে। এইসব যুদ্ধে কতগুলি নিয়ম কানুন থাকে। তাদের সাথে থাকে সরকারী রক্ষাকবচ। এক পক্ষের ফোজের কাছে অপর পক্ষের ফৌজ আত্মসমর্পণ করলে তাকে মেরে ফেলা হয় না। কিন্তু গেরিলা যুদ্ধের ক্ষেত্রে এসব কথা মানা খাটে না। শত্রুর হাতে পড়লে তাদের প্রাণনাশ অবধারিত। কিন্তু তবু গেরিলারা লড়াই করে – আদর্শের উপর অবিরল আস্থা থাকে বলেই তারা লড়াই চালিয়ে যেতে পারে। নিয়ম বাঁধা ফৌজরা যেরকম খেতে পায়, টাকা পায়, গেরিলারা তা পায় না। প্রতিকূল অবস্থায় অত্যন্ত কষ্ট করেই তাদের চালিয়ে যেতে হয় সংগ্রাম। তারা যা সাহায্য পায় তা হচ্ছে জনসাধারণের কাছে থেকে। তাই এমন কিছু করা চলে না যাতে জনসাধারণ বিরূপ হয়ে ওঠে, জনসাধারণের সাথে তাদের সদ্ভাবের অভাব ঘটে। গেরিলাদের এমন আচরণ করতে হয় যাতে জনসাধারণ বুঝতে পারে গেরিলারা তাদেরই লোক আর গেরিলাদের বিজয়ের ওপরই নির্ভর করছে তাদের ভবিষ্যৎ।
গেরিলা যুদ্ধের কায়দা সাধারণ যুদ্ধ থেকে আলাদা। গেরিলাদের থাকতে হয় সবসময় ছোট ছোট দলে বিভক্ত হয়ে। আক্রমণের সময় দশ এগারো জনের বেশি একসাথে যাওয়া উচিৎ নয়৷ জেনারেল গ্রিভাস মনে করেন চার পাঁচ জনের বেশি একসাথে আক্রমণে যাওয়া উচিৎ নয়৷
গেরিলাদের অস্ত্রপাতি সম্পর্কে গেরিলা যোদ্ধা বিশারদদের অভিমত হলো, অস্ত্র হতে হবে হালকা, যাতে সহজে বহন করা যায়, মাও সেতুং এর মতে সাধারণ মাংস কাটা ছুরিও, গেরিলারা নিজেদের পছন্দ মত হালকা বন্দুক, হাত বোমা ইত্যাদি নিজেরাই তৈরী করে নেয়। পরে যুদ্ধ এগিয়ে যাবার সাথে সাথে শত্রুর কাছ ছিনিয়ে নেয়া অস্ত্রশস্ত্রের ব্যবহারও শুরু হয়। যে ক্ষেত্রে বাইরে থেকে সাহায্য পাওয়া সম্ভব, সেক্ষেত্রে অন্যান্য অস্ত্রও ব্যবহার করে গেরিলারা। ভিয়েতনাম যুদ্ধে গেরিলারা হ্যান্ড প্রেসেও, কামরমাইলা মলোটিভ ককটেল, প্লাস্টিক বোমা ইত্যাদি ব্যবহার করছে। পরে ব্যবহার করেছে হালকা মেশিনগান, অটোমেটিক রাইফেল, মর্টার বাজুকা ইত্যাদি।
গেরিলাদের দমন করার জন্য যে সব পাল্টা ব্যবস্থা গ্রহন করা হয় তার মধ্যে রয়েছে গেরিলাদের কোন এলাকায় আটকে খাদ্য সরবরাহ বন্ধ করে না খাইয়ে মারা। গেরিলাদের দমন করতে হলে জানতে হয় কোন এলাকায় তারা আছে এবং কিভাবে আছে।
তাই গেরিলা বিরোধী অভিযানে গোয়েন্দা রেকি ভাগের ভূমিকা গুরুত্বপূর্ণ। গেরিলাদের তাই অবলম্বন করতে হয় যথেষ্ট গোপনীয়তা, অনেক সময় তাদের খতম করতে হয় শত্রুর দালালকে, সৃষ্টি করতে হয় ভীতি যাতে গেরিলাদের চালচলনের ওপর কেউ লক্ষ্য রাখার সাহস না পায়। কিন্তু গেরিলাদের আবার লক্ষ্য রাখতে হয় যাতে নিরপরাধ লোক দালাল রূপে চিহ্নিত হয়ে মারা না পড়ে। কারণ ওতে জনমত বিরুদ্ধে চলে যায়। জনসাধারণ বিরূপ হলে গেরিলা যুদ্ধ চলে না। নির্বিকার লোক খুন তাই পরিহার করতে বলেছেন প্রায় সকল গেরিলা বিশারদেরা।
গেরিলাদের আহারের জন্য নির্ভর করতে হয় জনসাধারণের ওপর। এই আহার্য সরবরাহ, যতদূর সম্ভব হতে হবে জনসাধারণের আপন ইচ্ছায়। জোর করে লুটপাট করে খাদ্য শস্য নেবার প্রয়োজন মাঝে মাঝে হতে পারে। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রেই এই নীতি পরিত্যাজ্য। কারণ তাতে লোকে গেরিলাদের উপর আস্থা হারায়। গেরিলাদের দল তখন পরিগণিত হয় ডাকাতের দল হিসেবে। মাও সেতুং বলেছেন, গেরিলাদের থাকতে হবে সাধারণ মানুষের মধ্যে স্বাভাবিক ভাবে মাছ যেমন থাকে পানির মধ্যে। গেরিলা যোদ্ধাদের তাই কেবল যুদ্ধ করলেই হয় না, জনসাধারণকে বোঝাতে হয় যুদ্ধের রাজনৈতিক তাৎপর্য। গেরিলারা একদিকে যেমন যোদ্ধা তেমনি আবার রাজনৈতিক কর্মী।
বাঙলাদেশে আজ যে গেরিলা যুদ্ধ চলছে, তা একটা জাতির স্বাধীনতা যুদ্ধ। জনসাধারণকে বোঝাতে হবে স্বাধীনতার তাৎপর্য। গেরিলাদের হতে হবে সৎ, নির্ভিক দেশ প্রেমিক মানুষের আদর্শ।
একটা দেশের মধ্যে যখন যুদ্ধ হয়, তখন সেই দেশের মানুষকে ক্ষয়-ক্ষতি স্বীকার করতে হয় প্রচুর। গেরিলাদের শত্রুর সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করার জন্য ভাঙতে হয় বড় সেতু, উড়িয়ে দিতে হয় রেললাইন, বিচ্ছিন্ন করতে হয় নানা ভাবে যোগাযোগ ব্যবস্থা। কিন্তু সবসময়ই মনে রাখতে হবে, যা কিছু ধ্বংস করা একান্ত প্রয়োজন, তাই ধ্বংস করতে হবে। অযথা জনগণের অসুবিধা সৃষ্টি করা চলবে না। সবসময় আক্রমণের লক্ষ্যবস্তু সম্পর্কে যথেষ্ট বিষয় বিবেচনা করে সিদ্ধান্ত নিতে হবে। শৌখিন ভাঙনের নেশা নিয়ে গেরিলা যুদ্ধ হয় না। গেরিলা যুদ্ধ সাধারণ যুদ্ধের চাইতে অনেক বেশি ভাবনা চিন্তার ব্যাপার। এখানে প্রতিটি সৈন্যকেই চিন্তা করতে হয় অনেক কিছু। কারণ এ যুদ্ধ কেবল সেনাপতির হুকুমে পরিচালিত যুদ্ধ নয়। আদর্শ ও দেশপ্রেমে উদ্বুদ্ধ যুদ্ধ।
***
বাংলাদেশ শিল্পীদের চিত্র প্রদর্শনী
(কলকাতা প্রতিনিধি)
কলকাতাঃ সাদার্ন এভিন্যুর বিড়লা ললিত কলা একাডেমিতে বাংলাদেশের ষোল জন চিত্র শিল্পীর শিল্প কর্মের এক প্রদর্শনী শুরু হয়েছে। প্রতিটা শিল্পকর্মে শিল্পীরা যেন নিজেদের চোখের অবিশ্রাম জলের ধারাকে যেন রঙ হিসেবে ব্যবহার করে বাংলাদেশের মর্মন্তুদ ঘটনাবলীকে বিধৃত করেছেন ক্যানভাসের গাত্রে। তুলির প্রতিটি পোঁচে খাঁকী ইউনিফর্মের বর্মে আচ্ছাদিত পশ্চিম পাকিস্তানী পশুদের হিংস্রতার রূপ ক্যানভাসে জীবন্ত রূপ দেয়া হয়েছে।
প্রদর্শনীতে অন্যান্যদের মধ্যে বাংলাদেশের খ্যাতনামা চিত্র শিল্পী কামরুল হাসান, দেবদাস চক্রবর্তী, স্বপন চৌধুরী, গোলাম মোহাম্মদ, চন্দ্র শেখর, মোস্তফা মনোয়ারের ছবি রয়েছে।
প্রদর্শনী ১৩ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত খোলা থাকবে।
***
পৃষ্ঠা ৭
ইয়াহিয়ার ‘অনুকম্পা’ বাঙালীর জন্য মৃত্যু ফাঁদ
অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের স্বয়ং নিযুক্ত প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান বাংলাদেশের যুদ্ধে ‘রাষ্ট্র বিরোধী ‘ কার্যকলাপের জন্য অভিযুক্ত ব্যক্তিদের প্রতি ‘সাধারণ অনুকম্পা’ ঘোষণা করেছে। সেই ঘোষণায় অবশ্য এ কথাও বলা হয়েছে যে, ইতিমধ্যেই যাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ আনা হয়েছে, তারা এই ‘সাধারণ অনুকম্পার’ আওতায় পড়বে না।
বাংলাদেশের মানুষ বেওয়ারিশ মাল নয় যে, ইয়াহিয়া খানের মেজাজ মর্জি মাফিক তাদের ইচ্ছা করলেই যথেচ্ছ ভাবে হত্যা করা যাবে কিম্বা ভবিষ্যতে প্রয়োজন বুঝলে হত্যা করার জস্যে ইয়াহিয়া খানের খোঁয়াড়ে পুরে রাখা যাবে। তবে সে প্রশ্ন না তুলেও বলা যায় যে, এই তথাকথিত অনুকম্পা সম্পর্কিত ঘোষণায় কানাকড়ি সত্যতার বালাইও নেই। ঘোষণাটি বিশ্লেষণ করলেই তা ধরা পড়বে।
প্রথমতঃ এই তথাকথিত ‘অনুকম্পা ‘র ঘোষণার আওতা থেকে বাঙ্গালী জাতির অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান এবং আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বাদ দেওয়া হয়েছে।
এর অর্থ হলো বাঙলাদেশের মানুষ এক বাক্যে যাদেরকে নিজেদের জাতীয় প্রতিনিধি হিসেবে নির্বাচিত করেছিল এবং বর্তমানে যার নেতৃত্বে তারা মুক্তি সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে তাদেরকে বিচ্ছিন্ন করার প্রয়াস৷ এই মুক্তি সংগ্রামে এবং আওয়ামী লীগের নেতৃবৃন্দের প্রতি বাঙলাদেশের মানুষের কোন সমর্থন নেই, ‘মুষ্টিমেয় বিচ্ছিন্নতাবাদী ও ভারতীয় এজেন্টদের প্ররোচনায়’ এরা বিভ্রান্ত হয়েছিল, ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার প্রতিই সাধারণ মানুষের সমর্থন রয়েছে, এটা বিশ্বের সামনে তুলে ধরাই এই ঘোষণার মূল উদ্দেশ্য।
তাছাড়া মুক্তি বাহিনীর গেরিলা এবং কমান্ডো আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তাদের নাভিশ্বাস উঠেছে৷ আপ্রাণ চেষ্টা করেও বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় স্বাভাবিক অবস্থা ফিরিয়ে আনা দূরের কথা, নুন্যতম প্রশাসনিক ব্যবস্থাও চালু করতে পারেনি। অপরদিকে মুক্তিবাহিনীর দূর্বার আক্রমণে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ ও রাজাকারদের মনে প্রচন্ড মৃত্যু ভীতি দেখা দিয়েছে। তারা ছুটির দরখাস্ত করতে শুরু করেছে। তাই বাঙালী পুলিশ, মুজাহিদ, আনসার এবং সশস্ত্র বাহিনীর বাঙালী কর্মচারীদের এই তথাকথিত ‘অনুকম্পা ঘোষণা’র আওতায় আনা হয়েছে। তাদের আশা এই যে, সংশ্লিষ্ট ব্যাক্তিরা এই টোপ গিললে মুক্তিবাহিনীতে বিভেদ সৃষ্টি করা যাবে এবং তাদের প্রশাসনিক কাজে নিয়োগ করে পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশদের বর্তমান দায়িত্ব থেকে অব্যহতি দেওয়া যাবে। ফলে বাঙ্গালীদের দিয়ে বাঙালী হত্যার সুযোগ পাওয়া যাবে।
বাঙলাদেশের ঘটনা সম্পর্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের আগামী অধিবেশন, কুয়ালালামপুরের কমনওয়েলথ পার্লামেন্টারি সম্মেলনে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে বিরূপ প্রতিক্রিয়া মোকাবিলার উদ্দেশ্যে একটি আনাড়ি চাল হিসেবে এই তথাকথিত ‘অনুকম্পার ঘোষণা’টি প্রচার করা হয়েছে।
জল্লাদ ইয়াহিয়া খানের উক্ত ঘোষণায় জাতি ধর্ম বর্ণ নির্বিশেষে সকলের প্রতি স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের এবং স্ব স্ব কাজে নিয়োগের আহ্বান জানানো হয়েছে৷ এই আহ্বানটিও একটা প্রচন্ড ভন্ডামি ও ধাপ্পা ছাড়া আর কিছুই নয়। পাকিস্তানের নাগরিক হওয়া সত্ত্বেও ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী সরকারীভাবেই হিন্দু নিধন যজ্ঞে প্রবৃত্ত হয়েছিল। পাকিস্তানী সংবাদপত্র এবং সরকারী বেতার সামরিক জান্তার এই হিন্দু বিরোধী নীতির ব্যাপারে কোনরকম গোপনীয়তার আশ্রয়ই গ্রহন করেনি। শুধু তাই নয়, ইয়াহিয়া খানের এই তথাকথিত ‘অনুকম্পা ঘোষণা’র পরও বাঙালী জাতীয়তাবাদী শক্তি এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়, বিশেষ করে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের প্রতি পাকিস্তানী সরকারী বেতারে বিষোদগার অব্যাহত ভাবে চলছে৷ এখন স্বভাবতই প্রশ্ন উঠে ইয়াহিয়া খানের এই তথাকথিত ‘অনুকম্পা ঘোষণা’র পরিপ্রেক্ষিতে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা বাঙলাদেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি ঢালাও অভিযোগ এনে তাদের নৃশংস হত্যাকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গাইতে চেষ্টা করছে, সেই অভিযোগ মিথ্যা বলে স্বীকার করতে তারা কি প্রস্তুত? অবশ্য পাকিস্তানী বেতারের প্রচারণা থেকে তা মনে করার কোন কারণ নেই। কাজেই ধর্ম ও সম্প্রদায় নির্বিশেষে সকলকে স্বগৃহে প্রত্যাবর্তনের আহ্বান জানানোর অর্থ হচ্ছে, সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে পুনরায় জামিন হিসেবে ব্যবহার করার সুযোগ গ্রহণের চেষ্টা তারা করছে বঙ্গবন্ধুকে ফাঁসি দেবার হুমকি দিয়ে।
ইয়াহিয়া খানের প্রতিশ্রুতির যে কানাকড়িও মূল্য নেই, প্রতিশ্রুতি ভাঙার জন্যই এই ঘাতক প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে, বাঙলাদেশের মানুষ তা জীবন দিয়ে বুঝতে পেরেছে। তারা এও জানে যে, প্রতিকূল বিশ্ব জনমতের চাপে এবং মুক্তিবাহিনীর মরণ আঘাতের মুখে পাকিস্তানী সামরিক জান্তার টালমাটাল অবস্থা সামাল দেবার জন্য ইয়াহিয়া খান নতুন চাল চেলেছে।
বাঙলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় মানুষ নিজেদের বাসভূমিতে ফিরে যাবে বাঙলার মাটি থেকে ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার পর৷ নিজেদের অধিকারের দাবীতে সে জন্য অবৈধ ঘাতক ইয়াহিয়া সরকারের ‘অনুকম্পার’ প্রয়োজন নেই। খুনী ইয়াহিয়া সরকার তা জানে বলেই ক্ষণে ক্ষণে বুলি ও ভোল পাল্টে বাঙলাদেশের মানুষকে হত্যা করার নতুন পায়তারা করছে।
***
বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের প্রতি জঙ্গীশাহীর নির্দেশ
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)
ইয়াহিয়ার রক্তখেকো সামরিক জান্তা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তিন জন, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন, বাংলা একাডেমির একজন গবেষক, ১৩ জন সি, এস, পি এবং ৪৪ জন ই, পি, সি, এস অফিসারকে তাদের সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার ফতোয়া জারী করেছে।
শিক্ষকদের মধ্যে রয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাস্ট্র বিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ডঃ মোজাফফর আহমদ চৌধুরী, অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক, ইংরেজি বিভাগের প্রধান ডঃ সারোয়ার মোর্শেদ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের প্রধান ডঃ মজহারুল ইসলাম, বাংলা একাডেমির গবেষক জনাব আবু জাফর শামসুদ্দিন। সামরিক আদালতে হাজির অন্যথায় তাদের অনুপস্থিতিতে বিচারের হুমকি দেওয়া হয়েছে।
সামরিক জান্তা যে ১৩ জন সি, এস, পি অফিসারকে তাদের বেয়নেটের সামনে কন্ঠনালী এগিয়ে দিতে বলা হয়েছে, তাদের মধ্যে রয়েছেন জনাব আনাদুজ্জামান, সৈয়দ আবদুল সামাদ, জনাব তৌফিক এলাহী, জরাব কুদরত এলাহী, জনাব নুরুল কাদের খান, জনাব খসরুজ্জামান চৌধুরী, জনাব রফিক উদ্দিন আহমদ, জনাব ওয়ালি উল ইসলাম, জনাব কামাল সিদ্দিকী, জনাব আকবর ও জনাব সাহাদাৎ হোসেন।
***
পৃষ্ঠা ৮
রণাঙ্গনেঃ
মুক্তি বাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রু সেনার ওপর প্রচন্ড চাপ অব্যাহত রেখে প্রচুর খান সেনা হতাহত, রাস্তা ঘাট, রেল সেতু, ট্রাক, জীপ, ট্রেন ও বৈদ্যুতিক ব্যবস্থার ব্যাপক ক্ষতি সাধন করেছেন।
মুক্তি যোদ্ধারা ঢাকার বৈদ্যের বাজার, কইকারদের, সোনারগাঁও এবং আনন্দবাজার শত্রু কবল মুক্ত করেছেন। তাছাড়া কুমিল্লা জেলার সালদা নদী ও সেখের বাজার এলাকাও মুক্ত করা হয়েছে। মুক্তি যোদ্ধারা ঐ সব এলাকায় বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করেছেন।
গত ৪ঠা ও ৫ই সেপ্টেম্বর যশোর, রাজশাহী, পাবনা ও কুষ্টিয়া জেলার বিভিন্ন অঞ্চলে মুক্তি বাহিনীর কমান্ডো আক্রমণে ১০ জন রাজাকার নিহত হয়েছে।
গত ৩রা সেপ্টেম্বর যশোর জেলার ধুলিয়ানিঘাট গ্রামে হানাদার সৈন্যরা যখন লঠতরাজ চালাচ্ছিল, মুক্তি যোদ্ধারা তখন সেখানে গিয়ে আক্রমণ করেন। আক্রমণে ৫ জন পাকিস্তানী সৈন্য খতম হয়।
রাজশাহী সেক্টর থেকে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ, নাটোরের দূর্গাপুর থানা এলাকায় মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমণে পাক সেনাদের পদালেহী দালাল, রাজাকার ও বর্বর সৈন্যরা ভীত সন্ত্রস্ত হয়ে পড়েছে। এ সম্পর্কে আসাদের সংবাদদাতা রণাঙ্গন থেকে জানাচ্ছেন যে, গত ২১শে আগস্ট অত্র থানার একটি এলাকায় ৫০-৬০ জনের একটি রাজাকার দল মুক্তি বাহিনীর ওপর আক্রমণের দুঃসাহস করলে স্বাধীনতাকামী তরুণ গেরিলা যোদ্ধারা তা প্রতিহত করে তীব্র পাল্টা আক্রমণ চালিয়ে ৯ জনকে খতম এবং ১২ জনকে গুরুতরভাবে জখম করেছেন। ঐ একই দিনে তথাকথিত শান্তিকমিটির সদস্য গণধিকৃত কুখ্যাত আবদুল কাদেরকে গেরিলা যোদ্ধারা হত্যা করেছেন।
গত ২৩শে আগস্ট নাটোরের দুর্গাপুর থানার কাশিপুর স্কুলে অবস্থানরত একদল তরুণ যোদ্ধা এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১১ জন হানাদার সৈন্যকে খতম ও বহু সংখ্যক সৈন্যকে আহত করেছেন। গেরিলা যোদ্ধারা উক্ত স্থান থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করেছেন।
এদিকে গত ২৫ শে আগস্ট দূর্গাপুর থানার অধীন আমগ্রামে গেরিলা বাহিনী রাজাকারদের একটি দলের উপর চোরাগোপ্তা হামলা চালিয়ে ৪ জনকে খতম করেন। এছাড়া তথাকথিত শান্তি কমিটির কুখ্যাত দালাল আবিদ আলীকেও খতম করেছেন।
আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন, গত ২৪শে আগস্ট গেরিলা যোদ্ধারা রাজশাহী বিদ্যুৎ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন করে দিলে সারা শহর গভীর অন্ধকারে তলিয়ে যায়। অন্যদিকে গাক সেনাদের পদলেহী দালাল বেতার পরিচালক (মোহাম্মদ সাইফুল্লাহ) দুইদিন বেতার চালু করতে ব্যর্থ হয়। ফলে দখলদার সেনার দিশেহারা ও বিব্রত হয়ে পড়ে।
বিলম্ব খবরে প্রকাশ, মুক্তি বাহিনীর তরুণ যোদ্ধারা গত ১৬ই আগস্ট বিক্রমপুরের শ্রীনগর থানা আক্রমণ করে ৩০ টা রাইফেল দখল করে নেয়৷ গেরিলা যোদ্ধারা পরবর্তীতে থানা ও পোস্ট অফিসে অগ্নি সংযোগ করে দেন।
আমাদের তরুণ যোদ্ধারা খান সেনাদের পাঁচটা দালাল মমিন খাঁ, চেয়ারম্যান ফাহিমউদ্দীন ও অন্য দুজনকে প্রকাশ্যে গুলি করে হত্যা করেছেন।
পূর্ব রণাঙ্গন থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, গত সপ্তাহে মুক্তিবাহিনী সিলেটের পাচারা, চরনল, আজনাপুর ও চাদপুর এবং কুমিল্লার নয়ানপুর, চানলা, মন্দভাগ এলাকায় শত্রুঘাটির ওপর সাফল্যজনক আক্রমণ চালিয়ে ৫৭ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদে পদলেহী ২৪ জন রাজাকাকে খতম করেছেন।
এই সব আক্রমণে ২৫ জন খান সেনা গুরুতর রূপে আহত এবং ৩ জন পাকিস্তানী সৈন্য ও ৯ জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর হাতে বন্দী হয়। এছাড়া স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা কলাচোরা ও সুলতানপুরে শত্রু সেনার কাছ থেকে প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নিয়েছেন।
সম্প্রতি মুক্তি বাহিনীর পোঁতা মাইনে একজন কর্ণেল সরফরাজ খান খতম হয়েছেন।
***
চোস্ত পাজামার জয়
চোস্ত পাজামা’ বলে সমধিক পরিচিত সামরিক জান্তার পাদুকালেহী মাহম্মুদ আলীকে জাতিসংঘের আসন্ন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে পাকিস্তানী প্রতিনিধি দলের নেতা মনোনীত করা হয়েছে।
***
বাংলাদেশ ফুটবল দল
গত ৫ই সেপ্টেম্বর পশ্চিম বাংলার বর্দ্ধমানের ক্যাম্পিং গ্রাউন্ডে বাংলাদেশ একাদশের সাথে শৈলেন মান্না একাদশের একটি প্রদর্শনী ফুটবল প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়। টিকেট বিক্রয় লব্ধ অর্থ বাংলাদেশের সাহায্যার্থে দান করা হয়। বাংলাদেশ দল প্রতিযোগিতায় ৩-০ গোলে বিজয়ের গৌরব অর্জন করে। বাংলাদেশের পক্ষে তাসলিম দুইটি এবং সূর্য্য হাজরা একটি গোল করেন। বাংলাদেশ ফুটবল একাদশের অধিনায়কত্ব করেন আইনুল হক।
খেলার শুরুতে বাংলাদেশের পতাকা উড্ডীন করা হলে হাজার হাজার দর্শক এক মিনিট নীরবে দন্ডায়মান থেকে লাখো শহীদের আত্মার প্রতি সম্মান জানান।
বাংলাদেশ জাতীয় একাদশ দল শীঘ্রই মোজাফফরপুর, পুর্ণিয়া, বেনারস, বোম্বে ও দিল্লীতে খেলায় অংশ গ্রহণ করতে যাবেন।
ইউনিকোডে টাইপ- Maruf Muktadir Khan