You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ৩ সেপ্টেম্বর ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পাতা-১

জয়বাংলা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র

রেজিস্টার্ড নম্বর-১(বাংলাদেশ সরকার)

শাসকচক্র সুবিচারের সামান্যতম মুখোশটুকুও ছুড়ে ফেলে দিয়েছেঃ বিবাদী পক্ষে কৌশলী রাখা আর প্রয়োজনীয় নয়ঃ  সাক্ষ্য গ্রহণ বা বাতিলের ক্ষমতা জল্লাদের হাতে ন্যাস্ত।

তবে কি ওরা বঙ্গবন্ধুকে ফাসী দেবেই?

[রাজনৈতিক ভাষ্যকার]

সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর অবিসম্বাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বব্যাপী তীব্র প্রতিবাদ সত্বেও পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিচারের প্রচলিত বিধানের সামান্যতম মুখোস টুকুও ছুড়ে ফেলে দিয়েছে। এখানে প্রাপ্ত এক খবরে জানা গিয়েছে যে, ৮৮ নং সামরিক আইন বিধি অনুযায়ী এই বিচার প্রহসনের সংশোধিত। পদ্ধতি অনুযায়ী আদালতে বিবাদী। পক্ষের উকিলের উপস্থিতির কোন প্রয়োজন হবে না। এই সংশোধনী বলে সাক্ষ্য প্রমাণ সংক্রান্ত বিধিও সংক্ষিপ্ত করা হয়েছে এতে। প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথভাবে নথীভুক্ত না করে, শুধু প্রদত্ত সাক্ষ্যের স্মারকলিপি বা সংক্ষিপ্তসার (মেমোরান্ডাম) নথীভুক্ত করা হবে। তাছাড়া কোন সাক্ষ্যকে তাদের অভিমত অনুযায়ী বিরক্তিকর, কিম্বা বিচারে বিলম্ব ঘটতে পারে অথবা “বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে” বলে মনে হলে সামরিক আদালত তা বাতিল করতে পারবে।

এই সংশোধনী থেকে এ কথাই প্রমাণিত হয় যে, সামরিক জান্তা বঙ্গবন্ধুকে অপরাধী বলে ঘোষণা করে তাকে প্রাণদণ্ডদানের পথে সামান্যতম অন্তরায় রাখতে চায়না। ইতিমধ্যেই গোপনে সামরিক আদালতে জনগণের ভোটে নির্বাচিত জাতীয় নেতার বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন আইনজ্ঞ ও আন্তর্জাতিক জুরিষ্ট কমিশন বৈধতার প্রশ্ন ও মানবাধিকার লংঘনের অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। কিন্তু সামরিক জান্তা তাতে কর্ণপাত না করে এক তরফা ভাবে দণ্ডদানের ব্যবস্থা সম্পন্ন করতে বদ্ধপরিকর।

গোপনে বিচারের ব্যবস্থা করার পরও আদালতে বিবাদী পক্ষের কৌশুলীর উপস্থিতির প্রয়োজনীয়তা রহিত করার কয়েকটি অর্থ হতে পারে। সামরিক জান্তা কর্তৃক সামরিক আদালতে তার বিচারের এখতিয়ারই বঙ্গবন্ধু অস্বীকার করেছেন এবং সেই জন্যে তিনি আত্মপক্ষ সমর্থন করতে রাজী হন নি। তা সত্বেও বিচারের মুখয়সটা বজায় রাখার জন্যে তথাকথিত পাকিস্তানের সামরিক জান্তা বিশিষ্ট আইনজীবী এ, কে, ব্রোহীকে বঙ্গবন্ধুর পক্ষ সমর্থনের জন্যে নিযুক্ত করেছিল। তারপর অকস্মাৎ সেই মুখোস ছুড়েফেলে দিয়ে বিচার পদ্ধতির সংশোধন করার প্রয়োজন হলো কেন ? হয় সামরিক জান্তার বিচার প্রহসন এতই হাস্যকর যে, যে কোন আইনজীবীর কাছেই তা অত্যন্ত  দৃষ্টিকটু ঠেকতে বাধ্য, কাজেই ব্রোহীর মত আইনজীবীর পক্ষে এই বিচারের সঙ্গে যুক্ত থাকা হয়তো অসুবিধাজনক মনে হচ্ছে। অথবা নিজেদের সুবিধা ও ইচ্ছা অনুযায়ী সাক্ষ্য প্রমান ও নথীপত্র জাল করা সত্বেও সামরিক কর্তৃপক্ষ বিবাদী পক্ষের কৌশুলীর উপস্থিতির ঝুকি নিতে সাহস পাচ্ছেনা।

প্রদত্ত সাক্ষ্য যথাযথ ভাবে লিপিবদ্ধ না করে সাক্ষ্যে কি বলতে চাওয়া হয়েছে (যা অবশ্যই সামরিক আদালতের। বিবেচনা অনুযায়ী নির্ধারিত হবে) সে সোন্তাসে শুধু সেটুকু লিপিবদ্ধ করার অর্থ হচ্ছে প্রদত্ত সাক্ষ্যকে তারা নিজেদের ব্যাখ্যা অনুযায়ী লিপিবদ্ধ করবে। যে সাক্ষ্য সেদিক থেকেও সামরিক কর্তৃপক্ষের বিবেচনায় তাদের মামলার অনুকূল বলে মনে হবে না, তাকে ‘বিরক্তিকর, বিচার দীর্ঘায়িত করবে কিম্বা ‘বিচারের লক্ষ্যকে বানচাল করতে পারে’ বলে সেই সাক্ষ্য বাতিল করার। ব্যবস্থা করায় বিচার পদ্ধতিটিকে একটি পূর্ব নিদিষ্ট রায়ের অনুকারী করা হয়েছে। এর ফলে প্রকৃত

পক্ষে পূর্বাহ্নেই বিচারের রায়। দিয়ে দেয়া হচ্ছে বলে ধরে নেয়া যায়, কারণ এ ক্ষেত্রে অভিযোগ কারী নিজেই বিচারক।

বঙ্গ বন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে সোচ্চার বিশ্ব জনমতের প্রতি এই সংশোধনী একটা চ্যালেঞ্জ। তারা সকল চক্ষু-লজ্জার বালাই বিসর্জন দিয়েই খোলাখুলি রায় ঘোষণা করে জানিয়ে দিতে চায় যে, তারা বিশ্ব জনমতের তো য়াক্কা করে না। বঙ্গবন্ধুকে তারা দণ্ডদান করবেই,—বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামীদের খোলাখুলি ভাবে একথা জানিয়ে দিয়ে তাদের ওপর একটা চাপ সৃষ্টির অভিপ্রায়ও সামরিক জান্তার থাকা অস্বাভাবিক নয়। কিন্তু অধিকৃত বাংলাদেশে গণহত্যা, ত্রাস ও নির্যাতনের রাজত্ব প্রতিষ্ঠা করেও তারা মুক্তি সংগ্রামীদের নিবৃত্ত করতে পারেনি, বঙ্গবন্ধুর বেআইনী বিচার প্রহসন ও প্রাণনাশের হুমকীও মুক্তিকামী বাঙালীদের নিবৃত্ত করতে পারবে না। কারণ বাঙলাদেশের মুক্তিকামী মানুষ ও বীর মুক্তিযোদ্ধারা তাদের প্রাণপ্রিয় নেতার । নির্দেশ ও নির্ধারিত পথই অনুসরণ করে চলেছে। কোন সময় নিদেশ দেবার জন্যে তিনি না। থাকলেও তার আরদ্ধ কাজ সম্পাদনের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর ওপর ন্যস্ত

করে গেছেন। দেশের মানুষ সেই – পথ থেকে কোন ক্রমেই বিচ্যুত হবে না। ইয়াহিয়ার সামরিক – জান্তা ও তার ঘাতক-বিচারকদের কেই এদেশের মানুষ আসামীর কাঠগড়ায় দাড়াতে বাধ্য করবে।যুদ্ধ বিধ্বস্ত খুলনার উথসা। দু’পক্ষের প্রচণ্ড সংঘর্ষের পর মুক্তি বাহিনী এলাকা দখল করে নেয়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত ভবনটি জল্লাদ সেনাদের ঘাটী ছিল।  ফটো: জয় বাংলা

বন্যার করাল গ্রাসে পৌনে দু কোটি বাঙ্গালী সন্তান! এদের বাঁচাতে হবে

                                                              (জয়বাংলা প্রতিনিধি )

নভেম্বরে মানব ইতিহাসের সর্বাধিক প্রলয়ঙ্করী ঘূর্নিঝড় ও সামুদ্রিক জলোচ্ছাস, পঁচিশে মার্চ পরবর্তী সময়ের সুপরিকল্পিত গণহত্যা, লুণ্ঠন, ধর্ষনের বিভীষিকায় বিপৰ্যন্ত বাংলাদেশের গণজীবনে আবার মত্ত হাতীর মতো  সর্বগ্রাসী বন্যা ঝাঁপিয়ে পড়েছে। বন্যা তার দুরন্ত আক্রোশে মাঠ-ঘাট, বন-বাদাড়, ক্ষেতের ফসল আর মাথা গুজবার ঠাই টুকু পর্যন্ত ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছে। দুর্ভিক্ষের রাহু গ্রস্ত বাংলাদেশে বন্যা আবার নরকের যন্ত্রনা নিয়ে আবির্ভূত হয়েছে।  ঢাকা, কুমিল্লা, ফরিদপুর, যশোর, কুষ্টিয়া সহ আটটি জেলা সম্পূর্ণ পানির নীচে চলে গেছে। লাখো মানুষের। ভবিষ্যতে বেঁচে থাকার অবলম্বন ক্ষেতের ধান বন্যার মত্ত তো ড়ে ভেসে গেছে, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ২ বন্যায় পৌনে দু’কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত, ৫০ লাখেরও বেশ লোক (বন্যায় ) গৃহহীন, দু’লাখ গৃহ বিধ্বস্থ এবং দু’শশা কোটি টাকার ফসল বিনষ্ট হয়েছে। প্রতি বছরই বন্যায় তার ধ্বংসলীলা রেখে যায় আর কোটি কোটি মানুষ নিঃস্ব ও সর্বহারা হয়। বন্যার ধ্বংসলীলা চরমে উঠলে ইমলামাবাদের বাংলা ও বাঙ্গালী ঘাতী কণ্ঠ সাময়িকভাবে বন্যা নিয়ন্ত্রণ পরিকল্পনার জাল’ বোনে। আবার সব হিমাগারে চলে যায়। বাঙ্গালীদের সহায় সম্বলহীন করা, অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙ্গে দেওয়া, বিভিন্ন কায়দায় হত্যা দ্বারা জনসংখ্যা কমানো যাদের পরিকল্পনার অন্তভূক্ত তাদের কাছে, তাদের হৃদয়ে এই কোটি বাঙ্গালীর দুর্দশা কোনরূপ মানবিক স্পন্দন কোন দিন জাগাতে এ পারেনি।

বিগত নভেম্বরের প্রাকৃতিক দুর্যোগে প্রায় পনের লাখ লোক নিহত এবং এক কোটি লোক গৃহহীন ও । সহায় সম্বলহীন হওয়ার পর সারা বিশ্বের সাহায্য ও সহানুভূতির হাত দিয়ে যে কোটি কোটি টাকা মূল্যের সাহায্য সামগ্রী ও নগদ অথ এনেছিল তার অধিকাংশই বর্তমানে জল্লাদ সেনাবাহিনী তাদের বাঙ্গালী নিধন কাজে লাগাচ্ছে। বিদেশ থেকে প্রাপ্ত অধিকাংশ অথ লাহোরের। ন্যাশনাল ব্যাঙ্কে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল। তা থেকে একটি পাই পর্যন্ত বাঙ্গালীদের দুর্দশা মোচনের জন্য ব্যয় হয়নি। বর্তমানে ইয়াহিয়া সরকার সে অর্থ বাঙ্গালী নিধনের জন্য তাদের সমরাস্ত্রের চাকাকে গতিশীল ও ঘূর্ণায়মান রাখার কাজে ব্যবহার করছে। নবেম্বরের দুর্যোগে বিধ্বস্ত উপকূলের অবস্থা পরিবেষ্টনের জন্য পাকিস্তান সেনাবাহিনীর হেলিকপ্টার পাওয়া যায়নি কিন্তু বর্তমানে বাঙ্গালীদের নিধনের জন্য অসংখ্য হেলিপ্টার বাংলাদেশের আকাশে পরিলক্ষিত হয়। বিশ্বের যে দু’একটি দেশ রিলিফ কাজের জন্য হেলিকপ্টার প্রদান করেছিল টিক্কার হারমাদ বাহিনী তাও সামরিক কাজে ব্যবহার করছে।

এবারের বন্যায় বাংলাদেশের কোটি লোক ক্ষতিগ্রস্ত ও সর্বহারা হলেও জল্লাদদের হাত দিয়ে রিলিফের একটি কানাকড়িও গলছে না। তবে ‘অথ মঞ্জুরের সংবাদ ঠিক ঠিক ভাবে দখলীকৃত বেতার ও সংবাদপত্র থেকে প্রচার করা হচ্ছে। বন্যার ধ্বংসলীলার সংবাদ অধিকৃত বেতার থেকে। প্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে বিদেশী সাহায্য আসলে তা দিয়ে তাদের শূণ্য তহবিল ভরে তো লা। বাঙ্গালীদের বাঁচিয়ে রাখার বিন্দুমাত্র আগ্রহ যে ইয়াহিয়া-টিকা চক্রের রয়েছে সে অপবাদ তাদের অকৃত্রিম মিত্ররাও দিতে পারবে না।

বাংলাদেশ সরকার তাই মনে করে, বন্যার্ত কোটি মানুষের দুর্গতি লাঘবের জন্য বিশ্ববাসীর সাহায্য হয় বাংলাদেশ সরকার অথবা কোন নিরপেক্ষ সংস্থার মাধ্যমে বিতরণ করতে হবে, তা না হলে সমুদয় সাহায্য সামরিক জান্তা বাঙ্গালী রক্ষা নয়, হত্যার

কাজেই ব্যয় করবে বলে দাবী না করেছেন। তার বাস্তব প্রমাণও ন সম্প্রতি পাওয়া গেছে। বাংলাদেশের নী অধিকৃত এলাকার সামরিক সরকার ।

বিভিন্ন জেলার প্রধানদের বিদেশ থেকে প্রাপ্ত রিলিফ সামগ্রীর একটি বিরাট অংশ সৈন্যবাহিনী ও রাজাকারদের আগামী ছয় মাসের জন্য যাতে ভরণ পোষণ করা হয় তার জন্য নির্দিষ্ট করে রাখতে গোপন নির্দেশ প্রদান করেছে।কার্ডের নীচে ইংরেজীতে লেখা রয়েছে EPGP–70/714605H -1 Lakh.

এ কার্ডেই শরণার্থী অভ্যর্থনার নমুনা পাওয়া যাবে।

 

আপনি যদি মৃত্যু বরণ করতে চান

[জয়বাংলা প্রতিনিধি ]

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার নরককুণ্ড থেকে শুধু মাত্র জীবন নিয়ে যারা ভারতের মাটিতে আশ্রয় নিয়েছে তাদের মধ্যে কেউ কেউ নাকি আবার বেয়নেটের ডগায় বিদ্ধ হওয়ার জন্য পড়িমরি করে পুরানো যায়গায় ফিরে যাচ্ছে। ইয়াহিয়ার সামরিক জান্ত। অন্ততঃ এ-রকম আভাষ দিচ্ছে তাদের গায়েবী আওয়াজ ও নিয়ন্ত্রিত সংবাদপত্রের মাধ্যমে।

ভারত থেকে যে সব শরণার্থী ফিরে যাবে তাদের অভ্যর্থনা ও হত্যার জন্য কি জাতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে তার নির্দেশ প্রদান করেছে ইষ্টার্ন কম্যাণ্ডের কমাণ্ডার লেঃ জেনারেল আমির আবদুল্লাহ খান নিয়াজী। নিয়াজী স্বাক্ষরিত ‘নিরাপত্তা পাস’ নামক গোলাবী রঙনির্দেশাবলীর আলোক চিত্ৰ ৬-এর পাতায় দেখুন। এর কার্ডে বলা হয়েছে, “যে কোন মিলিটারী। পুলিশ ফাড়ি অথবা শান্তি কমিটি এই কার্ড ধারীকে গ্রহণ করিবেন এবং তাহার উপর কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতন করা যাইবে না, তাহাকে পাকিস্তানী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করিতে হইবে যেহেতু সে পরের প্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হইয়াছিল।” এর উর্দু তরজমাও ‘পাস’-এর প্রথম পৃষ্ঠায় ছাপা হয়েছে।  অপর পাতায় জরুরী নির্দেশাবলী’ শিরোনামায় বলা হয়েছে “১। কার্ডধারী ইহা ডান হাতে উচু করিয়া ধরিবেন এবং আত্মসমর্পনের সময় যখন মিলিটারী  পুলিশ ফাড়ির দিকে অগ্রসর হইবেন

তখন উভয় হস্ত মাথার উপরে উঠাইবেন।

২। যদি কাহারও সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র থাকে তবে তাহা ঘাড়ের উপর যুলাইয়। ব্যারেলটিকে নীচের দিকে নামাইয়া আসিতে হইবে।

৩। তাহাকে গ্রহণ করার পর – নিরস্ত্র করা হইবে এবং যত্নের সহিত

খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া  যতশীঘ্র সম্ভব নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হইবে।”

 এ নির্দেশেরও উর্দু তরজমা ছাপা  হয়েছে।

    পাতা

যতদিন বাংলার আকাশ থাকবে, যতদিন বাংলার বাতাস থাকবে, ততদিন বাংলার সংস্কৃতিও থাকবে

বাংলাদেশ ও এশীয় রাজনীতি

চীনের প্রধান মন্ত্রী চৌ এন লাই অবশেষে মুখ খুলেছেন। যুগোশ্লাভিয়ার একজন সংবাদপত্র সম্পাদকের সঙ্গে আলোচনা প্রসঙ্গে তিনি বলেছেন, “ভারতীয় উপমহাদেশ এবং ভারত মহাসাগর বর্তমানে দু’টি বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এবং চীন এই এলাকাকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে।” চীনা প্রধান মন্ত্রী আরো বলেছেন, “চীন কখনোই বৃহৎ শক্তির মত আচরণ করবেন এবং মাঝারি ও ছোট দেশগুলোর দাবীর প্রতি সমর্থন জানিয়েই সে একথা প্রমাণ করবে।”

নয়া চীন শুধু এশিয়ার নয়, বিশ্বের একটি বৃহৎ দেশ। কম্যুনিষ্ট চীনের আবির্ভাবের আগে চিয়াং-শাসিত মহাচীনও ছিল বিশ্বের পঞ্চশক্তির অন্যতম শক্তি এবং অদ্যাবধি জাতিসঙ্ঘের নিরাপত্তা পরিষদে চিয়াং-শাসিত ফরমোজা গোটা চীনের প্রতিনিধি হিসাবে একটি আসন দখল করে রয়েছে। যদিও বিশ্বের অন্যান্য শান্তিকামী দেশের মানুষের মত বাংলাদেশের মানুষও মনে করে, জাতিসঙ্ঘ ও নিরাপত্তা পরিষদে চীনের আসনটি কম্যুনিষ্ট চীনেরই প্রাপ্য, ফরমোজার নয় ; তথাপি যুক্তরাষ্ট্রের নয়া উপনিবেশবাদী এশীয় নীতির দরুণ আজ পর্যন্ত নয়াচীন জাতিসঙ্ঘে আসন লাভ করেনি। এটা যেমন চীনের জন্য, তেমনি এশিয়ার সকল গণতন্ত্রকামী ও শান্তিকামী মানুষের জন্যও ক্ষোভ ও হতাশার কারণ। যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক চীনকে এশিয়ার রাজনীতিতে ‘একঘরে’। করে রাখার নীতি এশিয়ায় গণতান্ত্রিক রাজনীতিকে স্থিতিশীল হতে দেয় নি এবং আমেরিকার আগ্রাসী নীতিও এশিয়ার মাটিতে সফল হয়নি। ইন্দোচীনে দিয়েন বিয়েন ফু’র যুদ্ধে ফরাসীরা যে ভাগ্য বিপর্যয় বরণ করেছে, আজ ইন্দোচীনের ভিয়েৎনামে যুক্তরাষ্ট্র সেই একই বিপর্যয়ের সম্মুখীন। ভিয়েৎনামের যুদ্ধব্যয় যুক্তরাষ্ট্রের আর্থিক ব্যবস্থায় কি গুরুতর চাপ সৃষ্টি করেছে, তার প্রমাণ নিক্সনের সাম্প্রতিক ডলার সম্পর্কিত নীতি। ১৯৩০ সালের পর মার্কিন ডলার সম্ভবতঃ এত বড় সঙ্কটের সম্মুখীন আর কখনো হয় নি।

অবস্থার চাপে আমেরিকা আজ নয়াচীনের দুয়ারে আপোষ-প্রস্তাব নিয়ে হাজির। নয়াচীনও এই আপোষ আলোচনায় সম্মত হয়েছেন। এই আপোষ হোক বা না হোক বর্তমানের বিশ্ব-উত্তেজনা প্রশমনে তা যথেষ্ট সহায়ক হবে বলে অনেকেই মনে করেন। অন্যদিকে খবর রটেছে, ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতী ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশের সমস্যা সম্পর্কে চীনা প্রধান মন্ত্রীর কাছে এক চিঠি লিখেছেন। এই চিঠির জবাব এখনো আসে নি। কিন্তু চীন আফ্রোএশীয় টেবিল টেনিস টুর্ণামেন্টে ভারতকে আমন্ত্রণ জানিয়েছে। পিকিংয়ে নিযুক্ত ভারতীয় দূত এবং দিল্লীতে নিযুক্ত চীনা দূতও নাকি নিজ নিজ সরকারের সঙ্গে আলোচনার জন্য স্বদেশ যাচ্ছেন। দেখে শুনে মনে হয়, এশিয়ায় এতদিনের রাজনৈতিক অচলাবস্থার বরফ গলতে শুরু করেছে।  বিশ্ব-রাজনীতির এই দ্রুত ও নাটকীয় পরিবর্তনের মুখে মিঃ চৌ এন লাই এমন নতুন কথা বলবেন, যাতে এশিয়ার নিপীড়িত জাতি সমূহ নতুন করে স্বস্তি ও ভরসা লাভ করবে এটাই আমরা আশা করেছিলাম। বিশ্বের রাজ- নীতিতে বিশেষ করে এশিয়ার রাজনীতিতে সস্তুর কোটী মানুষের দেশ নয়াচীন তার নিজস্ব ভূমিকা গ্রহণ করুক, তা আমরাও চাই। কিন্তু এই ভূমিকা হোক বন্ধুত্বের, মৈত্রীয় ও সহযোগিতার ; প্রভুত্ব অথবা মুরুব্বিয়ানার নয়। কিন্তু এটা বেদনা দায়ক সত্য, চীনা প্রধান মন্ত্রী যতই বলুন,চীন কখনোই বৃহৎ

শক্তির মত আচরণ করবে না, কিন্তু তার মন্তব্যে বৃহৎ শক্তি সুলভ মুরুব্বিয়ানার – সুরই ধ্বনিত হয়েছে। চীনা প্রধান মন্ত্রী বলেছেন, ভারতীয় উপমহাদেশ ও ভারত মহাসাগর এখন দু’টি বৃহৎ শক্তির নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। চীন এই এলাকাকে মুক্ত করার জন্য চেষ্টা চালিয়ে যাবে। আমাদের আশঙ্কাও এখানেই নিহিত। ভারতীয় উপমহাদেশ তথা গোটা এশিয়াকে বৃহৎ শক্তির স্নায়ুযুদ্ধের আওতামুক্ত করার জন্য চীন একা কেন চেষ্টা করবে? এশিয়ার নিপীড়িত ও গণতন্ত্রী দেশগুলোর সঙ্গে তার সহযোগিতা ও সহমর্মিতার পথে বাধা কোথায়? এশিয়ার সদ্য-স্বাধীন গণতন্ত্রকামী দেশগুলোর সঙ্গে সহযোগিতার পথ এড়িয়ে কেবল মাত্র মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনার টেবিলে বসে এশিয়ার ভবিষ্যৎ নির্ধারণের চেষ্টা কি তাহলে দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে নতুন ভাগীদার হিসাবে নয়াচীনের অনুপ্রবেশের চেষ্টা বলে বিবেচিত হবে না? ভারতীয় উপমহাদেশ ও ভারত মহাসাগরে দুই বৃহৎ শক্তির সঙ্গে তৃতীয় শক্তি হিসাবে চীনের প্রভাব ও কতৃত্ব স্বীকার করে নেয়া হলেই কি এশিয়ার সব সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে ?

আমাদের দুঃখ ও বেদনার কারণ এই যে, চীনা প্রধান মন্ত্রীর দীর্ঘ বিবৃতির কোথাও বাংলাদেশ সমস্যা এবং বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের নির্যাতনের কথার উল্লেখ নেই। ইন্দোচীনের কয়েক লাখ মানুষকে যিনি কল্পিত জাপানী সাম্রাজ্যবাদের কবলমুক্ত করার জন্য বদ্ধপরিকর, তিনি এশিয়ার – সর্বাধিক ঘনবসতিপূর্ণ এলাকা বাংলাদেশে পাঞ্জাবী ইয়াহিয়া চক্রের বর্বর হত্যা- ভিযানের বিরুদ্ধে একটি কথা বলাও প্রয়োজন মনে করেন নি। অথচ মিঃ চৌ।

এন লাই জানেন, ১৯৫৬ সালে তিনি যখন বাংলাদেশ সফরে আসেন, তখন বাংলাদেশের মানুষই তাকে প্রথম ঐতিহাসিক সম্বর্ধনা জানায় এবং এশিয়ার নেতা’ দীর্ঘজীবি হোন বলে শ্লোগান প্রদান করে। এশিয়ার সেই বহু বিঘোষিত নেতা এবং সাম্রাজ্যবাদী কাগুজে বাঘের বিরুদ্ধে সদা খড়গহস্ত মিঃ চৌ এন লাই আজ বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য ফ্যাসিষ্ট চক্রের অত্যাচারের বিরুদ্ধে টু শব্দটি করা দূরে থাক, বরং তাদেরই অস্ত্র ও অর্থ দিয়ে সাহায্য জোগাচ্ছেন কম্যুনিজম ও লেনিনিজমের নামে, এটা কি কমুনিজম ও লেনিনিজমের জন্য বিশ শতকের সব চাইতে দুঃখজনক ট্রাজেডি নয়? সংকীর্ণ ও সুবিধাবাদী জাতীয় স্বার্থ কিভাবে সাম্যবাদী আন্তর্জাতিকতার স্বচ্ছ দৃষ্টিকে আচ্ছন্ন করতে পারে, বিভ্রান্ত করতে পারে, তার প্রমাণ খোঁজার জন্য এশিয়ার  মানুষের আজ আর বেশী দূরে দৃষ্টি নিক্ষেপের প্রয়োজন নেই।

আমরা বিশ্বাস করি, চীনের সস্তুর কোটী মানুষ যদি বাংলাদেশে ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়া চক্রের পাশবিক নির্যাতনের প্রকৃত খবর জানতে পারতেন, তাহলে ” তারাও বাংলাদেশের জন্য সাহায্য ও সহানুভূতির প্রেরণায় উদ্বেল হয়ে উঠতেন। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ আজ গোটা এশিয়ার রাজনীতিকে প্রভাবিত করতে চলেছে। এই বাস্তব সত্যকে অস্বীকার করার অর্থ, উট পাখীর মত = বালুতে মুখ গুজে অন্ধ হয়ে থাকা। বাংলাদেশের সমস্যাকে এড়িয়ে পিংপং কূটনীতি যেমন সফল হবেনা, তেমনি সফল হবে না, কাগুজে বাঘের সঙ্গে কাগুজে বৈঠক। নয়াচীন যদি সত্য সত্যই এশিয়ায় শান্তি,স্বাধীনতা ও প্রগতির ভিত্তি শক্তিশালী করতে চায়, তাহলে বৃহৎ রাষ্ট্র সুলভ পুরনো মুরুব্বিয়ানার ঢং ত্যাগ করে তাকে এই মহাদেশের ক্ষুদ্র বৃহৎ সকল রাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের সঙ্গে। সমন্বয় বিধান করে সহ অবস্থানের নীতিতে ফিরে যেতে হবে। পঞ্চাশ দশকের ‘তিব্বতী দাওয়াই’ এখন সস্তুর দশকে আর প্রযোজ্য নয়। বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটী মানুষের স্বাধীনতার সংগ্রামেও নয়াচীনকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে হবে। মধ্যযুগীয় নাদির শাহী বর্বরতার প্রতীক ফ্যাসিষ্ট ইয়াহিয়াচক্রকে মদদ জুগিয়ে এশিয়ায়—শুধু এশিয়ায় কেন, গোটা বিশ্বে শান্তি ও প্রগতি নিশ্চিত করার উপায় নেই।

আদমশুমারী বন্ধ

রয়টার খবর দিয়েছেন, আগামী ডিসেম্বর মাসে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে যে আদমশুমারী হওয়ার কথা ছিল, তা এক বছরের জন্য বন্ধ রাখা হয়েছে। ইসলামাবাদ থেকে সরকারীভাবে ঘোষণা করা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশের পরিস্থিতির দরুণ আদমশুমারী বন্ধ রাখা হল।’

এখানে উল্লেখযোগ্য যে, অধুনালুপ্ত পাকিস্তানে শেষ লোক সংখ্যা গণনা করা হয়েছে ১৯৬১ সালে। ১৯৭১ সালের ডিসেম্বর মাসে আবার তা গণনা করার কথা ছিল। এখন প্রশ্ন হল, হঠাৎ আদমশুমারীর কাজ বন্ধ করে দেয়ার কারণ কি? * এই প্রশ্নের একটি সহজ ও সরল জবাব রয়েছে। সুতরাং অধিক গবেষণার প্রয়োজন নেই। এই জবাবটি হল, গত মার্চ মাস থেকে আজ পর্যন্ত ইয়াহিয়ার জল্লাদ-বাহিনী কম পক্ষে ১০ লাখ মানুষ হত্যা করেছে। একমাত্র ভারতেই শরণার্থী গিয়েছে ৮০ লাখের উপর। এখনো প্রত্যহ হাজার হাজার শরণার্থী ভারতে চলে যাচ্ছে। আগামী ডিসেম্বর মাস পর্যন্ত যদি ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অবস্থান করে, তাহলে এই চার মাসে আরো ৮০ লাখ নর নারীর বাংলাদেশ ত্যাগ করার আশঙ্কা রয়েছে। যেসব শরণার্থী ভারতে না গিয়ে বর্মা চলে গেছেন, তাদের হিসাব এতে ধরা হয়নি।

এই নৃশংস অত্যাচারের কাহিনী চাপা দেয়ার জন্য ইয়াহিয়া এবং তার সাঙ্গোপাঙ্গরা রাতদিন পাগলা, মেহেরালির মত চীৎকার করে বলছেন, সব ঝুটহায়। অর্থাৎ সবই মিথ্যা। তারা কতিপয় দুস্কৃতিকারী’ ছাড়া কোন বাঙালির গায়ে হাত তো লেন নি। কিন্তু আগামী ডিসেম্বর মাসে যদি আদমশুমারী হয়, তাহলে হয়তো  দেখা যাবে, বাংলাদেশের লোক সংখ্যা ৭ কোটি = ২০ লাখ থেকে নেমে হঠাৎ ৫ কোটী ২০ লাখ বা সাড়ে চার কোটী হয়ে গেছে। ইয়াহিয়া-চক্র এই সত্যটি চাপা দেবেন কি করে ? ২৫শে মার্চের রাত্রের বর্বর হত্যাভিষান চাপা দেয়ার জন্য তারা এক ডজন বিদেশী সাংবাদিককে প্রায় উলঙ্গ করে ঢাকা থেকে বের করে দিয়েছেন। কিন্তু তারপরও সত্য চাপা থাকে নি। সুতরাং ডিসেম্বর মাসে আদমশুমারী শেষ করে সত্য চাপা দেয়ার অপপ্রয়াস সফল হবে, এমন ভরসা ইয়াহিয়া-চক্র নিশ্চয়ই করেন না।

প্রসঙ্গক্রমে একটা কথা বলা দরকার। ইয়াহিয়া-চক্র অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের লোক গণনার কাজ বন্ধ করে ভালই করেছেন। পাকিস্তান নামে যে দেশের  অস্তিত্ব আজ নেই, তার আবার আদমশুমারী কি ? তার বদলে ইয়াহিয়া-চক্র একটা কাজ করতে পারেন। জামাতে ইসলামীর নেতা মোল্লা মওদুদীকে ডেকে ইসলামাবাদের কবরস্থানে তাদের সাধের পাকিস্তানের জানাজা পাঠের আয়োজন করতে পারেন। কারণ, মৃতদেহ যত তাড়াতাড়ি কবরস্থ করা যায়, ততই ভালো। নইলে পচা দুর্গন্ধ শৃগাল ও শকুনি ডেকে আনতে পারে ।

পাতা

ইয়াহিয়ার নৃশংসতা বন্ধ করতেই হবে

                                                                    —কেনেভা

মার্কিন সিনেটের প্রভাবশালী সিনেটর মিঃ এডওয়ার্ড কেনেডী বাংলাদেশে পাকজঙ্গী শাহীর অনুসৃত নীতিকে “নিষ্ঠুর নির্যাতনেয় নীতি” বলে অভিহিত করেন এবং পশ্চিম পাকিস্তানে সকল রকম মার্কিন সাহায্য বন্ধ করার জন্য প্রেসিডেন্ট নিক্সনের কাছে দাবী জানান।

ভারতে শরণার্থী শিবির সমূহে সপ্তাহ ব্যাপী সফরান্তে মিঃ কেনো ওয়াশিংটনে প্রত্যাবর্তনের পর সেখানে এক সাংবাদিক সম্মেলনে এ দাবী জানান।

মিঃ কেনেডী হুশিয়ারী উচ্চারণ করে বলেন, “উত্তেজনা প্রশমন এবং শরণার্থীদের পর্যাপ্ত রিলিফের ব্যবস্থা করা না হলে পূর্ববাংলা সমস্যা পাকিস্তান এবং পূর্ব ভারতের জন্য একটা বিপজ্জনক পরিস্থিতির সৃষ্টি করতে বাধ্য।”

শরণার্থী সম্পর্কিত সিনেট সাবকমিটির চেয়ারম্যান মি: কেনেডী পাকিস্তানে সমরাস্ত্র চালান অব্যাহত রাখায় মার্কিন সরকারের কঠোর সমালোচনা করেন।

ওয়াশিংটন ন্যাশনাল প্রেস ক্লাবে সাংবাদিকদের কাছে এক লিখিত ভাষণে মিঃ কেনেডী মার্কিন সরকারের উপরোক্ত কাজকে ‘লজ্জাজনক কাজ বলে অভিহিত করেন।

তিনি বলেন মার্কিন সরকার ইচ্ছা করলে কলমের এক খোচায় পাকিস্তানে  অস্ত্র প্রেরণের লজ্জা জনক কাজ বন্ধ করে দিতে পারেন। মিঃ কেনেডী বলেন ‘বিগত বছরে পূর্ব বাংলা ঘুর্নীঝড়ও গৃহ যুদ্ধে ক্ষত বিক্ষত হয়েছে,  আর আজ সেখানে দেখা দিয়েছে – বন্যার তাণ্ডব।  মিঃ কেনেডী বলেন, পশ্চিম পাকি স্তানী সৈন্যরা যে নিরস্ত্র বাঙ্গালীদের হত্যা করেছে তার প্রমাণ তিনি পেয়েছেন। শরণার্থীরা পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও তাদের সহযোগীদের ব্যাপক গণহত্যা, লুঠতরাজ, নারী নির্যাতন ও অগ্নি সংযোগের বহু কাহিনী তার কাছে বলেছে।

     মিঃ কেনেডী বলেন, যে সরকার মানবতার মৌলিক নীতি সমূহ লংঘন করে চলেছে তাকে কোন রকম সামরিক ও অর্থ নৈতিক সাহায্য দেওয়া চলবেনা। পশ্চিম পাকিস্তানী মিঃ কেনেডী জানান যে, দক্ষিণপূর্ব এশিয়ায় বর্তমানে সন্ত্রাস ও নৃশংসতায় যে রাজত্ব চলছে তৎসম্পর্কে জনমত জোরদার করার জন্য তিনি সিনেট সাব-কমিটিতে নতুনভাবে ধারাবাহিক শুনানী গ্রহণ করবেন।

মিঃ কেনেডী বলেন যে, পাকিস্তান  সরকারের সাথে কূটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার বিষয়টি নিক্সন সরকারের বিবেচনা করে দেখা উচিৎ।

মিঃ কেনেডী বলেন, তিনি এ পর্যায়ে কুটনৈতিক সম্পর্ক ছিন্ন করার প্রস্তাব করবেন না। তবে পাকিস্তান সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির পন্থা। হিসাবে নিক্সন সরকারের তা বিবেচনা করে দেখা উচিৎ।ভারতে স্থাপিত শরণার্থী ক্যাম্পগুলোর অবস্থা পশ্চিম এশিয়ার আরব মোহাজের ক্যাম্পগুলোর চেয়ে খারাপ কি না জিজ্ঞেস করা হলে মিঃ কেনেডী। বলেন, ভিয়েতনাম সহ বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে আমি যত শরণার্থী শিবির দেখেছি তার মধ্যে ভারতে অবস্থিত শরণার্থী শিবির গুলোর অবস্থা সবচেয়ে শশাচনীয়।

তিনি বলেন, সপ্তাহব্যাপী ভারত সফরকালে তিনি যা দেখেছেন তাকে কেবল সমসাময়িক কালে মানবিক দুর্দশার সর্বাধিক ভয়াবহ দৃশ্য বলেই অভিহিত করা চলে।

ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশে তার নৃশংসতার নীতি পরিহার না করলে তিনি পাকিস্তানের প্রতি মার্কিন নীতিতে বড় রকমের রদবদল সাধনের আহ্বান জানান। এ প্রসঙ্গে তিনি পাকিস্তানকে সিয়াটো থেকে বহিষ্কারেরও প্রস্তাব করেন।

জেনারেলদের এবং বিশ্ববাসীর সামনে  এটা পরিষ্কারভাবে তুলে ধরতে হবে যে, পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা পূর্ব বাংলায় যে নৃশংস গণহত্যা চালিয়েছে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তাঁকে ঘৃণা করে।

বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় জল্লাদ বাহিনী পাইকারী হত্যাভিযান এখনও অব্যাহত রেখেছে। খুলনার কালীগঞ্জ থানার বসন্তপুর এই নারকীয় হত্যাকাণ্ডের স্থান। মুক্তি বাহিনীকে আশ্রয় দেওয়ার সন্দেহে বৃদ্ধ, বৃদ্ধা এবং দু’টি শিশুকে নির্মমভাবে হত্যা করা হয় ১৩ই আগষ্ট। আমাদের দুঃসাহসী মুক্তি বাহিনী পনেরই আগষ্ট এই এলাকা দখলের পর ‘জয় বাংলা’ ফটোগ্রাফার এই মর্মন্তুদ ও হৃদয় স্পর্শী আলোক চিত্রটি গ্রহণ করেন। মুক্তি বাহিনী এই হত্যার বদলা গ্রহণ করেছেন খান সেনাদের উপর।

মুজিবের বিচার প্রহসন

পাকিস্তানের জন্য ক্ষতির কাৱণ হবে

সাবেক বৃটিশ পার্লামেন্টে শ্রমিক দলীয় সদস্য এবং উইলসন সরকারের  কেবিনেট মন্ত্রী মিঃ পিটার শোর গত ২৮শে আগষ্ট কলকাতায় বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রহসন পাকিস্তানের জন্য একটা অমর্যাদাকর ব্যাপার এবং তা আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে পাকিস্তানের অসামান্য ক্ষতির কারণ হবে।

তিনি বলেন, ‘অনুরূপ একটা বিচার গোপনে অনুষ্ঠানের কথা চিন্তা করাও লজ্জাজনক।“

মিঃ শোর সরেজমিনে বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে তথ্যানুসন্ধানের জন্য ঐ দিনই নয়া দিল্লী থেকে কলকাতা আসেন। বিমান বন্দরে তিনি  সংবাদিকদের বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার যে কোন সমাধান তথাকার জনগণের অনুমোদন লাভ করতে হবে।

তিনি বলেন, জনগণের ইচ্ছা। অনিচ্ছা নিরূপনের সর্বোত্তম পন্থা হল। গণভোট। তবে গত নির্বাচনে শেখ। মুজিবের দলের বিপুল বিজয়ের পর সেখানকার জনগণ কি চায় সে সম্পর্কে আমার কোনও সন্দেহ নেই।

সিনেটর পার্সি

জঙ্গী শাহীর অতিথি হলেন না

পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী কখন কার সম্পর্কে কি ভাবে তা বলা ও বুঝা মুস্কিল। ইতিপূর্বে প্রভাবশালী মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডীর বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ শেষ মুহূর্তে প্রত্যাখ্যান করে জদীশাহী অপর একজন মার্কিন সিনেটর চালস পার্টিকে “সরকারী অতিথি হিসাবে বাংলাদেশ সফরের প্রস্তাব দেন। কিন্তু চার্লস পার্সি কি ধাতে গড়া জঙ্গীশাহী বোধ হয় তা বুঝে উঠতে পারেনি। তিনি সরাসরি তথাকথিত পাকিস্তান সরকারের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করে জানিয়ে দিয়েছেন যে, তিনি সরকারী অতিথি’র বদলে একজন বে-সরকারী সফরকারী হিসাবেই বাংলাদেশ সফর করবেন।

গত ২৮শে আগষ্ট নয়া দিল্লী থেকে ঢাকা যাত্রার প্রাক্কালে সিনেটর পাসি একথা জানান।

তিনি বাংলাদেশ সফরকালে শেখ মুজিব সম্পর্কে খোঁজ খবর নেবেন কিনা সাংবাদিকদের এ প্রশ্নের জবাবে সিনেটর পার্সি বলেন যে, সেখানে তার অনেক কিছু করার আছে।

প    র্যবেক্ষক মহলের মতে মি: চার্লস পার্সি ‘সরকারী অতিথি’ । হিসাবে বাংলাদেশে গেলে ব্যক্তিগত উদ্যোগে তার কিছুই করণীয় থাকত তিনি জঙ্গীশাহী যা বুঝাতে তার বাইরে কিছু বুঝবার, জঙ্গীশাহী যা দেখাতে তার বাইরে কিছু দেখার সুযোগ পেতেন না। সে জন্যই তিনি ‘সরকারী অতিথি’ হবার প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছেন।

পাতা

পাকিস্তানের ইতিহাস রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডেরই ইতিহাস

করাচীর একটি উর্দু ‘দৈনিক ন-ই রেসিনীতে’ খবর বেরিয়েছে, মিস ফাতেমা জিন্নাকে করাচীতে তার বাসভবনে হত্যা করা হয়। যদিও সরকারী ভাবে ঘোষণা করা হয় ফাতেমা জিন্না হৃদরোগে মারা গিয়ে। ছেন। ঐ খবরের কাগজে যারা মিস ফাতেমা জিন্নার লাশ গোছল করায়, তাদের তিন জনের মন্তব্য উদ্ধত করে বলা হয়েছে যে, তারা মিস ফাতিমা জিন্নার গলায় গভীর ক্ষত চিহ্ন লক্ষ্য করেছে। তারা। আরো বলেছে মিস জিন্নার তলপেটেও আঘাতের চিহ্ন ছিল। মনে হয়, তার গলায় ও তল পেটে ছুরিকাঘাত করা হয়েছিল। তার কাপড় রক্তে ভেজা ছিল। মশারির চাল ও বিছানার চাদরেও ছিল রক্তের দাগ। সংবাদ পত্রটিতে আরো বলা হয়েছে, মিস জিন্নার। শরীর সাদা কাপড়ে জড়ান ছিল। কেবল তার মুখের এক অংশ দেখা যাচ্ছিল। একদল ছাত্র পরলোকগত নেত্রীর মৃত দেহ দেখতে চাইলে পুলিশ তাদের সবার জন্য লাঠি চালায় ও কঁাদুনে গ্যাস প্রয়োগ করে। ফাতিমা জিন্ন। রাজনীতিতে ছিলেন গণতন্ত্রবাদী ও সামরিক শাসনের বিরোধি। প্রবল প্রতাপ আইয়ুব শাহীর বিপক্ষে তিনি নির্বাচনে দাড়ান। তাঁর লক্ষ্য ছিল পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু নির্বাচনে আইয়ুব জয় লাভ করেন, ষড়যন্ত্র করে। তার বুনিয়াদী গণতন্ত্রের নির্বাচনে অন্যের জয় লাভ করবার সম্ভাবনা ছিল। কম। তাছাড়া সেনা বাহিনী ও আমলাতন্ত্র ছিল তার পক্ষে। কিন্তু। নির্বাচনে জয় লাভ করেই সম্ভবতঃ সামরিক এক নায়ক আইয়ুবের রাগ যায়না ফাতিমা জিন্নার উপর। আইয়ুব অথবা তার সমর্থকদের নির্দেশে খুন হন ফাতিমা জিন্না। বাইরে প্রচার করা হয়, তিনি মারা গিয়েছেন আকস্মিক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে। এমনি ছিল আইয়ুবী শাসনের কড়া ব্যবস্থা যে তখন এই খুনের কথা প্রকাশিত হতে পারেনি। কিন্তু এখন তা প্রকাশ হতে পারছে, বোধ হয় আইয়ুব আজ আর ক্ষমতার আসনে নেই বলেই। তবে এর পেছনেও অন্য কোন ষড়যন্ত্র আছে কিনা তা বলা মুস্কিল।

পাকিস্তান আজ বাঙালীদের কাছে একটা মৃত বাস্তবতা। কিন্তু তবুও এই খুনের রাজনীতির কথা আলোচনা করতে হয়। কারণ,এই ষড়যন্ত্র ও ক্ষুনের রাজনীতির মূলে ছিল, পাকিস্তানে গণতান্ত্রিক ভাবধারার অভাব। পাকিস্তানের যে অংশে গণতান্ত্রিক ভাবধার বিশেষ  ভাবে ছিল, তা হল বাঙলাদেশে। বাঙলাদেশে হত্যার রাজনীতি ছিল না। যেসব রাজনৈতিক খুন হয়েছে তার সবগুলিই সংঘটিত হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানে। সেখানকার রাজনৈতিক ও সামরিক নেতাদের চক্রান্তই কাজ করেছে এই সব খুনের পশ্চাতে।

খুনের রাজনীতি আরম্ভ হয় পাকিস্তানের জন্মলগ্ন থেকেই। পাকিস্তান রাষ্ট্রের প্রতিষ্ঠাতা জনাব জিন্নার চিকিৎসক কর্ণেল ইলাহী বক্স তার বইতে জিন্নার মৃত্যু স্বাভাবিকভাবে ঘটেছিল কিনা সে বিষয় সংশয় প্রকাশ করেছেন। ১৯৪৮ সালের ১১ই সেপ্টেম্বর মিঃ জিন্নার আকস্মিক মৃত্যুর পর জানান হয়েছিল যে তিনি দীর্ঘ দিন থেকে ক্যান্সারে ভুগছিলেন। অথচ তৎকালীন পাকিস্তান জাতি এমন  কি মিঃ জিন্নার ব্যক্তিগত চিকিৎসক পর্যন্ত তা আগে জানতে পারেন

নি। মিস ফাতেমা জিন্নাহও যে জানতেন না তার প্রমাণ মিঃ  জিন্নার প্রতিটি মৃত্যু বার্ষিকীতে প্রদত্ত বাণীতে তিনি ব্যাপারটার প্রতি ইঙ্গিত করতেন।

     মিঃ জিন্নার মৃত্যুর পর এমনও খবর পাওয়া গিয়েছিল যে, তার মৃত্যুর দুই তিন দিন পূর্বে জিয়ারত থেকে কোন এক মহল জাতির  পিতার ব্যবহারের জন্যে কিছু সাদা কাপড় পাঠাতে করাচীতে এত্তেলা পাঠিয়েছিল। পরে সেই সাদা কাপড়েই মিঃ জিন্নার মৃতদেহ জিয়ারত থেকে করাচীতে আনা হয়। ‘

     এরপর ১৯৫১ সালের ১৬ই অক্টোবর পিণ্ডির প্রকাশ্য জন সভায়  প্রধান মন্ত্রী লিয়াকত আলী খুন হল। এই খুনের রহস্য এখনও উদঘাটিত হয়নি। কারণ, এই খুনের পেছনে যারা ছিলেন, তারা সকলেই ছিলেন উচ্চ ক্ষমতা সম্পন্ন।

এদের মধ্যে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রধান সেনাপতি ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রী সহ অনেকেই ছিলেন বলে বিভিন্ন মহলের সন্দেহ জনক। তার পর লিয়াকত হত্যার তদন্তকারী আর্মী, অফিসার ব্রিগেডিয়ার শের। আলি খান ও ব্রিগেডিয়ার ইফতিখার উদ্দীনকে বিমান বিধ্বস্ত করে। মারার পর এ সন্দেহ আরো ঘনীভূত হয়। কেননা, এ দুজনের সাথে। ছিল লিয়াকত হত্যার তদন্ত সংক্রান্ত যাবতীয় দলিল দস্তাবেজ।

এর পর ঘাতকের হস্তে প্রাণ দেন সীমান্ত গান্ধীর ভ্রাতা ডঃ খান সাহেব। ডঃ খান সাহেবের মতো  একজন নিষ্কলুষ চরিত্রের মানুষকে ব্যক্তিগত কারণে কোন ঘাতকের হত্যা করার প্রয়োজন ছিলোনা। সুতরাং এটা যে একটা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড তাতে কারো কোন সন্দেহ নাই।

     পশ্চিম পাকিস্তানের এককালীন গভর্ণর ও সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুবের শত কুকর্মের দোসর কালাবাগের আমীরের হত্যাকাণ্ডও একটি রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। এই লোকটি আইয়ুরের দোসর হিসাবে সারা পশ্চিম পাকিস্তানে খুন-খারাবির মাধ্যমে ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিল। ১৯৬৪ সালের নির্বাচনের সময়ে কালাবাগের আমীরের লোকেরা তৎকালীন আওয়ামী লীগ নেতা জনাব বাকা বালুচের প্রাণ নাশ করতে গিয়ে ভুলক্রমে পি, পি, আই-এর প্রতিনিধি জনাব জমীর কোরেশীকে খুন করে। অনুরূপ অসংখ্য রাজনৈতিক খুন সম্পাদন করেছিল কালাবাগের আমীর। কিন্তু পরবর্তী কালে ব্যক্তিগত স্বার্থ ও উচ্চাভিলাসের কারণে আইয়ুবের সাথে কালাবাগের আমীরের মন কষাকষি হয়। ফলে কালাবাগের। আমীর গভর্ণর পদ হারায় এবং বাড়ীতে গিয়ে চাষাবাদের ফাঁকে। আইয়ুব বিরোধী ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়। সুতরাং আইয়ব উপায়ান্তর না দেখে কালাবাগের নবাবের পুত্রকে দিয়েই তাকে ধরাধাম থেকে চির বিদায় দেবার ব্যবস্থা করে। 

হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর হত্যাকাণ্ডও ছিল আরেকটি। রজনৈতিক হত্যাকাণ্ড। জনাব সোহরাওয়ার্দী এন ডি এফ গঠন করে আইয়ুবী শাসনের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করেন। তারপর স্বাস্থ্যগত কারণে তিনি বিদেশ চলে যান। ১৯৬৩ সালের মাঝামাঝি সময়ে আওয়ামী লীগ পুনঃজীবনের প্রশ্ন নিয়ে দেখা দেয় মতানৈক্য। শেখ মুজিবর রহমান লণ্ডন গিয়ে নেতার সাথে আলাপ আলোচনা করেন এবং নেতাকে দেশে ফিরে আসতে অনুরোধ করেন। শহীদ।  সাহেব তাকে কথা দিয়েছিলেন যে তিনি ডিসেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশে ফিরবেন। কিন্তু ভাগ্যের নির্মম পরিহাস নির্দিষ্ট তারিখের কয়েকদিন আগেই খবর আসে যে শহীদ সাহেব বৈরুতের এক হোটেলে আকস্মিক ভাবে হৃদযন্ত্রের ক্রিয়া বন্ধ হয়ে মারা গেছেন। শহীদ সাহেব দেশে ফিরলে যাদের সিংহাসন কেঁপে উঠত তারাই তাকে বৈরুতে হত্যা করেছে বলে সর্বসাধারণের ধারণা জন্মে। এ ধারণা পরে আরো বদ্ধমূল হয় নানা কারণে। কারণ বৈরুতের হোটেলের যে কক্ষে শহীদ সাহেব থাকতেন তা বাহির থেকে বন্ধ থাকত। অথচ শহীদ সাহেবের মৃত্যুর পর কক্ষটা খোলা পাওয়া গিয়েছিল। * সর্বোপরি সোহরাওয়ার্দী সাহেবের কন্যা বেগম সোলায়মান। আজ ইয়াহিয়া খানদের প্রকাশ্য দালালী করছেন। তিনি ব্যক্তিগত ভাবে ঢাকায় এসে হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বসে আওয়ামী লীগে ভাঙ্গন ধরানোর প্রাণপণ চেষ্টা করেছেন এবং এখনও সে অপচেষ্টা থেকে নিবৃত হননি। অতি সম্প্রতি তিনিও বিদেশী সাংবাদিকের কাছে সাক্ষাৎকারে তার পিতার মৃত্যু স্বাভাবিক মৃত্যু ছিলনা বলে দাবী করেছেন।মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর ভাব শিষ্য এবং বঙ্গ বন্ধুর শ্রদ্ধেয় পরামর্শদাতা দৈনিক ইত্তেফাকের প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক জনাব তফাজ্জল হোসেন ওরফে মানিক মিয়ার মৃত্যুও স্বাভাবিক মৃত্যু ছিল না। ইয়াহিয়া খানই পাকিস্তানের চা বোর্ডের তৎকালীন চেয়ারম্যান জনৈক ব্রিগেডিয়ারের মাধ্যমে তাঁকে পিণ্ডিতে ডেকে। নিয়েছিল। মৃত্যুর কয়েক মিনিট আগেও সেই কীর্তিমান। ব্রিগেডিয়ার মানিক মিয়াকে ইয়াহিয়ার সরকারের মন্ত্রীত্ব গ্রহণের প্রস্তাব দিয়েছিল। কিন্তু জনাব মানিক মিয়া কি বলেছিলেন। পাকিস্তানে ২২ পরিবারের অন্যতম সদরে ইস্পাহানীর জবানীতেই পরে তা জানা গিয়েছিল। জনাব মানিক মিয়া বলেছিলেন : “আমি পদাঘাতে মন্ত্রীত্বের প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করব। এর কয়েক মিনিট পরেই মানিক মিয়ার মৃত্যু হয়।  এই সবের কারণ অনেক। পাকিস্তান হবার পর পাকিস্তানের মূল রাষ্ট্রিক ক্ষমতা চলে যায় পাঞ্জাবী ভূস্বামী শ্রেণীর হাতে। পাঞ্জাবের এই শ্রেণীর হাতেই এসে পড়ে সেনা বাহিনী ও প্রশাসনের ক্ষমতা। কারণ, সেনা বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রের উচ্চ পদে বহাল অধিকাংশ অফিসার, ভূ-স্বামী শ্রেণীর সন্তান। এদের মধ্যে অভাব ছিল ও আছে গণতান্ত্রিক চেতনার। এরা ডাণ্ডাবাজি ও লোক খুনের ঐতিহের মধ্যেই ছিল প্রতিপালিত। এরা আধুনিক ইউরোপের কাছ থেকে গ্রহণ করেছে পোশাক-পরিচ্ছদ, চাল-চলন। কিন্তু ইউরোপের মানব অধিকার ও গণতন্ত্রের ধারণা এদের চিন্তাধারাকে প্রভাবিত করতে পারেনি। অন্য দিকে বাঙলাদেশের নেস্তত্ব ভার যাদের হাতে ছিল ও আছে তারা অধিকাংশই মধ্যবিত্ত ঘরের সন্তান। তারা যে রাজনীতির ঐতিহ্য বাহী, তা “গণতান্ত্রিক। ইউরোপীয় ভাবধারার সাথে বাঙালী মনের যোগাযোগের ফলে যে নবজাগরণ আসে বাঙলাদেশে, এরা সেই ভাবধারার ধারক বাহক। বাংলাদেশে

তাই রাজনৈতিক নেতা খুনের রাজনীতি প্রশ্রয় পেতে পারেনি। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে এই খুনের রাজনীতিই প্রাধান্য পেতে চেয়েছে। বাঙলাদেশের সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের বিরোধ কেবল মাত্র অর্থনৈতিক নয়—এই বিরোধ মনধারার। এই বিরোধ, ভাবাদর্শের।

     বাঙলাদেশের মানুষ আজ তার স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছে।  এই স্বাধীনতা যুদ্ধ কেবল মাত্র পশ্চিম পাকিস্তানের ধন কুবেরদের শশাষণের নাগপাশ থেকে মুক্তির জন্য নয়—দেশে সত্যিকার গণতন্ত্র ও মানবিক অধিকার প্রতিষ্ঠাও এর লক্ষ্য। পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে সংযুক্ত থেকে বাঙলাদেশে গণতান্ত্রিক রাষ্ট ও  সমাজ ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা সম্ভব ছিল না বলেই বাঙলাদেশকে ঘোষণা

করতে হয়েছে আপন স্বাধীনতা। সর্বপ্রকার স্বৈরশাসনের অবসান  ঘটাবার জন্যই বাঙালী আজ অনোন্যপায় হয়ে অস্ত্র ধারণ করেছে।

জল্লাদের দরবারে কেউ হাজির হলেন না

মুজিব নগরে প্রাপ্ত খবরে জানা। যায়, জল্লাদ টিক্কা খান যে ৭২ জন আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যকে বিভিন্ন অভিযোগের জবাব দানের জন্য ২২ শে থেকে ২৬ শে আগষ্টের মধ্যে বিভিন্ন সামরিক আদালতে হাজির হওয়ার নির্দেশ দিয়েছিল তারা তা সম্পূর্ণরূপে অগ্রাহ্য করেছেন। জল্লাদ টিক্কা তাদের একজনকেও হাজির করতে পারেন নি।

ইয়াহিয়া খান প্রথমে এসব সদস্যের সদস্য পদ বাতিল ঘোষণা করে। তার পর জল্লাদ টিক্কাকে দিয়ে এদের বিরুদ্ধে নানারূপ আজগুবী ও অভদ্র জনোচিত। অভিযোগ আনয়ন করে।

বহু গন্যমান্য, সৰ্ব্ব জন শ্রদ্ধেয় ও প্রবীন আওয়ামী লীগ দলীয় এম, এন, এর বিরুদ্ধে টিক্কা খান ‘নারী ধর্ষনের’ অভিযোগ আনতেও দ্বিধা করেনি। সম্ভবতঃ টিক্কা খান-রা নিজেদের চেহারা।দিয়েই এদের বিচার করছে। অসভ্য, মনুষ্যত্বহীন, নরপিচাশ, রক্তপিপাসু জল্লাদদের কাছে থেকে এর চেয়ে  বেশী আর কিইবা আশা করা যায়।

খবরে আরো প্রকাশ, ২২শে থেকে  ২৬শে আগষ্টের মধ্যে একজন  আওয়ামী লীগ •এম এন এ-ও কোন  সামরিক আদালতে হাজির না হওয়ায়  টিক্কা খান তাদের হাজিরার মেয়াদ ১লা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বাড়িয়ে দেয়।  অবস্থা দৃষ্টে মনে হবে যে লাখো লাখো বাঙ্গালীর রক্তে বাংলাদেশের মাটি যে লোকটি রঙ্গিত করেছে, লাখো লাখো  মা-বোনের ইজ্জত নিয়ে যে লোকটি  ছিনিমিনি খেলেছে অবশেষে সেই  টিক্কা একেবারে দয়ার সাগর হয়ে গেছে! কিন্তু জল্লাদ দয়ার সাগর হোক আর নাই থােক তার নির্দেশে ১লা সেপ্টেম্বর তারিখেও কোন আওয়ামী লীগ এম, এন এ কোন – সামরিক আদালতে হাজির হন নি।

২২শে থেকে ২৬শে আগস্টের মধ্যে জল্লাদ টিক্কা খানদের দরবারে হাজির হওয়ার জন্য যাদের প্রতি নির্দেশ জারী করা হয়েছিল তন্মধ্যে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমদও ছিলেন।জল্লাদের দরবারে নেতৃবৃন্দ হাজির না হলে তাদের অনুপস্থিতিতেই বিচার হবে বলে হুমকি দেয়া হয়েছে।

জল্লাদের দরবারে যাদের হাজির হতে বলা হয়েছে তাঁদের কয়েক জনের নাম দেয়া হলোঃ

১। সৈয়দ নজরুল ইসলাম ২।  খোন্দকার মোস্তাক আহমদ, ৩। জনাব জিল্লুর রহমান ৪। জনাব মোঃ মোহসীন, ৫। জনাব আবদুল হামিদ, ৬। জনাব আবদুল মোমেন, ৭। জনাব শামসুর রহমান খান, ৮। অধ্যাপক খালেদ, ৯। জনাব শামসুর রহমান মোল্লা, ১০। মোল্লা জালাল উদ্দিন, ১১। জনাব তাহের উদ্দিন ঠাকুর, ১২। জনাব আলী আজম ভূঞা, ১৩। জনাব আবদুল করিম বেপারী, ১৪। জনাব খালেদ মোহাম্মদ আলী, ১৫। জনাব নূরুল হক, ১৬। জনাব খাজা আহমদ, ১৭। জনাব ওয়ালিউল্লাহ নওযোয়ান, ১৮। বেগম নূরজাহান মোরশেদ।

ইন্দিরা-চৌ-এর কাছে চিঠি পাঠিয়েছেন

ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী রক্তাক্ত, লাঞ্ছিতা, ধর্ষিতা  বাংলাদেশের পরিস্থিতি সম্পর্কে চীনের প্রধান মন্ত্রী চৌ এন লাই-র নিকট সরাসরি একটি চিঠি লিখেছেন।

১৯৬২ সালে ভারত-চীন সংঘর্যের পর এই প্রথম ভারতের একজন প্রধান  মন্ত্রী চীনের প্রধান মন্ত্রীর কাছে চিঠি  লিখলেন।

শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী বাংলাদেশ থেকে ৭০ থেকে ৮০ লাখ শরণার্থীর ভারতে প্রবেশের ফলে উদ্ভূত সমস্যার  মানবিক দিক, এর ফলে ভারতের  সামাজিক ও অর্থনৈতিক যে এক গুরুতর চাপ এবং তাদের বাংলাদেশে প্রত্যাবর্তনের ব্যাপারে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টির প্রশ্নে জুন এবং জুলাই মাসে বিভিন্ন সরকার এবং রাষ্ট্রপ্রধানদের কাছে যে চিঠি লিখেছেন চীনা প্রধান মন্ত্রীর নিকট প্রেরিত চিঠিও অনুরূপ বলে জানা গেছে।

পরবর্তী খবরে জানা গেছে যে, চীন ভারত-চীন আলোচনার সূত্রপাত করতে আগ্রহশীল। দু’দেশের মধ্যে মস্কোতে আলোচনা শুরু হতে পারে। কিন্তু এ আলোচনা লক্ষ্যে উপনীত হতে সহায়ক না হলে পিকিংএ আলোচনার সূত্রপাত হতে পারে।

পাতা-৫

একটি যুদ্ধ ঃ বহু ইতিহাস

(পূর্ব প্রকাশিতের পর) 

গ্রামের বাজার। প্রায় জনশূণ্য। টুল-বেঞ্চির আসবাব পত্রে সজ্জিত এবং সিনেমা পত্রিকার চিত্রে শশাভিত বাঁশের বেড়ার ছোট্ট চা ষ্টলটিতে একটি মাত্র খদ্দের বসে আছেন। টেবিলের উপর কাপড়ের ময়লা। একটি থলে। শূণ্য দৃষ্টিতে সামনের দিকে তাকিয়ে আছেন। দেখেই মনে হ’লঅনেক পথ তাকে হাঁটতে হয়েছে। আমাদের। পদশব্দে একটু চমকে উঠলেন। মাত্র। ভাবলেশহীন চাউনীতে গভীর ক্লান্তির ছাপ। কৌতুহল । হল। পাশে গিয়ে বসলাম। পকেট হাওড়াতে হাওড়াতে। বললাম ‘দেশলাই আছে। জবাব না দিয়ে পকেট থেকে দেশলাই বের করে দিলেন। সিগারেট জ্বালাতে জ্বালাতে বলি, কোত্থেকে এলেন? অনিচ্ছা সত্ত্বেও বললেন, ‘ঢাকাথেকে। কী করতেন?’ ‘মফস্বল কলেজে পড়াতাম। আপনি?  পরিচয় দিলাম। আলাপ জমে উঠতেই আমি দোকানদারকে দু’কাপ চায়ের কথা বললাম। – চা খেতে খেতে উনি বললেন, ‘গজবের রাতে আমি ঢাকা ছিলাম না, ছিলাম মুন্সীগঞ্জে। মুন্সী গঞ্জের যুবকেরা অধিকাংশই ছাত্র। ২৬শে মার্চ থানা লুঠ করা থি-নট থি, রাইফেল নিয়ে ছুটল নারায়ণগঞ্জ রক্ষা করতে। হাজার হাজার লোক তাদেরকে নদীর ঘাটে বিদায় অভিনন্দন জানাল-জানেন? ওরা বলছিল মারতে যাইতেছি। ওরা সকালে গেছে, ফিরল রাত তিনটার দিকে। পঞ্চবটি, চাসারা, জামতলীতে ; মাত্র তেইশ-চব্বিশ জন যুবক হানাদারদের সমোট দেড়দিন আটকে রেখেছিল। ওরা ট্যাঙ্ক মটারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল থি, নট থি দিয়ে-তাও ম্যাগাজিন ষ্টক ছিল খুবই কম। ওরা শত্রু সেনা মেরেছিল অনেক অথচ একজনও সামান্য আহত হয়নি। ওরা দেড় দিন আটকে রেখেছিল বলেই নারায়ণগঞ্জের লোকজন পালাতে পেরেছিলেন। গর্বে বুক ভরে উঠল। কানে বাজছে বজ্র কণ্ঠ, বাঙালী মরতে শিখছে—আর আমাদের দাবিয়ে রাখতে পারবে না।২৬ তারিখ সকাল থেকেই  মুন্সীগঞ্জে লোকের ভীড় শুরু হল। ঢাকা, ডেমরা, নারায়ণগঞ্জ, গোদনাইল, বিভিন্ন অঞ্চল থেকে হাঁটা পথে লোকজন যেযার গ্রামের দিকে পালাচ্ছেন। ভীত-সন্ত্রস্ত মানুষজন শুধু মাত্র প্রাণ বাঁচানোর জন্যেই ঘর বাড়ি, জিনিষ পত্র ফেলে কীভাবে যে পালাতে পারে—আমার ধারণা ছিল না। এক এক জনের মুখে = এক এক ধরণের কথা শুনি।আতঙ্কে ও ভয়ে সিদ্ধান্ত নিতেই দেরী হল, ঢাকা আদৌ যাব কী। সেখানে মা আছেন বোনের। বাসায়। অন্যান্য আত্মীয় স্বজনেরা আছেন—আমি প্রায় উন্মাদ হয়ে যাবার যোগাড়। শেষে পায়ে হেঁটেই নারায়ণগঞ্জ চলে গেলাম। রাস্তায় ট্যাঙ্কের দাগ চোখে পড়ল, দালানে বুলেটের মর্টারের ক্ষত চিহ্ন। একটা সিনেমা হাউস হুমড়ি খেয়ে পড়ে আছে। ভীত সন্ত্রস্থ এবং সন্দেহ প্রবন গুটি কয়েক যাত্রীকে নিয়ে ই, পি, আর, টি, সির বাস ঢাকার দিকে এগোচ্ছে। সারী সারী মিলিটারী ট্রাক অনবরত যাচ্ছে আসছে। হঠাৎ আমার মনে হ’ল বিপদে পড়লে কেউ এগিয়ে আসবে না—আমি মুক্ত এলাকা থেকে অধিকৃত এলাকায় প্রবেশ করছি। চাসারার পর থেকে বাসা পর্যন্ত বীভৎস দৃশ্যের অফুরাণ মিছিল। বস্তির পর বন্তি পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। দু একটি অর্ধদগ্ধ বাঁশ উর্ধমুখী হয়ে ব্যাকুলভাবে কী যেন বলতে চাচ্ছে মানব ভাষায় শাখারী পট্রির বর্ণনা দেয়া যাবে না। মধ্যযুগের ইতিহাস ওখানে আটকা পড়ে গেছে। গভীর উদ্বেগ আর দুশ্চিন্তায় দুরু দুরু বুকে বাসায় গিয়ে দেখি দরোজায় তালা ঝুলছে। ঘরটিকে অপরিচিত মনে হল। কাগজের _ উপর হাতে লেখা কলেমা তৌহীদ দেয়ালে সেঁটে দেয়া হয়েছে। কষ্ট হ’ল—আমার মা, পাঞ্জেগানা নামাজ পড়েন, সম্পদ রক্ষার ভয়ে শেষ পর্যন্ত তাকেও খোদার। কালাম ব্যবহার করতে হল। জানেন, “মায়ের সাথে আমার আর দেখা হয় নি।”

ভদ্রলোক চুপ করে থাকেন। একটা বক্ সিগারেট ধরালেন। আমিও চুপ করে আছি। কতক্ষণ পর বললাম—‘শিক্ষা বিভাগের উপর হানাদারদের এ্যাটিচ্যুড সম্পর্কে কিছু বলুন। তার চোখটা মুহূর্তে জ্বলে উঠল। জানেন, বর্বরেরা ডঃ গোবিন্দদেব, ডঃ। জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা, ডঃ মনিরুজ্জামান, প্রফেসর খাদিম, প্রফেসর বনধীর পাত্রকে হত্যা করেছে। জ্যোতির্ময় স্যারকে রাইফেলের বাট দিয়ে পিটিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আরও অনেক অধ্যাপক এদের হাতে – নিহত হয়েছেন—নির্যাতনের অপমানের শীকার হয়েছেন।

অনেকক্ষণ চুপ থেকে তিনি বললেন, জ্যোতির্ময় স্যারের কথা শুনবেন ? আমি বললাম, বেশতো  বলুন না। (চলবে)

কসাইখানা থেকে আর একজন বেরুলেন

আর একজন বাঙ্গালী কূটনীতিক জল্লাদ ইয়াহিয়ার অক্টোপাস থেকে বেরিয়ে এসে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করেছেন। এই কূটনীতিক হচ্ছেন জনাব মোহাম্মদ। শফিউল্লাহ। সুইডেনের রাজধানী স্টকহোলম পাকিস্তানী দূতাবাসের তিনি। একমাত্র বাঙ্গালী অফিসার ছিলেন।  বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যে জল্লাদ সরকার সুপরিকল্পিত ভাবে আমার জন্মভূমিকে পুড়িয়ে খাক করছে এবং নির্বিচারে বাঙ্গালীদের হত্যা করে চলেছে তাদের সাথে আমি কোনরূপ সম্পর্ক রাখতে পারিনা।”

৩০ বছর বয়স্ক জনাব শফিউল্লাহ আশা প্রকাশ করেন যে, অতিথিপরায়ণ সুইডিশ সরকার তাঁর স্ত্রী এবং দুই সন্তানকে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রদান করবেন।

তিনি বলেন যে, দু’বছর আগে। তাঁকে এই দূতাবাসে নিযুক্ত করা হয়। কিন্তু সম্প্রতি তাকে জল্লাদদের রাজধানী ইসলামাবাদে ফিরে যেতে বলা হয়েছে। তিনি বলেন যে, বাঙ্গালীদের বধ্যভূমি পশ্চিম পাকিস্তানে তিনি আর ফিরে যাবেন না।

স্মরন করা যেতে পারে যে, সুইডেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের পাঞ্জাবী রাষ্ট্রদূত জনাব ইকবাল আতাহার সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রশ্নে ইয়াহিয়া সরকারের সাথে মতান্তরের জন্য চাকুরী ছেড়ে দিয়ে অন্য দেশে আশ্রয় নিয়েছেন।

দিল্লিতে বাংলাদেশ মিশন

(বিশেষ প্রতিনিধি প্রেরিত)

নয়া দিল্লী : ভারতের রাজধানী নয়া দিল্লীতে বাংলাদেশ মিশনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ উপলক্ষে আয়োজিত এক গাম্ভীৰ্য্য পূর্ণ অনুষ্ঠানে নয়াদিল্লীস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব কে, এম, শাহাবুদ্দিন লাখো বাঙ্গালীর খুনে রঞ্জিত বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন।

জাতীয় পতাকা উত্তোলনের পর এক সংক্ষিপ্ত বক্তৃতায় জনাব শাহাবুদ্দিন বাংলাদেশ প্রশ্নে – ভারত সরকারের আন্তরিক সহ যোগিতা ও সহানুভূতির জন্য গভীর কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

স্মরণ করা যেতে পারে যে, কূটনীতিক জনাব শাহাবুদ্দিন এবং জনাব আমজাদুল হক নয়াদিল্লীস্থ অধুনালুপ্ত পাকিস্তান। হাই কমিশনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছিলেন। জনাব  শাহাবুদ্দিন পাকিস্তান হাই কমিশনের সেকেণ্ড সেক্রেটারী ছিলেন। এদের পরে হাই কমিশনের বাঙ্গালী ষ্টাফ জনাব আবদুল করিম এবং জনাব আবদুল মজিদ বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেন।

নিরাপত্তা পাস

যে কোন মিলিটারী/পুলিশ ফাঁড়ি অথবা শান্তি কমিটি এই কার্ডধারীকে গ্রহণ করিবেন।

এবং তাহার উপর কোন প্রকার শারীরিক নির্যাতন করা যাইবে না।  তাহাকে পাকিস্তানী হিসাবে পুনরায় গ্রহণ করিতে হইবে যেহেতু সে পরের প্ররোচনায় পথভ্রষ্ট হইয়াছিল।

জরুরী নির্দেশাবলী

১।কার্ড ধারী ইহা ডান হাতে উচু করিয়া ধরিবেন এবং আত্মসমপণের সময় যখন মিলিটারী/পুলিশ ফাঁড়ির দিকে অগ্রসর হইবেন তখন উভয় হস্ত মাথার উপরে উঠাইবেন।

২। যদি কাহারও সঙ্গে অস্ত্রশস্ত্র থাকে তবে তাহা ঘাড়ের। উপর ঝুলাইয়া ব্যারেলটিকে নীচের দিকে নামাইয়া আসিতে হইবে।

৩। তাহাকে গ্রহণ করার পর নিরস্ত্র করা হইবে এবং যত্নের সহিত খাবার ও চিকিৎসার ব্যবস্থা করিয়া যতশীঘ্র সম্ভব নিরাপদ স্থানে অপসারণ করা হইবে।

পাতা-৬

একদল বাঙ্গালী রাজাকার ১৫ই আগষ্ট তাদের রাইফেল এবং গোলাবারুদ নিয়ে খুলনার মুক্ত এলাকা কালীগঞ্জ থানার মুক্তিবাহিনীর ক্যাম্পে এসে ধরা দেয়। তারা এখন মুক্তি বাহিনীর সাথে শত্রু হননের দায়িত্ব পালন করছে। ছবির ডান পাশে রাজাকারদের রাইফেল দেখা যাচ্ছে। আত্মসমর্পনকারী রাজাকারদের মধ্যে একজন বলেন : খান সেনারা ভীত সন্ত্রস্থ হয়ে পড়েছে। তারা কোন এলাকায় যেতে হলে মাইন বিস্ফোরণের ভয়ে রাজাকারদের সামনে এগিয়ে দেয় এবং রাতের বেলা খান সেনারা বিবর ঘাটীতে লুকিয়ে থেকে রাজাকারদের বাইরে দাড়িয়ে পাহারা দিতে বাধ্য করে। ফটো: জয় বাংলা

রনাঙ্গনেঃ সারা বাংলাদেশে খানসেনা ও রাজাকার হত্যার মহোৎসব

মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসিক যোদ্ধারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে শত্রু সৈন্যদের ওপর মরণ পণ আক্রমণ অব্যাহত রেখেছেন।

গত ২৮শে আগষ্ট কুমিল্লা অঞ্চলে সালদা নদীতে মুক্তি বাহিনী হানাদার সেনাদের ওপর এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ১৯ জনকে খতম করে।

গত ২৭শে আগষ্ট রংপুরের পঁচাগড়ে মুক্তি যোদ্ধারা শত্রু ঘাঁটির ওপর দ্বিমুখী আক্রমণ চালান। স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধার কুড়িজন দসৈন্যকে খতম ও শত্রু শিবির ধ্বংস করেন।

শক্র কনভয়ের ওপর আক্রমণ

২৭শে আগষ্ট চাটর্গা-কুমিল্লা সড়কের ওপর ফেণী এলাকায়  শুভপুরের নিকট মুক্তি যোদ্ধারা হানাদার বাহিনীর একটি কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালিয়ে ১৫টির মধ্যে ৭টি যান ধ্বংস করে দেন।

মুক্তি যোদ্ধারা চাটগা গামী ঐ কনভয়ের ওপর আক্রমণ চালালে  ৮টি যান চাটগাঁর দিকে দ্রুত পালিয়ে যায়। পলায়ন কালে কাপুরুষ  সৈন্যরা তাদের ৪ জন সঙ্গীর লাশ ফেলে পালিয়ে যায়।

মালগাড়ী বিধ্বস্ত

এদিকে মুক্তি বাহিনীর গেরিলারা ২৫শে আগষ্ট সিলেট জেলার ছাতক বাজার ও আফজালাবাদ রেল ষ্টেশনের মধ্যবর্তী একটি মালগাড়ী ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন।  ২৬শে আগষ্ট মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধার রাজাকারদের। সন্ধানে নোয়াখালীর চৌমুহনী রেল ষ্টেশনে প্রচণ্ড আক্রমণ চালায়। এ আক্রমণে ৮ জন রাজাকার নিহত হয়। এর পরে মুক্তি যোদ্ধারা। একটি গ্যারেজের ওপরও আক্রমণ চালান। এখানে রাজাকাররা একটি শিবির স্থাপন করেছিল। এই আক্রমণে ১৫ জন রাজাকার নিহত হয়।

 

প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল

২৫শে আগষ্ট রাতে মুক্তিবাহিনী রংপুর জেলার ডিমলা থানার এলাকাভুক্ত সতিবাড়ী গ্রামে পাক হানাদার বাহিনীর একটি ছাউনী দখলের জন্য এক প্রচণ্ড আক্রমণ চালালে ১০ জন খান সেনা খতম হয়। এ ছাড়া গেরিলা যোদ্ধারা ১১জন রাজাকার, খান সেনাদের পদলেহী ৮ জন দালালকে বন্দী ও প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন। এই আক্রমণে আমাদের তরুণ যোদ্ধাদের ৪ জন আহত হন।

২৪শে আগষ্ট কুমিল্লার সালদা নদী ও মন্দভাগে মুক্তিবাহিনীর আক্রমণে ২৫ জন খান সেনা খতম হয়। মুক্তি বাহিনী একই অঞ্চলে পাক সৈন্যবাহী একটি মোটলঞ্চ আক্রমণ করে ৮জনকে খতম করেন।

২টি বিদেশী জাহাজ ক্ষতিগ্রস্ত

সম্প্রতি চট্টগ্রাম বন্দরে নোঙর করা দুটি বিদেশী জাহাজ মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা মাইন বিস্ফোরণ ঘটিয়ে বিশেষভাবে ক্ষতি গ্ৰন্ত করেন। পশ্চিম জার্মানী ও লাইবেরিয়ার এই দুটি জাহাজে পাকিস্তানী সৈন্যদের রসদ বোঝাই ছিল। লাইবেরিয়ার এই জাহাজটি পাকিস্তান ভাড়া করেছিল । ঐ. জাহাজে করে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে চট্টগ্রামে শত্রু সেনাদের জন্য প্রয়োজনীয় জিনিষপত্র। পাঠান হত। – টাঙ্গাইল জেলার কাকুয়ার কাছে ধলেশ্বরীতে মুক্তি বাহিনী চারটি লঞ্চ ডুবিয়ে দিয়েছেন।

ছুটিপুরে মেজর নিহত

যশোর সেক্টর থেকে আমাদের সংবাদদাতা জানাচ্ছেন যে, ২৫শে আগষ্ট পাকিস্তান সৈন্যবাহিনীর একজন মেজর গরুর গাড়ীতে করে ছটিপুর থেকে অন্যত্র গমনকালে মুক্তি বাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা মটার দিয়ে আক্রমণ করে তাকে খতম করেন। রাস্তা কর্দমাক্ত থাকায় উক্ত মেজর গরুর গাড়ীতে করে যাচ্ছিল।

গত ২২শে ও ২৩শে আগষ্ট মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধারা ছটিপুরে। ৩ ইঞ্চি মটর দিয়ে শক্ত ঘাঁটির উপর প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ১০ জন পাক ফৌজকে নিহত ও ৭ জনকে গুরুতররূপে আহত করেন। উক্ত আক্রমণে শত্রুপক্ষের ৫টি বাঙ্কার ও একটি গোলাবারুদ বোঝাই গাড়ী ধ্বংস হয়।

গত ২৪শে আগষ্ট গেরিলা যোদ্ধারা বিজয়নগর রাজাকারদের উপর এক অতর্কিত আক্রমণ চালিয়ে ৬জন নিহত ও ৪ জন আহত করেন। গেরিলাযযাদ্ধারা ২জন রাজাকারকে ২টি রাইফেল সহ বন্দী করতে সমর্থ হন।

সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি : আহমদ রফিক, মুজিব নগর জয় বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে আহমদ রফিক কতৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।

পাতা-৭

দখলীকৃত এলাকা ঘুরে এলাম

                                                          [জয়বাংলা প্রতিনিধি]

বেশ কিছুদিন পরিবারের কোন খোজ খবর জানতাম না। ওদের যেখানে রেখে এসেছিলাম সেখানে আছে কিনা, এবং থাকলে কিভাবে সংসার চলছে তা-ও জানতাম না। কারণ আসার সময় পরিবারের ১২/১৩ জন লোকের জন্যে স্ত্রীর হাতে রেখে এসেছিলাম মাত্র ৫০টি টাকা। তাছাড়া বার বার শুধু মনে পড়ছিল মায়ের কথা। এপ্রিল মাসে যখন পাক-বাহিনীর সাথে মুক্তি যোদ্ধাদের মুখোমুখী যুদ্ধ চলছিল। তখন কয়েক দিনের জন্যে আমি মুক্তি যোদ্ধাদের একটা ক্যাম্পের। ম্যানেজার হিসেবে কাজ করছিলাম। একদিন খবর পেলাম মার অবস্থা খুব খারাপ। বাড়ী। এসে দেখি সত্যই তাই। কানের কাছে গিয়ে ডাক দিতেই মা চোখ খুললেন এবং কিছুক্ষণের মধ্যেই উঠে বসলেন। তারপর খেয়ে দেয়ে মা আবার সুস্থ হয়ে উঠলেন। পরে শুনলাম, আমি যে ক’দিন মুক্তি বাহিনী ক্যাম্পে ছিলাম সে ক’দিন মা দানাপানি।গ্রহণ করেন নি। তাই মুক্ত এলাকায় থাকার সময় বার বার। শুধু মায়ের কথা মনে পড়ত।

এসব কারণে এবং দখলীকৃত এলাকার জনগণের অবস্থা দেখার মানসে ঠিক করলাম বাড়ী যাব। কিন্তু বন্ধু-বান্ধব ও হিতাকাঙক্ষীদের অনেকেই সাহস দিলেন না। কেবলমাত্র ‘মামা সব শুনে যেতে বললেন।

একদিন ভোরে রওয়ানা হলাম। বাড়ীর পথে। হাঁটতে হাঁটতে সকাল ১১টা নাগাদ গিয়ে পৌছলাম একটা মুক্তি বাহিনী ক্যাম্পে। বন-জঙ্গল ও গাছ-পালায় ঘেরা একটা পোড়া বাড়ীতে এই ক্যাম্প। বাড়ীটার পরিধির চারিদিকে অন্তত এক মাইল ব্যাপী স্থানে আর কোন বাড়ী ঘর নেই, নেই কোন রাস্তা ঘাট। আছে শুধু ধান আর পাট ক্ষেত।

 ক্যাম্পের কাছে যেতেই কে একজন হল্ট’ বলে চেঁচিয়ে উঠল। ডানে-বাঁয়ে তাকিয়ে দেখি একজন সৈনিক। কাছে এসেই জিজ্ঞেস করল আমি কে এবং কিজন্যে ওখানে গিয়েছি। বললাম,ক্যাপ্টেন সাবের সাথে দেখা করব। সৈনিকটা আমাকে দাড়িয়ে রেখে আর একজনকে ডেকে আনতে গেল। দ্বিতীয় লোকটি এসে বিনয়ের সাথে আমার পরিচয় জানতে চাইলেন। আমি পরিচয় দিয়ে বললাম ক্যাপ্টেন সাবের সাথে দেখা করব। তিনি আমাকে একটা গাছের গোড়ায় বাঁশের চটায় তৈরী একটা বেঞ্চিতে বসতে বলে ভেতরে গেলেন। তারপর মিনিট খানেকের মধ্যেই ফিরে এসে আমাকে ক্যাপ্টেন সা’বের কাছে নিয়ে গেলেন।

ক্যাপ্টেন সাবের ওই ক্যাম্পের অধিনায়ক। তার নির্দেশেই আমাদের তরুণ মুক্তিযোদ্ধারা অকাতরে প্রাণ নিচ্ছেন ও দিচ্ছেন। তিনি সারাদিন বসে বসে শত্রুপক্ষের গতিবিধির খবরা খবর নেন। তারপর নিজের ট্রাটিজী ঠিক করেন এবং তদনুসারে মুক্তি যোদ্ধাদের এ্যাকশনে পাঠান। সময় সময় নিজেই ছোট ভাইদের নিয়ে এ্যাকশনে চলে যান। অবশ্য তা নির্ভর করে এ্যাকশনের গুরুত্বের উপর। দোহারা চেহারার লোক এই ক্যাপ্টেন। তাকে ইতিপূর্বে দেখেছি বলে আবছা আবছা মনে পড়তে লাগল। কিন্তু কোথায় দেখেছি তা স্মরণ করতে পারছিলাম না। তবে তিনি আমাকে দেখেই চিনে ফেললেন। বললেন, – রহমত কেমন আছে? বললাম, জানি না। সাথে সাথে মনে পড়ল এ-ক্যাপ্টেনকে ঢাকা  মেডিক্যাল কলেজ হোষ্টেলে দেখেছি। তখন তিনি ছাত্র। ছিলেন এবং ছাত্রলীগ করতেন। তাকে দেখেছি প্রতিটি আন্দোলনে প্রতিটি মিছিলের পুরোভাগে। তাছাড়া দেখেছি সংবাদপত্রের রিপোর্টারদের টেবিলে।বললাম, আপনি ত ডাক্তার হয়েছিলেন, শুনিছি পরে আর্মি মেডিক্যাল কোরে যোগ দিয়েছিলেন। আর এখন দেখছি ‘কমাণ্ডারগিরি’ করছেন। একটু হেসে বললেন, এখন দরকার এ্যাকশনের, যুদ্ধের,তাই এ এমসি ছেড়ে যুদ্ধে নেমেছি।এরপর অনেক কথার পর জিজ্ঞেস করলাম আমাদের মুক্তি

যযাদ্ধারা কেমন করছে। কথাটা  বলার সাথে সাথে তিনি আমাকে

হাত ধরে ক্যাম্প দেখাতে নিয়ে  চললেন। ভেতরে গিয়ে দেখি

তরুণ মুক্তি যোদ্ধাদের প্রায় সবাই – আমাকে চেনে এবং আমিও তাদের অনেককে চিনি। এদেরকে দেখেছি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের – চত্বরে, রেস কোর্সের সমাবেশে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে, ঢাকার রাজপথে শশাভাযাত্রা ও মিছিলে। এদের অনেকেই বড় লোকের সন্তান। বেশ আরাম আয়েশে এরা দিন কাটাতে পারত। তদুপরি ওদের অনেকেই ছিল বিশ্ববিদ্যালয় ও কলেজের সেরা ছাত্র। অনায়াসে তারা সি এস। পি, পি এস পি হতে পারত। কিন্তু বঙ্গবন্ধুর অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত আমাদের এসব গৌরবের ধন আজ মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার্থে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়েছে। মার্চএপ্রিলের মত আজ আর তারা আনাড়ী যোদ্ধা নয়। এরা আজ

পুরাপুরি ট্রেনিং প্রাপ্ত। প্রয়োজনীয় অস্ত্র হাতে থাকলে এদের দশজন অন্ততঃ একশো দু’শো শত্রু সৈন্যকে ঘায়েল করতে পারে।

ক্যাপ্টেন ও ওদের কয়েক জনের সাথে আলাপ করে দেখলাম তারা নির্ভয়। মৃত্যুকে তারা আজ পরোয়া করে না। বাংলাদেশের মা-বোনদের যার। ইজ্জত নষ্ট করেছে তাদের খতম করার জন্যে ওরা মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা কষতে প্রস্তুত। তাতে ওদের এতটুকু সংশয় নেই, এতটুকু ভয়-ভীতি নেই। কথাটা এক পর্যায়ে ক্যাপ্টেন নিজেও আমাকে বলেছিলেন। কথা প্রসঙ্গে তিনি বলেছিলেন, “ওদের নিয়ে আমাকে অসুবিধায় পড়তে হয়। অনেক। বাঘ যেমন নরমাংসের গন্ধ পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে তেমনি ওরাত কোন স্থানে শত্রুর উপস্থিতির সংবাদ পেলে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে। শত্রুর কাছে কি অস্ত্রশস্ত্র আছে আর ওদের নিজেদের কাছে কি আছে তার বাদ-বিচার ওরা করতে চায় না। অথচ যুদ্ধে সৈনিকদের কর্তব্যগুলো নিয়ম মেনে চলতে হয়।

ক্যাম্প দেখে ক্যাপ্টেনের তাঁবুতে ফিরছি সে সময় অতি পরিচিত একজন মুক্তিযোদ্ধা কাছে এসে জিজ্ঞেস করল••ভাই, আমাদের মুজিব ভাই কি বেঁচে আছেন, ওনাকে কি আমরা ফিরে = পাব? – এ প্রশ্নে নতুনত্বের কিছু ছিল – না। এ প্রশ্নের সম্মুখীন হতে হয়

প্রতিদিন অসংখ্যবার। তবু একে কি জবাব দেব ভেবে পেলাম না। বললাম, মুজিব ভাইকে নিয়ে এত ব্যস্ত হয়েছেন কেন। তিনি ত বলে গেছেন হুকুম দিতে না পারলেও যেন আমরা নিজ নিজ কৰ্ত্তব্য করে যাই। সুতরাং তিনি বেঁচে আছেন কি নেই, ফিরে ফিরে আসবেন কি আসবেন না তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তিনি যা চিয়েছিলেন তা সমাধা করার কাজে আত্মনিয়োগ করাই কি শ্রেয় নয়? তিনি বললেন, “তা ত ঠিক। আমরা তাই করছি এবং করব। প্রয়োজন বোধে প্রাণ দেব। কিন্তু মুজিব ভাইকে ছাড়া যে বাংলাদেশের অস্তিত্ব চিন্তাই করতে পারি না। আর আমার নিজের কথা জানেন? মুজিব ভাই-এর হাতছানি না পেলে আমার অধ্যাপক হওয়া ত দূরের কথা। জীবনে মাধ্যমিক স্কুলের সীমানাও ডিঙ্গাতে পারতাম না। আমার বাবা ও ভাইকে ঘাতকরা হত্যা – করেছে। তাতেও বেঁচে আছি। কিন্তু মুজিব ভাইকে হারালে যে বাঁচতে পারব না।(চলবে)

আরব নিধনযজ্ঞে পাকিস্তানের হাত

ফেলিস্তিনের কমান্ডো নেতা জনাব ইয়াসির আরাফাত আল আহরাম পত্রিকার এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, কম্যাণ্ডো এবং জর্ডান সেনাবাহিনীর মধ্যে সম্প্রতি অনুষ্ঠিত এক যুক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে আনুমানিক তিন হাজার মুক্তিযোদ্ধা নিহত, আহত অথবা ধৃত হয়েছেন। তিনি অভিযোগ করেন, জর্ডনি সেনাবাহিনীর পক্ষে কম্যান্ডোদের হত্যার এই জঘন্য পরিকল্পনা রচনা এবং তার বাস্তবায়ন তদারক করেন পাকিস্তান সেনাবাহিনীর জেনারেল রের্ঙ্কের একজন অফিসার।

পাতা

বিদেশী সাংবাদিকের মতে

গেরিলা আক্রমণের মুখে বাংলাদেশে পাক সেনাদের মনোবল অৱ বেশী

দিন অক্ষুন্ন রাখা যাবে না

অবরুদ্ধ ঢাকা থেকে লণ্ডনের ডেলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা প্রেরিত এক খবরে বলা হয়েছে যে, ঢাকাস্থ পাক জেনারেলরা খুবই ফাপরে পড়েছে। সংবাদদাতা মি: হোলিংওয়ার্থ লিখেছেন, সপ্তাহে চারখানি সরবরাহকারী জাহাজ গেরিলারা ডুবিয়ে দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সৈন্য ও সামরিক দ্রব্য সামগ্রী পূর্ব পাকিস্তানে নিয়ে আসার ব্যাপারে গুরুতর অসুবিধা দেখা দিয়েছে। ২৩শে আগষ্ট এ-সংবাদ ‘ডেলি টেলিগ্রাফে প্রকাশিত হয়েছে। খবরে বলা হয়েছে, আট দিন আগে চট্টগ্রাম বন্দরে মেয়াদী মাইনের। বিস্ফোরণে দু’ খানা জাহাজ বিধ্বস্ত হওয়ায় এবং গত শনিবার চাঁদপুরের কাছে ৯০০ টনের একখানি উপকূলবর্তী মালবাহী জাহাজ ও একটি বিরাট বাঁধ ক্ষতিগ্রস্থ হওয়ায় পাক জঙ্গী চক্রের সঙ্কট এখন তীব্র হয়ে দেখা দিয়েছে।

খবরে জানা গেছে, গেরিলারা সুরক্ষিত সামরিক লক্ষ্যবস্তুর ওপর আক্রমণ শুরু করেছে এবং গেরিলা তৎপরতা শুরু হওয়ার পর থেকে এ পর্যন্ত ১৫৭টি প্রধান সড়ক ও রেলসেতু বিধ্বস্থ করেছে। তা ছাড়া প্রায় এক হাজারের মত ছোট সেতু ও কালভার্ট উড়িয়ে দেওয়া হয়েছে।

খবরে আরও প্রকাশ, পাক সেনাবাহিনী গুরুত্বপূর্ণ ঢাকা-চট্টগ্রাম রেল সেতুটি এখনও পর্যন্ত মেরামত করতে পারেনি। গত শুক্রবার কুমিল্লা ও চট্টগ্রামের মধ্যবর্তী প্রধান রেল সেতুটি বিধ্বস্থ হওয়ায় বন্দর থেকে খাদ্য দ্রব্য এবং অন্যান্য জিনিষপত্র পরিবহনেও গুরুতর অসুবিধা দেখা দিয়েছে।

আরও জানা গেছে যে, পাক সেনাদেরকে গেরিলা তৎপরতা সম্পর্কে একদম অন্ধকারে রাখা হয়েছে। উদ্দেশ্য খান-সেনাদের মনোবল অটুই রাখা। কিন্তু তা সত্ত্বেও রাস্তায় পোতা গুপ্ত মাইন, সৈন্যবাহী ট্রেনের লাইনচ্যুতি ও অপ্রত্যাশিত গোলাগুলি বর্ষণে তাদের মনোবল বেশী দিন অটুট রাখা আদৌ সম্ভব হবে না।

মুসলিম রাষ্ট্রের প্রতি একটি জিজ্ঞাসা

ইন্দোনেশিয়ার জাকার্তা টাইমস’-এ পাকিস্তানী সৈন্যদের বর্বরতার কথা উল্লেখ করতে যেয়ে বলা হয়, যখন মুসলমানরা সহস্র সহস্র মুসলমানদের হত্যা করছে তখন ইসলাম কি জীবিত থাকতে পারে ? বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে এ প্রশ্ন আজ গুরুত্ব সহকারে বিবেচনা করতে হবে।  

পত্রিকায় বলা হয়, শেষ পর্যন্ত পূর্ব পাকিস্তান যদি একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র হিসাবে জন্ম নেয় ( সমস্ত পৃথিবীই জানে যে, এটা হতে বাধ্য ) তা হলে বর্তমান সঙ্কটকাল অন্যান্য মুসলিম রাষ্ট্রের জন্য এটা কি উদ্বেগের কারণ হয়ে দাড়াবে না? যদি ভবিষ্যৎ স্বাধীন বাংলাদেশ মনে করে যে, মুসলিম জগত নিপীড়িতদের সমর্থন না করে ক্ষমতাবাদও নিপীড়ক ও শোষকদের সমর্থন যুগিয়ে এসেছে। সেদিন কি মুসলিম জগত দুর্বল হয়ে পড়বে না। ইসলামের জন্য এটা হবে একটি বিরাট আঘাত।

ব্রিটেনে বাংলাদেশ চিকিৎসক সমিতি

বিগত পনেরই আগষ্ট লণ্ডনে বাংলাদেশ মেডিকেল এসোসিয়েশনের কর্মকর্তা নির্বাচন পর্ব সমাপ্ত হয়। বৃটেন ছাড়া আমেরিকা, কানাডা, সুইডেন, বেলজিয়াম, আয়ারল্যাণ্ড, সৌদি আরব ও লিবিয়া প্রবাসী বাঙ্গালী চিকিৎসকরা পোষ্টাল ভোটের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করেন।

ডাঃ আবু হেনা সায়দুর রহমান সমিতির সভাপতি, ডাঃ কাজী ফজলুল হক ও ডাঃ মোহাম্মদ আবদুল হাকিম সহ-সভাপতি, ডাঃ জাফরুল্লাহ চৌধুরী সাধারণ সম্পাদক, ডাঃ আলতাফুর রহমান ও ডাঃ আবদুল মবিন, যুগ্ম সম্পাদক এবং ডাঃ শামসুল আলম ডাঃ আবদুস সাত্তার, ডাঃ কাজী নজরুল ইসলাম, ডাঃ নলিনী কান্ত বিশ্বাস, ডাঃ সৈয়দ সালেহ আহম্মদ সদস্য নির্বাচিত হয়েছেন।

মুক্তিযুদ্ধে শিল্পীবুদ্ধিজীবীদের

ভূমিকার প্রশংসা

সাপ্তাহিক ‘জয়বাংলা পত্রিকার সম্পাদক মণ্ডলীর সভাপতি, জনাব আহমদ রফিক বাংলাদেশের বর্তমান সঙ্কটজনক পরিস্থিতিতে শিল্পী সমাজের ওপর যে কঠোর দায়িত্ব অর্পিত হয়েছে তা আন্তরিক তার সাথে প্রতিপালনের আহ্বান জানিয়েছেন।

জনাব আহমদ কলকাতার ললিতকলা একাডেমীতে বাংলাদেশ চলচ্চিত্র শিল্পী ও কুশলী সমিতি আয়োজিত এক সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের উদ্বোধন করেন।

অনুষ্ঠানের উদ্বোধনকালে তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের ধারাবাহিক ইতিহাস বর্ণনা প্রসঙ্গে বলেন যে, দেশের আপামর জনসাধারণকে মাতৃভূমির অশেষ ঋণ পরিশোধের জন্য উদ্বুদ্ধ করার ব্যাপারে শিল্পী, সাহিত্যিক, কবি ও বুদ্ধিজীবীরা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা পালন করে যাচ্ছেন।

বাংলাদেশ স্বাধীনতা যুদ্ধে তহবিল সংগ্রহের জন্য এই সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে অন্যান্যদের মধ্যে পার্লামেন্ট সদস্য জনাব জিল্লুর রহমান উপস্থিত ছিলেন।

পাকিস্তান সিটোর কাছেও

পাত্তা পেলো না

                                                     [জয় বাংলা প্রতিনিধি ]

ইয়াহিয়া ও তার বুদ্ধিহীন, বিবেকহীন, ইতিহাসের জ্ঞানহীন কূপমণ্ডুক সামরিক জান্তা লেজে খেলতে চেয়েছিল। ভেবেছিল  তার রূপসী বর্ণাঢ্য লেজের যৌবনে আকৃষ্ট হয়ে অনেকেই তা . পাকড়াবার জন্যে হন্যে হয়ে উঠবে। কিন্তু সে বুঝতে পারেনি যে, পাঁচ মাসে তার চামড়া ঢিলে হয়ে গেছে, সে রূপহীন কদৰ্য হয়ে পড়েছে সারা শরীরে কুষ্ঠ রোগ ছড়িয়ে পড়ে তা থেকে বিকট গন্ধ বেরুচ্ছে। তাকে আলিঙ্গন করা দূরে থাকুক তাকে দেখে সবাই পড়ি মরি করে পালাতে পথ পাচ্ছে না।

বাংলাদেশে গণহত্যা চালাবার পর মুক্তি বাহিনীর চরম প্রতিশোধ নেয়ার পালা শুরু হলে ভীত-সন্ত্রস্ত ইয়াহিয়া এবং সামরিক জান্তা তার প্রায় তালাক দেওয়া নাগরের কাছে আবার লুডিড-খটক নাচ নেচে মনোরঞ্জনের চেষ্টা করতে গিয়েছিল। কিন্তু ‘সিটো’ শঠ প্রবঞ্চক পাকিস্তানকে জোড়া পায়ে লাথি মেরেছে।

থাইল্যাণ্ড ‘সিটোর’ (দক্ষিণ পূর্ব এশিয়া চুক্তি সংস্থ) সেক্রেটারী জেনারেল এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র তার প্রতিপত্তিশালী পার্টনার। থাইল্যাণ্ড পাকিস্তান সরকারের অনুরোধের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুষ্ঠ প্রদর্শন করায় অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রও তাদের প্রতি চোখ ঠেরে দিয়েছে। বারাঙ্গনাদের শেষ পর্যন্ত এমন ভাগ্যই বরন করতে হয়।

পাকিস্তান ‘সিটো থেকে অস্ত্র সাহায্য না পাওয়ার পর তার বৈদেশিক মুদ্রার প্রায় নিঃশেষিত ভাণ্ডার থেকে প্রায় রক্ত-মূল্যে থাইল্যাণ্ড থেকে বিমানের জ্বালানী ক্রয় করতে চেয়েছিল। কিন্তু থাইল্যাণ্ড হিটলার-আইখম্যানদের সাথে সম্পর্ক রাখা মানবদ্রোহী কাজ বলে মনে করে সে অনুরোধও প্রত্যাখ্যান করেছে।

এদিকে সিনেটর কেনেডী ওয়াশিংটনের জাতীয় প্রেস ক্লাবে এক জনাকীর্ণ সাংবাদিক সম্মেলনে পাকিস্তান তার বেহায়পনা ও বেয়াড়াপনা বন্ধ না করলে তাকে ‘সিটো’ থেকে বহিষ্কার করার প্রস্তাব দিয়েছেন।

লন্ডনে বাংলাদেশ মিশন

ভারতের বাইরে লণ্ডনে ২৭শে আগষ্ট আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাদেশ মিশনের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। বি বি সি এ খবর দিয়েছে।

মিশনের নেতৃত্ব করছেন বিচারপতি জনাব আবু সাঈদ চৌধুরী।

জনাব চৌধুরী অনুষ্ঠানে বক্তৃতা প্রসঙ্গে বলেন, পাকিস্তানী জঙ্গীশাহী সম্পূর্ণ বেআইনী ভাবে শেখ মুজিবকে বন্দী করে রেখেছে। তিনি অবিলম্বে শেখ মুজিবের মুক্তি দাবী করেন।

বিচারপতি চৌধুরী বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রের উদ্দেশ্যে আবেদন জানান। এ ছাড়া ইয়াহিয়া সরকারকে তিনি সব ধরনের সাহায্য বন্ধ করে দেওয়ার জন্যও সব রাষ্ট্রের নিকট আবেদন জানান। কারন, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী এই সব আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বাংলাদেশে গনহত্যায় ব্যবহার করে চলেছে।

বাংলাদেশ মিশন, ২৪ পেম ব্রিজ গার্ডেনস, লণ্ডন ওয়েষ্ট-২ ঠিকানায় স্থাপিত হয়েছে।

           

টিক্কার স্থলে মালিক

প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, জল্লাদ। চক্র বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার গভর্ণর পদ থেকে ঘাতক টিক্কাকে সরিয়ে তদস্থলে তাদেরই একজন তল্পিবাহক বাঙ্গালীকে গভর্ণর পদে বসিয়েছে। এই পদের জন্য পিণ্ডির সরকারী মহল ডাঃ এ, এম, মালিকের নাম সরকারীভাবে ঘোষণা করেছে।টিক্কা খানের অপসারণ ইয়াহিয়া-টিক্কার ক্ষমতার দ্বন্ধের অংশ কিনা অথবা লুষ্ঠিত মালের ভাগাভাগি প্রশ্নে মতানৈক্যেরনপরিণতি কিনা তা আমাদের – জানা নাই। তা নিয়ে মাথা – ঘামাবার প্রয়োজনও কোন বাঙ্গালীর নাই। বাংলাদেশ একটি স্বাধীন দেশ। তারগভর্ণর নিয়োগ বা বদলের কোন অধিকার ইয়াহিয়া খানদের নাই। তদুপরি কোন বাঙ্গালী যদি ইয়াইয়া খানের তল্পিবাহক হিসাবে গভর্ণর হতে চায় তাকে বাঙ্গালী জাতি এক নম্বরের দুশমণ হিসাবেই গ্রহণ করবে তিনি ডাঃ মালিকই হোন বা অন্য কেহ হোন। রাজনৈতিক মহলের ধারণা একটা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে ইয়াহিয়া খান বাঙ্গালী’ ডাঃ মালিককে বাংলাদেশের দখল_ কৃত এলাকার গভর্ণর নিযুক্ত করছে। তারা ডাঃ মালিককে গদিতে বসিয়ে ‘একথাই প্রমাণ করতে চাবে যে বাংলাদেশে সামরিক শাসন নেই এবং তদস্থলে বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু করা হয়েছে। সুতরাং ভারত থেকে শরণার্থীদের দেশে ফেরার আর কোন অসুবিধা রইল না অর্থাৎ তারা বুঝাতে চাবে যে বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে। ইয়াহিয়ার ইতিপূর্বেকার অন্যান্য চালের মত এচালও যে বাস্তবের কুঠারাঘাতে ভেঙ্গে দেবে তাতে সন্দেহ নাই।

জল্লাদের খায়েস মিটল না

পাকিস্তান সরকার অবশেষে বাংলাদেশে আদম শুমারী অনুষ্ঠানের দুষ্ট পরিকল্পনা বাতিল করেছে। গত ২৭শে আগষ্ট তথাকথিত পাকিস্তান সরকারের বেতারের এক খবরে একথা জানান হয়। খবরে বলা হয় যে, পাকিস্তান সরকারের মতে বর্তমানে বাংলাদেশের পরিস্থিতি এমন যাতে আগামী ডিসেম্বরে তথায় সুষ্ঠুভাবে আদম শুমারী অনুষ্ঠান সম্ভব হবে না।

বাংলাদেশে যে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহী আদম শুমারী করতে পারবে না তা আমরা আগেই জানতাম। কিন্তু গরজে পাগলরা তা বুঝেও বুঝতে চায় নি। কেননা ব্যাপারটির সাথে যে তাদের একটা অসৎ উদ্দেশ্য জড়িত ছিল

বস্তুতঃ জল্লাদ জঙ্গীশাহী যখন সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশ থেকে লাখো লাখো লোককে হত্যা ও ভিটেছাড়া করছিল তখনি ব্যাপারটা বাঙ্গালীদের কাছে পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। ওরা চেয়েছিল লাখো লাখো লোককে হত্যা করে এবং আরো ৮০/৯০ লাখ লোককে দেশ ত্যাগে বাধ্য করার পর সেখানে আদম শুমারী করে তারা পাকিস্তানে বাংলাদেশের সংখ্যাগুরুত্ব চিরদিনের জন্য নস্যাৎ করে দেবে। কিন্তু কয়েক মাসের প্রস্তুতির পর যখন দেখা গেল যে কোন ভদ্র বাঙ্গালী সন্তানের সহযোগিতা একাজে তারা পানে তখন তারা অস্পষ্ট একটা অজুহাত দেখিয়ে তা আপাতত বন্ধ করে দিল। যাক, বিলম্বে হলেও ইয়াহিয়া-টিকা আজ আংশিক উপলব্ধি করতে পেরেছে যে বাংলাদেশ আর তাদের বাপ-দাদার সম্পত্তি নয়। সামরিক শক্তির জোরে আজ আর সেখানে কোন কিছু করা সম্ভব নয়।

 

চোর!

বাংলাদেশের বুকের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যখন পৈশাচিক তাণ্ডব শুরু করে দেয় তখন পশ্চিম পাকিস্তানের রাজনীতিকগণ ( গাফফার খান ও ওয়ালি খান বাদে ) টু শব্দটি পর্যন্ত করেন নি। এখন তাদের কেউ ‘ইসলামের’ জোশে কেউ সংহতির মোহে, আবার কেউ ক্ষমতার লোভে ইয়াহিয়া-টিক্কার তালে তালে পা ফেলে চলছিলেন। কিন্তু আজ তাদের সবারই খোব ভাঙতে শুরু করেছে। তাই কেউ কেউ চুপে চুপে মুখ খুলতে শুরু করেছেন। কিন্তু তারা জানতেন না যে স্বৈরাচারী তার কাজ ফতেহ হলে কাউকে ছাড়ে না। তাই আজ ইয়াহিয়াচক্র পশ্চিম পাকিস্তানের যে সব রাজনৈতিক নেতা একটু বেয়াদবী দেখাচ্ছেন তাদেরকে পাকড়াও করছে। তবে ভদ্র জনোচিত অভিযোগে পাকড়াও করলেও আপত্তির তেমন কিছু থাকত না। কথা হচ্ছে একেবারে চুরি-ডাকাতির অভিযোগে।

খবরে প্রকাশ, পাকিস্তানের সামরিক চক্র পশ্চিম পাকিস্তানের মুলতান জেলায় ‘চুরি ও চুরি’ সংঘটনে সহায়তা করার অভিযোগে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের বেশ কয়েক জন নেতাকে গ্রেফতার করে জেলে পুরেছে। খবরটি প্রকাশ করেছে লাহোরের উদ দৈনিক ‘নওয়াই ওয়াকত।

যাদের গ্রেফতার করা হয়েছে তাদের মধ্যে রয়েছেন জনাব জুলফি কার আলি ভূট্টোর পাকিস্তান পিপলস্ পার্টির মালিক নিয়াজ আহমদ, নবাবজাদা নসরুল্লাহ খানদের পাকিস্তান ডিমোক্রেটিক পার্টির সৈয়দ মুকতার শাহ, খান আবদুল কাইয়ুম খানের মুসলিম লীগের মালিক এলাহী বক্স, এবং দৌলতানা মুসলীম লীগের জনাব রমজান ডেলি।

ইয়াহিয়া খানদের আইন অনুযায়ী অনুরূপ অভিযোগে সাজা পেলে এরা আর দেশের রাজনীতিতে তথা কোন নির্বাচনে অংশ নিতে পারবেন না।

মার্কিন সরকারের সমালোচনায় বোলজ

ভারতে নিযুক্ত সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত মিঃ চেষ্টার বোলজ সম্প্রতি ‘টাইমস অব ইণ্ডিয়ার’ চিঠিপত্র কলামে প্রকাশের জন্যে প্রেরিত এক পত্রে বলেন যে, বাংলাদেশে পাকিস্তানের জঙ্গীশাহীর সৃষ্ট পরিস্থিতির দরুণ ভারত সরকার যে সমস্যার সম্মুখীন হয়েছেন তৎসম্পর্কে মার্কিন সংবাদপত্র জগত, কংগ্রেস ও জনগণ আজ একমত। তার জানামতে ভারতের কোন অসুবিধার ব্যাপারে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে এমন ঐক্যমত আর কোন সময় প্রতিষ্ঠিত হয়নি। এই ঐক্যমতের মুখে বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন প্রশাসনের কার্যকলাপ তিনি নেহায়েত দুঃখজনক বলে অভিহিত করেন। মিঃ বোলজ তার পত্রে জানান যে, বিদেশী সংবাদপত্র ও বিদেশী নাগরিকদের কাছে তিনি এতদিন নিজ সরকারের সমালোচনা থেকে বিরত ছিলেন।

তিনি বলেন, বাংলাদেশ সমস্যার একটা রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানে সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য বিশ্ব ব্যাঙ্ক যে সুপারিশ করেছেন মার্কিন প্রশাসন তা মেনে চলতেও ব্যর্থ হয়েছেন।

তিনি বলেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হওয়া পর্যন্ত পাকিস্তানকে খাদ্যও ঔষধপত্রবাদে অন্যান্য সমস্ত সাহায্য বন্ধ করে দেবার জন্য মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ ইতিমধ্যেই মার্কিন বৈদেশিক সাহায্য কর্মসূচী আইন সংশোধনি করেছে। সিলেরে পরবর্তী অধিবেশনে সংশোধনটি বিপুল ভোটাধিক্যে গৃহীত হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!