You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ২৭ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয় বাংলা
শুক্রবার, ১০ই ভাদ্র, ১৩৭৮ ২৭শে আগষ্ট’৭১
তাকে হত্যা করে বাঙ্গালী জাতিতে স্তব্ধ করা যাবে না
[ জয় বাংলা প্রতিনিধি ]
মানব ইতিহাসের নৃশংসতম হত্যাকারী ইয়াহিয়া লাখো লাখো নিরপরাধ বাঙ্গালীর শোণিতে দেহ রঞ্জিত করেও তার রক্ত পিপাসা নিবৃত্ত করতে পারেনি। খেকি কুত্তা খিপ্ত হয়ে উঠলে যেমন দিকবিদিক জ্ঞান শূন্য হয়ে যা তা কিছু করে বসে তেমনি মদ্যপ দুশ্চরিত্র ইয়াহিয়াও ঝাকালো ডিম্পল হুইস্কির নেশায় গোলাবী হয়ে গিয়ে তার মনিব বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচারের প্রহসন চালাবার জন্য উদ্ধত ঔদ্ধত্ব্যে খেউ খেউ রব ছাড়তে শুরু করেছে।
মানব সভ্যতা ও মানবিক মূল্যবোধের প্রতি হুমকি স্বরূপ এই ঘৃণ্য নরপশুকে তার বিপজ্জনক কাজ থেকে নিবৃত্ত করার জন্য বিশ্বের মানবতাবাদী বিবেক তাদের কণ্ঠস্বরকে উচ্চগ্রাসে তুলেছেন। কিন্তু তাতেও কোন লাভ হচ্ছে না। উন্মত্ত খেকি কুত্তাকে যেমন মুগুরের আঘাতে মাথার মগজ বের করে দিয়ে মানুষের স্বাভাবিক জীবন যাত্রা পরিচালনার পথকে কণ্টকহীন করতে হয় ইয়াহিয়া এবং তার ইতিহাসের শিখা বিস্মৃত জান্তাকেও তেমনি প্রচণ্ডতার সাথে আঘাত করতে না পারলে আগুন নিয়ে খেলা করা থেকে নিবৃত্ত করা যাবে না। ইতিহাসের আস্তাকুড়ের গালিজ-পচা চরিত্র হিটলার, আইখম্যান, মুসোলিনীদেরও মিষ্টি কথায় নিবৃত্ত করা যায় নি। যেমন কুকুর তার জন্য তেমন মুগুরের প্রয়োজন। আমাদের মুক্তি বাহিনী..
[ পরের পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি ]

ইয়াহিয়ারা কেন পাক-ভারত যুদ্ধ বাধাতে চায়—
লণ্ডনের ‘নিউ ষ্টেটসম্যান’ পত্রিকায় একজন ভাষ্যকার—লিখেছেন ঃ বাংলদেশ গেরিলারা ভিয়েৎকংদের মত ভারী মর্টার ও মেশিনগান পেলে ৬ মাসের মধ্যেই বাংলাদেশকে মুক্ত করতে সক্ষম হতো।
ভাষ্যকার তার উক্তির সমর্থনে বিলোনিয়া ও সাতক্ষীরায় মুক্তি বাহিনীর সাফল্যের কথা উল্লেখ করেন। প্রকাশ, বিলোনিয়ায় জুলাই-এর শেষ দুই সপ্তাহ ব্যাপী যুদ্ধে ৭০ জন মুক্তি সেনা শহীদ হন কিন্তু খান সেনা নিহত হয় ৪৫০ জন। এই যুদ্ধে মুক্তি বাহিনীর আক্রমণ প্রতিরোধ করার জন্য হানাদার বাহিনী পূর্ণ দুই ব্রিগেড সৈন্য নিযুক্ত করেই ক্ষান্ত হয়নি অধিকন্তু ‘চীফ অব ষ্টাফ’ নিজে উপস্থিত থেকে যুদ্ধ পরিচালনার জন্য তত্বাবধান করতে বাধ্য হয়।
একই সময়ে সাতক্ষীরার যুদ্ধে ৩০০ জন পাকিস্তানী সৈন্য নিহত হয়। মুক্তি সেনা শহীদ হয় ২০ জন। মুক্তি বাহিনীর এই সাফল্যের কারণ হিসেবে ভাষ্যকার বলেন যে, বাংলাদেশ সেনা বাহিনীতে পৃথিবীর সব দেশের তুলনায় অনেক বেশী শিক্ষিত যুবক রয়েছে এবং তাদেরকে ট্রেনিং দেওয়া অপেক্ষাকৃত সহজ। অধিকন্তু তারা দেশের গরীব চাষীদের সঙ্গে মিশে গেলে পশ্চিমাদের পক্ষে গেরিলাদের সনাক্ত করা সম্ভব হয় না। খান সেনারা নিজেদের সাহায্যার্থে রাজাকার বাহিনী গঠন করেও খুব সুবিধে করতে পারেনি, ভাষ্যকার মন্তব্য করেন। রাজাকাররা সাধারণতঃ মুক্তি ফৌজের মোকাবিলায় টিকতে পারেনা এবং অস্ত্রশস্ত্র ছেড়েই পালিয়ে যায়, ফলে মুক্তি বাহিনীর অস্ত্রের অভাব কিছুটা পূরণ হয়।
ভাষ্যকার আরও বলেছেন ঃ পাকিস্তান এখন কোন একটা উপলক্ষ করে (ভারতের সঙ্গে) যুদ্ধ বাধানোর চেষ্টা করতে পারে কারণ তাদের হাতের ওপর দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হয়ে যাওয়ার চেয়ে অপর কোন রাষ্ট্রের সঙ্গে যুদ্ধ করে বাংলাদেশ হারানো অপেক্ষাকৃত সহনীয় এবং পশ্চিম পাকিস্তানকে অখন্ডিত রাখার ব্যাপারে অনেকটা অসহায়ক হবে।

তারা আজো সেই শপথ ভাঙ্গেনি
গত ৩রা জানুয়ারী রেসকোর্সের বিপুল জনসমাবেশে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান পরিচালনা করতে দেখা যাচ্ছে। বঙ্গবন্ধুর এক পাশে রয়েছেন আওয়ামী লীগের সিনিয়র ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এবং অপর পাশে রয়েছেন আওয়ামী লীগের অন্যতম ভাইস প্রেসিডেন্ট ও গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র সচিব খোন্দকার মোস্তাক আহমদ।

ক্রিকেটে ভারতের নয়া ইতিহাস
ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে শেষ ক্রিকেট টেষ্টে …উইকেটে জয়লাভ করে ভারত রাবার অর্জ্জনের গৌরব লাভ করেন। চলতি বছরে ওয়েষ্ট ইণ্ডিজের বিরুদ্ধেও ভারত রাবার লাভ করেন। চলতি সিরিজের অপর দুটি টেষ্ট অমীমাংসিত ভাবে শেষ হয়।
এই সাফল্যে কলকাতা বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব এম, হোসেন আলী ভারতীয় ক্রিকেট দলকে অভিনন্দন জ্ঞাপন করেছেন।
প্রসঙ্গত উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই প্রথম ইংল্যাণ্ডের বিরুদ্ধে সিরিজে জয়লাভ করে রাবার অর্জনের গৌরব লাভ করল।

‘অন্যায়, অত্যাচার, শোষণের বিরুদ্ধে শোষিত জনতার পাশে আমি আছি, থাকবো’–শেখ মুজিব

সম্পাদকীয়
বন্যা ও মুক্তিযুদ্ধ
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ অঞ্চল বন্যায় প্লাবিত হয়েছে। হানাদার বাহিনীর দখলীকৃত এক বিস্তীর্ণ এলাকা এখন পানির নীচে। বাংলাদেশের এটা সাম্বৎসরিক বন্যা। ১৯৫৫ সালে প্রথম এই সর্বগ্রাসী বন্যার প্লাবন দেখা দেয় বাংলাদেশে। এখন এটা নিয়মিত মৌসুমী ব্যাপার। প্রথম প্রথম এক বছর বা দু’বছর অন্তর এই বন্যা দেখা দিত। তারপর প্রতি বছর—এমনকি বছরে একাধিকবার এই প্লাবনে বাংলাদেশের মানুষ সর্বস্বান্ত হচ্ছে। বন্যায় প্রতি বছর বাংলাদেশে ফসলের যে ক্ষতি হয়, তার পরিমাণ দুশো কোটি টাকা। গবাদি পশু ও ঘর বাড়ির ক্ষয় ক্ষতির হিসাব এর মধ্যে ধরা হয়নি। অবশ্য এই দুশো কোটি টাকাও ইসলামাবাদের ‘মিথ্যাবাদী রাখাল বালকদের’ হিসাব। বন্যায় প্রকৃত ক্ষয় ক্ষতির হিসাব এখন পর্যন্ত জানা যায়নি বা জানানোর চেষ্টা হয়নি। ইসলামাবাদের উপনেবেশিক শাসকেরা সকল সময় এই ক্ষতির হিসাব চেপে রাখার চেষ্টা করেছেন।
বন্যায় বাংলাদেশের ক্ষতি শুধু ফসল, গবাদি পশু বা ঘর বাড়ি সম্পত্তি ধ্বংস হওয়ার মধ্যেই সীমাবদ্ধ নয়। এই ক্ষতির ধাক্কা যেমন পৌনপুনিক, তেমনি সুদূরপ্রসারী। এক বছরে একাধিকবার সর্বপ্লাবী বন্যা হওয়ার ফলে বাংলাদেশে খাদ্য ঘাটতি একটা সংক্রামক ব্যাধিতে পরিণত হয়েছে। দুর্ভিক্ষাবস্থা বাংলাদেশে নিত্যনৈমিত্তিক ব্যাপার। বন্যার দরুণ কৃষি সংস্কার ও অধিক খাদ্য ফলাও আন্দোলন কিছু মাত্র সফল হয়নি। ইসলামাবাদের শোষক চক্র বাংলাদেশকে ‘হরির লুঠের বাতাসার’ মত কেবল চোষণ করেছেন, কিন্তু বন্যার প্রতিকার এবং খাদ্য ঘাটতি দূর করার জন্য ‘সবুজ বিপ্লব’ অনুষ্ঠানের কোন ব্যবস্থা করেন নি। জাতি সঙ্ঘের পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টেও অত্যন্ত স্পষ্ট ভাষায় এই ব্যাপারে বলা হয়েছে যে, ‘বাংলাদেশে ভূমির উপর অত্যাধিক চাপ হ্রাসের জন্য শক্তি চালিত পাম্প ও গভীর নল কূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্তন দ্বারা বহু আগেই বাংলাদেশে সবুজ বিপ্লব বা কৃষি উন্নয়নের ব্যবস্থা তরান্বিত করা উচিত ছিল। কিন্তু বাংলাদেশে যা করা হয়নি, তা করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের মরুভূমিতে। সেখানে গভীর নল কূপের সাহায্যে সেচ ব্যবস্থা প্রবর্ত্তন দ্বারা গত চব্বিশ বছরে একটি খাদ্য ঘাটতি এলাকাকে খাদ্যে উদ্বৃত এলাকায় পরিণত করা হয়েছে। অন্যদিকে সেখানকার শিল্পোন্নতিতো রয়েছেই। বাংলাদেশে না হয়েছে শিল্পোন্নতি, না সবুজ বিপ্লব। ফলে খাদ্য ঘাটতি, দুর্ভিক্ষ ও দারিদ্রের করালগ্রাসে বাংলাদেশ আজ সর্বনাশের শেষ প্রান্তে উপনীত। তারপর গোদের উপর বিষফোড়ার মত জুটেছে প্রতি বছরের বন্যা।
পিয়ারসন কমিটির এই রিপোর্টের বিবরণ প্রকাশিত হলে বাংলাদেশে রীতি মত চাঞ্চল্য সৃষ্টি হয়। আজ ঢাকা শহরের যে দুটি বা তিনটি পত্রিকা পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর পা চাটা দালালের ভূমিকা গ্রহণ করেছে, মাত্র এক বছর আগে অর্থাৎ গত বছরের এই সময় তারাই পিয়ারসন কমিটির রিপোর্টের উদ্ধৃতি দিয়ে বাংলাদেশকে বঞ্চনা ও বাঙালীদের সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকদের বিশ্বাস ঘাতকতার বিবরণ ধারাবাহিকভাবে প্রকাশ করেছে এবং ইসলামাবাদ বাংলাদেশে ঔপনিবেশিক শাসন ও শোষণ চালাচ্ছে বলে অভিমতও প্রকাশ করেছে।
বন্যা বাংলাদেশ ও বাঙালীর জীবন মরণ সমস্যা। বন্যা সমস্যার সমাধান না হলে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিপর্যয় ও সামাজিক ধ্বংস রোধ করার দ্বিতীয় কোন উপায় নেই। কিন্তু গত ষোল বছর যাবৎ প্রতি বছর কোটী কোটী টাকার শষ্য নষ্ট, জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতি হওয়ার পরও এই সমস্যার যে সমাধান হয়নি, তার কারণ বাংলাদেশের উপর পশ্চিম পাকিস্তানী জঙ্গী চক্রের ঔপনিবেশিক শাসন। বাংলাদেশ ছিল পশ্চিম পাকিস্তানের শকুনী-চরিত্রের একদল মানবতাদ্রোহী শাসকের শাসন ও শোষণের নীলা ক্ষেত্র। পাকিস্তানের পরিকল্পনা কমিশনের প্রাক্তন কর্তা এবং এখন যিনি জেনারেল ইয়াহিয়ার অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, সেই পাঞ্জাবী আমলা এম,এম, আহমদ এ যুগের শ্রেষ্ঠ প্রতারক ও জালিয়াত আখ্যালাভের যোগ্য। বাংলাদেশের উপার্জিত বৈদেশিক মুদ্রায় পশ্চিম পাকিস্তানে তারবেলা, মংলা বাধ পরিকল্পনা কার্যকরী হয়েছে, পরিকল্পনা বহির্ভূত টাকায় জমির লবণাক্ততার সমস্যা মোচন করা সম্ভব হয়েছে, এমন কি বিনা প্রয়োজনে কয়েক হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে পাঞ্জাবের মরুভূমিতে ইসলামাবাদ নাম দিয়ে একটি নতুন রাজধানী তৈরী করা সম্ভব হয়েছে; কেবল সম্ভব হয়নি, ১৯৫৫ সালের পর বাংলাদেশের বন্যা-নিয়ন্ত্রণের জন্য পাচশো কোটি টাকার একটি প্রাথমিক পরিকল্পনার অর্থসংস্থান করা সম্ভব হয়নি, বাংলাদেশের একমাত্র প্রস্তাবিত আনবিক চুল্লি রূপপুর কেন্দ্রের জন্য বৈদেশিক সাহায্য সংগ্রহ করা।
বছরের পর বছর পরাধীনতার যে মর্মজ্বালা বাঙালীরা হাড়ে হাড়ে অনুভব করেছে, তারই বহিঃপ্রকাশ আজকের মুক্তি সংগ্রাম। আজকের স্বাধীনতার সংগ্রাম। এবারেও বাংলাদেশের দখলীকৃত বিস্তীর্ণ এলাকায় বন্যার ঢল নেমেছে এবং বিভিন্ন নদীতে পানির উচ্চতা বিপদ সীমার দিকে দ্রুত এগিয়ে গেছে। কিন্তু এবারের বন্যা বাঙালীদের জন্য যতই দুঃখ কষ্টের হোক, তার মধ্যে আশীর্বাদের অংশও কম নয়। বন্যার ফলে হানাদার বাহিনীর চলাচল এখন রুদ্ধ। তাদের ট্যাঙ্ক ও বিমান অকেজো হয়ে পড়েছে। দখলীকৃত এলাকায় বাঙ্গালী মুক্তি বাহিনী এই সুযোগে আগের চাইতেও তৎপর হয়েছেন। এই তৎপরতা আরো বাড়াতে হবে। শত্রুর উপর চূড়ান্ত আঘাত হানার সন্ধিক্ষণ দ্রুত এগিয়ে আসছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের বন্যা সমস্যার সমাধান, বাংলাদেশের মানুষের সকল দুঃখ কষ্টের অবসানের একমাত্র উপায় তার স্বাধীনতা। এই স্বাধীনতাকে তরান্বিত করাই আমাদের আজিকার একমাত্র কর্তব্য।

পিণ্ডির ‘রক্ষিতাদের’ ভূমিকা
পিণ্ডির রঙ্গমঞ্চে এখন নতুন খেলা চলছে। সোভিয়েট ইউনিয়নের সঙ্গে ভারতের মৈত্রী চুক্তি সম্পাদনের পর জেনারেল ইয়াহিয়ার গলা স্বর সপ্তম থেকে একেবারে নীচু খাদে নেমে গেছে। কথায় বলে, ‘খুটার জোরে ভেড়া কোদে।’ ইয়াহিয়া-চক্র ভেবেছিল, তারা একটি নয় দুটো খুটো সংগ্রহ করেছে। একটি চীন এবং অন্যটি আমেরিকা। এই খুটার জোরে তারা বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধ নিকেশ করে দেবেন এবং অন্যদিকে বাংলাদেশের লক্ষ লক্ষ শরণার্থীকে আশ্রয় দিয়ে যে ভারত এক বিরাট মানবতামূলক মনোভাবের পরিচয় দিয়েছে, তাকেও এক হাত দেখিয়ে দেবেন। কিন্তু ভারত-সোভিয়েট মৈত্রী চুক্তি সম্পাদিত হওয়ার পর বাচাল ইয়াহিয়ার মুখে আর রা’টি নেই। কথায় বলে ‘জাতে মাতাল তালে ঠিক।’ ইয়াহিয়াও তার কুচক্রী সঙ্গীরাও যতই নেশায় বুদ হয়ে থাকুন না কেন, ভারত-সোভিয়েট চুক্তির আসল তাৎপর্য তারা ঠিকই উপলব্ধি করেছেন।
বিশ্ব-রাজনীতিতে পশ্চিম পাকিস্তানের জঙ্গী চক্রের ভূমিকা এখন রক্ষিতার নয়, বারবনিতার। দীর্ঘকাল পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রে আমেরিকার ‘রক্ষিতা’ থাকার নীতি অনুসরণের পর এখন ইয়াহিয়া-চক্র ভাবছে, তাদের ‘বাবু’ একটি নয় দু’টি—চীন এবং আমেরিকা। পালাক্রমে কোল বদল দ্বারা ইয়াহিয়া-চক্র একবার চীনের এবং একবার আমেরিকার মনসৃষ্টি চেষ্টা করেছে এবং এবারে দুই ‘বাবু’—অর্থাৎ নিক্সন ও চৌ-এন লাইয়ের মধ্যে মিলন ঘটিয়ে একসঙ্গে উভয় দেশের অনুগ্রহ লাভ দ্বারা দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় তার গণতন্ত্র ও মানবতাবিরোধী দুস্কার্য অব্যাহত রাখার দুরাশা পোষণ করছে। কিন্তু পিণ্ডির ফ্যাসিষ্ট মিলিটারী জান্টা অতীত ইতিহাস থেকে কোন শিক্ষাই গ্রহণ করেনি। তাই নেশায় বুদ হয়ে ইয়াহিয়া এখনো রঙিন খোয়াব দেখছেন এবং ভাবছেন, তার বিপদে ‘বাবুরা’ সহায় হবেন। কিন্তু ‘বাবুরা’ যে রক্ষিতা বা বারবণিতাদের প্রকৃত বিপদে একেবারেই সহায়ক হন না, এই সত্যটি এই ক্ষমতাঅন্ধ মুর্খ-অত্যাচারীদের বোঝার শক্তি নেই।
ইরাকে নুরী আস্ সাইদ এবং ইন্দোচীনে দিয়েম বহুকাল আমেরিকার বিশ্বস্ত মিত্র এবং মার্কিণী স্বার্থের প্রতিভূ ছিলেন। ইরাকে ব্রিগেডিয়ার করিম কাসেমের নেতৃত্বে যখন বিদ্র্রোহ হয়, তখন প্রাণ বাচানোর আশায় বুলেট প্রুফ পোষাক গায়ে নুরী আস্ সাইদ বাগদাদের মার্কিণ দূতাবাসে ছুটে গিয়েছিলেন।এই দূতাবাসে মাত্র কয়েক গজের মধ্যে নুরী আস্ সাইদকে নৃশংসভাবে হত্যা করা হয়। কিন্তু তাকে আশ্রয় দেয়ার জন্য দূতাবাসের বদ্ধ দরোজা খুলে দেয়া দূরে থাক, জানালার একটি খড়খড়িও খুলে দেয়া হয়নি। আমেরিকার সমর্থন ও সাহায্যেই ভিয়েৎনামের তাবেদার সরকারের প্রেসিডেন্ট ছিলেন। আমেরিকার স্বার্থ রক্ষার জন্য ভিয়েৎনাম….
[ পরের পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি ]

ভিয়েতনাম পদ্ধতিতে গণহত্যার জন্য ইয়াহিয়া খান বিশেষ জল্লাদ বাহিনী গড়ে তুলেছে
পর্যবেক্ষকের দৃষ্টিতে
যুগে যুগে যে সমস্ত জল্লাদ সম্রাট ও রাষ্ট্রনায়ক বিশ্বের বুকে তাণ্ডব সৃষ্টি করেছে, নৃশংস হত্যার শিকার সাধারণ মানুষের রক্ত দিয়ে বর্বর শাসনের ইমারতে গাথুনি দিয়েছে—পিণ্ডির ইয়াহিয়া তাদের সমগোত্রীয়। অতীতের নির্যাতনকারী হত্যার নায়কদের ব্যতিক্রম তিনি নন। ২৫শে মার্চের বহু পূর্ব থেকেই এই মানব সভ্যতাবিরোধী হত্যাবাজ জেনারেল অত্যাধুনিক পদ্ধতিতে গণহত্যার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন। ক্রমে ক্রমে রুদ্ধদ্বার ভেদ করে অবিশ্বাস্য হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনার সংবাদ প্রকাশ পাচ্ছে।
সব জানোয়ারকে যেমন পোষ মানানো যায় না, তেমনি সব মানুষকে দিয়ে নিরীহ মানুষকে হত্যার জন্যে ঝুকি নেয়া সম্ভব নয়। সেজন্যেই রক্ত-পিপাসু ও পশু প্রকৃতির সেনাদের বাছাই করে হত্যাকাণ্ডের উদ্দেশ্যে প্রস্তুত করা হয়। বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এদের বিশেষ ট্রেনিং-এর ব্যবস্থা হয়েছিল।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র মুক্তিকামী ভিয়েৎনামী নাগরিকদের বেছে বেছে হত্যা ও ধ্বংসের উদ্দেশ্যে যেমন করে গুপ্ত ট্রেনিং প্রাপ্ত একটি বাহিনী প্রেরণ করেছিল—যার নাম সরকারী ভাবে ‘গ্রীন ব্যারেট’—ইয়াহিয়া সরকারও ঠিক তেমনি করে গোপনে ট্রেনিং দিয়ে একটি বিশেষ হত্যাকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। ব্যাপক গণহত্যা, বেছে বেছে জীবন নাশ, হিটলারের এস-এস অফিসারদের পদ্ধতিতে নির্য্যাতন, ধ্বংস ও অগ্নিকাণ্ড সম্পর্কে এদের বিশেষজ্ঞ করে তোলা হয়েছে। জেনারেলদের ফাইলে একে “বিশেষ বাহিনী” বা “স্পেশ্যাল ফোর্স” বলে উল্লেখ রয়েছে।
বেলুচিস্থানের রাজধানী কোয়েটা’র কাছাকাছি অঞ্চলে যে স্থানটিতে বৃটিশ আমল থেকেই সামরিক ছাউনী রয়েছে, তার নাম কাকুন। সাধারণ প্রশাসনিক কাজে কাকুন স্থানটির নাম উল্লেখ থাকে না। এই বিশেষ ছাউনীতে, সভ্য জগত হতে বিচ্ছিন্ন এই নিঃচ্ছিদ্র কাকুনে বাংলাদেশে হত্যার জন্যে বিশেষ জল্লাদ বাহিনী ট্রেনিং লাভ করে।
বিদেশী তথ্য অনুযায়ী, কাকুনে প্রায় এক ডজন আমেরিকান বিশেষজ্ঞ ইয়াহিয়ার স্পেশ্যাল ফোর্স তৈরীর কাজে ট্রেনিং দিচ্ছেন। দক্ষ হত্যাকারী গড়ে তোলাই এই বিদেশী বিশেষজ্ঞদের কাজ। বেতনভুক্ত এই হত্যাবিশেষজ্ঞদের আমদানী করা হয়েছে উত্তর ক্যারোলিনী থেকে।
আইয়ুব খার আমলে ১৯৬৪ সাল থেকেই এই ধরণের একটা বিশেষ বাহিনী গঠনের চেষ্টা চলছিল। আর সে সময় জেনারেল মুসা ও বর্তমান জেনারেল ইয়াহিয়া উক্ত বাহিনীর উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করেন। প্রধানতঃ পাঞ্জাবী ও আরো কয়েকটি রেজিমেন্ট থেকে বাছাই করা পাচ শত অস্বাভাবিক চরিত্রের সেনাকে পাঠানো হয় আমেরিকায় হত্যাবিশেষজ্ঞদের ট্রেনিং লাভ করতে। এই ব্যবস্থাটা এতোই গোপনে করা হয়েছিল যে, ইস্ট বেঙ্গল রেজিমেন্ট দূরের কথা, অধিকাংশ পশ্চিম পাকিস্তানী সেনা প্রধানও তা জানতেন না। এই সমস্ত হত্যা ও ধ্বংসের সেনাদের সমন্বয়ে যে হত্যাকারী নরপিশাচের দল গঠন করা হয়, তার নাম “স্পেশ্যাল ফোর্স”। দশ জনের এক একটি দল করে তোদের পঞ্চাশটি গ্রুপে বিভক্ত করা হয়।
আমেরিকার উত্তর ক্যারোলিনাস্থ “ফোর্ট ব্র্যাগ”-এ মার্কিণ স্পেশ্যাল ফোর্স ট্রেনিং ক্যাম্পটিতে এই ধরণের বিশেষ ট্রেনিং প্রাপ্ত হত্যা-বাহিনী তৈরী করা হয়ে থাকে। ইয়াহিয়ার স্পেশ্যাল ফোর্স প্রথমে এ “ফোর্ট ব্র্যাগ” ক্যাম্পেই লালিত হয়েছে। বর্ত্তমানে কোয়্টোস্থ “কাকুন” পশ্চিম পাকিস্তানী উন্মাদ জেনারেলদের “ফোর্ট ব্র্যাগ”। আর ‘কাকুন’ থেকে বিশেষভাবে শিক্ষাপ্রাপ্ত হত্যাকারী বাহিনীই হচ্ছে তাদের “গ্রীন ব্যারেট”।
জনৈক বিদেশী সাংবাদিকের তথ্য অনুযায়ী, অতীতে ও বর্তমানে ট্রেনিং প্রাপ্ত হত্যা বিশেষজ্ঞগণ বাংলাদেশে নরহত্যা ও ধ্বংসের অবিশ্বাস্য অভিযানে যুক্ত রয়েছে। কাকুন গুপ্ত শিবিরে এদের তিন সপ্তাহ ট্রেনিং দেয়া হয়ে থাকে। ট্রেনিং প্রাপ্ত জল্লাদদের সংখ্যা দিন দিনই এতো বৃদ্ধি পাচ্ছে যে, ভবিষ্যতের দুর্যোগের কথা বিবেচনা করে পশ্চিম পাকিস্তানের কোন কোন “বিদ্রোহ স্থানে” এদের পোষ্ট করার ব্যবস্থা হয়েছে।
২৫শের রাত্র থেকে মেজর-জেনারেল মিঠার উপর দায়িত্ব পড়েছিল ইয়াহিয়ার গেরিলা বাহিনীর। আর রক্তপিপাসু “স্পেশ্যাল বাহিনী” তারই সামগ্রিক নেতৃত্বের আওতায় আসে। এ-রাত্র থেকে এবং পরবর্ত্তী কালে এই বাহিনীই ইয়াহিয়ার গণহত্যার পরিকল্পনা কার্য্যকরী করেছে।
কিন্তু সেই স্পেশ্যাল বাহিনীর রক্ত লালসা শেষ হবার পূর্বেই তারা নিজেদের রক্ত প্রবাহ দেখে আৎকে উঠেছে। আর নিজের সঙ্গীর মৃত দেহের পাশে দাড়িয়ে শিউরে উঠেছে পরবর্ত্তী ভয়াবহ মুহূর্তের কথা ভেবে। ভিয়েৎনামে যেমন “গ্রীন ব্যারেটদের” পালিয়ে যেতে হয়েছে, বাংলাদেশের মাটিতে ঠিক তেমনি ভাবে ইয়াহিয়ার “স্পেশ্যাল বাহিনী’কে বিলীন হয়ে যেতে হচ্ছে। নৃশংস হত্যা আর ধ্বংসের শিকার দেশপ্রেমিক সাধারণ নাগরিকদের প্রত্যেকটি রক্ত কণিকা থেকে আজ জন্ম নিচ্ছে মুক্তি সেনা। তাদের দুর্জয় অভিযানের মুখে, তাদের প্রতি আক্রমণের তীব্রতার ঝলকে হত্যাকারী হায়নাদের জীবনে বিভীষিকার হাতছানি। মৃত্যু, উচ্ছেদ আর পরাজয়ের কালিমা তাদের আজ কলঙ্কিত ইতিহাসের ধিকৃত জীব বলে চিহ্নিত করছে।

রাষ্ট্রপতির যুদ্ধ তহবিলে অর্থ সাহায্য
সম্প্রতি বৃহৎ বোম্বাই বাঙালী সমাজের পক্ষ থেকে শ্রীঅরূপ কুমার সাহা রাষ্ট্রপতির যুদ্ধ তহবিলের জন্য পচিশ হাজার টাকার একটি চেক অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি জনাব সৈয়দ নজরুল ইসলামের হাতে প্রদান করেন। সে সময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশের জাতীয় চেম্বার অফ কমার্স-এর সভাপতি শ্রী এস,বি, দত্ত, জাতীয় পরিষদ সদস্য জনাব কে,এম, ওবায়দুর রহমান এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য শ্রী ফণী ভূষণ মজুমদার। রাষ্ট্রপতি চেক গ্রহণকালে উক্ত প্রতিষ্ঠানের মহৎ উদ্যোগের প্রশংসা করেন এবং কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।

নারী নির্যাতনে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা মধ্যযুগের বর্বরতাকে হার মানিয়েছে
বদরুন্নেসা আহমদ পার্লামেন্ট সদস্যা
নারী নির্য্যাতন কথাটি নতুন নয়। যুগে যুগে দেশে দেশে যুদ্ধের সময় বা অন্য কোন সামাজিক বিপর্যয়ের সময় নারী নির্য্যাতনের কাহিনী শোনা যায়। ইতিহাস তার সাক্ষ্য দেয়। নাদির শাহের আমলে, চেঙ্গিস খার আমলে এমনকি ভারতবর্ষে মধ্যযুগে রাজপুত রমণীদের উপর বহু নির্য্যাতনের কাহিনী লিপিবদ্ধ আছে। কিন্তু ১৯৭১ সালে ইয়াহিয়ার আমলে বাংলাদেশের মা-বোনেরা বর্বর পাক সৈন্যের হাতে যেভাবে নির্য্যাতনের শিকার হয়েছে ইতিহাসে তার নজির নাই। এই নজির হীন অত্যাচারের শিকার হয়েছে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার অসংখ্য মা-বোন। অল্প বয়সী বা যুবতী নারীদের এই অনেকেই নর-খাদকদের হাত থেকে নিজেদের রক্ষা করতে পারেনি। যদি কেউ তাদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে থাকেন সেটা তাদের নিতান্ত ভাগ্যের জোর বলতে হবে।
আমি স্ব-কর্ণে অনেক অত্যাচারের কাহিনী শুনেছি এবং চাক্ষুষ অনেক দেখেছি। সে সব কাহিনী বলতে গেলে নিজের মাথা ক্ষোভে রোষে হেট হয়ে যায়। স্বাধীন বাংলার প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ ঠিকই বলেছেন, “ঐ সব পাক সৈন্যদের পশুদের সঙ্গে তুলনা করলে পশুদেরও ছোট করা হয়।” পাক সৈন্যরা আজ পশুরও অধম। বর্বর আদিযুগের মানুষের হয়ত বা বিবেক ছিল। কিন্তু আজ পাক সৈন্যরা বিবেকহীন জানোয়ারে পরিণত হয়েছে। নিজেদের লোভ ও লালসা চরিতার্থ করার জন্য গ্রাম বাংলার নিরীহ যুবতী, গৃহিনী এবং কনাদের সম্পূর্ণ উলঙ্গ করে তাদের চোখের সামনে ঘুরে বেড়াতে বাধ্য করছে। মা ও মেয়েকে একই সারিতে দাড়াতে হয়েছে এবং তাও তাদের স্বামী বা পিতার সামনে। শুধু তাই নয় সেই সব নর পশুরা বাবা বা স্বামীর সামনেই তাদের ধর্ষণ করছে। দলে যতগুলো পশু ছিল তারা সবাই একই মেয়ের উপর অত্যাচার চালিয়েছে। অত্যাচারে জর্জরিত বহু মেয়ে মারা গেছে। কেউবা লজ্জা ও গ্লানি ভোলার জন্য আত্মঘাতী হয়ে মরেছে। শুধু গ্রামে নয়, শহরেও তাদের অত্যাচার সমান ভাবে চলছে। ঢাকা শহরের মেয়েরা আজ পথে বের হতে ভয় পায়। আমি নিজে ঢাকার কোন একটি পাড়ার খবর জানি, যেখানে বাবা নিজ কন্যাকে নিজ স্ত্রী পরিচয় দিয়েও রফা করতে পারে নি। বাবার বুকের উপর বেয়নেট বসিয়ে কন্যাকে বলপূর্বক জিপে উঠিয়ে নিয়ে গিয়েছে। উত্তর বাংলার কোন একটি ডাক্তারকে হত্যা করে তার তিনটি কন্যাকে সামরিক ছাউনিতে নিয়ে যাওয়া হয়। ঢাকার কোন একটি সুন্দরী মেয়ের বাবাকে বলা হয়েছে, হয় মেয়েকে তাদের ক্যাম্পে পাঠাতে হবে অন্যথায় এক লাখ টাকা সৈন্যদের কম্যাণ্ডারকে দিতে হবে। বাবা কন্যা বা টাকা কোন কিছুই দিতে না চাইলে তাকে হত্যা করা হয়। শোনা যায় সেই হতভাগ্যের কন্যা আজ ঢাকার ক্যান্টনমেন্টে বন্দিনী। এছাড়া সময় সময় ঘরের যুবতী স্ত্রী বা কন্যাকে ধরে নিয়ে যাওয়া হয় ক্যাম্পে গান বা নাচ দেখাইবার অছিলায় এবং সেখানে দিনের পর দিন চলে অকথ্য অত্যাচার, এই সব অত্যাচারের জন্য ঢাকায় টেলিভিশনের পর্দায় কোন মেয়ে সহজে আসতে রাজী হয় না, রাজী হয় না ঢাকার রেডিওতে গান গাইতে—এমনকি দিন দুপুরে ঢাকার রাস্তায় অল্প বয়সী মহিলাদের ঘুরতে দেখা যায় না।
নারী ধর্ষণ ছাড়া আরও বহু ধরণের অত্যাচারের কাহিনী বাঙ্গলাদেশের দখলীকৃত এলাকার আকাশে বাতাসে ছড়িয়ে আছে। যুবতী নারীদের স্তন কেটে ফেলে দেওয়া পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের কাছে খেলা স্বরূপ। এমনও নজীর আছে যে নারীদের ধর্ষণ করার পর বেয়নেট ঢুকিয়ে তাদের মেরে ফেলা হয়েছে। সন্তান সম্ভবা মেয়েদের পেটে বেয়নেটের খোচা মেরে পেট কেটে দিতে তাদের একটুও বাধে না। হাজারো রকমের অত্যাচারে বাংলার নারী আজ প্রপীড়িত ও জর্জরিত। তাদের কান্নায় বাঙ্গলাদেশের অধিকৃত এলাকার আকাশ-বাতাস আজ ভারী হয়ে গিয়েছে। পাক সৈন্যরা আজ ক্ষিপ্ত কুকুরের মত ঘুরে বেড়াচ্ছে। আমাদের বীর অসম সাহসী মুক্তি বাহিনীর কাছে মার খেয়ে তারা বন্য পশুর মত ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেছে। কিন্তু এই জঘন্য অত্যাচারের মুখোমুখি দাড়িয়ে আমাদের মা-বোনেরা তাদের মনোবল হারায়নি। আমি শুনেছি ঢাকার আশে পাশের একটি গ্রামের মেয়েরা দা-বটি নিয়ে বর্বর সৈন্যদের বেশ কিছুদূর নিয়ে যায়। তাছাড়া আমাদের দেশের বুদ্ধিমতী মেয়েরা কামোন্মত্ত সৈন্যদের চোখ ইশারায় প্ররোচিত করে নিজেদের ঘরে নিয়ে এসে তাদের হত্যা করেছে—এমন নজীরও আছে।
এই বিংশ শতাব্দীতে আমরা হিটলার মুসোলিনীর কাহিনী শুনেছি ভিয়েৎনামের নির্য্যাতন। শুনেছি বাইয়াফ্রার ইতিহাস। কিন্তু ইয়াহিয়া আজ সমস্ত ইতিহাসকে ম্লান করে দিয়েছে। বর্বর অত্যাচারের ও নজীরহীন নির্য্যাতনের মুখোমুখি সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী আজ দাড়িয়েছে। পৃথিবীর কোন শক্তির কাছে যদি আমরা সাহায্য না পাই, তাহলেও আজ এ কথা হলফ করে বলা যায় পশু শক্তি আমাদের কাছে মার খাবেই। সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী পর্বত প্রমাণ সাহস ও মনোবল নিয়ে এক হয়ে দাড়িয়েছে তাদের পরাজিত করে এমন শক্তি কারো নেই। আজ আমরা নিজেদের বলে বলীয়ান। আমাদের জয় হবেই।
জয় বাংলা।

‘পাকিস্তানরূপ কলসী ভেঙ্গে গেছে, দুধ চারদিকে ছড়িয়ে পড়েছে এবং ইয়াহিয়া চক্র তার চার পাশে বসে কাদছে’
স্বাধীন বাংলাদেশকে মেনে নিয়েই সমস্যার সমাধান সম্ভব—ওয়ালি খান
অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের রাজধানী রাওয়ালপিণ্ডির বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে ন্যাপ সভাপতি খান আবদুল ওয়ালি খান সরস বর্ণনা দান করেছেন। তার ভাষায় পাকিস্তানরূপ “কলসী ভেঙ্গে গিয়েছে। দুধ চারদিকে গড়িয়ে যাচ্ছে, তার চার পাশে বসে তারা কাদছে।”
পশ্চিম পাকিস্তানের নির্য্যাতিত অকুতোভয় পাঠান নেতা খান আবদুল গফফার খানের পুত্র খান ওয়ালি খান নাটকীয়ভাবে অধুনালুপ্ত পাকিস্তান ছেড়ে কাবুল গিয়ে পৌছেছেন।
তিনি কাবুল ‘নিউ ওয়েভ’ পত্রিকার প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন যে, পাকিস্তানকে ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়ার পথ থেকে এখন আর কেউ রুখতে পারবে না। পাকিস্তানের রাজনীতি এমন এক পর্যায়ে গিয়ে পৌছেছে যা থেকে আর ফিরে আসা সম্ভব নয়।
তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেছেন—“পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠনের অধিকার একমাত্র শেখ মুজিবেরই রয়েছে।’
তিনি সাংবাদিকদের কাছে এক বাস্তব সত্য নির্মম রূঢ় ভাষায় উদ্ঘাটন করেছেন। তিনি বলেছেন ঃ “পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের পক্ষে দীর্ঘদিন বাংলাদেশ দখলে রাখা অসম্ভব। আমেরিকার মতো শক্তিশালী দেশও যখন ভিয়েৎনামের বীর জনগণকে অস্ত্রের আস্ফালনে বশে আনতে পারেনি তখন খুদে পশ্চিম পাকিস্তান যার আর্থিক ও সামরিক বাজেটের স্ফীতি ঘটে বাংলাদেশের অর্থে, তারা কি করে এই অসম্ভব কাজ করবে।”
এক মাত্র ধর্মই একটি রাষ্ট্রের যে ঐক্যের বন্ধন হতে পারে না বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম সে চিন্তার মোহকে ভেঙ্গে তছনছ করে দিয়েছে। এ প্রসঙ্গে ওয়ালি খান ক্ষোভ আর বেদনা মিশ্রিত ভাষায় বলেন, “মুসলমান আর একজন নিরস্ত্র মুসলমানকে হত্যা করছে মুসলিম ভ্রাতৃ বোধ কোথায় গেল?”
তিনি বলেন যে, পাকিস্তানে নতুন সরকার গঠনের বৈধ অধিকার একমাত্র শেখ মুজিবর রহমানেরই রয়েছে। কারণ তিনি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা, কিন্তু সামরিক জান্তা শেখ সাহেবকে তার আইন সম্মত অধিকার থেকে বঞ্চিত করে বর্তমান সমস্যার সৃষ্টি করেছে।
পাঠান নেতা খান ওয়ালি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে ঘোষণা করেন যে, নির্বাচনে জনতার ম্যাণ্ডেট যদি মেনে নেওয়া হতো তা’হলে এই অভূতপূর্ব রক্তক্ষয় এড়ানো যেতো। কিন্তু সামরিক জান্তা এমন এক পরিস্থিতির জন্ম দিয়েছে যা থেকে পাকিস্তানকে রক্ষা করা আর কোন অবস্থাতেই সম্ভব নয়। তার ভাষায় “এ পাকিস্তান টুকরো টুকরো হয়ে যাবে।”
জনাব ওয়ালি খানের মতে পাকিস্তানের বর্তমান বিপর্য্যয় রোধ করার ব্যাপারে দু’টি মাত্র বিকল্প ভাবা যায়। এর প্রধান উপায় হচ্ছে পাকিস্তানকে বাংলাদেশ ছেড়ে দিয়ে আপোষ করা। এই প্রস্তাবই সমস্যার একমাত্র সমাধান বলে তিনি দৃঢ় অভিমত প্রকাশ করেন।
তার মতে সামরিক জান্তা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সাথে বাংলাদেশের সমস্যার সম্মানজনক মীমাংসার সুযোগ নিজেরাই বিনষ্ট করেছে।
সর্বশেষ খান ওয়ালি বলেন যে, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ অত্যন্ত বিপজ্জনক এবং আঞ্চলিক সংহতিও বিপদাপন্ন হয়ে পড়েছে।

দখলীকৃত বাংলাদেশে চীনা বিশেষজ্ঞ আমদানী?
বাংলাদেশের বিভিন্ন সেক্টরে সংগ্রামরত মুক্তি বাহিনীর কম্যাণ্ডারগণ পাক সেনাবাহিনীকে চীনের সমবর্দ্ধিষ্ণু সহায়তার কথা মুজিব নগর হেড কোয়ার্টারে জানিয়েছেন। তারা বলেছেন যে, মুক্তি বাহিনীর প্রচণ্ড আক্রমণ প্রতিহত করার জন্য আত্মরক্ষার তাগিদেই পর্যুদস্ত হানাদার বাহিনীকে শেষ অবধি চীন থেকে ‘বিশেষজ্ঞ’ আমদানী করতে হয়েছে।
মুজিব নগরে প্রাপ্ত খবর থেকে জানা যায় যে, এই সব বিশেষজ্ঞ গেরিলা প্রতিরোধ ইউনিট গঠন কার্যে নিযুক্ত রয়েছে এবং এইজন্য সুদূর গ্রামাঞ্চল থেকে সেনাবাহিনীতে স্থানীয় লোক সংগ্রহের চেষ্টা করছে। কিন্তু সে চেষ্টা ব্যর্থ হচ্ছে। মুক্তি বাহিনীর গেরিলা ও কম্যাণ্ডো আক্রমণের ফলে হানাদার বাহিনীকে বিপুল ক্ষয়ক্ষতি স্বীকার করতে হয়েছে এবং হানাদার বাহিনীর সাম্প্রতিক উদ্যোগ মুক্তিবাহিনীর চ্যালেঞ্জে মোকাবেলার প্রয়াস মাত্র।
বাংলাদেশের সমর বিশেষজ্ঞগণ মনে করেন যে, বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধে চীনের হস্তক্ষেপ বাংলাদেশের ভৌগলিক-রাজনৈতিক ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার। তারা মনে করেন, যে হানাদার বাহিনী ‘মরিয়া হয়ে লড়াই করছে শেষ পর্যন্ত সামগ্রিক সহায়তার লোভে বাংলাদেশকে চীনের হাতেও তুলে দিতে পারে।’ অবশ্য নয়া চীন ইয়াহিয়ার এই আগ্রাসী নীতিতে জড়িত হবে কিনা সে বিষয়ে অনেকেই সন্দেহ পোষণ করেন।
বাংলাদেশের জনগণ জাতীয়তাবাদে প্রবলভাবে আকৃষ্ট। যখন হানাদার বাহিনী গ্রামাঞ্চলে হামলা শুরু করে তখন স্থানীয় জনসাধারণ মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের যে-ভাবে সাদরে গ্রহণ করে, তাতেই জন সাধারণের মানসিকতাকে বোঝা যায়। বিস্তৃত অঞ্চল মুক্তি বাহিনীর গেরিলাদের দখলে আসে—এবং হানাদার বাহিনীকে পালিয়ে আত্মরক্ষা করতে হয়।
হানাদার বাহিনী স্থানীয় জন সাধারণের সহায়তায় নিজেদের সেনা বাহিনীকে সংগঠন করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। সেনা বাহিনীর সহায়ক দল হিসেবে যে মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনী গঠিত হয়—সে-সব দলগুলোও জন সাধারণের মনে প্রবল ঘৃণা ও বিতৃষ্ণার সৃষ্টি করেছে। মিলিশিয়া ও রাজাকার বাহিনীতে শুধুমাত্র অ-বাঙ্গালীরাই যোগদান করে। হানাদার বাহিনী বুঝতে পেরেছিল জন সাধারণের থেকে বিচ্ছিন্ন হলে বাংলাদেশে তাদের পতন অনিবার্য। অতএব রাজনৈতিক ও সামরিক সলা-পরামর্শের জন্য চীনের বিশেষজ্ঞদের উপদেশ হানাদার বাহিনীর জন্য অপরিহার্য্য হয়ে পড়ে।

কোসিগিনের হুশিয়ারী
সোভিয়েট প্রধান মন্ত্রী মিঃ কোসিগিন অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জল্লাদ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন বলে কূটনৈতিক সূত্রে জানা গেছে।
চিঠিতে মিঃ কোসিগিন বাংলাদেশে উৎপীড়ন বন্ধ করতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের তথাকথিত বিচারের ব্যাপারে আর না এগোতে সামরিক জান্তারে হুশিয়ার করে দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
পাকিস্তানে নতুন সোভিয়েট রাষ্ট্রদূত মিঃ এ,এ, রদিনভ রাওয়ালপিণ্ডিতে জেনারেল ইয়াহিয়ার হাতে এ চিঠিটি আর্পন করেছেন বলে কূটনৈতিক মহল খবর দিয়েছেন।
মিঃ কোসিগিন চিঠিতে আও বলেছেন ঃ বাংলাদেশে নিরাপত্তা বোধের অভাবেই সেখান থেকে এত নাগাড়ে শরণার্থীরা জীবন রক্ষার জন্যে ভারতে আশ্রয় নিচ্ছেন।
চিঠিতে মিঃ কোসিগিন নাকি পাকিস্তানকে হুশিয়ার করে দিয়ে বলেছেন ঃ ভারতের সঙ্গে যুদ্ধ বাধানো পাকিস্তানের পক্ষে আত্মহত্যার সামিল হবে।

ঔদ্ধত্যের জবাব
অগ্নিগর্ভ বাংলাদেশের গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত ঢাকার কার্জন হলকে অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের স্বাধীনতা দিবসের অনুষ্ঠানের কেন্দ্রস্থল করতে চেয়েছিল জল্লাদ বাহিনীর পা-চাটা জামাতে ইসলামীর দালালরা। ‘পাকিস্তানের ঐক্য’ শীর্ষক একটি আলোচনা সভার আয়োজন করার ধৃষ্টতা প্রদর্শন করেছিল দালালরা। আমাদের মুক্তি বাহিনীর দুঃসাহসী ছেলেরা বোমা মেরে সভা ভেঙ্গে দিয়ে ঔদ্ধত্যের দাত ভাঙ্গা জবাব দিয়েছে।

সংগ্রামী অভিনন্দন
“ইয়াহিয়া সরকারের বর্বর আক্রমণ বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় আজও অব্যাহত রহিয়াছে। আজও নির্বিচার গণহত্যা, নারী নির্যাতন, লুটতরাজ নিত্য-নৈমিত্তিক ঘটনা। ইহার বিরুদ্ধে বাংলাদেশের জাগ্রত জনতা মরণ পণ সংগ্রামে ঝাপাইয়া পড়িয়াছে। মুক্তি বাহিনী হানাদার সেনাবাহিনীর উপর দেশের সর্বত্র আঘাত হানিতেছে ও জ্ঙ্গীবাহিনী একের পর এক পরাজয় বরণ করিতেছে। সাথে সাথে জঙ্গীবাহিনীর অত্যাচারের বিরুদ্ধে ও বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের সপক্ষে বিশ্ববিবেক ক্রমশঃ সোচ্ছার হইয়া উঠিতেছে। এই মুহূর্তে পশ্চিম পাকিস্তানী স্বৈরাচারী সরকার বাংলাদেশের অবিসম্বাদীত নেতা শেখ মুজিবর রহমানের গোপন সামরিক আদালতে বিচার প্রহসন শুরু করিয়াছেন বলিয়া প্রচার করিয়াছেন। শেখ মুজিবর রহমান পাকিস্তানের জন্মের পর অনুষ্ঠিত প্রথম সারা দেশব্যাপী নির্বাচনের সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের নেতা এবং এই নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সর্বসম্মত রায়ে গঠিত স্বাধীন সার্বভৌম গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি। তাহাকে বিচার করার কোন অধিকার সামরিক একনায়কত্বের নাই। আমরা অবিলম্বে ইয়াহিয়া সরকারকে আগুন লইয়া খেলা হইতে বিরত থাকিতে আহ্বান জানাইতেছি। সাথে সাথে আমরা আমাদের দেশের নারী সমাজের পক্ষ হইতে বিশ্বের নারী সমাজ গণতান্ত্রিক মহিলা সংগঠন এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের সপক্ষে সমস্ত বিশ্ববাসীর নিকট আবেদন জানাইতেছি, পাক সরকারের উপর চাপ সৃষ্টির জন্য যাহাতে এই বিচার প্রহসন অবিলম্বে বন্ধ ঘোষণা করা হয় ও এই জননেতাকে মুক্তি দিয়া দেশবাসীর নিকট প্রত্যার্পণ করা হয়। অন্যথায় ইহার যে কোন পরিণামের জন্য জঙ্গী সরকারই দায়ী থাকিবে।
ইয়াহিয়া সরকার আজ তাহাদের পৈশাচিক হত্যালীলা হইতে বিশ্ববাসীকে বিভ্রান্তি করার জন্য এই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে পাক-ভারত সংঘর্ষে রূপ দেওয়ার চেষ্টা করিতেছে। এমনকি বর্ত্তমানে তাহাদের পরাজয় আসন্ন দেখিয়া ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের জিগির তুলিয়াছে।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামে ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন আমাদের দেশবাসীর নির্ভরযোগ্য সুহৃদের ভূমিকা পালন করিয়া আসিতেছেন। তাহাদের পারস্পরিক মৈত্রী চুক্তি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামকে জোরদার করিবে ও সাম্রাজ্যবাদী সাহায্যপুষ্ট পশ্চিম পাকিস্তানী ফ্যাসীবাদী সরকারকে দুর্বল করিবে।
–মালেকা বেগম, মুক্ত পূর্বাঞ্চল (বাংলাদেশ)

শেখ মুজিবের বিচার প্রহসন
জ্ঙ্গী শাসন ও পশ্চিমা শোষণে জর্জরিত বাংলাদেশ আজ মুক্তির সংগ্রামে লিপ্ত, বর্বর পশ্চিম পাকিস্তানী জ্ঙ্গীশাহী বিশ্বের ইতিহাসের সমস্ত অত্যাচারকে ম্লান করিয়া দিয়া বাংলাদেশের উপর তুলনা হীন ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করিয়াছে। যাহার ফলে প্রায় আশি লক্ষ লোক শরণার্থী হিসাবে ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হইয়াছে এবং অগণিত লোক এখনও ভারতে যাইতেছে। পৃথিবীর দুইটি বৃহৎ রাষ্ট্র পাকিস্তানকে অস্ত্র ও অন্যান্য সাহায্য দেওয়ায় পশ্চিম পাকিস্তানে যুদ্ধ-বাজদের অত্যাচার বাড়িয়াই চলিয়াছে। এমনকি সে ভারতকে আক্রমণ করার হুমকি দিতেছে। ভারতের অপরাধ সে শরণার্থীদের আশ্রয় দিয়াছে এবং বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতি সহানুভূতি জানাইয়াছে। অন্যদিকে বর্বর জঙ্গীশাহী মীমাংসা চরিতার্থ করার জন্য সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার শুরু করিয়াছে। বিশ্বের অধিকাংশ রাষ্ট্র্রই ইহাতে উদ্বেগ প্রকাশ করিয়াছে। তবুও যুদ্ধ-বাজদের চৈতন্য হয় নাই। ভারত ও সোভিয়েট ইউনিয়ন এই দুই দেশের মধ্যে সম্প্রতি যে শান্তি ও মৈত্রীর চুক্তি সম্পাদিত হইয়াছে; তাহাতে হয়ত বা পশ্চিম পাকিস্তানী যুদ্ধ-বাজদের ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধের হুমকি স্তিমিত হইতে পারে। বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রামকে দমন করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের যুদ্ধ-বাজরা যতই অত্যাচার ও গণহত্যা করুক না কেন, উহাকে কোন প্রকারে স্তব্ধ করিতে পারিবে না। সংগ্রাম জয় যুক্ত হইবেই।
দুনিয়ার কোন জাতির স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের সংগ্রাম নিষ্ফল হয় নাই। ভারতে আশ্রয় গ্রহণকারী বিরাট শরণার্থী সমস্যার সমাধান করিতে হইলে বর্তমানে বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে…..
[ পরের পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি ]

মাহমুদুল হক ওসমানী গ্রেফতার
পশ্চিম পাকিস্তানে রাজনৈতিক সংকটের পূর্বাভাষ
পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক জান্তা ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির (ন্যাপ) সেক্রেটারী জেনারেল মাহমুদুল হক ওসমানীকে গ্রেপ্তার করেছে। ন্যাপ সভাপতি খান আবদুল ওয়ালী খান লণ্ডন থেকে কাবুলে গিয়ে ইয়াহিয়ার সামরিক জান্তার মুখোস উন্মোচনের পর পার্টির সেক্রেটারী জেনারেলকে আটক করা হয়েছে।
পশ্চিম পাকিস্তানের গণতন্ত্র প্রিয় রাজনৈতিক কর্মীদের মধ্যে সামরিক জান্তার বিরুদ্ধে অসন্তোষ দানা বেধে উঠায় ইতিমধ্যেই বহু রাজনৈতিক কর্মীকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। ওয়াকিবহাল মহল আশঙ্কা করছেন যে, বেসামাল ইয়াহিয়া সরকারের হাতে পশ্চিম পাকিস্তানের আরও বহু গণতন্ত্র প্রিয় রাজনৈতিক নেতা ও কর্মী নিগৃহীত হতে পারে।
সিন্ধুর ধনকুবের ভূস্বামী, মুসলিম লীগ নেতা ও পাকিস্তানের এককালীন দেশরক্ষা মন্ত্রী এম,এ, খুরো অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের শাসনতান্ত্রিক সঙ্কট এবং পরবর্ত্তী ঘটনাপ্রবাহের জন্য ক্ষমতা মদমত্ত ভুট্টোকে দায়ী করেছেন।
জনাব খুরো ইয়াহিয়া সরকার এবং ভুট্টোকে ভারতের সাথে যুদ্ধ বাধানোর ‘পাগলামী’ থেকে নিবৃত্ত হওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।

নজরুলের ভাতা বন্ধ
কবি গুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরকে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় কোনঠাসা করার অপচেষ্টায় আইয়ুব-ইয়াহিয়া চক্র মানবতার কবি কাজী নজরুল ইসলামকে নিয়ে এক সময়ে অহেতুক সোরগোল তুলেছিল। বাংলার বিদ্রোহী চারণ কবিকে ‘মুসলমানের কবি’ বলে চিত্রিত করার হীন প্রচেষ্টা চালানো হয়েছিল। কিন্তু কবি নজরুল সম্পর্কে ইয়াহিয়া চক্রের মোহমুক্তি ঘটায় তার ভাতা পাকিস্তানের মানবতা বিরোধী জঙ্গী সরকার বন্ধ করে দিয়েছে।
কবি নজরুল দেশবিভাগের পর পাকিস্তান সরকারের কাছ থেকে প্রতি মাসে ৩৫০ টাকা করে ভাতা পাচ্ছিলেন। কিন্তু বিগত মার্চ মাস থেকে বাঙলাদেশে স্বাধীনতার সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর এ পর্য্যন্ত কবি পাকিস্তান সরকারের ভাতা পাননি। তার ভাতা বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে।
অপর এক খবরে জানা গেছে, কবি নজরুলের পুত্র কাজী সব্যসাচী পশ্চিম বঙ্গ সরকারের কাছে অসুস্থ কবির জন্য এ্যাড হক সাহায্য দেবার আবেদন জানিয়েছেন।

বাংলাদেশের সমর্থনে সিংহল
বাংলাদেশের নির্যাতীত জনগণকে সমর্থনের জন্য সিংহল সরকার জনমতের প্রবল চাপের সম্মুখীন হয়েছেন। বাংলাদেশের মুক্তিকামী জনসাধারণের জন্য সহানুভূতিশীল সরকারী নীতি নির্দ্ধারণ এবং শেখ মুজিবর রহমানের গোপন বিচারকে ধিক্কার দেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক জনসমষ্টির সঙ্গে সারীবদ্ধ হওয়ার স্বপক্ষে সিংহলে জনমত ক্রমশঃ প্রবল হয়ে উঠেছে।
যুক্তফ্রন্ট কোয়ালিশন সরকারের দুইটি সরকারী দল, ট্রটস্কীপন্থী এবং মস্কোপন্থী কম্যুনিষ্টগণ গণ্যমান্য নাগরিকদের দ্বারা গঠিত বাংলাদেশের জনগণের মানবাধিকার রক্ষা সমিতিতে যোগদান করেছেন। শ্রী লঙ্কা ফ্রীডম পার্টির অধিকাংশ পরিষদ সদস্যও উক্ত সমিতিতে যোগদান করবেন। সিংহলে বৌদ্ধ ধর্মের দুইটি সম্প্রদায়ের প্রধান পুরোহিতগণ এই আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা নেবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। বাংলাদেশের শরণার্থীদের জন্য গণত্রাণ ভাণ্ডারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে।

আবুল ফতের প্রতি
পররাষ্ট্র মন্ত্রীর অভিনন্দন
[ জয় বাংলা প্রতিনিধি ]
গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্র মন্ত্রী খোন্দকার মোস্তাক আহমদ ‘জয় বাংলার’ প্রতিনিধির সাথে এক বিশেষ সাক্ষাৎকারে ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জনাব এএফএম আবুল ফতেহ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় গভীর আনন্দ প্রকাশ করে তাকে অভিনন্দিত করেছেন।
তিনি বলেন, শুধু বাঙ্গালীরা নয়, বহু সংখ্যক অবাঙ্গালী কূটনীতিও জল্লাদ ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ সম্পর্কিত নৃশংস নীতির সাথে একমত হতে না পারায় তাদের স্থলে সেনা বাহিনীর জেনারেলদের নিয়োগ করা হচ্ছে। এ প্রসঙ্গে তিনি বৃটেন, ওয়াশিংটন ও নিউইয়র্কে নিযুক্ত পশ্চিম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতদের বিষয়ে উল্লেখ করেন।
পররাষ্ট্র মন্ত্রী বলেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানী যে সব কূটনীতিক ইয়াহিয়ার বাঙ্গালীর রক্তে-ভেজা অমানবিক নীতির সাথে একমত হতে না পেরে পদত্যাগ করবেন গণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার তাদেরকেও অভিনন্দন জানাবে।
সর্বশেষ জনাব আহমদ উদ্ধত ইয়াহিয়ার ঔদ্ধত্যপূর্ণ বাংলাদেশ নীতির বিরুদ্ধে সমুচিত জবাব দানের জন্য জনাব আবুল ফতেহর উজ্জল দৃষ্টান্তে অনুপ্রাণিত হয়ে জল্লাদদের সাথে সকল প্রকার সম্পর্ক ছিন্ন করে স্বাধীনতার রক্ত পতাকা সমন্নুত রাখার সংগ্রামে অংশ গ্রহণের জন্য প্রতিটি বাঙ্গালীর প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান।

এমন বর্বরতা জীবনে দেখিনি
‘পূর্ব বাংলার জনগণের উপর যে নির্মম অত্যাচার হয়েছে, আমি অতীতে কখনও তা প্রত্যক্ষ করিনি।’ যুক্ত আরব প্রজাতন্ত্রের প্রাক্তন উপ-মন্ত্রী জনাব আলী হাফিজ গত রবিবার কলকাতায় একথা বলেন।
জনাব হাফিজ বিশ্ব স্কাউট ব্যুরোর সদস্য এবং আরব স্কাউট লীগের সভাপতি। তিনি শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে কলকাতায় ফিরে গিয়ে সাংবাদিকদের বলেন, ‘আমি নিজের চোখে শরণার্থীদের অবর্ণনীয় দুঃখ-দুর্দশার চিত্র দেখে এসেছি। যারা শরণার্থীদের এই পরিস্থিতির মধ্যে টেনে এনেছে তাদের মানবিকতার কোন বালাই নেই।’

বঙ্গবন্ধুকে মুক্তি দিতে হবে—
গণ প্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের বিচার প্রহসনের বিরুদ্ধে বিশ্বের নেতৃবৃন্দের কণ্ঠ আরও সোচ্চার হয়ে উঠেছে।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের প্রাণরক্ষার জন্য বৃটেন, কানাডা, ভারত ও যুক্তরাষ্ট্রের ১৫ জন বিশিষ্ট ব্যক্তি অক্সফাম-এর মাধ্যমে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে এ ব্যাপারে তৎপর হওয়ার আবেদন জানিয়েছেন।
আবেদনকারীর মধ্যে আছেন ভারতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রাক্তন রাষ্ট্রদূত জন কেনের্থ গলব্রেথ, রাষ্ট্রসংঘের প্রাক্তন সহকারী সেক্রেটারী জেনারেল কানাডার ডঃ হিউ কীনলে কাইড, ভারতের প্রাক্তন সৈন্যাধ্যক্ষ জেঃ জয়ন্তনাথ চৌধুরী প্রভৃতি।
তারা আরও বলেছেন, বৃহৎ শক্তিগুলোর হস্তক্ষেপের ফলে বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতি থেকে যে কোন মুহূর্তে বড় রকমের যুদ্ধ বেধে যেতে পারে।
তাই বাংলাদেশের অবস্থা আয়ত্তে আনার জন্য তারা সকল রাষ্ট্রের কাছে পাকিস্তানকে সাময়িকভাবে সব রকম অর্থনৈতিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধের জন্য আবেদন জানিয়েছেন।

পঃ জার্মানীর মন্ত্রীর উদ্বেগ
পশ্চিম জার্মানীর দূতাবাসের মন্ত্রী মিঃ ডবলিউ বেরেগুস গত ২২শে আগষ্ট কলকাতায় বলেন যে, শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যা করা হলে পাকিস্তানের ইয়াহিয়া ভীষণ ‘রাজনৈতিক ভুল করবেন’।
তিনি বলেন, শেখ মুজিবরের ব্যাপার নিয়ে পশ্চিম জার্মানী সরকার শীগগীর পাকিস্তানের সঙ্গে কথাবার্তা বলবেন।

অষ্ট্রেলিয়ান সরকারের উদ্বেগ
পাকিস্তান সরকার রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর প্রিয় নয়নমনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবের যে বিচার চালাচ্ছে তাতে অষ্ট্রেলিয়া সরকার তার উদ্বেগের কথা পাকিস্তানকে জানিয়েছেন বলে অষ্ট্রেলিয়ান পররাষ্ট্র মন্ত্রী মিঃ নিগেল বোয়েন গত ১৮ই আগষ্ট পার্লামেন্টে বলেছেন।
প্রধান মন্ত্রী মিঃ উইলিয়াম ম্যাকমোহন ইয়াহিয়াকে প্রেরিত এক ব্যক্তিগত বার্ত্তায় অষ্ট্রেলিয়া সরকারের পক্ষে দুঃখ প্রকাশ করেছেন।

বাংলাদেশ ও বিশ্ব বিবেক
বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছাই রাজনৈতিক সমাধানের বাস্তব ভিত্তি
( রাজনৈতিক ভাষ্যকার )
পশ্চিম পাকিস্তানী ঘাতক ইয়াহিয়া ও তার জল্লাদ বাহিনীর বিরুদ্ধে বিশ্ব বিবেক জাগ্রত ও সোচ্চার হয়ে উঠেছে। রাজনৈতিক আলোচনা চালানোর নামে ইয়াহিয়া খান ষোলই মার্চ থেকে পচিশে মার্চ পর্যন্ত টালবাহানা করে নিজের ঘাতক বাহিনীর শক্তিকে সংহত করেছে এবং নিসন্ধিগ্ধু ও নিরস্ত্র বাঙালী জনতার ওপর আধুনিক মারণাস্ত নিয়ে ঝাপিয়ে পড়ার ব্লু-প্রিন্ট প্রস্তুত করেছে। তারপর ২৫শে মার্চের রাতে ভুট্টো আর ইয়াহিয়া খান গোপনে পালিয়ে যাবার পর মধ্য রাতে পূর্ণ সামরিক প্রস্তুতি নিয়ে ঝাপিয়ে পড়েছে নিরস্ত্র ঘুমন্ত নারী পুরুষ, শিশু, বৃদ্ধ নির্বিশেষে বাঙালী জনসাধারণের ওপর।
বাঙলাদেশের জাতীয় নেতৃত্ব গণতন্ত্র সম্মত নিয়মতান্ত্রিক পদ্ধতিতে বাঙালীর স্বাধিকার তথা দেশের রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে চেয়েছিল। কিন্তু ইয়াহিয়ার ঘাতক বাহিনী সমস্যার রাজনৈতিক সমাধাণের পথ পরিত্যাগ করে সামরিক পশু শক্তির আশ্রয় গ্রহণ করেছিল।
বিশ্ব বিবেক, বিশ্বের গণতন্ত্রকামী মানুষ ইয়াহিয়ার পশু শক্তির বিরুদ্ধে তীব্র ঘৃণা প্রকাশ করেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ একথা সুষ্পষ্টরূপে বুঝতে পারছে, ইসলামাবাদের শাসকচক্রের পক্ষে সামরিক পশু শক্তির সাহায্যে বাংলাদেশ সমস্যার কোন সমাধান সম্ভব নয়।
আর সেই জন্যেই জনৈক সাংবাদিক ও সাহিত্যিক সক্ষোভে প্রশ্ন করেছেন ঃ সাম্রাজ্যবাদকে ‘মানবতাবোধ সম্পন্ন’ করতে সমর্থ হবার পূর্বে আরও কত নিখুত মানুষকে ‘শান্তিপূর্ণ’ এবং ‘অহিংসভাবে’ মৃত্যুবরণ করতে হবে? ‘অহিংস’ মৃত্যু কি সম্ভব? এই ক্ষোভ এক্ষণে সারা পৃথিবীতেই ধ্বনিত হচ্ছে।

রাজনৈতিক সমাধান
সম্প্রতি বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের নেতৃবৃন্দ বাংলাদেশ ও পাকিস্তান সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের ওপরে জোর দিচ্ছেন। তারা মনে করছেন যে, অবিলম্বে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান না হলে পরিস্থিতির গুরুতর অবনতি ঘটবে এবং তার প্রতিক্রিয়া পড়বে সারা বিশ্বের ওপরে।

এডওয়ার্ড কেনেডির মন্তব্য
সম্প্রতি মার্কিণ সিনেটের উদ্বাস্তু বিষয়ক সাব-কমিটির প্রেসিডেন্ট সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি পশ্চিম বঙ্গ ও ত্রিপুরার শরণার্থী শিবির পরিদর্শন করে স্বদেশে ফিরে গিয়েছেন। স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের পূর্বে নয়া দিল্লীতে তিনি মন্তব্য করেন যে প্রকৃত অবস্থা দেখার পর তার ধারণা হয়েছে যে, একমাত্র রাজনৈতিক পথেই বাংলাদেশ সংকটের সমাধান হতে পারে এবং সেই রাজনৈতিক আলোচনা শেখ মুজিবর রহমানের সঙ্গেই হতে হবে। তিনি পূর্বাহ্নে এমন একটা ধারণাও দিয়েছিলেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান সম্পর্কে তার মনে একটা প্রস্তাব রয়েছে। কিন্তু সেই প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি সেই মুহূর্তে কিছু জানাতে অস্বীকার করেন।

পূর্ব জার্মানীর অভিমত
পূর্ব জার্মানীর তিন সদস্য বিশিষ্ট সংসদীয় প্রতিনিধিদল পশ্চিম বঙ্গের শরণার্থী শিবিরগুলো দেখার পর নয়া দিল্লীতে গত ২১শে আগষ্ট এক সাংবাদিক সম্মেলনে মন্তব্য করেছেন, “এশীয়া তথা বিশ্বের শান্তি ও নিরাপত্তা অক্ষুন্ন রাখতে হলে বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধান একান্ত প্রয়োজন বলে আমরা মনে করি।”

পশ্চিম জার্মানী
অপরদিকে নয়াদিল্লীর দূতাবাসে পশ্চিম জার্মানীর নবনিযুক্ত মন্ত্রী মিঃ ডবল্যু বেহরেম্ভস পশ্চিম বঙ্গের সীমান্তে বাংলাদেশ থেকে আগত শরণার্থীদের শিবির পরিদর্শন করার পর সাংবাদিকদের কাছে মন্তব্য করেছেন যে, শরণার্থীরা যাতে স্বদেশে ফিরে যেতে পারেন সে জন্যে সেখানে উপযুক্ত পরিবেশ সৃষ্টি হোক, এটাই তার দেশের কাম্য এবং সে জন্যে একটা রাজনৈতিক সমাধান প্রয়োজন।

সমাধান কোন পথে?
সকলেই বাংলাদেশে সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন। রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পরিবর্তে রাজনৈতিক পথে এই প্রশ্নের যদি মীমাংসা করা সম্ভব হয় তা’হলে আপত্তির কি থাকতে পারে। কিন্তু এই রাজনৈতিক সমাধানের রূপ কি হবে এবং কোন পথে এই সমাধানকে ফলপ্রসূ করা সম্ভব হবে তা কেউই খোলাখুলি বলছেন না।

হানাদার বাহিনীর প্র্রত্যাহার চাই
সিনেটর কেনেডি গণতান্ত্রিক ও মানবতাবাদী ভূমিকার জন্যে বিশ্বের গণতন্ত্রবাদী ও শান্তিকামী মানুষের অকুণ্ঠ শ্রদ্ধা ও অভিনন্দন লাভ করেছেন। তিনি নিজেই একটা কথা স্বীকার করেছেন যে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলার মাটিতে থাকা পর্যন্ত একজন শরণার্থীও স্বদেশে ফিরে যাবে না বরং আগমী কয়েক মাসের মধ্যে শরণার্থীর সংখ্যা এক কোটি বিশ লক্ষে দাড়াবে। আমাদের ব্যক্তিগত ধারণা সিনেটর কেনেডে সংখ্যাটা অনেক কমিয়ে বলেছেন। তবে তার কথা অনুযায়ীই বলা যায় যে, পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী বাংলাদেশে এমন একটা পরিস্থিতি সৃষ্টি করেছে যে, সেখানে মানুষের পক্ষে নিশ্চিন্তে নিরাপদে বাস করা সম্ভব নয়। তারা দেশে সামান্যতম স্বাভাবিক অবস্থাও ফিরিয়ে আনতে ব্যর্থ হয়েছে। অর্থাৎ বৈদেশিক হানাদার বাহিনীর চরিত্র তারা কোন ক্রমেই চাপা দিতে পারছে না। সেখানকার অবস্থাটা যে খুবই অবনত তার প্রমাণ পাওয়া যায়, পশ্চিম পাকিস্তানী সরকার কর্তৃক শেষ মুহূর্তে আকস্মিকভাবে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকায় সিনেটর কেনেডির সফরের অনুমতি বাতিল করার ভেতর দিয়ে।

‘ওপারেশন ওমেগার’ লাঞ্ছনা
বৃটিশ ও মার্কিণ নাগরিক সমবায়ে গঠিত ‘ওপারেশন ওমেগা’ নামে একটি সেবা প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকার দুস্থ মানুষের জন্যে প্রয়োজনীয় রিলিফ সামগ্রী বিতরণের উদ্দেশ্যে বেনাপোলের পথে বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় প্রবেশ করেছিল। কিন্তু পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী তাদের বাধা দেয় এবং ত্রাণ সামগ্রীসহ পুনরায় মুক্ত এলাকায় ফিরে আসতে বাধ্য করে। এই প্রতিষ্ঠানের সদস্যা ও সদস্যগণ মানবতার নামে এবং মানবাধিকারের দাবীতে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ অধিকার দাবী করেছিল। কিন্তু জল্লাদ হানাদার বাহিনীর কাছে মানবতা বা মানবাধিকারের বাণী অর্থহীন শব্দ মাত্র। অথচ এই হানাদার সামরিক জান্তাই বিশ্বের কাছে দখলীকৃত এলাকার দুর্গত মানুষের ত্রাণ কার্যের জন্য সাহায্য চেয়ে পাঠাচ্ছে।
আসলে তাহা বাঙালীদের ত্রাণ কার্যের জন্যে নয়, তাদের ভেঙে পড়া অর্থনীতিকে কোন রকমে টিকিয়ে রাখার এবং ঘাতক সৈন্যদের জন্যের রসদের সরবরাহ অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যেই এই সাহায্যের আবেদন জানানো হচ্ছে। তা নইলে ওপারেশন ওমেগার সদস্যদের সাহায্য সম্ভার দুস্থ মানুষদের মধ্যে বিতরণ করতে না দেয়ার কোন কারণ থাকতে পারে না।
যারা সত্য-সত্যই বাংলাদেশের রাজনৈতিক সমাধান কামনা করেন, তারা এটাও জানেন যে, একমাত্র বাঙলাদেশের জাতীয় নেতৃত্বের সঙ্গেই রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব। তারা এও জানেন যে, পচিশে মার্চের রাতেই ইয়াহিয়ার সামরিক চক্র সেই সমাধানের সকল পথ রুদ্ধ করে দিয়েছে।
শুধু মুখের কথায় একটা সামরিক জান্তাকে রাজনৈতিক সমাধানের পক্ষে আনা সম্ভব নয়, তাদের রাজনৈতিক সমাধানের পথে আসতে বাধ্য করতে হবে। ভাল কথায় তাদের মনে শুভ বুদ্ধির উদয় হবে না। সিনেটর কেনেডি নিজেই বলেছেন যে, পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক যুক্ত অবস্থায় প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা কিছুতেই স্বদেশে ফিরতে প্রস্তুত নয়, এ কথাটা তিনি উপলব্ধি করতে সমর্থ হয়েছেন। তা হলে এই সমস্যার সমাধান যে কি তাও তিনি নিশ্চয়ই উপলব্ধি করতে পেরেছেন।
তিনি নিজেই স্বীকার করেছেন যে, এই সমাধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ও তার রাজনৈতিক দলের সঙ্গে করতে হবে।
পূর্ব জার্মানীর প্রতিনিধি দলও বলেছেন যে, রাজনৈতিক সমাধান সেখানকার জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী হতে হবে। বাংলাদেশের নির্বাচন, আশী লক্ষ শরণার্থীর প্রতিবেশী রাষ্ট্রে আশ্রয় গ্রহন ও আরও সম পরিমাণ শরণার্থীর আগমন সম্ভাবনা এবং গণপ্রতিনিধিদের অভিমত থেকে জনগণের ইচ্ছা যে কি তা বুঝতে কারও অসুবিধা হবার কথা নয়।
আরও অস্ত্র-শস্ত্র ও রসদ দিয়ে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে তাদের ঘাতক বৃত্তিতে উৎসাহ দান করলে কোন ক্রমেই বাংলাদেশের জনগণের ইচ্ছা অনুযায়ী রাজনৈতিক সমাধান করা যাবে না। সত্য সত্যই রাজনৈতিক সমাধান করতে হলে পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান বন্ধ করতে হবে। অথচ মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্র এই হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্যদান করে রাজনৈতিক সমাধানের পথে অন্তরায় সৃষ্টি করছে।

দায়িত্ব জ্ঞানহীন ও নৈতিকতা বিরোধী
এককালে মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রের আণ্ডার সেক্রেটারী অব স্টেট ও ভারতে নিযুক্ত প্রাক্তন মার্কিণ রাষ্ট্রদূত মিঃ চেষ্টার বোলস মন্তব্য করতে বাধ্য হয়েছেন যে, পাকিস্তানে অব্যাহত মার্কিণ সাহায্য ‘দায়িত্ব জ্ঞান হীন’ ও নীতিবিগর্হিত। ভ্রান্ত মার্কিণ নীতি সংশোধন করে তিনি সামরিক সাহায্য দানের পরিবর্তে শেখ মুজিবর রহমানের সাথে আলোচনায় প্রবৃত্ত হবার জন্যে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টির পরামর্শ দিয়েছেন।
সিনেটর কেনেডির রাজনৈতিক সমাধানের রূপ রেখা আমাদের জানা নেই। কিন্তু প্রকৃত পরিস্থিতি তিনি নিজেই উপলব্ধি করতে পেরেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে তার রাজনৈতিক সমাধানের ফর্মূলা উদ্ভাবন করতে হবে।
পাকিস্তানের রাজনৈতিক কাঠামোর মধ্যে এই সমাধানের যে সম্ভাবনা ২৫শে মার্চের পূর্বে ছিল ২৫শে মার্চের মধ্যরাতেই সে সম্ভাবনাকে পাকিস্তানের হানাদার বাহিনী সম্পূর্ণ নস্যাৎ করে দিয়েছে। পশ্চিম পাকিস্তানের ন্যাপ নেতা ওয়ালী খানও সম্প্রতি কাবুলে এক সাংবাদিক সাক্ষাৎকারে এই সত্য স্বীকার করেছেন।
বিশ্বের বৃহৎ শক্তি পুঞ্জ তাদের প্রভাব বলয়ের ক্ষেত্র সম্প্রসারিত করার উদ্দেশ্যে এই সত্যটির প্রতি যদি উদাসীন থাকেন তা হলে বিশ্বের একটা মৌলিক ও শাশ্বত সত্যের প্রতিই মুখ ফিরিয়ে থাকা হবে। সেই সত্যটি হচ্ছে ঃ পৃথিবীর কোথাও কখনও জাতীয় মুক্তি সংগ্রামকে শেষ পর্যন্ত কেউই ব্যর্থ করতে পারেনি। জাতীয় মুক্তি সংগ্রাম চিরকাল জয় লাভ করেছে।
যারা আজ বাংলাদেশ সংকটের রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন তাদের এই সত্যটি সম্পর্কে পুরোপুরি অবহিত থাকতে হবে। হানাদার বাহিনীকে অস্ত্র, রসদ ও অর্থনৈতিক সাহায্য দান অব্যাহত রেখে রাজনৈতিক সমাধান সম্ভব নয়। সিনেটর কেনেডির এ ব্যাপারে বিশেষ দায়িত্ব রয়েছে। মার্কিণ জনগণের মধ্যে তার প্রভাব অনস্বীকার্য। পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য দান যে বাংলাদেশের সংকটকে দীর্ঘস্থায়ী করা এবং রাজনৈতিক সমাধানের পথে পর্বত প্রমাণ অন্তরায় সৃষ্টি করা, মার্কিণ জনগণের কাছে এই সত্য তাকেই তুলে ধরতে হবে।
‘আমরাও একা নই’, বলে ইয়াহিয়া খান যে সামরিক দম্ভোক্তি করেছে জাতীয় মুক্তি সংগ্রামের প্রেক্ষিতে এই দম্ভোক্তি যাদের সমর্থনের কথা ভেবে করা হয়েছে, তাদের জন্যে মোটেও শ্লাঘার বিষয় নয়, মার্কিণ জনগণ ও মার্কিণ সরকারের কাছে এ কথাও সিনেটর কেনেডিকেই পৌছে দিতে হবে। শরণার্থী শিবিরগুলো পরিদর্শনের এবং পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক দখলীকৃত বাংলাদেশে তার সফরের অনুমতি বাতিলের পর, এই দায়ীত্ব তার ওপর বিশেষভাবে বর্তেছে।

চারটি প্রশ্ন
বাংলাদেশ সমস্যা সম্পর্কে সম্প্রতি ভারতের প্রধান মন্ত্রী শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী চারটি মৌলিক প্রশ্নের প্রতি বিশ্ববাসীর দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। তিনি প্রশ্ন করেছেন ঃ সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাচার অধিকার আছে কি না? সংখ্যা গরিষ্ঠরা কি সংখ্যা লঘুদের দ্বারা নিপীড়িত হতে থাকবেন? এই সংখ্যা লঘুরাই কি সংখ্যা গরিষ্ঠদের দাবিয়ে রাখার জন্যে অন্যান্য দেশ থেকে অস্ত্র আমদানী করে চলবেন?
তিনি চান যে, প্রতিটি রাষ্ট্র উপরোক্ত প্রশ্নগুলো নিয়ে চিন্তা করুন এবং উত্তর দিন।
যারা আজ রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলছেন, তাদের আন্তরিকতা কতটুকু তার বিচার হবে ভারতীয় প্রধান মন্ত্রীর উপরোক্ত প্রশ্নের কার্যকরী উত্তরের ওপর।

জল্লাদশাহীর ওপর আর একটি প্রচণ্ড আঘাত
ইরাকে পাক-রাষ্ট্রদূতের বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা
মধ্য প্রাচ্যের ইরাকে নিযুক্ত পাকিস্তানের বাঙ্গালী রাষ্ট্রদূত জনাব আবুল ফতেহ লাখো লাখো বাঙ্গালী হত্যার নায়ক জালেম ইয়াহিয়ার জল্লাদ সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।
বাংলাদেশে স্বাধীনতা সংগ্রাম শুরু হওয়ার পর থেকে এই প্রথম একজন বাঙ্গালী রাষ্ট্রদূত জল্লাদদের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করে মাতৃভূমির অশেষ ঋণ পরিশোধের জন্য এগিয়ে এসেছেন। এর আগে সুইডেনে নিযুক্ত পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত জনাব আবহার ইয়াহিয়ার বাংলাদেশ নীতির প্রতি বীতশ্রদ্ধ হয়ে চাকুরীতে ইস্তেফা দিয়েছিলেন। তিনি অবশ্য পশ্চিম পাকিস্তানী ছিলেন।
ময়মনসিংহের অধিবাসী জনাব ফতেহ ইরাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রদূত নিযুক্ত হওয়ার আগে কোলকাতায় পাকিস্তানী মিশনের ডেপুটি হাই কমিশনার ছিলেন।
রাষ্ট্রদূত ফতেহ নাটকীয়ভাবে ইরাক ত্যাগ করেন। তিনি ইরাকে পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের পদে ইস্তেফা দিয়ে একটি ট্যাক্সিতে করে প্রায় হাজার মাইল পথ পাড়ি দিয়ে কুয়েতে পৌছেন। তারপর তিনি বাংলাদেশ আন্দোলনে যোগদানের জন্য বিমান যোগে ২১শে আগষ্ট লণ্ডনে পৌছেন।
লণ্ডনে এক সাংবাদিক সম্মেলনে তিনি বলেন, সাড়ে সাত কোটি মুক্তি পাগল বাঙ্গালী জাতির অবিসম্বাদিত নেতা শেখ মুজিবের তথাকথিত বিচারের প্রহসন দেখে তিনি আর ধৈর্য্য ধারন করতে না পেরে চাকরী ছেড়ে দিয়ে মুক্তি সংগ্রামে যোগদানের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন।
ঘটনা প্রবাহে মনে হচ্ছে, লণ্ডন, নিউইয়র্ক এবং ওয়াশিংটনে পশ্চিম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূতের ‘অযোগ্যতার’ অভিযোগে অপসারণ করা হতে পারে। লণ্ডনে পশ্চিম পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত সোলেমান আলীকে ইতিমধ্যেই অপসারণ করে জেনারেল ইউসুফকে নিযুক্ত করা হয়েছে। ওয়াশিংটনে আগা হিলালীকে অপসারণ করা হচ্ছে।

আর একজন কূটনীতিক
সুইজারল্যাণ্ডের বার্ণে পাকিস্তানী দূতাবাসের বাঙ্গালী কূটনীতিক কর্মী জনাব গোলাম মোস্তফা গত সপ্তাহে ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন কেরে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন।….
[ পরের পৃষ্ঠা পাওয়া যায়নি ]

আফ্রো-এশীয় চিন্তাবিদদের সম্মেলন আহ্বানের সিদ্ধান্ত
( কলকাতা প্রতিনিধি )
সংগ্রামী স্বাধীন বাংলাদেশ সহায়ক সমিতির এক সভায় নিকট ভবিষ্যতে বাংলাদেশ শরণার্থী শিশুদের মধ্যে কিছু পরিমাণ গরম কাপড় এবং বই বিতরণের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বিচারপতি শ্রী শঙ্কর প্রসাদ মিত্র সভাপতিত্ব করেন।
সভায় সামরিক ট্রাইব্যুনালে বিচারের প্রহসন দ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে হত্যার ষড়যন্ত্রের তীব্র নিন্দা করে এ মামলার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক জনমত সৃষ্টির জন্য বিশ্বের আইনজীবিদের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানানো হয়।

ইয়াহিয়ার চক্রান্ত ব্যর্থ ঃ পরিষদ সদস্যদের মধ্যে ভাঙ্গন ধরান গেল না
জল্লাদ ইয়াহিয়া চক্র আর একটা ধাক্কা খেল। তারা আশা করেছিল আওয়ামী লীগ পরিষদ সদস্যদের মধ্যে বিভেদ সৃষ্টি করে অর্থাৎ কিছু সংখ্যক সদস্যের সদস্য পদ খারিজ করে এবং কিছু সংখ্যক সদস্যের সদস্য পদ বহাল রেখে তারা বাংলাদেশের উপর নিজেদের শাসনও শোষণ অক্ষুণ্ন রাখতে পারবে। এই আশায় আশান্বিত হয়ে তারা জাতীয় পরিষদে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জন সদস্যের মধ্যে ৮৮ জনের সদস্য পদ বহাল রাখে এবং ৭৯ জনের সদস্য পদ কলমের এক খোচায় খারিজ করে দেয়।
ইয়াহিয়া খানরা আশা করেছিল সদস্য পদের মোহে এবং ব্যক্তি স্বার্থে অন্ধ হয়ে আওয়ামী লীগ দলীয় ৮৮ জন সদস্য ‘সুবোধ’ বালকের মত তার দলে ভিড়ে যাবেন। তারপর তিনি “অযোগ্য” ঘোষিত ৭৯ জনের জায়গায় উপনির্বাচন মারফত নিজের খয়ের খা লোকদের জাতীয় পরিষদে ঢুকিয়ে নেবেন।
ইয়াহিয়া খান হয়ত ভেবেছিল ১৯৫৫ সালে প্রথম গণপরিষদ ভেঙ্গে দিয়ে পাকিস্তানে প্রাসাদ চক্রান্তের রাজনীতির অন্যতম হোতা গোলাম মোহাম্মদ যখন বাংলা দেশের সমর্থন সংগ্রহ করতে পেরেছিলেন, ১৯৫৪ সালে তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান পরিষদে যুক্তফ্রন্টের ঐতিহাসিক বিজয়কে গোলাম মোহাম্মদ-মোহাম্মদ আলী যখন নস্যাৎ করতে পেরেছিল তখন তিনিই বা সফল হবেন না কেন। কিন্তু তিনি ভুলে গিয়েছিলেন যে এটা ১৯৭১ সাল। তিনি আরও ভুলে গিয়েছিলেন ১৯৭০ এর নির্বাচনে বাংলাদেশ থেকে নির্বাচিত প্রতিটি সদস্য শেখ মুজিবের অগ্নি মন্ত্রে দীক্ষিত এবং তারা রক্ত দিয়ে রক্তের ঋণ শোধ করতে ওয়াদাবদ্ধ।
তাই ইয়াহিয়া খানের টোপ গেলার মত লোক আজ আর বাংলাদেশে পাওয়া যাচ্ছে না। ১৬৭ জন জাতীয় পরিষদ সদস্যের মধ্যে ১৩৫ জন সম্প্রতি মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারী পার্টির সভায় যোগদান করে বাংলাদেশের মুক্তি যুদ্ধের প্রতি তাদের দৃঢ় সমর্থনের কথা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করেন। দুইজন সদস্য অসুস্থতার জন্য মুক্ত এলাকায় থেকেও সভায় যোগ দিতে পারেন নি। বাকী সদস্যদের মধ্যে দু’জন বাংলাদেশ সরকারের কার্য্যেপলক্ষে বিদেশে থাকায় তারাও সভায় যোগ দিতে পারেন নি।
অপর কয়েকজন সদস্য নিজ নিজ এলাকায় আত্মগোপন করে থেকে কাজ করছিলেন। কিন্তু ইয়াহিয়া খান তার “বহাল সদস্যের” তালিকায় এদের নাম অন্তর্ভূক্ত করায় তারা ইতিমধ্যেই মুক্ত এলাকায় চলে আসতে শুরু করেছেন। এ ধরণের তিনজন সদস্য নারায়ণগঞ্জের জনাব সফর আলী ও ঢাকার জনাব কফিল উদ্দিন চৌধুরী ও কেরাণীগঞ্জ দোহার থেকে নির্বাচিত জনাব আশরাফ আলী চৌধুরীর সাথে জয়বাংলা প্রতিনিধির কথাবার্ত্তা হয়েছে। তারা বলেন, “আমরা শত ঝুকির মধ্যেও নিজ নিজ আত্মগোপন করেছিলাম। কিন্তু যখন দেখলাম সে ইয়াহিয়া খান আমাদের নাম ‘বহাল সদস্যের’ তালিকায় অন্তর্ভূক্ত করেছে তখন মুক্ত এলাকায় চলে আসা শ্রেয় মনে করলাম। কেননা, অধিকৃত এলাকায় আর অবস্থান করলে দেশবাসী এবং বিশ্ববাসীর মনে এ ধারণাই জন্মাতে পারে যে আমরা নেতা ও নীতির প্রতি বিশ্বাস ঘাতকতা করেছি।”
তারা আরো জানান যে ইয়াহিয়া খান বহাল সদস্যের তালিকায় যে ৮৮ জন সদস্যের নাম ঘোষণা করেছে তার মধ্যে সামরিক বাহিনীর অমানুষিক নির্য্যাতনে কয়েকজন ইতিমধ্যেই মারা গেছেন।
তাই নির্ভরযোগ্য হিসাব মতে এই ৮৮ জনের মধ্যে শেষ পর্যন্ত ঢাকার জহর উদ্দীন, বরিশালের ফজলুল হক, মানিকগঞ্জের পুরুন ইসলামসহ মোট ৯ জনের বেশী সমর্থন ইয়াহিয়া চক্র পাবেনা। এই ৯ জনের মধ্যে কয়েকজনকে জল্লাদরা গ্রেফতার করে তাদের জেলে আটক রেখেছেন। ফলে ইয়াহিয়া খানকে ইতিপূর্বে ঘোষিত ৭৯টি আসন ছাড়া আরও অন্ততঃ ৭৯টি আসনে উপনির্বাচন করতে হবে।
ইয়াহিয়া খানেরা বোধ হয় ইতিমধ্যেই ব্যাপারটা উপলব্ধি করতে পেরেছে। তাই তথাকথিত পাকিস্তান সরকার তাদের বেতারের মাধ্যমে বহাল সদস্যদের পায়ে তৈলমর্দন শুরু করেছেন। গত সোমবার রাতে তথাকথিত পাকিস্তান বেতার থেকে টিক্কা খানেত বরাত দিয়ে বলা হয়েছে যে, বহাল সদস্যরা জনগণের প্রতিনিধি। তারা যেন অবিলম্বে নিজ নিজ এলাকায় গিয়ে জনপ্রতিনিধির দায়িত্ব গ্রহণ করেন। তারা ফিরে গেলে টিক্কা খানের সরকার তাদের জানমালের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধানের ওয়াদা করছে।
অন্যদিকে ইতিপূর্বৈ শূন্য ঘোষিত ৭৯টি জাতীয় পরিষদ আসনের জন্য প্রার্থী পাওয়ার ব্যাপারেও ইয়াহিয়া খানরা হতাশ হয়ে পরেছে। কেননা মুক্তিফৌজের কমাণ্ডো এবং গেরিলারা যে ভাবে সারা বাংলা তৎপর হয়ে উঠেছে তাতে উপনির্বাচনে প্রার্থী হয়ে কেহ পৈত্রিক প্রাণটি হারাতে চাবে এমন আশা করা বাতুলতা মাত্র। সুতরাং তার সাথে আরও ৮৭টি আসনে উপ নির্বাচন করতে গেলে হয়ত টেণ্ডার দিয়ে বিদেশ থেকে প্রার্থী আমদানী করতে হবে।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!