You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ৬ আগস্ট ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

জয়বাংলা

বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র

রেজিষ্টার্ড নম্বর-১ (বাংলাদেশ সরকার)

   মুজিব নগরঃ ১ম বর্ষ,১৩শ সংখ্যা         শুক্রবার ২০শে শ্রাবণ, ১৩৭৮   ৬ই আগষ্ট৭১

[মূল্যঃ ২৫ পয়সা]

 

 

জল্লাদের সাথে আর থাকতে চাই না

মুজিবনগর ৫ ই আগস্টঃ– এখানে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ,জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকারের সাথে সকল সম্পর্ক ছিন্ন করে জাতিসংঘ ও ওয়াশিংটনস্থ পাকিস্তান দূতাবাসের ১৫ জন বাঙালি সদস্য একযোগে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। এঁরা সবাই এখন মার্কিণ যুক্তরাষ্ট্রে রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনা করেছেন।অন্যান্যদের মধ্যে যে কয়জন পদস্থ কূটনৈতিক বাংলাদেশ সরকারের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন তারা হলেন মন্ত্রীর পদ মর্যাদা জনাব এনায়েত করিম, কাউন্সিলর জনাব এস,এ, এম,এস কিবরিয়া,সেকেন্ড সেক্রেটারী জনাব মোয়াজ্জেম আলী, জাতি সংঘের দ্বিতীয় স্থায়ী প্রতিনিধি জনাব সাঈদ করিম। বিদেশে পাকিস্তানের যেসব দূতাবাস রয়েছে তা থেকে বাঙালি কূটনীতিকবিদরা একে একে ইস্তফা দিচ্ছেন। তার আনুগত্য ঘোষণা করছেন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি, সবার বক্তব্য এক, অসম্ভব এই রক্তলোলুপ সরকারের সাথে সংস্রব রাখা। নিরীহ, নিরস্ত্র বাঙালিদের ওপর যে অত্যাচার তারা চালাচ্ছে ইতিহাসে এর কোনো নজীর নেই। একটা কথা এখানে পরিষ্কার করে বলা দরকার, বিদেশী দূতাবাসগুলোতে যেসব বাঙালি কূটনীতিবিদ রয়েছেন তারা যে কেবল বিবেকের তাড়নায় উদ্বুদ্ধ হয়ে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য স্বীকার করেছেন তা নয়,বাঙালি বলে তাদের সব সময় নানারকম ভোগান্তি পোয়াতে হতো। এক কথায় বলা যায় বিদেশী দূতাবাস গুলোতে বাঙালীদের উপর গতিবিধি ছিল এক্কেবারে  নিয়ন্ত্রিত,
তাঁদের সবাইকে রাখা হতো কড়া পাহারায়। এই সব কারণেও বাঙালী কর্মচারীরা অনেক আগে থেকেই জঙ্গীশাহীর ওপর চটা ছিলেন।
ইয়াহিয়া কি করবেন এখন? বাংলাদেশ মিশন আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন মোট চৌষট্টি জন কর্মচারী নিয়ে,এরপর নয়াদিল্লীর পাক দূতাবাসের থার্ড  সেক্রেটারি জনাব কে,ম শাহাবুদ্দীন এসিস্টেন্ট প্রেস সেক্রেটারী জনাব আমজাদুল হক, অপর একজন কর্মচারী জনাব আবদুল মজিদ, প্যারিসের দু’জন নিউইয়র্কে নিযুক্ত ভাইস কনসাল জনাব মোহম্মদ আলী, ওয়াশিংটনস্থ পাক দূতাবাসের অর্থনৈতিক উপদেষ্টা জনাব এ, এম, এ মুহিত,লন্ডন দূতাবাসের সেকেন্ড সেক্রেটারী জনাব মহীউদ্দীন আহমদ বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রদর্শন করেছেন।
ইয়াহিয়া কত ঢাকঢোল পেটাচ্ছেন এই বলে— কিছু না সব ঠান্ডা হয়ে গেছে, ক্ষমতা হস্তান্তর জন-প্রতিনিধির হাতে এই তো কিছুদিনের মধ্যেই করবো।আবার কখনো চেঁচামেচি করছেন এই বলে দরকার হলে যুদ্ধ করবো, আমি একা নই ইত্যাদি ইত্যাদি। তার চেঁচামেচী যতোই বাড়ছে বাঙালী কূটনীতিবিদরাও তার সাথে পাল্লা দিয়ে একে একে বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করছেন। এরা সব এমন অবুঝের দল, কিছুতেই ইয়াহিয়ার কান্নাকাটিতে বিশ্বাস করতে চায় না। এতো গেলো বাঙালী কর্মচারীদের কথা। এদিকে সুইডেনের পাকিস্তানী রাষ্ট্রদূত জনাব ইকবাল আতাহার চাকুরী থেকে ইস্তফা দিয়েছেন। বাঙালি না হলেও বিদেশী পত্র-পত্রিকার মারফত যে সব খবর তিনি পেয়েছেন তাতে তিনি মর্মাহত হয়ে চাকুরী ছেড়ে দিয়েছেন। তবে চাকুরী ছাড়ার পর তিনি দেশে ফিরে যাননি। বলা যায়না হাতের কাছে পেলে ইয়াহিয়ার নির্য্যাতনের শীকার হতে হবে তাঁকে, এই চিন্তা করে তিনি বেলজিয়ামে গিয়ে আপাতত আশ্রয় নিয়েছেন।

সর্বশেষ প্রাপ্ত হিসাবে জানা যায় যে জঙ্গী সরকারের মুখে পদাঘাত করে এ পর্যন্ত মোট ২৩ জন কূটনীতিবিদসহ ৯৪ জন বাঙ্গালী কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতি তাঁদের আনুগত্যের কথা ঘোষণা করেছেন।
বিদেশী দূতাবাস থেকে বাঙালী কর্মচারীদের ইস্তফা পাক সরকারের মুখে চুনকালী মেখে দিয়েছে। আজকে বিশ্ববাসীর সামনে এটাই প্রমাণিত হচ্ছে যে পাক সরকার যতই চেঁচামেচী করুক আসলে বাংলাদেশের সাংঘাতিক কিছু ঘটেছে, না হলে বাঙালী কর্মচারীরা সবাই একে একে ইস্তফা দিচ্ছেন কেন?

পঁচিশে মার্চের পর বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার জল্লাদবাহিনী যে গণহত্যা ও ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করেছিলো তার বিরুদ্ধে সর্বপ্রথম যে কন্ঠ বিদেশের সোচ্চারিত হয় তা হলো বাংলাদেশ মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী ও তার পত্নীর।বাংলাদেশ মিশনের মোট চৌষট্টিজন জন কর্মচারীকে নিয়ে এতো বড়ো একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন, আঠারোই এপ্রিল হাজার হাজার জনতার হর্ষধ্বনির মধ্যে তিনি তাঁর সিদ্ধান্তের কথা ঘোষণা করেন।ইয়াহিয়ার সকল ঘোষণা ও চেঁচামেচীর প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলী দেখিয়ে বাংলাদেশ মিশনের শীর্ষে পত পত করে উড়ছে বাংলাদেশের পতাকা।
একে একে ভেঙ্গে পড়ছে ইয়াহিয়ার বালির বাঁধ।একজন একজন করে ছাড়ছেন পাক আনুগত্য আন্তর্জাতিক কূটনীতি ক্ষেত্রে যেমন একদিকে ইয়াহিয়া সরকারের ভিৎ ধ্বসে পড়ছে তেমনি অপরদিকে বাংলাদেশের বুনিয়াদ উত্তরোত্তর সুদৃঢ় হচ্ছে।

কিছু আসবে যাবে না…..
(জয়বাংলা প্রতিনিধি)

জাতীয় পরিষদে নিরঙ্কুশ সংখ্যা গরিষ্ঠ দল আওয়ামী লীগের গুটিকতক বিশ্বাসঘাতক সদস্য ছাড়া দেশপ্রেমিক সংগ্রামী সদস্যগণকে শত ভয় এবং প্রলোভন দেখিয়েও বশীভূত করতে ব্যর্থ হয়ে অবশেষে এই বৃহত্তম দলের সংখ্যাগরিষ্ঠতা কমাবার জন্য নরপিশাচ পাক সরকার জঘন্য চক্রান্তে লিপ্ত হয়েছে।
প্রকাশ নরখাদক ইয়াহিয়া খান প্রধান নির্বাচনী কমিশনারকে আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় পরিষদ সদস্যদের বিরুদ্ধে রাস্ট্র বিরোধী ও হিংসাত্মক কার্যকলাপের অভিযোগ এনে তাঁদের সদস্যপদ বাতিল করার নির্দেশ দিয়েছে।
কিন্তু জঙ্গী ইয়াহিয়া খানের পাকিস্তান সরকারের কোনো অধিকার নেই আওয়ামী লীগের জাতীয় পরিষদ সদস্যদের সদস্যপদ নাকচ করার। কারণ ইয়াহিয়া খানের সেই পাকিস্তান আর জীবিত নেই। লাখো লাখো বাঙালীর রক্তের স্রোতের তলায় পাকিস্তানের মরা লাশ পচে গিয়েছে। বাংলাদেশের প্রশ্নে ইয়াহিয়া খানদের কথা বলার কোন ধৃষ্টতাই ইতিহাসের পরম সত্য স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশ বরদাশ্ ত করবে না।কাজেই জঙ্গী মাতাল ও উন্মাদ ইয়াহিয়া খানের এই শূন্য আস্ফালনে আওয়ামী লীগের তথা বাংলাদেশের কারও কিছু আসবে যাবে না।

 

 

কেনেডী ভারত সফর করবেন

বাংলাদেশ থেকে পাক জঙ্গী শাহীকর্তৃক বিতাড়িত শরণার্থীদের দুঃখ-দুর্দশা সরেজমিনে দেখার জন্য মার্কিন সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডী চলতি মাসের মাঝামাঝী ভারত এবং পাকিস্তান সফর করবেন বলে জানা গেছে। মিঃ কেনেডী সিনেটের শরণার্থী বিচার বিভাগীয় উপসমিতির চেয়ারম্যান। ইতিমধ্যেই তিনি ভারত সরকারের ভিসা পেয়েছেন বলে জানা যায়।শরণার্থী উপসমিতির অপর সদস্য সিনেটর চার্লস মাথিক্যসও ভারত সফরের কথা ভাবছেন।  

নৃশংসতা চলছে

বাংলাদেশে দখলীকৃত এলাকা থেকে পাক জল্লাদদের নৃশংসতার আরও খবর পাওয়া গেছে। সম্প্রতি পাক সেনারা উত্তর বাংলার ভোলাগঞ্জে গুলি করে ৮ জন নিরীহ নিরস্ত্র গ্রামবাসীকে হত্যা এবং ১২ জনকে আহত করে।
তারা ভীটাঘর, অমরখানা এবং ঘাটিয়া পাড়া প্রভৃতি গ্রাম ছেড়ে চলে যাওয়ার জন্য গ্রামবাসীদের উপর হুকুমজারী করেছে।
পাক জল্লাদ সেনারা সিলেট এবং শ্রীমঙ্গলে ৫ হাজার লোককে বন্দি করে রেখেছে। তাঁদের পাক সেনাদের অভ্যর্থনা শিবিরে নিয়ে দেখানো হবে যে, তাঁরা ভারত থেকে স্বদেশে ফিরে এসেছে।
পাক দস্যুরা ময়মনসিংহ জেলার হালুয়াঘাট গ্রামে অবাধে লুণ্ঠন করার পর গ্রামটি আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়। জল্লাদরা বহু সংখ্যক গ্রামবাসীকে মেসিনগানের গুলী দিয়ে হত্যা করে।জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী  জানিয়েছেন যে, কালোকুমা এবং তাতার নামক স্থানে প্রায় ২ শত মৃতদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।

দস্যুবাহিনীর হাতে দুজন সাব্ জজ নিহত

যশোহরের সাবজজ মিঃ সন্তোষ কুমার দাশগুপ্তের স্ত্রী মিসেস মায়া দাশগুপ্তা তার নাবালক পুত্র-কন্যাদের নিয়ে সম্প্রতি মুজিবনগরে এসে পৌঁছেছেন। গত পয়লা মে তাঁর স্বামীকে পশ্চিম পাকিস্তানী পশুরা নিষ্ঠুরভাবে হত্যা করেছে। জল্লাদবাহিনী এছাড়া বরিশালের সাব জজ মিঃ শ্রীনিতীন্দ্রনারায়ণ দাশ ও একমাত্র পুত্র অরবিন্দও গুলী করে হত্যা করেছে।
যশোরের জনৈক পাঞ্জাবী কর্ণেল তোফায়েলের নির্দেশে মিঃ সন্তোষ দাশগুপ্ত ১০ বছরের পুত্র সন্তান দেবাশীষ ও বাসার গৃহভৃত্য বাদল নন্দীকে বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর পাঞ্জাবী পশুরা তাদের একটা ইটখোলার কাছে গাড়ী থেকে নামিয়ে গুলি করে। গুলীবর্ষণের ফলে মিঃ দাশগুপ্ত ও গৃহভৃত্য সাথে সাথে মৃত্যুবরণ করে। কিন্তু পুত্র দেবাশীষ গুলীবিদ্ধ হওয়ার আগেই মাটিতে পরে যাওয়ার ফলে বেঁচে যায়। মিলিটারীর দল  ঐস্থান ত্যাগ করে না যাওয়া পর্যন্ত সে মৃতের ভান করে মাটিতে পড়ে থাকে। কিছুক্ষণ পর নরপশুর দল চলে গেলে সে দৌড়ে গিয়ে মাকে তার বাবার মৃত্যু সংবাদ দেয়।

পাঞ্জাবী পশুর দল ছেলেটি বেঁচে আছে শুনে কয়েক ঘন্টা পর ইটখোলার কাছে গিয়ে ছেলেটির সন্ধান করে, সেখানে ওকে না পেয়ে উন্মত্ত পশুরদলতার বাসায় গিয়ে হানা দেয়। সৌভাগ্যবশতঃএর মধ্যে মিঃ দাশগুপ্তের স্ত্রী তাঁর সব ছেলেমেয়েদের নিয়ে কোন নিরাপদ স্থানে পালিয়ে যাওয়ায় মিলিটারীর হাত থেকে রক্ষা পান। যশোহরের কোন এক মুসলমানের বাড়ীতে তাঁরা প্রায় আড়াই মাস আত্মগোপন করে থাকার পর মিসেস মতি দাশগুপ্তা সম্প্রতি মুজিব নগর এসে পৌঁছেছেন।  

মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল

বাংলা ভাষায় একটা প্রবাদ আছে, ‘মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল’।অধুনালুপ্ত পাকিস্তানের জবরদখলকারী শাসক ইয়াহিয়া চক্রের কান্ডকারখানা দেখে মনে হয়, এদেরও আর পাগল হতে বেশী দেরি নেই। মাত্র কিছু দিন আগে এক বিদেশী সাংবাদিকের কাছে হুঙ্কার দিয়ে বলেছে, “বিশ্ববাসী জেনে যাক, আমি যুদ্ধ করব। ভারত যদি বাঙলা দেশের কোন এলাকা দখল করে, তাহলে যুদ্ধে নামতে আমি দ্বিধা করবোনা।”
তারপর এক হপ্তা ঘোরেনি, ইয়াহিয়া আবার যুদ্ধের হুঙ্কার দিয়েছে। প্রকাশ, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি বৃহৎ রাষ্ট্রকে ইয়াহিয়া জানিয়ে দিয়েছে, ‘ভারত সীমান্ত থেকে যদি কামানের গোলা বর্ষিত হয়, তাহলে সামরিক সংঘর্ষ দেখা দেবে।’ প্রশ্ন হল,বার বার এই যুদ্ধ হুঙ্কার কেন? মাস দুয়েক আগেও ইয়াহিয়ার গলার স্বর খুব নরম ছিল। তখন তার মুখে ভালো ভালো কথা শোনা গেছে। ইয়াহিয়া বলেছে, ‘যুদ্ধ আমি চাইনা। ইন্দিরা গান্ধিও নিশ্চয়ই যুদ্ধ চাননা।কারণ, যুদ্ধ দ্বারা কোন সমস্যার সমাধান হতে পারে না।’
এই ইয়াহিয়াই এখন বলছে, সে যুদ্ধ করবে। এর অর্থ কি?
এই ব্যাপারে নানা মুনির অবশ্য নানা মত। কেউ কেউ বলছেন, আমেরিকার কাছ থেকে অস্ত্র এবং চীনের কাছ থেকে অস্ত্র এবং সমর্থন পেয়ে ইয়াহিয়ার সাহস বেড়ে গেছে। ইয়াহিয়া তাই— জোর গলায় বলছে,যুদ্ধ বাধালে আমরা একা যুদ্ধ করবোনা। এর একমাত্র অর্থ হচ্ছে, তাদের পেছনে চীন রয়েছে।

এই যুক্তি বিনা প্রতিবাদে মেনে নেয়া কঠিন। আমরা মনে করি, বাঙলাদেশে ইয়াহিয়ার খুঁটি যত নড়বড়ে  হচ্ছে, মুক্তিযুদ্ধের সাফল্য যতই অনিবার্য হয়ে উঠছে, ইয়াহিয়া তত বেশী ঘাবড়ে যাচ্ছে এবং গলার স্বর ততই বাড়ছে।
দু’মাস আগে ইয়াহিয়া নিশ্চিত ধরে নিয়েছিল যে, বাঙলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা খতম হয়ে গেছে এবং  এখন সে কিছু দালালকে সামনে রেখে নিশ্চিন্ত মনে বাঙলাদেশে একটি পাপেট গভরমেন্ট বসিয়ে শাসন-শোষণ চালাতে পারবে। এই ব্যাপারে একমাত্র অসুবিধা সৃষ্টি করতে পারে ভারত। সুতরাং ভারতকে তোয়াজ করে ঠান্ডা রাখতে পারলেই সব সমস্যার সমাধান।
কিন্তু দু’মাসের মধ্যে ইয়াহিয়া চক্রের এই খোয়াব ভেঙে  গেছে। মে ও জুন মাসের মধ্যে বাঙলাদেশের মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং তাদের হাতে মার খেয়ে হানাদার বাহিনীর মধ্যে চরম ত্রাস সৃষ্টি হয়েছে। এটা এখন আরো স্পষ্ট হয়ে উঠেছে, চলতি আগষ্ট মাসের মধ্যে না হলেও সেপ্টেম্বর মাসের মধ্যে বাঙলাদেশের মুক্ত এলাকার সীমানা অনেক বেড়ে যাবে, এমনকি কুমিল্লা অথবা চট্টগ্রামের মত শহরও মুক্তি বাহিনীর অধিকারে চলে আসবে। এই সম্ভাবনা যত বাড়ছে, ইয়াহিয়ার অস্থিরতা তত বেড়ে যাচ্ছে।

মুক্তি বাহিনী দখলীকৃত বাঙলা দেশের একটা বড় অংশ শীঘ্রই দখল করবে এই সম্ভাবনা স্বীকার করা ইয়াহিয়ার পক্ষে মৃত্যু তুল্য। ইয়াহিয়া তাই মিথ্যাবাদী রাখাল বালকের মতো চীৎকার শুরু করেছে, ভারত বাংলাদেশের কোন এলাকা দখল করলে আমি যুদ্ধ করবো।ভারত থেকে কামানের গোলা বর্ষিত হলে যুদ্ধ বাধবে…ইত্যাদি। এর অর্থ, মুক্তি বাহিনী দখলীকৃত বাংলাদেশের কোন একটা অংশ যে শীঘ্রই পুনরুদ্ধার করবে, ইয়াহিয়া তা বুঝতে পেরেছে। এখন পরাজয়ের লজ্জা আগে ভাগেই এড়ানোর জন্য এই হাক ডাক।
এটা গেলো ইয়াহিয়ার চীৎকারের একদিক।এর অন্যদিকও রয়েছে। আকাশ পথে দেড় হাজার মাইল এবং স্থল পথে তিন হাজার মাইল দূরে থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে ইসলামবাদ এখন বলতে গেলে প্রায় ফতুর।রেশন ও রসদের অভাবে হানাদার বাহিনীর মধ্যে বিক্ষোভ শুরু হয়েছে। বিমান বাহিনীতে দলত্যাগের হিড়িক দেখা দিয়েছে। আসন্ন বিপর্যয়ের মুখে দাঁড়িয়ে সামরিক জন্তার মধ্যেও আজ পীরিতি আর নেই।ইয়াহিয়া বলছে, এই অবস্থার জন্য টিক্কা দায়ী,টিক্কা বলছে ইয়াহিয়া দায়ী। লন্ডনে খবর রটে গেছে,যে কোনো সময় ইয়াহিয়ার বিরুদ্ধে অভ্যুথান হতে পারে।
পাকিস্তানের এবং নিজেদের এই চরম বিপর্যয়ের মুখে ইয়াহিয়া চক্রের এখন বাঁচার একমাত্র উপায়,যদি বাইরের বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গ বাংলাদেশ সমস্যায় বিরোধ মিটানোর নামে এগিয়ে আসেন এবং ইয়াহিয়া চক্রকে নিজেদের সৃষ্ট পাক চক্র থেকে টেনে তোলেন। ইয়াহিয়া তাই ক্ষিপ্ত জন্তুর মতো চীৎকার করে বৃহৎ রাষ্ট্রগুলোর দৃষ্টি আকর্ষণ করছে আর বলছে, যুদ্ধ এই লাগলো বলে। অর্থাৎ,তোমরা এগিয়ে না এলে যুদ্ধ বাধবে। সুতরাং তোমরা এগিয়ে আসো এবং আমাদের বাঁচাও।
কিন্তু ইয়াহিয়া-চক্রের সেই প্রবাদটি জানা উচিৎ,’শেষের সেদিন বড়ই ভয়ঙ্কর।’ ইয়াহিয়া-চক্রেরও শেষের সেদিন আজ সমূপস্থিত। চীনের নাম করে ভারতকেও আরও ব্লাকমেইলিং করা যাবে না। বাংলাদেশে ইয়াহিয়াকে একাই যুদ্ধ চালিয়ে যেতে হবে এবং মরতে হবে, এই তার নিয়তির বিধান। মাথার ঘায়ে কুকুর পাগল হলে কি হবে, বিশ্ববাসী জানে, ‘যে কুকুর ঘেউ ঘেউ করে, সে কামড়ায়না বা কামড়াতে পারে না। ‘ 

সম্পাদকীয়
এশিয়ার রাজনীতি

জয়বাংলা
১ম বর্ষ,১৩ শ সংখ্যা

যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবিত পিকিং সফর সম্পর্কে এখনো জল্পনা-কল্পনা শেষ হয় নি। তবে এই সফরের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বে যতটা সোরগোল হবে বলে প্রত্যাশা করা হয়েছিল, ততটা হয়নি। বরং খবরটা ফাঁস হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে যে নাটকীয় উত্তেজনা দেখা দিয়েছিল, তা ক্রমশঃই থিতিয়ে যাচ্ছে। কোন ঢাক্ ঢাক্ গুড় গুড় নীতি অনুসরণ না করে যদি নিক্সন ঘোষণা করতেন, তিনি আগামী দশ মাসের মধ্যে কোন উপযুক্ত সমযয়ে চীন সফরে যাবেন, তাহলে বিশ্ববাসী হঠাৎ চমকে যেতো না। কিন্ত ডাঃ হেনরি কিসিঙ্গারের পিন্ডি থেকে গোপনে পিকিং গমন এবং তারপর আকস্মিকভাবে নিক্সনের চীন সফরের সিদ্ধান্ত ঘোষণা, মনে হয় বিশ্বে চমক সৃষ্টির জন্যই অত্যন্ত কৌশলে সাজানো হয়েছিল।
নিক্সন সাহেব হয়তো আশা করেছিলেন, এই অতি নাটকীয় চমক সৃষ্টি দ্বারা তিনি বাংলাদেশ ও ভিয়েৎনাম সমস্যা থেকে তার দেশবাসীর দৃষ্টি অন্যত্র সরিয়ে নেবেন এবং এইভাবে আগামী প্রেসিডেন্ট -নির্বাচনে সহজেই বাজিমাত করে ফেলবেন। কিন্তু নিক্সন সাহেবদের আশা পূর্ণ হয়নি।তাঁর প্রস্তাবিত চীন সফরের চমক অল্পদিনেই ফেটে গেছে এবং বিশ্ববাসী বুঝে ফেলেছে, এটা একটা বড় রকমের স্ট্যান্ট্। আমেরিকার প্রাক্তন সিনেটর ম্যাকার্থি তো স্পষ্টই বলে দিয়েছেন, যুক্তরাষ্ট্রের আগামী নির্বাচনে বাংলাদেশ একটা বড় ইস্যু হবে। অন্যদিকে জনপ্রিয় মার্কিন সিনেটর এডোয়ার্ড কেনেডী ঘোষণা করেছেন, তিনিও চীন সফরে যাবেন।
ওদিকে আমেরিকার সঙ্গে বৈঠকের খবর প্রচারিত হওয়ার পর চীনের অবস্থা ও যে খুব সুবিধের হয়েছে তা নয়।
চীন এদ্দিন বলে এসেছে,আমেরিকা কাগজের বাঘ এবং এই কাগজের বাঘের সঙ্গে যারা দোস্তি করে তারা শোধনবাদী। নিক্সনের সঙ্গে চীনা নেতাদের প্রস্তাবিত বৈঠকের খবর প্রচারিত হওয়ার পর চীনের যারা আন্তরিক সমর্থক, তাদের মধ্যেও এই বিভ্রান্তি দেখা দিয়েছে যে, কাগজের বাঘের সঙ্গে দোস্তি পাতিয়ে চীনও কি তাহলে তাদের কথিত শোধনবাদী ও সাম্রাজ্যবাদী লেজুড় বৃত্তির নীতি অনুসরণ করবে?
বিশ্বময় এই বিভ্রান্তি ও সংশয় দূর করার জন্যই চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এন লাইকে তাড়াতাড়ি সাংবাদিকদের কাছে বলতে হয়েছে, তাদের ছয় দফা শর্ত্ত মেনে নিলে তবে চীন-মার্কিন আঁতাত সম্ভব। এই ছয় দফার মধ্যে  এমন সব শর্ত রয়েছে, যা মেনে নেওয়া আমেরিকার পক্ষে এই মুহূর্তে অসম্ভব।তাহলে শেষ পর্যন্ত ‘নয় মন তেলও হবেনা,রাধাও নাচবেনা’, এই অবস্থা না দাঁড়ায়।
এদিকে যে ইন্দোচীন বা ভিয়েৎনাম নিয়ে চীন-মার্কিন এত মন কষাকষি, সেই ভিয়েৎনামের মুক্তিবাহিনীর নেতারা স্পষ্ট ঘোষণা করেছেন, এশিয়ার ক্ষুদ্র, দুর্বল ও নির্যাতিত জাতিগুলোর স্বার্থকে পাশ কাটিয়ে যদি চীন ও আমেরিকার মধ্যে এই মহাদেশে শক্তি,সাম্য ও স্বার্থ ভাগাভাগির প্রশ্ন দেখা দেয়, তাহলে নিপীড়িত জাতিগুলো সে সম্পর্কে কিছুমাত্র উৎসাহিত বোধ করবে না। শুধু ভিয়েৎনাম নয়, ভিয়েৎনাম ও কম্বোডিয়ার চাইতেও এশিয়ার বড় প্রশ্ন আজ বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ। নিজেদের ক্ষুদ্র রাষ্ট্রীয় স্বার্থে যদি নিক্সন এডমিনিষ্ট্রেশন ও চীন সরকার সাড়ে সাত কোটি মানুষের বাঁচা-মরার প্রশ্নকে বাইপাশ করতে চান, সেক্ষেত্রে তাদের সম্পর্কে বাংলাদেশকে তার নীতি পুনর্বিবেচনা করে দেখতে হবে। বাংলাদেশ বিশ্বের সকল দেশের প্রতি মৈত্রী ও বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারণে ইচ্ছুক,কিন্তু তা তার স্বার্থ, অধিকার ও মর্যাদার বিনিময়ে নয়।  

অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের ভাষণ

মাতৃভূমিকে মুক্ত করতেই অস্ত্র ধরেছি
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

১৭৫৭ সালে পলাশীর আম্রকাননে আমাদের স্বাধীনতা সূর্য অস্তমিত হয়েছিল। আর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের আর একটি আম্রকাননে দাঁড়িয়ে আমরা বাংলাদেশের সাড়ে ৭ কোটি মানুষ এবং বঙ্গবন্ধুর তরফ থেকে স্বাধীনতা ঘোষণা করেছি।
বন্ধুরা আমার—- স্বাধীনতা ঘোষণা করে ১৭ই এপ্রিল সারা পৃথিবীর মানুষকে যে কথা বলেছিলাম আমি বিশ্বাস করি এ কথা আপনাদের অন্তরের বাণী। বিশ্বাস করি—-১৭ই এপ্রিলের এই ঘোষণা  বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের অন্তরের অন্তঃস্থলে মর্মবেদনার অগ্নি স্ফুলিঙ্গের বিরাট স্ফুরণ।
১৭ই এপ্রিল স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমি আমার সহকর্মী বন্ধু জনাব তাজউদ্দিন সাহেবকে প্রধান মন্ত্রির দায়িত্ব দিয়ে ছিলাম। তারই পরামর্শে এবং বঙ্গবন্ধুর পূর্বতম নির্দেশের বলে আমি আমার সহকর্মী বন্ধু জনাব খন্দকার মোস্তাক আহ্ মেদ সাহেবকে পররাষ্ট্র মন্ত্রীর কাজে নিয়োগ করেছিলাম। জনাব মনসুর আলী সাহেবকে অর্থমন্ত্রীর পদে নিয়োগ করেছিলাম। আর জনাব কামরুজ্জামান সাহেবকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রীর পদে নিযুক্ত করেছিলাম।
আমরা জানতাম আপনারা যে প্রয়োজনে তাঁদেরকে দীর্ঘকাল নেতৃত্বের আসনে বসিয়েছেন আমি আপনাদের সবার সঙ্গে পরামর্শ না করেও নিঃসঙ্কোচে আর বিনা দ্বিধায় তাঁদেরকে সরকারের দায়িত্ব দিতে পারি।
বন্ধুরা আমার, তাঁদেরকে দায়িত্ব দেওয়ার পরে তিন মাস চলে গিয়েছে। এই তিন মাস যাবত আমি আপনাদের কাছে স্বীকার করব, অকপটে স্বীকার করব—- যা করার ছিল অনেক কিছু করা সম্ভবপর হয় নাই।
কিন্তু আপনাদেরকে আমি একটি কথা বলব, জনাব তাজউদ্দিন আহমেদ এবং তার মন্ত্রিসভার সদস্যরা আন্তরিকতার সংগে কাজ করার চেষ্টা করেছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আমাদের সরকারের জন্মমুহূর্ত থেকেই কর্ণেল এ,জি ওসমানীর মত একজন স্বনামধন্য দেশপ্রেমিক সমরবিশারদকে সেনাবাহিনীর প্রধান সেনাপতিরূপে পেয়েছি। আপনারা জানেন অত্যাধুনিক সমরাস্ত্রে সুসজ্জিত পাকিস্তান বাহিনী জলে,স্থলে,অন্তরীক্ষে কিভাবে আমাদের বাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করছে। এটাও আপনাদের কাছে অজানা না,যে আমাদের বীর মুক্তি বাহিনী অসীম বীরত্বের সাথে কর্ণেল ওসমানীর নেতৃত্বে এই বিরাট পাকিস্তান বাহিনীর বিরুদ্ধে একটি অসম লড়াই লড়ে যাচ্ছেন।
মনে রাখবেন, বন্ধুরা, রণক্ষেত্রে পশ্চাৎপসরণ পরাজয় নয়। যুদ্ধের প্রয়োজনে পশ্চাৎপসরণ করতে হয় যাতে পুনরায় তীব্র আক্রমণে জয়লাভ করা যায়। যেদিন হিটলারের বাহিনী ফরাসী দেশ আক্রমণ করেছিল সেদিন শতশত, হাজার হাজার বছরের পুরাতন সভ্যতা ও সংস্কৃতির উত্তরাধিকারী ফরাসী সরকারকে ও হিটলারের কাছে মাথা নোয়াতে হয়েছিল।
আপনারা মনে রাখবেন মাত্র ৩ দিনে সব ধ্বংশ করে হিটলারের ট্রাঙ্ক বাহিনী প্যারিসের উপকণ্ঠে উপস্থিত হয়েছিল। সেদিন ফরাসী দেশের বীর নায়ক জেনারেল দ্যাগল মাত্র মুষ্টিমেয় সৈন্য নিয়ে ইংলিস চ্যানেল পার হয়ে ইংল্যান্ডের মাটিতে মাটিতে চলে গিয়েছিল। পরবর্ত্তীকালে আপনারা জানেন জেনারেল দ্যাগল শক্তি সঞ্চয় করে যেদিন ইংলিশ চ্যানেল পার হয়ে অবতরণ করেছিলেন সেদিন হিটলারের বাহিনী তার সামনে টিকতে পারে নাই।
বৃটিশের মত শক্তিশালী সেনাবাহিনী কেও সিঙ্গাপুর থেকে হটে আসতে হয়েছিল। সাময়িকভাবে বার্মা ত্যাগ করতে হয়েছিল। এইভাবে ঐতিহাসিক পশ্চাৎপসরণ করে তাদের শক্তি সঞ্চয় করতে হয়েছিল। যুদ্ধে পশ্চাৎপসরণ করতে হয় যুদ্ধের কলা-কৌশলের প্রয়োজনে। তাই বাঙলার মুক্তি বাহিনী আজকে সাময়িকভাবে যদি কোন কোন রণাঙ্গন থেকে পশ্চাৎপসরণ করে তবে তাকে পরাজয় মনে করবেন না।
আপনারা মনে রাখবেন আমাদের বীর মুক্তি যোদ্ধারা পরাজিত হওয়ার জন্য রণক্ষেত্রের অস্ত্র ধারণ করে নাই। আমাদের বীর মুক্তি যোদ্ধারা জয়লাভ করার জন্য অস্ত্র ধারণ করেছে। জয় আমাদের হবেই

বন্ধুরা আমার, আমি জানি আজকে বাংলার ঘরে ঘরে কি হাহাকার।আমি জানি নির্বাচিত প্রতিনিধি হিসাবে আপনাদের বুকের মধ্যে কি ক্রন্দনের রোল। আমি জানি আপনারা যখন শুনেন আপনার শহরে,আপনার গ্রামে, আপনার গঞ্জে যারা একদিন বিশ্বাস করে, ভালোবেসে আপনাদেরকে ভোট দিয়েছিল তাদের ঘর বাড়ী আজকে জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, তখন কি মর্মবেদনায় আপনারা পীড়িত হন।
আমি জানি যখন আপনারা শুনেন আপনার প্রতিবেশী নারীদেরকে বর্বর পশুরা ইজ্জতের হানী করছে, আমি জানি আপনাদের আপনাদের কলিজা ফেটে যায়। এই ধরনের অত্যাচার পৃথিবীর ইতিহাসে কোন সৈন্যবাহিনী কোন দিন করে নাই। নারীর ইজ্জত লুন্ঠন হচ্ছে আজ আমার বাংলাদশে। আমার বাংলাদেশে দশ লক্ষ মানুষ হত্যা করা হয়েছে। আমার বাঙলাদেশের মসজিদ আজকে ধ্বংস করা হয়েছে, বাংলার মন্দির আজকে ধ্বংস হয়েছে, বাংলার গীর্জা আজকে ধ্বংস হয়েছে, বাঙলার ফসল আজকে মাঠে মাঠে লুটিয়ে পড়েছে। আমাদের বীর তরুণদের কে আজকে হত্যা করা হচ্ছে, বুলেট দিয়ে গুলি করে মারা হচ্ছে।
এই কাহিনীর মর্মবেদনা আপনাদের বুকের ভিতর যেমন বাজে, আমার বুকে যেমন বাজে আর সকলের বুকে ও তেমনি বাজে। যদি বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে উপস্থিত থাকতেন তাঁর প্রিয় দেশবাসীর মর্মদন্তু দুঃখের কথা শুনে তিনি হয়তো অধীর হয়ে যেতেন  তাদের মুক্তির জন্য। তাই বন্ধুরা, আপনাদের ব্যথা আমরা জানি। আপনাদের ব্যথা বিশ্ববাসীকে বলার জন্য আপনার মন্ত্রিসভার সদস্যরা আপনার চেষ্টা করে চলেছে। তারা কি পর্যন্ত সফল হয়েছেন তার বিচার করবেন আপনারা। কিন্তু একটা জিনিষ আপনাদেরকে আমি স্পষ্ট করে বলে দিতে চাই। আপনার সমালোচনা করুন অনেক কিছু হয় নাই। কি ভাবে হতে পারে তার পথ দেখিয়ে দিন। কিন্তু বিশ্ববাসীর কাছে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা আর কূটনৈতিক কার্যকলাপের দ্বারা আমরা এই কথা প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছি যে বাঙলাদেশে গণহত্যা চলেছে। বাঙলাদেশে ধ্বংস যজ্ঞ চলেছে, আজকে আপনাদের মন্ত্রিসভা,প্রধান মন্ত্রী নিরলস চেষ্টা দ্বারা সারা পৃথিবীর কাছে প্রমাণ করতে সক্ষম হয়েছে যে ইয়াহিয়া ভুলা আর ভ্রান্ত আর আমরা সঠিক পথে চলেছি। আজকে সারা পৃথিবীর পত্র-পত্রিকা তা গ্রহণ করেছে।

চোখ মেলে চেয়ে দেখুন, আজকে লন্ডনের অবজারভার খুলুন, “সানডে টাইম” খুলুন, যে কোন পত্র-পত্রিকা খুলুন  দেখবেন ইয়াহিয়ার বর্বরতার নিন্দায় মুখর। নিউইয়র্কের পত্রিকাগুলি দেখুন, যে আমেরিকা সারা পৃথিবীর রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করে, সেই আমেরিকার জনমত আপনার আপনার সরকারকে সমর্থন করছে, নিউইয়র্কের টাইম এবং অন্যান্য সমস্ত প্রভাবশালী পত্রিকাগুলি প্রত্যেকেই আজকে ইয়াহিয়াকে ধিক্কার দিচ্ছে। তারা আজকে আপনার দাবীর নায্যতা তুলে ধরেছেন।
শুধু তাই নয় ফরাসীদেশে, ইটালীতে, জার্মাণীতে, স্কান্ডিনেভিয়ান দেশগুলোতে এমন কি আরবের কোন কোন অঞ্চলে বিশেষ করে বেরুতে আর সুদানের পত্রিকাগুলি আপনার পক্ষে আজকে মত প্রকাশ করে চলেছে।
বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন যে এখন পর্যন্ত এই রাষ্ট্রের এই সরকারের স্বীকৃতি কেন লাভ করা সম্ভবপর হয় নাই? কূটনৈতিক প্রশ্নে বৃহৎ শক্তিবর্গ পৃথিবীতে নিজস্ব স্বার্থের কারণে অনেক কিছু করে।
কিন্তু আপনারা জেনে রাখুন যেখানে বিশ্বের জনমত আপনার পক্ষে সেখানে বিশ্বের রাষ্ট্রগুলি আপনাকে স্বীকৃতি দেবেই। আমাদের বন্ধু, আমাদের প্রতিবেশী ভারত বর্ষ আমাদের ৬০ লক্ষ শরণার্থীকে শুধু আশ্রয় দেয় নাই আমাদের দাবির নায্যতাকে স্বীকার করে নিয়ে সারা পৃথিবীতে আমাদেরকে সাহায্য করার জন্য স্বেচ্ছায় আজকে এগিয়ে এসেছে। সেই জন্য ভারত সরকারের কাছে আমি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করি।
বন্ধুরা আমার, মুক্তি সংগ্রামে, স্বাধীনতা সংগ্রামে একদিকে যেমন সৈন্যবাহিনীকে প্রস্তুত করতে হয় চরম আঘাত হানার জন্য তেমনি আরেকদিকে কূটনৈতিক আক্রমণের দ্বারা শত্রুকে পর্যদুস্থ করতে হয়। আর তৃতীয়তঃ দেশের অভ্যন্তরের মানুষের মনোবলকে শক্ত রাখতে হয়। আর শত্রুর মনোবল ভাংতে হয়।
বিদেশে কূটনৈতিক প্রচার চালিয়েছেন আপনার সরকার। মুক্তি ফৌজকে সুসংগঠিত করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করছেন। দলে দলে, হাজারে হাজারে ছেলে আজ মুক্তি ফৌজে যোগ দেওয়ার জন্য, মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্য এগিয়ে আসছে। সবাইকে সমানভাবে সৈনিকের শিক্ষাদানের বন্দোবস্ত করা সম্ভব হয় নাই। তার একমাত্র কারণ আমাদের সীমিত সামর্থ।

(চলবে) 

দালাল নিধন চলছে
[জয়বাংলা প্রতিনিধি]

শ্যামল বাংলার বুকে হানাদার পাক সৈন্যদের  বাংলাদেশের বীর সন্তান অপরাজেয় মুক্তি যোদ্ধাদের এবার প্রতিশোধের পালা। এবার রক্তের বদলে রক্ত খুনের বদলে খুনের পালা। বাংলাদেশে কাপুরুষরা হত্যা করেছে নিরস্ত্র নিরীহ মানুষ আর বীর মুক্তি যোদ্ধারা এবার হত্যা করেছেন সেই জল্লাদদের এবং তাদের দালালদের।
মুক্তিযোদ্ধারা সম্প্রতি সিলেট জেলার এমনই একজন পশ্চিম পাকিস্তানী দালালকে খতম করেছেন  সিলেট জেলা পিডিপির সভাপতি এবং নূরুল আমিন ও মাহমুদ আলীর ঘেটু জসীম উদ্দীনকে খতম করা হয়েছে। এরা গণহত্যা এবং লুঠতরাজে পাক সেনাদের সাথে সহযোগিতা করতো। ঘটনার দিন তারা গাড়ীতে করে সিলেট থেকে আটগ্রাম যাওয়ার পথে মুক্তিবাহিনীর মাইন বিস্ফোরিত হয়ে গাড়িটি শুদ্ধ মিসমার হয়ে যায়।

কুমিল্লা শহরের একজন বড় দালালকেও মুক্তিবাহিনী সম্প্রতি খতম করেছেন। উক্ত দালালটি কুমিল্লা টাউন কমিটির সভাপতি।
সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা তাঁর বাড়ী ঘেরাও করে এই কুখ্যাত দালাল ও তাঁর ৬ জন সহচরকে খতম করে  দেন।  

বাংলাদেশের জন্যে পোপের উদ্বেগ প্রকাশ

খৃষ্টান জগতের ধর্মগুরু মহামান্য পোপ বলেছেন, বাংলাদেশের জনগনের শান্তি ও স্বাধীনতার পক্ষে বাংলাদেশের সমস্যার সমাধান হতে হবে।
কলকাতার আর্চবিশপ ফাদার পিয়ারে ফেলোনকে বাংলাদেশ সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য জানাবার জন্য মহামান্য পোপের কাছে পাঠানো হয়েছিলো।
ভ্যাটিকান সিটি থেকে ফিরে ফাদার পিয়ারে বলেন, মহামাণ্য পোপ বলেছেন বাংলাদেশের জনগণ সত্য, ন্যায় ও স্বাধীনতার জন্য যুদ্ধ করছেন।তাঁদের জয় হবেই।
ফাদার ফেলোন ফ্রান্স, হল্যান্ড,বেলজিয়াম, পশ্চিম জার্মানী, সুইজারল্যান্ড সফর করে সে সব দেশের জনগণের কাছে বাংলাদেশের প্রকৃত অবস্থা বর্ণনা করেন। তিনি রেডিও, টেলিভিশন ও সাংবাদিক সম্মেলনে বক্তৃতা করেন এবং এসব প্রচার সংস্থার মাধ্যমে তিনি বাংলাদেশে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের নৃশংস হত্যাকাণ্ড ও বর্বরতার চিত্র তুলে ধরেন।
ফাদার ফেলোন বলেন, মহামান্য পোপ বাংলাদেশের অসহায় জনগণের দুঃখ দুর্দশায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশে শান্তি ফিরিয়ে আনার জন্য আমাদের সকলের কাজ করা উচিত।  

লুন্ঠিত ধন সম্পত্তি প্রকৃত মালিককে ফিরিয়ে দেয়া হবে
(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

আমার প্রিয় দেশবাসী, সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা, পাক সেনারা গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দিয়ে, হাজার হাজার পরিবারকে গৃহহারা বাস্তুচ্যুত করে আমাদের সামাজিক এবং অর্থনৈতিক জীবনে এক চরম সংক্টের সৃষ্টি করেছে।
ওরা আমাদের খাদ্যের গুদাম জ্বালিয়ে দিয়েছে,বিষাক্ত রাসায়নিক দ্রব্য ছিটিয়ে ক্ষেতের ফসল নষ্ট করেছে, গৃহস্তের সোনাদানা, গরু-ছাগল লুঠ করে তাদেরকে পথে বসিয়েছে। এককথায় গ্রামীণ অর্থনীতির মূল ভিত্তিকেই  দিয়েছে চুরমার করে।
শহরাঞ্চলে দোকানপাট ভেঙ্গে দিয়েছে, পুড়িয়ে দিয়েছে এবং অবাঙ্গালীদের দিয়ে দোকানের জিনিষ পত্র লুট করিয়েছে।অনেক শিল্প সংস্থা জ্বালিয়ে দিয়েছে ; যন্ত্রপাতিগুলো পশ্চিম পাকিস্তানে পাঁচার করেছে। বাকী যে কয়েকটি রয়েছে সেগুলোতে বাঙ্গালী কর্মচারীর শতকরা নব্বই জনকে তাড়িয়ে দিয়ে অবাঙ্গালী বসিয়ে দিয়েছে। বাঙ্গালী শ্রমিকরা আজ বেকার; বাঙ্গালী শিল্পের কাঠামো আজ সম্পূর্ণ রূপে ভেঙ্গে দিয়েছে।
শুধু তাই নয় শহরে-বন্দরে বোমা নিক্ষেপ করে ওরা আমাদের গুরুত্বপূর্ণ অফিস-আদালত,সড়ক সেতু ধ্বংস করে দিয়েছে। হাটেমাঠের লোককে ভীত সন্ত্রস্ত করে সাধারন ব্যবসা বাণিজ্যকে করেছে বিপর্যস্ত। বিভিন্ন সরকারী ও আধাসরকারী সংস্থার হাজার হাজার কর্মচারীকে বরখাস্ত করে অসংখ্য পরিবারকে ঢেলে দিয়েছে অনাহার আর মৃত্যুর মুখে।
সবশেষে স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয় কে ধ্বংস করে, অধ্যাপক শিক্ষার্থীদের হত্যা করে মানব সম্পদে আমাদের বিনিয়োগের পথকে  করেছে রুদ্ধ; যার ফলে ভবিষ্যতে আক্রান্ত হতে পারে আমাদের দক্ষতা আর পারদর্শিতা।
কিন্তু বন্ধুগণ, সেনাবাহিনীর এই নৃশংসতা আর কুকর্মের খেসারত পোহাতে হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের সাধারণ মানুষকেও। কারণ, পশ্চিম পাকিস্তানের ঘরে ঘরেও আজ কান্নার রোল পড়েছে, সেখানকার অর্থনীতিও সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গে পড়েছে।

বাংলাদেশ থেকে কাঁচা মাল যাওয়া বন্ধ হবার ফলে তাদের রফতানি বাণিজ্য সম্পূর্ণ বন্ধ হয়ে গেছে। তাছাড়া বাংলাদেশের বাজার হারিয়ে ফেলায় পশ্চিম পাকিস্তানের পূর্ব উৎপাদিত শিল্প-দ্রব্য গুলোই গুদামে পঁচতে শুরু করেছে। নতুন উৎপাদনের সুযোগ-সম্ভাবনা ক্রমেই মিলিয়ে যাচ্ছে।
ফলে বহু শিল্প-কারখানা ইতিমধ্যেই বন্ধ হয়ে পড়েছে। বাকী অনেকগুলোতে প্রতিদিন শত শত শ্রমিক ছাঁটাই হচ্ছে। বেকারদের অভিশাপ নেমে আসছে পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতিতে।
তার ওপর রয়েছে সমর পরিচালনার বিরাট ব্যয়ভার। বাংলাদেশের সমরাভিযান অব্যাহত রাখতে ইসলামাবাদ সরকারকে প্রতিদিন ব্যয় করতে হচ্ছে গড়ে এক কোটি টাকা। মুক্তি বাহিনী গেরিলার হাতে প্রচন্ড মার খেয়েছ ওরা দিশেহারা হয়ে পড়ছে, আর ডিভিশনের পর ডিভিশন সৈন্য পাচার করছে বাংলাদেশে। ফলে খরচের পাল্লা ভারী হয়ে চলেছে প্রতিদিন। অথচ আয়ের পথ দিন দিন বন্ধ হয়ে আসছে। ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে।

তাই ওরা মরিয়া হয়ে উঠেছে। সাধারণ মানুষ থেকে প্রায়ই জোর করে নতুন ট্যাক্সের নামে টাকা পয়সা লুঠ করে চলেছে। কতিপয় নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যের ব্যবহার প্রায় বন্ধ করে দিয়ে জনগণের প্রাত্যহিক জীবনকে করে তুলেছে বিষময়।
তাই ভিক্ষার ঝুলি নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন দেশের কাছে ধর্না দিয়েছিল ইসলামাবাদ সরকারের বিশেষ দূত। কিন্তু তাতেও বিশেষ সাড়া মিলেনি। অগত্যা উন্নয়ন পরিকল্পনাকে সিকেয় তুলতে হয়েছে। হতাশায় ভেঙ্গে পড়েছে ইয়াহিয়া সরকার।
বিশ্বের বিভিন্ন দেশ এবং সাহায্য সংস্থা পাকিস্থানকে অর্থনৈতিক সাহায্য দিতে অস্বীকার করায় আমরা তাদের অভিনন্দন জানাচ্ছি।
সাথে সাথে আমি একথা সুস্পষ্ট করে জানিয়ে দিতে চাই পাকিস্তান এবং বাংলাদেশ আজ দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোনো অধিকারই ইসলামাবাদ সরকারের নেই। একমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীর নির্বাচিত প্রতিনিধির দ্বারা গঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমেই বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আসতে পারে।বস্তুতঃ ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য করার মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলা দেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাসত করবে না।
ভারত সরকার ও জনসাধারণের নানারূপ অসুবিধার মধ্যে লক্ষ লক্ষ বাস্তুত্যাগী বাঙ্গালীকে বাঁচানোর দায়িত্ব নিয়েছেন। আমরা এজন্য তাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞ। পৃথিবীর আরো যে সব বন্ধু রাষ্ট্র বিভিন্ন রকম সাহায্য নিয়ে এগিয়ে এসেছে তাদেরকে ও আমরা আমাদের কৃতজ্ঞ জানাচ্ছি।
বন্ধুগন,
স্বাধীন বাংলাদেশের অর্থনীতিকে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠিত করার উদ্দেশ্যে আমরা ইতিমধ্যে ‘বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন’ গঠনের উদ্যোগ নিয়েছি। 

গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থ মন্ত্রী জনাব এম.মনসুর আলীর বেতার ভাষণের পূর্ণ বিবরণ

যেহেতু বাংলাদেশের বেশ কিছু এলাকা এখনো শত্রুকবলিত রয়েছে তাই এ মুহূর্তে আমাদের পরিকল্পনার বাস্তব রূপায়ন সম্ভব হচ্ছে না। তবু সীমিত পরিসরে আমরা যে কয়েকটি অর্থনৈতিক পদ্ধতি গ্রহণ করেছি তা হচ্ছে এই—
১. এই মুক্তি সংগ্রামে যে সমস্ত বাঙ্গালী সন্তান জীবন দিয়েছে বাংলাদেশ সরকার তাদের পরিবার বর্গের ভরন-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণ করেছেন।
যারা পঙ্গু অথবা বিকলাঙ্গ হয়েছে  তাদের পরিবারকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য বাংলাদেশ সরকার সমুহ চেষ্টা করে যাবে।
২.শত্রুরা আমাদের অর্থনীতিকে ভেঙ্গে দিয়েছে। মুক্ত এলাকায় এই বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে দায়িত্ব বাংলাদেশ সরকারের। মুক্ত এলাকায় সরকার এ ব্যাপারে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহন করেছেন।
৩.যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো প্রণয়নে যে কথাটি আমরা সব সময়ই মনে রেখেছি সেটি হচ্ছেঃ চরম দুঃখ-কষ্ট সহ্য করে ও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষই এই মুক্তিসংগ্রামে প্রত্যক্ষভাবে অংশ গ্রহন করেছে সুতরাং স্বাধীনতার ফল ভোগ করার অধিকার তাঁদের সবারই রয়েছে। এবং সেই ফল থেকে তাঁরা যেন বঞ্চিত না হন তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে। মোট কথা সমগ্র জনসাধারণের অর্থনৈতিক মুক্তির নিশ্চয়তা বিধান করতে হবে।

যে সব দুষ্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙালীদের বাড়ী ঘর জোর করে দখল করেছে; ধন সম্পত্তি লুট করেছে; তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে এবং প্রকৃত মালিক কে তার ধনসম্পত্তি অবশ্যি ফিরিয়ে দেয়া হবে।
জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে নিঃসহায় মানুষের বাঁচার অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুর সহায়তায় জোর করে কেড়ে নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশে তাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই।

বন্ধুগন,
জানি আপনারা চরম দুরবস্থার মধ্যে দিন কাটাচ্ছেন।জানিয়ে মুহূর্ত্তে  আপনাদের এই অর্থনৈতিক সংকট নিরসন আমাদের পক্ষে সম্ভব নয়।তবুও আপনাদের কাছে অনুরোধ বিপদে ধৈর্যচ্যুত হবেন না। আজ আমরা এক অগ্নি-পরীক্ষার সমুখীন। একমাত্র চরম ত্যাগ তীতিক্ষার শপথেই আমরা এই পরীক্ষার উত্তীর্ণ হতে পারি।
স্বাধীন দেশের নাগরিক হিসেবে আপনাদের অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সে কর্তব্য রয়েছে সে গুলো সম্পর্কে আপনাদের আবার মনে করিয়ে দেবার প্রয়োজন বোধ করছি।
১.যেহেতু বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোনো বিদেশী সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার অধিকার নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিককে কথা অবশ্যি মনে রাখতে হবে।
২. শত্রুরা  সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের চরম দুর্ভিক্ষ এবং খাদ্যাভাব সৃষ্টি করছে। লাখো লাখো বাঙ্গালীকে অনাহারে মৃত্যুর মুখে ঠেলে দিয়ে বাংলাকে সত্যিকার শ্মশানে পরিণত করতে চাইছে।

এমতাবস্থায় প্রতিটি গ্রামকে খাদ্যে স্বয়ং সম্পন্ন হতে হবে। গ্রামবাসী ভায়েরা আমার; খাদ্য উৎপাদনে আপনাদের যথাশক্তি নিয়োগ করুন। শত্রু কবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখুন। কারণ এ ফসল বিক্রী করে শত্রু হাতিয়ার কিনবে বাংলাদেশের গণহত্যার জন্য।

গ্রামীন অর্থনীতির উপর জোর দিয়ে গ্রাম গুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে স্বয়ং সম্পন্ন করে তুলুন। গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তুলুন।পরস্পর সহযোগিতার মাধ্যমে নিজেদের বাঁচার পথ বেছে নিন। বাংলাদেশের উৎপাদিত পাট ও অন্যান্য অর্থকরী ফসল ইয়াহিয়া সরকার নানারূপ ভয়-ভীতির মাধ্যমে বিনামূল্যে কিংবা নাম মাত্র মূল্যে কেড়ে নিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে হত্যা করার জন্য মরণাস্ত্র কিনছে। আপনাদের অবগতির জন্যে জানাচ্ছি যে বাংলাদেশ সরকার ইতিমধ্যেই ‘বাণিজ্য বোর্ড ‘ গঠন করেছে। এই বোর্ড  বাংলাদেশের অর্থকরী ফসল বিদেশের বাজারে বিক্রীর সমূহ ব্যবস্থা করবে। আপনাদের উৎপাদিত ফসল আপনারা এই বোর্ডের মাধ্যমে বিক্রী করবেন। বাংলাদেশের কৃষকরা যাতে তাদের উৎপন্ন ফসলের উপযুক্ত মূল্য পায় তার নিশ্চয়তা বিধান করার জন্য বোর্ডের কর্মকর্তাদের সুস্পষ্ট নির্দেশ দিয়েছি।
সর্বশেষে নাগরিক ভাইদের কাছে আমার একান্ত অনুরোধ, আপনারা শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযোগিতা চালিয়ে যান। পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপাদিত যাবতীয় দ্রব্যের ব্যবহার সম্পূর্ণ রূপে পরিহার করুন।
কলকারখানার উৎপাদন বন্ধ রাখুন।শত্রুকে সদা সর্বত্র নাজেহাল করে তার অর্থনৈতিক কাঠামো সম্পূর্ণরূপে ভেঙ্গ দিন।
মনে রাখবেন, আপনাদের অসহযোগিতায় শত্রুর তথা পাকিস্তানের অর্থনীতি ইতিমধ্যে প্রায় ভেঙ্গে পড়েছে। আপনাদের পরিপূর্ণ অসহযোগিতায় অচিরেই তা ভেঙ্গে খান খান হয়ে যাবে। আপনাদের উপর আমার পূর্ণ আস্থা রয়েছে।
বন্ধুগন,
এখানে একটি কথা আপনাদের মনে করিয়ে দিতে চাই। একথা সত্যি যে শত্রু কবলিত এলাকায় আমাদের মুক্তি বাহিনী পুল, সেতু, উড়িয়ে দিয়ে সড়ক যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে। শত্রুর আশ্রয়স্থল কতিপয় দালান কোঠা ভেঙ্গে দিচ্ছে। প্রয়োজনে রাস্তাঘাট কেটে শত্রুর পরিবহন ব্যবস্থাকে অকেজো করে দিচ্ছে।
এতে আমাদের অর্থনীতিতে কিছু ক্ষয় ক্ষতি হচ্ছে সন্দেহ নেই। কিন্তু এ করা ছাড়া আমাদের অন্য কোন উপায় নেই।
শত্রু নিধনই আজ আমাদের প্রথম এবং প্রধান কর্তব্য। নিজেদের কিছু ক্ষয় ক্ষতি সহ্য করে ও আমাদের এ কর্তব্য সমাধা করতে হবে। দেশে যতক্ষণ পর্যন্ত একটি হানাদার সৈন্যও উপস্থিত থাকবে ততক্ষণ আমরা শত্রু-নিধন পর্ব চালিয়ে যাব।সামনে যত বাধাই আসুক না কেন।
অবশ্যি দেশ সম্পূর্ণ ভাবে শত্রু মুক্ত হলে আমরা প্রথমেই এসব রাস্তাঘাট পুননির্মানের কাজ শুরু করব। আমাদের সামগ্রিক প্রচেষ্টায় এ সবের পুনঃ নির্মানে বেশী সময় লাগবে না বলে আমার বিশ্বাস।

বন্ধুগন,
বাঙালী জাতির ইতিহাসে আজ এক চরম গুরুত্বপূর্ণ অধ্যায় রচিত হতে চলেছে। একটি স্বাধীন দেশের স্বাধীন নাগরিক হিসেবে বেচে থাকার মৌলিক মানবিক অধিকার থেকে সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালীকে যারা পশু শক্তির বলে বঞ্চিত করতে চাইছে তাদের সাথে আমাদের কোন আপোষ নেই। রক্ত ভেজা পথে এগিয়ে চলেছে বাঙালীর মুক্তি কাফেলা। কালের দেয়ালে পড়ছে রক্তের ছাপ। রক্তের আখরে লেখা হচ্ছে নবযুগের ইতিহাস।
লক্ষ লক্ষ নিরপরাধ বাঙালীকে হত্যা করে ইয়াহিয়া- টিক্কা যে পাপ করেছে ইতিহাসের কাঠ গড়ায় তাদের জবাব দিহি করতে হবে। ইতিহাসের অমোঘ দন্ড এড়ানোর উপায় কারো নেই।
সাম্রাজ্যবাদের দিন বহু আগেই শেষ হয়ে গেছে। পৃথিবীর যে দেশেই মুক্তিকামী মানুষের সংগ্রামে সাম্রাজ্যবাদী শক্তি পরাভূত হয়েছে। সবক্ষেত্রে একথাই প্রমানিত হয়েছে যে অস্ত্র প্রয়োগে স্বাধীনতা রক্ষার সংগ্রামে স্তব্ধ করা যায় না।
বাঙালীর এ মুক্তি-সংগ্রামকেও তাই বুলেট-ব্যয়নেট,সেলগোলায় স্তব্ধ করা যাবে না। রক্তে যখন মাতন জেগেছে, পদ্মা মেঘনায় বান ডেকেছে তখন তাকে রুখতে পারে এমন সাধ্যি কারো নেই।
মর্জি খোদা। জয় আমাদের সুনিশ্চিত এবং সে দিন বেশী দূরে নয়। জয় বাংলা।

ইয়াহিয়ার জ্যুডেনর‍্যট
(পূর্বপ্রকাশিতের পর)

তিনিই মাহবুবুল হক,যিনি ১৯৭০ সালের তেরই মার্চ কুর্মিটোলা সেনা-নিবাসে সম্পাদকদেরএক বৈঠকে জেনারেল সাহেবজাদাকে ছাত্রনেতাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নিতে অনুরোধ করেছিলেন। বিপ্লবী ও জঙ্গী ছাত্রনেতাদের তিনি খোলাখুলি ভাবে “রাষ্ট্রদ্রোহী” আখ্যা দিয়ে বসেন।  ঢাকাতে সাংবাদিক মহলে অনেকেই জানেন যে, ফটোগ্রাফারকে চাকুরী যাবার হুমকী দিয়ে তিনি দীর্ঘ দু’ বছর যাবত কেন্টনমেন্টে বিভিন্ন আন্দোলনের আলোকচিত্র সরবরাহ করে আসছেন। গত মে মাসে সামরিক বাহিনী তাকে দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকাগামী রেল চালু করার চেষ্টা করেন। তিনি সামরিক প্রহরাধীনে চট্টগ্রামে যান, তবে পরবর্তী দিন তিনি প্রাণের ভয়ে নোয়াখালীর বাড়িতে পালিয়ে যান। স্বাভাবিক ভাবেই এই বিশ্বাসঘাতক নিজে গ্রামেদ জনগণের কাছেও আশ্রয় পাননি।
সারাজীবন ব্যাপী জনস্বার্থ বিরোধী কার্যে যিনি সিদ্ধহস্ত, যিনি আইয়ুবের বিস্বস্ত জি-হুজুরের  ভূমিকা নিয়ে বাংলাদেশের স্বার্থ বিকিয়ে দিয়েছিলেন, সাড়ে তিন কোটি টাকার লোভে যিনি বিতাড়িত হয়েও পুনরায় কনভেনশন লীগে যোগদান করেছিলেন—- সেই গণধিকৃত গহিরাপতি ফ,কা, চৌধুরী গত নির্বাচনের স্রোতে বিলীন হয়ে যাওয়ার পরও পুনরায় আর্মির ছত্রছায়ায় স্বরূপ আত্মপ্রকাশ করেছেন। বাঙালীর কাছে তার অতীতকে পুনরায় উল্লেখ করার প্রয়োজন নেই।
এই ফ,কা, চৌধুরী ২৫ মে মার্চের সমসাময়িক কাল থেকেই বিপ্লবী ও স্বাধীনতাকামীদের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রে লিপ্ত। চট্টলে পরাজিত ইয়াহিয়া সেনাদের পুনঃ প্রবেশের সুযোগ চৌধুরী সাহেবই করে দিয়েছেন। শুধু তাই নয়, তিনি এখন স্থানীয় ইয়াহিয়া ব্রিগেডের পলিটিকাল কমিশার। তিনি জ্যুডেনব্যটের প্রথম সারীতে প্রধান পদ প্রার্থী।
আর্মিলকে সাহায্যকারী এই সমস্ত ভদ্রলোকদের মধ্যে কেউ এখন বিদেশে কেউ বা আশ্রয় নিয়েছেন সেনানিবাসে। এরা সকলেই প্রতিবিপ্লবী এবং সামরিক বাহিনীর ক্রীড়ানক। ইয়াহিয়ার জ্যুডেনর‍্যটসদস্য হবার লোভে নিজের দেশের ভাই-বোন-আত্মীয়-স্বজন-বন্ধু-বান্ধব ও দেশপ্রেমিকদের গণ হত্যার শিকার করে দিচ্ছেন এরা।
হিটলার পদলেহীদের প্রাণে রক্ষা করলেও,তাদের দেশে রাখেননি। একটা ভিন্ন রাষ্ট্র গঠনে সহায়তা করেছিলেন বলতে হবে। কারণ তিনি নিজেও জানতেন, যারা নিজ দেশবাসীকে হত্যায় সহায়ক ছিল তাদের বিশ্বাস করা রাজনৈতিক অজ্ঞতার পরিচায়ক। কিন্তু বাংলাদেশের এই সমস্ত জ্যুডেনর‍্যট সদস্যদের জন্যে এমন একটা দেশ ইয়াহিয়ার জেনাবেলইা কোথা থেকে খুঁজে বের করলেন।

  

নীলামের সম্পত্তি কিনছে কারা?

পাকিস্তানে জঙ্গী সরকার বাংলা দেশের প্রধান মন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, জাতীয় পরিষদ সদস্য আব্দুল মান্নান এবং ‘দি পিপল’ পত্রিকার সম্পাদক জনাব আবিদুর রহমানের স্থাবর ও অস্থাবর সম্পত্তি নিলামে বিক্রী করছেন।
পাকিস্তানে জঙ্গী সরকার মনে হয় এঁদের গ্রেপ্তার করতে না পেরে কোন এক বিশেষ জন্তুর মত একেবারে পাগল হয়ে গেছে। ভাবটা এই—-” তোদের না পাই, কিন্তু তাদের ঘরবাড়ী জমিজমা তো আছে। তারা তো পালিয়ে যেতে পারবেনা। বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় গভর্ণর টিক্কা খানকে আমাদের জিজ্ঞাসা—-এই সব সম্পত্তি কে কিনছে এবং কার এমন বুকের পাটা?
বিশ্ববাসীর কাছে আজ এটা অজানা নয় যে পঁচিশে মার্চের পর গত চার মাসের মধ্যে পট-পরিবর্তন হয়েছে হানাদার পাক দস্যুরা আজ মুক্তিবাহিনীর পশু আক্রমণের সামনে দিশেহারা হয়ে পড়েছে আজ বাংলাদেশের বহু এলাকায় মুক্তিবাহিনীর সম্পূর্ণ নিয়ন্ত্রণে। এই অবস্থায় এমন কোন বাপের বেটা রয়েছে যে সাহস করে এই সব স্থাবরঃ অস্থাবর সম্পত্তি কিনবে।
জঙ্গী সরকার নিলামের কথা বলে যতই ধোকা দেয়ার চেষ্টা করুক না কেন আমরা ভালভাবেই জানি যে ভীতসন্ত্রস্থ অবাঙ্গালীরা জেনেশুনে মরণফাঁদে পা দেবেনা। আর বাঙালীদের তো কোন প্রশ্নই উঠে না। তবুও একটা কথা আমরা না বলে পারিনা যে “অপরিণামদর্শী” কোন সাহসী(?) ব্যক্তি যদি নীলামের সম্পত্তি ক্রয় করে তা হলে তার পরিবার পরিজনদের প্রতি আমাদের সমবেদনা জানানো ছাড়া আর কিছুই করার থাকবে না। কারন?মুক্তিবাহিনী তো আশেপাশেই আছে। বাসায় পৌঁছুনোর আগেই সেই হতভাগ্যের লাশ পথেই গড়াগড়ি যাবে।”
তাই অনেকে সন্দেহ প্রকাশ করছেন যে, এই সব সম্পত্তি জঙ্গিশাশী নিজেরাই নিলাম করে নিজেরাই কিনছে।এই তো চান্স তাদের কিছু বিষয় সম্পত্তি হস্তাগত করার। ‘সেই পথ ধরে’ মানে আইয়ুব খান তো এ ব্যাপারে পথ প্রদর্শক, সুতরাং টিক্কারও যে এই ভীমরতি হবে এতে কোন সন্দেহ নেই, কিন্তু কথা হচ্ছে, টিক্কাখান সাহেব কি হবে এত লোভেরর পরিচয় দিয়ে? বাংলাদেশ স্বাধীন হবে এবং সেদিন যদি জনগণ আপনাকে পায় তা’হলে আপনি সেই কাবাবে পরিণত হবেন যার সাথে আপনার নামের মিল রয়েছে।  

শেখ মুজিবরে মুক্তির জন্য ঊথানটের হস্তক্ষেপ কামনা

বাংলাদেশ লীগ অব আমেরিকা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তিদানের ব্যাপারে জাতি-সংঘের সেক্রেটারী জেনারেল উথানটের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেলের কাছে প্রদত্ত এক আবেদনের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়ার বক্তব্যের উল্লেখ করে বলা হয় যে, শেখ মুজিবর রহমানের মানবিক অধিকার এতে খর্ব করা হয়েছে। বাংলাদেশে পাক সেনারা যে নির্মম গণহত্যা চালিয়েছে আবেদন পত্রে তার উল্লেখ রয়েছে।

বাংলাদেশ একাদশ বনাম মোহনবাগান প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচ

মুজিবনগর, ৩০ শে জুলাইঃ, কলকাতায় অবস্থানরত বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়গণ বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যার্থে একটি প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচের আয়োজন করেছেন।
আগামী ৭ই আগষ্ট বাংলাদেশ একাদশ ও মোহনবাগানের মধ্যে মোহনবাগান মাঠে এই প্রদর্শনী ফুটবল ম্যাচটি অনুষ্ঠিত হবে।
বাংলাদেশের ফুটবল খেলোয়াড়দের মধ্যে বেশ কয়েকজন আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন খেলোয়াড় রয়েছেন।
টিকেট প্রাপ্তির ঠিকানা শীঘ্রই ঘোষণা করা হবে।  

বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক নয়া ডাক টিকেট চালু
(জয় বাংলার বিশেষ প্রতিনিধি)

গত ২৯ শে জুলাই থেকে বাংলাদেশের ওপর ভিন্ন ভিন্ন রকমের আটটি ডাকটিকেট চালু করা হয়েছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে এসব ডাক টিকেট বিতরণ করা হবে। এর মধ্যে রয়েছে দশ পয়সা থেকে সর্বাধিক দশ টাকার ডাক টিকেট।
কলকাতায় বাংলাদেশ মিশনে এসব ডাক টিকেট কিনতে পাওয়া যাবে। এছাড়া, লন্ডনেও এসব ডাক টিকেট বিতরণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশন প্রধান জনাব হোসেন আলী গত ২৫শে জুলাই এক সাংবাদিক সম্মেলনে তথ্য প্রকাশ করেন।
ডাক টিকেট গুলোর ডিজাইন করেছেন প্রখ্যাত ডিজাইনার মিঃ বিমান মল্লিক।
ভিন্ন ভিন্ন রকমের প্রথম সিরিজের এই ৮ টি ডাক টিকেটের মধ্যে বাংলাদেশের মহান স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রতিচ্ছবি অঙ্কন করা হয়েছে।  

মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড আক্রমনের মুখে দিশেহারা পাক ফৌজ

মুক্তি বাহিনীর প্রচন্ড মারের মুখে এখন পাক ফৌজ দিশেহারা হয়ে পড়েছে। গত এক সপ্তাহের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর গেরিলারা সিলেট, কুমিল্লা, নোয়াখালী এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন স্থানে হামলা চালিয়ে মোট ৮৮ জন পাক সৈন্য ও সরকারের তাঁবেদারদের খতম করেছে।
গত পয়লা আগষ্ট মুক্তি বাহিনী কুমিল্লার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র উড়িয়ে দেয়। তাছাড়া শহরের আটচল্লিশ কিলোমিটার দূরে থাকা ঢাকা-কমিল্লা রোডে একটি গুরুত্বপূর্ণ সেতু মুক্তি বাহিনী উড়িয়ে দেয়ার ফলে কুমিল্লার সাথে বাংলাদেশের অন্যান্য সব শহরের যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়।
ফেণীতেও মুক্তি বাহিনী তাঁদের তৎপরতা অব্যাহত রাখার ফলে শহরের চারটি বিদ্যুৎ সরবরাহ কেন্দ্র বোমার আঘাতে চূর্ণবিচূর্ণ হয়ে যায়।
তাছাড়া চট্টগ্রাম বন্দরে নিউমুরিং-এ একটি কয়লা ডিপোও মুক্তি বাহিনী ধ্বংস করে। এবং বন্দরের বাইরে নোঙর করা একটি বিদেশী তেলবাহী জাহাজে তারা আগুনে বোমা নিক্ষেপ করার ফলে তাতে আগুন ধরে যায়। এই অবস্থা দেখে অপর দুটি বিদেশী তৈলবাহী জাহাজ ভয়ে পালিয়ে যায়।

মুক্তি বাহিনীর হাতে গত এক সপ্তাহে সিলেটের কমলপুর, কুমিল্লার মুকুন্দপুর ও কসবা এলাকায় মোট তিয়াত্তর জন পাকসেনা নিহত হয়েছে।

ময়মনসিংহ
মুক্তিযোদ্ধারা ময়মনসিংহ জেলার বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাক বাহিনীর উপর হামলা অব্যাহত রেখে তাদের নাস্তানাবুদ করে তুলছেন। তাঁরা এ জেলার বিভিন্ন স্থানে হানাদার পাক বাহিনী, তাদের সহযোগী রাজাকার বাহিনী এবং তাদের তাবেদারদের নিকট থেকে ৭০ টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
বীর মুক্তিযোদ্ধারা বেগুণবাড়ি বিখ্যাত রেল সেতুটি ধ্বংস করে দিয়ে
ময়মনসিংহ-জামালপুর-বাহাদুরাবাদ জগন্নাথগঞ্জ ঘাটের মধ্যে রেল চলাচল সম্পূর্ণ  অচল করে দিয়েছেন। ফলে ঢাকার সাথে শত্রু বাহিনীর উত্তরবঙ্গ যোগাযোগও বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে।
মুক্তিযোদ্ধারা গত ১৯শে জুলাই দুর্গাপুর থানার অন্তর্গত একটি গ্রামে রাতে টহলরত পাক বাহিনীর একজন সৈন্য কে হত্যা করে তার নিকট থেকে মেসিন গান দখল করেন।
ময়মনসিংহ শহরের পার্শ্ববর্তী মুক্তাগাছা ও দাপুনিয়া এলাকার বিভিন্ন স্থানে যুগপৎ হানা দিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা পাক দালালদের কাছ থেকে ৪৭টি রাইফেল, স্টেনগান, মেসীনগান এবং আরও ৯টি মারাত্মক অস্ত্র ও গোলাবারুদ দখল করে নেন।

জামালপুর মহকুমার হাজরাবাড়ী অঞ্চলে টহলদারী পাক দালাল রাজাকার বাহিনীর ১১জন শসস্ত্র গুন্ডার উপর হামলা করে মুক্তি বাহিনী ৯ জনকে হত্যা এবং তাদের কাছ থেকে অস্ত্রশস্ত্র দখল করেন।অবশিষ্ট ২জন রাজাকার মুক্তিবাহিনীর কাছে আত্মসমর্পণ করে। এখানে মুক্তি বাহিনী ১১টি রাইফেল উদ্ধার করেন।
মুক্তিযোদ্ধারা ১৪ই জুলাই থেকে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত বাজিতপুর থানা শান্তি কমিটির সহ-সভাপতি এবং অপর একজন পাক দালাল কে খতম করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা থানা উন্নয়ন বিভাগীয় সি ও এর অফিসে হামলা করে সকল দলিল পুড়িয়ে দেন। তাঁরা পাক রেঞ্জারদের দখলীকৃত বাংলোতে হাত বোমা নিক্ষেপ করেন। মুক্তিযোদ্ধারা সরাচরে টেলিফোন এক্সচেঞ্জে-এর উপর হাত বোমা নিক্ষেপ করে এটার ক্ষতি সাধন করেন।ভৈবর বাজার থানা, পোষ্টঅফিস এবং টেলিগ্রাফ অফিসের মুক্তিযোদ্ধারা হামলা করে অফিসের কাগজপত্র ধ্বংস করে দেন।

টাঙ্গাইল
সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা কালীহাতী থানার বল্লায় পাক সেনাদের ঘাটিতে চারদিক থেকে যুগপৎ আক্রমণ করে ২৪ জন পাক সেনা খতম এবং ৪৫ জনকে আহত করেন।
মুক্তি বাহিনী এখানে ৮টি রাইফেল,১টি মেসীনগান এবং প্রচুর গোলা বারুদ দখল করে নেন। উল্লেখযোগ্য যে,এই জেলার বিস্তীর্ণ এলাকা এখন মুক্তিযোদ্ধাদের দখলে রয়েছে।মুক্ত এলাকার পাক সেনাদের দালাল থানার দারোগা-পুলিশদের গ্রেফতার এবং তাদের অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে।

সম্প্রতি বাসাইল অভিমুখে যাবার সময় কান্তা ফেরীঘাটে মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর অতর্কিত হামলা চালান। পাক সেনারা আর অগ্রসর হতে ভরসা না পেয়ে পজিশান নিয়ে গুলি চালায়। কিন্তু দূর্দ্ধষ মুক্তিযোদ্ধাদের বেপরোয়া আক্রমণের মুখে তারা দিশেহারা হয়ে যায়। এই সংঘর্ষের ১৯ জন খান সেনা খতম এবং ৬০ জন আহত হয়। অবশিষ্টরা ৮টি মৃতদেহ ফেলে পিছু হটে যেতে বাধ্য হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখানে ২টি মেসীন গান,৯টি রাইফেল ও প্রচুর গোলাবারুদ দখল করেন।

ঢাকা
২৮শে জুলাই রাতে মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকার কমলাপুর রেল ষ্টেশনে দু’টি বোমা ফেলে আশেপাশের এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করে দেন। জানা গেছে যে,ঢাকার সঙ্গে সংযোগ রক্ষাকারী বিভিন্ন সেতুর সামনে হানাদার পাক সেনারা পাহাড়াদার বসিয়েছে। বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, মুক্তিযোদ্ধারা রায়পুরা থানার বেলাব বাজারের নিকট পাক সেনা বহনকারী ২টি নৌকা আক্রমণ করেন।
এতে ২০ জন খান সেনা খতম হয়। এরপর খান সেনারা এসে ১৫০ জন নিরীহ গ্রামবাসিকে হত্যা করে। তারা বেলাব বাজারেরও ক্ষতি সাধন করেছে বলে জানা গেছে। ২৮শে জুলাই আশুগঞ্জের নিকট মান্দাবাগ এলাকায় পাক হানাদারদের উপর মর্টার দিয়ে গুলী করে ৩ জন পাক সেনাকে খতম করেন।
বিলম্বে প্রাপ্ত্য অপর এক খবরে প্রকাশ, ১৫ই জুলাই নরসিংদীর নিকট মাইন বিস্ফোরণ হয়ে একটি ডিজেল ইঞ্জিন এবং ৪টি বগি লাইনচ্যুত হয়ে যায়। ৮ই জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা শিবপুরের একজন পাক দালালকে খতম এবং রাজাকারের নিকট থেকে একটি রাইফেল উদ্ধার করেন।

কুষ্টিয়া-যশোর-খুলনা
মুক্তিযোদ্ধারা সম্প্রতি গোপালপুরের নিকটে মালপুর থানা আক্রমণ করেন। এই আক্রমণে পাক হানাদার সেনাদের সহযোগী ৩জন পুলিশ নিহত এবং ২জন আহত হয়। থানার নিকটে পার্কিং করা একটি জীপও মুক্তিযোদ্ধারা ধ্বংস করেন। ২৫শে জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা আলমডাঙ্গা এবং হালমার মাঝামাঝি স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইনের একটি টাওয়ার বিধ্বস্ত করে দেন। এর ফলে শত্রু কবলিত আলমডাঙ্গা শহরে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ হয়ে যায়। এছাড়া, আলমডাঙ্গার নিকট মুক্তিযোদ্ধাদের মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাক সেনাবাহিনীর একটি ট্রেন লাইনচ্যুত হয়। এতে ১৫ জন পাক সেনা নিহত হয়।রেলের বগীটি বিধ্বস্ত হয়। তাঁরা আলমডাঙ্গা টেলিফোন এক্সচেঞ্জে হামলা করেন। এই হামলায় একজন অপারেটর নিহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা চুয়াডাঙ্গা এবং নীলমণিগঞ্জের মধ্যে একটি রেল সেতু উড়িয়ে দিয়ে পাক সেনাদের চলাচল ব্যাহত করেছেন।

মুক্তিযোদ্ধারা নবকাটি এবং ভোমরায় পাক-সেনাদের উপর মর্টারের সাহায্যে গোলাবর্ষণ করেন। এতে ৮জন খান সেনা খতম হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এই এলাকায় খান সেনাদের ৪টি বাঙ্কারও ধ্বংস করে দেন।কুলিয়া  ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান কুখ্যাত পাকদালাল জনাব আবদুল মজিদ মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে খতম হয়।মুক্তি যোদ্ধারা এই দালালের বাড়ীও পুড়িয়ে দেন।মধুখালি এবং দস্তিনায় ১০জন পাক সেনা খতম হয়।

তাঁরা হার্ডিঞ্জ ব্রীজ এলাকায় একটি ইলেকট্রিক সাব-স্টেশন ধ্বংস করে দেন। হরণকুণ্ডা এলাকায় ৫জন পাক দালাল খতম করা হয়।  মুক্তি যোদ্ধারা এই এলাকায় টেলিফোনের ৩ শত গজ তার উঠিয়ে নিয়ে যান।দোসতার কুখ্যাত মুসলিম লীগ নেতাকে খতম করা হয়। ঈশ্বরদী, পাবনা, মনোহরপুর এলাকায় ৪টি ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংস এবং টেলিফোন লাইন খুলে নিয়ে যান।

সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতিঃ আহমদ রফিক,ভারপ্রাপ্ত সম্পাদকঃ মতিন আহমদ চৌধুরী। মুজিব নগর জয় বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের পক্ষে আহমদ রফিক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত। 

শেখ মুজিবের বিচার করার অধিকার ইয়াহিয়া সরকারের নেই

প্রখ্যাত  আন্তর্জাতিক আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ মিঃ সুব্রত রায় চৌধুরী ইয়াহিয়া খান কর্তৃক স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে গোপনে সামরিক আদালতে বিচারের ধৃষ্ঠতা কে অবৈধ এবং আন্তর্জাতিক আইন বিরোধী বলে অভিহিত করেছেন।
জাতিসংঘের সনদ বিবেচনার আন্তর্জাতিক আইন সমিতির কলকাতা শাখার চেয়ারম্যান মিঃ সুব্রত রায় চৌধুরী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের বিচার প্রসঙ্গে ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রতিক বিবৃতির কথা উল্লেখ করে বলেন, প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের প্রস্তাব ১৯৪৯ সালের ১২ই আগস্ট এর চারটি জেনেভা চুক্তির সাধারণ অনুচ্ছেদ ও তৃতীয় অনুচ্ছেদের বিরোধী। পাকিস্তান এই চুক্তিতে স্বাক্ষর করেছে।
তিনি বলেন, আন্তর্জাতিক ধরনের না হলেও জেনেভা চুক্তি স্বাক্ষরকারী কোন দেশে কোন সশস্ত্র সংঘর্ষ ঘটলে তা তৃতীয় অনুচ্ছেদের আওতায় আসবে। যুদ্ধাবস্থা স্বীকৃত না হলেও যেকোনো গৃহযুদ্ধের ক্ষেত্রে এই অনুচ্ছেদটি প্রযোজ্য।
পাকিস্তানে এখন যে সশস্ত্র সংঘর্ষ চলছে আন্তর্জাতিক ধরনের না হলেও তাতে এই অনুচ্ছেদ প্রয়োগ করা যাবে।
যে সব ব্যক্তি সশস্ত্র বিরোধে সক্রিয় অংশ গ্রহণ করেন নি অথবা যারা আত্মসমর্পণ করেছেন তাঁরা এর আওতায় পড়বে না।স্বভাবতই শেখ মুজিবর রহমানের ক্ষেত্রে ৩ নং অনুচ্ছেদ প্রযোজ্য।
তিনি আরো বলেন ১৯৪৮ সালের ৬ই ডিসেম্বর জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মানবাধিকারের সনদ গৃহীত হয়। এই ঘোষণার ২নং ধারায় রাজনৈতিক মতবাদের পূর্ণ স্বাধীনতা স্বীকৃত হয়েছে। ১০ এবং ১১ নং ধারায় প্রতিটি ব্যক্তির কোন অপরাধের জন্য স্বাধীন বিচারালয় দ্বারা ন্যায় এবং প্রকাশ্য বিচারের অধিকার স্বীকৃত। শেখ মুজিবর রহমানের প্রস্তাবিত বিচার এইসব মৌলিক নীতির সম্পূর্ণ অস্বীকৃতি।

জাপান সংসদ সদস্যের বিবৃতি

জাপানের সংসদ সদস্য মিঃ কামিচি মিসিসুরা অবিলম্বে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তি দাবি করেছেন। তিনি বলেন যে, বাংলাদেশে নির্বাচনে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বাধীনে আওয়ামী লীগ সংখ্যা গরিষ্ঠতা অর্জন করেছে। মিঃ মসিমুরা বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের উদ্দেশ্যে আওয়ামী লীগ ও পাকিস্তানের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা শুরু করার জন্য উথানটের কাছে দাবী জানিয়েছেন। তিনি বাংলাদেশের সীমান্তে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক পাঠানোর বিরোধীতা করেন। তিনি বলেন যে,জাতিসংঘ বাংলাদেশ সম্পর্কে কিছুই করেনি।

৮ই আগষ্ট মুজিবর রহমান দিবস
বাংলাদেশ মৈত্রী সমিতি আগামী ৮ই আগষ্ট ভারতের মুজিবর রহমান মুক্তি দিবস পালনের উদ্যোগ নিয়েছেন।

ভারতের সংসদের ৪০ জন সদস্য এক যুক্ত বিবৃতিতে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের গোপন বিচারের নামে ইয়াহিয়ার ঘৃণ্য চক্রান্ত সম্পর্কে জনগণের দৃষ্টি আকর্ষণের জন্য দেশের সর্বত্র সভা-শোভাযাত্রা সংগঠিত করার উদ্দেশ্যে সকল রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য সংস্থা গুলির প্রতি আহবান জানিয়েছেন।তাঁরা তাদের বিবৃতিতে জাতিসংঘের সদস্য রাষ্ট্রগুলির কাছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির দাবিতে ইয়াহিয়ার উপর চাপ সৃষ্টি করার জন্য আবেদন জানিয়েছেন।

শেখ মুজিবের জন্য বিশিষ্ট বৃটিশ আইনবিদ

বিশিষ্ট বৃটিশ আইনবিদ মিঃ সীন ম্যাক ব্রাইড বঙ্গবন্ধু  শেখ মুজিবুর রহমানের গোপন বিচার এবং তাঁকে প্রাণদণ্ডে দণ্ডিত করার যে সম্ভাবনা রয়েছে তা রোধ করার ব্যাপারে শীঘ্রই পাকিস্তান সফরে যাবেন বলে জানা গেছে। পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ মিঃম্যাক ব্রাইডকে তার মক্কেল শেখ মুজিবর রহমানের সাথে দেখা করতে অনুমতি দেবে কিনা তা উদ্বেগের সাথে লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রসঙ্গে বাংলাদেশ পর রাষ্ট্রমন্ত্রী
অবধারিত বিজয় প্রতিরোধের চক্রান্ত
[জয়বাংলা প্রতিনিধি]

বাংলাদেশে পাক জঙ্গী সরকার কর্তৃক গত চার মাস ব্যাপী একটানা পাশবিক গণহত্যা এবং প্রায় এক কোটি লোককে বাড়ীঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দিয়ে মাতৃভূমি থেকে বিতাড়নের নৃশংসতম অপকর্ম ধামাচাপা দেয়ার দুরভিসন্ধি হিসাবে বাংলাদেশে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের যে অপচেষ্টা চলছে তার বিরুদ্ধে তীব্র প্রতিবাদ উঠেছে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের পক্ষ থেকে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং ভারত সরকার আসল সমস্যা পাশ কাটিয়ে পর্যবেক্ষকদের দুরভিসন্ধিমূলক জাতিসংঘের প্রস্তাবটি দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রত্যাখ্যান করেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে পর্যবেক্ষক প্রেরণের পরিবর্তে বাংলাদেশের মুক্তি আন্দোলনের কণ্ঠরোধ করার জন্য যাতে পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য ও অস্ত্রাদি প্রেরণ করা না হয় তা সুনিশ্চিত করার উদ্দেশ্যে পশ্চিম পাকিস্তানী অঞ্চলভুক্ত সমুদ্র বিমানঘাঁটি সমূহে রাষ্ট্রসঙ্ঘের পর্যবেক্ষক প্রেরণের জন্য জাতিসংঘের কাছে প্রস্তাব দিয়েছেন।
বাংলাদেশ জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাবকে মুক্তিযোদ্ধাদের অবধারিত বিজয় প্রতিরোধের কুচক্রান্ত বলে অভিহিত করে আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, অমানুষিক পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক যন্ত্রের কাঁটা মারা জুতার তলায় গণতন্ত্র পদদলিত করার ঘটনাটি রাষ্ট্রসংঘ নিশ্চিন্ত চিত্তে উপেক্ষা করেছিল, কিন্তু এখন যখন রক্তের নদীতে আমরা স্বাধীনতার মূল্য দিয়েছি তখন জাতিসংঘের নিদ্রা ভেঙেছে। তিনি জঙ্গী ইয়াহিয়ার কুচক্রে ব্যবহৃত না হওয়ার জন্য জাতিসংঘকে উপদেশ দেন। খোন্দকার মুশতাক আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার সৈন্যদের কবল থেকে বাংলাদেশে মুক্ত হওয়ার পর দেশ পুনর্গঠনের কাজে জাতিসংঘের সহায়তা গ্রহণ করা হবে বলে জানিয়ে দেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশের যে সবুজ ক্ষেত এখন লক্ষ কোটি মানুষের রক্তে রক্তিম হয়ে উঠেছে, সেখানেই আমাদের ভাগ্য নির্ধারিত হবে। আমাদের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্র। এবং বাংলাদেশ সরকারকে পাশ কাটিয়ে কোন কিছু করার চেষ্টা করা হলে এর পরিণতি ভয়াবহ হবে।খোন্দকার মুশতাক শরণার্থী সমস্যার ব্যাপারে জাতিসংঘের সাহায্য ও পুনর্বাসন হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিনের বিরুদ্ধে পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ করেন।

ভারতের প্রতিক্রিয়া

বাংলাদেশ ও ভারত সীমান্তে জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক নিয়োগের প্রস্তাবের বিরুদ্ধে ভারত সরকার কর্তৃক তীব্র প্রতিবাদ করেছেন, এ প্রস্তাবকে প্রকৃত বিষয় থেকে বিশ্বের দৃষ্টি সরিয়ে নেয়ার এবং তাকে ভারত ও পাকিস্তানের বিষয় হিসেবে তুলে ধরার দুরভিসন্ধি বলে ভারত সরকার মনে করছেন। দিল্লীর সরকারি মহল থেকে ৩০শে জুলাই দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষণা করা হয় যে, ভারতীয় এলাকায় জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের প্রস্তাবে ভারত সরকার কিছুতেই রাজি হবেন না।সোভিয়েট  ইউনিয়নসহ আরও কতিপয় দেশ বাংলাদেশ ও ভারতে জাতি সংঘ পর্যবেক্ষক প্রেরণের ঘোর বিরোধী। 

এ এক অনন্য যুদ্ধ

পাক সমর নায়করা বিশ্বাস করতেন, বাঙলাদেশে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়ে বাঙালীদের পদানত করে রাখা সম্ভব হবে। তারা চেয়েছিল নির্বিচারে বাঙালীদের হত্যা করে ত্রাসের রাজত্ব সৃষ্টি করতে। বিখ্যাত সাংবাদিক এন্টনি মাসকারেণহাস লিখেছেন, তাঁকে পাকিস্তানের কোন সমর নায়ক বলেছেন, প্রয়োজন হলে পাক বাহিনী বিশ লাখ বাঙালীকে হত্যা করতে প্রস্তুত। কিন্তু তাদের এই নির্বিচার গণহত্যার নীতি বাঙালীর মনে উল্টা প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করেছে। বাঙালী আজ মরণ পন সংগ্রামে ঐক্যবদ্ধ।তারা আজ মৃত্যুভয়ে ভীত নয়। গত চার মাসে এ মুক্তি বাহিনী অনেক সুসংগঠিত হয়ে উঠেছে। তাদের প্রতি-আক্রমণে পাক বাহিনী আজ ভীত,সন্ত্রস্থ। আমেরিকার বিখ্যাত সাপ্তাহিক পত্রিকা নিউজ উইক এর হিসাব অনুসারে ৩০,০০০ বাঙালী মুক্তিযোদ্ধা আজ বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলে যুদ্ধ করে চলেছে। আর এদের হাতে মৃত্যু ঘটছে বহু সংখ্যক পাক সৈন্যের।পাক-বাহিনীর রণনীতিতে এসেছে মৌলিক পরিবর্ত্তন। পাক-বাহিনী লাফিয়ে পড়েছিল বাঙলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর।তার রণনীতি আক্রমণাত্মক।কিন্তু আজ তার রণনীত হয়ে উঠেছে আত্মরক্ষামূলক।পাক বাহিনী আজ চাচ্ছে ঘাঁটি আগলে থাকতে।
পাক সেনা-বাহিনীতে সৈন্য ঘাটতি দেখা দিয়েছে।সারা বাঙলাদেশে দখল বজায় রাখবার মত যথেষ্ট জন্য সৈন্য পাক বাহিনীতে এখন আর নেই। বিদেশী পত্রিকার হিসাব অনুসারে খুব কম করে হলেও, ১৭,০০০ হাজার সৈন্য মারা গেছে অথবা আহত হয়ে অকেজো হয়ে পড়েছে। পাক-বাহিনীর অস্ত্র আছে যথেষ্ট। কিন্তু এই অস্ত্র চালাবার লোকের অভাব ক্রমশঃ তীব্র হয়ে দেখা দিচ্ছে এইটাই হল বিদেশী একাধিক সাংবাদিকের অভিমত।
নিউজউইকে বলা হয়েছে, পাক-বাহিনী যথেষ্ট অস্ত্রে সজ্জিত। কিন্তু এই বাহিনী বাঙলাদেশের সর্বত্র ছড়িয়ে থেকে যুদ্ধ করে যেতে পারবে না। কারণ, প্রয়োজনের তুলনায় পাক সেনা সংখ্যা মোটেই পর্য্যাপ্ত নয়।
শুধু অস্ত্র দিয়ে যুদ্ধ চলেনা।অস্ত্র চালাবার জন্য প্রয়োজন হয় জনবল। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তান থেকে যথেষ্ট সৈন্য আমদানীর গতি এখন মন্থর হয়ে পড়েছে।
পাক-বাহিনী তাদের জনবল বৃদ্ধির জন্য অবাঙালীদের মধ্য থেকে লোক সংগ্রহ করে একটি সহকারী বাহিনী গড়ে তুলেছে। এই বাহিনীর নামকরণ করা হয়েছে রাজাকার।কিন্তু এই রাজাকার বাহিনী দিয়ে কোনো কাজ হচ্ছে না।মুক্তি বাহিনীর হাতে প্রচন্ড মার খেয়ে ওদের অবস্থা কাহিল হয়ে পড়েছে। বাঙালা বাহিনী জনসাধারণের সহযোগিতা পাচ্ছে, কিন্তু এই অবাঙালী ফৌজেরা পাচ্ছে না। পাক-বাহিনীর মতই এরা জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন বাহিনী। বাঙলাদেশের মানুষ ও মাটির সাথে কোন যোগাযোগ নেই।
বাঙলাদেশ বাহিনীর এখন যুদ্ধনীতি হচ্ছে গেরিলা যুদ্ধের নীতি। লুকিয়ে থেকে হঠাৎ শত্রুকে আক্রমণ করা ও সরে পড়াই হল এই যুদ্ধনীতির গোড়ার কথা। এর উদ্দেশ্য হলো শত্রুর সেনা বাহিনীকে দুর্বল করা। তাদের সরবরাহ ব্যবস্থা বানচাল করা। এক কথায় আঘাতের পর আঘাত হেনে শত্রুকে নাকানি-চুবানি খাইয়ে পরাজয়ের মুখে ঠেলে দেয়াই এই গেরিলা আক্রমণের মূল লক্ষ্য।
দীর্ঘ দিন যুদ্ধ চালিয়ে যাবার ক্ষমতা পাক সরকারের নেই। পাকিস্তানকে সেনা ও গোলাবারুদ নিয়ে আসতে হচ্ছে সিংহল ঘুরে। এত দূর থেকে যুদ্ধ চালাবার ব্যয় ভার বহন করতে গিয়ে পাক অর্থনীতি ভেঙ্গে পড়ছে।
পাকিস্তানের গোলাবারুদ অস্ত্রপাতি খুব কমই প্রস্তুত হয়। পাকিস্তানকে গোলাবারুদ ও অস্ত্রের জন্য নির্ভর করতে হয় বিদেশের উপর।বিমান,ট্যাঙ্ক ও সাঁজোয়া চালাবার  জন্য যে তেলের প্রয়োজন হয় তাও আসে বিদেশ থেকে। কিন্তু বিদেশের উপর নির্ভর করে দীর্ঘ  যুদ্ধ চালিয়ে দেওয়া সম্ভব নয়।
আমেরিকা ও চীন পাকিস্তানকে আপাততঃ সাহায্য করছে। কিন্তু আমেরিকার জনসাধারণ পাকিস্তানের জঙ্গীচক্রকে সাহায্য দেবার বিরোধী। বিক্সন সরকার তার দেশের জনমতকে কতদিন উপেক্ষা করতে পারবেন, তা বলা যায় না।
চীন এমন একটি গোঁয়ার সরকারকে সমর্থন দিয়ে যাচ্ছে যার উপর জনগণের কোন বিশ্বাস ও আস্থা নেই। তবুও যদি চীন পাকিস্তানকে সাহায্য করে যায়,সেই সাহায্যের উপর ভর করেও পাকিস্তান দীর্ঘ যুদ্ধ চালাতে পারবে না। কারণ, যুদ্ধ কেবল অস্ত্র দিয়ে হয়না।যুদ্ধ করে মানুষ।সেই মানুষের অভাব ক্রমশ প্রকট হয়ে উঠছে পাক বাহিনীতে। বলা হয়ে থাকে বন্দুকের নল থেকে সব রাজনৈতিক ক্ষমতা বেরিয়ে আসে। কিন্তু ভুলে গেলে চলেনা বন্দুকটি চালাবার জন্য প্রয়োজন হয় একটি মানুষ।মানুষটির কথা বাদ দিয়ে বন্দুকের কথা ভাবা অর্থহীন।

পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বিমানে করেও সামরিক সরবরাহ ও সৈন্য আনা হয়। কিন্তু এতে খরচ পড়ে খুবই বেশী।প্রত্যেকটি সৈন্যকে আনতে খরচা পড়ে ৯০০ টাকার উপর। তা ছাড়া পাকিস্তানের বিমানের সংখ্যা এত অধিক নয় যে তার সাহায্যে দূর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে সব কিছু আনাবেন। একজন মার্কিন সামরিক বিশেষজ্ঞ মন্তব্য করেছেনঃ
পাকিস্তান প্রথম থেকে বিমানে করে সৈন্য ও রণসম্ভার বয়ে আনার খুবই কৃতিত্ব দেখিয়েছে।কিন্তু পাকিস্তানকে শীগগিরি সৈন্য চলাচল ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অসুবিধায় পড়তে হবে। কারণ বাঙলাদেশে ক্রমশঃ গেরিলা যুদ্ধ বীব্রতর হতে থাকবে।এর সাথে তাল মিলিয়ে চলতে হলে সৈন্য চলাচল ও সরবরাহ ব্যাপারে পাকিস্তানকে আরো ক্ষিপ্র হতে হবে। কিন্তু পাক সামরিক চক্রের সে সঙ্গতি নেই।তাঁদের লজিসটিকস্-এর  নানা জটিল সমস্যায় জড়িয়ে পড়তে হবে।  

জঙ্গীশাহীর ট্যাঁক খালি

মুজিবনগর,১০ই জুলাই, বাংলাদেশে যুদ্ধ চালাতে গিয়ে পাক জঙ্গীশাহীর কোষাগার ঠুঁটো জগন্নাথে এসে দাঁড়িয়েছে। তদুপরি বাংলাদেশ থেকে কাঁচা মাল রফতানি বন্ধ হয়ে যাওয়ায় এবং পাক সরকারের ব্যবসা-বাণিজ্যে ভাঁটা পড়ায় জঙ্গীশাহী এখন চোখে সরষে ফুল দেখতে শুরু করেছে।অপরদিকে বিশ্ব ব্যাংক কনসোর্টিয়ামসহ বিভিন্ন দেশ জঙ্গীশাহীকে আর্থিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়ায় দিশেহারা হয়ে পড়েছে।
ফলে জঙ্গী সরকার সরকারী কর্মচারীদের বেতন দিতে পারছে না। শুধু তাই নয়। জানা গেছে, সরকারী কর্মচারীগণকে চলতি আর্থিক বছরে তাদের বেতন বৃদ্ধির টাকা নগদে না দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে।
জঙ্গীশাহীর এ সিদ্ধান্ত অনুযায়ী ৫ শত টাকার অধিক বেতন পাওয়া কর্মচারিদের বেতন বৃদ্ধির টাকা নগদে না নিয়ে জঙ্গীশাহীর প্রভিডেণ্ড ফাণ্ডে দান করতে অথবা তথাকথিত সেভিংস সার্টিফিকেট কিনতে বাধ্য করা হয়েছে।
এছাড়া জঙ্গীশাহী সরকারী কর্মচারীদের মাসিক বেতন দেয়ার সময় তাঁদের বেতন থেকে বাংলাদেশে যুদ্ধের খরচ চালাবার জন্য তথাকথিত ‘দেশরক্ষা তহবিলে’ চাঁদা কেটে রেখে দেয়।
এতে সরকারী কর্মচারিদের মধ্যে তীব্র ক্ষোভ বিরাজ করছে। কারণ, তারা মনে করছেন যে, তাঁদের পয়সা দিয়েই জঙ্গীশাহী গোলাবারুদ ও অস্ত্র-শস্ত্র কিনে তাঁদের ভাই-বোন মা-বাবা আত্মীয়-স্বজনকে হত্যা করছে এবং বাংলাদেশের মানুষের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিচ্ছে।  

  

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!