You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ২৩ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

পাক চক্রের মিথ্যে প্রচারণার ধুম্রজাল ছিন্ন
সর্বশেষ ব্যক্তিও বললেন- না
আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি জানিয়েছেন যে, বাংলাদেশ মিশনের সর্বশেষ কর্মচারীও পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে সুইচ প্রতিনিধিকে লিখিত ও মৌখিক ভাবে সাফ জবাব দিয়েছেন, না, পাকিস্তানে যাবনা। ১৮ই জুলাই বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হোসেন আলীসহ অন্যান্য ৬৪ জন কর্মচারীও সুইস প্রতিনিধিকে একই জবাব দেন।
জঙ্গী ইয়াহিয়া শাহীর বধ্যভূমি পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে বাংলাদেশ মিশনের ৬৫ জন কর্মচারী স্বেচ্ছায় ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে না জবাব দেয়ায় পাক জঙ্গিশাহী ঢাকা বেতারে মিথ্যা প্রচারের ধুম্রজাল থেকে সত্য উন্মোচিত হয়ে গেল। পাক জঙ্গিশাহী তার জয়ঢাক ঢাকা বেতার এইসকল সাবেক পাক কূটনীতিবিদকে ভারত সরকার বলপূর্বক আটকিয়ে রেখেছিল বলে অহরাত্র গলাবাজি করতো। পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে সাবেক পাক মিশনের এই ৬৫ জন বাঙালি কর্মচারী বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষকে আজ এই প্রশ্ন করা হলে সাড়ে সাত কোটি মানুষ এক সুরে শুধু একটি ছবি দিবেন -আমরা পাকিস্থান চাইনা, আমরা স্বাধীন বাংলাদেশ চাই।
উল্লেখযোগ্য যে, পাক সামরিক জান্তা কর্তৃক বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় ও নিরস্ত্র মানুষের উপর বর্বরোচিত সশস্ত্র হামলার পটভূমিকায় বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর কলকাতা স্থাপাক ডেপুটি হাই কমিশনার জনাব হোসেন আলী সহ হাইকমিশনের ৬৫ জন বাঙালি কর্মচারী ১৮ই এপ্রিল বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করে দেশাত্মবোধের এক গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস সৃষ্টি করে।
বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশের পর পাক জঙ্গী সরকার এতে ভারতের হাত রয়েছে এবং ভারত সরকার জোর করে এসব পাকিস্তানি কূটনীতিবিদকে আটকিয়ে রেখেছেন বলে ঢালাও অভিযোগ শুরু করে শুধু তাই নয়, ঝাল মেটানোর জন্য পাক জঙ্গিশাহী ঢাকাস্থ ভারতীয় কূটনৈতিক মিশন আকস্মিকভাবে বন্ধ করে দেয় এবং কূটনীতিবিদসহ মিশনের সকল কর্মচারীকে গৃহ বন্দি করে রাখে।
ভারতের বিরুদ্ধে পাক জঙ্গিশাহীর মিথ্যা অভিযোগের সারবত্তা বর্তমান এবং ঢাকায় আটক ভারতীয় কূটনীতিককে উদ্ধার করার উদ্দেশ্যে দিল্লিতে নিযুক্ত রাষ্ট্রদূতের মাধ্যমে কলকাতাস্থ সাবেক কূটনীতিবিদদের পাকিস্তানে ফিরে যাওয়ার ব্যাপারে মতামত গ্রহণের এই ব্যবস্থা করা হয়।
গত ১৮ই জুলাই কলকাতায় সুইস প্রতিনিধির সাথে বাংলাদেশ মিশনের কূটনীতিবিদ ও অন্যান্য কর্মচারী বহুপ্রতীক্ষিত এবং আলোড়ন সৃষ্টিকারী সাক্ষাৎকার অনুষ্ঠিত হয়। দিল্লিস্থ সুইচ রাষ্ট্রদূত অসুস্থতার দরুন কলকাতায় উপস্থিত থাকতে না পারে তার পক্ষ থেকে তাঁর প্রথম সেক্রেটারি ডক্টর বোনার্ড তাদের মতামত নেন। অনুষ্ঠানে ভারত সরকারের প্রতিনিধি মিস্টার অশোক রায় এবং পাকিস্তানের পক্ষ থেকে জনাব মেহেদী মাসুদ উপস্থিত থাকেন।
ডঃ বোনার্ড প্রথমে বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হোসেন আলীর সাথে মিশনের নিকটস্থ একটি বাড়িতে সাক্ষাৎ করে তার মতামত নেন।
পরে একটি স্কুলের মিশনের অন্যান্য ৬২ জন কর্মচারীকে এক এক করে মতামত নেন।
খোদ ঢাকা শহরেই –
মুজিবনগরঃ ১৮ই জুলাই। বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদরদপ্তরের গণসংযোগ বিভাগ সূত্রে জানা গেছে যে দুর্জয় মুক্তিযোদ্ধারা শত্রু পাকসেনাদের সদরদপ্তরে প্রচন্ড তৎপরতা বৃদ্ধি করেছেন।
দুর্ধর্ষ মুক্তিযোদ্ধারা এ মাসের প্রথম সপ্তাহে ঢাকার একটি অভিজাত রেষ্টুরেন্টে ঢুকে হাতবোমা নিক্ষেপ করে পাকসেনাদের একজন অফিসার খতম করে। তারা জঙ্গীশাহীর পদলেহী পদস্থ সরকারি কর্মচারী জনৈক শহীদ আহমদকে হত্যা করেন। বীর মুক্তিযোদ্ধারা বাংলাদেশের মীরজাফর পিডিপি নেতা জনাব মাহমুদ আলীর বাসভবনে হাতবোমা নিক্ষেপ করলে এক ব্যক্তি নিহত হয়।
শহরে টহলরত চারজন খানসেনা এবং পাঁচজন পশ্চিম পাকিস্তানী পুলিশ মুক্তিযোদ্ধাদের আচমকা আক্রমণে খতম হয়।
এছাড়া মুক্তিযোদ্ধারা বকশিবাজারে সেকেন্ডারি এডুকেশন বোর্ড এর দপ্তরে বোমা নিক্ষেপ করে বোর্ডের মূল্যবান কাগজপত্র পুড়িয়ে দিয়েছে এবং ভবনের ক্ষতি সাধন করেছে। সিদ্ধিরগঞ্জ পাওয়ার স্টেশনটি ও মুক্তিযোদ্ধারা অকেজো করে দিয়েছেন।
নিক্সনের চীন সফর প্রসঙ্গে পররাষ্ট্রমন্ত্রী
মুজিবনগর, ১৮ই জুলাই, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মুশতাক আহমদ মার্কিন প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন সফরের সংবাদকে অভিনন্দিত করেছেন।
এক বিবৃতিতে তিনি বলেন, যে বিশ্বের স্বাধীনতাকামী মানুষ এই সংবাদে স্বস্তি বোধ করবেন।
কারণ, এবারের বিষয় দুটি শক্তি তাদের পারস্পরিক বিরোধ এর ব্যাপারে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর ফলপ্রসূ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে যাচ্ছেন। প্রেসিডেন্ট নিক্সনের এই সফর বিশ্বরাজনীতির শ্বাসরুদ্ধকর পরিবেশকে সুস্থ করার পক্ষে সুদুরপ্রসারী হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার বিবৃতিতে আশা প্রকাশ করেন যে, দুটি বৃহৎ শক্তির স্থায়ী শান্তি স্থাপনের প্রচেষ্টা বিশ্বের সংগ্রামরত স্বাধীনতাকামী জাতিসমূহের লক্ষ্য হাসিলের পথ সুগম করবে।
বিশ্ব ব্যাংক ও পাকিস্তানের উপর ক্ষুব্ধ
বিশ্ব ব্যাংক পাকিস্তানি হানাদার সৈন্যদের হামলাবিক্ষত বাংলাদেশে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের উন্নয়ন কাজ স্থগিত রাখার জন্য সুপারিশ করেছেন।
পিকিং ওয়াশিংটন সমঝোতা (?)
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নিক্সন চীন সফরে যাচ্ছেন। অবশ্য এখনই নয়। মাস দশেকের মধ্যে। চীনের প্রধানমন্ত্রী চৌ এখন লাই তাকে আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। নিক্সন বলেছেন, তার প্রস্তাবিত চীন সফরের উদ্দেশ্য ওয়াশিংটন ও পিকিং এর মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক করা। প্রেসিডেন্ট নিক্সন এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের উপরাষ্ট্রপতি থাকাকালে বলেছেন, নয়া চীনের আগ্রাসী নীতি অব্যাহত থাকলে তাকে স্বীকৃতিদান, জাতিসংঘে স্থানদান বা তার সঙ্গে সমঝোতা কোনটাই সম্ভব নয়। যুক্তরাষ্ট্রের মতে, চীন এশিয়ায় আগ্রাসী নীতির পুরোধা। এ যুক্তি খাড়া করে নিক্সন সাহেবরা এদ্দিন চীনের দিকে সহযোগিতার হাত বাড়াতে চান নি। এবার ভিয়েতনাম এবং কম্বোডিয়ায় রক্তপাত বন্ধ না হওয়া সত্বেও নিক্সন সাহেবের পিকিং সফরের এমন আকুল আগ্রহ দেখে মনে হয়, তার হৃদয় পরিবর্তন অথবা চিত্তশুদ্ধি ঘটেছে। এই চিত্তশুদ্ধি অবশ্য একতরফা নয়। কিছুকাল আগে প্রেসিডেন্ট নিক্সন তার এক নীতিনির্ধারণী ভাষণে বলেছিলেন, এশিয়ায় চীনের স্বার্থ বিনাশে তাদের আগ্রহ নেই; বরং এই স্বার্থের সঙ্গে নিজেদের স্বার্থের সমন্বয় সাধনের তারা আগ্রহী! এপ্রিল মাসে চেয়ারম্যান মাও সেতুং এক ব্যক্তিগত সাক্ষাৎকারে ঘোষণা করেন যে তিনি প্রেসিডেন্ট নিক্সন কে চীনের মাটিতে অভ্যর্থনা জানাতে প্রস্তুত। সঙ্গে সঙ্গে জানা গেল, চীনের প্রধানমন্ত্রী একদল মার্কিন পিংপং খেলোয়াড় কে পিকিং-এ গিয়ে ক্রীড়া প্রদর্শনের আমন্ত্রণ জানিয়েছেন। এই ক্রীড়া প্রদর্শনের কাজটি অবশ্য পিংপং খেলোয়াড়েরা সারেননি, সেরেছেন নিক্সনের জাতীয় নিরাপত্তা বিষয়ক উপদেষ্টা ডাক্তার হেনরি কিসিঞ্জার। চলতি মাসের গোড়ার দিকে তিনি দিল্লি ইসলামাবাদে সফরে আসেন। গত ৯ই জুলাই ইসলামাবাদ থেকে ঘোষণা করা হয় তিনি আকস্মিকভাবে পাকস্থলীর পীড়ায় আক্রান্ত হয়ে নাথিয়াগলিতে বিশ্রাম নিচ্ছেন। পরে জানা গেল, পেটের পীড়ার কথা বাত কে বাত্। আসলে তিনি গোপনে পিকিং সফর করে এসেছেন। তার পরেই প্রেসিডেন্ট নিক্সনের চীন গমনের এই প্রকাশ্য ঘোষণা!
মার্কিন প্রেসিডেন্ট বলেছেন, ১৯৭২ সালের মে মাসের আগে কোন এক উপযুক্ত সময় তিনি পিকিং যাবেন। দীর্ঘ ১০ মাসের মধ্যেই উপযুক্ত সময় আসার আগে কোথাকার পানি কোথায় গড়াবে তা বলা মুশকিল। নিক্সন এর পূর্ববর্তী রিপাবলিকান দলের প্রেসিডেন্ট আইসেনহাওয়ার ষাট দশকের গোড়ার দিকে সোভিয়েত ইউনিয়নের সঙ্গে সম্পর্ক স্বাভাবিক করার জন্য মস্কো সফরের আমন্ত্রণ গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু এই সফরের উপযুক্ত মাহেন্দ্রক্ষণ আসার আগেই ইউ টু বিমান দুর্ঘটনা সম্পর্কিত কেলেঙ্কারিতে প্যারিসে শীর্ষ বৈঠকে আইসেনহাওয়ার-ক্রুশ্চভ মুখ দেখাদেখি বন্ধ হয় এবং অত্যন্ত অমর্যাদাজনক পরিস্থিতিতে আইসেনহাওয়ারের মস্কো সফরের পরিকল্পনা পরিত্যক্ত হয়। আইসেনহাওয়ারের পরে ডেমোক্র্যাট দলের জন কেনেডি হোয়াইট হাউসে এসে রুশ-মার্কিন সম্পর্ক উন্নত করেন এবং মস্কো-ওয়াশিংটন হট লাইন চালু হয়! নিক্সন এর আমলে ইতিহাসের পুনরাবৃত্তি ঘটলে বিস্ময়ের কিছু নেই। নিক্সন হয়তো আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের আগে এশিয়ার নতুন শান্তি উদ্যোগ গ্রহণ ও চীন সফরের নামে বিক্ষুব্ধ মার্কিন জনমতকে ঠান্ডা ও প্রভাবিত করার চেষ্টা করবেন। কিন্তু আসল কাজটি অর্থাৎ চীন-মার্কিন সম্পর্ক উন্নত ও স্বাভাবিক করার কাজটি হয়ত করবেন তার পরবর্তী কোন প্রেসিডেন্ট। তিনি রিপাবলিকান দলের বদলে ডেমোক্র্যাট দলের প্রেসিডেন্ট হলে বিস্ময়ের কিছু নেই।
প্রেসিডেন্ট নিক্সনের প্রস্তাবিত চীন সফরের ঘোষণা বিশ্ববাসীকে বিস্মিত করেছে সন্দেহ নেই। বাংলাদেশের মত এশিয়ার অনেক উৎপীড়িত ও শোষিত জাতিই আশা করবে এই দুই বৃহৎ শক্তির মধ্যে সম্পর্ক স্বাভাবিক হলে এশিয়ায় অশান্তি ও রক্তপাত বন্ধ হবে এবং উৎপীড়িত জাতিগুলো উৎপীড়কের হাত থেকে মুক্তি পেয়ে জাতীয় স্বাধীনতা, শান্তি ও সমৃদ্ধির পথে এগোবে। তাদের এই প্রত্যাশা পূর্ণ হলে প্রস্তাবিত ওয়াশিংটন পিকিং বৈঠক বাংলাদেশেসহ এশিয়া ও আফ্রিকার সকল উৎপীড়িত জাতিরই সমর্থন ও অভিনন্দন লাভের যোগ্য এবং বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকারের পক্ষ থেকেই এই আশা নিয়েই এই বৈঠককে স্বাগত জানানো হয়েছে। কিন্তু বিশ্বের দুর্বল ও উৎপীড়িত জাতিসমূহের এই প্রত্যাশা যদি ব্যর্থ হয় এবং প্রমাণিত হয়, এই বৈঠক দ্বারা বাংলাদেশ, ভিয়েতনাম ও কম্বোডিয়ার মতো অসংখ্য বিপদজনক সমস্যাকে পাশ কাটিয়ে গিয়ে এশিয়ায় চীন ও আমেরিকার সংকীর্ণ রাষ্ট্রীয় স্বার্থের মধ্যে সমন্বয় বিধানের ব্যবস্থা হচ্ছে, তাহলে এই বহু বিঘোষিত বৈঠকে বহ্বাড়ম্বরে লঘুক্রিয়ায় পরিণত হতে পারে।
নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন সত্যই এশিয়ায় শান্তি নবযুগের সূচনা করতে চান, না চীন সফরের নামে তার যুদ্ধ সম্প্রসারণ নীতিতে বিরক্ত ও বিক্ষুব্ধ মার্কিন জনমতকে ঠান্ডা করে আগামী বছরের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের সুযোগ গ্রহণ করতে চান, সামনের কয়েক মাসের মধ্যে তা স্পষ্ট হয়ে উঠবে। বাংলাদেশের মানুষ এই কারণেই আশ্বস্ত যে, নিক্সন সরকার ইসলামাবাদের বর্বর জঙ্গী সরকারকে যতই অস্ত্র দিন, মদদ দিন যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী সংখ্যাগুরু মানুষ বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের পক্ষে রয়েছে। চেষ্টার বোলজ, সিনেট সদস্য এডওয়ার্ড কেনেডি প্রমুখ মার্কিন নেতার কন্ঠে যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী মানুষের প্রকৃত মনোভাব ধ্বনিত ও প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। তারা বাংলাদেশের ইয়াহিয়া চক্রের বর্বব নিধন নীতির নিন্দা করেছেন এবং বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের ব্যর্থহীন ভাষায় সমর্থন জানিয়েছেন। শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নয়, সারাবিশ্বের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের সাহায্য ও সমর্থন লাভের ফলে বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত জয় অবশ্যম্ভাবী। বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রশ্নকে বাইপাস করে গোটা এশিয়ায় শান্তি ও সমৃদ্ধির নিরাপত্তা বিধান করা যাবে না, একথা সকল বৃহৎ শক্তি নিশ্চয়ই অনুধাবন করেন। এশিয়ার সাধারণ মানুষ চায়, ওয়াশিংটন পিকিং সম্ভাব্য সমঝোতার ক্ষেত্রে এই সত্যের প্রতিফলন ঘটুক।
মুক্তিবাহিনীর নতুন তৎপরতা
বাংলাদেশের পূর্ব পশ্চিম রণাঙ্গনে মুক্তি বাহিনীর তৎপরতা দ্বিগুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। সবচাইতে আশার কথা, মুক্তিযুদ্ধের প্রাথমিক অসংগঠিত অবস্থা ক্রমে কেটে যাচ্ছে এবং সংঘটিত ট্রেনিং প্রাপ্ত তরুণ মুক্তিযোদ্ধাগণ ইয়াহিয়ার বর্বর হানাদার বাহিনীর বিরুদ্ধে চরম আঘাত হানার দুর্জয় মনোবল নিয়ে রুখে দাঁড়িয়েছেন। ইয়াহিয়া- টিক্কা নরপশু বাহিনীর সংখ্যা অনেক বেশি এবং আধুনিক অস্ত্রশস্ত্রে অনেক বেশি সজ্জিত হওয়া সত্বেও স্বাধীনতা মন্ত্রে উদ্দীপ্ত তরুণ মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে যুদ্ধে এটে উঠতে পারছে না। পশ্চিম রণাঙ্গনে মেহেরপুর থেকে ইতিমধ্যেই শত্রুবাহিনী বিতাড়িত হয়েছে, কুষ্টিয়ায় শত্রুর ঘাঁটি বিধ্বস্ত হয়েছে এবং ভেড়ামারায় মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করেছে বলে সর্বশেষ খবরে জানা গেছে। পূর্ব রণাঙ্গনে শালদা নদীতে হানাদার বাহিনীর পরাজয় অনিবার্য হয়ে উঠেছে। পূর্ব রণাঙ্গনের বিস্তৃত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা ইউনিটের তৎপরতায় পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ব্যতিব্যস্ত রয়েছে। তাদের ট্রেডিশনাল যুদ্ধকৌশল এখানে ব্যর্থ প্রমাণিত হয়েছে। ঢাকা-চট্টগ্রাম, খুলনার মতো গুরুত্বপূর্ণ শহরে হানাদার বাহিনীর লৌহ বেষ্টনী রচনা করা সত্ত্বেও মুক্তিবাহিনীর তরুণ গেরিলারা শহরগুলোর সর্বত্র ছড়িয়ে পড়েছে এবং শত্রুবাহিনী ও তার রাজনৈতিক দালালদের রাতের ঘুম দিনের বিশ্রাম হারাম করে দিয়েছে। অধিকৃত বাংলাদেশ বেসামরিক প্রকাশন ব্যবস্থা পুনরায় চালু করতে গিয়ে ব্যর্থ হওয়ায় টিক্কা খান এখন মরিয়া হয়ে উঠেছে। এই অর্থ শিক্ষিত সিপাই হঠাৎ পাওয়া পদ ও ক্ষমতার দম্ভে ধরাকে সরা জ্ঞান করছিল। ব্রিটিশ শ্রমিক দলের অন্যতম নেতা মিঃ বটমলি তার সঙ্গে সাক্ষাৎকারের পর দেশে ফিরে গিয়ে বলেছেন,” লোকটি বাংলাদেশের জনগণের মনোভাব এর সঙ্গে আদৌ পরিচিত নয়।” ইয়াহিয়া খান সম্পর্কে বটমলী বলেছেন -‘পাওয়ার ড্রাংক এরোগেন্ট’ বা ক্ষমতাগর্বী অহংকারী লোক। মুক্তিফৌজ ইয়াহিয়া আর টিক্কা চক্রের সকল অহংকার ও ঔদ্ধত্যের সমুচিত জবাব দিচ্ছে অস্ত্রের মুখে। সারা বাংলাদেশের সমর্থন, সাহায্য ও সহানুভূতি তাই মুক্তিবাহিনীর পেছনে। বাংলাদেশের যে তারুণ্য আজ অগ্নিমন্ত্রে দীক্ষিত তার ক্ষয় নেই, পরাজয় নেই। সাড়ে সাত কোটি মানুষের মুক্তির মন্ত্রে তারা অনুপ্রাণিত ও উৎসাহিত। এই যৌবন জল তরঙ্গ বালির বাঁধ দিয়ে রোখা যাবেনা। স্বাধীন বাংলার অস্তিত্ব, প্রতিষ্ঠা ও স্থায়ীত্ব নিশাবসান অরুণোদয়ের মতোই বাস্তব সত্য।
পাক জল্লাদদের নৃশংসতার ঘৃণিত কাহিনী
পশ্চিম পাঞ্জাবী জল্লাদগণ কর্তৃক বাংলা মায়ের আদরের দুলাল বাঙালি বীরযোদ্ধাদের নৃশংসভাবে হত্যার আরও লোমহর্ষক খবর পাওয়া গেছে।
খুলনা থেকে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে প্রকাশ, ইতিহাসের ঘৃণ্যতম পাঞ্জাবি জল্লাদ বাহিনী গত এপ্রিল মাসে খুলনায় প্রায় পৌনে দুই শত নিরস্ত্র ইপিআর বাহিনীর লোক বন্দি করে। তাদের মধ্য থেকে পরে ২৫ জনকে হত্যা করে খুলনার পশ্চিম পাঞ্জাবি পদলেহী এবং জল্লাদদের দোসর খান, এ, সবুরের বাড়ীর নিকটস্থ মডেল স্কুলের সামনে আম গাছে ঝুলিয়ে রাখে। লাশগুলো পঁচে গলে দুর্গন্ধ বিস্তার করলে ওদের মাটির নিচে পুঁতে রাখা হয়।
প্রকাশ, বঙ্গবন্ধুর আহ্বানে গত মার্চ মাসে অসহযোগ আন্দোলন শুরু হলে পাক দস্যুরা খুলনার ইপিআর বাহিনীর নিকট থেকে অস্ত্র ছিনিয়ে নেয়। এরপর এপ্রিল মাসে তাদের ১৭৫ জনকে নিরস্ত্র অবস্থায় বন্দী করে।
বর্তমানে খুলনায় পাক জল্লাদদের বন্দিশিবিরে আরো প্রায় ১৫০ জন বাঙ্গালী ইপিআর জওয়ান এক অমানুষিক যন্ত্রণার মধ্যে দিনাতিপাত করছেন। প্রত্যহ সকালে তাদের উপর পাকসেনাদের পদলেহী পুলিশ অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে থাকে। দুদিন পর পর তাদের মনুষ্য ভক্ষণের অযোগ্য খাদ্য সরবরাহ করা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের বিশ্ব ধিকৃত নারী জল্লাদ হিটলারের বন্দী শিবিরগুলোতে বন্দীদের উপর এরকম সুপরিকল্পিত উপায়ে নৃশংস অত্যাচার চালানো হতো।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, বাংলার দুশমন খাজা খয়ের উদ্দিনের ব্রিটিশ দালাল পূর্বপুরুষদের আমলে ১৭৫৭ সালে সিপাহী বিদ্রোহের সময় সিপাহী গণকে ব্রিটিশ জল্লাদবাহিনী হত্যা করে ঢাকার সাবেক ভিক্টোরিয়া পার্কের আমবাগানের ডালে ডালে ঝুলিয়ে রেখেছিল এবং ঝুলন্ত অবস্থায়ই সেদিনের বীর শহীদানের লাশগুলো পচে গলে নিঃশোষিত হয়েছিল।
সভ্য জগতে এরপর আর এমন নৃশংসতার কথা জানা যায়নি। বর্তমান মানবতাবাদ বিশ্বের পর রাজ্যলোলুপ জল্লাদরা বাংলার বুকে পুনরায় পরাধীন যুগের পৈশাচিক নৃশংসতার পুনরাবৃত্তি ঘটালো।
এছাড়া গত এপ্রিলের প্রথমদিকে পাক জল্লাদগণ ঢাকার কুর্মিটোলা সেনানিবাসে ন্যাশনাল সার্ভিস পরিকল্পনা অনুযায়ী সামরিক ট্রেনিংরত প্রায় ৬০/৭০ জন বাঙালি তরুণকে সামরিক বাহিনীর গাড়িতে করে ঢাকার অদূরে জয়দেবপুরে নিয়ে গিয়ে রাজবাড়ীর একটি কক্ষে ঢুকে গুলি করে হত্যা করে। উল্লেখযোগ্য ট্রেনিংরত এসব তরুণ প্রত্যেকেই কলেজের মেধাবী ছাত্র ছিল। পাক দস্যু বাহিনী মারণাস্ত্র নিয়ে বাংলার নিরস্ত্র মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ার কয়েকদিন পরে এ সকল বাঙালিদের তরুণকে নিজ নিজ বাড়ি চলে যাওয়ার জন্য পাক সামরিক কর্তৃপক্ষ ছুটি দেয় এবং নিরাপদে যাতে শহর থেকে যেতে পারে এ কথা বলে তাদের শহর থেকে দূরে জয়দেবপুর পর্যন্ত সামরিক বাহিনীর গাড়িতে করে নিয়ে গিয়ে এমন নির্মম ভাবে হত্যা করা হয়। বাঙালি তরুণদের আর বাড়ি যাওয়া হয়নি। বাংলার এসব তরুণদের মা-বাবা ও আত্মীয়-স্বজনগণ আদরের সন্তানদের কোন খোঁজ খবর না পেয়ে আজও পুত্রের আগমনের প্রতীক্ষায় অশ্রুসিক্ত মা-বাবা গভীর উৎকণ্ঠার সাথে দিনাতিপাত করছেন।
এছাড়া পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক বাহিনীর যে সকল বাঙ্গালীর জোয়ান ছিলেন, তাদের অনেককেই সম্প্রতি পাক-সামরিক কর্তৃপক্ষ স্বদেশে এসে বাবা-মায়ের সাথে সাক্ষাত করার জন্য ছুটি দান করে বলে জানা যায়। ছুটিদানেই নয়- এমনকি ঢাকা পর্যন্ত আমার পিআই এর টিকেট
ও তাদের কিনে দিয়ে করাচী বিমানবন্দরে এসে বিমানে উঠিয়ে দেয়। তারা ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছালে পাক দস্যুদের পদস্থ কর্তা তাদের বিমানবন্দর থেকে শহরের বাইরে নিরাপদ স্থানে পৌঁছে দেয়ার নাম করে কোথায় যে নিয়ে যায় তার আর কোন হদিস পাওয়া যায় না।
করাচি থেকে আগত জনৈক এক বাঙালি জোয়ান সম্প্রতি এক সাক্ষাৎকারে এই প্রতিনিধিকে জানান যে, পশ্চিম পাকিস্তান থেকে বাঙ্গলী জওয়ানদের ঢাকায় পাঠানোর সময় তাদের দ্বারা ছুটির দরখাস্ত লিখিয়ে রাখা হয় এবং ঢাকা বিমানবন্দরে পৌঁছানোর পর পাঞ্জাবি জল্লাদরা ঢাকায় তারা নিরাপদে পৌঁছেছেন এ ধরনের স্বীকারোক্তিমূলক একটি খাতায় তাদের বাঙালি জওয়ানদের স্বাক্ষর রেখে তারপর সামরিক বাহিনীর গাড়িতে নিয়ে যায়। উক্ত বাঙালি জোয়ানটি জানান যে, ঢাকা বিমানবন্দরে অবস্থানরত সামরিক বাহিনীর একজন অফিসারের সাথে তার খুব খাতির ছিল তাই তাকে গাড়িতে না তুলে নিরাপদে বিমানবন্দর থেকে অন্য পথে বের করে দেয়। তাই তিনি বেঁচে গেছেন।
পাক জল্লাদদের তথাকথিত শরণার্থী অভ্যর্থনা কেন্দ্রের স্বরূপ
মানবতার দুশমন পাক জঙ্গীশাহী নৃশংসতা আর ধাপ্পা দেওয়ার ক্ষেত্রে ইতিহাসের জঘন্য জল্লাদ হিটলার-মুসোলিনিরও নিষ্ঠুরতা ও হঠকারিতাকে হার মানিয়েছে। ইউরোপীয় দেশ সহ বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ রাজনীতিবিদও স্বীকার করেছেন। পাক জঙ্গী শাহীর মানবতাবিরোধী এই নিষ্ঠুরতা ও নব নব উপায়ে বিশ্বমানবতাকে ধোকা দেওয়ার অপপ্রয়াস কারো অজানা নেই। জঙ্গী শাহীর নগ্ন ও বীভৎস চেহারাকে কিছুতেই ঢাকা দিয়ে রাখতে পারেনি।
পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিষ্ঠুর হত্যাযজ্ঞ অনুষ্ঠান এবং বাড়িঘর জ্বালিয়ে পুড়িয়ে দেওয়ার পর শ্যামল বাংলার লক্ষ লক্ষ মানুষ কেবল প্রাণটিকে হাতের মুঠোয় নিয়ে বাপ দাদা চৌদ্দ পুরুষের ভিটেমাটি ছেড়ে ভারতে চলে যাওয়ায় বিশ্ববাসী তখন জঙ্গিশাহীর উপর তীব্র চাপ সৃষ্টি করেছে তখন জঙ্গিশাহী বিশ্বকে ধোকা দেওয়ার জন্য এক নতুন পন্থার আশ্রয় নিয়েছে।
নতুন ধোঁকাটি হচ্ছে বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার সীমান্তে তথাকথিত শরণার্থীদের অভ্যর্থনা কেন্দ্র। জঙ্গীশাহীর কন্সেন্ট্রেশন শিবির বলে পরিচিত গায়েবী আওয়াজ তথা পাক বেতার মারফত রোজেই গলা ফাটিয়ে চিৎকার করে বলছে প্রতিদিনেই নাকি ভারত থেকে শরণার্থীরা জল্লাদ বাহিনীর অভ্যর্থনা কেন্দ্রে নামধারী বধ্যভূমিতে চলে যাচ্ছে। কিন্তু এই তথাকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রের নেপথ্য কাহিনীটি হচ্ছেঃ নিষ্ঠুর নরপিশাচগণ অধিকৃত এলাকার গ্রামে রাত্রে আকস্মিকভাবে হামলা করে নারী-পুরুষ-শিশু এবং বৃদ্ধদের ধরে নিয়ে ওই তথাকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে রেখে দেয় এবং তাদেরই ছবি তুলে দস্যু কবলিত সংবাদপত্রের পৃষ্ঠায় ছাপিয়ে থাকে। আর বিদেশের রাষ্ট্রীয় প্রতিনিধিদের দাওয়াত করে এনে দেখাচ্ছে যে, ভারত থেকে শরণার্থীরা স্বদেশে ফিরে আসছেন।
কুমিল্লা থেকে আমাদের প্রতিনিধি জানিয়েছেন, হানাদার বাহিনী কুমিল্লা শহরের উত্তর দিকে বাস্তবী ইউনিয়নের কতগুলো গ্রাম জ্বালিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করে দিয়ে গ্রামবাসীদের ধরে নিয়ে গিয়ে কুমিল্লা জেলার পূর্ব সীমান্তে একটি তথাকথিত অভ্যর্থনা কেন্দ্রে আটক করে রেখেছে। সম্প্রতি বিদেশি প্রতিনিধি দলকে নিয়ে গিয়ে এই তথাকথিত অভ্যর্থনা সেকারিটি দেখিয়েছে। কিন্তু এতসব নির্লজ্জ জালিয়াতি করেও বিশ্বের দৃষ্টিকে ফাঁকি দিতে পারেনি। ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের নেতা মিঃ বটমলিও জঙ্গীশাহী ধাপ্পাবাজির কথা ফাঁস করে দিয়েছেন।
জঙ্গীশাহীর চারপাশে যে আজ অন্ধকার দেখতে শুরু করেছে এই নির্লজ্জ মিথ্যাচার থেকেই দিবালোকের মতো স্পষ্ট হয়ে ওঠে। কারণ অতি সাধারণ বুদ্ধি সম্পন্ন ব্যক্তি ও বুঝতে পারেন যে, নদীতে ডুবন্ত মানুষ একটি ভাসমান তৃণ বস্তুকেও জড়িয়ে ধরে বাঁচার ব্যর্থ চেষ্টা চালায়। কিন্তু আশাকরিও কি জঙ্গিশাহী শেষ রক্ষা করতে পারবে?
ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না
তারা কেউ কথা বলার সময় পেল না। কথা বলার সময় দিল না কেউ তাদের। তাদের অসহায়তায় আকাশ আর পৃথিবী নির্বাক হয়ে গেছে। দশজন বিশ জন নয়, এক শো দু শো নয়, এক হাজার দু হাজার নয়, অগণিত- বৃদ্ধ যুবক, তরুণ কিশোর, শিক্ষক-ছাত্র, সরকারি-বেসরকারি শ্রমিক-কৃষক, নারী-পুরুষ। অগণিত তারা জীবনের আকাশ থেকে খসে পড়ল একটি অভিশপ্ত রাতের ক্ষুদ্র একটি অংশ।
২৫শে মার্চের রাতে আর আর দিনের মতোই স্বাভাবিক নিয়মে গৃহে গৃহে ঘুমিয়ে ছিল তারা ঢাকা নগরীর অংশে অংশে। অকস্মাৎ কার নির্মম বন্দুক কামানের গুলির আঘাত তাদের বুকের পাঁজর ভেঙ্গে দিল। তাদের চোখের আলো নিভে গেল চিরদিনের তরে। কিন্তু সেখানেই শেষ নয়। আজও অব্যাহত গতিতে বিস্তৃত হয়ে চলেছে সারা বাংলাদেশের নগরে শহরে জনপদে জনপদে নিরীহ মানুষের উপর হিংস্রতা নৃশংসতা আর বর্বরতার চরম নগ্নতা নিয়ে। বাড়িঘর ছেড়ে মানুষ একবার যায় জঙ্গলে, আবার পথে, আবার শস্য ক্ষেতে, কোথাও যদি কোন আড়াল আবডাল থাকে সেইখানে- জীবনের মায়ায়। কিন্তু কোথায় যাবে সর্বত্রই ছড়িয়ে আছে তাদের জন্য শুধুই নিষ্ঠুরতা, বর্বরতা, নারী মাত্রেরই জন্য পাশবিকতা, সেইসাথে নিশ্চিত মৃত্যু। কোথায় যাবে তারা তা হলে? প্রান্তরে পথে বয়ে চলেছে অবিরাম স্রোত- বন্যার পানির স্রোত নয়, বহু প্রতীক্ষিত আকাশের বারিধারার শীতল স্রোত নয়। এ স্রোত রক্তের, মানুষের রক্ত- নিজের বাপ-মা, ভাই বোন, পুত্রকন্যা, পরিজন প্রতিবেশীর উষ্ণ রক্তের স্রোত। তবু তারেই মাঝখান দিয়ে আশ্রয়ের আশায় এগিয়ে যায় সীমান্তের ওপারে দৃষ্টি নিবদ্ধ করে। সেখানে নাকি ঠাই আছে দাঁড়িয়ে নিঃশ্বাস নেওয়ার, মানুষ আছে মানুষের জন্য দুঃসময়ে, দুঃখে চোখের পানি ফেলতে, সহানুভূতি আছে মানুষের জন্য মানুষের বুকে জমা। সবাই যে মানুষ, একই রক্তে মাংসে গড়া মানুষ, তাই। পথ চলতে তাদের অনেকেই ভেঙে পড়ে শ্রান্তিতে, ঢলে পড়ে মৃত্যুর কোলে। আকাশের দিকে চেয়ে কার উদ্দেশ্যে নীরব অভিমান রেখে যায়। দুর্ভাগ্য- তাড়িত এই জনস্রোত তাদের পশ্চাতে ফেলে যায় দীর্ঘদিনের শ্রম ও সাধনার ফলে গড়ে ওঠা শিল্প, সভ্যতা, সংস্কৃতি ও শিক্ষার ধ্বংসস্তূপ। অত্যাচারীর নির্মম হাত অত্যাচারিতের স্বাক্ষর বহনকারী সবকিছুকেই নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছে।
গত চার মাস ধরে অবিশ্রান্ত চলেছে মানুষের হাতে মানুষের এই লাঞ্ছনা। বাংলাদেশ এই হত্যাযজ্ঞের ভূখণ্ড, বাংলাদেশবাসী মাত্রেই নিষ্ঠুরতার শিকার -হোক সে মুসলিম, হোক হিন্দু, হোক বৌদ্ধ, হোক জৈন, হোক খ্রিস্টান। আর পাকিস্তানের সামরিক প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ইতিহাসের এই নজিরবিহীন হত্যাযজ্ঞের হোতা। দীর্ঘদিন সযত্নে পোষিত তার অমানুষিক বর্বরতাকে বাস্তবে রূপায়িত করার জন্য সারা বাংলাদেশে ছড়িয়ে পড়েছে তার হুকুম বরদার, লক্ষাধিক পাকসেনা। নগরে, শহরে, গঞ্জে, বাজারে, গ্রামে, গৃহে, ক্ষেতে-খামারে এমনকি মসজিদে মন্দিরে ছড়িয়ে পড়েছে এরা সীমাহীন নিষ্ঠুরতা আর চরম বর্বরতা নিয়ে। বৃদ্ধ, শিল্পী, অন্ধ, ভিক্ষুক, প্রার্থনারত মানুষ কেউ এদের হাত থেকে রেহাই যায়নি। গ্রাম থেকে গ্রামান্তরে গিয়ে এরা মানুষের ঘর গৃহস্থালী পুড়িয়ে দিয়েছে। মাঠের পর মাঠ সবুজের সমারোহকে বশীভূত করে সারা দেশের জন্য করাল দুর্ভিক্ষের পটভূমি তৈরি করেছে। বাংলাদেশ আজ শ্মশান, বাংলাদেশ আজ ভাগাড়। বাংলাদেশের আকাশে আজ শকুনি, গৃধিণীর পাখা ঝাপটানি। নদ-নদী খাল-বিল এর পথ মানুষের শবের স্তুপে রূদ্ধ। সুবিস্তীর্ণ গ্রাম দেশে আজ আবার কলেরার মহামারী দেখা দিয়েছে, কিন্তু তার প্রতিকার এর বিন্দুমাত্র সম্ভাবনা দেশের চিকিৎসক শ্রেণি আগেই ধ্বংস করে দেওয়া হয়েছে, সব ওষুধের দোকান জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। মানবতার ডাকে যারা দু’চারজন আজ রুগ্ন মানুষের সেবায় অগ্রসর হবার জন্যে পা বাড়াচ্ছে তাদেরকেও পাকসেনা গুলি করে মারছে। মানুষের ইতিহাসে মানুষ কোনদিন এত বড় বিপর্যয়ের সম্মুখীন হয়নি।
কিন্তু এই নিগৃহীত মানবতার অপরাধ কি? তারা তাদের জিজ্ঞাসা কে সোচ্চার করে যেতে পারল না বলেই কি কেউ এ প্রশ্নের জবাব চাইবে না? কেউ এগিয়ে আসবে না এই প্রশ্নের জাওয়ার আদায় করতে? লক্ষ লক্ষ নিষ্পাপ মানুষের বুকের তাজা রক্ত কি ব্যর্থ হয়ে যাবে?
এগিয়ে আসে কালের ইতিহাস! না তা হতে পারে না। এ প্রশ্নের জবাব দিতে হবে অত্যাচারীকে। এ প্রশ্নের জবাব আদায় করার দায়িত্ব যারা বেঁচে রয়েছে তাদের সবার।নইলে ইতিহাস কাউকে ক্ষমা করবে না।
বাংলাদেশের শোষিত মানবতা জীবনের ন্যূনতম দাবি করেছিল। বাঁচতে দিতে হবে তাদের। তাদের মেরে তাদের কঙ্কালের উপর দাঁড়িয়ে অপরের বাচা সেটি যেন আর না হয়। স্বাধীনতার জন্য দুঃখ বরণ করেছে সবাই। স্বাধীনতার আশীর্বাদ তাই সকলে সমান ভাবে ভোগ করবে। তাদের দাবি ছিল নিজেদের ন্যায্য পাওনা পেলেই সে দাবি মিটত। সে দাবিতে অপরের অধিকার ক্ষুণ্ন করার চিন্তা ছিল না, শোষণের অবসান ঘটনাকে বলিষ্ঠ আওয়াজ ছিল। সেই আওয়াজ কে স্থাপন করে দেওয়ার উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া গোটা বাংলাদেশের উপর হত্যা-খুন, ধ্বংস, বর্বরতা আর পৈচাশিকতা ছড়িয়ে দিল। অত্যাচারীর এছাড়া আর কোনদিন কেউ দেখেনি মানুষের ইতিহাসে। দেখে চেঙিস হালাকু ও নাদির শাহকে। কিন্তু এদের সবার সমন্বয় ঘটেছে যে ইয়াহিয়া খান তার বর্বরতার সামনে পূর্ববর্তী আর সবার কলঙ্কের কাহিনী ম্লান হয়ে গেছে।
কিন্তু বাংলার এতো কান্না, এতো আহাজারি, এতো দীর্ঘশ্বাস, এত রক্ত, আজও দুনিয়ার বৃহৎ শক্তিবর্গকে সার্থকভাবে চঞ্চল করে তুলতে পারল না কেন? মুখে ‘আহা’ বলে দুঃখ প্রকাশ করা ছাড়া আর কোন কিছু করলেন না কেউ আজও। বলিষ্ঠ পদক্ষেপে সক্রিয় হয়ে উঠলেন না তারা কেউ এই মানুষের দুশমনের খেয়ালকে চূর্ণ-বিচূর্ণ করে দিতে। মানুষের দুশমনকে চিরদিন মানুষইতো ধ্বংস করেছে, সম্মিলিত শক্তির কবলেই তো নিষ্পেষিত হতে হয়েছে যুগে যুগে মানবতার দুশমনদের। তাইতো সম্ভব হয়েছে সকল বিপত্তি আর বিপর্যয় উত্তীর্ণ হয়ে মানুষের পক্ষে বেঁচে থাকা, সম্ভব হয়েছে গণতন্ত্র, মুক্তি, স্বাধীনতা আর শান্তি সম্ভব হয়েছে সভ্যতার অগ্রগতি।
অত্যাচারীদের আহাজারি যেদিন সারাবিশ্বের কানে পৌঁছায়, লাঞ্ছিত মানবাত্মা গৃহহারা হয়ে যেদিন বিশ্বের দুয়ারে দাঁড়িয়ে প্রতিকার প্রার্থনা করে তখন কি বিশ্বের বিবেক মানবতার নামে জেগে উঠবে না? কি জবাব দিতে চান বিশ্বের গণতান্ত্রিক পূজারীরা, মানবাধিকার সনদের নির্মাতারা, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানকামীরা? আর কত দিন কাটবে বিচার-বিবেচনার নামে, আর কতদূর আভ্যন্তরীণ ব্যাপার এর দুর্বল অজুহাতে প্রশ্রয় দেওয়া চলবে অন্যায় কে? নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের উপর সীমাহীন অত্যাচারেই কি অত্যাচারের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়াবার জন্য যথেষ্ট কারণ নয়? মানুষ আর তার গোটা পরিবেশকে নির্বিকার চিত্তে নিশ্চিহ্ন করে দেওয়াই কি যথেষ্ট নয়, বিশ্বের ন্যায়নীতির সমর্থক জাতির বিবেক ও শুভ বুদ্ধিকে জাগ্রত করার জন্য? তাহলে, অন্যায়-অত্যাচারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে উঠে মানুষের জন্মগত অধিকার স্বাধীনতার পতাকা হাতে করে রক্ত পিচ্ছল সংগ্রামের পথে, এগিয়ে চলেছে বাংলার যে সাড়ে সাত কোটি মানুষ তাদের স্বীকৃতি দিতে এবং বলিষ্ঠ সক্রিয়তা নিয়ে তাদের পাশে দাঁড়াতে কেন বিলম্ব করেছেন বৃহৎ শক্তিবর্গ?
শুধু বাংলার মুক্তিবাহিনী বিশ্বরাজনীতির জাতিসংঘের মহাসচিব উঃ থান্ট দেরিতে হলেও সত্য উপলব্ধি করেছেন এবং দ্বিধাহীন কণ্ঠে তা প্রকাশ করেছেন। তার নিজের কথায় বাংলাদেশে পাক হানাদারদের ব্যাপক গণহত্যা ঘটনা ইতিহাসের সর্বাপেক্ষা বেদনাদায়ক ঘটনা আর মানুষের ইতিহাসের এক বিভীষিকা পূর্ণ এবং কালিমাময় অধ্যায়। কিন্তু এখানে কি কর্তব্য শেষ হলো মহাসচিব উথান্ডের? ভবিষ্যতের ঐতিহাসিককে? কথা বলতে হবে সেই কথাটি আগেভাগে উচ্চারণ করলেই নিশ্চয়ই জাতিসংঘের মহাসচিব এর কর্তব্য সমাপন হলো না। জাতিসংঘের মহাসচিব এর মুখের দিকে সারাবিশ্ব আজ অন্যায় আর অত্যাচারের রাস্তা প্রতিকারের আশা নিয়েছে আছে। চেয়ে আছে বাংলাদেশের লাঞ্ছিত মানবতা আর সেইসাথে বিশ্বের জাগ্রত জনমত। জাতিসংঘ কেন আজও এমন বাস্তব পন্থা গ্রহণ করবে না যার ফলে জেনারেল ইয়াহিয়া বাংলাদেশে গণহত্যা বন্ধ করতে বাধ্য হবেন -যার ফলে পৃথিবীর মানুষ ভাববার অবকাশ পাবে নানা অধিকারের দাবি নিয়ে মানুষের জন্য বাঁচার দিন আজও শেষ হয়ে যায়নি। মহাসচিব নিরুত্তর। কিছুই কি বলবেন না তিনি বিশ্বের জনমতের সামনে দাঁড়িয়ে?
দুনিয়ার কাছ থেকে সত্যকে ঢেকে রাখার জন্য জেনারেল ইয়াহিয়া যে অপচেষ্টা করেছিস তা তো নিদারুণ ব্যর্থতায় পর্যবসিত মিথ্যার জাল ভেদ করে সত্য আজ আপন মহিমায় স্পষ্ট হয়ে উঠেছে স্থান ও কালের শাখা রেখা শেষ হয়ে যায় যেখানে সেইখানে দাঁড়িয়ে একমাত্র মানুষ ও তার পৃথিবীর কল্যাণ চিন্তায় উদ্বুদ্ধ হয়ে অনেক সাংবাদিক, রাজনীতিবিদ, সংবাদ সংস্থা ও রাষ্ট্র দ্ব্যর্থহীন ভাষায় স্বীকার করেছেন ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহীর আক্রমণের ফলে বাংলাদেশের গণহত্যা আজ আর পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ বিষয় নয়। আন্তর্জাতিক ব্যাপারে দাঁড়িয়ে আছে তখনও কি বলতে চান জাতিসংঘের মহাসচিব উ থান্ট বিশ্বের দরবারে দাঁড়িয়ে? মুখ চেয়ে বসে বসে থাকতে পারেনা। বাংলাদেশের মুক্তির সংগ্রাম আজ সবকিছুর বাঙালির আগে, বাঁচা-মরার সংগ্রাম। সংগ্রাম তাদের করতে হবে, তা যে মূল্যেই হোক। সংগ্রাম ব্যতিরেকে মুক্তি সম্ভব নয়, সম্ভাবনায় বাঁচা। সংগ্রামের সাহায্যেই দুশমনকে খতম করতে হবে। একনিষ্ঠ ও সুসংহত সংগ্রামের সম্মুখে কোন দুশমন কোন দিন টিকতে পারে নাই আজো পারবে না। বিশ্ব যদি নির্বাক দর্শক হয়েছে থাকার পথেই বেছে নেয় তা আজ নিতে পারেন তারা কিন্তু বাংলার মুক্তিফৌজ একাই তার কর্তব্য সাধিতে এগিয়ে চলবে। মুক্তিফৌজ আরো যত প্রাণ লাগে দিবে, আরো যত রক্তের প্রয়োজন দিবে, তবু সংগ্রামের সর্বশেষ পর্যায় যেখানে পর্যায়, পরাজয় অজ্ঞাত, যেখানে লেখা আছে অত্যাচারীর সর্বনাশ আর মুক্তিকামী মানুষের জন্য বিজয়ের রজতশুভ্র রেখা সেই পর্যন্ত এগিয়ে চলবে। জয় বাংলা।

জল্লাদের দরবার
রচনাঃ অজাত শত্রু
(রূপক -জীবন্তিকা)
নকীব। (চিৎকার করে হাকছে) জনাব সদরে ই মুলুক, খান এ তালুক, কেল্লাফতে প্যায়ারের খান বাহাদুর –
ফতে। সিপাহসালার টিটিয়াখান, যুদ্ধের খবর কি?
সিপাহী। যুদ্ধ শেষ। আমাদের সেনারা এখন ক্যাম্পে বসে তন্দুরি রুটি খাচ্ছে।
মূর্খ খান। জনাব সদরের মুলক, গোস্তাকি মাফ। আমি দুর্মুখ খান। মাঝে মাঝে অপ্রীয় সত্যি কথা না বললে কেমন যেন অম্বল এর মত বুক জ্বলে যায়।
ফতে। তোমার কি বক্তব্য বলে ফেলো দুর্মুখ খান।
দুর্মুখ। আমাদের সিপাহসালার বুড়ো হলেও মনটা জুয়ান আছে। উনি এইমাত্র বললেন আমাদের সৈন্যরা নাকি যুদ্ধ শেষ করে এখন ক্যান্টনমেন্টে বসে বসে তন্দুরি রুটি খাচ্ছে আর ঘুমাচ্ছে।
ফতে। তুমি কি বলতে চাও?
দুর্মুখ। হুজুরে আলা আপনি তো তিন মাস হল হার্ট আর মাথা ঘুরানি ব্যামোতে আপনার মসরকি বাঙালে পা রাখতে পারেনি। যদি মেহেরবানী করে একবার বাংলাদেশের যান তাহলে দেখতে পাবেন মুক্তিবাহিনী।
ফতে। খামোশ, নালায়েক মুক্তিবাহিনি মুক্তিবাহিনী। আমাকে এখন পাগল না করে ছাড়বে না দেখছি।
দূর্মুখ। ভুইলা গিয়েছিলাম হুজুর বিচ্ছিন্নতাবাদী প্রতিদিন আপনার প্যায়ারের সেনাদলকে এ্যায়সন ধোপা পটকান পটকাচ্ছে যে, আমাদের সেই সব সেনারা তন্দুরি রুটি খাওয়ার বদলে হাসপাতালের বেডে খাবি খাচ্ছে। ওরা ঘুমাচ্ছি ঠিকই- তবে সে খুব সহজে ভাঙার নয়। উঃ কি মার হুজুর -একেবারে বদন বিগড়ে দিয়েছে।
ফতে। দুর্মুখ খানের এ কথা কি সত্য টিটিয়া খান।
সিপাহী। জনাব, মারতে গেলে মার খেতে হয়- এটাই আমাদের যুদ্ধের কৌশল।
ফতে। তাহলে ওইসব দেশদ্রোহীর হাতে আমার সাধের সেনাদল এখনো মার খাচ্ছে।
দুর্মুখ। খাচ্ছে মানে? এখন মার যে হজম করা মুশকিল। মেরে একেবারে তক্তা করে দিচ্ছে। আহা!
ফতে। দুর্মুখ খান, তোমার এই কথা শুনে আমার মাথাটা আবার ঘুরে উঠলো। পানি।
সিপাহী। আপনি বিচলিত হবেন না। আমাদের বীর সেনা বাহিনী জান দিয়েও দেশ রক্ষা করবে।
দূর্মুখ। দেশ রক্ষা নয়- বলুন তারা এখন পেট রক্ষায় ব্যস্ত।
ফতে। তার মানে? বেশ খোলসা করে বল দুর্মুখ খান।
দুর্মুখ। তার মানে বুঝলেন না জনাব? আপনার সেনাদল বাংলাদেশের অভিযান চালাবার নামে, নিরীহ মানুষগুলোকে হত্যা করেছে-তাদের যথাসর্বস্ব লুটতরাজ করেছে, ব্যাংক লুটেছে। এইসব লুটের টাকায় আপনার এক একজন গরীব সেনা রাতারাতি কোটিপতি বন গিয়া।
ফতে। এতো আনন্দের বিষয়। খোশ খবর।
দুর্মুখ। কিন্তু নিরানন্দে আপনি তাদের ভাসালেন জনাব। আচমকা একশো আর পাঁচশো টাকার নোট গুলোকে কাগজ করে দিয়ে আপনার ঐসব ক্রোড়পতি সেনাদের আপনি একেবারে পথে বসালেন। তারা বলছে কেল্লাফতে খান, আমাদের পথে বসালেন।
ফতে। সিপাহশালার এ কথা কি সত্য? এই দেখো মাথাটা আবার….
সিপাহী। আংশিক সত্য জনাব। লুটের টাকা নিয়ে সৈন্যদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দিয়েছে কিনা জানিনা। তবে তারা পুরো মাইনে না পাওয়াতে মানে ডিফেন্স সার্টিফিকেটে মাইনে দেওয়াতে বড়ই দুঃখ পেয়েছে।
ফতে। কি আর করা যাবে সিপাহসালার। যুদ্ধের ব্যয়, খয়রাতি সাহায্য বন্ধ, ব্যবসা অচল, এই সবে মিলে কোষাগার প্রায় শূন্য। উঃ মাথাটা কেমন যেন –
সিপাহী। ভাববেন না জনাব। আমাদের সেনারা মাইনে না পেলেও বীর বিক্রমে যুদ্ধ চালিয়ে যাবে।
দুর্মুখ। হ্যায় কুছ পরোয়া নেহি হে। পঁয়ষট্টি সালের যুদ্ধের সময় আমাদের স্বনামধন্য লারকানার নবাব নন্দন বলেছিলেন, যদি আমাদের ঘাস খেয়েও বাঁচতে হয় তবু হাজার বছর ধরে যুদ্ধ চালিয়ে যাব। ভাগ্যিস ১৭ দিনের যুদ্ধ থেমেছিল।
সিপাহী। তুমি পরিহাস করছে দুর্মখ খান।
দুর্মুখ। এ পরিহাস নয় সিপাহসালার -। বাস্তব আর মুখের বজ্র ঠাণ্ডা বুলি এক নয়। এর মধ্যেই শোনা যাচ্ছে, আমাদের কিছু সেনা নাকি আর বাংলাদেশের নিরীহ মানুষকে খুন করতে রাজি নয়।
ফতে। উঃ মাথাটা চক্কর দিয়ে উঠল!
সিপাহী। বিচলিত হবেন না জনাব। নিতান্ত কিছু সেনার মুখের কথা -মনের কথা নয়।
দূর্মুখ। আমাদের বৃদ্ধ সিপাহসালার আজকাল কি তার -প্রতিটি সেনার অন্তরের গভীর তলদেশে অন্বেষণ করে কথা বলছেন? আপনার বীর বেলুচ সেনারা যে ধীরে ধীরে বিদ্রোহ হয়ে উঠেছে। তারা নাকি এখন বলছে, কাফের হত্যার নির্দেশ আমাদের হয়েছিল। কিন্তু এখন দেখছি, আমরা যাদের খুন করছি, তারা নিরীহ মানুষ, তারা মুসলমান, তারা আমার ভাই।
ফতে। উঃ- মাথাটা আবার –
সিপাহী। জনাব আপনার মাথাটা অত ঘুরাবেন না। আপনার প্রেসার আবার বেড়ে যাবে। আমার উপর বিশ্বাস আর আস্থা রাখুন। সব ঠিক করে দেবো।
ফতে। কি করে আর আস্থা রাখি টিটিয়া খান। ইতিপূর্বে আপনি আমাকে বলেছিলেন সব স্বাভাবিক হয়ে গেছে। আমিও বিশ্বকে বুক ঠুকে বলেছিলাম, দেখে যান বিশ্ববাসী আমরা বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিশ্চিহ্ন করে দিয়ে সব স্বাভাবিক করে ফেলেছি। কিন্তু কতগুলো বিদেশী মানুষ এদেশে এসে আপনার -জারিজুরি সব ফাঁস করে দিল। আমার মুখ হাসালেন।
দুর্মুখ। শুধু মুখে হাসালের না, চোখের জলে লোমশ বুক ভাসালেন। আচ্ছা জনাব, যুদ্ধ টা বন্ধ করে দিলে হয় না?
ফতে। কি বললে?
দুর্মুখ। একটু ভেবে দেখুন, আপনার জন্মদাতা ও অবশেষে যুদ্ধে ক্ষান্ত দিয়ে নিরালায় বসে আত্মজীবনী লিখছেন আর দিলখুসবাগে পায়চারি করছেন। আপনিও না হয় সবকিছুতে ইস্তফা দিয়ে সাকি আর সুরা নিয়ে খোশমহলায় বাকি জীবনটা আরাম-আয়েশে কাটিয়ে দেবেন। কী দরকার এবার ঝুটঝামেলায়।
ফতে। দুর্মুখ খান, তোমার এ উদ্যত স্পর্ধা দেখে আমি বিস্মত হচ্ছি। রসনা সংযত করো। এই মুহূর্তে আমি তোমাকে বহিষ্কার করতে পারি।
দূর্মুখ। পারেন না জনাব। কারণ আমি আপনার হৃদয়ের গভীরে বাস করি সেখানে থেকে আমাকে বিতাড়িত করবেন কী করে।
সিপাহ। জনাব আমি তাহলে এখন চলি।
ফতে। আসুন, তবে হ্যাঁ স্মরণ রাখবেন সাড়ে সাত কোটি মানুষকে চরমভাবে সায়েস্তা না করা পর্যন্ত বিশ্রাম আমাদের হারাম।
সিপাহ। আপনি নিশ্চিত থাকুন। আর কদিন পর ওদের আমরা ফুঁয়ে উরিয়ে দেবো জনাব।
দুর্মুখ। (হেসে) দেখবেন সাড়ে সাত কোটি মানুষের মিলিত নিঃশ্বাসে আপনারা শেষে উড়ে না যান। নিজেদের গোড়া শক্ত করে রাখবেন।
সিপাহ। এ ব্যাপারে তোমার মাথা না ঘামালেও চলবে। আমি চললাম জনাব। খোদা হাফেজ!
ফতে। খোদাহাফেজ।
দুর্মুখ। জনাব, আমাদের সিপাহসালার ভীমরতি ধরেছে । ওকে অবসর দিন।
ফতে। আমিও তাই ভাবছি।
নকিব। জনাবে আলা, লারকানার নবাবজাদা আপনার দর্শন প্রার্থী।
ফতে। উঃ লোকটা আবার ঝামেলা করতে আসছে।
দুর্মুখ। সেকি জনাব, বাদশাহজাদা আপনার পেয়ারের দোস্ত। সেই দোস্তকে এখন বরদাস্ত না করার কারণ?
ফতে। ফতে যখন প্রয়োজন ছিল দোস্ত করেছি।
দুর্মুখ। আর এখন প্রয়োজন শেষে ছীবড়ের মতো রাস্তায় ছুড়ে ফেলে দিচ্ছেন এইতো।
ফতে। এইটাই আমাদের নীতি। যাও, নবাবজাদা কে পাঠিয়ে দাও।
নকীব। যো হুকুম জনাব।
দুর্মুখ। আমি কি চলে যাবো জনাব।
ফতে। না-না-থাক। বুঝলে দুর্মুখ খান এক এক সময় তোমাকে সহ্য করতে পারিনা সত্য আবার তোমার অস্তিত্বকে অস্বীকারও করতে পারি না। আসুন নবাবজাদা আসন গ্রহণ করুন। তারপর কি সংবাদ।
নবাব। আমার পক্ষে আর প্রকাশ্যে চলাফেরা দুঃসাধ্য জনাব। কোনরকমে ছাতি দিয়ে মাথা বাঁচিয়ে চলছি।
ফতে। কেন?
নবাব। আমার দলের সদস্যরা আজ কাল কেবলেই তাগাদা শুরু করেছে। তারা বলছে, আমরা এত তকলিফ করে সদস্য হলাম আর এখন পর্যন্ত উজির হওয়া তো দূরের কথা মাইনে টা পর্যন্ত পেলাম না।
ফতে। (হেসে) নবাবজাদা সেটা জানেন। কারণ ওর হাত দিয়েই তো ঘোল ঢালিয়াছেন। হেঃ হেঃ গোস্তাকি মাফ করবেন।
ফতে। দূর্মুখ খান।
নবাব। জনাব আপনি আমার কাছে ওয়াদা করেছিলেন, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ঠান্ডা করেই ক্ষমতা আমার হাতে অর্পণ করবেন।
দুর্মুখ। লাগ ভেল্কি লাগ, চোখেমুখে লাগ।
ফতে। নবাবজাদা আমার ওয়াদার পূর্বে আপনি আপনার দেশবাসীর কাছে ওয়াদা করেছিলেন যে, আপনার কত একর জমি যেন গরিবদের মধ্যে দান করবেন। আপনি ওয়াদা রক্ষা করেছেন?
নবাব। সেটা নিতান্তই আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
ফতে। আর এটাও আমার কিছুটা ব্যক্তিগত ব্যাপার বৈকি। কারণ –
দুর্মুখ। কারণ এ দেশ হুজুরের বাপ-দাদার খাসতালুক না হলেও গোটা মুলুকের এক ছত্র মালিক উনি হেঃ হেঃ।
ফতে। স্তব্ধ হও দূর্মুখ খান।
নবাব। আমি এসেছি এই জন্য যে, আপনার কাছ থেকে নতুন প্রতিশ্রুতি নিয়ে যাবো খাঁ সাহেব –
ফতে। প্রতীক্ষায় থাকুন -ব্যবস্থা হবে!
নবাব। তা তো বুঝলাম কিন্তু কবে?
দুর্মুখ। ঠিকই তো। তা তো বুঝলাম – কিন্তু কবে?
ফতে। দুর্মুখ খান –
দুর্মুখ। গোস্তাকি মাফ করা হোক জনাব।
ফতে। আর চার মাস অপেক্ষা করে নবাবজাদা। যদি দুর্যোগ কাটিয়ে উঠতে পারি, যদি পৃথিবীর মানচিত্রে এ রাজ্যের অস্তিত্ব থাকে তাহলে আমি অবশ্যই আপনাদের সম্পূর্ণ বিমুখ করবো না।
দূর্মুখ। হুজুর, পাঠানের বাচ্চা -এক কথার লোক। পাঠান জীবন থাকতে ওয়াদা খেলাপ করে না।
ফতে। নিশ্চয়ই।
দুর্মুখ। অবশ্যই নেহাত বেকাদায় পড়ে দুচারবার বাধ্য হয়ে জনাবকে কথার বরখেলাপ করতে হয়েছে। তবে পৃথিবীর গ্রেট ম্যানরা ওসব করেই থাকেন।
ফতে। দুর্মুখ তোমাকে আমি কতল করব। তুমি গাধার বাচ্চা।
দুর্মূখ। হুজুর আমার মা-বাপ। যা বলবেন তাই সত্যি।
নবাব। আমি চলি। আবার আসব। খোদাহাফেজ।
দুর্মুখ। লারকানার নবাব নন্দন একটু চটে গেছেন।
ফতে। কুছ পরোয়া নেহি। এই দেখো আমার মাথাটা ঘুরে উঠলো। বাতাস দাও -পানি খাওয়াও।
হানাদারেরা সমানে মার খাচ্ছে
মুজিবনগর -১৮ই জুলাই বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বাংলার অপরাজেয় অগ্নি সন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে আতঙ্কগ্রস্থ হানাদার পাকসেনারা সমানভাবে মার খেয়ে চলেছে। এখানে প্রাপ্ত খবর অনুযায়ী গত দুই সপ্তাহে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় ১ হাজার পাক সেনা খতম এবং ৩শত জন আহত হয়েছে। এসময় মুক্তিবাহিনীর হাতে পাকসেনাদের ৫০ জন তাবেদার খতম হয়।
এছাড়া গত দুই সপ্তাহ বাংলাদেশের বিভিন্ন এলাকায় দশটি সেতু এবং তিনটি টেলিফোন লাইন মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বিধ্বস্ত হয়। এগুলো হানাদারেরা হত্যাযজ্ঞে ব্যবহার করছিল।
উল্লেখ করা যেতে পারে যে, মুক্তিযোদ্ধারা ইতিমধ্যেই কুষ্টিয়া জেলার মিরপুর মহাকুমা, যশোর জেলার নাভারন, ঝিকরগাছা টাঙ্গাইল জেলার চারটি থানা, দিনাজপুরের পচাগর, সিলেটের জৈন্তাপুর এলাকায় স্বাধীন বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলন করেন। তারা কুষ্টিয়ায় পাকহানাদারদের একটি ঘাঁটি ধ্বংস করে দিয়েছেন।
এরই মাঝে মুক্তিযোদ্ধারা হানাদার পাকসেনাদের হেডকোয়ার্টার ঢাকায়ও তাদের গেরিলা তৎপরতা জোরদার করেছেন। ঢাকা সহ বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের অবিরাম প্রচন্ড আক্রমণে হানাদার খানসেনারা ব্যতিব্যস্ত হয়ে পড়েছে এবং তারা ঢাকাসহ বিভিন্ন দখলীকৃত জেলার সদর দপ্তর রক্ষা করবে, না বিভিন্ন রণাঙ্গনে প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা জোরদার করবে তা এখন ঠিক করে উঠতে পারছে না। পরিস্থিতি খারাপ বুঝে জঙ্গিশাহী ঢাকায় কারফিউ জারি করেছে।
গত তিন মাসে মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে প্রায় ৫শত অফিসারসহ ২০ হাজারেরও অধিক পাকসেনা নিহত হয়েছে। বাংলাদেশের খান সেনার সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাওয়ায় জঙ্গিশাহী অবাঙালি যুবকদের নিয়ে রাজাকার বাহিনী গঠন করেও তাল সামলাতে পারছে না। কারণ মুক্তিযোদ্ধাদের গণবাহিনীই এসব রাজাকারদের ঠান্ডা করে দিচ্ছে ফলে রাজাকার বাহিনীর হাতে অস্ত্রশস্ত্র মুক্তিবাহিনী ও গণবাহিনী দখল করে নিচ্ছে।
বাংলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে বেধড়ক মার খাওয়ায় পাক জঙ্গিশাহী দিশেহারা হয়ে পড়েছে। ইচ্ছা থাকলেও আর সৈন্য সংখ্যা বৃদ্ধি করা যাচ্ছে না। পশ্চিম পাকিস্তানকে অরক্ষিত রেখে সেখান থেকে সৈন্য আনা সম্ভব হচ্ছে না। কারণ, ১৯৬৫ সালে লাহোর, পেশাওয়ার, শিয়ালকোর্ট কোয়েটায় ভারতের ঠেলা এবং হরহামেশা আফগানিস্তানের ঠেলার ধুকধুকানি এখনো থামেনি।
তাই এবার জঙ্গিশাহি অধিকৃত আজাদ কাশ্মীরের বাগ পালীন্দ্রি, রাওয়ালা কোর্ট হাজিরাত প্রভৃতি উপজাতীয় এলাকায় সৈন্যসংগ্রহ কেন্দ্র খোলার চেষ্টা করছে বলে জানা গেছে। প্রকাশ, সুধান নামক উপজাতি লোকেদের জোর করে সেনাবাহিনীতে ভর্তি করার প্রয়াস চলছে। কিন্তু সুধানের নেতা ইব্রাহিম খাঁ পাক জঙ্গিশাহীকে সমর্থন করেনা, তাই সুধানরা সামরিক বাহিনীতে লোক ভর্তির কেন্দ্র স্থাপনে বাধা দিচ্ছে। তবে পাকবাহিনীর যদি তাদের উপর জুলুম করে তাহলে তাদের ক্ষোভ বিস্ফোরিত হয়ে পড়বে।
এদিকে ঢাকা, কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম প্রভৃতি শহরে প্রকাশ্য দিবালোকে মুক্তিযোদ্ধাদের ওস্তাদী মার শুরু হয়ে গেছে। সম্প্রতি মুক্তিযোদ্ধারা ঢাকায় গভর্নর হাউসের গেটে গুলি ও বোমা নিক্ষেপ করে একজন প্রহরীকে খতম করেছেন। সিলেট শহরের মুক্তিযোদ্ধারা ডেপুটি কমিশনারের অফিস এবং বাংলোতে হামলা চালিয়ে কয়েকজনকে হতাহত করেছেন।
বাংলাদেশ অর্থমন্ত্রীর দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা
বাংলাদেশের জন্য সাহায্য চাওয়ার অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই
মুজিবনগর, ১৮ই জুলাই গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রীর জনাবএম মনসুর আলী গতকাল সন্ধ্যায় স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক ভাষণে সুস্পষ্ট ভাষায় ঘোষণা করেন যে বাংলাদেশ এবং পাকিস্তান দুটি সম্পূর্ণ স্বতন্ত্র রাষ্ট্র। সুতরাং বাংলাদেশের জন্য অর্থনৈতিক সাহায্য চাওয়ার কোনো অধিকার ইসলামাবাদ সরকারের নেই।
অর্থমন্ত্রী তার ভাষণে বিশ্বের যে সকল দেশ এবং সংস্থা পাক জঙ্গী পাক সরকারকে সাহায্য দিতে অঙ্গীকার করেছেন তাদের অভিনন্দন জানিয়ে দৃপ্ত কণ্ঠে আরো বলেন যে, একমাত্র সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নির্বাচিত প্রতিনিধিদের গঠিত স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে বাংলাদেশে বৈদেশিক সাহায্য আনতে পারে। তিনি আরো বলেন বস্তুত ইয়াহিয়া সরকারকে সাহায্য করা মানেই হচ্ছে বাংলাদেশে গণহত্যায় সক্রিয় অংশ নেয়া এবং বাংলাদেশ সরকার তা কিছুতেই বরদাশ্ত করবেন না।
বাংলাদেশ সরকারের অর্থমন্ত্রী তার সারগর্ভ দীর্ঘ ভাষণে বাংলাদেশের অর্থনীতিতে সুদৃঢ় ভিত্তির উপর প্রতিষ্ঠার উদ্দেশ্যে বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশন গঠন, বাংলাদেশের সীমিত পরিসরে সরকার কর্তৃক কতিপয় অর্থনৈতিক কর্মকর্তাকে গ্রহণের এবং বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধে দেশবাসীর কতিপয় রূপরেখা বিশ্লেষণ করেন।
অর্থমন্ত্রী কর্মপদ্ধতি ব্যাখ্যা প্রসঙ্গে জনাব মনসুর আলী মুক্তিযুদ্ধের যেসব বাঙালি সন্তান জীবন দিয়েছেন বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক সেসব বীর শহীদানের পরিবারবর্গের ভরণ-পোষণের দায়িত্ব গ্রহণের কথা ঘোষণা করেন। তিনি আরো বলেন যে মুক্তিযুদ্ধে যারা পঙ্গু কিংবা বিকলাঙ্গ হয়েছেন তাদের পরিবারবর্গকেও যথাসাধ্য অর্থনৈতিক সাহায্য দেবার জন্য সরকারসমূহ চেষ্টা করবেন।
শত্রু কর্তৃক বিপর্যস্ত অর্থনীতির পুনরুদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্ব বলে ঘোষণা করে অর্থমন্ত্রী বলেন, যুদ্ধোত্তর বাংলার অর্থনৈতিক কাঠামো প্রণয়নে যে কথাটি আমরা সবসময় মনে রেখেছি সেটি হচ্ছে; চরম দুঃখ কষ্ট সহ্য করেও বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। সুতরাং স্বাধীনতার ফল ভোগ করার অধিকার সবারই রয়েছে। এবং সেই লাভ থেকে তারা যাতে বঞ্চিত না হন তার যথোপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণেরও তিনি নিশ্চয়তা দান করেন।
হানাদার বাহিনীর সাথে হাত মিলিয়ে যে সমস্ত দুষ্কৃতিকারী বাস্তুত্যাগী বাঙ্গালীদের বাড়িঘর জোর করে দখল এবং ধন সম্পদ লুট করেছে তাদের বিরুদ্ধে তিনি কঠোর সতর্কবাণী উচ্চারণ করে বলেন যে, এদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা অবলম্বন করা হবে এবং প্রকৃত মালিককে তার ধনসম্পত্তি অবশ্যই ফিরিয়ে দেওয়া হবে।
তিনি দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে আরো বলেন যে, জাতির এই চরম সংকটময় মুহূর্তে নিঃসহায় মানুষের অধিকার যারা পশ্চিমী শত্রুর সহায়তায় কেড়ে নিয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের তাদের বাঁচার কোন অধিকার নেই।
বাংলাদেশের অর্থমন্ত্রী ব্যয় দেশবাসীর কর্তব্য ব্যাখ্যা করে তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে উৎপন্ন যাবতীয় দ্রব্য বয়কট, শত্রুর সাথে পূর্ণ অর্থনৈতিক অসহযোগিতা অব্যাহত এবং কলকারখানার চাকা বন্ধ রাখার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানান। তিনি এক কথায় শত্রুর অর্থনৈতিক কাঠামো ভেঙে দিয়ে তাকে কাবু করার আহ্বান জানান।
শত্রুকে খাজনা-ট্যাক্স না দেওয়ার জন্য দেশবাসীর প্রতি আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, যদি বাংলাদেশ একটি স্বাধীন সার্বভৌম রাষ্ট্রের সেহেতু ২৫শে মার্চের পর থেকে বাংলাদেশের যাবতীয় খাজনা-ট্যাক্স একমাত্র বাংলাদেশ সরকারেরই প্রাপ্য। কোনো বিদেশি সরকারের এ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ করার কোনো অধিকার নেই।
তিনি জনসাধারণকে গ্রামীণ অর্থনীতির উপর জোর প্রদান, গ্রামে গ্রামে কুটির শিল্প গড়ে তোলার, শত্রুকবলিত এলাকায় বৈদেশিক অর্থ উপার্জনকারী ফসলের উৎপাদন বন্ধ রাখার এবং গ্রামগুলিকে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে সম্পূর্ণ করার মাধ্যমে শত্রুর মোকাবেলা করার আহ্বান জানান।

মুক্তিযুদ্ধ ও সাম্প্রদায়িকতা
বাংলাদেশের স্বাধীনতাকামী সৈনিকদের একটি মাত্র লক্ষ মুক্তি। অত্যাচারী হানাদার পশুদের হাত থেকে মুক্তি লাভ এবং রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সাংস্কৃতিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা সমগ্র দেশবাসী উদ্দীপ্ত। দীর্ঘ ২৩ বছর পশ্চিম পাকিস্তানের শাসন বাঙালি জীবনে বিকৃতি অপচেষ্টায় মেতে উঠেছে, তার হাত থেকে পরিত্রান ও আমাদের মুক্তির অন্তর্গত। বাঙালি জাতিকে ধ্বংস করার জন্য সাম্প্রদায়িকতার প্ররোচনা সৈনিক কুল কলংকি ইয়াহিয়া খানের মোক্ষম অস্ত্র। কিন্তু মানবিকতার আদর্শে উজ্জীবিত প্রতিটি বাঙালি আজ ঘৃণ্য সাম্প্রদায়িকতা অস্ত্রের বিরুদ্ধে বলিষ্ঠ প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। মুক্তিযুদ্ধ তাই এখন শত্রুর কবল থেকে দেশের মাটিকে রক্ষা করবার যুদ্ধ এবং সঙ্গে সঙ্গে সাম্প্রদায়িকতা জাতি ও বর্ণগত বৈষম্যের হিংস্রতা থেকে বাঙ্গালীদের মুক্ত করার যুদ্ধ।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম নস্যাৎ করতে কুখ্যাত ইয়াহিয়া সরকারের ষড়যন্ত্রের অভাব নেই। এর জন্য তারা মানব ইতিহাসের ঘৃণ্যতম পথটি বেছে নিয়েছে। এই জঘন্য ও কদর্য পথ হচ্ছে সাম্প্রদায়িকতা। কিন্তু সাম্প্রদায়িকতার কর্দমাক্ত পথে ইয়াহিয়া সরকারের সামরিক গাড়ির চাকা আজ স্তব্ধ। এই হীন গলিত মনোভাব নিয়ে যুদ্ধ জয়ের গন্তব্যে উত্তরণ, আজ তার পক্ষে সুদূরপরাহত। ইয়াহিয়ার সাম্প্রদায়িকতাবাদ বুমেরাং হয়ে ফিরে এসে পাকিস্তানকেই আত্মঘাতী করে তুলেছে। পাঞ্জাবীও বেলুচির এখন পরস্পরের মুখোমুখি শক্তি পরীক্ষার প্রতীক্ষায়।
অথচ শেখ মুজিবুর রহমানের অনুসৃত নীতি ছিল সর্বপ্রকার সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটন। পরিপূর্ণ মানবিকতার বিকাশ এর ধর্ম সম্প্রদায় গত তারতম্যের যে কোন পদ্ধতিতে প্রদর্শিত বিকারকে শেখ মুজিব ধ্বংস করেছিলেন। এজন্যেই তথাকথিত ধর্ম ব্যবসায়ী রাষ্ট্র পাকিস্থানের ভিত্তিমূল কেঁপে উঠেছিল। কারণ প্রতিক্রিয়াশীল চক্র কোনদিনও ধর্মকে একই সর্বরোগ সংহার কে হাতিয়ার ছাড়া আর কিছুই ভাবতে পারেনি। মানুষের কল্যাণে নিয়োজিত ইসলাম ধর্মকে এর সকল সমস্যা সমাধানের চাবিকাঠি হিসেবে বিকৃত ভাবে ব্যবহার করেছে।
২৫শে মার্চ এর আগের কথায়ই আসুন। ঐক্যবদ্ধ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যখন শেখ মুজিবুর রহমানের মধ্যে তাদের আশা-আকাঙ্ক্ষা কেন্দ্রীভূত করেছিল, কুচক্রীমহল তখন থেকেই গোপনে তৎপর হয়েছে সাম্প্রদায়িক বিষ উদগীরণ করে বিশাল জনতার সংগ্রাম কে হিংস্রতার আবর্তে তলিয়ে দেবার অপচেষ্টায়। ঢাকার মোহাম্মদপুর, চট্টগ্রামের পাহাড়তলী, রংপুরের সৈয়দপুরে স্পষ্টভাবে উস্কানি দিয়ে মুসলমানদের মধ্যে বাঙালি-অবাঙালি সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধাতে পর্যন্ত তাদের চেষ্টার অন্ত ছিল না। কিন্তু ৭ ই মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় শেখ মুজিবুর রহমান সিংহের মত গর্জন করে বলেছিলেন,’বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ তিনি যে ভাষাতেই কথা বলুন না কেন, সবাই বাঙ্গালী ,সবাই আমাদের ভাই।’ এই বলিষ্ঠ ও বজ্র দৃপ্ত ঘোষণা ইয়াহিয়া সরকারের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদটি মুহূর্তে ধূলিসাৎ হয়ে গিয়েছিল। সাম্প্রদায়িকতার সহস্রা প্রচারণায় সরল-সহজ মানুষের মধ্যে বিষ ঢুকানো হয়তো অসম্ভব নয়। কিন্তু একটি মাত্র বাক্য উচ্চারণ করে আত্মঘাতী বাঙালি অবাঙালি কে আধঘণ্টার মধ্যে নির্বাচন করে তোলার দৃষ্টান্ত স্থাপন একমাত্র শেখ মুজিবুর রহমানের পক্ষেই সম্ভব।
২৫ শে মার্চের পর ইয়াহিয়ার সামরিক সরকার সাম্প্রদায়িকতার নির্মম অস্ত্রে আবার শান দিয়েছে। বাঙালি অবাঙালি নয় এবারের হিন্দু বনাম মুসলমান। অসহায় নিরপরাধ সাধারণ মানুষ ইতিহাসের এই করুণতম ষড়যন্ত্রের শিকারে পরিণত হয়েছে। ইসলাম- অর্থ শান্তি এই ধর্মকে সাম্প্রদায়িকতার ছুরিকাঘাতে রক্তাক্ত করেছে পাপাচারী সামরিক সরকার। কিন্তু হিন্দু-মুসলমানদের ধর্মগত সাম্প্রদায়িক বিভেদ এদের শেষ কথা নয়। সম্প্রদায়ের নতুন প্রবক্তা ইয়াহিয়ার মতে আওয়ামী লীগের সমর্থনকারীরা একটি সম্প্রদায় সুতরাং ‘হে মুসলিম লীগ ও জামাত কর্মীগণ, তোমরা এদের খতম করো।’বাংলাদেশের সাত কোটি মানুষ বর্বর চক্রান্তের অভিশাপে বারবার দিশেহারা হয়ে উঠেছে।
কিন্তু ভবিতব্যের অনিবার্য প্রভাবে আজ ইয়াহিয়া খানের সাম্প্রদায়িকতা বাদের ষড়যন্ত্রের তাদেরই মরণ গহ্বরে রূপান্তরিত। ইয়াহিয়া নিজেই এখন তার উদ্ভট সাম্প্রদায়িক চেতনার করালগ্রাসে পতিত। ভাষাগত তারতম্য কে সামনে রেখে পাঞ্জাবী ও বেলুচ সামরিক ও বেসামরিক জনগণ হিংস্রতার অস্ত্র ধারণ করেছে। অন্যদিকে, পাকিস্তানী শাসক মন্ডলের সাম্প্রদায়িকতাবাদ এর ব্যাখ্যাই শেষ পর্যন্ত ছোবল দিয়ে বসেছে ভুট্টোর তথাকথিত বামপন্থী ও জামাতের ডানপন্থী নেতাদের শিরে। অন্যের শির কাটতে গিয়ে ইয়াহিয়ার নিজের শিরণাস্ত্র এখন ধুলায় লুণ্ঠিত।
ইয়াহিয়ার সাম্প্রদায়িক ষড়যন্ত্র আজ ধীরে ধীরে চালান হয়ে যাচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানের, বাংলাদেশ সাম্প্রদায়িকতার নয়। মেশিনগানের গুলি দিয়েও একটি অস্বাভাবিক বিভ্রান্তিকে চিরকাল ছড়িয়ে রাখা যায় না। এজন্যেই সম্প্রদায়ের নিষ্ঠুর মূলমন্ত্রে সামরিক নরপশুরা বাঙ্গালীদের মুগ্ধ করতে পারেনি। সাম্প্রদায়িকতার উদ্ভট তথ্যপ্রবাহ পরস্পর সহানুভূতিসম্পন্ন প্রতিটি বাঙালির কাছে আজ কোন উত্তেজনা জানাতে সক্ষম নয়।
স্বাধীনতা সংগ্রামে বাঙালিরা জাতি ও ধর্মগত ভেদাভেদের জবাব দিয়েছেন দুইটি প্রান্ত থেকে। প্রথমত, বাঙালির পরস্পরের প্রতি মমত্ববোধ প্রকাশের মাধ্যমে। দ্বিতীয়তঃ মুক্তিযোদ্ধারা বুলেটের মুখে এর প্রতিউত্তর রেখেছেন। ঢাকা, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে মুক্তিযোদ্ধাগণ সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের অবশিষ্ট অংশকে প্রাথমিক শত্রু হিসেবে বিবেচনা করে নির্মম হস্তে দমন করছেন। অতি শীঘ্র সমগ্র প্রদেশব্যাপী মুক্তিযোদ্ধাদের তৎপরতা সাধারণ মানুষের স্বস্তি ও শান্তি ফিরিয়ে আনবে।
মুক্তিযুদ্ধ একটি সামরিক যুদ্ধ মাত্র নয়, শুধু পৈশাচিক শত্রুসেনার হাত থেকে জনগণের মুক্তি লাভই নয়। ইয়াহিয়ার কল্যাণে প্রতিষ্ঠিত ও সামাজিক বিকৃতির হাত থেকে মুক্তি লাভের জন্য আজ আমাদের সংগ্রাম সার্থক করে তুলতে হবে। আওয়ামী লীগের অনুসৃত পদ্ধতিতে ধর্ম, জাতি, বর্ণ সম্প্রদায়ের সকল বিকৃতিকে সমূলে উৎখাতের পরিকল্পনায় সহ-অবস্থানের এক প্রজ্বল শেখ মুজিবুর রহমান ঘোষণা করেছিলেন। সে মানবিকতার সুন্দরতম আদর্শ পশুদের মনকে উদ্বুদ্ধ করতে পারেনি, বরং তাদের মনে ভীতির সঞ্চার করেছিল, পশুর পক্ষে পাশব শক্তির উন্মাদনাই সম্ভবত স্বাভাবিক। কিন্তু মুক্তিসেনারা মানবিকতার অস্ত্র নিয়ে এই পশুদের বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়িয়েছে, পশু কে হত্যা করার অন্য মনুষ্যত্বই সর্বাধিক কার্যকরী হয়েছে। এজন্য বাংলাদেশের সকল মুক্তাঞ্চলে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে সামরিক অস্ত্র প্রয়োগ করা হচ্ছে। সাত কোটি মানুষ তাই সম্প্রদায়গত বিরোধ সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে একতাবদ্ধ হয়েছেন। বাংলাদেশের আজকের এই যুদ্ধে একটি জাতির সামগ্রিক ভাবে বেঁচে ওঠার সর্বাত্মক যুদ্ধ। জীবন ধারার স্বাভাবিক বৃত্তিকে প্রতিষ্ঠা করতে দীর্ঘকালীন যুদ্ধেও বাঙালি কবি প্রেরণা যুগিয়ে যান।
‘এখনো বুকের মধ্যে কয়েকটি বিষাক্ত কাঁটা বিঁধে আছে,
ফোঁটায় ফোঁটায়,
বৃক্ষের রসের মতো এখনো আমার
মর্মমূলে
ঝরে যাচ্ছে রক্তধারা
এখনো অসংখ্য দুর্গজয়
সমাধান হয়নি
এখনও অনেক যুদ্ধ পড়ে আছে….
এখন অনেক যুদ্ধ পড়ে আছে।’
বাংলার বুকে শোষণের চাকা আর ঘুরবে না
র্যাটল নামে এক ধরনের অদ্ভুত বিষধর সাপ আছে। কাউকে ছোবল দেবার জন্য এরা মাঝে মাঝে চাতুরির আশ্রয় নেয়। রাটল সাপের লেজে অদ্ভুত ধরনের। লেজের শেষের দিকটা ক্রুর মতো প্যাঁচানো এবং রঙিন। সমস্ত দেহটাকে তৃণের আড়ালে ঢাকা রেখে শুধুমাত্র লেজের অংশটুকু বের করে মাটি থেকে একটু উপরে দোলাতে থাকে। ঠিক এমনই সময় কোন মানুষ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় হয়তো থমকে দাঁড়ায়। লেজটকে তার কাছে মনে হয় ছোট্ট কোন পতঙ্গ জাতীয় প্রাণী। কিছুক্ষণ সম্মোহিতের মত তাকিয়ে থাকার পর সেই লোকটি হয়ত আরেকটু এগিয়ে আসে এবং আওতার মধ্যে এলেই র্যাটল তার বিষধর দাঁত দিয়ে ছোবল বসিয়ে দেয়।
পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্রের শোষণ পদ্ধতিও অনেকটা এই রকমের। তারা র্যাটল সাপ সেজে দিনের-পর-দিন বাংলার মানুষরের অর্থনৈতিক এবং সাংস্কৃতিক ভিত্তির উপর ছোবল মেরেছে। এবং এরই ফলে গত ২৩ বছরে পশ্চিম পাকিস্তান এবং বাংলার মধ্যে গড়ে উঠেছে বৈষম্যের পাহাড়। আইয়ুবী আমলের ডিকেড অফ ডিফেন্স-এর চক্রান্তে পড়ে সেই বৈষম্য একটা ক্লাইম্যাক্সে এসে পৌঁছে ছিল। বাংলার মানুষের জাগ্রত চেতনা বাংলার বুকে যে গণ- আন্দোলনের প্রবল ঢেউ তুলেছিল তার চাপে আইয়ুব খান বাধ্য হয়ে সামরিক শাসন জারি করে ক্ষমতা হস্তান্তর করেছিল বর্বর ইয়াহিয়ার কাছে। এ শুধু ক্ষমতারই হস্তান্তর নয়-এবছর শোষণ চক্রটাকে ইয়াহিয়ার হাতে তুলে দেয়া, কিন্তু তার দ্বারা সে চক্রটাকে ঘোরানো সম্ভব হলো না। জাগ্রত বাংলার বুকে আর কোনদিনই শোষনের সে চাকা ঘুরবে না। তাই আক্রোশে মরিয়া হয়ে সারা বাংলা জুড়ে বর্বর ইয়াহিয়া সরকার পাশবিক হত্যাকাণ্ড ও লুণ্ঠন চালিয়ে যাচ্ছে। কিন্তু এ বেশি দিন টিকবে না টিকতে পারেনা। কারণ বাংলা জুড়ে বিদেশিদের এই অমানুষিক অত্যাচার দিনের-পর-দিন বাংলার মানুষ ও মুক্তিবাহিনীর পায়ের তলায় নিষ্পেষিত হচ্ছে।
ওদের শোষণ পদ্ধতিটা র্যাটল সাপের মত
বলছিলাম, পশ্চিম পাকিস্তানি শোষকগোষ্ঠীর শোষণ পদ্ধতি টা ছিল অনেকটা র্যাটল সাপের মত। গত ২৩ বছর ধরে তারা ধর্ম ও সংহতির দুলিয়া বাংলার মানুষকে সম্মোহিত করার চেষ্টা করে আসছে এবং সুযোগ বুঝে শোষণ করেছে। র্যাটল সাপ যেমন রঙিন লেজ দুলিয়ে মানুষকে আকৃষ্ট করে ছোবল মারে ঠিক তেমনি। অনেক সময় দেখা যায় ছোবল যদি সেই মানুষের গায়ে না লাগে তাহলে রেটল বিশেষ কায়দায় থলেতে চাপ সৃষ্টি করে দাঁতের ফাঁক দিয়ে সেই মানুষটির দিকে আক্রোশে বিষ ছুঁড়ে মারে। পশ্চিম পাকিস্তানি র্যাটল যখন শোষণের ছোবল বসাতে পারছে না ঠিক তখনই তারা বাংলার বুক জুড়ে অত্যাচার, অনাচারের বিষ ছুড়ে মারছে।
কিন্তু আজ আর তাতে লাভ নেই। ধর্ম ও সংহতির আবরণের অংশটুকু যে শোষণের একটা চক্রান্ত তা সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে অত্যন্ত স্পষ্ট। তাই আজ বাংলার মানুষ, বাংলার মুক্তিযোদ্ধারা বাংলার বুক থেকে পশ্চিম পাকিস্তানি র্যাটলটাকে সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত করে শোষনহীন স্বাধীনবাংলাকে নিয়ে নিশ্চিন্তে বেঁচে থাকতে চায়।
জঙ্গীশাহীর সাথে কোন আপোষ হতে পারে না
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমেদ সম্প্রতি রয়টারের প্রতিনিধির সাথে এক সাক্ষাৎকারে দ্ব্যর্থহীন কণ্ঠে বলেন যে, জঙ্গী ইয়াহিয়ার সাথে কোন আপোষেই চলতে পারে না। তিনি আরো বলেন যে, ইয়াহিয়ার জঙ্গী ফয়সালার সাথে বাংলাদেশ সরকারের কোনো সম্পর্ক নেই।
পাক সরকার এবং বাংলার মুক্তি সংগ্রামীদের মধ্যে পুনর্মিলনের কোন সম্ভাবনা আছে কিনা জিজ্ঞেস করা হলে তিনি বলেন, ইয়াহিয়া যা করতে পারে তাহল অবিলম্বে সৈন্য অপসারণ ও গণহত্যা বন্ধ করা। এবং এটাই একমাত্র সমঝোতা।
জনাব আহমেদ আরো বলেন, বাংলাদেশের নিজস্ব সরকার রয়েছে, ইয়াহিয়া ও তার জঙ্গী সরকারের সাথে আমাদের কোন সম্পর্ক থাকবে না। আমরা একটি স্বাধীন জাতি।
তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার সামরিক নিধনযজ্ঞের দরুন যদি গণতন্ত্র বাঁচতে না পারে তাহলে মানুষ বৃহৎ শক্তি তথা গণতান্ত্রিক শক্তির উপর থেকে আস্থা হারিয়ে ফেলবে।
তিনি পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দি বাংলার অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে মুক্তি দানের উদ্দেশ্য একজনকে চাপ দেওয়ার জন্য বিশ্ব রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি পাক জঙ্গিশাহীকে সামরিক ও অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারকে স্বীকৃতি দানের জন্য বিশ্বের বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান।
তিনি পশ্চিম পাকিস্তানে বন্দি আওয়ামী লীগ প্রধান শেখ মুজিবুর রহমানকে অবিলম্বে মুক্তি দানের ব্যাপারে বিশ্বের রাষ্ট্রসঙ্ঘের প্রতি আহ্বান জানান।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!