You dont have javascript enabled! Please enable it! 1971.07.30 | জয় বাংলা ৩০ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা - সংগ্রামের নোটবুক

জয় বাংলা ৩০ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

বাংলাদেশের মানুষ বরদাস্ত করবে না
বঙ্গবন্ধু বিচার করবে, একথা প্রচার করছে ইসলামাবাদের খুনিচক্র। কিন্তু এই অধিকার তাকে কে দিয়েছে? ইতিহাসের পথ রোধ করে যারা ক্ষমতার দাপটে উন্মাদ হয়ে উঠে বাংলার সরলপ্রাণ মানুষ তাদের শায়েস্তা করেছে। আর তাদেরই অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু আজ বন্দিদশায় কাটাচ্ছেন জঙ্গিশাহীর কারান্তরালে। কিন্তু তাকে বিচার করবার অধিকার তাদের নেই। জবরদস্তি করে এ প্রহসন করলে বাংলাদেশের মানুষ তাকে বরদাস্ত করবে না। উদ্ধত আচরণের সমুচিত জবাব দেবেই বাংলার মানুষ।
স্বাধীন বাংলাদেশে একটি সত্য। পৃথিবীর মানচিত্রে এ এক সার্বভৌম নবরাষ্ট্রের নাম। ইতিহাসে এ নাম সাড়ে সাত কোটি মানুষের রক্তের অক্ষরে লেখা চিরভাস্বর। এই দেশেরই প্রতিটি মানুষের প্রাণ প্রিয় সুহৃদ বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। তাকে দেশদ্রোহীর অপরাধে কাঠগড়ায় দাঁড় করাতে চায় এমন ধৃষ্টতা কার? পাকিস্তান নামের যে দেশটি আজ মৃত, তারেই নরপতি ইয়াহিয়া যদি এই দুঃসাহস নিয়ে বিশ্বের মানবগোষ্ঠীকে বোকা বানাতে চায় আর বাংলার সার্বিক মুক্তির অপ্রতিরোধ্য সংগ্রামকে করতে চায় দুর্বল তবে জেনে রাখ ইয়াহিয়া তোমাদের জবাবের দিন সমাগত। এবারেতে প্রতিশোধ নিয়েছি, পালাবার পথ দেব না তোমাদের।
জঙ্গী পাক সরকারের হাতে মাতৃভূমি বাংলাদেশ থেকে দেড় হাজার দূরে পশ্চিম পাকিস্তানের বন্দি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। স্বাধীন-সার্বভৌম বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর পরিবারবর্গের আশু মুক্তির জন্য জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, সোভিয়েত রাশিয়া, গ্ৰেট ব্রিটেন, গণচীন, ভারত, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের বার্তা প্রেরণ করে তাদের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।
এছাড়া গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ও পররাষ্ট্রমন্ত্রী খন্দকার মোশতাক আহমদ, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রপ্রধান ও জাতিসংঘের আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। বাংলাদেশ ছাত্রলীগের সভাপতি নুরে-আলম সিদ্দিকী ও সাধারণ সম্পাদক শাহজাহান সিরাজ যুবশক্তির অদম্য প্রেরণার অফুরন্ত উৎস বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে বিশ্বের যুবসমাজের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। নেতৃবৃন্দ তাদের বিবৃতিতে বলেন যে, স্বাধীন সার্বভৌম বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বিচার করার আইন সঙ্গত অধিকার আজ জঙ্গী সরকারের নেই।
মওলানা ভাসানীর নিঃসঙ্কোচ ঘোষণা
একমাত্র বিশ্বাসঘাতকরাই বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করবে
বাংলাদেশ ন্যাশনাল আওয়ামী পার্টির নেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী বলেছেন, আওয়ামী লীগকে বাদ দিয়ে বাংলাদেশের বামপন্থী দল সমূহের ঐক্যবদ্ধ ফ্রন্ট গঠনের কথা তিনি কখনও বলেনি।
এক বিবৃতিতে মৌলানা ভাসানি বলেন, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর থেকেই তিনি স্বাধীন সার্বভৌম সমাজতান্ত্রিক বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার কথা বলে আসছেন। জাতি, ধর্ম, নির্বিশেষে বাংলাদেশের জনগণের অর্থনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছেন।
মৌলানা ভাসানি বলেন -একমাত্র বিশ্বাসঘাতক মীরজাফররাই তাদের স্বার্থ সিদ্ধির জন্য মুক্তিসংগ্রামকে বিভেদ সৃষ্টির চেষ্টা করবে।
তিনি বলেন, আওয়ামী লীগের সাথে সকল রাজনৈতিক দলই বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে আজ ঐক্যবদ্ধ এই সংগ্রাম হবার নয়।
তিনি বলেন, জয় আমাদের হবেই।
পাকিস্তানকে উত্তর না দিলে ঠিক হবে না
খান আবদুল গফফর খান
পাখতুন নেতা খান আবদুল গফফর খান বলেছেন পাকিস্তান একটি অনিষ্টকারী শিশু। তাকে একটা চড় না মারা পর্যন্ত সে ঠিক হবে না। বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনার উল্লেখ করে তিনি বলেন, বিশ্ব রাষ্ট্রসমূহ এ ব্যাপারটাকে একটা তামাশা ভেবে মজা দেখছেন। নিপীড়িত মানুষের প্রতি তাদের কোনো সহানুভূতি নেই। তিনি আরো বলেন, এ পৃথিবীটা পাপী আর স্বার্থান্বেষীতে ভরা।
জাতিসংঘের কাছে বাইশটি সংস্থার আবেদন
আন্তর্জাতিক বেসরকারি ২২টি সংস্থা বাংলাদেশের পাক জঙ্গীশাহীর নারকীয় ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন এবং জঙ্গি ইয়াহিয়া সরকার কর্তৃক বাংলাদেশে মানবাধিকার এবং মৌলিক স্বাধীনতা লঙ্ঘনের ব্যাপারে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য জাতিসংঘের ‘বৈষম্যমূলক আচরণ এবং সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অধিকার রক্ষা’ বিষয়ক সাব-কমিটির কাছে আবেদন জানিয়েছেন।
জাতিসংঘের মাধ্যমে নয়া চক্রান্ত
বাংলাদেশ এবং ভারতের সীমান্ত জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক দল মোতায়েন করার প্রস্তাব করা হয়েছে। জাতিসংঘের উদ্দেশ্য উদ্বাস্তু পুনর্বাসন দপ্তরের হাই কমিশনার প্রিন্স সদরুদ্দিন বাংলাদেশের জাতিসংঘের ৪০ জন পরিদর্শক প্রস্তাব ও করেছেন। উদ্দেশ্য হিসেবে বলা হয়েছে, ভারতে চলে গিয়েছেন এমন লক্ষ লক্ষ শরণার্থী যাতে নিরাপদে স্বদেশে ফিরে আসতে পারেন এবং তারা পুনর্বাসিত হন তার তদারকি করা। দৃশ্যতঃ প্রস্তাবটি খুবই নির্দোষ ও সাধু। কিন্তু একটু তলিয়ে দেখলেই বোঝা যাবে দৃশ্যতঃ সাধু ও নির্দোষ প্রস্তাবটি আড়ালে রয়েছে জাতিসংঘ ও তার প্রধান মুরুব্বি যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের নতুন চক্রান্ত। কেবল একটি প্রস্তাব এসেছে তাদের পাকিস্তান ঘেঁষা এজেন্ট প্রিন্স সদর উদ্দিনের মারফত। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার এবং ভারত সরকার ও সঙ্গে সঙ্গে জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক মোতায়েনের ‘সাধু প্রস্তাব’ প্রত্যাখ্যান করেছেন।
কিছুদিন আগে জাতিসংঘের তরফ থেকে বাংলাদেশের উদ্বাস্তু দের পরিদর্শনের নামে ভারত, পাকিস্তান ও অধিকৃত বাংলাদেশ সফরে এসে ও সদরুদ্দিন নানা উল্টাপাল্টা কথা বলে গেছেন। উদ্দেশ্য ছিল, সম্ভবতঃ তার দোস্ত ইয়াহিয়ার পর গণহত্যার পাপ যথাসম্ভব কমিয়ে দেখানো।
প্রিন্স সদর উদ্দিনের কথা থাক। বাংলাদেশ ও ভারতের জাতিসংঘের পর্যবেক্ষক মোতায়েন করার প্রস্তাব শুনে অতি দুঃখের মধ্যেও আমাদের একটি পুরনো গল্প মনে পড়ছে। একবার এক সার্জেনের কাছে একজন রোগী দেখে বললেন, এমন কিছু বড় অপারেশন নয়। এখনই তিনি রোগীকে রোগ মুক্ত করে দেবেন। ঘটা করে সার্জন রোগীর দেহে অস্ত্রোপচার করলেন। প্রায় ঘণ্টাখানেক পরে কক্ষের বাইরে এসে রোগীর রুদ্ধশ্বাস আত্মীয়দের বললেন,”আপনাদের কি বলব অপারেশন অত্যন্ত সাকসেসফুল হয়েছে। তবে দুঃখের কথা এই টুকু যে, রোগী মারা গেছেন।”
বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার দস্যুচক্র বেপরোয়া গণহত্যা চালাচ্ছে আজ চার মাস হয়ে গেল। দখলীকৃত বাংলাদেশ এখন ধ্বংসস্তূপে পরিণত। এখনো বাংলা জীবন ও সম্পদ ধ্বংসের কোন সঠিক হিসাব হয়নি। বেসরকারি হিসাবে আশঙ্কা করা হয়েছে, মৃতের সংখ্যা দশ লাখ, গুরুতরভাবে আহত সংখ্যা ২৫ হাজার, সাধারণভাবে আহত ৩ লাখ, নির্যাতিতা নারীর সংখ্যা ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার। আর বাংলাদেশ থেকে হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান নির্বিশেষে শরণার্থী ভারতের ঠেলে দেওয়া হয়েছে ৭০ লাখের উপরে। এই পৈশাচিক ধ্বংসযজ্ঞ হত্যাকাণ্ড যখন চলছিল, তখন বাংলাদেশের নেতারা বারবার জাতিসংঘ ও বৃহৎ রাষ্ট্রপতির কাছে মানবতা ও বিশ্ব শান্তির নামে আকুল আবেদন জানিয়েছেন, এই শিশু ঘাতী ও নারীঘাতী বর্বরতা বন্ধে সক্রিয় হন, বাংলাদেশ মানবতার স্বার্থে জাতিসংঘের হস্তক্ষেপ চাই। জাতিসংঘ কোটি কোটি মানুষের এই বিপন্ন আর্তনাদের কান দেননি। আর বৃহৎ রাষ্ট্রবর্গের মধ্যে আমেরিকার জাহাজ বোঝাই করে অস্ত্র পাঠিয়েছে-এই অস্ত্র নিরীহ-নিরস্ত্র নর-নারী হত্যার কাজে লাগানো হবে এই তথ্য জেনেও। এই দীর্ঘ চার মাস পরে -যখনই ইয়াহিয়া চক্রের ধ্বংসপ্রায় সমাপ্ত হয়ে এসেছে, তখন জাতিসংঘ কর্তৃপক্ষ পর্যবেক্ষক পাঠাতে চান কি প্রয়োজনে? সেখানে স্তুপাকৃত মৃতদেহের সংখ্যা গুণতে? ধ্বংসস্তুপে পরিণত দখলীকৃত বাংলাদেশের জাতিসংঘের তথাকথিত ত্রাণকার্যের মহড়া দিতে? হ্যাঁ তাতে জাতিসংঘের ত্রাণকার্য অপারেশন অবশ্যই সাকসেসফুল হবে, কিন্তু রোগী বাঁচবে না; অর্থাৎ বাংলাদেশের ধ্বংস ও চূড়ান্ত বিপর্যয় ঠেকানো যাবে না। ধ্বংসস্তূপ ও মৃতদেহের স্তুপের উপর দাঁড়িয়েই জাতিসংঘের পর্যবেক্ষকরা তখন হয়তো দাবি করবেন, বাংলাদেশ ধ্বংস হয়ে গেছে তাতে আমাদের কি? আমাদের অপারেশন (অভিযান) সাকসেসফুল।’
জাতিসংঘ নামক একটি বিশ্ব প্রতিষ্ঠান যদি যথাযথই কোন অস্তিত্ব থাকত, তাহলে তারা ভারতে তো দূরের কথা বাংলাদেশেও পর্যবেক্ষক পাঠাবার নাম এখন মুখে আনতেন না। জাতিসংঘের কর্তা ব্যক্তিদের স্মরণ আছে কিনা আমরা জানি না, এপ্রিল -মে মাসের দিকে দখলীকৃত বাংলাদেশ ইয়াহিয়ার গণহত্যাযজ্ঞ যখন পুরোদমে চলছে, তখন জাতিসংঘ সেখানে ত্রাণ সামগ্রী প্রদান এবং নিজেদের তদারকিতে তা বন্টণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিল। ইয়াহিয়া তখন আন্তর্জাতিক রেডক্রসের একটি টিমকে শুধু পাকিস্তান থেকেই বহিস্কার করে দেয় নি, উথান্টের প্রস্তাবেও সাফ না বলে দিয়েছিল। তারপর জাতিসংঘের পক্ষ থেকে আবার নরম ভাষায় প্রস্তাব দেয়া হলো, জাতিসংঘের ত্রাণ সামগ্রী ইয়াহিয়ার সরকারি সংস্থাগুলোই বন্টন করবে, তবে তদারকি করবে জাতিসংঘের লোকেরা। এই প্রস্তাব ও প্রথমে ইয়াহিয়ার মনঃপুত হয়নি। ইয়াহিয়ার কাছে জাতিসংঘ আমল পায়নি। অন্যদিকে তার পৈশাচিক গণহত্যা ও গণ উৎপাদন বন্ধ করতেও জাতিসংঘ পারেননি। আক্রমণকারীরা অত্যাচারীর বর্বরতা বন্ধ করতে সাহসের সঙ্গে না এগিয়ে দীর্ঘ চার মাস পর এখন সক্রিয় হয়েছেন, পর্যবেক্ষক নিয়োগের নামে -আক্রান্ত পক্ষের আত্মরক্ষার প্রস্তুতিও উদ্যোগ-আয়োজন নষ্ট করার জন্য। এই না হলে আর জাতিসংঘ! আসলে জাতিসংঘ নামক বিশ্ব সংস্থাটির বহুদিন আগেই অস্তিত্ব লোপ পেয়েছে। নিউ ইয়র্কে জাতিসংঘ সদর দপ্তর নামে যে ভবনটি আছে তা প্রকৃতপক্ষে একটি বৃহৎ শবাধার। আর এ শবাধার বহনের জন্য সর্বাগ্রে এগিয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের নিক্সন অ্যাডমিনিস্ট্রেশন। এবং সর্বশেষ ব্যক্তি নিমন্ত্রিত হয়েছেন পাকিস্তান নামক একটি অধুনালুপ্ত রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া।
সবচাইতে মজার ব্যাপার এই যে, জাতিসংঘ ভারত সীমান্তে ও পর্যবেক্ষক মোতায়েন করতে চেয়েছেন। এ যেন মামার বাড়ির আবদার। ভারত সরকার অবশ্য সঙ্গে সঙ্গে এ ব্যাপারে না বলে দিয়েছেন। তথাপি প্রশ্ন থেকে যায়, ভারতে পর্যবেক্ষক পাঠিয়ে কি হবে? গৃহস্থবাড়িতে ডাকাত পড়েছে। ডাকাত না বেঁধে, গৃহস্ত বাধার এমন চমৎকার প্রস্তাব আর কখনো শোনা যায়নি। অপরাধ করেছে পাকিস্তান। ৭০ লাখ শরণার্থী সে ভারতের ঘাড়ে চাপিয়েছে। ভারতে শরণার্থীদের সাময়িকভাবে আশ্রয় দিয়ে বিরাট মানবতাবাদি ভূমিকায় পরিচয় দিয়েছে। এক্ষণে অপরাধী পাকিস্তানের সঙ্গে মানবতাবাদের ভারতকে এক আসনে বসিয়ে ভারতের ঘাড়ে পর্যবেক্ষক বসিয়ে দেয়ার প্রস্তাব বাতুলতা না নতুন চক্রান্ত পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে তা বিচার্য। এখানে আরো একটি কথা বলা দরকার; শরণার্থীরা ভারতে গিয়ে বিপন্ন হয়নি, তারা বিপন্ন হয়েছে পাকিস্তান ঘেঁষা জাতিসংঘ প্রতিনিধি-পৃন্স সদরুদ্দিন ইয়াহিয়ার অনেক দুষ্কর্ম চাপা দিতে চাইলেও বলতে বাধ্য হয়েছেন,”পাকিস্তানে ফিরে গেলে শরণার্থীদের জীবন বিপন্ন হবে না, এমন গ্যারান্টি আমি দিতে পারি না।’ যে স্বীকারোক্তির একমাত্র অর্থ, পাকিস্তানে এখনো অত্যাচার চলছে এবং দেশ ত্যাগীদের প্রত্যাবর্তন সেখানে নিরাপদ নয়। এই অবস্থায় জাতিসংঘের যদি সত্যই কোনো দায়িত্ববোধ থাকে, তাহলে তাদের একমাত্র কর্তব্য হচ্ছে অধিকৃত বাংলাদেশ থেকে অবিলম্বে অত্যাচারী হানাদার বাহিনী অপসারণের ব্যবস্থা করা এবং লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর স্বদেশ প্রত্যাবর্তন নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারকে তাদের বৈধ কর্তৃত্ব সম্প্রসারণে সাহায্য করা। তা না করে শরণার্থীদের জন্য মেকি দরদ দেখিয়ে বাংলাদেশে এবং ভারতে পর্যবেক্ষক প্রেরণের প্রস্তাব আনলে নতুন মোড়কে একটি পুরনো সাম্রাজ্যবাদী চক্রান্ত মাত্র। জাতিসংঘ এই চক্রান্তেরই বহুব্যবহৃত মাধ্যমে।
জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক ও জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েনের চমৎকার ফল বিশ্ববাসী একবার মধ্যপ্রাচ্যে এবং আরেকবার কঙ্গোতে প্রত্যক্ষ করেছে। জাতিসংঘের চমৎকার পর্যবেক্ষণ ও খবরদারি প্যালেস্টাইনেও দেখেছে। কঙ্গোতে বিপুল ভোটে নির্বাচিত প্রথম জাতীয় সরকারের প্রধানমন্ত্রী লুমুম্বা দেশের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা পুনঃপ্রতিষ্ঠার জন্য জাতিসংঘ বাহিনীকে আমন্ত্রণ -জানিয়ে নিজ দেশে নিয়েছিলেন। জাতিসংঘ বাহিনীর নাকের ডগায় দাঁড়িয়ে কঙ্গোর ফ্যাসিস্ট চক্র মহান দেশনায়ক লুমুম্বাকে পৈশাচিক নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করেছে। জাতিসংঘ এই হত্যাকান্ডের নীরব দর্শক ছিলেন মাত্র। সুতরাং বাংলাদেশের শরণার্থীদেরকে সেবার অসিলায় সুঁচ হয়ে ঢুকে জাতিসংঘ কাদের জন্য ফাল হতে চান, তা বুঝতে বোকা বাঙালিরও খুব বেশি দেরি হয়নি।
জাতিসংঘের মাধ্যমে এই নয়া চক্রান্তের উদ্দেশ্য অতি স্পষ্ট। দখলীকৃত বাংলাদেশে ইয়াহিয়ার হানাদার বাহিনী এখন ক্রমবর্ধিত গেরিলা তৎপরতার কাবু হয়ে পড়েছে। মুক্ত অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী বাহিনীর ওপর চূড়ান্ত আজাদ প্রস্তুতি নিচ্ছে। জাতিসংঘকে সংগঠিত ও শক্তিশালী হয়ে উঠেছে এবং ইয়াহিয়ার হানাদার চক্রান্তের মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে তারা নেপথ্যের মুরুব্বীরা চাচ্ছে, হানাদারের এই চরম মার থেকে বাঁচতে। পর্যবেক্ষক মোতায়েনের নামে যদি বাংলাদেশে ও ভারত সীমান্তে জাতিসংঘ বাহিনী মোতায়েন করা যায়, তাহলে মুক্তিবাহিনী ও গেরিলাদের তৎপরতা রোধ করা যাবে এবং তাদের মার থেকে হানাদার বাহিনীকে বাঁচানোও যাবে, এই তাদের দুরাশা। পাকিস্তানকে এখনো অস্ত্র প্রদান এর যুক্তি হিসেবে নিক্সন সরকার যে অভিনব তথ্য আবিষ্কার করেছেন, তা হল, বাংলাদেশের উগ্রপন্থীদের দমনের জন্য অস্ত্র প্রেরণ দরকার। ভবিষ্যতে এই তথাকথিত উগ্রপন্থীদের দমনের নামে মুক্তিবাহিনীকে দমনেরও এক চমৎকার যুক্তির নিক্সন সাহেবরা খাড়া করতে পারেন। বাংলাদেশের যখন জাতীয় মুক্তি যুদ্ধ চলছে, তখন সেখানে যারা উগ্রপন্থীদের অস্তিত্ব বা তাদের প্রভাব আবিষ্কার করতে পারেন, তাদের পক্ষে সবই সম্ভব’। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের বড় ব্যবসায়ীদের এখন প্রধান ব্যবসা অস্ত্র বিক্রয়। ভিয়েতনামের কিছু উদ্ধৃত্ত মার্কিন সৈন্য জাতিসংঘ পর্যবেক্ষক বাহিনীতে ঢুকিয়ে যদি বাংলাদেশে পাঠানো যায়, তাহলে এখানেও আরেকটি ভিয়েতনাম সৃষ্টিতে দেরি হবে না এবং মার্কিন অস্ত্র ব্যবসায়ীদের অস্ত্র ব্যবসায়েও ভাটা পড়বে না। যুক্তরাষ্ট্রের শান্তিকামী ও গণতন্ত্রকামী মানুষের ও তাই উচিত, তাদের দেশের রক্ত ব্যবসায়ীদের এই নতুন চক্রান্ত সম্পর্কে সজাগ হওয়া।
বাংলাদেশ সমস্যা হয় জাতিসংঘ তৈরি করে ও কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করতে চায়, তারপথ এখনো উন্মুক্ত রয়েছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের উপরাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম তার সাম্প্রতিক এক ভাষণে এই পথের কথাই সুস্পষ্ট ভাষায় বলে দিয়েছেন। এই পথ হল, বাংলাদেশ থেকে পাক হানাদার বাহিনী অবিলম্বে সরিয়ে ফেলার ব্যবস্থা করা, স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকার ও জাতিসংঘের স্থান দেয়া, গত ১০ বছর ধরে বাংলাদেশে যে শোষণ চালানো হয়েছে-বিশেষ করে গত ২৫শে মার্চের পর যে ধ্বংস সাধন করা হয়েছে, ইসলামাবাদ সরকারের কাছ থেকে তার ক্ষতিপূরণ আদায় করা এবং শরণার্থীদের স্বদেশ প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসনে সাহায্য করা। একমাত্র এ পথেই বাংলাদেশ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও ন্যায়সঙ্গত সমাধান সম্ভব। জাতিসংঘের তাই উচিত কোনো নেপথ্য চক্রি দলের চক্রান্তের মাধ্যম না হওয়া এবং ভাঁওতাবাজির আশ্রয় না নেওয়া। বাংলাদেশের মানুষ এখন অপরের কৃপাপ্রার্থী নয়। তাই নিজেরাই নিজেদের সমস্যা সমাধান ও হানাদার উৎসাদনে কৃত সংকল্প।
শত্রু সেনারা ত্রাহি ত্রাহি ডাকছে
বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গনে বঙ্গশার্দুল মুক্তিযোদ্ধাদের রণহুঙ্কারে শত্রুবাহিনীর মধ্যে ত্রাহি ত্রাহি ডাক এবং রণাঙ্গন ছেড়ে পালাবার হিড়িক শুরু হয়েছে। বড় বড় মেজরকে পিছনে খুঁটি হিসেবে খাড়া করেও ভীতু পাকসেনাদের যুদ্ধের ময়দানে ঠেকায়ে রাখা যাচ্ছে না। তারা মেজরকে মেরে অগত্যা পথ পরিষ্কার করে ঊর্ধ্বশ্বাসে কিছু হটে যাচ্ছে। প্রতিদিন মুক্তিযোদ্ধাদের বেদম মারে শত শত শত্রুসেনার বিদার দেহটা ঢলে পড়ার দৃশ্য চোখে ভেসে উঠলে শরীর তাদের ঠান্ডা হয়ে যায়, পা তাদের সামনে বাড়তে চায়না। বাড়ির মা-বাবা আত্মীয়-স্বজন, মা-বাবা, ছেলে-মেয়ে ও প্রিয়জনের কথা মনে পড়ে গেলে এমনিতেই শরীর অবশ হয়ে আসে হাত থেকে মারণাস্ত্র পড়ে যায়।
বাংলাদেশের বিভিন্ন রণাঙ্গন থেকে প্রতিদিন পাক দস্যুদের পলায়নী মনোবৃত্তির এ ধরনের অনেক খবর এখানে পাওয়া যাবেই।
বাংলাদেশ মুক্তিবাহিনীর সদর দপ্তরের তথ্য বিভাগের বুলেটিনে প্রকাশ, হানাদার পাক বাহিনী মুক্তিযোদ্ধাদের বেপরোয়া প্রচন্ড আক্রমণের মুখে নাজেহাল হয়ে পড়েছে। বাংলার দখলীকৃত এলাকা মুক্তিযোদ্ধাদের আক্রমণ আরও জোরদার হয়ে উঠেছে। তাদের হাতে শত শত পাকসেনা রাজাকার এবং তাদের সহযোগী দেশীয় দালালরা হতাহত হচ্ছে। শত্রুদের চলাচল ও সরবরাহ ব্যবস্থা অচল করার জন্য রেললাইন, রেলসেতু ও সড়ক সেতু উড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।
দিনাজপুর, রংপুর, রাজশাহী সেক্টর থেকে প্রাপ্ত খবরে জানা যায় যে, মুক্তিযোদ্ধারা ভুরুঙ্গামারী এলাকায় একটি পাক সেনা দল কে ঘিরে ফেলেন। এখানে পাকসেনাদের একটি জীব ধ্বংস করা হয়, অপর একটি অতর্কিত হামলায় ১১ জন পাকসেনা খতম এবং ৭ জন আহত হয়। মুক্তিযোদ্ধারা রইসবাগ এলাকায় লালমনিরহাট ও ককিনার মাঝামাঝি স্থানে রেললাইন উড়িয়ে দেন। পাক সেনাবাহী ট্রেন এখানে লাঞ্চিত ট্রেনের দুটি বগি উড়িয়ে দেয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা লাইনচ্যুত বগি দুটির ওপর হাতবোমা নিক্ষেপ করে ৩০ জন পাকসেনা খতম করেন।
বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে, মুক্তিযোদ্ধারা জুন মাসের শেষ সপ্তাহ থেকে ১৬ই জুলাই পর্যন্ত নারায়ণগঞ্জে তাদের কর্ম তৎপরতা জোরদার করেছেন। মুক্তিযোদ্ধারা নারায়ণগঞ্জের জেনারেল পোস্ট অফিসে হাতবোমা নিক্ষেপ করে কাগজপত্র পুড়িয়ে এবং অফিস ভবন এর ক্ষতি করেছেন। তারা নারায়ণগঞ্জের একটি সাবস্টেশনের ট্রান্সফর্মারও ধ্বংস করে দিয়েছেন। নারায়ণগঞ্জ শহরে তারা একগাল টহলদার পাকবাহিনীর উপর হামলা করে ১০ জন পাকসেনাকে খতম করেন। মুক্তিযোদ্ধারা দাউদকান্দি কুমিল্লা রোডে মাইন দিয়ে পাকসেনাদের জন্য রেশনে বহনকারী ট্রাক ধ্বংস করে দিয়েছেন। এখানে একজন পাক সেনা এবং তাদের আটজন দালালকে খতম করেন। এই এলাকায় তারা পাকসেনাদের একজন ইঞ্জিনিয়ার এবং দুইজন পাক সেনাকে হত্যা করেন। দাউদকান্দি থেকে পাক সৈন্য নিয়ে কুমিল্লার দিকে যাওয়ার সময় মুক্তিযোদ্ধাদের বিস্ফোরিত হয়ে তাদের গাড়িতে বিধ্বস্ত এবং ১০ জন সেনা খতম হয়।
মুক্তিযোদ্ধারা কুমিল্লা টাউন কমিটির প্রেসিডেন্ট এবং জনৈক সাবেক মন্ত্রীর বাড়ি ঘেরাও করে তাকে এবং তার অপর ৬ জন অনুচরকে হত্যা করেন। গত ১৯ শে জুলাই জগন্নাথ দিঘী এলাকায় পাকসেনাদের শিবিরের উপর আক্রমন করে ৬ জনকে হত্যা করেন। ছাগলনাইয়া মুহুরিগঞ্জ রাস্তায় মুক্তিযোদ্ধা দলের মাইন বিস্ফোরিত হয়ে পাকসেনাদের একজন অফিসার খতম এবং তার গাড়িটি সম্পূর্ণরূপে বিধ্বস্ত হয়। এখানে আরো দুই জন পাকসেনা আহত হয়, বাল্লাপুর এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা এখানে পাকসেনাদের গাড়িটি উল্টে ফেলে নষ্ট করে দেন। গাড়ির ড্রাইভার টি মারা যায়। মান্দাবাগ এলাকায় ১৩ জন খানসেনা খতম হয়, মুক্তিযোদ্ধারা এখানে খানসেনাদের একটি স্পিড বোর্ড ও ধ্বংস করে দেন। সালদা নদী তে ১১ জন পাকসেনা খতম এবং ১৫ জন আহত হয়, চট্টগ্রাম কাপ্তাই এর মাঝামাঝি রাঙ্গুনিয়া এলাকায় দুইটি ইলেকট্রিক টাওয়ার ধ্বংস করে দেন। মিরসরাই এলাকায় মুক্তিযোদ্ধারা ১১ই জুলাই একজন পাকসেনাকে খতম এবং তিনজন আহত করে তাদের নিকট থেকে চীনা অস্ত্রশস্ত্র দখল করে নেন। এই স্থানে তারা মাইন দিয়ে সেনাদের গাড়ি ধ্বংস করে দেন।
সিলেট জেলায় মুক্তিযোদ্ধারা ভাঙা সেতুর নিকট পাকসেনাদের একটি গাড়ি ধ্বংস করে দেন। বিয়ানীবাজার এলাকায় মুসলিম লীগের বিশিষ্ট নেতা একজন পাক দালালকে ও খতম করে দেন।
গত ১৭ ই জুলাই রাজশাহী জেলার শহীদ মুক্তিযোদ্ধাদের প্রচন্ড আক্রমণে ২২ জন পাকসেনা খতম হয়। প্রকাশ, এই দিন ৩০ জন পাকসেনা তাদের মহাদেবপুর শিবির থেকে ট্রাকে করে শাহপাড়ে টহল দিতে আসে। এদের সাথে রাজাকারও ছিল। খবর পেয়ে সতর্ক মুক্তিযোদ্ধারা তাদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন। ১৯শে জুলাই রোহনপুর এলাকায় ৩০ জন পাকসেনা একটি টহল পার্টির ওপর হামলা করে মুক্তিযোদ্ধারা একজন ক্যাপ্টেনসহ ৯ জনকে খতম করেন।
দিনাজপুর রাণীনগরে পাকসেনাদের আকস্মিক হামলা করে দশজন খানসেনাকে খতম এবং মাঝারি ধরনের মেশিনগান এবং বহু গোলাবারুদ দখল করেন।
২০ জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা বগুড়া শহরে সার্কিট হাউসে পাক সেনাদের ক্যাম্পে হাত বোমা ফেলে একজন সেন্ট্রিকে হত্যা করেন। মুক্তিযোদ্ধারা এই জেলার গুরুত্বপূর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন।
*পর্যবেক্ষকের চোখে*
ইয়াহিয়ার জ্যুডেনর্যট
নাজি ইয়াহিয়া এখন ১০ লক্ষ দেশপ্রেমিকের মৃতদেহের উপর একটি পদলেহী সরকার গঠনের চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছেন। বিদেশি সাংবাদিক, বিভিন্ন দেশের বিশিষ্ট রাজনীতিকদের সফরের অভিজ্ঞতা এবং পর্যবেক্ষকদের বক্তব্য থেকে আজ একথা স্পষ্ট যে, গণহত্যার নায়ক ইয়াহিয়া প্রতিবিপ্লবী বিশ্বাসঘাতকদের সন্ধান করছেন।
এই নিদারুণ হত্যা ও ধ্বংসের নির্দেশদাতা ইয়াহিয়া এবং তার সহকর্মীরা কারা? আর কী উদ্দেশ্য নিয়ে, কোন ধরনের বিশ্বাসঘাতকদের হত্যার সহযোগী করা হয়েছে।
সুপরিকল্পিতভাবে বহু লক্ষ জার্মান নাগরিককে হত্যাকারী হিটলারের দানব শক্তির কলঙ্কময় ইতিহাসকেও যে ম্লান করেছে, গণহত্যা ও নারী নির্যাতন, লুণ্ঠন আর নিরবচ্ছিন্ন ধ্বংসের মাধ্যমে -সেই নর হত্যাকারী রক্তপিপাসুর নাম ইয়াহিয়া।
লক্ষ লক্ষ নিরীহ শান্তিপ্রিয় দেশ প্রেমিকের রক্তে রঞ্জিত দানব সন্তানের সাঙ গাৎ টিক্কা খান নামে পরিচিত।
একচ্ছত্র ক্ষমতার লোভে নরখাদক দলের ক্রীতদাসের ভূমিকা গ্রহণকারী, জুনাগড়ের স্বাধীনতা সংগ্রামে বিশ্বাসঘাতক প্রধানমন্ত্রীর সন্তানটিকে ভুট্টো নামে সবাই জানেন।
আর আজ এদের এই আজ্ঞাবহ পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সমস্ত অফিসার হিটলারের জল্লাদ গোলাম আইকম্যান-এর রক্তস্রাবী ভূমিকা নিয়েছে।
এসমস্ত পর্যুদস্ত প্রতিদিন পরাজিত লুটেরা আর হত্যাকারীর দল শেষবারের মতো মাটি আঁকড়ে দখলকৃত বাংলাদেশের বেঁচে থাকার জন্য তাবেদারদের সন্ধান করছে।
অনেক দেশের ইতিহাসে দেখা গেছে, হত্যাকারীরা শাসন ও শোষণের প্রলোভন দেখিয়ে চক্রান্তকে সফল করার প্রয়াসে সাক্ষাৎ খুঁজে পায়। বিশেষ করে স্বাধীনতা ও মুক্তিকামী সংগ্রামীদের স্তব্ধ করার জন্য আর জল্লাদরা ক্রীড়ানকের ভূমিকা নিতে কুণ্ঠাবোধ করে না। তাদের সংখ্যা মুষ্টিমেয় হলেও, প্রভুর চেয়ে তাদের কর্মতৎপরতা কোন অংশেই তীব্র আর ভয়াবহ হয়না। বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামের বিরোধিতার ব্যাপারে তার ব্যাতিক্রম হয়নি।
এই সমস্ত সহযোগী ও সাক্ষাৎকে হত্যাকারীর ক্রীড়ানক রূপে নিজের আত্মীয়-স্বজন, দেশপ্রেমিক নাগরিক এবং কৃষক-শ্রমিক বিপ্লবী সাধারন এর বিরুদ্ধে জল্লাদের ভূমিকা নিতেই হয়। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পূর্বে তিরিশের যুগের হিটলারের উত্থানের সময় নাজী জার্মানির এই পরিস্থিতিই ছিল। বাংলাদেশের অধিকৃত এলাকার বিভিন্ন ইতিহাসেরই পুনরাবৃত্তির ব্যর্থ চেষ্টা চলছে।
জার্মানিতে সেসময় মজুরি বৃদ্ধি ও মানবিক জন্মগত অধিকার অর্জনের দাবিতে শ্রমিকরা মধ্যবিত্ত এবং বুদ্ধিজীবী মহল আন্দোলনের মাধ্যমে এগিয়ে আসছিল। নাজি জার্মানিকে সুসংহত করার উদ্দেশ্যে হেয় হিটলার তখন দেশের বিশ্বাসঘাতকদের নিয়ে একটা কাউন্সিল গঠন করেছিলেন তার নাম “জ্যুডেনর্যট।”
এই গণবিরোধী কাউন্সিলের সদস্য ছিলেন জার্মানি শ্রেষ্ঠ ধনীক -বণিক-ভুস্বামী ইহুদিদের সমন্বয়ে গঠিত এই জ্যুডেনর্যট-এর উপর দায়িত্ব পড়েছিল সর্বস্তর থেকে ইহুদি বিতরণ ও নিধন। হিটলারের জাতিবিদ্বেষ এসেছিল শ্রমিক-কৃষক শক্তির ভীতি ও বিদ্বেষ থেকে -কারণ সে সময়ে এই সমস্ত শোষিত শ্রেনী জার্মানিতে অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য নানাভাবে বিদ্রোহী হয়ে উঠেছিল। আর অর্থনৈতিক দিক থেকে এই শ্রমিকদের অধিকাংশই ছিল সাধারণ ইহুদি। তাই হিটলারের ইহুদি ধর্মের নামে সাধারণ মানুষের অঙ্কুরিত বিদ্রোহকে চিরতরে স্তব্ধ করতে চাইলেন। নাজি দর্শনের মাধ্যমে বিশ্বাসঘাতক ধনকুবেরদের সহযোগিতায় এক ভয়াবহ পুঁজিবাদ গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার পরিকল্পনা নিলেন। এরই নাম ‘জ্যুডেনর্যট’। আজ নাজির ইয়াহিয়া তার পূর্বসূরী হিটলারের ন্যায় বাংলাদেশে ‘জ্যুডেনর্যট’ গঠন করার দুঃস্বপ্নে মেতে উঠেছে।
হিটলার জ্যুডনর্যট সদস্যদের কাছ থেকে প্রগতিশীল বিপ্লবী, সংগ্রামী আর আন্দোলনে অংশগ্রহণকারী জার্মানিদের নাম সংগ্রহ করেছিলেন -তাদের দিয়েই লিস্ট তৈরি করেছিলেন। হিটলারের গণহত্যা প্রথম পরিকল্পনা যে এদেরই হাতে তৈরি ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়। গুপ্ত বাহিনীর এস এস অফিসার ও গেস্টাপোর কাছে পলাতকদের খোঁজখবর এরাই দিতেন। এর চাইতেও ভয়াবহ কাজ করেছিলেন তাঁরা বন্দিশিবির গড়ে তোলার পরামর্শ দিয়ে। হিটলারের ‘বেলসন’, ‘অসউইন’ ইত্যাদি কুখ্যাত বন্দি শিবিরগুলো তারই পরিণতি। বাংলাদেশের কিছু সংখ্যক বিশ্বাসঘাতকদের কার্যক্রমের সাথে এর গভীর মিল রয়েছে।
জনগণের প্রতি এই বিশ্বাসঘাতকতা করে ও গণহত্যার হাতিয়ার হয়ে জ্যুডনর্যটের ধনবান সদস্যগণ পুরস্কার পেয়েছিলেন নিজেদের জীবন।
ত্রিশের যুগে স্পেনে যা ঘটেছিল, বাংলাদেশের বর্তমান ঘটনার সাথেও তার মিল রয়েছে।১৯৩৭ সালে স্পেনের সামিউল আজনারের পার্টি পপুলার ফ্রন্ট ৪২০টি আসনের মধ্যে নির্বাচনে ২৭০টি আসন লাভ করেন। কিন্তু জেনারেল ফ্রাঙ্কো সেনাবাহিনীর জোরে নির্বাচন বানচাল করে রাষ্ট্রের ক্ষমতা দখল করে নেয়। নাজি হিটলার ও ফ্যাসিস্ট মোশালনি সে সময় ফ্রাঙ্কোকে গণতন্ত্র হত্যার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। অপরদিকে বিভিন্ন দেশ থেকে গঠিত আন্তর্জাতিক ব্রিগেড গণতান্ত্রিক শক্তিকে সাহায্য করা সত্ত্বেও বৃহৎ শক্তিগুলো এগিয়ে আসেনি। বরং তারা হস্তক্ষেপ না করার নীতির অজুহাতে নীরব দর্শকের ভূমিকা নিয়েছিলেন। আর এই দুষ্ট নীতির সুযোগ নিয়ে ফ্রাঙ্কো স্পেনে বিশ্বাস ঘাতক দালালদের সহযোগিতায় হত্যার অভিযান চালান-সামরিক সরকারকে চিরস্থায়ী করে তোলেন। বৃহৎ শক্তি বিশ্বযুদ্ধের অজুহাতে “হস্তক্ষেপ না করার” নীতি নিয়ে ফ্রাঙ্কোকেকে পরোক্ষ সহযোগিতা করেছিল। এর ফলে স্পেন ধর্মতান্ত্রিক শক্তিগুলোর লেজুড় হয়ে রয়েছে। অপরদিকে জ্যুডেনর্যট-এর সদস্যদের ন্যায় একশ্রেণীর দেশদ্রোহী নিপীড়কের ভূমিকা নিয়ে স্পেনের জেনারেল ফ্রাঙ্কো ও তার জেনারেলদের সামরিক শাসন চিরস্থায়ী করেছে।
আমাদের দেশে হত্যাকারী বিদেশি শাসক ইয়াহিয়ার জ্যুডেনর্যট-এর সদস্য হতে চাচ্ছেন কারা? কারা দেশ প্রেমিক নাগরিকদের মৃতদেহের স্তুপের উপর শাসনের ইমারত গড়ে তুলতে চাইছেন? বাংলাদেশের মাটিতে ইয়াহিয়ার জ্যুডেনর্যটের সদস্য হবার জন্যে সবার আগে যারা এগিয়ে এসেছেন, তাদের মধ্যে রয়েছেন উত্তরবঙ্গের সেবাশ্রম থেকে লুণ্ঠিত মুদ্রণালয়ের অধিকারী হামিদুল হক চৌধুরী। এই প্রেস থেকেই তিনি অবজারভার পত্রিকার ব্যবসা আরম্ভ করেছিলেন। তেজগাঁও শিল্প এলাকা এলেনবেরী ড্রাম কোম্পানির উৎপাদন দেশ বিভাগের পর পরই কোটিপতি ডালমিয়ার হাতে পাচার করে তিনি দশ লক্ষ টাকার মালিক হয়েছিলেন রাতারাতি। মন্ত্রিসভা থেকে বহিস্কৃত ও এ্যবডো’র শিকারং এই কূটচরিত্রের গণবিরোধী ভদ্রলোককে ১৯৫৮ সালের অক্টোবর মাসের ১৩ তারিখে দুর্নীতি নিরোধ আইনে গ্রেফতার করা হয়েছিল। আইয়ুবকে তার অবজারভার পত্রিকায় সহযোগিতার আশ্বাস দিয়ে তিনি সেবার রেহাই পান। স্বাধীন বাংলাদেশের সরকার ভবিষ্যতে দুর্নীতি পরায়ন ব্যক্তির সমস্ত সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করতে পারেন, সেই আশঙ্কা ইয়াহিয়ার গণহত্যায় পূর্ণ সহযোগিতা দান করছেন তিনি। বর্তমানে তিনি নিউইয়র্কে ইয়াহিয়ার ভ্রাম্যমাণ প্রতিনিধি রূপে কাজ করছেন।
তারেই লেজুড়, সর্বস্তরে পরিত্যক্ত সিলেটের নির্বাচনে পরাজিত মাহমুদ আলী। আয় বিহীন ব্যয়ের জন্য তিনি পরিচিত। গোলটেবিল সম্মেলনে বাংলাদেশের স্বার্থ বিক্রয়ের অপরাধে এই সদা শেরওয়ানি পরা ব্যক্তিটিকে কে বা কারা ঢাকায় ফেরার পর অপহরণ করেছিল। তিনিও গোপনে ঢাকা থেকে বেরিয়ে হক চৌধুরীর সাথে ইয়াহিয়ার দালাল বর্তমানে বিদেশে মুক্তিসংগ্রামের বিরুদ্ধে বক্তৃতার চেষ্টা করছেন।
বিশ্বাসঘাতকদের কিউ তে যারা প্রতিযোগিতা করছেন, তাদের প্রধানরা অনেকদিন যাবতেই বাংলাদেশে নাগরিকদের কাছে হক চৌধুরীর মতোই প্রতিক্রিয়াশীল ও প্রতিবিপ্লবী রূপে পরিচিত। এদের মধ্যে যেমন খাজা সাহেব। ঢাকা নবাব পরিবারের প্রধান ব্যক্তিদের বহুতর স্ত্রীর কোন একটি শালায় অবহেলায় পালিত সন্তান এই খাজা খয়ের উদ্দিন সাহেব।
রাজকীয় ক্ষমতা লাভের আশায় আর যারা উৎকণ্ঠায় ভুগছেন তাদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিষে জর্জরিত এককালে উলামায়ে হিন্দের প্রধান পীর মাওলানা গোলাম আজম, তারে খালাতো ভাই এ কিউ এম শফিকুল ইসলাম, যিনি কুখ্যাত বিহার কান্তের টাকা মারার দায়ে অভিযুক্ত ও পাঞ্জাবের শিল্পপতিদের উপদেষ্টা চৌধুরী মোহাম্মদ আলীর পদলেহনকারী কক্সবাজারের মৌলভী ফরিদ আহমদ। গত নির্বাচনে ইসলাম ব্যবসায়ী গোলাম আযম সম্পর্কে ঢাকায় দেয়ালে একটা পোষ্টার ছিল-ইসলামের যম, গোলাম আযম। শফিকুল ইসলাম, মৌলভী ফরিদ আহমদ ও গোলাম আযম ২৫ শে মার্চের পূর্ব থেকেই কুর্মিটোলার সেনানিবাসের সাথে সম্পর্ক রাখতেন। তাদের সাথে চতুর্থ ব্যক্তি ছিলেন খাজা খয়ের।
এদেরই প্রচেষ্টায় মিরপুরের ১২ নম্বর সেকশন ও মোহাম্মদপুরে বসবাসকারী ব্যক্তিদের সমন্বয়ে ২৭শে মার্চ থেকে ঢাকায় বিরোধী দল গঠিত হয়। এ দলের ব্যক্তিদের যাতে সেনাবাহিনীর লোকরা সহজে চিনতে পারে তার জন্য প্রত্যেকের কপালের উপর তখন সাদা রুমাল বাঁধা ছিল। এরা হত্যা ও লুটের ব্যাপারে সেনাবাহিনীকে বাড়ি ও লোক চিনিয়ে দিত। এপ্রিল মাসের খাজা খয়ের এদের নিয়ে শান্তি বাহিনী প্রতিষ্ঠা করেন। কোন প্রকার বাধার সম্মুখীন না হয়ে যাতে হত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন অব্যাহত রাখা যায় -তারই জন্য এই তথাকথিত শান্তি কমিটি। উপরোক্ত তিনজন ভদ্রলোক ও এতে বিশিষ্ট ভূমিকা পালন করেন। পরবর্তীকালে এই লুটেরা ও হত্যাকারী বাহিনী দিয়েই গঠিত হয়েছে “রাজাকার”।
এদেরই সহকর্মী ও ইয়াহিয়ার অপর সাঙ্গাদের নাম মাহবুবুল হক। হক চৌধুরীর পোষ্য এই ব্যক্তি অবিভক্ত ভারতের বিএনআর লোয়ার ডিভিশন কেরানির পদ থেকে শেষ পর্যন্ত ঢাকায় সামরিক বাহিনীর গোঁড়া সমর্থক দৈনিক পূর্বদেশের অসাংবাদিক সম্পাদক রূপে কাজ করছেন। ১৯৬৪ সালে রেল শ্রমিকদের ধর্মঘট নামিয়ে মোমেন খান অর্থলাভ করে তিনি ধর্মঘট ভেঙে দেন।

প্রধানমন্ত্রীর ভাষণের পূর্ণ বিবরণ
মাননীয় সদস্য ও সদস্যাগণ,
আমরা একটা যুদ্ধের মধ্যে আছি। এই যুদ্ধের ভয়াবহতা আমার চেয়ে বেশি আপনারাও জানেন। কাজেই নতুন করে আমার বলার প্রয়োজন আছে বলে মনে করি না।
আজকে এই যুদ্ধের ফলে ৬০ লক্ষেরও অধিক লোক ছিন্নমূল হয়ে বন্ধুরাষ্ট্র ভারতের মাটিতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন। দলমত নির্বিশেষে ভারতের প্রত্যেকটি মানুষ বাংলার স্বাধীনতাকামী মানুষের পাশে এসে দাঁড়িয়েছেন। তারা বিনা দ্বিধায় বুকে তুলে নিয়েছেন আমাদের ছিন্নমূল মানুষ কে। আমাদের এত লোক ভারতে চলে যাওয়ার ফলে তাদের বহু কষ্ট হয়েছে, তাদের অর্থনীতিতে প্রচন্ড আঘাত পড়েছে, তাদের রাজনীতিতে প্রচন্ড দোলা লেগেছে, তাদের সামাজিক অবস্থা পতনোন্মুখ হওয়ার জোগাড় হয়েছে। তাসত্ত্বেও ভারতের লোক দল-মত নির্বিশেষে আমাদের লক্ষ লক্ষ লোককে বুকে টেনে নিয়ে আশ্রয় দিয়েছেন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ এই বন্ধুত্বের কথা মনে রাখবেন। বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের পক্ষ থেকে আজ আমরা নিশ্চয়ই ভারতের জনগণকে, ভারতের সরকার এবং ভারতের প্রতিটি রাজ্য সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, আপনারা যে বন্ধুত্বের হস্ত প্রসারিত করেছেন, তার প্রতুত্তরে বাংলাদেশের মানুষ চিরদিনের জন্য আপনাদের বন্ধুদের কথা স্মরণ রাখবেন এবং চিরকাল বন্ধুত্বের হস্ত আপনাদের দিকে প্রসারিত করে রাখবেন।
মাননীয় সদস্য বৃন্দ,
আজকের যে ভয়াবহতা সকল দিকে তার পরিমাপ করা এক কথায় সম্ভব নয়। আপনারা বিভিন্ন বিপর্যয় দেখেছেন, বিভিন্ন দাঙ্গা-হাঙ্গামা দেখেছেন। কিন্তু বাংলার মাটিতে যা ঘটে গেল তার নজির সারা বিশ্বের ইতিহাসে বিরল। আমার মনে হয় এমন নরহত্যা নারী জাতির উপর নির্যাতন ব্যাপকভাবে পাইকারিভাবে নাৎসি জার্মানি ও ইয়াহিয়ার বর্বরতার কাছে হার মেনে গেছে। আপনি ইতিহাসে দেখেছেন নাৎসি জার্মানির নারী-পুরুষ-শিশু বৃদ্ধ নির্বিশেষে ইহুদীদেরকে গ্যাস চেম্বারে নিয়ে হত্যা করেছে। কিন্তু মাতৃজাতির উপর এমনইভাবে পাশবিক অত্যাচার করে পরে তারা আমার মায়ের জাতি কে গাছে বেঁধে উলঙ্গ করে লজ্জাস্থানের শুটিং করেছে। এর প্রতিশোধ বাংলার প্রতিটি সুসন্তানকে নিতে হবে। আমার এই মায়ের জাতিকে সম্মানের আসনে ফিরিয়ে নিতে হবে। যতদিন পর্যন্ত আমরা তা পারবো না, ততদিন পর্যন্ত আমরা ক্ষান্ত হব না; ততদিন পর্যন্ত আমরা মায়ের সুসন্তান দাবি করবো না।
তাই আমার মাননীয় সদস্য ও সদস্যাগণ, আপনাদের সামনে সমস্যা অতি বড়, এক বিরাট পরীক্ষা আপনাদের সামনে। ঘূর্ণিঝড় দেখেছেন; তুফান দেখেছেন, মর্মান্তিক ক্ষয়ক্ষতি। সেসব ঘূর্ণিঝড় বিধ্বস্ত এলাকায় আমরা রিলিফের কাজে যে আর্তের সেবার কাজে গিয়ে হিমশিম খেয়ে গিয়েছি, মানুষের যা চাহিদা, তা মিটাতে পারি নি। আর আজ বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ যেখানে সুপরিকল্পিতভাবে অত্যাচারিত ও নিগৃহীত আপনি সুষ্ঠুভাবে তাদের দুঃখ দূর করবেন এটা আশা করা কল্পনা ছাড়া কিছুই হবে না।
আজকের তাই অন্য সব ভুলে গিয়ে আমাদের বড় লক্ষ্য হবে আমার দেশের মুক্তিসংগ্রামকে জোরদার করা এবং হানাদার বাহিনীকে সমূলে পর্যুদস্ত করা। আমাদের আজ বড় লক্ষ্য হবে মাতৃভূমিকে সম্পূর্ণ শত্রুমুক্ত করে আমাদের ৬০ লক্ষাদিক ছিন্নমূল মানুষ কে নিজ দেশে ফিরিয়ে আনা। শুধু তাই নয়, ৬০ লক্ষাধিক যদি ভারতে চলে গিয়ে থাকেন, ১০ লক্ষেরও অধিক যদি মৃত্যুবরণ করে থাকেন তাহলে সাড়ে সাত কোটি মধ্যে বাকি সাড়ে ৬ কোটি বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় রয়ে গেছেন। তারা যে নির্যাতন ভোগ করছেন, যে কষ্ট ভোগ করছেন তাদের যে হাহাকার, যে দুঃখ, যে দুঃখ-যাতনা, যে যন্ত্রনা কাতরতা তার বর্ণনা কোন ভাষায় সম্ভব তা আমার জানা নেই। হৃদয় দিয়ে বুঝতে হলেও হৃদয়ের বল অনেক দরকার। ভালো করে বুঝতে গেলেও আমরা নিজেরা সজ্ঞান থাকতে পারব কিনা সন্দেহ।
আজ সেই সমস্ত মানুষ পরম দুঃখ কষ্টের মাঝেও প্রতিনিধিদের প্রতি চেয়ে আছেন। চেয়ে আছেন বাংলার আমাদের যুবকদের আশায় ও মুক্তিবাহিনীর আশায়। একদিন তারা আমাদের উদ্ধার করবেন, একদিন তোরা আমাদের লাঞ্ছনা থেকে সম্মানের আসনে প্রতিষ্ঠিত করবেন, সেই আশা করে তারা বসে আছেন। আমার বিশ্বাস বাংলার প্রত্যেকটি যুবক, প্রত্যেকটি প্রতিনিধি সে ব্যাপারে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। আমরা তাদের সেই অটুট আস্থা, এই আশা পূরণ করবোই করবো। আমার মাননীয় প্রতিনিধিরা তার জন্য আজ যে সমস্ত ব্যবস্থা অবলম্বন করা হয়েছে, সে সমস্ত বিরাট সমস্যার তুলনায় তা কিছুই নয়। ৬০ লক্ষ্য-উদ্বাস্তুকে খাওয়ার ব্যবস্থা করা, তার আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা আপনার আমার পক্ষে সম্ভব নয়। আজ আমাদের বন্ধু রাষ্ট্র ভারত এবং তাদের জনগণ অকাতরে তাদের করদাতাদের পকেটের টাকা, শ্রমিকরা তাদের শ্রমলব্ধ পয়সা এবং বিভিন্ন সহায়ক সমিতি পয়সা দিয়ে বাংলার ছিন্নমূল মানুষের জন্য দৈনিক কম হলেও দেড় কোটি টাকা খরচ করে চলেছেন। তাসত্ত্বেও মানুষ পেট ভরে পেট পাচ্ছেন না। আমি আগেই বলেছি, পেট ভরে খাওয়ানো সম্ভবও নয়। আজ তাই, কষ্ট আমাদের হচ্ছে। যদি আমরা দেশকে উদ্ধার করতে পারি তবেই সব কষ্টের লাঘব হবে। তাই আমরা যেসব পরিকল্পনা করেছি; তার মূল লক্ষ্য দেশ উদ্ধার।
ঐতিহাসিক গণপ্রতিনিধি সমাবেশ
অসহযোগ আন্দোলন থেকে স্বাধীনতা উত্তোলন করে স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার গঠন করার পর, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটি এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের প্রথম বৈঠক এ মাসের ৫ই ও ৬ই তারিখে মুজিবনগরে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
দেশমাতৃকার স্বাধীনতা রক্ষার জন্য যখন সাড়ে সাত কোটি মানুষ মৃত্যুঞ্জয়ী সংগ্রামে লিপ্ত হয়ে বুকের তাজা রক্ত বইয়ে দিয়েছে বাংলার শ্যামল প্রান্তরে, জাতীয়তাবাদের নব চেতনায় উদ্বুদ্ধ ও স্বাধীনতা মন্ত্রে দীক্ষিত সংগ্রামে বাংলার মহানায়ক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কারারুদ্ধ, বিশ্ব মানবতা যখন বিবেকের দংশনে কিংকর্তব্যবিমূঢ়, সারা বিশ্ব যখন বাংলার নেতৃত্ব, বিশেষ করে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে দিকে এক বিরাট উৎকণ্ঠা নিয়ে তাকিয়ে আছে, তেমনি এক মুহূর্তে এই সম্মেলন অনুষ্ঠিত হলো। কার্যকরী সংসদের ৩৯ জন সদস্য এবং উভয় পরিষদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বৈঠকে মোট ৩৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। এরমধ্যে ১৩৫ জন জাতীয় পরিষদ সদস্য ও ২৩৯ জন প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য। আওয়ামী লীগ দলীয় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের মধ্যে যারা সম্মেলনে উপস্থিত হতে পারেননি, তাদের মধ্যে বেশ কয়েকজন ইয়াহিয়া খানের সেনাবাহিনীর হাতে নিহত অথবা গ্রেপ্তার হয়েছেন এবং কয়েকজন আত্মসমর্পণ ও করেছেন। আর কেউ কেউ নিজ নিজ এলাকায় থেকে মুক্তিযুদ্ধ পরিচালনার কাজে ব্যস্ত থাকায় সম্মেলনে হাজির হতে পারেননি। অবশ্য আরো বেশ কয়েকজন সদস্য পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র সমূহে আশ্রয় নিয়েছেন।
এই বৈঠক কয়েকটি দিক থেকে বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগ তথা বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের নস্যাৎ করার উদ্দেশ্যে ত্রিমুখী আক্রমণ চালিয়েছিল। ইয়াহিয়া সরকার আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করে, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীও নির্বাচিত পরিষদ সদস্যদের ওপর সকল রকম অত্যাচার চালিয়ে তাদেরকে সর্বস্বান্ত করেছে। আর সর্বশেষে আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করা হলেও নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নির্বাচন বাতিল হবেনা’ বলে একটা মস্ত বড় প্রলোভনের টোপ ছেড়েছিল। কিন্তু এই বৈঠক প্রমাণ করে দিয়েছে যে, ইয়াহিয়ার প্রলোভনের টোপ সম্পূর্ণ ব্যর্থ হয়েছে।
সম্মেলনে উপস্থিত প্রতিটি মানুষেই যে সংগ্রামী বাংলাদেশের প্রতিনিধি তার চিহ্ন আঁকা রয়েছে তাদের চোখে-মুখে। তারা এসেছেন রণক্ষেত্রের মুক্তিযোদ্ধাদের এবং সারা বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষের দুর্জয় সংকল্পের প্রতিনিধি হিসেবে। তাদের চোখ মুখ চূড়ান্ত বিজয়ের আলোয় উদ্ভাসিত।
এই বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য, ঐতিহাসিক গুরুত্বও অনেক। ভাবীকালের ঐতিহাসিকেরা যেদিন বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রামের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখবেন, সেদিন এই মুজিবনগর বৈঠকের গুরুত্ব তার যথার্থ প্রেক্ষিত নিয়ে ইতিহাসে লিপিবদ্ধ হবে, এতে কোন সন্দেহ নেই। কেউ কেউ হয়তো বলতে পারেন, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সংসদ সদস্যরা একটা যুক্ত বৈঠক করেছেন এবং দেশের রাজনৈতিক ও সামরিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে কয়েকটি সিদ্ধান্ত নিয়েছেন, তার রাজনৈতিক গুরুত্ব থাকতে পারে, ঐতিহাসিক তাৎপর্য কি?
এই তাৎপর্য বুঝতে হলে আমাদের ফিরে যেতে হবে, আজ থেকে দু মাস আগে জানুয়ারির এক শীত বিকেলে রমনার সবুজ ঘাসে ঢাকা রেসকোর্সের ময়দানে। তখন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সদ্য নির্বাচন বিজয়ের মহা উল্লাস। গণতান্ত্রিক ও রাজনৈতিক অধিকার ফিরে পাওয়ার প্রত্যাশায় বাংলার আবালবৃদ্ধবনিতা প্রতীক্ষারত। সেই মহা বিজয় উল্লাসের দিনে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব প্রস্তাব দিলেন, রমনার মাছের প্রায় ২০ লাখ মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে-অর্থাৎ গণআদালতের দাঁড়িয়ে আওয়ামী লীগের সকল সংসদ সদস্যদের শপথ গ্রহণ করতে হবে, জনগনের রায় বানচাল হতে পারে, জনগণকে দেয়া প্রতিশ্রুতি ভঙ্গ হতে পারে এমন কাজ কেউ করবেন না। জনগণের সঙ্গে, গণ স্বার্থের সঙ্গে কেউ যদি বিশ্বাসঘাতকতা করে, তাহলে জনগণের অধিকার রইল তাকে চরম শাস্তি দেয়ার। সেদিনও বাইরের রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা প্রশ্ন তোলেননি তা নয়, নতুন করে আবার শপথগ্রহণের দরকার কি? বাংলাদেশের জাতীয় নেতা বঙ্গবন্ধু তার ভাষণে এর জবাব দিয়েছেন অল্প কয়েকটি কথায়,”এ নির্বাচনে বিজয়েই চূড়ান্ত বিজয় নয়। আমাদের আবার সংগ্রামে নামতে হতে পারে।”
মাত্র তিন মাসের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর ভবিষ্যৎবাণী অক্ষরে অক্ষরে ফলে গেল। ইউরিয়া চক্র বিশ্বাসঘাতকতা করলো। নিরস্ত্র এবং অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের মোকাবিলায় আধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত কয়েক ডিভিশন সৈন্য তারা লেলিয়ে দিল বাঙালি নিধনে। মার্চ মাসের ৭ তারিখে আবার লাখো লাখো মানুষ জমায়েত হলো রমনার ময়দানে তাদের মুক্তি সংগ্রামে নেতার নির্দেশ লাভের জন্য। তাদের সকলের মনেই সেদিন একটি নীরব প্রশ্ন, এরপর কি হবে? বঙ্গবন্ধু যদি তাদের মধ্যে না থাকেন, তাকে যদি গ্রেপ্তার হতে হয় বর্বর জঙ্গী চক্রের হাতে, তাহলে কি হবে? কে নির্দেশ দেবে সংগ্রামী জাতিকে? এ প্রশ্নেরও জবাব দিলেন বঙ্গবন্ধু নিজেই। আবেগ মন্ডিত বজ্র কন্ঠে বললেন,”আমি যদি নির্দেশ দেয়ার জন্য না থাকি, তাহলে আমার এই নির্দেশ রইল, এই সংগ্রাম চলবে। এই সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এ সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।”
বঙ্গবন্ধু আজ আমাদের মধ্যে হাজির নেই। হানাদার বর্বর ইয়াহিয়া চক্রের হাতে আজ তিনি বন্দি। কিন্তু বাংলাদেশের মুক্তিসংগ্রাম থামেনি, স্বাধীনতার সংগ্রাম পথভ্রষ্ট হয়নি, আওয়ামী লীগের একজন কর্মী অথবা নেতা নীতিভ্রষ্ট হননি, বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে তারা বিশ্বাসঘাতকতা করেননি। বরং তারা আরও ঐক্যবদ্ধ হয়েছেন। মুক্তি সংগ্রাম আরও জোরদার ও সংগটিত হয়েছে। সংগ্রামী চূড়ান্ত জয়লাভের দিনও ক্রমশ আমাদের নিকটবর্তী হচ্ছে। আর এ সংগ্রাম ও সাফল্যের নিরিখেই এ মাসে অনুষ্ঠিত মুজিবনগর বৈঠকের রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্ব বিচার করতে হবে।
ইয়াহিয়া -ভুট্টো -টিক্কা চক্র আশা করেছিল, বঙ্গবন্ধুকে আটক করা হলে নেতা হীন মুক্তি আন্দোলন বানচাল হবে; আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের নির্দেশ মেনে নিয়ে সাড়ে সাত কোটি মানুষের নির্বাচনী রায়কে ব্যর্থ করে দেবে। এ দুরাশায় ইয়াহিয়া তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলে বিশ্ববাসীকে ধোকা দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তাতে ভবি ভোলেননি। আওয়ামী লীগ দলীয় কয়েকজন পরিষদ সদস্যকে বন্দি করা ছাড়া আর দু একজনের বেশি ইয়াহিয়া খান দলে ভেড়াতে পারেন। আওয়ামী লীগ গোটা জাতির সমর্থন পেয়ে মুক্ত অঞ্চলের বাংলাদেশের গণপ্রজাতন্ত্রী সরকার গড়ে তুলেছেন, মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়েছেন। নগরে এই মাসের গোড়ার দিকে তারা সকলেই একত্র হয়ে ইয়াহিয়ার মিথ্যা প্রচারণা ফাঁস করে দিয়েছেন এবং
বিশ্ববাসীকে দেখিয়ে দিয়েছেন, শেখ মুজিব বন্দি হলেও আদর্শ রয়ে গেছে পেছনে, আর রয়ে গেছে তার সুযোগ্য সহকর্মীরা – যাদের নেতৃত্তের প্রভাবেই ইয়াহিয়ার তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের ফাঁদে তাদের কেউ ধরা দেননি। তারা সকলেই মুক্তাঞ্চলে রয়েছেন এবং মুক্তি সংগ্রামে শরিক হয়ে তাদের উপর অর্পিত দায়িত্ব পালনে রত। বিশ্বের কোন কোন প্রখ্যাত রাজনৈতিক ভাষ্যকার তাই বিস্মিত হয়ে মন্তব্য করেছেন, ‘বিশ্ব ইতিহাসে এমনটি আর কখনো ঘটেনি। আওয়ামী লীগের মতো একটি নিয়ম তান্ত্রিক রাজনৈতিক দল রাতারাতি বিপ্লবী চরিত্র গ্রহণ করবে এবং বিপ্লবী ভূমিকা পালন করবে, এটা বিস্ময়কর। বিশ্বের ইতিহাসে এটা তুলনাহীন, উপমাহীন ঘটনা।’
এই বৈঠক প্রমাণ করেছে, ইয়াহিয়া চক্রের চরম বর্বরতার মুখেও বাংলাদেশের গন ঐক্য অটুট, গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ এবং স্বাধীনতার চূড়ান্ত লক্ষ্য অর্জনে দৃঢ় সংকল্প। এই বৈঠক আমাদের মুক্তি বাহিনীর মনে নতুন প্রেরণা এনেছে, সাড়ে সাত কোটি মানুষের মনে এনেছে নতুন প্রত্যয়, দৃপ্ত সাহস। বহির্বিশ্বের বন্ধু রাষ্ট্রগুলো ও উপলব্ধি করেছেন, বাংলাদেশের একমাত্র বৈধ ও প্রতিনিধিত্বশীল সরকার গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
বঙ্গবন্ধুর কণ্ঠে কণ্ঠ মিলিয়ে আমরাও বলি, এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম আমাদের স্বাধীনতার সংগ্রাম! এবং এই সংগ্রামে, জয়লাভ অবশ্যম্ভাবী। উদয়াচলে মুক্তি সূর্যের আলোর রেখা উদ্ভাসিত। রক্ত পিছল সূর্য তোরণে আজ প্রতীক্ষারত বাংলাদেশের সংগ্রামী মানুষ। লক্ষ লক্ষ শরণার্থীর হাহাকার ব্যর্থ হবে না, বীরের রক্তস্রোত, মায়ের অশ্রু ধারা বিফলে যাবেনা। জয় আমাদের সন্নিকট এবং সুনিশ্চিত। জয় বাংলা।
(স্বাধীন বাংলা বেতার থেকে প্রচারিত)
ঐতিহাসিক সমাবেশে অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুলের ভাষণ
আমাদের এ সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম
স্বাধীন বাংলাদেশের মাননীয় পরিষদ সদস্য বর্গঃ
আপনারা আমার সংগ্রামী অভিনন্দন ও শুভেচ্ছা গ্রহন করুন। বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আমরা সবাই আজ এই প্রথম এক সঙ্গে মিলিত হওয়ার সুযোগ পেয়েছি। আমাদের এ সম্মেলন হচ্ছে জাতির এই ক্রান্তিলগ্নে। এমনই এক সময়ে আমাদের এই সম্মেলনের গুরুত্ব অপরিসীম। আমরা যখন এই পরিষদ কক্ষে তখন আমাদের মুক্তিফৌজের নওজোয়ানেরা অপূর্ব বীরত্বের সাথে শত্রুর মোকাবিলা করছে। হাজার হাজার যুবক পবিত্র মাতৃভূমির স্বাধীনতা রক্ষার সংকল্পে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। আত্মোৎসর্গের মহান আদর্শ তারা বলিয়ান। তাদের সমর বিদ্যায় পারদর্শী করে তোলার সর্বপ্রকার প্রচেষ্টা চলছে।
মাননীয় সদস্য বৃন্দ, জানি আপনারা জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি, বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ আপনাদের বিশ্বাস করে তাদের দায়িত্ব আপনাদের হাতে বুঝিয়ে দিয়েছিল।
মাননীয় সদস্য বৃন্দ, আমি জানি আপনারা আমরা সবাই বাংলার স্বাধীনতা যুদ্ধের সৈনিক বই আর কিছু নই। আমি জানি আমাদের মহান নেতা শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের সহচর আমরা এবং আমাদের মহান নেতার জীবনব্যাপী আদর্শ আর সংগ্রামের আমরা ধারক ও বাহক।
বন্ধুরা আমার, আদর্শের জন্য, নিজের জন্য নেতার কাছে আর বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিরক্ষার জন্য এই ধরনের অটুট মনোবল আর কোন দেশের জনপ্রতিনিধিরা দেখাতে পেরেছেন কিনা তার নজির আমার জানা নাই। আপনাদের বীরত্ব আপনাদের আদর্শনিষ্ঠা আপনাদের মনোবল ও মহান ত্যাগের প্রতি, আপনারা যারা গৃহহারা, সর্বহারা হয়েও বাংলার স্বাধীনতা সংগ্রামে আত্ম উৎসর্গ করেছেন -তাদের প্রতি আমার অকুণ্ঠ আন্তরিক সালাম আর অভিনন্দন।
বন্ধুরা আমার, নির্বাচনকালে আমরা রমনার রেসকোর্স ময়দানে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম। সেদিন আমাদের মহান নেতা আমাদেরকে শপথ বাণী উচ্চারণ করিয়েছিলেন। আর সেদিন সাক্ষী ছিল রমনা রেসকোর্স ময়দানের লক্ষ লক্ষ সংগ্রামী জনতা আর সাক্ষী ছিল বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষ নির্যাতিত-নিপীড়িত মানুষ। আমি আজ গর্বের সঙ্গে বলবো সেদিন বাংলার সাড়ে সাত কোটি মানুষকে সাক্ষী রেখে মহান নেতার হাত ধরে আমরা যে প্রতিজ্ঞা করেছিলাম সে প্রতিজ্ঞায় আমরা অটুট এবং অটল রয়েছি। আমি সারা পৃথিবীর রাস্ট্রনীতিবিদ, সারা পৃথিবীর যেখানে যে রাজনৈতিক দল আছেন সবাইকে আমরা বারবার আহ্বান করেছি। আবার আহ্বান করি। আপনারা দেখে যান মানুষের কাছে দেওয়া প্রতিজ্ঞা রক্ষার জন্য কি ধরনের আত্মত্যাগ আর অটুট মনোবল নিয়ে বাংলার জন নেতারা আজ স্বাধীনতার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছেন।
বন্ধুরা আমার, আপনাদের আদর্শ নিষ্ঠা। আপনাদের এই আত্মত্যাগ, আপনাদের অসীম মনোবল বিগত তিন মাস যাবত স্বাধীনতা সংগ্রামকে জিইয়ে রেখেছেন। অবশ্য সঙ্গে সঙ্গেই কথা বলতে হবে আমাদের যে সমস্ত বীর সৈনিকেরা, মুক্তি ফৌজের যে তরুণ সংগ্রামীরা মাতৃভূমির স্বাধীনতার জন্য অস্ত্র হাতে তুলে নিয়েছে এদের অপূর্ব বীরত্ব বাংলার মানুষের জন্য এক গর্বের বস্তু। আর ভবিষ্যৎ ইতিহাসের এক অপূর্ব বীরগাথা।
বন্ধুরা আমার, এরপর বাকি ইতিহাস যে ভাবে প্রবাহিত হয়েছে তার ধারাবাহিক বিবরণী বিশেষভাবে আমার দেওয়ার প্রয়োজন পড়ে না। আপনারা জনগনের কাছে যে প্রতিশ্রুতি দিয়ে নির্বাচিত হয়েছিলেন ছয় দফা ভিত্তিক শাসনতন্ত্র রচনার জন্য আপনাদের নেতার কাছে যে দায়িত্ব দিয়েছিলেন সে দায়িত্ব পালন করতে আপনাদের নেতা এবং তার সহকর্মীবৃন্দ তারা কি প্রচেষ্টা চালিয়েছিলেন, তা আপনাদের জানা আছে।
জাতীয় পরিষদের সদস্য ছিলেন তাঁরা জানেন একটা খসড়া শাসনতন্ত্র প্রণয়ন করে সেই খসড়া শাসনতন্ত্র আপনাদের সামনে পেশ করা হয়েছিল। আপনারা জানেন যে খসড়া শাসনতন্ত্র পর্যালোচনা আর পরীক্ষার জন্য ৩০ সদস্যবিশিষ্ট একটি সাব-কমিটি আপনারা গঠন করেছিলেন। এই ৩০ সদস্যবিশিষ্ট সাব-কমিটি যখন আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিল, সেই সময় আপনারা জানেন মার্চ মাসের পয়লা তারিখের কি করে হঠাৎ করে জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেব ভুট্টো সাহেবের পরামর্শে আর ভুট্টো সাহেবের অভিমান রক্ষা করার জন্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশন বন্ধ করে দেন। সারা পৃথিবীর কাছে আমরা বলেছি, আপনারা বলেছেন, আজকের পাকিস্তান দ্বিধা বিভক্ত হওয়ার যদি কোন মূল আর সঙ্গত কারণ থাকে, তাহলে সেই অবস্থার সৃষ্টি আমরা করি নাই। সে অবস্থার সৃষ্টি করেছেন ইয়াহিয়া খান সাহেব। আর সেই অবস্থা সৃষ্টি করেছেন পশ্চিম পাকিস্তানের শোষকেরা, তারা ২৩ বছর পর্যন্ত বাংলার গরিব, চাষী-মজুরের রক্ত শোষণ করে সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছে।
বন্ধুরা আমার, আওয়ামী লীগের মাননীয় সদস্য বৃন্দ, আমরা কি অপরাধ করেছি। আমাদের একমাত্র অপরাধ ২২ বছর পর্যন্ত আমরা পাকিস্তানের অখন্ডতা রক্ষা করার জন্য চেষ্টা করেছিলাম। আমরা বলেছিলাম, বাংলার মানুষকে শোষণ করে, বাংলার চাষী নজরুলের রক্ত শোষণ করে কায়েমি স্বার্থবাদীরা আর পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিবাদীরা যারা বাংলাকে আজ রিক্ত করেছে, শূন্য করেছে, বাংলার ঘরে ঘরে যারা অনাহারের স্রোত বইয়ে দিচ্ছে, তারাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করতে চায়! কিন্তু বন্ধুরা আমার নিয়মতান্ত্রিক উপায়ে সেই সমস্যার সমাধান করতে চাইলাম বলে আমরা নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিলাম। আমাদের নেতা নির্বাচন পরবর্তী কালেও একটার পর একটা চেষ্টা চালিয়েছিলেন। কিন্তু যারা কায়েমী স্বার্থবাদের দালাল, পশ্চিম পাকিস্তানের সামন্তপ্রভুদের দালাল, আজ যারা পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক যান তাদের ছত্রছায়ায় রাজনীতি করে শুধু বিলাস আর ভোগ করতে চায়, যারা বাংলার কোটি কোটি মানুষের স্বার্থকে চেয়ে দেখে নাই, সেই গ্রামের স্বার্থবাদীরা বঙ্গবন্ধুর গণতান্ত্রিক প্রচেষ্টায় বাধা হয়ে দাড়ালো। আওয়ামী লীগের আন্তরিকতাকে তারা দুর্বলতা মনে করে তাকে বানচাল করতে চেষ্টা করল।
বন্ধুরা আমার, পহেলা মার্চের পর থেকে একটার পর একটা ঘটনা যে কত দ্রুত গতিতে অগ্রসর হয়ে গিয়েছিল সে আপনারা অবশ্যই নিজেরা নিজের চোখে দেখেছেন। আমার স্পষ্ট মনে আছে যেদিন ইয়াহিয়া খান সাহেব জাতীয় পরিষদের অধিবেশন অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি ঘোষণা করলেন, সেদিন পূর্বানী হোটেলে আমরা সম্মেলনে আর একবারের মত আর শেষবারের মতো বসে ছিলাম।
মাননীয় জাতীয় পরিষদ সদস্য বৃন্দ, আপনাদের এখানে স্মরণ করিয়ে দেয় সেই ঐতিহাসিক মুহূর্তের কথা যখন আমরা জাতীয় পরিষদের সদস্যরা সেই পূর্বানি হোটেলে বঙ্গবন্ধুকে সামনে রেখে আমি ব্যক্তিগতভাবে একটার পর একটা প্রতিজ্ঞা বাণী উচ্চারণ করেছিলাম। আর আপনারা সেই প্রতিজ্ঞা প্রতিধ্বনিত করে আবার বলেছিলেন বাংলার মানুষের কাছে-আপনারা বিশ্বাসঘাতকতা করবেন না।
বন্ধুরা আমার, বিশ্বাসঘাতকতা আপনারা করেন নাই। জঙ্গী শাহীর অত্যাচার, ইয়াহিয়ার প্রলোভন কোন কিছু আপনাদের টলাতে পারে নাই। ইতিহাস এই কাহিনী একদিন স্বর্ণাক্ষরে লিখে থাকবে বলে আমার নিশ্চিত বিশ্বাস।
বন্ধুরা আমার, ইয়াহিয়া খান সাহেব আলোচনা করতে চেয়ে ছিলেন, আলোচনা হয়েছিল। আপনারা নিজ-নিজ এলাকায় মফঃস্বলে ছড়িয়ে পড়েছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের বাণী নিয়ে বাংলাদেশের হাটে-মাঠে-ঘাটে, বাংলাদেশের সরকারি আদালতে। বাংলার দেশ প্রেমিক ব্যবসায়ী বৃন্দ, বাংলাদেশ প্রেমিক ছাত্র-জনতার সাহায্যে আপনারা যে অভূতপূর্ব অসহযোগ আন্দোলন সৃষ্টি করেছিলেন, ইতিহাসে তার নজির নেই। সেই অসহযোগ আন্দোলনের মুহূর্ত যখন আমরা ক্রমে ক্রমে ধাপের পর ধাপ একটা থেকে একটা সংকটের মুখে উত্তরণ লাভ করছিলাম, সিম হয়তো ইয়াহিয়া খান সাহেব ১৫ই মার্চ ঢাকায় আলোচনা করতে এসেছিলেন। সেই আলোচনা বসেছিল। আপনারা ছিলেন না। আপনারা অনেকেই শুনেছেন, অনেকে দেখেছেন, অনেকে খবরের কাগজে পড়েছেন -আলোচনার সূত্রপাত হয়েছিল। ইয়াহিয়া খান সাহেবের সঙ্গে বঙ্গবন্ধুর আলোচনা শুরু হলো। ইয়াহিয়া খান সাহেব, আপনি যদি বিন্দুমাত্র সত্য কথা বলেন, আজকে না হোক, কবরে গিয়েও যদি জবাব দেন -তাহলে অস্বীকার করতে পারবেন না যে, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্রথম আলোচনাতেই আপনি স্বীকার করেছিলেন, জনগণের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দিবেন! স্বীকার করেছিলেন যে, মার্শাল ল’ উঠিয়ে দিবেন। স্বীকার করেছিলেন ছয় দফা ভিত্তিতে একটা অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র জারি করে ক্ষমতা আওয়ামী লীগের হাতে তুলে দিবেন। বন্ধুগণ এর ভিত্তিতে আলোচনা শুরু হল। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ এবং নির্দেশে আমি এবং আপনাদের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজ উদ্দিন সাহেব, আমরা আলোচনা শুরু করলাম। জনাব ইয়াহিয়া খান সাহেবের পক্ষে দিলেন লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদা। তাকে সাহায্য করার জন্য আনা হয়েছিল পাকিস্তানের প্রাক্তন বিচারপতি জাস্টিস কর্নেলিয়াস সাহেবকে। আর আনা হয়েছিল অর্থনীতিবীদ বাংলার মানুষের চিরশত্রু মির্জা মোহাম্মদ কে। আলোচনা চললো। ২৪ তারিখে ডকুমেন্ট তৈরি হল। জাস্টিস কর্নেলিয়াস সাহেব উপস্থিত ছিলেন। উনি যদি একজন সৎ খ্রিস্টান হয়ে থাকেন তাহলে তাকে এ কথা স্বীকার করতে হবে।
বন্ধুরা আমার, আপনারা বলতে পারেন, নিরস্ত্র মানুষকে কেন তারা গুলি করে মারল? মাননীয় পরিষদ সদস্যদের বাড়িঘর আক্রমণ করল। বাড়িঘরে কামান চালানো হলো। বহু পরিষদ সদস্যদের জায়গা থেকে জায়গায় খুঁজে বেড়ানো হলো। আপনারা সেসব কাহিনী জানেন।
সেই ২৫শে মার্চের রাতের আধারে এই বীভৎস ঘটনার প্রতিবাদে আপনারা রুখে দাঁড়ালেন। রুখে দাঁড়ালেন বাংলার নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা যে যেখানে ছিলেন। মফ:স্বল শহরে, জেলা শহরে, গ্রামে বন্দরে রাজনৈতিক নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য আপনারা রুখে দাঁড়িয়েছিলেন। আমি শ্রদ্ধার সঙ্গে স্বীকার করব আপনাদের বীর বাঙালি সৈনিকরা বেঙ্গল রেজিমেন্টের ছেলেরা যাদের বীরত্ব আজকের ইতিহাসের এক উজ্জ্বল অধ্যায়। কিন্তু বন্ধুরা যা ভাবতেও পারিনাই তাই হয়েছে। আমাদের ইপিআর বাহিনী, আমাদের পুলিশ বাহিনী, আমাদের আনসার, আমাদের মুজাহিদরাও বাংলার মানুষের পাশে এসে দাড়ালো। বন্দুক আর কামান তুলে নিল। আজ তারা সংগ্রামের পুরোভাগে। বাংলার গ্রামে বন্দরে গঞ্জে আপনারা দাঁড়ালেন। আমি কিভাবে যে আপনাদের শ্রদ্ধা জ্বালাবো তা আমি ভাষায় প্রকাশ করতে পারিনা। যে সমস্ত মিথ্যাবাদী বলে আওয়ামী লীগের নেতারা আর সদস্যরা সংগ্রামের পুরো ভাগে ছিল না তাদের আমি জবাব দিতে চাই। বাংলার মানুষ জানে আপনারা ছিলেন পুরো ভাগে। আমি জানি চট্টগ্রামে, ময়মনসিংহে, যশোরে, রংপুরে, খুলনায়, বরিশালে, ঢাকায়, ফরিদপুরে বাংলার সর্বত্র আপনাদের নেতৃত্বেই সংগ্রাম হয়েছিল। আপনারা সংগ্রাম পরিচালনা করেছিলেন বর্বর ইয়াহিয়া খান বাহিনীর বিরুদ্ধে। নিজের প্রাণের মায়া ত্যাগ করে আপনারা গ্রামে বন্দরে ঘুরে বেরিয়েছেন। বাংলার সৈনিক দের পাশে পাশে আপনারা ছিলেন। অকুতোভয়ে আপনারা লড়েছেন। বাংলার সৈনিক রা বুকের তাজা রক্ত মাতৃভূমির জন্য ঢেলে দিয়েছেন। এরপরে বাংলার স্বাধীনতার ঘোষণা না করে আর কি পথ ছিল? স্বাধীনতার জন্য লড়াই না করে আর কি উপায় ছিল। তা কি কেউ বাতলে দিতে পারে? মূলতঃ এবং বাহ্যত বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার মুহূর্তে স্বাধীনতা ঘোষণার বানি রেখে যান। আমরা দীর্ঘকাল যারা বঙ্গবন্ধুর পাশে পাশে থেকে সংগ্রাম করেছি, আমরা জানতাম, বঙ্গবন্ধু যদি গ্রেপ্তার হয়ে যান তবে স্বাধীনতা ঘোষণা তিনিই করে যাবেন। আরে স্বাধীনতা রক্ষা করার জন্যই আমাদের সংগ্রাম পরিচালনা করে যেতে হবে।
প্রিয় বন্ধুরা আমার, ২৫শে মার্চের রাতের পরে আমরা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিলাম। তাই আপনারা জানেন, স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার গঠনের ঘোষণা করতে আমাদের একটু বিলম্ব হয়েছিল।
আমরা যে পাঁচজন শেখ সাহেবের পাশে পাশে ছিলাম এবং যাদের কাছে কথিত, লিখিত, অলিখিত সর্বপ্রকারের দায়িত্ব বঙ্গবন্ধু দিয়ে গিয়েছিলেন, আমরা বিচ্ছিন্নভাবে বাংলার বনে বনে, জঙ্গলে ঘুরেছি। ১৩ই এপ্রিল তারিখে আমরা বাংলার পূর্ব অঞ্চলে সর্বপ্রথমে একত্রিত হলাম। আমার মাননীয় সদস্য বৃন্দ যারা উপস্থিত ছিলেন তাদের সামনে সেদিন আমি আমার সহকর্মীদের তরফ থেকে স্বাধীনতা কার্যকরী করার জন্য পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম। আমার সেই সমস্ত বন্ধুরা অবশ্যই স্বীকার করবেন তখন এমন একটা সময় ছিল যোগাযোগহীন অবস্থায় যখন আপনাদের বেশিরভাগই ছিলেন বাংলাদেশের দখলীকৃত এলাকায় অভ্যন্তরে। অথচ একটা সরকার গঠন না করলে স্বাধীনতা সংগ্রামকে পরিচালনা করা যাচ্ছিল না। সেইহেতু সেদিন যারা উপস্থিত ছিলেন সেই বন্ধুদের কাছেই আমরা পরিকল্পনা পেশ করেছিলাম।
বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্য করার আহ্বান
রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রেসিডেন্ট বিশ্বের ১৪৬ টি দেশের ১৫০০০ রোটারী ক্লাবের প্রতি বাংলাদেশের অসহায় শরণার্থীদের সাহায্যের জন্য সর্বাত্মক প্রচেষ্টা চালানোর আহ্বান জানিয়েছেন। বিশ্বের বৃহত্তম সংগঠন রোটারি ক্লাব বাংলাদেশের মর্মান্তিক ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে ইতিমধ্যেই বাংলাদেশের জনগণের সাহায্য সক্রিয়ভাবে এগিয়ে এসেছেন।
স্বাস্থ্য ডিরেক্টরের ধন্যবাদ
বাংলাদেশ সরকারের স্বাস্থ্য বিভাগীয় director-general ডাক্তার টি, হোসেন রোটারি ইন্টারন্যাশনাল এর প্রেসিডেন্টের বাংলাদেশের শরণার্থীদের সাহায্যে এগিয়ে আসার জন্য বিশ্বের রোটারি ক্লাব সমূহের প্রতি আহ্বান জানানোর সিদ্ধান্তকে অভিনন্দিত করেন। ঢাকা রোটারী ক্লাবের ডিরেক্টর ডাক্তার টি, হোসেন সকল রোটারি ক্লাব কলকাতাস্থ বাংলাদেশ মিশনের প্রধান জনাব হোসেন আলীর মাধ্যমে এসব সাহায্য প্রেরণের জন্য আহ্বান জানান।
ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে বসল বৈঠক
ইতিহাসের এই ক্রান্তিলগ্নে গত ৫ই এবং ৬ই জুলাই যুদ্ধবিক্ষত বাংলাদেশের মুজিবনগরে জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামীলীগের ওয়ার্কিং কমিটি এবং কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারির দু’দিনব্যাপী অধিবেশন হয়ে গেল। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি এবং দলের ভারপ্রাপ্ত সভাপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম ওয়ার্কিং কমিটির সভায় এবং দুটি পার্লামেন্টারি পার্টি যুক্ত সভায় সভাপতিত্ব করেন।
বিশ্বের রাজনৈতিক ইতিহাসে নজিরবিহীন ত্যাগ-তিতিক্ষা আর রক্তঝরা সংগ্রামের অগ্নিপরীক্ষা উত্তরণের ঐতিহ্যবাহী সাড়ে সাত কোটি বাঙালির জাতীয় প্রতিষ্ঠান আওয়ামীলীগ ও ওয়ার্কিং কমিটির এবং কেন্দ্রীয় প্রাদেশিক পার্লামেন্টারী পার্টির এই যুক্ত অধিবেশন রাজনৈতিক তাৎপর্য ও ঐতিহাসিক গুরুত্বের অধিকারী।
মহান নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ডাকে সারা বাংলাদেশে অহিংস অসহযোগ আন্দোলনের দাবানল এর পটভূমিকায় ঢাকায় অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি অধিবেশন এবং ২৫শে মার্চ সশস্ত্র পাকহানাদার সেনারা অতর্কিতে বাংলাদেশের নিরস্ত্র মানুষের উপর আসুরিক হিংস্রতা নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ার পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণার পর আওয়ামী লীগ-দলীয় মুক্ত জাতীয় প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের এরকম মহতী সম্মেলন এটাই প্রথম। জল্লাদ সামরিক সরকার যখন আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা, আওয়ামী লীগ প্রধান বাংলাদেশের অবিসংবাদিত গণনায়ক মান বন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানসহ আওয়ামীলীগ দলীয় নেতা ও কর্মীকে কারারুদ্ধ এবং জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য সহ দলীয় নেতা ও কর্মী কে যখন হত্যা করা হয়েছে, রক্তপিপাসু জল্লাদ সামরিক বাহিনী তাদের ধরার জন্য হন্যে হয়ে খুঁজে ফিরছে, তাদের বাড়িঘর যখন ভস্মীভূত করা হয়েছে, তাদের ধনসম্পত্তি যখন নিলামে উঠানোর ঘৃণ্যতম নেশায় মত্ত ঠিক এমনই এক মুহূর্তে জঙ্গীশাহীর সকল ভয়-ভীতি ও শত প্রলোভন ভ্রুক্ষেপ না করে হানাদার পাক দস্যুদের কবল থেকে দেশমাতৃকার মুক্তি, নির্যাতিত-নিপীড়িত ধূলি লুণ্ঠিতা মা-বোনকে মর্যাদার আসনে সুপ্রতিষ্ঠিত এবং দেশ থেকে বিতাড়িত ৭০ লক্ষ ছিন্নমূল মানুষকে শান্তি ও নিরাপত্তার সুনিশ্চিত পরিবেশে নিজ দেশে ফিরিয়ে এনে তাদের পুনর্বাসনের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি সমৃদ্ধ এক ঐতিহাসিক গুরুদায়িত্ব নিয়ে আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির এবং পার্লামেন্টারি পার্টির সদস্যগণ এই সভায় যোগদান করেন।
পর্লামেন্টারি পার্টির অধিবেশনে জাতীয় পরিষদেরর ১৩৫ এবং প্রাদেশিক পরিষদের ২৩৯ জন অর্থাৎ মোট ৩৪৭ জন সদস্য এই অধিবেশনে যোগদান করেন। যে ক’জন জঙ্গিশাহীর কারাগারে বন্দি তারা এই অধিবেশনে যোগ দিতে পারেননি। এছাড়া অন্যান্য যারা বিভিন্ন রণাঙ্গনে গুরুত্বপূর্ণ কাজে ব্যস্ত, যারা বন্ধু রাষ্ট্রগুলোতে আশ্রয় নিয়েছেন তারা উপস্থিত হতে না পারলেও অধিবেশনের যে কোনো সিদ্ধান্তের প্রতি পূর্ণ আস্থা ও সমর্থনের কথা জানিয়ে বাণী প্রেরণ করেন।
বৈঠকে উভয় পরিষদের দলের নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্য গনের উপস্থিতির প্রমাণ হয়ে গেল যে জঙ্গিশাহীর জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধি কে তাদের প্রলোভনে ভুলাতে পারেনি। এক নতুন সূর্যের আলোতে যখন বাংলার দশদিগন্ত উদ্ভাসিত সারা বিশ্ববাসীর দৃষ্টি যখন একটি নতুন মানচিত্রে নিক্ষিপ্ত ঠিক এমনই এক ঐতিহাসিক মুহূর্তে আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি পার্টি এবং ওয়ার্কিং কমিটির এই ঐতিহাসিক অধিবেশন হল।
সম্মেলনে যারা উপস্থিত তারা এক একজন যেন একেকটি অগ্নিস্ফুলিঙ্গ। তাদের চোখে-মুখে চরম প্রতিশোধ নেয়ার এক দুর্দমনীয় প্রতিহিংসার জ্বালাময় বহ্নিশিখায় কুমিল্লা জেলার চান্দিনা থেকে নির্বাচিত প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য হাজী রমিজ উদ্দিন কর্তৃক কোরআন তেলাওয়াতে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য, তার মুক্তি পাক হানাদার বাহিনী কর্তৃক নিহত বাংলার মানুষের আত্মার মাগফেরাত কামনা, শত্রুর মোকাবেলায় বাংলাদেশের মানুষের মনোবল অটুট এবং শত্রু বিতাড়নে নিয়োজিত বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধাদের শক্তি সাহস ও সাফল্য কামনা করে দীর্ঘ মোনাজাতের পর গুরুগম্ভীর পরিবেশে অধিবেশনের কাজ শুরু হয়। দু’দিনের অনুষ্ঠিত জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ সদস্যদের দুটি যুক্ত অধিবেশনে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ, অর্থমন্ত্রী জনাব এম মনসুর আলী, বাংলাদেশ বাহিনীর সর্বাধিনায়ক কর্নেল এ জি ওসমানী, জাতীয় পরিষদ সদস্য মেসার্স শামসুল হক, সুবোধ মিত্র, আজিজুর রহমান, আব্দুল মুস্তাকিম চৌধুরী, শামসুর রহমান খন্দকার, হাজী আব্দুস সামাদ, দেওয়ান আব্দুল আব্বাস, আব্দুল আওয়াল এবং প্রাদেশিক পরিষদ সদস্য মেসার্স ডাক্তার আসহাবুল হক, সৈয়দ হায়দার আলী, গৌর চন্দ্র বালা, নুরুল ইব্রালম, জামাল উদ্দিন আহমেদ, এম এস সোহায়সেন আশরাফুল ইসলাম, ক্ষিতীশ চন্দ্র মন্ডল, রাজা মিয়া, শেখ আব্দুর রহমান, আবুল হোসেন, সৈয়দ আতর আলী প্রমুখ সহ প্রায় ৬০ জন জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ নেতা আলোচনায় অংশ নেন। যুদ্ধ পরিস্থিতি, উদ্বাস্তু সমস্যা, পররাষ্ট্র নীতি, দেশের ভবিষ্যত অর্থনৈতিক পুনর্গঠন ও পুনর্বাসন সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা হয়। প্রতিটি বক্তার বক্তৃতায় হানাদার পাকসেনাদের গণহত্যার প্রতিশোধ এবং তাদের বাংলাদেশের পবিত্র মাটি থেকে চিরতরে নিশ্চিহ্ন না করা পর্যন্ত যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার ইস্পাত কঠোর সংকল্পের কথা ঘোষিত হয়।
অপরদিকে দুদিনের সাবেক কেন্দ্রীয় ও প্রাদেশিক আওয়ামী লীগ ওয়ার্কিং কমিটির সভায় দলের সাংগঠনিক বিষয়, মুক্তিযুদ্ধ, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির নয়ন মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মুক্তি এবং বাংলাদেশের রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক পরিস্থিতি সম্পর্কে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়। সভার সভাপতি গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম শপথ গ্রহণ করান।
উদ্ধত আচরণের প্রতিক্রিয়া মারাত্মক হবে
অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের তার বার্তা
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম জাতিসংঘের সেক্রেটারি জেনারেল উথান্ট ও বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত বার্তায় বলেন ইয়াহিয়া খান বর্তমানে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের বিচারের প্রহসনে মেতে উঠেছে। তিনি বলেন, বিশ্ববাসীর এ বিষয়ে অজানা নয় যে, জঙ্গী ইয়াহিয়া সরকার বাংলাদেশের প্রায় ১০ লক্ষ লোককে নৃশংসভাবে হত্যা করেছে। তার দুর্বৃত্ত সৈন্যদের অত্যাচারে ৭০ লক্ষেরও বেশি লোক নিজেদের জন্মভূমি ছেড়ে প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছেন।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম জানান, বাংলাদেশের ব্যাপক গণহত্যা নিমগ্ন হয়ে ইয়াহিয়ার সৈন্যদের যে ক্ষতি হয়েছে তা চাপা দেওয়ার ব্যর্থ চেষ্টা হিসেবে জঙ্গী সরকার এখন বঙ্গবন্ধুর বিচারের প্রশ্নে মেতে উঠেছে, এধরনের উদ্যত আচরণের দ্বারা জঙ্গি ইয়াহিয়া সরকার তার সৈন্যদের নৈতিক অধঃপতন ঠেকাতে পারবে না।
রাষ্ট্রপ্রধান গনের দৃষ্টি আকর্ষণ করে তিনি বলেছেন, বঙ্গবন্ধুর বিচারের নামে এ ধরনের কোনো উদ্যত আচরণ বা অপরিণামদর্শী উদ্যোগ নিলে তার প্রতিক্রিয়া মারাত্মক রূপ ধারণ করবে, রাষ্ট্রপ্রধানদের নিকট প্রেরিত তারবার্তায় তিনি বঙ্গবন্ধু তাঁর পরিবারবর্গের মুক্তির ব্যাপারে তাদের প্রভাব বিস্তারের অনুরোধ জানিয়েছেন।
প্রধানমন্ত্রীর বিবৃতি
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ পশ্চিম পাকিস্তানের জল্লাদ সরকারের হাতে বন্দি বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের নয়নের মনি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কথিত বিচার বন্ধের ব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের সরকারের পৃথক পৃথক এবং জাতিসংঘের মাধ্যমে সমষ্টিগত আশু হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন। মুজিবনগর থেকে প্রদত্ত এক বিবৃতিতে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বঙ্গবন্ধুর আদালতে তার বিচার প্রহসনে কেবল প্রতিবাদীই বিচারক এবং রায় কার্যকর কারি। সুতরাং এহেন বিচার প্রশাসনের ফলাফল সহজেই অনুমেয়। তিনি বলেন, ইয়াহিয়া খানের এই জঘন্য চক্রান্ত অবশ্যই বন্ধ করতে হবে। বিশ্ববাসীর উদ্দেশ্যে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জঙ্গী সরকারের এই উদ্দেশ্যমূলক বিচার প্রহসনের ব্যাপারে বিশ্ববাসী যদি কেবল নীরব দর্শক হয়ে থাকেন তাহলে ইহা মানবতা ও সভ্যতার মূল্যায়নের স্বার্থ চরম বিশ্বাসঘাতকতা ও অপরাধের কাজ হবে। তিনি আরো বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান শেখ মুজিবুর রহমানের জীবনের গুরুত্ব শুধু বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির মধ্যেই নিহিত নয়, বিশ্বের এই অংশের শান্তি ও স্থিতিশীলতার জন্য ও তার জীবনের গুরুত্ব অপরিসীম।
তিনি বলেন, পাকিস্তানের শাসন ক্ষমতা দখল এবং বাংলাদেশের জনমত ও মানবাধিকারকে নিপিষ্ট করার, অপরাধে অপরাধী জেনারেলদের কোনো নৈতিক ও আইনগত অধিকার নেই বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের আশা আকাঙ্ক্ষার প্রতীক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে বিচার করার!
ইসলামাবাদ সরকার একেবারে দেউলিয়া হয়ে পড়েছে
আমার প্রিয় দেশবাসী সংগ্রামী ভাই ও বোনেরা,
গত চার মাস ধরে আমরা সাড়ে সাত কোটি বাঙালির স্বাধীনতা রক্ষার এক মরণপণ সংগ্রাম করে চলেছি। পশ্চিম পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে সৃষ্টি করেছে নতুন ইতিহাস।
এই সংগ্রামে যেসব স্বাধীনচেতা অকুতোভয় বীর সন্তান শহীদ হয়েছে তাদেরকে আমি গভীর শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি। দেশমাতৃকার এইসব বীর সন্তানদের জন্য জাতি গর্বিত। তাদের মৃত্যুঞ্জয়ী মুক্তিপণে আমরা সবাই দীক্ষিত।
শত্রু বর্বর আক্রমণ এবং কিংবা বিকলাঙ্গ হয়ে পড়েছেন তাদের আমরা পূর্ণ সহানুভূতি জানাচ্ছি। আর যেসব অগণিত বীরসন্তান মুক্তিবাহিনী যোগদান করে হানাদার পশুদের সাথে প্রত্যক্ষভাবে চলেছেন স্বাধীনতার রক্ষার শপথে যারা রোদ বৃষ্টি ঝড় উপেক্ষা করে দুর্গম এলাকায় দিনের পর দিন বিনিদ্র রজনী কাটাচ্ছেন সেল,গোলা, বেয়নেটের সামনে ঝাঁপিয়ে পড়ে যারা শত্রু নিধন করে চলেছেন তাদেরকে জানাচ্ছি আমার প্রাণঢালা অভিনন্দন।
চরম দুঃখ কষ্টের মাঝেও বাংলার শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র, জনতা এই আন্দোলনের যে অকুণ্ঠ সমর্থন যোগাচ্ছেন বিশ্বের ইতিহাসে তার তুলনা নেই ।
বন্ধুগণ,
আমাদের এই সংগ্রাম সাংস্কৃতিক এবং অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রাম। দীর্ঘ ২৪ বছরের পশ্চিম পাকিস্তানের শাসনের ইতিহাস আজ আবার নতুন করে বলার প্রয়োজন নেই। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ এ কথা হাড়েহাড়ে অনুভব করেছেন যে পশ্চিম পাকিস্তানী শাসকগোষ্ঠী প্রথম থেকেই পূর্ববাংলাকে তাদের উপনিবেশ হিসেবে ব্যবহার করতে শুরু করেছিল এবং কিভাবে এই উপনিবেশকে টিকিয়ে রাখা যায় সেই ষড়যন্ত্রেই সবসময় লিপ্ত ছিল। বাংলাদেশের উৎপাদিত অর্থকরী ফসল বিদেশে রপ্তানী করে তারা পেয়েছে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা, এখানকার কাঁচামালে সমৃদ্ধ হয়েছে তাদের শিল্প সংস্থার বাংলাদেশ হয়েছে তাদের পণ্যের বাজার মাত্র।
শুধু তাই নয়, বাংলার অগণিত মানুষের হাড়ভাঙা পরিশ্রমের তারা গড়ে তুলেছে এক বর্বর সৈন্যবাহিনী বাংলার স্বার্থকে দমন করাই হচ্ছে যে সেনাবাহিনীর একমাত্র লক্ষ্য ও কাজ বাঙালির যখনই নিজেদের অর্থনৈতিক মুক্তির সংগ্রামে এগিয়ে গেছে এই বর্বর সেনাবাহিনী তখনই তাদের পশুশক্তি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েছে মুক্তিকামী মানুষের উপর। এরই নগ্নরূপ আমরা দেখেছি ১৯৫৮ সালে, ১৯৬৯ এবং সর্বশেষে ১৯৭১ সালের মার্চ মাসে।
বাঙালির অর্থনৈতিক মুক্তির দাবিতে প্রণীত হয়েছিল ছয় দফা কর্মসূচি। এর ভিত্তিতেই মুক্তির এক দুর্বার আন্দোলন গড়ে তুলেছিলেন জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। শহরে বন্দরে, হাটে-মাঠে, গঞ্জে গ্রামে সর্বত্র লাখো জনতা একই রায় দিয়েছিল – ৬-দফা বাঙালির বাঁচার দাবি। ছয় দফাই আমাদের মুক্তির একমাত্র সনদ।
কিন্তু পশ্চিমা সেনাবাহিনীর বরদাস্ত করতে পারলো না এই মুক্তি আন্দোলন। ৬ দফা আন্দোলনের নায়ক, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সহ ৩৫ জন বাঙ্গালীকে মিথ্যা ষড়যন্ত্র মামলায় জড়িয়ে জগতের কাছে নিজেদের করল হাস্যস্পদ। জনতার রুদ্ররোষে তাদের ষড়যন্ত্রের প্রাসাদ ভেঙে খানখান হয়ে গেল। জনতার রায়ে শেখ মুজিব মুক্ত হলেন। আসল ষড়যন্ত্রকারী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খান উপায়ান্তর না দেখে গদি ছাড়লেন। শান্তি রক্ষার নামে গদিনশীন ইয়াহিয়া খান।
গণতান্ত্রিক শাসন ব্যবস্থা চালু করবে বলে ইয়াহিয়া দেশে সাধারণ নির্বাচন দিল। সে নির্বাচনে সাড়ে সাত কোটি মানুষ ছয় দফার পক্ষে তাদের রায় ঘোষণা করলেন। বাংলার অর্থনৈতিক মুক্তির প্রতীক ৬ দফা আন্দোলনের সমর্থক আওয়ামী লীগ শতকরা ৯৮ ভাগ ভোট পেয়ে জয়যুক্ত হলেন। পৃথিবীর ইতিহাসে এই বিজয় নজিরবিহীন।
পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি কায়েমী স্বার্থবাদীদের এ বিজয় সইবে কেন? জনতার রায়কে নস্যাৎ করার জন্য তারা মরিয়া হয়ে উঠল। চিরাচরিত উপায়ে এবারও তারা তাদের ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রকে বাস্তবায়িত করতে নিয়োগ করলো তাদের যাবতীয় দুষ্কর্মের দোসর পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী, তাদের এই ষড়যন্ত্রে হাত মিলালো পশ্চিম পাকিস্তানের কায়েমী স্বার্থবাদী রাজনৈতিক মহল। নেমে এল ২৫ শে মার্চের ভয়াল রাত।
বন্ধুগণ,
তার পরের ইতিহাস একদিকে যেমন বর্বরতার দুরপনের কলঙ্কে কালিমাময় অন্যদিকে তেমনি মুক্তিকামী মানুষের আত্ম প্রত্যয়ের ভাস্বর। পশ্চিম পাকিস্তানের নৃশংসতা মানবসভ্যতার ইতিহাসে সবচাইতে কলঙ্কময় অধ্যায়। নাদির শাহ, চেঙ্গিস খান আর হিটলারকেও নৃশংসতায় হার মানিয়েছে নরখাদক ইয়াহিয়া-টিক্কা খান।
ওরা শুধু লাখো লাখো নিরাপরাধ নিরস্ত্র বাঙালিকে হত্যা করেই ক্ষান্ত হয়নি -এক সুপরিকল্পিত উপায়ে ওরা আমাদের অর্থনীতিকে করেছে সম্পূর্ণ ধ্বংস।
মার্কিন কূটনৈতিকের মন্তব্য
বাংলাদেশের তিন কোটি লোক গৃহহীন
নয়াদিল্লিতে মার্কিন কূটনৈতিক মহল বলেছেন যে, বাংলাদেশের তিন কোটি লোক ছিন্নমূল হয়ে পড়েছেন। তারা খাদ্য এবং নিরাপত্তা সন্ধানে বাড়িঘর ছেড়ে চলে গেছেন।
উক্ত মহল আরো বলেন, ঢাকা থেকে প্রাপ্ত খবরে তিনি জানতে পেরেছেন যে, বাংলাদেশের যোগাযোগ ব্যবস্থা সম্পূর্ণরূপে অচল হয়ে গেছে এবং এজন্য খাদ্যদ্রব্য সরবরাহ করা সম্পূর্ণ অসম্ভব হয়ে উঠেছে।
উক্ত মার্কিন মহলে আরো বলেন, বাংলাদেশের লোকদের জন্য অবিলম্বে খাদ্যদ্রব্য এবং অন্যান্য সাহায্য না পৌঁছলে ক্ষুধা এবং অনাহার আরও লক্ষ লক্ষ লোককে সীমান্ত অতিক্রম করে ভারতে চলে যেতে বাধ্য করবে।
এই মহলটি স্বীকার করেন যে, বাংলাদেশ সমস্যার সমাধানের পূর্বে সেখানে কোন প্রকার সাহায্য কার্য চালানো সম্ভব হবে না।
ভয়েজ অব আমেরিকা পরিবেশিত একবারে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকটের সম্মুখীন হয়নি, নেতৃত্বের অনুপস্থিতিতে এক বিরাট প্রশাসনিক সমস্যারও সম্মুখীন হয়েছে। ঢাকা সংবাদদাতার উদ্বৃত্তের উল্লেখ করে ‘ভয়েস অব আমেরিকা’ জানান, নিজস্ব নেতৃত্বের অভাবে বাংলাদেশের ভবিষ্যৎ প্রশাসন ক্ষেত্রেও শূন্যতা পূরণের কোন সম্ভাবনা নেই। কিভাবে বাংলাদেশে সমস্যার আশু সমাধান হবে সে সম্বন্ধে কোন ভবিষৎবাণী করা খুবই কঠিন বলে রেডিওটি মন্তব্য করে।