জয় বাংলা ১৬ জুলাই ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা
মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন
পাতা-১
জয়বাংলা পাকিস্তান মার্কিন অর্থ
সাহায্য পাবে না
বাংলাদেশের বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ইয়াহিয়া সরকার উন্নয়ন প্রকল্পের নতুন তালিকা প্রস্তুত না করা পর্যন্ত মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র পাকিস্তাঙ্কে অর্থনৈতিক উন্নয়ন এবং কারিগরি সাহায্য বন্ধ রাখবে। যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্র দফতরের জনৈক মুখপাত্র ১৩ ই জুলাই ওয়াশিংটনে এই তথ্য প্রকাশ করেন।
বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাপ্তাহিক মুখপত্র
রেজিস্টার্ড নম্বর-১(বাংলাদেশ সরকার)
মুজিব নগরঃ ১ম বর্ষ, ১০ম সংখ্যা শুক্রবার ৩১ শে আষাঢ়, ১৩৭৮, ১৬ জুলাই ১৯৭১ মূল্যঃ ২৫ পয়সা
আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির বৈঠকে দুর্জয় সংকল্প
আমরা শত্রু বিতাড়নের শেষ যুদ্ধ লড়ছি
বঙ্গবন্ধুর মুক্তি আদায়ে চাপ সৃষ্টির জন্য বিশ্বের বিভিন্ন রাষ্ট্রের প্রতি আবেদন
মুজিবনগর- গত ৫ ই এবং ৬ই জুলাই এখানে অনুষ্ঠিত অধুনা বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির এক যুক্তসভায় বাংলাদেশের পবিত্র অঙ্গন থেকে হানাদার পাকসেনাদের চিরতরে সম্পূর্ণ উৎখাত না হওয়া পর্যন্ত দুর্বার মুক্তিযুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার অনড় অবিচল সঙ্কল্পের কথা দ্যার্থহীন ভাষায় পুনরায় ঘোষণা করা হয়।
ফ্যাসিস্ট ইয়াহিয়া সরকারের অধীনে বন্দী সাড়ে ৭ কোটি বাঙ্গালীর অবিসংবাদিত নেতা গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের গভীর অসুস্থতায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবের গণতন্ত্রের এই নির্ভীক সিপাহসালারের নিরাপত্তার নিশ্চয়তা বিধান এবং তাঁকে মুক্তিদানের উদ্দেশ্যে হানাদার বিদেশি ইয়াহিয়া সরকারের উপর কার্যকরী চাপ প্রদানের জন্য বিশ্বের সকল রাষ্ট্র- বিশেষ করে জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান হয়। উল্লেখযোগ্য যে ওয়ার্কিং কমিটির এই যুক্ত সভায় বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম সভাপতিত্ব করেন। বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের ৩৯ জন সদস্য এই সভায় উপস্থিত ছিলেন। বাংলাদেশের নির্বাচিত গনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের পরিবর্তে পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক জান্তা কর্তৃক নিরস্ত্র নিরীহ বাঙ্গালীর উপর অতর্কিত হামলা এবং নির্বিচারে ইতিহাসের নৃশংসতম গণহত্যা চালানোর প্রেক্ষিতে বাংলাদেশে স্বাধীনতা ঘোষণা সম্পর্কিত সার্বিক পরিস্থিতি সভায় বিস্তারিতভাবে পর্যালোচনা করেন বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগের সাধারণ সম্পাদক জনাব এ, এইচ, এম, কামারুজ্জামান। এরপর সভায় বিলুপ্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগের কর্মকর্তা এবং ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যগণকে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির সদস্যভুক্ত করে নেওয়ার সিদ্ধান্ত সর্বসম্মতিক্রমে গ্রহণ করা হয়। সভায় গৃহীত এক প্রস্তাবে বঙ্গবন্ধুর পরিবার পরিজনদের উপর যাতে পাষণ্ড জল্লাদ ইয়াহিয়া সরকার আর নির্যাতন নিপীড়ন না চালায় তার নিশ্চয়তা বিধান এবং বঙ্গবন্ধুর পরিবারে লোকজনদের বাংলাদেশে সরকারের হাতে অর্পণের সুনিশ্চিত ব্যবস্থা করার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান হয়।
পার্লামেন্টারি পার্টির যুক্ত সভা
মুজিবনগর- গত ৫ ই এবং ৬ জুলাই এখানে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে আওয়ামীলীগ পার্লামেন্টারি পার্টির দুদিনব্যাপী যুক্তসভা অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান সৈয়দ নজরুল ইসলাম এই সভায় সভাপতিত্ব করেন।দুদিনব্যাপী অনুষ্ঠিত এই সভায় জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের ৩ শত ৭৪ জন সদস্য উপস্থিত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধ এবং বাংলাদেশ সরকারের গুরুত্বপূর্ণ জরুরী কাজে ব্যস্ত ৩০ জন সদস্য উপস্থিত হতে পারেননি। তাঁরা এই সভার যে কোন সিদ্ধান্তের প্রতি তাদের অকুণ্ঠ সমর্থন এবং একাত্মতা প্রকাশ করে বাণী প্রেরন করেন ।
জঙ্গিশাহীর হাতে আত্মসমর্পণকারী কেবল ৬/৭ জন এবং বন্দী সদস্যগণ ছাড়া অন্যান্য সদস্য নিরাপদ স্থানে রয়েছেন বলে জানা গেছে।
অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্ব ও দেশবাসীর মনোবলের প্রশংসা
মুজিবনগর ১০ ই জুলাই, গত ৫ই ৬ই জুলাই বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলামের সভাপতিত্বে এখানে অনুষ্ঠিত অধুনালুপ্ত নিখিল পাকিস্তান আওয়ামীলীগ এবং বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ ওয়ার্কিং কমিটির যুক্ত সভাই পবিত্র মাতৃভূমি উদ্ধারের জন্য হানাদার পাক সেনাদের বিরুদ্ধে দুর্বার লড়াইয়ে লিপ্ত বীর প্রসবিনী বাংলাদেশের সেই মরণজয়ী অগ্নিসন্তান মুক্তিযোদ্ধাদের ইস্পাত কঠোর মনোবল, অসীম সাহসিকতা, অতুলনীয় বীরত্ব এবং অদম্য শৌর্য-বীর্যের উচ্ছসিত প্রশংসা করা হয়। বঙ্গবীরঙ্গনার এই দামাল মুক্তিযোদ্ধাগণকে সভায় অভিনন্দন জানান হয়। এ ছাড়া , বাংলার সদাজাগ্রত চিরউন্নতশির জনসাধারণের সুদৃঢ় মনোবলেরও প্রশংসা করা হয়। যারা এই ন্যায়ের সংগ্রাম সমর্থন এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সর্বতোভাবে সক্রিয় সাহায্য ও সহযোগিতা করছেন তাঁদেরও অকুণ্ঠ ধন্যবাদ জানান হয়। সভায় মুক্তিযোদ্ধাদের কার্যক্রমের এবং দেশের ভবিষ্যৎ পুনর্গঠন ও উন্নয়ন মূলক কাজের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামীলীগের সাংগঠনিক তৎপরতা আরও জোরদার করার বিষয়ে ব্যাপক আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়।বলা হয়, যেহেতু গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার জনগনের প্রতিনিধিত্বমূলক একমাত্র বৈধ সরকার, তাই এই সরকারকে স্বীকৃতিদানের জন্য এই সভা বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানাচ্ছে।
সাহায্যদান বন্ধ করুন
সভায় গৃহীত অপর এক প্রস্তাবে বলা হয়, পাকজঙ্গিশাহী এখনও বাংলাদেশের শান্তিপ্রিয় মানুষের বিরুদ্ধে বেআইনি যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে। তাই এই সভা পাকজঙ্গিশাহীকে কোন প্রকার সাহায্য না দেওয়ার জন্য গনতন্ত্র ও মানবতার নামে বিশ্বের সকল রাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানাচ্ছে।
পাতা-২
যুক্ত বৈঠকের ঐতিহাসিক গুরুত্ব
চলতি মাসের ৫ই ও ওই তারিখে মুজিব নগরে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদ-সদস্যদের যে যুক্ত অধিবেশন হয়ে গেল তার ঐতিহাসিক গুরুত্ব ইতিমধ্যেই আমাদের জাতীয় জীবনে প্রতিভাত হতে শুরু করেছে। শুধু জাতীয় জীবনে নয়, আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রেও এই বৈঠক বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রাম ও তার গণ প্রতিনিধিত্বমুলক চরিত্রের একটা যথার্থ প্রেক্ষিত তুলে ধরবে তাতে সন্দেহ নেই। এতে রণাঙ্গণে সংগ্রামরত আমাদের বীর মুক্তি বাহিনীর ও গেরিলা যোদ্ধাদের মনোবল ও আক্ৰমণ-ক্ষমতা যেমন আরো বাড়বে, তেমনি বাংলাদেশের মুক্তি সংগ্রামে যেসব বন্ধুরাষ্ট্র অকৃপণ ভাবে সমর্থন জোগাচ্ছেন, তাদের এই সমর্থনের নৈতিক ভিত্তি আরো দৃঢ় হবে। কারণ, রণাঙ্গণের বীর মুক্তিযোদ্ধারা যেমন জানেন, তাদের সংসদীয় গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধভাবে তাদের পাশেই রয়েছেন, তেমনি বিশ্বের মানবতাবাদী ও শান্তিকামী বন্ধু দেশগুলোও জানবে, বাংলা দেশের মুক্তি সংগ্রাবে সকল স্তরের মানুষের ঐক্য অটুট ও অনড় রয়েছে। ভুল ভ্রান্তি মানুষ মাত্রেরই হয়। বাংলা দেশের মানুষের উপর আকস্মিক ভাবে চাপিয়ে দেয়া এই যুদ্ধে প্রাথমিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রেও ক্ষেত্র বিশেষে ভুলভ্রান্তি ঘটতে পারে। বিপ্লবের ইতিহাসে, স্বাধীনতার যুদ্ধে প্রাথমিক প্রস্তুতির ক্ষেত্রে এই ধরণের মানবিক ভূলভ্রান্তি—সবদেশে সব যুগেই ঘটতে দেখা গেছে। এই ভুল ভ্রান্তি বড় কথা নয়। বড় কথা, অটুট গণ-ঐক্য, জাতীয় ঐক্য এবং শত্রুর উপর আঘাত হানার ক্রমবর্ধমান মনোবল। গত তিনমাসে বাংলাদেশের মানুষ প্রমাণ করেছে, তারা নিরস্ত্র এবং অপ্রস্তুত থাকা সত্ত্বেও আধুনিক সমরাস্ত্রে সজ্জিত পাঁচ ডিভিসনের এক বিশাল ও বর্বর দস্যু বাহিনীর বিমান, ট্যাঙ্ক ও গানবোটের ত্রিমুখী আক্রমণ তারা সাফল্যের সঙ্গে প্রতিরোধ করে চলছে। তাদের বড় অল্প অটুট মনোবল ও দেশের সর্বস্তরের মানুষের মধ্যে ঐতিহাসিক ঐক্য। বাংলা দেশের একজন মানুষ, তিনি বুদ্ধিজীবি, চাকুরীজীৰী ব্যবসায়ী, কিম্বা গণ প্রতিনিধি হোন, অথবা ক্ষেতের চাষী ও কারখানার মজুর হোন, নিদেন দিনমজুর হোন, আজ একটি মাত্র লক্ষ্যে তারা সকলেই উদ্দীপিত ও অবিচল, তা হল বাংলা দেশের মুক্তি ও স্বাধীনতা। ষোড়শ ও সপ্তদশ শতকের প্যাটার্নে ইয়াহিয়ার জঙ্গীচক্র বাংলা দেশে যে ঘৃণ্য ঔপনিবেশিক শাসন কায়েম করতে চায়, তার শৃঙ্খল ভেঙ্গে মুক্তির উদয়াচলে—নতুন মুক্তি সূর্যের প্রত্যাশায় ভোরের অরুণিমার মত তাজা বুকের লহু ঢালছে দেশের বীর মুক্তিবাহিনী। এই রক্তদান বৃথা যেতে পারে না। মুজিব নগরের বৈঠকে সম্মিলিত হয়ে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্য ও নেতারা সমস্বরে এ কথাই ঘোষণা করেছেন, বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছেন। এই ঐতিহাসিক বৈঠক আরো স্পষ্ট করে তুলল, এই মুক্তিযুদ্ধে জনগণের ও জনপ্রতিনিধিদের ঐক্য কত অকৃত্রিম ও নিবিড়।
ফ্যাসিষ্ট আইয়ুবের রাজনৈতিক জারজপুত্র জুয়াড়ী ইয়াহিয়া বাংলাদেশের রাজনীতিতে একটি নতুন জুয়ার চাল চালতে চেয়েছিলেন। তিনি বিশ্ববাসীকে বোঝাতে চেয়েছিলেন যে, আওয়ামী লীগকে রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তিনি নিষিদ্ধ করেছেন বটে, তবে আওয়ামী লীগের পরিষদ সদস্যদের সদস্যপদ তিনি নষ্ট করেননি, এমন কি গত ডিসেম্বর মাসের নির্বাচনকেও তিনি বানচাল করতে চান না। সাধু! সাধু! এ নাহলে ‘নির্ভেজাল গণতন্ত্রী’ আর কাকে বলে! দুনিয়া দেখুক, ইয়াহিয়া-চক্র গণতন্ত্রের কতবড় পূজারী! তিনি জনগণের ফল নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন, কিন্তু দলের সদস্যদের হাতছাড়া করতে চান না। তিনি নির্বাচন বানচাল করতে চান না, চান নির্বাচনে জনগণের রায় বানচাল করে দিতে। তারপর যারা তার হাতে বয়েৎ হবে তাদের দিয়ে একটা পুতুল সরকার গঠন করে নিজেদের ইচ্ছামত এমন একটা শাসনতন্ত্র তৈরী করা, যে শাসনতন্ত্র জনগণের প্রতিনিধিদের দ্বারা রচিত এই মর্মে অপপ্রচার চালিয়ে বিশ্ববাসীর চোখে ধূলা দেখা যাবে এবং অন্যদিকে
যে শাসনতন্ত্রে নানা কথার মারপ্যাচে ক্ষমতার চাবিকাঠি রাখা হবে ইয়াহিয়ার বর্বর জঙ্গী চক্রের হাতে, জনগণের অথবা জনপ্রতিনিধিদের হাতে নয়। যে শাসনতন্ত্র হবে আইউবী শাসনতন্ত্রের চাইতেও ধোঁকাবাজিপূর্ণ। আর এই ইচ্ছা থেকেই ইয়াহিয়া এদ্দিন তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের কথা বলেছেন। তার এই ‘রাজনৈতিক সমাধানের’ বটিকা সেবনের জন্য আইউবের দশ বছরের সেবাদাস ফজলুল কাদের চৌধুরী, সবুর, ওয়াহিদুজামানের মধ্যে যেমন কাড়াকাড়ি পড়ে গেছে, তেমনি কাড়াকাড়ি লেগেছে আইউব আমলের গোপন সেবাদাস ফরিদ, খাজা খয়ের, গোলাম আজম প্রমুখ চামুদের মধ্যে। ইয়াহিয়া আশা করেছিলেন, এই চামুদের সঙ্গে আওয়ামীলীগের কিছু পরিষদ সদস্যকে ধরে বেধে এনে যুক্ত করে তিনি তার তাবেদার পার্লামেন্ট ও সরকার খাড়া করবেন। এই দুরাশা নিয়েই তিনি যে আওয়ামী লীগ দলীয় পরিষদ সদস্যদের বাড়ীঘর জ্বালিয়েছেন, তাদের পরিবার পরিজনের উপর অকথ্য অত্যাচার চালিয়েছেন, সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত করে ১৪ বছর জেল – দিয়েছেন, এমন কি তাদের কাউকে কাউকে খুন করেছেন, হঠাৎ সেই পরিষদ সদস্যদের প্রতিই “ক্ষমা প্রদর্শন” ও জীবনের নিরাপত্তার “নিশ্চয়তা” দিয়েপ্রচার কার্য চালাতে শুরু করেন। কিন্তু সীমান্তে ‘অভ্যর্থনা শিবির’ স্থাপন এবং দালালদের মাধ্যমে অনেক দেনদরবারের পরও দেখা গেছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যরা কেউ ইয়াহিয়ার বশম্বদ হতে কিংবা তার পা চাটা কুত্তাদের দলে ভিড়তে রাজি নয়। যে দু’একজন সদস্যকে বন্দুকের নলদেখিয়ে ইয়াহিয়া কয়েদ করেছেন, ভবিষ্যতে সুযোগ পেলে তারা কি করবেন, সে সম্পর্কেও ইয়াহিয়া-চক্র নাকি নিশ্চিত নন। ফলে এলো ২৮শে জুনের বেতার ঘোষণা। তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের প্রহসন শিকায় তুলে রেখে ইয়াহিয়া বাধ্য হয়ে বিশ্ব বাসীকে তার আসল চেহারা দেখালেন, বললেন, তিনি বিশেষজ্ঞ দ্বারা তৈরী একটা শাসনতন্ত্র দেশকে উপহার দেবেন। অর্থাৎ নিজেই একটা শাসনতন্ত্র তৈরী করবেন। দেশকে শাসনতন্ত্র দেয়ার নামে আইয়ুব যা করেছিলেন, তার রাজনৈতিক জারজপুত্রেরা তার চাইতে বেশি কি করতে পারেন?
ইয়াহিয়া-ভূট্টো-টিক্কা চক্রের এই ঘৃণ্য ষড়যন্ত্রেরই সমুচিত ও সফল জবাব বর্তমান মাসের গোড়ার দিকে অনুষ্ঠিত আওয়ামী লীগ দলীয় উভয় পরিষদের সদস্যদের যুক্ত বৈঠক। এই বৈঠকে জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদের সাড়ে পনর আনা সদস্য অংশ গ্রহণ করে একথাই দিবালোকের মত স্পষ্ট করে দিয়েছেন যে, আওয়ামী লীগের কিছু সংখ্যক সদস্যকে নিয়ে একটা তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের চেষ্টায় ইয়াহিয়া সফল হচ্ছেন বা হবেন, এই প্রচার সম্পূর্ণ মিথ্যা। ইয়াহিয়ার হাতে দু‘ চারজন বন্দী সদস্য ছাড়া কেউ নেই। বাংলা দেশের প্রকৃত গণপ্রতিনিধিরা রয়েছেন মুক্তাঞ্চলে, প্রকৃত বৈধ সরকার রয়েছে মুজিব নগরে। দস্যু ইয়াহিয়াচক্র অধিকৃত বাংলাদেশে অবৈধ দখলদার মাত্র। বাংলা দেশের মাটিতে অবস্থান করা বা বাংলা দেশের মানুষের নামে কথা বলার কোন অধিকার এই খুনী ও তস্কর-চক্রের নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বাংলাদেশের মানুষের নামে কথা বলবে, তাদের প্রতিনিধিত্ব করবে একমাত্র গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার।
মুজিবনগরের বৈঠক ঐতিহাসিক গুরুত্ব লাভ করবে এজন্যেই যে, এই বৈঠক বাংলা দেশের মানুষ ও মুক্তি বাহিনীর মনোবল দ্বিগুন বাড়িয়ে দিয়েছে। দেশের মানুষ জেনেছে তাদের গণপ্রতিনিধিরা রমনায় দশ লক্ষাধিক জনতার সামনে ৩রা জানুয়ারী তারিখে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুরের নেতৃত্বে যে শপথ গ্রহণ করেছিল, সে শপথ তারা ভঙ্গ করেনি, বরং অক্ষরে অক্ষরে পালন করছে। আজ মুক্তি বাহিনী জাতীয় স্বাধীনতা অর্জনের যে পবিত্র দায়িত্ব পালন করছে রণাঙ্গনে, সেই একই দায়িত্ব পালন করছে আওয়ামী লীগের সংসদীয় সদস্যেরা জাতীয় ও আন্তর্জাতীয় ক্ষেত্রে। গণমানুষ ও গণপ্রতিনিধিদের ভূমিকায় আজ আর কোন পার্থক্য নেই। একই প্রতিরোধ-চেতনা ও স্বাধীনতা কামনায় তারা উদ্বুদ্ধ, অনুপ্রাণিত। আন্তজাতিক ক্ষেত্রেও মুজিব নগর বৈঠকের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রথমতঃ নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের একটা অংশকে ইয়াহিয়া-চক্র হাতে পেয়েছে এবং তাদের যোগসাজশে ইয়াহিয়া বাংলা দেশের হয়ে কথা বলতে পারে এই দাবী ও প্রচারনা সম্পূর্ণ মিথ্যা প্রমাণিত হয়েছে। বিশ্বের শান্তিকামী গণতন্ত্রী ও মানবতাবাদী দেশগুলোর কাছে আজ এটা পরিস্কার যে, বাংলাদেশের গণপ্রতিনিধিরা ঐক্যবদ্ধ রয়েছেন এবং স্বাধীনতার লক্ষ্য অর্জনে তারা কৃতসংকল্প।
এই অবস্থায় বাংলাদেশের জনগণের নির্বাচিত বৈধ সরকার হিসাবে গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারই তাদের সর্ব প্রকার সাহায্য ও সহযোগিতা লাভের দাবীদার। গণপ্রতিনিধিত্বহীন ইয়াহিয়ার গণ-দুশমন চক্র বাংলা দেশে বেআইনী দখলদার, সুতরাং মুজিব নগরের বৈঠকের পর বাংলা দেশ সরকারের আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আরো ত্বরান্বিত হবে এবং বিশ্বের আরো বেশী সংখ্যক রাষ্ট্র বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের সাহায্য ও মৈত্রীর হাত বাড়াবেন, এ বিষয়ে আমরা সুনিশ্চিত। জনগণের ঐক্যবদ্ধ সংগ্রাম কখনো ব্যর্থ হয় না। বাংলাদেশের জনগণের মুক্তি সংগ্রামও ব্যর্থ হতে পারে না। স্বাধীনতার রক্তপতাকা মুক্ত অঞ্চলের ঘরে ঘরে উড়ছে। গণ ঐক্যের অজেয় দুর্গের প্রাকারে বাজছে আসন্ন বিজয়ের দুন্দুভি। পূর্ব দিগন্তে রক্তারুন উদয়ঊষার সুসংবাদ ছড়াচ্ছে। জয় আমাদের অবশ্যম্ভাবী। মুজিব নগরের বৈঠক এই অবশ্যম্ভাবী বিজয় আরো তরান্বিত করবে। জয় বাংলা।
পাতা-৩
পশ্চিম পাক দস্যুরা ইসলামের নামে এতকাল শোষণ করেছে
আমার মাকে দেখেছি পাঁচ ওয়াক্ত নমাজ আদায় করছেন। আবার সংসারের কাজও করছেন। আল্লাহ মানুষের রুটি-রোজগার যোগান, কাজেই যিনি সৃষ্টিকর্তা, যিনি আহার দেন, তার প্রতি কৃতজ্ঞতা জ্ঞাপন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা। প্রার্থনার মাধ্যমে অদ্যাবধি ধর্মভীরু মানুষ, তার সমস্ত মানসিক সংকটের পরিত্রাণ খুজেছে। মাকে দেখেছি, ইসলামের বিধি-বিধান থেকে যাতে তার বিচ্যুতি ঘটে, সে ব্যাপারে বড় সাবধানে থাকতেন। কিন্তু, এও দেখেছি আশে পাশের প্রতিবেশীদের প্রতি তিনি সর্বদা বিনয়ের সঙ্গে কথা বলতেন, গরীব-মজুরের দুঃখের দিনে তাদের যতটা পারতেন, সাহায্য করতেন। রোগ-ব্যাধি হলে সকলের পাশে এসে দাঁড়াতেন। অন্য দিকে, পাড়ার লোকেরাও মাকে সমীহ করে চলতেন, আপদে-বিপদে মায়ের পরামর্শ নিতেন। আরও দেখেছি, বাড়ির গরু-ছাগল হাঁস-মুরগী সকলের প্রতি তার একটা সহমর্মিতা ছিল। জন্তু জানোয়ারের প্রতি অযথা নিষ্ঠুরতা তিনি সইতে পারতেন না। গাছপালাও তার স্নেহাদর থেকে বাদ পড়েনি। কেউ, রাতের বেলা গাছের ফল বা পাতা ছিড়লে তিনি ক্ষেপে যেতেন। বলতেন, সবারই বিশ্রাম নেবার সময় আছে এবং গাছপালা তরুলতারও আছে।
অধ্যাপক আবদুল হাফিজ
ধর্ম বলতে আমি আজও যেটুকু বুঝি, সেটুকু আমি শিখেছি আমার মায়ের কাছে। ধর্ম মানে যে শুধু আচার নয়, তার সঙ্গে হৃদয়ের গভীর আত্মীয়তা দরকার, সেই শিক্ষা মায়ের কাছে আমি পেয়েছিলাম। অন্য কোন জাতির বিরুদ্ধে কখনও কথা বলতেন না-অন্য ধর্মের বিরুদ্ধেও বলতেন না। আমাকে বলেছিলেন, খোদা তো সবাইকে সৃষ্টি করেছেন, সবাইকে তিনি আহার দিচ্ছেন। কে ভালো আর কে মন্দ, সে বিচার করবেন খোদা। কে পাপী আর কে পুণ্যবান, সেটাও তিনিই স্থির করবেন। কাজেই খোদার সৃষ্ট জীব হয়ে, অন্যান্য সৃষ্ট জীবের বিচার করবার অধিকার আমার নেই। দেখো না, খোদা সকলেরই অন্ন দিচ্ছেন কে কোন ধর্মে বিশ্বাসী, তা দেখে তো তিনি অন্ন দেন না। আল্লার দেওয়া আলো হাওয়া শুধু পুণ্যবানই ভোগ করবে এমন তো নয় বাবা। পাপী-তাপীরাও তা সমানভাবে পায়। যদি আল্লাহ স্বয়ং পাপী-তাপী-বিধর্মী সবাইকে তাঁর স্নেহাদর দিতে পারেন সমানভাবে, তাহলে আমার কি ক্ষমতা যে আমি সবকিছুর বিচার করি। মা যেভাবে বলতেন, সেভাবে আমি বলতে পারি না। শুধু অনুভব করতাম, কথা বলবার সময় মায়ের চোখে মুখে বিশ্বাসের আলো কমণীয় হয়ে ফুটে উঠতো।
হঠাৎ মায়ের কথা মনে পড়েছিলো। মায়ের সঙ্গে কতদিন দেখা হয়নি। আর কি দেখা হবে ? হয়তবা হবে না। ইয়াহিয়ার খুনী সেনারা দশ লক্ষ খুন করেছে। আরও দশ লক্ষ করবে প্রয়োজনবোধে। মাগো, তোমার সঙ্গে যদি আর দেখা না হয়, ক্ষমা করো আমাকে ক্ষমা করো তোমার অকৃতজ্ঞ সন্তানকে। মাগো, শুধু আমি একা নই, তাোমারই মতো স্নেহপরায়ণ মায়ের কত সন্তান নিখোঁজ হয়েছে। কত যুবক ইয়াহিয়ার জল্লাদ সেনাবাহিনীর হাতে প্রাণ দিয়েছে। আর মাগো, তুমি কেঁদো না। মনে কোরো, এই আমার চিঠি। ঠিকানাবিহীন চিঠি। আজ যা বলছি—তা বলছি, তোমাকে লেখা আমার চিঠি থেকে।
তুমি তো ধর্মের কথা বলতে মা। ইয়াহিয়াও ধর্মের কথা বলছে। কিন্তু কী ভীষণ পার্থক্য! পশ্চিম পাকিস্তানের পুঁজিপতিরা ইসলাম ধর্মকে নিজেদের সেবা দাসী করে ফেলেছে। ১৯৪৭ সাল থেকে সেই যে শোষণ শুরু হল, তার আর শেষ হল না। তোমার তো মনে আছে মা, ১৯৫৪ সালে একমন ধান বেচে তুমি আমাকে এক দিস্তা কাগজ কিনে দিয়েছিলে। কারণটা তোমার জানা ছিল না। চন্দ্রঘোণা পেপার মিলের কাগজ প্রথমে যেতে পশ্চিম পাকিস্তানে, তারপর ফিরে আসতো ঢাকায় বিক্রির জন্য। কাগজের এজেন্টরা ছিল সবাই পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতি। | তামাক চাষের কথা তো তুমি জানো মা। কি হাড়ভাঙ্গা খাটুনী খেটে তামাক আমরা উৎপন্ন করতাম। অথচ আমরা তার দাম পেতাম না। যে মুহূর্তে তামাক পুঁজিপতির ঘরে যেতো, অমনি তার দাম বেড়ে যেতো। পশ্চিম পাকিস্তানীরা এভাবেই ধর্মের নামে ইসলামের নামে আমাদের শোষণ করেছে। বলেছে, মুসলমান মুসলমান ভাই ভাই। কিন্তু আজ তো দেখছো মা, আমরা সব ঠাই ঠাই। ধর্মের নামে শোষণ বেশীদিন চললো না। বাঙলার সন্তানেরা সব বুঝে ফেললো। তাই তারা রচনা করলেন বিপ্লবের পথ, মুক্তির পথ।
মার্চ মাস থেকে শুরু হল বিপ্লবের জয়যাত্রা। বাঙলার অগ্নি সন্তানেরা ঝাপিয়ে পড়লেন আন্দোলনে। ইয়াহিয়ার জল্লাদ সেনাবাহিনীও ঝাঁপিয়ে পড়লো। ওরা কি বলে জানো মা, ওরা নাকি ইসলাম ধর্মকে বাঁচাতে এসেছে। বাঙালী জাতটা নাকি উচ্ছন্নে গেছে, তাই তাদের শায়েস্তা করা দরকার। কিন্তু অবাক লাগে, যখনওরা শোষণ করে। ওদেরকে যদি বলা যায়, তোমরা যদি এতই মুসলমান হয়ে থাকো, তাহলে বাংলাদেশের মানুষকে এভাবে শোষণ করো কেন? কেন হিন্দু মুসলমানে বিভেদ সৃষ্টি করো ।কেন বাঙালী-অবাঙালীর মধ্যে দাঙ্গা বাঁধাও ? কিন্তু না ওরা এসব প্রশ্নের জবাব দেয় না। কেননা জবাব দেবার কিছুই থাকে না। কিন্তু তারা ইসলামের কথা বলে। কারণ ওরা সাধারন মুসলমানকে বিভ্রান্ত করতে চায়। ওরা শোষণ আর অত্যাচারের কাহিনী গোপন করার জন্যে ইসলামের কথা বলে। আর এখন এই মুহুর্তে, ইসলামের নামেই তারা বাঙালী মায়ের সন্তানকে হত্যা করছে। সে হত্যা, খুন, ধর্ষন, অত্যাচারের কাহিনী শুনবে মা। অবশ্য তুমি তো চোখের সামনেই সব দেখছো। তবু বলি মা শোনো।
ওরা কি ভাবে ইসলাম ধর্মের সেবা করছে শোনো। মুসলমানরা নমাজ আদায় করে মসজিদে, সেই মসজিদ ওরা ভেঙ্গে দিয়েছে বহু জায়গায়। একটি মসজিদে মুসলমানরা নমাজ পড়ছে—ওরা সেসব নমাজীদেরকে হত্যা করলো! ঢাকার রেসকোর্স ময়দানে ছিল বহু পুরানো কালীবাড়ী, তা ভেঙে গুড়িয়ে দিলো। চট্টগ্রামে বৌদ্ধদের বিহার ও মন্দির ওরা তছনছ করে দিয়েছে। খ্রীষ্টানদের গীর্জা বাড়ি ও স্কুলঘর ওরা ধ্বংস করেছে। সত্যি মা এমনভাবে ইসলাম ধর্মের সেবা কেউ কখনো করেনি। সব ধর্মের প্রতি ওরা সমান ওদার। কাউকে ওরা রেহাই দেয় না। দশলক্ষ বাঙালীকে ওরা শুধু হত্যাই করেনি, মুসলমান-হিন্দু-খ্রীষ্টান সবার মৃতদেহ ওরা শেয়াল-কুকুর, শকুনি-গৃধিনী দিয়ে খাইয়েছে। আজো রাস্তায় রাস্তায় নর-কঙ্কাল পড়ে আছে। নদীতে নদীতে ভেসে যাচ্ছে মৃতদেহ। সেদিন এক জায়গায় দেখছি, একটি মৃতদেহ পড়ে আছে। দুটি কাক মৃতদেহের চোখ দুটি উপড়ে নিচ্ছে। মাগো, আমার কি মনে হয় জানো, ওগুলো কাক নয়—ওগুলো পশ্চিম পাকিস্তানী খুনী জল্লাদদের প্রেতাত্মা!
কী অত্যাচার মা! তোমার পেটের সন্তান আমি—অথচ ধরো তোমার চোখের সামনেই আমাকে যদি ওরা খুন করে । মা তুমি সহ্য করতে পারবে। কিন্তু খুন তো সামান্য কথা। আমার মা-বোনকে ওরা কীভাবে ধর্ষণ করছে, তা ভাবা যায় না। মা-বাপের সামনে মেয়েকে ধর্ষণ করছে ইয়াহিয়ার সেনারা। কিন্তু তাতেও যখন সুখ হলো না, তখন বেয়নেট দিয়ে আমার বাোনেদের হত্যা করে। সন্তানের একমাত্র আশ্রয়, মায়ের স্তন্যকে ওরা কেটে নাবিয়ে দিয়েছে। হাজার হাজার মা-বোনকে ধরে নিয়ে গিয়ে সামরিক ছাউনিতে রেখেছে—তাতেও সাধ মেটেনি। আজ তাদেরকে পাঠানো হচ্ছে পশ্চিম পাকিস্তানে ইয়াহিয়া খানের সেবাদাসী করবার জন্যে। মাগো, এভাবেই ওরা ইসলাম ধর্মের সেবা করছে।
মাগো, ভেবে পাই না, তুমি যে আল্লাকে ডাকো, তার রুদ্র রোষ কেন এদেরকে আঘাত হানে না। কেন ধরণী দ্বিধা হয় না, কেন আকাশ ভেঙে পড়ে না মাথায়, কেন বজ্র এসে এদেরকে ধ্বংস করে না।
মাগো, আমরা বুঝেছি, এমনি কিছু হবে না। তাই মা মুক্তি বাহিনীর হয়ে লড়াই করছি। জয় আমাদের সুনিশ্চিত। যদি আর দেখা না হয় মা, তুমি জেনে রেখো, তোমার সন্তান দেশের জন্য লড়ছে। মা, আমারই মতো তোমার একছেলে কবিতা লিখে অত্যাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিল। তার কবিতা তাোমাকে পড়ে শোনাচ্ছিঃ
অনেক রক্ত দিয়েছি আমরা, বুঝি আরো দিতে হবে
এগিয়ে চলার প্রত্যেক উৎসবে।
তবুও আজকে ভরসা, যেহেতু তোমরা রয়েছ পাশে,
তোমরা রয়েছ এদেশের নিঃশ্বাসে।
তোমরা রয়েছ, আমরা রয়েছি, দুর্জয়-দুর্বার,
পদাঘাতে পদাঘাতেই ভাঙব মুক্তির শেষ দ্বার।
আবার জ্বালাবো বাতি,
হাজার সেলাম তাই নাও আজ, শেষ যুদ্ধের সাথী।
তাই এসো চেয়ে দেখি পৃথ্বী—
কোনখানে ভাঙে আর কোনখানে পড়ে তার ভিত্তি।
কোনখানে লাঞ্ছিত মানুষের প্রিয় ব্যক্তিত্ব ;
কোনখানে দানবের মরণ-যজ্ঞ চলে নিত্য ;
পণ কর দৈত্যের সঙ্গে
হানবো বজ্রাঘাত, মিলবে। সবাই এক সঙ্গে ;
সংগ্রাম শুরু কর মুক্তির
দিন নেই তর্ক ও যুক্তির
আজকে শপথ কর সকলে।
বাঁচাব আমার দেশ, যাবে না তা শত্রুর দখলে;
তাই আজ ফেলে দিয়ে তুলি আর লেখনী।
একতাবদ্ধ হও এখুনি।
পাতা-৪
মৃত পাকিস্তানকে জিইয়ে রাখার জন্যে ইয়াহিয়ার মরা কান্না
জেনারেল ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ পৃথিবীর সমস্ত শান্তিকামী মানুষকে। নিরাশ করেছে। তার বক্তৃতা থেকে একথা সুস্পষ্ট হয়ে গিয়েছে যে তিনি বাঙলাদেশের সমস্যার কোন রাজনৈতিক সমাধান চান না। কিন্তু কেবল বাঙলাদেশ নয়, তার বক্তৃতায় পশ্চিম পাকিস্তানের মানুষও খুশী হতে পারে নি। তার বক্তৃতার পর সিন্ধু প্রদেশ থেকে দাবী করা হচ্ছে, পূর্ণ আঞ্চলিক স্বায়ত্ত শাসন দিতে হবে। পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য অঞ্চল থেকেও পুর্ণ। স্বায়ত্ত শাসনের দাবী স্বাভাবিক ভাবেই উঠবে। কিন্তু ইয়াহিয়ার বক্তৃতায় এই ধরণের দাবী পুরনের কোন সম্ভাবনার ইঙ্গিত নাই। ফলে পশ্চিম পাকিস্তানেও দেখা দেবে গণ আন্দোলন। এই আন্দোলনের ফলে পশ্চিম পাকিস্তানও এগিয়ে যাবে ভাঙ্গনের মুখে। একথা এখন পরিষ্কার যে ইয়াহিয়ার অপরিণামদর্শীতাই পাকিস্তানকে ধ্বংস করেছে। জেনারেল এখন প্রমাণিত হয়েছে রাজনীতির কিছুই বোঝেনা। অবশ্য বাোঝার কথাও নয়, যদি ও ভান করেছিলেন যে তিনি অনেক কিছুই বোঝেন। তিনি মনে করেন, যুদ্ধের মাধ্যমে সব সমস্যার সমাধান করা যায়। তিনি মানুষের রাজনৈতিক শক্তিতে আস্থাবান নন। কিন্তু পাকিস্তানের সর্বাঞ্চলে যদি গণ বিক্ষোভ দেখা দেয়, তবে কেবল সেনা বাহিনীর সাহায্যে তা ঠেকিয়ে রাখা যাবে না। কারণ, সেনা শক্তি কখনও জনসাধারণের আশা আকাঙ্খাকে দাবীয়ে রাখতে পারে না। তা ছাড়া দেশের রাজনৈতিক ভাব ধারার দ্বারা সৈন্য বাহিনীও শেষ পর্যন্ত প্রভাবিত হবে। তার ঐক্য বজায় থাকবে না। ইতি মধ্যেই বাংলা দেশে পাঞ্জাবী ও বালুচ সৈন্যদের মধ্যে সংঘাত দেখা দিয়েছে। এ ছাড়া সেনাবাহিনীর এক অংশের মধ্যে এই প্রশ্ন উঠতে আরম্ভ করেছেঃ কতদিন এই যুদ্ধ চলবে। এই যুদ্ধের ফলাফল কি হবে। যুদ্ধের ফলে বাঙলাদেশের মানুষ তাদের শত্রু হয়ে উঠেছে। সারা পাকিস্তানের সব রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান যদি ফৌজদের করতে হয়,তবে সর্বত্র দেশের মানুষই হয়ে উঠবে তাদের শক্র। বাঙলাদেশ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছে। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানে সিন্ধি,বালুচি,পাঠান ও পাঞ্জাবীদের মধ্যে বিরাধে। ক্রমশঃ তীব্র হচ্ছে। পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির নামে পাঞ্জাবীদের শাসন কেউ মেনে নিতে রাজি হচ্ছে না। সিন্ধি,বালুচি ও পাঠানরা চাচ্ছে তাদের জাতীয় সত্ত্বার যথার্থ স্বীকৃতি। বাঙলাদেশে জয় বাংলা ধ্বনি উঠার আগেই সিন্ধুতে ধ্বনি উঠেছিল “জিও সিন্ধ”। পাঞ্জাবের সাথে সিন্ধু নদের পানির ভাগ নিয়ে পাঞ্জাবের সাথে সিন্ধুর বেধেছিল বিবাদ। পানির অভাবে সিন্ধুর চাষ আবাদের হতে চলেছে সমুহ ক্ষতি। বালুচি ও পাঠানরাও সুখী নয়। তাদের ন্যায্য পাওনা তারা পাচ্ছে না। এদের এই সব ন্যায্য দাবীর অতি সুবিচার না করলে পশ্চিম পাকিস্তানেও দেখা দেবে বিভিন্ন ভাষা ভাষী মানুষের স্বাধীনতা যুদ্ধ। আর এই যুদ্ধের ফলে যে পরিস্থিতির উদ্ভব হবে,পাকিস্তানের সেনাবাহিনীর পক্ষে তার মোকাবিলা করা অসম্ভব হয়ে পড়বে। বর্ণ ভিত্তিক জাতীয়তাবাদের বদলে, ভাষা ও জন্মগত জাতি ভিত্তিক জাতীয় পাকিস্তানে আজ সুস্পষ্ট হয়ে উঠেছে। ধর্মের জিকীর তুলে তাই পাকিস্তানের দুই অংশকে এক রাখা যাবে না। কারণ,এই সংঘাত বিভিন্ন ধর্মাবলম্বির মধ্যে হচ্ছে না,হচ্ছে একই ধর্মাবলম্বীর মধ্যে—যারা ভাষা ও রক্তের দিক থেকে আলাদা। তাছাড়া শিক্ষা,সংস্কৃত হতে কিছুই তাদের সাথে মিলে না।
পাকিস্তানে আজ যা ঘটছে তা ইতিহাসে নজীর বিহীন নয়। ধর্ম নিয়ে এক সময় ইউরোপে বহু রক্তক্ষয় ঘটেছে। কিন্তু তার পর এসেছে ভাষা ও রক্ত ভিত্তিক জাতীয়তার যুগ। প্রশ্ন উঠেছে সকল ভাষাভাষী ও রক্তগত জাতির সমান অধিকারের কথা উঠেছে দেশ গঠিত হতে হবে ‘এখনো গ্রাফিক্যাল প্রিন্সিপল‘-এর উপর ভিত্তি করে। ইউরোপে ভাষা ও রক্ত ভিত্তিক জাতীয়তার সমস্যা এখন মিটে যায় নি। বিশেষ করে বলকান অঞ্চলে। সম্প্রতি প্রেসিডেন্ট টিটো ঘোষণা করেছেন, তার দেশ যুগোশ্লাভাকিয়া আর ফেডারেশন থাকবে না, হবে কনফেডারেশন। কেন্দ্রের হাতে কেবল মাত্র দেশ রক্ষা ও বৈদেশিক নীতি রেখে আর সব ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হবে বিভিন্ন অঞ্চলের হাতে। যুগশ্লাভাকিয়া এখন থেকে হবে ছয়টি রাষ্ট্র ও দুটি স্বায়ত্ত প্রদেশের সমষ্টি। শুধু এই নয় বৈদেশিক ও দেশরক্ষার ব্যাপারে যুগশ্লাভাকিয়ার সবকটি রাষ্ট্র যদি ঐক্যমত না হয় তবে সেই ধরণের বৈদেশিক ও দেশরক্ষা নীতি যুগশ্লাভাকিয়ার প্রেসিডেন্ট গ্রহণ করতে পারবেন না। সারা যুগশ্লাভাকিয়াতে পাঁচটি জাতির বাস। তাদের সমস্যা ও অন্যান্য শাসনতান্ত্রিক এবং রাজনৈতিক সমস্যার সমাধান করতে গিয়েই প্রেসিডেন্ট টিটো গ্রহণ করেছেন এই নীতি। শক্তিশালী কেন্দ্র রেখে এই সব সমস্যার সমাধান করা সম্ভব হত না। প্রেসিডেন্ট টিটো একজন বিচক্ষণ সেনাপতি। হিটলারের বিরুদ্ধে তার রণনৈপুণ্য দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় বিশ্ব বাসীকে চমকৃৎ করে। কিন্তু টিটো কেবল একজন সমর নায়ক নন,তিনি দেশপ্রেমিক রাজনীতিজ্ঞ। তাই তার পক্ষে যে নীতি গ্রহণ করা সম্ভব হয়েছে,জেনারেল ইয়াহিয়ার কাছ থেকে সে রকম কোন রাজনৈতিক দূরদর্শিতা আশা করা বৃথা। পাকিস্তান আজ যে জঙ্গী শাসনের কবলে পড়েছে, তার মধ্যে এমন কোন লোক নেই যার কাছ থেকে রাজনৈতিক সুবুদ্ধি আশা করা যেতে পারে। ইংরেজের তৈরি, সাম্রাজ্য বাদের ঐতিহ্যবাহী এই সেনাবহিনীর সেনাপতিদের কোন সাধারণ রাজনৈতিক চেতনা নেই। এরা জনসাধারণের আকাঙ্খা থেকে সম্পূর্ণ ভাবেই বিচ্ছিন্ন।
যারা ভেবেছিলেন,ইয়াহিয়া সমস্যার রাজনৈতিক সমাধানের দিকে যাবেন,তাদের আশা ভ্রান্ত প্রমানিত হয়েছে। ইয়াহিয়া পাকিস্তানকে কনফেডারেশনে পরিণত করতে চান না। পাকিস্তানের কোন অঞ্চলের মানুষকেই তিনি কিছু মাত্র রাজনৈতিক ও জাতীয় অধিকার দিতে চান না। সারা পাকিস্তানেই তাই রাজনৈতিক বিপ্লব আসন্ন হয়ে উঠছে। বাঙলাদেশের মানুষের সংগ্রাম পশ্চিম পাকিস্তানের জনগণের বিরুদ্ধে নয়। বাঙলাদেশের মানুষের সংগ্রাম তার আত্মনিয়ন্ত্রন অধিকারের সংগ্রাম। এই সংগ্রাম পাকিস্তানের সমস্ত নিপীড়িত মানুষকে পথ দেখাচ্ছে। নিপীড়নের হাত থেকে মুক্তির জন্য অনুপ্রেরণা যাোগাচ্ছে। ইয়াহিয়ার ভুল বাঙালীর জয়কে আরো নিশ্চিত করে তুলেছে।
পাতা-৫
মুক্তিযোদ্ধারা দালালদের খতম করে চলেছে
বাংলাদেশের রাজনৈতিক এতিম এবং পশ্চিম পাঞ্জাবী প্রভুদের পদলেহনকারী রাজনৈতিক বিশারদ খানে সবুরের দক্ষিন হন্ত বলে পরিচিত সারোয়ার মোল্লা গত ১৩ই জুন মুক্তি বাহিনীর হাতে খতম হয়েছে।
খুলনার গুণ্ডাধিপতি খান-এ সবুরের এই কুখ্যাত চেলা নিশ্চিহ্ন হওয়ায় খুলনা ও যশোরের জনসাধারণ হাঁফ ছেড়ে বেঁচেছেন।
খুলনা থেকে আমাদের বিশেষ প্রতিনিধি আরও জানিয়েছেন যে, জনৈক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা সারোয়ার মোল্লার মুণ্ডু কেটে নিয়ে মুক্তি বাহিনীর নিকটস্থ শিবিরে উপস্থিত করে। মুক্তি বাহিনী দস্যু সরদার সারোয়ার মোল্লার বাড়ী থেকে দুটি ষ্টেনগান, দুটি রাইফেল, দুটি ডবল ব্যারেল বন্দুক এবং একটি রিভলবার উদ্ধার করেন।
উল্লেখযোগ্য যে, উক্ত সারোয়ার মোল্লার মোনেমী আমলে প্রাদেশিক পরিষদের একজন সদস্য ছিলেন। খুলনায় তিনি অনেক অঘটনের নায়ক।
সাম্প্রতিককালে তিনি আদা জল খেয়ে পাক দস্যু বাহিনীকে খুলনার বাঙ্গালী নিধনে সক্রিয় ভাবে সাহায্য করেন এবং সাঙ্গপাঙ্গদের নিয়ে খুলনা যশোরে বেপরোয়া লুঠতরাজ চালান।
খুলনা থানার অন্তর্গত দামোদর গ্রামে নিজ বাড়ীতেই তাকে সকাল ৭টায় মুক্তি বাহিনী হত্যা করেন। তার এই কুখ্যাত দস্যু সরদারকে বহু দিন থেকে খুঁজতে ছিল। প্রকাশ,তার নিরাপত্তার জন্য অবাঙ্গালী টাউটদের নিয়ে গঠিত একটি রাজাকার বাহিনী ছিল। ঘটনার দিন উক্ত রাজাকার বাহিনী কিছুক্ষণ গোলাগুলী চালিয়ে মুক্তি বাহিনীর প্রবল আক্রমনের মুখে টিকে থাকতে না পেরে শেষে ‘চাচা আপন পরান বাঁচা’ পথ অবলম্বন করে সরে পড়ে।সারোয়ার মোল্লাও নিজ ভবনের দোতলা থেকে মুক্তিযোদ্ধাদের দিকে গুলী ছুড়তে থাকে।
মুক্তিযোদ্ধাদের গুলীতে সে মাটিতে ঢলে পড়ে। এ সময় জনৈক কিশোর মুক্তিযোদ্ধা তার মুণ্ডু কেটে নেয়।
প্রকাশ, সারোয়ার মোল্লার স্ত্রী মুক্তিযোদ্ধাদেরকে টাকার একটি বিরাট পুটলা দেয় এবং তার স্বামীকে হত্যা না করার অনুরোধ জানায়। কিন্তু মুক্তিযোদ্ধারা ঘৃণা ভরে টাকার পুটলী প্রত্যাখান করে বলেন যে,আমরা টাকা লুঠ করতে আসিনি, আমরা বাংলার মীরজাফরদের খতম করতে এসেছি।
এ ঘটনার পর পাক দস্যু বাহিনীর বলেন কর্ণেল শমসের নেতৃত্বে পশ্চিম পাঞ্জাবী দরা গান বোটে এসে গ্রামের উপর ব্যাপক গোলা বর্ষণ করে। তারা ফুলতলা থানার ওসি জনাব হাবিবুর রহমানকে গ্রেফতার করে নিয়ে যায়।
আমাদের প্রতিনিধি আরও জানান যে,গত জুন মাসে মুক্তিযোদ্ধারা খুলনা ও যশোর জেলার বিভিন্ন স্থানের ৭৮ জন চেয়ারম্যান সহ মোট ১৩ জন দালাল খতম করেছেন। তন্মধ্যে কালিয়া থানার ওসি, কালিয়ার কুখ্যাত গুণ্ডা খলিল, কোতয়ালী থানার বয়রা ইউনিয়নের চেয়ারম্যান সিদ্দিক মিয়া, সবুরের পোষা গুণ্ডা বয়রার টুই বিশ্বাস প্রভৃতি উল্লেখ যোগ্য।
গত মাসে যশোর কোতয়ালী থানার অন্তর্গত নড়াইল রোডের পাশে গ্রামবাসিগন ১৩১৪ জন দুবৃত্তকে হত্যা করেন। প্রকাশ, প্রায় ৪৫জন দুবৃত্ত গ্রামের জনৈক মুসলমান অবিবাহিতা। তরুণীকে ধরে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করলে বীর গ্রামবাসিরা দুর্বত্তদের বিরুদ্ধে রুখে দাড়ান এবং তরুনীটি দুবৃত্তদের হাত থেকে উদ্ধার করেন।
পাক সেনাদের মধ্যে আত্মকলহ জোরদার হচ্ছে
এবার ঠেলা সামলাও ইয়াহিয়া
মুজিবনগর ১৩ই জুলাই বাংলার দুর্জয় সিংহশাবক মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে হানাদার পাক-সেনারা মার খেয়ে খেয়ে এবং নিজেদের অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ সম্পর্কে ভেবে বিভ্রান্ত এবং চরম হতাশাগ্রস্ত হয়ে পড়েছে। চরম হতাশা তীব্র আর্থিক সঙ্কট, অনাহার এবং রণক্লান্তিতে নাস্তানাবুদ পাক সেনাদের মধ্যে তীব্র আত্মকলহ শুরু হয়ে গেছে বলে জানা গেছে। উল্লেখযোগ্য যে, পূর্ব থেকেই পাঞ্জাবী,পাঠান এবং বেলুচ সৈন্যদের মধ্যে নানা কারণে সন্দেহ এবং পারস্পরিক বিদ্বেষভাব সৃষ্টি হয়। এ বিদ্বেষ ও সন্দেহ বর্তমানে বিস্ফোরন্মুখ আত্মকলহের রূপধারণ করেছে। স্মরণ থাকতে পারে যে, যুদ্ধের গোড়ার দিকে কুমিল্লায় পাঞ্জাবী ও পাঠান সৈন্যদের সশস্ত্র সংঘর্ষকে কেন্দ্র করে শেষ পর্যন্ত হানাদার বাহিনীর প্রধান হামিদ খান এবং বিমান বাহিনীর প্রধান ছুটে কুমিল্লায় এসে এ আত্মকলহ ধামা চাপা দেয়ার প্রয়াস পেয়েছে। কিন্তু সে চাপা বিদ্বেষ ও পারস্পারিক সন্দেহ বর্তমানে তীব্র আকার ধারণ করেছে। পূর্ববর্তী ঘটনাকে কেন্দ্র করে ঢাকার কুর্মীটোলায় কিছু সংখ্যক বালুচ সৈন্যকে অন্তরীণ করেও রাখা হয়েছিল। এ খবরটি অনেক গোপন করে রাখা সত্ত্বেও শেষ পর্যন্ত বালুচ সৈন্যরা জেনে ফেলেছে। ফলে তারা বিক্ষুব্ধ। হয়ে উঠেছে।
হানাদার পাক সেনাদের মধ্যে তীব্র অসন্তোষের আরও কারণ হলো : তাদের বলা হয়েছিল যে, ‘বাংলাদেশে হিন্দুস্থানী দুষমন’ এবং কাফেরদের শায়েস্তা করে তার স্বদেশে ফিরে যেতে পারবে এবং এতে এক সপ্তাহের বেশী দেরী হবে না। কিন্তু প্রকৃত প্রস্তাবে তারা তিন মাস অতিক্রম করলেও ‘দুষ্কৃতিকারীদের,শায়েস্তা করতে পারছে না। বরং ক্রমশই মুক্তিযোদ্ধাদের হাতে মারা পড়ে নিজেদের সংখ্যা কমে যাচ্ছে। অবস্থা দেখে ভবিষ্যতে নিজেদের স্ত্রী-পুত্র পরিবারের সাথে দেখা হবে—এমন কি তাদের লাশটিও স্বজনদের কাছে ফিরে যাবে ভরসা করতে পারছে না।
পাক সেনারা ভাবছে বাংলা দেশে এসে তারা যাদের হত্যা করছে, যাদের বাড়ীঘর পুড়িয়ে দিয়েছে তাদের কেহই কাফের কিংবা ‘হিন্দুস্থানী দুষমন নয়। এবং তারা সকলেই মুসলমান এবং পাকিস্তানী। এসব ভেবে পাক সেনাদের মনে পাক কর্তৃপক্ষ সম্পর্কে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
অপরদিকে পাঠান-বেলুচী সৈন্যরা স্পষ্ট বুঝতে পেরেছে যে, পাঞ্জাবী দস্যুরা বাংলার মাটি থেকে হাত গুটিয়ে শেষ বেলুচিস্তান এবং সীমান্তপ্রদেশের ঘাড়ের উপর সওয়ার হবে। একদিন হয়ত পাঞ্জাবী শোষকগোষ্ঠীর ভাড়াটে সৈন্যরা বেলুচ ও পাখতুনীদের উপরও বাঙ্গালীদের মতই নির্মম অত্যাচার ও হত্যাযজ্ঞ চালাবে। নিজের মা-বোনদের ইজ্জত রক্ষার জন্য হয়ত একদিন এ পাঞ্জাবী দুস্তদের বিরুদ্ধেই তাদেরও লড়তে হবে।এসব ভাবনায় বেলুচ-পাঠান সৈন্যগণ দারুণ হতাশাগ্রস্থ এবং পাঞ্জাবীদের প্রতি ভয়ানক সন্দিগ্ধ হয়ে উঠেছে।
এ ছাড়া, পাক হানাদার সৈন্য ও বাংলা দেশের অধিকৃত এলাকায় তাদের অবাঙ্গালী উর্দু ভাষী তাবেদারের মধ্যে লুষ্ঠিত অর্থ মালপত্রের বিলি বণ্টন নিয়ে তীব্র অসন্তোষের সৃষ্টি হয়েছে পাক সেনারা শান্তি কমিটিএবং তাবেদার উদ্ভাষীদের নিকট থেকে লুষ্ঠিত নগদ অর্থ,স্বর্ণ ও অন্যান্য মূল্যবান সম্পদ ছিনিয়ে নেয়ায় উর্দু ভাষী তাবেদারদের মধ্যে ও পাক সেনাদের ব্যাপারে ব্যাপক অসন্তোষ দানা বেঁধে উঠেছে।
জঙ্গীশাহী কর্তৃক ১ শত টাকা ও ৫ শত টাকার নোট বাতিল ঘোষনা করায় পাঞ্জাবী দস্য সৈন্যরা লুষ্ঠিত ১ শত ও ৫ শত টাকার নোট নিয়ে ভয়ানক বেকায়দায় পড়েছে। এরাই যাকে জনৈক পাঞ্জাবী মেজর এক লক্ষ টাকার ৫ শত ও ১ শত টাকা জমা দিতে গিয়ে গ্রেফতার হয়।
পাক সেনা ও উর্দুভাষী অবাঙ্গালীদের মধ্যে বিরোধ ও সন্দেহের আর ও একটি কারণ হলো,জঙ্গীশাহী অল পাকিস্তান রাইফেল, রাজাকার বাহিনী এবং ইষ্ট পাকিস্তান সিভিল আর্মড ফোর্সে উর্দু ভাষী অবাঙ্গালী যুবকদের যোগদান বাধ্যতামূলক করেছে। কিন্তু উর্দুভাষী অবাঙ্গালী যুবকরা মুক্তিবাহিনীর ভয়ে এবং ভবিষ্যতে বাংলার মাটিতে এদের ঠাঁই হবে না ভেবে পাঞ্জাবীদের বাহিনীতে যোগ দিতে রাজী হচ্ছে না। উর্দুভাষী অবাঙ্গালী যুবকরা মনে করছে যে, আজ হোক কাল হোক পাঞ্জাবীদের বাংলা দেশ ছাড়তে হবে। তখন তাদের বাংলা দেশেই থাকতে হবে, পশ্চিম পাকিস্তানের মাটিতে এদের ঠাই হবে না। কারন, ভারত থেকে আজও কোন উদ্বাস্তুকেই এ পর্যন্ত পাঞ্জাবের ভূমিতে প্রবেশ করতে দেয়া হয় নি।বাংলাদেশেই তাদের ঠাই হয়েছে, ভবিষ্যতেও মা-বোন দিয়ে থাকতে হলে বাংলা দেশেই থাকতে হবে। এ ছাড়া,কিছু সংখ্যক উর্দুভাষী অবাঙ্গালী পুলিশকে কোন কোন থানায় এবং শহরতলীতে টহল দানের কাজে নিয়োগ করা হলে এরা মুক্তি যোদ্ধাদের হাতে নিহত হবেই। যুবকরা পাঞ্জাবীদের সাথে হাত মিলাতে ভরসা করতে পারছে না।
কিন্তু পাঞ্জাবী প্রভুরাও ছাড়বার পাত্র নয়। তারা নিজের না গিয়ে মুক্তি বাহিনীর উদ্যত গোলাবারুদের সামনে শিখণ্ডীদের দিয়ে শেষ রক্ষা করতে চায়। তাই উর্দুভাষী অবাঙ্গালী যুবকরা তাদের ফাঁদে পা দিতে অস্বীকার করায় জঙ্গীশাহী তাদের গ্রেফতার এবং যুবকদের না পাওয়া গেলে তাদের অভিভাবকদের শায়েস্তা করা হচ্ছে। এসব ব্যাপারে পাঞ্জাবী হানাদার ও তাদের উদ্ভাষী অবাঙ্গালী সাগরেদদের মধ্যে, অসন্তোষ – ও ক্ষোভ তীব্র আকার ধারন করেছে। এ চাপা ক্ষোভ যে, যে কোন সময় ফেটে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে।
পাতা–৬
ইয়াহিয়া খানরাই দায়ী
খান আবদুল গাফফার খান বলেছেন, পশ্চিম পাঞ্জাবের পুজিপতি, সামন্তবাদী ও আমলাতান্ত্রিকদের প্রভুত্ব বজায় রাখার জন্য ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী বাংলাদেশের জনগণের বিরুদ্ধে যে যুদ্ধ শুরু করেছে পাকিস্তানের জনগণের তা ভেবে দেখা উচিত। তিনি বলেছেন, ইয়াহিয়ার জঙ্গীশাহী পূর্ব বাংলার জনগণের ওপর যে অকথ্য নির্যাতন চালিয়েছে এবং এখনো চালাচ্ছে তা পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার প্রয়োজনেও নয়, ইসলাম ধর্মকে রক্ষার তাগিদেও নয়। তিনি বলেন, বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র অপরাধ তারা বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতায় আওয়ায়ী লীগকে নির্বাচনে জয়ী হতে সহায়তা করেছেন। এই কারণেই বাংলাদেশের নিরীহ জনগণ আজ ইয়াহিয়ার বর্বর সৈন্যদের হাতে নির্মমভাবে নির্যাতীত হচ্ছেন। খান আবদুল গাফফার খান বলেন, বাংলাদেশের জনগণের একমাত্র প্রতিনিধি আওয়ামী লীগ জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে কেবল একটি প্রদেশেই সংখ্যাগরিষ্ঠতা লাভ করেননি—পাকিস্তান জাতীয় পরিষদের নির্বাচিত সদস্যদের মধ্যেও তারাই সংখ্যায় বেশী। অথচ সেই আওয়ামী লীগকে পাকিস্তান ভেঙে টুকরো করার দায়ে অভিযুক্ত করা হচ্ছে। প্রকৃত পক্ষে পাকিস্তানের দু’ভাগে বিভক্ত হওয়ার জন্য ইয়াহিয়া খানই দায়ী। আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে ইয়াহিয়ার যে অভিযোগ তার মূলে যদি কোনো সত্য থাকতো তা হলে তাদের গোড়াতেই এর বিরোধিতা করা উচিত ছিল। খান আবদুল গাফফার খান আরো বলেন, পাখতুন প্রদেশে পপুলার পার্টি যখন বিপুল ভোটে জয়লাভ করেছিল তখনো পাকিস্তানের শাসকচক্র পাখতুনদের বিরুদ্ধে কঠোর ও অমানুষিক ব্যবস্থা অবলম্বন করেছিল। তখন শাসকচক্র জিন্নাহর নেতৃত্বধীন পাখতুনিস্তানে মুসলিম লীগের নেতৃত্বে সংখ্যালঘিষ্ঠ দলকে গদীতে বসিয়েছিল এবং খুদাই খিদমতগার আন্দোলন নিষিদ্ধ করে দিয়ে পাখতুনদের বিরুদ্ধে অত্যাচারের ষ্টিমরোলার চালিয়েছিল। এখনো পাকশাসকচক্রের এক চেনামহল বাংলাদেশে জাতিধর্ম নির্বিশেষে নিরীহ জনগণের ওপর কঠোর নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে।
সীমান্ত নেতা খান আবদুল গাফফার খান বলেছেন
জনাব জুলফিকার আলী ভুট্টোর রাজনৈতিক জীবন প্রসঙ্গে খান গাফফার খান বলেন, ভুট্টোর চরিত্র বোঝা ভার। তার কথায় আস্থারাখা করো পক্ষে সম্ভব নয়। তার মুখ দিয়ে কখন যে কী ধরণের বক্তব্য বেরোয় তা বুঝা কষ্টকর। তিনি বলেন, জনাব ভুট্টো প্রথম অবস্থায়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিরর রহমানের ছয়দফা কর্মসূচী সমর্থন করেছিলেন। কিন্তু যখন দেখলেন যে নির্বাচিত সদস্যদের বেশীর ভাগই আওয়ামী লীগের সমর্থক তখন তার ভোল পাল্টে গেল। তিনি জোর দিয়ে বলেন, কোন জাতিকে জোর করে দমিয়ে রাখা যায় না। নির্যাতীত ও নিপীড়িত মানুষের জয় সুনিশ্চিত।
ব্রিটিশ পার্লামেন্টারি প্রতিনিধিদলের অভিমত
পাকিস্তান প্রচার যন্ত্র থেকে সব সময় বােঝাবার চেষ্টা করা হচ্ছে, বাঙলা দেশের অবস্থা স্বাভাবিক হয়ে এসেছে। বাঙলা দেশে সেনাবাহিনী যা করেছে আইন শৃঙ্খলা রক্ষার খাতিরেই করেছে। বাঙলা দেশের মানুষের উপর কোন অত্যাচার চালান হয়নি। তারা বিদেশ থেকে নানা সাংবাদিকদের ও বিদেশীদের নিয়ে আসছেন তাদের কথার সত্যতা প্রমান করবার জন্য। কদিন আগে পাক সরকার ঘােষনা করেছিল য়ে যে কোন বিদেশী সাংবাদিক বাঙলা দেশে ঘুরে বেড়িয়ে যে সংবাদ সংগ্রহ করতে পারবেন ও তাদের সংবাদ সরবরাহের উপর কোন নিয়ন্ত্রণ চাপান হবেনা। কিন্তু কদিন আগেই আমেরিকার বিখ্যাত দৈনিক সংবাদ পত্র ‘নিউ ইয়র্ক টাইমস’-এর সংবাদদাতাকে পাক সরকার। বাঙলাদেশ থেকে বহিস্কার করে দিয়েছেন। কারণ তিনি তার। দেশের লােককে জানাবার জন্য বাঙলা দেশে যা ঘটেছে সে সম্পর্কে ঘটনাগত ভাবে বিবরণী পাঠাচ্ছিলেন।
কদিন আগে পাক সরকার বৃটিশ পার্লামেন্ট-এর এক প্রতিনিধি দলকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন বাঙলাদেশের ঘটনা স্বচক্ষে দেখে যাবার জন্য। তাদের গতিবিধি ছিল নানা ভাবেই নিয়ন্ত্রিত। তাদের বাঙলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরিয়ে দেখান হয় হেলিকপটারে। কিন্তু তারা হেলিকপটার থেকে যা দেখেছেন এবং সে সম্পর্কে যতটুকু বলেছেন তা থেকেই অনুমান করা চলে, এযাবত পাক বাহিনী কি ধরণের ভয়াবহ অত্যাচার চালিয়েছে বাঙল দেশের উপর। পার্লামেন্টারী প্রতিনিধি দলের বিভিন্ন ব্যক্তি যা বলেছেন, তাহচ্ছে, সমস্ত বাঙলাদেশ জুড়ে এখন ত্রাসের রাজত্ব চলেছে। এই দলের নেতা মিঃ বটমলি বলেছেন, টিক্কা খান রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক সমস্যা সম্পর্কে একেবারেই অজ্ঞ ব্যক্তি। বাঙলা দেশের রক্ত স্নানের জন্য তিনিই বিশেষ ভাবে দায়ী। পাকিস্তান সেনাবাহিনী যা করেছে, তা এতই বাড়াবাড়ি যে, নিয়ম শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য তার প্রয়ােজন ছিল বলে বােঝান যায় না। নিয়ম শৃঙ্খলার জন্য এ ধরণের সামরিক তাণ্ডব অকল্পনীয় ব্যাপার। বৃটিশ পার্লামেন্টারী দলের অপর নেতা মিঃ প্রেন্টিস বলেছেন বাঙলা দেশের সমস্যার সামরিক সমাধানের যে পথ ইয়াহিয়া বেছে নিয়েছেন তা আসলে একটা মর্মান্তিক ভুল ছাড়া আর কিছু নয়। বৃটিশ পালামেন্টারি দলের নেতা ও অন্যান্য প্রতিনিধিদের এইসব বিবৃতি তাদের দেশের সরকারের উপর প্রভাব বিস্তার করবে কিনা বলা যায় না। কিন্তু বিলাতের মানুষের কাছে স্পষ্ট হয়ে উঠছে এ দেশে
কি ঘটছে। বৃটিশ পত্র পত্রিকার মারফত তাদের বক্তব্যের প্রভাব সঞ্চারিত হচ্ছে আমেরিকা ও অন্যান্য ইংরাজী ভাষাভাষী দেশে। পাকিস্তান সরকার প্রচার করে চলেছেন যে সাংবাদিকরা টাকা খেয়ে পাকিস্তানের বিপক্ষে অপপ্রচার করছে। কিন্তু পার্লামেন্টারি দলের প্রতিনিধি দলের বিরুদ্ধে এই অপপ্রচারের অভিযােগ আনা চলবে না। পার্লামেন্টারি প্রতিনিধি দলের বক্তব্য তাই বিশ্ববাসীর কাছে অনেক বেশী গুরুত্ব পাবে।
পাতা-৭
স্ফুলিঙ্গের আলিঙ্গন
মেয়ে চারটিকে জানি না, চিনিও না। নাম জিজ্ঞেস করার অবকাশ হয় নি কোনদিন। তার আগেই শত্রুহত্যার মহোৎসবে ওরা রেখে গেল অকল্পনীয় এক কীর্তি গাঁথা। সবুজ বনানীঘেরা ছায়া সুনিবীড় শান্তির নীড়ে আম কাঠালের বনের মাতাল বাতাসে বেড়েউঠা মেয়েগুলো আর কোনদিন বাঁশ ঝাড়ের ঝরা পাতা মাড়িয়ে এবাড়ী ওবাড়ী করবেনা। নাকের নোলক দুলিয়ে ঘোমটার আড়াল থেকে পথচলা মানুষকে দেখবার ভান করবে না। কিংবা রাজনীতি করা স্বামীর রাত্রির অন্ধকারে গা ঢাকা দিয়ে ভোরের সূর্য উঠার আগে পালিয়ে যাওয়ার বিরহ ব্যথায় উদ্বেল হয়ে ঘরের দাওয়ায় বসে কাঁথার বুকচিরে নক্সী কাটবে না।
বাংলাদেশের নদী মেখলা শ্যামল প্রান্তর জুড়ে সোনালী ধানের গুচ্ছ নাচিয়ে যে মৃদ্যুল বাতাস বইতো, তাকে বুকে জড়িয়ে ধরে যে।
॥ আবু নঈম ॥
কৃষান চিরতরে লুটিয়ে পড়েছে পলিমাটির বুকে, তার বধুয়া দেখেছে, ধানের গুচ্ছে রক্ত জন্মেছে। সমুদ্র উদ্বেল জনতা তরঙ্গে আজ সে ধানের গুচ্ছ বজ্ৰ মুঠিতে চেপে ধরা—সে তো আজ স্বাধীনতার বিজয়। বৈজয়ন্তী।
তাইতো বুকের সন্তানকে কেড়ে নিয়ে মায়ের সামনে হত্যা করলেও মা তার পাগলিনী নয়, সে রণরঙ্গিনী রূপধারণ করে নাবে মুক্তির মিছিলে। নাবে কচি ছেলেটার রক্তেভেজা জামাটা বুকে জড়িয়ে ধরে। আজ আমার মার চোখ কান্নার সমুদ্র নয় আশ্বিনের হাসি। তাইতো আমার বোনের বুক ব্যথার বিস্তীর্ণ প্রান্তর নয়, সে এখন আগুনের খনি। আজ ওদের অগ্নিগর্ত চোখে প্রত্যয়ের দৃঢ়তা, অমিত সাহসের বলিষ্ঠতা আর দূর্বার বিরহ সইবার অভূতপূর্ব মানসিকতা।
পিশাচের পৈশাচিক লালসায় নিষ্পেসিত বাংলা মায়ের ক্ষতবিক্ষত দেহে এখন বিস্ফোরিত আগ্নেয়গিরির দম্ভ। জীবনের সব হারানো প্রান্তরে বোনের আমার কেবল সব ফিরে পাবার স্পৃহা। ভাইকে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে পারে না সাহায্য করতে যুদ্ধের ময়দানে, কে বলে আজ সে কথা? কে বলে সলাজ ঘোমটাও একদিন পিশাচের গলায় ফাসি হয়ে জড়ায় না। ওরা সন্ত্রমকে বাজি রাখতে জানে, ওরা জানে বাংলা মায়ের মর্যাদা রক্ষা করতে। শান্তি দিলে স্বস্তিও দেবার দ্বিধা মনে আসে না। ওরা রক্তের বিজয় নিশান উড়িয়ে শত্রুর গা কাপিয়ে দেয়, তাই তো শুনি বীরাঙ্গনা বাংলার, নারী কুলশ্রেষ্ঠা বোনেরা আমার দস্যু-জল্লাদদের হত্যার দায়িত্বে পিছিয়ে যায় না।
বাংলাদেশের মুক্তিপাগল মানুষ হানাদার শত্রুর বিরুদ্ধে লড়ে চলেছে জীবনকে বাজী রেখে। প্রতিরোধের দূর্গ গড়ে তুলেছে গ্রামে-গঞ্জে। গেরিলা কায়দায় অতর্কিত হামলা চালিয়ে বর্বর পশুদের পিছু হটতে বাধ্য করছে। দেশের দখলীকৃত এলাকায় বাংলার মানুষ নিরস্ত্র হাতে অমিততেজ নিয়ে লড়ছে। ক্ষমতাদর্পী পরাক্রমশালী পাক বাহিনীর বছরের পর বছর দেয়া আধুনিকতম অস্ত্রের শিক্ষা নতুন প্রানে উজ্জীবিত মুক্তি ফৌজের হাতে ধূলিস্মাৎ হয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই আধুনিকতম অস্ত্রে সজ্জিত শত শত ইয়াহিয়া সৈনিক মুখ থুবড়ে লুটিয়ে পড়ছে, কেউবা পালাচ্ছে পৈত্রিক প্রাণ নিয়ে। ফেলে যাচ্ছে অস্ত্রশস্ত্র গোলাবারুদ।
বীরবিক্রমে লড়ে যাওয়া মুক্তিযোদ্ধাদের সাথে বাংলার মা বোনেরাও তাই দেখি আজ পিছিয়ে নেই। তারা নানাভাবে সাহায্য করছেন মুক্তির এ সংগ্রামকে।
পাক-সেনা বাহিনী পিরোজপুরের উত্তরাঞ্চলে দস্যুবৃত্তির মানসে মানুষকে হত্যা করতে করতে এসে ঢোকে নারী নির্যাতন আর লুঠতরাজ চালাতে থাকে নির্বিচারে। নরপিশাচদের হিংস্র পাশবিকতাকে রুখতে ওরা দৃঢ় মনোবল নিয়ে উঠে দাড়ালো সেদিন জীবন মৃত্যুকে পায়ের ভৃত্য করে। পশুবৃত্তির চরম লালসায় ইয়াহিয়ার বর্বর পিশাচগুলো উন্মাদ হয়ে যখন এগুতে থাকলো মেয়েদের দিকে। ওরা কেউই পালালো না। পাক হানাদারদের প্রশ্রয় দিলো কাছে আসবার। কিন্তু কাছে আসবার প্রয়াসে যখন ওরা মেয়েগুলোর দিকে হাত বাড়ালো তখন গর্জে উঠলো বাংলার বীরাঙ্গনা কুলনারীর হাতের পিস্তল অথবা কারও দেহ ছুরিকাঘাতে হলো বিধ্বস্ত। পাক-সেনাদের পৈশাচিক হাতের নরখাদক মেসিনগান তখন হত্যা করলো বাংলার রক্ত সিক্ত মাটির চার জন বীরঙ্গনাকে। মৃত্যুর আগে ওরা কিন্তু চারজন পাক তস্করে জান কবচ করে নিয়েছিল। ছুটে এল পাকসেনাদের আরও অনেকে। গ্রামের পর গ্রামে ঘরবাড়ী আর নারী পুরুষ রইলো না কেউ প্রতিহিংসার মুখে। অমানষিক অকথ্য অত্যাচার চালিয়ে মানুষকে ওরা হত্যা করেছে অন্যান্য জায়গার মতো। লুঠ করেছে সম্পদ, অপহরণ করেছে সোনাদানা। তারপর জ্বলিয়ে পুড়িয়ে ছারখার করেছে সব।
ত্যাগের মহিমায় সমুজ্জল চারটি মেয়ের অপূর্ব সাহসিকতামণ্ডিত বীরত্বকাহিনী প্রেরণার উৎস হয়ে রইলো এদেশের অগনিত মা বোনের। ওরা আর কোনোদিন আসবে না এ পৃথিবীতে। আমাদের কাছে বলবে না এক গোছা চুড়ির জন্যে। লালচেলীর ফাকে পান-বিনে ঠোট রাঙ্গা মুখতুলে স্বামীকে ঘরে ফেরার তাড়া দেবে না।
কিন্তু ওরা নির্দেশ দিয়ে গেলো নতুন পথের। সে পথ রক্তে পিছল, রক্তিম ওদের আত্মত্যাগের মহিমার নবসূর্য করে।
ওদের পূত রক্তের উজ্জ্বলতায় আঁধারের বুকচিরে যে সূর্য উঠেছে আজ, সেও রক্তেভেজা। পিরোজপুরের সেই সে মেয়ে চারটি, যাদের নাম জানিনা, ওদের পরিচয় তাই আমাদের সবার নামে। ওরা
আমাদের বোন। ওরা বাংলার নন্দিনী। ওদের প্রাণের স্বর্ণরেণু বাংলার পলিমাঠে আর জনপদে বিস্তৃত হোয়ে সব বোনের হৃদয়ে আনবে অদম্য স্পৃহা আর বলিষ্ঠ মানসিকতা। তাই আসুন, ওদের শহীদী রক্তের আভায় যে সূর্য পূর্ব দিগন্ত রাঙ্গিয়ে উঠে আসছে তাকে সবাই আমরা স্বাগত জানাই।
মুক্তিবাহিনী শপথে দৃপ্ত
বৃটিশ এম,পি ষ্টোন হাউজের মন্তব্য
মুজিবনগর ৮ই জুলাই, বৃটিশ পার্লামেন্টের শ্রমিক দলীয় সদস্য মিঃ জন ষ্টোন হাউজ বলেছেন যে, কাল বিলম্ব না করে বাংলাদেশে জাতি সংঘ বাহিনী পাঠিয়ে সাড়ে ৭কোটি মানুষকে জঙ্গী ইয়াহিয়ার হাত থেকে রক্ষা করা উচিত। তিনি বলেন,বাংলাদেশের ৬০ লক্ষ লোক ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন এবং বাংলা দেশের লোকদের দেশ ত্যাগ অব্যাহত রয়েছে। এক সঙ্গে এত লোকের দেশত্যাগ দুনিয়ার ইতিহাসে কোন নজীর নেই। তিনি বাংলা দেশে এই গনহত্যার বিরুদ্ধে প্রস্তাৰ নেয়ার জন্য আন্তর্জাতিক আদালতের প্রতি অনুরোধ করেন।
মিঃ ষ্টোন হাউজ গত ৬ই জুলাই সাংবাদিকদের জানান যে, বাংলা দেশের এই নারকীয় ঘটনায় গ্রেট বৃটেনের জনগণ বিক্ষুব্ধ। তিনি বলেন, বৃটিশ কমন্স সভায় এক তৃতীয়াংশ সদস্য বাংলা দেশকে স্বীকৃতি দানের এবং অবিলম্বে এই গণহত্যা বন্ধের প্রস্তাব পালমেন্টে উত্থাপনের জন্য নোটিশ দিয়েছেন। তিনি আর ও বলেন যে, ইতিমধ্যেই স্বাক্ষরিত সদস্য হয়তো আরও বেড়ে গেছে। কমন্স সভায় বক্ষণ দলের কয়েকজন ইহার অনুকূলে মতামত ব্যক্ত করার চিন্তা করছেন।
সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে মিঃ ষ্টোন হাউজ বলেন, ভারতের উপর ৬০ লক্ষ বাস্তুহারা চাপিয়ে পাক সরকার যুদ্ধের থেকে কিছু কম অবস্থার সৃষ্টি করেনি। তিনি আর ও বলেন, মুক্তি বাহিনীকে সাহায্য করলেই ভারতকে সরাসরি যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে হবে বলে তিনি মনে করেন না। তিনি বলেন, ইয়াহিয়ার সামরিক দাপট এবং জঘন্য অত্যাচারের কাছে নাৎসী জার্মানীর ইহুদীদের উপর অত্যাচারকে ও ছেলেমানুষী বলে প্রতিপন্ন হয়েছে।
আবেগ জড়িত কণ্ঠে মিঃ ষ্টোন হাউজ বলেন বিশ্ববিবেক বা মানবতা বলতে আজ আর কিছুই নেই। বাংলাদেশে পরিস্থিতি বিশ্ব জনমত এবং বিবেককে নাড়া দিতে পারবে সেদিন, মুক্তি বাহিনী অত্যাচারী পাক বাহিনীকে নাজেহাল করে কুক্ষিগত করতে পারবে।
তিনি জানান যে, মুক্তি বাহিনীর মনোবল খুবই শক্ত এবং মুক্তি বাহিনীর জয় অবশ্যম্ভাবী।
পাতা-৮
জয় বাংলা
মুক্তিযোদ্ধাদের বিজয় অভিযান অব্যাহত
মুজিবনগর, ১০ই জুলাই।
অপরাজেয় বাংলার অগ্নিসেনা মুক্তি যোদ্ধারা পাক জঙ্গী শাহীর ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে রেল চলাচলের অন্তসার শূন্য দাবী ভুল প্রমান করেছেন। বীর মুক্তি যোদ্ধারা নোয়াখালী জেলার স্থানে স্থানে রেলসেতু, সড়ক সেতু বিস্কোরণ ঘটিয়ে উড়িয়ে দিয়েছে এবং রেল লাইন উঠিয়ে ফেলায় জঙ্গীশাহীর ঢাকা চট্টগ্রামের মধ্যে ট্রেন চালানোর দুঃস্বপ্ন ধূলিস্মাৎ হয়ে গেছে । নোয়াখালী থেকে বিলম্বে প্রাপ্ত খবরে জানা গেছে নোয়াখালী সেকটর বীর মুক্তিযোদ্ধারা মাতৃভূমির পবিত্র মাটি থেকে পাক হানাদার বাহিনীকে নিশ্চিহ্ন করার উদ্দেশ্যে সাফল্যজনক ভাবে অভিযান চালিয়ে যাচ্ছেন। এরই মাঝে দস্যু বাহিনীর বহু সৈন্যকে হতাহত করেছেন।
গত ১৯শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা। নোয়াখালী জেলার বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কে টহলদার দস্যুবাহিনীর উপর অতর্কিত হামলা চালিয়ে ১৫ জনকে ঘটনাস্থলেই যমপুরীতে পাঠিয়ে দেন। আর ১০জন‘চাচা আপন বাঁচা’অবস্থায় চম্পট দেয়। তাদের ট্রাকটি বঙ্গ শাদূলরা ধ্বংস করে দেন। এর পর কাপুরুষ পাক সেনারা স্থানীয় এলাকার কয়েকটি বাড়ী পুড়িয়ে দিয়ে তাদের পশু শক্তির স্বাক্ষর রাখে।
২০শে জুন মুক্তিযোদ্ধারা সোনাইমুড়ী থেকে আধ মাইল উত্তরে একটি রেল সেতু উড়িয়ে দেন। তাতে চৌমুহনী-লাকসাম রেলপথ যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। পাক দস্যুরা এরপর রেল লাইনটি পুনরায় মেরামত করার প্রাণপণ চেষ্টা করেও ব্যর্থ হয়। বেগমগঞ্জ-লাকসাম সড়কে এই সময় মুক্তি বাহিনী দস্যুবাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনসহ ৩০ জনকে খতম, তাদের ২টি জীপ এবং ১টি ট্রাক ধ্বংস করেছেন। বীর মুক্তি যোদ্ধাদের এই সাফল্যে স্থানীয় এলাকার জনসাধারণ খুবই উনূদিত হয়েছেন।বজরা রেলওয়ে স্টেশনের আধ* মাইল দক্ষিণে চৌমুহনী লাকসামের মাঝে একটি রেলসেতু মুক্তিবাহিনী উড়িয়ে দিয়েছেন। এছাড়া, এই রেল সেতুর উভয় পাশের আধ মাইল করে রেললাইন উঠিয়ে দেয়া হয়েছে। ফলে দুষমন পাক সৈন্যদের রেল যোগাযোগ সম্পূর্ণ বিপর্যস্ত হয়ে পড়েছে। চন্দ্রগঞ্জ রেল সেতুটিও আংশিক বিনষ্ট করে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু পরে শত্রুপক্ষ তা আবার মেরামত করে ফেলে।
ভীমগঞ্জ -রায়পুর সড়ক পথে পেনাগাদ- চন্দ্রগঞ্জের মধ্যে কয়েক স্থানে রাস্তাটি ভেঙ্গে দেয়া হয়েছিল। তৰে শত্রুসেনরা পরে উহা মেরামত করে ফেলে।
গত ২৬শে জুন গেরিলারা লক্ষ্মীপুর পুরাতন রাস্তায় একটি সেতু উড়িয়ে দেন। লক্ষ্মীপুর রায়পুর সড়কপথে দুলাল বাজারের নিকট রাস্তাটি বিনষ্ট করে দেয়ায় শত্রুদের রায়পুর যাওয়া ব্যাহত হয়। তাতে রামগঞ্জে শুরুসেনাদের চলাচল ব্যাহত হয়।
২৬শে জুন মুক্তিবাহিনী লক্ষ্মীপুর বাগবাড়ীতে হানাদার বাহিনীর একটি ক্যাম্পে অতর্কিত হামলা চালিয়ে দেড়শত পাক হানাদার সৈন্যকে হত্যা করেন। এই হামলায় হানাদার বাহিনীর আরও দেড়শত সৈন্য আহত হয়। আহতদের মধ্যে আরও ৮জন মারা যায়। মুক্তি যোদ্বারা এই হামলায় হালকা মেশিনগান, স্বয়ংক্রিয় রাইফেল, ৩০৩ রাইফেল প্রভৃতি অস্ত্র। ব্যবহার করেন। উল্লেখ করা যেতে পারে যে, লক্ষ্মীপুরের পূর্ব দিকের মদন রেলসেতুটি পুর্বেই ধ্বংস করে দেয়া হয়েছিল।
গত ১৮ই জুন মুক্তিযোদ্ধারা নোয়াখালীর সদর মহকুমার পাক হানাদারদের কুখ্যাত গুপ্তচর সেরু মিয়ার বাড়ী ঘেরাও করে সেরুমিয়ার এক পুত্র এবং তার ৪ জন সশস্ত্র রক্ষীকে হত্যা করেন। সেরু মিয়া পলায়ন করে প্রাণরক্ষা করে। হানাদার বাহিনীর এই কুখ্যাত দালালের অনুচরদের হত্যা করায় স্থানীয় জনসাধারন স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলেছেন।
বাংলাদেশের বীর মুক্তিযোদ্ধারা গত ৪ঠা জুলাই সকালে রাজশাহী শহরে হানাদারদের একটি ট্রাকের উপর আকস্মিক আক্রমন চালিয়ে ৭ জন দস্যুসেনাকে খতম করেন
মুক্তি যোদ্ধারা গত ২রা জুলাই কুষ্টিয়া জেলার মহিষকুণ্ডিতে ওজন দস্থ্য সেনাকে হত্যা করেন। গেরিলাদের আক্রমনে চুয়াডাঙ্গার পুলিশ থানাটিও ধ্বংস হয়েছে।
বাংলাদেশের দক্ষিনাঞ্চল বরিশাল এবং ও পটুয়াখালীতেও মুক্তি যোদ্ধাদের মারমুখী তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। সম্প্রতি সিলেট জেলার সুনামগঞ্জের কাছে সুরমা নদীতে পাকদস্যুরা একটি রনতরীতে প্রচণ্ড গোলাবর্ষণ করে মুক্তি যোদ্ধারা বহু হানাদার সৈন্যকে খতম করে দেন। গত ২রা জুলাই মুক্তিযোদ্ধারা সুনামগঞ্জের কাছে অপর এক স্থানে একটি টহলদারী সৈন্য বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমন চালিয়ে নিশ্চিহ্ন করেন। কাপুরুষ পাকদস্যুরা যঙ্গকেশরী মুক্তি যোদ্ধাদের স্পর্শও করতে না পেরে উন্মত্ত ক্ষিপ্ত কুকুরের ন্যায় পার্শ্ববর্তী গ্রাম গুলোতে লুঠতরাজ ও নিরীহ লোকজনের বাড়ী ঘর পুড়িয়ে দিয়ে পশুবৃত্তি চরিতার্থ করে।
ঢাকা
বিবিসি প্রচারিত সংবাদে জানা যায় যে, মুক্তি বাহিনীর গেরিলার। ঢাকা-ময়মনসিংহের মধ্যে যোগাযোগ রক্ষাকারী একটি সড়ক সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন। পাক হানাদারদের সঙ্গে মুক্তি যোদ্ধাদের একাধিক সংঘর্ষ হয়েছে। ( মুক্তি যোদ্ধারা ঢাকার উত্তরে শ্রীপুর এলাকার একটি টহলদারী পাক বাহিনীর উপর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে তাদের খতম করে দেন।
পাবনা
গত ৬ই জুলাই রাতে মুক্তি যোদ্ধারা পাবনা জেলার পক্ষী এবং রাজশাহী জেলার বানেশ্বরে পাক সেনাদের একটি শিবিরে অতর্কিত আক্রমন করে ১৩জন হানাদার সৈন্যকে খতম করেন। তা ছাড়া গেরিলারা রাজশাহী নাটোর সড়কের একটি গুরুত্বপুর্ণ সেতু উড়িয়ে দিয়েছেন।
রংপুর
রংপুর জেলার হাতিবান্ধা,বরখাতা এলাকায় একটি টহলদারী পাক সেনা দল মুক্তিবাহিনীর হাতে নিশ্চিহ্ন হয়। ৪ঠা জুলাই দিনাজপুর অঞ্চলে মুক্তিযোদ্ধাগন বহু স্থানে রেল লাইন উড়িয়ে দিয়ে দস্যু সেনাদের চলাচল বিঘ্নিত করেন। কিছুদিন পূর্বে মুক্তিযোদ্ধাগণ খুলনা জেলার একটি থানা আক্রমণ করে পাঞ্জাবীদের সাহায্যকারী জনৈক দারোগা এবং কয়েকজন পুলিশকে হত্যা করে কয়েকটি রাইফেল ছিনিয়ে নেন।
সম্পাদকমণ্ডলীর সভাপতি আহমদ রফিক, ভারপ্রাপ্ত সম্পাদক : মতিন – আহমদ চৌধুরী। মুজিব নগর জয় বাংলা প্রেস থেকে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের পক্ষে আহমদ রফিক কর্তৃক মুদ্রিত ও প্রকাশিত।
পাতা-৯
একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস
( পূর্বপ্রকাশিতের পর)
এক মহা বিভীষিকার মধ্যে দিন কাটতে লাগলো। রাতের বেলায় শুয়ে ঘুমোবার ব্যর্থ চেষ্টা করি। ঘুম কিছুতেই আসেনা। এটা বললে হয়তো অত্যুক্তি হবেনা যে পঁচিশে মার্চের পর একঘণ্টাও ভালো ঘুম হয়েছে। মাঝে মাঝে শেষ রাতের দিকে হয়তো একটু চোখ লেগে আসলে, হঠাৎ মেশিনগান বা অটোমেটিক রাইফেলের গুলীর আওয়াজ আসলো: নিস্তব্ধতা ভঙ্গ করে। ব্যস আর কি ঘুম হয়। তার ওপর আবার নতুন বিপদ দেখা দিয়েছে সম্প্রতি। প্রত্যেকদিন রাত সাড়ে এগারোটার দিকে একটা মিলিটারী জীপ আমাদের গলিতে এসে খামাকা দাড়িয়ে থাকে ঘণ্টা খানেক। বুঝুন ব্যাপারটা কি রকম। দিনের বেলায় রাস্তায় মিলিটারী দেখলে ভয়ে বুক কাপে। বলুনতো, এই কারফিউর সময় যদি প্রত্যেক রাতে মিলিটারী জীপ এসে দাড়িয়ে থাকে মনের অবস্থা কি রকম হয়।
একটা কথা বলতে ভুলে গেছি। সেটা হচ্ছে আমার বাড়ীর ঠিক দুপাশেই হচ্ছে দুই দালাল মাঝে কাউন্সিল মুসলীম লীগের সাধারণ সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ওরফে দাড়িকুল ইসলাম এবং প্রাদেশিক জামাতে ইসলাম প্রধান গোলাম আজম। ভাবলাম হয়তো এদের দেখা শোনার জন্যে মিলিটারীর তরফ থেকে পাহারা দেয়ার জন্যে রাতের বেলা জীপ পাঠানো হয়। পরে খবর নিয়ে জানা গেলো কোন এক তরুন ক্যাপ্টেনের সাথে আমাদের পাড়ার এক যুবকের সাথে বেশ মিতালী হয়েছে। ওর কাছেই ক্যাপ্টেন সাহেব রাতের অন্ধকারে দেখা করতে আসে। ছেলেটি শফিকুল ইসলামের আত্মীয় দুটিলোকের কথা হচ্ছে, ক্যাপ্টেন সাহেবের ফুর্তিটুর্তির জন্যে সে ।। মালমশলা জোগার করে দেয়। বিপদের সময় মানুষের যথার্থ পরিচয় পাওয়া যায়। হামিদুল হক চৌধুরীর অর্বাচীন, বাচাল নাতি কাজ করতো আমাদের অফিসে। বলা বাহুল্য বেশ উচ্চপদেই সে বহাল ছিলো, অবশ্য প্রশাসনিক বিভাগে। একদিন অফিসে গিয়ে শুনলাম ও চাটগাঁ গেছে। মনে মনে খুব আফসোষ হলো এই ভেবে যে, যাওয়ার আগে দেখা হলে আমার বাসায় ঘুরে আসতে বলতাম। যাই হোক, একটা আশা ছিলো যে, সে আমার কলেজ জীবনের বন্ধু, একসাথে একই টিমে ক্রিকেট খেলতাম, মোটকথা ভালোই বন্ধুত্ব ছিলো। সে নিশ্চয়ই আমার বাসায় খোঁজ দিয়ে আসবে। কয়েকদিন পর ও ফিরে এলো। জিজ্ঞাসা করলাম কি খবর। আমার বাসায় গেছিলে, চাটগাঁর অবস্থা কি। এতগুলো প্রশ্নের জবাবে পেলাম একটি উত্তর, “আরে যত্তোসব বাজে কথা চাটগাঁর প্রায় জায়গা আমি ঘুরেছি। কোথাও কিছু হয়নি । No a singt bullet has been fired in Chittagong. বল্লাম, আমার বাসায় কি খবর? সে বললে বাসায় কেউ নেই, আমি তোমার বাসার সামনে দিয়ে গেছি। দেখলাম দরজা জানালা সব বন্ধ, মনে হয় কেউ নেই। উত্তর শুনে খুব হাসি পেলো। বললাম একবার ঢু মেরে আসলে তো পারতে, পরে শুনেছি হামিদুল হকের পেয়ারা নাতির এই সফর ছিলো মিলিটারীর উদ্যোগে আয়োজিত। তাহলে বুঝতেই পারছেন তার পক্ষে কি সম্ভব মিলিটারীর বিরুদ্ধে কিছু বলা। যদিও এটা বিশ্ববাসীর অজানা নয় চট্টগ্রামের প্রথম বাঙালী সৈন্যরা বিদ্রোহ ঘোষণা করেছিল, এবং চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাঞ্জাবী সেনাদের সাথে তারা যুদ্ধে লিপ্ত হয়, ফলে চট্টগ্রামের বহু এলাকা পরিণত হয়েছে ধ্বংসস্তুপে।ৰাঙলী হত্যা যজ্ঞ লীলার প্রথম পর্বের শেষের দিকে ঢাকায় একটি শান্তি মিছিলের আয়োজন করা হয়। নাগরিক শান্তি কমিটি ছিলো এর উদ্যোক্তা। কাদের সমন্বয়ে এই নাগরিক কমিটি গঠিত তা বোধ করি বুঝিয়ে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আমাদের কাগজ থেকে পাঠানো হলো আমাকে। ব্রীফিং অপরূপ—আপনি যা যা দেখবেন, ঠিক তাই রিপোর্ট করবেন। দুপুর তিনটার সময় বায়তুল মোকাররাম থেকে মিছিল শুরু হওয়ার কথা,আড়াইটার দিকে যখন পৌছলাম দেখি ফেষ্টুন, ব্যানার, প্ল্যাকার্ড, পাকিস্তানী পতাকা ইত্যাদি নিয়ে বেশ বিছু লোক জটলা করছে,আর মাঝে মাঝে স্লোগান দিচ্ছে, কাছে এগিয়ে গেলাম। পাকিস্তানের সংহতি ও ঐক্যের পক্ষে উর্দুতে শ্লোগান দেয়া হচ্ছে। ব্যানার, ফেসটুনও সৰ উর্দুতে লেখা। কয়েকজনের হাতে ছবিও দেখলাম। কায়েদে আজম, ফাতেমা জিন্নাহ, লেয়াকত আলী, আইয়ুব খান,ইয়াহিয়া খান,টিকা খান, ইকবাল, মীর্জা গালেব এদের ছবি। বুঝলাম এরাই পাকিস্তানের সংহতির প্রতীক।
যাই হোক, মিছিল শুরু হলো কিছুক্ষণ পর। সাথে রয়েছেন দালাল গোলাম আজম, দালাল শফিকুল ইসলাম, দালাল দুদুমিয়া, দালাল মাহমুদ আলী প্রমুখ। মিছিল মাত্র শুরু হয়েছে, এমন সময় বৃষ্টি শুরু হল। একেবারে ঝুপঝপ বৃষ্টি। মিছিলের অরধেক লোক দৌড়ে আশ্রয় নিলো ষ্টেডিয়ামের নীচে। মিছিল নওয়াবপুর, ইসলামপুর, চকবাজার হয়ে নিউমার্কেটের সামনে শেষ হয়েছিলো। ও হো আসল কথাই বলতে ভুলে গেছি। মিছিলে যার যোগ দিয়েছিলো, তারা সবাই ডান দিক থেকে কথা বলে। মানে উর্দু তে। অবশ্য মিছিলের পুরোভাগের নেতৃত্ব করেছেন বাঙালী দালাল নেতারা।
পরের দিন ‘পূর্বদেশ’ পত্রিকার প্রথম পাতায় বেরোল ছবি সহকারে ডবল কলম সংবাদ । স্বতস্ফুর্ত ভাবে হাজার হাজার নাগরিক শান্তি মিছিলে যোগ দেয়। তারা পাকিস্তানের ঐক্য ও অখণ্ডতার জন্যে শ্লোগান তোলেন। ঢাকায় ইতিপূর্বে এতোবড় মিছিল কখনো দেখা যায়নি ইত্যাদি ইত্যাদি যা দেখেছি তাই রিপোর্ট করেছি। কিন্তু এটা লেখা সম্ভব নয় যে উর্দুভাষীরাই মিছিলে যোগ দিয়েছিলো, কি তাদের উদ্দেশ্য, বুকে গুলীর ক্ষত নিয়ে কি কোন বাঙালীর পক্ষে সম্ভব এই মিছিলে যোগ দেয় ইত্যাদি কিছুই – আমাকে লিখতে দেয়া হয়নি।
এই ভাবে চলছিলো দিন। বুকে রুদ্ধ বেদনা চোখে চাপা অশ্রু। মাঝে মাঝে মনে হয় চীৎকার করে পৃথিবীকে জানিয়ে দেই, এসে দ্যাখো, পাকিস্তানের ঘরোয়া ব্যাপার মিটাতে গিয়ে কি ভাবে পাঞ্জাবী সৈন্যরা হত্যা করছে অধ্যাপক, ছাত্র বুদ্ধিজীবী শিল্পী লেখক, কৃষক, মজুরদের। শুয়ে শুয়ে ভাবছিলাম, “হায় আর কি ফিরে পাব সে জীবন”। বঙ্গোপসাগরের নীল জলের সেই হাতছানি, রাঙ্গামাটির হ্রদের কালো জলের নীচের অতল রহস্য, পাহাড়ে নাম না জানা পাখির কলরব সৰ মনে হয় সব স্বপ্ন। – সেদিন ছিলো পঁচিশে বৈশাখ পঁচিশে মার্চের পর এই পঁচিশ পালনের কোন প্রশ্নই উঠেনা। অফিসে আমরা কজন ঠিক করলাম চব্বিশে বৈশাখ রাত বারোটায় আফিসের মধ্যেই পঁচিশে বৈশাখ উদযাপিত হবে। চাদা ঠিক করা, প্রত্যেকে তিন টাকা, ভুনা গোসত আর খিচুরী, তারপর গান। নিজেরাই গাইব। রাত বারোটায় খাওয়া দাওয়া হলো এবং সব শেষে সমবেত কণ্ঠে গাওয়া হলো- “আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি।” একদিকে চলছে গান, বাইরে মিলিটারী গাড়ীর গর্জন।
সামরিক সরকারের আদেশে শহরের সব সিনেমা হলগুলো চালু করা হয়েছে। বাংলা ছবি ? মাথা খারাপ নাকি। সৰ উর্দু আর পাঞ্জাবী। ম্যাটিনী আর ইভনিং শো’ই কেবল চলে। একদিন কৌতুহল হলো, দেখি কারা সিনেমা দেখতে যায়। বলা বাহুল্য, উর্দু ছবিই দেখতে গেলাম, হলে সব মিলে গোটা তিরিশেক দর্শক হবে। আলাপ আলোচনার মাধ্যম হিসেবে যে ভাষা দর্শকরা ব্যবহার করছে, তা উর্দু। এদিকে ঢাকার দৈনিক কাগজগুলোতে রিপোর্ট বেরুচ্ছে। ঢাকা নগরীতে সম্পূর্ণ স্বাভাবিক অবস্থা বিরাজ করছে। বাজারে ক্রেতার ভীড়, কেনাকাটা প্রচুর হচ্ছে, শহরের সিনেমা হলগুলোতে দর্শকের ভীড় ইত্যাদি। বিশ্ববাসীকে ধোকা দেওয়ার কি অভিনব প্রচেষ্টা।
(চলবে)
পাতা–১০
বাংলাদেশের বিস্তীর্ণ প্রান্তর
এখন আগুনের খনি
দেয়ালের কার্ণিশে কার্ণিশে ফেটে পড়া অজস্র জনতার নিরলস কণ্ঠের শ্লোগানের চেয়েও গভীরতম শ্লোগান বাংলার বাতাসে বাতাসে আগুন ছড়াচ্ছে। কারণ এক একটা হৃদয় এখানে এক একটা শ্লোগান। দেয়ালে দেয়ালে সেটে থাকা যে সব পোষ্টার নির্যাতন, নিষ্পেষণের বিরুদ্ধে সাড়ে সাতকোটি মানুষের কণ্ঠকে সোচ্চার করেছিল তার চেয়ে গভীরতম পোষ্টার বাংলার আনাচে কানাচে সংগ্রামের উত্তেজনা ছড়াচ্ছে। কারণ এক একটি চোখ এখন এক একটি জ্বলন্ত পোষ্টার। কখনও বা পীচ গলা ভয়ঙ্কর দুপুরের রাজপথ ধরে, কখনো বা উত্তাল পদ্মা, মেঘনা, ব্রহ্মপুত্রের পারে পারে গড়ে ওঠা বন্দরে বন্দরে, গ্রাম থেকে গ্রামে ফেটে পড়া সরল মানুষের উদ্বেলিত মিছিল, এমন কি নিস্তব্ধ রাত্রির বুক বেয়ে নেমে আসা। কারফিউকে বিদ্ধস্ত করার মত ভয়ঙ্কর সেই মিছিলের চেয়েও গভীরতম মিছিল বর্বরতা গ্রাস করছে। কারণ বাংলার মাটিতে মাটিতে এখন রক্তের মিছিল। বাংলার অসংখ্য মায়ের বুক তার সন্তানের রক্তে ভিজে গেছে, অসংখ্য মা ও তার শিশুর রক্ত একাকার হয়ে গড়িয়ে পড়েছে বাংলার মাটিতে, নরঘাতক পশুর নির্মম উল্লাসের তলায় চাপা পড়েছে অজস্র সুখের নীড়। বাংলার অজস্র মানুষ আত্ম গৃহহারা,লাঞ্ছিত, নিপীড়িত, যে মাটির ঠাই মায়ের মৃত্যু শোককেও ভুলিয়ে দিতে পারে সেই মাটি থেকে নিষ্পেষপের প্রবল অত্যাচারে অনেকেই ভারতে গিয়ে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে।
এত সব ছাপিয়েও কিছু দৃশ্য চোখের সামনে ইস্পাতের ধারাল ফলার মত চকচক করে। সেই শিশুটির কথা মনে পড়ছে। সবে মাত্র তার মুখে কথা ফুটেছে। “তোমার বাড়ী কোথায়” জিগ্যেস করলে অদ্ভুত দুটো চোখ প্রসারিত করে আধো আধো বাংলায়
।আশরাফুল আলম।
বলত “জয় বাংলা।” টাঙ্গাইল রোডের উপর লাঠিতে ভর দিয়ে হেটে যাওয়া সেই বৃদ্ধার কথা ভোলা যায় না। যার একমাত্র মেয়ে তারই চোখের সামনে একতাল বিদ্ধস্ত লজ্জা হয়ে পড়েছিল। তার ভাইয়ের একমাত্র জোয়ান ছেলে তারই সামনে চাপ চাপ রক্তের মধ্যে শেষ নিদ্রায় ঢলে পড়েছিল। বর্বরদের রাইফেলের বাটের আঘাতে সেই বৃদ্ধার পিঠের উপর কালশিরে দাগ পড়ে গিয়েছিল।কিন্তু কই তাকে তো কাঁদতে দেখিনি। টঙ্গী থেকে জয়দেবপুর পার হয়ে জনহীন টাঙ্গাইল রোড ধরে সে হয়ত তার গ্রামের বাড়ীতে ফিরছিলো। কাছে গেলে শুনতে পেতেন সে আপন মনে বকে যাচ্ছে-অভিশাপ দিচ্ছে সেই সব পশুদের যারা পশুত্বকেও হার মানিয়েছে। কিন্তু তাঁর চোখে জল নেই। সে কঁদছে না। তার মুখে হতাশার ছাপ নেই, ছাপ নেই নিরাশার। কৈশোর, যৌবন, প্রৌঢ়ত্ব সীমানা পেরিয়ে আসা লাঠিতে ভর দিয়ে চলা জনহীন টাঙ্গাইল রোডের সেই বৃদ্ধার মূহুর্তটিকে মনে হচ্ছিল তাঁর জীবনের সবচেয়ে গতিশীল পদক্ষেপ।
মনে পড়ছে সেই মা আর তার ছেলের কথা। মায়ের পা গুলিবিদ্ধ। ছেলে তার হাত ধরে গ্রামের পথ দিয়ে এগিয়ে চলছে। | তখন সূর্য উঠছিল। পূবের আকাশে তখন ছাপে ছাপে রক্তের লোহিত কণিকা লেপটে আছে। সকালটাকে মনে হচ্ছিল রক্তলেখা সন্ধ্যা। চারিদিকে সবুজের নির্বাক সমারোহ। যৌবনের ভারে ধানের শীষগুলে ঢলে পড়েছে। বিস্তীর্ণ গ্রামের উপর দিয়ে দেখা যাচ্ছে বহু দূরে মিলিয়ে যাওয়া জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের অসম্ভব শক্তিশালী বৈদ্যুতিক লাইন। তারি পাশ ধরে একটি ছেলে তার গুলিবিদ্ধ মায়ের হাত ধরে অতি সন্তর্পনে এগিয়ে যাচ্ছে। দৃশ্যটার এখানেই শেষ নয়। সেই ছেলেটিকেই একদিন দেখা গেল ডাক্তারের কাছে হন্তদন্ত হয়ে ছুটে আসতে। তার মায়ের গুলিবিদ্ধ পায়ে পচন ধরেছে। এরও কিছুদিন পরের কথা। বাংলার মুক্ত এলাকার কোন এক ক্যাম্পে তাকে দেখা গেল। চোখদুটো ভীষণ এক উত্তেজনায় অলছে। দৃঢ় বদ্ধ চোয়ালের আশে পাশের মাংস পেশী গুলো বৈশাখী ঝড়ের পুর্ব মুহুর্তের মত থমকে আছে। হাতে রাইফেল। মুক্তিবাহিনীর সেই ক্যাম্পের বাইরে পাহারা দিচ্ছিল।এরি দুদিন আগে ঠিক এমনি গভীর রাতে সেই ছেলেটিই বসেছিল তার মৃত মায়ের শিয়রে।
বাংলার মাটিতে মাটিতে এখন সমুদ্রের চেয়েও গভীরতম অধ্যায় নতুন ইতিহাসের পথ কাটছে। বাংলার প্রতিটি হৃদয় এখন এক ” একটা শ্লোগান, এখানকার চোখ এখন এক একটা জ্বলন্ত পোষ্টার। বাংলার মাটি এখন রক্তের মিছিলে মিছিলে রক্তাক্ত।
বাংলাদেশ সম্পর্কে মন্তব্য করার
অধিকার ইয়াহিয়ার নেই
“কাণ্ডজ্ঞানহীন পাঞ্জাবী গোয়ার ইয়াহিয়ার বেতার ভাষণ সারা বিশ্বের কাছে একজন অশিক্ষিত রক্তপিপাসু সৈনিকের নির্বুদ্ধিতার পরিচয় বহন করে”। বৃটেনের বাংলা দেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের এক বিবৃতিতে এই মন্তব্য করা হয়।
এতে বলা হয় আওয়ামী লীগকে বে-আইনী ঘোষণা করে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবকে শত্রু আখ্যা দিয়ে বাংলার সবুজ মাটিতে লাখো শহীদের রক্তে রঞ্জিত করে আমার মা বোনের ইজ্জত নষ্ট করে আজ ইয়াহিয়া জাগনের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের নতুন ফমূলা দিচ্ছেন। নিজের মুখ বাঁচানোর জন্যে ইয়াহিয়া যতো কথাই বলুক না কেন বাঙালীদের কাছে এর জারিজুরি ফাঁস হয়ে পড়েছে। – তারা দ্ব্যর্থহীন ভাষায় ঘোষনা করেন বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ তথা বৃটেনে প্রবাসী বাঙালীদের পক্ষ থেকে আমাদের স্পষ্ট বক্তব্য ইয়াহিয়া আমাদের শত্রু দেশের রাষ্ট্রনায়ক বিধায় বাংলাদেশ সম্পর্কে তার কোন মন্তব্য করার অধিকার নেই, এবং তা বা আমাদের দেশের আভ্যন্তরীন ব্যাপারে অন্যায় হস্তক্ষেপ। বাঙালীরা তাদের প্রতিনিধিদের সরকার গঠনের জন্যে সুস্থ মস্তিকেই নির্বাচিত করেছে। সেখানে ইয়াহিয়ার কোন অধিকার নেই বাংলাদেশে কোন রকম উপনির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আমরা তাকে, তার মরদের এবং বাংলার মীরজাফরদের এই মর্মে হুশিয়ার করে দিতে চাই যে, অপ-প্রচেষ্টায় অংশ গ্রহণ করে, জঙ্গীর সাথে সহযোগীতা করে নিজেদের মৃত্যু ঘণ্টা নিজেরা না বাজাবেন না, বাংলার মীরজাফরদের বলে দিতে চাই ইয়াহিয়ার মতো এখনো যদি আপনারা আহাম্মকের স্বর্গে থাকেন—তাহলে তার খেসারতের জন্য দিতে হবে চরম মূল্য। বাংলাদেশ সরকার এবং বাংলার মানুষের কাছে আমাদের বক্তব্য—বাংলার জাত শত্রু পশ্চিম পাকিস্তানের সাথে আমাদের কোন প্রকার রাজনৈতিক সমাধান হতে পারে না। তাদের বিষ দাত ভেঙ্গে দিয়ে দেশকে সম্পূর্ণভাবে শত্রু মুক্ত না করা পর্যন্ত আমাদের এই সশস্ত্র সংগ্রাম চলবেই। নিজেদের শেষ রক্তবিন্দু দিয়ে স্বাধীনতা রক্ষায় আমরা বদ্ধ পরিকর। বিবৃতিতে আরো বলা হয়, সারা ইউরোপের ছাত্র, যুবক, শ্রমিক ও জনতা বাংলা দেশের মানুষের সাথে রয়েছেন। বাংলার মানুষ আজ একা নয়—তাদের কণ্ঠের প্রতিধ্বনী হয় আজ বিশ্বের কোটি কোটি মানুষের কণ্ঠে। পরিশেষে বিবৃতে লাখো শহীদের আত্মার রুহের মাগফেরাত কামনা ও মুক্তি সংগ্রামের প্রতি অভিনন্দন জানানো হয়। * বৃটেনের বাংলাদেশ ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের আহবাক খন্দকার মোশগরক হোসেন সম্প্রতি উপরোক্ত বিবৃতি টি আমাদের কাছে পাঠিয়েছেন। বিবৃতির সাথে প্রেরিত এক পত্রে তিনি বৃটেনে বসবাসকারী বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের তরফ থেকে ‘জয় বাংলা’ প্রকাশনার জন্যে ধন্যবাদ জানিয়েছেন। প্রসঙ্গতঃ উল্লেখযোগ্য যে ইনি ১৯৬৯ সালে গণ আন্দোলনের সাথে প্রত্যক্ষভাবে জড়িত ছিলেন, সে সময় তিনি মহসীন হলের সহ-সভাপতি ছিলেন।
পাতা-১১
আর দুজন কূটনীতিক বাংলাদেশের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করেছেন
প্যারিসে পাক দূতাবাসের দু’জন – বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ পাক জঙ্গী শাহীর সাথে তাদের সম্পর্ক ছিন্ন করে বাংলাদেশ সরকারের প্রতি তাদের আনুগত্য প্রকাশ করেছেন। উক্ত দুজন কূটনীতিবিদ প্যারিসের পাক দূতাবাস ছেড়ে দিয়ে ফ্রান্সে রাজনৈতিক আশ্রয় নিয়েছেন। এই দু’জন বাঙ্গালী কূটনীতিবিদ হচ্ছেন জনাব মোশারফ হোসেন এবং জনাব শওকত আলী।গত ৭ই জুলাই তারা প্যারিসে এক বেতার সাক্ষাৎকারে বলেন যে,পাক দূতাবাসে তাদের প্রতি অত্যন্ত অপমানকর ব্যবহার করা হচ্ছে। দূতাবাসের পাক জঙ্গী শাহীর পশ্চিম পাকিস্তানী কর্মকর্তারা তাদের নিকট থেকে পাসপোর্ট কেড়ে নিয়েছে। শুধু তাই নয়, দূতাবাসে এই দু’জন বাঙ্গালী কূটনীতিবিদকে তারা অবিশ্বাস করছে এবং তাদের নিচের পদে নামিয়ে দিয়েছে। জঙ্গী শাহী তাদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে পশ্চিম পাকিস্তানে ডেকে পাঠিয়েছে। দুজন কুটনীতিবিদই স্ত্রী ও ছেলেমেয়ে সহ প্যারিসে আছেন।
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলা দেশ সরকারের বৈদেশিক সংক্রান্ত দফতরের পক্ষ থেকে দেশ প্রেমিক উক্ত দু’জন বাঙ্গালী কুটনীতিবিদের প্রতি অভিনন্দন জানানো হয়েছে। তাদের সাথে সর্ব প্রকার সহযোগিতা করার জন্য ফরাসী সরকারের প্রতি আবেদন জানান হয়েছে।
প্যারিসের পাক মিশনের বাঙ্গালী কুটনীতিবিদ জনাব মোশারফ হোসেন এবং জনাব শওকত আলী বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য প্রকাশ করায় বাংলাদেশ সরকারের দিল্লীস্থ কূটনৈতিক প্রতিনিধি জনাব কে,এম শাহাবুদ্দিন অভিনন্দন জানিয়েছেন।
ফ্রান্স – রাশিয়া জঙ্গি শাহীকে অস্ত্র দেবে না
ভারতের বর্হিবিশ্ব বিষয়ক মন্ত্রী মিঃ শরন সিং গত ৯ই জুলাই ভারতীয় লোক সভায় জানান যে, ফ্রান্স ও রাশিয়া ২৫শে মার্চের পর থেকে পাক জঙ্গী শাহীকে সমরাস্ত্র সরবরাহ করেনি এবং দেবেও না।
তিনি আরও বলেন, ফরাসী সরকার জুনের শেষ নাগাদ ভারতকে জানিয়েছিল যে,পাকিস্তান বাংলাদেশে সামরিক বাহিনীকে নিরীহ নিরস্ত্র মানুষের বিরুদ্ধে লেলিয়ে দেয়ার পর তারা পাক জঙ্গী শাহীর সাথে অস্ত্র সরবরাহের ব্যাপারে নতুন কোন চুক্তিতে আবদ্ধ হন নি। এমন কি পুরনো চুক্তি অনুযায়ী যে সব অস্ত্র সরবরাহের কথা ছিল তা ও বন্ধ করে দেন। সোভিয়েত সরকার ভারতকে জানিয়েছেন যে,তারাও ২৫শে মার্চের পর পাক জঙ্গী শাহীকে আর কোন অস্ত্র দেন নি।
সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত বলেছেন যে, রাশিয়া পাক জঙ্গী শাহীকে ২৫ মার্চের পর অস্ত্র দিয়েছেন বলে কোন কোন সংবাদপত্রে যে যে খবর প্রকাশিত হয়েছে সোভিয়েত রাষ্ট্রদূত তা অস্বীকার করেন।
পশ্চিম জার্মানও সাহায্য দেবে না
পশ্চিম জার্মানদের অর্থনৈতিক সহযোগিতা দফতরের মন্ত্রী বলেছেন যে, কতগুলো শর্ত পূরন না করলে পাক জঙ্গী শাহীকে পশ্চিম জার্মান কোন উন্নয়নমূলক সাহায্য দেবে না। এই শর্তগুলো হচ্ছে : সকল পক্ষের নিকট সন্তোষজনক বাংলাদেশ সমস্যার রাজনৈতিক মীমাংসা এবং সমগ্র দেশের জন্য অর্থনৈতিক কার্যসূচী।
বাংলাদেশের নির্ভীক মুক্তিযোদ্ধাদেরঅভিবাদন জানাই
আমরা আন্তরিকভাবে বাংলাদেশ’ নাগরিকদের বিমান বা জাহাজে ভ্রমণের সুযোগ-সুবিধার ব্যবস্থা করে দিতে পেরে ধন্য। বিদেশ ভ্রমণের জন্য পাসপোর্ট, পরিচয়পত্র, সরকারী অনুমতি, ভিসা, হেলথ সার্টিফিকেট ইত্যাদি’র সব ব্যবস্থাই আমরাই করে থাকি। যাতায়ত খরচ বাবদ বিদেশী মুদ্রা বা ভারতীয় মুদ্রা আমরা নিতে পারি।বিলেত, আমেরিকা বা কানাডায় গমনকারী ছাত্রদের বা ইমিগ্র্যান্টদের বিশেষ কনসেশান দেওয়া হয়।
আন্তরিকভাবে আপনাদের সেবায়
ওরিয়েন্টাল ট্র্যাভেল সার্ভিস
৯৫এ, চিত্তরঞ্জন এভিনিউ, কলিকাতা-১২
(মেডিকাল কলেজের বিপরীতে) ফোন : ৩৪-৫৪৫১ (তিন লাইন) ক্যাবল : ORIENTOUR