You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ২৫ জুন ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

এরই নাম কি স্বাভাবিক অবস্থা?(সম্পাদকীয়)

মিথ্যার শত জাল বুনেও সত্যকে কোনদিন ঢেকে রাখা যায় না। স্বাধীন সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ বিশ্ব মানবতার কাছে আজ একটি মহাসত্য । এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সাড়ে সাত কোটি মানুষ ত্যাগ, তিতিক্ষা, শৌর্য্য র্বীর্য ও আত্মদানের যে নজির স্থাপন করছে তা মানব ইতিহাসে চিরদিন ভাস্বর হয়ে থাকবে ।অথচ এই মহা সত্যটিকে মুছে ফেলার জন্য সুপরিকল্পিত ভাবে জল্লাদ ইয়াহিয়া খান প্রথম থেকেই একের পর একটি করে মিথ্যার জাল বুনে বুনে তার প্রচার যন্ত্র, ব্যক্তিগত-দূত ও পৃথিবীর সর্বত্র প্রতিষ্ঠিত ডিপ্লোম্যাটিক মিশনের মাধ্যমে প্রচার চালিয়ে পৃথিবীর মানুষকে ধোকা দেওয়ার কত চেষ্টাই না করে এসেছে। সত্যের কাছে মিথ্যা পরাজিত হবেই। তাই ইয়াহিয়া খানের ধোঁকাবাজীও বিশ্ব মানবতার কাছে হার মানতে বাধ্য। সাড়ে ৭ কোটি বাঙালী জাতিকে রাজনৈতিক অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক  তথা সর্বতোভাবে নিশ্চিহ্ন করার মানসে নজির বিহীন নৃশংস গণহত্যা, ব্যাভিচার, লুণ্ঠন, প্রজ্জলন অনুষ্ঠিত হয়েছে । যার ফলে প্রায় ১০ লক্ষ নিরস্ত্র মানুষ প্রাণ হারিয়েছে, প্রায় ৬০ লক্ষ  মানুষ সর্বহারা বাস্তুত্যাগী হয়ে ভারতে আশ্রয় গ্রহণ করেছে এবং দুই কোটিরও অধিক বাঙালী বাংলার গ্রাম থেকে, গ্রামান্তরে আশ্রয়ের আশায় অনিশ্চয়তার পিছনে পিছনে ঘুরছে । শুধু তাই নয় গুটি কয়েক শহর ও বন্দর এবং মুষ্টিমেয় এলাকায় হানাদার বাহিনীর আধিপত্য সীমাবদ্ধ থাকলেও বাংলার ৬৪ হাজার গ্রামের প্রায় ৪ কোটি পরিবারের প্রায় প্রত্যেকটি গ্রাম ও পরিবার প্রত্যক্ষ কিংবা পরোক্ষ ভাবে আজ জল্লাদ ইয়াহিয়ার নৃশংস হত্যাযজ্ঞ ও অত্যাচারের শিকারে পরিণত হয়েছে। অথচ সম্পূর্ণ ব্যাপারটিকে ঢেকে রাখার জন্য পৃথিবীর মানুষকে অপপ্রচারের মাধ্যমে একথাই বুঝাতে চেয়েছিলেন যে, বিষয়টি একান্ত ভাবেই পাকিস্তানের “ঘরোয়া ব্যাপার” ।কিন্তু সাড়ে ৭ কোটি মানুষের করুণ ফরিয়াদে বিশ্বের দরবারে এই সত্যটি আজ প্রকাশ্য দিবালোকের মত প্রতিষ্ঠিত হয়েছে যে,ইয়াহিয়া খানের কাছে যা ঘরোয়া ব্যাপার মানব ইতিহাসে সেটা জঘন্যতম কলঙ্ক। কখনো ইসলামের ব্যবসা করে কখনো তথাকথিত প্রতিষ্ঠিত রাজ্যে অখন্ডতা্র নামে আবার কখনো সাম্প্রদায়িকতার জঘন্যতম অপপ্রচার করে বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের শাশ্বত সত্য প্রাণের চেয়েও প্রিয় যার জন্য প্রতিটি বাঙালী যে কোন ত্যাগকে হাসি মুখে গ্রহণের জন্য সদা প্রস্তত সেই স্বাধীনতা সংগ্রামকে ধামাচাপা দেওয়ার জন্য কত কষ্টই না করেছে।কিন্তু সূর্যের আলো থেকে কুয়াশা  দূরে সরে যাবেই। যতই দিন যাচ্ছে শত মিথ্যার ধুম্রজালকে ভেদ করে পূর্ব দিগন্তে সূর্য রশ্মি তত আসন্ন হচ্ছে। আজ সার্বভৌম বাংলা দেশ যেমন মহা সত্য, তথাকথিত পাকিস্তানের অবলুপ্তিও তেমনি একটি সত্য । ব্যক্তি বিশেষ কিংবা গোষ্ঠী বিশেষের স্বার্থান্ধতা ও হঠকারিতা এবং ভূলের মাশুল হিসাবেই এই অবলুপ্তি ঘটেছে, একথা আমরা পূর্বেই বলেছি এবং পৃথিবী তা স্বীকার করেছে ।

 কারণ, মৃত পাকিস্তানকে অথনৈতিক সাহায্য দিতে পৃথিবী আজ নারাজ। এর কোন বিশ্লেষণের অপেক্ষা রাখে না।কনসোর্টিয়াম  বৈঠক থেকে শুরু করে প্রত্যেকটি  সাহায্যকারী, দেশ অভিমত প্রকাশ করেছে ইয়াহিয়ার পাকিস্তানের আভ্যন্তরীণ ব্যাপারটি আন্তর্জাতিক দৃষ্টিতে এতই গুরুত্বপূর্ণ যে, বাংলাদেশে স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে না আসা পর্যস্ত সাহায্য দেওয়ার প্রশ্নটি স্থগিত রাখাই বাঞ্ছনীয়। এরকম অভিমত প্রকাশের পিছনে অবশ্য একটি গূঢ় রহস্য আছে। সাহায্যকারী দেশ ভাল ভাবেই জানেন যে, বাংলাদেশ আর ইয়াহিয়া খানের মৃত পাকিস্তান এক নয়।আর বাংলার পাট, চা, তামাক এবং চামড়ার টাকা ছাড়া বৈদেশিক খণ শোধ করার কোন সম্ভাবনা নেই। সুদের জন্যই যেখানে কিস্তি ভিক্ষে সেখানে আসল পাওয়ায় সম্ভবনা কোথায়? কাজেই জনাব ইয়াহিয়া খান ঢাক-ঢোল পিটিয়ে মুক্তিফৌজ থেকে শুরু করে রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দকে যারা দুদিন আগেও দূস্কৃতিকারী ও অনুপ্রবেশকারী বলে আখ্যায়িত হয়েছে তাদেরকে সাধারণ ক্ষমা প্রদর্শনের নামে রিসেপশন ক্যাম্প খুলে, আগে অস্বীকার করে পরে বিপাকে পড়ে মাত্র হাজার বাস্তুত্যাগী স্বীকার করে “স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে এসেছে’ শিরোনামাওয়ালা ১২ পৃষ্ঠার যায়গায় ২ পৃষ্ঠায় সংবাদপত্রগুলোকে প্রকাশ করতে বাধ্য করে, আর মুক্তিফৌজের কাছে পাক সেনাবাহিনীর বেধড়ক মার খাওয়া গোপন করে, গুটি কতক ভাড়াটিয়া পদলেহী তথাকথিত শিল্পী কন্ঠে ঢাকা বেতার কেন্দ্র থেকে ইসলামের গান গাইয়ে ইয়াহিয়া খান এ কথাই প্রমান করতে চেষ্টা করছেন যে সাহায্য পাওয়ার মত স্বাভাবিক অবস্থা এখন ফিরে এসেছে । বাংলায় স্বাভাবিক অবস্থা বাঙালীরাই ফিরিয়ে আনবে । প্রতিটি বাঙালী আজ দৃঢ় প্রতিজ্ঞ যে, সাড়ে সাত কোটি বাঙালীর নয়নমণি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানকে মুক্ত করে, হানাদার ইয়াহিয়া বাহিনীদের বাংলার মাটি থেকে নিশ্চিহ্ন করে, বাংলার স্বাধীনতার স্বীকৃতি আদায় করে, বিগত দিনের অর্থনৈতিক বঞ্চনার প্রতিশোধ ও ক্ষতিপূরণ আদায় করে বাংলার স্বাভাবিক অবস্থা ফিরে আনবেই।

কোন রকম সাহয্য দিয়ে পাকিস্তানের রক্তপিপাসু সামরিক সরকারকে   শক্তিশালী না করার   তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানান

গণপ্রতিনিধিদের দ্বারা গঠিত সরকারের প্রশাসনিক কাজে সরাসরি অংশ গ্রহণ ও পরিপূর্ণ আত্মমর্যাদার মধ্য দিয়ে একটা জাতি হিসাবেই আমরা বাঁচতে চাই–এই অটুট বিশ্বাস ও দৃঢ় মনোবল নিয়েই আমাদের মুক্তিবাহিনী মাতৃভূমি বাংলাদেশের স্বাধীনতা রক্ষার জন্য জীবন-পণ লড়ে যাচ্ছেন।  গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী তাজউদদীন আহমদ গত ১৩ই জুন বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি সংগ্রামী মানুষের উদ্দেশ্যে বেতার ভাষণে এ কথা বলেন । বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধে মুক্তিবাহিনীর বীর জওয়ানদের অতুলনীয় সাফল্য বর্ণনা প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, প্রয়োজনীয় অস্ত্র শস্ত্র পেলে ইনশাল্লাহ. অচিরেই আমাদের মুক্তিবাহিনী দেশ থেকে দুর্জন সৈন্যদের নিশ্চিহ্ন করতে সক্ষম হবে। স্বাধীন যুদ্ধক অধিকতর সুসংগঠিত ও জোরদার করার জন্ প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন দুনিয়ার বৃহৎ শক্তি বর্গের কাছে প্রয়োজনীয় অস্ত্র সাহায্যের আবেদন জানান । গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্র প্রধান বঙ্গবন্ধু: শেখ মুজিবর রহমানের মুক্তির ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দীন আহমদ ইসলামাবাদের ওপর চাপ সৃষ্টির জন্যও বৃহৎ শক্তিবর্গের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ পৃথিবীর মানচিত্রে স্থান করে নিয়েছে এবং সাড়ে সাত কোটি মানুষের ইচ্ছাশক্তি এখানে স্থায়ী হবে।স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত বেতার ভাষণে বাংলাদেশকে স্বীকৃতিদানের জন্য পৃথিবীর সকল রাষ্ট্রের কাছে আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন বলেন, জনসাধারণের স্বাধীন ইচ্ছার ভিত্তিতে গঠিত এই সরকারই দেশের একমাত্র প্রতিনিধি। পশ্চিম পাকিস্তানের ঐপনিবেশিক শাসন সম্পূর্ণরূপে প্রত্যাখান করে আমাদের জনগণ স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করছে।তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে বাংলা দেশের এই সংগ্রাম দেশের পুষ্পপত্রের মত এ মাটি থেকে উদ্ভূত। যে অসহনীয় রাজনৈতিক সম্পর্ক বাংলাদেশের অর্থনৈতিক বিকাশ ও সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্রকে বিপর্যস্ত করেছিল, সেই সম্পর্কের অবসান ঘটাবার জন্য জনসাধারণের ইচ্ছা থেকে এর উৎপত্তি। একে ভারতের  প্রচারনা বলে পাকিস্তান যে প্রচার চালাচ্ছে, তা তার সুপরিচিত কৌশল। বাংলাদেশের সকল সম্পর্কেই এইরূপ প্রচারণা হয়েছে; এতে আর কেউ কান দিচ্ছে না । বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের ১১ সপ্তাহের দুর্বার সংগ্রামের পর্যালোচনা করে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, দখলকারী শত্রুরা এক নিদারুন অবস্থায় পড়েছে । তাদেরকে লোক ও রসদ আনতে হয় বিমান পথে কয়েক হাজার মাইল দূর থেকে । আমাদের মুক্তি-বাহিনী আবার প্রত্যহ আক্রমণ চালিয়ে শত্রুর সরবরাহ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার গুরুতর বিপর্যয় ঘটাচ্ছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, হানাদারদের ভীতি প্রদর্শন ও প্রলোভন সত্ত্বেও কোথাও এখনও বেসামরিক শাসন ব্যবস্থা চালু হবার কোন লক্ষণ নেই, কলকারখানার চাকাও ঘোরেনি। জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, সুপরিকল্পিত হত্যা, লুণ্ঠন ও ধর্ষণের নীতি গ্রহণ করে তারা নিজেদেরকে চিহ্নিত করেছে মানুষের শক্র ও সভ্যতার শক্ররূপে। তাদের আর জনসাধারণের মাঝে রয়েছে ঘৃণার সমুদ্র সমান ব্যবধান । বৃহৎশক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানিয়ে তিনি বলেন, গণতান্ত্রিক শক্তির বিরুদ্ধে তারা যেন রক্তপিপাসু সামরিক একনায়কত্ববাদকে আর শক্তিশালী না করে তোলেন।বাংলাদেশ থেকে দখলদার সামরিকবাহিনী তুলে না নেওয়া পর্যন্ত  ইসলামাবাদ সরকারকে কোন রকম সাহায্য না দেওয়ার জন্য  তিনি বৃহৎ শক্তিবর্গের কাছে আবেদন জানান । তিনি আরও বলেন, ইসলামাবাদকে কোন রকম সাহায্য দেবার অর্থ পাকিস্তানের সামরিক শক্তি বৃদ্ধিকরা এবং সে শক্তি বাংলাদেশের মানুষকে দমন করার কাজেই শুধু ব্যবহৃত হবে।  মুসলিম বিশ্বের প্রতি আবেদন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমদ বলেন, ইয়াহিয়ার সৈন্যরা বাংলাদেশের ইসলামী ন্যায়-নীতির জন্য যুদ্ধ করছে, এরকম ধারণা হয়ে থাকলে তা সত্যি দুর্ভাগ্যজনক । কারণ, জনসাধারণের ইচ্ছা ও মানবাধিকারকে বর্বরচিত  দমন করে ইয়াহিয়া  ইসলামের দোহাই পাড়ছে।তুর্কী উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে আরব বিশ্বের মুক্তি সংগ্রামের উল্লেখ করে তিনি বলেন, মুসলিম তৃর্কদের  ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তারা মুক্তিসংগ্রাম করেছিলেন। পশ্চিম পাকিস্তানী  উপনিবেশিকতার বিরুদ্ধে আমাদের লড়াই তারই অনুরূপ । বাংলাদেশের আপামরজনতা এবং মুক্তিযোদ্ধাদের সাহস, বীরত্ব ও দেশপ্রেমের প্রতি অভিনন্দন জানিয়ে জনাব তাজউদ্দীন আহমেদ বলেন, ইসলামাবাদের ঔপনিবেশিক’ সৈন্যবাহিনীকে বীরত্বের সাথে বাধা দিয়ে তারা পৃথিবীর সকল দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষের হৃদয়কে সাড়া দিয়েছেন এবং তাদের  শ্রদ্ধা অর্জন করেছেন |গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী বলেন, একদিকে লুন্ঠনের পাশবিক লোভ, অন্যদিকে একটি জাতির স্বাধীনতা লাভের দুর্বার আকাংখা। এই যুদ্ধে জয় আমাদের হবে, তাতে সন্দেহের কোন অবকাশ নেই |

একটি যুদ্ধঃ বহু ইতিহাস(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

বাড়ী ফেরার সময় বার বার শুধু মনে পড়তে লাগল “দি পিপলস’ পত্রিকা অফিসের দৃশ্য । ভাবতে লাগলাম, তবে কি আমরা প্রাগৈতিহাসিক বর্বর যুগে ফিরে গেছি? ইয়াহিয়া খানরা একট] পত্রিকা অফিসকে ধ্বংস করে এতগুলো সাংবাদিক ও সংবাদপত্র সেবীকে নৃশংসভাবে হত্যা করে কি উদ্দেশ্য  সিদ্ধ করতে চেয়েছে? ইয়াহিয়া খানদের হাতে তো অসংখ্য পত্রিকা ছিল। একটি মাত্র ইংরেজী পত্রিকা যদি আওয়ামী লীগ ও বাংলাদেশের কথা বলে থাকে তাতে ক্ষতিটাই বা কি হয়েছে ?নিজস্ব পত্রিকাগুলো দ্বারা  ইয়াহিয়ার তার বিরোধিতা করাতে পারতো। তাছাড়া, পিপলস পত্রিকায় কোন অসত্য প্রকাশ করা হলে সরকার তো প্রাদেশিক সরকারের গণ-সংযোগ দফতর, কেন্দ্রীয় সরকারের আঞ্চলিক তথ্য দফতর, সমর-কর্তা্দের সরাসরি তদারকীতে পরিচালিত আন্তঃ সাভিসেস গণ-সংযোগ বিভাগ, এমন কি বেতার-টেলিভিশন মারফত  সংবাদ পরিবেশনের প্রতিবাদ -করে সত্য ঘটনা বিবৃত করে প্রেস নোট প্রচার করতে পারতো । আর একান্ত যদি পত্রিকা কোন অপরাধ করে থাকে তবে তার জন্য ইয়াহিয়া খানদের আইন অনুসারেই একমাত্র দায়ী হলেন পত্রিকার প্রকাশক ও মুদ্রাকর। সরকার তাদের গ্রেফতার করতে পারত, জেলে পাঠাতে পারত, জরিমানা করতে পারত। তাদেরই আইন অনুযায়ী কর্মরত সাংবাদিকরা বা অন্যান্য কর্মচারীরা তো কোন অপরাধ করেন নি। তবে কেন তাদেরকে নির্বিচারে কামান-মেশিনগান চালিয়ে হত্যা করা হল? সর্বোপরি, পশ্চিমা সৈন্যরা নিশ্চয়ই নিজেদের মানুষ বলে দাবী করবে। যদি তাই হয়, তবে নিরপরাধ মানুষগুলোর উপর কামান-মেশিনগান চালানোর আগে তারা ওদের বের হয়ে যাবার জন্য ৫ মিনিট সময় দিতে পারত। তারপর তারা ধ্বংস করতে পারত । কিন্তু তারা এর কোনটাই করেনি । তাহলে

কি একথাই বুঝতে হবে যে পিপলস পত্রিকা যা প্রকাশ করেছিলতার জবাব দেবার মত ক্ষমতা সরকারের ছিল না? পিপলস পত্রিকা তার ২৫শে মার্চের সংখ্যায় যে ডায়াগ্রামটি ছাপান হয়েছিল তার জবাব ইয়াহিয়া খানদের ন৷ হয় বিশ্বমানবতাকে একদিন দিতেই হবে।উক্ত পত্রিকার ২৫শে মার্চের সংখ্যায় একটা ডায়াগ্রাম ছাপা হয়েছিল। ২৫শে মার্চের আগের কয়েকদিন জয়দেবপুরে বেঙ্গল রেজিমেন্টের ফার্ষ্ট ব্যাটালিয়নকে আক্রমন করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানী সেনাবাহিনী যে মার খেয়েছে তার প্রতিশোধ নেয় নিরীহ, নিরস্ত্র গ্রামবাসীদের উপর। আশে পাশের গ্রামের শত-শত নিরীহ মানুষকে হত্যা করে  তাদের লাশ নিয়ে আসে ক্যান্টনমেণ্টে। তারপর তারা ক্যা্ন্টনমেণ্টের এক কোণে বড় বড় গর্ত খুঁড়ে তাতে পুঁতে রাখে ওসব  লাশ । এক একটা গর্তে শতাধিক লাশও পোতা হয়েছিল। পিপলস পত্রিকা সংশ্লিষ্ট এলাকাটার ডায়াগ্রাম এক বিশ্ববাসীকে জানিয়ে দিয়েছিল ইসলাম ও সংহতির, ধারক-বাহক পশ্চিমা জঙ্গী চক্রের অপকীত্তির কথা। তাই বোধহয়, ওরা ক্ষিপ্ত কুকুরের মত ব্যবহার করেছে পিপলস পত্রিকায় সাংবাদিক ও সংবাদপত্র সেবীদের সাথে। ২৮শে মার্চ সকাল ৬টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যস্ত সান্ধ্য আইন শিথিল করা হল। আর তারই মধ্যে চললো! সব জায়গায় বেধড়ক গুলীগোলা। দুলালের হুন্ডায় চেপে সাড়ে ৬টার সময় বেরিয়ে পড়লাম শহর দেখতে । পিপলস অফিসের ভয়াবহ দৃশ্য  দেখার পর থেকেই দৈনিক ইত্তেফাক অফিসটি দেখার জন্য মন যেন কেমন করছিল। তার কারণ অবশ্য ছিল। দৈনিক ইত্তেফাকের সঙ্গে বাঙ্গালীর নাড়ীর সম্পর্ক । বলতে গেলে ইত্তেফাকই বাঙ্গালীকে দীর্ঘ প্রায় পৌনে দুযুগ ধরে পথ প্রদর্শন করেছে । তাদের চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে শোষণ বঞ্চনার করুন চিত্র। ইত্তেফাক বাঙ্গালীর কাছে প্রমান করে দিয়েছে ধর্মান্ধতা, সাম্প্রদায়িকতা ও মানুষে মানুষে ভেদীভেদের কুফল। তাই যখনই বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা বা সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা-হাংগামা বাধিয়ে পিণ্ডির শাসকগোষ্ঠী জাতীয় ও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে ফায়দা লুটতে চেয়েছে ইত্তেফাক তখনই তার বিরুদ্ধে রুখে দাড়িয়েছে । সে জন্যই কাশ্মীরের হযরত বালের কি এক ঘটনাকে উপলক্ষ করে ১৯৬৪ সালে পিন্ডির শাসকগোষ্ঠী ও তাদের বাঙ্গালী দালাল মোনেম-সবুর খা্নরা বাঙ্গলাদেশের বুকে সাম্প্রদায়িক হাংগামা সৃষ্টি করেছিল, তখন ইত্তেফাক এ অশুভ চক্রান্তের বিরুদ্ধে জেহাদ ঘোষণা করে। সামরিক বাহিনীর উপস্থিতিতে ও যখন দাঙ্গা-হাঙ্গামা চলছিল তখন ইত্তেফাক বড় বড় কাঠের টাইপে “বাঙ্গালী রুখে দাড়াও” শিরোনামায় সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী ভাই-বোনের কাছে এক জোরালো আবেদন জানায়। ইত্তেফাক যেমন বাঙ্গালী স্বার্থকে বড় করে দেখতো তেমনই ভাবে বাংলাদেশের মানুষও ইত্তেফাকের কথাকে বড় করে দেখে প্রেস এন্ড পাবলিকেশন অর্ডিন্যান্স ও অন্যান্য আইনগত বিধি নিষেধের ফলে সব কথা বলতে না পারলেও আকার ইঙ্গিতে যেটুকু বলেছে তা দেখেই বাংলাদেশের মানুষ বুঝে গিয়েছিল দাঙ্গাবাজদের আসল উদ্দেশ্য । তাই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই হিন্দুমুসলমানের দাংগা রূপান্তরিত হয়ে গেল বাঙালী অবাঙালী দা্ংগায়। পিন্ডির শাসকগোষ্ঠী ও দালালরা চমকে উঠলো । দাঙ্গা বিরোধী অভিযান পরিচালনার অভিযোগে বঙ্গবন্ধুর সাথে মামলায় জড়ানো হলো ইত্তেফাক সম্পাদককে । দাঙ্গা করার অপরাধে দাংগাবাজদের বিরুদ্ধে মামলা হবে এটা স্বাভাবিক । কিন্তু যারা দাংগার বিরোধিতা করে, দাঙ্গাবাজদের দমন করতে চায় তাদের বিরুদ্ধে মামলা রুজু বিশ্বের ইতিহাসে এই বুঝি প্রথম। এছাড়া গণতন্ত্র, মানবিক মূল্যবোধ ও সংবাদপত্রের স্বাধীনতার ব্যাপারে ইত্তেফাক ও প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক মরহুম তোফাজ্জল হোসেন বরাবরই ছিলেন আপোষহীন। এর জন্য অতীতে দুবার ইত্তেফাকের প্রকাশনা বন্ধ হয়ে গেছে, ইত্তেফাকের বিরুদ্ধে হয়েছে অনেক মামলা, ইত্তেফাক সম্পাদককে করতে হয়েছে কয়েকদফা কারাবরণ। তাই, পিপলস অফিসের ধবংসলীলা দেখার পর বুঝতে বাকী রইল ইত্তেফাকের ভাগ্যে কি ঘটছে। সে জন্য সরাসরি হুণ্ডা চালাতে বললাম ইত্তেফাক অফিসের দিকে । গিয়েই দেখলাম আমার অনুমান সত্য। ইত্তেফাকের অফিস ভবনের বিভিন্ন অংশে তখনও আগুন জলছে। সদ্য     স্থাপিত রোটারী মেশিনটাও জলছে। আগুনের উত্তাপে ভিতরে যাওয়া সম্ভব নয়। রাস্তা থেকেই দাড়িয়ে দেখা গেল নীচতলা ও উপরতলায় কয়েকটি লাশ । ২৫শে মার্চের ভয়াল রাত থেকে ২৬শে মার্চ বিকেলে অফিসে কামান দাগানো সময় পর্যন্ত ইত্তেফাক অফিসে ছিলেন এরূপ কয়েকজন প্রবীন সাংবাদিকের কাছ থেকে সব জানতে পারলাম ।একটা সংবাদপত্র অফিস ধ্বংস করার কাজে তিন তিন খানা প্যাটন ট্যাঙ্ক ব্যবহারের নজির বিশ্ব ইতিহাসে এই প্রথম। হিটলার মুসলিনি বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতার জন্য ইতিহাসে কুখ্যাত হয়ে আছে। কিন্তু এ বর্বরতা তারাও কোনদিন করেছিল বলে শুনিনি। ইত্তেফাক ধ্বংসের যে কাহিনী পরে শুনেছি এবং জেনেছি  ২৫শে মার্চ রাতে যে সব সাংবাদিক অসাংবাদিক কাজ করতে এসেছিলেন হঠাৎ যুদ্ধ শুরু হয়ে যাওয়ায় তাদের অনেকেই অফি্স ছেড়ে বাড়ী যেতে সাহস পাননি। এদের মধ্যে ছিলেন দৈনিক ইত্তেফাকের এক্সিকিউটিভ এডিটর ও প্রখ্যাত সাংবাদিক জনাব সিরাজউদ্দীন হোসেন, বার্তা সম্পাদক জনাব আসিফ দৌল্লাহ, সিনিয়র রিপোর্টার সৈয়দ শাহজাহান, সহকারী সম্পাদক জনাব হাবিবর রহমান (মিলন ), ইত্তেফাকের প্রধান চিত্রশিল্পী হাশেম খাঁন সহ ৮ জ পেশাদার সাংবাদিক এবং পাবনার সাহিত্যিক জনাব ইকবাল হোসেন।এরা সবাই বার্তা কক্ষে আবদ্ধ ছিলেন। এ ছাড়া নীচতলা ও উপরতলায় আরও কিছু লোক ছিল। ২৫শে মার্চ রাত গেল ২৬শে মার্চ প্রায় সারাদিন গেল। কিন্তু কেউ বেরুতে সাহস করলো না। কেননা, রাস্তায় তখনও চলছে নির্বিচার গুলীবর্ষণ । পশ্চিমা সৈন্যরা রাস্তায় যাকে পাচ্ছে তাকেই গুলী করে মারছে। সারারাত সারাদিন না খাওয়া ইত্তেফাকে আটক সাংবাদিক ও অসাংবাদিকেরা তখন কাহিল অবস্থা । কেউ চেয়ারে হেলান দিয়ে ঝিমাচ্ছেন, আবার কেউ হয়তো টেবিলের উপর অসাঢ় হয়ে পড়ে আছেন। বেলা তখন চারটার মতোন। ইত্তেফাক অফিস ভবনের যে যায়গাটায় “দৈনিক ইত্তেফাক” কথাটা লেখা ছিল সেখানে একটা গোলা এসে পড়লো । গোলার আঘাতে সমস্ত ভবনটি কেঁপে উঠলো। অফিসে অবস্থানরত কেউ বুঝতে পারলো না ব্যাপারটা কি। তাদের সবাই ছুটে গেলেন দোতলায় ওঠার সিঁড়ির কাছে। গিয়েই যা দেখলেন তা থেকেই বোঝা গেল । দেখতে পেলেন অফিসের সামনের রাস্তার ঠিক উল্টো দিকে গভর্ণর ভবনের দেয়াল ঘেষে পজিশান নিয়ে আছে একটা প্যান ট্যাঙ্ক। আর তারই আশে পাশে সৈন্যরা প্রস্তত হয়ে আছে মেশিনগান ও স্বয়ংক্রিয় রাইফেল নিয়ে । ব্যাপারটা বুঝতে পেরেই সাংবাদিকরা সবাই শুয়ে পড়লেন। ঠিক এমনি সময় ঘটে গেল একটা ঘটনা। ইত্তেফাকের ক্যার্টিনের এক বয় দোতলার কোন এক জায়গায় লুকিয়ে ছিল। ১০/১১ বছরের এ অবুঝ ছেলেটিও কামানের গর্জন শুনে উত্তর পাশের জানালার কাছে এসে দাড়ালো । আর মুহুর্তের মধ্যে মেশিনের গানের একটা গুলী এসে লাগলো তার কপালে। তার সমস্ত মাথাটা চুর্ন-বিচুর্ণ হয়ে গেল মরার আগে একবার “মা” বলার সুযোগটিও তাঁর হয় নি। নীচের তলায় ছিল মেশিনম্যান সহ কয়েকজন পিয়ন-দারোয়ান। উপরের তলায় মেশিনগান ও গোলার আওয়াজ শুনে নীচতলার কোন এক কক্ষে অবস্থানরত ‘শামসু নামে একটা পিয়ন ব্যাপারটা বোঝার জন্য কনার বারান্দায় পা দিয়েছে । আর অমনি মেশিনগানের আর একটা গুলী এসে লাগলো তার বুকে । মুহূর্তের শামসুর প্রাণ বায়ু বের হয়ে গেল। তার মৃত দেহটা পড়ে রইল নীচের তলার বারান্দায়। ইত্যবসরে সাংবাদিকগণ হামাগুড়ি দিতে দিতে পুনরায় ঢুকলো বার্তা কক্ষে। নিজেদের নিরাপত্তার প্রশ্নে তারা তখন ভয়াবহ রকমের সংকিত হয়ে উঠলেন । কিন্তু বের হবার কোন উপায় নেই। তবু কোন কোন সাংবাদিক জীবনের উপর ঝুঁকি নিয়ে হলেও যে কোন দিকে বের হওয়ার চেষ্টা তুললেন। কিন্ত সিরাজ সাহেব তাতে বাধা দিয়ে বললেন ওরা বাইরে থেকে যাই করুক অন্ততঃ সংবাদপত্রের অফিসের ভিতরে এসে কাউকে গুলী করে মারবে না । সুতরাং তার মতে সংবাদপত্রের অফিসটাই নাকি সবচেয়ে নিরাপদ স্থান। একজন সভ্য, শিক্ষিত মানুষ হিসাবে সিরাজ সাহেবের বক্তবের মধ্যে হয়তো যুক্তি ছিল। কিন্তু বর্বর পশ্চিমা পকিস্তানী সৈন্যরা যে কতদূর যেতে পারে তা তখন তিনি আচ করে উঠতে পারেন নি যা হোক, কথপোকথন ও নানা চিন্তা ভাবনার মধ্যে তাদের প্রায় পৌণে একঘণ্টা কেটে গেল, ঠিক এমনি সময় ইত্তেফাক অফিসের উত্তর পুর্ব কোণে গোপীবাগের মোড়ে একখানা প্যাটন ট্যাঙ্ক এসে পজিশন নিল। তারপর ইত্তেফাকের ছাপাখানাটা লক্ষ্য করে শুরু করলো গোলাবর্ধন। ইত্যবসরে ইত্তেফাক অফিসের দক্ষিণ পশ্চিম কোনে সিনেমা হলের পার্শ্বে পজিশন নেয় আরও একটা ট্যাঙ্ক। সেই ট্যাঙ্ক থেকেও একাউণ্টস সেকশান লক্ষ্য করে বর্ষণ করে কয়েক রাউন্ড  গোলা । তারপর সৈন্যরা ঢুকে পড়ে অফিসের ভেতর। পেট্রোল ছিটিয়ে, গ্রেণেড ছুড়ে আগুন ধরিয়ে দেওয়া হল মেশিন কক্ষে । ইত্তেফাকের সাংবাদিকবৃন্দ এবার ঠিক করলেন তাদেরকে যে কোনভাবে চেষ্টা করতে হবে প্রাণে বাঁচার । কিন্তু কোনমতেই যে সামনের গেট দিয়ে বের হওয়া যাবে না তা তাদের বুঝতে বাকী রইল না। বার্তা কক্ষ ও সাধারণ কক্ষের মাঝখানে ছিল একট। দেয়াল। এ দেয়াল ও ছাদের মাঝখানে ছিল একফুট পরিমাণের ফাঁকা জায়গা । তাঁরা একজন আরেকজনের ঘাড়ে পা দিয়ে একজন একজন করে টপকালেন এ উচু দেয়াল। ইত্তেফাকের ছতলা ভবনটি তখন নির্মানাধীন । ভবনের পশ্চিম ধারে লিফটের জন্য রাখা হয়েছে গোলাকার একটা খালি জায়গা । ওখান দিয়েই একজন একজন করে নেমে গেলেন নীচতলায় । উদ্দেশ্য  ছিল প্রধান সম্পাদকের কক্ষের জানাল৷ ভেঙ্গে কোনরকমে বেড়িয়ে পড়বেন পশ্চিম দিকে । তারপর কপালে যা হয় তাই হবে। কারণ বসে বসে আগুনে পুড়ে মরাঁর চেয়ে চেষ্টা করে দেখতে ক্ষতি কি। কিন্ত হায়! দূর থেকে এ কক্ষের দিকে মুখ দিয়ে দেখলেন ৭/৮ জন পাঞ্জাবী সৈন্য ততক্ষণে আগুন দিচ্ছে। সৈন্যরা তখন নিজেদের কাজে এত ব্যস্ত ছিল যে তাদেরকে দেখতে পায় নি। সাংবাদিকরা আবার ফিরে গেলেন দোতলায় একটা নতুন উইংয়ে। সেখান থেকে নেমে গেলেন মেশিন কক্ষে সেখানে তখন দাউ দাউ করে আগুন জলছে। আগুনের লেলিহান শিখা এড়িয়ে পাশ কেটে কেটে তারা চলে গেলেন ইত্তেফাকের পূর্ব দেয়ালের পাশে। পাশের বাড়ীর এক পৌঢ় ভদ্রলোক ও তীর পুত্র এতক্ষণ জানালার ফাক দিয়ে দেখছিলেন ওদের বাঁচার অক্লান্ত প্রয়াস। সাংবাদিকদের দেয়ালের কাছে যেতে দেখেই তিনি চীৎকার করে বললেন, তার আপনারা এখান দিয়ে চেষ্টা করুন, এ ছাড়া আপনাদের বাচার আর কোন পথ দেখছি না। দাড়ান দেয়াল অতিক্রম করার জন্য একটা বাশ দিচ্ছি। তারপর,  ভদ্রলোক ও তার বাড়ীর জানালার ফাক দিয়ে ইত্তেফাক অফিসের মধ্যে ঠেলে দিলেন একটা লম্বা বাশ । আর এ বাশ বেয়ে বেয়ে এরা অতিক্রম করলেন ১১/১২ ফুট উচু দেয়াল। পাবনার সাহিত্যিক ইকবাল হোসেন সাহেব যে বার্তা কক্ষের দেয়ালই অতিক্রম করতে পারেনি তা এতক্ষন তাদের খেয়ালে আসে নি। যখন খেয়াল হলো তখন আর তাকে ফেরৎ পাওয়ার কোন উপায় ছিল না । আগুনের উত্তাপে তিনি সেখানেই মরে পড়ে ছিলেন। এ ছাড়া ইত্তেফাক অফিস ভবনে প্রধান মেশিনম্যান কামালসহ আরো কয়েকজনের লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। ঘটনার ৫/৭ দিন পরেও সে সব লাশ সরানো সম্ভব হয় নি।

Unicoded By: Mehedi Hasan Piyal

ভুলের মাশুল- স্বায়ত্ত শাসন থেকে স্বাধীনতা

ভুল সবই ভুল। পাকিস্তানটাই শেষ হয়ে গেল এই ভুলে। একটা মহাভুলকে সত্য বলে প্রমাণ করতে গিয়ে একটা জালিয়াতিকে সত্য বলে প্রতিপন্ন করতে গিয়ে হাজারটা ভুল -ভ্রান্তিকরে লেজে গোবরে হয়ে মার খেয়ে খেয়ে ভূট্টাভাজা হয়ে শেষপর্যন্ত যে উচ্ছন্ন যেতে হয় ইতিহাসে তার নজির ভুরিভূরি  কিন্তু কে কার ঝাড়ে বাঁশ কাটে। অর্থাৎ ইতিহাস আর কে পড়ে দেখে। যাক সে সব কথা ।পাকিস্তানের জন্মলগ্নেই পশ্চিম পাকিস্তানী কায়েমী স্বার্থবাদীরা আর তাদের ফৌজি সরদারেরা একটি মহাভুল করে বসলো। সেটা হল দেশের বৃহত্তর জনসমষ্টি বাঙালী আর বাংলাদেশকে বঞ্চিত করে চিরকালের জন্য গোলামীর জিঞ্জিরে বেধে নিজেরাই বাদশা সালামত বনে যাওয়ায়। জঘন্য দূরভিসন্ধি।দেশের সংখ্যাগরিষ্ঠ জনসমষ্টি বাঙালীদের এবং সবাধিক সম্পদশালী ও শতকরা ৭৫ ভাগ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনকারী বাংলাদেশকে শোষন করার জন্যে বাঙালীর রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের উপর একটানা হামলা চালিয়ে ভূল করলো ।এই প্রথম ভূলটা রূপায়িত করতে গিয়ে পাকিস্তানের জন্মমুহু্র্ত থেকেই গনতন্ত্রের টুটি চেপে ধরে রাখলেো।এইভাবে গনতন্ত্রকে হত্যা করতে গিয়ে শোষন ও শাসনচক্র আর ও একটা ভুল মারাত্মক ভুল করে বসলে । মারাত্মক ভুল করে বসলো।এরপর বছরের পর বছর ধরে একটানা শোষন আর বঞ্চনার সুদীর্ঘ ইতিহাস- এই করুন ইতিহাস কার ও অজানা নয়। শান্তিপূর্ণ ও গণতান্ত্রিক পদ্ধতিতে সমস্যার সমাধান বাংলার মানুষের কাম্য ছিল। সামান্যতম সুযোগ যখনই এসেছে বাংগালীরা তা সবিশ্বাসে ও সযত্নে গ্রহণ করেছে। গ্রহণ করেছিল ঐক্যবদ্ধভাবে গণতন্ত্রের উপর পুর্ণ আস্থা রেখে ১৯৫৪ সালের নির্বাচন। ঐতিহাসিক বিজয়কে নস্যাৎ করার জন্য পশ্চিম পাকিস্তানী প্রাসাদ ষড়যন্ত্রকারীরা মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যেই যুক্ত ফ্রন্ট মন্ত্রী সভা ভেঙ্গে দিয়ে ভুলের উপর ভুল করে বসলো।১৯৫৯ সাল । সাধারন নির্বাচনের আশ্বাস দেয়া হলো । এখানেও তারা করে বসল আর একটি মহাভুল। পশ্চিমা স্বার্থবাদীরা বুঝতে পারলো যে নির্বাচন হলেই আওয়ামীলীগ ক্ষমতায় চলে যাবে। অর্থাৎ কেন্দ্রের ক্ষমতা চলে যাবে বাঙ্গালীদের হাতে। তা ও কি কখনো হয়! রাতের অন্ধকারে কায়েমী স্বার্থবাদীদের প্রতিভু আইয়ুব খাঁ সামরিক আইনের মারফত ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত হলো । তার তখতে তাওস্‌খাবেত করার জন্য শান্তি ও গণতন্ত্রকামী বাঙ্গালীদের উপর চালানো হলো। নির্যাতনের ষ্টিম রোলার | দেশ প্রেমিক নেতৃ-বর্গকে করা হলো কারারুদ্ধ। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবর রহমান ১৯৬৬ সালে বাঙ্গালীর মুক্তি সনদ ৬ দফা ঘোষণা করলেন । আইয়ুব খান ৬দফার ৰিরুদ্ধে অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ ও গৃহযুদ্ধের হুমকি দেখিয়ে আরো একটি ভুল করে বসলেন। আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে আইয়ুব চক্রের বিরুদ্ধে দেশে দূর্বার গণ আন্দোলন শুরু হলো। আইয়ুবশাহী লাঠি, গুলি,জেল জুলুমের মাধ্যমে আন্দোলনকে স্তব্ধ করতে ব্যর্থ হয়ে শেখ মুজিবর রহমান ও অন্যান্য দেশ প্রেমিকদের বিরুদ্ধে কুখ্যাত আগড়তলা ষড়যন্ত্র মামলা সাজালেন এবং জীবনের ফাইনাল ভুল করে বসলেন । যাক সেসব কথা। ভুলের সংশোধন কখনও ভুল দিয়ে হয় না। পূর্বসূরীদের ভুলসায়রে হাবুডুবু খেতে স্বচক্ষে দেখেও এই “মহা সত্যটি” উপলব্ধি করতে সক্ষম হলেন না সেনাপতি ইয়াহিয়া খাঁ । একদিকে গণতন্ত্রে হিরো হওয়ার কুটিল বাসনা অন্য দিকে গণদুশমন আইয়ুব খানের উত্তরসূরী হিসাবে পুরাতন মদ নতুন বোতলে ঢেলে খাওয়ার উলঙ্গ লালসা কপটতার আশ্রয় নিলেন। সামরিক বাহিনীর কাছ থেকে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের বেফাস ওয়াদা করে বিশ্ববাসীকে তথা গণতন্ত্র ও স্বাধিকার আন্দোলনে নিবেদিত প্রাণ সাড়ে সাত কোটি বাংগালীকে বোকা বানাতে চেষ্টা করে নিজেই বুড়বক হয়ে গেলেন জনাব ইয়াহিয়া খান। এটাও করলেন তিনি ভুল করেই। অবশ্য এ ব্যাপারটার জন্য তাকে একা দায়ী করা চলে না। কারণ পশ্চিমা প্রভু মওদূদী দওলাতানা ও কাইউম গোষ্ঠীর পদলেহ বাংলার মীরজাফর, ধর্মব্যবসায়ী গোলামে আজম, শফিকুল ইসলাম, মাহমুদ আলী ফরিদ আহমদ, ফ কা চৌধুরী ,সবুর খান, খাজা খয়েরুদ্দিন প্রমুখ দালাল ও উপদালালেরা নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে এমন এক ভুল ছবি ও সাদ্দাদী খোয়াব সামনে তুলে ধরে ছিল যে নির্বাচনের ফলাফল ঘোষিত হওয়ার পর ইয়াহিয়া খাঁ বুঝতে পারলেন যে তার বাঙ্গালী দালালরা অংকে কতখানি কাঁচা |।যারা শুনছেন, ভুল কথাটা বারবার উচ্চারণ করাতে হয়তে। বিরক্ত হচ্ছেন । কিন্তু কি করবো বলুন ? সত্য গোপন করে আমরা তো আর্‌ ভুল করতে পারি না। তাই বলতে হয় যে ৩রা মার্চের জাতীয় পরিষদের অধিবেশন মূলতুবি ঘোষণা, করে ইয়াহিয়া আর ও একটি চরম ভুল করে ফেললেন । এটা করেছিলেন পুরানা দোসর নব আবিষ্কার রূপে উদিত এক গেলাসের ইয়ার জুলফিকার আলী ভূট্টোকে খুশী করার জন্য । দুয়ে মিলেই ভুল করলেন বাঙ্গালীকে গোলামে পরিণত করার ব্যর্থ চেষ্টা করে-_ভুল করলেন নিরস্ত্র-বাঙ্গালীদের উপর বর্বর সেনাবাহিনী লেলিয়ে দিয়ে তাদের জান মাল ইজ্জত নষ্ট করার চেষ্টা করে ভুল করলেন আওয়ামী লীগকে বেআইনী ঘোষনা করে।ইয়াহিয়া ভুট্টো বুঝতে ভুল করলো এই ভূলের মাশুল তাদের দিতে হবে জন্ম জন্মান্তরে।তারা ভুলে গিয়েছিল যে এটা ১৯৫৮ সাল নয়।ভুলে গিয়েছিলেন যে এটা ১৯৬৯ সাল ও নয় এটা ১৯৭১ সাল।১৯৫৮ সালে আইয়ুবের সামরিক অভ্যুত্থান ও ১৯৬৯ সালে ইয়াহিয়ার ক্ষমতা দখল প্রতিরোধ না করে বাংলার মানুষ যে ভুল করেছিল এবারে যে আর ভুল করবে না ইয়াহিয়া খাঁ চরম ভুল করে ফেললেন।এই ভাবে পশ্চিমা কায়েমী স্বার্থীদের ক্রমাগত ভুলের ফাটল ধরে ধরে এৰং একের পর একটি করে কঠিন থেকে কঠিনতর দেশপ্রেমের অগ্নিপরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে হতে জাতীয়তাবোধে উৎসর্গকৃত সাড়ে সাত কোটি বাঙ্গালী স্বায়ত্বশাসন থেকে স্বাধীনতায় উত্তীর্ণ  হয়ে গেল। মানবতার দুশমনেরা ভূল করে গেছে। কিন্তু বাঙ্গালীরা ভুল করে নাই। তারা ভুল করলো না শ্ত্রু  চিনতে তারা ভুল করলো না।অস্ত্র ধরতে তারা ভুল করলো না স্বাধীনতা ঘোষনা করতে । বাঙ্গালীরা  জানে নির্যাতনের সরোবরেই  একদিন মুক্তির কমল ফুটে উঠবে ।

জয় বাংলা ।      

রণাঙ্গনেঃ খান সেনাদের উপর মুক্তিবাহিনীর আক্রমণ তীব্রতর হয়েছেঃআরো সাত শতাধিক সৈন্য খতম

স্বাধীন বাংলাদেশ বেতারের খবরে প্রকাশ, হানাদারবাহিনী বাংলাদেশে যে বর্বরোচিত ও সুপরিকল্পিত গণহত্যা চালিয়েছে তারই অংশ হিসাবে আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ ও তাদের সমর্থকদের উপর অকথ্য নির্যাতন চালিয়ে যাচ্ছে। এই নির্মম অত্যাচারের হাত থেকে আমাদের প্রিয় নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজীবের বয়োবৃদ্ধ অসুস্থ পিতামাতাও রেহাই পাননি । খুনী ইয়াহিয়ার বন্য সৈন্য সামন্তরা তাদের নির্মম হত্যাযজ্ঞে সময় আওয়ামী লীগ নেতাদের বাড়ীঘর লুট করে এবং পরে পুড়িয়ে দেয়। তাদের আত্মীয় স্বজনের ওপর অমানুষিক অত্যাচার চালায়।পাক সৈন্যরা মহান নেতার জন্মস্থান টুংগীপাড়া গ্রামটির সর্বত্র এক ত্রাসের রাজত্ব কায়েম করে। বঙ্গবন্ধুর বাড়ীর ছ’ জন সহ গ্রামের বহু নিরীহ লোককে তারা হত্যা করে। হানাদারবাহিনী প্রিয় নেতার ৯ বছর বয়স্ক বৃদ্ধ বাবা এবং অসুস্থ মাকে পর্যন্ত লাঞ্ছিত করতে ছাড়েনি। যাওয়ার সময় দস্যু ও পাক-সৈ্ন্যরা  মহান নেতার বাড়ীর মূল্যবান জিনিষপত্র লুট করে পরে বাড়ীটাতে. আগুন ধরিয়ে দেয়। গত সাতদিনে চট্রগ্রাম রণাংগণে প্রায় একশত ৫০ জন পাক হানাদার মুক্তিবাহিনীর গেরিলাদের হাতে নিহত হয়েছে এবং বহু স্থান থেকে পাক-সেনা প্রত্যাহার করে নেওয়া হয়েছে বলে স্বাধীন

বাংলা বেতারকেন্দ্র জানিয়েছে। সমগ্র পূর্ব রণাংগনে গেরিলাদের তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে । কক্সবাজারে বহু পাক-সেনা হতাহত হয়েছে।এদিকে মর্টার ও মেশিনগানসহ আক্রমন চালিয়ে মুক্তিযোদ্ধারা ফেনীর উত্তর-পূর্ব অঞ্চলে ২০ জন পাক-সেনাকে হত্যা করেছেন ।স্বাধীনতাকামী তরুণ যোদ্ধারা গত ১৯শে জুন সিলেট সেক্টরে একটি এলাকায় পাক-হানাদারদের সঙ্গে এক সংঘর্ষে ১৩জন পাক-সেনাকে খতম করেন এবং প্রচুর অস্ত্রশস্ত্র ও গোলাৰারুদসহ ৩ জন পাক-ফৌজকে আটক করেছেন। এর আগের দিন এক প্রচণ্ড সংঘর্ষে মুক্তিবাহিনী সিলেটের কয়েকটি স্থানে আক্রমণ চালিয়ে কয়েকটি শত্রসেনার বাঙ্কার নষ্ট করেছেন এবং ৩০জন সৈন্যকে খতম করেছেন। এই আক্রমণে ২২তম রেজিমেন্টের একজন সৈন্যকেও আটক করেছেন ।মুক্তিবাহীনি রংপুরের বজড়াপড়ায় পাকসেনাদের ওপর অতর্কিত গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাক সেনাদের নাজেহাল করে ছেড়েছেন। এই আক্রমনে অনেক খান-সেনা হতাহত হয়েছে। সেই দিনই পাকসেনারা মৃত সৈন্যদের লাশ ও আহত সৈন্যদের নওগা নিয়ে যায়। এই আক্রমণে একজন অফিসারসহ দুজন পাক-সেনাকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলাযোদ্ধারা গ্রেফতার করেছেন। কয়েকদিন আগে মুক্তিবাহিনীর বীর যোদ্ধার ঠাকুরগায়ের কাছে মর্টার ও  মেশিনগান থেকে শক্র ছাউনীর উপর আচমকা গুলী চালায়।চট্টগ্রামে ও মুক্তিযোদ্ধাদের গেরিলা তৎপরতা বৃদ্ধি পেয়েছে। গত দু সপ্তাহ ধরে চট্টগ্রামে অধিক সংখ্যক গাড়ী ও সৈন্য নিয়ে পাক সেনাদের চলাফেরা করতে দেখা যাচ্ছে।কুষ্টিয়া রণাঙ্গনের মেহেরপুর এলাকায় এক দুঃসাহসিক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী কমপক্ষে ৩০ জন পাক সেনাকে খতম করেছেন, সেখানকার কুতুবপুরে মুক্তিবাহিনী খান-সেনাদের উপর আকম্মিক ভাবে ঝাপিয়ে পড়ে ১০ জন পাক খান-সেনাকে হত্যা করেন | গত ১৫ই জুন নাজিরাকোনায় এক প্ল্যাটুন পাক-সেনাকে আক্রমণ করে মুক্তিবাহিনীর অসম সাহসী যোদ্ধারা ২০জন দুশমন সৈন্যকে খতম করেছেন।স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, সাতক্ষীরার  নিকট দুশমন সৈন্যদের ঘাটির উপরও মুক্তিযোদ্ধারা আক্রমণ চালিয়েছেন । এ এলাকায় কয়েকটি আউট-পোষ্টও আমাদের মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে দস্যু সৈন্যদের অনেকেই হতাহত করেছেন ।গত ১২ই জুন ভোমরা সেক্টরের কলাবোয়ায় মুক্তিবাহিনী প্রচণ্ড আক্রমণ চালিয়ে ১৬ জন খান-সেনাকে খতম করেছেন । মুক্তিবাহিনী এ দিন রাতে আরেক অভিযানে ৬০ জন খান-সেনা হত্যা করেছেন। কলারোয়া ইউনিয়ন কাউন্সিলের চেয়ারম্যান ও তথাকথিত শান্তি কমিটির প্রেসিডেন্ট ওয়াজেদ আলী চৌধুরীকে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা যোদ্ধারা খতম করেছে ।মুক্তিবাহিনী বাংলাদেশের দক্ষিণ-পশ্চিম খণ্ডে বিশিষ্ট এলাকায় খান-সেনার উপর ব্যাপক আক্রমণ চালিয়ে মেহেরপুরের নিকটে এক পল্টন খান-সেনাকে খতম করেছেন। মুক্তিবাহিনী মেহেরপুর শহর থেকে প্রায় দু’ মাইল দূরে কামদেবপুর গ্রামে ইছাখালী সীমান্ত চৌকি দখল করে নিয়েছে। এতদাঞ্চলে মর্টার থেকে গুলীবর্ষণ করে মুক্তিবাহিনী শক্রসেনাদের এক পল্টন সৈন্য খেতম করে দিয়েছেন। নিহতদের মধ্যে কয়েকজন পদস্থ অফিসারও রয়েছে।এদিকে বেঈমান পাক-সেনারা এখনও বাংলাদেশে স্বাধীনতা- কামীদের ওপর অব্যহতভাবে নির্যাতন ও নির্বিচারে হত্যা চালিয়ে যাচ্ছে। টাঙ্গাইলে পাক-সৈন্যরা মীর্জাপুর হাসপাতালের প্রায় এক হাজার রোগী তাড়িয়ে দিয়ে হাসপাতাল ভবনটি দখল করে নিয়েছে। হাসপাতাল থেকে বিতাড়িত রোগীদের মধ্যে বেশ কিছুসংখ্যক সন্তান সম্ভবা মহিলাও ছিলেন। হাসপাতাল ভবনটি দখলের সময় ইয়াহিয়ার বর্বর-সৈন্যরা ডাক্তার ও নার্সদের অপমানিত করে এবং তাদের অনেককেই নৃশংসভাবে হত্যা করে ।চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগ্রাম ও সন্নিহিত অন্যান্য এলাকায় প্রবল বন্যা সৃষ্টির কুমতলব নিয়ে তারা কাপ্তাই-এর কর্ণফুলী জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের সব কটি সুইস গেটই বন্ধ করে দিয়েছে। এর ফলে হালদা, শঙ্খ এবং মাতামুহুরী নদীর জলস্ফীতি বিপদসীমা ছাড়িয়ে গেছে। ইতিমধ্যেই পার্বত্য চট্টগ্রামের মাহালছড়ি, মায়াণীর মুখ, উরসীর মুখ, রঙ্গীপাড়া প্রভৃতি অঞ্চলে বন্যার সৃষ্টি হয়েছে । এর আগে বর্ষা ও বৃষ্টির আশঙ্কায় জলবিদ্যুৎ প্রকল্পের

ম্যানেজার ১৬টির মধ্যে ৪টি গেট খুলে দিয়েছিলেন। পাক-সেনারা আবার এ ৪টি গেট বন্ধ করে দেয় এবং প্রকল্প ম্যানেজারকে গুলী করে হত্যা করে।

করাচিতে বাংগালীদের জীবন

সম্প্রতি করাচীর প্রভাবশালী জঙ্গ পত্রিকা মারফৎ জানা গেছে করাচীতে বাঙালীদের একটি বিশেষস্থানে অন্তরীণ করে রাখা হচ্ছে।অত্যাচার আর অবিচারের নমুনা হিসেবে. ‘জঙ্গ’ পত্রিকাটি এই খবর ছেপেছেন। ইয়াহিয়ার হিংস্র হায়েনার যে কেবল বাংলাদেশে বিভীষিকা ও অরাজকতার সৃষ্টি করেছে তা নয় তাদের ভয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালীদের জীবন আর নিরাপদ নয়। বাংগালিরা সন্ধ্যার পর রাস্তায় বেরোয়না। সামরিক সরকারের নির্দেশে বহু বাঙালী শ্রমিককে হত্যা করা হয়েছে করাচীতে | সুপরিকল্পিত উপায়ে ঠাণ্ডা মাথায় পৃথিবীর বুক থেকে বাঙালীদের নিশ্চিহ্ন করার যে পন্থা ইয়াহিয়াকে গ্রহণ করেছে ত৷ বিশ্বের সভ্য দেশগুলোকে করেছে ক্ষুব্ধ ও বেদনাহত। তাই তারা এক বাক্যে সবাই বলছেন বন্ধ করো এই নরমেধ যজ্ঞ। রাঙালীর আত্মনিয়ন্ত্রণের অধিকার থাকবে বাঙালীদের হাতে । কথায় আছে  পিপীলিকার পাখ৷ উঠে মরিবার তরে ।ইয়াহিয়া ও তার সাঙ্গো পাঙ্গো বড়ো বড়ো গোঁফ এবং ভুঁড়িওয়ালা জেনারেলরা আকাশে উড়ছেন। ধ্বংস তাদের অনিবার্য্য।যাক এখন আসল কথায় আসল যাক। সেদিন আমাদের অফিসে এসেছিলেন এক তরুণ। তিনি দিন দশেক আগে করাচী থেকে ঢাকায় আসেন। গত কয়েকদিন আগে তিনি মুজিবরনগরে এসে পৌছেছেন। তিনি বর্ণনা করছিলেন করাচীর অবস্থা ।অনেকক্ষণ ধরে আলাপ করলেন। কথায় কথায় বললেন বুঝলেন গত ছ’বছর ধরে করাচীতে আছি। আজ ইনসিকিউরড মনে হয়েছে । তাইতো পালিয়ে এলাম ।তার নিজের জবানিতেই সব ঘটনা শোনা যাক। করাচী ছেড়ে আমার পালিয়ে আসার কারণ হলো আমি শুধু বাংগালী নই আমি করাচী ছাত্র লীগ শাখার সাধারণ সম্পাদক ও বাংলা দেশ সমাজ কল্যান সমিতির প্রতিষ্ঠাতা সেক্রেটারী । পড়াশুনা করতাম করাচীর মেরিন একাডেমীতে । পঁচিশে মার্চের কয়েকদিন পর বাসায় চিঠি পাঠালে সামরিক কর্তৃপক্ষ । “তোমাকে আমাদের সাথে দেখা করতে হবে’’। এই হচ্ছে চিঠির নির্দেশ ।কয়েকজন বাঙালী বন্ধুকে বললাম এখন কি করা যায়। সবাই বললো তুমি পালিয়ে যাও। কোথাও গিয়ে লুকিয়ে থাকে ।দেখা করতে ঠেলেই গুলী করে মেরে ফেলবে । সবাই আমাকে পরামর্শ দিলো আমি যেনো পারলে ঢাকা চলে যাই। বন্ধুদের পরামর্শ মতে,বাসা ছেড়ে পালিয়ে আত্মগোপন করে রইলাম ।একাডেমীতে যাওয়াও আমার বন্ধ হয়ে গেলো । দিনের আলো থাকতেই শহরের এদিক ওদিক ঘোরাফেরা করে অন্যের বাসায় থাকতাম ।ছাব্বিশে মার্চ থেকে পনেরোই মে পর্যন্ত এই যে কদিন আমি করাচীতে ছিলাম তা আমার কাছে এক দুঃস্বপ্ন । সতেরোই এপ্রিল সামরিক সরকারের নির্দেশে সমগ্র গুন্ডাবাহিনী আক্রমণ চালালো লাওী, মাঙ্গোপীর, ফেডারেল এরিয়া, মূসা কলোনী ও আবিসিনিয়া কলোনী প্রভৃতি অঞ্চলে । এই সমস্ত এলাকায় থাকে বাঙালী শ্রমিকরা রাতের অন্ধকারে ঘুমন্ত নিরীহ শ্রমিকদের ওপর ঝাপিয়ে পড়লো ইয়াহিয়ার গুন্ডাবাহিনী , হত্যা করল তারা প্রায় কয়েক হাজার শ্রমিককে ।এই ঘটনার পর বাঙালীরা রাত বিরোতে ঘোরা ফেরা বন্ধ করে দিতে বাধ্য হয়। রাতের বেলা রাস্তায় কোন বাঙালীকে একা পেলেই গুণ্ডারা ছোরা চালাচ্ছে । মানে এক কথায় কি বিভীষিকার মধ্যে যে বাঙালীরা দিন গুজরান করছে তা বলার নয়। করাচীতে যে সব বাঙালী সামরিক অফিসার আছেন তাদের কারো কারোকে হত্যা করা হয়েছে বলে আমরা খবর পেয়েছি । এছাড়া বাকীদের টাকা বন্ধ করে দেয়া হয়েছে ফলে স্ত্রী পুত্র পরিবার নিয়ে অশেষ দুর্ভোগের মধ্যে তারা দিন কাটাচ্ছেন। বরখাস্তও করা হয়েছে সামরিক অফিসারদের অনেককে ।বাঙালীদের কতো ভাবে হেনস্থা করেছে ওরা তার ইয়ত্তা নেই।করাচীতে যে সব বাঙালী সরকারী অফিসার রয়েছেন তাদের কতৃপক্ষ এই মর্মে নির্দেশ দিয়েছেন যে অনুমতি ছাড়া কেউ করাচী ত্যাগ করতে পারবেনা ।সবাইর প্রতি কড়া নজর রাখছে তারা

করাচীতে বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের অবস্থা তো আরো কাহিল। তারা কেউ ক্লাশে যোগ দিতে পারছে না । সুযোগ পেলেই ছাত্রদের মারধোর করা হচ্ছে। করাচীর একমাত্র বাংলা কলেজ দুষ্কৃতিকারীরা ভেঙ্গে চুরমার করে দিয়েছে । তবেএকটা কথা হচ্ছে যে বাঙালী বিরোধী কার্যকলাপে যারা লিপ্ত হয়েছে তারা সিন্ধীনন। তারা সবাই করাচীতে বসবাসকারী পাঞ্জাবী ও বিহারী ।

Unicoded By: Mehedi Hasan Piyal

লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা – আমরা না তোমরা?-তাজউদ্দিন

(পুর্বে প্রকাশিতের পরে)

ইয়াহিয়ার এই নির্বিচার গণহত্যা আমাদের জন্য রাজনৈতিক দিক থেকে অর্থহীন নয়।আর এ কাজ পাকিস্তানে বিয়োগান্তক ও মর্মান্তিক ইতিহাসের শেষ অধ্যায়,যা ইয়াহিয়া নিজেই রচনা করেছে বাঙ্গালীদের রক্ত দিয়ে।বাংলাদেশ থেকে বিতাড়িত বা নির্মূল হওয়ার আগে তারা গ্ণহত্যা ও পোড়া মাটি নীতির মাধ্যমে বাংগালী জাতিকে শেষ করে দিয়ে যেতে চায়। ইত্যবসরে ইয়াহিয়ার লক্ষ্য হল আমাদের রাজনৈতিক, বুদ্ধিজীবী মহল ও প্রশাসন ব্যবস্থাকে নির্মূল করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, কারখানা, জনকল্যানমূলক প্রতিষ্ঠানসমূহ ধ্বংস করা এবং চূড়ান্ত পর্যায়ে শহরগুলোকে ধুলিস্যাৎ করা যাতে একটা জাতি হিসাবে কোন দিনই আমরা মাথা তুলে দাড়াতে না পারি। ইতিমধ্যে এ লক্ষ্য পথে তার সেনাবাহিনী অনেক দূর এগিয়ে গেছে। যে বাংলাদেশকে তারা দীর্ঘ ২৩ বছর নিজেদের স্বার্থে লাগিয়েছে, শোষণ করছে তাদেরই বিদায়ী লাথির উপহার হিসাবে সেই বাংলাদেশ সর্বক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে ৫০ বৎসর পিছিয়ে পড়লো ।অসউইজের পর গণহত্যার এমন জঘন্যতম ঘটনা আর ঘটেনি । অথচ বৃহৎ শক্তিবর্গ বাংলাদেশের ঘটনার ব্যপারে এ উটপাখীর নীতি অনুসরণ করে চলেছেন। তারা যদি মনে করে থাকেন যে এতদ্বারা তারা পাকিস্তানের ঐক্য বজায় রাখার ব্যাপারে সহায়তা করছেন তাহলে তারা ভূল করছেন । কেননা, পাকিস্তানের ভবিষ্যৎ সম্বন্ধে ইয়াহিয়া খান নিজেও আজ মোহমুক্ত । তাদের বোঝা উচিত যে, পাকিস্তান আজ মৃত এবং ইয়াহিয়া নিজেই পাকিস্তানের হত্যাকারী । স্বাধীন বাংলাদেশ আজ একটা বাস্তব সত্য। সাড়ে সাত কোটি বাঙালী তাদের অজেয় মনোবল ও সাহসের মাধ্যমে স্বাধীন বাংলাদেশের জন্ম দিয়েছে এবং প্রতিদিন হাজার হাজার বাঙালী সন্তান রক্ত দিয়ে এ নতুন শিশু রাষ্ট্রকে লালিত পালিত করছেন । দুনিয়ার কোন শক্তি এ নতুন জাতিকে ধ্বংস করতে পারবে না। আজ হোক কাল হোক দুনিয়ার ছোট বড় প্রতিটি রাষ্ট্রকেই গ্রহণ করতে হবে এ নতুন জাতিকে, স্থান দিতে হবে বিশ্ব রাষ্ট্র পুঞ্জে।সুতরাং, রাজনীতি এবং মানবতার স্বার্থেই আজ বৃহৎ শক্তিবর্গের উচিৎ ইয়াহিয়ার উপর পূর্ণ চাপ সৃষ্টি করা, তার লাইসেন্সধারী হত্যাকারীদের খাচায় আবদ্ধ করা এবং পশ্চিম পাকিস্তানে ফিরিয়ে দিতে বাধ্য করা। আমাদের সংগ্রামকে সৌভিয়েত  ইউনিয়ন, ভারত এবং বিশ্বের অন্যান্য বহু দেশের স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ যে সমর্থন দিয়েছেন তা আমর চিরকাল কৃতজ্ঞতার সাথে স্মরণ করবে । গণচীন, মাকিন, যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, গ্রেটবৃটেন ও অন্যান্য দেশের কারো থেকেও আমরা অনুরুপ সমর্থন আশা করি এবং তা পেলে সেজন্য তাদেরকে অভিনন্দন জানাবো । প্রত্যেকটি রাষ্ট্রের উচিত তাদের নিজ নিজ পর্যায়ে পশ্চিম পাকিস্তানের উপর চাপ সৃষ্টি করা এবং তারা যদি তা করেন তা হলে ইয়াহিয়ার পক্ষে বাংলাদেশের বিরুদ্ধে আর একদিনও হামলা অব্যাহত রাখা সম্ভব নয়। জনসংখ্যার দিক থেকে বাংলাদেশ হবে বিশ্বের অষ্টম বৃহৎ রাষ্ট্র। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য হবে ইয়াহিয়ার সেনাবাহিনীর সৃষ্ট  ভষ্ম ও ধ্বংসস্তুপের উপর একটা নতুন দেশ গড়ে তোলা । এ একটি দুরূহ ও বিরাট দায়িত্ব। কেননা আগে থেকেই আমরা বিশ্বের দরিদ্রতম জাতি সমূহের অন্যতম ৷ এ ছাড়া একটা উজ্জ্বল ভবিষ্যতের জন্যে মানুষ এক ঐতিহাসিক সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে । তারা প্রাণপণ সংগ্রামে লিপ্ত হয়েছে । তারা প্রাণ দিচ্ছে অকাতরে । সুতরাং, তাদের আশা আমরা ব্যর্থ করতে পারিনা। তাদের ভবিষ্যতকে উজ্জল করতেই হবে । আমার বিশ্বাস, যে জাতি নিজে প্রাণ ও রক্ত দিতে পারে, এতো ত্যাগ স্বীকার করতে পারে সে জাতি তার দায়িত্ব সম্পাদনে বিফল হবে না । এ জাতির অটুট ঐক্য স্থাপনের ব্যাপারে কোন বাধা বিপত্তি টিকতে পারে না । আমাদের এই অস্তিত্ব রক্ষার সংগ্রামে আমরা কামনা করি বিশ্বের প্রতিটি ছোট বড় জাতির বন্ধুত্ব। আমরা কোন শক্তি ব্লক বা সামরিক জোটভুক্ত হতে চাই না আমরা আশা করি শুধুমাত্র শুভেচ্ছার মনোভাব নিয়ে সবাই নিঃসঙ্কোচে সাহায্য করতে এগিয়ে আসবে আমাদের । কারো তাবেদারে পরিণত হওয়ার জন্য আত্মনিয়ন্ত্রণের দীর্ঘ সংগ্রামে আমাদের মানুষ এত রক্ত দেয়নি, এত ত্যাগ স্বীকার করছেন।আমাদের এই জাতীয় সংগ্রামে, তাই আমরা রাষ্ট্রীয় স্বীকৃতি এবং নৈতিক সমর্থনের জন্য বিশ্বের জাতিসমূহের প্রতি আকুল আবেদন জানাচ্ছি। এ ব্যপারে প্রতিটি দিনের বিলম্ব ডেকে আনছে সহ মানুষের অকাল মৃত্যু এবং বাংলাদেশের মূল সম্পদের বিরাট ধ্বংস। তাই বিশ্ববাসীর প্রতি আমাদের আবেদন, আর কালবিলম্ব করবেন না, এই মুহুর্তে এগিয়ে আসুন এবং এতদ্বারা বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের চিরন্তন বন্ধুত্ব অর্জন করুন।বিশ্ববাসীর কাছে আমরা আমাদের বক্তব্য পেশ করলাম। বিশ্বের আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে স্বীকৃতির বেশী দাবীদার হতে পারে না। কেননা,আর কোন জাতি আমাদের চেয়ে কঠোরতর সংগ্রাম করেনি, অধিকতর

ত্যাগ স্বীকার করেনি ।

জয় বাংলা।

ইয়াহিয়ার জংগী সরকার

বাংলাদেশের অবস্থা বর্ণনা করে ফরাসী পত্রিকা  লা ‘মদে একটি প্রবন্ধ প্রকাশিত হয়েছে। লা’মদ ফরাসীদেশের সব চাইতে বিখ্যাত দৈনিক পত্রিকা ।এই প্রবন্ধে বলা হয়েছে  আলজিরিয়ায় মুক্তি যোদ্ধাদের উপর যে কায়দায় বোমা বর্ষণ করা হত, ঠিক সেই রকম ধারায় বোমা ফেলা হয়েছে বাঙলাদেশের মুক্তিযোদ্ধাদের উপর | প্রবন্ধকার মশিয়ে জিরার ভিরাতেল, ২৫ শে মার্চ তারিখে যে সব বিদেশী সাংবাদিকদের আটক রেখে পরে তাদের নিজ নিজ দেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তাদের এবং পরে ইয়াহিয়া সরকার যে ছয়জন বিদেশী সাংবাদিককে বাঙলাদেশের অবস্থা দেখতে নিয়ে যায় তাদের অন্যতম ছিলেন। ভিরাতেল তার প্রবন্ধে লিখেছেন যে সব অফিসার সাংবাদিকদের নিয়ে ঘোরাফেরা করেছেন, তারা সব সময় সেনাবাহিনীর নির্দোষিতা সামরিক হস্তক্ষেপের যৌক্তিকতা সম্বন্ধে সাংবাদিকদের বিশ্বাস উৎপাদনের জন্য সর্বদাই চেষ্টা করছিলেন। সাংবাদিকদের কাছে বলা হয়েছে যে, রক্তপাত ও সম্পত্তি নাশের অধিকাংশ ঘটনাই ঘটেছে বাঙালী ও বিহারীদের মধ্যে দাঙ্গার ফলে।সেনাবাহিনীর লোকেরা বোঝাতে চাচ্ছিলেন সব দোষ বাঙালীদের  ভিরাতেস আরো  লিখেছেন সমস্ত ব্যপারটিকে হিন্দু চক্রান্ত,ভারতের কারসাজি বলে প্রচার করবার চেষ্টা চলেছে।পশ্চিম পাকিস্তানে এসব কথার দাম থাকলেও বাংলাদেশের বাঙ্গালীদের মধ্যে এই সব প্রচারের খুব একটা বড় ফলছে না।বাংগালী অফিসারদের ছাড়িয়ে দেয়া হচ্ছে।তাদের মাথার উপর পশ্চিম পাকিস্তান থেকে অফিসার এনে বসান হচ্ছে।অবাঙ্গালীদের বড় বড় চাকুরি দেওয়া হচ্ছে।সমস্ত বৃটিশ পত্র-পত্রিকায় বাংলাদেশে পাক বর্বরতার সমালোচনা করা হচ্ছে। বৃটিশ রক্ষণশীল দলের সমর্থক ডেইলিমেল পত্রিকায় বলা হয়েছে বৃটেন এখনো কেন পশ্চিম পাকিস্তান সরকারের সাথে স্বাভাবিক কূটনৈতিক সম্পর্ক বজায় রেখেছে তার যুক্তি খুঁজে পাওয়া কষ্টকর । কারণ, বাঙলাদেশে এখন যা ঘটছে তা পরিকল্পিত গণহত্যা।

Unicoded By: Mehedi Hasan Piyal

শরনার্থীদের অবস্থা

মাকিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাবশালী সাপ্তাহিক নিউজ উইক পত্রিকায় বাংলাদেশ থেকে ভারতে আগত শরনার্থীদের অবস্থার এক অতি করুণ বর্ণনা দেওয়া হয়েছে। লেখা হয়েছে কি ভাবে চল্লিশ লক্ষের উপর শরনার্থী তাদের দিন কাটাচ্ছে। অথচ বিশ্ববাসী এখনও এই সমস্যা সম্পর্কে নীরবতা অবলম্বন করে করে আছে। নিউজ উইক-এর সংবাদ দাতা টনি ক্লিফটন লিখছেন  একটি শরনার্থীকে জিজ্ঞাসা করলাম সে কেন এসেছে । বিধবা বৃদ্ধার নাম রমিমণ বিবি। সে আমার প্রশ্নের উত্তরে বলে, আমার এক মাত্র ছেলেকে পাঞ্জাবী; ফৌজরা গুলী করে মেরেছে । তার তো কোন অপরাধ ছিল না। জীবনে সে কোন অপরাধ করেনি । সে খামার থেকে ঘরে ফিরছিল। একজন মেথডিষ্ট খৃষ্টান পাদ্রির কথা উদ্ধৃতি দিয়ে ক্লিফটন লিখেছেন,পাঞ্জাবী সৈন্যরা ছেলে মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে।তাদের বাপ মাদের কাছে টাকা আদায় করছে।।টাকা না দিলে ছাড়ছে না ।একজন বাবা তার ছেলে কে ছাড়াবার জন্য সব টাকা দিতে পারে না।সে বলে তোমরা আমাকে মার।পাঞ্জাবীরা তাকে অকথ্য পিটাতে থাকে এবং একটা চোখ তুলে নেয়।অবশ্য  তারা পরে ছেলে ছেড়ে দেয়।পাঞ্জাবী ফৌজের কাছে ছোট ছেলে মেয়েরা কিভাবে মার খেয়েছে তার অনেক নিদর্শনের কথা উল্লেখ করেছেন ক্লিফটন।তিনি অনেক ছেলেমেয়েকে দেখেছেন,যাদের শরীরে ক্ষতবিক্ষত হয়ে আছে পাঞ্জাবী ফৌজের নির্মম প্রহারের ফল।ক্লিফটন বনগাঁ থেকে এই রিপোর্ট পাঠিয়েছেন নিউজ উইক থেকে।

বৃটিশ পত্র পত্রিকার অভিমত

বৃটিশ রক্ষণশীণ দলের সমর্থক ডেলি টেলিগ্রাফ পত্রিকা লিখেছে  ইয়াহিয়া খান বৃটিশ পার্লামেন্টারি দলের সদস্যা মিসেস জিলার নাইট-এর কাছে স্বীকার করেছেন যে, বাংলা দেশে পাক বাহিনীর কার্য্যকলাপ খুব রূঢ় ও “কর্কশ’ হয়েছে । সম্পাদকীয়তে এই পত্রিকা বলেছেন, এই রকম ঘৃণ্য পদ্ধতি অবলম্বন বৃটেনের সর্বাধিক জনপ্রিয় পত্রিকা ডেলি মিরর-এ বলা হয়েছে  বাংলাদেশের ঘটনাবলী সমগ্র উপমহাদেশেরই নয় সমগ্র বিশ্বের শাস্তিকে বিপন্ন করতে পারে। স্বস্তি পরিষদের উচিৎ এ ব্যাপারে কার্যকর ভূমিকা গ্রহণ করা আর বেশী বিলম্ব করলে পরিস্থিতি আয়ত্বের বাইরে চলে যেতে পারে। বৃটিশ উদার নৈতিক দলের সমর্থক গার্ডিয়ান পত্রিকায় বলা হয়েছে বাংলাদেশে যা কিছু ঘটছে তার জন্য দায়ী পাক সরকার । তার ভোটের রায়কে বাতিল করবার জন্যই বাঙলাদেশে রক্তক্ষয়ী সংগ্রাম আরম্ভ করেছে। পাক সরকারই বাঙলাদেশে অনধিকার প্রবেশকারী। রাষ্ট্র সঙ্ঘের সৃষ্টি হবার পর যত গুলি আস্তর্জাতিক দুঃখময় ঘটনা ঘটেছে বাঙলা দেশের ঘটনা তার মধ্যে করুণতম। অবজারভার পত্রিকায় বলা হয়েছে  ইয়াহিয়া খান যদি বাংলাদেশে তার নীতির পরিবর্তন না করেন, তবে অনিচ্ছা সত্ত্বেও ভারত যুদ্ধে জড়িয়ে পড়তে বাধ্য হবে।

স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের বাস্তবতাকে স্বীকার করা হোক

বৃটিশ পার্লামেন্টের ১২০জন শ্রমিক দলীয় সদস্য দাবী করেছেন যে,পাকিস্তান ফৌজ বাংলাদেশে যে ধরণের নির্বিচার গণ হত্যা লুটপাট ও নারী নির্যাতন চালাচ্ছে তাতে সেনাবাহিনীর কোন অধিকার নেই বাংলাদেশ শাসন করবার। সেনাবাহিনী তার বিশৃঙ্খল কার্যকলাপের দ্বারা নিজেদের বাংলাদেশ শাসনের সম্পূর্ণ অযোগ্য প্রমাণিত করেছে । বাংলাদেশ শাসনের আর কোন অধিকার তাদের থাকতে পারে না। বাংলাদেশের প্রশ্নটি নিরাপত্তা পরিষদে ওঠান উচিৎ। কারণ পরিস্থিতি সেখানে আন্তর্জাতিক শান্তির পক্ষে বিপদ জনক হয়ে উঠেছে । এ ছাড়া সেখানে যা ঘটছে তাহলে জেনোসাইড বা জাতি হত্যা। জাতিহত্যা রাষ্ট্রসংঘের সনদের বিরোধি বাংলাদেশের স্বাধীন সরকারকে সে দেশের মানুষের ইচ্ছার অভিব্যক্তি হিসাবে ধরে নিয়ে সেখানে তার সহযোগীতায় শাস্তি স্থাপনের চেষ্টা করা উচিৎ ।

অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করা হোক

 আমেরিকার বিখ্যাত নিউইয়র্ক টাইমসে পত্রিকায়  আবার বলা হয়েছে যে,পাকিস্তান সরকার কে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অর্থনৈতিক সাহায্য বন্ধ করে দেয়া উচিত।কারন যে সরকার তার দেশের একটি বৃহদাংশের সাথে যুদ্ধে লিপ্ত  তাকে সাহায্য করার অর্থ যুদ্ধের খরচা যোগান দেওয়া উন্নয়ন মূলক কাজের জন্য অর্থ যোগান দেওয়া নয়। যে শাসন বলপ্রয়োগের মাধ্যমে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকারকে হরন করেছে, ভোটের রায়কে বানচাল করেছে, যার নীতির ফলে প্রতিবেশী রাষ্ট্রে লক্ষ লক্ষ শরনার্থী এসে জড় হয়েছে এবং যার নীতির ফলে  প্রতিবেশী রাষ্ট্রের উন্নয়নকর্ম ও শাস্তি বিনষ্ট হওইয়া অসম্ভব নয়-_এমন একটি সরকারকে সাহায্য দান উচিৎ নয়। এই সাহায্যের দ্বারা জনসাধারণ উপকৃত হবে না।

Unicoded By: Mehedi Hasan Piyal

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!