You dont have javascript enabled! Please enable it!

জয় বাংলা ১৮ জুন ১৯৭১ তারিখের মূল পত্রিকা

মূল পত্রিকা পড়তে এখানে ক্লিক করুন

শুক্রবার ৩রা আষাঢ়, ১৩৭৮, ১৮ই জুন ১৯৭১
রাজনৈতিক সমাধান?
সম্পাদকীয়
বাংলাদেশ সমস্যার এক রাজনৈতিক সমাধানের প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে বিশ্বের বহু দেশ সোচ্চার হয়ে উঠেছে। কিন্তু এর কোনো রূপ পাওয়া যাচ্ছে না বলে ‘রাজনৈতিক সমাধান’ এ অস্পষ্ট কথাটি অনেক কল্পনা জল্পনা-কল্পনার জাল বুনে চলছে। যেকোনো সমাধানের পথে জল্পনা-কল্পনা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে, এবং সমস্যাকে জটিলতর করে। এ জন্য সুস্পষ্ট, সুনির্দিষ্ট পথের একান্ত প্রয়োজন।
যেকোন সমস্যার মতো বাংলাদেশের সমস্যাকে বাস্তবতার নিরিখে বিশ্লেষণ না করে, কেবল বাহ্যিক দৃষ্টিতে বিচার করা হলে, আমরা মনে করি এর সমাধান পাওয়া যাবে না। কেন আজ বাঙালি মরণপণ করে মুক্তিযুদ্ধে লিপ্ত হয়ে পড়েছে-একথাটির জবাব পেতে হবে।
পৃথিবীর কাছে অজানা নয় যে আওয়ামী লীগ গণতান্ত্রিক এক রাজনৈতিক দল। আওয়ামী লীগ নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতিতে বিশ্বাসী। তাই, আওয়ামী লীগ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করেছিল, নির্বাচনে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জয়ী হয়েও, শান্তিপূর্ণ সহাবস্থানের জন্য আলোচনা বৈঠকে মিলিত হয়েছিল। সঞ্জয় বিপ্লবী মত ও পথ আওয়ামী লীগের নয়। তবুও কেন আজ আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে বাংলাদেশের মানুষকে মুক্তি সংগ্রাম চালাতে হচ্ছে এর সদুত্তর পেতে হবে। এই সংগ্রামের, এবং ইয়াহিয়া খান সরকারের পৈশাচিক বর্বরতার বহু কথা বলা হয়েছে, বহু বই লেখা হয়েছে। দুনিয়ার সকলের কাছে এসব কথা জানা।
মূল সমস্যার মৌলিক কারণগুলোকে কোন সমাধানের চেষ্টা করা হলে, সাময়িকভাবে স্বস্তি পাওয়া গেলেও, স্থায়ী শান্তি আসতে পারে না। স্থায়ী সমাধানের জন্য নিরপেক্ষ, প্রভাবমুক্ত মন, গভীর ও সুদূরপ্রসারী -অন্তর্দৃষ্টি, এবং বাস্তব উপলব্ধির প্রয়োজন। তাই যারা রাজনৈতিক সমাধানের ধুয়া তুলেছেন তাদের কাছে সংগ্রামের সার্বিক রূপটি স্পষ্ট থাকতে হবে।
বাংলাদেশের মানুষ নির্বাচন শেষে স্বাভাবিকভাবেই আশা করেছিল, গণতন্ত্রের সাধারণ নিয়মে, একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে, আওয়ামী লীগ পাকিস্তানের সংবিধান রচনা করবে, পাকিস্তানের শাসন ভার, পরবর্তী নির্বাচন পর্যন্ত চালিয়ে যাবে। কিন্তু জন্মলগ্ন থেকে পাকিস্তানের ষড়যন্ত্রের রাজনীতি চলে আসছে তার এই পথ ধরে সাধারণ মানুষের বিরুদ্ধে কায়েমী স্বার্থবাদী, অগণতান্ত্রিক শক্তি আবারো চক্রান্ত শুরু করলো। মানুষের সমস্ত আশা-আকাঙ্ক্ষাকে নস্যাৎ করে দিয়ে শাসন ও শোষণকে অব্যাহত রাখার উদ্দেশ্যে তারা আকস্মিকভাবে, নিরাপরাধ, নিরস্ত্র বাঙালির ওপর পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্য লেলিয়ে দিল। তারা বাংলাদেশকে গোরস্থানে পরিণত করেছে, লক্ষ লক্ষ মানুষকে গৃহহারা, সর্বহারা করেছে, গোরস্থানে আবালবৃদ্ধবনিতা কে হত্যা করেছে, লক্ষ লক্ষ মা-বোনদের ইজ্জত হানি করেছে, কোটি কোটি টাকার সম্পত্তি লুট করেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক চক্রের নজিরবিহীন নির্মমতা ও পাশবিকতা, সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মনকে রক্তাক্ত করে দিয়েছে। বাঙালির চোখে আজ তীব্র ঘৃণা ও প্রতিহিংসার আগুন জ্বলছে। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম এর কন্ঠে যেদিন ধ্বনিত হল-‘লক্ষ লক্ষ শহীদের লাশের উপর বসে আলোচনা চলতে পারেনা’ -সেদিন ক্ষত-বিক্ষত বাঙালির মনের কথাটিই প্রতিধ্বনিত হয়ে উঠেছিল। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দ বাস্তব ও মুক্তিবাদী বলে ভাবাবেগকে প্রশ্রয় দেন না। মূলতঃ তারা নিয়মতান্ত্রিক ও শান্তিপূর্ণ রাজনীতিতে বিশ্বাসী বলে অপ্রয়োজনে রক্তপাতে আগ্রহী নন। বিনা রক্তপাতে যদি লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হয়, বাঙালির আশা-আকাঙ্ক্ষা যদি রূপায়িত হওয়া সম্ভব হয়, সেই পথ অনুসরণে যাতে কোনো প্রতিবন্ধকতা না আসে, তার জন্য অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম চারটি পূর্ব শর্ত দিয়েছেন। সুস্পষ্ট, দ্ব্যর্থহীন, সুনির্দিষ্ট অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধানের কেবল দেশপ্রেমেরই পরিচয় নয়, এতে তার মানবিকতা ও আন্তরিকতাকেও প্রতিভাত করেছে। তার চারটি শর্ত বাস্তব অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে বাঙালির মনের কথাটিকেই প্রতিধ্বনিত করেছে।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের চারটি শর্ত হলোঃ (১) বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান এবং অন্যান্য রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের বিনা শর্তে মুক্তি (২) বাংলাদেশ থেকে পশ্চিম পাকিস্তানী সমস্ত সৈন্যদের অপসারণ (৩) স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের স্বীকৃতি এবং (৪) বিগত ২৩ বছরের বঞ্চিত অর্থসহ বর্তমান যুদ্ধে ক্ষতিসাধিত সম্পত্তির ক্ষতি পূরণ।
বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলার অবিসংবাদিত নেতা। তিনি গণপ্রজাতান্ত্রিক বাংলাদেশের রাষ্ট্রপ্রধান। তাকে কারাগারে রেখে কোনো আলোচনা চলতে পারে না। আলোচনা চালাবার জন্য তার ও তার সহকর্মীদের বিনাশর্তে মুক্তি দিতেই হবে। বাংলা ও বাঙালির পক্ষে অভিমান যাবার একমাত্র অধিকারী বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের বাঙালিরা বিদেশি হানাদার বলে মনে করে। পশ্চিম পাকিস্তানী সৈন্যদের উপর বাঙ্গালীদের কোন আস্থা নেই। তাদের উপস্থিতিতে বাঙালি নিরাপদ মনে করতে পারে না এবং এ কারণেই ক্ষমা প্রদর্শনের কথা বলা সত্বেও কোন উদ্বাস্তু ফিরে যাননি। ভীতিও অবিশ্বাসের মধ্যে নিরাপত্তার ভাব জাগতে পারেনা। স্বাধীন বাংলাদেশ সরকার বাংলার সর্বস্তরের মানুষের আস্থাভাজন। বাংলার আশা-আকাঙ্ক্ষা স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের মাধ্যমে প্রতিফলিত। বাংলার নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে গঠিত সরকার প্রকৃত প্রস্তাবে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করার অধিকারী। আর পশ্চিম পাকিস্তানিরা গত ২৩ বছরে বাংলাকে শোষন করে, বঞ্চিত করে এবং সর্বশেষ গত মার্চ মাসের ২৫ তারিখ থেকে হত্যা-লুণ্ঠন, ইত্যাদিতে বাংলাদেশের অর্থনীতিকে যেভাবে ধ্বংস করে দিয়েছে তার ক্ষতিপূরণ দিতে হবে। নৈতিক বা আইনগত যে কোন বিচারে বাঙালি ক্ষতিপূরণ দাবি করতে পারে। বিনা অপরাধে তার সম্পদ নষ্ট করা হয়েছে। তাছাড়া বাস্তব দৃষ্টিভঙ্গিতে বিচার করলে বলতে হয়, অনাহার অনটন ক্লিষ্ট, দারিদ্র পীড়িত মানুষ কখনো শান্তিতে থাকতে পারে না।
সৈয়দ নজরুল ইসলামের চার দফার ভিত্তিতে রাজনৈতিক সমাধান হলে স্থায়ী ফল পাওয়া যাবে বলে আমরা বিশ্বাস করি। একটি জাতি নির্দিষ্ট এক লক্ষ্যে পৌঁছার জন্য জীবন-মরণ সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে। রাজনৈতিক সমাধান সেই লক্ষ্যে পৌঁছে দিতে ব্যর্থ হলে স্থায়ী ফল বা শান্তি আসতে পারে না। সত্য সে যতই কঠোর হোক, তাকে অস্বীকার করা যায় না এবং করাও উচিত নয়। বাস্তবতাকে উপেক্ষা করার চেষ্টা করা হলেও পরিস্থিতি তার নিজস্ব গতিতে বয়ে যেতে বাধ্য।
বাংলাদেশের ব্যাপারেও সত্যকে অস্বীকার করা উচিত হবে না। আজ নগ্নভাবে এ সত্যটি ভেসে উঠেছে যে বাংলা, পাঞ্জাব, সিন্ধু, বেলুচিস্তান, উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ এক নয় বাংলা ও বাঙ্গালীর সাথে পশ্চিম পাকিস্তানের মিলনের কথাই উঠে না, এমনকি সম্প্রীতি ও জাগতে পারে না। বাংলার প্রতি ঘরে যে হাহাকার উঠেছে প্রতিটি বাঙালির মন সেভাবে ক্ষতবিক্ষত হয়েছে, আর কোন মধুর বাণী এ হাহাকার, এ আর্তিতে প্রলেপ দিতে পারবে না। আজ স্পষ্ট হয়ে উঠেছে যে, বাংলার স্বাধীনতাই একমাত্র সমাধানের পথ। বাঙালির সঙ্গে পশ্চিম পাকিস্তানিদের ভাষা, সাহিত্য, সংস্কৃতি, কৃষ্টির কোন মিল নেই এই সর্ববাদীসম্মত বক্তব্যের সাথে গত ২৩ বছরের বঞ্চনা এবং গত কয়েক মাসের হত্যা, লুণ্ঠন, ব্যভিচার, নির্যাতন মিলে বাঙালি মন যেভাবে বিষাক্ত হয়ে গেছে, তাতে কোনো বন্ধনের কথা প্রলাপ বলেই মনে হবে। তাই আজ স্বীকার করে নিতে হবে পাকিস্তান যেকোনো বাস্তব বিচারে তার অস্তিত্ব হারিয়ে ফেলেছে। কেবল আবেগ-অনুভূতিতে সমস্যার বিচার চলে না।
এই পরিস্থিতিতে, পাকিস্তানকে গড়ে তোলার চিন্তাও বাতুলতার সমান। পশ্চিম পাকিস্তানী সামরিক বাহিনীর পৈশাচিকতায় শত শত কোটি টাকার সম্পদ নষ্ট হয়েছে, বাংলাদেশ এমনকি পশ্চিম পাকিস্তানের অর্থনীতি আজ প্রায় ধ্বংসের পথে। ধ্বংসস্তূপ থেকে অর্থনীতিকে করে তুলতে হলে জনসাধারণের সহযোগিতা অপরিহার্য। ভয়-ভীতি, ত্রাস, ঘৃণা, অবিশ্বাসের মধ্যে সহযোগিতা হতে পারেনা। চাপে পড়ে যে কাজ তাতে আন্তরিকতা থাকে না এবং আন্তরিকতা না থাকলে কার্যকরী প্রচেষ্টা চলতে পারে না। তাই রাজনৈতিক সমাধানের নামে যদি বাংলাদেশকে পশ্চিম পাকিস্তানের সঙ্গে জুড়ে দেওয়ার চেষ্টা চলে তাতে সংহতি-সে রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও সামাজিক যে কোন ক্ষেত্রেই হোক আসতে পারে না। বরং এ কথা বলা চলে, বাস্তব সত্যকে স্বীকার করে বাংলার স্বাধীনতাকে মেনে নিলে, কালের গতিতে বর্তমানের পুঞ্জিভূত হিংসা-বিদ্বেষ, অবিশ্বাস কেটে যেতে পারে এবং একসময় হয়ত প্রীতির বন্ধন গড়ে উঠতে পারে।
তাই, আমাদের অভিমত ভবিষ্যতের কল্যাণ কামনায়, বর্তমানে বাস্তবতার প্রেক্ষিতে নির্মম সত্য-বাংলার স্বাধীনতার স্বীকৃততে সমাধান হওয়া বাঞ্ছনীয়। এবং তখনই দীর্ঘস্থায়ী সুফল পাওয়া সম্ভব হবে।
ঐক্যবদ্ধ বাঙালি আজ সাম্প্রদায়িক মনোভাবের ঊর্ধ্বে
পৃথিবীর সভ্য মানুষ মাত্রই রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে বা একই রাষ্ট্রের মধ্যকার ধর্ম সম্প্রদায়ের মধ্যে হানাহানিকে ঘৃণা করে। এই সাম্প্রদায়িকতা ক্ষয়িষ্ণু শাসকচক্রের আত্মরক্ষার কবজ স্বরূপ। বর্তমান পাকিস্তান সরকারও নিজের অস্তিত্ব রক্ষার জন্য বাংলাদেশকে শাসনের হাতিয়ার স্বরূপ এই সাম্প্রদায়িকতাকে একটি প্রধান অবলম্বন হিসেবে বেছে নিয়েছে। এখন বাংলাদেশের সাম্প্রদায়িকতার বিষ পাকিস্তান সরকার ছড়াচ্ছে তার পশ্চাতে আছে শাসকগোষ্ঠীর পাকিস্তান সরকারের অনেক কৌশল, অনেক চক্রান্ত এবং অনেক স্বার্থের দ্বন্দ্ব।
একনায়ক শাসন ব্যবস্থায় শাসকশ্রেণী শাসন ও শোষণ যন্ত্রকে অব্যাহত রাখতে বিভিন্ন সম্প্রদায়ের মধ্যে অবিশ্বাস দ্বিধা সন্দেহ সৃষ্টি করে পরিণামে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ বাধিয়ে দেয়। পাকিস্তানের যতবার সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বেধেছে ততবারই তার মূলে পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকশ্রেনীর চক্রান্ত ক্রিয়াশীল ছিল। উদ্দেশ্য হচ্ছে মূল সমস্যা হয়েছে বাঙ্গালীদের দৃষ্টি অন্যদিকে সরিয়ে দেয়া ও বাঙালি জাতির আত্মপ্রতিষ্ঠা ব্যাহত করা। ফলে পশ্চিম পাকিস্তান কর্তৃক বাংলার শোষণ সহজতর হবে। পশ্চিম পাকিস্তানী শাসক চক্র বরাবরই চেয়েছে পূর্ব বাংলার জনগণ যেন একতাবদ্ধ না হতে পারে। কারণ পূর্ববাংলার হিন্দু-বৌদ্ধ মুসলমান খ্রিস্টান যদি একতাবদ্ধ হয় তবে তাকে কিছুতেই পশ্চিম পাকিস্তান রূখতে পারবে না। এ জন্যেও সাম্প্রদায়িকতার পক্ষে তার এত উৎসাহ। ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলনের পথ ধরেই পূর্ব বাংলার মানুষ ধীরে ধীরে সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে মতামত গড়ে তোলে; এই অভিজ্ঞান এরপর থেকে সাধারণ মনোভঙ্গি গড়ে উঠতে থাকে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন ও ১৯৫৪ সালে জনাব হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর প্রচেষ্টায় যুক্ত নির্বাচন প্রথা প্রবর্তন ও বাংলাদেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান আওয়ামী লীগের ধর্মনিরপেক্ষ রাজনীতির প্রভাবে সম্প্রদায় চক্রান্ত সৃষ্টির সমাধি রচনা হলো। আজ যারা স্বাধীনতা যুদ্ধের পুরোভাগে তাদের দ্বারা সাম্প্রদায়িকতার বিরুদ্ধে এবং স্বাধিকার প্রতিষ্ঠার পক্ষে সংগ্রাম শুরু হয়েছিল সেদিনই। আর এ ধর্মনিরপেক্ষ অসাম্প্রদায়িক সংগ্রাম চালাতে গিয়ে শেখ মুজিবুর রহমান সহ অসংখ্য রাজনৈতিক নেতাকর্মীকে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর বিভিন্ন নির্যাতনমূলক আইনের মাধ্যমে জেল ও নির্যাতন ভোগ করতে হয়েছে। ১৯৬৪ সালে আইয়ুব খানের প্রধান সহচর পূর্ব বাংলার প্রথম গভর্নর মোনায়েম খান পুনরায় এই সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা লাগানোর চেষ্টা করেন। শেখ মুজিবুর রহমান সহ অন্যান্য দেশের সর্বত্র দাঙ্গা বিরোধী আন্দোলন গড়ে তোলার আহ্বান জানালেন। এই সময় ঢাকার সকল পত্রিকায় ‘পূর্ববাংলা রুখিয়া দাড়াও’ শিরোনামায় বাঙালির প্রতি এক আকুল আবেদন করা হয়। সেই আহবানে এক অপার মানবতাবোধে উদ্বুদ্ধ হয়ে সমস্ত চক্রান্তের বিরুদ্ধে বাঙালি জাতি সাড়া দিল। দাঙ্গা রোধ করতে গিয়ে সেদিন আমির হোসেন চৌধুরীর মতো বহু মুসলমান অকাতরে মৃত্যুবরণ করে নিল। কথার ফানুস দিয়ে নয় বুকের তাজা রক্ত দিয়ে বাঙালি এবারও তার মানবতা প্রীতি প্রমাণ করলো। তারপর থেকে শাসকশ্রেণীর চেষ্টা করতে লাগল বাঙালি-অবাঙালি দাঙ্গা বাঁধিয়ে তাদের উদ্দেশ্য সফল করতে। কিন্তু বাংলাদেশের মানুষ সে ঘৃণ্য চেষ্টাও ব্যর্থ করে দিয়ে তাদের নিরাশ করল। বর্তমান সংগ্ৰামের একপর্যায়ে আবার পশ্চিমী শাসকচক্র সাম্প্রদায়িকতার ধুয়া তুলল। পাকিস্তানি বেতারযন্ত্র হিন্দুদের বিরুদ্ধে মিথ্যা প্রচারে তৎপর হয়ে উঠল। এই পর্যায়ে ইয়াহিয়ার জঙ্গী চক্র সুপরিকল্পিত ভাবে বেশ কিছু হিন্দু অধ্যুষিত গ্রাম পুড়িয়ে দিয়ে অসহায় জনগনকে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে পড়তে বাধ্য করেছে। হিন্দুদের সঙ্গে সঙ্গে মুসলমান গ্রামও পুড়লো, অগণিত হিন্দু মুসলমান বাঙালি জঙ্গি মেশিনগানের গুলিতে প্রাণ দিল। তার হলে সারা বাংলাদেশে আজ শ্মশানভূমি।
অত্যাচার চালানোর জন্য বর্বর সৈন্যবাহিনী ভয় দেখিয়ে কিছু লোককে গ্রামে গ্রামে অগ্নিসংযোগ ও লুটতরাজের কাজে নিয়োগ করে। এবং সেই অগ্নিসংযোগকারীকে দুষ্কৃতিকারী প্রতিপন্ন করার উদ্দেশ্যে ক্যামেরার সাহায্যে তাদের ছবি তুলে নিয়েছে, আবার পরক্ষণেই গুলি করে তাদের হত্যা করেছে। তবু বাংলাদেশের ঐক্যবদ্ধ স্বাধীনতা প্রিয় মানুষ সাম্প্রদায়িক উস্কানিতে উত্তেজিত হয়নি। ইস্পাতের মত কঠিন একতা নিয়ে অপেক্ষা করছে শত্রু ধ্বংস দেখার জন্য।
আজ সর্বোচ্চ সামরিক বাহিনীর সাধারণ মানুষকে হত্যা করে, ভয় দেখিয়ে নিজেদের এ লুটপাটে নিয়োজিত করেছে, এই সমস্ত জঘন্য অতাচারে জর্জরিত হয়ে নিরুপায় নিরীহ জনগণ দলে দলে পালিয়ে ভারতবর্ষের যেতে শুরু করে, হিন্দু মুসলমান বৌদ্ধ খ্রিষ্টান সকলেই পালাচ্ছে -এতেই প্রমাণিত হয় অত্যাচার এসেছে বাঙালি জাতির উপর। কোন ব্যক্তি বিশেষ, কোনো গোষ্ঠী বিশেষ বা কোন সম্প্রদায় বিশেষ এর উপর নয়। বহু বৌদ্ধ অধ্যুষিত এলাকা, খ্রিস্টান গির্জা, আজ ধ্বংসপ্রাপ্ত, হিন্দুদের মন্দির, মুসলমানদের মসজিদ কিছুই রেহাই পায়নি এই বর্বর অত্যাচারীদের হাত থেকে।
বাঙ্গালীদের নিশ্চিহ্ন করতে যেভাবে বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করা হয়েছে সেখানে হিন্দু-মুসলমান সমান হারে মরেছে। এর কারণ বাঙালিকে নেতৃত্বহীন করে দেওয়া। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শন বিভাগের অধ্যাপক ডক্টর গোবিন্দদেব এর পাশাপাশি পরিসংখ্যান বিভাগের প্রধান জনাব মনিরুজ্জামান এবং অধ্যাপক জ্যোতির্ময় গুহঠাকুরতার পাশে অধ্যাপক মুক্তাদিরও একই হাতের শিকার।
তাই দীর্ঘ ২৪ বছরের ইতিহাসের দিকে তাকালে বোঝা যায় অত্যাচারী পাকিস্তান সরকারের অতীত ও বর্তমান রাজনীতির প্রধান হাতিয়ার এই সাম্প্রদায়িকতা। আজ বাংলাদেশের মুক্তির প্রচেষ্টায় যে ঐক্যবদ্ধ শক্তির বিকাশ ঘটেছে তা বানচাল করার উদ্দেশ্যে প্রতিক্রিয়াশীল জঙ্গি সরকার বাঙালির মধ্যে অনৈক্য সৃষ্টির জন্য হন্যে হয়ে উঠেছে। তারা অবাঙালিদের হাতে প্রচুর অস্ত্র দিয়ে গ্রামে গ্রামে পাঠিয়ে দিচ্ছে, সেখানে তারা নতুন করে অত্যাচার শুরু করছে, রাস্তায় রাস্তায় এই সব অবাঙালিরা টহল দিয়ে বেড়াচ্ছে। এদিকে ইয়াহিয়া সরকারের প্রচারযন্ত্র এ কথা প্রচার করছে যে, বাংলা ও বাঙালি দের স্বাধিকারের জন্য যারা সংগ্রাম করেছে এবং এই সংগ্রামে যারা সাহায্য ও সহযোগিতা করেছে তারা এবং যেহেতু বাংলার সংখ্যালঘুরা ধর্মনিরপেক্ষ এবং অসাম্প্রদায়িক স্বাধীকার সংগ্রামের সাথে একাত্মতা করেছে, কাজেই তারাই পূর্ববাংলার এই দুরবস্থার জন্য দায়ী। এই ঘৃণ্য অপপ্রচারের একমাত্র উদ্দেশ্য হচ্ছে ভারত ও বাংলাদেশের সর্বত্র সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাধানো। লক্ষ লক্ষ বাঙালি আজ ভারতে আশ্রয় নিয়েছে, এ অবস্থায় যদি পাকিস্তানের উস্কানির ফলে কোথাও সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা বাঁধে তাহলে পাকিস্তান সরকারের উদ্দেশ্য সিদ্ধ হবে। তাই এই মুহূর্তে সবথেকে যা প্রয়োজন তা হচ্ছে বাংলা শত্রু ঘৃণ্য পশ্চিমা কুচক্রীদের ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করা, তাদের কোন প্রকার উস্কানিতে কান না দেওয়া বরং দিনের-পর-দিন মুক্তি যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য নিজেদের তৈরি করা। একথা মনে রাখতে হবে যে কোন স্বাধীনতা যুদ্ধে সহজে সাফল্য অর্জন করা যায় না। সুতরাং, সংগ্রাম যত কঠিন ও দীর্ঘ হোক না কেন তা চালিয়ে যাওয়ার জন্য তৈরি থাকতে হবে।
লাখো শহীদের লাশের তলায় পাকিস্তানকে কবর দিয়েছে কারা আমরা না তোমরা? – তাজুদ্দীন
২৪শে মার্চ জেনারেল ইয়াহিয়া এবং আওয়ামী লীগ উপদেষ্টাদের মধ্যে চূড়ান্ত বৈঠকে জনাব এম, এম, আহমদ সংশোধনী প্রস্তাব পেশ করেন। এই খসড়া প্রস্তাবের ব্যাপারে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত গ্রহণের জন্য জেনারেল পীরজাদার আহ্বানে একটা চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা ছিল। দুঃখের বিষয় কোন চূড়ান্ত বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি। বরং জনাব এম, এম, আহমদ আওয়ামী লীগকে না জানিয়ে ২৫ শে মার্চ করাচি চলে গেলেন।
২৫ শে মার্চ রাত এগারোটা নাগাদ সমস্ত প্রস্তুতি সম্পন্ন হয় এবং সেনাবাহিনী শহরে পজিশন গ্রহণ করতে থাকে। মধ্যরাত্রি নগর ঢাকা শহরের শান্তিপ্রিয় জনগনের উপর পরিচালনা করা হলো গণহত্যার এক পূর্বনির্দিষ্ট কর্মসূচি। অনুরূপ বিশ্বাসঘাতকতার নজির সমসাময়িক ইতিহাসে কোথাও খুঁজে পাওয়া যাবে না। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে দেননি কোন চরমপত্র। অথবা মেশিনগান আর্টিলারি কামান সুসজ্জিত ট্যাংকসমূহ যখন মানুষের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল ধ্বংসলীলা শুরু করে দিল তার আগে জারি করা হয়নি কোন কারফিউ অর্ডার। পরদিন সকালে লেফটেন্যান্ট জেনারেল টিক্কা খান তার প্রথম সামরিক নির্দেশ জারি করলেন বেতার মারফত। কিন্তু ৫০ হাজার তার আগেই লোক প্রাণ হারিয়েছে বিনা প্রতিরোধে। এদের অধিকাংশ ছিল নারী ও শিশু। ঢাকা শহর পরিণত হয় নরক-কুণ্ডে। প্রতিটি অলিগলি ও আনাচে-কানাচে চলতে লাগল নির্বিচারে গুলি। সামরিক বাহিনীর লোকদের নির্বিচার অগ্নিসংযোগের মুখে রাতের অন্ধকারে বিছানা ছেড়ে যেসব মানুষ বের হওয়ার চেষ্টা করলো তাদেরকে নির্বিচারে হত্যা করা হলো মেশিনগানের গুলিতে।
আকস্মিক ও অপ্রত্যাশিত আক্রমণের মুখে ও পুলিশ এবং ইপিআর বীরের মতো লড়েই গেল। কিন্তু দুর্বল, নিরীহ মানুষ কোন প্রতিরোধ দিতে পারল না। তারা মারা গেলে হাজারে হাজারে। পাকিস্তানের প্রেসিডেন্টের নির্দেশে সেনাবাহিনী যে ব্যাপক গণহত্যা চালিয়েছে আমরা তার একটা নির্ভরযোগ্য তালিকা প্রস্তুত করছি এবং শীঘ্রই তা প্রকাশ করব। মানব সভ্যতার ইতিহাসে যেসব বর্বরতা ও নিষ্ঠুরতা কাহিনী আমরা শুনেছি, এদের বর্বরতা নিষ্ঠুরতায় তার সবকিছু ম্লান করে দিয়েছে।
পাকিস্তানের সেনাবাহিনীকে লেলিয়ে দিয়ে ২৫শে মার্চ রাতে ইয়াহিয়া ঢাকা ত্যাগ করলেন। যাওয়ার আগে তিনি তাদেরকে দিয়ে গেলেন বাঙালি হত্যার এক অবাধ লাইসেন্স। কেন তিনি এই বর্বরতার আশ্রয় নিয়েছিলেন পরদিন রাত আটটার সময় বিশ্ববাসীকে জানানো হলো এর কৈফিয়ৎ। এ বিবৃতিতে তিনি নরমেধযজ্ঞ সংগঠনের একটা ব্যাখ্যা বিশ্ববাসীকে জানালেন। তার বক্তব্য একদিকে ছিল পরস্পরবিরোধী এবং অন্যদিকে ছিল মিথ্যার বেসাতিতে ভরা। মাত্র ৪৮ ঘন্টা আগেও যে দলের সাথে তিনি শান্তিপূর্ণ ক্ষমতা হস্তান্তরের ব্যাপারে আলাপ-আলোচনা চালাচ্ছিলেন দলের লোকদের দেশদ্রোহী ও দলটিকে অবৈধ ঘোষণার সাথে বাংলাদেশের পরিস্থিতি বা আলাপ আলোচনায় কোনো সঙ্গতি খুঁজে পেল না বিশ্ববাসী। বাংলাদেশের একমাত্র প্রতিনিধিত্বশীল এবং জাতীয় পরিষদের সংখ্যাগুরু আসনের অধিকারী আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘোষণা করে গণপ্রতিনিধিদের হাতে তার ক্ষমতা হস্তান্তরের ওয়াদাকে সাড়ে সাত কোটি বাঙালির মত প্রকাশের প্রতি তামাশা ছাড়া মানুষ আর কিছু ভাবতে পারল না। তার বক্তব্য থেকে একথা সুস্পষ্ট ভাবে প্রতিভাত হল যে ইয়াহিয়া খান আর যুক্তি বা নৈতিকতার ছত্র ছায়ায় আশ্রয় নিতে চান না এবং বাংলাদেশের মানুষকে নির্মূল করার জন্য তিনি জঙ্গী আইনের আশ্রয় নিতে বদ্ধপরিকর। পাকিস্তান আজ মৃত এবং অসংখ্য আদম সন্তানের লাশের তলায় তার কবর রচিত হয়েছে। বাংলাদেশে যে শত সহস্র মানুষের মৃত্যু হয়েছে তা পশ্চিম পাকিস্তান এবং পূর্ব পাকিস্তানের মানুষের মধ্যে একটা দুর্লঙ্ঘ্য প্রাচীর হিসাবে বিরাজ করছে। পূর্ব পরিকল্পিত গণহত্যায় মত্ত হয়ে ওঠার আগে ইয়াহিয়ার ভাবা উচিত ছিল তিনি নিজেই পাকিস্তানের কবর রচনা করছেন। তারই নির্দেশে তার লাইসেন্সধারী কসাইরা জনগণের উপর যে ধ্বংসলীলা চালিয়েছে তারা কোনমতেই একটা জাতীয় ঐক্যের অনুকূল ছিল না। বর্ণগত বিদ্বেষ এবং একটা জাতিকে ধ্বংস করে দেওয়াই ছিল এর লক্ষ্য। মানবতার লেশমাত্রও এদের মধ্যে নেই। উপরওয়ালাদের নির্দেশে পেশাদার সৈনিকরা লংঘন করেছে তাদের সামরিক নীতিমালা এবং ব্যবহার করেছে শিকারি পশুর মত। তারা চালিয়েছে হত্যাযজ্ঞ। নারী ধর্ষণ, লুটতরাজ, অগ্নিসংযোগ ও নির্বিচার ধ্বংসলীলা। বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাসে এর নজির নেই। এসব কার্যকলাপ থেকে একথারই আভাস মেলে যে ইয়াহিয়া খান ও তার সাঙ্গপাঙ্গদের মধ্যে দুই পাকিস্তানের ধারণা দৃঢ়ভাবে প্রোথিত হয়ে গেছে। যদি না হতো তাহলে তারা একই দেশের মানুষের উপর এমন নির্মম বর্বরতা চালাতে পারতো না।
জবাব দাও ইয়াহিয়াঃ শোষণ-বঞ্চনাই কি তোমাদের “ইসলাম”?
বিগত দুই সংখ্যার আলোচনা থেকে একথা সুস্পষ্টভাবে প্রমাণিত হয় যে পশ্চিম পাকিস্তান নিয়ন্ত্রিত তথাকথিত পাকিস্তান সরকার বহির্বাণিজ্যে বাংলাদেশের বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প-কারখানা গড়ে তুলেছে। আর সেসব শিল্প কারখানায় উৎপাদিত পণ্য বিক্রয়ের কাছে বাংলাদেশকে সংরক্ষিত বাজার হিসেবে ব্যবহার করেছে।
বর্তমান সংখ্যা আমরা তৎকালীন পাকিস্তানের দুই অংশের উন্নয়নমূলক একটা তুলনামূলক পর্যালোচনা প্রকাশ করছি। এ থেকে একথাই প্রমাণিত হবে যে, তথাকথিত পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় সরকার কোনদিন বাংলাদেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন চায়নি। যদি চাইতো তাহলে তারা দেশের শতকরা ৫৬ জনসংখ্যা অধ্যুষিত বাংলাদেশের মোট উন্নয়ন ব্যয় মাত্র শতকরা ২০ ভাগ করতে পারতো না। ইসলাম ও ইনসাফের প্রতি তাদের যদি এতোটুকু শ্রদ্ধা থাকতো তাহলে তারা বাংলাদেশের উন্নয়নের শতকরা ৫৬ ভাগই ব্যয় করত। ‘ইসলাম ও মুসলমানের’ নামে পাকিস্তান অর্জনের পর থেকে কেন্দ্রীয় সরকার এসেছে অনেক সরকার গিয়েছে কিন্তু বাংলাদেশের প্রতি তাদের মনোভাব এতটুকুও পরিবর্তন হয়নি। এর একমাত্র ব্যতিক্রম ছিল মরহুম হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর নেতৃত্বে গঠিত কেন্দ্রীয় সরকার। কিন্তু যেই মুহুর্তে তিনি বাংলাদেশের প্রতি ইনসাফ করার নীতি গ্রহণ করলেন তখনই শুরু হয়ে গেল তার ও তার সরকারের বিরুদ্ধে চক্রান্ত ও ষড়যন্ত্র। কেন্দ্রীয় পরিষদে সংখ্যাগুরু সদস্যের সমর্থন থাকা সত্ত্বেও তাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করা হলো। সুতরাং, বাঙ্গালীদের বহু আগেই বোঝা হয়ে গিয়েছিল যে, তথাকথিত পাকিস্তানে তারা কোনদিন ইনসাফ ও সুবিচার পাবে না।
সাবেক পাকিস্তানের চার-চারটি পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনার পর্যালোচনা করলেই ধরা পড়বে পশ্চিম পাকিস্তানী নেতাদের “ইসলাম ও সংহতি” প্রীতির নমুনা। প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় যে ক্ষেত্রে পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে ১১ শত ২৯ কোটি টাকা সে ক্ষেত্রে বাংলাদেশে ব্যয় করা হয়েছে ২৩১ কোটি টাকা। দ্বিতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ব্যয় করা হয়েছে ১৬ শত ৫৫ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশের ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ৫২৪ কোটি টাকা। তৃতীয় পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানে ব্যয় করা হয়েছে ৩৩ শত ৫৫ কোটি টাকা। অপরপক্ষে বাংলাদেশে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ১৪ শত ৪ কোটি টাকা। আর চতুর্থ পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় পশ্চিম পাকিস্তানের ব্যয় করা হয়েছে ৫১ শ ৯৫ কোটি টাকা। পক্ষান্তরে বাংলাদেশে ব্যয় করা হয়েছে মাত্র ২১ শত ৪১ কোটি টাকা। এ ছাড়া সিন্ধু অববাহিকা পরিকল্পনা ও উন্নয়ন বহির্ভূত খাতে ব্যয় করা হয়েছে পশ্চিম পাকিস্তানের পনের শত কোটি টাকা। অথচ তার বিনিময়ে বাংলাদেশে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজে একটি পয়সাও ব্যয় করা হয়নি।
(কোটি টাকার হিসাবে)
পরিকল্পনা (১৯৫০-৭০) পঃপাকিস্তান (১২৮৩৪ কোটি টাকা), বাংলাদেশ (৪৩৪০) মোট ব্যয়ের তুলনায় বাংলাদেশের শতকরা হার (২৫.২৬ কোটি টাকা)
সাবেক পাকিস্তানের ২৪ বছরের স্বল্পায়ূকালে নবাবজাদা লিয়াকাট আলি খান, পশ্চিমাদের দালাল স্যার খাজা নাজিমুদ্দিন, আরেক দালাল বগুড়ার মোহাম্মদ আলী, আই আই চন্ডিগড়, চৌধুরী মোহাম্মদ আলী, স্যার ফিরোজ খান নুন, ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান এবং তদীয় মনোনীত জেনারেল ইয়াহিয়া খান করাচি পিণ্ডীর মসনদে রোশনাই বাড়িয়েছেন। কিন্তু বাংলার মানুষের চেহারার রোশনাই বাড়ানোর তকলিফ তাদের কেউ নেন নি। তবে, ইসলাম ও সংহতির মাহাত্ম্য কীর্তনে কেউ কম যাননি।
বাংলাদেশে গুলির আঘাতে লাখো লাখো বাঙ্গালীর মুসলমানকে হত্যা করার পরও জল্লাদ গোষ্ঠী ইসলামের এই মাহাত্ম্য কীর্তনে ক্ষান্ত দেয়নি।
ইয়াহিয়া খান ও তার সাথীদের আমরা জিজ্ঞেস করতে চাই শতকরা ৫৬ জন অধিবাসী হওয়া সত্বেও বাংলাদেশের তথাকথিত ২৫.২৬ ভাগ অর্থ ব্যয় করা কি বঞ্চনার শামিল নয়? এটা কি ইসলাম সম্মত?
আওয়ামী লীগের ম্যানিফেস্টোর কয়েকটি দিক
ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানা
রাষ্ট্রায়ত্ত খাতঃ
ভারী ও বৃহদায়তন শিল্প কারখানার জাতীয়করণের ক্ষেত্রে উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।
অ- রাষ্ট্রায়ত্ত খাত
যেসব বৃহদায়তন শিল্প জাতীয়করণ হয় সেগুলো নিয়ন্ত্রণ ও পরিকল্পনা সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃংখলার অধীন থাকবে।
ব্যবস্থাপক ও ইকুইটি মূলধনের শ্রমিক অংশীদারিত্ব
যে সমস্ত শিল্প-কারখানা সত্বর জনগণের মালিকানাধীন আনা হবে না সরকার ক্রমবর্ধমানহারে তাদের ‘ইকুইটি’ মূলধন দখল করবে। সরকার যেটুকু ইকুইটি মূলধন আয়ত্ব করবে সংশ্লিষ্ট শিল্পে নিযুক্ত শ্রমিক যৌথভাবে সেই পরিমাণ অংশের মালিকানা লাভ করবে এবং সেই পরিমাণ অংশের মুনাফার ভাগ পাবে। শ্রমিকরা কেবল ইকুইটি মূলধনের নয়, শিল্প কারখানার ব্যবস্থাপনাও অংশগ্রহণ করবে।
মাঝারি আয়তন শিল্প কারখানা
বেসরকারি খাতে মাধ্যম আয়তন শিল্প-কারখানার উন্নতির জন্য সরকার উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় প্রেরণা যোগাবে। অবশ্য এইসব শিল্প-কারখানা পরিকল্পনা ও নিয়ন্ত্রণ সংস্থাগুলো কর্তৃক আরোপিত শৃংখলার অধীন থাকবে।
ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্প
আমাদের অর্থনীতির ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ক্ষুদ্রায়তন ও কুটির শিল্পের উন্নয়নের জন্য সরকার উৎসাহ ও সাহায্য যোগাবে এবং নিয়মিত কাঁচামাল সরবরাহের নিশ্চয়তা বিধান করবে। উদাহরণস্বরূপ তাঁতীরা ন্যায্যমূল্যে প্রচুর পরিমাণে ঋণ ও বাজারের যাবতীয় সুবিধা পাবে। ক্ষুদ্রায়তন শিল্প কারখানা প্রতিষ্ঠার কর্মসূচির ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া হবে। বৃহদায়তন শিল্প কারখানা পরিপূরক হওয়ার মতো করে এইসব ক্ষুদ্রায়তন শিল্প কারখানাকে উন্নত করা হবে। সমবায়ের মাধ্যমে এইসব হযরতের শিল্প কারখানা কে যতদূর সম্ভব উন্নীত করা হবে।
কৃষি সমবায়ের মাধ্যমে চাল-আটার কল, তেল-কারখানা, চিনির কল এবং অনুরূপ কৃষিজ পণ্য শিল্প যতদূর সম্ভব বেশি করে স্থাপন করা ও চালানো হবে।যাতে গ্রামাঞ্চলের দূর দুরান্ত সহ দেশের সর্বত্র ক্ষুদ্রায়তন শিল্প ছড়িয়ে পড়তে পারে সে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। গ্রাম অঞ্চলের সাধারণ মানুষ জাতি শিল্পায়নের সুযোগ-সুবিধায় শরিক হতে পারে এবং শহর গুলোর উপর থেকে মানুষের ভিড় ও চাপ কমে যায় সেটাই এই ব্যবস্থার লক্ষ্য।
কৃষি ও গ্রামের জনগনঃ
আমাদের জনগনের অধিকাংশ গ্রাম অঞ্চলের অধিবাসী। সেজন্য কৃষি ও গ্রামের মানুষের অবস্থা উন্নয়নের ওপর সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দেওয়া না হলে আমাদের জাতীয় অর্থনীতির বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের সমস্ত পরিকল্পনাই অর্থহীন হয়ে পড়বে। একদিকে আমাদের গোটা সমাজের সর্বত্র দারিদ্র ছড়িয়ে পড়েছে অন্যদিকে গ্রাম ও শহরের জীবনযাত্রার মানের মধ্যে গুরুতর বৈষম্য রয়েছে। এর পিছনে ঐতিহাসিক কারণ থাকলেও নিকট অতীতে সরকারের বৈষম্যমূলক নীতির জন্য এই বৈষম্য আরও বেড়ে গেছে। ফলে, গরিব চাষির হাত থেকে সম্পদ ধনী পুঁজিপতিদের হাতে ব্যাপকভাবে পাচার হয়ে গেছে। আওয়ামীলীগ অবিলম্বে গ্রাম অঞ্চলের জনগণকে এইরূপ শোষনের হাত থেকে বাঁচার অঙ্গীকার করছে। আর এটা করতে হলে কৃষিখাতে সুদৃঢ় ও প্রসারে বিপ্লবের প্রয়োজন এবং এ ধরনের বিপ্লব সাধন এর পূর্ব শর্ত হলো ভূমি ব্যবহারের বর্তমান পদ্ধতির পরিবর্তন সাধন এবং বহুমুখী সমবায়ের মতো নয়া প্রতিষ্ঠান স্থাপন।
আমাদের গ্রাম অঞ্চলের জনগণের আরো ত্যাগ স্বীকারের প্রয়োজন রয়েছে। সেই সঙ্গে এটাও স্বীকার করতে হবে যে, অতীতের দূষণের ফলে সৃষ্ট অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদের কৃষিতে নতুন জীবন দিতে হলে সরকারকে প্রভূত পরিমাণ আরো উন্নত বীজ থেকে শুরু করে নলকূপ পাওয়ার পাম্প ও কীটনাশক ঔষধ ইত্যাদি সাহায্য দিতে হবে। আওয়ামী লীগ আমাদের কৃষি ব্যবস্থায় বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনার জন্য প্রয়োজনীয় সমস্ত কিছু ব্যবস্থা গ্রহণের অঙ্গীকার করছে।
জায়গিরদারী, জমিদারি ও সরকারি প্রথা বিলোপ এবং সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণঃ
জমির ব্যবহার পদ্ধতিতে যে সমস্ত পরিবর্তন সাধন করা হবে বলে স্থির করা হয়েছে তা হলোঃ (ক) জমির প্রকৃত চাষীদের সাথে ভূমি ব্যবস্থার পুনর্বিন্যাস। (খ) জমির সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ এবং নির্ধারিত পরিমাণের অতিরিক্ত জমি ভূমিহীন কৃষকদের মধ্যে বিতরণ। স্থানীয় জনসাধারণের অবস্থা ও প্রয়োজনের দিকে লক্ষ্য রেখে জমির এই সর্বোচ্চ পরিমাণ নির্ধারণ করা হবে। (গ) সরকারি খাস জমি ভূমিহীন কৃষকদের কাছে বন্দোবস্ত দেয়া হবে।
রণাঙ্গনেঃ দিকে দিকে মুক্তিবাহিনীর সাফল্য অব্যাহত আরো সহস্রাধিক খানসেনা খতম
চলতি সপ্তাহে ও মুক্তি বাহিনী হানাদার পশ্চিম পাকিস্তানিদের উপর আক্রমন অব্যাহত রেখেছেন। বিভিন্ন রণাঙ্গনে তারা বেঈমান পাকসেনাদের উপর গেরিলা ও সাঁড়াশি আক্রমণ চালিয়ে যাচ্ছেন। এই আক্রমণে গত সপ্তাহে আরো সহস্রাধিক সৈন্য বাংলা বাহিনীর হাতে প্রাণ হারিয়েছে। এর মধ্যে সর্বাধিক সৈন্য প্রাণ হারিয়েছে ফেনী মহকুমায়। পাঁচ দিনব্যাপী সংঘর্ষে তিন শতাধিক খানসেনা স্বাধীনতাকামীদের হাতে নিহত হয়েছে। বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে দখল নিয়ে এই সংঘর্ষের সূত্রপাত হয় এবং ৫ দিনব্যাপী প্রচন্ড যুদ্ধ চলার পর হানাদার বাহিনী বাধ্য হয়ে বেগমগঞ্জ টেকনিক্যাল ইনস্টিটিউশন থেকে পালিয়ে যায়। স্বাধীন বাংলা বেতারের খবরে প্রকাশ, উক্ত ইনস্টিটিউশনের মুক্তিবাহিনী প্রবেশ করলে ৯ জন তরুণীসহ ১৫ টি লাশ দেখতে পায়। বেতারে আরো প্রকাশ যে, সমগ্র এলাকাটির যুদ্ধের স্বাক্ষর স্বরূপ পাক ফৌজের লাশগুলো ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে।
এদিকে গত ৬ই জুন দিনাজপুরের পাক হিলি ও বাজানা এলাকায় দুটি পৃথক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ৬৫ জন খান সেনাকে খতম করেছেন।
উত্তরাঞ্চল সেক্টরের মুক্তিবাহিনী এক বড় রকমের আক্রমণ চালিয়ে ৪০ জন সৈন্য নিহত করেছেন।
ঠাকুরগাঁও’র প্রায় ১৪ মাইল উত্তরে মুক্তিবাহিনী এক অতর্কিত হামলা চালিয়ে বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্য নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছেন। তাঁরা সোনারহাটের কাছে একটি সেতু ডিনামাইট দিয়ে উড়িয়ে দিয়েছেন।
হানাদার বাহিনী ঠাকুরগাঁর ১০ মাইল উত্তরে রুহিয়াতে আক্রমণ চালালে আমাদের স্বাধীনতাকামীরা তা দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করে। এ স্থানে খানসেনাদের পক্ষে প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। মুক্তিবাহিনীর কমান্ডোদের আক্রমণে রংপুরের ভুরুঙ্গামারীতে ১৯ জন পাক ফৌজ নিহত হয়। এ স্থানে ১৯ জন সেনা পাকা সড়ক ধরে জয়মনির হাট এর দিকে অগ্রসর হতে চেষ্টা করছিল। মুক্তিবাহিনী গোপন সূত্রে খবর পেয়ে শত্রুসেনার উপর ঝাঁপিয়ে পড়েন।
গত ৮ই জুন রংপুর রণাঙ্গনের ভুরুঙ্গামারীতে মুক্তিবাহিনীর সঙ্গে প্রচন্ড যুদ্ধে বহু পাক সৈন্য মারা যায়। এখানে তিন দিনের যুদ্ধে আমাদের স্বাধীনতাকামী বাংলা বাহিনী প্রায় ১২৫ জন পাক সৈন্যকে খতম করেছেন।
খুলনা অঞ্চলে মুক্তিবাহিনী নয়টি বাঙ্কার নষ্ট করেছেন এতে আর জন পাকসেনা তাতে নিহত হয়েছেন।
ময়মনসিংহ জেলার শিবপুর গ্রামে পাক সৈন্যের উপস্থিতির খবর পেয়ে মুক্তিবাহিনী হানা দিয়ে ছয় জনকে হত্যা করেছেন। ফাংরেঙ্গা পাড়ার উপর আক্রমণ চালালেও পাক সৈন্যের প্রচুর ক্ষয়ক্ষতি হয়। জয়ন্তীপুরেও পাকসেনাদের চৌকির উপর আকস্মিক আক্রমণ চালিয়ে পাঁচজন খতম করেছেন। এছাড়া ওই দিনে কসবার গঙ্গাসাগরে প্রচন্ড সংঘর্ষে ২৮ জন হানাদার দস্যুসৈন্য নিহত হয়।
খুলনার সাতক্ষীরা এলাকায় মুক্তিবাহিনী ৪৭ জন দালালকে আটক করেছেন। এরা সম্প্রতি অত্র অঞ্চলে এক ত্রাসের রাজ্য সৃষ্টি করেছিল। এদের আটজনকে ইতিমধ্যে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে।
গত ৯ই জুন মুক্তিবাহিনী চট্টগ্রাম, কুমিল্লা, সিলেট ও নোয়াখালীর বিভিন্ন এলাকার ব্যাপকভাবে প্রচন্ড আক্রমণ চালিয়ে আধ ডজন অফিসার সহ ২০০ জন পাক সৈন্যকে খতম করেন।
এছাড়া ওই দিনে ঢাকা ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ স্থানে মুক্তিবাহিনীর গেরিলা আক্রমণ চালিয়ে পাক ফৌজকে সন্ত্রস্ত করে তোলেন। গেরিলারা চট্টগ্রামের বিপণিবিতান, রিয়াজউদ্দিন বাজার, খাতুনগঞ্জ, পোর্ট ট্রাস্ট ও চট্টগ্রাম সড়কে বোমা নিয়ে আক্রমণ চালান। এসব আক্রমণে দুইজন শত্রুসৈন্য খতম হয়।
চট্টগ্রাম জেলার রামগড় ও কারেলাটের মধ্যে লাক্সারি গাড়িতে করে গমনকালে মুক্তিবাহিনীর গোলাবর্ষণে তিনজন পাক সেনা অফিসার এবং সৈন্য বাহিনীর একজন ক্যাপ্টেনের স্ত্রী নিহত হয়। গাড়িটি উলটে যাও এবং তাতে আগুন লাগে।
চট্টগ্রাম জেলার রামগড় ও আঁধারমানিক এলাকায় পৃথক পৃথক আক্রমণ চালিয়ে মুক্তিবাহিনী ৪০ জন সদস্যকে খতম করেছেন। নোয়াখালী জেলার ছাগলনাইয়া ও শুভাপুরের মধ্যে মুক্তিবাহিনীর পোতা মাইনে ছয়জন খান সেনাবাহী গাড়ী নিশ্চিহ্ন হয়। মুক্তিবাহিনীর পোতা মাইনে আরো ১৯ জন সৈন্য খতম হয় কুষ্টিয়ার সালমারি গ্রামে এখানকার মাইন বিস্ফোরণে উক্ত গ্রামের কালভার্ট উড়ে যায় এবং তখন দুই ট্রাক বোঝাই পাক ফৌজ সাবাড় হয়। এস্থলে ভুলবশতঃ পাকফৌজের মধ্যে পরস্পর সংঘর্ষ ঘটলে আরো ৩০ জন সৈন্য মৃত্যুর শিকার হয়। পরের দিন আরেকটি জীপ ঐ সড়ক দিয়ে যাবার সময় মাইন বিস্ফোরণে একজন মেজর সহ ৪ জন সৈন্য খতম হয়।
ইটাখোলা, কৃষ্ণপুরে ও শ্যামপুরে গেরিলারা চোরাগোপ্তা আক্রমণ চালিয়ে ১৯ জন শত্রুসেনাকে খতম করেছেন।
কুমিল্লা শহরে গেরিলা তৎপরতা তীব্রতর হয়ে উঠেছে। গেরিলা দল ন্যাশনাল ব্যাংক, মুসলিম কমার্শিয়াল ব্যাংক, হাবিব ব্যাংক ও পাবলিক হলে বোমা নিয়ে আক্রমণ করেন।
এছাড়া স্বাধীনতাকামীরা কুমিল্লার দক্ষিন দিকে একটি স্থানের রেল ইঞ্জিন উড়িয়ে দিয়েছেন। সালদা নদী এলাকায় মুক্তিবাহিনী পাক হজের আক্রমণ দৃঢ়তার সাথে প্রতিহত করেন। এখানকার সংঘর্ষে ৪৫ জন দখলদার সেনা খতম হয়েছে।
মুক্তিবাহিনীর অন্য একটি আক্রমণে সিলেটের মির্জাপুরে একজন অফিসার সহ প্রায় ১০ জন খতম হয়।
সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে একটি অতি প্রিয় নাম
স্বাধীন সার্বভৌম বাংলার প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দিন সাড়ে সাত কোটি বাঙালির কাছে আজ একটা অতি প্রিয় নাম।
বঙ্গবন্ধুর সুদীর্ঘ ২৭ বছরের একনিষ্ঠ কর্মী তাজউদ্দীন। বিশ্ব ইতিহাস, ভূগোল ও রাজনীতি সম্পর্কে তিনি লেখাপড়া করেছেন প্রচুর। বিশ্ব ইতিহাসের বা বিশ্ব রাজনীতির যে কোনো ঘটনা সাল তারিখ দিয়ে তিনি মুহুর্তের মধ্যে আপনাকে বলে দিতে পারবেন, অথবা বিশ্ব মানচিত্রের যেকোন স্থানের অবস্থিতি তিনি সাথে সাথে বলে দিতে পারবেন। আমেরিকার স্বাধীনতা যুদ্ধ, ফরাসি বিপ্লব, রূশ বিপ্লব, চীনে কমিউনিস্টদের ক্ষমতা দখল, মধ্যপ্রাচ্যে আরব-ইসরায়েল সংঘাত এবং ভিয়েতনাম ও আলজেরিয়ার মুক্তিযুদ্ধের সমস্ত ইতিহাসেই যেন তার নখদর্পণে।
তাই বোধহয় এ সমস্ত ইতিহাসের আলোকেই সেদিন তিনি জোর করেই বলেছিলেন,” আমরা কামিয়াব হবোই।” এ কথা বলার সময় যেন তার চোখে মুখে একটা আত্মপ্রত্যয় দ্যূতি খেলে গেল।
আজ থেকে ৪৬ বছর আগে ঢাকা জেলার কাপাসিয়া থানার দরদরিয়া গ্রামে তার জন্ম। ছাত্র হিসেবে ছিলেন অত্যন্ত মেধাবী ও বুদ্ধিমান। তবে নিয়মিত ছাত্র হিসেবে পরীক্ষা দেওয়া তার ভাগ্যে বড় একটা জোটেনি। তাই বলে তিনি কোনদিন পরীক্ষা খারাপ করেছেন এমন কথা কেউ বলতে পারবেনা। এম, ই, স্কলার্শিপ পরীক্ষায় জেলায় প্রথম স্থান অধিকার করেছিলেন আর মেট্রিক পরীক্ষায় দ্বাদশ স্থান এবং ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষায় চতুর্থ স্থান অধিকার করেন। অর্থনৈতিক শাস্ত্রের অনার্সসহ তিনি বিএ পাস করেন এবং জেলে আটক থাকা অবস্থায় পরীক্ষা দিয়ে আইনের ডিগ্রি লাভ করেন।
প্রাথমিক ছাত্রাবস্থাতেই তার হাতে খড়ি হয়ে রাজনীতিতে নেহায়েত অলক্ষ্যে। সেটা ১৯৩৭ সালের কথা। তখন তিনি সবেমাত্র চতুর্থ শ্রেণীতে উঠেছেন। সে অবস্থায় তিনজন শিক্ষিত রাজবন্দীকে কাপাসিয়া থানার কর্তৃত্বে রাখা হতো। তদনুসারে তিনজন রাজবন্দীকে রাখা হয়েছিল কাপাসিয়ার কর্তৃত্বে। ১৩ বছরের ফুটফুটে ও চটপটে তাজউদ্দিনকে দেখেই তাদের একজন একদিন কাছে ডেকে নিয়ে পটাপট কয়েকটি প্রশ্ন করলেন। তাজউদ্দিনের মত একটা গ্রাম্য ছেলে বিদ্যাবুদ্ধিতে তিনি সত্যিই অবাক হলেন, তারপর তারা তাকে ইতিহাস-ভূগোল, যুদ্ধ, অর্থনীতি, রাজনীতি এবং মনীষীদের জীবনী সম্পর্কীত প্রায় তিন কুড়ি বই পড়ালেন। তার পরে শুরু হলো পরীক্ষা।তাজউদ্দিন সব বিষয়ে পাশ করলেন, তবে রাজনীতিতে পেলেন বেশি নম্বর। তারা তাকে বললেন ভবিষ্যতে রাজনীতি করতে। এই রাজবন্দীদের সংস্পর্শে এসেই তাজউদ্দিনের হাতেখড়ি হয় রাজনীতিতে, কয়েক মাস পর তারা অন্তরীণাস্থার অবসান শেষে কোথায় চলে গেলেন তা তাজউদ্দিন আজও জানেন না। যাবার সময় তাজউদ্দিনের সাথে তাদের শেষ সাক্ষাৎ টুকুও হয়নি। কারণ তাজউদ্দীন তখন ভীনগাঁয়ে ফুটবল খেলতে গিয়েছিলেন। তবে তারাও যাবার সময় তাজউদ্দিনের ঘরে রেখে গিয়েছিলেন এক তোড়া গোলাপ। সেগুলো অনেক আগেই শুকিয়ে গেছে কিন্তু তাজউদ্দিন তার সুবাস এখনো পাচ্ছেন।
তাজউদ্দীন বরাবরই ছাত্র রাজনীতি করতেন। তবে তিনি ছাত্রাবস্থায় রাজনীতির চেয়ে সমাজ সেবাই বেশি করতেন।
মুসলিম রাজনীতির সাথে তিনি প্রত্যক্ষভাবে জড়িত হন ১৯৪৭ সালে আবুল হাশেমের প্রাদেশিক মুসলিম লীগের সাধারণ সম্পাদক হওয়ার পর, এর আগে তিনি মুসলিম লীগকে মনে করতেন ব্রিটিশ পত্রিকা খাজাগজাদের একটি সাম্প্রদায়িক প্রতিষ্ঠানরূপে, এ প্রসঙ্গে তিনি বলেন,” আমি মুসলিম লীগ নেতাদের মধ্যে সর্বপ্রথম ব্রিটিশ বিরোধী কথা শুনতে পাই জনাব আবুল হাশেমের মুখে। তাই তিনি আকৃষ্ট হলেন মুসলিম লীগের প্রতি। তিনি আরও বলেন, প্রথমে নারায়ণগঞ্জ এবং পরে ঢাকার পাকিস্তান ময়দানে প্রকাশ্য জনসভায় আবুল হাশিম মুসলিম লীগকে ঢাকার নবাবদের প্রাসাদ আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে আনার আহ্বান জানালেন। কেবল তখনই আমি মুসলিম লীগ রাজনীতির একটা অর্থ খুঁজে পেয়েছিলাম। তাই জনাব শামসুল হকের নেতৃত্বে মাত্র ১২ জন কর্মী নিয়ে ইসলামপুরের একটা ছোট ঘরের ছাদে চালু করেছিলাম মুসলিম লীগ সংগঠনের ভবিষ্যৎ পরিকল্পনা। আমাদের একমাত্র লক্ষ্য ছিল মুসলিম লীগকে আহসান মঞ্জিল থেকে বের করে এনে সাধারণ মানুষের প্রতিষ্ঠানে পরিণত করা। ১৯৪৪ সালে তিনি বঙ্গীয় মুসলিম কাউন্সিলের সদস্যও নির্বাচিত হয়েছিলেন। তারপর পাকিস্তান হলো মুসলিম লীগ আবার খাজা গজাদের প্রতিষ্ঠানে পরিণত হল। আর তাজউদ্দিন আহমেদ তার সাথে ছিন্ন করলেন সকল প্রকার সম্পর্ক।
মুসলিম লীগের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করলেও তাজউদ্দীন রাজনীতি ও ছাত্র আন্দোলনের সাথে সম্পর্ক ছিন্ন করেছেন এমন ভাবলে মহাভুল করা হবে। বস্তুতঃ দেশবিভাগের সময় থেকে ৪/৫ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আন্দোলন হয়েছে তার প্রতিটির সাথে তাজউদ্দীন ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ১৯৪৮ সালে চৌঠা জানুয়ারি যখন পূর্ব পাকিস্তান ছাত্র লীগ (বর্তমানে বাংলাদেশ ছাত্রলীগ) গঠিত হয় তিনি ছিলেন তার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। তিনি ছিলেন সর্বদলীয় রাষ্ট্রভাষা সংগ্রাম পরিষদের একজন গুরুত্বপূর্ণ সদস্য। আর বাংলাকে রাষ্ট্রভাষা করার প্রশ্নে যে ক’জন নেতা জিন্নাহ সাহেবের সাথে দেখা করতে গিয়েছিলেন তিনি ছিলেন তাঁদের একজন।
শেখ মুজিবরের সাথে তার প্রথম পরিচয় ১৯৪৪ সালের মাঝামাঝি সময়ে কলকাতায়। প্রথম সাক্ষাতেই যেন তাদের মধ্যে একটা ভাবের আদান-প্রদান হয়েছিল। তদবধি তাদের মধ্যে একটা নিবিড় সম্পর্ক সম্পর্ক চলে আসছে।
শেখ সাহেবের নেতৃত্ব সম্পর্কে তাজউদ্দিনের একটা বিরাট আস্থা প্রকাশ হয়ে গেলো সেদিন, কথা প্রসঙ্গে তিনি বললেন, “শেখ সাহেব কে আমি ছাত্রাবস্থা থেকে জানি, চিনি। তাকে আমি কোন দিন কোন ব্যাপারে পরাজয় বরণ করতে দেখিনি। বিশ্বাস করুন, তিনি এবারও জিতবেন।
১৯৪৯ সালের ২০শে জুন ঢাকায় বশিরের রোজ গার্ডেনে আওয়ামী লীগের জন্ম হয়। তাজউদ্দিন ছিলেন তারও একজন উদ্যোক্তা। কিন্তু তিনি সক্রিয়ভাবে আওয়ামী লীগের সাথে জড়িত হলেন না। কারণ তখন তিনি দ্বিতীয় পর্যায়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র। তারপর, পাকিস্তানের রাজনীতিতে অনেক উত্থান পতন ঘটেছে তাজউদ্দীন তার সাথে ছিলেন ওতপ্রোতভাবে জড়িত। লিয়াকত আলীর মূলনীতি কমিটির রিপোর্টের বিরুদ্ধে ১৯৫০ সালের ৫ ই নভেম্বর ঢাকায় যে গ্র্যান্ড ন্যাশনাল কনভেনশন বা জাতীয় মহাসম্মেলন হয় তাজউদ্দিন ছিলেন তার অন্যতম প্রধান উদ্যোক্তা। ১৯৫৩-৫৭ সাল পর্যন্ত তিনি ছিলেন ঢাকা জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক।(অস্পষ্ট) সালে সালে প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সমাজসেবা ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক নির্বাচিত হন এবং শেখ মুজিবের অবর্তমানে কিছুদিন সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। ১৯৬৪ সাড়ে তিন প্রাদেশিক আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক ও ১৯৬৬ সালে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন। সে থেকে পরপর আরো দু’বার নির্বাচিত হয়ে আজ পর্যন্ত তিনি উক্ত পদে বহাল আছেন।
১৯৬৬ সালের ৬ই ফেব্রুয়ারী লাহোরে যে সর্ব দলীয় নেত্রী সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয় শেখ সাহেবের সাথে তিনিও তাদের যোগদান করেন। ওই সম্মেলনেই শেখ সাহেব পেশ করেছিলেন তাঁর ঐতিহাসিক ছয় দফা কর্মসূচি। সম্মেলনের বিষয় নির্বাচনী কমিটিতেও তাজউদ্দীন ছিলেন শেখ সাহেবের সাথে অন্যতম সদস্য। ১৯৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনের জন্য গঠিত আওয়ামী লীগ পার্লামেন্টারি বোর্ডের সেক্রেটারি নির্বাচিত হন। এছাড়া ১৯৫৪ সালের তদানীন্তন বাংলার নির্বাচনে পরিষদ সদস্য নির্বাচিত হন। তখন তিনি আইন ও এম এ ক্লাসের ছাত্র ছিলেন। তিনি পৃথিবীর বেশ কয়েকটি দেশ পরিভ্রমণ করেছেন।
বুমেরাং!
পরের ধনে পোদ্দারি আর ঋণ করে ঘি খাওয়ার বদভ্যাস আছে একশ্রেণীর মানুষের ছিল। হাল আমলে আমাদের সাথে পাকিস্তানের পশ্চিমবঙ্গের ভাইয়াদের এই বদ অভ্যাসটা গড়ে উঠেছিল। বাংলাদেশের ট্যাক্সের টাকায় বিরাট সেনাবাহিনী পোষা যার তার সাথে যুদ্ধংদেহী মনোভাব প্রদর্শন রীতিমতো তাদের একটা বদ অভ্যাসটা হয়ে গিয়েছিল। বোধ হয় সে বদ অভ্যাসের বশবর্তী হয়েই তারা বাংলাদেশের মানুষের বিরুদ্ধে অঘোষিত যুদ্ধ শুরু করে দিয়েছে। কিন্তু এই যুদ্ধ যে বুমেরাং হয়ে তাদের সর্বনাশের কারণ হয়ে দাঁড়াবে তা তারা আগেই বুঝতে পারে নাই। বস্তুতঃ পশ্চিম পাকিস্তানের যে পুঁজিবাদী শ্রেণীর বাংলাদেশের বিরুদ্ধে জঙ্গিচক্রের যুদ্ধ ঘোষণায় উৎফুল্ল হয়ে বগল বাজাতে শুরু করেছিল তাদেরকেই আজ আর্তচিৎকার করতে শোনা যাচ্ছে।
প্রকাশ, বাংলাদেশ থেকে খাজনা ট্যাক্স আদায় করতে না পারায় অথবা বাংলাদেশের পাট বন্ধক রেখে বিদেশী ঋণ আনার সুযোগ না থাকায় ইয়াহিয়া খানের সরকার আজ আর্থিক সংকটে পতিত হয়েছে। তাই উপায়ান্তর না দেখে তারা পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্পপতিদের উপর ‘যুদ্ধের চাঁদা ধরেছে চাঁদার সর্বনিম্ন পরিমাণ ১০ কোটি টাকা। পশ্চিম পাকিস্তানের শিল্প পতিদের কেউ কেউ বিশেষ করে করাচি শিল্পপতি গণ এটাকে পাইকারি জরিমানা হিসেবে অভিহিত করে সরকারের কাছে আপত্তি জানিয়েছেন। জবাবে তাদের স্পষ্ট করে বলে দেওয়া হয়েছে যে পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিপতিদের স্বার্থেই ইয়াহিয়া চক্রকে বাংলাদেশের যুদ্ধ চালাতে হচ্ছে। সুতরাং, ইচ্ছায় হোক আর অনিচ্ছায় হোক তাদেরকে নির্দিষ্ট অঙ্কের টাকা দিতেই হবে। করাচির এইচ, এম, সিল্ক মিলের চাঁদা ধরা হয়েছে ২৫ লাখ টাকা। অথচ তাদের মোট সম্পত্তির পরিমাণইয়নাকি দ্বিগুণের বেশি হবে না। তাই তারা তাদের চাঁদার অঙ্কটা হ্রাস‌ করার কথা উত্থাপন করে কিন্তু তার সামরিক কর্তৃপক্ষ সরাসরি প্রত্যাখ্যান করে।
বাংলার মানুষ আর কোন গোজামিলের সমাধান গ্রহণ করবেনা – সৈয়দ নজরুল ইসলাম
গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম গত ৬ই জুন সংগ্রামী বাঙালি জাতির উদ্দেশ্যে প্রদত্ত এক বেতার ভাষণে বলেন, গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের রাষ্ট্রপ্রধান বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও আটক সকল গণপ্রতিনিধিদের অবিলম্বে মুক্তি দান, বাংলাদেশের মাটি থেকে হানাদার বাহিনী ফিরিয়ে নেয়া, স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দান এবং পশ্চিম পাকিস্তানের শাসক শ্রেণী কর্তৃক এযাবত বাংলাদেশ থেকে অপহৃত ধন-সম্পদ ও গত আড়াই মাসের লড়াইয়ে হানাদার বাহিনী বাংলাদেশের যে ক্ষতি সাধন করেছে একটি আন্তর্জাতিক সংস্থার মাধ্যমে তা নির্ণয় করুন প্রত্যাবর্তন ও ক্ষতিপূরণের রাজনৈতিক সমাধান আসতে পারে অন্য রাজনৈতিক সমাধানের কোনো প্রশ্নের উঠতে পারে না।
তিনি বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায় রাজনৈতিক সমাধান বা আপস-মীমাংসা সম্পর্কে যে জল্পনা-কল্পনা চলছে সে সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেন, বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষ কোন গোঁজামিলের সমাধান গ্রহণ করবে না।
আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপ্রধান বলিষ্ঠ কণ্ঠে ঘোষণা করেন, বাংলাদেশের মাটিতে আর কোনোদিন সাম্প্রদায়িকতা মাথা চাড়া দিয়ে উঠতে পারবে না। এদেশের স্বাধীনতার সংগ্রামে সকল বাঙালি -হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খ্রিস্টান একসাথে লড়েছেন, বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে বাংলার মাটি সিক্ত করে তারা এটাই প্রমাণ করেছেন এদেশের প্রতিটি প্রাণ ঐক্যবদ্ধ, অভিন্ন।
স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে প্রচারিত ভাষণে তিনি বলেন, স্বাধীনতার সংগ্রামের হিন্দু কৃষক জীবন দিয়েছেন, দিয়েছেন মুসলমান কৃষক। মসজিদ পুড়েছে হানাদার দস্যূদের হাতে, পুড়েছে মন্দির, গির্জা আর বৌদ্ধবিহার বিধ্বস্ত হয়েছে। বর্বর পাক সেনারা হত্যা করেছে ডাক্তার গোবিন্দ দেব, অধ্যাপক মনিরুজ্জামান, জ্যোতির্ময় গুহ ঠাকুরতা ও ফজলুর রহমানকে। আমরা একসঙ্গে লড়েছি একই সাথে জয়ী হব। এবং আমরা হবই।
সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন, হানাদার দস্যু ইয়াহিয়ার বর্বর সৈনিকদের নির্মম অত্যাচারে কৃষক-মজুর ছাত্র-শিক্ষক ছেড়ে ভারতে চলে যেতে বাধ্য হয়েছেন। তাদের তিনি আশ্বাস দিয়ে বলেন শত্রু হননের পর মুক্ত স্বদেশে ফিরে আমরা আবারো তাদের আপন ভিটেমাটিতে প্রতিষ্ঠা করবই।
এ প্রসঙ্গে আমাদের অস্থায়ী রাষ্ট্রপতি দেশত্যাগ করে যেসব বাঙালি ভাই প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারত আর বার্মায় আশ্রয় নিয়েছেন, তাদের সাহায্য করায় ভারত সরকার ও বর্মা সরকারের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করেন।
মুক্তিযোদ্ধাদের বীরত্বের প্রশংসা করে সৈয়দ নজরুল ইসলাম বলেন বাংলাদেশ সরকারের সীমিত সময়ের জন্য আপনাদের প্রয়োজন সর্বক্ষেত্রে পূরণ করা সম্ভব হচ্ছে না। বিভিন্ন রণাঙ্গনে আপনারা যে অসীম অটল মনোবলের পরিচয় দিচ্ছেন তার জন্য আজ সারা বাঙ্গালী জাতি গর্বিত। দেশমাতৃকার বীর সন্তান আপনারা। এই সংগ্রামে আপনাদের যেসব সাথেই শহীদ হয়েছেন যারা পঙ্গু হয়েছেন তাদের পরিবারবর্গের রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব আমার সরকার ইতিপূর্বেই গ্রহণ করেছেন।
তিনি বলেন, মুক্তিবাহিনীর সৈনিকেরা আমাদের আন্তরিক অভিনন্দন গ্রহণ করুন।
সীমান্ত প্রদেশের “ভারতীয় এজেন্ট” ঢুকেছে!
বুঝহে সুজন, যে জান সন্ধান……
পরের জন্য গর্ত করলে নিজেরা সেই গর্তে পড়তে হয়। আর যেসব নিয়ে খেলা করে তাকে সাপের হাতে প্রাণ দিতে হয়। নিয়তির এই বিধান লংঘনের ক্ষমতা কারো নেই।
‘ইসলাম ও মুসলমানের’ নামে পাকিস্তান অর্জনের পর থেকেই পশ্চিম পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠী বাঙ্গালীদের বিরুদ্ধে বিশেষ বিশেষ ধরনের অস্ত্র প্রয়োগ করতে শুরু করলো। বাঙালির উপর নিজেদের শোষণ-বঞ্চনা অব্যাহত রাখার জন্য তারা কথায় কথায় ‘বিচ্ছিন্নতাবাদ’ ‘ভারতীয় দালাল’ প্রভৃতি শব্দের অপপ্রয়োগ করতে লাগলো। মনস্তাত্ত্বিকদের মতে কোন ভুল শব্দ দ্বিতীয়বার উচ্চারণ করতে নাই। কিন্তু স্বার্থান্ধদের কাছে এসবের কোন মূল্য আছে? নাই বলেই তাদের হাতে পাকিস্তানের পঞ্চম প্রাপ্তি ঘটেছে। তারপর, পশ্চিম পাকিস্তানিরূপী যে এলাকাটা ছিলো তাও আজ খণ্ড-বিখণ্ড হতে চলেছে।
বিভিন্ন সূত্রে প্রাপ্ত সংবাদে প্রকাশ খোদ পশ্চিম পাকিস্তানেই বর্তমানে বিচ্ছিন্নতাবাদ শুরু হয়ে গেছে এবং সেখানে “ভারতীয় দালালদের” অনুপ্রবেশ ঘটেছে। প্রশ্ন জাগতে পারে বাংলাদেশের সাথে আঠারশ’ মাইলব্যাপী সাধারণ সীমান্ত থাকায় সেখানে না হয় ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা ঢুকে পড়তে পারে। কিন্তু উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তারা ঢুকলো কিভাবে? তবে কি বুঝতে হবে বাংলাদেশে যেমন মরণজয়ী বাঙালি মুক্তিযোদ্ধাদের দুষ্কৃতিকারী ও ভারতীয় অনুপ্রবেশকারীরা বলে চিত্রিত করার চেষ্টা চলছে। তেমনি সীমান্ত প্রদেশের ক্ষেত্রেও পাঠান মুক্তিযোদ্ধাদের আজ ভারতীয় দালাল বলে চালানোর চেষ্টা হচ্ছে?
কথাটা বলেছেন দন্ত-নখরহীন তথাকথিত সীমান্ত শার্দুল খানে আজম খান আব্দুল কাইয়ুম খান। তিনি এলান দিয়েছেন উত্তর-পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের বিচ্ছিন্নতাবাদী কাজ কারবার শুরু হয়ে গেছে এবং সেখানে হাজার হাজার ভারতীয় এজেন্ট ঢুকে পড়েছে। শুধু তাই নয় তারা সেখানে জনগণের মধ্যে লাখ লাখ রাইফেল মেশিনগান বিলি করে ফেলেছে। পশ্চিম পাকিস্তানী পুঁজিবাদ, সাম্রাজ্যবাদ ও সমরবাদ এর দালাল বাঙালির জানের দুশমন কাইয়ুম খানের বক্তব্য সম্পর্কে আমরা কোনো মন্তব্য করতে চাই না। তবে পাঠকসমাজের অবগতির জন্য আমরা শুধু এটুকু বলবঃ বুঝহে সুজন যে জান সন্ধান।
বাংলাদেশের মানুষের আশা-আকাঙ্ক্ষা পদদলিত করতে গিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের স্বার্থন্ধেরা যে নিজেদের কবর রচনা করেছে তা তারা জানত না। তারা জানত না যে এই বর্বরতার ফলশ্রুতি হিসেবে তারা নিজেদের সাধের কাশ্মীর হারাতে বসেছে। তারা জানতো না যে পাকিস্তানকে ধ্বংস করে তারা দ্বিজাতিতত্ত্বের কবর রচনা করেছে। তারা আরো জানতো যে তথাকথিত পাকিস্তান সম্পর্কে তারা কাশ্মীরের জনগণের মোহ মুক্তি ঘটাতে যাচ্ছে। তাই আজ তথাকথিত আজাদ-কাশ্মীর সরকারের প্রেসিডেন্ট সরদার আব্দুল কাইয়ুম কে বাঁচাও বাঁচাও চিৎকরতে শোনা যাচ্ছে। পশ্চিম পাকিস্তানের সংবাদপত্রসমূহ খবরে প্রকাশ সরদার কাইয়ুম নাকি কাশ্মীরের ‘আল ফাতাহ’ সংস্থাটি নিষিদ্ধ করার এবং তাদেরকে সমূলে উৎখাত করার জন্য পাকিস্তান সরকারের সাথে শলাপরামর্শ করছেন। প্রকাশ, ভারতের কবল থেকে অধিকৃত এলাকার দখলের উদ্দেশ্যে গঠিত হলেও তারা নাকি এখন আজাদ কাশ্মীর এলাকা থেকেই পাকিস্তানি কর্তৃত্ব উৎখাতের কাজে নিয়োজিত হয়েছে। তথাকথিত পাকিস্তান সম্পর্কে নাকি তাদের মোহমুক্তি ঘটে গেছে। তারা আজ বুঝতে পেরেছে তথাকথিত পাকিস্তানের ফাঁদে পা দিলে একদিন তাদের নিশ্চিহ্ন হয়ে যেতে হবে। আল ফাতাহ্, সম্পর্কে তথাকথিত পাকিস্তান আজাদ কাশ্মীর সরকার এত ভীত সন্ত্রস্ত উৎকন্ঠিত হয়ে উঠেছে যে -সেখানে ইতিমধ্যেই হাজার হাজার ‘আলফাতাহ্’ কর্মীকে গ্রেপ্তার করে জেলে পুরা হয়েছে।
অন্যদিকে, ভুট্টো ও ইয়াহিয়া গ্রুপের মধ্যে ক্ষমতার আকার ধারণ করেছে। বাংলাদেশ সমস্যার তথাকথিত রাজনৈতিক সমাধানের নামে পশ্চিম পাকিস্তানের সামরিক চক্র বাংলাদেশে একটা ‘টাউট সরকার’ খাড়া করার প্রচেষ্টা এখনো ত্যাগ করেনি কিন্তু পথটা আদৌ কুসুমাস্তীর্ণ নয়। বাংলাদেশের মানুষের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে দালাল দিয়ে কাজ সারার চেষ্টার মধ্যে যে ঘোরতর বিপদ নিহিত রয়েছে ইয়াহিয়া খান সাহেব ভালো করেই জানেন। বাঙালির স্বার্থের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করলে মরণজয়ী বাঙালি তরুণরা যে দালালদের হালাল করে দেবে তা তারা ভালভাবেই জানে। সেজন্যই বোধ হয় দালালে আজম খান আব্দুল কাইয়ুম খান জাতীয় পরিষদের পথ পরিহার পূর্বক ভিন্ন পথ ধরার জন্য তার মনিব ইয়াহিয়া খানকে পরামর্শ দিয়েছেন। তিনি পরবর্তী দিয়েছেন প্রেসিডেন্টের উচিত নিজ হাতে একটা শাসনতন্ত্র রচনা করে তা গণভোটে দেওয়া। খানে আজম সাহেবকে বহু আগেই বাহাত্তুরে পেয়েছে। তাই তিনি শুধু দিবাস্বপ্নই নয়, জেগে থেকেও যে স্বপ্ন দেখবেন -তাতে আর বিচিত্র কি! জনাব খান সাহেবের প্রতি আমাদের বক্তব্যঃ জনাব আপনারা গণভোট বা গুলির ভোট যা কিছু করতে চান আপনাদের বাপ-দাদার মুল্লুকেই করুন। আপনাদের এ দিল্লিকা লাড্ডু আমরা বহুৎ খেয়েছি; আর সাধও নেই, মোহও নেই। নিজেদের মাত্রভূমি থেকে তথাকথিত ভারতীয় এজেন্টদের দূর করে আপনাদের দেশে ইসলাম ও সংঘতি রক্ষা করতে পারেন কিনা চেষ্টা করে দেখুন। দয়া করে বাংলাদেশের দিকে পা বাড়াবেন না; কারণ ২৫শে মার্চের ভয়াল রাতের পর থেকে আপনাদের সাথে বাংলাদেশের আর কোন সম্পর্ক নাই।

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!