You dont have javascript enabled! Please enable it!

সেনেটর কেনেডীর হুঁশিয়ারী

মার্কিন ভাবমূর্তির মুখে চুণকালি মাখিয়েছেন প্রেসিডেন্ট নিকসন। বাংলাদেশে গণহত্যা চালিয়েছেন ইয়াহিয়া খান। তার হাতে অস্ত্র তুলছেন না তিনি কানে। পাক-সৈন্যের অত্যাচারে ঘর-বাড়ী ছেড়েছেন লক্ষ লক্ষ মানুষ। তারা আশ্রয় নিচ্ছেন ভারতে। মার্কিন প্রশাসকরা নির্বিকার। মানবতার অপমানে এবং গণতন্ত্রের অপমৃত্যুতে তাদের মনে জাগছে না কোন বেদনা। ওরা এ-সব দানবীয় অপকীর্তির মদতদার। এই রাষ্ট্রেরই নাগরিক সেনেটর এডােয়ার্ড কেনেডী-তারুণ্যের জ্বলন্ত উল্কা। হাতে নেই শাসক ক্ষমতা, কিন্তু অবিবেচক প্রশাসনের উপর নির্মম কষাঘাতে উদ্ধাম। তিনি এসেছিলেন ভারতে। ঘুরেছেন শরণার্থী শিবিরগুলাে। শুনছেন দুর্গতদের মর্মান্তিক কাহিনী। বাংলাদেশের পাক দখলীকৃত অঞ্চল সফরের অনুমতি মেলে নি তার। পথরােধ করে দাঁড়িয়েছিলেন ইয়াহিয়া খান। যদি যেতে পারতেন তবে দেখতে পেতেন পূর্ব বাংলার বুকে অসংখ্য ক্ষতচিহ্ন। স্বদেশে ফিরেই বাংলাদেশে মার্কিন নীতির সমালােচনায় মুখর হয়ে উঠেছেন তিনি। তাঁর দাবী—বন্ধ করতে হবে পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র এবং অর্থ সাহায্য। এগুলাে সাহায্য নয়, নিরস্ত্র মানুষের রক্তক্ষরণে ঘাতকের হাতিয়ার। যদি অবিলম্বে বন্ধ না হয় এই অনাচার তবে পাকিস্তান এবং পূর্ব ভারতে দেখা দেবে নিদারুণ দুর্যোগ।
সেনেটর কেনেডীর এই হুঁশিয়ারী হয়ত গ্রাহ্য করবেন না প্রেসিডেন্ট নিকসন। আশ্রিত এবং মরণদশার শেষ প্রান্তে আগত ইসলামাবাদকে ছাড়বেন না তিনি। মূমুর্ষ রােগীর দেহে রক্ত সঞ্চারের প্রাণান্ত প্রয়াস হয়ত চলবে আগের মতই। তাতে হবে না ঐতিহাসিক ঘটনা স্রোতের গতিধারার পরিবর্তন। মুক্তি বাহিনীর আঘাতের ক্ষমতা বাড়ছে দিন দিন। সম্প্রসারিত হচ্ছে মুক্ত অঞ্চল। বর্ষার পুরা সুযােগ নিচ্ছেন গেরিলারা। তাদের সঙ্গে তাল রেখে চলেছেন বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাের বাঙালী কর্মীরা। ছিড়ে ফেলছেন তারা ইসলামাবাদের সঙ্গে সব বন্ধন। নিচ্ছেন স্বাধীন বাংলাদেশের আনুগত্যে। দুশমনের হাতে মার্কিন অস্ত্র এবং অর্থ রােধ করতে পারবে না প্রগতির পদক্ষেপ। চারদিক থেকে উঠছে আমেরিকার বিরুদ্ধে প্রচণ্ড ধিক্কার। মুক্ত দুনিয়ার দাবীদার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র আজ বাংলাদেশের পায়ে শৃঙ্খল পরাতে ব্যস্ত। তার দোসর পাকিস্ত ানের স্বৈরাচারী শাসক চক্র। লজ্জায় মাথা হেট করেছেন সেনেটর কেনেডী। প্রেসিডেন্ট নিকসনের পাপের বােঝা বইতে হচ্ছে গােটা মার্কিন জাতির। অকৃতজ্ঞ নয় ভারতের এবং বাংলাদেশের জনতা। ভাল মন্দের ব্যবধান তারা জানেন। যে মুখে উঠেছে প্রেসিডেন্ট নিকসনের প্রতি ধিক্কার, সে-মুখ থেকেই বেরিয়ে এসেছে “কেনেডী কি জয়” ধ্বনি। প্রেসিডেন্ট নিকসন মাখাচ্ছেন আমেরিকার মুখে চুণ-কালি, আর সেনেটর কেনেডী মুছে ফেলছেন জাতীয় অপযশের কালিমা চিহ্ন। একজনের হাতে রাষ্ট্রীয় ক্ষমতা, অপরের সম্বল নৈতিক হাতিয়ার। এ দুয়ের লড়াই বর্তমান যুগের অসামান্য ঘটনা।
যখন কেনেডী ছিলেন ভারত সফরে তখন শরণার্থীর সংখ্যা ছিল প্রায় পঁচাত্তর লক্ষ। এখন দাঁড়িয়েছে আশী লক্ষে। কোটি কোটি টাকা খরচ হচ্ছে এদের ভরণপােষণে। বৈদেশিক সাহয্যের পরিমাণ নগণ্য। মার্কিন সেনেটর শরণার্থী সাব-কমিটির সভাপতি এডােয়ার্ড কেনেডী। তিনি চান বাংলাদেশের শরণার্থী ত্রাণে অধিকতর মার্কিন অর্থের বরাদ্দ। তাঁর চেষ্টা যদি সফল হয় তবে কিছুটা লাঘব হবে ভারতের আথিক বােঝা। মার্কিন সরকার ইসলামাবাদের শরণার্থী সৃষ্টির যন্ত্রে জোগাবেন তৈল, আর শরণার্থীদের ক্ষতে লাগাবেন যন্ত্রণানাশক প্রলেপ। এই সৃষ্টি ছাড়া দ্বৈত চিকিৎসায় সারবে না আসল রােগ। রােগের জীবাণুবাহক পাক-জঙ্গীবাদ। এটা এশিয়ার শান্তি বিঘ্নকর। কেনেডীর মৌল দাবীর ভিত্তি সুদৃঢ়। সব রকমের মার্কিন সাহায্য থেকে বঞ্চিত করতে হবে পাকিস্তানকে। তাহলে দুনিয়া বুঝবাে ইয়াহিয়ার স্বৈরাচারে বীতশ্রদ্ধ আমেরিকা। হয়ত মাঠে মারা যাবে তার উপদেশ। মুক্তির জন্য বাঙালীকে ঢালতে হবে আরও রক্ত। বর্ষা শেষে হয়ত আসবে পাক-বাহিনীর সর্বাত্মক আক্রমণ। আকাশ থেকে মুক্তি বাহিনীর উপর পড়বে বােমা। ক্ষেপণাস্ত্র কুকুরের মত প্রামাঞ্চলে ঝাপিয়ে পড়বে ধর্মান্ধের দল। দলে দলে শরণার্থী আসবেন ভারতে। রক্ত হােলীর তাণ্ডব আয়ত্তে রাখার জন্যই দরকার পাকিস্তানে মার্কিন অস্ত্র সরবরাহের অবসান। তা না হলে সম্বিত ফিরবে না ইয়াহিয়া খানের। প্রেসিডেন্ট নিকসন যা ভাল বুঝেন তাই করবেন। তাঁর মুখের দিকে চেয়ে বসে থাকবেন না বাংলাদেশ সরকার এবং মুক্তি বাহিনী। তাঁদের জয় নিশ্চিত এবং স্বাধীন বাংলাদেশ অনিবার্য। হিসাব নিকাশ শুধু আগামী দিনের সম্ভাব্য রক্তক্ষরণের পরিমাপের। আমেরিকা যদি হাত গুটায় তবে তার পরিমাণ কমবে, আর যদি না গুটায় তবে বাড়বে। সেনেটর কেনেডী এই দিনগুলাের জন্যই উদ্বিগ্ন। প্রেসিডেন্ট নিকসনের প্রতি তাই তার হুশিয়ারী।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৮ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!