You dont have javascript enabled! Please enable it!

জঙ্গীশাহীর বেতালা পদক্ষেপ

ফ্যাসাদে পড়েছেন ইয়াহিয়া খান। আওয়ামী লীগকে তিনি করেছেন বেআইনী। জাতীয় পরিষদ এবং প্রাদেশিক আইন সভায় তাদের অনেকগুলাে আসন হয়ে গেছে খারিজ। বড়াই করে বলেছিলেন ইসলামাদের ডকটেটর—আগামী নভেম্বর মাসের মধ্যে তিনি করবেন পূর্ব পাকিস্তানে উপ-নির্বাচন। এখন দেখছেন কাজটা সােজা নয়। পূর্ব পাকিস্তান আর নেই। সেখানে জন্ম নিয়েছে বাংলাদেশ। উপনির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না বাঙালী দালাল। মনে মনে যারা পাকিস্তানি তাদেরও ভয় মুক্তিবাহিনীর হাতে পড়লে এক সঙ্গে থাকবে না ধড়-গর্দান। তাদের মারের চোটে জঙ্গীরাই বেসামাল, অজঙ্গীরা কোন ছাড়। অবস্থাটা মােটেই সুবিধার নয়। উপনির্বাচনটা স্থগিত রাখার কথা নাকি ভাবছেন এখন ইয়াহিয়া খান। তাতেও মুস্কিল আসানের সম্ভবনা কম। বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাে থেকে একে-একে বিদায় নিচ্ছেন বাঙালী কূটনৈতিক কর্মীরা। তারা করছেন আনুগত্যের পরিবর্তন। ওরা এখন স্বাধীন বাংলাদেশের বিশ্বস্ত কর্মী। বাইরে ঘটছে ইসলামাবাদের মর্যাদাহানি। সবাই বুঝে ফেলছেন—স্বাভাবিক নয় পূর্ববাংলার অবস্থা। যদি তা হত তবে পাইকারীহারে পাকিস্তানের আনুগত্য ছাড়তেন না বাঙালী কূটনৈতিকবিদরা।
বিদেশীদের ধােকা দেওয়া দরকার। তা না হলে মান থাকে না। তাই নতুন প্যাচ কষার মতলব আঁটছেন জঙ্গী-শাসকেরা। লেঃ জেনারেল টিক্কা খান এখন বাংলাদেশের পাক-অধিকৃত অঞ্চলের দণ্ডমুণ্ডের কর্তা। তার সন্ত্রাসের রাজ্য ছেড়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন আশী লক্ষ শরণার্থী। প্রতিদিন বাড়ছে তাদের সংখ্যা। বিদেশী সাংবাদিকরা মাঝে মাঝে সফর করছেন পূর্ববাংলা। ওদের চোখে ধরা পড়ছে সত্যিকারের ছবি। গেরিলাদের তৎপরতা যত বাড়ছে পাক-সৈন্যরাও তত বেপরােয়া হয়ে উঠছে। হাতের কাছে পাচ্ছে তারা নিরস্ত্র গ্রমাবাসীদের। তাদের উপরই চলছে অকথ্য নির্যাতন। বিদেশী সাংবাদিকরা বিশ্বের সামনে তুলে ধরছেন এই ভয়াবহ চিত্র। মিথ্যাবাদী প্রতিপন্ন হচ্ছেন ইয়াহিয়া খান। তিনি বলছেন—পূর্ব পাকিস্তানের অবস্থা স্বাভাবিক। জঙ্গী নেতাদের চিন্তার ঢং আলাদা। ওরা নাকি একজন অসামরিক গভর্নর নিযুক্ত করতে চান পূর্ব-বাংলায়। ডাঃ মালিকের নাম উড়ছে বাতাসে। বিদায় নেবেন টিক্কা খান। তার শূন্য আসনে বসবেন ডাঃ মালিক। জঙ্গী শাসকেরা হয়ত ভাবছেন—এটা একটা চমৎকার চাল। দুনিয়া জানবে—অবস্থা স্বাভাবিক। প্রশাসনের অসামরিক প্রধান তার প্রমাণ। বাঙালীরাও খুশী হবেন—এতদিন পরে মাথার ওপর পেয়েছেন তারা একজন বাঙালীকে। খেয়াব দেখছেন ইয়াহিয়া খান। বাঙালীরা তীর মত নীরেট নন। দেশপ্রমিক এবং দালালের তফাৎ বােঝার ক্ষমতা আছে তাদের। ডাঃ মালিক যদি সত্যিই হন গভর্নর তবে তার ক্ষমতা কতটুকু? মিলিটারীর বেয়ােনেটের উপর বসে থাকবেন তিনি। একটু নড়চড় হলেই লাগবে খোঁচা। বেশী খেল দেখাতে গেলে একেবারে প্রপাত ধরণী তলে। দুনিয়াটাও বেকুব নয়; তারাও পেতেছেন মুক্তিবাহিনী। এ ফাঁদ থেকে উদ্ধারের একমাত্র পথ বাংলাদেশ থেকে পাততাড়ি গুটানাে।
গুণের অন্ত নই ইয়াহিয়া খানের। বহুরুপী সাজার বড় সখ তার। অপটু হাতের রুপসজ্জা ধরা পড়ে পদে পদে। কোন রুপসজ্জাতেই ঢাকা থাকে না তার নিজস্ব স্বরুপ। বেরিয়ে আসে রক্তস্নাত দস্যুর ভয়াবহ মূর্তি। বাংলাদেশে তিনি বসাতে চান সাক্ষীগােপাল অসামরিক প্রধান এবং বিদেশে পাক-দূতাবাসগুলাের ভার দিতে চান তিনি জঙ্গী নেতাদের। ভারত-বিরােধী প্রচার অভিযানে পেশাদার কূটনীতিবিদরা যেখানে ব্যর্থ সেখানে সফল হবেন তার জঙ্গী-সহচররা। এই আশা নিয়েই তাসের ঘর বানাবার মতলব আঁটছেন ইয়াহিয়া খান। আর তলে তলে করছেন অস্ত্র সংগ্রহ। বর্ষার পর হয়ত কঠিন আঘাত হানবেন তিনি মুক্তিবাহিনীর উপর। ইরান এবং অপর ক’টি মুসলিম রাষ্ট্র তার শয়তানির দোসর। তারাই করছে পাকিস্ত গনের জন্য অস্ত্র জোগার। বাংলাদেশে অসামরিক গভর্নর নিয়ােগের জল্পনা-কল্পনা এবং মুজিবের বিচারে আসামী পক্ষ সমর্থনের জন্য ব্রোহীকে অনুরােধ কুৎসিত ষড়যন্ত্র ঢাকার প্রাণান্তকর প্রয়াস। তলে তলে চলছে সামরিক আয়ােজন। বর্ষার শেষে আর একটা আঘাত আসবে মুক্তিবাহিনীর উপর। ভারত সীমান্তে ঘটবে ইতস্ততঃ সংঘর্ষের বিস্তৃতি। নদীর বন্যার পর দেখা দেবে শরণার্থীর বন্যা। বাংলাদেশ সমস্যা আসলে পাক-ভারত সমস্যা—একথা প্রমাণের জন্য চলবে নতুন উদ্যম। একেবারে নিভে যাবার আগে আর একবার জ্বলে উঠবে পাকিস্তান। তাই ইয়াহিয়ার মধ্যে এত অস্থিরতা এবং তার বেতালা পদক্ষেপ।

সূত্র: দৈনিক যুগান্তর, ২৫ আগস্ট ১৯৭১

error: Alert: Due to Copyright Issues the Content is protected !!